০৬. ভি এইচ দেশাই
লাইট অন-ফ্যান অন-ক্যামেরা রেডি স্টার্ট মিঃ জগতাপ।
স্টার্টেড।
সিন থারটি ফোর- টেক্ টেন।
দেশাই তার স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে শুরু করল, নীলাদেবী আপ কুছ ফিকির মত কিজিয়ে মায় নে ভি পেশাওয়ার কা পেশাব পিয়া হয়।
কাট কাট।
লাইট অন হল। দেশাই হাতের রাইফেলটা একদিকে সরিয়ে রেখে বলল, ওকে মি, গাঙ্গুলি, এবার ঠিক হয়েছে, তাই না?
অশোকের বলতে ইচ্ছে করছিল ঠিক হয়েছে না ছাই হয়েছে। কিন্তু তা না বলে চরম বিরক্তিটাকে ঢাকা দিয়ে দূর চক্ৰবালের দিকে তাকিয়ে জোর করে একটু হেসে বলল, ওয়ান্ডারফুল। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল, কেমন তাই না মান্টো? আমি দেশাইকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বললাম, সত্যি ওয়ান্ডারফুল।
অন্যান্যদের মধ্যে চাপা হাসির গুঞ্জন চলছিল। কিন্তু দেশাইকে অত্যন্ত খুশি মনে হল। কারণ, আমার মুখ থেকে কোনো সময় প্রশংসা শুনবার ভাগ্য তার হয়নি। আসলে অশোক আমাকে বলে দিয়েছিল স্যুটিং-এ দেশাইকে যেন নিরুৎসাহ না করি। দেশাই যদি টের পায় যে আমরা টিটকারি করছি, তাহলে সব কাজ তছনছ করে দেবে সে।
আমাদের কানাকানি ফিশফাস শেষ হলে দেশাই স্মারককে বলল, ঠিক আছে ভাই, এর পরের ডায়ালগটা বলো?
শুনে দেশাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললাম, মি. দেশাই, ডায়ালগটা আর একবার নিলে বোধ হয় ভালো হয়। এবার আরও ওয়ান্ডারফুল হবে।
দেশাই গুজরাটি কায়দায় মাথা দুলিয়ে বলল, তো নিয়ে নাও না–কে মানা করছে। গরম গরম হয়ে যাক।
দত্তরাম চিৎকার করে বলল, লাইট অন।
লাইটস অন হল। দেশাই আবার রাইফেলটা সামলে নিল। স্মারক ডায়ালগের খাতা নিয়ে দেশাই-র দিকে ঝুঁকে পড়ে বলল, আজ্ঞে, ওই ডায়ালগটা আর একবার বলবেন।
কোন ডায়ালগ? দেশাই বলল।
ওই যেটা খুব ওয়ান্ডারফুল হয়েছে।
দেশাই রাইফেলটা কাঁধে তুলে নিয়ে বলল, ঠিক আছে, ওটা আমার বেশ মনে আছে।
স্মারক আমাকে ইঙ্গিত করে বলল, মান্টো সাব, ডায়ালগটা আপনি একটু শুনে নিন আগে।
আমি দেশাইয়ের কাঁধে হাত রেখে বললাম, হ্যাঁ কী যেন ডায়ালগটা–নীলাদেবী–
দেশাই তার পেশোয়ারি লুঙ্গিটা দুরস্ত করে নিয়ে নীলাদেবীর (ভিরা) দিকে তাকিয়ে বলল, নীলাদেবী আপ কুই পেশোয়ার না কিজিয়ে মায় নে ভি আপ কা পানি পিয়া হয়।
শুনে ভিরা অট্টহাসি করে উঠল। দেশাই ঘাবড়ে গিয়ে বলল, কি হয়েছে মিস ভিরা, আপনি অমন করছেন কেন?
ভিরা আঁচলে মুখ চেপে সেটের বাইরে চলে গেল। দেশাই আরও বেশি আশ্চর্যান্বিত হয়ে স্মারককে বলল, কী হল?
স্মারক হাত দিয়ে মুখ চেপে অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল। আমি তাকে নিরস্ত করে বললাম, নাথিং সিরিয়াস খছি আ গই (কাশি এসেছে)। দেশাই হেসে উঠে বলল, ও–তাই বলল।
তারপর ডায়ালগটাকে আবার শান দিতে গিয়ে বলল, নীলাদেবী আপ কুই খাঁছি না কিজিয়ে মায় নে ভি দেবীকা…
অশোক মাথায় হাত চাপড়াতে শুরু করল। দেশাই কাছে এসে বলল, কী হয়েছে মি. গাঙ্গুলি?
না, কিছু না মাথা ধরেছে একটু। শর্টটা নিয়ে নিক।
হোক না আমি তো রেডি।
গাঙ্গুলি নিরুত্তাপ স্বরে বলল, ক্যামেরা রেডি রেডি মিঃ জগতাপ।
জগতাপ ভেঁপু বাজিয়ে বলল, ‘রেডি’ গাঙ্গুলি আরও বেশি মরা গলায় বলল, স্টার্ট সিন থারটি ফোর, টেক এলোন।
দেশাই রাইফেল সামনে নিয়ে বলল, নীলা পানি, আপ কুই দেরী না কিজিয়ে। মায় নে ভি পেশোয়ার কা …
অশোক প্রায় পাগলের মতো হয়ে চিৎকার করে উঠল, কাট কাট।
দেশাই রাইফেল মাটিতে রেখে দৌড়ে অশোকের কাছে এসে বলল, এনি মিসটেক মিঃ গাঙ্গুলি?
অশোক পারে তো খুন করে ফেলে এমন একটা দৃষ্টি দিয়ে নিষ্পেষিত করে ফেলছিল দেশাইকে। হঠাৎ ভাবটা সামলে নিয়ে কৃত্রিম প্রসন্ন হয়ে বলল, না কিছুই না। খুব ভালো হয়েছে, খুব ভালো হয়েছে।
তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল, চলো মান্টো, একটু বাইরে চলো। মাথাটা বড্ড ধরেছে।
গেটের বাইরে এসে অশোক প্রায় কেঁদে ফেলল।
বলো মান্টো, এখন কী করি? পেশোয়ারের পানি ওর মুখে উঠতেই চায় না। চলো, এক কাজ করি, লাঞ্চের জন্যে ব্রেক করে দি। দুপুর পর্যন্ত সারাটা দিন আজ বেকার গেল। প্রস্তাবটা সময় মতোই করেছে। এ সময় লাঞ্চের ব্রেক করা ছাড়া আর কোন গত্যন্তর ছিল না। এখন হাজার চেষ্টা করলেও দেশাইযের মুখ থেকে সঠিক সংলাপ বের হবে না। এটা বরাবরের অভিজ্ঞতা, যে-কোনো সংলাপই যদি একবার দেশাইয়ের মুখে আটকে পড়ে সেটাকে সঠিকভাবে বের করে আনা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। সত্যি বলতে কী, তার স্মরণশক্তিটাই একেবারে ভোঁতা। একেবারে ছোট্ট সংলাপটুকুও সে কোনদিন মুখস্থ করে রাখতে পারে না। দেশাইযের মুখ থেকে প্রথমবারেই যদি কোনো সংলাপ সঠিকভাবে কেউ শুনে থাকে, সেটাকে নেহাতই ব্যতিক্রম বলতে হবে। পর্যায়ক্রমে ভুল সংলাপ আওড়ানোর পরও দেশাই বুঝতে পারে না তার সংলাপ নিয়ে পরিচালকদের কী পরিমাণ তিতিক্ষা যাচ্ছে।
সংলাপের হাত-পা ভেঙে একেবারে বিকলাঙ্গ করেও সে টের পায় না সে কী করছে। তার পরও সে দর্শকদের মুখের দিকে এমন করে তাকায় যেন তার সংলাপটা আসলে আহা মরি গোছের হয়েছে। এ সময় তার অভিব্যক্তি অনেকের হাসির খোরাক জোগায়। আবার কোনো কোনো সময় পরিচালক কেন, আজেবাজে দর্শকদেরও ইচ্ছে হয়, ইট মেরে তার মস্তকটা চুর্ণবিচূর্ণ করে দেয়।
আমি ফিল্মিস্থানে বছর তিনেক ছিলাম। এ সময় দেশাই মোট চারখানা ছবিতে কাজ করেছিল। কোনো সময়ই একেবারে বিসমিল্লাতেই সে সঠিক সংলাপ বলতে পেরেছে বলে আমার স্মরণ নেই। জীবনে সে কত লাখ ফুট ফিল্ম নষ্ট করেছে, তার ইয়ত্তা নেই।
অশোকের মুখে শুনেছি, দেশাইয়ের রিটেক-এর সর্বোচ্চ রের্কড হল চুয়াত্তর। অর্থাৎ বোম্বে টকিজের সেই একমাত্র কুশলী, যে একটা সংলাপকে চুয়াত্তরবার ভুল বলেছে। এই চুয়াত্তর বারের সময় সে যে পরিচালককে কাঁদিয়েছে তিনি হলেন জার্মান পরিচালক ওয়াস্টন। তার মতো ধৈর্যশীল পরিচালক বোম্বে চিত্রজগতে অন্য কেউ ছিল বলে আমার বিশ্বাস হয় না। তিনি দেশাইকে বলেছিলেন, তোমাকে লোকেরা পছন্দ করে বলেই আমাদের এত বিপদ। নইলে কবেই তোমার টিকি ধরে বের করে দিতাম।
ওয়াস্টনের এই স্পষ্ট ভাষণের কারণেই রিটেক-এর রেকর্ড চুয়াত্তর পর্যন্ত উঠেছিল। একথা শুনে দেশাই বিগড়ে গিয়েছিল। অতঃপর দেশাইকে শান্ত করে পিঠে হাত বুলিয়ে সঠিক সংলাপ আদায় করে নিতে স্টুডিওর সকল কলাকুশলীকে তেল মালিশ করতে হয়েছে। আগেই বলেছি, দেশাই একবার বিগড়ে গেলে তাকে শান্ত করার মতো কোনো ঔষধ ছিল না। তখন ভরসা থাকত একমাত্র আল্লার ওপর।
একটু আগেভাগেই কী কারণে লাঞ্চের ব্রেক করে দেওয়া হয়েছে, দেশাই না জানলেও কলাকুশলী সবাই জানত। এ নিয়ে কেউ আর কানাঘুষো করল না। কারণ, দেশাই যতটুকু নর্মাল আছে সেটুকু পরিস্থিতিও আর থাকবে না।
অশোক গালগল্পে মন দিল। দেশাইও তার স্বভাবসিদ্ধ কায়দায় নানা হাসিঠাট্টার কথা বলছিল। তাতে হাসির কিছু না থাকলেও সবাই তা শুনে হাসছিল। এভাবে লাঞ্চের বিরতি শেষ হল। সবাই গা-ঝাড়া দিল। আবার স্যুটিং শুরু হল। অশোক বলল, দেশাইবাবু, আপনি ঠিক আছেন তো? আপনার ডায়ালগটা মনে আছে তো?
দেশাই নিশ্চিত কণ্ঠে বলল, আলবাত।
লাইট অন হল, থারটি ফোর সিন শুরু হল। দেশাই রাইফেলটা সামলে নিয়ে আবার দাঁড়িয়ে গেল।
নীলাদেবী– আপ-আপ একেবারে জবান আটকে গেল, আই এম স্যরি।
অশোকের মুখে আবার বিরক্তির রেখা দেখা দিল। কিন্তু সামলে নিয়ে বলল, ঠিক আছে, বলুন বলতে থাকুন।
সিন থারটি ফোর, টেক থারটিন। আবার শুরু হল। কিন্তু দেশাই পেশোয়ার আলাদা করতে পারল না। এরপর আরও চেষ্টার পরও যখন সঠিক সংলাপ বের হল না, আমি অশোককে আড়ালে ডেকে নিয়ে পরামর্শ দিয়ে বললাম, দাদামণি, এক কাজ করো। দেশাই যখন সংলাপ বলবে এবং পেশায়ার কা পেশাব-এর জায়গায় আসবে ঠিক এসময়টাতে যেন ক্যামেরার দিকে মুখ না রেখে বলে।
অশোক আমার কথা বুঝে নিল। কারণ পেশাব থেকে নিষ্কৃতি পাবার একমাত্র এ পথই রয়েছে। পরে এ অংশ স্বচ্ছন্দে ডাব করে নেয়া যাবে। বলার সময় ক্যামেরার দিকে মুখ রাখলে ডাব করার সময় উচ্চারণ এবং ঠোঁট সঞ্চালনে বৈসাদৃশ্য দেখা দিতে পারে।
দেশাইকে ব্যাপারটা যখন বুঝিয়ে বলা হল, দেশাই শক্ত হয়ে আমাদের জানাল এবারে সে মোটেই ভুল করবে না। কিন্তু পেশোয়ারের পানি যে ততক্ষণে মাথার ওপর উঠে গেছে। দেশাইকে বলা হল শুদ্ধ বলার চেষ্টা করার দরকার নেই। মুখে যা আসে সে যেন তাই বলে দেয়।
এবার দেশাই একটু ক্ষুব্ধ হল। আমাকে ডেকে বলল, ঠিক আছে মান্টো, বলার সময় আমি মুখ ঘুরিয়ে নেব। কিন্তু তুমি দেখে নিও আমি ডায়ালগ যদি ঠিকমতো না বলেছি, আর কীই বললাম।
সিন থারটি ফোর, টেক ফোরটিন–
হুকুম এল। দেশাই আবার রাইফেলটা তুলে নিল, ভিরাকে উদ্দেশ্য করে বলল, নীলাদেবী আপ কোই ফিকির না কিজিয়ে বলেই মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে বলল, ম্যায় নে ভি আপ পেশোয়ার কা পেশাব পিয়া হায়।
সিন কাট হল। দেশাই বিজয়ীর ভঙ্গিতে রাইফেলটা সাপটে ধরে অশোককে বলল, কেমন হয়েছে গাঙ্গুলি?
অশোক এবারে বজ্র কঠিন। ভ্রূ কুঁচকে বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ ঢের হয়েছে।
তারপর ক্যামেরাম্যান হরদীপকে উদ্দেশ্য করে বলল, চলো, নেক্সট শট।