আমি অনেক ভাল ভাল কীর্ত্তনীয়ার কীর্ত্তন শুনিয়াছি। বর্দ্ধমানের রসিক দাস, কুষ্টিয়ার শিবু, বীরভূমের গণেশ দাস প্রভৃতি প্রসিদ্ধ গায়েনদের কীর্ত্তনে মুগ্ধ হইয়াছি, কিন্তু নদীয়ার গৌরসাদকে যেরূপ দেখিয়াছিলাম, সেরূপ আর কোন কীর্ত্তনীয়াকে দেখি নাই। এক সময়ে আমি ইংরেজী ও সংষ্কৃত নানা কাব্য পাঠে আনন্দ পাইতাম, কিন্তু পান্থ যেরূপ নানা স্থান ঘুরিয়া শেষে বাড়ীর ঘাটে নৌকা বাঁধিয়া সোয়ান্তি পায়, আমি জীবন-সায়াহ্নে সেইরূপ কীর্ত্তনের আনন্দে অন্য সমস্ত মুখ ভুলিয়া গিয়াছি। গৌর দাস কীর্ত্তনীয়ার মধ্যে যে ভক্তি, প্রেম ও কাব্যের বিকাশ দেখিয়াছি, তাহাতে আমার মন একবারে কীর্ত্তনে মজিয়া গিয়াছিল। গৌরদাসের বর্ণ ছিল কালো, দেহ ছিপছিপে, মুখ-চোখে প্রতিভার কোনই ছাপ ছিল না। পথ দিয়া চলিয়া গেলে তাঁহাকে অতি সাধারণ লোক বলিয়া মনে হইত। মৃত্যুর পূর্ব্বে তাহার বয়স হইয়াছিল ৪৮/৪৯। এই লোকটি গানের আসরে নামিলে তাহার রূপ বদলাইয়া যাইত, সে নিজে না কাঁদিয়া শত শত লোককে অশ্রুজলে ভাসাইয়া লইয়া যাইত। সে ছিল সংগীতচার্য্য। তাল মান এ সকল ছিল তাহার আজ্ঞাকারী ভৃত্য, কিন্তু প্রেমের অলৌকিক প্লাবনে মনে হইত, তাহার সঙ্গীত-বিদ্যার কোন নিয়মের দিকে সে দৃকপাত করে না, অথচ সে যেদিকে একটু হাতের ইঙ্গিত করিয়াছে, কি পা বাড়াইয়াছে, সেইদিকেই তাল মান রাজার হুকুমে নফরের ন্যায় ছুটিয়া গিয়াছে। আখরগুলি তাহার হৃদয়োচ্ছ্বাস হইতে শত শত স্বর্ণপদ্মের ন্যায় ফুটিয়া উঠিয়াছে এবং তাহার সাবলীল কণ্ঠের বিলাপময় আলাপের পাছে রাগ-রাগিণী পতি-বিরহিতা স্ত্রীর ন্যায় পাগল হইয়া ছুটিতেছে। আমি এরূপ কীর্ত্তন আর শুনি নাই, তাহার ৪/৫ ঘন্টার কীর্ত্তন এক নিমেষের মত কোথা দিয়া চলিয়া গিয়াছে, তাহা বুঝিতে পারিতাম না। গৌরদাস সত্য সত্যই এই পৃথিবীতে স্বর্গরাজ্য স্থাপন করিবার শক্তি রাখিত। গোষ্ঠ গাহিতে গাহিতে সে প্রারম্ভে কৃষ্ণসখাদের যশোদার আঙ্গিনায় আনিয়া উপস্থিত করিত, সে যখন ‘গগনে হইল বেলা যত শিশু হয়ে মেলা রে-উপনীত নন্দের ভবনে’ কিবা বেণু-বীণা-বাঁশী রব, করয়ে রাখাল সব গাহিত, তখন যেন আকাশ পটে চিত্রিত সুরঞ্জিত প্রভাত দৃশ্যকে সকলের প্রত্যক্ষে উপনীত করিত। ইহার পরে আওত সুদামচন্দ রঙ্গিয়া পাগড়ী মাখে গাহিয়া সর্ব্বপ্রথম সুদামকে উপস্থিত করাইত। সে রূপ বর্ণনা অপূর্ব্ব। সুদামের মাথার পগগ কৃষ্ণপ্রেমের আবেশে বারে বারে খসিয়া পড়িতেছে, পগ লটপটি শিরে, তাহার গলায় মহির হারের সঙ্গে গো-বাধন দড়ি ঝুলিতেছে-স্ফুট চম্পকদল নিন্দিত তাহার বর্ণ। তৎপর অপরাপর সখার বর্ণনা, তাহাদের প্রত্যেকের ভিন্ন ভিন্ন রূপ, ভিন্ন ভিন্ন বেশভূষা- যার মা যেমন সাজায়েছে, কিন্তু তাহারা সকলে এক ডুরিতে বাঁধা, তাহা কৃষ্ণপ্রেমের ডুরি। চিত্রের পুত্তলীয় ন্যায় তাহারা একে একে নন্দের ভবনে উপস্থিত হইয়া দাদা বলাই এর আগমন প্রতীক্ষা করিতেছে। সুবলের সঙ্গে কৃষ্ণের অনেক তর্ক-বিতর্ক হইয়া গিয়াছে। সুবল বলিতেছে, এই বৃন্দাবনে তো সকলেরই মা আছেন, তোমার মা ইহাদের উপরে গেলেন কি করিয়া? আমরা তো মায়ের নিষেধ না মানিয়াই আসিয়াছি। তোমাকে ছাড়া আমরা থাকিতে পারি না-
যখন মায়ের কাছে ঘুমিয়ে থাকি,
তখন স্বপনে কৃষ্ণ কৃষ্ণ বলে ডাকি।
সত্যই ইহারা কৃষ্ণ প্রেমে তন্ময়। কৃষ্ণ বলিলেন, দেখ আমি চুড়া বেঁধে ধড়া পরে বসে রয়েছি- সে তোমাদেরই জন্য- মায়ের আদেশের প্রতীক্ষায়। আমার মা যে আমাকে ছাড়া তিলার্দ্ধও থাকিতে পারেন না- ইহার উপায় কি? যদি আমি না বলিয়া চলিয়া গেলে মা মারা যান, তবে ভাই কি করিব? সত্যি সত্যি বলছি-
একদিন নবনী খেয়েছিলেম লুকাইয়ে।
মরিতেছিলেন মা আমার না দেখিয়ে। (শে)
সুবল ছাড়িবার পাত্র নহে। সখাদের বিশ্বাস তাহারা কৃষ্ণকে যেরূপ ভালবাসে, মা যশোদাও তাহাকে সেরূপ ভালবাসিতে পারেন না। সে বলিতেছে-
“জানি রে তোর মায়ের প্রেম যত ভালবাসে,
সামান্য ননীর লাগি বেঁধেছিল গাছে।”
তোর দুখানি কোমল কর স্পর্শ করিতে আমরা আশঙ্কায় মরি, পাছে আমাদের কঠোর স্পর্শে তাহা ব্যথিত হয়, কোন্ প্রাণে মা যশোদা সেই কোমল হাত দুখানি দড়ি দিয়া বেঁধেছিলেন? সেই দড়ির দাগ এখনও তোর হাতে আছে, একটুখানি ননীর জন্য এত বড় শাস্তি দিলেন, সেই বাঁধার দাগ আমাদের বুকে শেলের মত বিধিয়া আছে। আর এক দিনের কথা-
বমল অর্জ্জুন যে দিন পড়েছিল গায়,
সে দিন তোর মা নন্দরাণী আছিল কোথায়?
তিনি এত বড় দুটো অর্জ্জুন গাছের সঙ্গে তো দড়ি দিয়া শিশুটিকে বাঁধিয়া গেলেন, কিন্তু যখন সে দুটো গাছ তোর ঘাড়ে পড়িল, তখন নন্দরাণী কোথায় ছিলেন- আমরাই তো তোকে আসিয়া বাঁচাইয়াছিলাম।
এই তর্ক-বিতর্কে মা যশোদার আঙ্গিনা মুখরিত হইয়া উঠিল। সখারা কাঁদিয়া বিভোর হইতেছে, রাণীকে বলিতেছে- আমরা তোমার গোপালকে চারিদিকে ঘিরিয়া থাকি, সকল রাখাল মিলি, মাঝে থাকে বনমালীর কানুর পায়ে একটি কুশাঙ্কুর ফুটিলে আমাদের প্রাণে বিঁধে। তাহারা যশোদাকে অনেক অনুনয় বিনয় করিল- কৃষ্ণের দিকে চাহিয়া সজল চক্ষে বলিল, আমাদের মত বিনি কড়িতে হেন নফর কোথা পাবি? সে সকল উচ্ছ্বসিত আবেদন নিবেদনে যশোদার মত কতকটা গলিয়া গেল। তিনি কৃষ্ণকে সাজাইতে বসিলেন- বিবিধ অলঙ্কারে কৃষ্ণের অঙ্গ ঝলমল করিতে লাগিল, কৌটা খুলিয়া অলকা-তিলকা পরাইলেন, চন্দনের ফোঁটায় যেন কপালে চাঁদের উদয় হইল। সমস্ত দেবতাকে ডাকিয়া রাণী কানুকে কাননে রক্ষা করিবার জন্য প্রার্থনা করিতে লাগিলেন। এইবার সখাদের সঙ্গে কৃষ্ণ গোষ্ঠে বাহির হইবেন। রাণী কানুর পায়ে নূপুর পরাইতে পরাইতে ভাবাবেশে সাশ্রুনেত্র হইলেন। কিন্তু পায়ে আলতা পরাইবার সময়ে আর নিজকে সামলাইতে পারিলেন না, তখন কাঁদিয়া বিবসা পাগলিনীর ন্যায় রাণী আজিনায় বসিয়া পড়িলেন এবং বলিলেন- আমি কিছুতেই আজ গোপালকে গোষ্ঠে যাইতে দিব না। তোরা যদি জোর করবি, তবে মাতৃবধের দায়িক হবি।
সখায়া মাথায় হাত দিয়া বসিয়া পড়িল। এই সময়ে তাহাদিগের মনে নূতন আশায় সঞ্চার করিয়া আকাশে বলরামের শিঙা বাজিয়া উঠিল। দাদা বলাই আসিতেছেন, সুতরাং যশোদা তাঁহার সঙ্গে ঘাঁটিয়া উঠিতে পারিবেন না। বারুণী-পানে মত্ত বলাই আসিতেছেন, কবি বলিতেছেন, বলাই এর বারুণী বিশুদ্ধ কৃষ্ণপ্রেম, তিনি একটু তোতলা, (নিত্যানন্দ একটু তোতলা ছিলেন, কবিরা বলরামে তাহাই আরোপ করিয়াছেন), টলিতে টলিতে বলাই আসিতেছেন, শিঙায় কানাই এর নাম একটু ঠেকিয়া ঠেকিয়া আসিতেছে, কাক্কা কানাই বলিতে বলিতে আসিতেছেন, তাঁহার মুখপদ্ম-কৃষ্ণ-প্রেমাশ্রুতে ভাসিয়া যাইতেছে। মা রোহিণী যেখানে যেটি সাজে, তাই দিয়া বলাইকে সাজাইয়া দিয়াছেন।
“গলে বনমালা হাতে হাড়-বালা, শ্রবণে কুণ্ডল সাজে।
ধব-ধব-ধব ধবলী বলিয়া ঘন ঘন শিঙা বাজে।
(কিবা) নব নটবর নীলাশ্বর লস্ফে ঝম্পে আওয়ে।
মদে মাতল কুঞ্জর গতি উলটি পালটি চাওয়ে।”
এই সুদর্শন শুভ্রকান্তি বিরাট্ দেহ বলদেবের পদভরে ধরিত্রী কম্পিত হইতেছে। মাতাল বলাই বলিতেছেন, খির রহ ধরনী পৃথিবীকে এই ভাবে আশ্বাস দিয়া আসিতে আসিতে বৃন্দাবনের প্রাতঃ সূর্য্যকরে প্রতিবিম্বিত স্বদেহের বিরাট ছায়া দেখিয়া তিনি মনে করিলেন, সত্যই বৃন্দাবন দখল করিতে কোন প্রবল আগন্তুক অভিযান করিয়া আসিয়াছে, তখন মত্ত বলাই ছায়াকে জিজ্ঞাসা করিতেছে তুই কে, পরিচয় দে? আমি কা-ক্কা কানাই এর দাদা, জানিস আমি কত বড়। বলাই বলিল না, যে তাঁহার হলকর্ষনে জগৎ উলটিয়া যাইতে পারে, সে বড় বড় অসুরকে অবলীলাক্রমে বধ করিয়াছে। বৃন্দাবনে সমস্ত রাজসিক দর্প ভাসিয়া গিয়াছে, কৃষ্ণপ্রেম ছাড়া সেখানে গৌরব করিবার কিছু নাই। তাই সে পরম দর্পে নিজ ছায়াকে বলিতেছে, জানিস্ আমি ভাই কানাই এর দাদা, এই পুরুষ বাক্যের উচ্চারণকালে তাঁহার ভ্রমরপুঞ্জের ন্যায় কজ্জল-
কৃষ্ণ ভ্রু-যুগল কৃঞ্চিত হইল। তাঁহার হন্তের আন্দোলন ও মুখ-ভঙ্গী ছায়ায় প্রতিবিম্বিত হইল। তখন শত্রুর উত্তেজনা ভ্রম করিয়া বলদেব সত্যই রাগিয়া গেলেন।
‘ আপন তনু ছায়া হেরি, রেষাবেশ হই,
হু হু পথ ছোড়াই বলি- অঙ্গুলি ঘন দেই।
কর পাঁচনি কক্ষে দাবি, রাঙ্গা ধুলি গায় মাখে,
কা-ক্কা কা-ক্কা কানাইয়া বলি ঘন ঘন ডাকে।’
এই মত্ততা, এই স্খলিত পদ, বিভ্রান্ত বাক, নিজের ছায়ার সহিত লড়াই, সুদর্শন বলাই এর গতিবিধি সমন্তই কৃষ্ণপ্রেমের ছাপ-মারা; এজন্য প্রস্ফুটিত শ্বেতপদ্ম যেরূপ জলের উপর ভাসে, সেইরূপ তাঁহার মূর্ত্তিকে আঁকা কৃষ্ণ-প্রেম সমস্ত উদভ্রান্ত ব্যবহারের মধ্যে ফুটিয়া উঠিয়াছে। তোতলার কানাই বলিতে কা-ক্কা কানাই ও ধবলী বলিতে ধব-ধব-ধব ধবলী বলিতে যাইয়া মুখে লালা পড়িতেছে, কবি তাহার মধ্যেও অপরূপ সৌন্দর্য্য আবিষ্কার করিয়াছেন।
বলাই এর মুখ যেন বিধুরে, বুক বহি পড়ে মুখের নাল
যেন শ্বেত কমলের মধুরে।
বলদেবকে দেখিয়া যশোদা ভীত হইলেন, এবার আর কৃষ্ণকে রাখা যাইবে না। তিনি মিনতি করিয়া বলিলেন, “গোপাল অতি শিশু, কোন বোধ সোধ নাই-সে কাপড়খানি পর্য্যন্ত পরিতে শিখে নাই, নন্দালয়ে আসিবার পথে কাপড় খসিয়া পড়িলে সে থমকিয়া দাঁড়ায়, এদিকে কাপড় পড়িয়া গিয়া তাহার নুপূরসহ পা দুখানি বেড়ীর মত জড়াইয়া কাঁদিতে থাকে, এমন অসহায় অব্স্থায় আমি কত বার খুঁজিয়া পাইয়া তাহাকে বাড়ী লইয়া আসিয়াছি, তোরা এমন শিশুকে বিপদ-সঙ্কুল গোষ্ঠে লইয়া যাইবি কোন প্রাণে?”
যশোদার এই বাৎসল্য অতুলনীয়। কংস-ধ্বংসকারী, বক-কিস্মির-কালীয়-বিধ্বংসী, পুতনারাক্ষসীর স্তনসহ প্রাণ-শোষণকারী, যমলার্জ্জুনোৎ- পাটক পরম পুরুষবরকে তিনি যে চক্ষে দেখিয়াছেন, তাহা মাতৃ-স্নেহের প্রতীক। মাতা জগজ্জয়ী বীর পুন্ত্রকেও শিশু বলিয়াই মনে করেন। যিনি জগতে মহাবিপ্লব ঘটাইয়া শক্তিশালী সাম্রাজ্য স্থাপন করিয়াছেন, তিনিও মায়ের কাছে শিশু, তিনি দিনরাত চিন্তা করেন। যদি মুহূর্ত্ত-কালের জন্য তিনি পুত্রের শৌর্য্য-বীর্য্যের কথা স্মরণ করেন, তখন জগৎপালনকারী রস-শ্রেস্ঠ বাৎসল্য আর তাঁহার মনে স্থান পাইতে পারে না। ভগবানের পালনী শক্তির মূর্ত্ত প্রকাশ সন্তানের প্রতি মমতার অবসান হইলে জগৎ-রক্ষার প্রধান আশ্রয় ভাঙ্গিয়া পড়ে, কুটীরের প্রধান অবলম্বন শালের খুটিটীর অস্তিত্বের বিলোপ হয়। বৈষ্ণব কবিরা সেরূপ রস-ভঙ্গ করেন নাই। একদিন মাত্র যশোদা মুহূর্ত্তের জন্য বিন্দুর মধ্যে প্রতিবিম্বিত ষড়ৈশ্বর্য্যশালী বিশ্ব-রূপের প্রকাশ বুঝিতে পারিয়া ক্রোড়ের অতি ক্ষুদ্র শিশুটির মধ্যে বিশ্ব-শক্তির স্বরূপ দেখিয়া তিনি অধীর হইয়া পড়িয়াছিলেন, এজন্য বাল-গোপাল হাঁ করিয়া মাতাকে যাহা দেখাইয়া চমৎকৃত করিয়াছিলেন, সে রূপ তিনি তখনই সম্বরণ করিলেন।
গৌরদাসের মুখে এই গোষ্ঠ শুনিতে শুনিতে ভগবানকে কিরূপে সখ্য-ভাবে পাওয়া যায়, তাহা আমি আভাসে বুঝিয়াছিলাম। জগৎ তাঁহার লীলাস্থল, সম্পূর্ণরূপে তাঁহার উপর নিজকে ছাড়িয়া দিয়া, তাঁহাকে প্রাণাপেক্ষা ভালবাসিয়া, তাঁহার সহিত সম্পূর্ণরূপে বৈষম্য-ভাব-বর্জ্জিত হইয়া কিরূপে সেই স্বর্গীয় যোগ দেওয়া যায়, গোষ্ঠ- গানে তাহা বুঝিয়াছিলাম। এই সখারা কৃষ্ণকে কখনই মান্য করে নাই- (“আমরা সামান্য ভেবে কখন মান্য করি নাই” (কৃ), “কত মেরেছি ধরেছি, কাঁধে করেছি, চড়েছি”, নিজে ফলটি খাইয়া উহা ভাল লাগিলে উচ্ছিষ্ট তাহার মুখে দিয়াছি “আপনি খেয়ে খাওয়ায়েছি”। এটি বুঝিতে হইবে, বৃন্দাবনের পূজার বিধি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র রকম। এখানে ভক্তি-শ্রদ্ধা রসাতলে গিয়াছে, এখন মনের উপর আইন-কানুনের জোর জবর্দ্দস্তি নাই, স্বেচ্ছায় তাঁহাকে সর্ব্বস্ব দিয়া ঠিক নিজের মত ভাবিলে, তবে লীলায় যোগদান করার অধিকার হয়। যদি সখারা প্রতিদিন প্রত্যূযে উঠিয়া গঙ্গা-স্নান, করিয়া নিত্য-নৈমিত্তিক সন্ধ্যা তর্পনাদি সমাধাপূর্ব্বক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে গঙ্গামৃত্তিকার ছাপ দিয়া, নৈবেদ্য সাজাইয়া পূজায় বসিয়া যাইত, তবে কি তাহারা কৃষ্ণের খেরু হইতে পারিত? রাধার পা ধরিয়া কৃষ্ণ মান ভাঙ্গাইতেছেন কিংবা সখারা তাঁহাকে উচ্ছিষ্ট খাওয়াইতেছেন-একথা বৈধী ভক্তির শাস্ত্রে নাই; গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায় বলিতেছেন–“সব অবিধি নদের বিধি”–যাহা কিছু অশাস্ত্রীয় তাহাই নদীয়ার শাস্ত্র। ভক্তি ও প্রেমের রাজ্যে ইহার অধিক স্বাধীন মত অন্য কোন ধর্ম্ম-সম্প্রদায় দেখাইতে পারিয়াছেন বলিয়া জানি না। চণ্ডীদাস বুঝাইয়াছেন, সম্পূর্ণরূপে তচ্চিন্তাশীল, তদধিকৃত, তন্ময় ভয়-লাজ-শঙ্কা-বিরহিত ও একান্তভাবে সমতাপন্ন না হইলে কৃষ্ণপ্রেম-লাভ হয় না। এজন্য রাধার প্রেম-বর্ণনাকালে অলঙ্কার-শাস্ত্রোক্ত সমস্ত উপমান ও উপ্রেক্ষা অগ্রাহ্য করিয়াছেন-
ভানু কমলে বলি সেহ হেন নহে,
হিমে কমল মরে, ভানু সুখে রহে।
কুসুম-মধুপে বলি সেহ নহে তুল,
না আসিলে ভ্রমর আপনি না যায় ফুল।
চাতক জলদে বলি সে নহে তুলনা,
সময় না হৈলে না দেয় এক কণা।
কি ছার চকোর চাঁদ দুহ সম নহে,
ত্রিভুবনে হেন নাই, চণ্ডীদাস কহে। (চ)
একজন মরিয়া যায়, অপর সুখে থাকে, এ আবার কেমন প্রেম? একজন আসিলে মিলন হইবে, সে না আসিলে অপরে তাহার স্বস্থান ছাড়িয়া একটুও নড়িবে না, সেই প্রসাদকাঙ্খীর আবার প্রেমের বড়াই কোথায়? একজন বিন্দু-কৃপার জন্য প্রতীক্ষা করিয়া থাকিবেন, অপরে ঠিক ঘড়ি ধরিয়া তাহার সুবিধানুসারে যৎকিঞ্চিৎ দিবেন, তখন না হইলে দিবেন না, এতো রাজবাড়ীর অতিথিশালার বরাদ্দ-মাফিক ভিক্ষাদান, এখানে প্রেম কোথায়? আর একজন অত্যূর্দ্ধে বসিয়া স্বীয় অপূর্ব্ব বৈভব লইয়া দর্প করিবে, অপর ব্যক্তি ক্ষুদ্রতম ভিক্ষুর ন্যায় তাহার কণা-প্রসাদের আকাঙ্কা করিয়া থাকিবে, দুই জনের পদ-পার্থক্য এতটা হইলে, সম-জ্ঞান না হইলে প্রেম কোথায় পাওয়া যাইবে?
বৈষ্ণব পদে ভক্ত ও দেবতার মধ্যে এক তিল ব্যবচ্ছেদ রেখা নাই। জগতে বাঙালীর মত আর কোন জাতি ভগবানকে এত আপনার করিয়া দেখিতে সাহসী হন নাই। কৃষ্ণ কখনও যশোদার হাতে, কখনও রাধিকার পদতলে, কখনও সখাদের মারধরের মধ্যে কত লাঞ্ছনা পাইতেছেন–সেই অবাধ, সম্পূর্ণরূপ একাত্মবোধ দ্বারা পরিশোধিত ক্ষেত্রে প্রেমের পূর্ণ বিকাশ হইয়াছে। যাহাকে সর্ব্বস্ব দিয়াও কিছু চায় না, তাহার কাছে দর্পহারীর দর্প থাকিবে কিরূপে? তিনি তাহাকে কি দিবেন?–সে শুধু তাঁহাকেই চায়। কি ভয় দেখাইবেন? সে শুধু তাঁহার বিরহকে ভয় করে–এরূপ লোকের কাছে ভগবান পরাজিত।
সখারা যখন বিপন্ন তখনও তাহারা পরম বিশ্বাসে কৃষ্ণের মুখের দিকেই চাহিয়া আছে, তাহাদের বিপদের জ্ঞান নাই, প্রেমের বলে তাহারা নির্ভয় হইয়া গিয়াছে, “আনন্দং ব্রহ্মণো বেত্তা না বিভেতি কদাচন।” অপোগণ্ড শিশু মায়ের কাঁধে মাথা রাখিয়া দুর্গম পথে চলিয়াছে, চারিদিকে ব্যাঘ্রগর্জ্জন, আকাশে কৃষ্ণদৈত্যের মত রাশি রাশি মেঘের ভ্রুকুটী, শিশু নিশ্চিন্ত, সে কোন ভয়ই পাইতেছে না, ভয়-ভাবনা সমস্ত তাহার মায়ের, মাতৃক্রোড়ের দুর্গ আশ্রয় করিয়া সে প্রেমের জোরে নির্ভয়–সখারা কৃষ্ণ-প্রেমে সেইরূপ নির্ভয়, তাহারা কংস চরের ভয় রাখে না।
গৌরদাসের কীর্ত্তন যে অপূর্ব্ব বৈকুণ্ঠ রচনা করিত, তাহাতে কিছুকালের জন্য আমি পার্থিব সমস্ত কথা ভূলিয়া যাইতাম, তাহাতে বৃন্দাবন-লীলাচ্ছলে ভাগবত তত্ত্ব এমনিভাবে প্রকটিত হইত। চৈতন্য চরিতামৃত প্রভৃতি গ্রন্থেরও পদাবলীর যে সকল স্থানের অর্থ আমি বহুকাল হাতড়াইয়া পাই নাই, এই মূর্খ কীর্ত্তনীয়ার গান তাহা আমাকে স্পষ্টভাবে বুঝাইয়া দিত। গান করিবার সময়ে যেন সে ভাগবত উদ্যানের একটি ভাবকল্পবৃক্ষের মত হইয়া যাইত, তাহার আখরে ও হন্তের ভঙ্গীতে যে লীলার কথা ফুটিয়া উঠিত, সেরূপ মূর্ত্ত মহাকাব্য–দিব্য সঙ্গীত আমি আর কখনও শুনি নাই। অন্য দেশ হইলে, এই গৌরদাসের জন্য কত কি না হইত। সে কথা বলিয়া কাজ নাই। কিন্তু বিলাতের অনুকরণে আমরা জীবন চরিত সাহিত্যের সৃষ্টি করিয়া যাহাদের গুণকীর্ত্তন করিয়া বড় বড় গ্রন্থ লিখিতেছি ও নব নব সৌধ নির্ম্মাণ করিতেছি, তাঁহাদের মধ্যে কয় জন যে গৌরদাসের গা ঘেঁষিয়া দাঁড়াইতে পারেন, তাহা বলিতে পারি না। তবে বুহ সরসীতে শতদল পদ্ম ও বনান্তে মল্লিকা, কুন্দ ও মালতী ফুটিয়া অনাদরে শুকাইয়া ঝরিয়া পড়ে, তাই বলিয়া তাহাদের মূল্য যে জগতের কোন মূল্যবান বন্ত অপেক্ষা অল্প তাহা কখনই স্বীকার করিব না, আমাদের দৃষ্টিশক্তির প্রসার অল্প,সেই জন্য বিরাট জ্যোতিষ্ক-গুলিকে আমরা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিন্দুর মত দেখিয়া থাকি।
দুই এক মাস পরে পরেই গৌর দাস আমার বাড়ীতে কীর্ত্তন গাহিত। তাহার দল সহ সে আমার আমন্ত্রণে বাড়ীতে আসিত। এই উপলক্ষে প্রতিবারই আমার ৪০/৫০ টাকা খরচ হইত। এ টাকা ব্যয় আমার সার্থক ছিল। লোকে দার্জ্জিলিং, শিমলা শৈলে বা ওয়ান্টারে ঘুরিয়া স্বাস্থ্য ফিরিয়া পায়। গৌর দাসের কীর্ত্তন শুনিয়া আমার মনে হইত, আমার মনোতরুর শুকনা পাতাগুলি জরিয়া পড়িতেছে এবং সবুজ পল্পব দেখা দিয়াছে এবং স্বর্গীয় কুসুমের কুঁড়ি ফুটিতেছে–তাহার সমাগমে আমার মনের মধ্যে এই ঋতুপরিবর্ত্তন লক্ষ্য করিতাম। সে আমাকে মর্ত্ত্যলোক হইতে স্বর্গলোকে লইয়া যাইত। আমার স্ত্রী-পুত্র-পরিবার, কালিদাসের কবিতা আমাকে যে সুখ দিয়াছে, ততোধিক আনন্দ দিয়াছে গৌরদাসের কীর্ত্তন।
মনে আছে, একদিন গৌরদাস রূপাভিসারের একটা গান গাহিতেছিল, সেই একটি গান গাহিতে তাহার পুরা তিনটি ঘন্টা লাগিয়াছিল, কিন্তু এই সময়টা যে কি ভাবে গিয়াছিল, তাহা আমি বুঝিতে পারি নাই। রাধা সেই গানটিতে শ্রীকৃষ্ণের চোখের ভঙ্গীর কথা বলিতেছিলেন, তাঁহার সেই নয়নের নৃত্য রাধার সর্ব্বাঙ্গ নাচাইতেছিল–সেই নৃত্যের আসর রাধার দেহ–কত ছন্দে, কত অমৃতাস্বাদী আখরে, সুরের সমন্ত ভাণ্ডার খালি করিয়া সেই চক্ষের নৃত্য চলিতেছিল। সে যে কি আনন্দে কীর্ত্তনটি শুনিয়াছিলাম, তাহা আর কি বলিব, বোধহয় বজ্রপাত হইলে তখন সেই শব্দ আমার কাণে পৌছিত না। যে কণ্ঠ ভগবান স্বয়ং নারদ বা তুম্বুরুর গীতি যন্ত্রের উপাদানে গড়িয়াছিলেন, তাহা তিনি অকালে ভাঙ্গিলেন কোন্ প্রাণে? গোলাপটি কেনই ফোটে, কেনই বা ঝরিয়া পড়ে কে বলিবে? কোন বিশিষ্ট কীর্ত্তনীয়ার দলের একটি লোক সেই সময়ে উপস্থিত ছিলেন, তিনি বলিলেন–গৌরদাসের কীর্ত্তনের সমকক্ষতা করিতে পারে, এরূপ লোক এ যুগে কেহ নাই। যাহারা আছেন, তাঁহাদের মধ্যে যিনি সর্ব্বশ্রেষ্ঠ, তিনিও গৌরের পায়ের কাছে বসিয়া অনেক বৎসর কীর্ত্তন শিখিতে পারেন।
শুনিয়াছি, গৌরদাস বাংলাদেশে খোলের ওস্তাদ ছিল, তাহার মত খোল বাজিয়ে আর কেহ ছিল না। সংগীতাচার্য্য বলিয়াও তাহার খ্যাতি ছিল, এ সকল বিষয় আমার অধিকার-বহির্ভূত। কিন্তু তাহার মত ভাবাবিষ্ট গায়ক আমি আর দেখি নাই। সে কৃষ্ণপ্রেম হরিলুটের মত বিলাইয়া শ্রোতাকে যাদুমত্রে ভুলাইয়া, ঘন্টার পর ঘন্টা আসরে মোহাবিষ্ট করিয়া রাখিতে পারিত এবং অশ্রুর প্লাবনে সকলকে ভাসাইয়া লইয়া যাইবার শক্তি রাখিত।