গুরুকুলবাস : প্রথম পর্ব
ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষাকে ইস্কুলের পণ্ডিতমশায় কোনও অজ্ঞাত কারণে মাতৃকুলনাশিনী বলে খুব আনন্দ পেতেন। পরীক্ষার ফল বের হবার পর রাস্তায় দেখা হলেই বলতেন, “মাতৃকুল নাশ ত হইয়া গেল। যাও, এইবার যাইয়া পিতৃকুল নাশ কর।” বলে নিজের রসিকতায় নিজেই খুব কিছুক্ষণ হা-হা করে হাসতেন। এই অর্থহীন রসিকতার পিছনে একটা ঐতিহ্যঘটিত ব্যাপার ছিল। সেটা হচ্ছে উদ্ভট শ্লোকের ঐতিহ্য : শব্দের ধ্বনির সুযোগ নিয়ে কিংবা সমাস-সন্ধি ধাতু-প্রত্যয়ের অপব্যবহার করে প্রতিপক্ষের মাথা ঘুরিয়ে দেওয়া। পণ্ডিতমশায়ের প্রিয় একটি উদ্ভট শ্লোক : “হনুমতা হতারাম, সীতা হর্ষম উপগতা।। ক্রন্দন্তি রাক্ষসাঃ সর্বে হারাম হারামারাম”। আপাত অর্থ-হনুমান কর্তৃক রাম নিহত, তাতে সীতা উৎফুল্ল আর রাক্ষসরা সবাই কেঁদে আকুল–হা রাম হা রাম বলে। প্রকৃত অর্থর ইঙ্গিত শব্দজোটের সন্ধিতে : তা ভাঙলে দাঁড়ায় হা আরাম, আরাম। অর্থাৎ, হনুমান কর্তৃক নিহত রাম না, আরাম মানে কানন, অশোককানন। কিন্তু ম্যাট্রিকুলেশন কেন মাতৃকুলনাশ হবে তার কোনও ব্যাখ্যা ছিল না। ধ্বনিসান্নিধ্যই রসিকতাটির মূল কথা। সে যাক, মোট কথা ওই বাক্যটি বারবার বলে পণ্ডিতমশায় অত্যন্ত আনন্দ পেতেন।
কিন্তু উনি যা-ই বলুন পিতৃকুলনাশের পথ সহজ ছিল না। এখনকার মতো কলেজে সিটের তুলনায় ছাত্রসংখ্যা অতিরিক্ত ছিল না। যেসব কলেজের নামডাক বেশি, সেখানেও যারা ভর্তি হতে চায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তারা শেষ অবধি ভর্তি হতে পারত। এখনকার মতো ভর্তির সময়ে ছাত্রর আত্মহত্যার অথবা মা বাপের সন্ন্যাস রোগ হওয়ার সংবাদ পাওয়া যেত না।
পরীক্ষায় খারাপ করলে ভর্তি হওয়া নিয়ে কিছু সমস্যা হয়তো হলেও হতে পারত, কিন্তু ভাল করলে যে ধরনের সমস্যা হত, তা এখন কেউ কল্পনা করতে পারবে না। তিরিশের দশকে এক পূজাসংখ্যায় একটি ব্যঙ্গরচনা বের হয়েছিল, যত দূর মনে পড়ে লেখক প্রমথনাথ বিশী। সঙ্গে কার্টুন ছিল–ছেলে পরীক্ষায় ভাল করেছে, পিতাঠাকুর স্মিতমুখে ইজিচেয়ারে শয়ান। পাশে কোনও কলেজের হতভাগ্য অধ্যক্ষ জোড় হস্তে জানু পেতে বসে আছেন। টেবিলের নীচে অনুরূপ আর একটি প্রাণীকে দেখা যাচ্ছে, তৃতীয় একজন খাটের তলা থেকে উঁকি দিচ্ছেন। কাহিনির বক্তব্য—ছেলে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় ভাল করেছে। ফলে তাকে নিজের কলেজে ভর্তি করার চেষ্টায় কলেজের সব অধ্যক্ষরা এসেছেন, তাঁদের পকেটে নানা প্রলোভনের ফর্দ। জোড় হস্ত, টেবিলতলাবাসী, খট্রান্তরালাশ্রয়ী এরা সবাই নিলামে নিজ নিজ ডাক পেশ করে চলে যাওয়ার পর বাড়ির সামনের ম্যানহোলে যে-অধ্যক্ষ লুকিয়েছিলেন, তিনি বের হয়ে এসে তাঁর অবিশ্বাস্য যৌতুকের পরিমাণ উল্লেখ করলেন। গৃহভৃত্যকে ঘুষ দেওয়া ছিল, তাই প্রতিদ্বন্দ্বীদের ডাকের মাত্রাটা ওঁর জানা থাকায় ডবল দাম হেঁকে উনি স্বচ্ছন্দে জিতে গেলেন।
কাগজে পরীক্ষার ফল বের হওয়ার পর কোনও কলেজের অধ্যক্ষ আমাদের বাড়ি এসে টেবিল বা খাটের তলায় লুকিয়ে থাকেননি ঠিকই, কিন্তু কলকাতার কোনও কোনও কলেজ থেকে যে ধরনের প্রলোভন দেখিয়ে চিঠি এসেছিল, তা আজকের দিনে বিশ্বাস করা কঠিন হবে। আর একজন দূরদর্শী পিতা পনেরো বছর বয়স্ক ম্যাট্রিক পাস পাত্রটির সঙ্গে তাঁর দ্বাদশবর্ষীয়া কন্যার সম্বন্ধ এনেছিলেন, পাত্রর বাকি পড়াশুনা ইস্তক বিলেত যাওয়া অবধি সব খরচ-খরচা দেবেন এই প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে। নেহাত বাবা আদর্শবাদী স্বদেশিওয়ালা ছিলেন, পণপ্রথায় বিশ্বাস করতেন না, না হলে বিয়েটা হয়েই যেত। ধনীর একমাত্র কন্যা বিবাহ করে বাকি জীবন সুখেস্বচ্ছন্দে কেটে যেত। কপালে নেই তো কী করা যাবে!
এই বিসদৃশ আতিশয্যর পিছনে বিদেশিশাসিত ভারতবাসীর জীবনের যে করুণ কাহিনি প্রচ্ছন্ন আছে, আমরা, বিশেষত যাঁরা সেই স্বর্গরাজ্যের কথা ভেবে মুকুলিত নেত্র হন তাঁরা, তা প্রায় ভুলতে বসেছি। বিশ এবং তিরিশের দশকে বেকার সমস্যা কী ভয়াবহ ছিল তা আমাদের স্মৃতি থেকে প্রায় মুছে গেছে। বি.এ এবং এম.এ-তে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়েও অর্থনীতিবিদ ডক্টর ভবতোষ দত্ত প্রায় সাত-আট বছর বেকার ছিলেন। নীরদ চৌধুরী মশায়ের জীবনের বেশ ক’বছর কেটেছে দৈনিক এক টাকা রোজগারে। বেকারি বা প্রায়োপবাস অনেক উচ্চশিক্ষিত মধ্যবিত্তরই অভিজ্ঞতার অঙ্গ ছিল। আজ যেসব বাম এবং দক্ষিণপন্থী চিন্তাবীর জহরলাল নেহরুর পিতৃতর্পণ না করে প্রাতরাশ করেন না, তাঁরা মাঝে মাঝে ব্রিটিশ শাসনের স্বর্ণযুগ স্মরণ করলে দেশের কিছু উপকার হতে পারে।
যেখানে সুযোগ-সুবিধা এত সীমিত ছিল, সেখানে যাঁদের জীবনে কিছুটা সাফল্যের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে তাঁদের নিয়ে বঞ্চিত সমাজে একটু বাড়াবাড়ি হওয়া আশ্চর্য কিছু না, যদিও সবাই জানত যে, পরীক্ষার ফল ভাল হওয়া ভাল রোজগারের কোনও গ্যারান্টিও নয়। তা ছাড়া উনিশ শতক থেকেই বাঙালি সমাজে পরীক্ষার ফল নিয়ে মাতামাতি করার একটা। ঐতিহ্য দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। এখন এই প্রবণতা কিছুটা কমেছে মনে হয়। তবে সম্ভবত মূল্যবোধের দিক থেকে কার কত মাইনে, কত বড় বাড়ি তা নিয়ে আলাপ-আলোচনার চেয়ে পরীক্ষার ফল নিয়ে মাতামাতিটা ভাল ছিল। শুনি আমাদের উঁচু মানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আজকালকার স্মার্ট ছাত্রীরা, যেসব মেয়েরা মন দিয়ে পড়াশুনা করে তাদের নাম দিয়েছে জবাকুসুম টাইপস। এই অভিধার সৃষ্টিকারিণীরা সম্ভবত মাথায় তেল দেয় না অথবা কেশবাস বহু বর্ণে রঞ্জিত করে। একটা কথা বলে এই প্রসঙ্গ শেষ করি। প্রাইভেট কলেজগুলি ভাল ছাত্র জোটাবার জন্য ব্যস্ত থাকত, কারণ কলেজের সুখ্যাতি পরীক্ষার ফলের উপর নির্ভর করত, এবং কলেজের ছাত্রসংখ্যা নির্ভর করত তার সুখ্যাতির উপর।
কিন্তু যাদের নিয়ে মাতামাতি করা হত তাদের পক্ষে এর ফলটা ভাল হত না। পনেরো ষোলো বছর বয়সে বেশির ভাগ মানুষের বুদ্ধি পাকে না। অবশ্যি পরেও যে পাকে তার কোনও স্থিরতা নেই। অপরিণতবয়স্ক মানুষকে নিয়ে বেশি আমড়াগাছি করলে সে তার নিজের সত্যিকার পরিমাপটা বুঝতে শেখে না। আমড়াগাছির ফলে আমি স্বয়ং নিজেকে মহাপণ্ডিত ভাবতে শুরু করেছিলাম। আমার মূর্খত্ব যে কত গভীর তা যতদিনে বুঝলাম ততদিনে সত্যিকার পাণ্ডিত্য অর্জনের সময় চলে গেছে। অনেক সময়ই দেখা যেত, প্রথম দিকের পরীক্ষায় যারা ভাল করত শেষে তারা বিশেষ সুবিধে করতে পারত না। কিন্তু নিজের সম্পর্কে ধারণা এবং প্রত্যাশাটা অতিরিক্ত বেড়ে যাওয়ায় বাকি জীবন ব্যর্থতাবোধে ভুগত। আমার এক পরিচিত ব্যক্তি ম্যাট্রিক পরীক্ষায় ‘স্ট্যান্ড’ করেছিলেন অর্থাৎ তিনি প্রথম দশজনের মধ্যে একজন ছিলেন। আশি পার হয়েও তাঁর এই আক্ষেপ যায়নি যে, ম্যাট্রিকে যারা তাঁর থেকে মাত্র তিন-চার নম্বর বেশি পেয়েছিল তারা এখন করে খাচ্ছে। এই পরীক্ষাকেন্দ্রিক চিন্তার আর এক অপূর্ব উদাহরণ দেখেছিলাম সত্যজিৎ যখন ভারতরত্ন উপাধি পান। ওঁর সহপাঠী এক অত্যন্ত পণ্ডিত ব্যক্তি মন্তব্য করলেন, “আরে ও তো বি.এ-তে আমার চেয়ে অনেক কম নম্বর পেয়েছিল।”
.
যা হোক, কলেজে ভর্তি হওয়ার কাহিনিতে ফিরে আসি। দাদাকে নিয়ে আমরা তিন পুরুষ প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র। ইস্কুলে ছাত্রাবস্থায় পরে আমার ইংরেজি সাহিত্য পড়ার ইচ্ছে। বেশ কিছুদিন ধরে তারক সেন, শ্রীকুমার ব্যানার্জি, সুবোধ সেনগুপ্ত, তারাপদ মুখার্জি, সোমনাথ মৈত্র প্রমুখ ইংরেজি সাহিত্যের ডাকসাইটে শিক্ষকদের নাম শুনে আসছি। কিন্তু শেষ অবধি ভর্তি হলাম গিয়ে স্কটিশ চার্চ কলেজে। তার কারণ কিছুটা বিচিত্র। আমার দাদা পড়াশুনায় কোনও অর্থেই খারাপ ছিলেন না। কিন্তু মা-বাবার ধারণা ছিল যে, উনি চেষ্টা করলে আরও অনেক ভাল করতে পারতেন। কথাটা অবশ্যই সত্যি। কিন্তু বহুমুখী প্রতিভাসম্পন্ন মানুষটি ওই চেষ্টাটি করতে রাজি ছিলেন না, কারণ ওঁর ধারণা ছিল–রূপরসবর্ণগন্ধময় জীবনের সব কিছু উপেক্ষা করে পরীক্ষায় ভাল করার চেষ্টাটাই সফল এবং সার্থক জীবনযাত্রার একমাত্র পথ না। এই পারিবারিক দ্বন্দ্বর ফলে ছোটবেলা থেকেই ওঁর মেজাজটা বিদ্রোহী ধরনের হয়ে গিয়েছিল। কোনও অবস্থায়ই উনি যাঁদের হাতে ক্ষমতা, মানে ইংরেজিতে যাকে বলে ‘অথরিটি ফিগার’, তাঁদের সহ্য করতে পারতেন না।
বরিশালের বি.এম কলেজ থেকে ফার্স্ট ডিভিশনে আই.এ পাস করে উনি প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। কিন্তু ওখানকার অনেক কিছুই ওঁর ভাল লাগেনি। ওঁর বক্তব্য—এখানে বেশ কিছু শিক্ষক বড়লোকের ছেলেদের বেশি খাতির করে। কলেজটা ছেঁদো স্মবারির একটি ডিপোবিশেষ। আর জাতীয়তাবাদী ছাত্রদের উপর বিশেষ নজর রাখা হয়। একজন শিক্ষক যে টিকটিকি সেকথা সবাই জানে। এইসব কথা দাদা বেশ নির্ভরযোগ্য উদাহরণ দিয়েই বলতেন। ফলে আমার ভক্তি ছুটে গেল। অনেক খোঁজখবর নিয়ে আমি স্কটিশ চার্চ কলেজে ভর্তি হলাম। প্রধান আকর্ষণ—ইংরেজির বিখ্যাত অধ্যাপক মোয়াট সাহেব।
থাকার ব্যবস্থা হল বিডন স্ট্রিটের এক প্রান্তে মানিকতলা বাজারের উলটো দিকে ডাফ হস্টেলে। তার অন্যতম আকর্ষণ দুবেলা মাংস খেতে দেয়, যদিও তার পরিমাণ দশ থেকে পনেরো গ্রামের মধ্যে। খাওয়ার সময় অণুবীক্ষণ যন্ত্র হাতে থাকলে খুঁজে পেতে অসুবিধে হত না। ডাফ হস্টেল প্রধানত খ্রিস্টান ছাত্রদের জন্য তৈরি হয়েছিল। কিন্তু খ্রিস্টানসংসর্গে আহারবিহার সম্পর্কে কুসংস্কার ত্যাগ করে কিছুদিন বাস করলে হিন্দু ছাত্ররাও হয়তো সত্যধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হতে পারে, সম্ভবত এই আশায় এক সময় ওখানে অখ্রিস্টান ছাত্রদের নিখরচায় থাকতে দেওয়া হত। আমাদের সময় খরচা দিতে হত, কিন্তু অন্য কলেজের ছেলেদের তখনও থাকতে দেওয়া হত। সেই সুবাদে দাদা প্রেসিডেন্সির ছাত্র হয়েও হিন্দু হস্টেল ছেড়ে দুই ভাই একত্র থাকার সুবিধে হবে এই বিবেচনায় ডাফ হস্টেলে চলে এলেন। আর একই নিয়মের সুযোগ নিয়ে বি.এ ক্লাসে উঠে প্রেসিডেন্সি কলেজে চলে গেলেও ছাত্রাবস্থায় পুরো সাত বছর আমি ডাফ হস্টেলের বাসিন্দা ছিলাম। জীবনের প্রথম বড় বড় ঘাত-প্রতিঘাতগুলির অভিজ্ঞতা ওইখানে থাকার সময়ই হয়। কলকাতার নেশাও ওইখানেই আমাকে প্রথম পেয়ে বসে। সে নেশা আজও কাটেনি।
সে সময়কার খরচ-খরচা সায়েস্তা খাঁর আমলের তুলনায় খুব বেশি ছিল এমন বলা চলে না। হস্টেলে দুবেলা খাওয়া, সকালের চা আর ইলেকট্রিক খরচা সহ ঘর ভাড়া ছিল একুশ টাকা। আমায় মাইনে দিতে হত না, ফলে চল্লিশ টাকায় মাস বেশ ভালই চলে যেত। হস্টেলের নিয়ম অনুযায়ী প্রত্যেক বাসিন্দাকেই পালা করে বাজার যেতে হত। তাই চল্লিশের দশকে কলকাতার বাজারদর আমাদের বেশ সড়গড় হয়ে গিয়েছিল। মাছের দর ছিল সের প্রতি ছ’আনা। বর্তমান প্রজন্মের বোঝার সুবিধের জন্য বলছি—সের আর কিলোগ্রাম প্রায় তুল্যমূল্য। আর ষোলো আনায় এক টাকা হত। মাংস আর গলদা চিংড়ি ছিল সের প্রতি বারো আনা। দুধ ছিল চার আনা সের। ছ’ আনায় একটা মুরগি পাওয়া যেত। আর দু আনা খরচা করে হস্টেলের বাবুর্চিকে দিয়ে রাঁধিয়ে নেট আট আনা ব্যয়ে চারজনে একটা মুরগি মাঝে মাঝেই খেতাম। চিনা রেস্তরাঁয় পেট ভরে খেতে মাথাপিছু দু-তিন টাকার বেশি পড়ত না। আর ফারপোর বিখ্যাত তিন কোর্স লাঞ্চের বাঁধা দাম ছিল তিন টাকা। সিনেমার টিকিটের দাম ছিল ন আনা। উঁচু ক্লাসের টিকিট এক টাকা দু আনা। ‘৪৩-এর দুর্ভিক্ষের পর থেকে জিনিসপত্রের দাম বাড়তে শুরু করে। বেড়েও ‘৪৭ সনে যখন হস্টেল ছাড়ি তখন হস্টেল খরচা মাসিক একুশ টাকার জায়গায় আটত্রিশ টাকা দাঁড়িয়েছিল। উনিশ শতকে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের মাইনেয় বাঙালিবাবুরা কেন এত শ্লাঘা বোধ করতেন গত শতাব্দীর চল্লিশের দশকের এই বাজার খরচার হিসাব থেকে তার কিছুটা হদিশ পাওয়া যায়।
ডাফ হস্টেলে বাসিন্দার সংখ্যা মাত্র পঞ্চাশ। কিন্তু সংস্কৃতি বৈচিত্র্যে জায়গাটি সত্যিই অসাধারণ ছিল। যাকে বলে নানা দিগদেশাদাগত্য নানাবিধঃ পক্ষিণঃ নিবসন্তি। পক্ষীদের মধ্যে একটি বড় অংশ কেরল থেকে আসা সিরিয়াক খ্রিস্টান। তারা যে ‘মাদ্রাজি’ নয়, এ কথাটা বুঝতে বেশ কিছু সময় লেগেছিল। কিন্তু আমাদের সহাধ্যায়ী কিছু কিছু বঙ্গপুঙ্গবের কাছে ওদের মাদ্রাজিত্ব কিছুতেই ঘোচেনি। অবজ্ঞার ভাব প্রবল হলে বলত, মদ্র।
মহাভারত-অনুযায়ী মদ্রদেশটা বিন্ধ্যের দক্ষিণে না, পঞ্জাবে, কিন্তু সেকথা তাদের কে বোঝাবে? নানা দিক থেকেই ওদের আহারবিহার আমাদের থেকে স্বভাবতই অন্য ধরনের ছিল। পঁচানব্বই ভাগ জল আর পাঁচ ভাগ দই দিয়ে ওদের জন্য দহিপানি তৈরি থাকত। ভাতের সঙ্গে দহিপানি মেখে নিয়ে তারপর তারা ওই দিয়ে ডাল-তরকারি খেত। আর ওরা বাড়ি থেকে নারকেলের গুঁড়োর সঙ্গে মেশানো নানা মশলার একটা মিক্সচার নিয়ে আসত, সে বস্তুটিও ভাত আর দহিপানির সঙ্গে খাওয়া হত : বিস্বাদ না, কিন্তু ব্ৰহ্মতালু বিদারক রকমের ঝাল। আরও দক্ষিণ থেকে সিংহলদেশবাসী কিছু বৌদ্ধ ছাত্রও ওখানে থাকত। তাদের নামবৈচিত্র্যে চমৎকৃত হতাম। একটি স্মরণীয় নাম স্মৃতিতে গেঁথে গিয়েছিল–ডাম্বুরি লিয়ানাগি ধনপাল সমরশেখর। নামের মালিকটির সঙ্গে বহুদিন পর দিল্লিতে আবার দেখা হয়। তখন সে সিংহলের হাই কমিশনে ফার্স্ট সেক্রেটারি। সাক্ষাৎমাত্র তাঁকে তাঁর পুরো নামটি গড়গড় করে বলে যাওয়ায় মানুষটি খুব খুশি। নিজের নামের চেয়ে প্রিয় জিনিস মানুষের আর কী-ই বা আছে? এরা ছাড়া বেশ কিছু পর্বতনন্দনও ওই মহাদ্রুমে বাসা বেঁধেছিল—বেশির ভাগই খাসিয়া বা ভুটিয়া, দু-একজন তিব্বতিও ছিল। তিব্বতিদের মধ্যে একজনের বাড়ি ছিল লাসা। আমরা ধরে বসলাম, লাসা যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিতে হবে। সে ভরসা দিল—এ আর এমন কী কথা? সে তার তিন নম্বর বাবাকে বললেই ব্যবস্থা হয়ে যাবে। ব্যাপারটা সে বুঝিয়েও দিল। ওদের অভিজাত পরিবারে ক’ভাই মিলে একটি মেয়েকে বিয়ে করে, সম্পত্তি যাতে ভাগ না হয়ে যায়। ফলে সব ভাইরাই বাবা, কেউ আর কাকা-জ্যাঠা না। ওর তিন নম্বরি বাবা দলাইয়ের ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টা। তাঁর ভরসায়ই ও আমাদের আশ্বাস দিয়েছিল।
পর্বত অঞ্চল থেকে যারা আসত, বিশেষত খাসিয়ারা, তারা দেখতাম অনেকেই আমাদের তুলনায় অর্থবান এবং তাদের জীবনযাত্রার ধরন অনেক বেশি পশ্চিমায়িত। আমরা সে যুগে ধুতি-পাঞ্জাবি-পায়জামা পরতে অভ্যস্ত ছিলাম। এরা বেশ দামি সুট-বুট-টাই পরত। তার চেয়েও বড় তফাত ছিল আর এক ব্যাপারে : এরা প্রায় সবাই এবং বেশ কিছু অহমিয়া ছাত্র সন্ধে হলেই বোতল আর গেলাস নিয়ে বসত। এটা উপজাতীয় প্রথা না সাহেবদের কাছে শেখা তা কখনও ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি। বোধ হয় মদ্যপানটা উপজাতীয় ব্যাপার, হুইস্কিটা পশ্চিমাগত। তখনও বাঙালির ঘরে ঘরে হুইস্কিদেবীর নিত্যপূজা চালু হয়নি। ফলে রোজ সন্ধ্যায় কিছু ছাত্ৰ একত্র বসে চুটিয়ে মদ খাচ্ছে, এ ব্যাপারটা একটু বিসদৃশ মনে হত।
কিন্তু মদ খাওয়া কাকে বলে এবং তার আনুষঙ্গিক বিলাস কত দূর যেতে পারে সেটা দেখাল রেঙ্গুন জাপানিদের হাতে যাওয়ার পর বর্মা থেকে পালিয়ে আসা উদ্বাস্তু ছাত্ররা। প্রথম কথা, এরা বেশ ক’জন অত্যন্ত ধনী ঘরের ছেলে। রেঙ্গুন পতনের আগে এদের অবস্থা কী ছিল জানি না, কিন্তু পরে যা ছিল তা যে বেশ কয়েক পুরুষ অধঃপাতে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট তা বুঝতে কোনও অসুবিধে হত না। এইসব স্বর্ণমণ্ডিত তরুণ হস্টেলে আহারাদি কমই করতেন। সন্ধে হলেই চার-পাঁচ জন ইয়ার একত্র হয়ে দু-চার পাত্র পানাদি হত। রাত্রের আহারটা প্রায়ই ফারপো বা পেলেটির বাড়িতে সেরে নিয়ে ওই অঞ্চলেই বিহারটাও সারতেন। হস্টেলে ফিরতে ফিরতে মাঝরাত। কখনও কখনও দেখতাম এঁরা সকালের দিকে ফিরছেন—অধরের তাম্বুল বয়ানে লেগেছে ঘুমে ঢুলুঢুলু আঁখি গোছের অবস্থা। মানে তাম্বুলও যা লিপস্টিকও তা। বিহার বলে কথা!
.
আমাদের হস্টেলে সংস্কৃতিগত বৈচিত্র্যের পরিপূরক ছিল বিচিত্র ব্যক্তিত্বের সমাবেশ। বংশীবাদক দাশরথি, যার কথা রোমন্থনে লিখেছি, স্কটিশ চার্চ কলেজটাকে নিতান্তই অনুরাগচর্চার একটা সুযোগ—মানে ইংরিজিতে যাকে বলে ‘ফেসিলিটি’ বলে ধরে নিয়েছিল। পুস্তক বস্তুটি তাকে স্পর্শ করতে কখনও দেখিনি। তবে মাঝে মাঝে হাতে একখানা গানের খাতা নিয়ে ঘুরতে দেখেছি। ফলে ওর জীবনে এক অদ্ভুত প্যারাডক্স দেখা দিল। যে ক্লাসে ও কখনও যায়নি, বছরের পর বছর ও সেই ক্লাসেই রয়ে গেল। কতকটা সেই নেই তাই খাচ্ছ, থাকলে কোথায় পেতে গোছের ব্যাপার আর কী! ক্লাসে ও শেষ অবধি এল-যখন ভাগ্যদোষে এম, এ পাস করে স্কটিশ চার্চ কলেজে মাস দুই পড়াচ্ছি, তখন। দেখি ক্লাসে ইতস্তত ঘুরে বেড়াচ্ছে। প্রশ্ন করলাম, এটা কী হচ্ছে? ‘সিট খুঁজে পাচ্ছি না, স্যার!’ অচেনা জায়গা, অসুবিধে হবারই কথা। বলোম, বাঁদরামি কোরো না, বসতে হয়তো বসো, না হলে কেটে পড়ো। অমনি চারিদিক থেকে ধ্বনি উঠল, “ঝগড়া করবেন না স্যার, ঝগড়া করবেন না।” মানে দাশু যে আমার ছাত্র না, ইয়ার—এ তথ্যটা ও সবাইকে আগেই বুঝিয়ে দিয়েছিল। ইয়ার্কি করতে গিয়ে দাশুর একবার জীবন বিপন্ন হয়েছিল। অসমের খগেন চৌধুরিকে আমরা কেউ ঘাঁটাতাম না, কারণ বিচিত্র স্বভাবের মানুষটি কখন কী করে বসবে তার কিছু ঠিক ছিল না। ওর উচ্চারণ অনুকরণ করে আড়ালে আমরা ওকে শৌডরি বলতাম, কিন্তু তা নিতান্তই আড়ালে। কারণ মুষ্টিযোদ্ধা খগেন যে-কোনও সময় তার অর্জিত বিদ্যা ব্যবহার করতে প্রস্তুত ছিল। খগেন-দাশরথি সংবাদটা খগেনের ভাষায়ই বলি, এবং যতটা সম্ভব তারই উচ্চারণে। “বোঝলেন, আইজ একটা কাণ্ড হৈআ গেল। আমি দাশুর ঘরে গিশিলাম। সে একটা কিছু কইল। কী কইল খেয়াল করি নাই তখন। বাইর হইয়া গেলাম। হেদুয়া পর্যন্ত গিয়া হঠাৎ খেয়াল হইল, দাশু আমারে অপমান করছে। মেজাজ গরম হইয়া গেল। হস্টেলে ফিরিয়া আইলাম। তারপর দাশুর দরজায় গিয়া, টক, টক-দুইটা টোকা দিলাম। দাশু দরজা খুল্লিয়া দিল। ওর মুখের দিকে তাকাইলাম না, তাকাইলে রাগ পড়িয়া যাইত। দরজা খুলতেই, ধরাম, ডাইন হাতে একটা ঘুষি, একটা দাঁত পড়িয়া গেল। ধরাম, আর একটা ঘুষি—এইবার বাঁ হাতে। আর একটা দাঁত পড়িয়া গেল। আমারও রাগ পড়িয়া গেল। দাশুরে হেদুয়া নিয়া গিয়া একটা কুলফি খাওয়াইয়া দিলাম। ঠিক করি নাই?” প্রশ্নটার লক্ষ্য কোন দিকে—দাঁত ওপড়ানো না কুলফি খাওয়ানো—তা বুঝতে না পেরে নিরুত্তর থাকাই নিরাপদ মনে হল। চৌধুরি সাহেবের পরবর্তী ইতিহাস বড় করুণ। কোনও কারণে স্ত্রীর উপর উনি চটে যান। তারপর প্রথমে তাঁকে এবং তারপর নিজেকে গুলি করে জীবনান্ত ঘটান। এবার আর রাগ পড়ে গেলে কলহটা মিটিয়ে ফেলার পথ উনি খোলা রাখেননি।
আরও কয়েকটি চরিত্র বেশ মনে আছে। অসম থেকে আগত মওলা সাহেব উড়ুক্কু বাহিনীতে যোগ দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন, তাই আকাশে যা কিছু ওড়ে সে সম্বন্ধে উনি ‘অন্তিম জ্ঞানের আধার’, ফাইনাল অথরিটি। বড় কিছু আকাশে উড়ছে দেখলেই বলতেন, “ইডা? ইডা ত ইয়ারক্রাফট কেরিয়ার।” না, বানান ভুল করিনি। এয়ার শব্দটা ওঁর উচ্চারণে ইয়ারই হয়ে যেত। তাছাড়া আকাশে উড্ডীয়মান যানে কিছু ইয়ার-বখসি নিশ্চয়ই থাকত। শ্রীহট্টবাসী আলি সাহেব ছিলেন অত্যন্ত পড়ুয়া ছেলে। রাত এগারোটায় হস্টেলে বৈদ্যুতিক আলো নিভিয়ে দেওয়া হত, তখন উনি খ্যানখেনে গলায় রাস্তার ওপারে দোকানদার কাশীর শরণাপন্ন হতেন, “খাশী-ই-ই অ খাশী-ই, মুম আছে, মুম?” এই মোম সংগ্রহ ব্যাপারটা কেন রাত এগারোটার আগে সম্ভব হত না, এই রহস্যের কখনও সমাধান হয়নি। হস্টেলের পোয়েট লরিয়েট দাশু ব্যাপারটাকে কাব্যে অমরত্ব দিল :
মুম জ্বালাইয়া, দরজা আটকাইয়া
রোজ পড়ে কেডা?
আলি সাহেব এডা।
খুল্লোঁ থেকে আগত সাহাবাবু কিছুটা গাঁওয়ার ছিলেন সন্দেহ নেই, কিন্তু তাই বলে তাঁর উচ্চাশার কিছু অভাব ছিল না (আজকাল রাজনৈতিক শুদ্ধতাবাদের যুগ, সুতরাং বলে রাখা ভাল যে খুল্লোঁ উচ্চারণটা আমার না, স্বয়ং সাহাবাবুর)। হস্টেলবাসীর মধ্যে বালাসোর-নন্দন ভবেশ রায় ছিলেন কলেজের প্রধান মহিলানবিশ। সর্বদাই দেখা যেত ‘ভবেশদা, ভবেশদা’ করে একপাল মেয়ে ওর পিছন পিছন ঘুরছে। এর কারণ, ব্রহ্মচর্য ভবেশের সহজাত প্রবৃত্তি। সে মেয়েদের ব্যবহার করত নিছকই সংগঠন আর চাঁদা আদায়ের কাজে। ফলে তারা শ্রদ্ধায় মুহ্যমান, ন্যুব্জদেহ। মাঝে মাঝে তার আদর্শবাদী কার্যকলাপে আমাদের বিশেষ হেনস্থা হতে হত। মে মাসের কাঠফাটা গরম। ঘরে কোনও রকমের পাখাই নেই। খালি গায়ে ইজার পরে শুয়ে হাঁসফাঁস করছি। এমন সময় দরজায় করাঘাত। কে আর আসবে এ সময়? যেমন ছিলাম তেমন থেকেই দরজা খুললাম। দেখি চাঁদার খাতা হাতে দুই সুন্দরী, তাদের একজন নীলাঞ্জনা মেহতা, পরবর্তী জীবনে আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু সুভাষ ধরের স্ত্রী। অদুরে পালের গোদা ভবেশ। ভবেশের এক জোড়া গোঁফ ছিল। সত্যিই ইচ্ছে হল ওর গোঁফ ধরে খুব নাচি।
সে কথা যাক। মফস্সলের নারীসঙ্গবর্জিত জীবন থেকে হঠাৎ সহশিক্ষায় উত্তরণ সাহাবাবুর পক্ষে সহজ হয়নি। উনি স্পষ্টই বিচলিত। দুর্বার যৌবনের ভার লাঘব করার জন্য উনি ভবেশের কাছে পাঠ নেবেন ঠিক করলেন। ওর দ্বারস্থ হয়ে জিগ্যেস করলেন, “ভবেশবাবু, একটা কথা কয়েন দেখি। মাইয়ারা আপনারে এত পছন্দ করে ক্যান?” ভবেশ কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে, গোঁফ চুমরে বলল, “রোনাল্ড কোলম্যানের ছবি দেখেছেন?” “হেইডা আবার কেডা?” মেট্রোর লবিতে নিয়ে গিয়ে সাহাবাবুকে রোনাল্ড কোলম্যানের ছবি দেখিয়ে ভবেশ হেইডা কে বুঝিয়ে দিল। পারিশ্রমিক হিসাবে এক টাকা দু-আনার সিটে ভবেশকে ছবি দেখাতে হল। তদুপরি কাফে ডি মনিকোতে কবরেজি কাটলেট আর আইসক্রিম সানডি। এক চামচে আইসক্রিম মুখে তুলে ভবেশের প্রশ্ন, “বুঝলেন কিছু?” “ছবি দ্যাখলাম, হ্যাতে বোঝনের কী আছে?” “হুঁ। রোনাল্ড কোলম্যান হলিউডে মেয়েদের মধ্যে সব চেয়ে জনপ্রিয় নায়ক।” “হ্যাতে আমার কী আউগগাইল? অর মতো চেহারা ত আমার সাত জন্মেও হইবে না!” নিরাশায় সাহাবাবু ভেঙে পড়লেন। ভবেশ আশ্বাস দিল, “মিস্টার সাহা, চেহারাটা কিছু না। কলেজে তো কত লালটু ছেলে আছে। তাদের পিছন পিছন মেয়েরা ঘোরে? আসল ব্যাপারটা বুঝুন। রোনাল্ডের গাল ভাঙা আর আমারও তাই। মেয়েদের কাছে ভাঙা গালের আকর্ষণ দুর্নিবার। ওইটেই হচ্ছে আসল কলকাঠি।” “তয় ত আমার কোনওই ভরসা নাই। যহন পোলাপান আছিলাম তহন থিয়া মায়ে দুধ-ঘি খাওয়াইয়া খাওয়াইয়া খোদার খাসির মতো মোডা করছে। এহন ভাঙা গাল হইবে কেমনে?” ভবেশের মুখে শার্লক হোমসের মতো রহস্যময় হাসি, “পথ আছে, আছে। তবে সাধনা করতে হবে।” বলে সাহার কানের কাছে মুখ নিয়ে সাধনার পথ বাতলে দিলেন। সাহা উদ্ভাসিত মুখ, “হেয়া তো পেরায়ই হয়।” “কয় বার?” “হফতায় বার দুই ত হয়ই।” “না, তার কাজ না। সংখ্যাটা বাড়াতে হবে”। এর পর থেকে ম্যালভোলিওর মতো আহ্লাদিত মুখে সাহাবাবু ঘুরে বেড়ায় আর রোজই ভবেশের কাছে বুলেটিন পেশ করে। “আইজ তিনবার। আইজ চাইর বার।” ইত্যাদি। সংখ্যাটা সাতে পৌঁছলে ভবেশের কাছে ডেলিগেশান গেল, “ভবেশদা, এবার থামান। লোকটা মরে যাবে।” ভবেশ সাহাকে গাল ভাঙার অব্যর্থ মহৌষধ হিসাবে ব্যবস্থা দিয়েছিল—আত্মরতি।
আর যারা ছিল, তাদের মধ্যে দু’জনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব হয়েছিল,—ইতিহাসের ছাত্র কবি সত্যমাধব দত্তচৌধুরি আর স্ট্যাটিস্টিকসের ছাত্র জামান সাহেব ওরফে কামারুজ্জমান, হুমায়ুন কবীরের ভাগনে। এক জার্মান ভদ্রমহিলার কাছে জামান আর আমি ফরাসি শিখতে যেতাম। সেই সূত্রেই ওর সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা হয়। ভাষা শেখার ব্যাপারে ওর অসাধারণ দক্ষতা ছিল। তাই এক সঙ্গে পড়াটা বেশিদিন চলেনিঃ ও যখন দশ নম্বর পাঠে পৌঁছে গেছে, আমি তখনও ছয়ে ঠেকে আছি। কিন্তু ওই যে ক্লাসের পর সাঙ্গুভ্যালির চায়ের দোকানে বসে দু-আড়াই ঘন্টা আড্ডার অভ্যেস হয়ে গেল, তার কিছু রদবদল হল না। সাঙ্গুভ্যালি থেকে হস্টেল, তারপর নীচে খাওয়ার ঘরে গিয়ে কিছু অখাদ্য ভক্ষণ। দুটো নাগাদ বলি, “জামান সাহেব, এর পরের ক্লাসটা করব ভাবছি।” “কেন বাজে কথা বলছেন? গিয়ে তো হেদোয় বসে থাকবেন। ক্লাসটা কার?” “মিস রবির।” “ও, তাই এত উৎসাহ! আরে অনেক দেখেছেন। এমন কিছু দেখতে না। পড়াতে তো একেবারেই পারে না। রূপ দেখিয়েই রয়ে গেল। বসুন, বসুন। বেট ডেভিসের ছবি হচ্ছে। চলুন। সে রবির চেয়ে অনেক ভাল দেখতে।” মেট্রোতে বেট ডেভিসের ছবি দেখার আগে জহুরকে ডেকে সামনের দোকান থেকে বার দুই চা আনানো হল। এক চুমুক খেয়ে মুখ বিকৃত করে জামান সাহেব বল্লেন,”অপেয়।” বাকিটা মুখ না বিকৃত করেই খেলেন। রোজ একই ঘটনা ঘটে। সামনের দোকানের অপেয় চা দিনে পাঁচ-ছ কাপ খাওয়া হয়। চা খাওয়ার পর বেট ডেভিসের ছবি। তারপর কাফে ডি মনিকো। “একটু ইডেন গার্ডেনে ঘুরে আসবেন না কি? আরে একটু হাঁটাচলা করুন। বড়ই আলসে হয়ে যাচ্ছেন।” তথাস্তু। ইডেন গার্ডেনে হাঁটাচলা করে আলসেমির চিকিৎসা। তারপর “চাং ওয়ায় না খেয়ে কি আর হস্টেলে ফিরবেন? আপনাকে আমি চিনি না?” সম্ভবত আমি নিজেই নিজেকে চিনতাম না। ফলে চাং ওয়ায় না খেয়ে হস্টেলে ফিরলাম না। চাং ওয়া এবং নানকিঙের সঙ্গে জামানের সূত্রেই ঘনিষ্ঠ পরিচয় হল। হস্টেলে ফিরতে ফিরতে প্রায় রাত এগারোটা। মোট এগারো ঘণ্টা নিরঙ্কুশ বিলাসব্যসনে ব্যয়িত হয়েছে। অবশ্যি সাকুভ্যালি আর কাফে ডি মনিকোতে যেসব চপকাটলেট খাওয়া হয়েছে তাতে বিলাসের চেয়ে বেসনের অংশই বেশি। দেহমন আত্মগ্লানিতে অবসন্ন। শেষে কি বর্মার উদ্বাস্তুদের অনুগামী হব? সারা দিনে পুস্তক স্পর্শ হয়নি। রাত্রে দুঃস্বপ্ন দেখি, থার্ড ডিভিশনে আই. এ. পাস করেছি। পাঠের শত্ৰু শুধু জামান সাহেব না। একদল সহপাঠী ক্লাস শেষ হতে না হতে ঘরে এসে জুটত, তারপর দু-তিন ঘণ্টা নিরেট আড্ডা। এই পালের গোদা ছিল বর্তমানে বিখ্যাত নাট্যকার বাদল সরকার, যার বাস ছিল পাশের রাস্তায়, প্যারী রো তে। বাদলের নাট্যপ্রতিভা তখনও প্রকাশ পায়নি, কিন্তু আড্ডাপ্রতিভা অসামান্য। কে তখন ভেবেছিল যে এই বিজ্ঞানের ছাত্রটি একদিন নাটকের জগতে আসাধারণ প্রতিভা বলে স্বীকৃত হবে!
সত্যমাধবের কথাটা বলা হয়নি। সে ছিল নিরঙ্কুশ ভাল ছেলে। ঘড়ি ধরে ছ ঘণ্টা পড়াশুনো করত আর ইতিহাস অনার্সে যেসব প্রশ্ন আসার সম্ভাবনা, ফিতে দিয়ে মেপে তার প্রতিটির ঠিক খাতার পৃষ্ঠার তিন পৃষ্ঠা লম্বা উত্তর লিখত, কারণ ওর চেয়ে বেশি পরীক্ষার হলে লেখা সম্ভব না। এইসব সাধনভজনের পর যা সময় থাকত তা ব্যয়িত হত কবিতা লিখে, ইংরেজি-বাংলা উপন্যাস পড়ে আর সপ্তাহে একটা সিনেমা দেখে। তিনটের শোতে, কারণ ওই সময় টিকিটের দাম কম। শৈশবে পিতৃহীন সত্যমাধবের স্থির লক্ষ্য ছিল একটিই–অনিশ্চয়তামুক্ত সচ্ছল জীবন। এর বেশি কিছু ও চাইত না। কিন্তু বাঁধা পথের পথিক এই মানুষটি অনন্যসাধারণ ছিল জীবন ও জগৎ সম্বন্ধে তার মূল্যায়নে। শেক্সপিয়ার, নিউটন, আইনস্টাইন বা রবীন্দ্রনাথের স্তরের মানুষ ছাড়া আর কারও জীবন বা কীর্তিতে প্রশংসনীয় ও কিছু পেত না। বাকি সবই দ্বিতীয় শ্রেণির, সেকেন্ড ক্লাস। কলেজের বিখ্যাত সব অধ্যাপক, সিনেমাজগতের জগদ্বিখ্যাত সুন্দরীরা, সত্যমাধবের হিসাবে এরা সবাই ছিল সেকেন্ড ক্লাস। কলেজ ছাড়ার অনেক বছর পর ওর সঙ্গে যখন দেখা হয়, তখন সে গুজরাত অঞ্চলে ডাকসাইটে পুলিশ অফিসার। আলোচনা প্রসঙ্গে সত্যজিতের ‘পথের পাঁচালী’র কথা উঠল। ওর সংক্ষিপ্ত মন্তব্য, ‘সেকেন্ড ক্লাস’। ‘পথের পাঁচালী’ সেকেন্ড ক্লাস! কার তুলনায়? উত্তর : “চার্লি চ্যাপলিন।” মূল্যায়নের মাপকাঠিটা ছোট করতে ও কখনও রাজি না। একবার ও ভ্যান গগকেও সেকেন্ড ক্লাস বলেছিল—দা ভিঞ্চি এবং মাইকেল এঞ্জেলোর তুলনায়। প্রসঙ্গত একটা কথা বলি। বাঙালি উচ্চারণবিশারদ আঁতেলরা খুশি হবেন। ভ্যান গগের নামের সত্যিকার উচ্চারণ ভান খখ, মানে খুব খারাপ রকম গলা বসে গেলে খ-টা যে রকম শোনাবে সেই রকম আওয়াজ করতে হবে। পৃথিবীর অন্য কোনও ভাষার বর্ণমালায় ওই বিকট ওলন্দাজ আওয়াজের তুলনীয় অক্ষর সম্ভবত নেই। গলা ব্যথা হলে মাঝে মাঝে চেষ্টা করে দেখতে পারেন। চ্যবনপ্রাশ ছাড়াই ব্যাধিমুক্ত হবেন।
আর দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন চরিত্রের লোকের কথা বলে প্রসঙ্গান্তরে যাব। প্রথম শম্ভু নন্দ–কলেজে প্রথম দিন প্রথম ক্লাসে যে-ছেলেটি আমার পাশে বসেছিল সেই ছেলেটি। মহম্মদ আলি বা বরকত আলির তৈরি স্যুট পরে সে ক্লাসে আসত। ওরা থাকত নিমতলাঘাট স্ট্রিটের এক প্রান্তে, এক বহুতল বাড়ির ভিতর দুই ঘরের একটি ফ্ল্যাটে। প্রতি শনি রবিবারে ওর বাড়িতে দুপুর বা রাতের খাওয়া আমার বাঁধা ছিল। বড় কাঁসার থালায় প্রায় থালার সাইজেরই পুরি, আর তার সঙ্গে ছোট ছোট কটোরায় একটু টকটক স্বাদের অতি মুখরোচক পাঁচ-ছ রকম তরকারি। শম্ভু বিহার অঞ্চলের অধিবাসী, পূর্বপুরুষ পঞ্জাবি। পরে উত্তর ভারতের নিরামিষ আহার খাওয়ার সুযোগ অনেকবার হয়েছে। কিন্তু শম্ভুর বাড়ির রান্নার মতো সুখাদ্য কোনও রাজা-মহারাজার বাড়িতেও কখনও খাইনি। ওদের ধরনধারণ ছিল সম্পূর্ণ সেকেলে। খাওয়াদাওয়া মেঝেতে আসন পেতেই হত। কিন্তু একটা ব্যাপারে খুব অবাক হয়েছিলাম। ওদের সনাতনী জীবনযাত্রার অন্যতম অঙ্গ ছিল পরিমিত পরিমাণে মাদকদ্রব্য পান। গ্রামের বাড়ি থেকে মাঝে মাঝেই দুই ধরনের বাড়িতে তৈরি ফলের মদ আসত—সান্তরে আর আনানস, মানে কমলা আর আনারসের রস রোদে দিয়ে গাঁজিয়ে তৈরি। পুরি তরকারির সঙ্গে কাঁসার গ্লাসে ঢেলে খাওয়া হত। অপূর্ব সুস্বাদু পানীয়। প্রথম যেদিন খাই জিনিসটার তেজ জানা ছিল না। শম্ভুর বাবা মহেশবাবু দু-একবার চেতাবনি উচ্চারণ করলেন, “বাচ্চে, সোচকে পিনা।” তারপর আর কিছু মনে নেই। দিন দুই পরে জ্ঞান হয়ে দেখলাম যেখানে বসে খাচ্ছিলাম সেখানেই শুয়ে আছি। বিশেষ বিশেষ দিনে সিদ্ধি ঘোঁটা হত। শম্ভুর এক মামা এ বিষয়ে পারদর্শী ছিলেন। সিদ্ধি দেবাদিদেব মহাদেবের পেয়। একটু সম্ভ্রমের সঙ্গে নাড়াচাড়া করতে হয়। সিদ্ধি বাটা হয়ে গেলে পেস্তা বাদামের সরবতে মিশিয়ে মামাজি পুতাটিকে শিবজ্ঞানে ব্যোম ব্যোম মন্ত্রে পূজা করে তার মাথায় পানীয়টি ঢেলে দিতেন। আর সেই মন্ত্রপূত সিদ্ধি আমরা অমৃতজ্ঞানে সেবন করতাম। তূরীয়ানন্দে দেহমন পবিত্র হয়ে যেত।
প্রথম পরিচয়ের পর কিছুদিন শম্ভু বড় জ্বালাত। যখন তখন এসে উপদ্রব করত, লেখাপড়া করতে দিত না। শেষে কণ্টকেনৈব কণ্টকম্ নীতি অবলম্বন করে জামান সাহেবকে বলতাম বাইরে থেকে ঘরে তালা লাগিয়ে দিতে। শম্ভু চলে গেলে জামান এসে দরজা খুলে দিত। আমাদের পরিচয়ের ষষ্ঠিতম বার্ষিকীর দিনে এই অপরাধ আমি শম্ভুর কাছে স্বীকার করি। তা সত্ত্বেও আমাদের বন্ধুত্ব এখনও অটুট আছে। কলকাতা শহরে কয়েক লক্ষ অবাঙালির বাস। তাদের সঙ্গে আমাদের আদানপ্রদান নেই বললেই চলে। শম্ভুর কৃপায় এই অপরিচয়ের পর্দা একটু সরেছিল।
নীরদবাবুর লেখা ‘আত্মঘাতী বাঙালি’ উপন্যাস নয়, প্রবন্ধ-সংগ্রহ। ওটা উপন্যাস হলে, ওই বইয়ের উপযুক্ত নায়ক হতে পারত এরকম একটি মানুষ ডাফ হস্টেলের বাসিন্দা ছিলেন। ভদ্রলোক বোধ হয় এখনও জীবিত। তাই তাঁর সত্যিকার নাম প্রকাশ করছি না। ম্যাট্রিকে পাঁচটা লেটার পেয়ে হীরকবাবু আই.এস.সি. পড়তে স্কটিশ চার্চ কলেজে এসেছিলেন। আমার সঙ্গে যখন পরিচয় তখন উনি ওই কলেজেই ইকনমিকসে অনার্স পড়ছেন। অত্যন্ত ফিটফাট সৌখিন মানুষটি আবদাল্লা ৫৫৫-র টিন থেকে অনর্গল সিগারেট খেতেন আর তার ফাঁকে ফাঁকে জীবন ও জগৎ সম্বন্ধে সংক্ষিপ্ত সব মন্তব্য করতেন। অনেক সময় মন্তব্য নয়, মন্তব্যের ইঙ্গিত শুধু থাকত। তার গূঢ় অর্থ ওঁর বয়স্য, আমার দাদাই শুধু বুঝতেন। তারপর সেই গূঢ়ার্থ চিন্তা করে দু’জনেই খুব হো হো করে কিছুক্ষণ হাসতেন। ব্যাপারটা অন্য লোকের কাছে রহস্যময় থেকে যেত। কিন্তু জীবন ও জগৎ সম্বন্ধে হীরকবাবুর মূল বক্তব্য আমি বুঝেছিলাম। পৃথিবীটা বড় নোংরা জায়গা। এখানে সবাই বিচিত্র মুখোশ পরে নিজের ধান্দায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। সে ধান্দাগুলিও নোংরা, নেহাতই ছোট জাতের। যদি কিছু হঠাৎ মনে হয় মহৎ বা শ্রদ্ধেয়, খুঁটে দেখ, ভিতরে পাবে শুধু কদর্য নোংরা। এখানে উচ্চাশারও কোনও মানে নেই। পূরীষ-পুষ্করিণীতে আকণ্ঠ ডুবে থেকে মানমর্যাদা ভোগ-ঐশ্বর্যে লাভ কী? এখানে একমাত্র করার মতো কাজ বসে বসে মজা দেখা—মানুষের বোকামি আর ভণ্ডামি তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করা। উচ্চাঙ্গের প্রহসন দেখার আনন্দ পাবে। হীরকবাবুর ক্ষমতা ছিল জীবনের যে কোনও ক্ষেত্রে সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছনোর। সে সম্ভাবনা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে উনি ঠিক করলেন উনি কোনও অফিসের বড়বাবু হবেন। বাবুর চেয়ারে বসে নীচের লোকের খোসামুদেপানা আর উপরের লোকের বোকা আত্মম্ভরিতা দেখে হো হো করে হাসবেন। এই সিদ্ধান্তে অটল থেকে জীবনের সব সম্ভাবনা উনি তিলে তিলে নষ্ট করেছিলেন। কীভাবে উনি ওঁর এই নেতিবাচক ভূয়োদর্শনে পৌঁছলেন, তা কখনও জানতে পারিনি। লোকে বলাবলি করত ওঁর জীবনে একটা ব্যর্থ প্রেমের ইতিহাস ছিল। তখনকার দিনে অনেকেরই থাকত। কিন্তু ওই প্রচণ্ড বুদ্ধিমান মানুষটি কি কোনও নারীর কাছে বঞ্চনা পেয়ে সমস্ত মানুষকে অবিশ্বাস করতে শিখেছিলেন? এ কথা আমি বিশ্বাস করতে পারিনি।
.
এই পরিচ্ছেদের নাম দিয়েছি গুরুকুলবাস। কিন্তু গুরুদের কথা এখনও পর্যন্ত কিছু বলা হয়নি। যে গুরুর কাছে পাঠ নেওয়ার উদ্দেশ্যে স্কটিশ চার্চ কলেজে ভর্তি হয়েছিলাম তাঁর নাম রেভারেন্ড মিস্টার মোয়াট। এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি নিয়ে উনি স্কটিশ মিশনে যোগ দেন। মিশন থেকে ওঁকে জিগ্যেস করে উনি কলকাতার কলেজে ইংরেজির চেয়ারে যেতে রাজি আছে কি না। উনি সানন্দে রাজি হয়ে এলেন। বলতেন, “এসে দেখি, চেয়ার টেয়ার কোথাও নেই। গোটা দুই বেঞ্চি আছে বটে।” এ দেশ ওঁর ভাল লাগেনি। পুরানপন্থী ব্রিটিশ ভদ্রলোকটি ভারতীয়দের এক ধরনের বর্বরই মনে করতেন। সম্ভবত আমি ভর্তি হওয়ার অল্পদিন আগে যে এক বছর ধরে ছাত্র ধর্মঘটে কলেজটির সর্বনাশ ঘটে, সেই ধর্মঘট ওঁর স্থায়ী বিরাগের অন্যতর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ড্রয়িং রুমের ভদ্রতার নিয়মকানুন মেনে ধর্মঘট হয় না। তার উপর ওই আন্দোলনের দু-একটি নেতার সঙ্গে পরে পরিচয় হয়ে দেখেছি—এমন দুর্বিনীত অসভ্য রকমের দেমাকি লোক বাজারে টেন্ডার দিলেও পাওয়া কঠিন হত। এঁদের কেউ কেউ বাংলার রাজনীতিটা পারিবারিক সম্পত্তি মনে করতেন। স্বাধীনতা-উত্তর যুগে আমাদের অনেক দুর্ভাগ্য পোয়াতে হয়েছে। কিন্তু ঠিক ওই জাতীয় মানুষের রাজত্ব যে কায়েম হয়নি তার জন্য ভাগ্যকে ধন্যবাদ দিই। মোট কথা সাম্রাজ্যের সুফলে বিশ্বাসী মোয়াট সাহেবের মতো লোকের পক্ষে এইসব লোককে সহ্য করা সম্ভব ছিল না। ওঁর কাছে কলকাতায় বাস করা ঈশ্বরদত্ত শাস্তি বলেই মনে হত। কিন্তু খ্রিস্টান ধর্মযাজক হিসাবে কর্তব্যজ্ঞানে সেই শাস্তি উনি মাথা পেতে মেনে নিয়ে সমস্ত কর্মজীবন কলকাতায়ই কাটান।
কিন্তু এক ব্যাপারে সম্ভবত ওঁর কোনও আক্ষেপ ছিল না। উনি পড়তে এবং পড়াতে ভালবাসতেন। খ্যাতির লোভ ওঁর ছিল না। কখনও কিছু লিখেছেন বলে শুনিনি। ডাক হস্টেলের সুপারিন্টেন্ডেন্ট হিসাবে এক বিরাট ফ্ল্যাটে উনি থাকতেন। সে ফ্ল্যাটের সব দেওয়ালই বইয়ের আলমারিতে ঢাকা ছিল। উনি তখন কলকাতার সব চেয়ে নামজাদা শিক্ষকদের একজন। ওঁর ক্লাস করতে প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্ররাও আসত। তখন আমি ইংরেজি অনার্স পড়ব ঠিক করেছি। উনি ওঁর গ্রন্থসংগ্রহ থেকে আমাকে বই ধার দিতেন–সাহিত্যে রুচি যাতে মার্জিত হয় সেই উদ্দেশ্যে এবং সমালোচনার অ-আ-ক-খ শেখাবার জন্য।
ইংরেজির অন্যান্য শিক্ষকদের কাছেও আমার যাওয়া-আসা ছিল। এদের চলাফেরা পোশাক-আশাকে এক ধরনের বৈশিষ্ট্য বা স্টাইল ছিল যা আমাদের কলেজের অধ্যাপক সম্বন্ধে প্রচলিত ধারণার সঙ্গে মিলত না। এঁদের কাউকে কখনও ধুতি পরতে দেখিনি। সবারই ইংরেজি উচ্চারণ বিশুদ্ধ ছিল। তা ছাড়া মহী বোস, সুশীল দত্ত এরা সবাই অসম্ভব রকমের স্মার্ট ছিলেন। মিস্টার দত্ত রামবাগানের দত্ত পরিবারের যে-অংশটি খ্রিস্টান হয়ে যায়, সেই পরিবারের ছেলে। ওঁদের বাড়ি যেতাম মাঝে মাঝে। ড্রয়িংরুমটি ভিক্টোরীয় আসবাবপত্র আর শ্বেতপাথরের মূর্তি দিয়ে সাজানো ছিল।
এর সম্পূর্ণ বিপরীত ঐতিহ্যর মানুষ ছিলেন বাংলার প্রধান অধ্যাপক বরিশালসন্তান এবং পিতৃবন্ধু ডক্টর সুধীর দাশগুপ্ত। উনি এক সময় বিপ্লবী দলের সভ্য হিসাবে সতীনদার সহকর্মী ছিলেন। খদ্দর পরতেন এবং নিয়মিত যোগাভ্যাস করতেন। নন্দনশাস্ত্র নিয়ে গভীর গবেষণাভিত্তিক একটি বই লেখেন উনি—যার মূল প্রতিপাদ্য ছিল নতুন এক নন্দনতত্ত্ব যা গ্রিক এবং সংস্কৃত দুই ধারা থেকেই সম্পূর্ণ ভিন্ন। ওঁর অগাধ পাণ্ডিত্য থাকা সত্ত্বেও বৈষয়িক জীবনে কখনও কোনও উন্নতি হয়নি। তখনকার দিনে নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষাব্রতীদের অনেকেরই অভিজ্ঞতা একই ধরনের। এঁদের মধ্যে কেউ কেউ ছিলেন যাঁরা শুধু পড়াশুনো করার আনন্দেই পড়তেন, জীবন থেকে কোনও প্রত্যাশাই ছিল না। বাংলা বিভাগের বিপিনবাবুর স্মৃতিশক্তি ছিল অসাধারণ। উনি যা একবার পড়তেন তাই ওঁর মুখস্থ হয়ে যেত। বেশ কিছু বই ওঁর আদ্যোপান্ত মুখস্থ ছিল। মেঘনাদবধ কাব্য তার একটি। অকৃতদার মানুষটির জীবন কাটে কলকাতার এক মেসে।
স্কটিশ চার্চ কলেজে পড়ার সময় সব চেয়ে বিচিত্র চরিত্রের যে মানুষটির সঙ্গে পরিচয় হয় তাঁর নাম অরুণ সেন, বাংলা সাহিত্যের ঐতিহাসিক দীনেশ সেনের পুত্র এবং কবি সমর সেনের বাবা। একদিন কলেজে ঢুকছি, হঠাৎ উনি পেছন থেকে ডাকলেন। বললেন, “জানো, আমি তোমার জ্যাঠা হই?” কথাটা জানা ছিল কারণ দীনেশবাবু সম্পর্কে বাবার মামা ছিলেন। ওঁর উৎকেন্দ্রিকতার নানা গল্প বাবার কাছে শুনতাম। পরবর্তী প্রস্তাবে একটু হকচকিয়ে গেলাম। “ক্লাসের পর আমার সঙ্গে দেখা কোরো। তোমার এক দিদি আছেন জানো? জ্যোৎস্না? তাঁর কাছে নিয়ে যাব।” আমার দিদি আছেন, অথচ আমি জানি না। ব্যাপারটা একটু অদ্ভুত মনে হল। যা হোক, ক্লাসের পর বাধ্য ছেলের মতো অরুণবাবুর সঙ্গে জ্যোৎস্নার বাড়ি গেলাম। জ্যোৎস্না মানে অভিনেত্রী জ্যোৎস্না গুপ্ত। হঠাৎ মনে পড়ল বাবার আপন মামাতোভাই কুমার গুপ্ত এক সময় সিনেমা থিয়েটারের জগতে পৃষ্ঠপোষক হিসাবে সুপরিচিত ছিলেন। কুমারকাকাকে কখনও দেখিনি। কিন্তু চাপা গলায় মাঝে মাঝেই ওঁর বিষয়ে আলোচনা শুনেছি। উনি রঙ্গমঞ্চের এক অভিনেত্রীকে বিয়ে করে কার্যত সমাজচ্যুত হন। এঁদো গলির মধ্যে ওঁদের বাড়ি গিয়ে একটু অদ্ভুতই লেগেছিল। তখন প্রায় পাঁচটা বাজে। তখনও বাড়ির দরজা জানালা সব বন্ধ। মা বাপ আর মেয়ে তিনজনেই মাটিতে মাদুর পেতে ঘুমাচ্ছিলেন। বাড়িতে আসবাবপত্র প্রায় কিছু নেই বললেই চলে। অভিনেত্রীর বাড়ি কী রকম হতে পারে সে সম্পর্কে আমার একটা ধারণা ছিল। তার সঙ্গে কিছুই মিলল না। শুধু অবাক হয়ে দেখলাম কুমার গুপ্তকে। শত দুঃখ কষ্ট সত্ত্বেও কী অসাধারণ রূপ। বাবার মামাবাড়ির সবারই রূপের খ্যাতি ছিল—রূপের আর উৎকেন্দ্রিকতার। মাতুলক্রমে সেই রূপ বাবাও পেয়েছিলেন। আর কোনও কারণে চটে গেলেই মা বলতেন, “মামাবাড়ির ধারা। কিছু তো আসবে!” কিছু যে এসেছিল সেটা আমারও ধারণা।
জ্যোৎস্না গুপ্তের বাড়ি আর যাওয়া হয়নি। তার এক কারণ অরুণবাবু অল্পদিন পরেই কলেজ ছেড়ে দিলেন। আরও দুটি কাজ করলেন সেই সঙ্গে। প্রথম ওঁর বন্ধু শিশির ভাদুড়ীকে শ্রীরঙ্গম নামের রঙ্গমঞ্চ গড়ে তোলার জন্য প্রভিডেন্ট ফান্ডের সঞ্চিত পুরো টাকাটা দিয়ে দিলেন। এটা শোনা কথা। দ্বিতীয় কাজটা সম্বন্ধে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই। উনি এক অভিনেত্রী বিয়ে করলেন। তার কিছুদিন পর যুদ্ধের মাঝামাঝি সময় উনি আই. এন. এ-দের সঙ্গে যোগ রাখার অভিযোগে রাজবন্দি হন। একটা ট্রান্সমিটারে উনি ওদের প্রচারবার্তা শুনছিলেন। সেই সময় ওঁকে গ্রেফতার করে। ওঁর সঙ্গে আবার দেখা হয় অনেক বছর পর। গড়িয়াহাট কোয়ালিটির মোড়ে ট্রামের জন্য অপেক্ষা করছি। হঠাৎ উনি এগিয়ে এসে বিনা ভূমিকায় শুরু করলেন, “তোমাকে একটা কথা বলি। কালিদাসের মেঘদূতম্ প্রেমের কাব্য না, দেশপ্রেমিক কবির ভারত-বর্ণনা। যক্ষবিরহ শুধু একটা ছুতো।” কথাটা বলে উনি ট্রামে উঠে পড়লেন। আর কখনও ওঁর সঙ্গে দেখা হয়নি।
আমার জীবনের ধারা বদলে দেন একটি মানুষ, তাঁর কথা এই প্রসঙ্গে বলি। তাঁর নাম মহেন্দ্রলাল সরকার, আমার বন্ধু বাদলের বাবা। ইতিহাসের অধ্যাপক এই মানুষটি ভাল পড়াতে পারতেন না, ওঁর গলায় একটা অপারেশন হওয়ার ফলে ওঁর কথা বলতেও কষ্ট হত। ওঁর ক্লাসে গিয়ে অকারণ গোলমাল করা ছাত্রদের একটা ফুর্তি দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। ব্যাপারটা আমার খুব খারাপ লাগত। তাই মাঝে মাঝে ওঁর কাছে যেতাম। উনি আমাকে বলতেন, “ইংরেজি পড়ে কী করবে? দেশে বসে ইংরেজি সাহিত্যের ক্ষেত্রে কিছু করা প্রায় অসম্ভব। দেখ না, বড় বড় পণ্ডিতরা সব রয়েছেন, কারও কিছু অবদান নেই। ইতিহাস পড়ো। স্যার যদুনাথ রাজনৈতিক ইতিহাস লিখেছেন, তুমি মোগল যুগের অর্থনৈতিক ইতিহাস লেখো। কিন্তু সুশোভনের কাছে পালিয়ে যেয়ো না যেন।” কিছুদিন ভাববার পর ওঁর উপদেশটাই গ্রহণ করি। কিন্তু প্রথমটা, দ্বিতীয়টা না। ফারসি পড়া আবার শুরু করলাম। এবার প্রেম নয়, জ্ঞানের সন্ধানে।
‘৪১ সনের অগাস্ট মাসে একদিন মোয়াট সাহেবের ক্লাস করছি। হঠাৎ বাইরে একটা গোলমাল শোনা গেল। মোয়াট আমাকে বললেন দেখে আসতে কী ব্যাপার। বের হয়ে শুনলাম, একটু আগে রবীন্দ্রনাথ মারা গিয়েছেন। কথাটা এসে ক্লাসে বলতেই প্রচণ্ড একটা হইচই শুরু হল। মোয়াট সাহেবের চোখে সেই গভীর ব্যঙ্গের দৃষ্টিটা কখনও ভুলব না। ভারতবাসীরা যে বর্বর, তাদের দেশের শ্রেষ্ঠ মানুষটির প্রয়াণে শোকপ্রকাশের ভঙ্গি দেখে উনি সে বিষয়ে নিঃসন্দেহ হলেন।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের প্রথম পর্বে অক্ষশক্তির সর্বত্রই জয় হচ্ছিল। সিঙ্গাপুর এবং বর্মা জাপানিদের অধিকারে চলে যাওয়ার পর ওরা প্রায় ভারতবর্ষের দরজায় এসে পৌঁছেছে। ১৯৩৯-এই কংগ্রেস মন্ত্রিসভাগুলি থেকে পদত্যাগ করে কতকটা নিষ্ক্রিয় অসহযোগের পথ নিয়েছে। কিন্তু অবস্থা যে ওইখানেই থেমে থাকতে পারে না এ কথা আমরা সবাই বুঝছিলাম। জাতীয় কংগ্রেসের ভিতরেই একদল প্রত্যক্ষ আন্দোলনের জন্য চাপ দিচ্ছিলেন। ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধে যুদ্ধপ্রচেষ্টা ব্যাহত না করার জন্য নেহরুর ব্যগ্রতার পিছনে খুব একটা জনসমর্থন ছিল মনে হয় না। একটা কিছু শিগগিরই ঘটবে এবং তাতে আমাদের ছাত্রসমাজের একটা ভূমিকা থাকবে, এ বিষয়ে আমরা নিঃসন্দেহ ছিলাম। এই সময় ক্রিপস ভারতবর্ষে এলেন। আমরা খুব আশা করলাম স্বাধীনতা এবার সত্যি আসবে। পৃথিবীর সর্বত্র আমাদের বয়সি ছেলেরা লড়াই করছে, ইংরাজের সঙ্গে সমঝোতা হলে আমরাও সৈন্যবাহিনীতে যোগ দেব, ফ্যাসিবাদ সম্পর্কে যাদের চিন্তায় কোনও অস্পষ্টতা ছিল না তারা অনেকেই মনে মনে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু ক্রিপস মিশন সফল হল না। নেহরুর বন্ধু স্যার স্ট্যাফোর্ড ওঁকে এবং গাঁধীকে দোষ দিয়ে দেশে ফিরে গেলেন। আসলে ক্রিপসও জানতেন না যে, ভিতরে ভিতরে চার্চিল আর লিনলিথগো কলকাঠি নাড়ছিলেন মিশন যাতে সফল না হয়। নেহাতই আমেরিকা আর বামপন্থী সহকর্মীদের চাপে চার্চিল আলোচনায় বসতে নিমরাজি হয়েছিলেন। ক্ষমতা হস্তান্তরের ইচ্ছা ওঁর কোনওদিনই ছিল না। গত তিন দশকের গবেষণায় এসব তথ্য পাওয়া গেছে। তখন কেউই কিছু জানত না।
ক্রিপস দেশে ফেরার পর পরবর্তী কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা শুরু হল। গাঁধীজি স্পষ্টই ইঙ্গিত দিলেন—উনি গণআন্দোলনের কথা ভাবছেন, যে আন্দোলনের মূল সূত্র হবে ‘করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে’। কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে প্রস্তাব করা হল, ‘ইংরাজ ভারত ছাড়ো’। কুইট ইন্ডিয়া। ৯ আগস্ট ভোরবেলা গাঁধী সহ কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ বন্দি হলেন। ভারতবর্ষের শহরে শহরে গ্রামে গ্রামে আগুন জ্বলল। কলকাতায় স্কুল কলেজ সব বন্ধ হয়ে গেল। তল্পিতল্পা গুটিয়ে আমি বাড়ি ফিরলাম।