সন ’৪২
১৯৪২ সনের ৯ আগস্ট গাঁধীজিসহ কংগ্রেস নেতৃবৃন্দর গ্রেফতার হওয়ার খবর সকালবেলায়ই কলকাতায় পৌঁছে যায়। তার সঙ্গে সঙ্গে সত্যমিথ্যা নানা গুজবও আমাদের কানে আসে। সত্যি খবর—বোম্বাইয়ের রাস্তায় বলতে গেলে জনতার প্রকাশ্য বিদ্রোহ হয়েছে। সমস্ত কারখানা, অফিস, দোকানবাজার, স্কুলকলেজ সব বন্ধ হয়ে গেছে। বারবার গুলি চালানো সত্ত্বেও ক্ষিপ্ত জনতাকে সরকার বাগে আনতে পারেনি। ওই শহরে সরকারের অধিকার ফিরে পেতে তিন দিন লেগেছে। ইংরেজের বিরুদ্ধে এই স্বতঃস্ফূর্ত বিদ্রোহ ভারতবর্ষের নানা জায়গায়ই রাতারাতি ছড়িয়ে পড়েছিল। আর খবরের মধ্যে ভুয়া গুজব ছিল—সেনাবাহিনীতে বিদ্রোহ হয়েছে। অনেক জায়গায়ই পুলিশ সরকারের আদেশ অমান্য করে বিদ্রোহী জনতার সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। দেশের এক বিস্তৃত অঞ্চলে জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
গত চার দশকের গবেষণার ফলে আগস্ট আন্দোলনে সত্যিতে কী হয়েছিল সে সম্পর্কে আমাদের ধারণা কিছুটা স্পষ্ট হয়েছে, যদিও জাতীয়তাবাদীদের দিক থেকে ওই ঘটনা সংক্রান্ত যেসব তথ্য পাওয়া গেছে তা ব্যবহার করে আন্দোলনের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস এখনও কেউ লেখেননি। সেই ইতিহাসের উপর আলোকপাত করা এই পরিচ্ছেদের উদ্দেশ্য না। অন্য কয়েক লক্ষ কিশোরের মতো বর্তমান লেখকও ওই আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েছিল। কিন্তু আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা যে-অঞ্চলে সীমাবদ্ধ ছিল, অর্থাৎ বরিশাল জেলা, সেখানে আন্দোলন দানা বাঁধতে পারেনি। সুতরাং এ বিষয়ে আমার স্মৃতির ঐতিহাসিক তথ্য হিসেবে মূল্য খুবই সামান্য, নেতিবাচক বললেও ভুল হয় না।
৯ আগস্ট সকাল থেকেই কলকাতায় কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটে ঠিকই, কিন্তু পুলিশ সহজেই তার মোকাবিলা করতে পেরেছিল বলে আমার ধারণা। সকাল দশটা নাগাদ অন্যান্য কলেজের ছাত্রদের নিয়ে বেশ বড় একটি শোভাযাত্রা ‘ইংরেজ ভারত ছাড়ো’, ‘করেঙ্গে ইয়ে মরেঙ্গে’ ইত্যাদি স্লোগান দিতে দিতে হেদুয়া পৌঁছয়। ক্লাস সেদিন ঠিক বসেনি। ছেলেরা কলেজের চৌহদ্দির ভিতর এবং হেদুয়ায় জলাশয়ের চারপাশে ইতস্তত ঘুরে বেড়াচ্ছিল। বোধহয় গোলমালের আশঙ্কায় মেয়েরা প্রায় কেউই আসেনি। শোভাযাত্রা হেদুয়ায় পৌঁছান মাত্র সবাই দৌড়ে গিয়ে মিটিংয়ে যোগ দিল। একটি পুলিশের গাড়িও এসে পার্কের রেলিংয়ের বাইরে দাঁড়াল। দু-একটি বক্তৃতা এবং সাম্রাজ্যবাদবিরোধী প্রস্তাবের পর মিছিল আবার রাস্তায় বের হল। পুলিশের গাড়ি আমাদের পিছু নিল, কিন্তু অনেকটা পথ কোনও বাধা দিল না। ঠিক কোথায় মনে পড়ে না, সম্ভবত মেডিক্যাল কলেজ ছাড়িয়ে পুলিশ আমাদের পথরোধ করল। তারপর কাঁদুনে গ্যাসের তীব্র গন্ধ নাকে এল এবং তার সঙ্গেই বন্দুকের ফাঁকা আওয়াজের শব্দ পেলাম। আওয়াজটা যে ফাঁকা তা আমরা তখন বুঝতে পারিনি। বলতে লজ্জা হয়, বন্দুকের শব্দে আমরা দৌড়ে পালালাম। এই প্রসঙ্গে একটা কথা উল্লেখযোগ্য। এই ঘটনার প্রায় চার বছর পরে কলকাতার ছাত্ররা আই.এন.এ নেতাদের মুক্তির দাবিতে আন্দোলন করে। পর পর দু দিন তাদের উপর গুলি চলে। সত্তর-আশি জন ছাত্র মারা যায়। তখন কিন্তু কেউ পালায়নি। এই সময় একটা কথা খুব শুনতাম : বৈপ্লবিক অবস্থা, ‘রেভোলিউশনারি সিচুয়েশন’। হয়তো ১৯৪৬ এর আগে আমরা ওই অবস্থায় পৌঁছইনি।