০৭. বিদেশি আধিপত্য

৭. বিদেশি আধিপত্য

লিবীয়গণ

১১৫৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তৃতীয় রামেসেস মৃত্যুবরণ করেন। তার উত্তরাধিকারী (শিথিল রাজকীয় বংশধারার) চতুর্থ থেকে একাদশ রামেসেসের সবাই ছিল দুর্বল, গুরুত্বহীন। রামেসেস উত্তরাধিকারীদের আশি বছরের (১১৫৮-১০৭৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে) শাসনামলে একটি ব্যতিত থিবিসের প্রায় সবগুলি কবর লুষ্ঠিত হয়ে যায় এমনকি দ্বিতীয় রামেসেসের সমাধির মূল্যবান সম্পদগুলিও চুরি হয়ে যায়। ১১৩৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ষষ্ঠ রামেসেসকে কবরস্থ করার সময় উৎক্ষিপ্ত আবর্জনার নিচে কাকতালীয়ভাবে দুই শতাব্দী পূর্বে টুতেনখামেনের সমাধিটি ঢাকা পড়ে যায় এবং আধুনিককাল পর্যন্ত অবিকৃতভাবে টিকে থাকে।

ফারাওদের ক্ষমতার অবনতি ঘটার সাথে সাথে পুরোহিতদের ক্ষমতা বৃদ্ধি হচ্ছিল। ইখনাতনের উপর পুরোহিতদের কর্তৃত্বলাভ মিশরীয় রাজমুকুটকে ছায়াচ্ছন্ন করে ফেলে। এমনকি দ্বিতীয় রামেসেসকেও সতর্কভাবে পুরোহিতদের অধিকারকে সম্মান দেখাতে হয়েছিল। নবম এবং দশম রাজবংশের শাসনকালে অধিকহারে কৃষিভূমি, কৃষক এবং সম্পদ ফারাওদের আয়ত্তে এসেছিল। পুরোহিত সম্প্রদায়ের ক্ষমতা বৃদ্ধির ফলে ধর্ম অধিকতর অনমনীয় ও রক্ষণশীল হয়ে পড়ে। এটা জাতির জন্যে মোটেই হিতকর ছিলনা।

রামেসেস বংশের শাসকরা পুরোহিতদের হাতের পুতুল ছিল। তাদের হয়তো স্মরণ ছিল হিক্সসদের আধিপত্যের সময় আমেনের পুরোহিতরা উজান মিশরের থিবিস শাসন করত। শেষ পর্যন্ত ১০৭৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে যখন একাদশ রামেসেসের মৃত্যু হয় তখন সিংহাসনে আরোহণের জন্য তার কোনো প্রত্যক্ষ উত্তোরাধিকরী ছিল না। তৎপরিবর্তে আমেনের প্রধান পুরোহিত যিনি সেনাবাহিনীর প্রধান ছিলেন, তিনি নিজেকে মিশরের শাসনকর্তা হিসেবে ঘোষণা করেন। অবশ্য তিনি অখণ্ড মিশরের শাসক হতে পারেননি।

ব-দ্বীপ অঞ্চলে দ্বিতীয় একপ্রস্ত শাসকের উত্থান ঘটে যাদের রাজধানী ছিল দ্বিতীয় রামেসেসের নিজ শহর তানিসে। মানেথো তাদের তানিও বংশ বলে উল্লেখ করেন এবং তাদেরকে একবিংশ রাজবংশের মর্যাদা দেন। এ সময় মিশর পূর্বের যে কোনো সময়ের চাইতে অধিকতর দুর্বল হয়ে পড়ে কারণ মিশর ছিল বিভক্ত। আর এক হাজার বছর পূর্বে মেনেসের প্রচেষ্টা বিফলে পরিণত হয়।

একবিংশ রাজবংশের শাসনামলে সিরিয়ার সাথে রশি টানাটানি শেষ হয়। ইসরাইলিরা জুডীয় যোদ্ধা ডেভিডের মধ্যে তাদের নেতাকে খুঁজে পায় আর তার নেতৃত্বে ফিলিস্তিনিরা সম্পূর্ণ পরাজিত হয় এবং আশেপাশের ছোট ছোট জাতি গোষ্ঠীগুলি তাদের পদানত হয়। এটা ইতিহাসের এমন এক মুহূর্ত যখন নীল ও ইউফ্রেটিস-তাইগ্রিস উভয় এলাকায় দুর্বল সময় অতিক্রম করছিল। কাজেই ডেভিড এই সুযোগ গ্রহণ করলেন এবং তিনি এক ইসরাইলি সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন যা সিনাই উপদ্বীপ থেকে ইউফ্রেটিস নদী পর্যন্ত সমগ্র ভূমধ্যসাগরীয় উপকূল সাম্রাজ্যের অধিভুক্ত ছিল। এমনকি উপকূলবর্তী কেনানিও নগরসমূহ, যদিও তাদের স্বাধীনতা উপভোগ করছিল তারা সতর্কভাবে ডেভিড এবং তদীয়পুত্ৰ সলোমনের অধীনতামূলক মিত্ৰতায় আবদ্ধ হয়েছিল।

ডেভিড ও সলোমনের রাজত্বকালে একবিংশ সম্রাটদের শাসনে খণ্ডিত মিশর অপেক্ষা ইসরায়েল অধিকতর শক্তিশালী ছিল। মিশর ইসরায়েলের সাথে মিত্রতা করতে পেরে খুশি হয়েছিল এবং ফারাও তার এক কন্যাকে সলোমনের হারেমে পাঠিয়ে দেন। এই ফারাওটির নাম বাইবেলে উল্লেখ নাই, তবে যেহেতু ৯৭৩-৯৩৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দ সলোমনের রাজত্বকাল সেহেতু অনুমান করা যায় ফারাওটি ছিলেন দ্বিতীয় সুসেনিস, যিনি এই রাজবংশের সর্বশেষ রাজা।

দ্বিতীয় সুসেনিসের অনেক সমস্যা ছিল। বংশ পরম্পরায় মিশরীয় সৈন্যদের দুর্বলতা অত্যধিক ভাড়াটিয়া নির্ভরতা সৃষ্টি হয় বিশেষ করে লিবীয় দলপতিদের অধীনে। এটি একটি অবশ্যম্ভাবী ব্যাপার যে ভাড়াটিয়া সৈন্যদের আধিক্য তাদের দলপতিদের উপর নির্ভরতা বাড়িয়ে দেয় এবং মাঝে মাঝে এই ভাড়াটিয়া সেনাধ্যক্ষরা সরকারের উপর প্রভাব খাটায় এবং অন্তর্ঘাত সৃষ্টি করে।

দ্বিতীয় সুসেনিসের আমলে লিবীয় সেনাধ্যক্ষ ছিলেন শশশংক। তার সমর্থন সুসেনিসের জন্য অত্যাবশ্যক ছিল। শেশংক রাজ-পরিবারকে বাধ্য করেন তার সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনে। শেশংকের পুত্রের সাথে ফারাও-এর কন্যার বিবাহ হয়। এটা ছিল এক আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। এতে করে পরিষ্কার হয়ে যায় যে, সেনাধ্যক্ষটির সিংহাসন অধিকারের একটি মতলব ছিল। সম্ভবত সুসেনিস তার আরও এক কন্যাকে সলোমনের হাতে দিয়েছিলেন এই আশায় যে, ইসরাইলিদের সমর্থনে জেনারেলের বাড়াবাড়ি রোধ করা যাবে। এক্ষেত্রে তিনি হতাশ হয়েছিলেন। ৯৪০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে যখন দ্বিতীয় সুসেনিসের মৃত্যু হয় তখন শেশংক অবাধে সিংহাসন দখল করে নিল। কে তাকে বাধা দেয়?

নতুন ফারাও প্রথম শেশংক হিসাবে সিংহাসনে আরোহণ করেন এবং তাকে দ্বাবিংশ রাজবংশের প্রথম সম্রাট বলে গণ্য করা হয়। মাঝে মাঝে এই রাজবংশকে লিবীয় রাজবংশ বলে আখ্যায়িত করা হয়। তবে এতে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। সত্যিকারভাবে লিবীয়রা কখনোই মিশর জয় করতে পারেনি। আর যে সব লিবীয় সৈন্য মিশর অধিকার করেছিল তারা প্রকৃতপক্ষে মিশরীয় হয়ে গিয়েছিল। শেশংক তার রাজধানী স্থাপন করেন তানিসের পঁয়ত্রিশ মাইল উজানে বুবাস্তিস নামক স্থানে। তিনি পুনর্বার থিবিস দখল করে সাম্রাজ্যের অখণ্ডতা ফিরিয়ে আনেন। একশ পঁচিশ বছর পরে মিশর আবার অখণ্ড শক্তিতে পরিণত হল। শেশংক থিবিসকে নীল উপত্যকার সাথে যুক্ত করার জন্য তার নিজ পুত্রকে আমেনের পুরোহিত নিযুক্ত করেন।

এরপর তিনি ইসরাইলের দিকে দৃষ্টি দেন। সম্ভবত ইসরাইলের সাথে তার পূর্বসূরির মিত্ৰতা তিনি ভালো দৃষ্টিতে দেখেননি। প্রথমেই তিনি আক্রমণ না করে ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নেন। উত্তর ইসরাইলিরা জুডিও বংশের শাসন পছন্দ করত না এবং তারা বিদ্রোহের চেষ্টা করে। এই বিদ্রোহ দমন করা হয়। তবে এর নেতা জেরোবোয়াম শেশংকের আশ্রয় প্রার্থনা করেন। ৯৩৩ খ্রিস্টাপূর্বাব্দে সলোমনের মৃত্যুর পর শেশংক জেরোবোয়ামকে ইসরাইলে ফেরত পাঠান এবং নতুন করে একটি বিদ্রোহ সাফল্য লাভ করে।

ডেভিড ও সলোমনের স্বল্পস্থায়ী সাম্রাজ্য চিরতরে ভেঙ্গে পড়ে। বৃহত্তর এবং সমৃদ্ধতর উত্তর অংশ ইসরায়েল নামটি ধরে রাখে। তবে যিনি এর রাজা হন তিনি ডেভিডের বংশধর ছিলেন না। যেরুজালেমকে কেন্দ্র করে দক্ষিণের ক্ষুদ্রতর রাজ্যটি ছিল জুড়া। যেখানে ডেভিডের বংশধর পরবর্তী তিন শতাব্দী যাবৎ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিল।

শেশংক তার সামনে দেখতে পেলেন সংকুচিত এক জুডা বিদ্রোহের কবলে বিপর্যস্ত। আর তিনি এক অভিযানের প্রস্তুতি নিলেন। তৃতীয় থুতমস এবং দ্বিতীয় রামেসেসের মতো তিনি সিনাই থেকে অভিযান শুরু করলেন। তবে এবার শক্তিশালী মিত্তানী বা হিট্টাইটের মতো শক্তিশালী শত্রুর মুখোমুখি হতে হয়নি। ইতিহাসের এই পর্যায়ে মিশরের তেমন সাহস ছিল না। জুড়ার মতো একটি ক্ষুদ্র রাজ্যকেই তিনি সামাল দিতে পেরেছিলেন। ৯২৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে শেশংক জুডা আক্রমণ করলেন যার ফলাফল বাইবেলে লিপিবদ্ধ আছে (শেশংককে এখানে শিশাক নামে অভিহিত করা হয়)। তিনি যেরুজালেম অধিকার করেন, সেখানকার মন্দির লুটপাট করেন এবং কিছুকালের জন্য জুডাকে করদ রাজ্যে পরিণত করেন।

তিনি নিজেকে বিজয়ী বলে অনুভব করে থিবিসে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করেন। যেখানে তার বিজয়ের বিস্তৃত বিবরণ লিপিবদ্ধ করা হয়। তিনি কার্মাকের মন্দিরও সম্প্রসারিত করেন এবং সেখানে তার সাম্রাজ্যের সাফল্যের কথা খোদাই করান।

শেশংক শুধু তার বংশের প্রথম রাজাই ছিলেন না একমাত্র তিনিই প্রকৃত সাহস দেখাতে পেরেছিলেন। তার উত্তরাধিকারী প্রথম অর্সকন ৯১৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সিংহাসনে আরোহণ করেন এবং তিনি মিশরকে যথেষ্ট সম্পদশালী ও সমৃদ্ধ দেখতে পান। তবে তিনি নিজেকে ছাড়া আর কিছুই ধরে রাখতে পারেননি। ৮৮৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তার মৃত্যুর পর অবসম্ভাবী অধঃপতনের শুরু হয়।

সেনাবাহিনী বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ে আর এর সেনাধ্যক্ষরা হাতের কাছে যা পায় লুট করে নেয়। ৭৬১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে থিবিস বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং মানেথ এখানকার রাজাকে এয়োবিংশ রাজবংশ বলে উল্লেখ করেন। এই ছিল তকালে মিশরের দুরবস্থা।

.

নুবীয়গণ

নতুন সাম্রাজ্যের অধীনে নুবিয়া প্রকৃতপক্ষে ছিল মিশরের একটি দক্ষিণ সম্প্রসারণ। সে যুগের সকল পুরাতাত্ত্বিক আবিষ্কার থেকে বোঝা যায় তা ছিল সম্পূর্ণরূপে মিশরীয় চরিত্রের। এর কয়েক শতাব্দী পর মিশরের অবক্ষয়ের সময় নুবিয়া সম্পূর্ণরূপে দৃশ্যপট থেকে অদৃশ্য হয়ে যায়। নিঃসন্দেহে বহুধাবিভক্ত মিশর এবং বিবদমান থিবিস প্রথম প্রপাতের ওপারে মিশরকে ধরে রাখতে পারেনি। এতে করে নুবিয়া জাতীয়তাবাদী শক্তির অধিকারে চলে যায়।

দৃশ্যত তারা চতুর্থ প্রপাতের সামান্য নিচে নাপ্টাকে তাদের ক্ষমতার কেন্দ্ররূপে প্রতিষ্ঠা করে। এই শহরটি প্রকৃতপক্ষে মিশরীয় শক্তির সীমা নির্দেশ করে (তৃতীয় থুতমস সেখানে একটি শিলালিপিযুক্ত স্তম্ভ স্থাপন করেছিলেন)। মিশরীয় প্রভাবের নমনীয়তা সত্ত্বেও এত দূরের অঞ্চলকে ধরে রাখা সম্ভব হয়নি।

তবে নুবিয়াতে মিশরীয় সংস্কৃতি টিকে ছিল। যখন শেশংক থিবিস অধিকার করেছিলেন তখন আমেনের একদল পুরোহিত নাপ্টায় আশ্রয় নিয়েছিল এবং সেখানে তাদের স্বাগত জানানো হয়েছিল। সন্দেহ নাই তারা সেখানে নির্বাসিত সরকারের মতো কাজ করেছিল এবং নুবীয় রাজাদের মিশর আক্রমণে তাগিদ দিত, যাতে তাদের রাজকীয় পৌরহিত্যের অধিকার বজায় থাকে।

প্রকৃতপক্ষে পুরোহিতদের প্রভাবেই ধর্মীয় দিক দিয়ে নুবিয়া মিশরের চাইতে অধিক মিশরীয় হয়ে দাঁড়ায়, আমেন পূজায় অধিকতর রক্ষণশীল হয়ে পড়েছিল। বিজয়ের মধ্যদিয়ে গৌরব অর্জন স্থানীয় রাজাদের একটি স্বাভাবিক ইচ্ছা এবং সে গৌরব অর্জনের মাধ্যমে ধর্মকেও সুরক্ষিত করা যাবে। ৭৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ নাগাদ নুবীয়রা উত্তরদিকে অভিযান শুরু করে।

বিজয় অর্জন তেমন কঠিন ছিল না। কারণ বহুধাবিভক্ত মিশর সহজ শিকারে পরিণত হয়েছিল। নুবীয় শাসক কাশতা অনায়াসেই খিবিস দখল করে নেন এবং নির্বাসিত পুরোহিত বংশধরদের সেখানে পুনর্বাসিত করা হয়। কাশতার উত্তরাধিকারী পিয়াংখি ৭৩০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আরও উত্তরদিকে অগ্রসর হন, একেবারে ব-দ্বীপের অভ্যন্তরে। তাকে নতুন রাজবংশের প্রথম রাজা হিসাবে গণ্য করা হয় (তার নিজের দেশ ইথিওপিয়ার নাম অনুসারে ইথিওপীয় বংশ)। কিছুদিনের জন্য জনদুয়েক মিশরীয় শাসক ব-দ্বীপের একাংশে তার বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়াবার চেষ্টা করে। মানেধ্যে এই মিশরীয়দের চতুর্বিংশ এবং নুবীয় বিজয়ীদের পঞ্চবিংশ রাজবংশরূপে গণ্য করেন।

পিয়াংখির ভাই শাখা ৭১০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে উত্তরাধিকার লাভ করেন এবং নাপ্টা থেকে অধিকতর গৌরবময় খিবিস নগরে তার রাজধাণী স্থানান্তর করেন।

ইথিওপীয় রাজবংশকে বহিরাগত মনে করা ঠিক হবে না। নিশ্চিত করে বলা যায় এ বংশের রাজারা মিশরের মূল ভূখণ্ডের বাহিরের তবে লিবীয় রাজবংশের মতোই সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে পুরোপুরি মিশরীয়।

ইতিমধ্যে পশ্চিম এশিয়ায় একটি নতুন সাম্রাজ্যের অভ্যুদ্বয় ঘটছিল যা প্রাচীন মিত্তানী ও হিটাইটদের পিছনে ফেলে এগিয়ে গিয়েছিল এবং নিষ্ঠুরতার দিক দিয়ে নজির স্থাপন করেছিল।

.

এসিরীয়গণ

সাম্রাজ্যটি ছিল এসিরীয়া। মিশরের প্রাচীন সাম্রাজ্যের সময়ই তাইগ্রিস নদীর উজান এলাকায় এসিরীয় শক্তির উত্থান ঘটে। এটি ইউফ্রেটিস-তাইগ্রিস এলাকার নগর রাষ্ট্রের সংস্কৃতি ধার করে একটি নতুন সমৃদ্ধ বাণিজ্যিক জাতির জন্ম দেয়।

কয়েক শতাব্দী ধরে তারা সামরিক দিক দিয়ে অগ্রসর প্রতিবেশী জাতির অধীনে ছিল। উদাহরণস্বরূপ এটি ছিল মিত্তানী অধীনস্থ রাজ্য এবং তৃতীয় পুতমসের আক্রমণে বিপর্যস্ত মিত্তানীর অংশীদার ছিল। এক শতাব্দী পরে এটি হিট্টাইটদের অধীনে চলে যায়। ১২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে হিট্রাইটদের পতনের পর একটি নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সুযোগে সমুদ্রচারী কিছু জাতির আগমনে একটি অন্ধকার যুগের সূচনা হয় যা সমগ্র পশ্চিম এশিয়াকে প্রভাবিত করে।

তবে অদ্ভুত এক বিস্ময়কর ঘটনা ঘটে। এসিরীয়রা হিব্রাইটদের কাছ থেকে লোহা গলানোর পদ্ধতি শিখে নেয়। যেমনটা সে সময়ের অনেক জাতি শিখেছিল। তবে তারাই সর্বপ্রথম এই ধাতুটির ব্যবহারিক পদ্ধতি আবিষ্কার করতে পেরেছিল।

তারা তাদের সৈন্যবাহিনীকে লোহার অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত করতে পেরেছিল। যেমনটা করেছিল গ্রীস আক্রমণের সময় ডরিয়ানরা। এসিরীয়রা ধীরে ধীরে পরিপূর্ণ লৌহাস্ত্র-সজ্জিত সেনাবাহিনী গঠন করে। এটি ছিল এক গোপন অস্ত্র। এক হাজার বছর পূর্বে যেমনটি ছিল অশ্ব ও রথ।

এসিরীয়গণ প্রাথমিক যুদ্ধজয়ের আস্বাদ পেয়েছিল যখন তাদের রাজা প্রথম তিগলাথ-পিলেসার ১১০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে পশ্চিম ভূমধ্যসাগরের দিকে অভিযান চালিয়েছিল যখন রামেসেস বংশধরেরা মিশরে ক্ষমতাসীন। তবে এসিরীয়গণ পিছু হটে আসে যখন নতুন যাযাবররা পশ্চিম এশিয়ার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এবার এই যাযাবর জাতিটি ছিল আর্মেনীয় যারা ইসরায়েল ও জুডার উত্তরে একটি রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিল। ইসরাইলিদের কাছে এবং তাদের নিজেদের কাছেও রাজ্যটির নাম ছিল আরাম। তবে বাইবেলে কিং জেস-এর ভাষ্যমতে গ্রিক ভাষায় দেশটির নাম ছিল সিরিয়া।

যে সময় লিবীয় বংশ মিশর শাসন করছিল এসিরীয়ার তখন পুণরুত্থান ঘটে। এর সৈন্যবাহিনী অভুতপূর্ব যুদ্ধাস্ত্রে সজ্জিত ছিল, যেমন ভারী দেওয়াল ভাঙ্গার উপকরণ, যা দিয়ে সুরক্ষিত নগরকার ভেঙ্গে ফেলা যায়। ৮৫৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে এসিরীয় বাহিনী সিরিয়া আক্রমণ করেছিল এবং কিছু সময়ের জন্য সিরীয় ইসরাইলি যৌথ বাহিনী তাদের ঠেকিয়ে রাখতে পেরেছিল। তবে ডেভিড ও সলোমনের প্রতিষ্ঠিত সাম্রাজ্যের দুর্বলতা স্পষ্ট দেখা গিয়েছিল আর শীঘ্রই ভূমধ্যসাগরীয় উপকূলের এই ছোট্ট রাজ্যটির পতন হয়েছিল।

৭৩২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে যখন নুবীয়রা মিশর অধিকারে ব্যস্ত তখন এসিরীয় রাজা তৃতীয় তিগলাথ- পিলেসার সিরিয়া রাজ্য ধ্বংস করে এর রাজধানী দামাস্কাস দখল করে নেয়। দশ বছর পরে তার একজন উত্তরাধিকারী দ্বিতীয় সাৰ্গন ইসরায়েল ধ্বংস করে এর রাজধানী সামারিয়া দখল করে নেন। ৭০১ খ্রিস্টপূর্বাব্দ নাগাদ সাগনের পুত্র ও উত্তরাধিকারী সেনাকেরিব যেরুজালেম অবরোধ করেন।

ব-দ্বীপ অঞ্চলে সদ্য প্রতিষ্ঠিত নুবীয় ফারাওগণ এসিরীয় ভীতি দূর করার জন্য মরিয়া হয়ে চেষ্টা করে। হিক্সসদের পর থেকে এমন ঘটনা আর কখনো ঘটেনি মিত্তানী-হিটাইট বাহিনী ইউফ্রেটিস নদীর তীরে অবস্থান করছিল। তবে এসিরীয়রা সরাসরি মিশর সীমান্তে চলে এল। তার চেয়েও বড় কথা, তারা ইচ্ছাকৃত এক নিষ্ঠুর যুদ্ধের অবতারণা করেছিল যার ফলে মিশরীয়দের মনোবল সম্পূর্ণ ধসে পড়ে।

মিশরীয়রা বুঝতে পেরেছিল যে ভয়ংকর লৌহ বর্মে সজ্জিত এসিরীয় বাহিনীর মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। তাই নুবীয় ফারাও চেষ্টা করেছিলেন সিরিয়, ইসরাইলি, জুডীয় এবং ফিনিসীয়গণকে এগিয়ে আনতে। তার গুপ্তচরগণ অর্থ এবং মিষ্টবাক্য ছড়িয়েছিল যেখানে যেমন প্রয়োজন এবং এসিরীয় আক্রমণের বিপদ সম্বন্ধে তাদের সচেতন করতে চেয়েছিল। মিশর সতর্কতার সাথে তার শক্তি সংহত করেছিল এই আশায় যে যেভাবেই হোক এসিরীয় বিপর্যয় থেকে বাঁচা যাবে।

অবশেষে এসিরীয় বাহিনী যখন যেরুজালেম অবরোধ করে তখন সবার চৈতন্যোদয় হলো যে এবার যুদ্ধে নামতে হবে এবং তার ভ্রাতুস্পুত্র তাহাকার অধীনে মিশরীয় বাহিনীকে প্রেরণ করেন সেনাকেরিবের মোকাবেলা করতে। মিশরীয়রা পরাজিত হয়েছিল তবে সে ছিল এক কঠিন সগ্রাম এবং সেনাকেরিবকে আপাতদৃষ্টিতে একটি দুর্বল বাহিনীর মোকাবেলা করতে হয়েছিল। তবে তার নিজ সাম্রাজ্যে বিদ্রোহের সংবাদ শুনে সাময়িকভাবে তাকে ফিরে যেতে হয়েছিল। মিশর রক্ষা পেয়েছিল এবং যেরুজালেমেও আনন্দ উল্লাস চলছিল যেহেতু তারা আরও এক শতাব্দীর জীবন ফিরে পায়।

এসিরীয় সাম্রাজ্যে সকল প্রকার বিশৃঙ্খলা দূর করে যখন সাম্রাজ্যকে ভীতিমুক্ত সন্ত্রাসমুক্ত করতে সক্ষম হলেন ঠিক সেই মুহূর্তে ৬৮১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সেনাকেরিবকে হত্যা করা হয় এবং এসিরীয় সাম্রাজ্যে চরম বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্যের শুরু হয়।

তার পুত্র এসাহাৰ্ডন আবার বাইরে দৃষ্টি দিতে সক্ষম হলেন। মিশর সম্বন্ধে তিনি নতুন করে ভাবতে শুরু করলেন। মিশর যখন এসিরীয় ষড়যন্ত্রে ব্যস্ত তখন এসিরীয়া নিজ দেশে একের পর এক বিদ্রোহ দমনে নিয়োজিত। ইতিমধ্যে তাহার্কা ফারাও হিসাবে মিশরের সিংহাসনে আসীন এবং এসহার্ডন মিশরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত।

তাহার্কা এবং তার মিশরীয় বাহিনী মরিয়া হয়ে সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ শুরু করে। ৬৭৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তারা একটি যুদ্ধে এসিরীয় বাহিনীকে পরাস্ত করতে সক্ষম হয়। তবে এতে চূড়ান্ত পতন শুধু কিছুদিনের জন্য বিলম্বিত হয়েছিল। ৬৭১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এসাহাৰ্ডন অতিমাত্রায় আত্মবিশ্বাস পরিত্যাগ করে সুপরিকল্পিতভাবে যুদ্ধে ফিরে আসেন। তিনি মেসি এবং ব-দ্বীপ অধিকার করেন এবং তাহাকাকে দক্ষিণে হটে যেতে বাধ্য করেন।

তবে তাহার্কা হাল ছেড়ে দেননি, তিনি একটি প্রতিআক্রমণের প্রস্তুতি গ্রহণ করলেন এবং ভাটির দিকের আক্রমণে সাফল্য লাভ করলেন। ৬৬৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আর একটি আক্রমণের আয়োজন করার পূর্বেই এসহার্ডন মৃত্যুবরণ করেন। তবে তার পুত্র আসুরবানিপাল পিতার অসমাপ্ত কাজ সম্পূর্ণ করেছিলেন। তিনি যে শুধু মেসি পুনর্দখল করেছিলেন তাই নয়, তিনি এমন একটা কিছু করেছিলেন যা ইতিপূর্বে হিক্সসরাও করতে পারেনি। তিনি থিবিসে আশ্রয় নেয়া তাহাকার পশ্চাদ্ধাবন করেন।

৬৬১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তিনি থিবিস দখল করে ধ্বংস করে দেন এবং নুবীয় ফারাও বংশের সমাপ্তি টানেন। নুবিয়াতে তারা আরও এক হাজার বছর রাজত্ব করেছিল তবে তাদের সভ্যতার অধঃপতন ঘটে এবং এক শতাব্দীর স্বল্পস্থায়ী গৌরবের চির অবসান ঘটে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *