দানব পাখি
আমাদের পারিবারিক ব্যবসা হচ্ছে গাছপালার চারা বিক্রি। দুষ্প্রাপ্য গাছের সরবরাহকারী হিসেবে শহরে আমাদের যথেষ্ট সুনাম রয়েছে। বনে, পাহাড়ে ঘুরে বিভিন্ন ধরনের ফুলগাছ আমরা সংগ্রহ করি। আমাদের কাছে অর্কিডের চমৎকার সংগ্রহ রয়েছে। সেবার আমরা বুনো অর্কিডের একটি ছোট প্রদর্শনীর আয়োজন করেছি। শহরের অর্কিড সংগ্রহকারীদের অনেকেই এসেছিলেন। বিভিন্ন দুর্গম স্থান থেকে এই অর্কিডগুলো সংগ্রহ করেছি আমরা।
দুপুরের দিকে লোকজন তেমন নেই। আমি বসে আছি। দরজা ঠেলে একজন রুক্ষ চেহারার লোক ঢোকে। এ ধরনের লোক সাধারণত ফুল গাছ কেনে না। চারদিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকায় লোকটি। ঘরের ভিতরে বনজ লতাপাতার এক ধরনের ঝাঁজালো গন্ধ।
-এটা কি বুনো অর্কিড?
-হাঁ।
-এটা নিশ্চয়ই সাইপ্রিপেডিয়াম প্রজাতির।
লোকটি তাহলে অর্কিড ভালোভাবে চেনে। বিভিন্ন প্রজাতির খবর রাখে।
-আপনারা নিশ্চয় এ জাতের অর্কিড সূর্যমুখী দ্বীপ থেকে সংগ্রহ করেছেন?
এবার আমার অবাক হওয়ার পালা। আসলেই এ ধরনের অর্কিড শুধু ঐ দ্বীপটিতে দেখতে পাওয়া যায়। এ খবর তো সবার জানার কথা না। আমি লোকটির দিকে কৌতূহলী হয়ে তাকাই। তার মুখের ডান দিকে একটি বড় কাটা দাগ। নিষ্ঠুর প্রকৃতির চেহারা।
-বুঝলেন, ঐ দ্বীপে আমি গিয়েছিলাম সাতাশ বছর আগে। আমার শখ ছিল দ্বীপ থেকে দ্বীপে ঘুরে বেড়ানো। অনেক দ্বীপে গেছি। ইস্ট ইন্ডিজ, ক্যারিবিয়ান, মাদাগাসকার। অনেক ধরনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে। সবচাইতে রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতাটি হলো একবার একটা দানব পাখির উরুর হাড় এনেছিলাম।
-দানব পাখি! যাদের কথা রূপকথায় দেখতে পাওয়া যায়। সিন্দাবাদের কাহিনিতে আছে বিশাল রক পাখির কথা।
-আছে। সিন্দাবাদ নাবিক তার দ্বিতীয়বারের সমুদ্রযাত্রায় একটি দ্বীপে নেমেছিলেন। ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ তার চোখে পড়ল বিশাল একটি সাদা গম্বুজ। মসৃণ। সেটা আসলে ছিল রক পাখির ডিম। মার্কো পোলোর ভ্রমণ কাহিনিতে আছে মাদাগাসকারের লোকেরা বলে বছরের বিশেষ এক মৌসুমে দক্ষিণ দিক থেকে সেই দ্বীপে উড়ে আসে বিশাল এক পাখি।
-আপনি কি সেই রহস্যময় দানব পাখির কথা বলছেন?
-প্রাচীনকালের পাখি। নাম ইপাইওরানিস। চার পাঁচ’শ বছর আগে ঐ ধরনের পাখিদের দেখতে পাওয়া যেত। যেমন মরিশাস দ্বীপের ডোডো। নিউজিল্যান্ডের মোয়া। ঐ দানব পাখিরা একসময় অবলুপ্ত হয়ে গেল পৃথিবীর বুক থেকে। আমি ঐ পাখির উরুর একটি হাড় আনতে পেরেছিলাম।
লোকটি কেমন রহস্যময় হাসি হাসছে। আমার মনে হলো লোকটি এর বাইরে আরো কিছু জানে।
-শুধুই কি হাড়?
আসলে গিয়েছিলাম ঐ পাখির ডিম খুঁজতে। তার পরেই তো ঘটল বিপত্তি।
-ব্যাপারটা কী হয়েছিল বলুন তো?
আমাকে আগ্রহী শ্রোতা পেয়েছে লোকটি। সামনের চেয়ারটায় বসে।
-শুনেছিলাম ধূসর জলাভূমিতে নাকি পাওয়া যায় দানব পাখির ডিম। খুব দুর্গম এলাকা। সেখানে যেতে ভীষণ কষ্ট। আস্তাননারিভো থেকে আরো প্রায় নব্বই মাইল উত্তরে ছিল ঐ জলাভূমিটা। পূর্ব উপকূলের জলা। সেখানকার পানির একটা অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য রয়েছে। সেখানে কোনো কিছু পচে যায় না। তবে পানিতে রয়েছে বাজে, উৎকট একটা গন্ধ। একদম আলকাতরার মতো গন্ধ। ওখানেই পেয়েছিলাম ডিমগুলো। এক একটা ডিম দেড় ফুটের মতো লম্বা।
আমার সাথে মাত্র দু’জন আদিবাসী ছিল। সহজে সেখানে কেউ যেতে চায় না। আদিবাসীদের কাছে জায়গাটি হলো প্রেতভূমি। ডাইনিদের আস্তানা। প্রচুর টাকার লোভ দেখিয়ে ওদের নিয়ে গিয়েছিলাম। আমাদের সাথে ছিল মাত্র কয়েক দিনের খাবার আর
তাবু।
এক সময় আমরা পৌঁছলাম ঐ দুর্গম জায়গাটিতে। চারদিকে থিকথিকে কাদা। মোটামুটি শক্ত দেখে একটা জায়গা খুঁজে বের করে তাঁবু খাটালাম। চারপাশে কেমন আঁশটে একটা গন্ধ। ঐ গন্ধে সারা গা যেন গুলিয়ে যায়। আমরা সাথে করে লোহার শিক নিয়ে গিয়েছিলাম। কাজ হলো ঐ শিক দিয়ে কাদা খোচানো। এভাবেই হবে ডিম খোঁজা।
আদিবাসীদের কাছে শুনলাম এক সময় দ্বীপে দানব পাখিরা পাখা ঝাপটে বেড়াত। তাদের নিয়ে অনেক গল্প, গান রয়েছে। তারা পূর্বপুরুষের কাছে শুনেছে এই বিশাল পাখিদের কথা। কিন্তু তারা কেউ এ পাখি দেখে নি।
আমাদের কাছে তথ্য ছিল ১৭৪৫ সালে ম্যাকার নামে একজন ধর্মযাজক মাদাগাসকার দ্বীপে এই রহস্যময় ইপাইওরানিস পাখিদের শেষ জীবিত অবস্থায় দেখেছিলেন। তাঁর ভ্রমণ কাহিনিতে এর উল্লেখ রয়েছে।
কাদা খোঁচাতে খোঁচাতে একদিন আমরা সেখানে পেয়ে গেলাম ডিম। একটা ডিম পাথরের ওপর পড়ে ফেটে গেল। আশ্চর্য, ডিমটার ভেতর থেকে টাটকা গন্ধ পেলাম। অথচ এ ডিমগুলো চার পাঁচশ বছরের পুরানো। অবশ্য ঐ জলাভূমির পানির বৈশিষ্ট্য হলো ওখানে আবার কোনো কিছু পচে যায় না।
ডিমটা ভেঙেছিল এক আদিবাসী। আমার প্রচণ্ড রাগ হলো। কত কষ্ট করে এসেছি এখানে। মূল্যবান ডিম। সাবধানে রাখবে না। আমি রেগে গিয়ে আদিবাসীটাকে আঘাত করলাম। ওরা দুজন চাপা রাগে ফুঁসতে লাগল। ওরা যে আমার ওপর শোধ নেবার পরিকল্পনা করছে তা তখন বুঝতে পারিনি।
সন্ধের বেলায় তাঁবুর সামনে বসে সূর্যাস্ত দেখছি। ধূসর পাহাড়ের ছায়া পড়েছে জলাভূমিতে। হঠাৎ ঝপাত শব্দ শুনে দেখি দুই আদিবাসী ক্যানন নৌকা পানিতে ভাসিয়ে দিয়েছে। এর মানে আমাকে এখানে একলা রেখে ওরা পালিয়ে যাবে। কি ভয়ানক অকৃতজ্ঞ। পকেট থেকে পিস্তল বের করলাম। চিৎকার করে বললাম ওদের ফিরে আসতে। ওরা আমার কথাকে কোনো পাত্তাই দিল না। গুলি করলাম। একজন ঝপ করে পানিতে পড়ল। অন্যজন নৌকোর খোলে মুখ গুজে শুয়ে পড়ল। ক্যানোটা ভেসে চলে যাচ্ছে আমার নাগালের বাইরে। এখানে একাকী থাকলে আমার মৃত্যু ঘটবে। আমি ছুরি দাঁতে আকড়ে পানিতে ঝাপ দিলাম। যে করেই হোক ক্যানোটাকে আটকাতে হবে। চারপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার। মাঝে মাঝে ঢেউয়ে ঐ মাথাগুলো ফসফরাসের আলোতে জ্বলে উঠেছে। আমি নিঃশব্দে সাঁতার কেটে এগিয়ে যেতে লাগলাম। ক্যানোটাকে দেখা যাচ্ছে। একসময় নৌকোর কাছে এসে পড়লাম। আদিবাসীটার কোনো সাড়াশব্দ নেই। ক্যানো ধরে উঠলাম। খোলের উপর আদিবাসীর নিথর শরীর পড়ে আছে। গুলি ঠিকই লেগেছিল। লাশটাকে পানিতে ফেলে দিলাম।
নৌকো ভেসে চলে অজানার পানে। ক্লান্তিতে আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। শরীর অবসন্ন হয়ে পড়েছিল। ভোরে উঠে দেখি চারদিকে সীমাহীন পানি। রোদের তেজ ক্রমশ বাড়ছে।
এভাবে কেটে গেল কয়েক দিন। কোনো জাহাজের দেখা পেলাম না। এক সময় খাবার শেষ হয়ে এলো। নৌকোয় রয়েছে শুধু ডিম। দানব পাখির ডিম। খিদের জ্বালা সইতে না পেরে একদিন একটা ডিম ভাঙলাম। অন্য ধরনের গন্ধ পেলাম। অনেকটা রাজহাঁসের ডিমের মতো। কুসুমের পাশে সরু লাল জালের মতো দাগ। তিন দিন পর আরেকটা ডিম ভাঙতেই এক অবিশ্বাস্য দৃশ্য দেখলাম। ডিমের ভিতরে তিরতির করে একটা বাচ্চা ফুটছে। এ কি করে সম্ভব! প্রায় পাঁচ’শ বছর আগের প্রাচীন একটি ডিম। তাও এতদিন পোঁতা ছিল কাদাতে। এ থেকে কী করে বাচ্চা হচ্ছে? তবে কী ঐ জলাভূমির বৈশিষ্ট্যের জন্যেই এতদিন ডিমটার ভেতরের অংশটা এখনো জীবন্ত রয়েছে। পচতে দেয়নি। বিস্মিত হয়ে দেখছি ভ্রুণের মধ্যে বিরাট একটা মাথা আর বাঁকানো পিঠ দেখা যাচ্ছে। যা ক্রমশ আকার নিচ্ছে। পাতলা একটা পর্দা ঢেকে রেখেছে কুসুমটাকে।
আমি যেন ঐ ছানাটির হৃদপিণ্ডের শব্দ শুনতে পেলাম। ধুকপুক করছে। পাঁচ’শ বছরের সীমানা পেরিয়ে একটা প্রাণ আবার বুঝি ফিরে আসছে পৃথিবীতে। অবয়ব পাচ্ছে। বিচিত্র এক অনুভূতিতে তখন আমি আলোড়িত। সমুদ্রে একাকী ভেসে চলেছি। আমার নৌকোয় জন্ম নিচ্ছে একটি পাঁচশো বছরের পুরানো ডিম থেকে পাখির ছানা। রোদের তাপে সে ডিম ফুটছে। এ এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা।
খিদের জ্বালা প্রচণ্ড জ্বালা। খিদে প্রচণ্ড হলে আর কোনো বুদ্ধি তখন সহজে কাজ করে না। আমার সামনে ঐ আধফোটা বাচ্ছা। যেন নরম মাংসের একটি ডেলা। কোনো খাবার নেই নৌকোতে। সমুদ্র থেকে মাছও ধরা যাচ্ছে না।
ঐ বাচ্চাটাকে মেরে খেয়ে ফেললাম। মাংসে উৎকট গন্ধ। নৌকোয় শুধু আরেকটি ডিম অবশিষ্ট রয়েছে। যে ডিমটা ভেঙে ছানা বেরিয়েছিল ঐ ডিমের খোলাটাকে নৌকোর দাঁড় হিশেবে ব্যবহার করতে লাগলাম। এতে নৌকোর গতি খানিক বাড়ল। কোণায় পড়ে আছে ছানাটার রক্তমাখা পালক। এভাবে ভেসে ভেসে শেষ পর্যন্ত একটা প্রবাল দ্বীপে পৌঁছলাম।
ছোট্ট একটি দ্বীপ। তার মাঝখানে জলাশয়। সেখানে রয়েছে ডোরাকাটা মাছ। দ্বীপে তেমন গাছপালা নেই। সোনালি লতার ঝোপ রয়েছে। ক্যানোটাকে টেনে তুললাম। এটাই তখন একমাত্র ভরসা। এরপর নৌকো থেকে যত্নের সাথে ডিমটাকে নামিয়ে আনলাম। রোদে ঝকঝক করছে ডিমটা। শুকনো বালুতে গর্ত করে তার ভেতরে ডিমটাকে রেখে দিলাম। এমনভাবে রাখলাম যাতে ডিমে ভালো করে রোদ লাগতে পারে। এরপর বেরুলাম খাবারের খোঁজে। গাছে ফল রয়েছে। তাতে একটু কষটে স্বাদ। তবু কোনোমতে খাওয়া যায়। মাছ ধরলাম হ্রদ থেকে। ঝিনুক দিয়ে চেঁছে ফেললাম লম্বা মাছগুলোর আঁশ।
সে রাতে প্রচণ্ড বৃষ্টি হলো। বাজ পড়ল শব্দ করে। কোনোমতে একটা পাতার ঝুপড়ি বানিয়ে রাত কাটালাম। ঢেউয়ের তাণ্ডবে ক্যানোটা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল। আমি ডিমটাকে জড়িয়ে ধরে রাখলাম। হঠাৎ শুনতে পেলাম ডিমের ভিতরে নড়াচড়ার শব্দ। ভিতর থেকে ঠোকরানো হচ্ছে ডিমের খোলা ক্রমশ দাগ ফুটে উঠতে লাগল। আশ্চর্য, এটার ভেতরে থেকেও এত বছর পর বাচ্চার জন্ম হচ্ছে। ডিমের একপাশ ফুটো হয়ে গেল। সেই ফুটো দিয়ে মুখ বার করল একটা কুৎসিত বাদামি মাথা। জুলজুল করে তাকাচ্ছে। এই হচ্ছে দানব পাখির ছানা। এর পূর্বপুরুষেরা চার পাঁচশ বছর আগে দাপিয়ে বেড়াতো এই দ্বীপে। ছানাটি মরমর করে খোলা ভেঙে বেরিয়ে-এলো। ডানা ঝাড়লো। কেমন কদাকার দেখাচ্ছে ছানাটিকে। দানব পাখির ছানা আমার সামনে তিরতির করে হাঁটছে। ছানাটি কোঁক কোঁক শব্দ করে ডাকছে। আবার মুখ হাঁ করল। জন্মের পর নাকি প্রাণিদের প্রচণ্ড খিদে পায়। ছানাটি খিদের জ্বালায় অস্থির হয়ে পড়েছে। আমি তাড়াতাড়ি ওর সামনে কয়েকটা ডোরাকাটা মাছ এনে ফেললাম।
ছানাটি লাফ দিয়ে পড়ল সেই মাছগুলোর ওপর। মাছগুলো ঠোটের সাহায্যে চিরে খেতে লাগল। প্রথম দিনেই এত খাওয়া। বোঝা গেল পাখিটির রয়েছে রাক্ষুসে খিদে। হবেই তো। দানব ছানা
দিন দিন বড় হতে লাগল ইপাইওরনিসের ছানা। যত দিন যেতে লাগল ততই যেন পাখিটির রূপ খুলল। ডাগর হয়ে ওর শক্তি বাড়ল। মাথায় নীল ঝুঁটি। লেজের পালক সবুজ। পাখিটি আমার অনুগত। এই নির্জন দ্বীপে দানব পাখিটার সাথে আমার যে ভাব করতেই হবে। পাখিটি হয়ে উঠল আমার খেলার সঙ্গী। দ্বীপের বিভিন্ন প্রান্তে আমরা ছুটোছুটি করতাম।
প্রতিদিন আমি সাগর তীরে দাঁড়িয়ে থাকতাম জাহাজের আশায়। যদি দিগন্ত রেখায় কোনো জাহাজ দেখা যায়। দানব পাখিটির আমি একটি নাম দিয়েছিলাম। রিকি। মাঝে মাঝে ঝুঁটি ঘুরিয়ে নাচাতো। যখন দ্বীপের আবহাওয়া প্রতিকূল হয়ে উঠত তখন রিকি আমার কাছে গুটিশুটি মেরে বসে থাকত। এমনি করে ঐ ছোট প্রবাল দ্বীপে দু’বছর কেটে গেল। লকলক করে বেড়েছে রিকি। লম্বায় হয়েছে চৌদ্দ ফুট। মাথাটি দেখতে হয়েছে গাঁইতির ফলার মতো। বাদামি চোখ। চোখের দুপাশে হলুদ দাগ। শরীরের পালক মসৃণ।
কিন্তু ধীরে ধীরে রিকির স্বভাব পাল্টে যেতে লাগল। ক্রমশ বুনো হয়ে উঠল। ওর ভেতরের দানব পাখির স্বভাবটা প্রকাশ পেতে লাগল। হিংস্র মারকুটে লোভী স্বভাব। বেপরোয়া ধরনের মারমুখী হয়ে থাকা।
রিকি আমার কাছে এসে পা ঠোকরায়। এর মানে তাকে হ্রদ থেকে ডোরাকাটা মাছ ধরে এনে দিতে হবে। আমার পক্ষে সবসময় মাছ ধরা সম্ভব হয় না। মাছ পাওয়া মাত্রই রিকি ঠোট বাড়িয়ে সব নিয়ে যায়। কপাত কপাত করে গিলে ফেলে। কি যে প্রচণ্ড খিদে ঐ পাখিটির। একদিন অনেক কষ্ট করে কয়েকটা মাছ ধরলাম। ভাবলাম এগুলো নিজেই বসে খাব। কোত্থেকে ছুটে এলো রিকি। এসেই মাছ খেতে চাইল। আমি বাধা দিলাম। অমনি ফুঁসে উঠল দানব পাখি। আমার দিকে তেড়ে এসে আমাকে টুকরো করে দেয়ার চেষ্টা করল। আমি ক্ষিপ্ত হয়ে ওর মাথায় একটা আঘাত করলাম। অমনি হিংস্র পাখিটা ঝাঁপিয়ে পড়ল আমার উপর। এরপর আমাকে ধারালো ঠোটে আঘাত করল। জোরে লাথি কষালো আমার শরীরে। সাংঘাতিক জোর সেই লাথির। আমার মনে হলো দানব পাখিটা আমাকে আঘাতে আঘাতে মেরে ফেলবে। তারপর আমার মাংস ছিড়ে ছিড়ে খাবে। কতটা অকৃতজ্ঞ প্রাণি।
আমি মৃত্যুর ভয়ে ছুটতে লাগলাম। পাখিটাও আমাকে তাড়া করছে। প্রচণ্ড গতি তার। একবার ওর লাথির আঘাতে বালুমাটিতে মুখ থুবড়ে পড়লাম। তারপর পাখিটা আমার শরীরের বিভিন্ন স্থানে ঠোকরাতে লাগল। শরীরটাকে কোনোমতে ঘঁষতে নিয়ে হ্রদের বুকে ঝাপিয়ে পড়লাম। পাখিটা হ্রদে নামতে পারবে না। সারাদিন দাঁড়িয়ে রইলাম হ্রদে। পাখিটাও মহা শয়তান। ওটা কোথাও গেল না।হ্রদের পাশে পায়চারি করতে লাগল লম্বা পা ফেলে। বাদামি চোখে ভয়ঙ্করভাবে আমার দিকে তাকিয়ে গলা বেঁকিয়ে কর্কশ স্বরে চিৎকার করতে লাগল মাঝে মাঝে।
আমার সমস্ত শরীরটা থেঁতলে দিয়েছে ঐ পাখি । আমি ভাবছিলাম ডিম ফুটিয়ে এটার পৃথিবীতে আলো দেখালাম। বড় করলাম। পুষ্ট করলাম। সেই কিনা আজ আমাকে শেষ করতে চাইছে। ভাবলাম একসময় বিরক্ত হয়ে হ্রদের পাশ থেকে চলে যাবে পাখিটা। কোথায় কি। সে দাঁড়িয়ে রইল হ্রদের পাশে। আমি উঠে আসামাত্রই যেন ঝাঁপ দেবে। এভাবে আর কতক্ষণ হ্রদের এক গলা পানিতে দাঁড়িয়ে থাকা যায়। ডুব সাঁতার দিয়ে একটা তালগাছের তলায় গেলাম। তারপর আহত শরীরটা নিয়ে কোনোমতে উঠে গেলাম তালগাছের মাথায়। আমাকে গাছে উঠে যেতে দেখে ছুটে এলো পাখিটা। গলা লম্বা করে আমাকে ধরতে চাইল। কি ভয়ঙ্কর স্বভাব। আমাকে যেন কোনোমতেই ছাড়বে না। আমার জীবনটা দুর্বিষহ করে দিল এই পাখিটা।
এভাবে আর কতক্ষণ থাকা যায়। পাখিটা হ্রদের কিনারায় কাদাপানি ঘেঁটে পোকামাকড় খুঁটে খাচ্ছে। আমি কখনো চুপিসারে নেমে যাই হ্রদের মাঝে। বাকি সময় কাটাই তালগাছের মাথায়।
একদিন তালগাছে ঘুমিয়ে রয়েছি পা ঝুলিয়ে। হঠাৎ তীব্র যন্ত্রণায় আমি চিৎকার করে উঠলাম। আমার বাঁ পা রক্তে সপসপ করছে। দানব পাখিটা তালগাছের পাশে একটা ঝুপশি গাছে উঠে আমার গোড়ালিতে কামড় দিয়েছে। এক খাবলা মাংস তুলে নিয়েছে। অসহ্য যন্ত্রণা চিনচিন করে আমার সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে যেতে লাগল। নিচে নেমে যে পাতা কচলে ক্ষতস্থানে লাগাব তারও কোনো উপায় নেই।
নামামাত্রই আমি ছিন্নভিন্ন হব। অসহনীয় এক পরিবেশ। এভাবে বেঁচে থাকা যাবে না। মরিয়া হয়ে উঠলাম। মাথার ভেতরে নানা ধরনের নিষ্ঠুর পদ্ধতি ঝিলিক দিতে লাগল। এ অবস্থা থেকে মুক্তির একটাই মাত্র উপায় রয়েছে। যেভাবেই হোক পাখিটাকে খুন করতে হবে। এই দানব পাখি এখন আমার জীবনের প্রধান শত্রু। একে পৃথিবী থেকে শেষ করতে না পারলে আমি আর বেঁচে থাকতে পারব না।
কিভাবে খুন করা যায় পাখিটাকে। দড়ির ফাঁস ল্যাসো বানিয়ে ছুঁড়ে মারতে হবে। এভাবে বুনো অস্ট্রিচ পাখিদের ধরা হয়।
হ্রদের পাশের নলখাগড়া আর শরের আঁশ থেকে পাকিয়ে পাকিয়ে একটা বড় দড়ি বানালাম। এই দড়িটি বানাতে আমার অবশ্য কয়েক দিন লাগল। খুব সাবধানে কাজটা করতে হয়েছিল। দড়ির আগায় বাঁধলাম একটা বড় প্রবালের টুকরো। এভাবে তৈরি হলো দড়ির ফাঁস।
এবার পাখিটাকে আটকাতে হবে। এক দিন সুযোগ বুঝে দড়িটা ঘুরিয়ে ছুঁড়ে দিলাম পাখিটার দু’পা লক্ষ্য করে। ছাত করে পা আটকে গেল। পাখিটা দড়ির বাঁধন থেকে মুক্ত হবার জন্যে অস্থির হয়ে লাফাতে লাগল। যত লাফাচ্ছে তত বেশি করে দড়ির পাকে জড়িয়ে যাচ্ছে। একসময় পাখিটা দড়িতে জড়িয়ে মাটিতে পড়ে গেল। দানব পাখিটা মাটিতে পড়ে কাতরাচ্ছে। আমি ওর দিকে এগিয়ে গেলাম। আমার হাতে ছুরি। পাখিটা পা ছুঁড়ে মারার ব্যর্থ চেষ্টা করছে। ওর বাদামি চোখ দুটো দিয়ে যেন ক্রোধের আগুন ঠিকরে আসছে। আমি আর দেরি করলাম না। পাখিটার গলা চেপে ধরে ছুরির পোচ বসিয়ে দিলাম। তারপর কয়েক টানে গলাটা কেটে ফেললাম। ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটল। বালুমাটি লাল হয়ে গেল। আমি একটি দুষ্প্রাপ্য রহস্যময় পাখিকে হত্যা করলাম। আসলে করতে বাধ্য হলাম।
এর কয়েকদিন পর একটি পালতোলা জাহাজ আমাকে ঐ দ্বীপ থেকে উদ্ধার করে। আমি ঐ পাখিটারই উরুর হাড় এনেছিলাম।
এইচ, জি ওয়েলস এর কাহিনি অবলম্বনে।