০৩. পরিরানি নাসিম বানু
আমার ছবি দেখার শখ অমৃতসরেই মিটে গিয়েছিল। অমৃতসরে আমি অগণিত ছবি দেখেছি, যার ফলে বোম্বেতে যখন মোসাওয়ার পত্রিকার সম্পাদনা করতে এলাম বেশ কিছুকাল ছবি দেখতে যাইনি। পত্রিকাটি ছিল সিনেমা সংক্রান্ত। অনেকে পাস দিয়ে যেত। তবু আমি ছবি দেখতে যেতাম না।
সেকালে বোম্বে টকিজের ‘অচ্ছুত কন্যা’(৪) নামক একটা ছবি বেশ কিছুকাল ধরে চলছিল। ছবির দ্বাবিংশত সপ্তাহে আমি ভাবলাম, ছবিটার মধ্যে এমন কী আছে যে এতদিন ধরে চলছে? ছবিটা দেখা দরকার।
এ ছবিতে আমি সর্বপ্রথম অশোককুমার আর দেবিকারানিকে দেখি। অশোকের অভিনয় তেমন ভালো হয়নি। কিন্তু দেবিকার অভিনয় বেশ পাকাপোক্ত। ছবি মোটামুটি উৎরে গেছে। ছবিটাতে তেমন বাড়াবাড়ি ছিল না। একটা সাদাসিধে কাহিনি, বেশ পরিচ্ছন্ন পরিণতি। এ ছবিটার পরই আমি আবার ঘনঘন ছবি দেখতে শুরু করে দিলাম।
সেকালে নাসিম বানু নামে একজন অভিনেত্রীর বেশ নামডাক। চারদিকে তার রূপের। চর্চা হত। সিনেমার পোস্টারে এবং বিজ্ঞাপনে পরিরানি নাসিম বানু বলে উল্লেখ করা হত। আমার পত্রিকাতেও তার বেশ কটি ছবি ছাপলাম। সত্যি তার স্বাস্থ্য চেহারা সবকিছু অনুপম ছিল। সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছিল তার চোখজোড়া।
তখন সবেমাত্র তার দুটো ছবি তৈরি হয়েছে। দুটো ছবিই সোহরাব মোদী বানিয়েছেন। ছবিগুলো বেশ হিট করেছিল বলে শুনেছি। কিন্তু আমি কেন জানি না ছবিগুলো দেখতে পেলাম না। এরপর অনেকদিন গত হল। একদিন হঠাৎ বিজ্ঞাপন দেখলাম যে, মনরো মুভিটোনের পক্ষ থেকে ‘পুকার’(৫) ছবি হচ্ছে আর তাতে পরিরানি নাসিম সম্রাজ্ঞী নূরজাহানের চরিত্রে অবতরণ করবেন।
ছবিটি তৈরি হতে বেশ সময় লাগল। পত্র-পত্রিকায় পুকারের বিজ্ঞাপনে নাসিম নূরজাহানের রূপসজ্জায় অপরূপ ভঙ্গিতে প্রতিভাত হল।
‘পুকার’-এর প্রথম প্রেস-শোতে আমি দাওয়াত পেলাম। সম্রাট জাহাঙ্গিরের ন্যায় নীতির একটা হাতে-বানানো কাহিনি এর বিষয়বস্তু। বড়ো আবেগময় এবং নাটকীয়ভাবে ছবির পরিসমাপ্তি করা হয়েছে। ছবিটাতে সংলাপ এবং পোশাকের ওপর বেশি জোর দেওয়া হয়েছিল। সবদিক দিয়ে ছবিটি ভারতের চিত্রশিল্পের পুরোনো রেকর্ড ভেঙে এক নতুনত্ব স্থাপন করে।
নাসিমের অভিনয় তেমন ভালো হয়নি। তবে তার অনুপম রূপশ্রী এবং সাজসজ্জা তার অভাব অনেকটা পূরণ করে দিয়েছে। আমার যতটুকু মনে পড়ে ‘পুকার’-এর পর নাসিম আর দু-একটা ছবিতে অভিনয় করেছিল। কিন্তু পুকার’ ছবিতেই তার খ্যাতি হয়েছে বেশি।
এ সময় নাসিমের নামে নানা গুজব ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে। এটা সবাই জানেন চিত্রজগতে স্ক্যান্ডাল চলে দেদার। কখনও শোনা যেত সোহরাব মোদী নাসিমকে বিয়ে করবে। আবার কখনও শোনা যেত হায়দ্রাবাদের নিজামের পুত্র মোয়াজ্জেম শাহ এবং নাসিমের মধ্যে প্রেম চলছে। অচিরেই তাকে নিয়ে সে চলে যাবে। শেষোক্তটি অনেকাংশে সত্য ছিল। কারণ সেকালে নিজামের পুত্র প্রায় সময় বোম্বেতে আনাগোনা করতেন। এবং অনেকবার তাকে নাসিমের বাড়িতে দেখা গেছে। নিজাম তনয় দেদার টাকা ঢেলেছেন। নাসিমের মা শামসাদ ওরফে ছামিয়া বেগমকে প্রসন্ন করিয়ে মা মেয়ে দুজনকেই তিনি হায়দ্রাবাদ নিয়ে গেলেন।
কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে সেখানে তাদের দম আটকে আসতে লাগল। হায়দ্রাবাদটা কেমন যেন রূঢ় ঠেকতে লাগল তাদের কাছে। তা ছাড়া নিজাম তনয়ের মেজাজটাতেও কেমন একটু গোঁয়ারেপনা। নিজামের রাজত্ব থেকে পালিয়ে আসা দুষ্কর ছিল। তবু কেমন করে নাসিমের মা অবশেষে বোম্বে ফিরে আসতে সক্ষম হলেন, সে কথা ভেবে সবাই আশ্চর্য হল।
নাসিম বানু ফিরে আসায় বোম্বেতে একটা হইচই পড়ে গেল। খুব পোস্টারবাজি হল। লোকেরা দু-ভাগে ভাগ হয়ে গেল। একদল নিজাম তনয়ের পক্ষ নিল, অপর দল নাসিমের। বেশ কিছুকাল কাদা ছোঁড়াছুড়ি হল। অবশেষে একদিন সব থেমে গেল।
আমি ততদিনে চিত্রজগতে ঢুকে পড়েছি। কিছুকাল ইম্পেরিয়ালের মুন্সীগিরি করলাম। পরিচালকদের নির্দেশে চটকদার ভাষায় সংলাপ রচনা করতাম। বেতন ছিল মাত্র ষাট টাকা। এরপর কিছুটা উন্নতি করে হিন্দুস্থান সিনেটোনে নানুভাই দেশাই-এর ওখানে একশো টাকার চাকরি নিলাম। এখানে আমি সর্বপ্রথম আমার চিত্ৰকাহিনি রচনা করি। পরে তা ‘আপনি নাগরিয়া’ নামে চিত্রায়িত হয়। এমন করে আমি চিত্রজগতে প্রায় পরিচিত হয়ে গেলাম।
এসময় একটা বিজ্ঞাপনে দেখলাম, এহসান নামের একজন তোক তাজমহল পিকচার্স’ নাম দিয়ে একটা ফিল্ম কোম্পানি খুলেছেন এবং ‘উজালা’ নাম দিয়ে একটা ছবির কাজেও নেমে পড়েছেন। বলা বাহুল্য, ছবির নায়িকা হবেন নাসিম বানু।
এ ছবি তৈরির গোড়ায় ছিলেন ‘পুকার’-এর কাহিনিকার কামাল আমরোহী এবং পাবলিসিটি ম্যানেজার এম এ মুগনী। ছবি তৈরির প্রথমেই আমরোহী এবং মুগনীর মধ্যে ঝগড়ার সূত্রপাত। এ ঝগড়ার পরিণতি শেষ পর্যন্ত আদালত অবধি গড়ায়। তাদের ঝগড়া সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত মানে মানে ছবিটা তৈরি হয়েছিল।
ছবির কাহিনি, সংলাপ, গান, অভিনয় সবকিছু নিম্নমানের হয়েছিল। ফলে ভালো চলেনি। এহসান সাহেবকে অবশেষে বহু টাকা গচ্চা দিয়ে কোম্পানি বন্ধ করে দিতে হয়েছিল।
কোম্পানি বন্ধ করে দিলেও নাসিম বানুর সঙ্গে হৃদয়ের লেনদেন তার বন্ধ হল না। ছবি তৈরির সময়ই এহসান নাসিমের প্রণয়াসক্ত হয়েছে অবশ্য এমন কথা বলা ঠিক হবে না। কারণ এর আগেও এদের জানাশোনা নিবিড় ছিল। এহসানের পিতা খান বাহাদুর মোঃ সোলায়মান (চিফ ইঞ্জিনিয়ার) নাসিমের মা শামসাদের প্রণয়াসক্ত ছিলেন। সাদা কথায় তিনি তার দ্বিতীয় পত্নী (উপপত্নী) ছিলেন। অতএব তাদের এ প্রেম অনেকটা বংশানুক্রমে প্রাপ্ত বলা যেতে পারে। কিন্তু এ নিয়ে লোকেরা বলাবলি করত বলে এহসান অত্যধিক লজ্জা পেত। যার কারণে সে সুটিং-এর সময় খোলাখুলিভাবে নাসিমের সঙ্গে মিশতে পারত না। সুতরাং তাদের প্রেম অনেকটা গুজব বই কিছু নয়। কিন্তু এই অনুকূল জনমতকে মিথ্যা করে দিয়ে এহসান যেদিন নাসিম বানুকে দিল্লিতে নিয়ে বিয়ে করে ফেলল সবাই বিস্মিত হল। খবরটা নাসিম বানুর ভক্তদের জন্যে নিঃসন্দেহে মর্মান্তিক ছিল। ভক্তরা আরও বেশি ভেঙে পড়ল। যখন শুনতে পেল নাসিম চিত্রজগৎ ছেড়ে ঘরকন্নায় মনোনিবেশ করেছেন।
এহসান-নাসিমের প্রেমের কথাটি আমি জানতাম না। কিন্তু অশোকের বর্ণনা থেকে এর চমকপ্রদ রোমান্টিক গন্ধ পাওয়া যায়।
‘চল্ চলরে নওজোয়ান’ শেষ হতে দু-বছর লেগেছিল। দুটি বছর নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা এবং তিতিক্ষায় কাটল। কিন্তু অতঃপর ছবি যখন আশানুরূপ সাফল্য লাভ করল
আমাদের সবার ওপর একটা ম্লান ছায়া নেমে এল। মুখার্জি তো একেবারে ভেঙে পড়ল। কিন্তু তারপর তাকে তাজমহল পিকচার্স-এর ওপর একটি ছবি পরিচালনা করতে হল। এ ভাঙা মন নিয়ে একাজে তিনি হাত দিতেন না। কিন্তু কী করা, আগে থাকতে এটার কনট্রাক্ট হয়েছিল।
ততদিনে এস মুখার্জির সঙ্গে এহসানের বেশ দহরম মহরম হয়ে গিয়েছিল। কাজেই এহসান তাজমহল পিকচার্সের দায়িত্ব মুখার্জির কাঁধে চাপিয়ে দিল। মুখার্জি আমার সঙ্গে পরামর্শ করল। শেষে সিদ্ধান্ত হল ‘বেগম’ নাম দিয়ে আমি এমন একটা কাহিনি লিখব যাতে নাসিম বানুর সৌন্দর্যকে বেশি কাজে লাগানো যায়।
আমি মোটামুটি একটা প্লট খাড়া করলাম, মুখার্জি তাতে আবার কিছুটা রদবদল করলেন। যখন ছবি তৈরি হয়ে গেল, আমি আশ্চর্য হয়ে দেখলাম আমি যে কাহিনি লিখেছিলাম সেটা কাগজপত্রেই আটকা রয়ে গেছে। আমার সে কাহিনির প্রতিচ্ছায়াটা শুধু রুপালি পর্দায় দেখতে পেলাম।
‘বেগম’ লেখার সময় নাসিমের সঙ্গে আমাদের ঘনিষ্ঠতা বেড়ে যায়। আমি এবং এস মুখার্জি দুপুরে নাসিমের ওখানে খেয়ে রাত অবধি বসে কাহিনি রদবদল, পরিবর্তন পরিবর্ধন করতাম।
আমরা ভাবতাম, নাসিম না জানি কত বড়ো বাড়িতে থাকে। কিন্তু যখন পোরবন্দর রোডে তার বাংলোতে ঢুকলাম, আমার সব ধারণা পালটে যেতে লাগল। সেকেলে ধরনের একটা বাড়ি, দেওয়ালের আস্তর শসা, জানলার খড়খড়ি টুটফুটা। চারিদিকে কিছু মামুলি আসবাবপত্র, সম্ভবত সেগুলো ভাড়া করে এনে রাখা হয়েছে।
এই বাড়ির পটভূমিকায় আমি নাসিমকে গভীর করে দেখলাম। বারান্দায় দাঁড়িয়ে সে গোয়ালার সঙ্গে দুধের কুপনের হিসাবপত্র নিয়ে বচসা করছিল। সে টেনে টেনে কষ্ট করে গোয়ালার সঙ্গে কথা বলছিল। নাসিমের অভিযোগ হল, গোয়ালা আধা সের দুধের হেরফের করেছে। আমি আশ্চর্য হয়ে গেলাম, যে নাসিমের জন্যে কত লোক দুধের নহর বইয়ে দেবার জন্যে প্রস্তুত, সেই নাসিমের আধ সের দুধের হিসাবের কী দরকার পড়ল?
আমি আস্তে আস্তে টের পেলাম, পুকার’-এ যে রূপবতী নুরজাহানের রূপসজ্জায় প্রতিভাত হয়েছিল আসলে সে নেহাত ঘরোয়া স্বভাবের একটি মেয়ে। ঘরকন্নার সব বিশেষণের সঙ্গে সে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
বেগমের কাজ যখন আরম্ভ হল, ড্রেসের সম্পূর্ণ দায়িত্ব নাসিম নিয়ে নিল। অন্যথায় ড্রেসের জন্যে আমাদেরকে ১০-১২ হাজার টাকা বরাদ্দ করতে হত। নাসিম দরজি ডেকে নিজের বাড়িতেই দরজিখানা বসিয়ে দিল। তার পুরোনোনা শাড়ির সম্ভার থেকে কাপড় কেটে কেটে প্রয়োজনীয় কামিজ ঘাগরা ইত্যাদি তৈরি করিয়ে নিল। কাপড় পরিধানের ব্যাপারে নাসিমকে বলা যেতে পারে সে কাপড় পরত, কিন্তু ব্যবহার করত না। যে কোনো পোশাকেই তাকে মানাত। এ জন্য এস মুখার্জি তাকে ‘বেগম’ ছবিতে বিচিত্র পোশাকে পেশ করেছেন। এক কাশ্মীরি গেঁয়ো মেয়ের রূপসজ্জায় ক্লিওপেট্রার পোশাক থেকে আরম্ভ করে সর্বশেষ পোশাকে তাকে অবতীর্ণ করেছেন।
আমরা নিশ্চিত জানতাম, অন্তত বিচিত্র পোশাকের কল্যাণে হলেও ছবিটার কাটতি হবে। আফশোস, দুর্বল পরিচালনা এবং দুর্বল মিউজিকের দরুন ছবিটা মার খেয়ে গেল।
এ ছবিটার জন্য আমরা বেশ পরিশ্রম করেছিলাম। রাত তিনটে অবধি আমরা এহসানের বাড়িতে কাজ করতাম। গভীর রাত অবধি এহসান আমাদের কথাবার্তা, শলাপরামর্শ শুনত। তার একটা অভ্যাস ছিল, পা দোলাত। যখন দেখতাম পা আর দোলাচ্ছে না বুঝতাম এহসান ঘুমিয়ে গেছে। তখন আমরাও ঘুমের প্রস্তুতি নিতাম।
এহসানের এ অভ্যাসটা বড়ো খারাপ লাগত। এহসান রসঘন একটা গল্পের মাঝখানে হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়ত। নাসিম এহসানের আগে কোনো সময়েই ঘুমাত না। আমরা নাসিমের চোখে ঘুমের নোটিশ দেখলে তখন আর মোটেই কাজ করতাম না। বাড়ি ফিরে যাওয়া আমার জন্য খুব কষ্টকর হত। আমার বাসা ছিল ঘোর বন্দরে। ট্রামে প্রায় পৌনে একঘণ্টা লাগত। আমার এ অসুবিধা সম্পর্কে মুখার্জিকে বললাম। শেষে সবাই সিদ্ধান্ত করল, আমি কিছুকালের জন্য এহসানের বাড়িতেই অবস্থান করব।
এহসান বড়ো ঢিলে স্বভাবের লোক ছিল। কোনো কথা বলতে তার এক বছর কেটে যেত। সে বলতে চাচ্ছিল, আমার কোনো কিছুর দরকার হলে বিনা দ্বিধায় যেন তাদের কাছ থেকে চেয়ে নিই। কিন্তু আমি তা বলার আগেই বুঝতাম, সব রকম আরাম আয়েসের উপকরণ মজুদ থাকা সত্ত্বেও তারা আমার দিকে বিশেষ খেয়াল রাখত।
নাসিম চমৎকার পাঞ্জাবি বলতে পারত। চল চলরে নও জোয়ানের একজন অভিনেতার কাছে আমি এ খবরটা দিলাম যে, নাসিম চমৎকার পাঞ্জাবি বলতে পারে। সে বিশ্বাস করল না। একদিন স্যুটিং-এর সময় নাসিম, রফিক এবং অশোক উপস্থিত ছিল। আমি রফিককে বললাম, ইবরুনজা কাকে বলে?
রফিক বলল, এটা আবার কোন ভাষার শব্দ?
কেন আবার পাঞ্জাবি! বলো এর অর্থ কী?
রফিক তার স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে বলল,
মাইনু মালুম নেই। আই ইবরুনজে দে পুত্তুর।
এভাবে প্রকাশ হয়ে গেল যে নাসিম পাঞ্জাবি জানে।
অশোক প্রায়ই ক্যাপ্টেন সিদ্দিকীর বাসায় যেত। প্রথম প্রথম সিদ্দিকীর বাসাটার পরিবেশ কেমন যেন একটু এলোমেলো মনে হল। তারপর এক সময় সে রীতিমতো উন্নত ধরনের সেন্টের গন্ধ পেতে লাগল। ক্যাপ্টেন সিদ্দিকীকে জিজ্ঞেস করায় সে কথাটা এড়িয়ে গেল।
একদিন ক্যাপ্টেন বাসায় ছিল না। অশোক গিয়ে হাজির হল। সেদিনও সেই সেন্টের গন্ধ। অশোক শুঁকতে শুঁকতে আবিষ্কার করল যে, গন্ধটা ওপরের তলা থেকে আসছে। পা টিপে টিপে ওপরে চলে গেল সে। দরজা সামান্য খুলতেই সে হঠাৎ দেখল নাসিম বানু একজন লোকের কণ্ঠলগ্ন হয়ে আছে। লোকটি হলেন মিঃ এহসান।
এরপর অশোক ক্যাপ্টেনকে ব্যাপারটা বলল। ক্যাপ্টেন বলল, এটা তো অনেককাল থেকেই চলছে।
আমি যতটুকু জানতাম, নাসিম ও এহসানের প্রণয়ের বিরুদ্ধে তার মা এবং বোনেরা খড়হস্ত ছিল। তাদের সঙ্গে এহসানের অনেকবার ঝগড়া হয়েছে। কিন্তু পিতা খান বাহাদুর সোলায়মান এদের বিয়েতে রাজি ছিলেন। তাই আর তাদের বিয়ে কোনোমতে আটকালো না। বিয়ের পর নাসিম দিল্লিতেই বসবাস শুরু করল, যেখানে তার শৈশব কেটেছিল।
বিযের সম্পর্কে এবং বিয়ের ব্যাপারে কিছুকাল খবরের কাগজ ইত্যাদিতে দেদার চর্চা হল। কিন্তু শত চেষ্টাতেও নাসিম আর চিত্রজগতে ফিরে এল না।
ইতিমধ্যে চিত্রজগতে অনেক উত্থানপতন হয়ে গেছে। অনেক চিত্র প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে ব্যাঙের ছাতার মতো। অনেক তারকার উত্থানপতন হয়েছে। হিমাংশু রায়ের আকস্মিক মৃত্যুতে বোম্বে টকিজ এক মগের মুল্লুকে পরিণত হল। দেবিকারানি (মিসেস হিমাংশু) এবং রায়বাহাদুর চুনীলাল (জেনারেল ম্যানেজার)-এর মধ্যে ঝগড়া-ফাসাদ শুরু হল। অবশেষে রায়বাহাদুর তার নিজের গ্রুপ নিয়ে বোম্বে টকিজ থেকে আলাদা হয়ে গেলেন। সে দলে ছিলেন এস মুখার্জি, গল্প লেখক এবং পরিচালক জ্ঞান মুখার্জি, অশোককুমার, কবি প্রদীপ, সাউন্ড রেকর্ডস্ট এস ওয়াচা, কমেডিয়ান দেশাই, সংলাপ রচয়িতা শাহেদ লতিফ এবং সন্তোষী। এরা নতুন চিত্র প্রতিষ্ঠান তৈরি করলেন যার নাম দেওয়া হল ফিল্মিস্থান। এস মুখার্জিকে বানানো হল প্রডাকশন কন্ট্রোলার। নতুন ব্যবস্থাপনায় স্টুডিওকে নতুন আবরণে সাজানো হল। সবকিছু ঠিকঠাক। কিন্তু এস মুখার্জিকে একটু চিন্তিত মনে হল। ছবির জন্যে কাহিনি ইত্যাদি তৈরি করা হল। এস মুখার্জি চাইছিলেন, কী করে দেবিকারানিকে টেক্কা দেয়া যায়।
অনেক আকাশপাতাল ভেবেচিন্তে ঠিক করলেন, যদি নাসিম বানুকে পুনরায় চিত্রজগতে আনা যায় তাহলেই বাজিমাত।
অশোকের সুবাদে ক্যাপ্টেন সিদ্দিকীর সঙ্গে এস মুখার্জিরও জানাশোনা ছিল। তা ছাড়া রায়বাহাদুর চুনীলালের সঙ্গে এহসানের বাবার গলায় গলায় খাতির ছিল। সুতরাং নাসিম অবধি তাদের অভিপ্রায় পৌঁছোতে দেরি হল না। এরপর সবচেয়ে বড়ো বাধা ছিল, প্রথমত এহসানকে রাজি করানো তারপর নাসিমকে।
একমাত্র এস মুখার্জির আত্মবিশ্বাসই নাসিমকে আনার ব্যাপারে যথেষ্ট সহায়তা করেছে। এহসান প্রথমদিকে অমত করেছিল। কিন্তু পরে রাজি হয়ে গেল। নাসিমকে রাজি করানোর সুখবর নিয়ে বোম্বেতে অবতরণের পরই পত্র-পত্রিকায় এ খবর ফলাও করে ছাপা হল। সর্বত্র একটা আলোড়ন পড়ে গেল যে চল চলরে নওজোয়ান’-এ নাসিম বানু নায়িকা হিসেবে অবতরণ করছে। নাসিমের পুনরায় চিত্রজগতে প্রত্যাবর্তনের খবরটা সত্যি একটা চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে।
তখন আমি দেড় বছর অল ইন্ডিয়া রেডিয়োর সঙ্গে জড়িত থেকে আবার বোম্বে ফিরে এসেছি এবং শওকত হোসেন রিজভীর জন্য একটা কাহিনি লেখার কাজে আত্মনিয়োগ করেছি।
এ কাহিনির পর আরও ক-টা কাহিনি লেখা হল। এসময় আমি ঘর থেকে খুব কম বের হতাম। আমার স্ত্রীর এতে খুব খারাপ লাগত। সে ভাবত, আমি অকাজে বসে বসে দিনগুলো কাটাচ্ছি।
আলিগড় ইউনিভার্সিটি থেকেই আমার সঙ্গে শাহেদ লতিফের জানাশোনা। ফিল্মিস্থানের কাজ থেকে ছুটি পেলেই আমার কাছে চলে আসত সে। একদিন আমার স্ত্রী শাহেদ লতিফের কাছে অভিযোগ করে বলল, ভাই একে বলুন, কোথাও গিয়ে চাকরি করার জন্যে। ঘরে বসে শুধু শুধু স্বাস্থ্য নষ্ট করছে। একটা চাকরি নিলে অন্তত ঘরে থাকার রোগটা তো তার কাটবে।
এর ক-দিন পর মিলাদ থেকে শাহেদ লতিফের ফোন এল। শাহেদ লতিফ আমাকে জানাল, এস মুখার্জি একটা ইন্টারভিউ নিতে চাইছে আমার। কারণ তার একজন লোকের দরকার।
চাকরির আমার কোনো দরকার ছিল না। তবে ‘ফিল্মিস্থান দেখার জন্য আমি অগত্যা রওনা হয়ে গেলাম। ফিল্মিস্থানের পরিবেশ অত্যন্ত ভালো মনে হল আমার। এস মুখার্জির দ্বারা আমি বেশ প্রভাবান্বিত হলাম। সুতরাং সেখানেই কন্ট্রাক্ট হয়ে গেল। বেতন সর্বমোট তিনশো টাকা। আমার বাসা থেকে সেই ‘গোরেগাঁও’ পৌঁছোতে এক ঘণ্টা লাগত। এক ঘণ্টার জার্নি করে এ বেতনে আমার পোষাত না। তবু আমি মেনে নিলাম। ভাবলাম ঠিক আছে এদিক সেদিক থেকে কিছু কামাই করে নেব।
ফিল্মিস্থানে প্রথম প্রথম আমার কাছে বেখাপ্পা লাগত। কিন্তু পরে বেশ জমে উঠল। এস মুখার্জির সঙ্গেও বেশ খাতির হয়ে গেল আমার।
এসময় আমি নাসিম বানুকে ছিটেফোঁটা কয়েকবার দেখলাম। গাড়িতে করে কয়েক মিনিটের জন্যে আসত এবং চলে যেত।
এস মুখার্জি বড়ো খুঁতখুঁতে স্বভাবের লোক ছিলেন। কাহিনি লেখার পরে সেটাকে নিয়ে মাসকে মাস বসে যেতেন। তারপর পরিবর্তন এবং পরিবর্ধনের কাজ শেষ হলে স্যুটিং-এর বন্দোবস্ত করতেন। ছবিতে প্রথম দিকের দৃশ্যগুলোতে নাসিম বানুর চরিত্র ছিল না। অবশেষে একদিন তার সঙ্গে দেখা হল। স্টুডিয়োর বাইরে ফোলডিং চেয়ারে পায়ের ওপর পা রেখে বসে ফ্লাস্ক থেকে ঢেলে ঢেলে চা পান করছিল সে। অশোক আমার সঙ্গে তার পরিচয় করিয়ে দিতে সে বলল, হ্যাঁ আমি তো ওঁর লেখা গল্প পড়েছি।
তারপর আমাদের আলাপ জমে উঠল। নাসিম তখন মেকআপ অবস্থায় ছিল। তার আসল চেহারা দেখতে পারিনি। তবে প্রথম দেখাতে তার যে জিনিসটি আমি নোট করেছি তা হল কথা বলার সময় কেমন যেন টেনে টেনে কষ্ট করে কথা বলে।
‘পুকার’-এর নাসিম আর চল চলরে নওজোয়ান’-এর নাসিমের মধ্যে আকাশপাতাল প্রভেদ ছিল। পুকারে সে নুরজাহানের রূপসজ্জায় ছিল আর এতে সে এক ভারতীয় স্বেচ্ছাসেবী মহিলার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। প্রসাধন ছাড়া নাসিম বানুকে আমি যখন দু-তিনবার দেখলাম তখন মনে হল কোনো মহফিল বা মজলিসের জন্য নাসিম বানুর মতো মানানসই মহিলা আর হয় না। মজলিসের যে কোণেই নাসিম বানু বিরাজ করত রীতিমতো আলোকিত হয়ে উঠত সে কোণটা।
পোশাকপরিচ্ছদ এবং রং নির্বাচনের ব্যাপারে নাসিম বানু অনন্যসাধারণ ছিল। গোলাপি রংটা বড়ো মারাত্মক। এ রংটা মানুষের চোখে ধাঁধা লাগিয়ে দেয়। কিন্তু মানুষের চোখের সব রকম প্রতিকূলতাকে অগ্রাহ্য করে নাসিম সে রংটাই নিজের জন্যে বেশি পছন্দ করত।
নাসিমের প্রিয় পোশাক ছিল শাড়ি। ঘাগরাও পরত। কখনও শালোয়ার কামিজও পরত। নাসিমের কাছে বহু বছরের পুরোনো শাড়ির বিরাট সম্ভার মজুদ ছিল।
অন্যান্য মহিলাদের তুলনায় নাসিম অত্যন্ত পরিশ্রমী ছিল। স্বাস্থ্য এবং চেহারা ছিল একহারা। কিন্তু তা সত্ত্বেও বিস্তর পরিশ্রম করতে পারত। সারাক্ষণ সেটে বসে থাকত। এস মুখার্জিকে খুশি করা খুব সামান্য কথা ছিল না। অথচ তার সব রকম রিহার্সাল সে নীরবে পালন করত। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঝলসানো সার্চ আলোর সামনে ওঠাবসা করতে হত। কিন্তু তারপরও দেখতাম, নাসিম কোনো রকম পরিশ্রান্ত হয় না। আসলে ব্যাপার হল, নাসিম অভিনয় করাকে খুব ভালোবাসত। আমি সুটিং-এর পর রাসপ্রিন্ট দেখতাম– নাসিমের অভিনয় ভালোই লাগত। যেখানে তার অভিনয় ভালো লাগত না সেখানে দৈহিক চাকচিক্য ভালো লাগত। সবদিক দিয়ে বিচার করলে চল চলরে নওজোয়ানে’ নাসিম বানুর অভিনয় অনেকাংশে প্রশংসনীয় হয়েছিল।
মুখার্জি চেয়েছিলেন ছবিটার গতি চাঞ্চল্যপূর্ণ হোক। কিন্তু নাসিম স্বভাবতই ঠান্ডা মেজাজের বলে তা আর হল না।
ছবি রিলিজ হল। তাজ হোটেলে বিরাট পার্টি হল। পার্টিতে নাসিমকে অন্য রকম মনে হল। মনে হল, পর্দার নাসিমের সঙ্গে এর কোনো মিল নেই। যেন একজন মোগল শাহজাদী সেজেগুজে বসে আছে।
নাসিমের নানি কাশ্মীরি। অমৃতসরের এই মহিলাটির কাছ থেকেই সম্ভবত নাসিম পাঞ্জাবি শিখেছিল। তা ছাড়া মায়ের সঙ্গে দিল্লিতে বসবাস করত বলে উর্দুও জানত। ছোটোবেলায় কনভেন্টে পড়াশোনার ফলে ইংরেজিটাও বেমালুম আয়ত্ত করে নিয়েছিল। সংগীতে অল্পবিস্তর ব্যুৎপত্তি ছিল। সেটাও তার মায়ের দান। কিন্তু সে মায়ের মতো সুধাকণ্ঠী ছিল না। অনেক ছবিতেই সে তার নিজের মুখের নাকি গান নিজে গেয়েছে। কিন্তু তার গানে তেমন মাধুর্য নেই। সম্প্রতি গানের চর্চা সম্পূর্ণ বাদ দিয়েছে।
নাসিমের চারপাশে তার বন্ধুদের যে চক্র গড়ে উঠেছিল সেটা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। নাসিমের গোসলখানায় স্নান করার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। তার গোসলখানা দেখে আমি একেবারে নিরাশ হয়ে পড়লাম। আমি ভেবেছিলাম, না-জানি তার বাথরুম কত আধুনিক সামগ্রী দিয়ে সাজানো। বিদেশি নানা রকমারি সাবান, আরও কত কী? কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তার কিছুই না। একটা বিরাট বালতিতে মিলাদের ভারী পানি এবং একটা অ্যালুমিনিয়ামের মগ। ওই পানি এমনই ভারী যে, গায়ে সাবান মেখে যতই আপনি ঘষতে থাকুন না কেন, ফেনা হবে না।
কিন্তু নাসিমকে যখনই দেখতাম একেবারে সজীব সতেজ মনে হত। মাঝারি ধরনের হালকা প্রসাধন করত। গোলাবের পাপড়ির মতো মনে হত তার ত্বক।
হরেক রকম সেন্ট লাগানোতে তার জুড়ি ছিল না। তার কাছে, বহু দুষ্প্রাপ্য সেন্ট পাওয়া যেত। গহনাপত্রের বেলায়ও কারও চেয়ে কম যেত না সে। নিত্যনতুন গহনা পরত। কখনও হিরার কাকন, কখনও জড়োয়া চুড়ি আবার কখনও বা মোতির হার।
খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে সে অত্যন্ত সাদাসিধেভাবে চলত। প্রায়শই এহসানের অজীর্ণ এবং নাসিমের সর্দি লেগে থাকত। নাসিম কাঁচা মরিচ দিয়ে ভাত খেতে বসে যেত আর এহসান তার খাবার কেড়ে খেয়ে ফেলত। প্রায় প্রত্যেকদিনই খাবার সময় তাদের ঝগড়া হত। তাদের ঝগড়ার ধরন দেখলে মনে হত তাদের প্রেম কী ধরনের।
আমার স্ত্রী নাসিমকে একবার নিমন্ত্রণ করেছিল। সালুনে যে ঘি দেওয়া হয়েছিল তা নাকি বেশ ভালো ছিল। নাসিম খাবার টেবিলেই আমার স্ত্রীকে ধরে বসল, এ ঘি কোথায় পাওয়া যায় সে খবর দিতে। সাফিয়া বলল, এ ঘি তো হরদম বাজারে পাওয়া যায়। পলসনের ঘি।
তাহলে আমাকে দুটা টিন আনিয়ে দাও না।
আমি চাকরকে বললাম। সে কিছুক্ষণের মধ্যেই পাশের যে দোকানটিতে আমার হিসাবপত্র ছিল, সেখানে থেকে দুটো টিন নিয়ে এল। এরপর সে মোট গোটা আটেক নিয়েছিল। একদিন হঠাৎ সে আমাকে বলল, আপনার ঘিয়ের টিনের হিসাবটা তো করলেন না।
হিসাবের আবার কী দরকার পড়ল?
কিন্তু সে কথায় তাকে দমানো গেল না। টিনের দাম সে দেবেই। অবশেষে বাধ্য হয়ে আমি পুরো হিসাব দিলাম। নাসিম একটু চিন্তা করে বলল,
আপনি বলছেন আটটা। আমার তো মনে হয় সাতটা।
আমি একটু লজ্জিত হয়ে বললাম, হ্যাঁ, সাতটাই হবে তাহলে।
না, না, সাতটাই বা হবে কেন? তাহলে আটটাই।
এভাবে সাত এবং আট নিয়ে আমার অনিচ্ছা সত্ত্বেও বেশ কথাকাটাকাটি হল। শেষে নাসিম তার চাকরকে খালি টিনগুলো বের করে গুণে দেখতে হুকুম করল। চাকর বের করে দেখল সাতটাই। নাসিম বিজয়ীর ভঙ্গিতে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
এখন গুণে দেখুন তো।
হ্যাঁ, সাতটাই তো দেখছি।
এমন সময় চাকরটি বলল, বিবিজান, আসলে টিন আটটা ছিল। একটা ‘ভঙ্গল’ নিয়ে গেছে।
আমি প্রতি মাসে পাঁচশো টাকা পেতাম। প্রতি মাসে আমাকে পাই পাই হিসাব দিতে হত তাকে। কিন্তু তাতে কোনো রকম সাত আট এর হেরফের হয়নি।
স্বামী-স্ত্রী দুজনেই আমার কাজে সন্তুষ্ট ছিল। কিন্তু এহসান মাঝে-মাঝে আমার তিরিক্ষি মেজাজে রুষ্ট হয়ে উঠত। অবশ্য তা বাইরে তেমন প্রকাশ করত না।
মি. এহসান এমনিতে খুব দরাজ দিল ছিল। কিন্তু নাসিমের বেলায় সে যথার্থ সংকীর্ণ ছিল। বিশেষ বিশেষ কজন তোক ছাড়া নাসিমকে আর কারও সঙ্গে কথা বলতে দিত না। এমনিতে নাসিমও তেমন হইহুল্লোড় বা জমজমাট পার্টি পছন্দ করত না। কিন্তু একবার বাধ্য হয়ে তাকে এক উজ্জ্বল কাজে যোগ দিতে হয়েছিল। সেটা ছিল হোলির উৎসব। আলীগড় ইউনিভার্সিটিতে মুডপার্টির একটা ট্র্যাডিশন আছে। বোম্বের চিত্র-জগতের হোলি উৎসবের একটা ট্র্যাডিশন আছে। এটা প্রথমত বোম্বে টকিজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। পরে ফিল্মিস্থানে তা সংক্রমিত হয়।
ফিল্মিস্থানে ‘হোলি’ উৎসবের প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন এস মুখার্জি। মিসেস মুখার্জিও (অশোকের বোন) এ ব্যাপারে কম যেত না। সে ছিল মেয়েদের লিডার। হোলির দিনে আমি শাহেদ লতিফের বাড়িতে বসেছিলাম। শাহেদের স্ত্রী ইসমত চুঘতাই আর আমার স্ত্রী সাফিয়া কী কথা নিয়ে যেন বাড়িটা তোলপাড় করে তুলেছে। এমন সময় ওদের ওপর হোলির আক্রমণ হল। ইসমত আত্মরক্ষার জন্যে উঠে দাঁড়িয়ে এমন একটা ভাব করল যে, তার গায়ে যদি কেউ রং দেয় তাহলে ভালো হবে না কিন্তু। আনন্দের দিনে কে কার মুড দেখে। ইসমতের ভাবকে তিরোহিত হতে হল। এবং চোখের পলকে অন্যান্যদের মতো সেও রঙে লাতপাত হয়ে গেল।
আমি আর শাহেদ বাকি ছিলাম। কিন্তু কয়েকটা পিচকারির পর আমাদেরকেও আর চেনার উপায় ছিল না।
আমাদের মধ্যে যখন আর কেউ বাকি ছিল না, শাহেদ লতিফ দাঁড়িয়ে গিয়ে বলল, এবারে চলো নাসিম বানুর বাড়ি যাই।
রঙের পিচকারি নিয়ে হইহল্লা করে আমরা নাসিমের পোরবন্দর রোডের বাড়ির দিকে রওনা দিলাম। আমাদের হইহল্লা শুনে নাসিম এবং এহসান বেরিয়ে এল। নাসিমের পরনে হালকা রঙের জর্জেট শাড়ি ছিল। শাহেদ লতিফ রং ছিটাবার জন্যে পিচকারিতে হাত দিচ্ছিল, আমি বাধা দিয়ে বললাম, আগে ওকে কাপড় বদল করতে বলল। নাসিম একটু মুচকি হেসে বলল, কাপড় বদলাতে হবে?
একথা বলতে না বলতেই একাধিক পিচকারির নানা রঙে নাসিম একেবারে জবুথবু হয়ে গেল। নাসিমকে একটা রঙিন চিড়িয়ার মতো মনে হল তখন।
রং ছিটানোর পালা শেষ হতেই হাডুডু পর্ব শুরু হল। প্রথমে পুরুষরা তারপর মেয়েরা। হাডুডু খেলাটা জমেছিল বেশ। এস মুখার্জির মোটা বউ যখনই ধরাশায়ী হত অট্টহাসির রোল পড়ে যেত সবার মধ্যে। আমার স্ত্রীর চোখে রঙিন চশমা ছিল। এজন্যে সে একজনকে ধরতে গিয়ে আরেক জন ধরে বসত।
নাসিম বেশি দৌড়োদৗড়ি করতে পারত না। আসলে সে বোঝাতে চাইত যে, দৌড়োদৌড়িটা তার ধাতে সয় না। অবশ্য খেলাতে সে প্রচুর আনন্দ পাচ্ছিল।
নাসিম-দম্পতি আজব ধরনের ধর্মভীরু ছিল। পথে কোনো কাগজ পড়ে থাকলে সসম্ভ্রমে তুলে নিয়ে চুমা দিত। জ্যোতিষ শাস্ত্র, হাত গণনা এবং অদৃষ্টবাদ ইত্যাদিতে তাদের পুরোপুরি আস্থা ছিল। রেসের দিন তার অবস্থা দেখার মতো ছিল। একটা ভালো ঘোড়ার ওপর হয়তো সে টিকিট ধরে বসবে, এমন সময় সেখান দিয়ে একজন কানা লোক চলে গেল। ব্যস, তাহলে টিকিট ধরা তার ও পর্যন্তই। এরপর বাড়িতে এসে সব দোষ নাসিমের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে বলত, আসলে তুমিই সব অনিষ্টের মূল।
এমন দিন যেত না, যেদিন ওদের মধ্যে এটা ওটা নিয়ে ঝগড়া না হত।
নাসিমের সন্তান দুটো নানার কাছেই থাকত। তাদেরকে স্টুডিওর আবহাওয়ায় আসতে দিত না।
মৃত পিতার প্রতি গভীর অনুরাগ ছিল। তার ভ্যানিটি ব্যাগে সবসময় তার পিতার ফটো থাকত। আমার আবার চুরি করে মেয়েদের ব্যাগ দেখার অভ্যেসটা বরাবর ছিল। একদিন আমি চুরি করে তার ব্যাগ দেখছিলাম এমন সময় নাসিম এসে উপস্থিত হল। বললাম, ক্ষমা করবেন, এটা আমার একটা বাজে অভ্যেস। সুযোগ পেলেই আমি মেয়েদের ব্যাগ না দেখে পারি না। আচ্ছা এ ফটোটা কার?
কেন, এটা আমার আব্বার ফটো।
এমন ভঙ্গিতে বলল, যেন ছোটো একটা মেয়ে তার বাপ সম্পর্কে বলছে।
যাক আর একটা ঘটনা বলে আমি নাসিম পর্ব সমাপ্ত করছি।
‘বেগম’-এর কাহিনি লেখার সময় এস মুখার্জির সঙ্গে একটা দৃশ্য নিয়ে বচসা হতে অনেক রাত হয়ে গেল। রাত দুটো তখন। সাড়ে তিনটার একটা ট্রেন আছে। আমার সঙ্গে সাফিয়াও ছিল। আমরা যাবার জন্যে পা বাড়াতেই নাসিম বলল, এখন এটা যাবার সময় নাকি? এখানেই থেকে যাও।
আমি বললাম, কোনো অসুবিধা হবে না। কিছুক্ষণ প্ল্যাটফর্মে পায়চারি করতে করতে ট্রেন এসে পড়বে, তারপর দিব্যি আরামে বসে বাড়ি চলে যাব।
কিন্তু নাসিম এহসান দুজনই নাছোড়বান্দা হয়ে ধরল। বাধ্য হয়ে থেকে গেলাম। ততক্ষণে এস মুখার্জি চলে গেলেন। আমি বারান্দায় শুয়ে পড়লাম। এহসানও আমার কাছে একটা সোফার শুয়ে পড়ল।
সকালে নাস্তা করে আমরা বাড়ি রওনা দিলাম, সাফিয়া আমাকে ঘটনাটা বলল। সাফিয়া এবং নাসিম শোবার ঘরে ঢুকলে নাসিম বলল, তুমি শুয়ে পড়া।
বলেই পালঙ্কে একটা নতুন চাদর বিছিয়ে দিল। তারপর একটা নতুন স্লিপিং স্যুট বের করে নাসিম সাফিয়াকে বলল, এটা পরে নাও। একেবারে নতুন স্যুট।
সাফিয়া কাপড় বদল করে শুয়ে পড়ল। ওদিকে নাসিমও কাপড় বদল করে নিল এবং মুখের মেক-আপ ধুয়ে ফেলল। সাফিয়া তার মুখের দিকে তাকিয়ে আশ্চর্য হয়ে বলল, একী তোমার চেহারা নাসিম? তুমি দেখছি একেবারে শ্যামলা। অথচ…
নাসিম মুচকি হেসে বলল, এ শুধু প্রসাধনেরই কারসাজি, নইলে আমিও একটা বাজে মেয়ের মতোই তো।
মেক-আপ ধুয়ে ফেলে নানা ধরনের তেল মালিশ করল মুখে। তারপর অজু করে কোরান শরিফ পড়তে শুরু করে দিল সে। আমার স্ত্রীর মুখ থেকে অলক্ষে বেরিয়ে এল, হায় নাসিম, তুমি দেখছি আমাদের চেয়েও অনেক ভালো মেয়ে।
কোরান তেলাওয়াত করে নাসিম শুয়ে পড়ল।
বোম্বের পরিরানি, পুকারের নুরজাহান, এহসানের জীবনসঙ্গিনী, ছামিরান বাইর মেয়ে এবং দু-সন্তানের জননী নাসিম বানু।
***
৪। ‘জীবন-নাঈয়া’র পর দেবিকারানি-অশোককুমার জুটির পরের ছবিই ‘অচ্ছুত কন্যা’। বোম্বে টকিজেরই ছবি-পরিচালনা ফ্রাঞ্জ অস্টেন। মুক্তি পায় ১৯৩৬-এ। এরপর থেকে অশোক-দেবিকা হিন্দি সিনেমার সোনার জুটি হয়ে ওঠে।
৫। ‘পুকার’ উর্দু ছবি। মনরো মুভিটোন নয়। ওটা হবে মিনার্ভা মুভিটোন। ১৯৩৯-এ মুক্তি পাওয়া এই ছবিটিতে নাসিম বানুর বিপরীতে সম্রাট জাহাঙ্গিরের ভূমিকায় অভিনয় করেন চন্দ্রমোহন। মিনার্ভা মুভিটোনের মালিক ছিলেন সোহরাব মোদী ও তার ভাই রুস্তম।