প্রথম দর্শন চিত্রে।
“হাম সে সরলা, অবলা অখলা, ভালমন্দ নাহি জানি,
বিরলে বসিয়া, পটেতে লিখিয়া, বিশাখা দেখালে আনি।” (চ)
মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ লিখিয়াছেন, দর্শন-প্রার্থীকে প্রথমে আভাস মাত্রে দেখা দিয়া ভগবান প্রলুব্ধ করেন। এইজন্য চিত্র-দর্শনের পরিকল্পনা।
সে রূপ নীল-কৃষ্ণ নব মেঘের ন্যায়, জগতের সমস্ত বর্ণের প্রধান বর্ণ। যাহা নীলাকাশে, নীলাম্বুতে, নীলবনান্তে সর্ব্বত্র খেলে, সেই নয়নাভিরাম স্নিগ্ধ কৃষ্ণাভ নীলরূপ–ভগবানের প্রতীক। রাধা যেদিকে দৃষ্টিপাত করেন, সেইদিকেই সেই স্মেরাস্য কমলনেত্র কৃপাময়ের কৃপার আলেখ্য। সেই রূপ সমুদ্রের মত বিশাল এবং জল-বিন্দুর মত ক্ষুদ্র, মহৎ হইতে মহান্, অণু হইতে অনীয়ান্। তিনি অনন্ত আকাশে অনন্ত শক্তির আধা, বহু-রূপ, বহু-শীর্ষ, বহু-প্রহরণধারী, কিন্তু আমার কাছে, আমারই মত ক্ষুদ্র; বড়র কাছে বড়, “ভয়ানাং ভয়ং ভীষণং ভীষণানাং”ম কিন্তু আমার মত ক্ষুদ্রের কাছে তিনি ক্ষুদ্র। বিশাখা যখন চিত্রপট দেখায়, তখন আর আর সখীরা নিষেধ করিয়াছিল,
“বিশাখা যখন দেখায় চিত্রপট।
মোরা বলেছিলাম সে বড় লম্পট।।” (কৃ)
‘লম্পট’ কথায় পাঠক চমকিয়া উঠিবেন না; মহাজন-পদাবলীতে ভুবন-পাবন চৈতন্যদেবকে “কীর্ত্তন-লম্পট” বলা হইয়াছে। কৃষ্ণে সমর্পিতা প্রাণারাধা যখন–
“কি চিত্র বিচিত্র মরি দেখিইল চিত্র করি,
চিত মম নিলে যে হরি!”
বলিয়া সখীদের গলা জড়াইয়া মূর্চ্ছিত হইয়া পড়িলেন–তখন তাহারা বিলাপ করিয়া বলিতেছে,
“বিনা গুণ পরখিয়া কেন এমন হ’লি রাই;
দোষগুণ তার, না করি বিচার, কেবল রূপ দেখি রাই ভুলে গেলি।” (কৃ)
চিত্র-দর্শনের পর ছায়া-দর্শন। যমুনা-তীরে নীপ-তরুর উপরে কৃষ্ণ। যমুনা-জলে শিখিপুচ্ছ ও মকর-কুণ্ডলের দীপ্তির প্রতিবিম্ব ঝল্মল্ করিয়া উঠিয়াছে। রাধা উর্দ্ধে চাহিয়া কৃষ্ণরূপ দেখিতে পারেন নাই–কারণ “দাদা বলাই সঙ্গে ছিল” লজ্জায় মুখ উঁচু করিয়া কালো রূপ দেখিতে পারেন নাই। আনত চোখে যমুনা-জলে বিম্বিত কৃষ্ণকে দেখিতে ছিলেন, তিনি তখন জ্ঞান-হারা। সেই আনন্দময়, চির-সুহৃৎ, যিনি রূপের রূপ, সখার সখা, অন্তরে বাহ্যে জীব নিরন্তর যাঁহাকে খুঁজিতেছে, কখনও শিশুর হাস্যে, রূপসীর রূপে, মাতৃ-অঙ্কে, ফুলে-পল্লবে–পৃথিবীর সহস্র শোভায়–ধনে, মানে, প্রতিষ্ঠায় যাঁহার সন্ধান করিয়া সহস্রবার ভুল করিয়াছে–অমৃতকুণ্ড-ভ্রমে কূপে পড়িয়াছে–সেই রূপের সন্ধানে এ-ঘরে ও-ঘরে ঘুরিয়া ফিরিয়া ব্যর্থকাম হইয়াছে–আজ বহুদিন পরে, যুগ-যুগান্তের শেষে তাঁহাকে প্রথম দর্শন! এ কি অভাবনীয় আনন্দ! চৈতন্যদেব বলিয়াছেন–
“সর্ব্বত্র কৃষ্ণের রূপ করে ঝলমল।
সে দেখিতে পায় যার আঁখি নিরমল।।”
তিনি তো সর্ব্বত্রই আছেন, কিন্তু তাঁহাকে দেখার নির্ম্মল চক্ষু আজ রাধা পাইয়াছেন। যমুনার জলে প্রতিবিম্বিত কৃষ্ণকে দেখিয়া তিনি যুগ-যুগান্তরের কষ্ট ভুলিয়া গেলেন। সখীরা জলে কলসী নামাইবেন, রাধিকা বলিতেছেন–
“ঢেউ দিও না জলে বলে কিশোরী।
দরশনে দাগা দিলে হবে পাতকী।।” (গো, ক)
কলসী জলে ডুবাইলে জলে আঁকা কৃষ্ণের ছায়া ঢেউ-এ ভাঙ্গিয়া যাইবে, এজন্য রাধা নিষেধ করিতেছেন; যিনি যোগীর যোগানন্দ, প্রেমিকের প্রেম-সিদ্ধি, যুগ-যুগ তপস্যার ফলে মুহূর্ত্তের জন্য তাঁহাকে পাইয়াছিলেন–এই আনন্দে বাঁধা দিলে পাপ হইবে, রাধা মৃদুস্বরে মিনতি করিয়া তাহাই বলিতেছিলেন।
তাহার পরের কথা চণ্ডীদাসের পদেই পাওয়া যাইবে।