০৪. চিরঞ্জীব শ্যাম
তারিখ আমার ঠিক মনে নেই। পানাভ্যাস ছাড়বার জন্যে মানসিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলাম। এমন সময় পত্রিকায় শ্যামের মৃত্যুসংবাদ পড়লাম। চেতন অচেতনের মাঝামাঝি একটা অবস্থায় আমার মানসিক অবস্থা তখন দোদুল্যমান ছিল।
শ্যামের মৃত্যুসংবাদ পড়ে প্রথমত আমি ভাবলাম এসব আমার মানসিক বিকার ছাড়া আর কিছুই নয়। মদ্যপান ছেড়ে দেওয়াতেই আমার এ অবস্থার কারণ এর আগেও তো এমন অনেক বন্ধুদের মৃত্যুসংবাদ পড়েছি, যারা এখনও দিব্যি বেঁচে বর্তে আছে।
আমার স্পষ্ট মনে আছে, খবরটা পড়ে পাশের কামরার পাগল বন্ধুটিকে ডেকে বললাম, জানো আমার এক অকৃত্রিম বন্ধু মারা গেছে।
কে সে?
শ্যাম।
কোথায় মারা গেছে, এখানে?
আমি কোনো জবাব দিলাম না। হঠাৎ আমার মানসপটে শ্যামের নানা অভিব্যক্তির ছবি ভেসে উঠতে লাগল। চির উজ্জ্বল হাস্যমুখর বন্ধুবৎসল শ্যাম। প্রাণপ্রাচুর্যে ভরা শ্যাম। মৃত্যুকে যে কোনোদিন স্বীকার করত না সেই চির দুর্দম হৈ-হুঁল্লোড়প্রিয় শ্যাম–না, এমন হতে পারে না। শ্যাম কোনোদিন মরতে পারে না। এসব খবর আর খবরের কাগজ আমার মস্তিষ্কের বিকৃতি। আমার মানসিক বৈকল্য।
আস্তে আস্তে অ্যালকোহলের নেশাটা যখন কেটে গেল তখন সত্যি সত্যি জানলাম, শ্যাম আর ইহজগতে নেই। একটা ভীষণ মর্মান্তিক ব্যথায় আমার খানখান হয়ে যাবার কথা ছিল, কিন্তু সেসব কিছু আমার মনে হল না। অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই যেন শ্যামের মৃত্যু হয়েছে। শ্যামের মৃত্যু হয়েছে এ যেন বহুদিন আগের ঘটনা। এখন শ্যামের স্মৃতি নিয়ে শোকতাপ করা ছাড়া আর কিছু করার নেই আমার।
শ্যামের হাসি গান আর উচ্ছল হই-হুঁল্লোড় এখনও যেন শুনতে পাই আমি। শুনে শুনে কানে তালা দিতে হয়।
হাসপাতালের বাইরে লোকেরা বলাবলি করছিল যে, শ্যামের মৃত্যুসংবাদ শুনে সা’দত হাসান মান্টো পাগল হয়ে গেছে। আসলে যদি সত্যি তাই হত তাহলে আমি খুব দুঃখিত হতাম। কারণ, শ্যামের মৃত্যু মূলত আমাকে প্রকৃতিস্থ করে দিয়েছে। শ্যামের মতো লোকই যখন মরতে পারে তখন বিশ্বের সব কিছুর অস্তিত্বই পদ্মপত্রে নীর। শ্যামের মৃত্যুসংবাদে যদি সত্যি পাগল হতাম তাহলে সেটাও একটা পাগলামি হত। শ্যামের মৃত্যুসংবাদ শুনে পাগল হয়ে যাওয়া মূলত শ্যামকে অপমান করা।
শ্যাম তার পরিবার পরিজনের মাঝে চিরদিন বেঁচে থাকবে। তাজি (মমতাজ) ছিল তার জীবনের দুর্বলতার স্বাক্ষর (শ্যামের মতে)। যেসব মেয়েরা শ্যামের প্রেমে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ছিল তাদের মুখেও আজ আর ‘শ্যাম জিন্দাবাদ’ ধ্বনি শোনা যাবে না।
মৃত্যুর সময় সে যেন আমাকে ডেকে বলেছিল, মান্টো, সত্যি মৃত্যুর স্বাদটা অন্য রকমের, যা কোনোদিনই কল্পনা করিনি।
শ্যামের কথা ভাবতেই আমার বিখ্যাত রুশ ঔপন্যাসিক আয়ার তাজ বিশিফের নায়ক সিনাইনের কথা মনে পড়ে যায়। শ্যাম ছিল প্রেমিক, কিন্তু প্রেম তার পেশা ছিল না। সব সৌন্দর্যের দ্বারেই সে তার শকট ভিড়িয়ে দিত। মনে হয় মৃত্যুও এক সুন্দর সত্তা। নইলে কোনোদিনই সে মৃত্যুর কাছে পরাভব মানত না।
সে উষ্ণ এবং প্রচণ্ডতাকে ভালোবাসত। লোকেরা বলে, মৃত্যুর হাত হিমশীতল। হিমশীতল হলে অবশ্য শ্যাম মৃত্যুর হাতটা ঝটকা টানে সরিয়ে দিয়ে বলত,
–তোমার হাতটা ওদিকে রাখো দিকিনি, বড্ড ঠান্ডা। প্রাণচাঞ্চল্য নেই তোমার হাতে।
সে এক চিঠিতে একবার আমাকে লিখল, প্রিয় মান্টো, এখানকার সবকিছু ‘হাপটিল্লা’ ধরনের। কিন্তু আসল ‘হাপটিল্লা’র স্বাদ এখানে নেই। সত্যি বলতে কী, জীবনটা কাটছে বেশ ভালো। মদ আড্ডা সমানে চলছে। তাজি (মমতাজ) ছ-মাস পর ফিরে এসেছে। হতভাগী এখন আমার বিরাট একটা দুর্বলতাস্বরূপ বিরাজ করছে। তুমি বেশ জানো, মেয়েদের প্রেম-পরশের আমেজ আদায় করা কতখানি প্রাণান্তকর। আফটার অল আমি একজন নমাল মানুষ।
নিগার (নিগার সুলতানা) মাঝেমধ্যে আসে। কিন্তু ‘ত’-এর স্থান সর্বোচ্চে। প্রায় সন্ধ্যাতেই তোমার বকাঝকাগুলো মনে পড়ে।
‘হাপটিল্লা’র একটা ইতিহাস আছে। আমি তখন ‘বোম্বে টকিজ’-এ চাকরি করি। কামাল আমরোহীর চিত্ৰকাহিনি হাবেলী’ (পরে যা ‘মহল’(৬) নামে চিত্রায়িত হয়) নিয়ে বেশ মাজাঘষা চলছে তখন। অশোক, ওয়াচা, হাসরাত লাখনুভী এবং আমি এ মাজাঘষার কাজে প্রতিদিন বসে যেতাম। শেষ দিকে কাজের কথা রেখে আমাদের মধ্যে গালগল্পও শুরু হয়ে যেত। মজবুর’ ছবির সুটিং শেষ হলে শ্যামও এসে আমাদের দলে ভিড়ত।
কামাল আমরোহীর একটা বড়ো বাজে অভ্যেস আমার ভালো লাগত না। সে এমনি গালগল্পের আসরেও অলংকারযুক্ত শব্দ ব্যবহার করত আর লেখার কথা তো বলাই বাহুল্য।
একদিন ট্রেনে চড়ে বোম্বে টকিজে আসছিলাম। ট্রেনে বসে খবরের কাগজ খুলে স্পোর্টস কলাম দেখছিলাম। স্টেডিয়ামে ক্রিকেট ম্যাচ হয়েছে। একজন খেলোয়াড়ের নাম হাপটিল্লা’ লেখা হয়েছে। আমি অনেক চিন্তা-ভাবনা করে ভাবলাম, হয়তো হায়বতুল্লা নামের অপভ্রংশ। টকিজে পৌঁছোবার পর কামাল আমরোহী তার কাহিনির একাংশ পড়ে শোনায়। অশোক আমাকে বলল,
কেমন লাগল মান্টো?
মন্দ হয়নি, তবে ‘হাপটিল্লা’ গোছের হল না।
হঠাৎ কেন জানি আমার মুখ থেকে এই আজগুবি শব্দটা বেরিয়ে গেল। আসলে আমি বোঝাতে চাচ্ছিলাম, বক্তব্য তেমন জোরদার হল না।
সেই থেকে আমাদের মধ্যে হাপটিল্লার ব্যবহার। হাপটিল্লা থেকে শেষ অবধি হাপটিলিটি এবং হাপটিলাইজ ইত্যাদি শব্দও তৈরি হল। এবং অতঃপর এ শব্দটি বোম্বের চিত্রজগতে ছড়িয়ে পড়েছিল। ২৯-৭-৪৮ ইং তারিখে শ্যাম আমাকে লিখল:
প্রিয় মান্টো আবারও তোমাকে নীরব রোগে পেয়ে বসেছে দেখছি। তোমার এ নীরবতা আমাকে বড়ো বিচলিত করে। একেক সময় তোমার ওপর এত রেগে যাই যে, থরথর করে গা কাঁপতে থাকে। তুমি জানো আমিও তেমন ভালো চিঠিপত্র লিখিয়ে নই। তবে হাপটিল্লা ধরনের কিছু চিঠিপত্র লিখতে বড়ো ভালো লাগে। কিন্তু হাপটিল্লা বড়োই দুর্লভ।
মান্টো, কে যেন বলেছিল কথাটা : যখন কোনো প্রেমিকের শব্দভাণ্ডার ফুরিয়ে যায় তখন সে চুমা দিতে শুরু করে। আর যখন কোনো বক্তার শব্দভাণ্ডার ফুরিয়ে আসে তখন সে কাশতে থাকে। এই সঙ্গে আমিও একটি কথা যোগ করতে চাই। যখন পুরুষের পৌরুষ ফুরিয়ে যায় তখন সে অতীতকে টেনে নিয়ে আসে। তুমি ঘাবড়ে যেও না। শেযোক্ত পর্যায়ে আমি এখনও আসিনি। একটু পাগল হয়ে অতীত নিয়ে মাতলামি করার আমার অবসর মোটেই নেই। অথচ এটার খুবই দরকার আমার।
নাসিমের ছবি (চান্দনী রাত) অর্ধেক প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। অমরনাথের সঙ্গে একটা ছবির চুক্তি করেছি। বলো দেখি আমার নায়িকা কে হবে? নিগার সুলতানা। আমি সেধেই নিগারের নাম প্রস্তাব করেছি। পুরোনো স্মৃতিকে একবার পর্দার ওপর রোমন্থন। করে দেখতে চাই, কেমন লাগে।
তার্জি এখনও আমার জীবনে আছে। নিগারকে বড়ো মিষ্টি লাগে। গত কদিন থেকে রমলাও এখানে আছে। তার সঙ্গে মিলিত হয়ে বুঝতে পারলাম সে এখনও আমার পূজা করছে। সুতরাং তার সঙ্গেও ওঠাবসা চলছে।
আমি বিশেষ কোন জায়গায় সীমিত থাকতে চাই না। আমি মানুষকে ঘৃণা করি। এভাবেই জীবন যাচ্ছে। আসলে এ জীবনটাই এক প্রেমিকা যার জন্যে আমার অগাধ ভালোবাসা। জীবন বেঁচে থাকুক আর সবকিছু জাহান্নামে যাক।
লেখকের নামটা মনে নেই। ভাবটা এই ধরনের: লোকটি মানুষকে এত ভালোবাসত যে, কখনও সে নিজেকে নিঃসঙ্গ মনে করত না (নিজেকে ভালোবাসার বেলায়) অনুরূপ সে তাদেরকে ঘৃণাও করত।
মমতাজ জেব কোরেশি এম এ-র ছোটো বোন। ভাইয়ের সঙ্গে বোম্বেতে আসার পর জহুর রাজার প্রেমে পড়ে। অতঃপর তার কাছ থেকে ছাড়া পেয়ে যখন লাহোরে চলে আসে–তখনই শ্যামের সঙ্গে তার সংযোগ। বোম্বেতে আসার পর শ্যামের আর্থিক অবস্থা সচ্ছল হলে মমতাজকে সে বিয়ে করে নিল। মমতাজ মা হতে চলেছিল।
শ্যাম ফুটফুটে ছেলেদের খুব ভালোবাসত। শ্যামের এ অভ্যেস অনেক মেয়েদের ভালো লাগত না। নাক সিটকাত। কিন্তু সেসব মেয়েদের মন পাবার জন্যে শ্যাম তার এ ধরনের অভ্যেসগুলোকে মোটেই শোধরাতে চেষ্টা করত না। তার ভিতর-বাহির এক রকম ছিল। সে আমাকে বলত, মান্টো, আমার অভ্যেসগুলোকে ভ্র-কুঁচকানো মাগিগুলোর বড্ড খারাপ লাগে, তাই না? শালিরা প্রসাধনের আড়ালে যে কত খুবসুরত তা কি আমি জানি না?
শ্যাম সব মেয়েদের সঙ্গে খোলাখুলি ঠাট্টা মশকারা করত। অশ্লীল আলাপ করত। অনেক মেয়েদের তা আত্মসম্মানে লাগত। শ্যামের এসব দুষ্টুমি আবার ভালোও বাসত অনেক মেয়েরা।
শ্যামের সঙ্গে আমার প্রথম কোথায় কখন দেখা হয়েছে, তা মনে নেই। মনে হত, তার সঙ্গে আমার পরিচয় হবার অনেক আগেই পরিচয় হয়ে রয়েছে। তবে যতটুকু মনে পড়ে, সম্ভবত লেডি জামশেদজি রোডেই আমাদের প্রথম দেখা। সেখানে আমার বোনের বাসা ছিল। হাইনেস্ট’-এর ওপরের ফ্ল্যাটে ডায়মন্ড থাকত। সেখানে শ্যাম আসা-যাওয়া করত। সিঁড়িতেই আমাদের পরিচয় এবং কথাবার্তা হয়েছে। শ্যাম ডায়মন্ডকে মিসেস শ্যাম বলত। আইনত তারা স্বামী-স্ত্রী না হলেও প্রকৃতপক্ষে তাদের সম্পর্ক স্বামী-স্ত্রীর চেয়েও অনেক বেশি ছিল। একবার হাসপাতালে ভর্তি করার সময় শ্যাম ডাক্তারদের খাতায় ওর নাম লিখিয়েছিল ‘মিসেস শ্যাম’। তা নিয়ে ‘ডায়মণ্ড’-এর স্বামীর সঙ্গে শ্যামের একচোট হয়ে যায়। অবশেষে এর পরিণতি মামলা অবধি গিয়ে গড়ায়। অবশ্য পরে এসব মিটমাট হয়ে গেছে। এরপর ডায়মন্ড যখন চিত্রজগতে হাতেখড়ি নেয় তখন থেকে সে শ্যামের নাগালের বাইরে চলে গেল। তবে সে ডায়মন্ডকে ভুলতে পারেনি।
পুনার এক মনোরম উদ্যানে একবার আমি আর শ্যাম ভ্রমণ করছিলাম। হঠাৎ শ্যাম আমাকে বলল, মান্টো, জানো ডায়মন্ডটা লেডি দি গ্রেট। খোদার কসম করে বলছি, এমন মেয়ে আমি দেখিনি। সব রকম বিপদ-আপদকে সে তুচ্ছ করে চলতে পারে।
তারপর একটু চিন্তা করে বলল, মান্টো, মেয়েরা সন্তান উৎপাদনকে এত ভয় করে কেন? অবৈধভাবে হয় বলে? আসলে এ পাপ-পুণ্যের আবোল-তাবোলগুলো কী? টাকার নোট জাল হতে পারে, কিন্তু সন্তান হালাল-হারাম হতে পারে না। এটা তো মানুষের আদিম উন্মাদনা। আদম ও ইভের প্রবর্তিত এ উন্মাদনা চিরন্তন, অবিনশ্বর। এ প্রবৃত্তিকে কোনোদিন মানুষ দমিয়ে রাখতে পারে না।
শ্যামের চিন্তাধারা, হাসিঠাট্টা–সবই গভীর অর্থবহ এবং উচ্চাঙ্গের ছিল। সভাসমিতিতে যারা টুপি পায়জামা পরে ভালো মানুষটি সেজে বসে থাকত শ্যাম তাদেরকে সঙ মনে করত। মদ্যপানের সময় যদি কেউ হঠাৎ গম্ভীর হয়ে দার্শনিক বনে যেত- শ্যামের ধৈর্য আর বাঁধ মানত না। এলোপাথাড়ি গালাগালির তুবড়ি ছুটত তার মুখ থেকে।
পুনার ‘জোবায়দা কটেজ’-এ শ্যাম আর মাসুদ পারভেজ একত্রে থাকত। একটা ছবির কাহিনি কিনে নেবার ব্যাপারে আমিও ছিলাম সেখানে। মাসুদ স্বভাবতই গোমড়ামুখো ছিল। একদিন সকাল থেকে ‘রম’ চলছিল। শ্যাম তার স্বভাবসিদ্ধ কায়দায় হন্না করে বাড়ি তোলপাড় করে তুলছিল। কিন্তু মাসুদ সারাটি দিন একেবারে গুম মেরে রইল। শ্যামের প্রথমদিকে খেয়াল ছিল না। আচমকা খেয়াল হতেই মাসুদকে সম্বোধন করে বলল,
কী মশাই, আপনার কাব্যচর্চা দেখছি এখনও শেষ হল না?
এমন সময় সেখানে কৃষণ চন্দর(৭) এসে উপস্থিত হল। শ্যাম কৃষণকে মাসুদের এ গাম্ভীর্য সম্পর্কে ইঙ্গিত করল। কৃষণ মাসুদকে নিয়ে পড়ল, এ কোন ধরনের কবিত্ব? সেই সকাল থেকে বকধার্মিকের মতো ভাব ধরে বসে আছ, এখনও এক চরণও রচনা হল না। তোমার এসব পাগলামি রেখে বরং একটু কথাবার্তা বলল।
মাসুদকে নিয়ে আমাদের হাসি-ঠাট্টা বেশ চলছে। হঠাৎ মাসুদ সবাইকে বলল, চলো আমরা এবার বেরিয়ে পড়ি।
সবাই বেরিয়ে পড়লাম। মাসুদ সবাইকে জুতো পকেটে পুরে দৌড়াতে বলল। রাত তখন বারোটা। পুনার পথঘাট নীরব নিস্তব্ধ থমথমে। উদ্দেশ্যহীনভাবে আমরা দৌড়োতে লাগলাম। পথে কৃষণ চন্দরের বাড়ি। আগেভাগেই সে আমাদের দল ছেড়ে কেটে পড়েছে। আমরা তার বাড়িতে গিয়ে হানা দিলাম। ঘনঘন দরজার কড়া নাড়ার পর কৃষণ এসে দরজা খুলল। বাড়িতে একদল মাতাল ঢুকছে টের পেয়ে কৃষণের ছামিনা খাতুন পেছনের দরজা দিয়ে বের হয়ে গেল। আমরা আবারও পথে নেমে পড়লাম।
পুনাতে যত্রতত্র মন্দির। প্রত্যেক ফার্লং-এর মাথায় একটা মন্দির। মাসুদ এক মন্দিরে গিয়ে ঘণ্টা বাজাল। আমি আর শ্যাম মন্দিরের দেবতার সামনে সেজদায় পড়ে শম্ভু শম্ভ
বলতে লাগলাম। তারপর অকস্মাৎ সবাই মিলে খিলখিল করে হেসে উঠলাম।
এসব মাতলামি করতে করতে রাত তিনটা বেজে গেল। শ্যাম হঠাৎই এক রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে এমন সব অশ্লীল গালিগালাজ শুরু করে দিল, যা শুনে কানে তালা দেবার জো। আমি আর কখনও তার মুখ থেকে এসব গালি শুনিনি।
রাত চারটায় আমরা জোবেদা কটেজ’-এ ফিরে এলাম। বিলম্ব না করে শুয়ে পড়লাম। কিন্তু মাসুদ তখনও জেগে ছিল। গুনগুন করে কী একটা কবিতার চরণ ভাজছিল।
শ্যাম মদ্যপানের বেলায় মধ্যপন্থা কোনোদিনই মানত না। খেলাধুলোর ব্যাপারে সারা মাঠ জুড়ে খেলা করত। শ্যাম আমাকে প্রায়শ বলত, আমি সবসময় চৌকা পছন্দ করি, কিন্তু আমার ভাগ্যে ছক্কা এসে যায়।
দেশ বিভাগের কিছুকাল আগের ঘটনা। বোম্বেতে তখন বড়ো আকাল অর্থাৎ দুভিক্ষ। কিন্তু আমাদের আজ্ঞা এবং মদ কোনদিনই বাদ যেত না। সেদিন আমরা কথায় কথায় বেশি পান করে ফেললাম। ঘটনাক্রমে শাহেদ লতিফ এবং রাজা মেহদি আলি খানও এসে গেল। কিছুক্ষণ পর জানতে পারলাম বাইরে কারফিউ। রাজা চলে যেতে চাইছিল, আমি তাকে বাধা দিয়ে বললাম, পাগল হয়েছ?
শ্যাম বলল,
হ্যাঁ ইয়ার, এখানেই থেকে যাও। আজকাল তাজি নেই।
রাজা বলল, তোমাদের এ পালঙ্কে আমার ঘুম হবে না।
শুনতেই শ্যাম তাকে গ্লাস ভরতি করে এগিয়ে দিয়ে বলল, এটা শেষ করে নাও, তাহলেই ঘুম আসবে।
রাজা একটানে সবটুকু পান করে ফেলল। তারপর অর্ধরাত পর্যন্ত তাজির কথাবার্তা চলল। তাজি শ্যামের সঙ্গে ঝগড়া করে বোনের বাড়ি চলে গেল, মনে হল কোনোদিনই সে আর ফিরে আসবে না। আর শ্যামও এমনভাবে তাকে বিদায় করেছে যে, সে কোনোদিনই তার তাজির মুখ দেখবে না। অথচ দূরে থেকে দুজনেই দুজনের জন্যে তড়পাচ্ছে। প্রায় সন্ধ্যাতেই শ্যাম তাজির কথা বলতে বলতে অনেকটা পাগলের মতো হয়ে যেত। আমি ভাবতাম, হতভাগা সারারাত বোধ হয় আর ঘুমাবে না। কিন্তু বিছানায় পিঠ লাগাতেই নিঃসাড় হয়ে পড়ত সে।
আমার ফ্ল্যাটে মাত্র দুটো কামরা ছিল। একটা শোবার আর একটা বসবার। শোবার কামরায় শ্যাম আর তাজি থাকত। তখন তাজি নেই বলে সেই কামরার বিছানা রাজ মেহদি আলি অধিকার করে নিল। আমি বসবার কামরায় মাদুর বিছিয়ে শুয়ে পড়লাম।
অনেক রাতে মনে হল কে যেন আমার পাশে শুয়ে আছে। ভালো করে চেয়ে দেখলাম, শ্যাম। সে ছিল ভিতরে। এখানে এল কেমন করে? এরপর কাপড় পোড়ার গন্ধ পেলাম। উঠে ভেতরে গেলাম। শ্যাম যে পালঙ্কে শুয়েছিল, গিয়ে দেখি সেই পালঙ্ক জ্বলছে। অন্য পালঙ্কে রাজা মেহদি আলি নাক ডেকে অঘোরে ঘুমাচ্ছে। আগুন নেভানোর জন্যে কে যেন পানি ছিটিয়ে নিভানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু নারকেলের ছোবড়া থেকে আগুন ধরেছে বলে আগুন সহজে নিভানো সম্ভব হয়নি। আমি রাজাকে জাগালাম। কিন্তু সে পাশ ফিরে আরও আঁটোসাঁটো হয়ে শুল। আমি তাড়াতাড়ি বাথরুমে গিয়ে এক বালতি পানি এনে ঢেলে দিলাম। আগুন নিভে গেল।
অনেক কষ্টে রাজাকে জাগিয়ে পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করলাম। সে জেগেই রসিয়ে রসিয়ে বলতে লাগল, তোমার এই শ্যাম বেটা আস্ত হনুমান। রাত দুটো হবে। তখন। হঠাৎ দেখি কী, শ্যাম হনুমান সেজে লেজে আগুন ধরিয়ে তোমার খাটে নাচানাচি করছে। আমি এসব স্বপ্ন মনে করে আবার শুয়ে পড়লাম। আবার ভাবলাম বেচারির পালঙ্কটা যদি একেবারেই জ্বলে যায় কী উপায় হবে? উঠে দেখলাম, শ্যাম লা পাত্তা। তোমাকে খবর দেবার জন্যে তোমার রুমে গেলাম। গিয়ে দেখি হনুমান শ্যাম ভালোমানুষটি সেজে তোমার পাশে গুটিশুটি শুয়ে আছে। তার লেজও নেই লেজের আগুনও নেই।
রাজা মেহেদি আলি খান বলল, আমি তোমাকে অনেক করে জাগালাম, কানে ফুঁ দিলাম, ঘণ্টা বাজালাম–কিন্তু কোনো কিছুতেই তোমার কুম্ভকর্ণের নিদ্রা ভাঙল না। এরপর নিরুপায় হয়ে তোমার কানে কানে বললাম।
খাজা হুইস্কি খাবে– বোতল বোতল হুইস্কি এসেছে।
একথা শুনতেই তুমি চোখ খুলে বললে, কোথায়?
আগে ওঠো– দেখ তোমার বাড়িঘর সব জ্বলছে।
রাখো বাজে কথা।
সত্যি বলছি- কসম করে বলছি, তোমার পালঙ্কে আগুন লেগেছে।
আগুন লেগে থাকলে ফায়ার সার্ভিসে খবর দাও।
আবার পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়লে। এরপর আমি শ্যামকে জাগিয়ে ব্যাপারটা বোঝাতে চেষ্টা করলাম। শ্যাম চোখ পাকিয়ে বলল তুমিই নিভিয়ে দাও না ইয়ার, খামোখা কেন বিরক্ত করছ?
শ্যামের উক্তি শুনে আমি জগ ভর্তি পানি এনে আগুনের ওপর ঢালতে লাগলাম। এবং যখন মনে করলাম, আগুন নিভে গেছে তখন শুয়ে পড়লাম।
শ্যাম যখন ঘুম থেকে জাগল আমি (মান্টো) তাকে আগুন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম। শ্যাম ঠোঁট উলটিয়ে বলল, না তো, আমি তো এ সম্পর্কে কিছুই জানি না।
শ্যাম যখন অস্বীকার করল ব্যাপারটা জটিল মনে হল। অবশেষে সবাই মিলে আমরা তদন্তে লেগে গেলাম। আসল ব্যাপার উদঘাটন করতেই হবে আমাদের। তদন্ত শেষে যেটা উপলব্ধি করলাম সেটা হল আগুন শ্যামের কারণেই লেগেছিল। কিন্তু পাছে রাজার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে এই ভেবে শ্যাম আমার কাছে এসে চুপচাপ শুয়ে পড়েছিল।
শ্যাম প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী তাজিকে বিয়ে করতে গিয়ে যে উৎসবের আয়োজন করেছিল, এমন উৎসব বোম্বেতে আর হয়নি। যুগ যুগ ধরে চিত্র জগতে যেন তার নাম থাকে, এজন্য বিয়ের অনুষ্ঠানকে মদে প্লাবিত করে দিয়েছিল। কিন্তু এ প্লাবনের প্রতিক্রিয়া তার জীবনে কোনো আশীবাদ বয়ে নিয়ে আসেনি।
শ্যাম শুধু নারী এবং বোতলের জন্যেই পাগল ছিল না, জীবনের সব রকম সুন্দর এবং ভালো জিনিসের প্রতিই সে আসক্ত ছিল। একটা ভালো বইকে সে এতখানি ভালোবাসত, কোনো মেয়েকেও এত ভালোবাসত না। তার মা ছোটোবেলায়ই মারা গিয়েছিল। সৎমা ছিল। সত্যকে সে আপন মায়ের চেয়েও বেশি ভালোবাসত। সে মা-র গর্ভের যেসব ভাইবোন ছিল, তাদেরকেও সে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসত।
ধন এবং খ্যাতি অর্জনের জন্য তার জীবনের একটা বিরাট অংশ সংগ্রাম এবং তিতিক্ষায় কেটেছে। চরম দুঃখের দিনে সে হাতে পয়সা নিয়ে হেসে হেসে বলত, দোস্ত, আর কত কষ্ট দেবে? একদিন না একদিন আমার পকেটে তোমাকে আসতেই হবে।
তার এ উক্তি একদিন সত্য হয়েছে। অতি অল্প দিনের মধ্যেই সে বাড়ি গাড়ি এবং খ্যাতি অর্জন করেছিল।
মৃত্যুর পূর্বেও তার মাসিক হাজার হাজার টাকা ইনকাম ছিল, বোম্বের অভিজাত এলাকায় তার সুদৃশ্য বাংলো ছিল। অথচ এমন এক সময় ছিল, যখন সে মাথা গোঁজবার ঠাই পেত না। তবু তার হাসি চিরকালই ছিল অম্লান। দুঃখের দিনেও সে হাসত, সুখের দিনেও হাসত।
যে ধনের জন্যে সে মাথার ঘাম পায়ে ফেলেছে, সেই ধন যেদিন এসে তার দ্বারস্থ হয়েছে, মোটেই সে তাকে স্বাগত জানায়নি। তার ভাঙাচোরা খাঁটিয়াতেই বসতে দিয়েছে তাকে।
আমি আর শ্যাম যখন একত্রে এক বাড়িতে থাকতাম, আমাদের দিনগুলো বড্ড এলোমেলো যাচ্ছিল। দেশের রাজনৈতিক অবস্থার মতো চিত্রশিল্পের অবস্থাও তথৈবচ ছিল। আমি বোম্বে টকিজে চাকরি করতাম, আর সে সম্প্রতি একটা ছবিতে দশ হাজার টাকার কন্ট্রাক্টে সই করেছে। কিন্তু সময়মতো টাকা পেত না। তা সত্ত্বেও আমাদের দিন কোনোমতে কেটেই যেত। টাকা হাতে থাকলেই খরচ করতাম। কার টাকা কে খরচ করছে এ ধরনের কোনো খেয়াল ছিল না আমাদের মধ্যে। জানি না, এমতাবস্থায় বাড়িতে মেয়েছেলে থাকলে কী অবস্থা হত।
একদিন, অতি কষ্টে, কোত্থেকে যেন সে কিছু টাকা (সম্ভবত পাঁচশো) সংগ্রহ করেছে। আমার পকেট তখন গড়ের মাঠ। মিলাদ থেকে বাসায় ফিরছিলাম। পথিমধ্যে শ্যাম প্রোগ্রাম করল সে চার্চগেটে এক বন্ধুর কাছে যাবে। হঠাৎ সে পকেট থেকে দশ টাকার নোটের একটা বান্ডিল বের করে দু-ভাগ করে এক ভাগ আমাকে দিয়ে বলল, ধরো, টাকাগুলো নিয়ে নাও। আমি আসছি।
আমি টাকাটা হাতে নিলাম আর শ্যাম ‘টা টা’ বলে বিদায় হল। যেতে যেতে সে বলল, সেফটির জন্যে টাকাটা দু-ভাগ করে নিলাম, টাটা হাপটিল্লা।
সন্ধ্যায় যখন সে ফিরে এল, বাসায় কাবাব হচ্ছিল। জানলাম, চিত্রতারকা কে কে (কুলদীপ কাউর) তাকে একটা প্রাইভেট কথা বলার জন্যে ডেকেছিল। ফেরার সময় সে, এক বোতল ব্রান্ডি নিয়ে এসেছে। গ্লাসে এক পেগ ঢালতে ঢালতে বলল, প্রাইভেট কথাটা কী ছিল জানো মান্টো? আমি লাহোরে একবার কার কাছে যেন বলেছিলাম কে কে আমার জন্যে খুব পাগল। আসলে সে সত্যিই পাগল ছিল। কিন্তু আমি ওকে পাত্তা দিতাম না। আজ সে প্রতিশোধ নেবার জন্যে ডেকে বলল, কে বলল আমি তোমার জন্যে পাগল ছিলাম? সব মিথ্যে কথা। তুমি এসব আজেবাজে কথা আর বললো না কিন্তু। আমি হেসে বললাম, তুমি আমার জন্যে পাগল নাই বা ছিলে, না হয় এখন একবার পাগল হও। একথা শুনে সে এমন একটা জবাব দিল, যার জন্যে আমাকে একটা ঘুসি অপচয় করতে হয়েছিল।
আমি বললাম, ছি তুমি মেয়েমানুষের গায়ে হাত তুলেছ?
শ্যাম হাতের ক্ষতস্থান দেখিয়ে বলল, ভাগ্যিস, শালি হঠাৎ সরে গিয়েছিল। সরে যাওয়াতে আমার ঘুসি লাগল দেয়ালে। যার দরুন এই দশা–বড্ড জ্বালাতন করে শালি।
এসব মাত্র বছর দুয়েক আগের ঘটনা। লাহোর চিত্রশিল্পের মন্দা বাজার এবং ঠান্ডা গোস্তের মামলার কারণে ভীষণরকম ভুগছিলাম। এ মামলার আদালত আমাকে দোষী সাব্যস্ত করে তিন মাস সশ্রম কারাদণ্ড এবং তিনশো টাকা জরিমানা করেছে। আমার মন এত তিক্ত হয়ে উঠেছিল যে, ইচ্ছা হচ্ছিল সমুদয় সাহিত্যকর্ম এনে আগুনে পুড়িয়ে ফেলি। তারপর কোনো অফিসের কেরানিগিরি নিয়ে বিপন্ন বাচ্চাদের মুখে কিছু দেবার জন্যে ঘুষ খেতে আরম্ভ করে দিই। এরপর কারও সাতেও থাকব না পাঁচেও থাকব না।
এ সময় আশ্চর্য অন্তর্দ্বন্দ্বে আমার দিনগুলো কাটছিল। এক ধরনের লোক মনে করত, গল্প লিখে মামলা মকদ্দমা করাটাই বোধ হয় আমার পেশা। কেউ মনে করত, সস্তা নাম কামাই করে দু-পয়সা উপার্জন করার জন্যে আমি এসব কাণ্ডকারখানা করছি। আমার বিরুদ্ধে মোট চারটে মামলা হয়েছিল। এ চার মামলায় আমার ওপর কী কেয়ামত গেছে তা একমাত্র আমিই জানি।
আর্থিক অবস্থা আমার কোনোদিনই ভালো ছিল না। তদুপরি নানা কার্যকারণে একবারে পথে বসার জোগাড় হল। এ সময় মাকতাবাই জাদিদ-এর চৌধুরী ভ্রাতৃবৃন্দ আমার খুব সাহায্য করেছেন। দুঃখ এবং দুশ্চিন্তা ভুলে থাকার জন্যে বেশি বেশি মদ পান করতাম। আমার পানের মাত্রা যখন বেড়ে গেল, তখন ওরা টাকাপয়সা কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আমি মনঃক্ষুণ্ণ হব ভেবে তা আর করলেন না।
সে সময় আমার কারও সঙ্গেই যোগাযোগ ছিল না। সারাক্ষণ একটা নিদারুণ অস্থৈর্যে ছটফট করতাম। দিনভর মদ্যপায়ী বন্ধুদের বাড়িতে পড়ে থাকতাম। সেসব বন্ধুদের কারোরই শিল্প-সাহিত্যের প্রতি আসক্তি ছিল না। এভাবে আমি দিন দিন দৈহিক এবং আত্মিক অধঃপতনের দিকে নেমে যেতে লাগলাম।
একদিন ‘তাহসিন পিকচার্স’-এর মালিকের পক্ষ থেকে হঠাৎ এক চিঠি পেলাম। আমি যেন অবিলম্বে তার সঙ্গে দেখা করি। বোম্বে থেকে কে যেন কী একটা খবর পাঠিয়েছে। বোম্বে থেকে আমাকে স্মরণ করার মতো কেউ আছে জেনে কৌতূহলবশত আমি তাহসিন পিকচার্স-এ গেলাম। গিয়ে দেখলাম, শ্যাম আমার জন্যে শ-পাঁচেক টাকা পাঠিয়েছে। শ্যাম বারবার তাহসিন পিকচার্স-এর দফতরে মালিককে টেলিগ্রাম করে টাকাটা তাড়াতাড়ি দিয়ে দেবার জন্যে বলছিল। আমি যখন তাহসিন পিকচার্স-এর দফতরে পৌঁছোলাম, সেদিন মালিক শ্যামের কাছে উত্তর লিখে জানাচ্ছিল যে, শত চেষ্টা করেও মান্টোকে খুঁজে বের করতে পারি নাই।
আমি টাকাগুলো হাতে নিতেই অশ্রুতে চোখ ভরে এল। আমি অনেক চেষ্টা করে শ্যামকে চিঠি লিখে জানিয়ে দিতে চেয়েছিলাম যে, শ্যাম শুধু শুধু কেন টাকাগুলো পাঠিয়েছে। শ্যাম কী করে জানল, আমার হাতে টাকাপয়সা নেই? কিন্তু ক-বারই চিঠি লিখে ছিঁড়ে ফেললাম এই ভেবে যে, শ্যাম দুঃখিত হবে। বলবে, মান্টো এই বুঝি তোমার উত্তর হল?
সেবারে শ্যাম যখন তার নিজস্ব ছবির প্রদর্শন উপলক্ষ্যে অমৃতসর এসেছিল, সময় করে লাহোরেও একবার এসেছিল। লাহোরে এসে সে লোকদের কাছে আমার ঠিকানা তালাশ করছিল। ইতিমধ্যে ঘটনাক্রমে আমিই জেনে গেলাম শ্যাম এসেছে এবং একটা ফাংশানে যাচ্ছে। আমি দৌড়ে সেখানে গিয়ে উপস্থিত হলাম।
আমার সঙ্গে শ্যামের পুরোনো বন্ধু রশিদ আত্রে ছিল। গাড়ি যখন হলের আঙিনায় প্রবেশ করছিল, আমাকে এবং আত্রেকে দেখে ফেলল সে। শ্যাম হাত নেড়ে একটা চিৎকার দিল। ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বলল। কিন্তু ভক্তদের ভিড় এড়ানোর জন্যে ড্রাইভার গাড়ি থামাতে পারল না। একই পোশাকে শ্যাম আর ওমপ্রকাশ গাড়ি থেকে নেমে পড়ল। পরনে সাদা স্যুট মাথায় পানামা হ্যাট। হলের পেছনের দরজা দিয়ে ঢুকল ওরা। দৌড়ে এসে দুজন লেপ্টে গেলাম। এরপর এত বেশি হই-হল্লা এবং শোরগোল হল যে, আসল কাজের কথা কিছুই বলতে পারলাম না। ওপরতলার গ্যালারি আমাদের ওপর ভেঙে পড়ার জো হল।
হল থেকে বের হয়ে শ্যাম এক ফিল্ম ডিস্ট্রিবিউটারের কাছে রওনা দিল। সেখানে পৌঁছেও আমরা ভক্তদের ভিড় এড়াতে পারিনি। কথা শুরু করে একটা কথাও শেষ করা গেল না। লোকদের জ্বালায় টিকতে না পেরে শ্যাম ব্যালকনিতে এসে দর্শন দিল সবাইকে।
লাহোরে এসে শ্যাম সবদিকে সচকিত। রোমান্টিক শহর লাহোরের পথঘাটে স্তর স্মৃতি জড়িয়ে। আজ তো অমৃতসর আর লাহোরের মাঝে হাজার মাইলের ব্যবধান রচিত হয়েছে। কিন্তু এমন একসময় ছিল যখন লাহোর, রাওয়ালপিণ্ডি এবং অমৃতসর ছিল শ্যামের নখদর্পণে।
শ্যাম আমাকে বলল, সব সময়ে আমার সঙ্গে থাকে। কিন্তু তার অস্থির চঞ্চলতা আমার মোটেই ভালো লাগল না। রাতে তার হোটেলে গিয়ে দেখা করব বলে আমি বিদায় নিলাম।
শ্যামের সঙ্গে এতদিন পর দেখা অথচ কেমন যেন একটা অসামঞ্জস্য ভাব বিরাজ করছে আমাদের মধ্যে। আমার বড়ো বিরক্তি লাগছিল। ইচ্ছা হচ্ছিল কারও সঙ্গে আমার একটা বড়ো রকমের মারামারি, কাটাকাটি হয়ে যাক এবং আমি পরাস্ত হয়ে একটা দীর্ঘ বিশ্রাম নিই। মনের এই অবস্থা নিয়ে শ্যামের হোটেলে গেলাম এবং একজনের সঙ্গে মদ পান শুরু করে দিলাম।
রাত সাড়ে নটার সময় সর্বত্র একটা হইহল্লা শুনে বুঝলাম শ্যাম এসেছে। তার কামরায় দর্শনার্থীদের বেজায় রকম ভিড়। আমি সেখানে বসে রইলাম কিছুক্ষণ। কিন্তু মন খুলে কোনো কথা হল না। আমার মনে হল আমাদের আবেগকে তালাবদ্ধ করে কে যেন চাবিটা দূরে রেখে দিয়েছে। আমরা চাবিটা এনে যতই খুলবার চেষ্টা করছি কোনোমতেই খুলছে না।
আমার মোটেই ভালো লাগছিল না। সন্ধ্যায় ডিনার শেষে শ্যাম আবেগসমৃদ্ধ বক্তৃতা দিল। কিন্তু তার একটা শব্দও আমার কানে গেল না। সব লোকগুলো যখন একসঙ্গে হাততালি দিল তখন বুঝলাম শ্যামের বকবক শেষ হয়েছে। আমি উঠে তৎক্ষণাৎ ভেতরের কামরায় চলে গেলাম। সেখানে ফজলি সাহেব বসেছিলেন। শ্যাম এসে বলল, সবাই হিরামণ্ডি যাচ্ছে। চলো, তুমিও আমার সাথে চলো।
শুনে আমার কেঁদে ফেলতে ইচ্ছা করল, আমি বললাম, আমি যাব না, তুমি গেলে যাও।
তাহলে আমার জন্যে অপেক্ষা করো কিন্তু আমি এই এলাম বলে।
ওরা চলে গেলে আমি শ্যাম এবং চিত্রশিল্পকে ইচ্ছামতো গালি দিলাম। আমি ফজলিকে বললাম:
মনে হচ্ছে আপনি এখানে থাকবেন। যদি আপনি অসুবিধা মনে না করেন, দয়া করে আপনার গাড়িতে করে আমাকে একটু বাড়িতে পৌঁছে দিন।
রাতভর আজব আজব স্বপ্ন দেখলাম। শ্যামের সঙ্গে খুবই লড়াই ঝগড়া হল। সকালে যখন দুধওয়ালা এল, আমি তাকে নিয়ে পড়লাম, তুমি বড়ো বদমাশ। তুমি পাজি, তুমি চাড়াল।
মাথা থেকে যখন ভূতটা নেমে গেল তখন টের পেলাম, আমি একটা মস্ত অন্যায় গালি দিয়ে ফেলেছি।
আসলে সেটা আমার কণ্ঠ ছিল না। রাজনীতির ভূতের কণ্ঠ। এসব কথা ভাবতে ভাবতে আমি হাত বাড়িয়ে দুধ নিলাম, যে দুধের বারো-আনাই পানি। আসলে দুধওয়ালা কিন্তু চাঁড়াল নয়। আমার মনে একটা জিঘাংসা মাথাচাড়া দিয়ে উঠল যে, প্রকৃতপক্ষে শ্যাম তো চাঁড়াল, হিন্দু।
যে কালে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে প্রচণ্ড হত্যাকাণ্ড চলছিল, রোজ হাজার হাজার হিন্দু মুসলমান মারা যাচ্ছিল, আমি এবং শ্যাম রাওয়ালপিণ্ডি থেকে পালিয়ে এসে একটা শিখ পরিবারে আশ্রয় নিলাম। পরিবারের লোকরা লোমহর্ষক হত্যাকাণ্ডের তাজা কাহিনি শোনাচ্ছিল। শুনে শুনে শ্যামের রক্ত গরম হয়ে উঠেছিল। আমি তা দেখে ভড়কে গিয়েছিলাম। সেখান থেকে যখন বিদায় নিয়ে পথে নেমে পড়লাম আমি শ্যামকে বললাম,
আমি তো মুসলমান। তোমার কি ইচ্ছা করে না আমাকে হত্যা করতে?
এখন আর ইচ্ছা করে না। তবে যখন হত্যার কাহিনি শুনছিলাম তখন ইচ্ছা করছিল।
একথা শুনে আমি বড়ো আঘাত পেলাম। আমারও খুন করতে ইচ্ছা করছিল ওকে। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা এসব মানসিক দ্বন্দ্ব থেকে মুক্তি পেলাম।
বোম্বেতে তখন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার আগুন ছড়িয়ে পড়েছিল। বোম্বে টকিজের কর্তৃত্ব যখন অশোক ও ওয়াচার হাতে চলে গেল, কেমন করে যেন বড়ো বড়ো পদে মুসলমান নিয়োজিত হয়ে পড়ল। এতে হিন্দু স্টাফরা খেপে গেল। ওয়াচার কাছে গোপনে চিঠি আসতে লাগল যে, অচিরেই স্টুডিয়োকে ভস্মীভূত করা হবে এবং কাটাকাটি শুরু হবে। কিন্তু অশোক এবং ওয়াচা এসব ঘোড়াই কেয়ার করত।
ওরা এ বিষয় পরোয়া না করলেও আমার কিন্তু চিন্তা ধরে গিয়েছিল। আমি ওদেরকে বললাম, বোম্বে টকিজ থেকে আমাকে মুক্তি দাও। কারণ, হিন্দুরা মনে করবে আমার কারণেই বোম্বে টকিজে গোরুখেকোদের আধিপত্য বেড়ে চলেছে। কিন্তু ওরা আমাকে বলল, তোর মাথা খারাপ হয়েছে রে মান্টো।
মাথা আমার সত্যি খারাপ হতে চলেছিল। কারণ, আমার পুত্র-পরিজন ছিল পাকিস্তানে। পাকিস্তান যখন ভারতের অংশ তখন তার সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা ছিল। কিন্তু এখন হয়েছে ভিন্ন দেশ।
আমার সামনেই বোম্বেতে ১৫ আগস্ট উদ্যাপিত হল। দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র পেয়ে দুটো জাতিই খুব খুশি হল। কিন্তু মারামারি কাটাকাটি তখনও চলছিল দেদার। বোম্বের পথেঘাটে ‘হিন্দুস্থান জিন্দাবাদ’-এর পাশাপাশি পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ ধ্বনিও শোনা গেল। কংগ্রেসের পতাকার পাশে পাকিস্তানি পতাকাও দেখতে পেলাম। নেহরু আর জিন্নাহ, দুজনের কথাই পথেঘাটে শুনতে পেলাম। বুঝতে পারলাম না, ভারত আমার, না পাকিস্তান আমার। আর রোজ রোজ এত রক্ত কার জন্যে প্রবাহিত হচ্ছে। যে শবগুলোর ধর্মের মাংস চিল-কুকুরে খাচ্ছে তাদের হাড়গুলো জ্বালানো হবে, না দাফন করা হবে, বুঝে উঠতে পারলাম না। এতকাল আমরা পরাধীন ছিলাম। স্বাধীনতার প্রয়োজন ছিল। এখন আমরা স্বাধীন হয়েছি, এখন আবার আমাদের গোলাম হবে কারা?
রোজ এত হিন্দু-মুসলমান কেন মারা যাচ্ছে একথায় হিন্দুস্থানি, পাকিস্তানি এবং ইংরেজি সবরকম জবাবই ছিল। কিন্তু সত্যিকারভাবে তালাশ করতে গেলে এর কোনো জবাব ছিল না। কেউ বলত, এর জবাব সিপাই বিদ্রোহ’তে পাবে। কেউ বলত, এর জবাব ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে পাবে। আবার কেউ একটু পিছিয়ে গিয়ে বলত, এর জবাব মোগলদের ইতিহাসে তালাশ করো। যারা জবাব তালাশ করত তারা ক্রমে পিছিয়েই যাচ্ছিল, আর হত্যাকারীরা ক্রমশ এগিয়ে চলেছিল এবং এই রক্ত দিয়ে লেখা ইতিহাস রচনা করছিল।
পাকিস্তান-হিন্দুস্থান দুটো দেশই স্বাধীন হয়েছে, কিন্তু মানুষ তাদের দেশেই চিরকালের মুখতা, বর্বরতা, সাম্প্রদায়িকতা এবং ধর্মের দাস হয়ে রইল।
আমি শরীর খারাপের অজুহাত করে বোম্বে টকিজে যাওয়া ছেড়ে দিয়েছিলাম। আমার এসব দেখে শ্যাম মুখ টিপে হাসত, সে আমার মনের অবস্থা জানত। এরপর পানাভ্যাসের মাত্রাটা একটু বাড়িয়ে দিয়ে এসব চিন্তা থেকে বাঁচতে চাইলাম। সারাদিন সোফায় গুটিশুটি মেরে গম্ভীর হয়ে বসে থাকতাম। একদিন শ্যাম স্টুডিও থেকে ফিরে এসে আমাকে টিটকারি দিয়ে বলল,
কিহে খাজা, কাব্য-চচা এখনও শেষ হল না?
শুনে আমার বড় বিরক্ত লাগল। শ্যাম কেন আমার মতো করে ভাবতে চায় না? আমি অহোরাত্র এসব নিয়ে যুদ্ধ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়তাম, আর ওদিকে শ্যাম হইহুল্লোড়, হাসি, চিৎকার ইত্যাদি করে বেড়াত। মনে হত, ও এসব চিন্তার এক কিনারা করে রেখেছে।
অনেক চিন্তাভাবনা করে করে আমি ঠিক করলাম এখানে আর থাকব না। শ্যাম রাত্রের স্যুটিং-এ গিয়েছিল। আমি মালসামান বাঁধতে শুরু করলাম। ভোর রাত্রে শ্যাম ফিরে এসে যখন দেখল সব কিছু বেঁধেছেদে ফেলেছি। শুধু বলল, শেষ পর্যন্ত চললে তাহলে?
হ্যাঁ।
এছাড়া আমাদের মধ্যে আর কোনো কথা হয়নি। শুধু সুটিং-এর নানা গালগল্প করে কিছুক্ষণ হাসাহাসি করল। যখন আমি রওনা দেব, এমন সময় আলমারি খুলে বোতল বের করে দু-গ্লাসে ঢেলে আমার দিকে এক গ্লাস এগিয়ে দিয়ে বলল, হাপটিল্লা’। আমিও ‘হাপটিল্লা’ বললাম। শ্যাম হঠাৎ অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল; শুয়োর কোথাকার।
‘পাকিস্তানের’, আমি বললাম। শ্যাম সজোরে চিৎকার করে বলল, পাকিস্তান জিন্দাবাদ’।
‘জিন্দাবাদ হিন্দুস্থান’ আমি বললাম।
নীচে ট্রাকওয়ালা আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। আমি নেমে গেলাম। পোর্ট অবধি শ্যাম আমাকে এগিয়ে দিল। জাহাজ ছাড়তে তখনও বেশ দেরি ছিল। শ্যাম এটা-ওটা বলে আমাকে আনন্দ দিতে চেষ্টা করছিল। যখন সিটি বাজল, হাপটিল্লা’ বলে সে বিদায় হল। একবারও পেছন ফিরে আর তাকাল না।
লাহোর পৌঁছে আমি ওকে চিঠি লিখলাম। সঙ্গে সঙ্গেই ও জবাব দিল:
এখানে সবাই তোমাকে স্মরণ করে। আমাদের মাঝে তুমি নেই এটা বড়োই তীব্র হয়ে বাজে। ওয়াচা বলে তুমি চোরের মতো চলে গেলে। একবার তাকে বলেও যেতে পারতে। বোম্বে টকিজে মুসলমানদের মধ্যে যে ছিল অগ্রদূত সে কেমন করে পালিয়ে গিয়ে নিজের আদর্শকে শহিদ করতে পারল? ওয়াচা বলে। খুব সম্ভব তুমি ওয়াচাকে চিঠি লিখেছ আর না লিখে থাকলে একটুও দেরি না করে লিখে ফেল। ইতি
–তোমার শ্যাম।
আজ আমি মৃত শ্যামের আত্মার কাছে একটি কথা জিজ্ঞেস করতে চাই, আমি বোম্বে টকিজ ছেড়ে আসতে পারলাম, কিন্তু নেহরু কেন কাশ্মীর ছাড়তে পারছেন না?
——–
৬। কাহিনি চিত্রনাট্যই নয়, ছবিটি পরিচালনাও করেছিলেন কামাল আমরোহী। নায়ক-নায়িকা হলেন অশোককুমার ও মধুবালা। এটা বোম্বে টকিজের ছবি। মুক্তি পায় ১৯৪৯-এ।
৭। কৃষণ চন্দর। বিখ্যাত উর্দু গল্পকার ও ঔপন্যাসিক। তাঁর রচিত উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে ‘রোটি কাপড়া মোকাম’, গাদ্দার’, বাম ওয়াসি হ্যায়’ প্রমুখ। বেশ কিছু ছোটোগল্প লিখেছেন। মানবতা ও ব্যঙ্গ তার রচনার অন্যতম অবলম্বন।