বুক ভরা শ্বাস
আচ্ছা বলুন তো, মহাকাশ সম্পর্কে সবজান্তা কারা? কোনোদিন যারা পৃথিবীর টান কাটিয়ে পাড়ি দেয়নি মহাকাশে। তাদের আবার বেশ কিছু বদ্ধমূল ধারণা রয়েছে। যেমন তারা নিশ্চিত জানে যে পৃথিবীর বাইরে বায়ুশূন্য মহাকাশে অরক্ষিত মানুষের দেহ নিমিষের মধ্যে বীভৎসভাবে একেবারে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে।
মহাকাশযানে বসে বায়ুশূন্যতার শিকার এমন কয়েকটি মৃতদেহ আমি নিজের চোখে দেখেছি। যা দেখলে মহাকাশে পাড়ি দেয়ার আগ্রহ একদম কমে যাবে। কিন্তু আর সব নিয়মের মতো এই নিয়মটিরও ব্যতিক্রম আছে। কথাটি বলছি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে। এ কতদিন হয় যোগাযোগ উপগ্রহটি নির্মাণের কাজ প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। ওটার সব প্রধান অংশগুলো জোড়া লাগানো হয়ে গেছে। আবাসিক অংশগুলোতে সৃষ্টি করা হয়েছে স্বাভাবিক পার্থিক বায়ুচাপ।
পুরো স্টেশনটাকে তার নিজস্ব অক্ষের চারপাশে ধীর গতিতে ঘূর্ণিয়মান অবস্থায় নিয়ে আসা হয়েছে। যাতে কৃত্রিম মাধ্যাকর্ষণের সৃষ্টি হয়। দুশো ফুট ব্যাস বিশিষ্ট চাকাটির কিনারায় ঘূর্ণনের গতি তখন ঘণ্টায় ত্রিশ মাইল। এই গতিশীলতাকে আমরা অবশ্য অনুভব করতে পারতাম না। কারণ এই ঘূর্ণনের ফলে কেন্দ্রাতিক শক্তি আমাদের শরীরে ওজন ফিরিয়ে এনেছিল। পৃথিবীতে থাকার সময় আমাদের যা ওজন হতো স্টেশনের মধ্যে তা হলো অর্ধেক। এর ফলে বেশ দীর্ঘ সময়ের জন্যে ভারশূন্য থাকার পর বেশি ওজনের জন্যে আমাদের কোনো রকমের অস্বস্তি হতো না।
ঘটনার রাতে আমরা চারজন ঘুমাচ্ছিলাম ছয় নম্বর শোবার ঘরে। ছোট বেলুনের আকারের ঘরটি ছিল স্টেশনের একেবারে নিকারায়।
আমাদের মহাশূন্যের স্টেশনটার আকার ছিল অনেকটা এই রকম, একটা বাই সাইকেলের চাকা যার টায়ারের বদলে রয়েছে একটা পটোলের মালা। ছয় নম্বর শোবার ঘরটি হচ্ছে এই পটোলগুলোর একটি। তারই মধ্যে নিশ্চিন্তে আমরা চারজন ঘুমাচ্ছিলাম।
হঠাৎ একটি ধাক্কা খেয়ে আমার ঘুমটা ভেঙে গেল। চমকে উঠে বসে ভাবলাম, কী হলো। মহাকাশ স্টেশনে রোজকার ঘটনার বাইরে কোনো কিছু ঘটলে তখনই সেদিকে দৃষ্টি দিতে হয়। তাড়াতাড়ি ইন্টারকমের বোতাম টিপলাম। হ্যালো, কন্ট্রোল সেন্টার, কিসে ধাক্কা লাগল?
কোনো সাড়া শব্দ পাওয়া গেল না। এবার চমকে গেলাম। ঘাবড়ে গিয়ে বিছানা থেকে লাফ দিয়ে নামলাম। আমার জন্য আরও চমক অপেক্ষা করছিল। অনুভব করলাম একদম মাধ্যাকর্ষণ নেই। মেঝে থেকে ছিটকে গিয়ে ছাদে ঠেকলাম। এরপর কোনোরকমে এটা সেটা ধরে ফিরে এলাম যথাস্থানে। লক্ষ করলাম বিদ্যুৎও চলে গেছে। আলো আসছে জরুরি ব্যাটারিচালিত বাতি থেকে। পুরো স্টেশনটা আর ঘুরছে না। ব্যাপারটা তো এমন হতে পারে না। কি হয়েছে তা বুঝতে পারা কঠিন না। ইন্টারকম কোনো কাজ করছে না। আলো নেই। এর অর্থ আমাদের কেবিনটা স্টেশন থেকে কোনো প্রকারে ছিটকে আলাদা হয়ে গেছে। আর আমরা এখন মহাকাশে নোঙর ছেঁড়া হালবিহীন নৌকোর মতো ভেসে চলেছি। কোনো জানালাও নেই যা দিয়ে বাইরে তাকানো যাবে। বাতাস আসা যাওয়ার পথগুলো বায়ুর চাপ কমার সাথে সাথে নিজ থেকেই বন্ধ হয়ে গেছে। এর ফলে কিছুক্ষণের জন্যে অন্তত আমাদের নিজস্ব আবহাওয়া মণ্ডলের মধ্যে বাঁচা যাবে। তবে খুব বেশিক্ষণ তা চলবে না। কারণ, একটা শিসের শব্দ শুনে বুঝতে পারছিলাম যে কেবিনের কোথাও একটি ছিদ্র হয়েছে। যেখান দিয়ে দ্রুত বেরিয়ে যাচ্ছে বাতাস। স্টেশনের অন্য অংশের কি হয়েছে কে জানে। আমাদেরই মতো অবস্থা হয়েছে হয়তো সকলেরই। পুরো স্টেশনটাই হয়তো টুকরো টুকরো হয়ে ভেসে চলছে এদিক ওদিক। আমাদের সহকর্মীরাও হয়তো আমাদের মতো ভয়াবহ সঙ্কটে পড়েছে। অথবা হয়তো সকলেই মারা গেছে। একমাত্র ক্ষীণ আশা হচ্ছে যে আমরাই শুধু ছিটকে এসেছি। স্টেশনের বাকি অংশ ঠিক আছে। এবং আমাদের উদ্ধার করতে সেখান থেকে কর্মীরা আসবে। আমরা তো আর ত্রিশ মাইলের বেশি গতিতে চলছি না। ফলে উদ্ধারকর্মীরা রকেট স্কুটারে করে আমাদের অল্প সময়ের মধ্যে ধরে ফেলতে পারবে।
এক ঘণ্টা লাগল। এই একটি ঘণ্টাকে আমাদের কাছে তখন অনন্তকাল বলে মনে হচ্ছিল। আমরা ততক্ষণে ছটফট করছি বাতাসের অভাবে। জরুরিকালীন ব্যবহারের জন্যে রক্ষিত অক্সিজেন ট্যাংকও প্রায় খালি হয়ে এসেছে।
দেয়ালে করাঘাত হচ্ছে। আমরাও এদিক থেকে দেয়ালে শব্দ করলাম। কয়েক সেকেন্ড পরে একটা চাপা কণ্ঠস্বর আমাদের ডাকাডাকি শুরু করল। বাইরে কেউ স্পেস স্যুটের শিরস্ত্রাণ ধাতব দেয়ালে ঠেকিয়ে চিৎকার করছে। ঐ শব্দ আমাদের কাছে এসে পৌঁছাচ্ছে সরাসরি বাহিত হয়ে। খুব পরিষ্কার করে অবশ্য শোনা যাচ্ছে না।
তাড়াতাড়ি কমে আসছে অক্সিজেন। দ্রুত ভাবতে লাগলাম এবার কি করা। পুরো কক্ষটাকে টেনে নিয়ে কেন্দ্রীয় স্টেশনে পৌঁছানোর আগেই আমাদের মৃত্যু ঘটবে বাতাসের অভাবে। অথচ উদ্ধারকারী মহাকাশযান আমাদের কয়েক ফুটের মধ্যেই রয়েছে। প্রধান সমস্যা হলো এই কয়েক ফুট বায়ুশূন্যতা স্পেস স্যুট ছাড়া কি করে পেরিয়ে যাওয়া যাবে।
আমরা পরিকল্পনা ঠিক করে নিলাম। একথা বুঝে নিলাম প্রথমবার কোনোরকম গোলমাল হলে দ্বিতীয়বার আর সুযোগ আসবে না। এবারে সকলে গভীরভাবে অনেকটা পরিমাণ অক্সিজেন টেনে নিলাম, যাতে ফুসফুসের সর্বত্র তা ছড়িয়ে পড়ে। সবাই যখন প্রস্তুত আমি তখন দেয়ালে করাঘাত করে বাইরে অপেক্ষমান বন্ধুদের জানালাম যে আমরা তৈরি।
পরপর কয়েকটি ঠকঠক শব্দ। দেয়াল কাটছে। আমরা সবাই দেয়ালে লাগানো হাতগুলো জোরে আঁকড়ে ধরে রইলাম। যেখানে দেয়াল কাটছে তার থেকে যতটা সম্ভব দূরে সরে গেলাম। কি যে ঘটবে তা তো জানি না। কিন্তু যখন যা হবার হলো তখন যেন সব খেই হারিয়ে গেল। কেবিনে একটি যেন বিস্ফোরণ ঘটল। প্রচণ্ড একটা হাওয়া আমাকে তীব্রভাবে টানতে লাগল। আমার হাঁ করা মুখের মধ্য দিয়ে অতর্কিতে আমার ফুসফুসের সমস্ত বাতাস বেরিয়ে গেল। তারপর নিরবচ্ছিন্ন নীরবতা। দেয়ালের বিরাট ফাটলের মধ্য দিয়ে দেখা যাচ্ছে অজস্র তারা। তখন কি রকম অনুভূতি হচ্ছিল সেটা বিচার করতে এক মুহূর্ত থামিনি। তবু মনে হলো আমার চোখ দুটো জ্বালা করছে। সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে পড়েছে চিনচিনে একটা ভাব। ভীষণ শীত করছে। চামড়া থেকে বোধহয় পানির বাষ্পীভবন শুরু হয়ে গিয়েছিল।
পরিষ্কার মনে আছে। সেটা হলো গা ছমছম করা নিরেট শব্দহীনতা। স্পেস স্টেশনে পুরোপুরি নীরবতা কখনও থাকে না। বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতির গুনগুনানি সব সময়ই শোনা যায়। কিন্তু এখানে তো বিরাজ করছে মহাশূন্যের সর্বাত্মক নিস্তব্ধতা। বাতাস নেই যার মাধ্যমে শব্দ চারদিকে ছড়িয়ে পড়বে।
দেয়াল কাটার প্রায় সাথে সাথেই আমরা বাইরে ঝাঁপ দিলাম। সূর্যের প্রচণ্ড আলোতে সাথে সাথে অন্ধ হয়ে গেলাম। কিন্তু তাতে অসুবিধা কিছু হলো না। কারণ স্পেস স্যুট পরিহিত অপেক্ষমাণ উদ্ধারকারীরা বাইরে আসতে আমাকে ধরে পাশে দাঁড়ানো মহাকাশযানে ঢুকিয়ে নিল। এয়ার লকের মধ্যে ঢুকল বাতাস, তার সাথে ঢুকল শব্দ, ঢুকল চেতনা। মনে হলো এবার আবার তাহলে নিঃশ্বাস নেয়া চলতে পারে। পরে শুনেছিলাম উদ্ধারের কাজ শেষ হতে সময় লেগেছিল বিশ সেকেন্ড।
বায়ুশূন্যতায় নিঃশ্বাস গ্রহণকারী সংঘের আমরাই হলাম প্রতিষ্ঠাতা। এরপরে অদ্ভুত বারোজন এভাবে বেঁচেছে। তারাও পড়েছিল এই ধরনের সঙ্কটজনক অবস্থায়। বর্তমান রেকর্ড হচ্ছে দুটি মিনিট বায়ুশূন্য অবস্থায় থাকা। তারপরে শরীরে আগেই রক্ত ফুটতে থাকে টগবগ করে। এবং বুদবুদের সৃষ্টি হয় রক্তে। সেই বুদবুদ হৃৎপিণ্ডে পৌঁছাতে বেশি সময় লাগে না।
আমার ক্ষেত্রে একটি মাত্র শারীরিক ক্ষতি হয়েছে। সেকেন্ড পনের জন্যে আমার শরীরে সূর্যের আলো লেগেছে।
খাঁটি সূর্যের আলো। বুঝতে পারলেন তো, পৃথিবীতে আপনারা বায়ুমণ্ডলের মধ্যে যেয়ে মিয়ানো সূর্যের যে আলো পান তা নয়। বায়ুশূন্যতা আমাকে কিছু করতে পারে নি। কিন্তু আমার সমস্ত শরীর ঐ প্রখর তাপে পুড়ে একেবারে কালো হয়ে গিয়েছিল।
আর্থার সি. ক্লার্ক রচিত ‘টেক এ ডিপ ব্রেথ’- এর অংশ বিশেষ