১২. রোমান মিশর
রোমানগণ
রোমান সাম্রাজ্য থেকে রোমান প্রদেশে পরিণত হওয়াটা মিশরের পক্ষে তেমন কোনো বিশাল পরিবর্তন নয়। নিশ্চিত করে বলা যায়, মিশরীয় শাসকরা এখন থেকে আলেক্সান্দ্রিয়ার পরিবর্তে রোমে বসবাস শুরু করেন, তবে এতে মিশরীয় কৃষক সম্প্রদায়ের তেমন কিছু আসে যায় না। তাদের কাছে আলেক্সান্দ্রিয়া এবং রোম কোনোটাই বিদেশ বলে অনুভূত হয়নি আর ফারাও ও টলেমীয়দের চাইতে রোমান সম্রাটদেরকে বেশি অপরিচিত বলে বোধ হয়নি। অগাষ্টাস এবং তার পরবর্তী সম্রাটগণ মিশরকে তাদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি মনে করতেন এবং ভালোভাবেই লুটপাট চালাতেন। তবে মিশর এতে চিরকালই অভ্যস্ত ছিল। এক সময় এটা ছিল ফারাওদের সম্পত্তি পরবর্তীকালে টলেমীয়দের, কাজেই চিরকাল এমনটাই চলে এসেছে। রোমানরা যদি করের অতিরিক্ত টোল আদায় করে তাহলে সেটা টলেমীয়দের চাইতে বেশি কিছু ছিল না। আর রোমান সরকারের সুযোগ্য শাসনে সেটা প্রদান করা তেমন কষ্টসাধ্য মনে হয়নি।
ইহজাগতিক সমৃদ্ধির দিক দিয়ে বিচার করলে মিশরের তুলনামূলকভাবে অধিকতর সুবিধাই হয়েছিল। শেষার্ধের টলেমীয়গণের রাজত্বে অবক্ষয় শুরু হয় আর এখন শক্তিশালী রোমান প্রশাসনে অবস্থার অনেকটাই উন্নতি হয়। জটিল খাল-খনন পদ্ধতি যার উপরে কৃষি-ভিত্তিক অর্থনীতির ভিত স্থাপিত ছিল, তার আরও উন্নতি করা হয়। রোমানরা তৈরী করেছিল রাস্তা, নির্মাণ করেছিল জলাধার এবং লোহিত সাগরে বাণিজ্যিক নৌবহর চালু করেছিল। সে সময়ে মিশরের জনসংখ্যা সত্তর লক্ষে উপনীত হয়েছিল এটা অতীতের যে কোনো সময়ের চাইতে অধিক।
বুদ্ধিবৃত্তিক অগ্রগতিও স্তিমিত হয়নি। আলেক্সান্দ্রিয়ার লাইব্রেরি ও জাদুঘর সরকারি প্রণোদনায় সচল ছিল এবং তা ব্যবহারের শর্ত আগের চাইতে নমনীয় ছিল। গ্রিক নগরীগুলির মধ্যে আলেক্সান্দ্রিয়াই ছিল সর্ববৃহৎ এবং আকার ও সমৃদ্ধির দিক দিয়ে রোমকে অতিক্রম করে গিয়েছিল।
অধিকন্তু নীতিগতভাবে মিশরীয়রা সম্পূর্ণ ধর্মীয় স্বাধীনতা ভোগ করত এবং মিশরীয়দের বিশ্বাসের উপর মৌখিক সমর্থন ছিল। এটা মিশরীয় কৃষক সম্প্রদায়ের জন্য সর্বাধিক সন্তুটির বিষয়। ইতিপূর্বে আর কখনো তাদের ধর্মমতের এত ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটে নাই। এতবেশি মন্দির নির্মাণ ও সমৃদ্ধ করা হয়নি। বাধাহীনভাবে মিশরীয় সংস্কৃতি এগিয়ে চলেছিল। গ্রিকরা তাদের কর্মকাণ্ড শুধু আলেক্সান্দ্রিয়াতেই সীমাবদ্ধ রেখেছিল কিন্তু রোমান আমলে তা সমগ্র ভূখণ্ডে বিস্তৃতি লাভ করে। সর্বোপরি রোমান শাসনে পরিপূর্ণ শান্তি বিরাজমান ছিল। সমগ্র ভূমধ্যসাগরীয় এলাকা রোমানদের এই শান্তিতে অংশীদার হতে পেরেছিল। তবে কোনো রোমান এলাকায় মিশরের চাইতে অধিক নিবিড় ও নিরবচ্ছিন্ন শান্তি উপভোগ করতে পারেনি। অবশ্য মাঝে মাঝে দুর্ভিক্ষ ও প্লেগ দেখা দিত এবং উত্তরাধিকার নিয়ে দ্বন্দ্ব-বিবাদ সৃষ্টি হতো, তবে দীর্ঘস্থায়ীভাবে চিন্তা করলে এগুলি তেমন মারাত্মক ছিল না।
অগাষ্টাস নিজেই এই শান্তি-নীতির উদ্বোধন করেছিলেন। দানিয়ুবের দক্ষিণ এবং এল নদীর পশ্চিমে বর্বরদের আক্রমণ প্রতিহত করেছিলেন। যাতে এই সীমার বাইরে তার সাম্রাজ্যের পরিধি বিস্তৃত করা যায়।
কাজেই রোমানদের মিশর অধিকারের অল্পদিনের মধ্যেই রোমান ভাইসরয় গেয়াস পেট্রোনিয়াসের ধারণা জন্মে যে ফারাওদের সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থা কার্যকরভাবে গ্রহণ করাই অধিকতর সুবিধাজনক। তিনিও নুবিয়ায় অভিযান চালাতে পারেন এবং ২৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি তাই করেছিলেন আর তাতে তিনি বিজয় লাভও করেছিলেন তবে অগাষ্টাস তাকে ডেকে পাঠান। নুবিয়াতে তাদের কোনো প্রয়োজন নাই এবং শান্তি বজায় রাখাই বেশি প্রয়োজন। তবু এই অভিযান লোহিত সাগরের ওপারে দক্ষিণ আরবে বাণিজ্য সম্প্রসারণে প্রণোদনা যুগিয়েছিল। কোনো যুদ্ধবাজ সম্রাট হলে হয়তো সেই অঞ্চলটি অধিভুক্ত করতে চাইতেন কিন্তু অগাষ্টাস এ ধরনের কোন প্রচেষ্টা করেননি।
৬৯ খ্রিস্টাব্দে একটি স্বল্পকালীন আতঙ্ক দেখা দিয়েছিল। রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে বিদ্রোহ দেখা দেওয়ায় রোমের পঞ্চম সম্রাট নীরো আত্মহত্যা করেন। অগাষ্টাসের কোনো উত্তরাধিকারী জীবিত ছিল না। তাই বিভিন্ন প্রান্ত থেকে রোমান জেনারেলরা ক্ষমতা গ্রাস করার জন্য ছুটে আসতে থাকে।
একটি গৃহযুদ্ধের আশঙ্কায় জনগণ রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করতে থাকে। এমনকি সাম্রাজ্য ভেঙ্গে যাওয়ার আশঙ্কাও দেখা দেয়। যেমনটা ঘটেছিল আলেক্সান্ডারের সাম্রাজ্যে।
সৌভাগ্যবশত অনতিবিলম্বে বিষয়টির নিষ্পত্তি করা সম্ভব হয়। ভেসিয়ান নামে একজন রোমান জেনারেল যিনি প্রাচ্যে বিদ্রোহ দমনে সক্ষম হয়েছিলেন, তিনি মিশরে তার সৈন্য সমাবেশ করেন এবং রোমে খাদ্য সরবরাহ বন্ধ করে দেন (সাম্রাজ্যের প্রায় অধিকাংশ সময় মিশর ছিল রোমের রুটির ঝুড়ি) এর ফলে ছোটখাটো সংঘর্ষের মাধ্যমে সিংহাসন অধিকার করেন।
ভাগ্য ভালো, মিশরের তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি। ভেস্পসিয়ানের সৈন্য সঞ্চালনের সময় তারা বড় কোনো সমস্যার সৃষ্টি করে নাই। কয়েকজন আলোকিত সম্রাটের সিংহাসন অধিকারের ফলে দ্বিতীয় শতাব্দীর সূত্রপাত হয়। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন হাড্রিয়ান। যিনি তার শাসনকালের প্রায় সব সময়ই সারা রাজ্যে ঘুরে বেড়াতেন এবং রাজ্যের বিভিন্ন প্রদেশের অবস্থা যাচাই করতেন। ১৩০ খ্রিস্টাব্দে তিনি মিশর ভ্রমণ করেন। প্রায় দেড় শতাব্দী পূর্বে পম্পেই, জুলিয়াস সিজার, মার্ক এন্টনি ও অক্টেভিয়ানের পরে তিনিই ছিলেন সর্বাপেক্ষা বিশিষ্ট ব্যক্তি।
হাড্রিয়ান নীল নদের উজান ভাটিতে ভ্রমণ করেন এবং সবকিছুই সপ্রশংস দৃষ্টিতে দেখেন। তিনি পিরামিড এবং থিবিসের ধ্বংসাবশেষ পরিদর্শন করেন। তিনি মেমননের সংগীত শ্রবণ করেন (ইতিপূর্বে উল্লিখিত)। তবে এজন্য তিনি বেশি সময় দিতে পারেননি। হাড্রিয়ানের ভ্রমণের কয়েক দশক পরে মূর্তিটির সংস্কার প্রয়োজন হয়। নির্মাণ কাজে কিছু পরিবর্তন আনা হয় যার ফলে এই সংগীত আর শ্রম্নতিগোচর হয় না। মেমননের সংগীত আর কখনোই শোনা যায়নি। হাড্রিয়ানের ভ্রমণের একটি বিষাদময় ঘটনা হল তার সার্বক্ষণিক সঙ্গী এন্টিনোয়াস নীল নদীতে ডুবে মারা যায় (কেউ কেউ মনে করে সে আত্মহত্যা করেছিল)। তার মৃত্যুতে হাড্রিয়ান দারুণভাবে শোকাহত হয়ে পড়েন এবং তার সম্মানার্থে একটি নগর প্রতিষ্ঠা করেন (এন্টিনোপলিস)। সেখানে এই হেভাজন ব্যক্তিটির অনেক চিত্র ও মূর্তি ছিল।
.
ইহুদিগণ
রোমান শাসনের প্রথম দুই শতাব্দীব্যাপী শাসনে সবচেয়ে যে শোচনীয় ঘটনাটি ঘটে তা হলো ইহুদিদের দুর্ভাগ্য। টলেমীয়দের আমলে ইহুদিরা সমৃদ্ধির শীর্ষে অবস্থান করত। তাদের উপাসনার স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছিল এবং তারা গ্রিকদের সমমর্যাদা ভোগ করত। তখন থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত ইহুদিরা কখনো বিদেশে সংখ্যালঘু হিসাবে কারও কাছ থেকে এত ভালো ব্যবহার পায়নি (একমাত্র ব্যতিক্রম বলা যেতে পারে মধ্যযুগে স্পেনে মুসলিম শাসনামলে)। তার বিনিময়ে তারা মিশরের সমৃদ্ধি ও সংস্কৃতিতে অবদান রেখেছিল।
উদাহরণস্বরূপ প্রধানতম আলেক্সান্দ্রীয় দার্শনিকদের মধ্যে একজন ছিলেন ফিলো জুডাইউস। তার জন্য ৩০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে, ক্লিওপেট্রার আত্মহত্যার বছরে অথবা তার অল্প কয়েক বছর পরে। তিনি ইহুদি এবং গ্রিক উভয় সংস্কৃতিতে সুপণ্ডিত ছিলেন। তাই গ্রিকদের কাছে ইহুদি ধর্মতত্ত্বের ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। তার চিন্তা চেতনা প্লেটোর চিন্তার এত কাছাকাছি ছিল যে তাকে ইহুদি প্লেটো বলা হতো।
দুর্ভাগ্যবশত ফিলোর জীবকালেই ইহুদিদের ভাগ্যাকাশ অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। তাদের মধ্যে কিছু সংখ্যক স্বাধীনতা হারানো মেনে নিতে পারেনি এবং এমন একজন রাজার অপেক্ষা করতে থাকে যিনি হবেন স্বর্গীয়ভাবে উদ্দীপ্ত (শেষের কথাটি হিব্রম্ন ভাষায় “মেসিয়া” গ্রিক ভাষায় “খ্রীস্টোস,” ল্যাটিন ভাষায় “খ্রিস্টাস” এবং ইংরেজিতে “ক্রাইস্ট”)। মেসিয়া এসে শত্রুদেরকে পরাস্ত করে একটি আদর্শ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা করবেন এবং তিনি হবেন তার অধীশ্বর যার রাজধানী হবে যেরুজালেম এবং সমগ্র পৃথিবী তার অধীনে চলে আসবে। ইহুদি ধর্মগ্রন্থে এই পরিণতির কথা উল্লিখিত আছে। তাই অধিকাংশ ইহুদি আজ পৃথিবী যেমনটা আছে তেমনটা মেনে নিতে রাজী নয়। বাস্তবিকপক্ষে মাঝে মাঝেই কোনো একজন ইহুদি নিজেকে মেসিয়া বলে ঘোষণা করেন এবং তাকে স্বীকার করে নেওয়ার লোকেরও অভাব হয় না। আর এতে করেই জুডিয়ায় রোমানদের সাথে তাদের বিরোধ সৃষ্টি হয়।
জুডিয়ার চাইতে আলেক্সান্দ্রীয় ইহুদিরা মেসিয়া স্বপ্নে তুলনামূলকভাবে কম আবিষ্ট ছিল তবে গ্রিক ও ইহুদিদের মধ্যে এ নিয়ে একটি চাপা ক্ষোভ বিরাজমান ছিল। তাদের জীবন প্রণালী অনেকটাই ভিন্ন ছিল এবং উভয়েই নিজেদের অবস্থানে অনড় ছিল। ইহুদিরা অনড় ছিল যে তাদের ঈশ্বরই সত্যিকারের ঈশ্বর এবং অন্য ধর্মকে তারা অবজ্ঞা করত, যাতে করে অ-ইহুদিরা বিরক্ত হতো। এদিকে গ্রিকরাও অনড় ছিল যে তাদের সংস্কৃতিই প্রকৃত সংস্কৃতি।
অধিকন্তু গ্রিকরা ইহুদিদের বিশেষ সুযোগ সুবিধা লাভে অসন্তুষ্ট ছিল। পৌত্তলিক বলিদান, ম্রাটের প্রতি স্বর্গীয় আনুগত্য এবং বাধ্যতামূলক সেনাবাহিনীতে যোগদান থেকে ইহুদিদের অব্যাহতি (যেটি গ্রিক ও মিশরীয়দের জন্য বাধ্যতামূলক ছিল) তারা ভালো চোখে দেখেনি। জুডিয়ার রোমান শাসকরা ইহুদিদের ধর্মীয় গোড়ামী এবং রাজকীয় প্রথা নিয়মের প্রতি সামান্য শ্রদ্ধা প্রদর্শনে অনীহায় বিরক্তি বোধ করত। এক সময় উন্মাদ সম্রাট ক্যালিগুলা যেরুজালেমের মন্দিরে তার নিজের একটি মূর্তি স্থাপনের দৃঢ়সংকল্প প্রকাশ করেন আর ইহুদিরা মরিয়া হয়ে এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে প্রস্তুতি নেয়।
ফিলো জুডাইউস নিজেই একটি প্রতিনিধি দলের প্রধান হয়ে এই অধর্মোচিত কার্য থেকে বিরত থাকার আবেদন নিয়ে রোমে গমন করেন। ক্যালিগুলার মৃত্যু এবং তার উত্তরাধিকারীর নিষেধাজ্ঞা থেকেই শুধু এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ সম্ভব হয়। তবে কেবল এই অবসম্ভাব্যতাকে সাময়িকভাবে স্থগিত করা সম্ভব হয়। ৬৬ খ্রিস্টাব্দে ক্ষুব্ধ ইহুদিরা স্বাধীনতার দাবিতে কর প্রদান বন্ধ করে দেয় এবং বিদ্রোহের বিস্ফোরণ ঘটে। রোমান সৈন্যবাহিনী জুডিয়ার দিকে ছুটে যায় আর একটি তিন বছর স্থায়ী অভূতপূর্ব নিষ্ঠুর যুদ্ধের সূচনা হয়। ইহুদিরা অমানবিক নাছোড়বান্দা হয়ে যুদ্ধে টিকে থাকে। উভয় পক্ষেই বিপুলসংখ্যক লোকক্ষয় হয়।
এই যুদ্ধটি রোমান সরকারকে কিছুটা নাড়া দিয়ে যায়। কারণ বিদ্রোহের শুরুতে সম্রাট নীরোকে হত্যা করা হয়, অংশত এ কারণে যে ইহুদিদের তরফ থেকে দুঃসংবাদটির জন্য তিনি দায়ী। জুডিয়া যুদ্ধে রোমান সেনাপতি ভেস্পসিয়ানকে নীরোর স্থলাভিষিক্ত করা হয়। অবশেষে ৭০ খ্রিস্টাব্দে জুডিয়াকে শান্ত করা সম্ভব হয়। ভেসিয়ানের পুত্র টাইটাস যেরুজালেম অধিকার করে ধ্বংস করে ফেলেন। মন্দির ভেঙ্গে ফেলা হয় আর নেবুচাদ্রেজারের পর থেকে ইহুদি ধর্মকে সর্বনিম্ন স্তরে নামিয়ে আনা হয়।
জুডিয়ার বাইরের ইহুদিরা এই যুদ্ধে অংশ নেয়নি আর রোমানদের কাছ থেকে তারা ন্যায়সঙ্গত আচরণ লাভ করেছিল (এমনকি বর্তমান কালে পার্ল হারবারের ঘটনার পর জাপানিরাও আমেরিকানদের কাছ থেকে এমন নমনীয় আচরণ লাভ করেনি)।
অবশ্য মিশরে উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে বিরোধ সামলানো কঠিন হয়ে পড়ে। রক্তাক্ত দাঙ্গা শুরু হয়ে যায়। ইহুদি এবং গ্রিক কেউই এই বিরোধের দায় থেকে মুক্ত হতে পারে না। উভয় পক্ষই নিষ্ঠুর আচরণ করতে থাকে। তবে ইহুদিদের বিয়োগান্ত ক ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় তারা সব সময় ছিল সংখ্যালঘু এবং তারাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আলেক্সান্দ্রিয়ার ইহুদি মন্দির ভেঙ্গে ফেলা হয়। হাজার হাজার ইহুদিকে হত্যা করা হয় এবং আলেক্সান্দ্রিয়ার ইহুদিরা এই দুঃসময় আর কখনোই কাটিয়ে উঠতে পারেনি।
এসব ঘটনার পর মিশরের ইহুদিরা সব সময় রোমান ও গ্রিক শাসনের বিরুদ্ধে বিরূপ মনোভাব প্রকাশ করে এসেছে। সাইরেনিতে তখনও একটি শক্তিশালী ইহুদি কলোনী ছিল, আর ১১৫ খ্রিস্টাব্দে তাদের একটা সুযোগ এসে গেল। সে সময় রোমান সম্রাট ট্রেজান দূরপ্রাচ্যে একটা যুদ্ধে লিপ্ত ছিল। আর রোমান সাম্রাজ্যের শেষ চেষ্টা হিসাবে রোমান বাহিনীকে পারস্য উপসাগরের কাছে নিয়ে গেল। হয়তো মিশরে তার একটি মিথ্যা মৃত্যু সংবাদ প্রচারিত হয়েছিল (সে সময় সম্রাটের বয়স ষাট বছর), অথবা হয়তো একজন মেসিয়ার আবির্ভাব প্রচারিত হয়েছিল। সে যাই হোক না কেন, সাইরেনির ইহুদিরা ক্ষেপে গিয়ে একটি ধর্মোন্মাদ আত্মঘাতী বিপ্লবে জড়িয়ে পড়েছিল। হাতের কাছে যে গ্রিককেই তারা পেয়েছিল তাকেই হত্যা করেছিল, আর বিস্মিত রোমানরা তাদের বিরুদ্ধে একদল সৈন্য পাঠিয়েছিল। দু’বছর ধরে এই বিশৃঙ্খল অবস্থা চলতে থাকে এবং ১১৭ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ মিশর থেকে ইহুদিরা প্রকৃতপক্ষে উৎখাত হয়ে যায়।
এই বিদ্রোহ রোমান ইতিহাসকেও প্রভাবিত করেছিল। মিশরে বিশৃঙ্খলার সংবাদে ট্রেজান ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। রোমান বিজয়ের ঢেউ আর কখনো এতদূর পর্যন্ত আসেনি আর এখান থেকেই রোমের সৌভাগ্যে ভাটা পড়তে শুরু করে। ট্রেজানের উত্তরাধিকার লাভ করেন হাড্রিয়ান। যার কথা আমি আগেই উল্লেখ করেছি একজন রাজকীয় পর্যটক হিসাবে। যেমনটা বর্ণনা করেছি মিশর ভ্রমণের পূর্বেই তিনি নির্জন জুডিয়ার মধ্য দিয়ে অতিক্রম করেন। আর অবশিষ্ট ইহুদিদের ধ্বংসস্তৃপের প্রতি ভক্তিশ্রদ্ধা দেখে বিব্রত বোধ করেন। তার কাছে মনে হয়েছিল বোধ হয় আর একটি বিপ্লব আসন্ন। তাই তিনি আদেশ দিলেন যেরুজালেমকে একটি রোমান নগরী হিসাবে পূনর্নির্মাণের এবং তার পারিবারিক নাম অনুসারে নাম রাখেন “এলিয়া”। আর বিধ্বস্ত ইহুদি মন্দিরের জায়গায় নির্মাণ করেন জুপিটারের এক মন্দির। এই নগরে ইহুদিদের প্রবেশ সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করা হয়।
তবে হাড্রিয়ানের এই কার্যক্রম বিদ্রোহ দূর করার পরিবর্তে আরও বেশি করে উসকে দেয়। আর একজন মেসিয়ার আগমন ঘোষণা করে ইহুদিরা আবার বিদ্রোহ শুরু করে। তাদের মন্দির অপবিত্র করলে ক্ষিপ্ত হয়ে তারা ১৩২ থেকে ১৩৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিন বছর যুদ্ধ চালিয়েছিল। এর ফলে মিশরের মতো জুডিয়াও ইহুদি শূন্য হয়ে পড়ে।
এরপর থেকে ইহুদিবাদের গুরুত্বপূর্ণ আশ্রয় হয়েছিল বেবিলনিয়ার ইহুদি কলোনী যা নেবুচাদ্রেজারের আমল থেকে টিকেছিল এবং ইউরোপীয় কলোনী যা বিদ্রোহে অংশ নেয়নি। তারা সর্বদাই সেখানে রোমানদের সন্দেহের দৃষ্টিতে ছিল।
.
খ্রিস্টানগণ
আলেক্সান্ডার দ্য গ্রেটের সময় থেকে এশিয়া ও আফ্রিকায় গ্রিক সংস্কৃতির বিস্তার কখনো একপাক্ষিক ব্যাপার ছিল না। গ্রিকরা বিদেশি সংস্কৃতির সংস্পর্শে এসেছিল আর তাদের কিছু কিছু বিষয়ের প্রতি আকৃষ্টও হয়েছিল।
বিদেশি ধর্ম তাদের বিশেষ আকর্ষণীয় ছিল কারণ এগুলি ছিল গ্রিক ও রোমান দাপ্তরিক ধর্মের চাইতে অধিকতর বর্ণিল, গভীরভাবে আনুষ্ঠানিকতাপূর্ণ এবং অধিকতর আবেগময়। প্রাচ্যের ধর্মসমূহ ধীরে ধীরে পশ্চিমে প্রসার লাভ করতে থাকে।
রোমানরা ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার পর শান্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে, সংস্কৃতির সংমিশ্রণ আরও দ্রুততর ও সহজতর হতে থাকে। একদা যা ছিল স্থানীয় ধর্ম তা সমগ্র সাম্রাজ্যে বিস্তৃত হতে থাকে।
প্রথম কয়েক শতাব্দীর মধ্যে মিশর এ সব ধর্মের প্রাণবন্ত বিচরণক্ষেত্র হয়ে দাঁড়ায়। গ্রিক ভাবধারায় রঞ্জিত মিশরীয় সেরাপিও মতবাদ প্রথমে গ্রীসে এবং তারপর রোমে বিস্তৃতি লাভ করে। প্রথম দুই ম্রাট অগাষ্টাস এবং টাইবেরিয়াস
এসব সমর্থন করেননি, কারণ প্রাচীন রোমক ধর্মের পুনরুজ্জীবনের একটি ব্যর্থ স্বপ্ন ছিল। তবে যে ভাবেই হোক এটা ছড়িয়ে পড়ে। ইতিমধ্যে ট্রেজান ও হাড্রিয়ানের সময় সাম্রাজ্যের এমন কোনো প্রান্ত বাকি রইল না যেখানে এই ধর্মের অনুসারীদের অভাব ছিল। তিন হাজার বছর পূর্বে পিরামিড নির্মাণের সময় থেকেই এই ধর্মটির প্রচলন ছিল। মিশরীয় দেবী আইসিস-এর ধর্মমত এর চেয়েও বেশি আকর্ষণীয় ছিল এবং তাকে স্বর্গের রানি রূপে চিত্রিত করা হতো। হানিবলের অন্ধকার যুগে রোমানদের যখন ধারণা হয় যে সেই পরাজয় কোনো দেবতার রোষাগ্নি ছাড়া সম্ভব ছিল না, তখন থেকেই রোমে এর প্রভাব দৃষ্টিগোচর হয়। এমনকি নীল নদ থেকে দুই হাজার মাইল দূরে সুদূর দ্বীপ ব্রিটেনেও ঘটনাচক্রে আইসিস-এর মন্দির নির্মাণ করা হয়েছিল এবং তার আনুষ্ঠানিকতা পালন করা হতো। তবে যদিও মিশর পৃথিবীকে ধর্ম দিয়েছিল সে-ও বহির্বিশ্ব থেকে নিয়েছিল। বিশেষ করে জুডিয়া থেকে।
জুডিয়ার অস্তিত্বের শেষ শতাব্দীতে যখন অনেকেই নিজেদেরকে মেসিয়া বলে ঘোষণা দিতে শুরু করে, এবং যখন ইহুদি জনগণ তার জন্য ক্ষুধার্ত চিত্তে অপেক্ষা করছিল তখন একজনের আবির্ভাব ঘটেছিল যার নাম যশুয়া। তার জন্ম অগাষ্টাসের রাজত্বকালে, ৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। তার শিষ্যরা তাকে মেসিয়া হিসাবে সাদরে গ্রহণ করে। তিনি মেসিয়া যাওয়া, গ্রিক ভাষায় জিসাস ক্রাইস্ট। ২৯ খ্রিস্টাব্দে টাইবেরিয়াসের রাজত্বকালে তাকে ক্রুশবিদ্ধ করে হত্যা করা হয়। টাইবেরিয়াসের ভয় ছিল হয়তো শেষ পর্যন্ত ইহুদিরা যিশুকে রাজা করে তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবে।
তার ক্রুশবিদ্ধ হওয়াতেই ইহুদিদের মন থেকে যিশুর মেসিয়াত্বের বিশ্বাস লোপ পায়নি, আর শীঘ্রই একটি কাহিনী বিস্তার লাভ করতে থাকে যে তিনি কবর থেকে পুনরুত্থান করেছিলেন। ইতিহাসের এই পর্যায়ে ইহুদিদের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের উদ্ভব ঘটে। তাই এটাকেও একটা নতুন সম্প্রদায় হিসাবে গণ্য করা যায়- যিশুখ্রিস্টের অনুসারী অথবা খ্রিস্টান হিসাবে।
এই সম্প্রদায়ের প্রথম কয়েক বছরে যে কেউ ভাবতে পারে এদের ভবিষ্যৎ তেমন উজ্জ্বল নয় এবং গ্রিক ও রোমান ধর্মমতের বিরুদ্ধে এর টিকে থাকার সম্ভাবনা কম। নিশ্চিত করে বলা যায় কুসংস্কারাছন্ন বহু দেবত্ববাদে বিশ্বাসে বিরক্ত হয়ে বহু লোক ইহুদিবাদের কঠোর একেশ্বরবাদিতা এবং তাদের উন্নত নৈতিকতাবোধে আকৃষ্ট হয়। কাজেই অনেক অ-ইহুদি যার মধ্যে অনেকেই উচ্চ সামাজিক মর্যাদার অধিকারী ছিল তারা জুডাইজমকে গ্রহণ করে।
এ ধরনের ধর্মান্তরকরণ খুব বেশি ছিল না, কারণ ইহুদিরা নিজেরাই এটাকে কঠিন করে তুলেছিল। তারা সহজ জীবনাচরণের সাথে আপোস করেনি এবং অনেক নিয়মকানুনে আবদ্ধ করেছিল। তার চাইতেও বড় কথা তারা সম্রাট-পূজার ঘোর বিরোধী ছিল এবং ধর্মান্তরিতদের এ থেকে বিরত থাকতে চাপ দিত।
এভাবেই খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিতরা নিজ সমাজ থেকেই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ত। ৬৬ থেকে ৭০ খ্রিস্টাব্দে রোমানরা খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিতদের ষড়যন্ত্রকারী হিসাবে গণ্য করত এবং প্রকৃতপক্ষে ধর্মান্তরকরণ বন্ধ করে দিয়েছিল।
খ্রিস্টধর্মের প্রচারকগণ অনেক অসুবিধার মধ্যে কাজ করলেও একজন লোকের প্রভাবে কিছুটা সহজ হয়েছিল। এই ব্যক্তিটি ছিলেন সল (পরে যিনি পল নামে পরিচিত হয়েছিলেন)। তিনি ছিলেন টার্সাসের (যে নগরে ক্লিওপেট্রার সাথে এন্টনির প্রথম দেখা হয়েছিল) একজন ইহুদি। প্রথমে তিনি খ্রিস্টধর্মের ঘোর বিরোধী ছিলেন কিন্তু খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হওয়ার পরে খ্রিস্টান মিশনারীদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত এবং সক্রিয় মিশনারীরূপে পরিগণিত হন।
তিনি অ-ইহুদি সমাজে ভাষণ দিয়ে বেড়াতেন এবং খ্রিস্টধর্মের একটি বিশিষ্ট মতবাদ ধারণ করেন যা ইহুদি আইন ও ইহুদি জাতীয়তাবাদের বিরোধী। তৎপরিবর্তে তিনি একটি বিশ্বজনীন মতবাদ প্রচার করেন যেখানে জাতীয়তা ও সামাজিক অবস্থান নির্বিশেষে সকল মানুষ খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করতে পারে। তিনি একটি উন্নত নৈতিকতার সাথে একেশ্বরবাদ প্রচার করেছিলেন যেখানে মুসার জটিল নিয়মনীতি ও বাধ্যবাধকতা পরিহার করা হয়েছিল। এর ফলে মিশর এবং আরও অনেক স্থানে প্রচুর লোকজন খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হতে লাগল।
তৎসত্ত্বেও সম্রাট-পূজার আনুষ্ঠানিকতায় খ্রিস্টানদের প্রবেশাধিকার ছিল না এবং ইহুদিদের মতো তাদেরকেও সন্দেহ ও ষড়যন্ত্রকারী হিসাবে দেখা হতো। ৬৪ খ্রিস্টাব্দে নীরোর রাজত্বকালে রোমে একটি ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে দোষী সাব্যস্ত করে খ্রিস্টানদের উপর অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়। কথিত আছে যে, এই নির্যাতনের শেষ পর্যায়ে পলকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।
পলের প্রচারের মাধ্যমে খ্রিস্ট-সমাজ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল, যার একভাগ ইহুদি ঐতিহ্যকে আঁকড়ে ধরেছিল আর অন্যভাগ তা প্রত্যাখ্যান করেছিল। এর চরম পর্যায়ে ইহুদি বিদ্রোহ শুরু হয়েছিল। যেসব ইহুদি খ্রিস্টের শিক্ষাকে গ্রহণ করেছিল, তারা ছিল পরিপূর্ণ শান্তিবাদী। তাদের কাছে ইতিমধ্যেই মেসিয়া (যিশুর রূপ ধরে) এসেছিল আর তারা ছিল তার অপেক্ষায়। কাজেই যিশু ব্যতিত অন্য কারও নামে জুডিয়ার রাজনৈতিক স্বাধীনতার সংগ্রাম তাদের কাছে অর্থহীন। তাই তারা পর্বতে গিয়ে যুদ্ধে অংশ নিল। যে সব ইহুদি বেঁচে রইল তারা খ্রিস্টানদের বিশ্বাসঘাতক আখ্যা দিল যার ফলে ইহুদিদের খ্রিস্ট ধর্মান্তরকরণ স্তিমিত হয়ে পড়ল।
৭০ খ্রিস্টাব্দ থেকে জুলাইজম থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক খ্রিস্টীয় ধর্মের আবির্ভাব হয়, এবং ইহুদি জগতে ছড়িয়ে পড়ে আর গ্রিক দর্শন ও পৌত্তলিক উৎসবের দ্বারা নিজেও প্রভাবিত হয়ে পড়ে।
৯৫ খ্রিস্টাব্দের শেষ ভাগে ভেস্পসিয়ানের কনিষ্ঠপুত্র রোমান স্রাট ডমিশিয়ান ইহুদি এবং খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে একটি আইন পাশ করেছিল, আপাতদৃষ্টিতে তিনি উভয় সম্প্রদায়কে একই দৃষ্টিতে দেখতেন।
স্বাভাবিকভাবেই ইহুদিবাদ ও খ্রিস্টধর্মের মধ্যে একটি বিরোধ ছিল। খ্রিস্টানরা ইহুদিদের প্রতি বিরূপ ছিল এ কারণে যে তারা যিশুকে মেসিয়া বলে স্বীকার করেনি। আরও একটি কারণ যিশুর ক্রুশবিদ্ধ করণে ইহুদিদের একটি ভূমিকা ছিল (তারা ভুলে গিয়েছিল যে যিশুর শিষ্যরাও ছিল ইহুদি)। অপরপক্ষে ইহুদিরা খ্রিস্ট মতবাদকে ধর্মদ্রোহরূপে গণ্য করত এবং তাদের দৈব-দুর্যোগের জন্য খ্রিস্টানদেরই দায়ী করত।
তবুও এই দুই ধর্মের মধ্যে তিক্ততা এতটা ভয়ংকর হতো না যদিনা তার মধ্যে মিশরের প্রভাব থাকত। ইহুদি-বিরোধী মনোভাব মিশরীয়দের মধ্যে যে কোনো জায়গার চেয়ে বেশি ছিল, যার ফলে খ্রিস্টধর্মে নষ্টিকবাদ প্রসার লাভ করে।
নষ্টিকৰাদ ছিল একটি খ্রিস্টপূর্ব দর্শন যা পার্থিব অনিষ্ট নিয়ে বেশি করে ভাবত। নষ্টিকবাদীদের কাছে নৈর্ব্যক্তিক ঈশ্বরই প্রকৃত ঈশ্বর। যিনি প্রকৃত কল্যাণ এবং সর্বশক্তিমান শাসনকর্তা, তিনি জ্ঞানের প্রতিমূর্তি।
পৃথিবী থেকে জ্ঞান সম্পূর্ণ বিযুক্ত যা ধরাছোঁয়ার বাইরে। এই বিশ্ব সৃষ্টি হয়েছে একজন অধস্তন দেবতা ডেমিউর্জের (ডেমিউর্জ একটি গ্রিক শব্দ যার অর্থ প্রকৃত শাসক) দ্বারা। যেহেতু ডেমিউর্জের ক্ষমতা ছিল সীমাবদ্ধ তাই পৃথিবী মতে পরিপূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। মানব দেহ একটি নিকৃষ্ট বস্তু তাই আত্মাকে এর থেকে বেরিয়ে যেতে হয়।
কিছু কিছু নষ্টিকৰাদী খ্রিস্টধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিল আবার কেউ কেউ এ থেকে বেড়িয়েও গিয়েছিল। এই মতবাদের একজন বিশিষ্ট নেতা ছিলেন মার্শিয়ন। তিনি ছিলেন এশিয়া মাইনরের অধিবাসী এবং মনে করা হয় তিনি একজন খ্রিস্টান বিশপের পুত্র ছিলেন।
ট্রেজান এবং হাড্রিয়ানের রাজত্বকালে মার্শিয়ন এই ধারণা পোষণ করতেন যে, ডেমিউর্জ প্রকৃতপক্ষে ওল্ডটেষ্টামেন্টের গড- যিনি একজন নিম্নতর দেবতা, যিনি বিশ্ব সৃষ্টি করেছিলেন। অপরপক্ষে যিশু ছিলেন প্রকৃত বিজ্ঞ ঈশ্বরের প্রতিনিধি। যেহেতু যিশু ডেমিউর্জের সৃষ্টিকর্মের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন না, তাই পবিত্র আত্মা আর মানব দেহ ধারণের মাধ্যমে তিনি তার উদ্দেশ্য পরিপূর্ণ করেন।
কিছুকালের জন্য মিশরে নষ্টিক মতবাদ বেশ জনপ্রিয় ছিল কারণ ইহুদিবিরোধী অনুভূতির সাথে তার সাদৃশ্য ছিল। এতে করে ইহুদি-ঈশ্বরকে দানবের রূপ দেওয়া হয় আর ইহুদি ধর্ম গ্রন্থকে দানবের দ্বারা অনুপ্রাণিত ভাবা হয়।
তবে নষ্টিক খ্রিস্টবাদ বেশি দিন স্থায়ী হয়নি, কারণ খ্রিস্টধর্মের মূল ধারা এর বিরোধী ছিল। অধিকাংশ খ্রিস্টীয় নেতাই ইহুদি-ঈশ্বর এবং ওল্ডটেষ্টামেন্টকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। তারা মনে করত ওল্ডটেষ্টামেন্টের ঈশ্বরই নিউ টেষ্টামেন্টের ঈশ্বর, যিশু যাকে ধারণ করেছিলেন।
যদিও নস্টিকবাদ লোপ পেয়ে যায়, তবে এটা কিছু কালো রেখা ছেড়ে গিয়েছিল। খ্রিস্টধর্মে পৃথিবী ও মানুষের মধ্যে বিদ্যমান অশুভ সম্বন্ধে ধারণা ছিল, যার ফলে ইহুদি বিদ্বেষ আগের চাইতে আরও কঠোর হয়। তার চাইতেও বড় কথা মিশরীয়রা যিশুর সাথে সংশ্লিষ্ট নষ্টিক ধ্যানধারণাকে সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাগ করতে পারেনি যার ফলে মিশরীয় খ্রিস্ট সমাজের মধ্যে একটা অন্তর্দ্বন্দ্ব রয়ে যায় এবং যার ফলে মিশরে খ্রিস্টধর্ম টিকে থাকেনি।
খ্রিস্টধর্মে আরেকটি মিশরীয় প্রভাব লক্ষ করা যায় স্বর্গের রানি আইসিসের মাধমে। তিনি শুধু মিশরের নয় রোমেও ছিলেন সবচেয়ে জনপ্রিয় দেবী তার ঔজ্জ্বল্য সৌন্দর্য কমনীয়তা রূপলাভ করেছিল কুমারী মাতা মেরীর মাধ্যমে। এতে করে খ্রিস্টধর্মে একটি নারী প্রভাবের অনুপ্রবেশ ঘটেছিল। ইহুদি ধর্মে যা ছিল সম্পূর্ণ অনুপস্থিত।
.
রোমের অধোগতি
ট্রেজান ও হাড্রিয়ান এবং তাদের উত্তরাধিকারী এন্টনিয়াস পায়াস ও মার্কাস অরেলিয়াসের সাম্রাজ্যকাল ছিল রোমের সবচেয়ে গৌরবজ্জ্বল দিন। আশি বছর ধরে রোম সুরক্ষা ও শান্তিতে ছিল। তবে শীঘ্রই এর সমাপ্তি ঘটল। মার্কাস অরেলিয়াসের অযোগ্য পুত্র ১৮০ খ্রিস্টাব্দে ক্ষমতাসীন হলেন এবং ১৯২ খ্রিস্টাব্দে তাকে হত্যা করা হয়। অতঃপর রোমান সাম্রাজ্য একটি অস্থির পরিস্থিতিতে নিপতিত হয় যখন ক্ষমতাগ্রাসের জন্য জেনারেলরা পরস্পরের সাথে সংগ্রামে লিপ্ত হয়। ঠিক যেমনটা ঘটেছিল নীরোর মৃত্যুতে।
এই সংগ্রামে সবচেয়ে সুযোগ্য ব্যক্তি ছিলেন পেসেনিয়াস নিগার তখন যার অবস্থান ছিল সিরিয়ায়। শীঘ্রই তিনি মিশর অধিকার করে বসেন যা ছিল রোমের রুটির ঝুড়ি, ঠিক যেমনটা হয়েছিল সোয়াশ’ বছর আগে ভেস্পাসিয়ানের আমলে। রোমের দিকে অগ্রসর না হয়ে তিনি আগের জায়গাতেই থেকে যান আর ধরে নিয়ে ছিলেন যে খাদ্যের অভাবে রোম নিজেই এসে তার কাছে ধরণা দেবে।
রোমেই রয়ে গেলেন দানিয়ুবের তীরে তাড়া খাওয়া জেনারেল সেন্টিমিয়াস সিভেরাস। তিনি রোমে তার আসন পাকা করে পূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে এশিয়া মাইনরে গিয়ে নিগারকে ধরে ফেলেন এবং তাকে পরাজিত করেন। এরপর সেপ্টিমিয়াস সিভেরাস রোমের সম্রাট হয়ে বসলেন।
তার জ্যেষ্ঠপুত্র কেরাকেলা ২১১ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনের উত্তরাধিকার লাভ করেন এবং ২১২ খ্রিস্টাব্দে একটি আদেশ প্রচার করেন যার মাধ্যমে রোম সাম্রাজ্যে বসবাসকারী সকলকে রোমের নাগরিক হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। মিশরের জনগণ রোমের নাগরিক হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করে দারুণ গর্ব অনুভব করে। তাদেরকে রোমের সিনেটেও স্থান দেওয়া হয় (সে সময় অবশ্য সিনেট কোনো রাজনৈতিক গুরুত্ব বহন করত না, প্রকৃতপক্ষে এটা ছিল এক সামাজিক ক্লাবের মতো)।
তবে রোমের জন্য আসন্ন দিনগুলি বেশ কঠিন হয়ে পড়ছিল। মার্কাস অরেলিয়াসের সময় রোমে এক দারুণ প্লেগের আক্রমণে প্রায় জনশূন্য হয়ে পড়ে এবং সেই সাথে অর্থনৈতিক দৈন্যদশায় পতিত হয়। রাষ্ট্রপরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহ করা বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। শুধু নাগরিকরাই করের আওতাভুক্ত ছিল আর কেরাকেলার আদেশের ফলে তা সকল স্বাধীন জনগণের উপর প্রযোজ্য হয় এবং তাছাড়াও বাড়তি কর ধার্য করা হয়েছিল।
হাড্রিয়ানের পরে কেরাকেলাই প্রথম মিশর ভ্রমণে গিয়েছিলেন, তবে উপলক্ষটি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। এক শতাব্দী পূর্বে হাড্রিয়ান ছিলেন শুধু একজন কৌতূহলী পর্যটক, যিনি মনের আনন্দে শান্তিপূর্ণ এক সাম্রাজ্যে ঘুরে বেড়িয়েছেন। কেরাকেলা ছিলেন এক কঠিন সময়ে যখন উত্তর এবং পূর্ব থেকে শত্রুরা রোমের দুর্গপ্রাকারে আঘাত হানছিল। তিনি মিশরে গিয়েছিলেন অসন্তুষ্ট চিত্তে শত্রুর মোকাবেলা করতে।
কঠিন অর্থ-সংকটের চাপে পিষ্ট হয়ে কেরাকেলা আলেক্সান্দ্রিয়ার মিউজিয়ামে পণ্ডিতদের সহায়তা দানে বিরত থাকেন। সম্ভবত কেরাকেলার দৃষ্টিতে এটা তেমন অযৌক্তিক ছিল না। এক শতাব্দীর বেশি সময় ধরে মিউজিয়ামটি নিষ্প্রভ হয়ে পড়ছিল এবং জ্ঞান বিজ্ঞানে খুব কমই অবদান রাখছিল। মিশরের সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিজ্ঞানী ছিলেন জ্যোতির্বিজ্ঞানী টলেমী। তার কাজ ছিল মূলত পূর্ববর্তী জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের কাজের উপর গবেষণা। সম্ভবত কেরাকেলা অনুভব করেছিলেন যে মিউজিয়ামটি মৃতপ্রায় এবং এখানে অর্থব্যয় করা নিষ্ফল যখন সাম্রাজ্য নিজেই অর্থসংকটে ভুগছিল। এরপর আর এই মিউজিয়াম প্রাণ ফিরে পায়নি।
কেরাকেলার এই কার্যকলাপ নিঃসন্দেহে পণ্ডিতদের মধ্যে অসন্তোষের সঞ্চার করেছিল আর সে সময়ের ইতিহাসবিদরা তার সম্বন্ধে বিরূপ মনোভাব প্রকাশ করেছিলেন। মনে করা হয় তিনি তুচ্ছ কারণে আলেক্সান্দ্রিয়া আক্রমণ করে হাজার হাজার নাগরিককে মেরে ফেলেন। সন্দেহ নাই যে এটি একটি অতিরঞ্জিত কাহিনী।
তবে আলেক্সান্দ্রিয়া বিজ্ঞানে ক্ষয়িষ্ণু হলেও বিদ্যাচর্চায় পশ্চাৎপদ হয়নি। এক ধরনের পণ্ডিত ব্যক্তির উদ্ভব ঘটেছিল যারা ছিলেন খ্রিস্টান ধর্মতাত্ত্বিক আর এই পথ অনুসরণ করে আলেক্সান্দ্রিয়া পৃথিবীকে এগিয়ে নিতে পেরেছিল।
পলের পরে এক শতাব্দী ধরে খ্রিস্টধর্ম প্রসার লাভ করে নিম্নশ্রেণির মানুষ ও মহিলাদের মধ্যে, বিশেষ করে দরিদ্র অশিক্ষিত মানুষের মধ্যে। শিক্ষিত ও সম্পদশালী শ্রেণী এর বিরোধীতা করেছে। যারা গ্রিক দার্শনিকদের সুক্ষ্ম বুদ্ধিবৃত্তির অনুসারী ছিলেন তাদের কাছে ইহুদি ধর্মগ্রন্থ বর্বরোচিত এবং খ্রিস্টের শিক্ষাকে সাদামাটা এবং খ্রিস্টধর্মের প্রচারকে হাস্যকর বলে মনে হয়েছে। আলেক্সান্দ্রিয়ার ধর্মতত্ত্ববিদের এই মনোভাবের বিরুদ্ধে কঠোর সংগ্রাম করতে হয়েছে। এই সংগ্রামে যিনি সক্রিয়ভাবে নিয়োজিত ছিলেন তিনি ১৫০ খ্রিস্টাব্দে এথেন্সে জন্মগ্রহণকারী এক পুরোহিত ক্লেমেন্ট, যিনি আলেক্সান্দ্রিয়ায় শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। তিনি একাধারে গ্রিক দর্শনে ও খ্রিস্ট্রীয় তত্ত্বে পারদর্শী ছিলেন। তিনি গ্রিক দর্শনের ভিত্তিতে খ্রিস্ট্রীয় মতবাদকে সমৃদ্ধ করে তাকে একটি সম্মানজনক রূপ দিতে পেরেছিলেন। তারচেয়েও বড় কথা তিনি এর এমন ব্যাখ্যা দিতে পেরেছিলেন যাতে সম্পদশালী ব্যক্তিরাও মুক্তির আস্বাদ পেতে পারে। তাছাড়া তিনি নষ্টিকবাদের বিরুদ্ধে একটি শক্ত অবস্থান নিতে পেরেছিলেন।
ক্লেমেন্ট ছিলেন একজন গ্রিক এবং তিনি মিশরে তার শিক্ষা প্রচার করতেন। মিশরে অরিগেন নামে তার একজন মিশরীয় শিষ্য ছিল। তিনি ১৮৫ খ্রিস্টাব্দে আলেক্সান্দ্রিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন এবং বংশগতভাবে একজন গ্রিক পৌত্তলিকের সন্ত নি ছিলেন। ক্লেমেন্টের মতো তিনিও খ্রিস্ট মতবাদের সাথে গ্রিক দর্শনের মিশ্রণ ঘটাতে পেরেছিলেন।
তিনি প্লেটোবাদী একজন দার্শনিক সেলসাসের সাথে বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন কারণ সেলসাস খ্রিস্টান ধর্মের বিরুদ্ধে একটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। সেলসাসের বিরুদ্ধে অরিগেন একটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন যাতে খ্রিস্টধর্মের পক্ষে এবং সেলসাসের বিরুদ্ধে লেখা হয়।
বর্তমানে সেলসাসের বইয়ের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না, তবে অরিগেনের গ্রন্থে এর দশ ভাগের নয় ভাগই উদ্ধৃতি হিসাবে পাওয়া যায়। অরিগেনকে ধন্যবাদ যে তার প্রতিপক্ষের চিন্তাধারাকে তিনি বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছেন। এভাবেই খ্রিস্টধর্মের বৌদ্ধিক অনুষঙ্গে মিশরীয়রা অবদান রাখতে পেরেছে এবং ধ্রুপদী বিদ্যাচর্চায় খ্রিস্ট্রীয় মতবাদের উত্তরণ ঘটাতে পেরেছে তবে সময় দ্রুত খারাপ হতে থাকে। ২২২ খ্রিস্টাব্দে সেল্টিমিয়াস সিভেরাসের এক প্রপৌত্র আলেক্সান্ডার সিভেরাস সম্রাট হলেন। তিনি একজন সহৃদয় কিন্তু দুর্বল প্রকৃতির ব্যক্তি ছিলেন এবং তার মায়ের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতেন। ২৩৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি নিহত হন।
এরপর সম্রাটগণের এক জংলী উৎসব শুরু হয়। একের পর এক জেনারেলরা সিংহাসনের দাবিদার হয়ে চলে আসেন আর তার বিরোধী জেনারেল তাকে হত্যা করে। এই অন্তর্দ্বন্দ্বে প্রচুর শক্তি ক্ষয় হয়। আর এর ফলে উত্তর থেকে জার্মান বর্বররা বন্যার মতো ধেয়ে আসে আর এখানে সেখানে টুকরো টুকরো রাজ্যের সৃষ্টি হয়।
এবার সুযোগ এল পারসিকদের। ছয় শতাব্দী পূর্বে আলেক্সান্ডারের বিজয়ের পর এখন তার পুনর্জন্ম হলো। তৃতীয় এন্টিয়োকাসের পরে সেলুকীয় সাম্রাজ্যের পূর্বের প্রদেশগুলি স্বাধীনতা লাভ করে এবং একটি সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে, রোমানরা যাকে বলত পার্থিয়া (এটা পারসিয়া শব্দেরই একটি রূপান্তর)।
তিন শতাব্দীব্যাপী রোম ও পারস্যের মধ্যে উত্থান পতনের এক যুদ্ধ চলতে থাকে যাতে উভয় পক্ষে রক্তক্ষয় ছাড়া আর বিশেষ কিছুই অর্জন ছিল না। তারপর ২২৮ খ্রিস্টাব্দে যখন আলেক্সান্ডার সিভেরাস সিংহাসনে আসীন তখন পার্থিয়ান অঞ্চলে এক নতুন রাজবংশের সূচনা হয়। যা ছিল একজন পারসিক দলপতি সাসানের বংশধর। কাজেই এই রাজ বংশকে বলা হয় সাসানীয়।
আলেক্সান্ডার সিভেরাসের মৃত্যুর পর রোমে যখন নৈরাজ্য চলছে সেই সুযোগে পারসিকরা অভিযান চালিয়ে পশ্চিম দিকে অগ্রসর হয়। ২৬০ খ্রিস্টাব্দে এডেসায় তারা রোমান সৈন্যের মুখোমুখি হয়। রোমান সৈন্যের নেতৃত্বে ছিলেন সম্রাট ভ্যালেরিয়ান।
ঠিক কী ঘটেছিল তা আমরা জানিনা, তবে আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় অদক্ষভাবে পরিচালিত রোমান সৈন্যরা ফাঁদে পড়ে যায় এবং পরাজয় স্বীকারে বাধ্য হয় এবং ভ্যালেরিয়ান নিজেও বন্দী হন। কোনো রোমান সম্রাট শত্রুদের হাতে বন্দী হয়, এটাই তার প্রথম দৃষ্টান্ত আর এই বজ্রনির্ঘোষ কর্ণবিদারী প্রতিপন্ন হল। পারসিক সৈন্যরা স্রোতের মতো এশিয়া মাইনরের উপর ভেঙ্গে পড়ে।
এবার ঘটল একটি বিস্মক ঘটনা। সমুদ্র থেকে একশত ত্রিশ মাইল দূরে সাম্রাজ্যের পূর্ব সীমান্ত সিরিয়ায় পালমিরা নামে একটি মরুশহর ছিল। রোমান সাম্রাজ্য যখন ক্ষমতার শীর্ষে তখন এটি বেশ সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছিল।
ভ্যালেরিয়ানের পরাজয়ের সময় পালমিরা ছিল একজন আরব বংশীয় সদার অডিনেথাসের শাসনাধীন। তিনি পারস্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেন। তিনি অবশ্য পারস্য সৈন্যের মুখোমুখি হতে চাননি (যারা ছিল অনেক পশ্চিমে) তৎপরিবর্তে পূর্ব ও দক্ষিণে তেসিফোনের দিকে অগ্রসর হয়েছিলেন যা ছিল কম সুরক্ষিত পারসিক রাজধানী। বিরক্ত পারসিকরা পশ্চাদপসারণে বাধ্য হয় এবং তাদের রোম বিজয়ের স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়। কৃতজ্ঞ রোমানরা তাকে বিভিন্ন উপাধিতে ভূষিত করে এবং তাকে একজন স্বাধীন রাজা হিসাবে স্বীকৃতি দেয় তবে রাজকীয়তা সে যুগে কোনো নিরাপদ ব্যবস্থা ছিল না এবং ২৬৭ খ্রিস্টাব্দে অডিনেথাস নিহত হন।
ক্লিওপেট্রার মতো একজন শক্তিধর ও উচ্চাকাক্ষী স্ত্রীলোক জেনোবিয়া তার শূন্যস্থানে মাথা তুলে দাঁড়ালেন। তার স্বামীর সমস্ত উপাধি তার পুত্রের বলে তিনি দাবি করলেন এবং নিজেই রোমের সম্রাটের পদ দখল করতে প্রস্তুত হলেন। ২৭০ খ্রিস্টাব্দে তার সৈন্যবাহিনী এশিয়া মাইনর অধিকার করে নিল আর সেই শীতকালেই তিনি মিশরে অভিযান পরিচালনা করলেন।
মিশরীয়রা সিনাইয়ের দ্বারপ্রান্তে শত্রুসৈন্যের উপস্থিতি দেখে, তিন শতাব্দী পূর্বে অগাষ্টাসের পর থেকে যেমনটা আর কখনো দেখেনি, বিস্ময়বিমূঢ় হয়ে পড়ল। তারা কোনো প্রতিরোধই গড়ে তুলতে পারল না। সাম্রাজ্যের পূর্বাঞ্চলের এক তৃতীয়াংশ নিজের নিয়ন্ত্রণে এনে জেনোবিয়া ও তার পুত্রকে রোমের যৌথ ম্রাট ঘোষণা করলেন।
তবে রোমে আর একজন সম্রাটের উদ্ভব ঘটল তিনি অরেলিয়ান, যিনি অরাজকতার কালে রোমের সিংহাসন আঁকড়ে ধরে ছিলেন। দ্রুতগতিতে এবং শক্তিমত্তার সাথে তিনি এশিয়া মাইনরের দিকে অগ্রসর হলেন। সঙ্গে সঙ্গে জেনোবিয়ার বাহিনী পিছু হটে মিশর ত্যাগ করে তাদের নিজ অবস্থানে চলে গেল।
২৭৩ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ অরেলিয়ান পালমেরীয় বাহিনীকে সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন এবং পালমিরা দখল করে নিল। জেনোবিয়া ক্লিওপেট্রার চাইতে কম সৌভাগ্যবতী ছিলেন। তাকে বন্দী করে নিয়ে যাওয়া হয় অরেলিয়ানের বিজয়োৎসব অনুষ্ঠানে। এই গোলযোগের সুযোগে মিশরে ফাইমাস নামে একজন সম্পদশালী মিশরীয় নিজেকে সম্রাট ঘোষণা করেন। পালমিরা থেকে মিশরে ফিরে এসে অরেলিয়ান আলেক্সান্দ্রিয়া দখল করে নেন এবং ফাইমাসকে ক্রুশবিদ্ধ করেন। প্রথমে জেনোবিয়া ও তারপর অরেলিয়ানের দ্বৈত আক্রমণ থেকে রেহাই পেয়ে মিশর তার নিজস্ব গতিতে চলতে লাগল।
তবে কিছু একটা হারিয়ে গিয়েছিল। সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য ফাইমাস ও অরেলিয়ানের হট্টগোলে আলেক্সান্দ্রিয়ার মিউজিয়াম ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। টলেমীয়দের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন যা ছয় শতাব্দী ধরে টিকেছিল এবং তিনটি রাজবংশ যার প্রণোদনা দিয়েছিল, তা নিমেষেই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল।
তবে সব কিছু শেষ হয়ে যায়নি। লাইব্রেরির অসংখ্য পেপিরাসের বান্ডিল এখনও টিকে আছে এবং যাতে সঞ্চিত রয়েছে গ্রিক সংস্কৃতির হাজার বছরের জ্ঞান এবং বিদ্যা।