কক্সবাজার : সমুদ্রের স্বাদ
চট্টগ্রাম শহরের দক্ষিণ-পূর্বে বঙ্গোপসাগরের পাড়ে একটি মনোরম শহর আছে। ইংরাজ সরকারের এক কর্মচারী, মিস্টার কক্স-এর নামে মহকুমা শহরটির নাম ছিল Cox’s Bazar। বাঙালি উচ্চারণে নামটি দাঁড়িয়েছিল ককসোবাজার। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আগে মধ্যবিত্ত বাঙালি ভদ্রলোকেরা হাওয়া বদলাতে যেমন পশ্চিমে গিরিডি, মধুপুর, ঘাটশিলা যেতেন, তেমনই সমুদ্রের সন্ধানে যেতেন পুরী এবং কক্সবাজার। কক্সবাজারই ইংরাজ রাজত্বের আগে আরাকান রাজের রাজধানী রোসঙ্গ। আধা বৌদ্ধ আধা মুসলমান রোসঙ্গের মগ-নৃপতি জ্ঞানীগুণী সভাসদ সংগ্রহ করে বিক্রমাদিত্যর সভা বসিয়েছিলেন। এই সভারই অন্যতম সভ্য, কবি আলাওল কাব্যে আত্মপরিচয় লেখেন :
“রোসঙ্গেতে গুণীজন যতেক
আছেন্ত।
তালেব আলিম বলি আদর করেন্ত।”
তালেব বা তালিব–যার বহুবাচনিক রূপ তালিবান বলতে আমেরিকান ও পাকিস্তানি গোয়েন্দা বিভাগ সৃষ্ট আফগান গুন্ডাবাহিনী বোঝাত না–কথাটার অর্থ শিক্ষাব্রতী, অতএব সভ্য মানুষের শ্রদ্ধার পাত্র। অনেক কোশেশ করে এই সুন্দর শব্দটি পশুধর্মী কিছু দ্বিপদের অভিধায় পরিণত করা হয়েছে। সতেরো শতকে তালেব আলিম পূর্ণ রোসঙ্গ শহর বিশেষ সমৃদ্ধ ছিল। শাহজাহান-নন্দন শাহ সুজা ভ্রাতৃযুদ্ধে হেরে এইখানে আশ্রয় নেন। এবং আশ্রয়দাতার রাজ্যটি দখল করার ষড়যন্ত্র করায় সপারিষদ আক্রান্ত এবং নিহত হন। তার মেয়েদের নিয়ে চালু রোমান্টিক কাহিনিটি কবির সুমিষ্ট ছোট গল্প ‘দালিয়া’র বিষয়বস্তু। কিন্তু আসলে কী ঘটেছিল তার তালাশ পাই ওলন্দাজ কোম্পানির কাগজপত্র ঘাঁটতে গিয়ে। মর্মন্তুদ কাহিনি। আধা বৌদ্ধ আরাকানরাজকে পারিষদরা বলেন, মেয়েদের রক্তপাত নিষিদ্ধ, তথাগতর নিষেধ আছে। তাই ধর্মপ্রাণ নরপতি ওঁদের পানাহার বন্ধ করে দিয়ে তিলে তিলে হত্যা করেন। ভদ্রলোক নারীর রক্তপাতরূপ পাপ থেকে রেহাই পেলেন। মানুষের করুণা আর ধর্মবোধ কখন কী রূপ নেয় বলা কঠিন।
সতেরো শতকে স্পেনের ইনকুইসিটররাও করুণাপরবশ হয়েই ধর্মভ্রষ্টদের পুড়িয়ে মারত। এ যুগে নবজন্মপ্রাপ্ত খ্রিস্টান বুশ সাহেবের করুণায় ইরাকের কী হাল হয়েছে সেটাও বিবেচনা করুন।
এই ইতিহাসকথার সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত স্মৃতির কোনও সম্পর্ক নেই। কারণ কক্সবাজারের সঙ্গে আমার পরিচয় এইসব ঘটনার প্রায় তিনশো বছর পরে। আমাদের এবং সেবকবৃন্দ নিয়ে বাবা-মা যেসব জায়গায় ‘চেঞ্জ’-এ যেতেন, কক্সবাজার তাদের মধ্যে প্রধান। শিলংয়ের গল্পও অনেক সময়ই শুনতাম। কিন্তু ওই পার্বত্য শহরটির কোনও স্মৃতি আমার নেই। অচেনা পৃথিবীর সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাৎ কক্সবাজারে। সে পরিচয় বিস্ময়, ভয় আর বর্ণনাতীত আনন্দে ভরা। ১৯৭৪ সনে আর একবার কক্সবাজার গিয়েছিলাম চট্টগ্রাম থেকে আবাল্য বন্ধু সামসুল হুদার সঙ্গে, একটা জিপ চালিয়ে। পথটি আগাগোড়াই স্বাধীনতা সংগ্রামের ক্ষতচিহ্নে ভরা ছিল। ৬০ মাইল পথ যেতে বারো ঘণ্টা লেগেছিল। ‘পথ’ শব্দটা সৌজন্যবশত ব্যবহার করছি। মনে হয়েছিল অন্তহীন খানাখন্দ পার হয়ে কক্সবাজার পৌঁছলাম। সেখানে তখন বড় বড় হোটেল হয়েছে, যার একটিও ত্রিশের দশকে ছিল না। তবে ‘৭৪ সনে সেসব হোটেলে অতিথি বিশেষ ছিল না। এতদিনে নবলব্ধ সমৃদ্ধিতে জায়গাটি গোল্লায় গেছে বলে আমার ধারণা।
‘৩০-এর দশকের কক্সবাজার নিতান্তই ছোট শহর, গ্রাম বললেও খুব ভুল হয় না, পরিষ্কার, ছিমছাম জায়গা। বাংলার চেয়ে আরাকান-বর্মার ছাপই তার বহিঃ এবং অন্তঃপ্রকৃতিতে বেশি। চট্টগ্রাম থেকে জাহাজে করে আমরা কক্সবাজার যেতাম। বন্দর নয়, তাই পাড়ের কাছ অবধি পৌঁছানো যায় এমন জাহাজঘাটা ছিল না। জাহাজ সমুদ্রেই নোঙর ফেলত। সেখান থেকেই বিস্ময়ের শুরু। এই সেই সমুদ্র যার পার দেখা যায় না, যেখানে বড় বড় ঢেউ উঠে নৌকাটাকে বিষম দোলাতে থাকে, আর দূরে যে-জল দেখা যায় তার রং নীল! যে-সমুদ্র রামচন্দ্র শাসন করেছিলেন? যার উপর বানররা সেতু বন্ধন করেছিল? এমন অদ্ভুত জিনিসও পৃথিবীতে আছে? আর আমি তা স্বচক্ষে দেখছি? জাহাজ থেকে ঝোলানো সিঁড়ি বেয়ে যে নৌকায় নামলাম সেও বা কী বিচিত্র। এ আমাদের বজরা বা কোশ নৌকা না, নানা রঙে রং করা সাম্পান। দাঁড়িরা রঙিন লুঙ্গি পরা মগ। এরাই সমুদ্রবিহারী জলদস্যু-শীতল জ্যাঠার কাছে শুনেছি। বাচ্চাদের ধরে দাসব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে। কখনও কখনও কেটেও ফেলে। আমাকে বেচে দেবে না তো? আমি তো কোনও কাজই করতে পারি না। আমার মতো ক্রীতদাস দিয়ে লোকের কী সুবিধে হবে? অ আ ক খ লেখা আর রান্নাবাড়ি খেলার জন্য কেউ ক্রীতদাস পোষে? তবে কেটে ফেলতে পারে। ভরসার কথা এরা তো আফ্রিকার মানুষখেকো না। শুধু শুধু কেটে কী লাভ হবে? তবে ছোট হিস্যার ওরা যে মোষবলি দেয়, সেও তো খাবার জন্য না। একটু মা’র কাছ ঘেঁষে বসি। কী জানি ওদের দেবী হয়তো মানুষবলি পছন্দ করেন। কিন্তু মাঝির লাল সবুজ ডোরাকাটা লুঙ্গিটা বড় সুন্দর। ওরকম কি একটা আমি পাব? হঠাৎ খেয়াল হল মগরা বিদেশি। এই আমি প্রথম বিদেশি দেখলাম। ‘অগো’ বেঙ্গি, ‘মগো’ বেঙ্গি, জগদীশ্যা, কালুদা, মন্টুদা কেউ কখনও বিদেশি দেখেনি। অবিশ্যি সাহেবরাও বিদেশি। কিন্তু ওরা তো ভুলিয়ে ভালিয়ে আমাদের রাজা হয়ে বসেছে। তাই আর ঠিক বিদেশি নেই।
এইসব চিন্তা করতে করতে নগার কাঁধে চেপে সমুদ্রতীরের কাছেই যেখানে আমাদের জন্য বাড়ি ভাড়া করা হয়েছে, সেদিকে চলেছি। কত বালি আর বালিয়াড়ি। বালিয়াড়িগুলি প্রায় চাঁদমারির মতো উঁচু, একটু বেশিও হতে পারে। ওই রকম বালির উপর দিয়ে গড়িয়ে পড়লে ব্যথা লাগবে না একটুও। সমুদ্রের পাড়ে জায়গায় জায়গায় অল্প জল জমে আছে। ওখানে কি গামছা দিয়ে মাছ ধরা যাবে? আর পলাশ ফুলের মতো টকটকে লাল ওগুলি কী? আমরা কাছে আসতেই বালির নীচে পালাল। নগা বলল, “কাঁকড়া অছি।” কাকড়া! এত সুন্দর? লাল ফুলের মতো দেখতে? হঠাৎ নগা কাঁধ থেকে আমাকে নামাল। সামনেই একতলা কাঠের একটা বাড়ি। পুরো বাড়িটা কাঠের তৈরি হয়? বিস্ময়ের শেষ নেই।
মালপত্র নামানো শেষ হলেই বাবা সবাইকে তাড়া লাগালেন—”চল, সমুদ্রে স্নান করে আসি৷” সঙ্গে শীতল জ্যাঠাও এসেছেন। উনি বললেন, “ওরে সব মূর্খের ডিম। তাড়াতাড়ি কর। সমুদ্র শুখাইয়া গ্যালে আর নাইতে পারবি না। অগস্ত্য মুনি আইল বল্লিয়া।” অগস্ত্য মুনি এসে সমুদ্র শোষণ করবেন এই আশঙ্কায় আমরা তাড়াতাড়ি করি। সমুদ্রের কাছাকাছি পৌঁছে হাত-পা পেটে ঢোকার অবস্থা। এত জল! এর যে তীর নেই। আর কত বড় বড় ঢেউ! কী বিপদেই পড়লাম। বাবা শক্ত করে হাত ধরে আছেন। উপেন্দ্রকিশোরের ‘ছোটদের রামায়ণ’ এ দেখা রামচন্দ্র কর্তৃক সমুদ্র-শাসনের ছবি স্মরণ করি। নিজেকে রামচন্দ্র কল্পনা করে সাহস সংগ্রহের শেষ চেষ্টা করি। কীসের কী। হঠাৎ একটা বড় ঢেউ এসে বাবার হাত থেকে আমাকে ছিনিয়ে নিল। বিপদের আশঙ্কা ছিল না। তখন আমরা বোধহয় মাত্র এক ফুট জলে দাঁড়িয়ে। ঢেউটা এসে পাড়েই আছড়ে পড়ল। কিন্তু কে কাকে বোঝায়? ‘ভ্যাঁ ভ্যাঁ’ ধ্বনিতে আকাশ বাতাস ভরে গেল। শীতল জ্যাঠা চোখ পাকিয়ে সংক্ষেপে বললেন, “মূর্খের ডিম।” যতিদিদি এসে কোলে তুলে নিল। সমুদ্রস্নান এবং সমুদ্রশাসনের সেই ইতি।
কিন্তু সমুদ্রের প্রতি সভয় অনুরাগেরও সেই থেকেই শুরু। এখনও ঘণ্টার পর ঘণ্টা সমুদ্র দেখে কাটাতে পারি। কোনও ক্লান্তি বা বিরক্তি আসে না। আর কক্সবাজারে সমুদ্রস্নানই একমাত্র ফুর্তির উপায় ছিল না। জোয়ারের জল এসে সমুদ্রসৈকতের অনেকটাই কিছুক্ষণের মতো গ্রাস করত। ভাটার সময় জলরেখা স্বস্থানে ফিরে গেলেও জায়গায় জায়গায় জল জমে থাকত। সে জল আমার সাইজের মানুষের কোমর, কোথাও কোথাও গলা অবধি উঠত। যতিদিদির সাহায্যে আমার সমুদ্রশাসনের উচ্চাশাটা ওই অল্প জলেই সারতাম। বেশ আত্মতৃপ্তি হত। মানে যে সাপের শিং নেই, দাঁত নেই, তাকে তেড়েমেড়ে ডান্ডা দিয়ে ঠান্ডা করা আর কী! ওই জলে গামছা দিয়ে যেসব মাছ ধরা যেত, সেগুলি সবাই খুব ছোট না। একটি ছ ইঞ্চি মতো সাইজের মাছ ছিল, তার নাম দেওয়া হয়েছিল পোটকা মাছ। কারণ তার পেট টিপে ধরলে সে শরীরটাকে ফুলিয়ে একটি টেনিস বলের মতো গোলাকার করে ফেলত। পোটকা মাছের আগ্রাসন শক্তি আমাদের জানা ছিল না। সে একদিন যতির হাত কামড়ে দিল। হাত ফুলে আকারে ও আয়তনে স্ফীত পোটকার সঙ্গেই তুলনীয় হয়ে উঠল। তৎসহ যতির আত্মবিলাপ। “ওরে বাবারে, পোটকা মাছের বিষ আছে রে।” এই শোকগীতিকে শীতল জ্যাঠা কীর্তনে পরিণত করলেন। সকালবেলা ঘুম ভাঙত সেই করুণ রসময় মাথুর শুনে, “ওরে বাবারে, পোটকা মাছের…” ইত্যাদি ইত্যাদি।
সমুদ্রপাড়ের বালিয়াড়িগুলিও অ্যাডভেঞ্চারের পটভূমি। ওইখানেই আমার কাঞ্চনজঙ্ঘা অভিযান, ম্যালোরি-আরভিনের মতো পাহাড়ের চূড়ার কাছে মেঘ আর কুয়াশার আড়ালে অন্তর্ধান। বিয়োগান্ত কাহিনির নায়কের ভূমিকায় নিজের প্রতি শ্রদ্ধা আর সহানুভূতিতে মন ভরে যেত। বালিয়াড়ির অন্যতম আকর্ষণ সোনকুঁচের ঝোঁপ। এক অংশ লাল এক অংশ কালো এই অতিক্ষুদ্র জিনিসটি স্যাকরাদের ব্যবহার করতে দেখেছি সোনা ওজন করার জন্য। শুনেছি সব সোনকুঁচেরই সমান ওজন—এক রত্তি। এর চেয়ে কম ওজনের কোনও জিনিস নাকি নেই বালুকণা ছাড়া। ওটা যে ঝোপঝাড়ে জন্মায় এই বিস্ময়কর তথ্য আমার জানা ছিল না। বালিয়াড়ির দ্বিতীয় বিস্ময়—এদের অস্থিরমতিত্ব। আজ এখানে রয়েছে, কাল সকালে তার চিহ্নও নেই। হাওয়ায় কোথায় উড়িয়ে নিয়ে গেছে।
আর সমুদ্রতীরে বিস্ময়ের কি শেষ আছে? এত টকটকে লাল কাকড়া আর কোথাও দেখিনি। নিঃশব্দ পদসঞ্চারে ওদের কাছে গিয়ে ধরে ফেলার কায়দাটা বসা সহজেই আয়ত্ত করে ফেলল। তারপর সুতোয় বেধে আমাদের বারান্দার রেলিংয়ে তাদের ঝুলিয়ে দেওয়া হত। কোনও মতে নড়েচড়ে ওরা পরস্পর কাছাকাছি এসে জড়াপোটলা হয়ে থাকত—বোধ হয় বন্দিদশায় স্বজাতির কাছে সান্ত্বনার আশায়। দৃশ্যটা আমার ভাল লাগত না। কিন্তু বসার এই নিষ্ঠুর খেলা থামানো যেত না। সমুদ্রপাড়ের আর এক বিস্ময় ছিল জেলিফিশ–যাদের পরিধি এক আঙুল থেকে তিন-চার ফুট অবধি। ওদের প্রায়স্বচ্ছ শরীরে নানা রঙের খেলা। আর ছিল কং। কাঠুয়া জাতীয় কোনও প্রাণী। এদের পেছনে শক্ত একটি কাটা-ওদের আত্মরক্ষার আয়ুধ। এরা আমার সমুদ্রভীতির অন্যতম কারণ। কক্সবাজারের সমুদ্রতীরে সব চেয়ে বড় আনন্দ ছিল কড়ি কুড়ানো। ঢেউয়ের সঙ্গে কত বিচিত্র আকার এবং রঙের কড়ি, শঙ্খ, ঝিনুক যে ভেসে আসতোর কেউ হিসাব করেনি। আমাদের বরিশালের বাড়িতে দুটি কাঁচের আলমারি ভর্তি কড়ি, ঝিনুক আর শঙ্খ ছিল। সবই কক্সবাজার থেকে সংগ্রহ করা। বোধ হয় কোনও দুটি কড়ি এক চেহারার ছিল না।
ছোট শহরটির আর একটি প্রধান আকর্ষণ ছিল ক্যাং অর্থাৎ বৌদ্ধ মন্দির বা প্যাগোডা। এর সেবায় যাঁরা নিযুক্ত ছিলেন, হলুদ কাপড় পরা সেই কৌমার্যব্রতী পুরোহিতগোষ্ঠী বা ভিক্ষুদের স্থানীয় নাম ছিল ফুঙ্গি। মন্দিরে সারি সারি কাঠের বুদ্ধমূর্তি। দুপুরবেলা কাঠের বারকোশে জল নিয়ে মূর্তিদের স্নান করানো হত। এই পুণ্যকার্যে আমরাও অংশ নিতাম। ‘ওঁ’ ‘ওঁ’ ধ্বনি তুলে বুদ্ধমূর্তির মাথায় জল ঢেলে বেশ একটা আত্মপ্রসাদ বোধ হত। বুদ্ধকে স্নান করানোর মতো দায়িত্বপূর্ণ কাজ যাকে দেওয়া হয়েছে, সে যে সম্পূর্ণ সাবালক এ বিষয়ে কি আর সন্দেহ আছে? বাড়ি ফিরে অবশ্যি সাবালকত্বটা নাকচ হত। বুদ্ধমন্দিরে যে ব্যক্তি বুদ্ধের সেবক, বাড়ি ফিরে সে স্বয়ং বুদ্ধত্ব দাবি করত। আত্মার বিবর্তন হয়ে সম্বোধি লাভ একদিন সব জীবাত্মারই হবে–এ তো জানা কথা। প্রজ্ঞা একটু তাড়াতাড়ি অগ্রসর হয়ে কারও কারও ক্ষেত্রে ৮৪ কোটি জন্মের অনেক আগেই বুদ্ধত্বপ্রাপ্তি যদি ঘটে তাতে আপত্তি করলে চলবে কেন? কক্সবাজারের ভাড়াটে বাড়ির স্নানাগারে নিত্য শুদ্ধ মুক্ত আত্মা যে-দেহে তখন বাস করছেন, সেই সাড়ে তিন ফুট উঁচু দেহটি বদ্ধ পদ্মাসনে ভূমিস্পর্শ মুদ্রায় অর্ধনিমীলিত নেত্রে ধ্যানস্থ হত। আর ফুঙ্গির ভূমিকায় নগা এবং বসা ওঁ ওঁ ধ্বনি তুলে বোধিসত্ত্বর মাথায় জল ঢালত। সে এক পবিত্র মুহূর্ত। প্রজ্ঞাটা পাঁচ বছর বয়সে লাভ হয়ে যাওয়ায় একটা সুবিধা হয়েছিল। পরবর্তী জীবনে বহু বজ্জাত নানাভাবে জ্বালিয়েছেন, তাতে খুব বিচলিত হইনি। হলে পাগল হয়ে যেতাম।
সপ্তাহে এক বা দুদিন বুদ্ধ মন্দিরের কাছে হাট বসত। ফল, তরিতরকারি, বাসনকোসন, জামাকাপড় সবই এখানে পাওয়া যেত। হাটুরেরা অনেকেই মেয়ে-জাতিতে মগ, বর্মি আর পার্বত্য উপজাতীয়। নাক একটু চেপ্টা, কিন্তু দেখতে বেশ সুন্দর বিশেষত বর্মিরা। আর তাদের পোশাক? বর্ণবৈচিত্র্যে এমন নয়নমনোহর দেহসজ্জা আর দেখিনি। এখনও মনে হয় রঙের ছটায় বর্মি মেয়েদের পোশাক সবাইকে ছাড়িয়ে যায়। ওই পোশাকের উপর বড় লোভ ছিল। লুঙ্গি তো ওরা মেয়েপুরুষ সবাই পরে। একটা পেলে বেশ হত। একদিন বাড়ি ফিরে দেখি রঙ্গিন ফিতেয় বাঁধা একটি প্যাকেট আমার বিছানার উপর রয়েছে। খুলে দেখিলাল ডোরাকাটা সবুজ রঙের একটি ক্ষুদ্রকায় সিল্কের লুঙ্গি। আমার এক মার্কিনমুলকবাসী একদা দরিদ্র বন্ধু মাঝে মাঝেই নিজের জীবন পর্যালোচনা করে আনন্দে আত্মহারা হয়ে বলেন, “আমার কী সৌভাগ্য!” ওঁকে বলতে ইচ্ছে করে, পাঁচ বছর বয়সে কক্সবাজারে আমার সেই লুঙ্গিলাভজনিত সৌভাগ্যর সঙ্গে ওঁর বহু লক্ষপতি হওয়ার সৌভাগ্যর কোনও তুলনা হয় না। কারণ সৌভাগ্যর উপলব্ধিটা নিতান্তই সাবজেকটিভ (কথাটার উপযুক্ত মানে ইংরাজি না জেনেও বোঝা যায় এমন বাংলা প্রতিশব্দ কারও জানা থাকলে জানাবেন)।
কক্সবাজারের হাটে আমার জন্য যে আরও কল্পনাতীত সৌভাগ্য তোলা আছে, সে কথা আমার জানা ছিল না। এক সুপ্রভাতে শীতল জ্যাঠা বললেন, “চল, মূর্থের ডিমেরা। হাটে লইয়া তগো বেচ্চিয়া দি৷” দাদা আর আমি ওঁর দুই হাত ধরে হাটের দিকে রওনা হলাম। ওখানে ডিমের চাহিদা কিছু আছে দেখেছি, কিন্তু মুর্খের ডিমের একেবারেই নেই, ফলে আমরা নিশ্চিন্ত। শীতল জ্যাঠা অন্য কোনও দিকে না তাকিয়ে সোজা এক পার্বত্য রমণীর বেসাতির সামনে নিয়ে আমাদের দাঁড় করালেন। তার পণ্যবস্তু দেখে আমি হতবাক। এমন জিনিসও পৃথিবীতে আছে, আর তা হাটে বিক্রি হয়। এ তো সোজা আলিবাবা কাহিনির চল্লিশ দস্যুর গোপন দৌলতখানা থেকে আমদানি। শীতল জ্যাঠা বললেন, “দ্যাখছো? হিরার লাঠি!” তাই বল, না হলে লাঠিতে এত বিচিত্র রং, সূর্যের আলো এরকম ঠিকরে বের হয়! দাদা বরাবরই সন্দিগ্ধ প্রকৃতির মানুষ, সহজে ভুলত না (পরবর্তী জীবনে এক ব্যবসা করতে গিয়েই এ নিয়মের ব্যতিক্রম করায় সর্বস্বান্ত হয়েছিল)। সে বেপরোয়াভাবে বলল, “হিরা না ছাই। রঙিন তার দিয়ে মোড়া।” শীতল জ্যাঠা চোখ পাকড়ে ধমকালেন। “চুপ কর, মূর্থের ডিম।” দরদস্তুর করে চার আনা দিয়ে আমাকে একটি হিরের লাঠি কিনে দেওয়া হল। দার্শনিক সন্দেহপ্রবণতার ফলে কী হারাইতেছে দেখে দাদা দুশ্চিন্তিত : “আমি?” —”ক্যান, তারের লাঠি দিয়া তুই কী করবি?” দাদা কেঁদে ফেলে আর কী। শীতল জ্যাঠা এবারকার মতো মূর্খের ডিমকে ছেড়ে দিলেন। তারও একটি চার আনা মূল্যের হিরার লাঠি লাভ হল।
‘৪৮ সালে যেদিন বরিশাল ছেড়ে আসি, সেদিন জিনিসপত্র গোছাতে গিয়ে দেখি মরচে পড়া তারে জড়ানো ফেলে দেওয়া লোহার লাঠিটি আলনার পেছনে কাত হয়ে পড়ে আছে। ভাবলাম—ওর আর আমাদের অবস্থা একই দাঁড়িয়েছে।
হঠাৎ এক দিন বেশ ভোর ভোর সময়ে দেখি একটা ঝরঝরে গাড়ি আমাদের বাড়ির সামনে প্রস্তুত। কিছু বাক্স-পেটরাও দেখলাম নামানো হয়েছে। যতি এবং নগা-বসা সহ আমরা সবাই প্রস্তুত। শুনলাম আমরা হিমঝরা যাচ্ছি। সেখানে বনবিভাগের ডাকবাংলো আছে। সেখানে থেকে বাবা পাখি শিকার করবেন। ওখানকার বনমোরগ বিখ্যাত—সৌন্দর্যে এবং সুখাদ্য হিসাবে। বুনো শুয়োরও আছে তবে তাদের দাঁত বেশ দশাসই। তাদের শিকার করা এবং তাদের হাতে বা দাঁতে শিকার হওয়া, দুটোই সম্ভব ঘটনা। ফলে মা ফতোয়া দিয়েছেন–শিকার-টিকার যা করতে হয়, ডাকবাংলোর চৌহদ্দির মধ্যে থেকে। নিতান্তই নাবালক দুটি ছেলে আছে। অবুঝ লোকের হাতে পড়ে অনেক দুর্ভোগ ভুগতে হয়েছে (এই প্রসঙ্গে দুর্ভোগের তালিকাটা আর একবার শুনতে হত), দুর্ভাগ্য আর বাড়তে দিতে উনি সম্পূর্ণ নারাজ।
ধুঁকতে ধুঁকতে থামতে থামতে ঠেলতে ঠেলতে আমাদের পুষ্পক রথ যখন হিমঝরার ডাকবাংলোয় পৌঁছাল তখন বেশ অন্ধকার হয়ে গেছে। নানা অচেনা জন্তু বা রাতপাখির ডাক শোনা যাচ্ছে। বাবা বেশ খুশি খুশি মুখে বন্দুকটা হাতে তুলে নিয়ে বললেন, “একটু ঘুরে আসি।” মা বললেন, “না।” ওঁর মুখের দিকে তাকিয়ে বাবা বুঝলেন, এই ‘না’র আর ‘হ্যাঁ’ হওয়া সম্ভব নয়। বন্দুকটা তুলে রেখে দিলেন।
বন কখনও এর আগে দেখিনি। বন না অরণ্য। সমুদ্র যদি ভয় বা বিস্ময়ের কারণ হয়েছিল, সন্ধ্যার আবছায়া অন্ধকারে দেখা এই অরণ্য আরও যেন অভিভূত করল। এমন বনেই তো তাড়কা রাক্ষসী আর তার সহচরদের বাস ছিল। মুনি-ঋষিরা আগুন জ্বেলে তবু ওদের কিছুটা তফাতে রাখতেন। আর রাম-লক্ষ্মণ কাছাকাছিই থাকতেন। দরকার হলে বিশ্বামিত্রকে দিয়ে খবর পাঠালেই এসে পড়তেন। নিজেকে বোঝাই–আরে ওগুলো তো গল্প, তাছাড়া দণ্ডকারণ্য থেকে হিমঝরা অনেকটা পথ। আর রাক্ষসরা কি মোটর গাড়ির চেয়ে তাড়াতাড়ি চলে? হোক সে লঝঝর গাড়ি। কিন্তু আর যারা আছে শুনেছি? বাঘ, ভালুক, দাঁতাল শুয়োর? পরিত্রাণের ভরসা ছেড়ে দিয়ে চোখ বুঝে শুয়ে থাকি। চোখ খুললেই তো ওদের দেখতে পাব।
চোখ যখন খুললাম, পৃথিবীর চেহারা তখন সম্পূর্ণ বদলে গেছে, আলোকের ঝরনাধারায় স্নান করে হিমঝরা তখন নন্দনকানন। পৃথিবীতে এত রূপও আছে! এত নানা রঙের পাখি, এত বিচিত্র বুনো ফুল। শহরের বাড়ি ছেড়ে কেন আমরা এই স্বর্গরাজ্যে বাস করি না? মুনি ঋষিরা তো ফলমূল খেয়ে দিব্যি থাকতেন, রাম-লক্ষ্মণ তার সঙ্গে কিছু হরিণের মাংসের কাবাবও খেতেন। বড়রা কেন যে কী করে, ভেবে পাওয়া যায় না। পিকনিকের জন্য কিছু খাবার-দাবার নিয়ে আমরা ঝরনা দেখতে বের হলাম। সে আর এক বিস্ময়। ঘন বনে ঢাকা পাহাড়ের গা বেয়ে ধাপে ধাপে জল নেমে আসছে তীব্র বেগে। মাঝে মাঝে সূর্যালোক যেখানে পড়েছে সেদিকে তাকালে চোখে ধাঁধা লাগে। মা’র ফতোয়া উপেক্ষা করে বাবা ওই হিমশীতল জলে নামলেন। “উনি কি কথা শোনার মানুষ?” (এই বিরক্তি প্রকাশের পেছনে প্রচ্ছন্ন গর্ব ছিল—এ কথা আমরাও বুঝতে পারতাম।) কিন্তু যখন আমাদেরও জলে নামাবার চেষ্টা হল, তখন মা সত্যিই বাধা দিলেন। “ছেলে দুইটারে মারতে চাও?” —”তয় তুমিই আসো” বলে এক হ্যাঁচকা টানে বাবা মাকে ঝরনায় নামালেন। “কী পাগলের হাতেই যে কাকা দিলেন!” খুশিতে উজ্জ্বল মা’র তরুণ মুখটি আজও স্পষ্ট মনে পড়ে।
হিমঝরা বাসের এই তীব্র আনন্দের শেষ দিনটায় একটা বিঘ্ন ঘটল। সন্ধেবেলা আমরা ডাকবাংলোয় ফিরলাম। বাংলোর পাশেই এক ঝাউগাছে একটি বনমোরগ বুক ফুলিয়ে এসে বসল। সে যেন ভয়ডর কখনও শেখেনি। “উচ্চ শির উচ্চে রাখি সমুখে করে আঁখিপাত।“ পাখিরও এত রূপ এর আগে কখনও দেখিনি। উজ্জ্বল সোনালি রঙের পালকের মাঝে মাঝে সবুজ আর লালের খেলা। মাথায় টকটকে লাল ঝুটি। আর পালকগুলি যেন সেই সকালেই কেউ মেজে ঝকঝকে করেছে। ময়ূরের রূপও এর কাছে তুচ্ছ। হঠাৎ রসভঙ্গ হল, দুম করে। একটি গুলির আওয়াজ। তীক্ষ্ণ আর্তনাদ করতে করতে পাখিটা উড়ে গেল। সেই আর্তনাদ আজও কানে বাজে। পাশে তাকিয়ে দেখি বন্দুক হাতে বাবা, মুখের ভাব অপরাধক্লিষ্ট। মা বলছেন, “এমন সুন্দর প্রাণীটারে তুমি মারতে পারলা!” মারতে উনি পারেননি। পাখিটা আহত হয়েছে শুধু। সেই রাত্রে আমার খুব জ্বর হয়। বিকারের ঘোরে নাকি বারবার প্রশ্ন করি, “পাখিটা কোথায় গেল?” বাবা আর কখনও শিকারের জন্য বন্দুক ধরেননি।
অনেকদিন পর ঢাকায় বসে বাংলাদেশের পরিচালকদের করা কয়েকটি ছবি দেখি। তার মধ্যে একটি ছবি ঠাকুরমার ঝুলির রাক্ষস-খোক্কসের গল্প নিয়ে। বেশ ছবি, তবে দু-একটা ভুলচুক ছিল। যেমন রাজকন্যা আয়নার সামনে বসে প্রসাধন করছেন। প্রসাধন দ্রব্যর আধারটির উপর লেখা Pond’s Cream। অবশ্যি রূপকথার রাজকন্যা Pond’s Cream মাখবেন না, এমন কোনও শাস্ত্রীয় বিধান নেই। কিন্তু যে ঘটনাটার কথা বলতে যাচ্ছি সেটা বোধ হয় একেবারেই চলে না। বনের ভিতর থেকে রাক্ষসের গর্জন শোনা যাচ্ছে, হাঁউ মাঁউ খাঁউ, মানুষের গন্ধ পাঁউ। (শুনলাম বাংলাদেশের পরিচালকরা নাকি হিমঝরাতেই অরণ্যের দৃশ্যগুলো তুলেছিলেন। আমার শৈশবের ভয়টা নিতান্ত অমূলক ছিল না।) রাক্ষস বন থেকে বেরিয়ে এল। বেশ ভয় করার মতো চেহারা। মুলোর মতো দাঁত, কুলোর মতো কান, অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গও তার সঙ্গে বেমানান না। কিন্তু হঠাৎ রসভঙ্গ হল। রাক্ষসকে ঢাকা দিয়ে একটি ট্রাক চলে গেল। ট্রাক আর রাক্ষস? এদের সহাবস্থান বোধ হয় কোনও শিল্পশাস্ত্রই অনুমোদন করবে না।
কক্সবাজারে ফিরে একদিন সকালবেলা দেখলাম বাড়ির আবহাওয়া অন্য রকম। সকলেরই মুখ গম্ভীর কিন্তু শান্ত। কোনও বিরোধ বা অশান্তির ছায়া নেই। বাবা অন্য দিনের মতো খদ্দরের ধুতি-পাঞ্জাবি পরেছেন। অতিরিক্ত মাথায় একটি গাঁধী টুপি। মা’র পরনেও খদ্দরের শাড়ি। নগা কোথা থেকে খদ্দরের একটা ফতুয়া জোগাড় করেছে, ওরও মাথায় গাঁধী টুপি। বারান্দায় আমরা সকলে পা-মুড়ে বসলাম। মা দুটো গান করলেন, “বল বল বল সবে শত বীণা বেণু রবে ভারত আবার জগৎ সভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে’’ আর ‘গান্ধী-গান্ধী বলে রব উঠল জগতে’। তারপর হাঁড়িকুড়ি বাসনকোসন কিছু নিয়ে আমরা সমুদ্রের পাড়ে গেলাম। সেখানে কটা ইটের উপর হাঁড়ি চাপানো হল, নীচে কাঠকুটো আর খবরের কাগজ দিয়ে আগুন জ্বালানো হল। নগা মহা উৎসাহে সমুদ্র থেকে নোনা জল তুলে এনে হাঁড়িতে ঢালল। জল শুকিয়ে এলে নুনটা তুলে নিয়ে একটা মাটির পাত্রে রাখল। সঙ্গে সঙ্গে গলা ফাটিয়ে ধ্বনি, “মহাত্মা গান্ধীকি জয়।” আমরাও চেঁচালাম, “জয়”। নগা বলল, “ইংরাজ সরকার নিপাত গেল।” দাদা মুরুব্বিয়ানা চালে আমাকে বুঝিয়ে দিল, “আমরা লবণ আইন অমান্য করলাম।”কথাটার অর্থ বুঝতে কয়েক বছর কেটে গেল। সমুদ্রের পারে আরও কিছু মেয়ে-পুরুষ সমুদ্রের জল এনে নুন তৈরি করছিল। দুটি পুলিশপুঙ্গব বালির উপর দাঁড়িয়ে এইসব ক্রিয়াকর্ম দেখছিল, বোধ হয় ওদের উপর হুকুম ছিল কাউকে কিছু না বলার। ওইদিনে উপমহাদেশের অন্য প্রান্তে ডাণ্ডির সমুদ্রতীরে গাঁধী এবং তাঁর অনুগামীরা ইতিহাস রচনা করছিলেন।