১৩. কোকিলকণ্ঠী নূরজাহান
নুরজাহানকে সম্ভবত আমি প্রথমবার ‘খান্দান’(১৩) ছবিতে দেখি। তখনকার দিনে সে ‘বেবি’ ছিল। যদিও রুপোলি পর্দায় তাকে বেবির মতো দেখানো হয়নি। একজন তরুণীর দেহে পূর্ণতার যেসব চিহ্ন থাকা প্রয়োজন তার দেহে তা পরিস্ফুট ছিল এবং সময় মতো তা প্রদর্শন করতে পারঙ্গম ছিল।
সেকালে নূরজাহান সিনেমা দর্শকদের জন্যে বিতর্কের বস্তু ছিল এবং দর্শকের মধ্যে সে প্রলয়কাণ্ডের মতো প্রভাব বিস্তার করেছিল। কিন্তু আমার কাছে তার শেকেল ছুরতে’ এমন কোনো বৈশিষ্ট্য ছিল বলে মনে হয় না– একমাত্র তার দুর্দান্ত গলা ছাড়া। সায়গলের পরই আমি নূরজাহানের গলার প্রতি আকৃষ্ট হই। এমন দরাজ কণ্ঠ অপূর্ব খরজ ও তীক্ষ্ণ তীব্র শাণিত পঞ্চম আর কারও কণ্ঠে শুনিনি। আমি মনে করি এই মেয়েটি একটি তান এক ঘণ্টা ধরে রাখতে পারে– বাজিকরেরা যেমন শুন্যে লম্বা দড়ির ওপর স্থির হয়ে থাকতে পারে।
নূরজাহানের কন্ঠে এখন আর সেই লালিত্য, সেই মাধুর্য, সেই কোমলতা ও প্রাঞ্জলতা নেই- যা তার কণ্ঠের সবচেয়ে বড়ো বৈশিষ্ট্য ছিল। যদিও লতা মুঙ্গেশকরের ঐন্দ্রজালিক কণ্ঠ আজ সর্বত্র আদৃত হচ্ছে– তবুও যখন নূরজাহানের কণ্ঠ শোনা যায়, শ্রুতি তাকে উপেক্ষা করতে পারবে না।
নূরজাহান যে একজন ওস্তাদের মতো সংগীতবিদ্যায় পারদর্শিনী তা খুব কম লোকই জানে। ঠুমরি, খেয়াল, ধ্রুপদ সবই গাইতে পারে এবং তা অত্যন্ত সুষ্ঠ ও নিখুঁত ভাবেই গেয়ে থাকে। এই সংগীতবিদ্যা সে অর্জন করেছে তার জন্মস্থান থেকে এবং সেখানকার পরিবেশ ছিল সংগীত শিক্ষার জন্য অত্যন্ত উপযোগী, কিন্তু খোদাপ্রদত্ত একটা বস্তুও ছিল। সংগীতবিদ্যায় অসাধারণ জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও যদি গলায় দরদ না থাকে তাহলে সেই প্রতিভা শ্রোতাদের নিকট গ্রহণীয় হয় না।
নুরজাহান সংগীতও জানত এবং খোদাপ্রদত্ত কণ্ঠেরও অধিকারিণী ছিল।
এখানে আমি আপনাদের একটা মজার কথা শোনাই। খোদা যাদের প্রতি অনুগ্রহ প্রদর্শন করেন, তারা তার অপব্যবহার করে থাকে। আমি দেখেছি, তারা এ সবের কোনোই পরোয়া করে না। বরং ইচ্ছাকৃতভাবে যথেচ্ছাচার করে বেড়ায়। আর তা নষ্ট হয়ে যায় অবলীলাক্রমে।
মদ গলার জন্যে অত্যন্ত অপকারী কিন্তু সায়গল অত্যন্ত মদ্যপ ছিলেন। টক এবং তেলেভাজা খাবার গলার জন্য ক্ষতিকর একথা কে না জানে, কিন্তু নূরজাহান প্রায় একপোয়া তেলের আচার খেয়ে ফেলত। আরও মজার ব্যাপার, যেদিন তাকে সিনেমায় গান গাইতে হত, সেদিনই সে বেশি পরিমাণে আচার খেত। তারপর বরফ দেয়া পানি খেয়ে মাইক্রোফোনের সামনে যেত।
অশোককুমারকেও আমি বরফ খেতে দেখেছি। যখনই গান রেকর্ড করতে যেত তখন তাকে বরফের টুকরো চিবোতে দেখা যেত।
যতদিন রেকর্ডের অস্তিত্ব থাকবে স্বৰ্গত সায়গলের কণ্ঠও ততদিন জীবিত থাকবে। অনুরূপ ভাবে নুরজাহানের কণ্ঠও বহুদিন বেঁচে থাকবে এবং ভবিষ্যৎ বংশধরদের কানে সে কণ্ঠ মধু ঢালতে সক্ষম হবে।
নূরজাহানকে আমি শুধু পর্দায় দেখেছিলাম। আমি তার ‘শেকেল ছুরত’ এবং অভিনয়ে কখনও আকৃষ্ট হইনি। শুধু তার কণ্ঠ শুনে অভিভূত হয়েছিলাম। তার বয়েসও ছিল কম তাই আমি বিস্মিত হয়েছিলাম, এত অল্প বয়সে সে এত ভালো গান শিখল কী করে? সেকালে খুরশিদও শ্রোতাদের কম প্রভাবিত করেনি- শামশাদও আলোচ্য বিষয় ছিল। কিন্তু নূরজাহানের কণ্ঠের নীচে সবার কণ্ঠ তলিয়ে গেল।
সুরাইয়ার(১৪) উদ্ভব এদের পরে। আমার দুঃখ হয় সায়গল সুরাইয়া জুটির ছবি হল, কিন্তু নূরজাহান-সায়গলের জুটি হল না। জানি না প্রডিউসারদের মাথায় এই জুটির কথা কেন ঢোকেনি। এই জুটি কোনো ছবিতে নামলে সংগীত জগতে এক বিপ্লবের সূত্রপাত হত।
নূরজাহানের সঙ্গে আমার কবে সাক্ষাৎ হয়, কখন হয়, কোথায়, কেমন করে এ কাহিনি অত্যন্ত দীর্ঘ। আমি কয়েক বছর বোম্বাইতে অবস্থানের পর বিভিন্ন কারণে বিরক্ত হয়ে দিল্লি চলে যাই এবং অল ইন্ডিয়া রেডিয়োতে চাকরি করি। কিন্তু এখানেও মন বসল না। বোম্বাই থেকে ‘মুসব্বির’ পত্রিকার সম্পাদক নজির লুধিয়ানবির কয়েকটি চিঠি পেলাম। সে লিখেছে, তুমি এখানে চলে এসো। খান্দানের পরিচালক শওকত হোসেন রিজভি বোম্বে এসেছেন এবং আমার কাছেই অবস্থান করছেন। তাঁর ইচ্ছা তুমি তার জন্যে একটা কাহিনি লিখে দেবে।
আমি দিল্লি ত্যাগ করলাম, এ হল সেই সময়কার কথা, যখন ক্রিপস মিশন ব্যর্থ হয়ে ফিরে গেল। সম্ভবত ১৯৪০ সালের ৭ আগস্ট আমি বোম্বে পৌঁছই। শওকতের সঙ্গে আমার দেখা হয় ক্লেয়ার রোডের ১/১৭ ডেলফি চেম্বারে। এটা তার অফিস ও আবাস উভয়ই ছিল।
বড়োই সুগঠিত দেহের অধিকারী ছিল শওকত। ফরসা রং, গাল দুটোর লালিমা আর অতি সূক্ষ্ম জন গিলবার্ট ধরনের একজোড়া গোঁফ, কোঁকড়া চুল, দীর্ঘদেহী সুন্দর পরিচ্ছদ, পরিচ্ছন্ন পাতলুন, সদ্য পাটভাঙা কোট, টাই-এর নটটাও নিখুঁত, একটু দুলে দুলে হাঁটে। আমি প্রথম দর্শনেই তার অকপট বন্ধু বনে গেলাম।
আমি দিল্লি থেকে আসার সময় প্রিয় ব্রান্ড ‘ক্রাভেন-এ’ সিগারেট প্রচুর পরিমাণে সঙ্গে এনেছিলাম। কারণ যুদ্ধ শুরু হয়েছে। বোম্বেতে এই সিগারেট প্রায় দুষ্প্রাপ্য। শওকত আমার কাছে পঁচিশ টিন ও প্রায় পঞ্চাশ প্যাকেট সিগারেট দেখে অত্যন্ত খুশি হল।
আমরা দুজন তখন ১/১৭ ডেলফি চেম্বারে থাকতাম। দুটো কামরা ছিল জাহাজি সাইজের। একটায় ছিল অফিস অপরটি ছিল শয়নগৃহ। কিন্তু আমরা অফিসেই শুয়ে থাকতাম। মুশারফ এসে আমাদের বিছানা বিছিয়ে দিত।
শওকত যতদিন ওখানে ছিল ততদিন বেশ আনন্দেই দিন কাটত। ক্রাভেন সিগারেট আর নাসিকের হরিণমার্কা হুইস্কির পেছনে পয়সা উড়ত। শওকত ‘খান্দান’ তৈরির পর একজন বড়ো ডাইরেক্টর বনে গেল। কিন্তু লাহোর থেকে বোষে এসে কিছুদিন থাকবার। পরই তার সব কিছু খরচ হয়ে গেল।
অবস্থা বড়োই নাজুক ছিল। আমি ৭ আগস্ট বোম্বে পৌঁছই এবং ৯ আগস্ট যখন টেলিফোন করতে যাই, দেখি সব লাইনই ডেড। পরে জানতে পারলাম, কংগ্রেসি লিডারদের গ্রেফতারির তৎপরতা চলছিল তাই নিরাপত্তার খাতিরে সমস্ত টেলিফোন লাইন কেটে রাখা হয়েছে।
গান্ধিজি, জওহরলাল নেহরু, মওলানা আজাদ প্রমুখ নেতাকে গ্রেফতার করে কোনো অজ্ঞাত স্থানে প্রেরণ করা হয়েছে। শহরের অবস্থা গুলিভরা বন্দুকের মতো। বাইরে বের। হওয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। কয়েকদিন পর্যন্ত আমরা হরিণমাকা হুইস্কি খেয়েই চালালাম। এই সময় ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতেও বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। যেহেতু পরিস্থিতি ছিল অনিশ্চিত তাই কে ফিল্ম তৈরির ঝুঁকি নেবে। অতএব ছবি করার আলাপ-আলোচনা অনির্দিষ্ট কালের জন্য স্থগিত হয়ে গেল এবং আমরা নজির লুধিয়ানবির বাড়ির রান্না বিস্বাদ খাবার খেয়ে দিন কাটাতে লাগলাম। তবু কখনো-কখনন জীবনের স্পন্দন শুরু হত এবং আমরা ছবির কাহিনি নিয়ে মাঝে মাঝে আলাপ-আলোচনা করতাম।
এই সময় শুনতে পেলাম নূরজাহানও বোম্বে এসেছে। শওকতের সঙ্গে দেখা হওয়ার আগেই অমি জানতে পেরেছিলাম সে কথা।
মাহিমে আমি কয়েকজন আত্মীয়ের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। তা ছাড়া রেডিয়ো আর্টিস্ট ছামীনা’রও ঠিকানা আনতে গেলাম। পরে ছামীনার সঙ্গে কৃষণ চন্দরের সম্পর্ক স্থাপিত হয়। এই মেয়েটিকে আমি অল ইন্ডিয়া রেডিয়ো দিল্লি থেকে বোম্বে পাঠিয়েছিলাম। কেননা তার ফিল্মে কাজ করার শখ ছিল। তাকে আমি পৃথ্বীরাজ ও ব্রজমোহনের কাছে চিঠি দিয়ে পাঠিয়েছিলাম। এখন আমি জানতে চাইছিলাম সে ফিল্মে কাজ পেল কি না।
মেয়েটি অত্যন্ত চালাক ছিল এবং অভিনয়ও বেশ ভালোই করত। ডায়ালগ বলতে পারত খুব সুন্দরভাবে এবং চেহারাও ভালো ছিল। এ জন্যে আমি আশান্বিত ছিলাম, নিশ্চয়ই সে এ লাইনে সাফল্য অর্জন করবে।
আমি জানতে পারলাম সে শিবাজি পার্কের কোনো একটা জায়গায় থাকে। কিন্তু জায়গাটা এত বড়ো যে ‘ছামীনা খাতুন’-এর খোঁজ পাওয়া খুবই মুশকিল। তাই আমি নিজামি সাহেবের ওখানে গেলাম– তিনি ক্যাডল রোডের একটা বাড়িতে থাকতেন। তার ঠিকানা আমি জানতাম কেননা তিনি প্রায়ই আমাকে চিঠি লিখতেন। ইনি সেই নিজামি যিনি মমতাজ শান্তিকে তালিম দিয়েছিলেন এবং ওয়ালি সাহেব যার কাছে কয়েক বছর ধরনা দিয়ে পড়েছিলেন। অবশেষে নিজামি সাহেবের আদর্শ অনুসরণ করেই তিনি মমজাত শান্তিকে নিয়ে পলায়ন করেন। ইনিই সেই নিজামি– যাঁর স্ত্রী গীতা নিজামি সিনেমা-জগতে বেশ পরিচিত ছিলেন এবং অবশেষে তাঁর স্বামীকে ধোঁকা দিয়ে পরপর কয়েকজনের সঙ্গে বিয়ের গাঁটছড়া বাঁধেন। তার নামে আদালতে কয়েকটি মকদ্দমাও দায়ের করা হয়েছিল এবং বর্তমানে তিনি একটি সুন্দরী মেয়েকে সঙ্গে করে ডান্সিং পার্টি করে দেশে দেশে পাকিস্তান প্রচার করে বেড়াচ্ছেন।
নিজামি সাহেবের সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল শুধু পত্রের মাধ্যমে এবং তাও অতি নিয়মানুগ।
নিজামি সাহেব ধুতি আর গেঞ্জি পরে বসেছিলেন, আমাকে আগ্রহের সঙ্গে স্বাগত জানালেন। তিনি আমাকে আগমনের কারণ জিজ্ঞেস করলেন। আমি আমার উদ্দেশ্য ব্যক্ত করার পর তিনি বললেন, ছামীনা খাতুন এখনই আপনার সামনে হাজির হচ্ছে।
তার একজন আধমরা গোছের হিন্দু ম্যানেজার ছিল। তাকে তিনি হুকুম করলেন, মান্টো সাহেবের জন্য এখনই ছামীনা খাতুনকে হাজির করো। তারপর আমার দিকে চেয়ে বললেন : ‘আমি আপনার সব রকম সেবার জন্যে প্রস্তুত।’ অতএব তিনি এখনই আমার জন্য মৌখিক ভাবে একটা উত্তম ফ্ল্যাট, দামি ফার্নিচার ও একটা গাড়ির ব্যবস্থা করে। ফেললেন।
নিজামি যাই হোন, লোকে তাকে ভেড়ুয়া বলে, বেদে বলে–আমি কিন্তু তার বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে অজ্ঞ। কিন্তু আমার নিজের চোখে দেখে তাকে একজন সংগ্রামী তোক বলে মনে হল, এবং তিনি তার বিদ্যায় পুরোপুরি দক্ষ ছিলেন। আমি সেদিন প্রথম সাক্ষাৎকারে দেখলাম মমতাজ শান্তির ওপর তার যে প্রভাব তা কোনো পিতার পক্ষেও সম্ভব নয়। আর ওয়ালি সাহেব তাঁর সামনে এমনভাবে মাথা নুইয়ে ছিলেন মনে হচ্ছিল তিনি যেন একজন সহিস।
তিনি এই গৃহের বাদশাহ ছিলেন এবং সকলেই তাকে কর দিত। তার কাজ ছিল শুধু প্রডিউসারদের মদ খাওয়ানোর দাওয়াত দেওয়া, ব্ল্যাক মার্কেট থেকে পেট্রোল কেনা এবং মমতাজ শান্তিকে উপদেশ দেওয়া, তুমি যদি এই ভঙ্গিমায় হাসতে পারো তাহলে অমুক প্রডিউসার তোমাকে কনট্র্যাক্ট দেবে। তুমি যদি অমুক শেঠের সঙ্গে এইভাবে করমর্দন করো তাহলে সেই রাতে আমার পকেটে দশ হাজার এসে পড়বে।
আমি সেখানে বসে হয়রান হয়ে দেখছিলাম আমি কোন জগতে এসে পড়েছি। সেখানকার সব কিছুই আর্টিফিসিয়াল। ওয়ালি সাহেব নিজামির আদেশে তার স্লিপার। এনে পায়ের কাছে রাখলেন। তার মধ্যেও কৃত্রিমতা ছিল– খোদার কসম করে বলছি কৃত্রিমতা ছিল। আর মমতাজ শান্তি অত্যন্ত সাদাসিধে পোশাকে জানালার ধারে দাঁড়িয়ে পর্দার জন্য পেরেক ঠুকছিল। নিজামি সাহেব বলছিলেন, মান্টো সাহেব, এই মেয়েটি বড়োই সরল। সিনেমা জগতে থেকেও সে আশপাশের কোনো কিছু জানে না। আর এসব হল আমার শিক্ষার ফল।
আমার মন বলছিল এ সবই ফ্রড, সবই জাল। কিন্তু নিজামি সাহেবের সামনে তার প্রশংসা করতে হল।
কিন্তু কথা হচ্ছিল নুরজাহানকে নিয়ে। মমতাজ শান্তিকে তালিম দেওয়া এবং সৎপথে পরিচালনার সম্বন্ধে কথা বলতে গিয়ে তিনি বললেন, বর্তমানে নূরজাহানও তারই আশ্রয়ে আছে এবং মমতাজ শান্তির মতো শিক্ষা গ্রহণ করছে। তিনি বললেন : মান্টো সাহেব, যদি এই মেয়েটি আরও কিছুদিন লাহোরে থাকত তাহলে ওর সর্বনাশ হয়ে যেত এতদিনে। আমি ওকে এখানে আনিয়েছি এবং তাকে বলছি, দেখ মেয়ে শুধু ফিল্ম স্টার হলে কোনো ফায়দা নেই। কোনো একটা অবলম্বনও চাই। আগে থেকেই প্রেম করার প্রয়োজন নেই, আগে উপার্জন করতে শেখ। যখন ব্যাংকে তোমার প্রচুর টাকা জমে যাবে তখন কোনো ভদ্রলোকের সঙ্গে ঘরসংসার পেতে বসো। সারা জীবন সে তোমার গোলামি করবে। আপনার কী মনে হয় মান্টো সাহেব, আপনি তো একজন বুদ্ধিমান ব্যক্তি।
আমার সমস্ত বুদ্ধিই নিজামি সাহেবের ফ্ল্যাটে ঢোকার আগে নীচের ফুটপাথে পড়েছিল। আমি কী জওয়াব দেব! ব্যস, বলে বসলাম, আপনি মূল্যবান কথা বললেন। তিনি খুব খুশি হলেন। সুতরাং তিনি তখনই নূরজাহানকে ডেকে পাঠালেন। তখনই আবার টেলিফোনের ঘণ্টি বেজে উঠল এবং একটু পরই নুরজাহানের গলা শোনা গেল, এখনই আসছি, কামাল সাহেবের টেলিফোন এসেছে।
নিজামি সাহেব একটু হেসে বললেন, ‘এই কামাল সাহেব হচ্ছেন সৈয়দ কামাল হায়দার আমরোহী’ (পুকার খ্যাত কামাল) নিজামি সাহেব আমার দিকে চেয়ে বললেন, অবলম্বন যদি হয়, তাহলে কামালের চেয়ে ভালো অবলম্বন নূরজাহানের আর কে হতে পারে। কিন্তু আমি তাকে পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছি বিয়ে-টিয়ের ধারেও যেও না। কামাল রোজগার করতে পারে, তার কিছু যদি নূরজাহান পায় তো ক্ষতি কী?
আমি হেসে বললাম: আপনার মতো গুরু যখন আছে তখন আর চিন্তা কীসের?
নিজামি সাহেব খুশিতে ডগমগ হয়ে উঠে তখন আমাকে একটা ফার্স্ট ক্লাস লেমন স্কোয়াস খাওয়ালেন।
নিজামি সাহেবের ফ্ল্যাটে আমি এক নজর নূরজাহানকে দেখেছিলাম এবং আমার এই উপলব্ধি হয়েছিল যে, এই মেয়েটি যৌবনের দিকে ধাপে ধাপে এগিয়ে যাচ্ছে, এবং তার হাসির ভঙ্গিমা একটা ব্যবসায়িক ঢং রচনা করে রেখেছে তার দেহে মেদের সঞ্চারও ঘটেছে–একদিন নিশ্চয়ই সে তার গুরুর যোগ্য শিষ্যায় পরিণত হবে।
সৈয়দ শওকত হোসেন রিজভির সঙ্গে লাহোর পাঞ্চোলি স্টুডিওতে নূরজাহানের প্রেমালাপ শুরু হয়েছিল। এ নিয়ে মকদ্দমাও হয়েছিল। আত্মরক্ষার জন্যে নূরজাহান আদালতে বিবৃতি দিয়েছিল তার সঙ্গে শওকত সাহেবের কোনো সম্পর্ক নেই। সে তাঁকে ভাই-এর মতো মনে করে।
নুরজাহানের এই আদালতি ভাই এখন বোম্বে এসে গেছে।
আমি শওকতকে নূরজাহানের কথা বললাম যে, তার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে। তখনও পর্যন্ত আমি তাদের রোমান্টিক সম্পর্কের কথা জানতাম না। বর্তমানে তাদের মন কষাকষি চলছে তাও জানতাম না। সে হুইস্কির গ্লাস জোরে টেবিলের ওপর রেখে বলল চুলোয় যাক।
আমি একটু বিদ্রুপের সুরে বললাম, তো হাজার বার যাক, কিন্তু সে তো তোমার ‘খান্দানে’ হিরোইন ছিল।
হেসে বলল মান্টো কথা হল এই, আমি তার সম্বন্ধে কোনো কথাই শুনতে চাইনে। আমি জানি সে বোম্বেতে আছে। সে আমার পেছনে এখানেও ধাওয়া করছে। কিন্তু এখন আমার তার কোনো প্রয়োজন নেই।
আমি যখন তাকে বললাম, নূরজাহান কামাল আমরোহীকে টেলিফোন করে এবং নিজামিও চাইছে যাতে এ দুইজনের সংযোগ ঘটে তখন আমি অনুভব করলাম, বাইরে সে যতই অবজ্ঞা প্রদর্শন করুক ভেতরে খুবই উত্তেজিত হয়ে পড়েছে।
এরপর দীর্ঘকাল ধরে যখনই নূরজাহানের কথা উঠত তখনই আমি বুঝতে পারতাম শওকত এখনও নূরজাহানকে তার মন থেকে মুছে ফেলতে পারেনি। তাই সম্পর্কটা ছিল কৃত্রিম। আসলে এই সংগীত-সম্রাজ্ঞী তার হৃদয় রাজ্যের অধিকারী ছিল, এমনকি দৈহিক সম্পর্কও ছিল তাদের মধ্যে। তারা কোনদিনই বিচ্ছিন্ন হবে না বলে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছিল।
একদিন আমি শওকতকে খোলাখুলি জিজ্ঞেস করলাম- দ্যাখো ভাই, সত্যি বলো তো, তুমি এখনও নূরজাহানকে ভালোবাস কি না? শওকত জোরের সঙ্গে সিগারেটের ছাই ঝেড়ে বলল, হ্যাঁ ভাই, ভালোবাসি, কিন্তু গোল্লায় যাক সে। আমি ধীরে ধীরে ওকে ভুলে যাব।
কিন্তু নিয়তি তখন হাসছিল। সে যে সিদ্ধান্ত করেছিল সে সিদ্ধান্ত একেবারেই অটল। এর মধ্যেই ডাইরেক্টর ভি.এম. ব্যাসের সঙ্গে শওকতের কন্ট্রাক্ট হয়ে গেল। তিনি এর আগে নূরজাহানের সঙ্গেও একটা ছবি তৈরির জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলেন।
নূরজাহান বোম্বে আসার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি খবর পেয়ে গেলেন এবং তখনই তার সঙ্গে কন্ট্রাক্ট করে ফেললেন। কেননা তিনি জানতেন খান্দান ও অপর ছবিতে সফল অভিনয় করার দরুন তার নামে যে-কোনো ফাইন্যান্সিয়ারকে আটকানো সম্ভব হবে। আবার যখন তিনি জানতে পারলেন, খান্দানের ডাইরেক্টরও বোম্বে এসেছে তখন তিনি খুশিতে ফুলে উঠলেন। তিনি তখনই তার কর্মচারীদের পাঠালেন। শওকত হোসেন রিজভির সঙ্গে কয়েকবার সাক্ষাতের পর তার সঙ্গেও একটা ছবি তৈরির জন্য চুক্তিবদ্ধ হলেন।
কী ফিল্ম হবে; কেমন হবে, কাহিনি কী– এসব কারুর জানা ছিল না কিন্তু শেঠ ভি.এম. ব্যাস যখন নূরজাহান ও শওকতের সঙ্গে তার চুক্তিপত্র দেখালেন তখন তার চাহিদা মাফিক টাকা পেতে বিন্দুমাত্রও কষ্ট হল না।
প্রকৃতির গতিই বিচিত্র। শওকতও জানত না নূরজাহান সানরাইজ পিকচারে এসে গেছে আর নূরজাহানও জানত না তার আদালতি ভাইও এই ছবিতে তার সঙ্গে আছে। বড়োই লম্বা কাহিনি। আমি সংক্ষেপেই বলি।
শেষে একদিন সবই প্রকাশ হয়ে পড়ল। নিজামি ভীত হলেন যে, তার পরিকল্পনা। শেষে ব্যর্থ না হয়। যে ছবি শওকত পরিচালনা করবে তার নায়িকা হবে নূরজাহান। উভয়ের ‘পুণর্মিলন’ নিজামির পক্ষে দুঃখজনক ছিল। অতএব তিনি নূরজাহানের অভিভাবকরূপে শেঠ ব্যাসকে বললেন, তিনি এসব সহ্য করতে রাজি নন। কিন্তু ব্যাস নিজামি সাহেবের চেয়ে ধূর্ত ছিলেন। তাই তিনি তাঁর গুজরাটি চালে পঞ্জাবি কিস্তিমাত করে দিলেন। তিনি নিজামিকে রাজি করালেন যে, নূরজাহান শওকতের ছবিতে কাজ করবে, তাতে যত বিপত্তিই ঘটুক না কেন। সেখানে বসেই দুজন করদর্শন করলেন, উঠে কোলাকুলি করলেন এবং একে অপরকে ভাই বলে সম্বোধন করলেন।
এবার দুজনেই মনে মনে সন্তুষ্ট ছিলেন। শেঠ ব্যাসের সন্তুষ্টির কারণ ছিল তিনি কাজ বাগিয়ে নিয়েছেন এবং নিজামির খুশির কারণ ছিল তিনি একজন ফিল্মি-শেঠের কৃপাদৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছেন। শেঠ ব্যাস গোঁড়া বৈষ্ণব ছিলেন। নয়তো সেদিনই নিজামি সাহেব তাকে বাড়িতে ডেকে এনে মমতাজ শান্তির হাতে রান্না মোরগ পোলাও খাইয়ে দিয়ে তাদের বন্ধুত্বের ভিত পাকা করে ফেলতেন। আর যদি শেঠ বোতল রসিক হতেন তাহলে আধমরা হিন্দু ম্যানেজারকে দিয়ে কালোবাজার থেকে দু-বোতল হুইস্কি আনিয়ে দিতেন।
এবার একটা মজার কথা শুনুন। কথা তো পাকাপাকি হয়ে গেল। আমারও শেঠ ব্যাসের সঙ্গে একটা গল্প লেখার চুক্তি হয়ে গেল। আমি এবং শওকত গল্পের বিষয়বস্তু নিয়ে আলোচনা করছিলাম। অগ্রিম টাকাও পেয়েছিলাম। মির্জা মুশাররফ চাওলা এবং সায়গল (এরা বর্তমানে বড়ো ডাইরেক্টর) তখন আমাদের আরদালির কাজ করত, আরও মজার কথা হল এই যে, মির্জা মুশাররফ আমাদের সঙ্গেই পান করত, কিন্তু তৃতীয় পেগ পান করার পরই কাঁদতে শুরু করত। শওকতের হাত-পা ধরত এবং যেসব সন্দেহ শওকতের মনে কখনও উদয় হয়নি সেইসব কথা বলত আর মাফ চাইত। তারপর কাঁদতে কাঁদতে সে তার নববিবাহিতা স্ত্রীর কথা স্মরণ করত। তারপরই শুরু হত গান। যদিও এসব ছিল ফ্রড অর্থাৎ কৃত্রিম, কিন্তু সিনেমা জগতে এসব ছাড়া আর কীই বা হওয়া সম্ভব।
শেঠ ব্যাস তার ফিল্মের স্যুটিং শুরু করে দিয়েছিলেন। এর আগে যেসব সিনের চিত্র করা হয়েছিল তাতে নূরজাহানের কোনো রোল ছিল না। অর্থাৎ নূরজাহান ও শওকতের সাক্ষাৎকার এখনও পর্যন্ত সম্ভব হয়ে ওঠেনি। এক রাতে নোটিশ বোর্ডে দেখা গেল, নূরজাহান সেটে আসবে।
সেই রাতে আমি চলতে চলতে শিবাজী পার্কে রফিক গজনবির বাসায় গিয়ে পৌঁছলাম। এই খ্যাতনামা গীতিকার ও সংগীত পরিচালকের বিভিন্ন টাইয়ের বিভিন্ন প্রকার গেরোয় হরেক রকমের রোমান্স বাঁধা থাকত।
রফিক আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। আমাদের উভয়ের মধ্যে কোনো কৃত্রিমতা ছিল না। তার ফ্ল্যাটে পা দিয়েই দেখলাম পুরো মহফিল জমে আছে। আমি বিনা দ্বিধায় ভেতরে গিয়ে হাজির হলাম। গিয়ে দেখি সোফায় তার নতুন বউ খুরশীদ ওরফে অনুরাধা বসে আছে। তার পাশে নূরজাহান। অপর একটা চেয়ারে মিসেস নিজামিজি বিরাজমান এবং মেঝের ওপর আমার বন্ধু রফিক গজনবি এমনভাবে বসে আছেন যেন কোনো নতুন সোমনাথ অভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
যাক এসব কথা, রফিক সোমনাথের ওপর তার নতুন অভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছে আমি একথা বলতে পারি না। নিজামি এ বিষয়ে সচেতন ছিলেন কিনা এবং নূরজাহান নিজেও তার উদ্দেশ্য সম্বন্ধে অবগত কি ছিল না– খোদাই সব জানেন।
নিজামি সাহেবের কাছ থেকে আমি জানতে পারলাম মমতাজ শান্তিও এখনই এসে পড়বে। আমার বিস্ময়বোধ হল একথা ভেবে যে, ওদিকে সুটিং হচ্ছে আর এদিকে হুইস্কির পালা চলছে। নিজামির হাতেও গ্লাস–নূরজাহানও ধীরে ধীরে রঙিন পানীয় ঠোঁটে ছোঁয়াচ্ছিল। খুরশিদ ওরফে অনুরাধা তো পাঁড় মাতালের মতো গটগট করে গিলে চলছিল।
আমি ঘরে ঢুকতেই সে তার অভ্যাস মতো আমাকে একটা বড়ো গোছের গালাগালি দিল এবং পরক্ষণেই অতি বিনয়ের সঙ্গে বলে উঠল আসুন আসুন বসুন, নূরজাহানের দিকে ইঙ্গিত করে আমাকে জিজ্ঞেস করল ‘জানো, এ কে?
আমি বললাম- জানি।
রফিক অবজ্ঞার সুরে বলল, না, তুমি কিছু জানো না। এ হল নূর, নুর-এ-জাহ, প্রাণের প্রশান্তি। খোদার কসম এমন গলা পেয়েছে যে, বেহেস্তের কিন্নরকণ্ঠী হুরও যদি শোনে তাহলে আকাশ থেকে নীচে নেমে আসবে ওকে অভিনন্দন জানাতে।
আমি জানি রফিক কেন এই প্রশংসার সেতু রচনা করছে। মোদ্দা কথা, সে এই প্রশংসার সেতু অবলম্বন করে নূরজাহানের দেহ পর্যন্ত পৌঁছবার চেষ্টা করছিল। কিন্তু আমার চোখে স্পষ্ট প্রতিভাত হল, নুরজাহানের এতে বিন্দুমাত্রও স্পৃহা নেই। সে রফিকের কথা শুনছিল এবং তাকে সন্তুষ্ট করার জন্যে মাঝেমধ্যে কৃত্রিম হাসির মারফত তার জওয়াব দিচ্ছিল।
রফিক একজন হাড়কিপটে লোক। কিন্তু সেদিন সে অস্বাভাবিকভাবে হাতেমতাই এর ভূমিকা গ্রহণ করেছে। তার বোতল থেকে একটা বড়ো পেগ সে আমাকে দান করল এবং অনুরোধ করল, ওটা যেন আমি এক চুমুকেই শেষ করে দিই। এমন সময় হঠাৎ টেলিফোনের ঘন্টি বেজে উঠল। খুরশিদ ওরফে অনুরাধা তার হালকা পাতলা কিন্তু সুন্দর হাত দিয়ে ফোনের চোঙা তুলে কানে লাগিয়ে অপর পক্ষের কথা শুনেই চঞ্চল হয়ে উঠল। নূরজাহানের দিকে ফিরে ভীত কণ্ঠে বলল–শেঠ ব্যাস।
নিজামি এতে একটুও বিচলিত না হয়ে বলে উঠলেন : বলে দাও বেটি নূরজাহান এখানে নেই।
খুরশিদ ওরফে অনুরাধা বলে দিল ‘সে এখানে নেই।’
টেলিফোনের ব্যাপারটা শেষ হলে রফিক খুরশিদকে বলল : শায়দা, যাও ভেতর থেকে হারমোনিয়ামটা নিয়ে এসো। শেঠ ব্যাস জাহান্নামে যাক।
শায়দা হারমোনিয়ামের বাক্স খুলল, ঢাকনা তুলে বাতাস ভরে নূরজাহান নিজের বিশিষ্ট ভঙ্গিমায় একটা সুর তুলল। রফিক ঝিমুতে লাগল আর মুখে বলতে লাগল ‘বাহ, সোবহান আল্লা।
আমার ধারণায় রফিকের ওপর আল্লামা ইকবালের এই কবিতাটি খুব খাটে–দেতে হ্যায় সুরুর আউওল।
লাতে হ্যায় শরাব আখির।
অর্থাৎ প্রথমে নেশায় মত্ত করো, পরে দেও পান পাত্র।
আপনারা পদার নট-নটীদের অভিনয় দেখেন এবং তাদের অভিনয়ে মোহিত হয়ে যান। আমি এই নাটকের একটি দৃশ্য শুধু আপনাদের দেখাচ্ছি–যা সেদিন ওখানে অভিনীত হয়েছিল। তা ছিল শতকরা একশো ভাগ সত্যিকার নাটক।
নুরজাহান হারমোনিয়ামটি সোফার ওপর রাখল। পাশে অনুরাধা ওরফে খুরশিদ, হাতে হুইস্কির গ্লাস। রফিক গজনবি কার্পেটের ওপর জোড়াসনে বসে আছে আর তার কামনালোলুপ চোখ দুটো নূরজাহানের মুখে, দেহের নানা জায়গায় ঘুরে বেড়াচ্ছে এবং গান শুরু হওয়ার আগেই মাথা নাড়াতে শুরু করেছে। স্ত্রী নিজামি জান পাশের চেয়ারে বিরাজমান রয়েছে, তার পাশেই এই অধম বসে।
নূরজাহান গাইতে শুরু করল, সম্ভবত পিলু ঠুমরি- ‘তোরে নৈন কাজর বিন কারে’- এ সময় একটা মোটর বাইরে এসে দাঁড়াল। একজন মোটর থেকে বের হয়ে সোজা ভেতরে এসে পড়লেন। ইনি শেঠ ব্যাস।
ক্ষণিকের জন্য সবাই চকিত হয়ে উঠল কিন্তু নিজামি তখনই অবস্থা আয়ত্তে আনতে সক্ষম হলেন। শেঠ ব্যাসের আগমন সম্বন্ধে তিনি বিস্ময় প্রকাশ করে চেঁচিয়ে খুরশিদকে বললেন: ‘ওগো বাছা, একী জুলুম শুরু করেছ- সে ব্যথায় বাঁচে না আর তোমরা তাকে জোর করে গান গাওয়াচ্ছ। দেখ না একবার গেয়েই ওর হাল বিগড়ে গেছে। তারপর তিনি নূরজাহানের দিকে তাকিয়ে ভীতিপূর্ণ চোখে বললেন, শুয়ে পড়ো বাছা, শুয়ে পড়ো’। শেষে নিজেই এগিয়ে গিয়ে তাকে শুইয়ে দিলেন। নূরজাহান জোরে জোরে কাতরাতে লাগল। রফিকও উঠে সংশয়পূর্ণ চোখে নূরজাহানকে দেখতে লাগল। নিজামি সাহেব একবার খুরশিদের দিকে চেয়ে জোরে জোরে বললেন, শায়দা ওঠ। বসে কী দেখছিস? শিগগির গরম পানির বোতল নিয়ে এসো। খুব মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হয়েছে।
শায়দা উঠে তাড়াতাড়ি ভেতরে চলে গেল। নিজামি নূরজাহানকে সান্ত্বনা দিতে লাগল, তারপর শেঠ ব্যাসের দিকে চেয়ে বললেন, ভাইজান, এ হল সেই রোগ–প্রায়শ মেয়েদের হয়ে থাকে।
শেঠ ব্যাস চুপচাপ বসে রইলেন। আমি তো দম বন্ধ করেছিলাম।
নিজামি সাহেব আবার নূরজাহানের যন্ত্রণাকাতর দেহের দিকে ফিরে চাইলেন এবং তাকে আশ্বাস দেওয়ার প্রচেষ্টা করতে লাগলেন। তারপর আবার এসে শেঠ ব্যাসের পাশে বসে পড়লেন এবং বলতে শুরু করলেন, কাল থেকে বেচারি ব্যথায় মারা যাচ্ছে– আমাকে বলছিল চাচাজান, আমি স্যুটিং-এ যেতে পারব না। কিন্তু আমি বললাম, না বাছা এটা অশুভ লক্ষণ। বোম্বেতে এটা তোমার পয়লা ছবি, তার ওপর সুটিঙের পয়লা দিন–এসব ছাড়াও শেঠ ব্যাস আমাকে ভাই বলেছেন, তুমি নিশ্চয়ই স্যুটিং-এ যাবে, এজন্যেই আমি এখানে এসেছিলাম যে রফিকের কাছ থেকে কিছু ব্রান্ডি নিয়ে তার গাড়ি করেই স্টুডিও যাব। আপনি চিন্তা করবেন না। আপনার ক্ষতি আমারই ক্ষতি। আপনি তো আমার ভাই।
শেঠ ব্যাস চুপ করে বসে রইলেন। নিজামি ছাড়া আর কারও মুখেই রা ছিল না। রফিক গজনবি দাঁতে নখ কাটছিল এবং আমি চিন্তা করছিলাম এ সব হচ্ছেটা কী? কাহিনি ছিল আমার লেখা, মিউজিক রফিকের–এবং শেঠ ব্যাস আমাদের মনিব–এমন সময় হাজির হলেন–যখন আমরা একটু ফুর্তি করছিলাম।
নিজামি শেঠ ব্যাসকে তার বিশিষ্ট ভঙ্গিমায় আরও অনেক কথা বললেন। যখন একে অপরকে ভাই বলেছি তখন মনে কোনো সন্দেহের অবকাশ থাকা উচিত নয়।
ততক্ষণে খুরশিদ গরম পানির বোতলটা এনে নূরজাহানের পেটের ওপর রাখল। এতে সে কিছুটা শান্ত হল। তারপর নিজামি সাহেব চুপসে বসে থাকা শেঠ ব্যাসকে বললেন: আপনি তশরিফ নিয়ে যান। আমি আর রফিক এখনই নূরজাহানকে নিয়ে আসছি। তারপর স্বগতোক্তির মতো করে বললেন: আমার মনে হয় খুরশিদকেও সাথে নিয়ে যাব। কারণ মেয়েদের ব্যাপারটা মেয়েরাই ভালো জানে।
শেঠ ব্যাস উঠে তাঁর টুপিটা ঠিক করে মাথায় বসিয়ে চলে গেলেন –এবার সবার ধড়ে জান এল। নুরজাহান তার পেটের ওপরকার গরম পানির বোতলটা (ঠান্ডা পানি ভরা ছিল) সরিয়ে ফেলল। তারপর নিজামিকে জিজ্ঞেস করল- যতক্ষণ স্টুডিয়ো থেকে গাড়ি না আসবে সাধ্য কী যে সে স্টুডিয়ো যায়। আর গাড়ি আসলে পরও আমি তাকে এক ঘন্টা দাঁড় করিয়ে রাখতাম। রায়বাহাদুর চুনিলাল আমার বড়ো একজন সুহৃদ তাঁকে পর্যন্ত গ্রাহ্য করিনি। কোনো সময় এমনও হয়েছে যে, তিনি নিজের গাড়িতে করেই মমতাজ শান্তিকে নিয়ে গেছেন।
নিজামি আরও কিছুক্ষণ ধরে প্রডিউসর ও শিল্পীদের মধ্যেকার সম্পর্কের বিশদ বিবরণ অতি সূক্ষ্মভাবে বয়ান করলেন এবং যেসব কৌশল শিল্পীদের অবলম্বন করা উচিত সেইসব রহস্যও বিবৃত করলেন। নিজামি জোরের সঙ্গে নুরজাহানের মাথায় এ কথা ভরে দিলেন যে, তার সঙ্গে নূরজাহানের আর কোনো সম্পর্ক নেই।
এই আলাপে আমাকে যোগ দিতে হল, কারণ শওকতের সঙ্গে আমার প্রগাঢ় বন্ধুত্ব হয়ে গেছে এবং সে একথাও আমার কাছে স্বীকার করেছিল যে, সে নূরজাহানকে ভালোবাসে। তারপর মিজা মুশাররফের কাছ থেকে জানতে পারলাম শওকত নূরজাহানকে ভুলবার জন্যে অপরাপর মেয়েদের পেছনে ধাওয়া করছে।
স্বভাবত শওকত ছিল একজন ওয়াচ মেকার এবং এ বিদ্যায় সে দক্ষও ছিল– তাই প্রতিটি বস্তুই সে নিপুণতার সঙ্গে মেরামত করতে ভালোবাসত। কোনো বিকৃত দ্রব্য, বাঁকাচোরা পেরেক, অনিয়মিত ঘড়ি, কোঁচকানো কাপড়, কোনো বিশ্রী দাগ সে সহ্য করতে পারত না। তার চরিত্রের একটা শৃঙ্খলা ছিল, যা একটা ভালো ঘড়িতে হয়ে থাকে। কিন্তু নূরজাহানের ব্যাপারে সে একেবারেই অসহায় ছিল। সেই ঘড়ির কলকবজা সে কেমন করে মেরামত করবে যে ঘড়ির নাম হল হৃদয়। যদি তা এমন কোনো বস্তু হত– যা সে সামনে রেখে আই গ্লাস দিয়ে দেখতে পারত। যদি তার হেয়ার স্প্রিং ও ব্যালেন্স স্টাফের বিকৃতি ধরতে পারত, তাহলে সে ক্রু ড্রাইভার দিয়ে সব খুলে দেখতে পারত দোষটা কোথায় কিন্তু এ ব্যাপারটা তো মনের, হৃদয়ের।
ওদিকে নূরজাহান- যার গলায় অপূর্ব সুরের মূর্ঘনা–সেও ভাবত এবং চঞ্চল হয়ে উঠত কী করে তার মন থেকে শওকতের স্মৃতি ঝেড়ে ফেলা যায়। বড়ো বড়ো ওস্তাদের মতো সে খেয়াল গাইতে পারত–কিন্তু একটি খেয়াল তার মন ও মস্তিষ্ককে আচ্ছন্ন করে রাখত এবং এই খেয়াল হল তার প্রিয়তমের খেয়াল। সুন্দর সুপুরুষ শওকতের–যে তার জীবনের চরম আনন্দ দান করেছিল–যে তার দেহসায়রে হাবুডুবু খেয়েছে দীর্ঘকাল।
শওকত সম্পর্কে আলোচনা শুরু হতেই নূরজাহান মুখে তার প্রতি বিতৃষ্ণা ভাব প্রদর্শন করল। তখন আমি পারলাম না– আমি আকস্মিক বললাম, নূরজাহান, এসব বাজে কথা যা তুমি বলছ, আমি কসম খেয়ে বলতে পারি–সেটা তোমার মনের কথা নয়। আর শওকতের মুখেও তোমার সম্বন্ধে যা শুনি সেটাও মিথ্যে। তোমরা আসলে একে অপরের জন্যে পাগল। কিন্তু উভয়েই আত্মপ্রতারণা করছ। গতকাল সন্ধ্যায়ই ‘মুসাব্বর’-এর অফিসে তোমাদের কথা আলোচনা হচ্ছিল। শুধু কালই নয়- প্রতিদিনই হয়। সে বলে, বাদ দাও ওর কথা। তোমার অবস্থাও ঠিক তেমনই, তার কথা আলোচনার সময়ে আমি তোমার চোখে পানি দেখেছি। তোমাকে ছেড়ে সে বাঁচতে পারে না। জানি না তুমি কীভাবে তাকে মুগ্ধ করে রেখেছ?
নূরজাহানের মনে ভাবান্তর শুরু হল।
আমি আবার বলতে শুরু করলাম : আত্মবঞ্চনা ত্যাগ করো। আমি স্বীকার করি নিজামি সাহেব অত্যন্ত বিজ্ঞ ব্যক্তি কিন্তু প্রেম ভালোবাসাবাসির ব্যাপারে ওঁর কৌশল অচল। ওসব দুনিয়ার আর সব বাজারে চলে থাকে– এখানে এসব হল অচল মুদ্রা।
নিজামি সাহেব আমার বক্তৃতায় এতই ডুবেছিলেন যে, যখন তিনি অসম্মতিজ্ঞাপক ভাবে মাথা নাড়ালেন তখন মনে হল, তিনি বোধশক্তি হারিয়ে ফেলেছেন। তখন আমি আরও এগিয়ে গিয়েছি। নূরজাহানের চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছিল। আমি বললাম “তোমরা দুজনই বোকা। পরস্পরকে ভালোবাস কিন্তু তা গোপন করে রাখছ। কার কাছে কার ভয়ে– এ দুনিয়ার লোক তো কারও ভালোবাসা দেখতে পারে না। তার অর্থ এই নয় যে, লোকে ভালোবাসবে না। মমতাজ শান্তির জীবন অবশ্যই ঈষার। বিষয়। নিজামি সাহেবের মতো সহৃদয় এবং জ্ঞানী চাচার নিয়ন্ত্রণে সে খোদার ফজলে আরও উন্নতি করবে। কিন্তু (এখানে নিজামি সাহেবের দিকে ফিরে বললাম) নিজামি সাহেব, আপনার একথা অজানা নয়, প্রত্যেক লোকের একই চাচা কাজে লাগে না। যে উপদেশ দিয়ে আপনি মমতাজ শান্তিকে গড়ে তুলেছেন তা নুরজাহানের পক্ষে খাপ নাও খেতে পারে। কারণ দুজনের স্বভাবে আকাশপাতাল পার্থক্য। আমি কি মিথ্যে কথা বলছি।
আমি এবার নিজামি সাহেবকে এমন পর্যায়ে নিয়ে এসেছিলাম যে, এখন আর তাঁর পক্ষে আমার কথায় সায় না দিয়ে উপায় ছিল না। এই সুবর্ণ সুযোগের পুরোপুরি সদ্ব্যবহার করতে লাগলাম। আমি নূরজাহানের মন ও মস্তিষ্কের ওপর আরও চাপ দিলাম– হয়তো সে এর জন্যে আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল –ভালো করে বুঝিয়ে দিলাম। তোমরা একে অপরের জন্যে জন্মেছ এবং এখন যে তোমরা আত্মপ্রবঞ্চনা করছ, এটা অত্যন্ত মারাত্মক তোমাদের জন্যে।
নিজামি সাহেব উঠে গেলেন। কিন্তু তিনি খুশি ছিলেন না, তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের জন্যে তিনি আমার সঙ্গে রুক্ষ ব্যবহার করতে পারলেন না। তিনি আমার সঙ্গে খুব খুশি হয়ে কথাবার্তা বললেন এবং জানালেন, আপনার জন্যে ফ্ল্যাট ও ফার্নিচারের ব্যবস্থা প্রায় সম্পন্ন করে ফেলেছি। তিনি আরও বিস্ময় প্রকাশ করলেন যে, আমি এতদিন কোথায় ছিলাম– ফ্ল্যাটের চাবি তার ম্যানেজারের কাছে আছে এবং তিনি সব সময়ই আমার জন্যে অপেক্ষা করছেন। ব্ল্যাক মার্কেট থেকে পেট্রোল কেনার ব্যবস্থাও রেখেছিলেন। এছাড়া তিনি জানালেন আমি যেন তার দাওয়াত কবুল করি– তিনি আমাকে মুরগির গোশত ও জনি ওয়াকারের ব্ল্যাকলেবেল দিয়ে আপ্যায়ন করবেন।
আমিও তার কথার জবাবে যোগ্য শব্দ প্রয়োগের ধন্যবাদ প্রদান করলাম। কিন্তু তিনি একেবারে নাছোড়বান্দা হয়ে গেলেন, আমি যেন তাঁর দাওয়াত কবুল করি– আমাকেও বাধ্য হয়ে তাঁর নিমন্ত্রণ গ্রহণ করতে হল; কিন্তু আমি জানতাম, নিমন্ত্রণে মুরগির গোশত বা জনি ওয়াকারের নামগন্ধও থাকবে না।
আমি জানতাম কামাল আমরোহির প্রতি নূরজাহানের কিছুমাত্র আকর্ষণ ছিল না। তার টেলিফোন আসত, কিন্তু সে তার জওয়াব দিত না। যখন সে তার সেকেন্ডহ্যান্ড গাড়ি নিয়ে আসত, নূরজাহান কোনো কামরায় গিয়ে লুকিয়ে থাকত এবং নিজামির কোনো উপদেশই সে শুনত না।
এসব ব্যাপারে খবরাখবর আমার মারফত শওকতের কাছে পৌঁছোত। আমি আরও জানতাম, নুরজাহান ধূর্ত নিজামির জালে আটকা পড়েছে সেখান থেকে তাকে বের করা কঠিন কাজ। সুতরাং আমরা এক আলোচনা বৈঠকে মিলিত হলাম।
‘মুসাব্বির’ সম্পাদক নজির লুধিয়ানবি, আমি আর শওকত এই তিনজন ছিলাম। বৈঠকে প্রস্তাব নেওয়া হল ক্যাডল রোডে একটি বাড়ি নেব।
নজির লুধিয়ানবির চেষ্টায়ই ক্যাডেল রোডের সমুদ্রতীরে নীচের তলায় আমরা একটা সুন্দর ফ্ল্যাট পেয়ে গেলাম। এতে তিনটে বাথরুম, কয়েকটি কামরা এবং একটা বড়ো ড্রয়িংরুম ছিল।
ফ্ল্যাট ভাড়া নেওয়া হয়ে গেল–ভাড়া সম্ভবত একশো পঁচাত্তর টাকা। ফার্নিচার ইত্যাদি এনে দু-সপ্তাহের মধ্যেই ঘরটা সাজানো হয়ে গেল। শওকতের বেডরুম ছিল সমুদ্রের দিকে দরজাওয়ালা।
এখান থেকে পাঁচশো কদম চললেই নিজামির ফ্ল্যাট। অর্থাৎ এখন নুরজাহান ও শওকতের মধ্যেকার ব্যবধান রয়ে গেল মাত্র পাঁচশো কদম।
আমার জিম্মায় যে কাজ ছিল সেটা আমি অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে চলেছিলাম। কখনও নিজামির ফ্ল্যাটে গিয়ে হাজির হতাম। যদি নূরজাহানের দেখা পেতাম তাহলে বলতাম, শওকত আজ কতবার তার জন্যে হায় হায় করেছে এবং তার বিরহে কেঁদেছে।
আমার মারফত নুরজাহান একথাও জানতে পেরেছিল, শওকত এখন তাদের পাড়ায়ই থাকে এবং সে সাগর তীর ধরে পাঁচশো কদম গেলেই তার কাছে পৌঁছে যেতে পারে কিংবা শওকতও তার কাছে এসে পৌঁছোত পারে।
এখানে আমি একটা কথা আপনাদের জানিয়ে দিতে চাই। সেটা হল আমি দুজনের বিয়ের প্রবল বিরোধী ছিলাম। অভিনেত্রীর সঙ্গে বিয়ে-শাদির ব্যাপারটা আমার ধারণায় সংগত নয়। দুজন একত্রে বসবাস করুক- এই যথেষ্ট। যখন ভালো লাগবে না তখন যার যার পক্ষ দেখবে। কিন্তু শওকত তো দাসখত লেখার পক্ষপাতী ছিল। আমি তাকে অনেক বোঝালাম– সে অবশেষে কথা মানল এবং আমাকে জানাল, যদি নূরজাহানের সঙ্গে তার মিলন হয় তাহলেও সে তাকে বিয়ে করবে না।
তখন আমি আমার লেখা নওকর’-এর পটভূমি লেখায় ব্যস্ত ছিলাম। এছাড়া ক্যাডল রোড বাইকুল্লার ব্যবধানও বেশি ছিল–তাই শওকতের ওখানে যাতায়াত বেশ কমে গিয়েছিল। বেশ কিছুদিন পর আমি শওকতের ফ্ল্যাটে গেলাম। সব চুপচাপ। নজির লুধিয়ানবি সকালে গোসল ও নাস্তা সেরে অফিসে চলে গেছে। শওকত তখনও ঘুমিয়ে।
আমি তার শোবার ঘরে গিয়ে কড়া নাড়লাম। কোন সাড়াশব্দ পেলাম না। তারপর আবার জোরে কড়া নাড়লাম–ভেতর থেকে শওকত তন্দ্রাজড়িত কণ্ঠে বলে উঠল : ‘কে?’
আমি বললাম : মান্টো।
শওকত বলল : দাঁড়াও।
আমি দাঁড়িয়ে রইলাম। তিন মিনিট পর দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে দেখলাম ঘরের একমাত্র পালঙ্কে নূরজাহান শুয়ে আছে। আমি দেখেই চেঁচিয়ে উঠলাম ইনকিলাব জিন্দাবাদ।
নূরজাহানের চোখ দুটো দেখে মনে হচ্ছিল, এইমাত্র লন্ড্রি থেকে তাকে ধুয়ে আনা হয়েছে। তাকে একটু চঞ্চল মনে হচ্ছিল, আমি তাকে বললাম : তাহলে চিতোর গড় জয় করে নিয়েছ? শওকত হাসল– সে হাসিতে আত্মতৃপ্তির ভাব দেখা গেল। সে আস্তে। করে বলল, এসো বসো।
বলে শওকত বিজয়গর্বে একবার নূরজাহানের দিকে চেয়ে দেখল, নূরজাহান তখন চাদর মুড়ি দিয়ে খাটে শুয়েছিল। শওকত বলল : কাঁচা সুতোয় বেঁধে নিয়ে এলাম।
জানি না, সুতো কাঁচা না পাকা ছিল– তবে আমি একটা বলতে পারি, সে সুতো হাতে পাকানো নয়– হৃদয় দিয়ে পাকানো। আর খুব ভালোভাবে মাজা ঘষা ছিল। নয় তো পাঁচশো কদমের ব্যবধান এত তাড়াতাড়ি কী করে অতিক্রম করল।
শওকত আমাকে বলল : মান্টো, আমি ওকে বিয়ে করতে চাই।
আমি আবার তাকে বললাম: সে তোমার ইচ্ছে–কিন্তু আমার পরামর্শ হল এটা তুমি ভালো করছ না। তুমি এ বিষয়ে তোমার আত্মীয়স্বজনদের কাছ থেকে কোনো পরামর্শ নিয়েছ?
এ প্রশ্নের উত্তরে শওকত চুপ করে রইল।
বোম্বে শহরে তখন একজন হাকিম ছিলেন, তাঁর নাম ছিল আবু তাহের আশক আজিমাবাদী। ইনি এক আজব বস্তু ছিলেন। বয়েস পঁচাত্তর বছর হলেও মন ছিল একেবারে তরুণদের মতো। চোখের দৃষ্টিও বেশ পরিষ্কার ছিল। দাঁতও সব ছিল। তিনি প্রত্যেক ছবির প্রথম শো দেখতেন। পাঁচটি ভাষায় কথা বলতেন। ইংরেজি, পার্সি, আরবি, উর্দু ও গুজরাটি। খুব পরিশ্রমী লোক ছিলেন। হেকিমি চিকিৎসাও করতেন, আবার কাব্যচর্চাও করতেন। শওকতের সঙ্গে আমি তাকে পরিচয় করিয়ে দিই। সে তার পরম ভক্ত হয়ে যায় এবং তাকে চাচাজান বলে ডাকতে শুরু করে।
কয়েকদিন পর হাকিম সাহেব আমার কাছে এলেন। তাকে আমি অত্যন্ত শ্রদ্ধা করতাম। আমার রচনার সৌকর্য বৃদ্ধির জন্য তিনি অযাচিতভাবে আমাকে অনেক উপদেশ দিতেন। তাছাড়া তিনি আমাকে স্নেহও করতেন খুব। কেন-না আমি সব সময়েই তার সেবার জন্য উন্মুখ থাকতাম। কথায় কথায় তিনি আমাকে জানালেন, শওকতের সাথে নুরজাহানের বিয়ে হয়ে গেছে। এ খবরে আমি বিস্ময় বোধ করলাম। রীতিমতো আকাশ থেকে পড়লাম আমি।
একথা আর কদিন গোপন থাকা সম্ভব? পঁচাত্তর বছরের বৃদ্ধের সঙ্গে আমি কী তর্ক করব। আমার শুধু রাগ হচ্ছিল, শওকত কেন একথা গোপন করল। বিয়েই যদি করবে তবে তাতে আমার উপস্থিতিটা দোষের হবে কেন?
এরপর কিছুকাল গত হল।
নিজামি একেবারে চুপসে গেলেন। এদিকে সৈয়দ কামাল হায়দার আমরোহি টেলিফোন করে হয়রান হল এবং অবশেষে সেও হতাশ হয়ে কর্মে ব্যাপৃত হল।
শওকতের বেডরুম আবাদ হয়ে গেছে। সেখানে সব সময় হই-হুঁল্লোড় আর আনন্দের ঢেউ বয়ে যেতে লাগল। নূরজাহানের কণ্ঠ থেকে মধু ঝরতে লাগল। রফিক গজনবিকে দিয়ে সুর করিয়ে রিহার্সাল চলত সব সময়।
আরেকটা ঘটনা শুনুন:
আমার বড়ো ভাই ব্যারিস্টার সাঈদ হাসান বহুদিন ফিজি দ্বীপপুঞ্জে প্র্যাকটিস করতেন। একবার দেশে ফেরার পথে তিনি বোম্বে আসবেন বলে আমাকে খবর দিয়েছিলেন এবং তাতে লিখেছিলেন : আমি যেন বোম্বে শহরে তার জন্য একটা ফ্ল্যাট ঠিক করে রাখি। তখন আমি সপরিবারে মাহিমে থাকতাম। আমার ফ্ল্যাটটা খুবই ছোটো ছিল। তাই আমি প্রথমে স্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করলাম। সেখানে ‘মুসাব্বির’ পত্রিকার সম্পাদক নজির লুধিয়ানবিও উপস্থিত ছিলেন। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম শওকত আর নজির যে ফ্ল্যাটে থাকে সেখানেই তার থাকার ব্যবস্থা করা হোক। এক কামরায় ছিল নদীর, তা ছাড়া ছিল শওকত আর নূরজাহান যাদের শুধু একটা বেডরুমের প্রয়োজন ছিল। অবশিষ্ট কামরাগুলো তাদের তেমন কাজে আসত না। তাই আমার ভাইসাহেব যিনি বিদেশি জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত ছিলেন তার জন্যে সেখানে একটা বড়ো কামরার ব্যবস্থা করলাম। সুতরাং তিনি যখন বোম্বে এলেন এবং কয়েকদিন অবস্থান করবেন বলে জানালেন তখন আমরা তাঁকে ক্যাডল রোডে নিয়ে গেলাম।
তিনি কামরা দেখে অত্যন্ত খুশি হলেন। বাড়িটা প্রায় নতুনই ছিল। আধুনিক ধরনের দোতালা। ওপরতলায় বাড়িওয়ালা থাকত। পেছনে সমুদ্রের দিকে দুশো কদম গেলেই একটা ছোট্ট বাগান পড়ত। সে বাগানে দোলনা ছিল ছেলেদের খেলবার জন্যে।
সমুদ্রের হাওয়া সব সময়ই এখানে বইতে থাকত। তেজ হাওয়ার জন্য সমুদ্রের দিকে সব দরজা জানালা বন্ধ রাখতে হত– যাতে ঘরের আসবাবপত্র পড়ে ভেঙেচুরে না যায়।
ভাইজান তাঁর অল্প মালপত্র নিয়ে ওখানে উঠলেন। তাকে খুবই আনন্দিত মনে হল। কিন্তু কয়েকদিন পরই চরম ট্র্যাজেডি শুরু হয়ে গেল।
সিনেমা জগৎ হল রাতের জগৎ। দিনের বেলায় তারা নিজের নিজের বাসায় থাকে এবং সন্ধ্যা হতেই শওকতের বাসায় এসে জড়ো হয়। তখন চলত হুইস্কির পালা, তার সঙ্গে অট্টহাসি আর হই-হুঁল্লোড়। তারপর কাহিনি পড়ে শোনাত কেউ। একেক সময় এমন গোলমাল হত যে, উপরতলার লোককে বাধ্য হয়ে বলতে হত, তোমাদের জন্যে তো একদণ্ড ঘুমোত পারি না।
এক রাতে শওকত পরি চেহারা নাসিমবানুর স্তাবক কথিত মি. মুগনীকে দাওয়াত করল। সেখানে মিজা মুশাররফ ছিল। আমিও সস্ত্রীক সেখানে উপস্থিত ছিলাম। খাওয়া দাওয়ার পরই আমি স্ত্রীকে নিয়ে সরে পড়লাম। কেন-না আমার অন্যত্র একটা কাজ ছিল, ভাইজান শওকত আলির পুত্র জাহেদ আলির বাসায় নিমন্ত্রিত ছিলেন। অনেক রাতে তিনি ফিরে দেখেন, একদল মাতাল হই-হল্লা করছে। তাদের চিৎকারে কান ঝালাপালা, কারও কথাই শোনবার উপায় ছিল না। জানি না তিনি আর কী দেখেছিলেন। পরদিন সকালে তার বিছানাপত্র নিয়ে খেলাফত হাউসে গিয়ে উঠলেন এবং আমাকে আমার বন্ধুদের। সম্বন্ধে এমন সব কটুক্তি করলেন যা আজও আমার কানে গরম সিসা ঢালার মতো মনে হয়।
তিনি সারাজীবন শুধু আইনের বই পড়েছেন। মকদ্দমা চালিয়েছেন, আর ঘুরে বেড়িয়েছেন লাহোর, বোম্বে, পূর্ব আফ্রিকা ও ফিজি দ্বীপপুঞ্জে। তিনি কী করে জানবেন সিনেমা জগতের কথা। এ জগতের প্রেমিক প্রেমিকারাই বা কেমন হয়ে থাকে। খেলাফত হাউজ যে গলিতে অবস্থিত সে গলির নাম হল লাভ লেন’। অর্থাৎ প্রেমের গলি।
এবার নূরজাহানের দিকে ফেরা যাক। তার বড়ো বোন সেই ক্যাক্স রোডেই গোপনে পতিতাবৃত্তি করত তার এক ভাই-এর সহায়তায়। আমি জানি মি. শওকত কখনও তাকে সেখানে যাওয়ার অনুমতি দিত না।
নূরজাহানের ভাই একজন পাকা জুয়াড়ি ছিল। শেয়ার মার্কেটে জুয়া খেলত সে। তাই নূরজাহান ও শওকতের মিলন ঘটায় তার মনে দুঃখ হয়েছিল দারুণ। সে আবার চাচা নিজামির সঙ্গে পরামর্শ করতে লাগল যাতে এদের বিচ্ছেদ ঘটে এবং নূরজাহানকে দিয়ে নিজেদের সুবিধা করতে পারে। কিন্তু তাদের সে পরিকল্পনা বানচাল হয়ে গেল। শওকতকে ভীতি প্রদর্শন করা হল, কিন্তু সেও শক্ত মানুষ ছিল। তাই তাদের তৎপরতা শেষ হয়ে গেল।
ফিল্ম নওকরের সুটিং চলছিল। সুরারোপ করছিল রফিক গজনবি। সে খুবই মনোযোগের সঙ্গে নিজের কাজ করত। কিন্তু আমি সব সময়ই অনুভব করতাম রফিক গজনবি সব সময় মনমরা হয়ে থাকত। তার কারণ তারই নাকের ডগার সামনে আরেকজন এসে ছুকরিটাকে হাতিয়ে নিয়েছে।
যাই হোক, ফিল্ম নওকরের চিত্র গ্রহণের কাজ চলছিল। এই সময়ে আমার মনে হল, শওকত কোনো একটা লোকের কাজে সন্তুষ্ট থাকতে চায় না এবং ফিল্ম তৈরির ব্যাপারে সে নিজেকে সবচেয়ে বিজ্ঞ মনে করে থাকে। আমি তাকে কাহিনির পুরো পটভূমিকা ও সংলাপ লিখে দিয়েছিলাম, সে তা পছন্দও করেছিল। কিন্তু পরে জানতে পারলাম সে গোপনে আরও কয়েকজনকে দিয়ে সংলাপ লেখাচ্ছে। তাদের মধ্যে আমার শ্রদ্ধেয় আশক আজিমবাদীও একজন। তাই আমি তীব্র ভাষায় শওকতের কাছে প্রতিবাদ জানালাম। শওকত বুদ্ধিমান ছিল– সে নানা কৌশলে আমার মাথা ঠান্ডা করতে চেষ্টা করছিল। কিন্তু আমার মন খারাপ হয়ে গেল। কারণ কাহিনিও আমার মর্জিমতো লেখা হয়নি এবং তার প্রত্যেক স্থানেই শওকত তার মর্জিমতো অদল-বদল করেছে।
আমি বরাবর একজন বদরাগি ও রগচটা লোক, কিন্তু তার সামনে আমার কোনো প্রভাবই খাটত না। তা ছাড়া কিছুদিন তার সঙ্গে কাজ করার পর আমার এ ধারণা জন্মেছিল, যে লোক আমার সঙ্গে বসে হরিণমার্কা হুইস্কি ও জাভেন সিগারেট উড়িয়েছে এবং আমার সব কথাতেই সায় দিয়েছে–সে ফিল্ম তৈরির ব্যাপারে তার ঘড়ি নির্মাতার মস্তিষ্কের সাহায্যই নেবে–এতে কোনো সন্দেহ নেই। তাই আমিও নওকরের’ প্রোডাকশন থেকে নিঃশব্দে বের হয়ে এলাম। তার বিরুদ্ধে আমার অভিযোগ ছিল, কিন্তু আমাদের মধ্যে কোনো রকম চিড় ধরেনি এতে। আমি প্রথমে বলেছি, দেশে রাজনৈতিক আন্দোলনের জন্য ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির অবস্থা একেবারে খারাপ হয়ে পড়েছিল। কেউ যদি মঞ্চে দাঁড়িয়ে ইনকিলাব-জিন্দাবাদ’ ধ্বনি দিত তাহলেই কয়েকটা ফিল্ম বন্ধ হয়ে যেত। তা ছাড়া লড়াই-এর জন্য কাঁচা ফিল্মও দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠেছিল। এই দুরবস্থার জন্য কোনো ফিল্ম ডিরেক্টরেরই অবস্থা ভালো ছিল না। প্রডিউসারদের কাছেও বাহানার অন্ত ছিল না, টাকা কোথায়? লড়াই শুরু হয়েছে– আজ ক্রিটের যুদ্ধ, কাল ফিনল্যান্ডে, পরশু জাপানি আক্রমণের আশঙ্কা, কিন্তু সত্যি বলতে কী প্রডিউসার ও মাড়োয়ারি পুঁজিপতিরা এই সময়েই তাদের ঝুলি ভর্তি করেছে বেশি।
এই সময়ে আরেক জায়গায় শওকত কন্ট্রাক্ট পেল। সম্ভবত শেঠ জায়েরির (জওহরির বিকৃত বোম্বাই উচ্চারণ) সঙ্গে। লোকটা দারুণ ধড়িবাজ ছিল।–বড়ো বড়ো গুন্ডা বদমাইশদের সঙ্গে ছিল তার যোগাযোগ। কিন্তু যুদ্ধ তাকে শেঠ বানিয়ে দিল। এবার সে একটু আয়েশ-আরাম করবার ইচ্ছে করল। তাই ফিল্ম কোম্পানি খুলল। দু চারটে মোটরও কিনে ফেলেছিল সে। এই শেঠের সঙ্গে শওকতের কন্ট্রাক্ট হল। সে তাকে তিন হাজার টাকা অগ্রিম প্রদান করল। তখন আমিও ছিলাম শওকতের সঙ্গে। ক্যাশ করার পর আমি তা সঙ্গে নিয়ে পোস্ট অফিসে গেলাম।
পোস্ট অফিসে গিয়ে সেই টাকার সবই শওকতের বাড়িতে রেজেস্ট্রি বিমা করিয়ে পাঠিয়ে দিলাম। আমার মনে হয় নূরজাহান আমার এই কাজ পছন্দ করেনি। কিন্তু তাতে আমার কী এসে যায়।
এই সময়েই আমি শওকতকে জীবন বিমা করে নেবার কথা বলি। আমার কথা সে খুব কমই অমান্য করত। অতএব এভাবে দশহাজার টাকার পলিসি নেওয়া হয়ে গেল। আজ মনে হয়, আমার তখনকার কার্যাবলিতে কোনো মুরুব্বিয়ানা ছিল না– বালকসুলভ চপলতা, পরকে উপদেশ আর নিজের বেলায় উদাসীন থাকার নামান্তর।
নূরজাহান আরও সুন্দর হয়ে উঠেছিল। পুরুষের সান্নিধ্য নারীর সৌন্দর্য বর্ধনের জন্যে অতি প্রয়োজনীয়। তার দেহে যৌবনের লাবণ্য বিকশিত হয়ে উঠেছিল। যেসব অপূর্ণতা লাহোরে পরিদৃষ্ট হয়েছিল বোম্বে এসে তা পূর্ণতা লাভ করল এবং এক বিমলানন্দে তার সারা দেহ ঝলমল করতে লাগল।
একদিন আউটডোর স্যুটিং ছিল। বোম্বাই-এর শহরতলীতে কারও একটা সুন্দর বাগান নির্বাচন করেছিল শওকত। ক্যামেরায় রেড ফিল্টার লাগিয়ে স্যুটিং চলছিল– যাতে দিনকে রাত বলে দেখানো যায়।
শওকত আমাকে অনুরোধ জানাল, আমিও যেন তার সঙ্গে যাই। আমার একটু দেরি ছিল তাই শেঠ ব্যাসের গাড়িতেই রওয়ানা হলাম। লোকেশানে গিয়ে নূরজাহানকে দেখলাম, তাকে দেখেই আমার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। বিচিত্র সাজে সেজেছিল নূরজাহান। মামুলি সালোয়ার কামিজ পরেছিল, কিন্তু বড়োই চক্ষুপীড়াদায়ক।
সালোয়ারটা ছিল জালের তৈরি। ইংরেজিতে ওটাকে নেট বলা হয়। সাধারণত এসব কাপড় পর্দার জন্যে ব্যবহার করা হয়, জানি না এটা নূরজাহানই নির্বাচন করেছে না শওকত নিজে। কামিজও সেই একই কাপড়ের। এখন ভেবে দেখুন, এই কাপড়ে কী করে নূরজাহানকে আবৃত করা হয়েছে।
সেখানে শোভনা সমর্থও ছিল। নূরজাহানের এই সাজসজ্জা দেখে আলোর সামনে আমি অসহায়ের মতো এদিক ওদিক তাকাতে লাগলাম–অবশেষে আমি শোভনা সমর্থের কাছে গিয়ে বসলাম। সে একপাশে লুকিয়েছিল।
শোভা সমর্থ একজন শিক্ষিত মহিলা। কথা বলতেও জানে। সে সম্ভ্রান্ত মারাঠি বংশের মেয়ে। তার মধ্যে ‘হিলক টান’ (বোম্বের ভাষায় ছিনালি) ছিল না, খুব ভদ্র ও শিষ্ট। সেও এই ফিল্মে কাজ করছিল। তার সঙ্গে আমি একটা ঘাসের চামড়ার ওপর বসে নূরজাহানের পোশাকের জ্বালা ভুলতে চেষ্টা করলাম।
আগেই বলেছি, ফিল্ম নওকরের ওপর আমার তেমন আগ্রহ ছিল না। শওকত তার খেলা খেলছিল এবং আমি তাতে হস্তক্ষেপ করতে সংকোচ বোধ করতাম।
আমার বিস্ময়ের ব্যাপার ছিল, শওকত হল কট্টর হিন্দুস্থানি (উত্তর প্রদেশের লোক) আর সে হল পঞ্জাবি– ধরতে গেলে জাটনি’-একটা গেঁয়ো মেয়ে, কিন্তু উভয়ে বেশ আনন্দেই ছিল। শওকত পঞ্জাবি ঢং-এ উর্দু বলত আর নূরজাহান উর্দু ঢং-এ পঞ্জাবি বলার চেষ্টা করত।
ফিল্ম নওকর’ তৈরি হয়ে যাওয়ার পর শওকতের সঙ্গে আমার সম্পর্কে ছেদ পড়ল। সে একাধারে প্রেম ও ব্যবসা শুরু করে দিল। আর আমি আমার কাজে মত্ত হলাম।
শওকত প্রতিভাধর ব্যক্তি হওয়া সত্ত্বেও ব্যবসায়ী লোক ছিল। সুতরাং সে যুদ্ধকালীন সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে শুরু করল এবং কিছু দিনের মধ্যেই নিজস্ব ফিল্ম কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করল। একটা ভালো ছবিও সে তৈরি করল– যা বক্স অফিস হিট হয়েছিল। একে তো একজন দক্ষ পরিচালক ও সম্পাদক হিসেবে তার নাম ছিল, তারপর ফিল্ম কোম্পানি তৈরি করার পর সে শিল্প এলাকায়ও নিজের প্রতিষ্ঠা করে নিল।
সাধারণত প্রডিউসার ডাইরেক্টরগণ ফিল্ম অ্যাকট্রেসকে এইজন্যই বিয়ে করে না যে, তারা তাদের ব্যবসায়িক জীবনের কর্ণধারিণী মনে করে। কিন্তু শওকত কী উদ্দেশ্যে বিয়ে করেছিল– তা ঠিক বুঝা যায় না। কিন্তু আমি বুঝতে পারি, সে নূরজাহানকে বিয়ে না করলেও তার উন্নতির কোনো বাধা হত না। কেন-না সে তার ব্যবসায়ে অত্যন্ত দক্ষ ব্যক্তি ছিল এবং গাধার মতো খাটতে পারত।
জানি না শওকত কেন আবার বোম্বে ছেড়ে পাকিস্তান এল। সম্ভবত সে একজন গোঁড়া মুসলমান বলে। যদি বোম্বেতে কেউ মুসলমানদের সম্বন্ধে কোনো বিরূপ মন্তব্য করত, তাহলে সে তখন স্কুড্রাইভার দিয়ে তার মাথার খুলি খুলে তার মগজ মেরামতের অপচেষ্টা করত। কিংবা এও হতে পারে, নূরজাহান তাকে বাধ্য করেছে। লাহোর তার অতি প্রিয় শহর। কেন-না পঞ্জাবিদের মতে লাহোর লাহোরই।
বোম্বেতে সে খুব খ্যাতি অর্জন করেছিল। দু-একটা ফিল্ম সে এমন ভালো করেছিল যে, সে একজন সর্বজনস্বীকৃত ডাইরেক্টর বলে খ্যাতি লাভ করেছিল। সে কোটি কোটি টাকা উপার্জন করতে পারত সেখানে, কিন্তু সে পাকিস্তানকেই তার বাসস্থান বলে স্বীকার করল। পাকিস্তানে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির পতনকে সে তার ঘড়ি নির্মাতার মস্তিষ্ক খাঁটিয়ে মেরামত করল। সে শোরির ভস্মীভূত স্টুডিও পেয়ে গেল এবং সেটাকে একটা উন্নতমানের স্টুডিওতে উন্নীত করল।
আপনাদের খুব কম লোকেরই জানা আছে। শাসনুর স্টুডিওর প্রতিটি উটে শওকত হোসেন রিজভীর স্পর্শ রয়েছে।
লাহোরে এসেও সে আমার বন্ধুই আছে। আমাকে সে সর্বপ্রকারে সহায়তা করত। একবার আমি তার কাছে গেলাম তার গায়ের সাদা শার্টটায় বোতাম ছিল না। আমি বিস্ময় প্রকাশ করতে সে হেসে জওয়াব দিল, কী করব ভাই, পয়সা নেই যে বোতাম কিনব।
সিগারেট চাইতেই সে বলল, আমি কয়েকদিন থেকে ধারে সিগারেট খাচ্ছি।
এ হল সেই লোকের অবস্থা, যার স্টুডিওর লোকেরা রেফ্রিজারেটরের পানি পান করে, যার বাগানে শত শত ফুল ফোটে, শত শত শ্রমিক যেখানে বাড়ির কাজ করছে, যার নূরজাহান রয়েছে– দামি কাপড়চোপড়, সজ্জিত বাড়ি এবং মোটরে চড়ে যে ঘুরে বেড়ায়।
নূরজাহান সম্বন্ধে কয়েকটি অপবাদ শোনা যায়; এবং কিছুটা হয়তো সত্যও বটে।
নূরজাহান একটু দাম্ভিক। তার সৌন্দর্যের ওপর গর্ব করার মতো বস্তু ছিল না– শুধু এক গলা ছাড়া। এই গলায় ছিল অপূর্ব মাধুর্য। সেজন্যে যদি সে বড়াই করে তাতে কোনো আপত্তি উঠতে পারে না। কিন্তু এ জন্যেই বদমেজাজি হতে হবে তার তো কোনো কারণ নেই।
আমার মনে আছে একবার আমার স্ত্রী বলেছিলেন : আপনি তো নূরজাহানকে জানেন, সে কি আমাদের বাড়িতে আসতে পারে না?
আমি বললাম : কেন পারবে না, হাজার বার আসতে পারে।
আমি শওকতকে বলতেই সে পরদিনই আমার বাসায় তাকে পাঠিয়ে দিল। আমি অনেক অ্যাকট্রেস দেখেছি– খ্যাতনামী, উন্নত ধরনের কিন্তু ওদের মধ্যে অস্বাভাবিক কিছু দৃষ্ট হয়নি।
নূরজাহান সবতাতেই কৃত্রিমতা প্রকাশ করছিল। তার হাসি আলাপ সবই কৃত্রিমতায় ভরা ছিল। জানি না এই কৃত্রিমতা তার চরিত্রে কোথা থেকে এল? কখনও এমনও মনে হত, তার এবং শওকতের দাম্পত্য জীবনও হয়তো কৃত্রিম।
নূরজাহান জাঁকজমকের সঙ্গে এল। দেখা করল। আমি মনে করলাম, আমি এখান থেকে সরে পড়ি যাতে মেয়েরা খোলাখুলি আলাপ জমাতে পারে কিন্তু আমার স্ত্রীর এক বান্ধবীর অনুরোধে সেখানে থাকতে হল। তার ইচ্ছা, নূরজাহান যেন একটা গান করে।
আমি তাকে বললাম, নূরজাহান, এরা তোমার গান শুনতে চাইছে, তুমি দু-একটা গান শুনিয়ে দাও।
নূরজাহান পোশকিভাবে জওয়াব দিল, না সাহেব, অন্য কোনো সময় হবে– এখন গলা ঠিক নেই।
আমি কাবাব হয়ে গেলাম, তার গলা ঠিকই ছিল, কেন-না তার গলা তো ইস্পাতের তৈরি, যা কোনো দিনই খারাপ হতে পারে না। এটা শুধু ভান করছিল। আমি আবার তাকে বললাম, নূরজাহান এসব বাহানা এখানে চলবে না। তোমাকে গাইতে হবে। আমি তো হাজার বার তোমার গান শুনেছি কিন্তু এরা চাইছে তোমার গান শুনতে। তাই তোমাকে ভালোমন্দ যাই হোক- গাইতেই হবে। তবু সে আপত্তি করতে লাগল। তখন আমার স্ত্রী বললেন, সে যখন গাইবেন না কেন তাকে অনুরোধ করছ। অনেক পীড়াপীড়ির পর শেষে সে ফয়েজের একটা গজল গেয়ে শোনাল।
হতভাগি কী গলাই না পেয়েছিল, আর কী সুরেই না গেয়েছিল, এত বছর পরও আমার কানে সেই সুর মধুবর্ষণ করে চলেছে।
নূরজাহানের অনেক প্রেমিক ছিল– আমি এমন কতকগুলো বাবুর্চিকে জানি, যারা নুরজাহানের ছবি উনুনের ধারে লটকে তার গাওয়া গান বেসুরো গলায় গাইত আর তাদের সাহেব মেমদের জন্যে খাবার রান্না করত।
বাড়ির চাকরদেরও জানি যারা নিম্মি, নার্গিস এবং কামিনী কৌশলকে পছন্দ করত। কিন্তু নূরজাহানের পাগল অসংখ্য, কোথাও তার ছবি দেখলেই কেটে তাদের ভাঙা বাক্সে রেখে দিত। এবং অবসর সময়ে বের করে চোখকে আনন্দ দান করত। নূরজাহানকে কেউ খারাপ বলেছে কি অমনি যুদ্ধং দেহী হয়ে রূখে দাঁড়াত।
আমার ঘরেও একজন নূরজাহানের প্রেমিক আছে, সে যে কোনো সুন্দরী মেয়ে, কোনো নববধূ কিংবা লাল পোশাক পরা মেয়েকেই নুরজাহান বলত। নুরজাহানের গাওয়া যত গান সবই তার কণ্ঠস্থ। সে নিজেও অত্যন্দ সুন্দর, কিন্তু নূরজাহানের কোনো কোনো বৈশিষ্ট্য তার কাছে এতো ভালো লাগত যে, সব সময়ই সে তার কথা বলত।
সে আমার নিকট আত্মীয়। আমার ভাগিনেয়ের সন্তান। তার নাম শাহেদ জালাল। আমরা তাকে আদর করে টাকু বলতাম। তাকে আমরা অনেক বোঝালাম, নূরজাহানের কথা ছেড়ে দাও, সে বিবাহিতা মহিলা। তার ছেলেপিলে আছে, তার সঙ্গে তোমার বিয়ে হতে পারে না।
ফিল্ম দেখত, তাতে যদি নূরজাহান না থাকে তখন তার মন বিগড়ে যায়। তাই ঘরে নুরজাহানের গান গেয়ে সে গায়ের জ্বালা জুড়োয় এবং মা-বাপকে বলে আমি নুরজাহান ছাড়া আর কাউকেই চাইনে।
কয়েকদিন পর তার দাদা শওকত রিজভীর কাছে গেলেন। তিনি তাকে বললেন, দ্যাখো তোমার স্ত্রীর একজন প্রেমিক জন্মেছে। সে একেবারে পাগল হয়ে ওঠে তার জন্যে। শেষে এমন না হয় যে তাকে নিয়ে পালিয়ে যায়। আর তুমি হাপিত্যেশ করতে থাকো।
সে খুব অধীর হয়ে উঠল, কারণ দাদা মিয়া তাকে এসব কথা কেন শোনালেন, একটু অপ্রতিভও হয়ে গেল সে। তারপর জিজ্ঞেস করল কে এই লোকটা। দাদা মিয়া বললেন : আমার নাতি।
আপনার পৌত্র? বয়েস কত?
মিয়া সাহেব বললেন : এই প্রায় চার বছর হবে।
এটা অল্পদিনের কথা। নূরজাহান যখন একথা শুনল তখন খুব আনন্দ কৌতুকবোধ করল–সে বলল, আমি নিজেই গিয়ে আমার প্রেমিককে বিয়ে করব। শাহেদ জালালও খুব খুশি হল। নূরজাহান কখন এসে তাকে দুলহা বানাবে সেই প্রতীক্ষায় সে দিন কাটাতে লাগল।
এর কিছুদিন পরে নূরজাহানের আরেকটি প্রেমিকের কথা শোনা গেল, তার বয়স চার বছর নয় অনেক বেশি। সম্ভবত সে নাপিত বা হাজাম ছিল, সব সময় তার গান গাইত আর তার কথাই বলত। একজন তাকে জিজ্ঞেস করল, তুমি কি সত্যি নূরজাহানকে ভালোবাস?
হাজাম গম্ভীরভাবে জওয়াব দিল : এতে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। তার বন্ধু তাকে পরখ করবার জন্য বলল যদি ভালোবাসো তাহলে মাহিওয়ালের মতো নিজের মাংস কেটে দিতে পারো তাকে?
হাজাম তখনই তার ধারালো ক্ষুরটা বের করে দিয়ে বন্ধুকে বলল, আমার দেহের যে কোনো জায়গার গোশত কেটে নিতে পারো।
না জানি তার বন্ধু কেমন লোক ছিল, সে তখনই তার বাহু থেকে এক পোয়া পরিমাণ মাংস কেটে ফেলল, তারপর ভয় পেয়ে পালিয়ে গেল। হাজাম অতিরিক্ত রক্তপাতের দরুন অজ্ঞান হয়ে পড়ল।
এই হতাশ প্রেমিককে যখন মেয়ো হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল তখন একটু জ্ঞান ফিরতেই তার মুখ দিয়ে বের হল, নূরজাহান।
এছাড়া বর্তমানে নূরজাহানের নামে একটা মকদ্দমা চলছে। সে নবাগত চিত্রতারকা নিঘার সুলতানাকে স্টুডিও-র ভেতরে নিষ্ঠুরভাবে মেরেছিল। আদালতে আছে তাই সে সম্বন্ধে কোনো কিছু বলা আদালত অবমাননার পর্যায়ে পড়তে পারে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই, নূরজাহান সেই মেয়েটিকে মারল কেন? সত্যি বলতে কী, আমি খবরের কাগজে পড়ে নিঘার সুলতানার নাম জানতে পারলাম। জানি না, এই মোহতারেমা কী করে কবে সিনেমায় এলেন। শুনেছি তিনি ঢাকার বাসিন্দা হবেন হয়তো দেখা যাক, মকদ্দমায় কী হয়।
নুরজাহানের সুস্থ সুন্দর স্বামী জীবিত। সুন্দর সুন্দর সন্তানের জননী সে– যার জন্যে লাহোরের হাজাম তার পোশত কেটে দিতে পারে। তার চার বছরের প্রেমিক শাহেদ জালাল এখনও তাকে বিয়ে করার স্বপ্ন দেখে আর যেসব বাবুর্চি উনুনের পাড়ে তার ছবি রেখে থালা মাজবার সময় বেসুরো গলায় নূরজাহানের গাওয়া গান এবং এমনি করেই তাদের দুঃখ গড়া জীবনকে সরস করে তোলে। আর অপরদিকে একজন আমি যে তার স্বল্প কাপড়ে নির্মিত বক্ষবাস দেখে চোখ বন্ধ করে ফেলি। জানি না অত উঁচু করে বক্ষবাস পরার মধ্যে সে কী সৌন্দর্য খুঁজে পায়। আর সৈয়দ শওকত হোসেন রিজভীই বা কী করে এসব সহ্য করে যা সব সময়ই লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।*
—–
* এ প্রবন্ধ রচনার পর মান্টো বেশি দিন বেঁচে ছিলেন না। তাই নূরজাহানের জীবনের পরবর্তী বৈপ্লবিক পরিবর্তন সমৃদ্ধ আর কোনো বর্ণনা পাওয়া যায়নি। তবে নূরজাহান আর বর্তমানে শওকত হোসেন রিজভীর স্ত্রী নন। তরুণ চিত্রনায়ক এজাজকে তিনি কয়েক বছর আগে বিয়ে করেছেন। বর্তমানে এরা লাহোরের অন্যতম সুখী পরিবার। হালে এজাজও নাকি তাকে পরিত্যাগ করেছে বলে শোনা যায়।