শেষ ফেরি
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল ভার্জিনিয়া রত্নার। শেষ সময় বলে তাহলে একটা কিছু আছে। রত্নার বাইরে তাকাল। সামনে বিস্তীর্ণ সমুদ্র। সূর্যের আলো ঝিকমিক করছে সমুদ্রের পানিতে। রত্নারের চোখ দুটো করকর করে উঠল। বলল, আজকের কাজের জন্যে অবশ্য দিনটি বেশ চমৎকার। তবুও আজ যদি একবার ঝড়ো হাওয়া বইতো। তাহলে আমার মনের সাথে সেটা খুব সুন্দর ভাবে মানিয়ে যেত।
রত্নারের পাশেই ছিলেন মহাকাশ সংস্থার বড় কর্মকর্তা রবার্ট গিল। একথা শুনে গিল একটু যেন ক্ষেপে গেলেন। তার কণ্ঠে স্পষ্ট ঝাঁঝ ফুটে ওঠে।
-তুমি আর বসে বসে কাঁদুনি গেয়ো না। এইমাত্র তুমি নিজেই বললে যে সবকিছুরই একটা শেষ সময় রয়েছে। বলোনি?
-বলেছি। কিন্তু তাই বলে আমাকেই শেষ কাজটা করতে হবে কেন?
-এর কারণ হচ্ছে আমাদের সংস্থার তুমিই হচ্ছ সবচাইতে দক্ষ মহাকাশযান চালক। আমরা চাইছি শেষটা যাতে খুব সুন্দরভাবে শেষ হয়।
-তাহলে আমাকেই বা কেন বেছে নেয়া হয়েছিল এই সংস্থাটির অস্তিত্ব ধ্বংস করার জন্যে।
-মধুর পরিসমাপ্তি। বাহ!
রত্নার একটু মুখ বিকৃত করল। তাকাল সামনের দিকে। ব্যস্ততার সাথে মহাকাশ ফেরিতে মালপত্র তোলা হচ্ছে। ওর মনে হলো এই ব্যস্ততায় একটু আতঙ্কও যেন মিশে আছে। যাত্রীরা দীর্ঘ সারিতে অপেক্ষা করছে। এসব কিছুরই আজ সমাপ্তি ঘটতে যাচ্ছে।
রত্নার গত বিশ বছর ধরে মহাকাশ ফেরি চালাচ্ছে। এই কাজটি সে করছে অত্যন্ত যোগ্যতার সাথে। সব সময় ভেবে এসেছে যে একবার না একবার একটা শেষ সময় আসবে। রত্নার ভাবল শেষ ফেরিযানটি যদি উড়তে গিয়ে বিস্ফারিত হয় তাহলে বোধহয় সবচাইতে ভালো হয়। অন্তত পৃথিবীর পক্ষ থেকে একটা প্রতীকী প্রতিবাদ জানানো যায়।
গিল মাথা ঝাঁকাল।
-রত্নার, মনে হচ্ছে তুমি পুরানো দিনের কথা ভেবে কিছুটা আবেগপ্রবণ হয়ে উঠেছ। ব্যাপারটা কিন্তু কর্তৃপক্ষকে জানাতে হবে।
-তাই জানাও। তাহলে কর্তৃপক্ষ আমার মানসিক অবস্থার কথা বিবেচনা করবে। ফলে হয়তো আমাকে এই ফেরি চালানোর হাত থেকে তারা মুক্তি দেবে। আমিও তাহলে বেঁচে যাব। ৬১৬ জন যাত্রীর সংখ্যা বেড়ে ৬১৭ জন হবে। কারণ আমিও তখন ওদের সারিতে গিয়ে দাঁড়াতে পারব। এই শেষ ফেরিযানটা অন্য কেউ পরিচালনা করে নিয়ে যাবে। তার নাম ইতিহাসের পাতায় লেখা থাকবে।
-তোমার ব্যাপারটা কর্তৃপক্ষকে জানাব না আমি। ওটা একটা কথার কথা। তুমি যতটা ভয় পাচ্ছ তার কোনো কিছুই ঘটবে না। এইসব ফেরিযানগুলো মহাকাশ যাত্রার ব্যাপারে একেবারেই সমস্যা মুক্ত। কোনো যান্ত্রিক ত্রুটি তাতে থাকে না।
-সব সময় তা কিন্তু নয়। এন্টারপ্রাইজ সিক্সটিয়ের বেলায় কি ঘটনা ঘটেছিল? মনে নেই?
রত্নারের কণ্ঠে এক ধরনের বিষাদ।
-আরে ওটা কি একটা বড় খবর হলো? ১৭০ বছর আগের একটা ঘটনা। এরপর থেকে কোনো মহাকাশযানে দুর্ঘটনা ঘটেনি। এখন আমাদের সাহায্য করছে মাধ্যাকর্ষণ প্রতিরোধ ব্যবস্থা। শব্দ সমস্যাও নেই। কানে এখন আর তালা ধরে না। রকেটে উড়তে গেলে যে ভয়ঙ্কর মহা গর্জন হতো এখন তাও নেই। প্রায় নিঃশব্দে মহাকাশযাত্রা শুরু হয়ে যায়। শোনো রত্নার, তুমি বরং মহাকাশ ফেরির দিকে এগিয়ে যাও। কারণ যাত্রার আর মাত্র ত্রিশ মিনিটেরও কম সময় রয়েছে।
-তুমি আমাকে বোঝাতে চাইলে যে মহাকাশযাত্রা এখন সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয়। সে ক্ষেত্রে আমার এমন কী ভূমিকা রয়েছে?
-আমি না বললেও ব্যাপারটা তুমি ভালো করেই জানো। কিন্তু মহাকাশযানে তোমার উপস্থিতি এখন একটি নিয়মের ব্যাপার।
-আমার মনে হচ্ছে এখন তুমিও পুরানো দিনের চিন্তা-ভাবনার মধ্যে ডুবে যাচ্ছ। তুমি এমন দিনের কথা বলছ যখন মহাকাশযান পরিচালকেরা নিজেরাই যন্ত্র চালাতেন। যা হোক আমি যাব।
-রত্নারের মনে হলো প্রথমে মহাকাশযান পরিচালনায় সাহায্যের জন্যে মাধ্যাকর্ষণহীন যন্ত্রের আবিষ্কার হলেও তা ছিল পরীক্ষামূলক স্তরে। সে সময়ে মহাকাশ স্টেশনে মহাকাশযানের চাইতেও বড় যন্ত্রপাতি বসাতে হতো মাধ্যাকর্ষণহীনতা সৃষ্টি করার জন্যে। তাও এসব যন্ত্র কখনও কাজ করত এলোমলোভাবে। আবার কখনও একেবারেই কাজ করত না। কিন্তু এখন মাধ্যাকর্ষণহীনতা সৃষ্টির জন্যে যন্ত্রগুলো হয়ে গেছে খুবই ছোট ছোট। আর কর্মক্ষমতা বেড়েছে সাংঘাতিকভাবে। এখন প্রতিটি মহাকাশযানেই একটি করে মাধ্যাকর্ষণহীনতা যন্ত্র বসানো হচ্ছে। সম্পূর্ণ ত্রুটিমুক্ত এই যন্ত্র। এর সাহায্যে ওজনহীন মালপত্র এবং যাত্রীদের কিভাবে নড়াচড়া করতে হয় সে সম্পর্কেও দক্ষ কর্মীর কোনো অভাব নেই।
এখানকার মহাকাশযানগুলো যেমনি বিশাল তেমনি জটিল। এতে রয়েছে আরও জটিল ও উন্নতমানের কম্পিউটার। মানুষ এ পর্যন্ত যত যন্ত্রপাতি তৈরি করেছে তার মধ্যে এই মহাকাশযানগুলোই বোধহয় সবচাইতে উন্নত আর জটিল। বেশ কয়েক ধরনের মহাকাশযান রয়েছে। কোনো কোনো যান মহাকাশ উপনিবেশ থাকা কোনো উৎপাদন কেন্দ্রের মধ্যে যাতায়াত করে। কোনো যান মহাকাশ কারখানা থেকে কোনো খাদ্য উৎপাদন কেন্দ্রের মধ্যে অথবা চাঁদ থেকে এদিক ওদিক যাতায়াত করে। এসবের জন্য কোনো মাধ্যাকর্ষণহীনতা যন্ত্র বসানোর প্রয়োজন পড়ে না। এগুলোর গঠনপ্রণালী এত জটিল না।
নানা কথা ভাবতে ভাবতে রত্নার এসে হাজির হলো মহাকাশযানের পরিচালকের কক্ষে। চারদিকে তাকিয়ে দেখল খুবই চেনা দৃশ্য। চারপাশে নির্দেশক যন্ত্রগুলো ওকে জানিয়ে দিচ্ছে মহাকাশযান এবং তার ভেতরের অবস্থা। কোন যন্ত্র কিভাবে কাজ করছে। মহাকাশযানের কোন জায়গায় কোন মালপত্র রাখা হয়েছে। কোন যাত্রী কোথায় বসেছে। সহকর্মীরা কে কোথায় কাজ করছে।
৩৬০ টিভি পর্দায় মহাকাশযানের বাইরের চারদিক স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে। রত্নার ভাবছিল, অতীতে এই স্থানটি থেকেই মানুষ প্রথম মহাকাশযাত্রা শুরু করেছিল। সে ছিল সেই বীরত্বপূর্ণ দিনে। এখান থেকেই মানুষ মহাকাশে পাড়ি দিয়েছে উপনিবেশ স্থাপনের জন্যে। শক্তি উৎপাদন কেন্দ্র তৈরি করার জন্যে। কারখানাগুলোকে নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের প্রয়োজন হয়। এক একটি মহাকাশ উপনিবেশে দশ হাজার লোক বাস করতে পারে।
এই বিশাল মহাকাশ স্টেশনের সামান্য একটুখানি মাত্র অবশিষ্ট আছে। যাত্রা শুরু করার জন্যে যে সামান্যতম জিনিশের প্রয়োজন শুধুমাত্র সেটুকু আছে। বাকি সব কিছু খুলে খুলে একটা একটা করে মহাকাশযানে তুলে দেয়া হয়েছে। ঐ অংশটুকু এই পৃথিবীর মাটিতেই পড়ে থাকবে। মহাকাশযান চলে যাবে। তারপর ঐ শেষ অংশটুকুতে মরচে পড়বে। ধীরে ধীরে ক্ষয়ে যাবে। শেষ স্মৃতিটাও যাবে একদিন মুছে।
পৃথিবীর মানুষরা কি করে অতীতকে ভুলে যাবে? রত্নার যেন দেখতে পেল সমুদ্র ও জীবনহীন মরুভূমি। কোথাও কোনো বাড়ি ঘরের চিহ্নমাত্র নেই। সবুজ বন, হলুদ বালি, নীল টলটলে পানি আর কিছুই নেই।
সময় হয়ে আসছে। ওর অভ্যস্ত চোখ বলে দিল, মহাকাশযান যাত্রার জন্যে পূর্ণভাবে তৈরি। যন্ত্রপাতি কাজ করতে শুরু করেছে। এবার যাত্রার নির্দেশ দেয়া শুরু হয়েছে। মাথার উপরের পরিচালনা উপগ্রহ সঙ্কেত দিতে শুরু করেছে। যাত্রাপথ পরিষ্কার। রত্নার জানে কোনো যন্ত্রপাতিতে হাত দেয়ার কোনোরকম প্রয়োজন নেই। মহাকাশযান সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয়।
মহাকাশযানটি এক সময় নিঃশব্দে উঠে পড়ল। গত ২০০ বছর ধরে যে সব পরিকল্পনা কার্যকরী করা হয়েছিল এই মুহূর্তে তার শেষ পরিণতি ঘটে গেল। মহাকাশে মানুষ চাঁদ মঙ্গল অন্যান্য গ্রহাণু এবং মহাকাশ উপনিবেশে বসবাস শুরু করে দিয়েছে।
পৃথিবী থেকে মানুষের দলটি তাদের সাথে যোগ দেয়ার জন্যে এই মাত্র রওয়া হলো। ত্রিশ লক্ষ বছরের পৃথিবীর বাস শেষ হলো।
দশ হাজার বছরের পার্থিব সভ্যতার শেষ হলো। শেষ হলো চারশ বছরের ব্যস্ত এবং দ্রুত শিল্পোন্নতির পৃথিবী। আবার ফিরে গেল তার আদিম অবস্থায়। মানব সভ্যতার আদিস্থান হিশেবে পৃথিবী হয়ে রইবে স্মৃতিস্তম্ভ।
শেষ মহাকাশ ফেরিযান পৃথিবীর সর্বোচ্চ আবহাওয়ামণ্ডলের মায়া কাটিয়ে মহাকাশের আঙিনায় এসে পড়ল। পৃথিবী ছোট হতে হতে এক সময় বিন্দুতে পরিণত হলো। মহাকাশে ছড়িয়ে পড়া কোটি কোটি মানুষেরা এ কথা খুব ভালো করেই জানে যে পৃথিবীর বুকে মানুষ আর কোনোদিন পা রাখবে না।
মুক্তি পেল পৃথিবী। সত্যিই মানুষের হাত থেকে পৃথিবী মুক্তি পেল।
রে ব্রাডবেরির কাহিনি অবলম্বনে।