ছায়া রহস্য
সেটা ছিল লাল রোদের একটি দুপুর। সামনের বাড়ির পামগাছের ডালে বসে একটি চিল অনেকক্ষণ ধরে ডাকছে। ক’দিন থেকেই লক্ষ করছি চিলটা সেখানে বাসা বাঁধার চেষ্টা করছে। আমি মাঝে মাঝে বাইনোকুলার দিয়ে চিলটাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখার চেষ্টা করছি। ঘাড়ের কাছে খয়েরি পালকের পাশে কিছু শাদা পালকও দেখি। কিছুদিন আগে আমি এ শহরের একমাত্র পাখি দেখার ক্লাবের সদস্য হয়েছি। কাক, চিল এবং চড়ই সম্পর্কে একটি বেশ বড় প্রবন্ধ লিখেছি। ক্লাবের মাসিক সভাতে সেটি পড়ব। পাখিগুলোর কিছু রঙিন স্লাইডও দেখাব। পত্রিকায় একটি চমৎকার খবর বেরিয়েছে। আমেরিকার একটি তিমি রক্ষাকারী সমিতি ১২০ ফুট লম্বা প্লাস্টিকের তিমির মডেলে বাতাস ভরে ভাসিয়ে দিয়েছে। নাম তার ফ্লো। ফ্লো এখন আমেরিকার বিভিন্ন শহরের উপর দিয়ে ভেসে যাচ্ছে। অনেকেই দেখছে সেই ভাসমান তিমিকে। তার গায়ে বড় বড় করে লেখা, ‘আমাদের তোমরা আর হত্যা করো না। আমরা বেঁচে থাকতে চাই।’ এই দশকে তিমি শিকার খুব বেড়ে গেছে। গোপনে বিভিন্ন সমুদ্রে দেদার তিমি হত্যা চলছে। এই হত্যালীলার হাত থেকে বাচ্চা তিমিরাও এখন আর রেহাই পাচ্ছে না। দুরন্ত সমুদ্রের বুক তাদের রক্তেও লাল হয়ে যাচ্ছে। হারপুন বিঁধে তাদের শরীরও ঝটপটিয়ে ওঠছে। শিকারিদের লোভ তিমির বিশাল চর্বির ভাণ্ডারের দিকে। তিমির শরীর যেন একটি পুরো কারখানা। তিমির হাড়ও অনেক কাজে লাগে। রহস্যময় শাদা তিমি মবিডিকের গল্প পড়েছিলাম। প্রাণিবিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন এভাবে নির্বিচারে তিমি হত্যা চলতে থাকলে প্রাণিটি ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
এমনি করে কত প্রাণি পৃথিবীর বুক থেকে হারিয়ে গেছে। মরিশাস দ্বীপের ডোডো পাখি, নিউজিল্যান্ডের মোয়া পাখি, ক্যারিবিয়ানের কোনো কোনো দ্বীপের নেনে নামের এক জাতের হাঁস। সেই বাতাসভর্তি প্লাস্টিকের তিমি নাকি চেরী ফুলের আর, ফুজিয়ামার দেশ জাপানে। সেই দেশে একটি বিরাট সমাবেশ হবে তিমি রক্ষা সমিতির সদস্যদের। কিভাবে প্রাণিটিকে নিষ্ঠুর শিকারিদের হাত থেকে, লোভী ব্যবসায়ীদের হাত থেকে রক্ষা করা যায় তার আলোচনা চলবে। আমি যখন এই খবরটি পড়ছি তখন দরজায় ঠক ঠক শব্দ। কে এলো এই ভর দুপুরে। দরজা খুলতেই দেখি পিয়ন। হাতে চিঠি।
আমি দেখলাম লম্বা খামের উপর থোকা থোকা চেরী ফুল আর ফুজি পাহাড়ের ছবির ঝকঝকে ডাকটিকিট। বাহ্, অদ্ভুত মিলে গেল তো ব্যাপারটি। সত্যি, মাঝে মাঝে এমন সব ঘটনার মিল হয়ে যায় যে রীতিমতো অবাক হয়ে যেতে হয়। টোকিও থেকে এক কোম্পানি লিখেছে বাংলাদেশের উপজাতীয়দের উপর একটি প্রামাণ্য ভিডিও তুলতে কিছুদিনের মাঝেই একটি দল আসছে। আমি যেন তাদের সাথে সবরকমের সহযোগিতা করি।
বছর কয়েক আগে একটি জাপানি টিভি দলের সাথে সুন্দরবনে কাজ করেছিলাম। ওরা এসেছিল পৃথিবীর সবচাইতে বড় ম্যানগ্রোভ অরণ্য সুন্দরবনের উপর তথ্যচিত্র তুলতে। সেই থেকে যোগাযোগ। বাওয়ালিরা কিভাবে বনবিবিকে নিয়ে উৎসব করে। কিভাবে পাখিদের বলি দেয়, মউলরা কিভাবে সুন্দরী গাছের ডালে ঝুলে থাকা মৌচাক থেকে মধু সংগ্রহ করে সেসব দৃশ্য তোলার জন্যে আমি তাদের সাহায্য করেছিলাম। পরিচালক হানোদা আমাকে খুশি হয়ে একটি চমৎকার জাপানি আকাই টেপরেকর্ডার উপহার দিয়েছিলেন। আমি তাতে সুন্দরবনের অনেক ধরনের রহস্যময় শব্দ রেকর্ড করে রেখেছিলাম। শীতের সময়ে পাতা ঝরার শব্দ। হরিণের বাচ্চার টিউ টিউ করুণ ডাক। ছবি তোলার সেসব দিনগুলো ছিল যথেষ্ট উত্তেজনাময়। নদীর বুক দিয়ে চলেছে আমাদের লঞ্চ। মাছ ধরার নৌকো যাচ্ছে। কত রকমের মাছ। চান্দা, ভেটকি, পায়রাতলি, কাইন, গলদা, নোনা চিংড়ি। গলদার লাল মগজ গরম ভাতের সাথে মাখিয়ে খেতে সে কি স্বাদ। কোথায় লাগে তার কাছে শহরের খাবার। চরপাটা দিয়ে জেলেরা মাছ ধরছে। ওদের কালো শরীর। বাঁশের শলা দিয়ে পাটা তৈরি হয়। বহুদূরের এলাকা থেকে লোকেরা মাছ ধরতে আসে সুন্দরবনে। জালিয়ার চরে মৌসুমি বসতি করে। হোগলা পাতার ঝুপড়ি বানিয়ে থাকে। আমরা জালিয়ার চরে শুটিং করেছিলাম। রাশি রাশি মাছ টাঙিয়ে রাখা হয়েছে। চরের বালুমাটিতে কোথাও সবুজ পাতা। পাতার নিচে তরমুজ। রঙিন ছবিতে খুব চমৎকার এসেছিল। জাপানি টিভি দলটি শুধু রয়েল বেঙ্গল টাইগারের সন্ধান করত।
কোথায় পাবে বাঘের দেখা। নদীর একপাশে ভিজে মাটিতে একবার বাঘের পায়ের ছাপ দেখা গেল। সেই ছাপের ছবি ক্যামেরায় বিগ ক্লোজ আপে তোলা হলো। মাঝে মাঝে বনের ভেতর দিয়ে ছুটে যায় হরিণের পাল। তাদের ছবি তোলা হয় টেলিলেন্সের সাহায্যে। ভাটি এলাকায় আছে পাখির বাতান। সেখানে গাছের মাথায় এসে থাকে রকমারি পাখি। কুড়া, বক, বিল বাগচু। সূর্য ডোবার পর খাবারের খোঁজে এই পাখিরা বিলের বুকে ঝপাৎ করে নামে।
একটি কষাড় ঝোপের কাছে দেখেছিলাম একজন মানুষের বাঘে খাওয়া শরীরের কিছু অংশ। মাছি ভিনভিন করছে। সেটার ছবি তুলল হানোদা। তারপর দেখেছিলাম সেই শবদেহটিকে পাশে ফেলেই অন্য বাওয়ালিরা কাঠ কাটতে, মধু সংগ্রহ করতে বনের ভেতরে এগিয়ে যাচ্ছে। জীবিকার তাগিদে ওরা ওখান থেকে পালাতে পারে না। হানোদা এক সন্ধেবেলায় লঞ্চের রেলিংয়ে হেলান দিয়ে গম্ভীর গলায় আমাকে বলেছিল, বেঁচে থাকার জন্যে কত কষ্ট করে এখানকার লোক। শুধু কিছু ভাত, নুন আর মাছের জন্যে।
চিঠিটা হাতে নিয়ে সেসব কথা ভাবছিলাম। আবার কিছু কাজ করতে পারব ভেবে ভালো লাগছিল।
নির্ধারিত দিনেই জাপানি টিভি দলটি এলো। চার জনের দল। পরিচালক একজন তরুণ। নাম মিসুমিসু। হানোদার প্রিয় ছাত্র। হানোদা তার কাছে নাকি আমার কথা বলেছে। ওরা এসেই চটপট করে কাজের পরিকল্পনা করে ফেলল। সময় নষ্ট করতে মোটেই তারা রাজি নয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে বছরের এ সময় তাপমাত্রা কি রকম থাকে সেসব তথ্য ওরা নিজ দেশে থাকতেই সংগ্রহ করেছে। এত গুছিয়ে কাজ করে জাপানিরা যে কোনো রকমের অসুবিধে অনুভবই করা যায় না। ঠিক হলো প্রথমে যাওয়া হবে বান্দরবানে। খুমি আর মুরংদের জীবনযাত্রার ওপর ছবি তুলতে। আমি দেখলাম ওরা আমাদের দেশের উপজাতীয়দের সম্পর্কে অনেক তথ্য যোগাড় করেছে। মিসুমিসুর সাথে খুব ভাব হয়ে গেল আমার। জাপানের একটি টেলিভিশন কোম্পানির সদস্য হয়ে সে ব্রাজিলের গভীর অরণ্যে ছবি তুলে এসেছে গত বছর। সেটা নাকি দারুন রহস্যময় এক জায়গা। একদল জংলির সন্ধান পেয়েছিল যারা শুধু পিঁপড়ে আর উইপোকা খায়। কোনোদিন পানির কাছে যায় নি। সমস্ত শরীরে উলকি আঁকা। মিসুমিসুর ইচ্ছে আছে বিভিন্ন দেশের উপজাতীয়দের ঘুমপাড়ানি গান নিয়ে একটি ছবি করার।
আমি দেখেছি বিভিন্ন দেশের ঘুমপাড়ানি সুরের মাঝে, কথার মাঝে এক ধরনের চমৎকার মিল রয়েছে। আফ্রিকার জুলু জাতির মা হয়তো তার ছেলেকে ঘুম পাড়াবার সময় ঘুমপাড়ানি মাসিকে লোভ দেখাচ্ছে বাইসনের মাংশ দেবে বলে আর তোমাদের দেশে বলছে কাজলি গরুর দুধ দেবে। ল্যাপল্যাণ্ডের মায়েরা বলছে বলগা হরিণের বুটি বুটি ছাল দেবে।
মিসুমিসুর সাথে কথা বলে আমার চমৎকার লাগল। এ ধরনের লোকদের সাথে কথা বললে কাজ করায় বেশ উৎসাহ পাওয়া যায়। মনে হয় এ্যাডভেঞ্চারে চলে যাই। কোন অরণ্যে কিংবা পাহাড়ে। যেখানে লুকিয়ে আছে গভীর রহস্য। মিসুমিসুর এক ভাই হোক্কাইডোর কাছে একটি দ্বীপে শ্যাওলার চাষ করছে। শ্যাওলা থেকে চমৎকার সব খাবার প্রস্তুত করা যায়। আগামী বছর হোক্কাইডোতে ওরা একটি অদ্ভুত রেস্তোরা খুলবে। সেখানকার মেনুতে থাকবে আশ্চর্য ধরনের কিছু খাবার। জাপানের বুনো তিতিরের কলজের স্যুপ, শ্যাওলার সালাদ, তাতানি মাছের ডিমের সাথে পায়রার বুকের নরোম মাংশের ভাজি। নানারকমের বনজ লতাপাতা দিয়ে ওরা খাবার তৈরি করবে। রেস্তোরাঁটিতে থাকবে প্রাচীন ধরনের পরিবেশ। গাছের গুড়ি কেটে বানানো হবে বসার জায়গা। গানের পরিবর্তে সেখানে বাজবে বিভিন্ন পশু পাখির ডাকের ক্যাসেট। মিসুমিসু তাদের সেই ভবিষ্যতের রেস্তোরাঁতে যাওয়ার জন্যে আমাকে আমন্ত্রণ জানালো।
পরদিন আমরা রওয়ানা দিলাম বান্দরবানের দিকে। পাহাড়ি পথ। কোথাও জুম চাষ হচ্ছে। জঙ্গল পোড়ানো হচ্ছে। এক জায়গায় দেখলাম শসা আর ঢেঁড়সের বাগান। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাঁশের ঘর। কাঠের খুঁটির উপর ঘরগুলো। মাটি থেকে পাঁচ-ছয় ফুট উঁচুতে। বান্দরবনের রাজবাড়ি থেকে একটি জিপ সংগ্রহ করলাম। যেতে হবে থানছি থানাতে। সবটা পথ আবার জিপে যাওয়া যাবে না। ওখানেই পাহাড়ের চূড়াতে ঘর বানিয়ে থাকে খুমিরা।
দু’পাশের অপরিচিতি গাছপালা আর পাখি দেখে জাপানি দলটি বেশ উল্লসিত। মাঝে মাঝে থেমে কিছু শূটিং করছি। খুমিরা গাছের ডালে ঘর বানায়। আমার মনে হচ্ছিল সুইস ফ্যামিলি রবিনসনের কথা। কিভাবে জাহাজডুবির পর নির্জন দ্বীপে একটি পরিবার গাছে বাসা বানিয়েছিল। খুমিদের গ্রামের চারদিকে পরিখা। সহজে যাওয়া যায় না। ওরা বেশ বিছিন্নভাবে থাকে। আমরা বান্দরবানের রাজবাড়ির একজন সদস্যকে গাইড হিশেবে সাথে করে নিয়ে গিয়েছিলাম।
খুমিদের গ্রাম প্রধানের সাথে কথা বলে ছবি তোলার অনুমতি পাওয়া গেল। আমরা একটি খোলা জায়গায় তাঁবু বাঁধলাম। মিসুমিসুর উৎসাহ ওদের বিভিন্ন উৎসবের ছবি তোলার। একটি উৎসব হলো ‘ছাগল হত্যা’। গ্রাম প্রধানের শপথ নেবার দিন উৎসব করে। অদ্ভুত সুরে বাজনা বেজে উঠল। খুমিরা উঠোনের চারদিকে গোল হয়ে বসে। কয়েকজন লোক একটি ছাগলের পায়ে দড়ি বেঁধে বিভিন্ন দিক থেকে টানতে লাগল। এমনি করতে করতে এক সময় ক্লান্ত হয়ে গেল ছাগলটি। তখন উঠে দাঁড়াল খুমি প্রধান। টকটকে লাল চোখ তার। হাতে ধারালো অস্ত্র। এক কোপে ছাগলটিকে হত্যা করে। ফিনকি দিয়ে রক্ত ছোটে। সেই রক্তে হাত ভিজিয়ে শপথ নেয় খুমিরা। তারা অনুগত থাকবে। সারা জীবন অনুগত থাকবে গ্রাম প্রধানের কাছে।
হত্যা করা ছাগলটির মাংশ তখন কেটে সবার মাঝে ভাগ করে দেয়া হয়। রক্তমাখা মাংশ রান্না হবে। ভোজ হবে। সবাই পেটপুরে খাবে। পোষা কুকুরের দিকেও মাংশের টুকরো ছুঁড়ে দেবে।
এ ধরনের আরেকটি উৎসবের শুটিং করেছিলাম মুরংদের গ্রামে। উৎসবটির নাম হলো ‘নস্যাৎ পা’। জুম চাষের সময় একটি ষাঁড়ের বাচ্চাকে এক জায়গায় ঘেরাও করে আটকে রাখে। তারপর মুরং নারী পুরুষরা নাচতে নাচতে বাঁশের চোখা শলাকা দিয়ে সেই ষাঁড়কে আঘাত করতে থাকে।
তখন মুরংদের খুব নিষ্ঠুর মনে হয়। একটানা বাজনা বাজে। ডিডিং ডং ডিডিং ডং। এমনি আঘাতে আঘাতে কাবু হয়ে যায় ষাঁড়টি। যেই ষাঁড়টি মারা যায় অমনি তার মাংশ কেটে নেয় সবাই। আগুনে ঝলসে খায়।
সেদিন সারাদিন শুটিং করে আমরা ক্লান্ত। সাথে বাবুর্চি এনেছি। চমৎকার রান্না করে। কচি বাঁশের ভেতরে চাল ভরে সেদ্ধ করে সেই ভাত খেতে খুব মজা। কেমন মিষ্টি একধরনের গন্ধ। কিছু বনমুরগিও আনা হয়েছে। শেষ বিকেলের দিকে আমি আর মিসুমিসু একটু হাঁটতে বেরুলাম। লোকালয় ছেড়ে গেলেই কেমন নিঝুম লাগে পরিবেশ। মনে হয় কোথাও যেন কোনো শব্দ নেই। একটি অদ্ভুত আকৃতির পাহাড় দেখে আমরা কৌতূহলী হই।
বুনো গাছপালায় জায়গাটি ঠাসা। তার মাঝে পাহাড়ের একটি গুহামুখ দেখা যাচ্ছে। ছমছমে অন্ধকার। একটা বড় আকারের গিরগিটি সাঁৎ করে এক ঝোপ থেকে অন্য ঝোপে চলে গেল। আমি চমকে যাই। গুহাটাকে কেমন রহস্যময় মনে হতে থাকে। আমি মিসুমিসুকে চলে আসতে বলি। সে নাছোড়বান্দা। আমরা শেষ বিকেলের আলোতে গুহার সামনে এসে দাঁড়াই। নিচে আরেকটি গুহা দেখা যাচ্ছে। পাহাড়ের ফাটল দিয়ে ম্লান আলো যেন সেই গুহার ভেতরে চুইয়ে নামছে। চারপাশে কোনো শব্দ নেই। হঠাৎ মিসুমিসু চমকে আমার হাত ধরে। আমি সাথে সাথে তাকাই। নিচের গুহাটিতে আবছা অন্ধকার। একটি লোকের ছায়ামূর্তি দেখা যাচ্ছে যেন। লোকটি কেমন কুঁজো হয়ে থপথপিয়ে হাঁটছে। যেন আদিম যুগের এক মানুষ। হাতে একটি পাথরের অস্ত্রের মতো কি যেন দেখা যাচ্ছে। লোকটির কাঁধে ওটা কি? বাইসনের মৃতদেহ। আশ্চর্য, এই জঙ্গলে বাইসন আসল কোত্থেকে? আমরা কি তাহলে ভুল দেখছি। কে এই লোক! আস্তে আস্তে লোকটির মূর্তি যেন বাতাসের মাঝে মিলিয়ে যায়। সেই দৃশ্য দেখে আমার কেমন শীত শীত করতে থাকে। মিসুমিসুও কেমন চুপ হয়ে যায়। আমরা দু’জন মুরং পাড়ায় হেঁটে আসি। আমাদের মাথায় শেষ বিকেলের সেই গুহার আবছা অন্ধকারের দৃশ্যটি দপদপ করতে থাকে।
পরদিন খুব সকাল হতেই আমি আর মিসুমিসু সেই গুহার দিকে রওনা দেই। ফকফকে আলো চারদিকে। উজ্জ্বল আলো থাকলে ভয় কম লাগে। পাহাড়ের ঢালু বেয়ে নামতে আমাদের খুব কষ্ট হয়। বুনো গাছের কাটায় শরীরের অনেকটা অংশ ছিড়ে যায়। শক্ত লতা ধরে আমরা নেমে যাই। আমার তখন টারজানের ছবির কথা মনে হয়। লাল মুখের কয়েকটা বাঁদর কিচকিচ করে এক ডাল থেকে অন্য ডালে লাফাতে থাকে।
পায়ের নিচে লম্বা ছনঘাস। সরসর শব্দ হচ্ছে। এক জায়গায় দেখি কয়েকটি পাখির কঙ্কাল পড়ে আছে।
সামনেই সেই গুহামুখ। ভেতরে থিকথিকে অন্ধকার। একটা বড় বাজপাখি মাথার উপর দিয়ে চক্কর মারতে মারতে উড়ে গেল। উপরের দিকে তাকাই। গতকাল বিকেলে যেখানটায় আমরা দাঁড়িয়ে দৃশ্যটা দেখছিলাম সে জায়গাটিকে চিনতে পারি। আমরা আস্তে আস্তে গুহার ভেতরে প্রবেশ করি। গতকালের দেখা সেই লোকটির আস্তানা এটা। ভেতরে ঢুকে আমরা টর্চ জ্বালাই। এক ধরনের ভ্যাপসা গন্ধ। গুহাটি বেশ পরিষ্কার। আমরা এদিক ওদিকে তাকাই। কোথাও সেই মৃত বাইসনটা নেই। কোনো লোকের থাকার কোনোরকমের চিহ্ন নেই। এই গুহাতে যে কেউ বহু বছর ধরে বাস করে না এ ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত হই। তবে গতকাল শেষ বিকেলে আবছা অন্ধকারে আমরা কাকে দেখেছিলাম! মিসুমিসুকে খুব চিন্তিত মনে হয়। কি যেন গভীরভাবে ভাবছে। গুহার ভেতরে পায়চারি করছে।
তুমি ঠিক জানো এই জঙ্গলে বাইসন পাওয়া যায় না? মিসুমিসু আমাকে প্রশ্ন করে।
-মোটেই পাওয়া যায় না। তবে কয়েক হাজার বছর আগে নাকি এদেশে বাইসন পাওয়া যেত। বইতে পড়েছি। এমনকি নোয়াখালীর বিভিন্ন চরে, দ্বীপ হাতিয়াতে, সন্দ্বীপের ঘাসের বনে বাইসন চরতো বলে জানা গেছে।
মিসুমিসুর মুখটাকে একটু উজ্জ্বল মনে হয়। যেন রহস্যের কালো পর্দাটির মাঝে একটুখানি আলো পেয়েছে।
-তোমাদের এই অঞ্চলে কবে থেকে মানুষ বাস করছে?
-নতুন পাথরের যুগ থেকে। সীতাকুণ্ডের পাহাড়ের কাছে নতুন পাথরের যুগের বেশ কিছু অস্ত্রশস্ত্র পাওয়া গেছে বছর কয়েক আগে। সেগুলো ঢাকা মিউজিয়ামে রাখা আছে। মিসুমিসুকে এবার বেশ গম্ভীর দেখায়।
গতকাল বিকেলে আমরা যে বাইসন শিকারিকে এই গুহাতে দেখেছি সে এ যুগের নয়। সে নতুন পাথরের যুগের মানুষ।
-মানে?
-আর আমরা কোনো আসল লোককে দেখি নি। চার হাজার বছর আগের ছায়াকে দেখেছি।
সেই কথা শুনে আমার আবার কেমন শীত শীত করতে থাকে। ঠিক এ ধরনের একটি ব্যাপার ব্রাজিলের জঙ্গলের এক পাহাড়ের গুহাতেও দেখেছিলাম। তারপর দেশে ফিরে কয়েকজন বৈজ্ঞানিকের সাথে আলাপ করি। তারা আমাকে নতুন এক রহস্যের সন্ধান দেয়। ব্যাপারটা অনেকটা এ রকম, একটি মানুষ এক জায়গায় কিছুক্ষণ থেকে উঠে গেলেও তার অবয়বের ছায়াটি সেখানে কিছুক্ষণের জন্যে থাকে। যেটা ঠিক খালি চোখে দেখা যায় না। বিশেষ উত্তাপের সাহায্যে সে ছায়া অবয়বের কাঠামোকে দেখা যায়। রাশিয়াতে বর্তমানে এই পদ্ধতি প্রয়োগ করে চলচ্চিত্র তৈরি হচ্ছে। এর নাম হলোগ্রাফি পদ্ধতি। হাজার বছর আগে নতুন পাথরের যুগের সময় এই গুহাটিতে সেই বাইসন শিকারি বাস করত। সে হয়তো এক বিকেলে জঙ্গল থেকে একটি বাইসনকে হত্যা করে কাঁধে ফেলে তার সেই গুহাতে ফিরে এসেছিল। তার সেই দিনের ছায়ার ভিডিও ইমেজ যেকোনো ভাবেই হোক গুহার আবছা অন্ধকারে বন্দী হয়ে আছে। গুহাতে সেই বিশেষ এক ধরনের উত্তাপ সৃষ্টি হলেই সেই ছায়ামূর্তি ধীরে ধীরে ফুঠে ওঠে। আমরা গতকাল সেই বাইসন শিকারির সচল ছায়াকেই দেখেছি। এ এক রহস্য।
আমি আর মিসুমিসু গুহার আবছা অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এলাম। মিসুমিসু শুধু বলল, কত অদৃশ্য ছবি আমাদের চারপাশে মিশে আছে। যদি সেগুলো দেখতে পারতাম।
কয়েকটা হলুদ পাখি ডানায় রোদ মেখে সামনের ঝোপ থেকে হঠাৎ উড়াল দিল।