০৫. সাম্রাজ্যের উত্থান

৫. সাম্রাজ্যের উত্থান

পুনরায় থিবিস

একদিকে উত্তরে যখন হিক্সসরা রাজত্ব করছে, থিবিসে তখন মধ্য সাম্রাজ্যের গৌরবগাথা বুকে ধারণ করে আমেনের পুরোহিতরা রাজ্য চালাচ্ছে। তারা ক্রমান্বয়ে ক্ষমতা সুসংগঠিত করেছিল, আর এটা সহজ হয়েছিল, সাংঘর্ষিক অবস্থা সৃষ্টির জন্য কোনো বৃহৎ শক্তির অস্তিত্ব ছিলনা- অন্ততপক্ষে আপার মিশরে- আর তারা বড় কিছু করার পরিকল্পনা করছিল।

হিক্সসদের আগমনের প্রায় সত্তর বছর পর ১৬৪৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে থিবীয় শাসকরা নিজেদেরকে রাজা বলে ঘোষণা করে আর সঙ্গতকারণেই তারা নিজেদেরকে সমগ্র মিশরের সত্যিকারের রাজা মনে করতে থাকে। এভাবেই এক নূতন রাজবংশের সূচনা ঘটে মেনেথো যার নাম দেন সপ্তদশ রাজবংশ।

প্রথমদিকে থিবীয় রাজাদের অবস্থা তেমন আকর্ষণীয় বোধ হয়নি। উত্তরাঞ্চল মূলত হামলাকারীদের দখলেই রয়ে যায়। নুবীয়দের দুর্গ পুড়িয়ে ধ্বংস করে দেয়া হয়। তাদের অধিকারে যেটুকু রয়ে যায় তা মূলত তাদের নিজ নগর আর উত্তর দক্ষিণে একশ মাইল দীর্ঘ নীলনদের সংকীর্ণ উপত্যকা। আর এটুকুও নিজেদের অধিকারে রাখতে তাদের অনেক ঘাম ঝরাতে হয়।

দুটি বিষয় তাদের অনুকূলে কাজ করেছিল। যদি একটি যুদ্ধবাজ জাতি কঠোরভাবে সরল জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয় আর তারা যদি কোনো সভ্য দেশ জয় করে তা দখলে নেয়, তাহলে অতি শীঘ্রই তারা বিলাসী এবং আয়েশি জীবনে আসক্ত হয়ে পড়ে, আর অতি শীঘ্রই কষ্টকর সামরিক জীবনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ে।

তারা যুদ্ধপ্রিয় থাকে না (ঐতিহাসিকরা যুদ্ধের প্রতি এই অনীহাকে প্রায়ই অবক্ষয়ের লক্ষণ বলে ধারণা করেন, তবে যুদ্ধের প্রতি এই বিতৃষ্ণাকে একটি অসভ্য জাতির সভ্যতার দিকে পদক্ষেপ বলেও মনে করা যেতে পারে)।

সে যা-ই হোক না কেন, হিক্সসরা স্থায়ীভাবে বসবাস করে নমনীয় হতে শুরু করে। শাসকরা, বিশেষ করে নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা আচরণ এবং ভাবভঙ্গিতে মিশরীয় হয়ে পড়ে আর সে কারণেই আর আগের মতো যুদ্ধনিপুণ থাকতে পারে না।

দ্বিতীয়ত, গোপন অস্ত্রটি যুদ্ধে ব্যবহৃত হয়ে যাওয়ার পরে আর গোপন থাকে না। দক্ষিণ মিশরীয়রা ইতিমধ্যে অশ্ব ও রথের ব্যবহার রপ্ত করে নেয়, আর হিক্সসদের সাথে সমানে সমানে লড়াই করতে সক্ষম হয়।

সপ্তদশ রাজবংশের রাজারা হিক্সসদের সাথে যুদ্ধ করে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। তারা তাদের ক্ষমতা উত্তর দিকে সম্প্রসারিত করে আর আক্রমণকারীদের এলাকা ধীরে ধীরে সঙ্কুচিত হতে থাকে। হিক্সসদের শেষ রাজা কামোসের রাজত্বের শেষদিকে তাদের রাজ্যের সীমা রাজধানীর মধ্যেই আবদ্ধ হয়ে পড়ে।

কামোস বা সামগ্রিকভাবে হিক্সস, কাউকেই আর শেষ বিজয় দেখার অপেক্ষায় থাকতে হয়নি। কী ঘটেছিল সেটা জানা যায়নি। অনুমান করা যেতে পারে কামোসের মৃত্যুর পর তার কোনো সন্তান জীবিত ছিল না। সম্ভবত তার দূর সম্পর্কের কোনো ভাই ক্ষমতা গ্রহণ করেছিল। সেটা হয়ে থাকলে তাকে কোনো মতেই নূতন রাজবংশের সূচনা বলে গ্রহণ করা যায় না। আমরা ঠিক জানিনা মানেথো রাজবংশ নির্ণয়ের জন্য কোন মানদণ্ড ব্যবহার করেছিলেন। হয়তো মানেথো ভেবেছিলেন হিক্সসদের বিতাড়নের পর একটা নূতন রাজবংশের প্রতিষ্ঠা অপরিহার্য ছিল, সেখানে ক্ষীণ পারিবারিক সম্পর্ক বড় বাধা ছিল না।

অষ্টাদশ রাজবংশ (সপ্তদশ রাজবংশের মতোই) মিশরের ইতিহাসে তেমন মহত্ত্ব অর্জন করতে পারেনি। ১৫৭০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয় যার প্রথম প্রতিনিধিত্ব করেন আহমোসে এবং তিনি তার পূর্বসূরির সম্ভবত ভাই, এবং আমোসের আর কাজ সমাপ্ত করেন।

বদ্বীপের এক চূড়ান্ত যুদ্ধে তিনি হিক্সসদের শেষ রাজা তৃতীয় এ্যাপোফিসকে সম্পূর্ণরূপে পরাজিত করে মিশরের বাইরে তাড়িয়ে দেন। এমনকি তিনি হিক্সসদের প্যালেস্টাইন পর্যন্ত তাড়িয়ে নিয়ে যান এবং সেখানে আরও একবার তাদের পরাজিত করেন।

এভাবেই হিক্সসরা হঠাৎ করেই ইতিহাসের পাতায় ঢুকে প্রায় দেড় শতাব্দীব্যাপী এক সমৃদ্ধ সাম্রাজ্য শাসন করে হঠাৎ করেই আবার রহস্যজনকভাবে নিঃশব্দে ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে যায়। সিরিয়া এবং আশেপাশের অঞ্চলের সেমিটিক গোত্রের লোকদের সাথে হিক্সসদের আলগা হলেও এক ধরনের সম্পর্ক ছিল, আর এখন তারা সেই এলাকাতেই ফিরে গেল। তবে হিক্সসরূপে তাদের আর কোনো পরিচয় রইল না, আর বিভিন্ন সেমিটিক গোত্র যেমন কেনানীয়, ফিনিসীয়, এ্যামোরীয় পরিচয়ে ভূমধ্যসাগরের পূর্ব তীরে দীর্ঘদিন মিশরীয়দের সাথে যুদ্ধ করেছিল।

হিক্সসদের সাথে মোকাবেলা শেষ করার পর আহমোস উত্তরে নুবিয়া পর্যন্ত মিশরীয় ক্ষমতা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার কাজে মনোনিবেশ করেন এবং প্রভাবশালীদের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। হিক্সস উপাখ্যান থেকে মিশরীয়রা অন্তত একটি মূল্যবান শিক্ষা লাভ করেছিল, আর উদ্ধত অভিজাতরা সিংহাসনের প্রতি আনুগত্য প্রকাশে বাধ্য হয়েছিল। এভাবেই মিশরীয় পরিস্থিতি মহান চতুর্থ রাজবংশের আবহে প্রত্যাবর্তন করেছিল। আহমোসের শাসনকাল এভাবেই প্রায় দুই শতাব্দীব্যাপী অস্থিরতার পরে ক্ষমতা সংহত করতে পেরেছিল। তাই পরবর্তী মিশরীয় ইতিহাসকে বলা হয় নূতন সাম্রাজ্য।

সন্দেহ নাই হিক্সসদের আমলে যেসব এশীয় জাতি মিশরে প্রবেশ করেছিল, প্রকৃত মিশরীয়রা ক্ষমতায় পুনরাবর্তনের পরেও তাদের কেউ কেউ রয়ে যায় আর তারা স্বাভাবিকভাবেই “পঞ্চমবাহিনী” হিসেবে কাজ করেছিল। তাই নিরাপত্তার কারণে এশীয়দের সকল প্রকার অধিকার থেকে নিবৃত্ত করে রাখা হয়েছিল। এই ক্রীতদাসত্ব থেকে মুক্তিলাভেক্স জন্যই ইহুদিরা ফারাওদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল।

তবে অন্তত একটা বিষয়ে প্রাচীন ও মধ্য সাম্রাজ্য থেকে নতুন সাম্রাজ্যের পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়, আর তা হলো মিশরীয়রা জীবনের সত্য উপলব্ধি করতে পেরেছিল। তারা বুঝতে শিখেছিল, পৃথিবীতে তারাই একমাত্র জাতি নয়। মিশরের চারদিকে যে সব জাতি তাদের বেষ্টন করে আছে তারা সবাই নিকৃষ্ট প্রাণী নয়। তাদের চারপাশে আরও অনেক যুদ্ধবাজ জাতি রয়েছে যারা তাদের ধ্বংস করে দিতে পারে আর মিশরকে গুঁড়িয়ে দেয়ার আগেই তাদের গুঁড়িয়ে দিতে হবে।

মিশরীয় বাহিনীতে এবার যুক্ত হলো রথ, যার ঐতিহ্য রয়েছে শক্তিশালী শত্রুর বিরুদ্ধে বিজয় লাভের। সম্রাটদের আবির্ভাব ঘটল যাদের শক্তিশালী সৈন্যবাহিনী পরিচালনার মাধ্যমে মিশরের বাইরে বিজয়লাভের অভিজ্ঞতা হয়েছিল। রাজা এখন শুধু পুরোহিত আর ঈশ্বর নন, তিনি এখন একজন মহাশক্তিধর সেনাপতিও বটে। এভাবেই রাজা তার প্রজাদের কাছে আরও মহৎ হয়ে উঠল। ঈশ্বররূপে জনগণের কাছে তার ভাবমূর্তি ছিল শান্ত, অপ্রদর্শনীয় শস্য উৎপাদনের প্রতীক, তবে সেনাপতিরূপে তিনি ছিলেন উগ্র ভয়ংকর মূর্তিরূপে।

নতুন সাম্রাজ্যে মিশরীয় রাজারা এক নতুন উপাধি অর্জন করেছিল। ইতিপূর্বে মিশরের সাধারণ লোক স্রাটের নাম উচ্চারণ করে তাকে অপবিত্র করা হয়েছে বলে মনে করা হতো। বর্তমানকালে আপনি বলার পরিবর্তে যেমন সম্বোধন করা হয় ইয়র ম্যাজেস্টি, এমনকি বর্তমান গণতান্ত্রিক আমেরিকাতেও সম্বোধন করা হয় মিঃ প্রেসিডেন্ট, অথবা বলা হয় হোয়াইট হাউস মনে করে যে- তেমনি মিশরীয়রা সম্রাটের উল্লেখ করতে গিয়ে তার প্রাসাদের নামানুসারে বলত “পে-রো” যার বর্তমান রূপ ফারাও।

আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে বলতে হয়, এই উপাধিটা অষ্টাদশ রাজবংশের পূর্বে ব্যবহৃত হয়নি, এটা আমাদের কাছে এসেছে বাইবেলের কল্যাণে। বাইবেলে যে সব কাহিনী লিপিবদ্ধ আছে সে সব ঘটনার সূত্রপাত নব্য রাজবংশকে কেন্দ্র করে। ওল্ড টেস্টামেন্টে অনৈতিহাসিকভাবে ফারাও কথাটা আব্রাহামের সাথে দ্বাদশ এবং যোসেফের (ইউসুফ) কালের কল্পকথা যুক্ত করা হয়েছে নব্য রাজবংশের সাথে।

.

সম্প্রসারণ

প্রথম আমহোসের পুত্র ও উত্তরাধিকারী প্রথম আমেনহোটেপ সিংহা নে আরোহণ করেন ১৫৪৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে (কোনো কোনো মিশর তত্ত্ববিদ আমেনোফিস নামটা বেশি পছন্দ করেন, কারণ মিশরীয় নামের ব্যাপারে মতপার্থক্য না থাকলেও উচ্চারণের ব্যাপারে কিছুটা পার্থক্য রয়ে গেছে)।

প্রথম আমেনহোটেপের অধীনেই মিশরে এক নতুন ধারার সূত্রপাত ঘটল। তার সেনাদল নুবিয়ার গভীর পর্যন্ত সাম্রাজ্য বিস্তার ঘটাল ইতিপূর্বে যে সীমা বিস্তৃত ছিল তিন শতাব্দী পূর্বে তৃতীয় আমেনেমহাটের আমলে। নীল নদের পশ্চিমে সিনাইয়েরও ওপারে ছিল তার সাম্রাজ্যের পরিসর।

মিশরের পূর্বপ্রান্তে বিশাল সাহারা মরুভূমি। তবে এমনকি মধ্য সাম্রাজ্যের আমলেও এটা আজকের মতো ততটা শুষ্ক ও জনহীন ছিলনা। উপকূলীয় অঞ্চল প্রচুর লোক পোষণের উপযোগী যথেষ্ট উর্বর ছিল। আজ যেখানে শুধু কিছু ঝোঁপঝাড় আর কিছু ছাগল ভেড়া ছাড়া আর কিছুই দেখা যায়না, সেকালে সেখানে ছিল পর্যাপ্ত আঙুর বাগান, আর জলপাইয়ের উদ্যান। আর মরুদ্যানগুলিও ছিল অসংখ্য আর সুবিস্তৃত।

পরবর্তী শতাব্দীসমূহে গ্রিকরা মিশরের পশ্চিম উপকূলে কলোনি স্থাপন করে। স্থানীয় অধিবাসীদের কাছ থেকে গ্রিকরা মিশরের পশ্চিমের উত্তর আফ্রিকার বিস্তীর্ণ এলাকার নাম দিয়েছিল “লিবিয়া”। তাই ইতিহাসে এই এলাকার মরুদ্যানে বসবাসরত লোকরা পরিচিত ছিল “লিবীয়” নামে এলাকাটা এখনও লিবিয়া নামেই পরিচিত, (আর ১৯৫১ সালে স্বাধীন লিবিয়া রাষ্টের পরিচিতি লাভ করে)। লিবীয়রা জাতিগতভাবে মিশরীয়দের সমগোত্রের হলেও সংস্কৃতিগতভাবে ছিল অনেক। পশ্চাৎপদ। নীল নদের পলিবাহিত উর্বর মাটি মিশরীয়দের জন্য খাদ্যের নিশ্চয়তা প্রদানের কারণে, মিশরীয়রা প্রচুর সম্পদ সঞ্চয় করতে পেরেছিল, যা মিশরে এক উন্নত সভ্যতার জন্ম দিয়েছিল। প্রান্তিক সম্পদের অধিকারী হওয়ায় লিবীয়দের সে সুযোগ ছিলনা, পশুচারী যাযাবররা বেশিদূর অগ্রসর হতে পারেনি।

লিবীয়রা মাঝে মাঝে পূর্বদিকে নীল উপত্যকার শান্তিপূর্ণ কৃষি অঞ্চলে আক্রমণ পরিচালনা করাটাকে লাভদায়ক মনে করত। চকিত আক্রমণে হতবুদ্ধি করে দিতে পারলে লুটের মাল বেশ ভারীই সংগ্রহ করা যেত আর প্রতিশোধমূলক আক্রমণে মিশরীয়রা ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা লিবীয়দের তেমন কাবু করতে পারতনা।

এসব হামলার সংখ্যা বেড়ে যেত যখন মিশরীয়রা নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাতে লিপ্ত থাকত। কারণ এমন অবস্থায় মিশরীয়দের জন্য সীমান্তের উপর নজরদারি রাখা কঠিন ছিল। হিক্সস আমলে যখন মিশরে চলছিল দারুণ বিশৃঙ্খল অবস্থা, তখনই লিবীয়রা সেই সুযোগ গ্রহণ করেছিল আর সেই অবস্থা মিশরীয়দের জন্য ছিল চরম বেদনাদায়ক।

প্রথম আমেনহোটেপ বুঝতে পেরেছিলেন লিবীয়দের ঠেকিয়ে রাখার একমাত্র উপায় পশ্চিম দিকে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা। নীলের পশ্চিমের মরুদ্যানসমূহ এবং উপকূলের শক্ত ঘাটিগুলি অবশ্যই মিশরীয় সেনাবাহিনীকে স্থায়ীভাবে দখলে নিতে হবে। লিবীয় আক্রমণকারীদের যদি আসতেই হয়, তাহলে আরও দক্ষিণের ঘাটি থেকে আসতে হবে। তাদেরকে বহুদূরের পথ অতিক্রম করে আসতে হবে এবং ফিরেও যেতে হবে বহু দূরের পথে। সেক্ষেত্রে তাদের অবিরাম মিশরীয় আক্রমণের ঝুঁকির সম্মুখীন হতে হবে। এক্ষেত্রে লাভের চাইতে ঝুঁকির মাত্রাই বেশি হবে।

প্রথম আমেনহোটেপ তার পরিকল্পনা সঠিকভাবে রূপায়ণ করতে পেরেছিলেন বলেই মিশরীয় ক্ষমতার সীমানা তৃতীয় এবং চতুর্থ রাজবংশের তুলনায় চতুর্দিকে অনেক বেশি দূর পর্যন্ত সম্প্রসারিত হতে পেরেছিল। উত্তরে নুবীয়, পশ্চিমে লিবীয় এবং উত্তর-পূর্বে কেনানীয়দের উপর প্রভুত্ব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিল। সেজন্যই এই সময়টাকে মিশরীয় সাম্রাজ্য বলে অভিহিত করার একটা প্রবণতা লক্ষ করা যায়।

প্রথম আমেনহোটেপের কোনো পুত্র, এমনকি আপাতদৃষ্টিতে কোনো উত্তরাধিকারীও ছিলনা, তবে এটাও সঙ্গত মনে হয়না যে তিনি একজন দখলদার ছিলেন, মানেথো তাকে দিয়ে কোনো রাজবংশের সূচনা করেননি, বরং নূতন রাজা এবং তার বংশধরকে অষ্টম রাজবংশের অংশ হিসেবেই দেখিয়েছিলেন। সম্ভবত আমেনহোটেপের কোনো পুত্র ছিলনা আর তার জামাতাই সিংহাসনের উত্তরাধিকার লাভ করেন। তার আইনসঙ্গত উত্তরাধিকার নিশ্চিত হয় তার স্ত্রীর অধিকারের মাধ্যমে।

সে যাই হোক, ১৫২৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ক্ষমতায় আসীন হলেন প্রথম থুতমস, আনেক সময় যে নামটি উচ্চারিত হয় খতমেস নামে। প্রথম থুতমস আমেনহোটেপের নীতি কঠোরভাবে অনুসরণ করেন। তিনি আরও দক্ষিণে চতুর্থ প্রপাত পর্যন্ত অগ্রসর হন, যাতে করে নীল নদের প্রায় বারোশত মাইল পর্যন্ত তার অধিকারে চলে আসে এক বিশাল এলাকা। নূতন ফারাওর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ত্ব ভূমধ্যসাগরের পূর্ব উপকূল নিজের অধিকারে নিয়ে আসা যেটা পরবর্তী তিন শতাব্দীব্যাপী মিশরের অংশ রয়ে যায়।

যেখানে কেনানীয়রা বাস করত, গ্রিকরা যাকে বলত সিরিয়া, সেখানে একটা উন্নত সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। মরু সাগরের ঠিক উত্তরে জেরিকো নামে যে শহরটি গড়ে উঠেছিল, সেটা ছিল পৃথিবীর সর্বপ্রাচীন শহরগুলির অন্যতম, যার সময় নির্ধারণ করা হয় ৭০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এক কৃষিভিত্তিক সমাজে, যে সময়ে নীল এবং ইউফ্রেতিস তাইগ্রিস এলাকায় সভ্যতার স্পর্শ লাগেনি।

কেনানীয় শহরগুলির সাথে কোনো নদীপথের সংযোগ ছিলনা, তাই এগুলি কার্যকরভাবে ঐক্যবদ্ধও হতে পারেনি। তাদের ইতিহাসের অন্তকাল পর্যন্ত এগুলি পৃথক নগররাষ্ট্ররূপেই রয়ে যায়। তাই তারা একদিকে ঐক্যবদ্ধ মিশর এবং অন্যপাশে বেবিলনিয়ার সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় টিকে থাকতে পারেনি। শুধু মিশর ও বেবিলনিয়ার দুর্বল মুহূর্ত ছাড়া তারা কখনোই স্বাধীন রাষ্ট্ররূপে টিকে থাকতে পারেনি, সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা তো অনেক দূরের কথা।

মিশরীয় সৈন্যরা ইতিপূর্বেও সিরিয়ায় প্রবেশ করেছিল। মধ্য সাম্রাজ্যের সুবর্ণ যুগে তৃতীয় আমেনেমহাট এক শহর দখল করেছিলেন যাকে “শেখেম” বলে চিহ্নিত করা হয় যার অবস্থান ছিল সিনাই উপদ্বীপের সীমান্ত থেকে প্রায় একশ মাইল উত্তরে। প্রথম আমহোস যেখানে হিক্সসদের তাড়া করে সিরিয়ায় ঢুকে পড়ে, আর প্রথম আমেনহোটেপ সেখানে বিজয় অর্জন করেন।

প্রথম থুতমস এর চেয়েও বেশি কিছু করতে চেয়েছিলেন। তিনি এক বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে সিরিয়ায় প্রবেশ করে ইউফ্রেতিসের উজানে কার্ধেমিশ দখল করে নেন, যা সিনাই উপদ্বীপ থেকে চারশ মাইল উত্তরে। তার উপস্থিতির চিহ্নস্বরূপ সেখানে তিনি একটা পাথরের স্তম্ভ স্থাপন করেন। মেঘবিহীন ভূখণ্ডের সন্তান, মিশরীয় সৈন্যরা বৃষ্টির মুখোমুখি হয়ে ভাবল তাদের উপর আকাশ থেকে নীল নদ ঝরে পড়ছে। তারা ইউফ্রেতিসের স্রোতোধারার গতিপথ দেখেও অবাক হয়েছিল, “যে নদীর প্রবাহিত হওয়ার কথা উত্তর দিকে তা প্রবাহিত হচ্ছে দক্ষিণ দিকে।”

নূতন রাজত্বের আগমনে স্থাপত্যের এক অভিনব আড়ম্বরপূর্ণ রীতির প্রচলন ঘটল। পিরামিড স্থাপনের প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় রীতির অবসান ঘটল। নূতন করে আর কোনো পিরামিডের স্থাপনা হলোনা। তার পরিবর্তে ফারাওরা তাদের প্রচেষ্টা নিয়োজিত করল বিশালাকৃতি স্তম্ভ আর বিপুলায়তন মূর্তি স্থাপনায়।

সুদৃশ্য অলঙ্করণের ধারা বহমান রইল অষ্টম রাজবংশের ফারাওদের রাজধানী থিবিসে। এসময় একাদশ বা দ্বাদশ রাজবংশের মতো বদ্বীপ বা লেক মোয়েরিসের দিকে ধাবিত হওয়ার প্রবণতা দৃষ্টিগোচর হলোনা। হয়তো নিম্ন মিশর তার মর্যাদা অনেকটা হারিয়ে ফেলেছে, কারণ, যে সময় থিবিস স্বাধীন, সে সময়ে এ অঞ্চলটা হিক্সসদের অধীনে ছিল। তাছাড়া দীর্ঘ নুবীয় এলাকা মিশরীয় আধিপত্যে আসার ফলে থিবিস আরও বেশি কেন্দ্রীয় অবস্থানে এসে গেল।

থুতমস এবং তার উত্তরসূরিরা থিবিসে বিশাল বিশাল মন্দির নির্মাণ করেন। প্রত্যেক রাজাই চেষ্টা করেন প্রস্তরখণ্ডের প্রাচুর্যে ও অলঙ্করণের আতিশয্যে তার পূর্বসূরিকে অতিক্রম করতে। এই উদ্দেশ্য নিয়েই থুতমস থিবিসের উত্তরপ্রান্তে আমেনে তার মন্দির নির্মাণ করেন যে স্থানটি এখন আধুনিক কাৰ্মাক গ্রামের অন্ত গত। থিৰিসের দক্ষিণ অংশে পরবর্তীকালে আরও একটা বিশাল জাঁকজমকপূর্ণ মন্দির নির্মাণ হয়েছিল।

থিবিস নগরটির অবস্থান ছিল নীল নদের পূর্ব তীরে। পশ্চিম তীরে গড়ে উঠেছিল বিশাল এক সমাধিসৌধ। তখন পর্যন্ত শবদেহকে সুরক্ষিত রাখার ব্যবস্থা করতে হতো যাতে শবদেহের সাথে প্রদত্ত অলঙ্কারসমূহ নিরাপদ থাকে। ইতিপূর্বে গৃহীত পদক্ষেপসমূহ নিষ্ফল প্রমাণিত হয়েছিল। তাই থুতমস অন্য কিছু একটা ভেবেছিলেন।

পর্বতপ্রমাণ পিরামিড নির্মাণ করে তার মাঝে শবদেহকে রাখার পরিবর্তে তিনি প্রাকৃতিক পাহাড়কে নির্বাচন করেছিলেন। পর্বতের পাশ দিয়ে সুড়ঙ্গ খুঁড়ে পর্বতের নিচে মাটির গভীরে মৃতদেহ রাখার ব্যবস্থা করেছিলেন এবং সেই কবরের সুরক্ষার সব রকমের ব্যবস্থাই নিয়েছিলেন। কবর-তস্করদের বোকা বানাবার জন্য কবরে প্রবেশের করিডর বানিয়েছিলেন গোলকধাঁধার আকারে। মূল্যবান রত্নসমূহ যেখানে রাখা হতো সেই প্রকোষ্ঠ সুরক্ষার সর্বপ্রকার ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল এবং অনুরূপ প্রকোষ্ঠ আরও অনেকগুলি বানানো হতো। একটি সমাধি স্থাপন করা হয়েছিল মাটির গভীরে ৩২০ ফিট নিচে এবং সেখানে পৌঁছানোর আঁকাবাঁকা পথটি ছিল ৭০০ ফিট দীর্ঘ।

পাহাড়ের নিচের প্রথম সমাধিটি ছিল প্রথম থুতমসের, তবে পরবর্তী অন্তত আরও ষাটজন ফারাও এই পদ্ধতিটি অনুকরণ করেছিল। প্রকৃতপক্ষে উপত্যকাটি একটি মৃতের নগরীতে পরিণত হয়েছিল। তবে এসব কিছুই কোনো কাজে আসেনি। ঘুরপাক খাওয়া সুড়ঙ্গপথ, ধূর্ত মেকি পথ, গুপ্ত প্রবেশপথ, শক্তিশালী তন্ত্রমন্ত্র কোনোকিছুই কাজে আসেনি। একটি ছাড়া সব কবরই মাত্র কয়েক দশকের মধ্যেই তছনছ হয়ে যায়। যে একটি কবর আধুনিক কাল পর্যন্ত টিকে থাকে সেটা কেবল দৈবক্রমে। পরবর্তী কবর খননের বালি পাথরের আবর্জনাপ আগেরটির প্রবেশপথ ঢেকে দিয়েছিল আর তাই পরবর্তী পঁয়ত্রিশ শতাব্দীব্যাপী আর কেউ সেই আবর্জনাভূপের দিকে দৃষ্টি দেয়নি।

প্রথম থুতমসের রাজত্বকাল থেকে শুরু করে বেশ কয়েক শতাব্দীব্যাপী থিবিস ছিল পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে মহান জাঁকজমকপূর্ণ এক নগরী। অপরিমেয় বাহুল্যময় রাজধানী জনমনে শুধু যে অহেতুক অহংকারের জন্ম দেয় তাই নয়, সম্ভাব্য শত্রুদের মাঝেও সমীহর সঞ্চার করে। এটাকে একপ্রকার মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধরূপেও গ্রহণ করা যায়। আধুনিককালে তৃতীয় নেপোলিয়ন এই তত্ত্বটি গ্রহণ করেছিলেন।

.

মহান রানি

প্রথম থুতমসের পরে আবির্ভাব হয়েছিল এক উল্লেখযোগ্য শাসকের। তিনি ছিলেন তার পুত্র এবং উত্তরাধিকারী। প্রথম থুতমসের রাজত্বের শেষভাগে তিনি পিতার সাথে শাসনকার্যে অংশগ্রহণ করতেন, আর নিজের হয়ে রাজত্ব করেন অতি অল্প সময়ের জন্য, যদি অবশ্য তেমনটা করার মোটেই সুযোগ হয়ে থাকে। প্রকৃতপক্ষে সত্যিকারের শাসকরূপে আবির্ভাব ঘটেছিল এক নারীর, যিনি ছিলেন প্রথম থুতমসের কন্যা আর দ্বিতীয় থুতমসের স্ত্রী।

মিশরীয়দের একটা স্বাভাবিক প্রচলিত প্রথা ছিল নিজের ভগ্নীকে বিবাহ করা, যে প্রথাটি আমাদের অস্বাভাবিক বলে মনে হয়। এনিয়ে হয়তো অনেক যুক্তি দাঁড় করানো যায়। এমনটা হতে পারে উত্তরাধিকার বর্তিত হতো কন্যার মাধ্যমে, পিতৃতান্ত্রিকতা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পূর্বে দীর্ঘদিন এই প্রথাটি প্রচলিত ছিল, অথবা এমনটা হতে পারে তখন পর্যন্ত কৃষিকাজের দায়িত্ব ন্যস্ত ছিল নারীদের উপর (আর পুরুষদের দায়িত্ব ছিল শিকার করার), তাই ভূমির অধিকার বর্তাত নারীদের উপর। এই রীতি মিশরীয়রা শক্ত করে আঁকড়ে ধরেছিল বহু শতাব্দীব্যাপী, আর কন্যাকে বিবাহ করার পূর্ব পর্যন্ত রাজপুত্র কখনোই রাজ্যের উত্তরাধিকারী হতে পারেনি, কারণ কন্যাই ছিল প্রকৃত উত্তরাধিকারী।

এমনও হতে পারে যে মিশরীয় রাজপুত্রকে অবশ্যই তাদের সমকক্ষকে বিবাহ করতে হবে- রাজগৃহ থেকে প্রায়ই যে উন্নাসিক প্রথাটির বিরোধীতা আসত। এধরনের একটা মনোবৃত্তি বর্তমানে ইউরোপীয় রাজপরিবারেও দৃষ্টিগোচর হয়। ইউরোপীয় রাজপরিবারে বিবাহ প্রায়ই সীমাবদ্ধ থাকে প্রথম কাজিনের মধ্যে। তবে গীর্জার ধর্মবিশ্বাসের কারণে সাধারণের মধ্যে এই প্রথাটির বিরোধীতা হয়ে থাকে। সীমিত সংখ্যার কারণে, রাজপরিবারের ব্যাপারে গীর্জার পক্ষ থেকে কিছু ছাড় দেয়া হয়েছে।

এই গৌরবের যুগে মিশরীয় রাজপরিবারের সমকক্ষ আর কোনো পরিবার ছিলনা। উন্নাসিকতার কারণেই ভ্রাতা-ভগ্নীর বিবাহ ছাড়া গত্যন্তর ছিলনা। যে ক্ষেত্রে পিতার একাধিক স্ত্রী থাকত, সেক্ষেত্রে সৎ ভাইবোন। দ্বিতীয় থুতমস তার সৎ বোন হাশেপসুতকে বিয়ে করেছিলেন। ১৪৯০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে দ্বিতীয় থুতমসের মৃত্যুর পর তার এক রক্ষিতার পুত্র (হাৎশেপসুতের পুত্র নয়) তাত্ত্বিকভাবে তৃতীয় থুতমসের ফারাও হিসাবে সিংহাসনের উত্তরাধিকার লাভের কথা থাকলেও অল্প বয়সের কারণে শাসনকার্য চালাতে সক্ষম ছিলেন না এবং তার প্রতিনিধিরূপে সম্মা হাশেপসুতই সাম্রাজ্যের দায়িত্ব পালন করেন।

তিনি ছিলেন অত্যন্ত ক্ষমতাধর এক নারী, আর শীঘ্রই একজন ফারাওর সকল ক্ষমতাই গ্রহণ করে বসেন। তিনি যেসব স্মৃতিস্তম্ভ বানিয়েছিলেন তাতে সর্বদাই তাকে একজন পুরুষের পোশাকে দেখা যায়, এমনকি তাতে কোনো স্তনের রেখা দেখা যায়না বরং মুখে কৃত্রিম দাড়িগোফই শোভা পায়। তিনিই ইতিহাসের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ নারী শাসক।

অবশ্য কৃত্রিম দাড়িতেই সবকিছু সমাধান হয়ে যায়না। তিনি দক্ষতার সাথে সৈন্য পরিচালনা করতে পারতেন না, তাই আশা করতেন তার সেনাধ্যক্ষরা এমনকি সাধারণ সৈন্যরাও তার অনুগত হয়ে চলবে। এই বংশের যুদ্ধময় ইতিহাসে তার রাজত্বকালই ছিল সবচেয়ে শান্তিপূর্ণ আর তিনি তার রাজ্যকে লুটের দ্বারা নয় বরং শিল্পের দ্বারা সমৃদ্ধ করতে পেরেছিলেন। তিনি বিশেষ উৎসুক ছিলেন সিনাইয়ের খনি এবং চেষ্টা করেছিলেন মিশরের বাণিজ্য সম্প্রসারণে।

তিনি থিবিসের ওপারে এক সুদৃশ্য মন্দির নির্মাণ করেছিলেন যাতে তিনি পান্টের সাথে বাণিজ্য সম্পর্ক স্থাপনের দৃশ্যসমূহ অঙ্কিত করান। যেসব দ্রব্য আমদানি করা হতো সেগুলি, এমনকি তার মধ্যে একটা চিতাবাঘ এবং কিছুসংখ্যক বানরও অন্তর্ভুক্ত ছিল (হাৎশেপসুত কি এগুলো পোষার জন্য এনেছিলেন নাকি তার কোনো চিড়িয়াখানা ছিল)।

চতুষ্কোণ স্তম্ভ (ওবেলিস্ক) সাধারণত নির্মাণ করা হতো সূর্যদেবতা রী’র প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের জন্য। এগুলি দীর্ঘ পাতলা, উপরের দিকে সামান্য সরু সোজা করে স্থাপিত পাথরের স্তম্ভ এবং শীর্ষদেশ পিরামিডের মতো তীক্ষ্ণ। আদিতে উজ্জ্বল ধাতুর পালিশ দেওয়া ছিল যাতে পবিত্র সূর্যের কিরণ প্রতিফলিত হতে পারে ( এতে প্রতিফলিত ছায়া সূর্যঘড়ির মতো সময় নিরূপণে সহায়তা করত নাকি?)। “ওবেলিস্ক” শব্দটা এসেছে গ্রিক ভাষা থেকে যার অর্থ “সুচ”।

চতুষ্কোণ স্তম্ভ সর্বপ্রথম নির্মিত হয় প্রাচীন রাজবংশের আমলে, আর সে সময় এগুলি তেমন উঁচু ছিলনা। একক এ্যানাইট প্রস্তরখণ্ড কেটে মিশরীয়রা এই স্তম্ভ নির্মাণ করত, আর এগুলি যত দীর্ঘ হতে থাকে ততই এগুলি সামাল দেয়া কঠিন হয়ে পড়ে। এগুলি সূর্যঘড়ি হিসাবেই হোক বা স্মৃতিস্তম্ভ হিসাবেই হোক, দশ ফিট উচ্চতাকেই উঁচু বলে গণ্য করা হতো।

মধ্য রাজবংশের আমলে যখন অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্রাকৃতি পিরামিড নির্মাণ করা হতো, তখন ওবেলিস্ক নির্মাণে বেশি শ্রম দেয়া সম্ভব ছিল। এগুলি স্থাপন করা হতো মন্দিরের সামনে, প্রত্যেক দরজার দুপাশে। প্রায় প্রত্যেক মন্দিরের প্রবেশপথেই ছিল এসব আকর্ষণীয় বস্তু। হেলওপলিস ছিল এসব স্তম্ভ দ্বারা সমৃদ্ধ। এগুলি মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল অগুনতি আর এগুলির উপর থেকে নিচ পর্যন্ত হিয়ারোগ্লিফিকে উল্কীর্ণ ছিল সেইসব রাজার কীর্তিকাহিনী যার আমলে এটি নির্মিত হয়েছিল আর ছিল রাজার ইচ্ছামতো আত্মপ্রশংসা। মধ্য রাজবংশের একটা ওবেলিস্কের উচ্চতা ছিল ৬৮ ফিট।

নূতন রাজবংশের আমলে যখন পিরামিড নির্মাণ সম্পূর্ণরূপে পরিত্যক্ত হয়েছিল, তখন বিশাল উচ্চতার ওবেলিস্ক নির্মাণ একটা উন্মাদনায় পরিণত হয়। প্রথম থুতমস একটি ওবেলিস্ক নির্মাণ করেন যার উচ্চতা ছিল ৮০ ফিট, এরপর হাৎশেপসুতের নির্মিত স্তম্ভ দুটির প্রত্যেকটির উচ্চতা ছিল ৯৬ ফিট করে।

সর্বোচ্চ ওবেলিস্ক যা আজও টিকে আছে, সেই ১০৫ ফিট ওবেলিস্কটি নির্মিত হয় রোমে। আর একটি ৬৯ ফিট ওবেলিস্ক, যেটা তৈরি হয়েছিল হাশেপসুতের উত্তরাধিকারের আমলে, সেটা ১৮৮১ সালে নিউইয়র্ক সেন্ট্রাল পার্কে বয়ে আনা হয়। সেখানে এটা পরিচিতি লাভ করে মিশরের সবচেয়ে বিখ্যাত রানি ক্লিওপেট্রার নামানুসারে “ক্লিওপেট্রার সুচ” নামে যিনি রাজত্ব করেছিলেন ওবেলিস্কটি নির্মাণের প্রায় ১৫০০ পরে। লন্ডনেও রয়েছে আর একটা ক্লিওপেট্রার সুচ।

মিশরে যেসব ওবেলিস্ক নির্মিত হয়েছিল তার মধ্যে আজ পর্যন্ত দাঁড়িয়ে রয়েছে মাত্র তিনটি, একটা হেলিওপলিসে আর দুটি থিবিসে। শেষের দুটির মধ্যে একটি প্রথম থুতমস আর অন্যটি হাৎশেপসুতের আমলে।

ওবেলিস্ক আধুনিক মানুষের কাছে একটা ধাঁধা হাজির করে। এগুলি ভীষণ ভারী, সবচেয়ে ভারীটির ওজন প্রায় ৪৫০ টন। এত ভারী একখণ্ড পাথর কিভাবে খাড়া করা হলো সেটা এক দুর্বোধ্য ব্যাপার, যদি সেকালে মিশরীয়দের আয়ত্তে যেসব যন্ত্রপাতি ছিল তা বিবেচনায় নেওয়া হয়। এনিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে, তবে মিশরতত্ত্ববিদরা এব্যাপারে একমত হতে পারেনি, এই একই ধাঁধার সম্মুখীন হতে হয় যখন ভাবি, ব্রিটনরা প্রাচীনকালে কিভাবে স্টোনহেঞ্জ উত্তোলন করেছিল, আর এই ঘটনাটা ঘটেছিল সেই একই সময়ে, মিশরের সিংহাসনে যখন আসীন ম্রাট হাৎশেপসুত। পরবর্তী শতাব্দীগুলিতে পিরামিডের অনুকরণের চেষ্টা না করা হলেও, ওবেলিস্কের অনুকরণ করা হয়েছিল। এর সবচেয়ে উৎকৃষ্ট উদাহরণ ১৮৮৪ সালে ওয়াশিংটন স্তম্ভ যা নির্মাণ করা হয়েছিল জর্জ ওয়াশিংটনের স্মৃতির উদ্দেশে। প্রযুক্তিগত উন্নতির কারণে ওয়াশিংটন স্তম্ভটি মিশরে তৈরি যে কোনো স্তম্ভের চাইতে বিশালাকার। এর উচ্চতা ৫৫৫ ফিট আর এ চতুষ্কোণ ভিত্তি প্রস্তরের প্রত্যেক পার্শ্বদেশ ৫৫ ফিট (এই পাঁচ সংখ্যাগুলি নেহায়েৎ কাকতালীয় নয়)।

যতই রাখঢাক করা হোক না কেন, ওয়াশিংটন মনুমেন্ট মোটেই একক প্রস্ত রখণ্ডে নির্মিত নয়, সাধারণ নির্মাণশৈলীর কারুকাজ আর মিশরীয়দের মতো মোটেই একক প্রস্তরখণ্ডের নিখুঁত নির্মাণকাজ নয়।

.

শীর্ষ দেশ

১৪৬৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে রানি হাশেপসুতের মৃত্যুর সময় তৃতীয় থুতমস প্রায় পঁচিশ বছরের যুবক আর নিজের তেজ ও সাহস দেখাবার জন্য উদগ্রীব। পরবর্তীকালে আমরা তাকে যেভাবে দেখি তাতে মনে হয়না তিনি তার ফুপু-সত্মার আচলবদ্ধ ছিলেন। এতে বোঝা যায় মহিলাটি কী কঠোর প্রকৃতির ছিলেন যাতে তৃতীয় থুতমসের মতো একজন শক্তিমান ব্যক্তিকে কজায় রাখতে পেরেছিলেন।

নূতন ফারাও মহিলার প্রতি কতটা বিতৃষ্ণ ছিলেন আর রানি তার উপর কতটা নিপীড়ন চালিয়েছিলেন তা আর গোপন থাকেনা। হাশেপসুতের রেখে যাওয়া স্মৃতিচিহ্নগুলির প্রতি কতটা অসম্মান দেখিয়েছিলেন। তার নাম যত জায়গা থেকে মুছে ফেলা যায় সেটা তিনি করেছিলেন আর তার জায়গায় পূর্ববর্তী পুতমসের নাম বসিয়েছিলেন। এমনকি তিনি তার মনমেন্টটি অসম্পূর্ণ রেখেছিলেন, যা সেকালের পরিপ্রেক্ষিতে সবচেয়ে বড় অসম্মান।

তারচেয়েও বড় কথা, যে সব ক্ষেত্রে রানি অনুজ্জ্বল ছিলেন সেখানে নিজের ঔজ্জ্বল্য প্রকাশ করা- যেমন সামরিক ক্ষেত্র। এটাকে শুধু আত্মম্ভরিতা মনে করা ঠিক হবেনা, আবশ্যিকতাও বটে। সিরিয়ার পরিস্থিতি তার প্রপিতামহ প্রথম থুতমসের চাইতে অবনতির দিকে যেতে থাকে। একটা নূতন শক্তির উত্থান ঘটেছিল।

দুই শতাব্দী পূর্বে একটি অ-সেমিটিক জাতি হুরীয়রা উত্তর দিক থেকে উঠে এসেছিল। তখন সিরিয়ার সেমিটিক জাতিসমূহের উপর চাপ পড়েছিল আর তাই তারা স্বীয়দের দক্ষিণে মিশরের দিকে তাড়িয়ে দিয়েছিল যাতে হিক্সস আধিপত্য নিরঙ্কুশ হতে পারে। এমনকি হুরীয় সেনাবাহিনীর একাংশ হিক্সস বাহিনীর সাথে মিশে গিয়েছিল।

তবে হুরীয়রা মূলত ইউফ্রেতিসের উজান অঞ্চলেই থেকে যায়, যেখানে তারা “মিত্তানী” নামে এক শক্তিশালী রাজ্যের গোড়াপত্তন করে, যেটি ইউফ্রেতিস ও তাইগ্রিস অঞ্চলের এক সংকীর্ণ ভূখণ্ড। সিরিয়া মিশর সীমান্ত ঘাটিতে তাদের যথেষ্ট প্রভাব পড়ে। সেই অঞ্চলে মিশরীয় প্রভাবের উপর এটা ছিল এক বিপজ্জনক আশঙ্কা।

একজন শক্তিশালী রাজা হয়তো এর থেকে মুক্ত থাকার জন্য উত্তর সীমান্তে প্রতিরোধমূলক আক্রমণ চালাতে পারত, হাশেপসুতের শান্তির নীতি মিশরবাসীদের জন্য সুখকর হলেও দূর সীমান্তে বিপদের কালোছায়া ফেলেছিল।

তৃতীয় থুতমস ক্ষমতালাভের পর সিরিয়ার কেনানীয় রাজা ভেবেছিল এটাই মিশরীয় আধিপত্য খর্ব করার উপযুক্ত সময়। নতুন রাজা একজন নারীর ক্রীড়নক ছিলেন বলে তাদের মধ্যে ধারণা জন্মে তিনি যুদ্ধে তেমন সামর্থ্য দেখাতে পারবেন না, তাছাড়া তাদের পেছনে ছিল নূতন শক্তি মিত্তানী, যারা অর্থ ও সামরিক শক্তি দিয়ে সহায়তার আশ্বাস দিয়েছিল।

তবে তৃতীয় থুতমস এর যোগ্য জবাব দিতে পেরেছিলেন। তিনি যুদ্ধযাত্রা করে সিরিয়ার “মেগিডো” শহরে কেনানীয়দের সম্মিলিত বাহিনীর মুখোমুখি হন। এই শহরটি বাইবেলে উল্লিখিত “আর্মাগেডন” শহর যেটা পরবর্তীকালে বিশ্বখ্যাত যেরুজালেম শহরে পরিণত হয়। সেখানে থুতমস এক মহান বিজয় অর্জন করেন, তারপর ধারাবাহিকভাবে অভিযান চালিয়ে তার আরব্ধ কাজের সমাপ্তি টানেন।

মেগিডোর ১২০ মাইল উত্তরে কাদিশ শহরে তার প্রতিপক্ষ তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে। অবশেষে তৃতীয় থুতমস ১৪৫৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে কাদিশ দখল করতে সমর্থ হন, যদিও এজন্য তাকে ছয়টি অভিযান পরিচালনা করতে হয়।

কাদিশের উত্তরে আরও একটা ভয় ছিল আর তা হলো খোদ মিত্তানীর তরফ থেকে। তৃতীয় থুতমস আরও এগারোটি অভিযান পরিচালনা করেন আর তিনি ইউফ্রেতিস উপত্যকা পর্যন্ত অগ্রসর হন, ইতিপূর্বে যেমনটা করেছিলেন প্রথম থুতমস, তবে এবারের প্রতিপক্ষ অনেক বেশি শক্তিশালী। তিনি ইউফ্রেতিস পার হয়ে যান, যেটা তার পিতামহ করতে পারেননি, এবং মিত্তানীয় রাজ্য আক্রমণ করেন। তার সব সাফল্যের মতো এবারও মিত্তানীকে করদ রাজ্যে পরিণত করেন।

এটা মিশরীয় সৈন্যবাহিনীর জন্য এক বিপুল গৌরবের বিষয়, আর এজন্য প্রথম থুতমসকে বলা হয় “থুতমস দ্য গ্রেট।” অথবা “মিশরের নেপোলিয়ন।” সামরিক সাফল্যই যদি সবকিছু হয়, তাহলে থুতমস একজন সফল জেনারেল হিসেবেই ইতিহাসে চিহ্নিত হয়ে থাকতেন। তবে রাজ্যের সুশাসন নিশ্চিত হওয়ায় মিশর এক সমৃদ্ধ শক্তিশালী দেশরূপে আবির্ভূত হয়। সেজন্য তৃতীয় থুতমসকে সর্বশ্রেষ্ঠ ফারাও বলে অভিহিত করা হয়।

স্বয়ং শাসক হিসেবে ৩৩ বছর সিংহাসনে অধিষ্ঠিত থাকার পর ১৪৩৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তৃতীয় থুতমসের মৃত্যু হয়। তিনি মিশরে যে গতির সঞ্চার করেন, সেই গতিতেই মিশর চলতে থাকে পরবর্তী পৌণে এক শতাব্দীব্যাপী আর এর জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে পঞ্চাশ লক্ষে উন্নীত হয়।

দ্বিতীয় আমেনহোটেপ, চতুর্থ থুতমস, তৃতীয় আমেনহোটেপ, এরা সবাই থুতমস দ্য গ্রেটের পুত্র এবং পৌত্র ছিলেন এবং তারা সবাই মহান ফারাওর ঐতিহ্য সযত্নে লালন করেছিলেন। তারা অবশ্য সাম্রাজ্যের পরিসর বাড়াবার চেষ্টা করেননি, আর এটা করা অবশ্যই বিজ্ঞোচিত হতো না, কারণ ইতিমধ্যে মিশরের সীমানা এতদূর প্রসারিত ছিল, যে পর্যন্ত একটি দেশ নির্বিরোধে শাসন করা যায়। যোগাযোগ ব্যবস্থা এর বাইরে প্রসারিত করা সম্ভব ছিলনা।

চতুর্থ থুতমস সুচিন্তিতভাবে শান্তির নীতি অনুসরণ করেন এবং মিশরীয়দের বিচ্ছিন্নতার নীতি পরিত্যাগ করে এক মিত্তানীয় মেয়েকে বিবাহ করেন। তিনি তৃতীয় থুতমসের আরব্ধ সর্বশেষ ওবেলিস্কটির নির্মাণকাজ শেষ করেন, যে দৈত্যাকার বস্তুটি এখন রোমে বিরাজমান।

চতুর্থ থুতমসের মিত্তানীয় রানির পুত্র তৃতীয় আমেনহোটেপের আমলে মিশরের সমৃদ্ধি চরম শিখরে আরোহণ করে। তৃতীয় আমেনহোটেপ, যিনি ১৩৯৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সিংহাসনে আরোহণ করেন এবং সাইত্রিশ বছর ধরে মিশরের শাসনভার বহন করেন, বাইরে যুদ্ধবিগ্রহ পরিচালনার চাইতে তিনি দেশের ভিতরে বিলাসিতাকে প্রাধান্য দিতেন, মিশরবাসীও তার সাথে সেই বিলাসিতায় অংশীদার হতো। তার পূর্বসূরিরা অবিরাম চেষ্টা করত থিবিসের সৌন্দর্যবর্ধনে আর আমেনের মন্দির সম্প্রসারণে। তিনিও সেই ধারাবাহিকতা বজায় রাখেন চারপাশের করদরাজ্যসমূহ থেকে যে অর্থ আসত সেই অর্থের সাহায্যে।

আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে মিত্তানী রানি “তি”কে তিনি খুব ভালোবাসতেন। বিস্তারিত শিলালিপিতে নিজের সাথে তিনি রানিকেও শামিল করেন আর নীল নদের পশ্চিম তীরে এক মাইল দীর্ঘ বিশাল এক হ্রদ খনন করান।

তার মৃত্যুর পর তার সম্মানার্থে এক চমৎকার মন্দির নির্মাণ করা হয় যার প্রবেশপথের দুপাশে তার দুটি বিশাল মূর্তি স্থাপন করা হয়। সূর্যোদয়ের পরেই উত্তরের মূর্তিটা থেকে এক মধুর ধ্বনি নির্গত হতো। মনে হয় আমেনের পুরোহিতরা ভিতরে কোনো একটা কৌশল সংযোজন করেছিল যাতে সাধারণ মানুষকে অভিভূত করা যায়। আর এটা নিশ্চিত যে শুধু আমেনের ভক্তরাই অভিভূত হতো তাইনা, পরবর্তীকালে গ্রিক পর্যটকরাও চমকিত হতো।

প্রকৃতপক্ষে এসব অত্যাশ্চর্য মৃর্তির কথা গ্রিকদের কাছে অনেক আগেই পৌঁছেছিল, কারণ তাদের অনেকেই কল্পকথায় আস্থা এনেছিল। একটি গ্রিক পুরাণকথায় ট্রয়ের যুদ্ধে (তৃতীয় আমেনহোটেপের আমলের দেড় শতাব্দী পরের ঘটনা) ইথিওপিয়ার এক রাজাকে ঘিরে একটি কাহিনী আছে, নীল নদের অনেক উজানের ইথিওপিয়া সে সময় মিশরের অধিভুক্ত ছিল। যেমনন নামের এই রাজাটি ট্রয়ের পক্ষ নিয়ে যুদ্ধ করেছিল, আর মনে করা হতো সে ছিল উষাদেবী “ঈয়সের” পুত্র। তিনি একিলেসের দ্বারা নিহত হন, আর মেমনন প্রতি প্রভাতে তার মাকে স্মরণ করে গান গাইত। এই মেমননই হয়তো তৃতীয় আমেনহোটেপ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *