১৪. অন্তিম দৃশ্য

১৪. অন্তিম দৃশ্য

পারসিকগণ

জাস্টিনিয়ানের আমলে সাম্রাজ্যের সম্প্রসারণ দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ৫৬৫ খ্রিস্টাব্দে জাস্টিনিয়ানের মৃত্যুর অব্যবহিত পরেই বর্বরদের অভিযানে ইতালি লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় এবং ৫৭০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ উপদ্বীপটি হাতছাড়া হয়ে যায়।

পশ্চিমের বর্বর আক্রমণের চাইতেও আরও বড় উৎকণ্ঠার বিষয় ছিল পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের আরও পূর্বে এক শক্তির অভ্যুদয় ঘটেছিল। রোমান স্রাটরা (শুধু জাস্টিনিয়ান নয় তার পূর্বসূরি ও উত্তরসূরিরাও) পশ্চিমে তাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেছিল সেখানে রোম সাম্রাজ্যের শক্ত অবস্থান নির্মাণ করতে। তাদের প্রাধান্য বজায় রাখার জন্য সব সময় পারস্যের সাথে সংগ্রাম করতে হয়েছিল।

এমনকি জাস্টিনিয়ান যখন পশ্চিমে তার বিজয় অব্যাহত রেখেছিল, তখনও তাকে পারস্যের সাথে দুটি যুদ্ধে অংশ নিতে হয় এবং শেষ পর্যন্ত শান্তি চুক্তিতে আসতে হয়। অবশেষে পারস্যে দ্বিতীয় খসরুর আমলে পরিস্থিতি চূড়ান্ত অবস্থায় পোঁছে।

পূর্ব রোমান সাম্রাজ্য যখন আভার যাযাবর উপজাতির আক্রমণে বিপর্যস্ত তখন দ্বিতীয় খসরু সেই সুযোগ গ্রহণ করেন। জাস্টিনিয়ানের মৃত্যুর পর থেকেই তারা দানিয়ুব নদীকে অবলম্বন করে বারবার আক্রমণ চালাতে থাকে। পারস্যের রাজা বিপুল সাফল্য অর্জন করে এবং এশিয়া মাইনরের উপর দিয়ে অগ্রসর হয়। ৬০৮ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ দ্বিতীয় খসরু কনস্টান্টিনোপল প্রণালী পার হয়ে ক্যালসিডনে পোঁছান।

তার সৈন্যবাহিনী সিরিয়াতেও অভিযান পরিচালনা করে। সেখানকার জনগণ তাকে আক্রমণকারী শত্রু হিসাবে না দেখে খ্রিস্টীয় রক্ষণশীলতার বেড়াজাল থেকে মুক্তিদাতা হিসাবে গণ্য করেছিল। দ্বিতীয় খসরু ৬১১ খ্রিস্টাব্দে এন্টিয়ক এবং ৬১৩ খ্রিস্টাব্দে দামেস্ক অধিকার করেন।

৬১৪ খ্রিস্টাব্দে রোমান সাম্রাজ্যের উপরে একটি হতাশাজনক আঘাত আসে, যখন পারস্য বাহিনী যেরুজালেম অধিকার করে এবং প্রকৃত ক্রুশ বহন করে নিয়ে যায় (কথিত আছে যে এটিই সেই ক্রুশ যাতে যিশুকে ঝোলানো হয়েছিল)। ৬১৯ খ্রিস্টাব্দে পারসিকরা মিশরে প্রবেশ করে। এজন্য মনোফাইসাইটদের বিতর্ককে ধন্যবাদ দেওয়া উচিত। পারসিকরা সহজেই মিশর অধিকার করে, যেমনটা এক হাজার বছর পূর্বে আলেক্সান্ডার মিশর অধিকার করেছিল। সে সময় যেমন আলেক্সান্ডারকে ভাবা হয়েছিল পারসিকদের যাতাকল থেকে ত্রাণকর্তা হিসেবে, ভাগ্যের পরিহাস, এবার গ্রিক যাতাকল থেকে ত্রাণকর্তা হিসাবে পারস্যের রাজাকে দেখা হল।

প্রকৃতপক্ষে দ্বিতীয় খসরুর বিজয়ের মাধ্যমে আলেক্সান্ডারের অর্জনকে নষ্ট করে দেয়া হয়। পারসিকদের পরাজয়ের এক হাজার বছর ধরে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে পারস্য নেতৃবৃন্দের প্রথমে সেলুকীয় এবং পরে রোমান সম্রাটদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের চূড়ান্ত পরিণতি ঘটল। শেষ পর্যন্ত তারা হৃত গৌরব ফিরে পেল। ইরানীয় উচ্চভূমি, মেসপটেমিয়া, সিরিয়া, এশিয়া মাইনর এবং মিশর তাদের করায়ত হলো।

এই সংকট নিরসনে হেরাক্লিয়াস নামে এক নূতন সম্রাটের অভ্যুদয় ঘটল, তিনি হলেন এক ক্ষীয়মান সাম্রাজ্যের অধীশ্বর। শুধু যে সমগ্র প্রাচ্য পারস্যের অধিকারে চলে গিয়েছিল তাইনা, ৬১৬ খ্রিস্টাব্দে একটি জার্মান উপজাতি সাম্রাজ্যের পুরো স্পেনীয় অঞ্চল দখল করে নেয়। ইতিমধ্যে এ্যাভার্সরাও দানিয়ুবের দিক থেকে চাপ সৃষ্টি করতে থাকে। ৬১৯ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ তারা কনস্টান্টিনোপল পর্যন্ত এগিয়ে আসে।

সৈন্যবাহিনীকে পূনর্গঠিত ও শক্তিশালী করতে হেরাক্লিয়াসের দশ বছর লেগে যায়, আর এক প্রবল ধর্মোন্মাদনার মধ্যে তিনি এশিয়া মাইনরে ঢুকে পড়েন। ৬২২ ও ৬২৩ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে তিনি উপদ্বীপ থেকে পারসিকদের সম্পূর্ণরূপে বিতাড়িত করতে সক্ষম হন। তারপর তিনি মহা উৎসাহে পারস্যের মূল ভূখণ্ডের দিকে অগ্রসর হন। এ জন্য তিনি কোনো বাধা মানতে রাজী নন। ৬২৬ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ তিনি কনস্টান্টিনোপলের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়েন।

কনস্টান্টিনোপল বেঁচে গিয়েছিল। এর প্রাচীর আভারদের আক্রমণেও টিকে ছিল। ৬২৭ খ্রিস্টাব্দে পুরাকালে যেখানে নিনেভ নগরী ছিল, এক কঠিন যুদ্ধের পর সেখানে তিনি পারসিকদের পরাজিত করেন। এখানেই পারসিকদের সমাপ্তি। দ্বিতীয় খসরু পদচ্যুত ও নিহত হন, এবং তার উত্তরাধিকারী তাড়াহুড়া করে একটি সন্ধিচুক্তি স্বাক্ষর করেন। মিশরসহ পারস্যের সমগ্র বিজিত স্থান সুরক্ষিত থাকে। সত্যিকারের ক্রুশটিও ফিরিয়ে দেওয়া হয় এবং ৬৩০ খ্রিস্টাব্দে হেরাক্লিয়াস নিজেই এটা যেরুজালেমে ফিরিয়ে আনেন। বল্কান এলাকায় আভার-জোয়ার স্তিমিত হতে থাকে এবং কয়েক বছরের মধ্যেই মনে হয় জাস্টিনিয়ানের সময়ের সবকিছুই পুনরুদ্ধার হয়ে যায় (শুধু ইতালি ও স্পেন ছাড়া)।

জাস্টিনিয়ান অনুভব করেন সাম্রাজ্যে একটি ভয়ানক এমটি রয়েছে, আর তা হল অবিরাম ধর্মীয় বিরোধ। সিরিয়া ও মিশরের এত সহজে পতন হয় এই ধর্মীয় বিরোধের কারণে আর হেরাক্লিয়াস জানতেন এটা বারবার ঘটতেই থাকবে যদিনা একটি সমঝোতায় পৌঁছানো যায়।

তাই তিনি একটি সমঝোতার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। কনস্টান্টিনোপল বিশাস করত যিশুর দুইটি রূপ আছে, একটি স্বর্গীয় এবং একটি মানবিক। অথচ মিশর ও সিরিয়া শুধু একটি রূপকেই ধারণ করত। তাহলে এমনটি কি করা যায় না যে যিশুর দুটি রূপ থাকলেও তার একটি ইচ্ছা- অন্য কথায় দুটি রূপের মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব থাকবে না? এই ধারণাকে বলা হয় মনোথেলিটিজম (এক ইচ্ছা)। মনে হয়েছিল এই সুন্দর সমঝোতায় সবাই সম্মত হবে।

হয়তো সেটাই হতো যদি সেটা কেবল ধর্মীয় বিরোধ হতো। সমস্যা ছিল সিরিয়া ও মিশরের জাতীয়তাবাদী মনোভাব এই সমঝোতার ব্যাপারে আগ্রহী ছিল না। এটাও হতে পারে যে কনস্টান্টিনোপল যদি মনোফাইসাইটিজমকে সম্পূর্ণরূপে গ্রহণও করত তাহলেও সিরিয়া ও মিশর বিবাদের আর একটি বিষয় খুঁজে বের করত। কাজেই অসন্তোষ রয়েই গেল, তাই কোনো কথা বা কোনো কাজের দ্বারা তার উপর প্রলেপ দেওয়া যাবে না।

.

আরবীয়গণ

যতদিন হেরাক্লিয়াস সিংহাসনে ছিলেন মনোফাইসাইটীয় বিরোধ এবং ধর্মীয় অসন্তোষ সম্পূর্ণরূপে তাত্ত্বিক ব্যাপার ছিল। তবে একটি সংকটের মুহূর্ত এগিয়ে আসছে। রোমান সাম্রাজ্য এবং পারস্যের মধ্যে চার শতাব্দীব্যাপী যুদ্ধ বিশেষ করে শেষ বিশ বছরের কঠিন সংগ্রাম উভয় পক্ষেরই শক্তি নিঃশেষ করে ফেলে। তাদের যুদ্ধ একটি স্থিতাবস্থার মধ্যে আসে এবং উভয়ই হাপাতে থাকে আর এই সুযোগে একটি নতুন সতেজ এবং ধর্মোন্মাদ শক্তি ময়দানে ঢুকে পড়ে। সবার বিস্ময়বিমূঢ় দৃষ্টির সামনে নতুন উপসর্গটি একটি অপ্রত্যাশিত দিক- আরব উপদ্বীপ থেকে সামনে চলে আসে।

আরব উপদ্বীপ মূলত মরুঅঞ্চল হলেও এর উর্বর প্রান্তে একটি চকপ্রদ সভ্যতার বিকাশ ঘটে এবং মাঝে মাঝেই তা সভ্যজগতের উপরে চড়াও হয়। মিশরীয় রাজারাও বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করেছিল দক্ষিণ আরবের সাথে যেখানে বাইবেলের শেবা ও অফির রাজ্য অবস্থিত ছিল।

তবে আরবরা কোনো সময়ই নেহায়েত উৎপাতের চাইতে বেশি কিছু ছিল না, আর যখনই উত্তর-পশ্চিম এবং উত্তর-পূর্বের সাম্রাজ্য শক্তি তাদের দিকে এগিয়ে আসত তারা চুরমার হয়ে যেত। কিন্তু উত্তরের উভয় সাম্রাজ্য লড়াই করতে করতে যখন ক্লান্ত তখন আরবীয়রা একজন নতুন এবং শক্তিশালী নেতৃত্বের সন্ধান পেল।

এটি ছিল একটি ধর্মীয় পূনর্জীবনের ফসল। প্রাচীন আরবীয় বহুদেবত্ববাদ আধুনিক শালীন ইহুদি ও খ্রিস্টীয় বিশ্বাসের দ্বারা অপসৃত হয়েছিল। জাতীয়তার কারণে একেশ্বরবাদের অগ্রগতি ছিল শ্লথ। যেহেতু ইহুদিবাদ ও খ্রিস্টধর্ম বহিরাগত বলে মনে হয়েছিল, তাই একটি স্থানীয় বিশ্বাসের অত্যন্ত প্রয়োজন ছিল।

মিশর থেকে লোহিত সাগরের ওপারে আরব উপজাতির পবিত্র নগরী মক্কায় ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে মুহাম্মদ (স:) নামে এক বালক শিশুর জন্ম হয়। যিনি তাঁর চল্লিশ বছর বয়সে একেশ্বরবাদী একটি ধর্মের প্রচার শুরু করলেন। তার প্রাপ্ত প্রত্যাদেশসমূহ “কোরান” নামে এক পবিত্র গ্রন্থে সংকলিত করা হয়।

মুহাম্মদ (স:) প্রচারিত নতুন ধর্মের নাম ইসলাম (আল্লাহর প্রতি সমর্পণ)। যারা এই ধর্মমত গ্রহণ করেছিল তাদের বলে মুসলমান। যিশুর মতো প্রথম দিকে তিনিও স্বদেশবাসীর আনুকূল্য লাভ করতে পারেননি। ৬২২ খ্রিস্টাব্দে মুহাম্মদ (স:) তার অনুগত কয়েকজন সমর্থকসহ মক্কা থেকে চলে যেতে বাধ্য হন। (হিজরত)। তিনশত পঞ্চাশ মাইল উত্তরে মদিনা নগরে তিনি আশ্রয় লাভ করেন। মুহাম্মদ (স:) ধীরে ধীরে মদিনায় তার অনুসারীদের সংগঠিত করতে থাকেন এবং তাদেরকে একটি যোদ্ধার দলে পরিণত করেন যারা নূতন বিশ্বাসে উদ্দীপ্ত ছিল।

৬৩০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ তিনি মক্কায় যুদ্ধযাত্রা করেন, আট বছর পূর্বে যেখান থেকে তাকে তাড়িয়ে দিয়েছিল এবং সেই যুদ্ধে জয়লাভ করেন। এ বছরই হেরাক্লিয়াস বিজয়ীর বেশে যেরুজালেমে প্রবেশ করেন। বহির্বিশ্বের খুব কম জাতিই সে সময় মুহাম্মদ-এর (স:) মক্কা বিজয় সম্বন্ধে জানতে পেরেছিল।

এই সময় থেকে মুহাম্মদ-এর (স:) অগ্রগতি দ্রুততর হল। ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে তার। মৃত্যুর সময় সমগ্র আরব জাতি ইসলামের পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ হয়। আল্লাহর নামে তারা তাদের বিশ্বাসকে বিস্তৃত করতে বদ্ধপরিকর ছিল। আল্লাহ তাদের পক্ষে থাকলে তাদের হারার সম্ভাবনা নাই। যুদ্ধক্ষেত্রে অবিশ্বাসীদের হাতে তাদের মৃত্যু ঘটলেও অনন্ত স্বর্গে তাদের বাসস্থান নিশ্চিত।

মোহাম্মদের উত্তরাধিকার লাভ করেন হযরত আবু বকর (রা:), যিনি ছিলেন তার সর্বপ্রথম অনুসারী। তিনি ছিলেন প্রথম খলিফা (উত্তরাধিকারী)। তার অধীনে আরব বাহিনী উত্তর-পূর্ব দিকে পারস্য সাম্রাজ্য এবং উত্তর-পশ্চিম দিকে সিরিয়া আক্রমণ করে।

হেরাক্লিয়াস আরব শক্তির অবমূল্যায়ন করেছিলেন। পারস্যের যুদ্ধে অসম্ভব শক্তি-ক্ষয়ের মাধ্যমে তিনি যে বিজয় অর্জন করেছিলেন তাতে তুষ্টি লাভ করে তার শেষ জীবনে তিনি শুধু শান্তির প্রত্যাশা করেছিলেন আর স্বয়ং কোনো যুদ্ধে জড়াবেন না বলে স্থির করেছিলেন। অপর্যাপ্ত সৈন্য নিয়ে তিনি তার ভাইকে যুদ্ধে পাঠিয়েছিলেন। আরবরা তাকে পরাজিত করে ৬৩৪ খ্রিস্টাব্দে দামেস্কের দিকে অগ্রসর হল। প্রবাদ আছে যে, ঐ একই দিন হযরত আবু বকরের (রা:) মৃত্যু হয় এবং মুহাম্মদ-এর (স:) আরেকজন সঙ্গী হযরত ওমর (রা:) তার উত্তরাধিকারী হন।

পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যে প্রাথমিক পরাজয়ের পর কনস্টান্টিনোপলের রোমান সাম্রাজ্য নড়েচড়ে বসে এবং একটি শক্তিশালী রাজকীয় বাহিনী দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হয় বিষয়টির চূড়ান্ত সমাধান করার জন্য। সাময়িকভাবে আরবরা দামেস্ক থেকে পিছু হটে যায়।

যা হোক, রাজকীয় বাহিনী আপাতদৃষ্টিতেই শুধু শক্তিশালী বলে বোধ হয়েছিল। এই বাহিনীর অধিকাংশ সদস্যই ছিল ভাড়াটিয়া আর তারা নিশ্চিত ছিল না তাদের পাওনা চুকানো হবে কি না এবং সিরিয়ার মনোফাইসাইট জনগণ যুদ্ধের ব্যাপারে বিতৃষ্ণ ছিল। তারা নতুন এই আরব শক্তি ইসলাম সম্বন্ধে তেমন কিছু জানত না তবে তারা নিশ্চিতভাবে জানত যে তারা কনস্টান্টিনোপলের ধর্মীয় ক্রিয়াকলাপ পছন্দ করত না।

তাই ৬৩৬ খ্রিস্টাব্দের ২০ আগষ্ট পৃথিবীর ইতিহাসের এক চূড়ান্ত যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়ে যায়। যুদ্ধটি সংঘটিত হয় ইয়ারমুক নদীর তীরে। নদীটি জর্ডানের উপর দিয়ে পশ্চিম দিকে প্রবাহিত হয়ে লোহিত সাগরে পড়েছে। এটি ছিল একটি কঠিন যুদ্ধ। রাজকীয় বাহিনীর আক্রমণে আরব সৈন্যরা বার বার পিছু হটছিল। তাদের অশ্ব ও উষ্ট্রবহর নিয়ে অক্লান্ত আরব সৈনিকরা বার বার দিক পরিবর্তন করছিল এবং ফিরে আসছিল আর রাজকীয় বাহিনী ক্লান্ত হয়ে পড়লে তাদের প্রত্যেকটি সৈন্যকে হত্যা করেছিল। এটি আরবদের জন্য ছিল একটি চুড়ান্ত বিজয়। পরবতী আট শতাব্দীব্যাপী রোমানরা শুধু আত্মরক্ষার সংগ্রামই করেছে।

আরবদের কথা বলতে গেলে তারা ইচ্ছামতো বিভিন্ন অঞ্চল দখল করে চলেছে, যারা তাদের সাথে সহানুভূতিশীল তাদের সাথে কাঁধ মিলিয়ে এবং যারা তাদের বিরোধী তাদের সাথে নিষ্ঠুর আচরণ করে।

চার মাস অবরোধের পর ৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে আরবরা যেরুজালেম দখল করে নেয়। মাত্র আট বছর আগে হেরাক্লিয়াস এখানে প্রকৃত ক্রুশ বহন করে আনেন আর খ্রিস্টানরা এ নিয়ে উল্লসিত ছিল কিন্তু আবার নগরীটি হাতছাড়া হল, এবার চিরতরে।

দ্বিধাগ্রস্ত পারস্য সম্রাটদের হাত থেকে সিরিয়ার অবশিষ্টাংশ দখল হয়ে যায় যেমনটা হয়েছিল মেসোপটেমিয়ায়। বাস্তবিক পক্ষে পারসিকরা রোমানদের বিরুদ্ধে যেমন শক্তিমত্তা ও জেদের সাথে লড়াই করেছিল তারা এই নতুন শক্তির কাছে অসহায় বোধ করল। পারসিকরা একের পর এক যুদ্ধে পরাস্ত হতে লাগল এবং ৬৪১ খ্রিস্টাব্দে তাদের আর কোনো প্রতিরোধের শক্তি রইল না।

শুধু বিশ বছর আগে যে পারস্য ক্ষমতার শীর্ষে আরোহণ করেছিল এখন তারা আর কেউ রইল না। আরবদের সামনে এখন শুধু দেশ দখলের মহোৎসব।

ইতিমধ্যে সিরিয়া থেকে আরব বাহিনীর একাংশ আমর ইবন আল-আসের নেতৃত্বে দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হয়। ৬৪০ খ্রিস্টাব্দে পেলুসিয়ামে তাকে আমন্ত্রণ জানানো হয় একদা তেরোশ বছর পূর্বে যেখানে সেনাকেরিবের সৈন্যের অবস্থান ছিল।

একমাস অবরোধের পর আমর শহরটি দখল করে নেন। প্রথম যুদ্ধটি ছিল শেষ যুদ্ধ এবং বিনা যুদ্ধেই মিশর দখল করা হয়, যেমনটা ঘটেছিল হিক্সসদের সময়।

৬৪১ খ্রিস্টাব্দে পরাজয়ের গ্লানি বুকে নিয়ে হেরাক্লিয়াসের মৃত্যু হয় এবং পরের বছর ৬৪২ খ্রিস্টাব্দে আমর আলেক্সান্দ্রিয়া দখল করে নেন। একটি প্রতিআক্রমণে রাজকীয় বাহিনী নগরটি পুর্নদখল করে তবে খুব সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য। হাজার বছরের গ্রিক ও রোমান গৌরবের এখানেই সমাপ্তি।

প্রবাদ আছে যে, আলেক্সান্দ্রিয়ার লাইব্রেরি এই সময়ে চূড়ান্তভাবে ধ্বংস করা হয়। লাইব্রেরির গ্রন্থসমূহ আমরের সামনে নিয়ে আসা হয়। কথিত আছে তিনি বলেছিলেন “এই বইগুলি যদি পবিত্র কোরানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় তাহলে এগুলি অপ্রয়োজনীয় আর যদি পবিত্র কোরানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হয় তাহলে এগুলি ক্ষতিকর। অতএব উভয় ক্ষেত্রেই এগুলি ধ্বংস করা প্রয়োজন। তবে অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন এটা নেহায়েত গল্প, সত্য নয়। কয়েক শতাব্দী ধরে মিশরের খ্রিস্টান শাসকদের পৌত্তলিক বিরোধী শক্ত অবস্থানের ফলে ধ্বংস করার মতো খুব কম গ্রন্থই টিকে ছিল।

.

মুসলিম মিশর

মিশরের মনোফাইসাইটরা ভেবে থাকতে পারে যে, কনস্টান্টিনোপলীয় নিয়ন্ত্রণ থেকে বেরিয়ে আসতে পারলে তারা স্বাধীনভাবে তাদের ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালন করতে পারবে আর প্রকৃতপক্ষে আরবরা খ্রিস্টানদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল।

আরবদের মিশর বিজয়ের বিশ বছরের মধ্যেই মুসলিম সৈন্যরা দক্ষিণে নুবিয়ার দিকে অগ্রসর হয়ে আফ্রিকার অবশিষ্ট রোমান প্রদেশগুলি দখল করে নেয়। কার্থেজ অধিকার করা হয় ৬৯৮ খ্রিস্টাব্দে এবং আফ্রিকার সমগ্র উত্তর উপকূল মুসলিম নিয়ন্ত্রণে আসে ৭১১ খ্রিস্টাব্দের মধ্যেই। মিশরীয় খ্রিস্টানরা কখনোই ইউরোপীয়দের আত্মীয় ভাবতে পারেনি। ৬৮০ খ্রিস্টাব্দে কনস্টান্টিনোপলে ষষ্ঠ ধর্মীয় সম্মেলন আহবান করা হয়েছিল, তবে দুইটি বিবদমান বিশ্বাসের মধ্যে আপোস মীমাংসা করা সম্ভব হয়নি।

মিশরীয় খ্রিস্টানরা নিঃসন্দেহে নিজেদেরকে পরিত্যক্ত ভেবেছিল, প্রথমত মুসলিম বিজয়ের দ্বারা এবং দ্বিতীয়ত ইউরোপীয় অনমনীয়তার দ্বারা। তাই মিশর ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হতে থাকে। তিন হাজার পাঁচশত বৎসর পূর্বে প্রতিষ্ঠিত রাজধানী মেসি অবশেষে চূড়ান্তভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। এর কাছেই আল-ফুস্তাতে মুসলমানদের একটি নতুন রাজধানী নির্মাণ করা হয়।

৭০৬ খ্রিস্টাব্দে প্রাচীন ভাষার পরিবর্তে আরবী ভাষাকে দাপ্তরিক ভাষা হিসাবে গণ্য করা হয়। ধীরে ধীরে খ্রিস্টানরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে থাকে, কারণ এতে করে সরকারি সুযোগ সুবিধা পাওয়ার পথ খুলে যায়। তবে মিশরের সমৃদ্ধি ক্রমেই হ্রাস পেতে থাকে, কারণ আরবরা মরুসন্তান হওয়ায় কৃষির ব্যাপারে অনুৎসাহী ছিল। কাজেই তারা খালগুলির যত্ন নিতে আগ্রহ দেখায়নি এবং এগুলি ধীরে ধীরে অবক্ষয়ের দিকে যেতে শুরু করে। সারাদেশে অনাহার দুর্ভিক্ষ বিস্তার লাভ করে যাতে করে দেশ দারিদ্রপীড়িত হয়ে পড়ে যা বর্তমানকাল পর্যন্ত বহাল আছে।

স্থানীয় মিশরীয়রা বেশ কয়েকবার বিদ্রোহ করে। ৮৩১ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহ অত্যন্ত নিষ্ঠুরতার সাথে দমন করা হয় যার পরে আর কখনো বিদ্রোহ দেখা দেয়নি (তবে মিশর থেকে খ্রিস্টধর্ম পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে যায়নি এখনও মিশরের পাঁচ শতাংশ লোক কপ্টিক মতবাদে বিশ্বাসী খ্রিস্টান)। মিশরীয় খ্রিস্টানরা নুবিয়ায় (বর্তমানে যা ইথিওপিয়া) সেখানে খ্রিস্টান মিশনারী প্রেরণ করে এবং বর্তমানে সে দেশটিতে খ্রিস্টানরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ।

প্রাচীন মিশরের সবকিছুই শেষ হয়ে গেছে- নগর, ভাষা, ধর্ম, সমৃদ্ধি- তবে ভূখণ্ড ও জনগণ এখনও সেখানে টিকে আছে আর আমি এবার মিশরের বর্তমান ইতিহাস নিয়ে কথা বলতে চাই। অষ্টম শতাব্দীতে প্রতিষ্ঠিত মুসলিম সাম্রাজ্য এত বিস্তার লাভ করেছিল যে তার অখণ্ডতা বজায় রাখা কঠিন হয়ে পড়েছিল। নবম শতাব্দীতে তাদের মধ্যে বিবদমান গোষ্ঠীর আবির্ভাব হয়।

৮৬৬ খ্রিস্টাব্দে কিছুদিনের জন্য তোলনীয় নামে একটি দুর্বল রাজবংশের অধীনে মিশর একটি স্বাধীন দেশে পরিণত হয়। ৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে অধিকতর শক্তিশালী ফাতেমীয়রা মিশরের শাসনভার গ্রহণ করে। প্রথম ফাতেমীয় শাসক আল-ফুসাতকে রাজধানী হিসাবে পরিত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেয়, যা তিন শতাব্দী ধরে মিশরের রাজধানী ছিল। ৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে এখান থেকে তিন মাইল উত্তরে আল-কাহিরা (বিজয়ী) নামে এক নতুন নগর প্রতিষ্ঠা করে। আমরা একে বলি কায়রো আর প্রায় এক হাজার বছর ধরে এটাই মিশরের রাজধানী।

আল-হাকিম ছিলেন ফাতেমীয় শাসকদের মধ্যে সবচেয়ে কঠোর। একজন গোড়া মুসলমান হিসেবে তিনি খ্রিস্টানদের উপর কঠিন নির্যাতন চালান। ১০০৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি যেরুজালেমের হলি সেপালকার গির্জা ধ্বংস করে ফেলেন। এতে করে ইউরোপে কঠিন ক্ষোভের সঞ্চার হয় আর এটাই ছিল ক্রুসেডের সূত্রপাত।

ক্রুসেডের মাধ্যমেই ইউরোপীয় ইতিহাসে মিশরের পুনরাবর্তন ঘটেছিল। চার শতাব্দী ধরে ইউরোপ একটি অন্ধকার যুগ অতিক্রম করছিল। মিশর ছিল সেই দিগন্তের বাইরে। ১০৯৬ খ্রিস্টাব্দে দুর্বলভাবে সংগঠিত খ্রিস্টান বাহিনী পূর্বে প্যালেস্টাইনের দিকে অগ্রসর হয় এবং অসংগঠিত মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিজয় অর্জনে সক্ষম হয়। ১০৯৯ খ্রিস্টাব্দে তারা যেরুজালেম দখল করে নেয়।

ইতিমধ্যে ফাতেমীয় বংশ অবক্ষয়ের চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে যায়। সালাদিন ইউসুফ বিন আইয়ুব একজন উজির (আমরা যাকে বলি প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতা দখল করে নেয়। ইউরোপীয়দের কাছে তিনি সালাদিন নামে পরিচিত। নয় শতাব্দী পূর্বে তৃতীয় টলেমীর পরে তিনি মিশরের সবচেয়ে যোগ্য শাসক। তিনি সিরিয়া ও মিশর তার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসেন এবং ক্রুসেডারদের তাড়িয়ে দিয়ে ১১৮৭ খ্রিস্টাব্দে যেরুজালেম দখল করেন।

তবে তার দুর্বল উত্তরাধিকারীদের সময়ে ক্রুসেডাররা আবার ফিরে আসে এবং এমনকি মিশর দখলেরও চেষ্টা করে। ইউরোপের সবচেয়ে উচ্চাকাক্ষী প্রচেষ্টা ছিল ফ্রান্সের নবম সুইয়ের (সেন্ট লুই) অধীনে। ১২৪৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি নীল নদের ব-দ্বীপে অবতরণ করেন। তবে ১২৫০ খ্রিস্টাব্দে লুই পরাজিত ও বন্দী হন। মিশরীয় শাসকরা মামলুক বাহিনীর (আরবীতে মামলুক শব্দের অর্থ ক্রীতদাস) সহায়তায় দেশ শাসন করে। ক্রমান্বয়ে মামলুকদের শক্তি বৃদ্ধি ঘটতে থাকে।

মধ্য এশিয়ার একটি যাযাবর জাতি যখন ঝড়ের বেগে পশ্চিম দিকে এগিয়ে আসছে মিশরে তখন একজন মামলুক সেনাপতি বাবর সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন। মঙ্গলরা চীন এবং পারস্য অধিকার করে নেয় আর ক্রুসেডাররা যখন সিরিয়া ও মিশরে নিষ্ফল সংগ্রামে রত তখন মঙ্গলরা সমগ্র রাশিয়া অধিকার করে নেয়। এবার তারা অভিযান চালায় দক্ষিণ এশিয়ায়। চল্লিশ বছর ধরে মঙ্গলরা কোনো যুদ্ধেই পরাজিত হয়নি।

তবে ১২৬০ খ্রিস্টাব্দে তারা উত্তর প্যালেস্টাইনে বাবরের (ভারতের বাবর নয়) মুখোমুখি হয়। সমগ্র বিশ্বকে চমকিত করে এই যুদ্ধে বাবরের মামলুক বাহিনী বিজয় লাভ করে। মঙ্গলরা পিছু হটে যায়। তাদের অপরাজেয়তার কাহিনী কল্পকথা হয়ে রইল। সমগ্র মিশর বাবরের অধিকারে চলে এল।

বেশ কয়েক শতাব্দী ধরে মামলুক শাসন চলতে থাকে। অবশেষে অটোমান তুর্কিরা তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে সামনে এগিয়ে এল। তারা ধীরে ধীরে এশিয়া মাইনর দখল করে নিল এৱং ১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দে ইউরোপে অভিযান চালিয়ে কনস্টান্টিনোপল দখল করে নেয়। তাদের শক্তি যে শুধু ইউরোপীয় খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে প্রয়োগ হয় তাই নয় তারা এশিয়া ও আফ্রিকার মুসলমানদের বিরুদ্ধেও যুদ্ধ করে।

অটোমান সুলতান প্রথম সেলিম ১৫১৭ খ্রিস্টাব্দে মামলুক সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে কায়রো পর্যন্ত অগ্রসর হন। কিছুদিনের জন্য মিশরকে পশ্চাদপসরণ করতে হয়। এরপর ধীরে ধীরে অটোমান শক্তি দুর্বল হতে থাকে এবং ১৬৮৩ খ্রিস্টাব্দে শেষবারের মতো ভিয়েনার প্রাচীরে তারা আঘাত হানে। তবে অস্থীয় ও রুশ বাহিনীর আক্রমণে তারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। ১৭৬৯ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ অটোমান শক্তি এতই দুর্বল হয়ে পড়ে যে, মামলুকরা আবার মিশর দখল করে নেয়।

পশ্চিম ইউরোপ এবার অটোমান শক্তিকে থামিয়ে দিতে সক্ষম হল। সাড়ে পাঁচশ বছর পূর্বে নবম লুইয়ের পর ফরাসী বাহিনী ১৭৯৮ খ্রিস্টাব্দে আরেকবার মিশর আক্রমণ করে বসল। এবার ফরাসী বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন নেপোলিয়ন বোনাপার্ট। মামলুকরা আরও একবার সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করে। তবে তাদের পুরনো যুগের তলোয়ার জাতীয় ভোঁতা অস্ত্রশস্ত্র এবং অনিয়ন্ত্রিত বাহিনী আধুনিক যুগের একজন শ্রেষ্ঠ সেনাপতির সামনে দাঁড়াতে পারেনি। পিরামিডের যুদ্ধে মামলুক বাহিনী সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। নেপোলিয়ন মিশর থেকে চলে যেতে বাধ্য হন শুধু ব্রিটিশ নৌবাহিনীর কারণে। ব্রিটিশরা তার সরবরাহ লাইন বিচ্ছিন্ন করে দেয় যা মিশরীয় বা তুর্কি বাহিনী পারেনি।

১৮০৫ থেকে ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মোহাম্মদ আলীর দৃঢ় শাসনে মিশর সত্যিকারের স্বাধীনতা ভোগ করে। ১৮১১ খ্রিস্টাব্দে তিনি মামলুক নেতাদের বিজয়োৎসব পালনের জন্য একটি দুর্গে আমন্ত্রণ জানান এবং তারা সেখানে এলে সবাইকে হত্যা করেন। এখানেই মামলুক বংশের ছয় শতাব্দীর রাজত্বের অবসান ঘটল।

ভূ-মধ্যসাগর ও লোহিত সাগরের মধ্যে একটি সংযোগ খাল খননের গুজব আকাশে বাতাসে শোনা যাচ্ছিল। ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে মিশরীয় শাসক প্রথম আব্বাস (মোহম্মদ আলীর নাতি) ফরাসী উদ্যোক্তা ফার্ডিন্যান্ড দ্য লেসেপসূকে সুয়েজ যোজকের উপর দিয়ে খাল খননের অনুমতি প্রদান করেন। ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে মোহম্মদ আলীর আর এক নাতি ইসমাইল দাপ্তরিকভাবে সুয়েজ খাল খুলে দেন।

অবশ্য ইসমাইলের বিলাসিতাপূর্ণ জীবনযাপন মিশরকে অর্থনৈতিকভাবে দেউলিয়া করে দেয়। যার ফলে ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে মিশর বাধ্য হয় ব্রিটেনের কাছে সুয়েজ খালের নিয়ন্ত্রণ বিক্রি করে দিতে। ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ ব্রিটেন মিশর অধিকার করে নেয়।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে অটোমান সাম্রাজ্য শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে এবং বিভিন্ন আরবী ভাষাভাষী রাষ্ট্রকে স্বাধীনতার আশ্বাস দেওয়া হয়। ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে গ্রেট ব্রিটেন মিশরকে নামমাত্র স্বাধীনতা দিতে রাজি হয় এবং মিশরীয় শাসক ইসমাইলের কনিষ্ঠ পুত্র প্রথম ফুয়াদ নিজেকে রাজা ঘোষণা করেন। তবে গ্রেট ব্রিটেন মিশরে সামরিক নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখে।

১৯৩৬ সালে ফুয়াদের পুত্র প্রথম ফারুক শাসনভার লাভ করেন এবং ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে মিশর লীগ অ নেশন্স-এ যোগ দেয়। ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটেন নাৎসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয় এবং মিশরীয়দের বাধ্য করে ব্রিটিশের পক্ষে থাকতে। তারপর ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে ইতালি যোগ দেয় জার্মানীর সাথে। যেহেতু মিশরের পশ্চিমের দেশ লিবিয়া ছিল ইতালির নিয়ন্ত্রণে কাজেই উত্তর আফ্রিকায় যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল।

ইতালি কর্তৃক মিশর আক্রমণ সহজেই প্রতিহত করা হয় আর ব্রিটেন লিবিয়া পর্যন্ত যুদ্ধকে এগিয়ে নেয়। মিত্রকে সাহায্য করার জন্য জার্মানী এগিয়ে আসে এবং ব্রিটেনকে আবার মিশরে তাড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়। মিশর আলেক্সান্দ্রিয়ার ৬৫ মাইল পশ্চিমে আল-আমিন পর্যন্ত সরে আসতে বাধ্য হয়।

১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বরে ব্রিটিশ বাহিনী আল-আমিন থেকে প্রতিআক্রমণ শুরু করে এবং বিজয় লাভ করে। জার্মান বাহিনী এক হাজার মাইল পিছিয়ে যায়। মিশর রক্ষা পায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মিশর পূর্ণ স্বাধীনতা দাবি করে। ধীরে ধীরে ব্রিটিশরা মিশর ছেড়ে চলে যায় শুধু সুয়েজ খালের উপর তাদের নিয়ন্ত্রণ রেখে দেয়।

ইতিমধ্যে উত্তর-পূর্ব দিকে মিশরের এক নতুন শত্রুর আবির্ভাব ঘটে। বহু শতাব্দী ধরে ইহুদিরা তাদের স্বদেশভূমি জুডিয়াতে প্রত্যাবর্তনের স্বপ্ন দেখে আসছিল। অবশেষে তাদের জন্য সুযোগ এসে গেল। ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে আরব ভাষাভাষী পৃথিবীর প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও প্যালেস্টাইনে ইসরায়েল নামে এক স্বাধীন ইহুদি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা হয়। মিশর চেয়েছিল শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে তা রোধ করতে। তবে ইসরায়েলের কাছে তাদের অপমানজনক পরাজয় ঘটে।

মিশরে সাধারণ লোকের মধ্যে একটি ব্রিটিশ তথা পাশ্চাত্যবিরোধী মনোভাব দানা বাঁধতে থাকে। ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে একটি বিদ্রোহের সূত্রপাত হয়। অনেক বিদেশিকে হত্যা করা হয়। রাজা ফারুককে সিংহাসন ত্যাগে বাধ্য করা হয় আর মিশরের সাথে পশ্চিমের সম্পর্ক তিক্ত হয়ে উঠে। ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে একজন মিশরীয় সেনাধ্যক্ষ গামাল আব্দেল নাসের ক্ষমতা দখল করে নেন এবং একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করেন।

মিশর পরিকল্পনা গ্রহণ করে প্রথম প্রপাত আসোয়ানের কাছে একটি বিশাল বাঁধ নির্মাণের, যাতে করে মনুষ্যনির্মিত একটি বিরাট হ্রদের সৃষ্টি হবে এবং এর ফলে হাজার হাজার একর উর্বর ফসলীভূমির উৎপত্তি ঘটবে। যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে অর্থ সাহায্যের প্রত্যাশা করা হয়েছিল। তবে মিশর চেষ্টা করছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন ও সমাজতান্ত্রিক দেশসমূহের সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন করার এবং আমেরিকার সেক্রেটারী অব স্টেট ফস্টার ডালেস এর ঘোর বিরোধী ছিলেন। ১৯৫৬ সালে অপ্রত্যাশিতভাবে তিনি ঘোষণা করেন যুক্তরাষ্ট্র সাহায্য প্রদানে ইচ্ছুক নয়।

ক্ষুব্ধ মিশর বাধ্য হয়েই সোভিয়েত ইউনিয়নের দিকে আরও বেশি করে ঝুঁকে পড়ে। নাসের সুয়েজ খালের জাতীয়করণ করেন, যাতে করে বিদেশি নিয়ন্ত্রণের শেষ চিহ্ন মুছে যায় এবং এতে করে সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছ থেকে অর্থ সাহায্যের প্রতিশ্রম্নতি পান।

ব্রিটেন, ফ্রান্স এবং ইসরায়েল ডালেসের বোঝা বহন করতে ইচ্ছুক ছিল না। তারা ঐক্যবদ্ধভাবে সমাজতান্ত্রিক শিবিরে মিশর যাতে যোগ দিতে না পারে সে জন্য মিশরের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে যুদ্ধ ঘোষণা করে। মিশর হয়তো সেটা প্রতিরোধ করতে পারতনা কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন অবিলম্বে এই যুদ্ধ বন্ধের দাবি জানায়। আর ডালেস তার বোকামির ফাঁদে ধরা পড়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে আপোস করতে বাধ্য হন। আমেরিকা আরব দেশসমূহের সাথে তার বন্ধুত্ব বিলিয়ে দিতে চায়নি। কাজেই আক্রামক বাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়।

এরপর পরিস্থিতি যা দাঁড়ায় তাকে শান্তি বলা যায় না। মিশর ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে চায় এবং তাকে সুয়েজ খাল ব্যবহার করতে দিতে চায়না এবং ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য আরব দেশসমূহকে ঐক্যবদ্ধ করতে থাকে। সোভিয়েত ইউনিয়ন দেখল মধ্যপ্রাচ্যে তার প্রভাব বিস্তারের এটি একটি বড় সুযোগ (পঞ্চাশের দশকে আমেরিকার দোদুল্যমানতাকে ধন্যবাদ)। কাজেই সোভিয়েত ইউনিয়ন মিশর ও অন্যান্য আরব দেশে অঢেল অস্ত্র সরবরাহ করতে থাকে। ইতিমধ্যে ইসরায়েল ফ্রান্সের কাছ থেকে অস্ত্র লাভ করে এবং তার বিশ লক্ষ সৈন্যের এক বিরাট বাহিনী গড়ে তোলে।

নাসের চেষ্টা করেন তার ইসরায়েলবিরোধী নীতির দ্বারা সমস্ত আরব ভূখণ্ডে তার প্রভাব বজায় রাখতে। ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি ছয় বছর মেয়াদে প্রেসিডেন্ট পুণর্নির্বাচিত হন। তিনি সিরিয়ার সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখেন এবং যেসব আরব দেশ ইসরায়েল ও পশ্চিমের সাথে নমনীয় মনোভাব পোষণ করে তাদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেন। এমনকি তিনি ইয়েমেন ও দক্ষিণ পশ্চিম আরবে একটি অসফল যুদ্ধেরও সূত্রপাত করেন।

অবশেষে ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি সঠিক অবস্থানে চলে আসেন। তিনি ইসরায়েল সীমান্তে সৈন্য প্রেরণ করেন এবং দক্ষিণ লোহিত সাগরে ইসরায়েলী জাহাজের প্রবেশ বন্ধ করে দেন, ইসরায়েলের পূর্ব সীমান্তের প্রতিবেশী জর্ডানের সাথে মৈত্রী স্থাপন করেন। তার আশা ছিল ইসরায়েলকে ক্ষেপিয়ে দেওয়া এবং ঐক্যবদ্ধ আরব রাষ্ট্রের সংখ্যাগরিষ্ঠের চাপে ইসরায়েলকে নিশ্চিহ্ন করা। পাঁচ জুন তিনি ইসরায়েলকে যুদ্ধে নামতে বাধ্য করেন।

তৃতীয়বারের মতো ইসরায়েল মিশরকে অপমানজনক পরাজয় এনে দেয়। সেই সাথে জর্ডান ও সিরিয়াও পরাজিত হয়। কায়রো শহরের জনসংখ্যা প্রায় ষাট লক্ষ। এটি আফ্রিকা মহাদেশের সর্ববৃহৎ শহর। যদি অভ্যন্তরীণ সমস্যা নিরসন করতে পারে তাহলে মিশর এখনও বিশ্ব ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এই সমস্যা সমাধান করতে হলে ইসরায়েলের সাথে তাকে এক ধরনের সমঝোতায় আসতে হবে। যে যুদ্ধ জয় করা যাবেনা, তা অনন্তকাল চালিয়ে যাওয়ার কোনো অর্থ হয় না। তাতে করে তার জনগণের আরও দুর্দশা বাড়তে পারে। কিন্তু তবু যতদিন মধ্যপ্রাচ্য সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের টানাপোড়েনের মধ্যে ঘুটি হিসাবে ব্যবহৃত হবে ততদিন শান্তির প্রত্যাশা দুরূহ। আধুনিক বিশ্বে কোনো একটি দেশে কি শান্তি বিরাজ করতে পারে, যদি সর্বত্র অশান্তির বাতাবরণ চলতে থাকে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *