শহর বরিশাল—‘ভদ্রজনের বাসা’
কৈশোরে টুর্গেনিভের উপন্যাসের সঙ্গে পরিচয় ঘটে। ইংরাজি অনুবাদে একটি উপন্যাসের নাম আমার খুব ভাল লাগত—”Nest of the Gentry’, কেমন মনে হত, নামটা বরিশাল শহরের সঙ্গে খুব খাপ খায়।
প্রবাস-দুঃখ ভোগ করতে যখন বরিশাল ছাড়ি, তখন আমার বয়স ছয়-সাত। যখন ফিরলাম, তখন আমার এগারো বছর বয়স। বয়সের তুলনায় অকালপক্কতা অনেক দূর এগিয়ে গেছে। নিজেকে বেশ কেওকেটা মনে করতে শুরু করেছি। বরিশাল জিলা স্কুলে ভর্তি হয়েছি। সেখানে লেখাপড়ায় ভাল করায় এবং কীর্তিপাশার জমিদারনন্দন হিসাবে (এটা যদিও কিছুটা প্রচ্ছন্নভাবে) বেশ খাতির পাওয়ায় ল্যাজ কিছুটা স্ফীত হয়েছে। বালিগঞ্জ গভর্নমেন্ট স্কুলে ছিলাম ‘বিমর্ষ বানর’। আর জিলা স্কুলে হলাম ‘বীরদর্প হনুমান’! এখানে একটা কথা বলি। লেখাপড়ায় ভাল মানে পৌরুষহীন গবেট, ‘Sissy’, এই বিশ্বাস আমাদের ছেলেবেলায় ইস্কুল-সংস্কৃতির অঙ্গ ছিল না। ফাস্ট-সেকেন্ড হওয়া ছেলেরাই ক্লাসে মনিটর হত, এবং তাদের ব্যবহার অসহ্য না হলে ছাত্র-মাস্টার সবাই তাদের খাতির করত। ফলে জিলা স্কুলের জীবন আমার পক্ষে সুখের হয়েছিল। আর ছেলের সুখ্যাতি করতে কোনও কোনও মাস্টারমশাই যে বাবার সঙ্গে দেখা করতে আসতেন, তার সামাজিক তাৎপর্য বুঝতেও অসুবিধে হত না। এই অসম সম্পর্কের দুঃখ আর লজ্জার দিকটা উপলব্ধি হতে বেশ ক’বছর লেগেছিল। বৈষম্য যেখানে নিজের স্বার্থ, বিশেষত সামাজিক মর্যাদার অনুকূল, সেখানে আদর্শ হিসাবে সাম্যবোধ সহজে আসে না।
প্রথমেই বলেছি, ‘ভদ্রজনের বাসা’ এই নাম কৈশোরে বরিশাল শহরের সুষ্ঠু বর্ণনা বলে মনে হয়েছিল। কারণ চারপাশে যাঁদের দেখতাম, তাঁরা সবাই প্রায় মধ্যবিত্ত ভদ্রলোক। জীবনযাত্রার মানে কিছু উনিশ-বিশ তফাত থাকলেও মোটামুটি একই ধরনের আর্থিক অবস্থা তফাত বোঝার জন্য একটি মাপকাঠি ছিল—পাকাবাড়ি, না কাঁচাবাড়ি (অর্থাৎ ইটের বদলে বেড়ার দেওয়াল, টালি বা টিন অর্থাৎ করোগেটেড লোহার ছাদ)। পরে আবিষ্কার করি, অপরাধী বা রাজবন্দিদের শ্রেণিবিভাগ করার জন্য সরকার বাহাদুরও কাঁচা-পাকা বাড়ির মাপকাঠি মেনে নিয়েছিলেন। পাকাবাড়ির বাসিন্দা হলে উচ্চশ্রেণি, মাটিতে কম্বল শয্যার বদলে খাটপাট, দৈনিক খাইখরচা আট আনা না হয়ে পাঁচসিকে। পাঁচসিকের বাজার করলে বরিশালে তখন দুটো মুটের দরকার হত। সুতরাং উচ্চশ্রেণির বন্দির মাথাপিছু দৈনিক ওই বিপুল সম্পদ খরচা হত মনে করলে ভুল হবে। সমাজতাত্ত্বিকরা কিছুকাল মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে ‘উচ্চ-মধ্য’ ‘মধ্য-মধ্য’ এবং ‘নিম্ন-মধ্য’ বলে তিন উপশ্রেণিতে ভাগ করতেন। বোধ হয় বরিশালের মধ্য-মধ্য এবং নিম্ন-মধ্যবিত্তরা কাঁচাবাড়িতে থাকতেন। অবশ্যি এই মাপকাঠি সব ক্ষেত্রে খাটত না। আমরা অবশ্যই পাকাবাড়িতে থাকতাম এবং জীবনযাত্রার মান উচ্চ-মধ্যবিত্তেরই ছিল (যদিও সহপাঠী এবং মাস্টারমশাইদের মধ্যে অনেকের নিতান্ত ভুল ধারণা ছিল যে আমরা বড়লোক), তবে মাসিক আয় হিসাব করলে পরিচিত বেশ ক’জন কাঁচাবাড়ির বাসিন্দা উকিল-মোক্তার আমাদের তুলনায় চার-পাঁচগুণ রোজগার করতেন। আর রীতিমতো ধনী সাহাবাবুর বাড়ির ছাদও টিনের ছিল। জীবনযাত্রার মান আয়ের চেয়েও সামাজিক সংস্কৃতির উপর নির্ভর করত। সেদিক থেকে বিচার করলে চমকপ্রদ বৈচিত্র্য চোখে পড়ত–লাখুটিয়ার জমিদার পরিবার আর শ্বেতাঙ্গিনী পত্নীর স্বামী জার্ডিন রায় ছিলেন পাকা সাহেব, অন্য এক জমিদারবাড়িতে আহার-বিহারে পান্তাভাতভোজী পেঁয়ো বরিশালবাসীর সঙ্গে কোনও তফাত ছিল না।
আমরা যখন কলকাতা-প্রবাসী হই, তার ঠিক আগে শুধু আমরা একাই বরিশালের এজমালি বাড়িতে বাস করতাম। আমরা যখন কলকাতায়, তখন সপরিবারে মেজ জ্যাঠামশায়, আর তাঁর দুই ভাই-রাঙাজ্যাঠা আর শম্ভুকাকা গ্রাম ছেড়ে শহরের বাড়িতে চলে আসেন। রাঙাজ্যাঠা নিঃসন্তান ছিলেন, মেজঠাকুমার ছেলে শম্ভুকাকা বি. এম. কলেজে পড়তেন। ওঁদের আর এক ভাই, নিনু কাকা ওরফে ব্যারিস্টার শশাঙ্ক সেন, কলকাতাবাসী। আমরা বরিশাল ফেরায় মেজজ্যাঠারা বাড়ির যে-দিকটায় নদী সেই দিকটা আমাদের ছেড়ে দেন। এই সহাবস্থানের অভিজ্ঞতা আমাদের প্রজন্মের পক্ষে সুখের হয়েছিল, সন্দেহ নেই। কিন্তু আমরা যৌথ পরিবার না হওয়া সত্ত্বেও, যৌথ পরিবারে যে-ধরনের খিটিমিটি লেগে থাকে এবং মনোমালিন্য ঘটে তার থেকে রেহাই পাইনি। বাড়িতে জল সরবরাহ যথেষ্ট ছিল না। ফলে দুই পরিবারের কে কখন কল খুলতে পারবে তার সময় বাঁধা ছিল। এই চুক্তি কেউই মানত না। ফলে চাপা স্বরে কটু কথার বিনিময় লেগেই থাকত। তবে উচ্চৈঃস্বরে ঝগড়ার গ্রাম্যতায় কেউ পৌঁছাননি। আলাদাভাবে দুই পরিবারের জল সরবরাহর ব্যবস্থা করা কিছু অসম্ভব ছিল না। কিন্তু সে চেষ্টা কখনও হয়নি। হয়নি যে তা জমিদার পরিবারগুলির অবক্ষয়ের অন্যতম উদাহরণ বলে আমার ধারণা।
দুই পরিবারে মনকষাকষি আমাদের প্রজন্মকে প্রত্যক্ষভাবে কখনও স্পর্শ করেনি। বড়দের মধ্যেও এক ধরনের সৌহার্দ্য ঝগড়াঝাটির সঙ্গেই সহাবস্থান করত। অসুখে-বিসুখে পরস্পরের পাশে দাঁড়ানো কখনও বন্ধ হয়নি। ওঁরা, বিশেষ করে মহিলারা, অনেকটা সময়ই পরস্পরের সঙ্গে কাটাতেন। নিন্দাবান্দাটা আড়ালেই হত। আমাদের জ্যাঠতুত ছোট ভাই অশোক আর আমাদের ছোট বোন প্রায় এক বয়সী ছিল। ওদের কখনও ঝগড়া করতে দেখিনি। আমাদের জ্যাঠতুত দিদি ব্রজমোহন কলেজে পড়তেন। বয়সে দাদার চেয়ে কিছু বড়। ওঁর সঙ্গলাভের জন্য আমরা দুই ভাই-ই বিশেষ ব্যগ্র ছিলাম।
কিন্তু নতুন ব্যবস্থায় নাবালক লজে থাকার সব চেয়ে স্মরণীয় স্মৃতি, মেজ জ্যাঠামশায়ের সান্নিধ্যলাভ। বর্তমান রচনার প্রধান উদ্দেশ্য এক লুপ্ত যুগের স্মৃতি পরিবেশন করা, এ কথা ভূমিকায় বলেছি। ত্রিশ বা চল্লিশের দশকের বাঙালি সমাজের সঙ্গে আমার দৃষ্টিতে আজকের যুগের সমাজের সব চেয়ে বড় তফাত প্রধানত এক বিষয়ে। সে সময় জীবনের নানা ক্ষেত্রে কিছু মানুষ দেখেছি-যাঁরা আদর্শনিষ্ঠায় চরিত্রগুণে অনন্যসাধারণ। তাঁরা নানা পথের পথিক—কেউ দেশের বা সমাজের জন্য উৎসর্গীকৃত প্রাণ, কেউ জ্ঞানসাধক, কেউ সাহিত্য বা শিল্পপ্রেমিক, কেউ বা ধর্মপ্রাণ মানুষ। এক ব্যাপারে এইসব বিভিন্নধর্মী মানুষ কিন্তু একই পথের পথিক ছিলেন। এঁরা সকলেই ব্যক্তিস্বার্থ আর দৈনন্দিনতার বাইরে এমন কিছু জিনিসকে জীবনের প্রধান অবলম্বন বলে আঁকড়ে ধরেছিলেন, সভ্যতার ইতিহাসে মানুষ যাকে মূল্যবান মনে করেছে। এদের বেশির ভাগই আমাদের রাজনৈতিক, সংস্কৃতিগত বা ধর্মীয় ইতিহাসে পরিচিত নাম নন। কিন্তু এঁদের জীবনচর্যা বহু মানুষকে বেঁচে থাকা ব্যাপারটাকে একটু উঁচু তারে বাঁধতে উদ্বুদ্ধ করত। তখন জীবনে সুযোগ-সুবিধা, বৈষয়িক উন্নতির সম্ভাবনা নিতান্তই সীমিত ছিল। বেশির ভাগ মধ্যবিত্ত মানুষ ফলে একটা অভাব বা ব্যর্থতাবোধে ভুগত। আমি যাঁদের কথা বলছি, তারা শাসরোধকারী পরিবেশের প্রভাব উপেক্ষা করে এক মহত্তর জীবনে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন।
আমার মেজ জ্যাঠামশাই হিমাংশুবাবু এই শ্রেণির মানুষ ছিলেন। সাহিত্যের ক্ষেত্রে ওঁর সূক্ষ্ম রুচিবোধ ছিল। এক দিকে সংস্কৃত সাহিত্য এবং দর্শনে উনি গভীর জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। অন্য দিকে ওঁর শোওয়ার ঘরের কোনায় ছোট আলমারিটি কন্টিনেন্টাল সাহিত্যের ইংরাজি অনুবাদে ঠাসা ছিল। রোজ সন্ধেবেলা উনি নিজের ছেলেমেয়ে এবং আমাদের ডেকে কালিদাসের কাব্য পড়ে শোনাতেন এবং প্রাঞ্জল বাংলায় তার অনুবাদ করতেন। ’মেঘদূত’, ‘কুমারসম্ভব’, ‘অভিজ্ঞানশকুন্তলম্’ ইত্যাদি মহাকবির প্রধান রচনাগুলির সঙ্গে এইভাবেই প্রথম পরিচয় ঘটে। আরও একটি অনবদ্য সাহিত্যকর্মের সঙ্গে উনি আমাদের পরিচয় করান—প্রবোধেন্দু ঠাকুরের অনুবাদে কাদম্বরী। ভারতীয় সভ্যতার স্বর্ণযুগে অভিজাত জীবনের সেই অপূর্ব বর্ণনা যেন অন্য এক জগতে নিয়ে যেত। লণ্ঠনের অপর্যাপ্ত আলোয় অপ্রশস্ত খাটে বসে সেই সাহিত্যচর্চার স্মৃতি জীবনের এক মহার্ঘ সম্পদ হয়ে রয়েছে। জ্যাঠামশাই রবীন্দ্রকাব্যও ভারী সুন্দর আবৃত্তি করতেন। যৌবনে লেখা ওঁর ছোট একটি কাব্যগ্রন্থ ছিল—’অনবসিতা’। রবীন্দ্রপ্রভাবান্বিত রচনা, কিন্তু স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল।
উচ্চাঙ্গের সাহিত্যে প্রথম পাঠ ওঁর কাছ থেকে পাই। কিন্তু ওঁর জীবনের যা মূল অবলম্বন, সেই গভীর ধর্মানুভূতির জগতে বিশ্বাসের অভাবে আমার প্রবেশাধিকার ছিল না। সেই অবিশ্বাস ত্যাগ করার কোনও কারণ এখন অবধি খুঁজে পাইনি। ইতিহাসে ধর্ম নানা অনিষ্টের কারণ হয়েছে—এ কথা না মানারও কোনও হেতু দেখি না। কিন্তু ধর্মবিশ্বাস যে ব্যক্তিমানুষকে চেতনার উচ্চতম সম্ভাবনায় পৌঁছে দিতে পারে, ইতিহাস এবং নিজের অভিজ্ঞতায় তার প্রমাণ বারবারই পেয়েছি। এ কথাটা ঈশ্বর আছেন কি নেই—এ প্রশ্নের উত্তরের উপর নির্ভর করে না। শিল্প, সাহিত্য, বিজ্ঞানের মতো ধর্মচিন্তাও মানুষের সৃজনীশক্তির অন্যতর শ্রেষ্ঠ প্রকাশ। এ তথ্যের প্রথম সন্ধান পাই জ্যাঠামশায়ের জীবনে।
উনি পৌরাণিক হিন্দু ধর্মে আক্ষরিক অর্থে বিশ্বাসী ছিলেন। প্রতিদিন আদ্যোপান্ত ‘চণ্ডী’ পাঠ করতেন। কিন্তু ওই পৌরাণিক কাহিনির মর্মার্থ ওঁর কাছে কী ছিল জানি না। দেবী কর্তৃক মহিষাসুর বধের কাহিনি ওঁর চেতনা উদ্দীপ্ত করত—মনে হয় না। ওই কাহিনি কল্পনা করে সূক্ষ্ম রুচিবান মানুষের চোখ দিয়ে অনর্গল অশ্রুবর্ষণ হয়? ওঁর আর একটি প্রিয় স্তব ছিল ‘কপূরাদিস্তোত্র’—যেখানে মহাকালীর ভয়াবহ বর্ণনা আছে। তাঁর কটিতে মানুষের কাটা হাতের মালা, গলায় নরমুণ্ডের, তাঁর কর্ণভূষণ দুটি শিশুর কাটা মাথা। লোল জিহ্বা থেকে রক্ত যুঝিয়ে পড়ছে। এ বর্ণনায়ও ওঁর অনর্গল অশ্রুবর্ষণ হত, যেমন হত পূজার সময় বলির দৃশ্যে। এইসব আপাত ভয়াবহ বর্ণনা বা দৃশ্যে উনি কোন করুণাময়ী বিশ্বমাতার রূপ দেখতে পেতেন? এ প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই। কিন্তু এসব সময় ওঁর অশ্রুসিক্ত মুখ দেখে বুঝতে পারতাম, অনুভূতি বা চেতনার যে-জগতে উনি পৌঁছেছেন, তা আমাদের নাগালের বাইরে।
ওই জগৎ সম্বন্ধে আমার কৌতূহল এবং বিস্ময়বোধ ছিল, কিন্তু বিশ্বাস কখনওই ছিল না। তাই জ্যাঠামশায়ের কাছ থেকে যা পেয়েছিলাম তা হল কাব্যসাহিত্যের জগতে প্রবেশপত্র। উনি এবং আমার বাবা দুজনেই উচ্চাঙ্গের অভিনেতা ছিলেন। কীর্তিপাশার স্টেজে গোবিন্দমাণিক্য আর রঘুপতির ভূমিকায় ওঁদের অভিনয় কলকাতার পেশাদারি স্টেজে বিখ্যাত নটদের অভিনয়ের সঙ্গে তুলনীয় ছিল। ওঁদের পড়া শুনে শুনেই প্রথম রবীন্দ্ররচনায় অনুরাগ জন্মায়। জ্যাঠামশায় ‘কথা ও কাহিনি’কে সাহিত্য হিসাবে খুব উঁচু জায়গা দিতেন। বলতেন—গল্পকথা বলে সাহিত্যপ্রেমিকরা ওই কবিতাগুলিকে উচিত মূল্য দেননি। বাবার প্রিয় কাব্যগ্রন্থ ছিল সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী দুটি কবিতাগ্রন্থ—’বলাকা’ আর ‘পলাতকা। ওঁদের পড়া শুনে শুনে যে-অলোকসামান্য জগতের পথ দেখতে পেলাম, তার বিচিত্র প্রকৃতি আবিষ্কারের উপায় অনেকটা বরিশালের বাড়িতেই ছিল। মেজজ্যাঠার বইয়ের আলমারিতে ইবসেন, মোপাসা, টলস্টয়ের লেখার সন্ধান পাই। তেরো-চোদ্দো বছর বয়সে ‘রেজারেকশন’ পড়ে পাপ-পুণ্য সম্বন্ধে ঐতিহ্যলব্ধ ধারণা প্রচণ্ড ধাক্কা খায়। আমাদের বসবার ঘরে বড় বড় তিনটে আলমারিতে ঠাকুর্দা এবং বাবার সংগ্রহ করা বইগুলি ছিল। বাংলা বইয়ের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের যাবতীয় লেখার প্রথম সংস্করণ, বঙ্কিম, শরৎচন্দ্র, বিভূতিভূষণের উপন্যাস, বাঁধানো ‘প্রবাসী’ আর ‘ভারতবর্ষ’। ইংরাজি বইয়ের সংগ্রহ অসম বৈচিত্র্যে ভাস্বর। একটা শেলফ জুড়ে ডিকেন্স-এর উপন্যাস-সমগ্রর চামড়ায় বাঁধানো রাজসংস্করণ। তা ছাড়া শেলি, কিটস, ব্রাউনিং, বায়রন, গলসওয়ার্দি আর কুট হামসুন, স্ট্রিন্ডবার্গ, ইয়োহান বয়্যার প্রমুখ স্ক্যান্ডিনেভিয়ান লেখকদের বেশ কিছু বই। নিচু সুরে বাঁধা জনপ্রিয় ইংরাজি সাহিত্যের মধ্যে ছিল রাইডার হ্যাগার্ড, বুলওয়ার লিটন, মারি করেলির লেখা। ইংরাজি ভাষা কিছুটা সড়গড় হওয়ার পর ভালমন্দ সবরকম লেখাই গোগ্রাসে গিলতাম। আর একটি আলমারি ভর্তি ছিল ঠাকুর্দার বিশেষ শখের সংগ্রহ—থিওসফিক্যাল, সোসাইটির প্রকাশিত যাবতীয় রচনা এবং তার সঙ্গে প্রেততত্ত্ব বিষয়ক আরও অনেক বই। ঠাকুর্দা ভগবানে বিশ্বাস না করলেও ভূতে বিশ্বাস করতেন। এ বিষয়ে কেউ কোনও প্রশ্ন করলে ভুরু কুঁচকে নাকি প্রতিপ্রশ্ন করতেন, “ভগবান নেই বলে ভূতও থাকবে না, এমন কোনও কথা আছে?” এসব বই ছাড়া, সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ ঘোষিত বেশ কিছু বাংলা ইংরাজি বই ছিল।
নানা বিষয়ে বইয়ের সংগ্রহ শুধু আমাদের বাড়িতেই ছিল এমন না। বরিশালে অনেক ভদ্রলোকের বাড়িতেই প্রচুর সংখ্যক বই ছিল। কীর্তিপাশা ইস্কুলের হেডমাস্টার মহেন্দ্ৰকাকার ছোট ভাই মোক্তার মনাই দত্তর বাড়িতে অন্তত দু-তিন হাজার বই ছিল। এখানে উল্লেখযোগ্য—তখন Everyman-এর বইয়ের দাম ছিল প্রতি খণ্ড এক টাকা দু আনা। Penguin বোধ হয় ১৯৩৬ বা ১৯৩৭ সনে প্রকাশ শুরু হয়। দাম প্রতি খণ্ড ছয় আনা। Everyman, Worlds Classics, Nelsons Classics ইত্যাদি সিরিজের প্রত্যেকটি বই মনাইকাকা কিনেছিলেন। উনি অল্প বয়সে বখে গিয়ে আই.এ. পাস করার পর লেখাপড়া ছেড়ে দেন। ফলে পেশায় তিনি উকিল না, মোক্তার। কিন্তু উন্নাসিক ইংরাজি দৈনিক স্টেটসম্যানে এই মফস্বলবাসী আই.এ. পাস মোক্তারের লেখা নিয়মিত প্রকাশিত হত। বিখ্যাত লড়াকু পণ্ডিত দেবপ্রসাদ ঘোষের বাড়িতে শিল্প, সাহিত্য, ইতিহাস, বিজ্ঞান ইত্যাদি নানা বিষয়ে কয়েক হাজার বই ছিল। শুনেছি ওঁদের বাড়িতে বইয়ের সংখ্যা আট-দশ হাজারের কম ছিল না। শুধু শেখার আনন্দে দেবপ্রসাদবাবু আঠারোটি ভাষা শিখেছিলেন। সায়েস্তাবাদের নবাবের বাড়িতে রীতিমতো লাইব্রেরি ছিল। মাস-মাইনে দিয়ে লাইব্রেরিয়ান রেখে সেসব বইয়ের তত্ত্বাবধান করাতেন। পরিচিত ভদ্রলোকদের নিখরচায় এইসব বই ধার দেওয়া হত। এ ছাড়াও ছিল পাবলিক লাইব্রেরি, শঙ্কর মঠ এবং রামকৃষ্ণ মঠের গ্রন্থসংগ্রহ, প্রতিটি স্কুলে এবং ব্রজমোহন কলেজে বেশ চমক লাগার মতো গ্রন্থসংগ্রহ। বরিশাল জিলা স্কুলের লাইব্রেরিতে মোগল যুগের ইতিহাস সম্পর্কীয় আকর গ্রন্থের যা-কিছু ইংরাজি অনুবাদে পাওয়া যায় তার সবই ছিল। একজন মাস্টারমশাই ক্লাসে ওই বইগুলি থেকে পড়ে শোনাতেন। মোগল ইতিহাস সম্বন্ধে আমার কৌতূহল ওইভাবেই শুরু হয়।
এইসব পুস্তক সংগ্রহ আর গ্রন্থাগারের কথা তুললাম একটি কারণে। উনিশ শতকে যে পশ্চিমি শিক্ষার শুরু হয়– বাঙালিজীবনে তার একটি মহৎ দান বিশ্বসংস্কৃতি সম্বন্ধে অন্তহীন কৌতূহল। ১৯১৭ সনে স্যাডলার কমিশন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শন করে মন্তব্য করেন যে, শিক্ষিত বাঙালি যুবক শুধু নিজের দেশে কী হচ্ছে জেনে তুষ্ট না, লন্ডন, প্যারিস, নিউ ইয়র্কে জ্ঞানের জগতে কী হচ্ছে সে খবর জানার জন্য তার দুরন্ত আগ্রহ। বরিশালের শিক্ষিত মহলে এই প্রবণতা স্পষ্টতই নজরে আসত। টাউন হলের পাশেই কালা ভাইয়ের দোকানে নানা বিষয়ের বই পাওয়া যেত। একটা শেলফ জুড়ে ফরাসি বই ছিল। ওই ভাষাটি ভালভাবে পড়তে পারেন, এ রকম বেশ কয়েকজন লোক ছিলেন। এঁদের একজনের সঙ্গে স্কুলকলেজে পড়ার সময় ঘনিষ্ঠতার সুযোগ পাই। তিনি বঙ্কিম রায়চৌধুরী। জন্ম থেকে প্রায় দৃষ্টিহীন মানুষটি স্থানীয় গার্লস স্কুলে এবং পরে ব্রজমোহন কলেজে পড়াতেন। জীবনের অধিকাংশ কেটেছে পঞ্চাশ থেকে পঁচাত্তর টাকা মাইনের চাকরিতে। ওই সামান্য আয়ে উনি রীতিমতো চমকপ্রদ লাইব্রেরি গড়ে তুলেছিলেন। প্রাচীন ভারতবর্ষের ইতিহাস নিয়ে উনি গবেষণা করেছিলেন। কিন্তু প্রেমাদ রায়চাঁদ স্কলারশিপের প্রতিযোগিতায় হেরে যাওয়ায় ওঁর গবেষণা আর এগোয়নি। কারণ কিছুটা অর্থাভাব। বোধহয় একটা মান-অভিমানের ব্যাপারও ছিল। কারণ ও বছর স্কলারশিপটা যিনি পান, ওঁর সঙ্গে সত্যিই তার তুলনা হত না। ইতিহাসের ছাত্র হলেও বঙ্কিমবাবুর প্রধান আনন্দ ছিল সাহিত্যে। সংস্কৃত কাব্য আর ইংরাজি কবিতা উনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা মুখস্থ বলে যেতেন। আর্থিক অনটন, লেখাপড়ার জগতে ব্যর্থ উচ্চাশা ওঁর জীবনে কোনও তিক্ততার সৃষ্টি করেনি। সাহিত্য শিল্প ইতিহাস থেকে উনি যে গভীর আনন্দ পেতেন, তা ওঁকে সমস্ত অভাব আর ব্যর্থতাবোধ উত্তরণ করে এক শুদ্ধ রসলোকে নিয়ে যেত। ওই দরিদ্র মানুষটি দুঃখী ছিলেন না। যে আনন্দর নাগাল উনি পেয়েছিলেন, কৃষ্টির দিক থেকে ওঁর তুলনায় নিচু স্তরের মানুষের তা পাওয়া সম্ভব না। প্রায় দৃষ্টিহীন মানুষটির গ্রন্থসংগ্রহে অপ্রত্যাশিত একটি জিনিস ছিল, রেনেসাঁসের সময় থেকে আধুনিক কাল অবধি প্রধান প্রধান ইউরোপীয় শিল্পীদের আঁকা ছবির প্রতিলিপি। প্রায় চোখের সঙ্গে ঠেকিয়ে ওই ছবিগুলি উনি দেখতেন। ওই সীমিত পরিচয় থেকেই উনি অনেকটা তৃপ্তি পেতেন। সেই বিগত যুগের রেখাচিত্র আঁকতে গিয়ে একটা কথাই বারবার বলা প্রয়োজন মনে করি। সে যুগে শিক্ষিত সমাজে অনেক মানুষ ছিলেন যারা অন্য কোনও ফলের প্রত্যাশা না রেখে শিল্প বা জ্ঞানের চর্চা অথবা কোনও আদর্শ অনুসরণ করে জীবনের সার্থকতা লাভ করতেন। স্বাধীনতা-উত্তর ভারতবর্ষে বহুমুখী সুযোগ-সুবিধা এবং কিছুটা আর্থিক সাচ্ছল্য পাওয়ায় আমাদের জীবনের সেই ধারাটি প্রায় শুকিয়ে গিয়েছে। প্রায়, কিন্তু সম্পূর্ণ না। যখন শুনি যে পশ্চিমবঙ্গের এক মফসসল শহরে একটি সাইকেলের দোকান কেন্দ্র করে গ্রিক ভাষা, সাহিত্য, দর্শনচর্চার জন্য একটি গোষ্ঠী গড়ে উঠেছে, তখন বুঝি যে ত্রিশ-চল্লিশের দশকে আমাদের ছোট শহরটিতে যে-জীবনাদর্শের পরিচয় পেয়েছিলাম, তা এখনও সম্পূর্ণ লুপ্ত হয়নি।
‘ভদ্রজনের বাসা’ বরিশাল শহরে মানুষের হাতে অবসর ছিল যথেষ্ট। তার একটা বড় অংশ গালগল্প আড্ডায় খরচা হত সন্দেহ নেই। কিন্তু সব আড্ডাই নেহাত ভেরেন্ডাভাজায় ব্যয় হত না। মেজজ্যাঠার আসরে বঙ্কিমবাবু, সংস্কৃতের অধ্যাপক অতুল দাস, তার ছেলে সাহিত্যিক অমূল্য দাস (ছদ্মনাম সম্বুদ্ধ) যখন আসতেন তখন উচ্চাঙ্গের সাহিত্য আলোচনা হত। বাবার কাছে আসতেন স্থানীয় রাজনৈতিক কর্মীরা কংগ্রেস থেকে শুরু করে মুসলিম লিগ অবধি নানা দলের মানুষ। এঁরা কখনও আন্তর্জাতিক রাজনীতি বা দেশের সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতেন, কখনও আলোচ্য বিষয় থাকত কোনও স্থানীয় সমস্যা যা আবেদন নিবেদন বা আন্দোলনের পথে সমাধানের চেষ্টা হত৷
বাবার বৈঠকখানায় যারা আসতেন তারা অনেকেই এক সময় বিপ্লবী ছিলেন–’অনুশীলন’ বা ‘যুগান্তর’ দলের সভ্য হিসাবে। পরে কেউ গাঁধীবাদী, কেউ বা কমিউনিস্ট অথবা সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী কংগ্রেসের সভ্য। খান ইসমাইল চৌধুরীর ছেলে শাহজাহান চৌধুরী, আমাদের শাজু কাকা, স্থানীয় রেভলিউশনারি সোশ্যালিস্ট পার্টির নেতা। বিপ্লবীরা একটা বিষয় নিয়ে কথা বলতেন না-পুলিশি অত্যাচার। এঁরা কেউ কেউ মাঝে মাঝে আমাদের বাড়ি-সংলগ্ন টিনের ঘরে রাত কাটাতেন। ওঁদের সঙ্গে কালেক্টরেটের পুকুরে স্নান করতে যেতাম। তখন দেখতাম অনেকের গায়ে মাথায় বীভৎস ক্ষতচিহ্ন। প্রশ্ন করলে অনেকে চুপ করে থাকতেন। কেউ কেউ বলতেন—ওগুলি পুলিশি কৃপার স্মৃতিচিহ্ন৷ কেউ তকমা পেয়েছেন শোভাযাত্রায় গুলি বা লাঠি চার্জের ফলে, আর কারও তকমা রুদ্ধদ্বার কক্ষে পুলিশের সঙ্গে নিভৃত বিশ্রম্ভালাভের স্মৃতি বহন করত। একদিন বৈঠকখানা ঘরে অনেকে বসে আছেন, একটি মানুষ ঢুকলেন যাঁর চুল উসকো-খুসকো, চোখে উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টি। সবাই উঠে দাঁড়াল। উনি কিছুক্ষণ বসে থেকে আপনমনে বিড়বিড় করে কী বললেন। তারপর উঠে চলে গেলেন। শুনলাম ইনি উল্লাসকর দত্ত। আন্দামানে পুলিশি অত্যাচারে ওঁর মাথা খারাপ হয়ে গেছে।
বরিশাল জেলায় কংগ্রেসি দেশপ্রেমিকদের মুকুটহীন রাজা ছিলেন সতীন্দ্রনাথ সেন, সার্বজনীন সতীনদা। বলা বাহুল্য ওঁর শিরস্থিত অদৃশ্য মুকুট কণ্টকনির্মিত। বয়ঃপ্রাপ্তির পর তাঁর পরিণত জীবনের অর্ধেকেরও বেশি কাটে জেলখানায়। শেষ বছরগুলি কাটে পাকিস্তানি জেলে। সেখানেই যক্ষ্মারোগে বিনা চিকিৎসায় ওঁর মৃত্যু হয়। স্বাধীনতা-পরবর্তী যুগে ভারতবাসী তাঁকে সম্পূর্ণ ভুলে যায়নি। পশ্চিমবঙ্গের পরিষদ ভবনে এবং লোকসভার দেয়ালে ওঁর ছবি ঝুলছে। কলকাতায় এক চৌমাথার মোড়ে ওঁর আবক্ষ প্রস্তরমূর্তিও স্থাপিত হয়েছে। কিন্তু ওঁর এবং ওঁর সহকর্মীদের আড়ম্বরহীন আত্মত্যাগ, আজীবন দুঃখবরণ আমরা মনে রাখিনি। আমাদের সাম্প্রতিককালের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য যে অনেকাংশে সেই ত্যাগের মূল্যে কেনা, এ চেতনা ক্ষীণ হতে হতে প্রায় সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে গেছে। আমাদের জাতীয় আন্দোলনের বুর্জোয়া চরিত্রের সম্পর্কে আলোচনা যখন শুনি, তখন অনেকগুলি মুখ মনে পড়ে। সতীনদার সবসময়ের সঙ্গী তারাপদ ঘোষ, তাঁর ছোট ভাই কুট্টি, শান্ত স্বল্পভাষী গাঁধীবাদী কর্মী বিনোদ কাঞ্জিলাল, সর্বত্যাগী কমিউনিস্ট পার্টির কর্মীরা—এঁদের তুলনীয় মানুষ এখন আর দেখতে পাই না তো! কেমব্রিজের তরুণ ইংরেজ ঐতিহাসিকরা ইংরাজ রাজত্বে ভারতীয় রাজনীতির স্বার্থভিত্তিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তুখোড় বুদ্ধিদীপ্ত হাবিলদারচর্চা গোষ্ঠীর গবেষকরা স্বাধীনতা আন্দোলনে এলিট-গোষ্ঠীর আধিপত্য প্রয়াসই দেখতে পেয়েছেন। কিন্তু ওই যে সব মানুষ ঐহিক জীবনে অন্তহীন বঞ্চনা মেনে নিয়ে দেশকে পরাধীনতা থেকে মুক্ত করার কাজে প্রাণ উৎসর্গ করেছিলেন, এই সব ঐতিহাসিক হিসাবনিকাশে তাঁদের সন্ধান পাই না কেন? কোন স্বার্থবুদ্ধি তাঁদের প্রণোদিত করেছিল? তাঁদের সীমাহীন দুঃখবরণের পেছনে কোন ঐহিক সুখের আশা হাতছানি দিচ্ছিল?
কিন্তু ওঁদের রাজনৈতিক প্রয়াসে ফাঁকি না থাকলেও অনেক ফাঁক ছিল সন্দেহ নেই। কমিউনিস্ট বা কংগ্রেস সোশ্যালিস্ট পার্টির স্থানীয় নেতারা ছাত্রদের মধ্য থেকে নতুন কর্মী বা সভ্য জোটাবার চেষ্টা করতেন ঠিকই, কিন্তু কংগ্রেসের দিক থেকে এরকম প্রচেষ্টা আমাদের শহরে বিশেষ দেখিনি। এ. আই. সি. সি-র নির্বাচনের সময় এলে চার আনা চাঁদা নিয়ে সভ্য করার একটা চেষ্টা হত। কিন্তু সে চেষ্টাকে কর্মীসংগ্রহের চেষ্টা বলা চলত না। স্থানীয় বা দেশব্যাপী আন্দোলনের সম্ভাবনা দেখা দিলে অনেক তরুণ কর্মী জুটত ঠিকই। কিন্তু স্থায়ী আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য এই ভাবে অবস্থা-নির্ভর কর্মীসংগ্রহ যথেষ্ট ছিল না। তার চেয়েও বড় কথা—প্রায় কোনও রাজনৈতিক দলই মধ্যবিত্তর গণ্ডির বাইরে থেকে কর্মী সংগ্রহ করতে পেরেছিলেন বলে মনে হয় না, ফজলুল হক সাহেবের নেতৃত্বে কৃষক-প্রজা দল এ বিষয়ে ব্যতিক্রম ছিল সন্দেহ নেই। ওঁদের শোভাযাত্রায় গ্রামীণ কৃষকশ্রেণির লোক দেখা যেত, যেমন কমিউনিস্টদের শোভাযাত্রায় নিম্নবর্গীয় শহুরে মানুষরা অংশগ্রহণ করতেন। কিন্তু কোনও দলেরই পার্টি অফিসে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ছাড়া অন্য কোনও শ্রেণির লোক দেখিনি। টাউন হলের উল্টো দিকে দরমার বেড়ার ঘরে পাশাপাশি সব বিভিন্ন দলের দফতর ছিল। সেখানে আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং যে-দল যে-মতবাদে বিশ্বাসী তার তত্ত্বকথা সম্পর্কিত বেশ কিছু বই থাকত। মার্কসবাদ, গাঁধীবাদ, সমাজতন্ত্রবিষয়ক তত্ত্বচিন্তার রূপরেখা, নানা দেশে বিপ্লবের ইতিহাস ইত্যাদি বহু বিষয়ের সঙ্গে পরিচয় প্রথম ওইখানেই হয়। বলাবাহুল্য, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত গণ্ডির বাইরে কেউ এই সব তত্ত্ব বা তথ্যের নাগাল পেতেন না। শুনতাম, কমিউনিস্টরা তাঁদের নিম্নবর্গীয় সভ্য বা সমর্থকদের রাজনৈতিক শিক্ষার জন্য ক্লাস করতেন। এই ধরনের পঠন-পাঠন নিয়মিত হত কি না এবং হলেও কতটা ফলপ্রদ হত তা আমার জানা নেই। আমি কংগ্রেসি সমাজতন্ত্রীদের চেষ্টায় যে-রাজনীতির ক্লাস হত, তাতে গিয়েছি। ব্যাপারটা ঠিক নিয়মিত ভাবে হত না, কর্মীরা সুযোগ-সুবিধামতো ক্লাস নিতেন। ফলে আমাদের যদি পাঠ্য বিষয় সম্পর্কে কিছুমাত্র জ্ঞান হয়ে থাকে, তা বক্তৃতা শুনে না, পার্টি অফিস থেকে বই ধার করে পড়ে।
রাজনৈতিক দলগুলির কর্মী/সমর্থক সংগ্রহের ব্যাপারে আর একটা বড় ফাঁক ছিল। মুসলিম লিগ এবং কৃষক-প্রজা পার্টি ছাড়া অন্য কোনও দলের কর্মীদের মধ্যে মুসলমানদের দেখা যেত না। এর ব্যতিক্রম ছিল শাহজাহান চৌধুরীর নেতৃত্বে রেভলিউশনারি সোশ্যালিস্ট পার্টির বরিশাল শাখা, কিন্তু ১৯৪১ সনে শাজুকাকা যখন মুসলিম লিগে যোগ দিলেন, সম্ভবত তখনই এই ব্যতিক্রমেরও অবসান ঘটল। ত্রিশের দশকেও মুসলমান কর্মীরা বরিশালে আইন অমান্য আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন। কিন্তু আমার পরিচিত বহু কংগ্রেস কর্মীর মধ্যে একজনও মুসলমান ছিলেন না। তখন মুসলিম লিগ এবং কৃষক প্রজা পার্টির অভ্যুত্থানের যুগ, মুসলমান ছাত্ররা অধিকাংশ ফজলুল হক সাহেবের সমর্থক ছিলেন। কিন্তু ক্রমে মুসলিম রাজনীতিরও ধারা বদল হচ্ছিল।
ইস্কুলের জীবনে এই পরিবর্তনের ছায়া পড়েছিল। সরকারি ইস্কুল, কিন্তু হিন্দু এবং মুসলমান ছাত্রদের জন্য আলাদা দুটি লোহার ট্যাঙ্কে পানীয় জলের ব্যবস্থা ছিল। কোনও কোনও মুসলিম সহপাঠী আমাদের শুনিয়ে শুনিয়ে বলতেন যে, তাঁরা হিন্দুদের ছোঁয়া খান না। সত্যিতে মুসলমানদের মধ্যে ছোঁয়াছুঁয়ির ব্যাপারে কেউ মাথা ঘামাত না। কিন্তু নতুন রাজনৈতিক তথা সাম্প্রদায়িক চেতনার যুগে হিন্দুদের ছুৎমার্গের পাল্টা জবাব হিসাবেই ওঁদের মধ্যে এ জাতীয় ব্যবহারের সূচনা হয় বলে আমার বিশ্বাস। এই নতুন অর্জিত গোঁড়ামি যে অল্পদিনের মধ্যেই ঐতিহ্যলব্ধ আচার বলে স্বীকৃতি পায়—তসলিমার আত্মচরিতে তার প্রমাণ পাই। একদিন আমরা কয়েকজন শোরগোল করতে করতে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি। এমন সময় এক ঘোড়ার গাড়ি থেকে কিছু সিনেমার হ্যান্ডবিল ছুঁড়ে দিল। বক্তব্য জগদীশ থিয়েটারে ভক্ত ‘প্রহ্লাদ’ নামের একটি ছবি দেখানো হচ্ছে। আমার এক সহপাঠী কাগজটা নিয়ে তাতে থুতু ছেটাল। “এটা কী করলি” জিগ্যেস করায় উত্তর হল, “তুই একদিন হাতেম তাই ছবির হ্যান্ডবিলে থুতু দিয়েছিলি।” এ রকম ঘটনা কখনও ঘটেনি, কারণ ‘হাতেম তাই’ বলে কোনও ছবি কখনও তৈরি হয়েছে বলেই আমার জানা ছিল না। কিন্তু বন্ধুটির উক্তির পেছনে কী মনোভাব কাজ করছিল তা বুঝতে অসুবিধে হয়নি। সেই মনোভাবের চরম প্রকাশ ঘটত মোহনবাগান-মহামেডান স্পোর্টিংয়ের খেলার দিনে। একবার ইস্টবেঙ্গল-মহামেডান স্পোর্টিংয়ের খেলায় ইস্টবেঙ্গল জিতেছে। আমার ওই বন্ধুটিই মন্তব্য করলেন, “ইস্টবেঙ্গল জিতেছে তাতে মালাউনদের এত আহ্লাদ কেন?” বক্তব্যর হেতু ইস্টবেঙ্গল দলেরও অনেকগুলি খেলোয়াড় মুসলমান। একটা কথা এখানে উল্লেখযোগ্য। এই বন্ধুটি পরে পূর্ব পাকিস্তানের একজন লব্ধপ্রতিষ্ঠ ঔপন্যাসিক হিসাবে খ্যাতি অর্জন করেন এবং তাঁর লেখায় সাম্প্রদায়িকতার কোনও চিহ্নমাত্র ছিল না। অনেক দুঃখের ভিতর দিয়ে গিয়ে বাঙালি মুসলমান বুদ্ধিজীবীরা গভীর মানবিকতাবোধকে স্বধর্ম বলে গ্রহণ করেন। কিন্তু আমরা যখন ইস্কুলে পড়ি তখনও সে দিন বহু দূর।
স্কুলে দু’দিন দুটি ঘটনা ঘটে, তাতে হাওয়া কোন দিকে যাচ্ছে বুঝতে অসুবিধা হল না। একদিন ক্লাসে ইতিহাসের পরীক্ষায় প্রশ্ন এল, ‘শিবাজী যে শুধুমাত্র ধূর্তামি, শঠতা আর মিথ্যাচারের বলে রাজ্যস্থাপন করেছিল, প্রমাণ-সহ তাহা আলোচনা কর।’ এই মাস্টারমশাইয়ের ক্লাসে, ক্লাস শেষ হওয়ার সময় জহুর বলে একটি ছেলে নিতান্তই অকারণ পুলকে ‘বন্দেমাতরম’ ধ্বনি তুলেছিল। শিক্ষক ওঁকে বেদম পেটালেন, অথচ উনি ব্যক্তিগত সম্পর্কের ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িকতার কোনও লক্ষণ কখনও দেখাননি। আমি নিজে ওঁর খুবই স্নেহের পাত্র ছিলাম। চট্টগ্রাম শহরে ওঁর বাড়ি গিয়ে বেশ কিছুদিন থেকেছি। সেখানে আদর-যত্নের কোনও অভাব হয়নি। যে-জাতীয় সাম্প্রদায়িক কথাবার্তা আমরা আমাদের মুসলমান সহপাঠীদের অনেকের মুখে শুনতাম, হিন্দুদের মধ্যেও ঠিক এই রকম কথাবার্তাই হত বলে আমার বিশ্বাস। কিন্তু আমাদের বাড়িতে হত না। সাম্প্রদায়িকতা যে জাতীয় জীবনের সব চেয়ে বড় শত্রু, এ কথা বাবা সব সময়ই বলতেন। আমাদের চারপাশে যাঁরা ছিলেন, তাঁরাও প্রায় সবাই একই পথের পথিক। আর আমাদের ঘনিষ্ঠ পারিবারিক বন্ধু ছিলেন খান ইসমাইল চৌধুরীর পরিবার এবং ফজলুল হক স্বয়ং। হিন্দু পরিচালিত খবরের কাগজে ওঁকে নিয়ে নিষ্ঠুর বিদ্রূপ করা হত। উনি তাতে বিশেষ ক্ষুব্ধ হতেন। কিন্তু বরিশালবাসীর কাছে উনি ছিলেন সম্প্রদায়নিরপেক্ষ সর্বজনপ্রিয় মানুষ। রাজনীতির নানা হেরফের সত্ত্বেও এ ভালবাসা উনি কখনও হারাননি।
যখন দ্বিজাতি তত্ত্বর প্রথম অবতারণ হল, তখন একদিন বাবাকে প্রশ্ন করেছিলাম, “বাবা, এটা কি সত্যি কথা? মুসলমানরা আর আমরা ভিন্ন জাতি, ভিন্ন নেশন?” বাবার স্পষ্ট উত্তর, “না, আমরা ভাই।” “তবে এ সব কথা উঠছে কেন?” “শরিকি বাড়ির ছেলে, বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে কেন? সম্পত্তি নিয়ে ভাইয়ে ভাইয়ে কাজিয়া বেধেছে।” “এর পরিণাম কী হবে? এ ঝগড়া কি মিটবে?” “না, এসব মেটে না। এ একবার শুরু হলে দুয়েরই সর্বনাশ ঘটে। ‘বিনাশকালে বিপরীত বুদ্ধি’, আমাদের সর্বনাশ আসন্ন।” কলকাতা শহরে ‘৪৬ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় সেই সর্বনাশের চেহারা দেখেছিলাম। কিন্তু সর্বনাশ ঘটলেও সব কিছু নাশ হয় না। তাই আমরা এখনও বেঁচে আছি। এখনও ভরসা রাখি যে দুই সম্প্রদায়েরই দুবৃত্তদের শত চেষ্টা সত্ত্বেও একদিন মানবিকতাবোধে উদ্দীপ্ত শুভবুদ্ধিরই জয় হবে। বৃহত্তর ভারতবর্ষের রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতার নিরঙ্কুশ জয়লাভ এখনও হয়নি।
আমার মুসলমান সহপাঠীদের মধ্যে শুধু একজনই সম্প্রদায়নিরপেক্ষ রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেছিল। মুজিবর রহমান ওরফে সোনা মিঞা। গ্রামের ছেলে। ক্লাসে ওই ফার্স্ট হত। হেডমাস্টার সিরাজউদ্দিন আহমেদ মুজিবকে ইস্কুল-সংলগ্ন হস্টেলে থাকার জায়গা দিয়েছিলেন সম্ভবত নিখরচায়। মুজিব শাহজাহান চৌধুরীর দলে যোগ দিয়েছিল। হঠাৎ একদিন পুলিশ এসে ওকে ধরে নিয়ে গেল। সাতদিন পর ওকে ছেড়ে দেয়। কিন্তু হাজতবাসের ফলে ইস্কুল-হস্টেলের ঘরে থাকা আর চলল না। ১৯৩৯ সনে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে ছাত্র ফেডারেশন পূর্ব বঙ্গের সর্বত্র আন্দোলন শুরু করে। আন্দোলনের বাইরের চেহারাটা ছিল সর্বদলীয়। ফলে আমরাও এইসব জলুশ আর ধর্মঘটে যোগ দিই। সরকারি স্কুল। ক্লাসের পরীক্ষায় ভাল করায় কিছু জলপানি পেতাম। স্কুলের নিয়মবিরুদ্ধ ওইসব কাজের জন্য জলপানি বন্ধ হওয়ার কথা। কিন্তু স্নেহপ্রবণ হেডমাস্টার সাহেব আমাদের নষ্টামি দেখেও দেখতেন না। জলপানি বন্ধ হয়নি।
সিরাজউদ্দিন আহমেদের মতো সুপুরুষ কমই দেখেছি। ধবধবে ফরসা রং, কটা চোখ, ফ্রেঞ্চকাট দাড়িওয়ালা মানুষটির চেহারার সঙ্গে পঞ্চম জর্জের চেহারার বিশেষ মিল ছিল। উনি কাউকে কখনও বকেননি, বা শাস্তি দেননি। কারও সঙ্গেই বিশেষ কথাও বলতেন না। কিন্তু ওঁর সমস্ত ব্যক্তিত্ব ঘিরে এক রাজকীয় গাম্ভীর্য ছিল। তাতেই আমরা ভয় পেতাম। জিলা স্কুলে পড়বার সময় আমার একবার মরণাপন্ন অসুখ হয়। সিরাজউদ্দিন সাহেব দেখতে এসেছিলেন। চলে যাবার সময় মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। অবাক হয়ে দেখলাম—ওঁর চোখে জল। উনি উঁচু ক্লাসে ইংরাজি পড়াতেন—বিশুদ্ধ উচ্চারণে এবং অত্যন্ত মার্জিত ইংরাজিতে। উনি আমাদের বাইবেল পড়তে উৎসাহ দিতেন। বলতেন এই সপ্তদশ শতকের ইংরাজি এখন অচল। কিন্তু জটিল কথা কীভাবে সহজতম ভাষায় বলা যায় তার উদাহরণ ইংরাজি বাইবেলের চেয়ে ভাল কোথাও নেই। অবসর নেওয়ার আগেই উনি এবং ওঁর স্ত্রী একই সঙ্গে অসুস্থ হলেন। কী অসুখ বুঝতে পারা গেল না। তিন-চার দিনের জ্বরে দু’জনেই চলে গেলেন—একদিন আগে-পরে। তখন ওঁর বয়স তিপ্পান্ন কি চুয়ান্ন।
ইস্কুলের বাইরেও মাস্টারমশাইদের সঙ্গে আমাদের একটা সামাজিক সম্পর্ক ছিল। দু-তিনজন একত্র হয়ে আমরা ওঁদের বাড়িতে যেতাম। বেশির ভাগ সময় শুধু মুজিবর আর আমি। কখনও রবিবার সকালবেলা প্রাতরাশের সময় উপস্থিত হলে মুসলমান শিক্ষকরা একটু বিদ্রুপের সুরে জিগ্যেস করতেন, “নাস্তা খাবা?” প্রশ্নটার মর্মার্থ না বুঝে এবং ওঁরা যাতে বিব্রত না হন সে কথা ভেবে প্রথম প্রথম মানা করতাম। পরে বুঝলাম—এই না বলার ভুল অর্থ হতে পারে। তাই একটু বেশি উৎসাহ দেখিয়েই খেতাম। কেউ কেউ প্রশ্ন করতেন, “তোমাগো মা বাপে কিছু কইবে না তো?” সগর্বে উত্তর দিতাম, “আমাদের মাবাবা এইসব কুসংস্কারে বিশ্বাস করেন না।”
নদীর পাড়ে একটি ভাঙাচোরা বাড়িতে আমাদের এক অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ফছি সাহেব বাস করতেন। ফছি নামে আরও একজন শিক্ষক ছিলেন। তাই নদীর পাড়ের বাসিন্দাটিকে সবাই বলত বড় ফছি সাহেব। একদিন আমাদের কলকাতা-প্রবাসী বড়দা আর আমি নদীর পাড়ে বেড়াচ্ছি। হঠাৎ বড় ফছি সাহেবের সঙ্গে দেখা। বড়দার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে উনি বিশেষ পীড়াপীড়ি শুরু করলেন—ওঁর বাড়িতে এক দিন চা খেতে হবে। শেষ পর্যন্ত আমরা রাজি হলাম। ঠিক হল পরের দিনই আমরা যাব। বড়দা বললেন, “আশা করি কাবাব-টাবাব খাওয়াবে।” ভীষণ খুশি হয়ে ফছি সাহেব আমাদের আপ্যায়ন করে নিয়ে বসালেন। চা এল—তার উপর পুরু দুধের সর ভাসছে। বড়দাকে বললেন, “মোডা করিয়া মালাই দিছি। খায়েন তো?” বড়দা মিথ্যাভাষণ করলেন, “কয়েন কী? অমন জিনিস। খামু না।” তারপর এল পোড়া পোড়া ক’টুকরো পাউরুটি। অকৃতদার দরিদ্র মানুষটি এর বেশি কিছু ব্যবস্থা করতে পারেননি। বড়দা একটু বিরক্তই হলেন। এই খাওয়াবার জন্য কেউ কাউকে নেমন্তন্ন করে। পরদিন বিকালে আবার ওঁর বাড়ির পাশ দিয়ে যাচ্ছি। দেখলাম বাড়ির বাইরে বেশ ভিড়। কিছু একটা ঘটেছে মনে হল। ঢুকে যা দেখলাম—তা কল্পনা করতে পারিনি। ফছি সাহেবের দেহটি ছাদের কড়ি থেকে ঝুলছে। উনি আত্মহত্যা করেছেন। ভদ্রলোকের বয়স তখন সত্তরের কাছে। কোন অজ্ঞাত দুঃখে উনি আত্মহত্যা করলেন তা কেউ জানতে পারেনি। চব্বিশ ঘন্টা আগেও তো উনি মহা উৎসাহে অতিথি আপ্যায়ন করছিলেন। তখন তো ওঁর জীবনের প্রতি কোনও বীতস্পৃহা দেখিনি!
আমরা যখন স্কুলে পড়ি তখন রাজনৈতিক চেতনায় সাম্প্রদায়িকতার বিষবৃক্ষ শিকড় গেড়েছিল সন্দেহ নেই, কিন্তু সামাজিক সম্পর্কে তার ছায়া পড়েনি। স্থানীয় রাজনীতিতে শহরের মিউনিসিপ্যালিটিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিলেন কংগ্রেসপন্থী হিন্দুরা। আর জেলা বোর্ডে কৃষক প্রজা দলের মুসলমান প্রতিনিধিরা আধিপত্য করতেন। ১৯৩৭-এর নির্বাচনের পর কংগ্রেস তাঁর বাড়ানো হাত গ্রহণ করতে গররাজি হওয়ায় ফজলুল হক মুসলিম লিগের সহযোগিতায় খাজা-প্রজা মন্ত্রিসভা গঠন করেন। তপসিলি জাতির যোগেন মণ্ডল, বরিশালের উকিল হাসেম আলি খাঁ, এঁরা সব মন্ত্রিসভার সদস্য হন। কিন্তু সকাল-সন্ধ্যা আমাদের বৈঠকখানায় যেসব ভদ্রজনের পায়ের ধুলো পড়ত, তাঁরা সব সম্প্রদায়ের এবং সব দলেরই মানুষ। সামাজিকতা ছাড়া স্থানীয় সমস্যার সমাধানের উপায় আলোচনা হত। পরিচিত মুসলমান ভদ্রলোকরা, বিশেষ করে ইসমাইল চৌধুরীর পরিবারের সবাই, নিয়মিত আসা যাওয়া করতেন। চৌধুরী সাহেবের বেগম এবং বাড়ির অন্যান্য মহিলারা আমাদের সামনে পর্দা করতেন না। ওঁদের বাড়িতে দাওয়াত বরিশালজীবনের বিশেষ আকর্ষণ ছিল। পরবর্তী জীবনে দিল্লি-লখনউর অভিজাত মুসলিম ভবনে খাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে। রামপুরনবাবের বিখ্যাত বাবুর্চির রান্নাও খেয়েছি। কিন্তু চৌধুরী সাহেবের বাড়ির মোগলাই রান্নার চেয়ে স্বাদু খাবার কখনও কোথাও খেয়েছি এমন মনে পড়ে না। বেগম সাহেবা কিছু কিছু রান্না মাকে শিখিয়েছিলেন। কিন্তু মা বলতেন-শেখাবার সময় উনি একটু কারচুপি করতেন, সুস্বাদের সব রহস্য প্রকাশ হত না, কারণ ভদ্রমহিলা ওঁর রন্ধনপটুত্বের কোনও প্রতিযোগী জোটে এটা একেবারেই চাইতেন না।
মুসলমান বন্ধুদের বাড়িতে ইদের নেমন্তন্ন বাঁধা ছিল। তখন বেশির ভাগ উচ্চ-মধ্যবিত্ত মুসলমান বাড়িতে গোমাংস ঢুকত না, ওটা প্রধানত দরিদ্র মুসলমান ভবনেই বেশি চালু ছিল। ক্কচিৎ-কখনও বাড়িতে গোমাংস রান্না হলে ছেলেদের উপর কড়া আদেশ থাকত তা যেন হিন্দু বন্ধুদের না দেওয়া হয়। নিষিদ্ধ বস্তুর উপর আমার বরাবরই লোভ। আর মুসলমান বন্ধুরা বলতেন—ভুনা গোস্ত আর শিককাবাব গোমাংসে যেমন জমে, আর কিছুতেই তেমন না। পরীক্ষা করে দেখলাম কথাটা অক্ষরে অক্ষরে সত্যি। সুতরাং সুযোগ পেলেই পরীক্ষার পুনরাবৃত্তি হতে থাকে। সমস্ত ব্যাপারটাই অবশ্যি বিশুদ্ধ বৈজ্ঞানিক জ্ঞানস্পৃহার ফল। কিন্তু একদিন ধরা পড়লাম। যে বন্ধুটি নিষিদ্ধ মাংস খাওয়াত তার বাবা তাকে প্রচণ্ড ঠেঙালেন। আমাকেও খুব বকলেন, “আমার বাড়ি আইয়া তুমি জাইত খোয়াইলা। এহন তোমার বাপেরে আমি কী কমু?” কওনের আর কী বা ছিল? বিনয় সরকার মশাই বলতেন, বামনিরা এক থাল ষাঁড়ের ডালনা সামনে ধরে দিত, সেই খেয়ে তবে মুনিঠাকুররা উপনিষদ আর ঋক-সংহিতা রচনা করতেন। গোমাংস নিষিদ্ধ ঘোষণা করা আর প্রাচীন হিন্দু সভ্যতার অবক্ষয়ের মধ্যে যে কার্যকারণ সম্পর্ক আছে এ বিষয়ে আমার সন্দেহ নেই। শরীরে উচ্চাঙ্গের প্রোটিন সরবরাহ বন্ধ করে দিলে, উচ্চাঙ্গের সৃষ্টিকর্ম যে বন্ধ হবে তাতে আর সন্দেহ কী? আর্যাবর্তে আজ এ কথা বলে পার পাওয়া কঠিন। গৈরিকপন্থী সোনার চাঁদেরা লেখা তো পোড়াবেই, সুযোগ পেলে লেখককেও পোড়াবে।
হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক বিষয়ে আমার মোদ্দা কথা, রাজনৈতিক সম্পর্ক যেমনই হোক, ব্যক্তিগত সম্পর্কে তার ছায়া পড়েনি। মুসলমান বন্ধু-বান্ধবরা সোজাসুজি বলতেন, “তোমাগো কংগ্রেসই আমাদের ডুবাইলে।” এ নিয়ে নির্দ্বিধায় তর্ক হত, কিন্তু মনোমালিন্য ঘটত না।
আমি অল্প বয়স থেকেই অতিশয় অকালপক্ক ছিলাম। তাই আমার সত্যিকার বন্ধুত্ব জমত বয়সে অনেক বড় মানুষদের সঙ্গে। যখন ১৩/১৪ বছর বয়স তখন ব্রজমোহন কলেজের অধ্যক্ষ হয়ে এলেন বিখ্যাত বিপ্লবী শৈলেন্দ্রনাথ ঘোষ। সঙ্গে এলেন তাঁর মার্কিন পত্নী এবং দুই সুন্দরী কিশোরী কন্যা। বরিশালের তরুণদের মধ্যে প্রেমের বান ডাকল। সে বানে আমিও ভেসে গেলাম। এসব কথা আলোচনার জন্য যোগ্য বন্ধুর প্রয়োজন। সে কাজ কি ইস্কুলের ক্যাবলা সহপাঠীদের দিয়ে চলে? বঙ্কিমবাবু আমার বন্ধুই হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁকে ব্যাপারটা বলব ভেবেছিলাম। শেষ পর্যন্ত সাহস না পেয়ে রোমিও-জুলিয়েট, লায়লা-মজনু ইত্যাদি বিয়োগান্ত প্রেমের কাহিনি উত্থাপন করে কী গুরুতর ব্যাপার ঘটছে তা পরোক্ষে বুঝিয়ে দিতাম।
উপযুক্ত শ্রোতা পেলাম মানিককাকাকে। মানিক ইসমাইল চৌধুরীর ভাইপো, আমার চেয়ে বয়সে ১২/১৩ বছরের বড়। উনি আমার বিশেষ বন্ধু ছিলেন। হঠাৎ ভয়াবহ সব কবিতা লিখতে শুরু করায় ওঁকে গুণমুগ্ধ শ্রোতা হিসেবে পেলাম। সেসব কবিতা মনে পড়লে এখনও গায়ে কাঁটা দেয়। মানিককাকার সুক্ষ্ম রুচিবোধ ছিল এবং বাংলা, ইংরেজি, উর্দু, ফার্সি এই চার ভাষাতেই উনি প্রচুর পড়াশুনা করেছিলেন। সম্পূর্ণ দুর্বোধ্য কোনও কারণে উনি আমার কাব্যপ্রচেষ্টা অনুমোদন করলেন। উৎসাহের আধিক্যে বাংলার অধ্যাপক উদীয়মান কবি-সাহিত্যিক সুধাংশু চৌধুরীর কাছে আমার বিকচমান কবি-প্রতিভার কথা বললেন। একদিন মানিককাকার সঙ্গে সুধাংশুবাবুর বাড়ি গেলাম। মানিককাকার পীড়াপীড়িতে দু-একটা কবিতা ওঁকে দেখালাম। মনে হল—ভদ্রলোক গোঁফের আড়ালে হাসি চাপার চেষ্টা করছেন। কিন্তু মুখে বললেন, “বেশ হয়েছে, আরও লেখ।” ‘বেশ’ যে হয়নি, সে বিষয়ে আমার সন্দেহ ছিল না। কোনও দৈবশক্তি আমাকে রক্ষা করল। বেশি দেরি হওয়ার আগেই কবি হওয়ার সাধনা ত্যাগ করি। সুধাংশুবাবুও অধ্যাপনা ও সাহিত্যকর্ম ছেড়ে ব্যবসায়ে নামেন। ওঁকে শেষ দেখি কলকাতার রাস্তায়। শোফার চালিত বিরাট গাড়িতে চলেছেন, মুখে সিগার, গোঁফ অন্তর্হিত।
মানিককাকা আমার কাব্যপ্রচেষ্টায় উৎসাহ দিয়ে ভাল করেননি। কিন্তু ওঁর কাছে বহু ফার্সি বয়েত শুনে আমার ভাষাটা সম্পর্কে কৌতূহল জন্মায়। বিশেষ করে একটি ধ্রুপদী গানের ফার্সি বয়েত আমার নবজাগ্রত প্রেমিক হৃদয়ে বড় ঝঙ্কার দিয়েছিল। বয়েতটি নিম্নরূপ–
“পা-এ সাগ বুসিদা মজনু
শখছ-এ পুশত—ইয়ে চিসত
গোফত ইয়ে সাগ গাহে গাহে
রাহ্-এ লায়লা রফতাহ বুদ”।
ভাবার্থ : মজনু একটি কুকুরের পদচুম্বন করলেন। জনৈক ব্যক্তি প্রশ্ন করলেন, এটা কী ব্যাপার? উত্তর হল, লায়লার ভবন যে সরণিতে, এই সারমেয় মাঝে মাঝে সেই পথে যেত। অভিভূত হয়ে ইস্কুলের মৌলভি সাহেবের বাড়ি গিয়ে ফার্সি পড়া শুরু করলাম। জনাবের অনুকরণে মুখ বিকৃত করে কাফ গাফ ধ্বনিতে বাড়ির সবার কান ও প্রাণ ঝালাপালা করতে লাগলাম। মানিককাকা খুশি হয়ে একখণ্ড ওমর খৈয়ামের রুবাইয়া উপহার দিলেন। সঙ্গে উপদেশ দিলেন, “এ কিন্তু প্রেমের কবিতা না, দর্শন। মহব্বত বুঝতে চাও তো নেজামি পড়।” সেই নেজামির সঙ্গে পরিচয় ঘটে অনেক পরে, ১৯৬৯ সনে হাভার্ডে যখন এক সেমেস্টার পড়াচ্ছি তখন আর একবার ফার্সির পাঠ নিতে গিয়ে। মানিককাকা নিজের অজান্তে আমার ভবিষ্যৎ জীবনের একটা পথ নির্দেশ করে দিলেন। কিন্তু ফার্সি ভাষার সঙ্গে আমার সম্পর্ক কিছুটা ব্যর্থ প্রেমের। চোদ্দো বছর বয়স থেকে ভাষাটা আয়ত্ত করার চেষ্টা করেছি, বারবার বহু শিক্ষকের কাছে পড়েছি—দেশে এবং বিদেশে। কিন্তু ভাষাটার উপর সম্পূর্ণ দখল কখনও আসেনি। কৈশোরে দুরাশা ছিল কখনও ইজিচেয়ারে শুয়ে অভিধানের সাহায্য ছাড়া হাফেজ আর রুমি পড়ব। ভাষাজ্ঞানটা কিছুতেই অত দূর এগোয়নি। দিল্লিতে দেখতাম পৃথ্বীনাথ ধর (তখন ইনস্টিটিউট অফ ইকনমিক গ্রোথ-এর অধ্যক্ষ) হাফেজ-এর দিওয়ান হাতে নিয়ে পায়চারি করছেন আর সুর করে পড়ছেন। বাস্তবিক ভারী হিংসা হত।
.
স্কুলে পড়ার সময় আমার ঘনিষ্ঠতম বন্ধুরা আমার চেয়ে বয়সে অনেক বড় ছিলেন—একথা একটু আগেই লিখেছি। মানিককাকা আমার কাব্য ও সাহিত্যচর্চার সঙ্গী ছিলেন। আর রাজনীতি এবং দর্শনের পাঠ পাই সত্যব্রত ঘোষ ওরফে রুণুদার কাছ থেকে। রুণুদা বিখ্যাত পণ্ডিত দেবপ্রসাদ ঘোষের ছোট ভাই। কৈশোরে ও প্রথম যৌবনে রুণুদা এবং ওঁর দিদি শান্তিসুধা ঘোষ বৈপ্লবিক দলের কর্মী ছিলেন। রুণুদা বহুদিন বরিশালের বাইরে কাশীতে নজরবন্দি ছিলেন, তারপর বেশ কয়েক বছর ওঁদের বরিশালের বাড়িতে। রুণুদা খুব সম্প্রতি মারা গেছেন। মৃত্যুর অল্পদিন আগে খবরের কাগজে প্রকাশিত এক প্রবন্ধে ত্রিশের দশকের এক রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের রহস্য প্রকাশ করেন। ঘটনাটি ঘটে বরিশাল শহরে এক সরকারি প্রদর্শনীকে কেন্দ্র করে। আইন অমান্য আন্দোলন তখন চলছে। কংগ্রেসি ভলান্টিয়াররা প্রদর্শনীর পথ বন্ধ করে শুয়ে আছে। সাহেব ম্যাজিস্ট্রেট ওদের সাবধানে ডিঙিয়ে ভেতরে গেলেন। কিন্তু রাজভক্ত যতীশ দারোগা তাঁর ভক্তি প্রকাশ করলেন ভলান্টিয়ারদের লাথি মেরে সরিয়ে। যাঁরা লাথি খেলেন তাঁদের কয়েকজন গাঁধীবাদী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করলেও গোপনে সশস্ত্র অভ্যুত্থানে বিশ্বাসী বিপ্লবী দলের সভ্য ছিলেন। এঁরা চারজন–কারও বয়সই ষোলোর উপরে না—সিদ্ধান্ত নিলেন যে, যতীশকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে। পরদিন দিনের আলোয় এঁদের একজন রমেশ যতীশ দারোগার বুকে ছুরি বসিয়ে দেয়। চব্বিশ ঘণ্টা পরে পুলিশ যখন পনেরো বছর বয়স্ক রমেশকে আদালতে হাজির করে, তখন তার মাথায় একটি চুলও নেই—পুলিশ মুঠো মুঠো করে ছিঁড়েছে। রমেশ একবারও মুখ খোলেনি। প্রথমে ওর মৃত্যুদণ্ড হয়, তারপর অপ্রাপ্তবয়স্ক বলে যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরের আদেশ হয়। ঘটনার সত্তর বছর পরে রুণুদার প্রবন্ধে মৃত্যুদণ্ডের সিদ্ধান্ত কীভাবে নেওয়া হয়েছিল তার বিবরণ প্রকাশ পায়। যে-চারজন কিশোর বিপ্লবী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, রুণুদা তাঁদের একজন।
আমার সঙ্গে যখন রুণুদার পরিচয় হয় তখন উনি অন্তরীণ থেকে পলিটিক্যাল সায়েন্সে এম. এ. পাস করেছেন। রাজনৈতিক মতবাদের দিক থেকে উনি তখন এম. এন. রায়ের অনুগামী। ওঁর কাছেই প্রথম হেগেল এবং মার্কসের পাঠ নিই। এবং এম. এন. রায়ের সমস্ত ঐতিহ্যলব্ধ চিন্তাধারার বিরুদ্ধে, বিশেষত গতানুগতিক নীতিবোধ সম্বন্ধে মতামতের সঙ্গে ওঁর মাধ্যমেই পরিচয় হয়। উনি আমাকে এম. এন. রায়ের ‘মেমোয়্যার্স অফ এ ক্যাট’ পড়ান। ওই বস্তুবাদী জীবনদর্শন তখন খুব মনে ধরেছিল। পরে মনে হয়েছে—কেন মানবেন্দ্রনাথ এবং কমলাকান্ত দু’জনেই মানুষের ভণ্ডামি উদঘাটন করতে বিড়ালের আশ্রয় নিলেন? ওদের বুদ্ধির কাছে বাস্তব জীবনে আমাদের প্রায়ই হার মানতে হয় বলে?
বিদ্যাবুদ্ধির জন্য রুণুদা আমাদের কাছে হিরো ছিলেন। ওঁর নায়কোচিত গুণ আরও এক উপযুক্ত ক্ষেত্রে প্রকাশ পেল। রুণুদা তাঁর প্রেমিকা স্কটিশ চার্চ কলেজের ডান্ডাস হস্টেল-বাসিনী অঞ্জলি ওরফে মিনির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। অল্পদিনের মধ্যেই পরমা সুন্দরী অঞ্জলি মিনিবউদি রূপে আত্মপ্রকাশ করলেন। মা বাবার আপত্তি থাকায় ‘ইলোপ’ অর্থাৎ কন্যাহরণ করে বিয়ে করতে হয়েছিল। রুণুদা হিরো থেকে হিরোশ্রেষ্ঠর পদে উন্নীত হলেন। রুণুদার সঙ্গে শেষ পর্যন্ত আমার যোগাযোগ ছিল। শেষজীবনে বম্বের এক ফ্ল্যাটে উনি বাসা বাঁধেন। সম্পূর্ণ একাই থাকতেন। নব্বই বছর বয়সেও আগের মতোই পিঠ সোজা করে বসে মিনিটে দুশো শব্দ রেটে কথা বলতেন। ওঁর তারুণ্যে কখনও ঘাটতি পড়েনি।
বরিশাল জেলায় গুণিজনের অভাব ছিল না। সে যুগের মধ্যবিত্ত বাঙালির মূল্যবোধে অর্থ-প্রতিপত্তির তুলনায় সংস্কৃতি, জ্ঞান, দেশপ্রেমের ক্ষেত্রে অবদানকেই বড় মনে করা হত। আদর্শ হিসেবে যাঁদের নাম সব সময় শুনতাম তাঁরা বেশির ভাগই পণ্ডিত ব্যক্তি। নামটা সবচেয়ে বেশি শোনা যেত দেবপ্রসাদবাবুর, কারণ সত্যিই ওঁর তুলনীয় পাণ্ডিত্য খুব কম লোকেরই ছিল। ওঁর বোন, অঙ্কে অনার্স নিয়ে ঈশান স্কলার, শান্তিসুধাদিব নামটাও খুব শুনতাম। আর বিখ্যাত দুই ঐতিহাসিক-হেমচন্দ্র রায়চৌধুরী আর সুরেন্দ্রনাথ সেন, বরিশালেরই সন্তান। রমেশচন্দ্র মজুমদার ফরিদপুরের লোক হলেও ওঁর শ্বশুরবাড়ি বরিশালের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। আর নাম শুনতাম অদ্ভুতকর্মা ‘খোকা ভগবান’ সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তর। উনি তিন বছর বয়সে বিশুদ্ধ উচ্চারণে বেদ-উপনিষদ আবৃত্তি করতেন—এ কথার অনেক প্রমাণ ছিল। লোকে বলত-উনি জাতিস্মর। উনি মেজজ্যাঠার কাছে প্রায়ই আসতেন। ওঁর পারিবারিক জীবনে প্রচণ্ড অশান্তির সময় উনি খুব ঘনঘন আসতেন। মেজজ্যাঠা বলতেন, “মানুষটা একটু শান্তি খোঁজে।” এক নিন্দুক ব্যক্তি প্রশ্ন করলেন, “শান্তি কি কোনও মাইয়ালোকের নাম?”
আমার সৌভাগ্য, এইসব বিখ্যাত মানুষের দরজা সব সময়ই খোলা থাকত, আমাদের মতো বালখিল্যরা গেলেও বিরক্ত হতেন না। হেমবাবু ওঁর প্রথম বিবাহসূত্রে আমাদের আত্মীয় ছিলেন। ওঁকে নির্দ্বিধায় ইস্কুলের পাঠক্রমের জন্য লেখা প্রশ্নোত্তর পর্যন্ত দেখিয়েছি। উনি যত্ন করে পড়ে মতামত দিতেন। সুরেন সেন মশাই পণ্ডিত মূর্খের তফাত করতেন না। মহারাষ্ট্রের ইতিহাস সম্বন্ধে ওঁর গবেষণালব্ধ তথ্য সবাইকে শোনাতেন, রমেশবাবু ‘দ্বীপময় ভারত’-এ হিন্দুদের কীর্তিকাহিনি বর্ণনা করতেন।
শুধু একটি মানুষের মূল্য বরিশালবাসী তাঁর জীবৎকালে বুঝতে পারেনি। মানুষটির নাম জীবনানন্দ দাশ। ওঁর কবিতার সমঝদার বরিশাল শহরে বেশি কেউ ছিল না। বরং শনিবারের চিঠির প্রতিধ্বনি করে ঠাট্টা-বিদ্রূপই বেশি শোনা যেত। মানুষটি নিতান্তই সঙ্গীহীন ছিলেন। রূপহীন কবির চলাফেরাও ছিল গ্রাম্যতা-দোষে দুষ্ট। উনি একা একা নদীর পাড়ে হাঁটতে যেতেন। ওঁর পেছন পেছন কিছু বখাটে ছেলে ওঁকে ভেঙিয়ে ভেঙিয়ে হাঁটত। কলেজেও উনি একা বসে থাকতেন, কারও সঙ্গে বিশেষ কথা বলতে দেখা যেত না। ওঁর স্ত্রী রাজনৈতিক কাজে বিশেষভাবে জড়িত ছিলেন। তাঁকে যেদিন পুলিশে গ্রেফতার করে সেদিন কবি হাউহাউ করে কেঁদেছিলেন। এ নিয়ে হাসাহাসির অন্ত ছিল না। ‘বনলতা সেন’-এর কবির ব্যক্তিগত জীবনের গভীর ট্র্যাজেডি ওঁর মৃত্যুর পরে প্রকাশিত গদ্য রচনায় ফুটে উঠেছে। ওঁর কবিতা বুঝতে পারতাম না। কিন্তু মানুষটার জন্য কষ্ট হত।
.
ইস্কুলজীবন শেষ হয়ে এল। ১৯৪১ সনে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিলাম। ক্লাসে সেকেন্ড হতাম। মাস্টারমশাইরা বলতেন—একটা ডিস্ট্রিক্ট স্কলারশিপ পেতেও পার। পরীক্ষার ফল বের হবার অল্প ক’দিন বাকি। কী কাজে বাবা কলকাতা গেলেন। হঠাৎ ওঁর টেলিগ্রাম এল–ফলটা আশাতীত রকমের ভাল হয়েছে। ফজলুল হক সাহেবও তার করলেন, “বরিশাল কি জয়।” দৈনিক পত্রিকায় ছবি বের হল। জীবনে এই প্রথম বড় রকমের সাফল্য। রাতারাতি বঙ্গবিখ্যাত হলাম, বরিশালবিখ্যাত তো বটেই। শহরে সবাই সবাইকে চেনে। সপ্রশংস দৃষ্টিতে চেনা-অচেনা সবাই তাকাচ্ছে। বরিশালের লোক নিচু স্বরে কথা বলতে জানে না। কেউ বলছে “দেখাইলে বটে ছ্যামড়া।” কেউ, “কীর্তিপাশা গেরামের নাম রাখলে।” আহা, কানে যেন মধু ঢালছে সব। শিরায় শিরায় অ্যাড্রিনালিন টগবগ করছে। মানিককাকা এসে জড়িয়ে ধরলেন, “কামাল কিয়া!” জাগতিক সাফল্য ছোট জাতের জিনিস, ও নিয়ে বেশি লাফালাফি করতে নেই–বরাবর এই শিক্ষাই পেয়েছি। কিন্তু ওই বস্তুর প্রথম স্বাদ বড় মধুর লেগেছিল। কর্মজীবনে ওর তুলনীয় আনন্দ আর কখনও পাইনি।