চণ্ডীদাসের একটি কবিতা, যাহা সচরাচর চণ্ডীদাসের পদাবলীতে মুখবন্ধস্বরূপ প্রথমে স্থান পাইয়া থাকে, এখানে সেইটির উল্লেখ করিব। কেহ কেহ এই পদটির মধ্যে শ্লীলতার অভাব দেখিয়াছেন। এমন লোকও আছেন, যাঁহাদের কাছে কালীঘাটের কর্দ্দমাক্ত গঙ্গাজলও পবিত্রতার খনি। আমি বৈষ্ণব-কবিতাগুলি যে ভাবে পড়িয়াছি, যে চক্ষে দেখিয়াছি, তদ্ভাবে ভাবিত লোক ছাড়া আমি সে চক্ষু অপরকে দিব কি করিয়া? যাঁহারা আমার ভাবে এই পদগুলি বুঝিবেন না, তাঁহাদিগকে বুঝাইবার সাধ্য আমার নাই। তাঁহাদের নিকট আমার এই অনুরোধ, তাঁহারা যেন শেলী পড়েন, কীট্স্ পড়েন, বৈষ্ণব পদ পড়িয়া তাঁহাদের কোন লাভই হইবে না, অথচ হয় ত এমন কথা বলিয়া ফেলিবেন, যাহাতে অহেতুকভাবে অপরের প্রাণে ব্যথা লাগিতে পারে।
আমি “সই কেবা শুনাইল শ্যাম নাম” গানটির কথাই বলিতেছিলাম।
পার্থিব প্রেম ও ইন্দ্রিয়াতীত প্রেম–এই দুইয়ের মধ্যে একটা তফাৎ থাকিলেও, সাংসারিক প্রেমের মধ্য দিয়া এমন একটা সন্ধিস্থলে পৌঁছান যায়–যেখানে যেরূপ আকাশ ও পৃথিবী দিগ্বলয়ে পরস্পরকে ছুঁইয়া ফেলে, সেইরূপ পার্থিব ও অপার্থিব প্রেমের সেখানে দেখাদেখি হয়; গাছের ডালটারে আশ্রয় করিয়া যেরূপ স্বর্গের ফুল ফুটে, এই প্রেম সেই ভাবে জড়রাজ্য হইতে আনন্দলোক দেখাইয়া থাকে। কোন নায়ক-নায়িকা নাম জপ করিয়াছে, সেমন তো বড় দেখা যায় না। তবে যাহাকে ভালবাসা যায়, তাহার নামটি যে মিষ্ট লাগে–তাহার উদাহরণ সাধারণ সাহিত্যে একেবারে দুর্লভ নহে! বঙ্কিমচন্দ্র কুন্দ-নগেন্দ্রের নামটিতে সেইরূপ মিষ্টত্ব আবিষ্কার করিয়া সংগোপনে অতি সন্তর্পণে ‘নগ’ ‘ নগ’ ‘নগেন্দ্র’ এই অর্দ্ধস্ফুট শব্দগুলি উচ্চারণ করিয়াছিল। অর্দ্ধোদ্গত কুসুম-কোরকের ন্যায় এই নাম লইতে যাইয়া তাহার ব্রীড়াশীল কণ্ঠস্বর কাঁপিয়া উঠিয়াছিল। বৈষ্ণব পদ-মাধুর্য্যের এখানে একটু আভাষ পাওয়া যায় মাত্র।
কিন্তু ভাগবত-রাজ্যে নামই মুখ-বন্ধ। এ পথের নূতন পান্থ প্রথম প্রথম বিব্রত হইয়া পড়িবেন; নাম করিতে যাইয়া দেখিবেন, সাংসারিক চিন্তার নানা জটিল ব্যূহ তাঁহাকে ঘিরিয়ে ধরিয়াছে,–করাঙ্গুলীর সঙ্গে মালা ঘুরিতেছে, কিন্তু দুই এক মিনিট পরে পরেই অসতর্ক মন সংসারের নানা কথায় নিজকে জড়াইয়া ফেলিয়াছে। তখন তিনি সাবধান হইয়া মনকে শুধু নামের মধ্যে আবদ্ধ করিয়া রাখিবার সঙ্কল্প করিবেন। পুনরায় দেখিবেন, সাংসারিক চিন্তা, সন্তানের পীড়া, মোকদ্দমার কথা, অর্থাগমনের উপায় প্রভৃতি বিষয় হইতে বিষয়ান্তরে মন চলিয়া যাইতেছে–এ যেন কাঁঠালের আঠা, ছাড়াইতে চাহিলেও ছাড়াইতে পারা যায় না।
কিন্তু দৃঢ়সংকল্প-দ্বারা অসাধ্য সাধন হয়। ধীরে ধীরে মনের আবর্জ্জনা দূর হইতে থাকে। পৌষের কুয়াশা কাটিয়া গেলে প্রাতঃসূর্য্যোদয়ের মত ক্রমে ক্রমে মনের মহিমা প্রকাশ পায়। এইভাবে মন স্থিত হইলে, ইন্দ্রিয়-বিকার থামিয়া গেলে, নাম আনন্দের স্বরূপ হইয়া অপার্থিব-রাজ্যের বার্ত্তা বহন করে। নামের এই অপরূপ আস্বাদ কতদিনে মানুষ পাইতে পারে জানি না, ইহা সাধনা ও যুগ-যুগের তপস্যা-সাপেক্ষ।
তখন নাম শোনা মাত্র উহা মর্ম্মে মর্ম্মে প্রবেশ করে, কান জুড়াইয়া যায়–প্রাণ জুড়াইয়া যায়। প্রেমিক তখন পৃথিবী ভুলিয়া নামের পোতাশ্রয়ে নঙ্গড় বাঁধেন। সেস্থান শুধু নিরাপদ্ ও নির্ব্বিঘ্ন নহে–তাহার মোহিনীতে মন মুগ্ধ হইয়া যায়।
“সই, কেবা শুনাইল শ্যাম-নাম।
কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিল গো–
আকুল করিল মোর প্রাণ।”
কত তিলোত্তমা, কত রজনী, কত বিনোদিনী ও রাজ-লক্ষ্মীর প্রেমের কথা কবিতা আপনাদিগকে শুনাইয়াছেন, আপনারা সীতা-সাবিত্রী-দয়মন্তীর কথা শুনিয়াছেন;–কিন্তু এইরূপ না দেখিয়া নামের “বেড়াজালে” পড়িতে আর কাহাকেও দেখিয়াছেন কি? শুধু নাম শোনা নহে, নাম-জপ। “জপিতে জপিতে নাম অবশ করিল গো”–নাম জপ করিতে করিতে ইন্দ্রিয়গুলির সাড়া থামিয়া যায়–যেরূপ হাটের কলরব দূর হইতে শোনা যায়, কিন্তু হাটের মধ্যে আসিলে আর সে কলরব শোনা যায় না। জপ করিতে করিতে বহিরিন্দ্রিয়ের ক্রিয়া থামিয়া যায়–“অবশ করিল গো”-কথায় ইন্দ্রিয়াতীত অবস্থার কথাই আমি বুঝিয়াছি।
বঙ্গীয় জনসাধারণের সঙ্গে আমাদের এইখানে নাড়িচ্ছেদ হইয়া গিয়াছে। তাহাদের মনোভাব এখনও এইরূপ অর্থগ্রহণের অনুকূল আছে, বিদেশী শিক্ষার গুণে আমরা খনির কাছে থাকিয়াও মণির সন্ধান লইতে ভুলিয়া গিয়াছি।
নাম শুনিয়াই অঙ্গ এলাইয়া পড়িয়াছে, মন বেহুঁস্ হইয়া সেই নামরূপী ভগবানের দিকে ছুটিয়াছে। তিনি কে, যিনি শুধু নাম দিয়াই আমার মন হরণ করিয়াছেন? আমার বিদ্রোহী ইন্দ্রিয়গুলি আগুনের মত জ্বালা উৎপাদন করিতেছিল, সেই অগ্নিকুণ্ডে শুধু নামের গুণেই যেন বারি বর্ষিত হইল–সকল জ্বালা, সকল তাপ জুড়াইয়া গেল।
এখন তাঁহাকে কি করিয়া পাইব? তিনি কে, কেমন করিয়া জানিন? ফুলের মালা হাতে করিয়া আছি, কাহাকে পরাইব?
“নাম-পরতাপে যার ঐছন করল গো
অঙ্গের পরশে কিবা হয়!”
নাম-জপ শুষ্ক দৈহিক প্রক্রিয়া ছিল, কিন্তু এই বালুস্তূপ এক লুক্কায়িত ফল্গুনদীর অমৃত-উৎসের সন্ধান দিল। নাম শুনিলে মন চকিত হরিণীর ন্যায় ইতি-উতি কাহাকে খুঁজিতে থাকে? হারানিধি হইতেও তিনি প্রিয়তর, পৃথিবীর সমস্ত সুখ সে আনন্দের কণিকাও দিতে পারে না–
“না জানি কতেক মধু, শ্যাম-নামে আছে গো–
বদন ছাড়িতে নাহি পারে!”
যত বার তাঁর নাম আবৃত্তি করিতেছি, তত বার সাংসারিক ক্লান্তি ও অবসাআদ দূর হইয়া এক অলৌকিক পরমানন্দের আভাষ পাইতেছি, চক্ষু দুইটি অশ্রু-সিক্ত হইতেছে।
তাঁহাকে দেখি নাই, শুধু নাম শুনিয়াছি, তাহাতেই আমি আপন ভুলিয়াছি–তাঁহার স্পর্শ যেন কিরূপ? সে অমৃত-সায়রে কবে অবগাহন করিব? তিনি সর্ব্বত্র আছেন, শুনিয়াছি; কিন্তু ইহা তো একটা শোনা কথা। যেখানে “তাহার বসতি”, আমি সেইখানেই আছি, তিনি এই মুহূর্ত্তে এইখানেই আছেন, এরূপভাবে তাঁহার সত্তা উপলব্ধি করিলে কি এই নয়ত-মিথ্যাচার-পূর্ন সংসারে–এই ক্ষণবিধ্বংসী দেহ লইয়া–এই অসত্য ও ভ্রান্তির কুহক-জালে জীবন কাটাইয়া দিতে পারিতাম! যদি বুঝিতাম, তিনি এই মুহূর্ত্তে আমার কাছে আছেন, তবে কি তাঁহাকে ফেলিয়া–সত্যস্বরূপকে ফেলিয়া মরীচিকার পাছে ধাবিত হইতে পারিতাম! প্রিয়ের প্রিয় যিনি, আত্মীয়ের আত্মীয় যিনি, আপনা হইতে আপনার যিনি–যিনি মা হইয়া অক্লান্ত দাসীর ন্যায় আমার পরিচর্য্যা করিতেছেন, পুত্র হইয়া ভৃত্যের ন্যায় আদেশ পালন করিতেছেন, স্ত্রী হইয়া স্বীয় মুক্তকেশজালে আমার পায়ের ধূলা ঝাড়িতেছেন, সখা হইয়া আমার সঙ্গে খেলা করিতেছেন, শত্রু হইয়া আমার দোষ দেখাইতেছেন–আমারই মঙ্গলের জন্য–আমি বারম্বার ছুটিয়া পলাইতে চাই, তিনি তো তিলার্দ্ধকালও আমাকে ছাড়িয়া থাকিতে পারেন না, কখনও চোখ রাঙ্গাইয়া শাসন করিয়া, কখনও পরিচর্য্যা করিয়া–আলিঙ্গন-চুম্বনে মুগ্ধ করিয়া যিনি সতত আমার কাছে আছেন, চোখের আড়াল হইতে দিতেছেন না–তিনি এই মুহূর্ত্তে এইখানে আছেন, ইহা সত্য সত্যই উপলব্ধি করিলে কি আমি গার্হস্থ্যধর্ম্ম এখন যেমন করিয়া করিতেছি, তেমন করিয়া করিতে পারিব? তখন চক্ষু-কর্ণ প্রভৃতি দশ ইন্দ্রিয় মুগ্ধ হইয়া যাইবে–আনন্দহিল্লোলে মনসপদ্ম বিকশিত হইবে, শরীর কদম্বকোরকের ন্যায় ঘন ঘন রোমাঞ্চিত হইবে, তখন কি আমি কূলধর্ম্ম, গৃহধর্ম্ম, দেহধর্ম্ম প্রভৃতি যাহা এখন পালন করিয়া থাকি, তাহা তেমনই ভাবে পালন করিতে পারিব?
কবি বলিতেছেনঃ-
“যেখানে বসতি তার সেখানে থাকিয়া গো
যুবতীধরম কৈছে রয়?”
যে সকল কথা কাণে বাধে, তাহা অকুন্ঠিতভাবে কবি বলিয়া গিয়াছেন, কারণ তাঁহার দৃষ্টি অন্তর্ম্মুখী,–
“কহে দ্বিজ চণ্ডীদাস, কুলবতী কুলনাশে
যুবতীর যৌবন যাচায়।”
এই শুদ্ধ অপাপ-বিদ্ধ কৃষ্ণ প্রেম–ইহা যাহার মনে জন্মিয়াছে, পদ্মার ঢেউএ যেরূপ কুল ভাঙ্গিয়া পড়ে, তাহারও তো কুল সেইরূপ ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছে। কুল-গর্ব্ব, জাতি-গর্ব্ব, পদ-গর্ব্ব, এই সকল তো মত্ত হস্তীর ন্যায় আমার মনের দুয়ারে বাঁধা ছিল–
“দম্ভ-শালে মত্ত হাতী, বাঁছা ধিল দিবা রাতি”
আজ ইয়াহাদের সকলেরই ছুটি; আমি অবরোধে ধৈর্য্য ও আত্ম-সংযম পণ করিয়া বসিয়াছিলাম, আজ সে “ধৈর্য্য-শালা হেমাগার” ভাঙিয়া পড়িয়াছে, আমি কিছুতেই নিজকে সামলাইতে পারিতেছি না। আমি তাঁহাকে দেখিয়াছি এবং আমার সমস্ত তাঁহাকে নিবেদন করিয়া দিয়াছি। স্ত্রীলোককে তাহার লজ্জারূপ শাড়ী আবরণ করিয়া রাখে–প্রাণ যার তবু লজ্জা ছাড়িতে পারে না, কিন্তু আমি উপযাচক হইয়া আমার দেহ, মন, যৌবন ও লজ্জা তাঁহার চরণে ডালি দিয়াছিঃ “যুবতীর যৌবন যাচায়।” চণ্ডীদাস আর একস্থানে বলিয়াছেন, “কানুর পীরিতি–জাতিকুল-শীল ছাড়া।” সে রাজ্যে ব্রাহ্মণ-শূদ্র, কুলীন-অকুলীন নাই; “শীল”, আচার-বিচারের নিয়ম নাই।
আমি এই পদের অর্থ যেরূপ বুঝিয়াছি, তাহাই লিখিলাম। কিন্তু যিনি অন্যরূপ বুঝিবেন, তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করি, শুধু নাম শুনিয়া বিহ্বল হয়, পাগলা-গারদ ছাড়া এরূপ লোক কোথায়ও কি পাওয়া যায়? আর প্রেম করিয়া দিন-রাত্রি মধু-চক্রের ন্যায় নামকে আশ্রয় করিয়া আনন্দের সন্ধানে ফেরে, এরূপ কে আছে? কেবল এই পদে নহে, চণ্ডীদাসের বহু পদে শুধু পার্থিব ভাব দিয়া ব্যাখ্যা করিতে গেলে এইরূপ ঠকিতে হইবে।