বড়হিস্যার বাড়ি
আয়ুর্বেদশাস্ত্রী বৈদ্যবংশের সন্তান দেওয়ান কৃষ্ণকুমার সেন সম্ভবত আঠারো শতকের কোনও সময়ে ভূষণার সত্রাজিত রায়ের বংশধর রায়কাঠির রাজার কাছ থেকে প্রভুভক্তির পুরস্কার হিসাবে কীর্তিপাশা গ্রাম তালুক পান। তাঁর দুই ছেলের নামে তালুকের নাম হয় রাজারাম সেন কাশীরাম সেন তালুক। জ্যেষ্ঠ রাজারাম সম্পত্তির দশ আনা অংশ পেয়ে বড় হিস্যার বাড়ি প্রতিষ্ঠা করেন। ছয় আনার অংশীদার কনিষ্ঠ কাশীরামের বংশধররা ছোট হিস্যার বাড়ি বলে পরিচিত হন। চকমিলান মিনি প্রাসাদটি কখনও বোধ হয় একটি বাড়িই ছিল। দুই হিসায় মামলা-মোকদ্দমা লাঠালাঠি নিয়ে ঝগড়াটা জমে উঠলে বার্লিন শহরের মতো মাঝখানে দেওয়াল তুলে এক বাড়ি দুই বাড়িতে পরিণত হয়। দুই বাড়িই প্রায় একই চেহারার দুর্গাদালান আর থিয়েটারের জন্য বাঁধা আটচালায় শোভিত ছিল। শুধু বংশের রক্ষয়িত্রী দেবী সিদ্ধেশ্বরীর বাড়ি বড় হিস্যার ভাগেই পড়েছিল। এ সব কথাই ‘রোমন্থন’-এ লিখেছি। এখানে সংক্ষেপে পুনরাবৃত্তি করলাম।
যদিও আমরা বরিশালের বাংলো বাড়িতেই বছরের দশ-এগারো মাস থাকতাম, জ্ঞান হওয়া অবধি জানতাম যে, আমাদের সত্যিকার বাড়ি কীর্তিপাশা গ্রামে বড় হিস্যার জমিদারবাড়ি—যেখানে আমরা সসাগরা ধরণীর অধীশ্বর। বরিশালের বাড়িটি বাসা মাত্র, নিতান্তই ক্ষণকালের আস্তানা।
প্রপিতামহ প্রসন্ন সেন ক্ষমতাশালী পুরুষ ছিলেন। জানি না, ইংরেজ পরিবারে মানুষ হয়ে ওঁর ইংরাজি কেতার কর্মক্ষমতা জন্মেছিল কি না। উনি সম্পত্তি বহুগুণ বাড়িয়েছিলেন এবং ওঁরই আমলে বড় হিস্যার এক মহলা বাড়ি দুই মহলায় পরিণত হয়। অর্থাৎ একটি চক বা প্রশস্ত উঠোন ঘিরে বড় দোতলা বাড়িটিকে বাড়িয়ে আর একটি মহল অর্থাৎ একই চেহারার দ্বিতীয় চক ঘিরে এক নম্বর মহল সংলগ্ন আর একটি দোতলা দালান তৈরি হয়। বাইরের মহলের প্রশস্ত ছাদে আমার ঠাকুর্দার বসবার একটি ঘর ছিল। তার ঠিক উপরে আর একটি ঘর। সেখানে কাঠের সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হত, পূজার সময় চারতলার ঘরটিতে বাল্যখিল্যদের সারা রাতের আড্ডা জমত।
প্রসন্নকুমার ঢাকা গিয়ে মৌলবিদের কাছে ফার্সি শেখেন। বড় হিস্যার বাড়ির হলঘরে অনেকগুলি বড় বড় বইয়ের আলমারি ছিল, তার একটি ফার্সি বইয়ে ভর্তি। ওই সংগ্রহটি প্রপিতামহের সময়ে শুরু হয় বলে আমার ধারণা। ওর একটি বড় অংশ লখনউয়ের মুন্সি নওলকিশোরের লিথোপ্রেসে ছাপা, বাকি বইগুলি এশিয়াটিক সোসাইটির Bibliotheca India সিরিজের। প্রসন্নবাবু রেলপথ হওয়ার অনেক আগেই জল এবং স্থলপথে সারা ভারতবর্ষ ঘুরে বেড়ান। ওঁর এই ভ্রমণের নেশা জিন মারফত আমার রক্তস্রোতে কিছুটা পৌঁছেছে মনে হয়। যখনই সুযোগ পাই বিপুলা এ পৃথিবীর নানা জায়গায় পথে-বিপথে ঘুরে বেড়াই। তবে ভ্রমণের সঙ্গে সঙ্গে প্রপিতামহ শ্বেতপাথরের আসবাবপত্র এবং বাসনকোসন সংগ্রহ করতেন—মুখ্যত আগ্রা এবং জয়পুর থেকে। জায়গা এবং অর্থের অভাবে ওটা আমার ঠিক হয়ে ওঠে না। বিরাট বিরাট ভড় সেই পাথরের তৈরি আসবাব নিয়ে কীর্তিপাশার খাল অবধি আসত-সোজা আগ্রা থেকে। খাল তখনও যথেষ্ট গভীর বলেই সম্ভব হত। এসব কথা শৈশবে গ্রামবৃদ্ধদের কাছে শুনেছি, তাঁদের শৈশবস্মৃতি হিসাবে।
প্রসন্নবাবু মাত্র চৌত্রিশ বছর বয়সে কলেরায় মারা যান—চারটি পুত্র সন্তান এবং বেশ ক’টি কন্যা সন্তান রেখে। কন্যাদের সদ্বংশীয় স্বজাতি-পুত্র দেখে বিয়ে দেওয়া হত এবং জামাইরা ঘরজামাই হয়ে সেরেস্তায় চাকরি করতেন (এ প্রসঙ্গে দীনবন্ধু মিত্রর ‘জামাই বারিক’ দ্রষ্টব্য)। কন্যারা পিতৃগৃহেই থাকতেন। দুর্গাস্তব মারফত বাঙালি হিন্দুমাত্রেই জানেন যে, দেবী নানা রূপে সর্বভূতেষু সংস্থিতা। তবে সাক্ষাৎ মহিষমর্দিনীরূপে সংস্থিতা হওয়ার জন্য বাবার পিসিমাদেরই উনি বেছে নিয়েছিলেন। মর্দনের কাজটা মহিষাসুরের উপর না হয়ে প্রধানত স্বামীদের উপরই হত। এই হতভাগ্যদের দুই একটিকে ছোটবেলায় দেখেছি। তাদের ভীতত্রস্ত চলাফেরায় বিবাহের সুখস্মৃতি চিরকালের মতো মুদ্রিত হয়ে গিয়েছিল। নারীবাদীরা role model-এর খোঁজে আমার এই পিতৃ-পিতৃষ্বসাদের জীবন ও চরিত্র সমীক্ষা করতে পারেন। পুরুষশাসিত সমাজ? ওঁদের শাসন করবে এমন পুরুষ দ্বাপর-ত্রেতায়ও জন্মায়নি। স্বয়ং রাবণ ওঁদের দেখলে ইঁদুরের গর্তে ঢুকতেন।
ঠাকুর্দারা চার ভাই একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে ক্রমে পৃথগন্ন হন। তিন ভাই কীর্তিপাশায়ই থেকে যান। কনিষ্ঠ, আমার ঠাকুর্দা, বরিশালে বাস করতে শুরু করেন। কীর্তিপাশার বাড়িতে চার ভাইয়ের জন্য আলাদা আলাদা কয়েকটি করে ঘর ছিল। দোতলায় চকের একদিকে রেলিংয়ের পাশ ধরে উঁচু বারান্দা, তার পাশে কয়েক সিঁড়ি নেমে এইসব ঘর। এই ঘরগুলিতে পরে চার ভাইয়ের ছেলেরা সপরিবারে বাস করতেন। বারদালানে বিশাল হল ঘর বড় বড় বইয়ের আলমারি, ঝাড়লণ্ঠন ওরফে শ্যাভেলিয়ের, শ্বেতপাথরের টেবিল আর বেঁটে বেঁটে কিছু সিংহাসন, কিছু তৈলচিত্রচার ভাইয়ের এবং তাঁদের মা ষষ্ঠীপ্রিয়া দেবীর (উনিও মহিষমর্দিনীর অংশাবতার ছিলেন বলে শুনেছি) আর বড় ঠাকুর্দার শখের ফোটোগ্রাফির ‘ফলশ্রুতি’ —এক বিশাল ট্রাঙ্ক ভর্তি ফোটোর নেগেটিভ। হলের এক কোনায় আর একটি ট্রাঙ্কে শখের থিয়েটারের জন্য সাজপোশাক, ঝুটা গয়নাগাটি, টিনের তলোয়ার জাতীয় অস্ত্রশস্ত্র। ভব্যজনদের আপ্যায়ন আর প্রজাদের নালিশ-ফরিয়াদ শোনা এই ঘরেই হয়। ‘উত্তরের কোঠা’ (বরিশালি উচ্চারণে ‘কোডা’) নামধেয় বৈঠকখানাটি ছিল জলসাঘর। লখনউ-বারাণসীর বাইজিদের খেয়াল-ঠুংরির আওয়াজ এবং নূপুর কিঙ্কিণী—এক সময় ওই ঘর থেকেই শোনা যেত। তবে তা আমাদের জন্মের আগে। একতলার সামনের দিকে সারি সারি ঘরজমিদারির দফতরখানা তথা সেরেস্তাঘর। সেরেস্তার কর্মচারীদের অনেকের ওইখানেই শয়ন। ওই ঘরগুলির পাশেই বেশ জমকালো ‘সিংদরজা’ অর্থাৎ সিংহদ্বার। প্রতিমা বিসর্জনের দিন এই দরজা দিয়ে শোভাযাত্রা করে দেবীর নিষ্ক্রমণ হত। আর বিয়েসাদিতে বরকে পালকি চড়িয়ে এই দরজা দিয়েই আনা হত। সিংহদ্বার দিয়ে চকে ঢুকলে ডাইনে দুর্গাদালান–যার পশ্চিমবঙ্গীয় নাম চণ্ডীমণ্ডপ। তার মুখোমুখি আটচালা, শখের থিয়েটারের জন্য বাঁধানো স্টেজ। দেবীদের পূজার সময় ওই আটচালার জমিতে হাড়িকাঠ বসানো হত। আটচালার পেছনে এবং একপাশে মাটির উপরে এবং নীচে অনেকগুলি ছোট ছোট ঘর–অন্ধকার, স্যাঁতসেঁতে। পিতল, কাঁসা, পাথর আর রূপার কাড়ি কাড়ি বাসন, থিয়েটারের সাজসরঞ্জাম, ঢাল, তলোয়ার, ল্যাজা, সড়কি ইত্যাদি প্রাক-আধুনিক যুদ্ধাস্ত্র এইসব ঘরে রাখা থাকত। হাঁড়ি-কুড়ি যা ছিল তার এক-একটিতে একশো লোকের রান্না হতে পারত। দেবীর ভোগের থালা বারকোসগুলিও অনুরূপ মাপের। মাটির নীচের ঘরগুলির মধ্যে একটি ছিল ‘আন্ধারিয়া কোঠা’। জনশ্রুতি—ওই ঘরে অবাধ্য প্রজা তথা শত্রুপক্ষের লেঠেলদের গুম করা হত।
আমরা বছরে একবার কি দুইবার জলপথে কীর্তিপাশা যেতাম। খুব ছোটবেলায় আমাদের ছয়-দাঁড়ের গ্রিনবোট বা বজরা করে যেতাম। পরে ভাড়া করা কোশ নৌকায়। বরিশাল থেকে কীর্তিপাশা ষোল মাইল। গ্রিন বোটে ওই পথ যেতে প্রায় পুরো একদিন লাগত, আর দুই দাঁড়ের কোশ নৌকোয় আট-দশ ঘণ্টা। কিন্তু ওই নৌকাযাত্রাটাই আমাদের এক মহা উৎসব ছিল। পথে সুজার কেল্লা (যেখানে নাকি ভ্রাতৃযুদ্ধে পরাজিত শাহ সুজা আরাকান পালাবার পথে ক্ষণস্থায়ী মাটির কেল্লা গড়েছিলেন), নলছিটি, ঝালকাঠি বন্দর। নদীর পাড়ে মাঝে মাঝে ক্ষিরাই আর মর্মার ক্ষেত। দুই-ই শসাজাতীয় অতি সুস্বাদু, সবজি বলুন সবজি, ফল বলুন ফল। একটি গোলাকার, অন্যটি জাম্বো সাইজের। নৌকা থামিয়ে ক্ষেতের মালিককে সামান্য কিছু পয়সা দিয়ে আমরা যথেচ্ছ খেতাম। আর জেলেরা মাঝে মাঝে ইলিশ মাছের জাল তুলত। জালের কালো সুতোর আড়ালে রৌদ্রে উজ্জ্বল রূপার ঝকমকি। ইলিশ মাছ জলের বাইরে দু-এক সেকেন্ড মাত্র বাঁচে। সেই সদ্য ধরা ইলিশ মাছ জেলেদের কাছ থেকে কিনে ভেজে খাওয়া হত। ও বস্তু পেলে দেবতারা তুচ্ছ অমৃত খেতে যেতেন না—এ বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ।
নদী ছেড়ে খাল বেয়ে বড় হিস্যার বাড়ির ঘাটে পৌঁছতাম। সেখানে কর্মচারী মেরধা তথা ভাই এবং কাকাদের রিসেপশন কমিটি তৈরিই থাকত। পৌঁছানো মাত্র ‘আইয়া গ্যাছে, আইয়া গ্যাছে’ বলে একটা ধ্বনি উঠত। খালের ধারে প্রথমেই চোখে পড়ত ডাঙায় তোলা ভাঙা গ্রিনবোটটি। বড় হয়ে মনে হত ওটি আমাদের অবক্ষয় এবং দুর্ভাগ্যের প্রতীক। পূর্বপুরুষ জমিদারি স্থাপন করেছিলেন, প্রপিতামহ তার সমৃদ্ধি বাড়িয়েছিলেন, ঠাকুর্দা এবং তার দাদারা সেই সম্পদ ভোগ করেছেন, বাবা-জ্যাঠাদের আমলে আমাদের সৌভাগ্যসুর্য অস্তমুখী। কিছুটা অর্থাভাবে, কিছুটা উদ্যোগহীনতার ফলে সর্বত্রই ভাঙনের চিহ্ন। বজরা আর সারানো হয় না, শহরের বাড়ির পুকুর সংস্কারের অভাবে মজে যায়। জমিদারভবনের দেওয়াল ফুঁড়ে বট-অশ্বথের চারা গজায়। মালিকদের কিছুতেই যেন তাপ-উত্তাপ নেই।
এই প্রসঙ্গে জমিদারি প্রথা সম্পর্কে দুই-একটি কথা বলতে চাই। এই প্রথা নিয়ে ভালমন্দ অনেকে অনেক কিছু বলেছেন। কিন্তু Floude Commission-এর রিপোর্ট ছেড়ে দিলে প্রথাটির যে-চেহারা আমি দেখেছি, তার সঙ্গে মেলে এমন বাস্তব বিবরণ আর কোথাও পাইনি। এক-এক জন অদ্ভুত সব কাল্পনিক তথ্য পরিবেশন করেছেন। একজন লিখেছেন—সারাদিন হেঁটেও তাদের সম্পত্তির সীমানা পার হওয়া যেত না। ভদ্রলোক বোধহয় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের কথা ভাবছিলেন। আসলে জমিদারি সম্পত্তি ওরকম এক নাগাড়ে একশো-দুশো মাইলব্যাপী হত না। বড় জমিদারিগুলি একটার পর একটা মহাল বা তালুক সংগ্রহ করে গড়ে উঠত। মহাল মানে revenue unit-সরকার বাহাদুরের নথিপত্রে যার জন্য দেয় একটা বাঁধা খাজনা ধরা থাকত। সাধারণত বিশেষ বিশেষ জমিদারির সম্পত্তি যেসব মহাল, তা ছড়ানো ছিটানো থাকত, পরস্পরসংলগ্ন প্রায় কখনওই না। আমাদের কীর্তিপাশা গ্রামের মধ্যেই অন্য তালুকদারের ছিট তালুক ছিল–যা আমাদের সম্পত্তির অংশ না।
জমিদারদের দুরবস্থার সূচনা হয় দুই কারণে। প্রথম কথা বংশানুক্রমে শরিক বা অংশীদারের সংখ্যা বাড়তে থাকে। প্রপিতামহ একাই মালিক ছিলেন, তার ছেলেরা চার শরিক আর বাবা-জ্যাঠাদের সময় শরিক-সংখ্যা বারো। প্রথাটি বজায় থাকলে আমাদের আমলে সতেরো জন শরিক হত। অথচ সম্পত্তির আয় বাড়ছিল না, কমছিল। কমার কারণ অব্যবস্থা। খাজনা আদায়ের ভার ম্যানেজারের হাতে ছেড়ে দেওয়া হত। তিনি নায়েব-গোমস্তা-তহশিলদারদের উপর নির্ভরশীল। কর্তারা যখন কিছু দেখেন না, পরস্পর শরিকি ঝগড়াঝাটিতে এবং সমাধানহীন দুশ্চিন্তায় মগ্ন, তখন ম্যানেজারের কী দায় পড়েছে সুস্থ শরীর ব্যস্ত করার? যাঁদের উপর খাজনা সংগ্রহের ভার, তারা শক্তের ভক্ত, নরমের যম। অর্থাৎ বর্ধিষ্ণু প্রজাদের কাছে কেঁচো। তাদের সঙ্গে শলাপরামর্শ করে নিজের ট্যাঁকে কিছু পয়সা গুঁজে সস্তায় জমি বন্দোবস্ত করেন। অসহায় দরিদ্র প্রজাদের কাছে নৃসিংহ অবতার। কিন্তু যাদের কিছুই নেই, তাদের কাছ থেকে বেশি কিছু বের করা অসম্ভব। ইংরিজি প্রবাদে বলে—পাথর নিংড়ে রক্ত বের করা যায় না। প্রজার সর্বনাশ হত ঠিকই, কিন্তু জমিদারের ভোগে লাগত না। বাবুরা সবই জানেন। কিন্তু কিছু করার ক্ষমতা বা উৎসাহ প্রায় নিঃশেষ হয়ে গেছে। সরকারের খাজনা, সেরেস্তার খরচা এবং মানেজারের মাইনে দিয়ে যা বাকি থাকত তা বারো শরিককে তাদের ন্যায্য অংশ অনুযায়ী মাসে মাসে ‘অ্যালাউয়েন্স’ বা মাসোহারা দেওয়া হত। যাদের অংশ এক আনা, তাদের অ্যালাউয়েন্স কখনও কখনও দুই ঘরের অঙ্কে নামত। খাজনা আদায় খারাপ হলে সেরেস্তার জমানো টাকা থেকে ধার দেওয়া হত। অথচ এজমালি সম্পত্তির বাঁধা খরচা মানে জমিদারি ফুটানির বহিঃপ্রকাশ, যথা বিনা প্রয়োজনে ডজন ডজন ঝি-চাকর পালন, পূজা-আর্চা, পুণ্যাহ ইত্যাদিতে ব্যয়বাহুল্য এক চুলও কমানো হত না। কমালে মান থাকে না। আর মামলা-মোকদ্দমা, বিশেষত ছোট হিস্যার সঙ্গে, ক্ষীয়মাণ রোজগারের একটা বড় অংশ শুষে নিত। কর্তারা বছরে দু-তিনবার সম্পত্তি-সংক্রান্ত মিটিংয়ে বসতেন। যত দূর জানি, তাতে ঝগড়াঝাটিই হত, কোনও সিদ্ধান্ত হত না। বেশ কয়েক জন শরিকের সিদ্ধান্তে পৌঁছবার মতো বিদ্যাবুদ্ধিও ছিল না। বারবার আলোচনা হয়েছে সম্পত্তি পার্টিশন করে নেওয়ার, যাতে যে যার নিজের ব্যবস্থা করে নিতে পারে। ব্যস, ওই পর্যন্তই।
ত্রিশ এবং চল্লিশের দশকে তারাশঙ্কর আর বনফুলের কিছু কিছু রচনায় জমিদারি ঐতিহ্যর এক রোমান্টিক চেহারা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। অবশ্যি তারাশঙ্কর তার শেষের দিকের লেখায় জমিদারদের অবক্ষয় এবং অপদার্থতার কথাই তুলে ধরেছেন। কোনও কালে তাদের পিতৃপুরুষ গরিব চাষির শ্রমের ফল শুষে নিয়ে চোখধাঁধানো বিলাসিতা করেছেন, ইংরাজ কোম্পানির সুবাদে বেনিয়ানির পয়সায় সম্পত্তি কিনে অভিজাত বনার চেষ্টা করেছেন—এ নিয়ে গৌরব করার হেতু কী, আমি কোনও দিনই বুঝতে পারিনি। অথচ অনেক মধ্যবিত্ত বাঙালিই জমিদার বংশের সন্তান বলে বিশেষ গর্ববোধ করেন। মধ্যস্বত্বভোগী নিম্নমধ্যবিত্ত ভদ্রলোকদেরও ‘ভূস্বামী’ বলে দেমাক করতে দেখেছি।
অন্যের পরিশ্রমের ফল বংশানুক্রমে ভোগ করে নিষ্কর্মা জীবনযাপন করায় গর্বের কী আছে এ প্রশ্নের সত্যিই কোনও সদুত্তর নেই। আর অধিকাংশ ক্ষেত্রে জমিদাররা বেনিয়ান মুৎসুদ্দির বংশধর। পুরনো আমলের রাজা-মহারাজারা বেশির ভাগই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ‘সূর্যাস্ত আইন’-এর ফলে পথে বসেন। আর রাজা-মহারাজারাও যে সংস্কৃতি এবং সুকৃতিতে উজ্জ্বল জীবন যাপন করতেন এমন না। মাত্র দু-চারজনই এ নিয়মের ব্যতিক্রম। সুতরাং অভিজাত শব্দটা এলোপাথাড়িভাবে জমিদার পরিবার সম্পর্কে প্রয়োগ করা ঠিক না, এমনকী জোড়াসাঁকো-পাথুরিয়াঘাটার ঠাকুর পরিবারও কোম্পানির বেনিয়ানদের বংশধর।
ছেলেবেলায় আমাদেরও জমিদারের বাচ্চা বলে বেশ দেমাক ছিল। তার এক কারণ, গ্রামে গেলে চারপাশের লোক এবং ‘প্রজাপুঞ্জ’ অর্থাৎ রায়তরা আমাদের এত তোলা-তোলা করত যে, মিথ্যা আত্মাভিমান ফুলে ফেঁপে ওঠা ছাড়া উপায় ছিল না। অন্যত্র লিখেছি জমিদার বাড়ির ছেলে-বুড়ো সবাইকে প্রজারা ‘মহারাজ’ সম্বোধন করত। এটা যে কতটা হাস্যকর তা বুঝতে বেশ সময় লেগেছে। পূজার সময় পাঁচ গ্রামের লোক জমিদার বাড়ি দেখতে আসত। তাদের সর্বত্র প্রবেশাধিকার ছিল। আর যদিও তখন ঘরে ছুঁচোর ঠিক কীর্তন না হলেও একক সঙ্গীত অবশ্যই শুরু হয়েছে, বাইরে কোঁচার পত্তন কোনও দিক থেকেই ক্ষুণ্ণ হয়নি। বারো মাসে তেরো পার্বণ যথারীতি চলছে। শাক্ত পরিবার বলে প্রতি পূজায়ই পাঁঠাবলি। অষ্টমীতে ১০৮টি। মানবিক কারণে মোষবলির বীভৎসতা বন্ধ হয়েছে (যদিও ছোট হিস্যারা ব্যাপারটা শেষ অবধি চালিয়ে গেছেন—অর্ধাশনে থেকেও), কিন্তু সেই খরচায় এলাহি চালে কাঙালিবিদায় হচ্ছে। আর পূজা-আর্চা, বিসর্জন, পুণ্যাহে রাজকীয় চাল সম্পূর্ণ বজায় আছে। নানা অনুষ্ঠানেই কিংখাবে মোড়া রৌপ্যদণ্ড সমন্বিত রাজছত্র বের হয়। বিসর্জনের শোভাযাত্রায় রুপার আশাসোটা নিয়ে প্রহরীরা আগে আগে চলে। মেরধারা ল্যাজা-সড়কি হাতে জমিদার বাড়ি পাহারা দেয়। সিদ্ধেশ্বরীর বাড়ির সামনের মাঠে লেঠেলরা প্রচণ্ড বিক্রমে খেলা দেখায়। সুতরাং রাজকীয় বৈভবে যে কোথাও ঘাটতি পড়েছে, তা গ্রামের দরিদ্র মানুষ কী করে বুঝবে? আর সেরেস্তার আমলা কর্মচারী, প্রসন্নকুমারের নামে স্থাপিত স্কুলের শিক্ষকরা (যাঁদের বেতন অনেকটাই জমিদারি সেরেস্তা থেকে আসে) আমাদেরই খরচায় চালু ডিসপেনসারির এল.এম.এস. ডাক্তাররা যে সুযোগ-সুবিধা পেলেই এসে কিছুটা চাটুকারিতা করবেন, এ আর আশ্চর্য কী? ফলে গ্রামবাসের অভিজ্ঞতা আমাদের মানসিকতার পক্ষে সম্পূর্ণ স্বাস্থ্যকর ছিল না। একটা উদাহরণ দিই। দেশভাগের কয়েক মাস পরে—তখন আমাদের উদ্বাস্তুজীবন শুরু হতে দেরি নেই—বড় হিস্যার বাড়ির হলঘরে আমরা জ্যাঠতুত খুড়তুত ক’ভাই আমাদের অন্ধকার ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা করছি। হঠাৎ কালুদা সগর্বে বললেন, “হেয়া যাই কও, এখনও বড় হিস্যার বাড়িতে কেউ একডা বাতকর্ম করলে কীর্তিপাশা গ্রাম কাপ্পিয়া ওডে।” ওঁর সহোদর মনুদা স্লান হেসে বললেন, “ভাইডি, সেদিন আর নাই।”
বড় হিস্যা পরিবারের বায়বীয় প্রতাপে কালুদার এই অটল বিশ্বাসে ওঁর কোনও উপকার হয়নি। কলকাতার উদ্বাস্তূপল্লীতে নিজের হাতে বানানো ঝুপড়িতে ওঁর জীবনের দ্বিতীয়ার্ধ কাটাতে হয়।
কিন্তু বাল্য এবং কৈশোরে গ্রামবাসের অভিজ্ঞতা আনন্দময়ই ছিল। অবক্ষয়, আর্থিক সমস্যা, ভবিষ্যতের আসন্ন অন্ধকার আমাদের জীবনে ছায়া ফেলত না। বোধ হয় তার একটা কারণ, আমরা যেতাম উৎসবের সময় অথবা অল্প কয়েকদিনের জন্য ফুর্তি করতে। গ্রামে জীবন বা জমিদারি ব্যবস্থার সমস্যা-সংকটে আমরা, অর্থাৎ অল্পবয়স্করা প্রত্যক্ষভাবে শরিক ছিলাম না। গাড়ি-ঘোড়াবিহীন শান্ত গ্রামজীবনে এক ধরনের নিবিড় শান্তির স্বাদ পাওয়া যেত, ব্যবহারিক জীবনের শত সমস্যা আর সংঘাত সম্ভবত তাকে সম্পূর্ণ নষ্ট করতে পারত না। তলিয়ে দেখতে গেলে সে শান্তি হয়তো অলীক। দুঃস্থ প্রজা, সমস্যাপীড়িত জমিদার অথবা তার সামান্য বেতনের কর্মচারী কেউই যে খুব নিশ্চিন্ত সুখের জীবন যাপন করত তা নয়। কিন্তু আমাদের নদীমাতৃক জেলায় জমির উর্বরতা আর নদীপুকুরে মাছের প্রাচুর্যের কৃপায় কেউই ঠিক না-খেয়ে থাকত না। ৪৩-এর দুর্ভিক্ষও ওই অঞ্চলে মানুষকে ঘরছাড়া করেনি, কারও উপবাসে মৃত্যু হয়নি। দেশবিভাগের পর কিছু একদা-সচ্ছল মানুষ যে ভিক্ষাবৃত্তি নিতে বাধ্য হয়েছিলেন, তার পিছনে বিশেষ রাজনৈতিক এবং সমাজতাত্ত্বিক কারণ ছিল। মানুষের পেটে ভাত ছিল এবং ভোগ্যবস্তু সম্বন্ধে প্রত্যাশাও ছিল খুবই সীমিত। দরিদ্র বাড়িতেও মেয়েরা গৃহজাত তরিতরকারি আর মাঠ-জঙ্গল থেকে সংগ্রহ করা প্রকৃতির তুচ্ছ দানগুলি সুখাদ্যে পরিণত করতেন। ফলে অনেকের জীবনেই এক ধরনের সুখ ছিল—এ কথা বললে বোধ হয় অতিরঞ্জন হবে না। গ্রামে ভেকধারী বোষ্টম ছাড়া কাউকে ভিক্ষা করতে দেখিনি।
বড় হিস্যার বাড়িতে পূজার সময়টা সকলেরই মহা আনন্দের দিন। আমাদের ছোট পরিবারটি বাদ দিলে ওই বাড়ির সবাই আক্ষরিক অর্থে বিশ্বাস করতেন যে, বোধনের দিন পুরুতঠাকুর প্রাণপ্রতিষ্ঠা করার পর থেকে তিন/চার দিন দেবী সপরিবারে আমাদের দুর্গাদালানে উপস্থিত। চালচিত্রে আঁকা শিবও এসেছেন। ওপর থেকে সব কিছু দেখছেন। গল্প শুনতাম—কে এক অবিশ্বাসী কথাগুলি সত্যি কি না পরীক্ষা করতে দেবীর পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দা দিয়ে কেটে ফেলে। কাটা পা থেকে অঝোরে রক্ত পড়ায় তার সন্দেহ নিরসন হয়।
বহু দূরের সব গ্রাম থেকে শয়ে শয়ে মানুষ বড় হিস্যার বাড়ির পূজা দেখতে আসত। দুর্গাদালানের সামনে হাড়িকাঠে পাঁঠাবলি হত। একটা গভীর ভয়মিশ্রিত আকর্ষণবোধ নিয়ে দৃশ্যটা দেখতাম। বলির সময়ে চারদিকে ঢাক আর মন্দিরার শব্দে কানে তালা ধরত। তার সঙ্গে ভক্তদের ‘মা’ ‘মা’ ধ্বনি। আমার পরম ভক্ত মেজ জ্যাঠা দু’হাত জোড় করে মনে মনে স্তব পাঠ করতেন। আমাদের চোখে যে-দৃশ্য ভয়াবহ, তা দেখে ওঁর দু চোখ দিয়ে অনর্গল অশ্রুবর্ষণ হত। আমার সবচেয়ে ফুর্তি ছিল অহিংস বলিতে—যখন হাড়িকাঠ সংলগ্ন মাটির ডেলার উপর লাউ, কুমড়ো, মোচা ইত্যাদি খড়্গাঘাতে কাটা হত। সব শেষে কিছু ফুলও ওইভাবেই কুচি কুচি করে কাটা হত। বলির তরকারিগুলি দীর্ঘাঙ্গ বলে আমি বলতাম ‘লম্বাগলি বলি’। সামনের মাঠে সিদ্ধেশ্বরীর বাড়ির সামনে ছোট হিস্যার মোষবলি জীবনে একবারই দেখেছি। মোষটাকে নাকে কানে সর্ষে দিয়ে ক্ষেপিয়ে তারপর টেনে এনে হাড়িকাঠে জোতা হত। ওই বীভৎস দৃশ্য দ্বিতীয়বার দেখার ইচ্ছে হয়নি। সন্ধ্যায় আরতি। গ্রামের কেউ কেউ আরতিনৃত্যে বিশেষ পটু ছিলেন। কালুদা ধূমায়মান ধুনুচি মুখে বা মাথায় নিয়ে ঢাকের বাজনার তালে তালে ভারী সুন্দর নাচত। পূজার কদিন বাড়ির মেয়েরা স্নান করে চওড়া লালপেড়ে শাড়ি পরে প্রতিমা বরণ করতেন। জ্যেষ্ঠা থেকে কনিষ্ঠা পর্যন্ত সবাই লাইন করে যেতেন। তারপর একের পর এক প্রত্যেকে সব দেবদেবীদেরই বরণ করতেন। এক অসুর আর বাহনরাই বাদ পড়ত। বিসর্জনের আগে বরণের সময় মেয়েদের অনেকের চোখেই জল। রাত্রে সবাই নৌকা করে বিসর্জন দেখতে যাওয়া হত। ফেরার সময় যাঁরা বেশি ভক্তিমতী তাঁদের চোখের জল আর বাধা মানত না। বাড়ি ফিরে শুন্য দুর্গাদালানে পা মুড়ে বসে পুরুতঠাকুরের ছেটানো শান্তিজল গ্রহণ। তারপর কোলাকুলি, বিজয়ার বিশিষ্ট জলখাবার ভক্ষণ—নাড়ু, নারকেলের চিড়াজিরা, ফুল, গঙ্গাজলি বা পদ্মচিনি, তক্তি যার অপরিহার্য অঙ্গ ছিল। গঙ্গাজলি বা চিড়াজিরা বহুদিনের মধ্যে কারও বাড়িতে আর দেখিনি। ওসব জিনিস বানানোর মতো সময় এবং উৎসাহ মহিলাদের নেই সে কথা বুঝতে পারি। কিন্তু খাদ্যগুলি কি মিষ্টি বা ভাজাভুজি ব্যবসায়ীদের পক্ষেও লাভজনকভাবে তৈরি করা অসম্ভব? বিজয়ার কোলাকুলির সময় একটি গ্রাম্য রসিকতা খুব চালু ছিল। প্রতিমা নামানোর সময় কোনও রসিক তরুণ সিংহের শিশ্নটি সযত্নে সংগ্রহ করতেন। কোলাকুলির পর আশীর্বাদস্বরূপ বস্তুটি তিনি কনিষ্ঠদের কপালে ঠেকিয়ে দিতেন। হাসির হররা উঠত। এই আশীর্বাদ যাতে পেতে না হয়, আমরা সবাই সে বিষয়ে সতর্ক থাকতাম।
গ্রামের বাড়ি যাওয়ার উৎসাহের প্রধান কারণ কিন্তু পূজার ঘটা বা ফুর্তি নয়—ওখানকার স্থায়ী বাসিন্দা ভাইবোন কাকা-জ্যাঠা যাদের সঙ্গে স্নেহের বন্ধন গভীর ছিল, তাদের সঙ্গলাভ। আর ফাউ হিসাবে পেতাম ইস্কুলের কিছু শিক্ষক, সেরেস্তার কয়েকজন কর্মচারী আর আমাদের বয়সি কয়েকটি ভদ্রসন্তানের সঙ্গে সময় কাটাবার সুযোগ। জমিদারির এজমালি ভৃত্যদেরও কেউ কেউ আত্মীয়র মধ্যেই গণ্য হত। স্কুলের হেডমাস্টার মহেন্দ্র দত্ত, তাঁর ভাই উপেন, তহশিলদার নসা এঁদের তিনজনকেই আমরা কাকা ডাকতাম। ভাণ্ডারি দামুকেও কাকা ডাকতাম। সকালের অনেকটা সময়ই কাটত কাকা এবং জ্যাঠতুত ভাইদের সঙ্গে বাড়ির সামনে পুকুরের জলে অথবা বাঁধানো ঘাটে। আর দুপুরে খাওয়ার পর আড্ডার প্রধান জায়গা ছিল মহেন্দ্ৰকাকার বাড়ি। আড্ডার অকুস্থল বিকালে স্থানান্তরিত হত খালের উপরকার নড়বড়ে সাঁকোর উপর। আর রাত্রে ভাইরা সবাই চারতলার ঘরে জমা হতাম। এদের মধ্যে তিন-চার জনের গানের গলা খুব ভাল ছিল। আমাদের মধ্যে জ্যেষ্ঠ বড় জ্যাঠার ছেলে বড়দা কবিতা আর গান লিখতেন। উনি ‘মেঘদূতম’ ভারী সুন্দর ছন্দে অনুবাদ করেছিলেন। আমার ধারণা জমিদারিপ্রথা সত্যিই জমিদারদের শ্রেণি হিসাবে নিরুদ্যম করে ফেলেছিল। বড়দা সেই উদ্যমহীনতার শিকার। জীবতত্ত্বে এম.এসসি. পাস করে উনি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মৎস্য বিভাগে চাকরি করতেন। কিন্তু ওঁর সত্যিকার প্রতিভাপ্রসূত গান আর কবিতাগুলি কখনও প্রকাশ করার চেষ্টাও করেননি। ওঁর সহোদর ভাই রতনদা, মন্টুদাও ভাল গাইতেন। আর জ্যোৎস্নারাতে চারতলার ঘরে সেজ জ্যাঠার ছেলে কালুদা দরাজ গলায় গান ধরত, ‘যখন গাহে নীল পরি, বিজন রাতে, আকাশ পথে সঞ্চরি’। নিস্তব্ধ গ্রামের আকাশ বাতাসে সে-গানের সুর বহু দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে যেত। বিভাগোত্তর বাংলায় এইসব প্রিয়জনদের কারও জীবনই খুব সুখের হয়নি। রতনদা, মন্টুদা গান শিখিয়ে আর গেয়েই জীবিকা উপার্জন করেছেন, কালুদা বাঙালির সাবেকি পেশা কেরানিগিরি নিয়ে এবং ঝোপড়িবাসী হয়ে।
ইস্কুলটিকে এবং আমাদের বাড়িকে কেন্দ্র করে গ্রামে একটা সংস্কৃতির আবহাওয়া ছিল। শিক্ষকদের কেউ কেউ আমাদের লাইব্রেরি থেকে নিয়মিত বই নিয়ে পড়তেন। মহেন্দ্ৰকাকা ভারী সুন্দর ইংরাজি লিখতেন, লেখার ব্যাপারে বাগাড়ম্বর যে দুর্বলতার লক্ষণ, এ কথা উনিই প্রথম বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। ইংরাজি ও বাংলার শিক্ষক দেবকুমারবাবু আধুনিক কবিতা লিখতেন। সব যে খুব রসোত্তীর্ণ হত এমন না। দুটো লাইন মনে আছে : “তুলো বের করা বালিশ। রুগণা স্ত্রীর মতো পালিশ”। উনি রাবীন্দ্রিক আদর্শে নাটক লিখে ছেলেদের দিয়ে অভিনয় করাতেন—আমাদেরই বাঁধানো স্টেজে। নিজেও অংশ গ্রহণ করতেন। সুন্দর ধুতি পাঞ্জাবি পরা সুপুরুষ এই দরিদ্র মানুষটির কাজেকর্মে ব্যবহারে সব কিছুতেই একটা সুরুচির ছাপ ছিল, হয়তো একটু কৃত্রিমতাও ছিল—কিন্তু তা নিতান্তই বাহ্যিক। উনি কালুদাকে গৃহশিক্ষক হিসাবে পড়াতেন। ওঁর সংস্কৃতিব্যঞ্জক উচ্চারণে ‘কালাচাঁদ’ ডাকটি আমরা নকল করে বিমল আনন্দ পেতাম। এই প্রসঙ্গে আর একটি মানুষের কথাও লিখি—যাঁকে দেখে মনে হত শরৎচন্দ্র-লিখিত ‘দত্তা’র রাসবিহারী চরিত্র সামনে রেখে ঈশ্বর তাঁকে সৃষ্টি করেছিলেন। ওঁর পরনে সূক্ষ্ম খদ্দরের কাপড়। মুখের ভাষা এত মার্জিত এবং সুমধুর যে, তার একমাত্র তুলনা ঢাকার বিখ্যাত মসলিন। দূর সম্পর্কের আত্মীয়তার সুযোগ নিয়ে এক অশিক্ষিত জমিদারের ফ্রেন্ড-ফিলসফার অ্যান্ড গাইড হয়ে ঢুকে পড়ে উনি ওই পরিবারের হর্তাকর্তা-বিধাতা হয়ে বসেন। সুচ হয়ে ঢুকে উনি ফাল হয়ে বের হলেন। মূর্খ জমিদার আর তাঁর পরিবার গজভুক্তকপিত্থবৎ পথে নিক্ষিপ্ত হল। ষাটের দশকেও লোকটি বরিশাল শহরে বেশ জাঁকিয়ে বাস করছিলেন।
স্কুলের শিক্ষকরা দু-একজন বেশ বিচিত্র চরিত্রের ছিলেন। তাঁদের কেউ কেউ দরিদ্র জীবনের শূন্যতা পূরণ করতেন বিচিত্র কল্পনার সাহায্যে। বিহারীবাবুর দাবি ছিল—ওঁর যোগসিদ্ধি হয়ে নানা রকম অলৌকিক ক্ষমতা জন্মেছে। আকাশে উড্ডীয়ন তার একটি। এই সব গুহ্য তথ্য তিনি উপনিষদের মতো শুধু নিতান্ত নিকটস্থ দু-একজনকে জানাতেন, যাঁরা তৎক্ষণাৎ কথাটা সারা গ্রামে রাষ্ট্র করতেন। মহেন্দ্ৰকাকাও ছোটবেলায় ওঁর ছাত্র ছিলেন। একদিন আমরা পুকুরের ঘাটে বসে আছি। কাকা একটু গলা নামিয়ে—যাতে সবাই শুনতে পায়, এইভাবে বিহারীবাবুকে প্রশ্ন করলেন—”স্যার, কাইল সন্ধ্যাবেলা আপনে পুবদিকে কোথাও গেছিলেন নাকি?” প্রশ্নের অনুক্ত ইঙ্গিত-স্যার আকাশপথে কোথাও গিয়েছিলেন কি না। বিহারীবাবু স্মিত হেসে বললেন, “দেইখ্যা ফেলছ!” সেদিন সন্ধ্যায় তেতালার ঘরে স্কুলের সেক্রেটারি আমার বাবার সঙ্গে বিহারীবাবু দেখা করতে এলেন। ঘুরে ফিরে যোগসিদ্ধির কথাটাই উঠল। স্যার বললেন—সিদ্ধিটা এখন এমন অবস্থায় পৌঁছেছে যে, যোগবলে উনি পৃথিবীর রাজনৈতিক অবস্থাও বদলে দিতে পারেন। আমার স্বদেশিপন্থী বাবাকে উনি আশ্বাস দিলেন যে, ভারতবর্ষের স্বাধীনতা অর্জনও ওঁর প্রায় ক্ষমতার মধ্যে এসে গেছে। শুধু সাধনায় আর একটু সময় দেওয়া দরকার। পাঁচ টাকা মাইনে বাড়িয়ে দিলেই সেটা সম্ভব হতে পারে। মাসিক পাঁচ টাকা খরচা বাঁচাতে গিয়ে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা কয়েক বছর পিছিয়ে গেল।
কয়েক সপ্তাহ গ্রামবাসের পর আবার ওই বাড়ির পাশের খাল থেকেই কোশ নৌকা করে শহরে ফিরতাম। বাল্যে বোধহয় অতিরিক্ত আবেগপ্রবণ ছিলাম। তাই গ্রামের আত্মীয়বন্ধুদের ফেলে আসতে বড় কষ্ট হত। তাঁরাও সব ম্লানমুখে খালের পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন। বরিশাল ফিরে বড় কোঠার মন্টুদাদা আর সেজ কোঠার কালুদাদাকে পোস্টকার্ডে চিঠি লিখতাম : “পূজার ছুটিটা বড়ই আনন্দে কাটিল। এখন তোমাদের জন্য বড়ই মনোকষ্ট হইতেছে।” বাস্তববাদী দাদারা সম্ভবত এই মনোকষ্ট ব্যাপারটা ঠিক বুঝতেন না। মন্টুদাদা চিঠির উত্তর দিতেন : “তোমার পত্ৰ পাইলাম। আমরা ভাল আছি। আশা করি তোমরাও ভাল আছ। আমার আশীর্বাদ জানিবা। ইতি—আশীর্বাদক মন্টুদাদা।” আশীর্বাদক মন্টুদাদা বয়সে আমার চেয়ে চার মাসের বড় ছিলেন। আমার বয়স তখন সাত কি আট।
সুহৃদ-বিরহ অসহ্য হলে হঠাৎ সাইকেল নিয়ে কীর্তিপাশা চলে যেতাম কখনও বাড়িতে বলে, কখনও না বলে। কীর্তিপাশা থেকে প্রত্যাশিত তারবার্তা আসত “Sriman arrived safely”। খবরটা পৌঁছলে বাড়িতে যুগপৎ রৌদ্র এবং হাস্যরসের বান ডাকত। যখন বয়স বছর দশেক, তখন কীর্তিপাশা যাওয়ার এক সঙ্গী জুটল—অক্সফোর্ড মিশনের ব্রাদার কেটলি, যিনি বিশুদ্ধ বরিশালিতে বাক্যালাপ করতেন। কিন্তু ওঁর সঙ্গে গেলে হাঁটতে হত, সাইকেল চড়ায় উনি বিশ্বাসবান ছিলেন না। আর সে কি হাঁটা, ঘণ্টায় চার মাইলের কম নয়, বেশিই হবে। সকাল সাড়ে আটটা-নটায় রওনা হয়ে দুপুরের আগেই পৌঁছে যেতাম। রাত্রে সেজঠাকুমার খাস ভৃত্য অন্তাকে দিয়ে ব্যথায় জর্জর গা-পা টেপাতে হত।
কীর্তিপাশা যাওয়ার অন্যতম আকর্ষণ ছিল মেজঠাকুমা এবং তাঁর রান্না। মেজদাদু কামিনীবাবু স্ত্রী মারা যাওয়ার পরে দ্বিতীয়বার বিয়ে করেছিলেন এক দরিদ্র বৈদ্য কন্যাকে। ইনিই আমাদের মেজঠাকুমা। দুটি ছেলেমেয়ে নিয়ে অতি অল্প বয়সে উনি বিধবা হন। আবেগপ্রবণ দুঃখী মানুষটির সহজেই চোখে জল আসত, আর ওঁর জীবনে চোখে জল আসার কারণের কখনও অভাব ঘটেনি। আমরা গেলে উনি এবং ওঁর ছেলে শম্ভুকাকা যে খুব খুশি হতেন তা বুঝতে অসুবিধে হত না। শম্ভুকাকা আমাদেব সাঁতারের সঙ্গী ছিলেন। আর ঠাকুমার খুশির অন্যতর এবং আমাদের পক্ষে বিশেষ আনন্দদায়ক প্রকাশ ছিল পঞ্চব্যঞ্জন বেঁধে আমাদের খাওয়ানোয়। সামান্য তরিতরকারি হাতের গুণে যে কী অমৃততুল্য হয়ে উঠতে পারে, ওঁর রান্না যে খেয়েছে সেই বুঝেছে। পরবর্তী জীবনে ফরাসি দেশে এবং চিনে শ্রেষ্ঠ রাঁধুনিদের রান্না খাওয়ার সুযোগ পেয়েছি। কিন্তু সত্যি বলছি, মেজঠাকুমার রান্নার সঙ্গে তুলনা হয়, আহারের ক্ষেত্রে এমন কোনও অভিজ্ঞতা আমার হয়নি। হলফ করে বলতে পারি—এ কথা শুধু নস্টালজিয়া-প্রসূত নয়।
আমার সঙ্গে কীর্তিপাশা অভিযানে অনেক সময়ই সঙ্গী হতেন কেটলি সাহেব এবং আমার দু-একটি মুসলমান বন্ধু। মেজঠাকুমা নির্দ্বিধায় এঁদের ওঁর ঘরে—যার এক দিকে ঠাকুর পূজার আর অন্য দিকে ভোলা উনুনে রান্নার ব্যবস্থা—আমার পাশেই পাত পেড়ে খাওয়াতেন। এ নিয়ে ওঁর মনে কোনও দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল এমন ভাবার কোনও কারণ কখনও হয়নি। কেটলি সাহেব কীর্তিপাশা যাওয়ার পথে মাঝে মাঝেই থেমে উদ্বাহু হয়ে নৃত্য করতেন, ‘আইজ ঠাকুমার রান্না খামু’ বলে। নাচানাচি করার মতো ব্যাপারই বটে।
ঠাকুমার চোখের জল কখনও থামেনি। বড় হিস্যার জমিদারবাড়ি ছেড়ে শেষ বয়সে উনি উদ্বাস্তুজীবন যাপন করেন কলকাতায় ছেলের ভাড়া করা একটি ঘরে। মেয়ের বিয়ে হয়েছিল এক সুপুরুষ স্মার্ট ডাক্তারের সঙ্গে। রূপহীনা হাবাগোবা মানুষ খুকনিপিসি জগদীশ গুপ্তর যোগ্য স্ত্রী ছিলেন না। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে ভদ্রলোক মধ্যপ্রাচ্যে যান এবং সেখান থেকে ফিরে পূর্বপরিচিতা এক সুন্দরীকে বিবাহ করেন। দেশভাগের কিছুদিন পরে পিসির ছেলেটিকে রেখে দিয়ে ওঁর শ্বশুরবাড়ির লোকেরা ওঁকে সম্পূর্ণ রিক্তহস্তে ওঁর বৈমাত্রেয় ভাই ব্যারিস্টার শশাঙ্ক সেনের (আমাদের নিনুকাকা) দরজায় ফেলে দিয়ে চলে যায়। কিছুদিন পর ছেলেটি মাথা খারাপ হয়ে মারা যায়। শেষ জীবনে খুকনিপিসিরও মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। বিয়ের পর পিসির বেজায় খুশি খুশি মুখটা মনে পড়ে। আধুনিকমনা ডাক্তার ভদ্রলোকটি কেনই-বা ওঁকে বিয়ে করতে গেলেন, আর পরে কী করে এত নির্মম হলেন–এ সব প্রশ্নের কোনও সদুত্তর পাইনি।