ছত্রাক মানুষ
নিকষ কালো রাত। আকাশে কোনো তারা দেখা যাচ্ছে না। পাতলা কুয়াশার চাদর ঝুলছে চারদিকে। আমরা তখন প্রশান্ত মহাসাগরে। আমাদের ছোট মাছধরা জাহাজটি সাগরের ঠিক কোথায় আছে তার সঠিক অবস্থান জানি না। গত সাত দিন সূর্যের দেখা মেলেনি। ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছি। এই ছোট জাহাজে আমি ছাড়া আর দু’জন নাবিক রয়েছে। তারা ঘুমুচ্ছে।
ঘন অন্ধকারের ভেতরে ছপছপ করে এগিয়ে যাচ্ছি। চারপাশে কেউ যেন আলকাতরা গুলে দিয়েছে। সেই অন্ধকারের ভেতরে হঠাৎ একটি ক্ষীণ কণ্ঠস্বর শুনে চমকে উঠলাম। কেউ যেন দুর্বল কণ্ঠে বলছে, এই জাহাজ…এই জাহাজ…
সমুদ্রে কে এমনভাবে আমাদের ডাকছে? আবার শুনতে পেলাম সেই আকুল ডাক। শরীরটা কেমন শিরশির করে উঠল। আমি এবার একটু সাহস সঞ্চয় করে বললাম, কে তুমি? কি চাচ্ছ? কোথায় তুমি?
অন্ধকার সমুদ্রে আমার ডাককে কেমন অদ্ভুত শোনাল। খানিক পরেই উত্তর পেলাম।
-ভয় পাবার কিছু নেই। আমি একজন বুড়ো মানুষ।
-তাহলে আমার পাশে আসছো না কেন? সামনে চলে এসো।
-না…না। আমি তা এখন পারছি না। আর সেটা নিরাপদ হবে না।
-কি বলতে চাইছ তুমি? নিরাপদ হবে না মানে। কে তুমি?
আর কোনো উত্তর পাওয়া গেল না। অদ্ভুত ব্যাপার। আমি তাড়াতাড়ি কয়লা ঘরে ঢুকে একটা বাতি নিয়ে এলাম। ঘন অন্ধকারে বাতির আলোটাকে কেমন ভুতুড়ে দেখাচ্ছে। আমি রেলিংয়ে ঝুঁকে বাতিটা উঁচু করে ধরে আলো ফেলার চেষ্টা করলাম। তখন সমুদ্রে একটা কান্নার মতো শব্দ শুনলাম। বাতির ক্ষীণ আলোতে আবছাভাবে মনে হলো কেউ যেন একটা ডিঙ্গি নৌকা বেয়ে যাচ্ছে। আমাদের জাহাজের একজন নাবিক তখন জেগে উঠেছে।
-কী হয়েছে জর্জ? কার সাথে কথা বলছ তুমি?
-এদিকে একটু এসো তো। ব্যাপারটা রহস্যময় লাগছে।
নাবিক উইল ঘুম ভাগা চোখে এলো। আমি তোকে এই অদ্ভুত ঘটনাটি বললাম। উইল বেশ সাহসী। সে চিৎকার করে বলল, এই নৌকো। এই নৌকো।
সমুদ্র থেকে উত্তর এলো, বাতিটা নিভিয়ে দাও।
উইল আমার হাত থেকে বাতিটা নিয়ে কয়লা ঘরে রেখে আসল। দাঁড়ের শব্দ পাওয়া গেল। কিছু দূর এসে শব্দটা বন্ধ হলো। উইল জোর গলায় বলল, আমাদের কাছে এসো। এখানে তোমার ভয় পাবার কিছু নেই। আমরা তোমার জন্য নিরাপদ।
অন্ধকার সমুদ্র থেকে শব্দ এলো, কথা দাও, এদিকে কখনও আলো ধরবে না। আমি অবাক হলাম। নিশি রাতের বুড়ো লোকটি তাহলে আলো সহ্য করতে পারে না। আবার শব্দ এলো, আমার সাথে আরও একজন কিন্তু রয়েছে। আমার স্ত্রী।
উইল বলল, আমরা তো আলো সরিয়ে ফেলেছি। এবার কাছে এসো। তোমাদের কথা বল। তোমাদের পরিচয় জানাও।
ছপছপ দাঁড় বাওয়ার শব্দ পাওয়া গেল। নৌকোটা এগিয়ে আসছে। এক সময় দাঁড়ের শব্দ থামল। আমি ঘন অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে বললাম, কি চাও আমাদের কাছে?
-খাবার চাই। খুব ক্ষুধার্ত আমরা। আমার স্ত্রীকে দ্বীপে রেখে এসেছি।
উইল কেবিন ঘর থেকে খাবার নিয়ে এলো।
-নাও, খাবার নাও। কাছে এসো।
বুড়ো উত্তর দিল, আমি তোমাদের কাছে আসতে সাহস পাচ্ছি না।
অবাক হলাম। বৃদ্ধ খাবার যন্ত্রণায় ছটফট করছে। অথচ কোনো এক অজানা ভয়ে খাবার নিতে আমাদের জাহাজের কাছে আসতে সাহস পাচ্ছে না। আমরা তখন ভাবলাম একটা বাক্সে ভরে খাবার ভাসিয়ে দেই। তাই করলাম।
তোমার কাছে আমরা খাবার পাঠাচ্ছি। কিছুক্ষণ পর অন্ধকার থেকে একটি আনন্দের শব্দ ভেসে এলো। বুঝলাম অদৃশ্য লোকটা খাবারের বাক্সটি পেয়েছে। খানিক পর লোকটি আমাদের বিদায় সম্ভাষণ জানাল। আবার দাঁড় টানার শব্দ পেলাম।
অন্ধকার সমুদ্রে আমরা বিস্ময়কর এক ঘটনার মুখোমুখি হলাম। অদৃশ্য লোকটা আবার ফিরে আসছে। দাঁড়ের শব্দ ক্রমশ কাছে আসছে। আমাদের জাহাজের সামান্য দূরে এসে থামল। অন্ধকার থেকে আবার ভেসে এলো সেই বিচিত্র শব্দ।
-এই জাহাজ।
-আবার এসেছ তুমি।
-হাঁ। চলেই গিয়েছিলাম। কিন্তু তোমাদের কাছ থেকে ভালো ব্যবহার পেয়ে ঠিক করলাম। আমাদের জীবনে যে অন্ধত্ব ঘটনা ঘটে গেছে তা তোমাদের কাছে খুলে বলব। অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক জীবন আমাদের। সেই কতদিন থেকে এই দুর্বিসহ জীবনের বোঝাকে টেনে নিয়ে বেড়াচ্ছি।
-কতদিন থেকে? জানতে চায় উইল। সেই অ্যালবাট্রোস জাহাজডুবির পর থেকে।
আমাদের মনে পড়ল সেই জাহাজটি নিউ ক্যাসেল থেকে মাস ছয়েক আগে ফ্রিসকোর দিকে রওনা দিয়েছিল। এরপর থেকে ঐ জাহাজটির আর কোনো খবর নেই।
-কী হয়েছিল অ্যালবাট্রোস জাহাজের?
-প্রবল এক ঝড়ের মধ্যে পড়েছিল। জাহাজের মাস্তুল ভেঙে গেল। পাল ছিড়ে গেল। ভোরে দেখি জাহাজের নিচে মস্ত বড় ফুটো। কলকল করে পানি ঢুকছে। জাহাজ ডুবে যাচ্ছে। অন্য নাবিকেরা লাইফ বোটে উঠে পড়েছে। শুধু আমি ও আমার স্ত্রী মালপত্র গোছাতে দেরি করায় তারা আমাদের ফেলে রেখে চলে গেল। আমরা তখন কোনোমতে ছোট্ট একটা ভেলা বানিয়ে তাতে উঠে পড়লাম। তারপর ভেসে গেলাম অজানার উদ্দেশে। ভোরবেলায় দেখলাম আমরা একটি লেগুনের মধ্যে ঢুকে পড়েছি। পাতলা কুয়াশার ভেতরে দেখলাম সামনে একটি জাহাজের কাঠামো ভাসছে। আমাদের ভেলাটি ঐ জাহাজের কাছে গেল। চিৎকার করে ডাকাডাকি করলাম কিছুক্ষণ। জাহাজ থেকে কোনো প্রত্যুত্তর পেলাম না। ভেলাটিকে জাহাজের একপাশে নিয়ে লাগালাম। একটা কাছি ঝুলছে। সেটাকে ধরে উপরে উঠতে আরম্ভ করলাম। কাছিটি বেশ পিছল। এক ধরনের ধূসর শেওলা কাছিতে জড়িয়েছিল। ফলে আমাদের উঠতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল। জাহাজের গায়েও ঐ রকম শেওলার পুরু আস্তরণ দেখলাম। কোনোমতে হাত-পা দিয়ে আঁকড়ে ডেকে প্রবেশ করলাম। শরীরের অনেক অংশ ঘষটানিতে ছিলে গেল। গিয়ে দেখি সারা ডেকজুড়ে শেওলা ছড়িয়ে আছে। মনে হলো এগুলো বিশেষ এক জাতের ছত্রাক। কোনো কোনোটি গোলাকার পিণ্ডের মতো। কোনো কোনোটি আবার কয়েক ফুট উঁচু। জাহাজটিতে কোথাও কোনো মানুষের দেখা পেলাম না। অন্যপাশে একটি দড়ির মই দেখতে পেলাম। আমার স্ত্রী সেটা বেয়ে উপরে উঠে এলো। আমরা তখন জাহাজের দুটো কেবিনকে পরিষ্কার করলাম। যাতে কোনোরকমে সেখানে থাকা যায়। অল্প পরিমাণে খাবার পেলাম। তবে পরিষ্কার পানির পাত্র পেলাম।
কদিন আমরা সেই জাহাজেই কাটালাম। বিস্মিত হয়ে দেখলাম। ছত্রাকের সেই গোলাকার পিণ্ডগুলো ক্রমশ বড় হয়ে কেবিনের মেঝে ও দেয়ালকে ছেয়ে ফেলেছে। আমরা সেগুলো চেঁছে পরিষ্কার করলাম।
কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার হলো চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই তারা আবার আগের মাপে বেড়ে উঠল।
সাতদিন পর এক সকালবেলা আমার স্ত্রী তার মুখের পাশে ছোট ফুটকি দেখতে পেল । আমি তা দেখে একটু চমকে উঠলাম। বুঝলাম জাহাজে থাকা মোটেই নিরাপদ না। তাড়াতাড়ি জিনিশপত্র গোছাতে লাগলাম। ধূসর ছত্রাক ততক্ষণে তাদের কাজ শুরু করে দিয়েছে। আমার স্ত্রীর শালের পাড়েও তা ছড়িয়েছে।
ভেলাটি তখনও জাহাজের পাশে ছিল। আমরা সেটায় করে তীরে পৌঁছলাম। যতই তীরের কাছাকাছি হচ্ছি দেখছি সেখানে যেন ছত্রাকে ছত্রাকে এক ভয়ঙ্কর দাঙ্গা বেধে গেছে। কোথাও ঢিপির আকারে সেগুলো গজিয়ে উঠেছে। বাতাসে সেগুলো কেঁপে ওঠে। কোথাও তা বিরাট আঙুলের মতো। কোথাও মাটির সাথে মসৃণভাবে লেপটে রয়েছে।
সমুদ্রের তীরে এমন কোনো স্থান নেই যেখানে এ ধরনের ছত্রাক লুকানো অবস্থায় ছিল না। বেশ কিছু দূর যাওয়ার পর আমরা একটা ফাঁকা জায়গা পেলাম। বালুময় জায়গা। সেখানে কোনো ছত্রাক নেই। বাকি সব জায়গা ছিল ধূসর ছত্রাকে ভরা। থিকথিক করছে। এটাই অন্তত একটি জায়গা যেখানে কোনো ছত্রাক নেই। সেখানে আমাদের জিনিশপত্রগুলো রাখলাম। আমি আবার জাহাজে ফিরে গেলাম। সেখান থেকে সংগ্রহ করলাম একটি পাল। তা দিয়ে আমি কোনোমতে দুটো তাঁবু তৈরি করলাম।
সপ্তাহখানেক কেটে গেলে কোনো ঝুট ঝামেলা ছাড়া। একদিন আমার স্ত্রী দেখল তার ডান হাতের বুড়ো আঙুলে ফুটে উঠেছে সেই ফুটকি চিহ্ন। একটা গোল দাগ। ধূসর বর্ণের একটি আঁচিল। সেটা দেখে আমি ভীষণ ভয় পেলাম।
আমার স্ত্রী বলল, তোমার মুখের পাশে, কানের কাছে, চুলের নিচে ওসব কিসের দাগ? বুঝলাম জীবাণু আমাদের আক্রমণ করেছে। মৃত্যুচিন্তা আমাদের আচ্ছন্ন করল। একবার ভাবলাম জিনিশপত্র নিয়ে সমুদ্রে ফিরে যাই। কিন্তু অসহায় আমরা। ধূসর ছত্রাক আমাদের শরীরের কোষপিণ্ডকে আক্রমণ করেছে। তার হাত থেকে যেন মুক্তি নেই।
আমাদের তখন সেই নির্জন উপত্যকায় অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। ধূসর ছত্রাক ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতে লাগল। আমরা তার বিরুদ্ধে লড়াই করে চলেছি।
মাঝে মাঝে যেতাম সেই ভাঙা জাহাজটিতে। ভাঁড়ারে খোঁজ করতাম খাবারের। সেখানেও তখন বেড়ে চলেছে ছত্রাক। ডেকে গজিয়ে ওঠা ছত্রাক পিণ্ডগুলো তখন আমার মাথা সমান উঁচু হয়ে গেছে। বুঝতে পারছিলাম, এই দ্বীপ ছেড়ে যাওয়ার কোনো উপায় আমাদের নেই। মারাত্মক এক রোগ আমাদের আক্রমণ করেছে। এ নিয়ে সুস্থ সমাজে আর কোনোভাবেই ফিরে যাওয়া যাবে না।
বুড়ো লোকটির কণ্ঠস্বর আর্দ্র হয়ে এলো।
আমাদের খাদ্য সঙ্কট দেখা দিল। লেগুনে মাছ ধরার চেষ্টা করলাম। ব্যর্থ হলাম। এরপর গেলাম সমুদ্রে মাছ ধরতে। অল্প পরিমাণে মাছ। এ দিয়ে খিদে নিবৃত্ত হয় না।
একদিন ছত্রাকের জঙ্গলে প্রবেশ করলাম। হঠাৎ বাম দিকে একটা কর্কশ শব্দ শুনতে পেলাম। সাথে সাথে সেদিকে ফিরে দেখি আমার কনুইয়ের পাশে বিভিন্ন আকারের ছত্রাক দুলছে। মনে হলো তাদের যেন প্রাণ আছে। হঠাৎ সেদিকে তাকিয়ে থাকতে একটি অদ্ভুত রকমের চিন্তা আমার মাথায় এলো। মনে হলো এই অদ্ভুত আকারের ছত্রাকগুলো হলো বিকৃত চেহারার মানুষ। আমার মাথায় ঝিলিক দিয়ে গেল এই চিন্তাটা। কান্নার ধ্বনি শুনতে পেলাম। একটা শাখার মতো হাত তার চারপাশের গুল্মলতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ধেয়ে আসছে আমার দিকে। এক ভয়াবহ বিচিত্র রোগ আমাদের ক্রমশ অস্থির করে তুলল। আমাদের শরীরে সেই কোষপিণ্ড অস্বাভাবিক দ্রুততার সাথে ছড়িয়ে গেল। কোনোকিছুতে আর প্রতিরোধ করা গেল না। আমরা যে একদিন মানুষ ছিলাম তা ধীরে ধীরে লুপ্ত হলো। দিন দিন বৃদ্ধি পেল ছত্রাক খাবার স্পৃহা। আমরা পরিণত হয়েছি ছত্রাকের গুল্মে। আজ সমুদ্রে এসেছিলাম মাছ ধরতে। তোমাদের জাহাজ দেখে খাবারের জন্যে ডাক দিলাম। তোমরা আমাদের অনেক উপকার করেছ। খাবার দিয়েছ। বিদায়।
তখন ভোর হয়ে আসছে। হালকা আলো চারপাশে। সমুদ্রের বুকে নরম আবহাওয়া। আমরা দেখতে পেলাম অপসৃয়মাণ নৌকোটিকে। দাঁড়ের পাশে যেন বসে রয়েছে স্পঞ্জের একটা পিণ্ড। রহস্যময় ছত্রাক মানুষ। ঐ মানুষের কোষপিণ্ডে গজিয়েছে ধূসর শৈবাল। কি অদ্ভুত পরিণতি। মাথা নিচু করে দাঁড় টানছে ছত্রাক মানুষ। দ্বীপে রয়েছে ওর স্ত্রী। ওরা আর কোনোদিনই সভ্য সমাজে ফিরে আসবে না।
কুয়াশার ভেতরে ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল সেই বিচিত্র প্রাণি। দাঁড় টানার শব্দ আর পাওয়া যাচ্ছে না।
উইলিয়াম হোপ হডসনের কাহিনি অবলম্বনে।