১০. পরাজয়? (১৯৭৯-৯৯)

১০. পরাজয়? (১৯৭৯-৯৯)

মৌলবাদী রিকনকুইস্তা দেখিয়ে দিয়েছিল যে, ধর্ম আর যাই হোক অবলুপ্ত শক্তি ছিল না। ইরানি বিপ্লবের পর পর জনৈক উত্তেজিত মার্কিন সরকারী কর্মকর্তার মতো আর একথা বলার জো ছিল না: ‘ধর্মকে আবার কে কবে গুরুত্বের সাথে নিয়েছে?‍ মৌলবাদীরা ধর্মবিশ্বাসকে ছায়া থেকে বের করে এনে দেখিয়ে দিয়েছিল যে, আধুনিক সমাজে এক বিশাল জনগণের কাছে এটা আবেদন রাখতে পারে। তাদের বিজয় সেক্যুলারিস্টদের হতাশায় ভরে দিয়েছিল; এটা আলোকন যুগের পোষ মানানো, নম্র ব্যক্তিগত পর্যায়ে নমিত বিশ্বাস ছিল না। এটা যেন আধুনিকতার মূল্যবোধ উপেক্ষা করে যাচ্ছিল। ১৯৭০ দশকের শেষার্ধের ধর্মীয় আক্রমণ দেখিয়ে দিয়েছিল যে, বিভিন্ন সমাজ মেরুকৃত অবস্থায় রয়েছে; বিংশ শতাব্দীর শেষ নাগাদ এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, ধার্মিক ও সেক্যুলারিস্টরা আরও বেশি বিভক্ত হয়ে গেছে। এখন আর একে অন্যের ভাষায় কথা বলতে পারছে না এরা, পরস্পরের দৃষ্টিভঙ্গি বুঝতে পারছে না। সম্পূর্ণ খাঁটি যৌক্তিক দৃষ্টিভঙ্গিতে মৌলবাদ ছিল বিপর্যয়, কিন্তু মৌলবাদীদের মতে এটা বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদের অবৈধ আধিপত্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ হওয়ায় এটা বিস্ময়কর ছিল না। কীভাবে আমরা এইসব মৌলবাদকে ধর্মীয় আন্দোলন হিসাবে মূল্যায়ন করব? মৌলবাদীদের বিজয় কি সত্যিকার অর্থে ধর্মের পরাজয়ের সমান, আর মৌলবাদী হুমকীর কি অবসান ঘটেছে?

যারা তখনও বিশেষ করে আলোকনের নীতিমালা মেনে চলত তাদের পক্ষে ইরানের ইসলামি বিপ্লব বিশেষভাবে অস্বস্তিকর ছিল। বিপ্লব কঠোরভাবে সেক্যুলারিস্ট ধরনের হওয়ার কথা ছিল। জাগতিক বাস্তবতা যখন এক নতুন মর্যাদা অর্জন করে ও ধর্মের অতীন্দ্রিয় বলয় হতে স্বাধীনতা ঘোষণা করতে প্রস্তুত হয়, ঠিক তেমন একটা সময়েই তা সংঘটিত হয় বলে মনে করা হত। হান্নাহ আরেন্দট তাঁর জনপ্রিয় গবেষণা অন বিভ্যুলুশন (১৯৬৩)-এ যেমন ব্যাখ্যা করেছেন: ‘শেষ পর্যন্ত এমন হতে পারে যে আমরা যাকে বিপ্লব আখ্যায়িত করে থাকি সেটা এক নতুন সেক্যুলারিজমের জন্ম ডেকে আনা ক্রান্তিকাল মাত্র।” জনপ্রিয় গণঅভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে একটি ধর্মতাত্ত্বিক রাষ্ট্রের আবির্ভাব যেন পাশ্চাত্য প্রজ্ঞার এর আপাত আনাড়ী প্রত্যাখ্যানে প্রায় বিব্রতকর দারুণ অতিকল্পনা বলে মনে হয়েছে। ইরানি বিপ্লবের ঠিক অব্যবহিত পর কেউই আশা করেনি যে খোমেনির সরকার টিকে থাকবে। আধুনিক ইসলামি সরকারের মতো ধর্মীয় অভ্যুত্থানের ধারণাটিই স্বাভাবিক যুক্তিতে স্ববিরোধী মনে হয়েছিল।

কিন্তু পশ্চিমাদের এই সত্য মেনে নিতে হয়েছিল যে, অধিকাংশ ইরানি ইসলামি শাসন চায়। বহু আমেরিকান ও ইউরিাপিয় পর্যবেক্ষক আস্থার সাথে ‘উন্মাদ মোল্লাহদের’ উৎখাত করতে যে ‘মধ্যপন্থীদের’ অবির্ভাবের প্রত্যাশা করেছিলেন, তাদের আবির্ভাব ঘটেনি। বিপ্লবের পর ইরানে জাতীয়তাবাদী ও সেক্যুলার ও গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র আকাঙক্ষীরা নিজেদের সংখ্যালঘু হিসাবে আবিষ্কার করেছে। অবশ্য, ইসলামি সরকারের রূপ ঠিক কেমন হওয়া উচিত তা নিয়ে কোনও ঐকমত্য ছিল না। শরিয়তির অনুসারী পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত বুদ্ধিজীবীগণ হ্রাসকৃত যাজকীয় শাসনের সাথে সাধারণ মানুষের শাসন চেয়েছেন। খোমেনির নতুন প্রধানমন্ত্রী মেহেদি বাযারগান অনৈসলামিক পার্লামেন্টারি আইনে ভেটো প্রয়োগের ক্ষমতাসহ একটি মুজতাহিদদের কাউন্সিলসহ ১৯০৬ সালের সংবিধানে (রাজতন্ত্র বাদে) ফিরে যেতে চেয়েছেন। কুমের মাদ্রাসাগুলো খোমেনির বেলায়েত-ই ফাকিহ’র বাস্তবায়নের জন্যে চাপ দিতে থাকে, কিন্তু আয়াতোল্লাহ শরিয়তমাদারি ও আয়াতোল্লাহ তালেকানি অতীন্দ্রিয়বাদে অনুপ্রাণিত একটি যাজক গোষ্ঠীর হাতে জাতির শাসন ভার তুলে দেওয়ার এই ধারণার প্রবল বিরোধী ছিলেন, কেননা তা শত বছরের শিয়া ঐতিহ্যের লঙ্ঘন করে। এমন এক রাজনীতিতে ভীষণ বিপদের ছাপ দেখতে পেয়েছিলেন তাঁরা। ১৯৭৯ সালের অক্টোবর নাগাদ মারাত্মক বিবাদ সৃষ্টি হয়েছিল।৩ বাযারগান ও শরিয়তমাদারি খোমেনির অনুসারীদের তৈরি ফাকিহকে (খোমেনি) সর্বোচ্চ ক্ষমতদানকারী খসড়া সংবিধান আক্রমণ করেন, যিনি সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রণ করবেন এবং অনায়াসে প্রধানমন্ত্রীকে বরখাস্ত করতে পারবেন। সংবিধান একজন নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট, একটি মন্ত্রীসভা ও বার সদস্য বিশিষ্ট শরীয়া বিরোধী আইনের বিরুদ্ধে ভেটো দানের ক্ষমতাসহ একটি কাউন্সিল অভ গার্ডিয়ানের ব্যবস্থাও রেখিছিল।

খসড়া সংবিধানের বিরোধী পক্ষ শক্তিশালী ছিল। বামপন্থী গেরিলা আন্দোলনগুলো, ইরানের অভ্যন্তরের জাতিগত সংখ্যালঘু ও প্রভাবশালী মুসলিম পিপল’স রিপাবলিকান পার্টি (আয়াতোল্লাহ শরিয়তমাদারি প্রতিষ্ঠিত) প্রবলভাবে এর বিরুদ্ধে ছিল। উদারপন্থী ও পাশ্চাত্য শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণী ক্রমবর্ধমানহারে তাদের চোখে নতুন সরকারের ধর্মীয় বাড়াবাড়ির কারণে হতাশ হয়ে পড়ছিল: সাবেক শাহর স্বেচ্ছাচারের বিরুদ্ধে বীরের মতো লড়াই করে এবার ইসলামি স্বৈরতন্ত্রের কব্জায় পড়তে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছিল তাদের কাছে। তারা লক্ষ করেছিল, খসড়া সংবিধানে কেবল ইসলামি আইন ও রেওয়াজকে লঙ্ঘন না করার ক্ষেত্রেই সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও রাজনৈতিক বক্তব্য প্রকাশের স্বাধীনতা (যার জন্যে উদারপন্থীরা পাহলভীদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল) নিশ্চিত করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বাযারগান বিশেষভাবে স্পষ্টবক্তা ছিলেন। সরাসরি খোমেনিকে আক্রমণ না করার ব্যাপারে সবসময়ই সতর্ক ছিলেন তিনি, তবে ইসলামি বিপ্লবী দলে, তাঁর দাবি অনুযায়ী ইসলামি বিপ্লবের গোটা লক্ষ্যকেই লঙ্ঘনকারী প্রস্তাবিত সংবিধানিক ধারাসমূহের জন্যে দায়ী, তাঁর ভাষায়, প্রতিক্রিয়াশীল যাজকদের বিরুদ্ধে সমালোচনামুখর ছিলেন।

সঙ্কটের মুখে পড়েছিলেন খোমেনি। ৩রা ডিসেম্বর, ১৯৭৯, এক জাতীয় গণভোটে খসড়া সংবিধানের উপর জনগণের ভোট দানের তারিখ স্থির হয়েছিল। বেলায়েত-ই ফাকিহ পরাস্ত হতে যাচ্ছে বলে মনে হয়েছিল। এই পর্যন্ত খোমেনি ছিলেন বাস্তববাদী; পাহলভী সরকারকে উৎখাত করার জন্যে নিপুণভাবে বামপন্থী, ইসলামপন্থী, বুদ্ধিজীবী, জাতীয়তাবাদী ও উদারপন্থীদের কোয়ালিশনকে সামাল দিয়ে আসছিলেন। কিন্তু ১৯৭৯ সালের শেষ নাগাদ এটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে, পরস্পরবিরোধী উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যে পরিচালিত বিভিন্ন গ্রুপের এই অসম মৈত্রী ভেঙে যেতে বসেছে এবং বিপ্লবের ভবিষ্যৎ-তিনি স্বয়ং বুঝতে পারছিলেন সেটা-বিপদাপন্ন। তখন অজ্ঞাতসারে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।

মহাশয়তান হিসাবে আমেরিকার বিরুদ্ধে নিন্দাবাদ সত্ত্বেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকার ও তেহরানের নতুন ইসলামি সরকারের সম্পর্ক সতর্ক হলেও সঠিক ছিল। ১৪ই ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৯, খোমেনির ইরানে ফিরে আসার অল্প পরেই ছাত্ররা রাজধানীর আমেরিকান দূতাবাসে আক্রমণ চালিয়ে দখল করে নেওয়ার প্রয়াস পায়, কিন্তু খোমেনি ও বাযারগান দ্রুত অনুপ্রবেশকারীদের বহিষ্কারের পদক্ষেপ নেন। তা সত্ত্বেও মহাশয়তান সম্পর্কে আস্থাহীন ছিলেন খোমেনি, আমেরিকা বিনা যুদ্ধে ইরানে তার স্বার্থ ছেড়ে দেবে, এটা বিশ্বাস করতে পারেননি। আমরা অধিকাংশ মৌলবাদীদের যে বৈকল্যে তাড়িত হতে দেখি, সেই একই কারণে খোমেনি বিশ্বাস করেছেন যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র স্রেফ উপযুক্ত সময়ের অপেক্ষা করছে এবং শেষ পর্যন্ত ১৯৫৩ সালের মুসাদ্দিককে উৎখাত করার মতোই নতুন ইসলামি প্রজাতন্ত্রকে হুমকি দেবে। ২২শে অক্টোবর, ১৯৭৯ মরণব্যধি ক্যান্সারের চিকিৎসা গ্রহণের জন্যে শাহ নিউ ইয়র্ক সিটিতে গেলে খোমেনির সন্দেহ যেন নিশ্চিত হয়ে ওঠে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকার নিজস্ব বিশেষজ্ঞ ও তেহরানের তরফ থেকে সাবেক শাহকে প্রবেশাধিকার না দেওয়ার ব্যাপারে সতর্ক করে দেওয়া হলেও কার্টারের বিশ্বাস ছিল যে, এই মানবিক সেবার ক্ষেত্রে সাবেক এই অনুগত মিত্রকে তিনি প্রত্যাখ্যান করতে পারবেন না।

সাথে সাথে মহাশয়তানের বিরুদ্ধে খোমেনির বাগাড়ম্বর আরও জ্বলাময়ী হয়ে ওঠে। শাস্তি প্রদানের জন্যে রেযা শাহকে ইরানে ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি করেন তিনি, সাবেক সরকারের অনুগত সকল কর্মচারীকে ছাঁটাইয়ের আহ্বান জানান। খোদ ইসলামি ইরানের অভ্যন্তরেই পশ্চিমের উপর নির্ভরশীল বিশ্বাসঘাতকদের ঘাপটি মেরে থাকার ঘোষণা দেন তিনি, তাদের অবশ্যই জাতির ভেতর থেকে বহিষ্কার করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী বাযারগান এবং সেই সাথে খসড়া সংবিধানের অন্য বিরোধীরাই যে এই আক্রমণের লক্ষ্য ছিলেন সেটা বুঝতে খুব বেশি বুদ্ধির প্রয়োজন হয় না। ১লা নভেম্বর বিমান যোগে আলজেরিয় স্বাধীনতার বার্ষিকীতে যোগ দিতে গিয়ে কার্টারের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা গনিউ ব্রেনিস্কির সাথে করমর্দনরত অবস্থায় ছবি তোলায় খোমেনির চালে হেরে যান বাযারগান। ইসলামি বিপ্লবী দলে তাঁর প্রতিপক্ষ বাযারগানকে আনেন্দের সাথে আমেরিকান এজেন্ট হিসাবে গালমন্দ করতে শুরু করে। এমনি উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে ৪ঠা নভেম্বর প্রায় তিন হাজার ইরানি ছাত্র তেহরানে আমেরিকান দূতাবাসে আক্রমণ চালিয়ে নব্বইজনকে জিম্মি হিসাবে আটক করে। প্রথমে খোমেনি অচিরেই তাদের মুক্তি নিশ্চিত করবেন এবং আগের মতো ছাত্রদের প্রত্যাহারের নির্দেশ দেবেন বলে মনে হয়েছিল। খোমেনি ছাত্রদের দূতাবাসে হামলার বিষয়টি আগে থেকে জানতেন কিনা আজও তা স্পষ্ট নয়। সে যাই হোক, প্রায় তিনদিন নীরব ছিলেন তিনি। কিন্তু বাযারগান যখন বুঝতে পারলেন, দূতাবাস মুক্ত করার জন্যে খোমেনির সমর্থন পাচ্ছেন না, নিজের রাজনৈতিক গুরুত্ব উপলব্ধি করে ৬ই নভেম্বর বিদেশমন্ত্রী ইব্রাহিম ইয়াযদিসহ পদত্যাগ করলেন তিনি। মাত্র কয়েক দিন আটক রাখার উদ্দেশ্য থাকলেও ছাত্ররা অবাক হয়ে উপলব্ধি করেছিল যে আসলে ইরান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভেতর এক প্রধান বিরোধ জন্ম দিয়েছে তারা। খোমেনি ও ইসলামি বিপ্লবী প্রজাতন্ত্র ছাত্রদের পক্ষে সমর্থন ঘোষণা করেন। বিশ্বজুড়ে জিম্মি নাটকের ব্যাপক প্রচার খোমেনিকে এক নতুন নিশ্চয়তা দেয়। মহিলা জিম্মি ও কৃষ্ণাঙ্গ মেরিন গার্ডদের মুক্তি দেওয়া হলেও বাকি বাহান্নজন আমেরিকান কূটনীতিককে ৪৪৪ দিন বন্দি করে রাখা হয় এবং ইরানি রেডিক্যালিজমের প্রতীকে পরিণত হয় এই ঘটনা।

খোমেনির চোখে জিম্মিরা ছিলেন দৈববর। বাইরের শত্রু মহাশয়তানের প্রতি মনোযোগ নিবদ্ধ করে, তাদের আটক ও বিপ্লব উত্তর আমেরিকার প্রতি জন্মানো ঘৃণা এক অভ্যন্তরীণ দুষ্কালে ইরানিদের খোমেনির পেছনে ঐক্যবদ্ধ করেছিল। বাযারগানের বিদায় এক নিমেষে খসড়া সংবিধানের সবচেয়ে উচ্চকিত বিরোধীর মুছে দিয়েছিল ও বিরোধী শক্তিকে দুর্বল করেছে। যথারীতি ডিসেম্বরের রেফারেন্ডামে লক্ষণীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে নতুন সংবিধান পাস হয়। খোমেনি জিম্মি সংকটকে স্রেফ নিজের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতির আলোকেই বিবেচনা করেছিলেন। গোড়াতে বানি সদরের কাছে যেমন ব্যাখ্যা করেছিলেন তিনি:

তৎপরতার বহু সুবিধা রয়েছে। অমেরিকানরা ইসলামি প্রজাতন্ত্রের স্থায়িত্ব লাভ দেখতে চায় না। জিম্মিদের আটক রেখে নিজেদের অভ্যন্তরীণ কাজ শেষ করব আমরা, তারপর ছেড়ে দেব ওদের। এটা আমাদের জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করেছে। বিরোধীরা আমাদের বিরুদ্ধে কিছু করার সাহস পাবে না। কোনও ঝামেলা ছাড়াই আমরা সংবিধানকে জনগণের সামনে ভোটের জন্যে তুলে ধরতে পারব, প্রেসিডেন্ট ও সংসদীয় নির্বাচনও অনুষ্ঠান করা যাবে। আমরা এইসব কাজ শেষ করার পরই জিম্মিদের মুক্তি দেওয়া যাবে।৪

খোমেনির জ্বলাময়ী বাগাড়ম্বর সত্ত্বেও এটা ইসলামের মিথোসের বাতলে দেওয়া নীতি ছিল না, বরং এক ধরনের বাস্তবভিত্তিক লোগোস। তাসত্ত্বেও সঙ্কট খোমেনির নিজস্ব প্রোফাইলও বদলে দিয়েছিল। একজন বাস্তববাদী রাজনীতিক হয়ে থাকার বদলে তাঁর নিজের দৃষ্টিতেই পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে উম্মাহর সংগ্রামে নেতায় পরিণত হয়েছিলেন তিনি; ‘বিপ্লব’ শব্দটি তাঁর ভাষণে প্রচলিত ইসলামি পরিভাষার অনুরূপ প্রায় পবিত্র মূল্য লাভ করেছিল: একমাত্র তিনিই বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর ক্ষমতা রাখেন এবং এর শক্তির সীমাবদ্ধতা তুলে ধরেন। একই সময়ে সারা বিশ্বে সঙ্কটের ফলে ইরান ও ইসলাম সম্পর্কে অস্বাভাবিকভাবে নয়া ঘৃণা ছড়িয়ে পড়ায় খোমেনিকে ভেতরের বাইরের প্রতিপক্ষের হুমকির মুখে বিপ্লবের নাজুকতা সম্পর্কে ঢের বেশি সজাগ করে তুলেছিল। ১৯৮০ সালের মে মাসের শেষের দিকে ও জুলাই মাসের মাঝামাঝি সরকারের বিরুদ্ধে চারটি ভিন্ন ভিন্ন অভ্যুত্থান উন্মোচিত হয়েছিল এবং বছরের শেষ পর্যন্ত সেক্যুলারিস্ট গেরিলা ও খোমেনির বিপ্লবী গার্ডদের ভেতর অবিরাম যুদ্ধ বজায় ছিল। এই দিনগুলোর বিভ্রান্তি ও ভীতি সারা ইরান জুড়ে তথাকথিত বিপ্লবী কাউন্সিলের গজিয়ে ওঠার ভেতর দিয়ে আরও প্রবল হয়ে উঠেছিল, সরকার এগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিল না। এইসব কোমিতেহ বেশ্যাবৃত্তি বা পাহলভীদের অধীনে বিভিন্ন পদে অধিষ্ঠিত থাকার মতো ‘অনৈসলামিক আচরণ’-এর অপরাধে শত শত লোককে হত্যা করে। একটি কেন্দ্রিয় শক্তির পতনের পর এই ধরনের স্থানীয় সংস্থার আবির্ভাব সমাজকে পুনর্গঠনের লক্ষ্যে পরিচালিত বিপ্লবের সর্বজনীন বৈশিষ্ট্য বলেই মনে হয়। খোমেনি এই কোমিতেহগুলোর বাড়াবাড়ির নিন্দা করেছেন, এসবকে ইসলামি আইনের পরিপন্থী ও বিপ্লবের সত্যতা বিনষ্টকারী ঘোষণা করেছেন। কিন্তু সেগুলোকে ভেঙে তো দেনইনি বরং শেষ পর্যন্ত নিজের আনুকূল্যে এনে নিয়ন্ত্রণ করেছেন ও তৃণমূল পর্যায়ে সরকারের সমর্থকে পরিণত করেছেন।o ইরাকের বিরুদ্ধে যুদ্ধেরও মোকাবিলা করতে হয়েছিল খোমেনিকে। ২০শে সেপ্টেম্বর, ১৯৮০ ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হুসেইনের বাহিনী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মদদে দক্ষিণ-পশ্চিম ইরানে হামলা করে। এর মানে, খোমেনি সূচিত সামাজিক সংস্কার কর্মসূচি স্থগিত রাখতে হয়েছিল। এই সময় জুড়ে আমেরিকান জিম্মি একটা উদ্দেশ্য পূরণ করেছে। কেবল প্রয়োজন ফুরিয়ে যাওয়ার পরই ১৯৮১ সালের ২০শে জানুয়ারি (নতুন মার্কিন প্রেসডিন্ট রোনাল্ড রেগানের ক্ষমতা গ্রহণের দিন) তাদের মুক্তি দেওয়া হয়েছিল।

অবশ্য জিম্মিদের দুর্ভোগ অনিবার্যভাবে নয়া ইসলমি প্রজাতন্ত্রের ইমেজকে দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। সঙ্কটের সময় মহাশয়তানের বিপুল পাপাচার নিয়ে বড় বড় বুলি সত্ত্বেও এই জিম্মি আটকের ভেতর ধর্মীয় বা ইসলামি কিছু ছিল না। বরং উল্টো। জিম্মি আটকের বিষয়টি সকল ইরানির ভেতর জনপ্রিয় না নাহলেও অনেকেই এর প্রতীকীবাদ উপলব্ধি করতে পেরেছিল। দূতাবাসকে কোনও বিদেশী দেশের এলাকা মনে করা হয়, এভাবে ছাত্রদের দখলদারি ছিল আমেরিকার সার্বভৌমত্বের উপর আগ্রাসনের মতো। কিন্তু তাসত্ত্বেও অনেকের চোখে ইরানের দূতাবাসে আমেরিকার নাগরিকদের আটকে রাখার ব্যাপারটি জুৎসই মনে হওয়ার কারণ অনেক দশক ধরে ইরানিরা মনে করে এসেছে যে পাহলভী স্বৈরাচারকে সমর্থন দিয়ে আসা দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্ররোচণাতেই নিজ দেশে কারাবন্দি ছিল তারা। কিন্তু ধর্ম নয়, এটা ছিল প্রতিশোধের রাজনীতি। দখলের গোড়ার দিনগুলোতে জিম্মেদের কারও কারও হাত-পা বেঁধে রাখা হয়েছিল, তাদের কথা বলতে দেওয়া হয়নি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের পরিত্যাগ করেছে বলে জানানো হয়েছে। পরে জিম্মিদের আরও আরামদায়ক জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়, কিন্তু এই ধরনের নিষ্ঠুরতা ও দুর্ব্যবহার ইসলামসহ সকল প্রধান কনফেশনাল ধর্মের মৌল দর্শনের বিরোধিতা করে: বাস্তব দয়ার দিকে চালিত না হলে কোনও ধর্মীয় মতবাদ বা অনুশীলন খাঁটি হতে পারে না। বৌদ্ধ, হিন্দু, তাওবাদী ও সকল একেশ্বরবাদী বিশ্বাস একমত পোষণ করে যে পবিত্র বাস্তবতা স্রেফ দুর্জয়, ‘দূর আকাশে’ নয় বরং তিনি প্রতিটি মানুষের অন্তরে বাস করেন; সুতরাং তাকে পরম সম্মান ও শ্রদ্ধার সাথে দেখতে হবে। মৌলবাদী বিশ্বাস, তা সে ইহুদি, ক্রিশ্চান বা মুসলিমই হোক, ক্রোধ ও ঘৃণার ধর্মতত্ত্বে পরিণত হলে এই গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারে না।

প্রকৃতপক্ষেই এই ধরনের জিম্মি আটক বন্দিদের প্রতি আচরণের নির্দিষ্ট ইসলামি আইনের লঙ্ঘন করে। কোরান দাবি করে, মুসলিমদের প্রতিপক্ষের সাথে মানবিক আচরণ করতে হবে। এখানে জোর দিয়ে বলা হয়েছে যে, নিয়মিত যুদ্ধ ছাড়া বন্দি আটক (যা স্বয়ং আমেরিকান জিম্মি আটক ও তাদের বন্দি রাখা প্রত্যাখ্যান করে) বেআইনি। বন্দিদের সাথে অবশ্যই দুর্ব্যবহার করা যাবে না, বৈরিতা শেষ হয়ে যাবার পর তাদের হয় দয়া প্রদর্শন করে বা মুক্তিপণের বিনিময়ে ছেড়ে দিতে হবে। কোনও মুক্তিপণ না মিললে বন্দিকে কাজের সন্ধান করার সুযোগ দিয়ে ছেড়ে দিতে হবে যাতে সে নিজেই সেই অর্থ মেটাতে পারে; তাকে যে মুসলিমের হেফাযতে দেওয়া হয়েছে তাকে অবশ্যই বন্দিকে সেই পরিমাণ অর্থ সংগ্রহে সাহায্য করতে হবে।’ বন্দিদের প্রতি এই আচরণ সংক্রান্ত একটি হাদিস খোদ পয়গম্বরের প্রতি নির্দেশ করে। ‘তোমরা যা খাবে তাকেও তাই খেতে দিতে হবে, একই রকম পোশাক পরতে দিতে হবে, কোনও কঠিন কাজ করতে দিলে তাদের সেই কাজে সাহায্য করতে হবে।” স্বৈরাচারী সরকারের হাতে তার বাস্তবভিত্তিক কারণে বিদেশের মাটিতে নির্বাসিত শিয়া ইমামদের শ্রদ্ধাকারী শিয়াদের কাছে জিম্মি আটক বিশেষভাবে নিন্দনীয় হওয়া উচিত। এভাবে জিম্মি আটক রাজনৈতিকভাবে হয়তো অর্থপূর্ণ হতে পারে, কিন্তু সত্যিকার অর্থে ধর্মীয় বা ইসলামির কোনওটাই নয়।

মৌলবাদ একটি যুদ্ধংদেহী বিশ্বাস, নিজেকে বৈরী পৃথিবীতে বেঁচে থাকার লক্ষ্যে যুদ্ধে লিপ্ত মনে করে। এটা দৃষ্টিভঙ্গিকে ক্ষতিগ্রস্ত ও অনেক সময় বিকৃত করে। আমরা যেমন দেখেছি, খোমেনি বহু মৌলবাদীকে আক্রান্তকারী এমনই বিকৃত ফ্যান্টাসিতে ভুগেছেন। ২০শে নভেম্বর, ১৯৭৯, জিম্মিদের আটক করার অল্প পরে, বেশ কয়েক শো সৌদি আরবের সুন্নি সশস্ত্র মৌলবাদী মক্কার কাবাহ দখল করে নেয় এবং তাদের নেতাকে মাহাদী ঘোষণা করে। খোমেনি এই অপবিত্রকরণের নিন্দা করে একে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের যোগসাজশের ফল বলে বর্ণনা করেছেন। সাধারণত লোকে যখন বিপদাপন্ন বোধ করে তখনই এই ধরনের ষড়যন্ত্রের ধারণা দেখা দেয়। ইরানের ভবিষ্যৎ ভাবনা ছিল ম্লান। খোমেনির ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও ক্রমবর্ধমান হারে সরকারের বিরুদ্ধে মোহমুক্তি ঘটছিল। সরকারের কোনও রকম সমালোচনা বা বিরোধিতাই সহ্য করা হচ্ছিল না। ১৯৮১ সালে খোমেনির সাথে অন্য প্রধান আয়াতোল্লাহদের সম্পর্কের অবনতি ঘটে; একদিকে শরীয়া আইনে সম্পূর্ণ প্রত্যাবর্তন আকাঙ্ক্ষী রেডিক্যাল ইসলামিস্ট ও অন্যদিকে বামপন্থী সেক্যুলারিস্ট ও সাধারণদের ভেতর কার্যত যুদ্ধ চলছিল। মাত্ৰ এক বছর প্রেসিডেন্ট থাকার পর বানি সদর ২২শে জুলাই, ১৯৮১ উৎখাত হন; প্যারিসে পালিয়ে যান তিনি। ২৮শে জুন খোমেনির প্রধান যাজকীয় মিত্র আয়াতোল্লাহ বিহিশতি এবং ইসলামি বিপ্লবী দলের পঁচাত্তর জন সদস্য দলীয় হেডকোয়ার্টারে এক বোমা বিস্ফোরণে নিহন হন।১১ এই পর্যায় অবধি খোমেনি সাধারণদের সরকারের উচ্চ পর্যায়ের দায়িত্ব দিতে পছন্দ করেছেন, কিন্তু অক্টোবরে হুজ্জাত উল-ইসলাম আলি খামেনিকে প্রেসিডেন্ট হওয়ার অনুমোদন দেন তিনি। মজলিসে যাজকরা এবার সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেন। ১৯৮৩ সাল নাগাদ সরকারের সকল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমন করা হয়। বানি সদরের বিদায়ের পর মুজাহিদিন-ই খালক আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে গিয়েছিল; ন্যাশনাল ফ্রন্ট, ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি (মুসাদ্দিকের নাতির নেতৃত্বাধীন) এবং শরিয়তমাদারির মুসলিম পিপল’স রিপাবলিকান পার্টি ভেঙে দেওয়া হয়। খোমেনি ক্রমবর্ধমানহারে ‘অভিব্যক্তির সমরূপতা’র উপর জোর দিচ্ছিলেন।১২

কোনও একটি বিপ্লবের পর প্রায়শঃই যেমন ঘটে, নতুন শাসকগোষ্ঠী আগেরটির মতোই স্বৈরতান্ত্রিক হয়ে ওঠে। প্রতিপক্ষের ঘেরাও অবস্থায় আদর্শিক সমরূপতার উপর জোর দিতে শুরু করেছিলেন খোমেনি। কিন্তু ইসলামি পরিভাষায় এটা ছিল এক নতুন বিচ্যুতি। ইহুদিবাদের মতো ইসলাম অনুশীলনের সমরূপতার দাবি করলেও কখনওই মতবাদগত অর্থডক্সির কথা বলেনি। শিয়াদের একজন মুজতাহিদের ধর্মীয় আচরণের অনুকরণ (তাকলিদ) করার কথা ছিল, কিন্তু তাঁর বিশ্বাসের সাথে একমত পোষণ করার কথা ছিল না তাদের। কিন্তু এখন খোমেনি জোরের সাথে ইরানিদের তাঁর বেলায়েত-ই ফাকিহ মেনে নিতে ও সব ধরনের বিরোধিতা ভুলে যাবার কথা বলছিলেন। ‘অভিব্যক্তির ঐক্য’, ১৯৭৯ সালে হাজ্জ যাত্রীদের উদ্দেশে বলেছিলেন তিনি, ‘বিজয়ের আসল রহস্য।১৩ সঠিক আদর্শ বেছে না নেওয়া পর্যন্ত জনগণ তিনি তাদের জন্যে যেমন আধ্যাত্মিক সম্পূর্ণতা আশা করছেন সেটা অর্জন করা সম্ভব হবে না। মতামতের প্রশ্নে কোনও গণতন্ত্র থাকবে না; জনগণকে অবশ্যই প্রধান ফাকিহকে মেনে চলতে হবে, যাঁর অতীন্দ্রিয় যাত্রা তাঁকে ‘প্রকৃত ধর্মবিশ্বাস’ যুগিয়েছে। তখনই তারা ইমামদের পথে চলতে পারবে।১৪ কিন্তু এর অর্থ স্বৈরাচার ছিল না। বৈরী বিশ্বে টিকতে হলে মুসলিমদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। ‘ইসলাম আজ শত্রু ও ব্লাসফেমির মুখোমুখি,’ আযেরবাইযানের এক প্রতিনিধিদলকে বলেছিলেন তিনি। ‘আমাদের প্রয়োজন ক্ষমতা। মহান ও প্রশংসিত আল্লাহ’র শরণাপন্ন হয়ে এবং অভিব্যক্তির ঐক্যের ভেতর দিয়ে ক্ষমতা লাভ করা যেতে পারে।১৫ পরাশক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে চাইলে মুসলিমদের অন্তর্কলহে লেগে থাকলে চলবে না। আধুনিকায়নের প্রক্রিয়ার কারণে দীর্ঘদিন ‘দুই জাতিতে’ বিভক্ত ইরানকে ঐক্যবদ্ধ ও ইসলামের পথে ফিরিয়ে আনতে হলে ব্যাপক কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে।

খোমেনি পিতামাতাদের সরকারের প্রতি বৈরী সন্তানদের ত্যাগ করার ও যেসব ইরানি ধর্ম নিয়ে পরিহাস করে তাদের ধর্মদ্রোহী ঘোষণা ও মৃত্যুদণ্ডের যোগ্য অপরাধে অপরাধী হিসাবে তাদের বিচারের নির্দেশ দিলে বোধগম্যভাবেই পশ্চিমারা ভীত হয়ে উঠেছিল। ইউরোপ ও আমেরিকায় এক পবিত্র মূল্যে পরিণত হওয়া বুদ্ধিবৃত্তিক স্বাধীনতার আদর্শের লঙ্ঘন ছিল এটা। কিন্তু পশ্চিমারা এটাও লক্ষ করতে বাধ্য হয়েছিল যে খোমেনি কখনওই ইরানি জনগণকে, বিশেষ করে বাজারি, মাদ্রাসা ছাত্র, অল্প-পরিচিত উলেমা ও দরিদ্রদের ভুলে যাননি।১৬ শাহর আধুনিকায়ন প্রক্রিয়ায় এদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি, এরা আধুনিক রীতিনীত উপলব্ধি করতে পারেনি। পাশ্চাত্য সেক্যুলারিস্টরা যেখানে ঐতিহ্য অগ্রাহ্য করাকে প্রোমিথিয়ান ও বীরত্বসূচক মনে করতে শিখেছে, খোমেনির অনুসারীরা সেখানে আল্লাহর সার্বভৌমত্বকেই সর্বোচ্চ মুল্যবিশিষ্ট হিসাবে দেখে আসছিল; তারা ব্যক্তির অধিকারকে পরম মনে করেনি। খোমেনিকে বুঝতে পারলেও পশ্চিমকে বুঝতে পারেনি তারা। তখনও ধর্মীয়, প্রাক আধুনিক ঢঙে কথা বলেছে, ভেবেছে, পশ্চিমারা যা বুঝতে পারেনি। কিন্তু নিজেকে পোপিয় আবহ দিচ্ছিলেন না খোমেনি। তিনি জোর দিচ্ছিলেন যে, তাঁর ‘ভ্রান্তিহীনতা’র মানে এই নয় যে তিনি ভুল করেন না। তিনি তাঁর প্রতিটি কথাকেই ঐশী অনুপ্রাণিত বাণী ভেবে বসা শিষ্যের প্রতি বিরক্ত বোধ করেছেন। ‘আমি গতকাল এমন কিছু বলে থাকতে পারি, যেটা আজ বদলে ফেলেছি, আবার কালও বদলে ফেলব,’ ১৯৮৩ সালের ডিসেম্বরে কাউন্সিল অভ গার্ডিয়ানের যাজকদের উদ্দেশে বলেছিলেন তিনি। ‘এর মানে এই নয় যে গতকাল আমি একটা বিবৃতি দিয়েছিলাম বলেই একে ধরে বসে থাকতে হবে। ১৭

তাসত্ত্বেও ‘অভিব্যক্তির ঐক্য’ ছিল সীমাবদ্ধ, কেউ কেউ বলবেন, ইসলামের বিকৃতিও। ইহুদি ও ক্রিশ্চান মৌলবাদীরাও অনেক সময় কঠোরভাবে—কেবল ধর্ম সম্পর্কে তাদের দৃষ্টিভঙ্গিই সঠিক বলে তাদের নিজস্ব ঢঙে গোঁড়া সমরূপতার উপর জোর দিয়েছে। খোমেনির ‘অভিব্যক্তির ঐক্য’ ইসলামের আবিশ্যিক বিষয়গুলোকে মতাদর্শের পর্যায়ে নামিয়ে এনেছে; খোমেনির নিজস্ব তত্ত্বকে অতিরিক্ত প্রাধান্য দিয়ে স্বর্গীয় সত্যি সংক্রান্ত নেহাতই মানবীয় ধারণাকে পরম মর্যাদা দান করে বহুঈশ্বরবাদীতার ঝুঁকি সৃষ্টি করেছে। কিন্তু খোমেনির বিপদাশঙ্কা থেকেও এর সৃষ্টি হয়েছিল। বছরে পর বছর ধর্মের প্রতি ধ্বংসাত্মক এক আগ্রাসী সেক্যুরাইজড শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে লড়াই করে আসছিলেন তিনি; সাদ্দামের বিরুদ্ধে লড়তে হাচ্ছিল তাঁকে, ইসলামি প্রজাতন্ত্রের প্রতি বহির্বিশ্বেও চরম বৈরিতার ব্যপারে তীক্ষ্ণভাবে সজাগ ছিলেন। ‘অভিব্যক্তির ঐক্য’ ছিল আত্মরক্ষামূলক উপায়। ইরানকে আরও একবার ইসলামী দেশে পরিণত করে খোমেনি ইসলামকে ধ্বংস করতে উদ্দত এক খোদাহীন বিশ্বে একটা নতুন বিরাট ছিটমহল সৃষ্টি করছিলেন। দমননীতির অভিজ্ঞতা, অনুমিত বিপদ এবং ক্রমবর্ধমান সেক্যুলার বিশ্বের মূল অস্তিত্বের বিরুদ্ধে লড়াই করার ধারণা যুদ্ধংদেহী আধ্যাত্মিকতার সৃষ্টি করেছে এবং ইসলামের বিকৃত ছবি তৈরি করেছে। দমনের অভিজ্ঞতা ছিল ভীতিকর, ফলে নিপীড়ক ধর্মীয় দর্শনের সৃষ্টি হয়েছে।

খোমেনি বিশ্বাস করেছিলেন যে, বিপ্লব আধুনিক বিশ্বের যৌক্তিক বাস্তববাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ছিল। লোকে দেখিয়ে দিয়েছিল যে, দুজ্ঞেয় লক্ষ্য বিশিষ্ট একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা অর্জনের লক্ষ্যে প্রাণ উৎসর্গ করতে রাজি আছে তারা। ‘একটি উন্নত আবাস পেতে কেউ কি তার সন্তানকে শহীদ হওয়ার পথে ঠেলে দিতে রাজি আছে?’ ১৯৭৯ সালের ডিসেম্বরে কারুশিল্পীদের এক সমাবশে প্রশ্ন রেখেছিলেন তিনি। ‘এটা কোনও ইস্যু নয়। ইস্যু হচ্ছে অন্য জগৎ। শাহাদৎ মানেই ভিন্ন জগতের জন্যে। আল্লাহ’র সকল পয়গম্বর ও সাধুই এই শাহাদৎ কামনা করে এসেছেন…জাতিও এই অর্থ চায়।’১৮ বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদ জীবনের পরম অর্থ সংক্রান্ত প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে না। এটা সব সময়ই মিথের এখতিয়ার ছিল। পশ্চিমে মিথলজির পরিত্যাগ কোনও কোনও মহলে এক অনুমিত শূন্যতার জন্ম দিয়েছে, সার্ত্র যাকে ঈশ্বর আকৃতির গহ্বর হিসাবে ব্যাখ্যা করেছেন। বহু ইরানি তাদের দৈনন্দিন ও রাজনৈতিক জীবনে আকস্মিক অন্তর্মুখীনতায় দিশাহারা হয়ে পড়েছিল। খোমেনি বিশ্বাস করেছিলেন, মানুষ তিনমাত্রার প্রাণী; তাদের আধ্যাত্মিক ও বস্তুগত চাহিদা রয়েছে, এবং ধর্মকে কেন্দ্রিয় পরিচয়ে পরিণতকারী একটি রাষ্ট্রের পক্ষে প্রাণ উৎসর্গ করার ইচ্ছা প্রদর্শন করে তাদের সম্পূর্ণ মানবিক পরিচয় উদ্ধারের প্রয়াস পাচ্ছিল তারা। স্বয়ং খোমেনি এমনকি সংকটের কালেও রাজনীতির দুর্জ্জেয় বৈশিষ্ট্য খুব কমই বিস্মৃত হতেন। ইরান-ইরাক যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বানি সদর সাবেক শাহর সামরিক কর্মচারীদের কারাগার থেকে মুক্ত করে সরাসরি অপারেশনে পাঠানো ফলদায়ী হতে পারে বলে পরামর্শ দিয়েছিলেন। প্রত্যাখ্যান করেছেন খোমেনি। তিনি বলেছিলেন, বিপ্লব অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি বা আঞ্চলিক অখণ্ডতা সংক্রান্ত ছিল না। তিনি ইমাম আলির শাসনের বিরোধিতাকারী সিরিয়ায় উমাঈয়া রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা মুয়াবিয়ার বিরুদ্ধে তাঁর যুদ্ধকালীন একটি গল্প বলেছিলেন। সেনাবাহিনী যুদ্ধে রওয়ানা দেওয়ার ঠিক আগে আলি সৈনিকদের উদ্দেশে স্বর্গীয় একত্ব (তাওহিদ) সম্পর্কে ভাষণ দিয়েছিলেন। তাঁর কর্মকর্তারা এমন একটা সময়ে এই ধরনের বয়ান উপযুক্ত কিনা জানতে চাইলে আলি জবাব দিয়েছিলেন: ‘কোনও পার্থিব লাভালাভের জন্যে নয়, বরং এই কারণেই আমরা মুয়াবিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই করছি।২০ যুদ্ধের উদ্দেশ্য ছিল উম্মাহর ঐক্য রক্ষা করা, যাকে অবশ্যই ঈশ্বরের একত্বের প্রতিফলন ঘটাতে হবে। মুসলিমরা তাওহিদের জন্যে যুদ্ধ করছিল, সিরিয়া জয় করার জন্যে নয়।

এটা অবশ্যই শ্রদ্ধাযোগ্য, কিন্তু এখানে একটা সমস্যা রয়েছে। মানুষের অর্থ ও মিথোসের প্রয়োজন আছে, কিন্তু তাদের আবার কঠিন, যৌক্তিক লোগোসও প্রয়োজন। প্রাক আধুনিক সমাজে এই দুটি বলয়কে অবিচ্ছেদ্য মনে করা হয়েছে। কিন্তু মিথকে যেমন যৌক্তিক বা যুক্তিভিত্তিক পরিভাষায় ব্যাখ্যা করা যায়নি, ঠিক তেমনি একে বাস্তব রাজনীতিতেও প্রকাশ করা যায়নি। এটা কঠিন ছিল, এবং অনেক সময় আবশ্যিকভাবে ধর্ম ও রাজনীতির বিচ্ছেদ ঘটিয়েছে। ইমামতের ধর্মতত্ত্ব দেখিয়েছে যে, অতীন্দ্রিয় দর্শন ও একজন রাষ্ট্রনায়কের প্রয়োজনীয় কঠিন বাস্তববাদীতার ভেতর এক ধরনের বৈসাদৃশ্য রয়েছে। খোমেনি অনেক সময় মিথোস ও লোগোসের সূক্ষ্ম পার্থক্য গুলিয়ে ফেলেছেন। এর ফলেই তাঁর বেশ কিছু নীতি বিপর্যয়কর ছিল। জিম্মি সংকটের পরপর তেলের আয় আকস্মিক হ্রাস ও রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগের অভাবে দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আদর্শগত শুদ্ধি পররাষ্ট্র দপ্তর ও শিল্পক্ষেত্রে যোগ্য লোকের অভাব সৃষ্টি করেছে। পশ্চিমকে বৈরী করে ইরান গুরুত্বপূর্ণ সরঞ্জাম, খুচরো যন্ত্রাংশ এবং কারিগরি পরামর্শ বাজেয়াপ্ত করেছিল। ১৯৮২ সাল নাগাদ মূদ্রাস্ফীতি চড়ে ওঠে, সৃষ্টি হয়েছিল ভোগ্যপণ্যের মারাত্মক ঘাটতির, বেকারত্বের হার বেড়ে দাঁড়িয়েছিল মোট জনসংখ্যার ৩০ ভাগে (৫০ ভাগ শহরে)।২১ জনগণের ভোগান্তি ধর্মীয় দিক থেকে জনকল্যাণকে ক্ষমতায় আসার এজেন্ডার একেবারে সবার উপরে স্থান দানকারী সরকারের পক্ষে বিব্রতকর ছিল। দরিদ্রদের জন্যে যথাসাধ্য করেছেন খোমেনি। পাহলভীদের আমলে সবচেয়ে দুর্দশার শিকার অংশের ভোগান্তি লাঘবে ফাউন্ডেশন ফর দ্য ডাউনট্রডেন প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। ফ্যাক্টরি ও ওয়ার্কশপে ইসলামি সংগঠনসমূহ শ্রমিকদের সুদবিহীন ঋণের যোগান দিয়েছে। গ্রামাঞ্চলে কন্সট্রাকশন জিহাদ কৃষক সমাজের জন্যে এবং কৃষি, জনস্বাস্থ্য ও কল্যাণমূলক প্রকল্পে, বিশেষ করে যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকায় নতুন দালানকোঠা নির্মাণের জন্যে তরুণ শ্রমিক নিয়োগ করেছে। কিন্তু ইরাকের সাথে যুদ্ধে কারণে এইসব প্রয়াস মার খেয়ে গেছে, যা খোমেনির সৃষ্টি ছিল না।

অতীন্দ্রিয় ও প্রায়োগিকের মধ্যকার টানাপোড়েন সম্পর্কে সজাগ ছিলেন খোমেনি। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, একটি আধুনিক রাষ্ট্রের জনসংশ্লিষ্টতা ও সম্পূর্ণ প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার প্রয়োজন। পাশ্চাত্য এর নিজস্ব আধুনিকায়ন প্রক্রিয়ায় যেমন আবিষ্কার করেছে, এটাই শিল্পায়িত, প্রযুক্তিয়ায়িত সমাজে কার্যকর একমাত্র রাষ্ট্রব্যবস্থা। আধুনিক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহকে জনগণের কাছে অর্থপূর্ণ করে তোলার জন্যে ইসলামি প্রেক্ষাপট দান করাই ছিল তাঁর বেলায়ত-ই ফাকিহ তত্ত্বের প্রয়াস। প্রধান ফাকিহ ও কাউন্সিল অভ গার্ডিয়ানস নির্বাচিত মজলিসকে পাশ্চাত্য সেক্যুলারিস্ট আদর্শের সাথে নিজেদের খাপ খাওয়াতে অক্ষম মুসলিমদের প্রয়োজনীয় একটি অতীন্দ্রিয় ধর্মীয় তাৎপর্য দেবে: বেলায়েত-ই ফাকিহ এভাবে পার্লামেন্টের বাস্তব কর্মকাণ্ডের জন্যে একটি অতীন্দ্রিয় ভিত্তি প্রদান ও আধুনিকতাকে ঐতিহ্যবাহী দর্শনে ধারণ করার একটি প্রয়াস ছিল। কিন্তু নাজাফের মাদ্রাসায় বেলায়েত-ই ফাকিহ গড়ে তুলেছিলেন খোমেনি। বলা হয়ে থাকে, কাগজে কলমে ভালো হলেও ইরানের মাটিতে বাস্তব প্রয়োগ করতে গিয়ে সেটা সমস্যাসঙ্কুল প্রমাণিত হয়েছে। ১৯৮১ সালের গোড়ার দিকে এই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল, এবং এই সমস্যা খোমেনিকে বাকি জীবন জ্বালিয়ে মেরেছে। ২২

১৯৮১ সালে মজলিস সম্পদের সুষ্ঠু বণ্টন নিশ্চিত করবে এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ ভূমি সংস্কারের প্রস্তাব উত্থাপন করে। এই পদক্ষেপের প্রতি খোমেনির সহানুভূতি ছিল। শরীয়াহর বিধানের বিরোধী হলেও জনগণ এতে উপকৃত হত। তিনি এও বুঝতে পারছিলেন যে ইরান এই ধরনের মৌলিক সংস্কার অর্জন করতে না পারলে তা কৃষিভিত্তিক ও সামন্তবাদী রয়ে যাবে, যেকোনও আধুনিকায়ন প্রয়াসই হবে উপরিগত। কিন্তু ভূমি সংস্কার বিল সমস্যার মুখে পড়ে। সংবিধান অনুযায়ী সকল আইনেরই কাউন্সিল অভ গার্ডিয়ান্স কর্তৃক অনুমোদিত হওয়ার কথা ছিল; তাদের মতে ইসলাম বিরোধী হলে যেকোনও আইন নাকচ করার ক্ষমতা ছিল তাঁদের। কাউন্সিলের বহু উলেমারই বিপুল পরিমাণ জমি ছিল, তাদের সামনে বিলটি উপস্থিত করা হলে ভেটো প্রদানের ক্ষমতা প্রয়োগ করেন তাঁরা, তাঁদের সিদ্ধান্তের পক্ষে শরীয়াহ আইনের উল্লেখ করেন। খোমেনি তাদের বোঝানোর চেষ্টা করেন। যাজকগণের, তিনি বলেন, ‘যোগ্যতা নেই এমন কোনও বিষয়ে নাক গলানো উচিত নয়। সেটা ‘ক্ষমার অযোগ্য পাপ হবে, কারণ তাতে যাজকদের প্রতি জাতির মনে অবিশ্বাসের সৃষ্টি হবে।২৩ যাজকগোষ্ঠী ধর্ম ও ফিকহ বুঝলেও আধুনিক অর্থনীতি বোঝেন না; ইসলামি প্রজাতন্ত্রকে অবশ্যই একটি আধুনিক রাষ্ট্র হতে হবে, যেখানে নিজস্ব দক্ষতার ক্ষেত্রে কাজ করার জন্যে বিশেষজ্ঞ প্রয়োজন।

কিন্তু অচলাবস্থা অব্যাহত থাকে। কাউন্সিল অভ গার্ডিয়ান্স এই ইস্যুতে পিছু হটতে অস্বীকৃতি জানায়, খোমেনি আরও আধ্যাত্মিক কৌশলের আশ্রয় নেন। ১৯৮১ সালের মার্চে যাজকদের একটি দলকে তিনি বলেন: ‘নিজেকে সংস্কার না করে কারও অন্যকে সংস্কার করার চিন্তা করা উচিত নয়। খোদ যাজকগণই স্বার্থপরতা আর অর্থহীন ক্ষমতায় দ্বন্দ্বে ব্যস্ত থাকলে সাধারণ জনগণকে আর ইসলামে ফিরিয়ে আনতে পারবেন না। উলেমার প্রতিটি সদস্যকে অবশ্যই দেশের উন্নয়নে বাধার সৃষ্টিকারী এই অহমবাদ অতিক্রম করতে হবে। সমাধান হচ্ছে ‘এমন এক পর্যায়ে উঠে আসা যেখানে তুমি…নিজেকে উপেক্ষা করতে পারবে,’ উপসংহারে পৌঁছেছেন খোমেনি, ‘যখন প্রতিযোগিতায় মেতে ওঠার মতো কোনও সত্তা থাকে না, তখন আর কোনও বিরোধ, কোনও সংঘাত থাকে না।২৪ খোমেনি অনুসৃত অতীন্দ্রিয় ইরফান থেকেই এর সরাসরি উদ্ভব; সন্ধানী আল্লাহ’র নিকটবর্তী হওয়ার সাথে সাথে ধীরে ধীরে নিজেকে পরিবর্তনকারী আল্লাহ’র দর্শনকে ধারণ করতে না পারা পর্যন্ত স্বার্থপর আশাআকাঙ্ক্ষা থেকে মুক্ত করে নেয়। কিন্তু আধুনিক রাজনীতির গতিময়তা আধ্যাত্মিক ধ্যানের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের। কাউন্সিল অভ গার্ডিয়ান্সের উলেমাগণ খোমেনির আবেদনে কান দেননি। রাজনীতি সাধারণভাবে নারী-পুরুষকে সত্তার উন্নত সত্তা দিয়ে আকর্ষণ করে। আধুনিক সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলো পরস্পর বিরোধী স্বার্থের একটা ভারসাম্যের ভেতর দিয়ে কাজ করে, এই ধরনের আত্মবিনাশ দিয়ে নয়। বেলায়েত-ই ফাকিহ’র প্রণয়নের সময় খোমেনি বিশ্বাস করেছিলেন যে, কাউন্সিল অভ গাডিয়ান্সের উলেমাগণ অদৃশ্যের অতীন্দ্রিয়, গোপন (বাতিন ) মূল্যবোধসমূহকে নিশ্চিত করবেন; কিন্তু সে জায়গায় তাদের সাধারণ মরণশীলদের মতোই যাহিরের বস্তুবাদে আটকে আছেন বলে মনে হয়েছে।

কাউন্সিল অভ গার্ডিয়ান্সের সাথে অচলাবস্থার অবসানের লক্ষ্যে মজলিসের প্রাণবন্ত বক্তা হোজ্জাত উল-ইসলাম রাফসানজানি খোমেনিকে প্রধান ফাকিহ হিসাবে ভূমি সংস্কার বিল পাসে তাঁর কর্তৃত্ব প্রয়োগের আবেদন জানালেন। ইসলামি বিষয়ে সংবিধান প্রধান ফাকিহকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেওয়ার অধিকার দিয়েছে। কাউন্সিল অভ গার্ডিয়ান্সের সিদ্ধান্ত বাতিল করে দিতে পারতেন তিনি। রাফসানজানি পরামর্শ দিলেন যে, খোমেনি চাইলে জনগণের কল্যাণে প্রয়োজন হলে একজন জুরিস্টকে কোরান ও সুন্নাহয় প্রত্যক্ষভাবে উল্লেখ করা হয়নি এমন সব বিষয়ে ‘দ্বিতীয় পর্যায়ের’ বিধান দেওয়ার ক্ষমতাদানকারী ইসলামি নীতি মাসলাহাহ’র উদ্ধৃত করতে পারেন। কিন্তু খোমেনি তেমন কিছু করতে চাননি। তিনি বুঝতে শুরু করেছিলেন যে, প্রধান ফাকিহর অবস্থান আধুনিক বিশ্বে টিকে থাকতে হলে ইসলামি প্রজাতন্ত্রের যে কর্তৃত্ব থাকা প্রয়োজন সেটা দুর্বল হয়ে যেতে পারে। প্রবীন মানুষ ছিলেন তিনি। ব্যক্তিগত ক্যারিশমা অনুযায়ী তিনি সরকারের সিদ্ধান্তে নাক গলানো ও তা বদলে দিতে থাকলে মজলিস ও কাউন্সিল সেগুলোর বিশ্বাসযোগ্যতা ও অখণ্ডতা হারাবে, ইসলামি সংবিধান মরণ থেকে রেহাই পাবে না। কাউন্সিল ও মজলিসের এই টানাপোড়েন অব্যাহত ছিল।

ইরাকের বিরুদ্ধে যুদ্ধে প্রতিদিন শাহাদৎ বরণ করে চলা ইরানি শিশুদের উদাহরণ টেনে উলেমাদের লজ্জা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন খোমেনি। এই শিশু শহীদরা একটি অতীন্দ্রিয় দর্শনকে বাস্তব নীতিতে পরিণত করার নৈতিক বিপদ তুলে ধরেছে। যুদ্ধ ঘোষণার মুহূর্ত থেকে কিশোররা তাদের যুদ্ধ ক্ষেত্রে পাঠানোর আবেদন জানাতে মসজিদে ভিড় জমাতে শুরু করেছিল। তাদের অনেকেই বিপ্লবের সময় রেডিক্যাল হয়ে ওঠা বস্তি ও শ্যান্টি টাউন থেকে এসেছিল। পরে তাদের অনিবার্যভাবে বিষণ্ন ও গম্ভীর জীবনকে অ্যান্টিক্লাইমেক্স হিসাবে আবিষ্কার করে। কেউ কেউ ফাউন্ডেশন ফর দ্য ডাউনট্রেডেনে যোগ দিয়েছে বা কন্সট্রাকশন জিহাদে কাজ করেছে, তবে এর সাথে রণক্ষেত্রের উত্তেজনার কোনও তুলনা চলতে পারে না। ইরান যুদ্ধের পক্ষে কারিগরি দিক থেকে সমৃদ্ধ ছিল না; জনসংখ্যার বিস্ফোরণ ঘটেছিল, দেশের তরুণরাই ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। ফাউন্ডেশন ফর দ্য ডাউনট্রেডেন অ্যাকশনের জন্যে উদগ্রীব বিশ মিলিয়ন তরুণের এক সেনাবাহিনীর নিউক্লিয়াসে পরিণত হয়েছিল। বার বছরের কিশোররা যাতে বাবা মায়ের অনুমতি ছাড়াই যুদ্ধে যাবার জন্যে নাম লেখানোর যোগ্যতা অর্জন করতে পারে সেজন্যে সরকার একটি আইন পাশ করে। ইমামের শিষ্যে পরিণত হবে তারা, মারা গেলে তাদের স্বর্গে স্থান পাওয়ার ব্যাপারে নিশ্চয়তা দেওয়া যেতে পারে। লক্ষ লক্ষ কিশোর রক্তরাঙা পট্টি (শহীদের চিহ্ন) পরে যুদ্ধক্ষেত্রে ভীড় জমাতে শুরু করেছিল। কেউ কেউ মাইনফিল্ড পরিষ্কার করেছে, সেনাবাহিনীর সামনে থেকে দৌড়ে গেছে এবং প্রায়শঃই ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। অন্যরা পরিণত হয়েছিল আত্মঘাতী বোমাহামলাকারীতে, কামিকাযি স্টাইলে ইরাকি ট্যাংকের উপর হামলা করেছে। তাদের অছিয়তনামা লেখাতে বিশেষ লিপিকারদের যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানো হয়েছে, সেগুলোর বেশকয়েকটাই ইমাম খোমেনির কাছে লেখা চিঠির রূপ নিয়েছিল, এবং ‘বন্ধুর পাশে দাঁড়িয়ে বেহেশতের পথে’ যুদ্ধ করার আনন্দ ও তাদের জীবনে তাঁর বয়ে আনা আলোর কথা বলেছে সেগুলো।২৫

এই তরুণরা বিপ্লবে খোমেনির বিশ্বাসকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করে। অদৃশ্যের শ্রেষ্ঠত্বের পক্ষে ‘সাক্ষী’ হতে ইমাম হুসেইনের নজীর অনুসরণ করে প্রাণ দিচ্ছিল তারা। এটা ছিল নিগূঢ়বাদের সর্বোচ্চ রূপ, যার মাধ্যমে একজন মুসলিম নিজেকে অতিক্রম করে ঈশ্বরের সাথে ঐক্য অর্জন করে। তাদের প্রবীন পুরুষদের বিপরীতে এই শিশুরা আর স্বার্থপরতা ও বস্তুগত জগতের সাথে গাঁটছড়া বাঁধা ‘প্রকৃতির দাস’ থাকেনি। ইরানকে তারা ‘এমন একটি অবস্থা অর্জনে সাহায্য করছিল যাকে স্বর্গীয় বলে উল্লেখ করা ছাড়া আর কোনওভাবেই বর্ণনা করা সম্ভব নয়।’২৬ নারী-পুরুষ যতক্ষণ বস্তু ও পার্থিব বিষয়ের দিকে মনোযোগী থাকবে, মানবেতরে পরিণত হবে তারা। ‘মৃত্যু মানে কিছু না নয়,’ ঘোষণা করেছিলেন খোমেনি। ‘এটাই জীবন।’২৭ শাহাদৎ বরণ পাশ্চাত্য যৌক্তিক বাস্তববাদীতার বিরুদ্ধে ইরানের বিদ্রোহ ও জাতীর আত্মার জন্যে মহান জিহাদের ক্ষেত্রে আবিশ্যিক জরুরি অংশে পরিণত হয়েছিল ২৮ কিন্তু খোমেনির শাহাদৎ বরণ ‘কিছু না নয়’ বলে জোর দেওয়া সত্ত্বেও হাজার হাজার শিশুকে ভীতিকরভাবে অকাল সহিংস মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়ার ভেতর নিহিলিজম ছিল। এটা জীবনের পবিত্র অলঙ্ঘনীয়তা সংক্রান্ত এবং প্রয়োজনে আমাদের জীবনের বিনিময়ে হলেও সন্তানদের জীবন বাঁচানোর সহজাত তাগিদের ধার্মিক ও সেক্যুলারিস্ট সবার পক্ষেই গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক মানবীয় মূল্যবোধ বিরোধী। শিশু শহীদের এই কাল্ট তিনটি একেশ্বরবাদী ধর্মবিশ্বাসের মৌলবাদীরা সমানভাবে প্ৰবণ ধর্মের এমন আরেকটি মারাত্মক বিকৃতি। সম্ভবত এর উদ্ভব ঘটেছে আমাদের ধ্বংসের আকাঙ্ক্ষী শক্তিশালী প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে লড়াই করার ভীতি থেকে। তবে অতীন্দ্রিয়, পৌরাণিক আজ্ঞাকে একটি বাস্তব ভিত্তিক, সামরিক বা রাজনৈতিক নীতিমালায় পরিবর্তনের বিপদটুকুও তুলে ধরে এটা। মোল্লা সদরা সত্তার অতীন্দ্রিয় মৃত্যুর কথা বলার সময় হাজার হাজার তরুণের স্বেচ্ছা শারীরিক মৃত্যুর কথা ভাবেননি। আবার, আধ্যাত্মিক বলয়ে নিপুণভাবে কাজ করে এমন কিছুকেই আক্ষরিক ও প্রায়োগিকভাবে পার্থিব জীবনে অনূদিত হলে তা বিধ্বংসী হয়ে উঠতে পারে।

ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থা নির্মাণ করা যে খুবই কঠিন সেটাই পরিষ্কারভাবে প্রমাণিত হতে চলেছিল। ১৯৮৭ সালের ডিসেম্বরে নাজুক ও অসুস্থ খোমেনি আরও একবার সাংবিধানিক বিভিন্ন ইস্যুতে ভাষণ দেন। এইবার কাউন্সিল অভ গার্ডিয়ান্স শ্রম আইনে বাধার সৃষ্টি করছিল, তাদের মতে এটা শরীয়াহ বিরোধী ছিল। প্রতিক্রিয়াশীল ও অভিজাতপন্থী উলেমাদের চেয়ে জনপ্রিয় মজলিসের সমর্থক খোমেনি জনগণের কল্যাণের স্বার্থে প্রয়োজন হলে রাষ্ট্রের মৌলিক ইসলামি ব্যবস্থা পরিবর্তনের ক্ষমতা থাকার কথা ঘোষণা করেন। শরীয়াহ ছিল প্রাক শিল্পায়ন বিধি, আধুনিক বিশ্বের বাস্তব প্রয়োজনের নিরীখে তার অভিযোজন প্রয়োজন। খোমিন যেন এই বিষয়টি বুঝতে পেরেছিলেন। তিনি বলেন, রাষ্ট্র চাইলে

যেকোনও ধরনের সামাজিক, অর্থনৈতিক, শ্রম…নাগরিক বিষয়াদি, কৃষি বা অন্য কোনও ব্যবস্থা দিয়ে মৌল ইসলামি ব্যবস্থা প্রতিস্থাপিত করতে পারে ও সেবা দিতে পারে…এটা রাষ্ট্রের সাধারণ ও সামগ্রিক নীতিমালার বাস্তবায়নে উপায় হিসাবে একচেটিয়া অধিকার।২৯

স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন খোমেনি। এই ধরনের বাস্তব বিষয়ে রাষ্ট্রের অবশ্যই ‘একচেটিয়া’ অধিকার থাকতে হবে ও প্রথাগত ধর্মের বাধাসৃষ্টিকারী বিধিবিধান থেকে মুক্তি পেতে হবে। দুই সপ্তাহ পরে আরও অগ্রসর হন তিনি। প্রেসিডেন্ট খামেনি তাঁর মন্তব্যকে এটা বোঝাতে ব্যাখ্যা করেন যে, প্রধান ফাকিহর আইনের ব্যাখ্যা দেওয়ার অধিকার রয়েছে। খোমেনি জবাবে বলেন, তিনি তেমন কিছু বোঝাতে চাননি। ফাকিহ হিসাবে তাঁর নিজস্ব বিধানের কোনও রকম উল্লেখ না করে তিনি পুনরাবৃত্তি করেন যে, সরকার কেবল স্বর্গীয় আইনের ব্যাখ্যা করারই অধিকারী নয়, বরং খোদ আইনেরই বাহন। সরকার আল্লাহ কর্তৃক পয়গম্বরকে দান করা সেই স্বর্গীয় আইনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ এবং ‘প্রান্তিক স্বর্গীয় আইনের উপর অগ্রাধিকার রয়েছে তাঁর।’ এমনকি প্রার্থনা, রমযানের উপবাস এবং হাজ্জের মতো ‘স্তম্ভ’গুলোর ক্ষেত্রে এর অগ্রাধিকার আছে:

সরকারের যেকোনও বৈধ চুক্তি এককভাবে রদ করার ক্ষমতা রয়েছে… সেই চুক্তি যদি ইসলাম ও দেশের স্বর্থের পরিপন্থী হয়ে। ধর্মীয় বা সেক্যুলার যাই হোক না কেন, ইসলামের স্বার্থ বিরোধী হলে তাকে রোধ করতে পারে।

শত শত বছর ধরে শিয়ারা বিভিন্ন বলয়ের বিচ্ছিন্নতার উপর জোর দিয়ে এসেছে: ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতার পরম মিথোস রাজনীতির বাস্তব লোগোসের অর্থ যোগালেও তা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিল। এখন খোমেনি যেন জনগণের স্বার্থ ও ইসলামের বৃহত্তর মঙ্গলের জন্যে সরকারের প্রয়াসে অবশ্যই কোনও বাধা দেওয়া যাবে না বলে জোর দিচ্ছিলেন।

অনেকে ধরে নিয়েছিল যে খোমেনি তাঁর নিজস্ব সরকারের কথা বোঝাচ্ছেন এবং তিনি বেলায়েত-ই ফাকিহ মতবাদকে ইসলামের ‘স্তম্ভগুলোর’ চেয়েও উচ্চতর এক পর্যায়ে তুলে আনতে চাইছেন বলে ভেবেছে। পাশ্চাত্য পর্যবেক্ষকগণ খোমেনির বিরুদ্ধে অতিক্ষমতাধর ভাববার অভিযোগ এনেছেন। কিন্তু স্পিকার রাফসানজানি উল্লেখ করেন, খোমেনি ফাকিহর কথা বলেননি। খোমেনির সবচেয়ে রেডিক্যাল সমর্থকদের ভীত করে তিনি মত প্রকাশ করেন যে, ‘সরকার’ বলে খোমেনি মজলিসের কথাই বুঝিয়েছেন। ১২ই জানুয়ারি, ১৯৮৮ এক অসাধারণ বয়ানে রাফসানজানি বেলায়েত-ই ফাকিহর এক নতুন ব্যাখ্যা হাজির করেন। আল্লাহ পয়গম্বরের মাধ্যমে কোরানে উম্মাহর প্রয়োজনীয় সকল আইন প্রকাশ করেননি। তিনি এই ক্ষমতা মুহাম্মদকে (স) প্রদান করেছেন, যিনি তাঁর ‘ভাইস-জিরেন্টে’ পরিণত হয়েছেন এবং এইসব গৌণ বিষয়ে তাঁকে নিজস্ব সহজাত ক্ষমতা প্রয়োগের কর্তৃত্ব দিয়েছেন। এখন প্রধান ফাকিহ ইমাম খোমেনি নিজের ক্ষমতা মজলিসের হাতে তুলে দিয়েছেন, নিজস্ব সহজাত বিবেচনা থেকেই এখন মজলিসকে আইন প্রণয়ন করতে হবে। এর মানে কি তবে ইরান পাশ্চাত্য গণতন্ত্রকে আলিঙ্গন করতে যাচ্ছিল? কোওনভাবেই না। আইন প্রণয়নের এই অধিকার জনগণ নয়, এসেছে আল্লাহ’র কাছ থেকে, যিনি তাঁর ক্ষমতা পয়গম্বর, ইমাম এবং এখন ইমাম খোমেনিকে দিয়েছেন এবং তারাই-জনগণ নয়-মজলিসের শাসনের বৈধতা দান করেছেন। ‘সুতরাং বুঝতেই পারছেন,’ তাগিদ দিয়েছেন রাফসানজানি, ‘গণতন্ত্ৰ পশ্চিমের চেয়ে ঢের ভালো রূপে উপস্থিত রয়েছে,’ কারণ তা আল্লাহয় প্রোথিত। এটা ‘জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্যে, বেলায়েত-ই ফাকিহর অনুমতিতে স্বাস্থ্যকর সরকার পদ্ধতি।’৩১ আবারও পশ্চিমের মতোই আধুনিক রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তা ইরানকে গণতান্ত্রিক রাজনীতির দিকে ঠেলে দিয়েছে, কিন্তু এবার তা এসেছে ইসলামি মোড়কে যার সাথে জনগণ নিজেদের সম্পর্কিত করতে এবং তাদের নিজস্ব শিয়া ঐতিহ্যের সাথে একে সংযুক্ত করতে পেরেছে।

রাফসানজানি সম্ভবত নিজের সীমার বাইরে চলে গিয়েছিলেন, কিন্তু খোমেনিকে খুশি মনে হয়েছে। ১৯৮৮ সালের বসন্তকালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে তিনি যাজকদের কোনও উল্লেখ ছাড়াই স্রেফ মজলিসকে সমর্থন করার জন্যে জনগণের কাছে আবেদন জানিয়েছিলেন। অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের আকাঙ্ক্ষী জনগণ সুপ্ত ভর্ৎসনা বুঝতে ভুল করেনি, উলেমারা অর্ধেক আসন খুইয়েছিল। নতুন মজলিসে ২৭১ সদস্যের মধ্যে ৬৩ জন সদস্য প্রথাগত মাদ্রাসা শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন।৩২ আবার, খোমেনিকে ফলাফলে সন্তুষ্ট মনে হয়েছে। ১৯৮৮ সালের শীতে সংবিধানের সংশোধন আকাঙ্ক্ষী অধিকতর বাস্তববাদী রাজনীতিবিদদের প্রতিও সবুজ সঙ্কেত দান করেছিলেন তিনি। অক্টোবরে উলেমারা যাতে দেশের প্রগতিতে বাধা সৃষ্টি করতে না পারে সেজন্যে তাগিদ দেন তিনি। পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় নেতৃত্ব দেবেন ‘বিশেষজ্ঞরা, বিশেষ করে কেবিনেট মন্ত্রী, উপযুক্ত মজলিস কমিটিসমূহ … বৈজ্ঞানিক ও গবেষণা কেন্দ্রগুলো….উদ্ভাবক, আবিষ্কারকারী এবং অঙ্গীকারাবদ্ধ বিশেষজ্ঞ।’৩৩ দুই মাস পরে সংবিধান সংশোধনের লক্ষ্যে একটি কমিটিকে কাজ করার অনুমতি দান করেন তিনি। অধিকতর রেডিক্যাল ইসলামপন্থীরা হতাশ হয়ে পড়ে। কিন্তু ইমামের অনুমোদনে বাস্তববাদীরা বিজয়ী হচ্ছিল বলে মনে হয়েছে।

এমনি অন্তর্কলহের প্রেক্ষাপটে মৃত্যুর চার মাস আগে ১৪ই ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৯, ব্রিটিশ ভারতীয় লেখক সালমান রূশদির বিরুদ্ধে ফতওয়া জারি করেন খোমেনি। রূশদি তাঁর দ্য স্যাটানিক ভার্সেস উপন্যাসে এমন একটি চরিত্র সৃষ্টি করেছিলেন বহু মুসলিমের কাছে যাকে পয়গম্বর মুহাম্মদের (স) ব্লাসফেমাস চিত্রায়ন মনে হয়েছে। পয়গম্বরকে এখানে একজন কামুক, প্রতারক ও স্বেচ্চাচারী হিসাবে তুলে ধরেছেন তিনি-এবং সবচেয়ে বিপজ্জনকভাবে-বলার চেষ্টা করেছেন যে কোরান শয়তানি প্রভাবে প্রভাবিত হয়েছিল। এটা এমন এক উপন্যাস যা অনন্য সাধারণভাবে উত্তর আধুনিক বিশ্বের ঝিম লাগানো দ্বিধা তুলে ধরেছে। যেখানে কোনও সীমা নেই, নিশ্চয়তা নেই, পরিষ্কার বা সহজবোধ্য নির্দিষ্ট পরিচয় নেই। আক্রমণাত্মক অনুচ্ছেদগুলো ছিল এক ধরনের ব্রেক ডাউনে আক্রান্ত ও পাশ্চাত্যের ইসলামবিরোধী কৃসংস্কার লালনকারী একজন বিভ্রান্ত ভারতীয় চিত্র তারকার স্বপ্ন ও কল্পনা। ব্লাসফেমি ছিল আঁকড়ে ধরা অতীতের স্মৃতি বাতিল করে প্রাচীন বিভিন্ন সূত্র থেকে মুক্ত একটি স্বাধীন পরিচয় অর্জন করারও প্রয়াস। কিন্তু বহু মুসলিম মুহাম্মদের (স) এই ছবিকে গভীরভাবে আঘাতসৃষ্টিকারী হিসাবে অনুভব করেছে। এটা তাদের নিজস্ব মুসলিম ব্যক্তিত্বের পবিত্র কিছুর লঙ্ঘন মনে হয়েছে। ব্রিটেনের অন্যতম উদার মুসলিম ড. যাকি বাদাওয়ি দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকাকে বলেছেন, রূশদির বাক্যগুলো ‘কোনও মুসলিমের আপন বোনকে ধর্ষণ করার চেয়েও ঢের বেশি খারাপ।’ প্রতিটি মুসলিম সত্তার ইসলাম চর্চায় পয়গম্বর এমনি অন্তস্থঃ সত্তায় পরিণত হয়েছেন যে উপন্যাসটি ‘যেন আপনার দেহে ছুরিকাঘাত করা বা আপনার বোনকে ধর্ষণ করা’র মতো। পাকিস্তানে দাঙ্গা হয়েছে, এবং ইংল্যান্ডের ব্র্যাডফোর্ডে আনুষ্ঠানিকভাবে বইটি পোড়ানো হয়েছে। এখানে পাকিস্তান ও ভারতীয় বংশোদ্ভূত মুসলিমদের এক বিরাট অংশ বাস করে, এরা কেবল ক্রিশ্চান ধর্মের প্রতি আক্রমণের জন্যেই শাস্তি দানকারী ব্রিটিশ ব্লাসফেমি আইনের প্রতি আপত্তি জানিয়েছে। ইংল্যান্ডে ব্যাপক বিস্তৃত কুসংস্কার সম্পর্কে সজাগ ছিল তারা। ১৩ই ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানে বিক্ষোভকারীদের উপর পুলিসের গুলিবর্ষণের দৃশ্য দেখে খোমেনি ধরে নেন উপন্যাসটা অবশ্যই খারাপ। তাঁর ফতওয়া সারা বিশ্বের মুসলিমদের ‘যেখানেই পাওয়া যাক সালমান রুশদি ও তাঁর প্রকাশককে হত্যা করার’ নির্দেশ দেয়।

পরের মাসে অনুষ্ঠিত ইসলামিক কনফারেন্সে পঁয়তাল্লিশটি সদস্যের ভেতর চুয়াল্লিশটি দেশ অনৈসলামিক হিসাবে ফতওয়ার নিন্দা করে। ইসলামি বিধানে কোনও অভিযুক্তকে বিনা বিচারে মৃত্যুদণ্ড দান অনুমোদনযোগ্য নয়, অমুসলিম দেশে মুসলিম আইনও প্রয়োগ করা যায় না। ইসলামের আরও একটি বিকৃতি ছিল এই ফতওয়াটি। খোমেনির অন্যতম প্রধান আধ্যাত্মিক গুরু মোল্লা সদরা তীব্রভাবে এই ধরনের অনুসন্ধায়ী সহিংসতা ও নির্যাতনের বিরোধিতা করেছেন। চিন্তার স্বাধীনতার উপর জোর দিয়েছিলেন তিনি। আরও একবার ইসলাম একটি মারাত্মক আঘাত সহ্য করেছে, এই বিশ্বাস থেকে মুসলিম ক্ষোভের উদ্ভব হয়েছিল; বহু বছরের দমন, মর্যাদাহ্রাস ও সেক্যুলারিস্ট হামলা মুসলিম কাণ্ডজ্ঞানকে ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছে। ফতওয়া ছিল এক ধরনের যুদ্ধ, পশ্চিমের সেক্যুলার ও উদারপন্থীরা একে সেভাবেই দেখেছে, তারা তাদের সবচেয়ে পবিত্র মূল্যবোধ লঙ্ঘিত হয়েছে বলে মনে করেছে। তাদের চোখে, মানবতা-অতিপ্রাকৃত আল্লাহ নন-সকল জিনিসের পরিমাপক; নারী-পুরুষকে অবশ্যই তাদের মননশীলতার সর্বোচ্চ শিখরে ওঠার জন্যে স্বাধীনতা দিতে হবে। মুসলিম, যাদের কাছে আল্লাহ’র সাবভৌমত্বই শেষ কথা, তারা এটা মেনে নিতে পারেনি। রূশদি ঘটনা ছিল সমন্বয়ের অতীত দুটি অর্থডক্সির সংঘাত; কোনও পক্ষই অন্যের দৃষ্টিভঙ্গি বুঝতে পারেনি। একই দেশে বাসরত বিভিন্ন গ্রুপ একে অন্যের সম্পূর্ণ বিপক্ষে ও সম্ভাব্য যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিল।

১৯৮৯ সালের জুন মাসে খোমেনির পরলোকগমনের পরপরই ধার্মিক ও সেক্যুলারিস্টদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। পশ্চিমে খোমেনিকে প্রতিপক্ষ বিবেচনা করা হত, তাঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় ইরানিদের বাঁধভাঙা শোকের মাতম দেখে লোকে মহাবিস্মিত হয়ে গিয়েছিল। তাঁর কফিন ঘিরে জনতা এমন প্রবলভাবে হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল যে লাশ উল্টে পড়ে গিয়েছিল; ইমামকে যেন চিরকালের জন্যে নিজেদের কাছে রেখে দিতে চেয়েছিল তারা। অবশ্য, তাঁর মৃত্যুর পর ইসলামি প্রজাতন্ত্র ভেঙে খানখান হয়ে যায়নি। প্রকৃতপক্ষেই, তা ব্যাপক স্থিতিস্থাপকতা দেখিয়েছে। জিম্মি ইস্যুর মতো ফতওয়া পশ্চিমের শত্রুতা যোগালেও ইরান পাশ্চাত্য চেতনার কাছাকাছি অগ্রসর হচ্ছে বলে মনে হয়েছে। ৯ই জুলাই, ১৯৮৯ তারিখে পাশ হওয়া নতুন সংবিধান একটি অধিকতর সেক্যুলার, বাস্তবভিত্তিক ধরনের সরকারের দিকে অগ্রসর হওয়ার লক্ষণ তুলে ধরেছে। প্রধান ফাকিহর উপর আর অতীন্দ্রিয় ক্ষমতা আরোপ করা হচ্ছিল না, কিংবা খোমেনির মতো জনপ্রিয় গ্রহণযোগ্যতায় অভিষিক্ত হওয়ারও প্রয়োজন ছিল না। তাঁকে যুক্তিসঙ্গতভাবে ইসলামি আইন জানতে হবে, কিন্তু প্রবীন মুজতাহিদ হওয়ার আর দরকার পড়বে না। একাধিক সম্ভাব্য প্রার্থী থাকলে, ‘রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি’ই হবে নতুন নেতার চূড়ান্ত যোগ্যতার গুণ। কাউন্সিল অভ গার্ডিয়ান্স ভেটো প্রয়োগের অধিকার রেখে দিলেও নতুন এক্সপিডেয়েন্সি কাউন্সিলের মাধ্যমে এর ক্ষমতা সীমাবদ্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। এইসব পরিবর্তনের ফলে মজলিস গার্ডিয়ান্সের বাধার মুখে পড়া বিভিন্ন সংস্কার বাস্তবায়নে সক্ষম হয়।৩৫

খোমেনির অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার পরের দিন, আয়াতোল্লাহ খামেনিকে ফাকিহ ঘোষণা করা হয়; এবং ২৮শে জুলাই, ১৯৮৯, রাফসানজানি নতুন নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হন। তাঁর কেবিনেট থেকে রেডিক্যালরা বাদ পড়েন; মন্ত্রীদের এক তৃতীয়াংশই ছিলেন পশ্চিমে শিক্ষিত; তারা আরও পাশ্চাত্য বিনোয়াগ ও আরও পুঁজিপতি, অর্থনৈতিক ব্যাপারে সরকারের ভূমিকাকে খাট করার প্রতি জোর দিতে থাকেন। তারপরেও সমস্যা থেকে গিয়েছিল। কট্টরপন্থীরা বাস্তববাদীদের বিরুদ্ধে লড়াই অব্যাহত রাখে; কাউন্সিল অভ গার্ডিয়ান্সের রক্ষণশীলরা তখনও সংস্কারের পথে বাধা সৃষ্টি করতে পারছিলেন, প্রাতিষ্ঠানিক বিভিন্ন অংশ ত্রুটিপূর্ণ রয়ে গিয়েছিল। কিন্তু রাষ্ট্রের প্রয়োজন যেন ইরানিদের বৃহত্তর বহুত্ববাদ ও পাশ্চাত্য ঐতিহ্যের চেয়ে বরং শিয়া ঐতিহ্যের ভিত্তিতে সেক্যুলারিজমের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। লোকে ইসলামি পরিবেশে পাশ্চাত্য মূল্যবোধের দিকে অগ্রসর হতে পারছিল, সেগুলোর প্রতি আগের চেয়েও কম বৈরী ছিল।

গুরত্বের ক্ষেত্রে পরিবর্তনের বিষয়টি ইরানের অন্যতম নেতৃস্থানীয় বুদ্ধিজীবী আব্দোলকরিম সুরোশের রচনায় লক্ষ করা যেতে পারে। লন্ডন ইউনিভার্সিটিতে ইতিহাস বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করেছিলেন সুরোশ, বিপ্লবের পর খোমেনির সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদ অলঙ্কৃত করেছেন। বর্তমানে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের অংশ নন তিনি, কিন্তু যারা ক্ষমতায় আছেন তাদের প্রবলভাবে প্রভাবিত করে থাকেন। তাঁর শুক্রবারের ভাষণগুলো ঘনঘন প্রচারিত হয় এবং মসজিদ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্যতম উল্লেখযোগ্য বক্তা তিনি। সুরোশ খোমেনি ও শরিয়তি, এই দুজনকেই শ্রদ্ধা করলেও তাঁদের অতিক্রম করে যান। পশ্চিম সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি অনেক সঠিক, তিনি এমনও বলেছেন, বিংশ শতাব্দীর শেষে বহু ইরানির তিনটি পরিচয় থাকবে: প্রাক ইসলামি, ইসলামি ও পশ্চিমা; একে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতেই হবে তাদের। পশ্চিমের সমস্ত কিছুই দূষিত বা আসক্ত করার মতো নয়। কিন্তু সুরোশ পশ্চিমের অতি রেডিক্যাল সেক্যুলারিস্ট রীতি মেনে নেবেন না। তাঁর দৃষ্টিতে বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদ ধর্মের গ্রহণযোগ্য বিকল্পের যোগান দিতে পারে না। মানুষের সব সময়ই তাকে বস্তুর উর্ধ্বে নিয়ে যাওয়ার মতো আধ্যাত্মিকতার প্রয়োজন। ইরানিদের আধুনিক বিজ্ঞানের মূল্যবোধ উপলব্ধি করা শিখতে হবে, কিন্তু আবার নিজস্ব শিয়া ঐতিহ্যও ধরে রাখতে হবে।৭ ইসলামকেও অবশ্যই পরিবর্তিত হতে হবে: ফিকহকে অবশ্যই আধুনিক শিল্পায়িত বিশ্বের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে হবে, নাগরিক অধিকারের দর্শন ও একবিংশ শতকে নিজের শক্তিতে টিকে থাকার মতো একটি অর্থনৈতিক তত্ত্ব গড়ে তুলতে হবে। সুরোশ আবার উলেমা শাসনেরও বিপক্ষে ছিলেন, কারণ ‘ধর্মের উদ্দেশ্য অনেক বড়, তাকে কেবল যাজকদের হাতে ছেড়ে দেওয়া যায় না। সুরোশ প্রায়শঃই অধিকতর রক্ষণশীল যাজকদের সামলোচনার মুখোমুখি হতেন, কিন্তু তাঁর জনপ্রিয়তা বোঝায় যে, ইসলামী প্রজাতন্ত্র একে পশ্চিমের আরও কাছে নিয়ে যাওয়ার মতো বিপ্লব উত্তর একটি পর্যায়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

১৯৯৭ সালের ২৩শে মে হোজ্জাত উল-ইসলাম সায়ীদ খাতামি এক ভূমিধস বিজয়ের ভেতর দিয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে এটা যেন আরও পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। সম্ভাব্য ৩০ মিলিয়ন ভোটের মধ্যে ২২ মিলিয়নই পেয়েছিলেন তিনি। অবিলম্বে পশ্চিমা জগতের সাথে আরও নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তুলতে চাওয়ার বিষয়টি স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন তিনি। ১৯৯৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সালমান রুশদির বিরুদ্ধে দেওয়া ফতওয়ার সাথে তাঁর দেশের সম্পর্কের অবসান ঘটান। পরে ফাকিহ আয়াতোল্লাহ খামেনি একে অনুমোদন দেন। তারপরও খাতামি তাঁর সংস্কার পদক্ষেপকে কাউন্সিল অভ গার্ডিয়ান্সের তরফ থেকে বাধাগ্রস্ত হতে দেখেন, কিন্তু তাঁর নির্বাচন জনগণের একটা বড় অংশের পক্ষ থেকে বৃহত্তর বহুত্ববাদ, ইসলামি আইনের আরও কোমল ব্যাখ্যা ও ‘হতদরিদ্রদের’ জন্যে অর্থনৈতিক সুরক্ষা ও নারীদের জন্যে আরও প্রগতিশীল নীতিমালার* আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিত হয়েছিল। ইসলাম থেকে পিছু হটার কোনও ব্যাপার ছিল না। ইরানিরা তখনও তাদের রাষ্ট্রব্যবস্থাকে শিয়া মোড়কেই আবদ্ধ দেখতে চাইছিল বলে মনে হয়েছে, আধুনিক মূল্যবোধসমূহকে যা বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়েছে মনে করা কোনও কিছু থেকে অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য করে তুলেছে বলে মনে হয়েছে। এমন হতে পারে যে, কোনও একটি রেডিক্যাল আন্দোলনকে এর আগ্রাসন ও অসন্তোষের ভেতর দিয়ে কাজ করতে দেওয়া হলে তা অন্যান্য ট্র্যাডিশনের সাথে সৃজনশীলভাবে মিথষ্ক্রিয়া করতে শিখতে পারে, নিকট অতীতের সহিংসতা এড়িয়ে যায় এবং সাবেক শত্রুর সাথে মৈত্রী গড়ে তোলে।

[* ১৯৯৯ সালের গ্রীষ্মে এটা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল, যখন ইরানি ছাত্ররা আরও গণতন্ত্রের এবং উলেমাদের হাতে বাধাগ্রস্ত হবে না, এমন একটি ইসলামি সরকারের দাবিতে রাস্তায় নেমে এসেছিল।]

১৯৮১ সালে পশ্চিমা বিশ্ব সুন্নি মৌলবাদীদের হাতে প্রেসিডেন্ট সাদাতের হত্যাকাণ্ডের সংবাদে গভীর শোক প্রকাশ করার মুহূর্তে মিশরে এটা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। ১৯৭৩ সালে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সাফল্য উদযাপনের উদ্দেশ্যে এক কুচকাওয়াজ পরিদর্শনে গিয়েছিলেন সাদাত। কুচকাওয়াজের একটা ট্রাক সহসা ঠিক প্রেসিডেনশাল স্ট্যান্ডের সামনে লাইন ছেড়ে বের হয়ে আসে। ফার্স্ট লেফটেন্যান্ট খালেদ ইসলামবুলিকে ট্রাক থেকে লাফ দিয়ে নেমে ছুটে আসতে দেখে সাদাত উঠে দাঁড়ান, তিনি ভেবেছিলেন অফিসারটি তাঁকে স্যালুট করতে যাচ্ছে। কিন্তু তার বদলে মেশিনগানের এক ঝাঁক বুলেট ছুটে আসে। সাদাতের দেহ লক্ষ্য করে ক্রমাগত গুলি বর্ষণ করতে থাকে ইসলামবুলি, এমনকি নিজে পেটে গুলি খাওয়ার পরেও চিৎকার করে বলছিল, ‘কুত্তাটাকে, বেঈমানটাকে আমার হাতে তুলে দাও!’ হামলা মাত্র পঞ্চাশ সেকেন্ড স্থায়ী হলেও সাদাত ছাড়াও আরও সাতজন প্ৰাণ হারিয়েছিল, এবং অন্য আঠাশজন আহত হয়েছে।

আক্রমণের ভয়াবহতায় তীব্র ধাক্কা খেয়েছে পশ্চিমারা। সাদাতকে তারা পছন্দ করত। সাদাত এমন একজন মুসলিম শাসক ছিলেন যাঁকে তারা বুঝতে পারত। তিনি ‘ধর্মান্ধ’ না হয়েও যেন ধার্মিক ছিলেন; পশ্চিমারা ইসরায়েলের সাথে তাঁর শন্তি উদ্যোগ ও তাঁর খোলা দুয়ার নীতিকে সমীহ করত। আমেরিকান ও ইউরোপিয় যুবরাজ, রাজনীতিক ও প্রেসিডেন্টদের এক বিরাট দল সাদাতের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যোগ দিয়েছিলেন। কোনও আরব নেতা অবশ্য আসেননি, রাস্তায়ও জনতার কোনও ভীড় ছিল না। মিশরিয় জনগণ সাদাতের জন্যে চোখের পানি ফেলেনি, কিংবা পরে ইরানিরা যেমন খোমেনির লাশের চারপাশে করবে তেমনিভাবে তাঁর কফিনের পাশে ভীড় করেনি, শোকে স্তব্ধ হয়ে যায়নি। আরও একবার আধুনিক পশ্চিম ও মধ্যপ্রাচ্যের অধিকতর প্রথাগত সমাজগুলো বিপরীত মেরুতে সরে গিয়েছিল, এবং ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে পরস্পরের দৃষ্টিভঙ্গি উপলব্ধি করতে পারেনি তারা।

আমরা যেমন দেখেছি, উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মিশরিয় সাদাতের শাসনের সাথে ইসলামের চেয়ে বরং জাহিলিয়াহ আমলেরই বেশি মিল বলে মনে করতেন। ১৯৮০ সালে মুসলিম ক্যালেন্ডারের অন্যতম পবিত্র দিনে কায়রোয় গ্রীষ্মকালীন শিবির অনুষ্ঠান থেকে বিরত থাকতে বাধ্য করা জামাত আল-ইসলামিয়াহর ছাত্র সদস্যরা সালাদিন মসজিদ দখল করে নেয়, ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি প্রত্যাখ্যান করে এবং সাদাতকে একজন ‘তার্তার’ হিসাবে নিন্দা জানায়। ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেও কেবল নামেই মুসলিম ত্রয়োদশ শতকের অন্যতম মঙ্গোল শাসক ছিলেন তার্তার জামাতের অন্য দমিত সদস্যরা শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সহিংস জিহাদে নিবেদিত গোপন সেলের নেটওয়ার্কে যোগ দেয়। খালেদ ইসলামবুলি ছিল এই জিহাদি সংগঠনের সদস্য।

সাদাত এই মতদ্বৈততা সম্পর্কে সজাগ ছিলেন। বন্ধু শাহ’র নিয়তি বরণ করতে চাননি। ১৯৭৮ সালে তাঁর ভাষায় ল অভ শেম জারি করেন তিনি। প্রতিষ্ঠিত নিয়ম থেকে চিন্তায়, কথায় বা কর্মে যেকোনও ধরনের বিচ্যুতি নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত ও সম্পত্তি ও পাসপোর্টের বাজেয়াপ্তিকরণের শাস্তিযোগ্য হবে। নাগরিকদের উপর সরকারের প্রতি সমালোচনামূলক কোনও সংগঠনে যোগ দান, কোনও প্রচারণায় অংশ গ্রহণ বা ‘জাতীয় শান্তির প্রতি হুমকি সৃষ্টি’ করতে পারে এমন কোনও কিছু প্রকাশনার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। এমনকি কারও পারিবারিক পরিবেশে মামুলি মন্তব্যও বিনা শাস্তিতে পার পাওয়ার জো ছিল না।৪১ সাদাতের জীবনের শেষ মাসগুলোতে সরকার আরও বেশি নিপীড়ক হয়ে উঠেছিল। ৩রা সেপ্টেম্বর, ১৯৮১ সাদাত তাঁর চেনা ১৫৩৬ জন সমালোচককে আটক করেন; তাঁদের ভেতর মন্ত্রীসভার সদস্য, রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, যাজক ও ইসলামি গ্রুপের সদস্যরা অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। এভাবে আটক একজন ইসলামিস্ট ছিল সাদাতের ঘাতকের ভাই মুহাম্মদ ইসলামবুলি।৪২

আমরা সাদাতের হত্যাকারীর অনুপ্রেরণা সম্পর্কে ইসলামবুলির জিহাদি সংগঠনের আধ্যাত্মিক গুরু আব্দ আল-সালাম ফারাজের নিবন্ধে একটা ধারণা পেতে পারি। হত্যাকাণ্ডের পর, ডিসেম্বরে আল-ফরিদাহ আল-গায়বাহ (“দ্য নেগলেক্টেড ডিউটি’) প্রকাশিত হয়েছিল। অ্যাপোলোজিয়া ছিল না এটা, আবার আদতে সাধারণ মানুষের উদ্দেশ্যেও লেখা হয়নি। এটা সংগঠনের সদস্যদের মাঝে গোপনে বিলি করা হয়েছিল বলে মনে হয় এবং জঙ্গী মুসলিমরা পরস্পরের সাথে কী বিষয়ে কথা বলছে, কী তাদের উদ্বেগের বিষয়, তাদের ভীতি কী নিয়ে, এসব সম্পর্কে জানার সুযোগ করে দেয়। মুসলিমদের, যুক্তি তুলে ধরেছেন ফারাজ, একটা জরুরি দায়িত্ব রয়েছে। আল্লাহ পয়গম্বর মুহাম্মদকে (স) একটি প্রকৃত ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কোরানের উদ্ধৃতি দিয়ে ফারাজ তাঁর নিবন্ধের শুরু করেছেন যেখানে দেখা যায় মুহাম্মদের (স) কাছে প্রথম ঐশীবাণী আসার মাত্র তের বছরের ভেতরই আল্লাহ তাঁর নির্দেশ পালনে ব্যর্থ মুসলিমদের প্রতি অধৈর্য হয়ে উঠেছিলেন। ‘তাদের জন্যে কি এখনও সময় আসেনি’ তৎপর হওয়ার? অসন্তোষের সাথে প্রশ্ন করেছেন আল্লাহ।৪৩ চৌদ্দশো বছর পরে তিনি কতখানি অধৈর্য হতে পারেন! সুতরাং, মুসলিমদের অবশ্যই আল্লাহ’র ইচ্ছা বাস্তবায়নের জন্যে সম্ভাব্য সব কিছু করতে হবে। তাদের শান্তিপূর্ণ, অহিংস পদ্ধতিতে ইসলামিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে পারবে মনে করা আগের প্রজন্মগুলোর মতো হলে চলবে না। একমাত্র উপায় হচ্ছে জিহাদ, পবিত্র যুদ্ধ ৪৪

জিহাদই ছিল শিরোনামের ‘অবহেলিত দায়িত্ব’। ফারাজ যুক্তি দেখান যে, মুসলিমরা এখন আর এই পবিত্র সহিংসতা প্রয়োগ না করলেও এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। শত বছরের ইসলামি ঐতিহ্যের সামনে ঘুরে বেড়াচ্ছে। নিজের বক্তব্যের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরতে কুতবের মতোই নিষ্ঠুরভাবে নৈর্বাচনিক হতে হয়েছে ফারাজকে, এবং এই প্রক্রিয়ায় অনিবার্যভাবে বিকৃত মুসলিম দর্শন তুলে ধরেছেন তিনি। আবার, এটা নিপীড়নের অভিজ্ঞতা থেকে উদ্ভুত বিকৃতি ছিল। ফারাজ জোর দিয়ে বলেছেন যে, ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার একমাত্র উপায় তরবারি। একটি হাদিসের উদ্ধৃতি দিয়েছেন তিনি, যেখানে পয়গম্বর ধর্মের স্বার্থে যুদ্ধে অনিচ্ছুক ব্যক্তি এমনভাবে মারা যাবে ‘যেন সে কোনওদিন মুসলিম ছিল না, বা যে কিনা কপটাচারে পরিপূর্ণ, কেবল বাহ্যিকভাবেই মুসলিমের ভান করে বলেছেন বলে কথিত রয়েছে।৪৫ কোরানে আল্লাহ মুসলিমদের স্পষ্ট বলে দিয়েছেন, ‘তোমাদের জন্যে যুদ্ধের বিধান দেওয়া হলো, যদিও এ তোমাদের পছন্দ নয়।’৪৬ মুসলিমদের তিনি নির্দেশ দিয়েছেন

অংশীবাদীদের যেখানে পাবে বধ করবে। তাদেরকে বন্দি করবে, অবরোধ করবে ও তাদের জন্যে প্রত্যেক ঘাঁটিতে ওত পেতে থাকবে।৪৭

ফারাজের বিশ্বাস ছিল, তরবারির এই পঙক্তি মুহাম্মদের (স) কাছে মুসলিমদের প্রতি শত্রুর সাথে শান্তি স্থাপন ও সৌজন্যের সাথে আচরণের নির্দেশ দানের পঙক্তি অবতীর্ণ হওয়ার অনেক পরে অবতীর্ণ হয়েছিল। সুতরাং, এগুলো যেসব আয়াতে কোরানকে সহিংতা বিরোধী মনে হয় সেগুলোকে রদ করে দিয়েছে।৪৮

কিন্তু ফারাজের একটা সমস্যা ছিল। কোরান কেবল মূর্তিপূজকদের লক্ষ্য করেছে (‘যারা আল্লাহ’র পাশে তুচ্ছ বস্তুতে ঐশ্বরিকতা আরোপ করে’), কিন্তু সাদাত নিজেকে মুসলিম দাবি করে বলেছেন, তিনি পাঁচটি ‘স্তম্ভ’ পালন করেন। মুসলিমরা কীভাবে তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পারে? ফারাজ ইবন তাঈমিয়াহর ফতওয়ায় এর জবাব খুঁজে পেয়েছেন, যিনি যুক্তি দেখিয়েছিলেন যে, চতুর্দশ শতাব্দীতে ইসলাম ধর্ম গ্রহণকারী মঙ্গোল শাসকগণ আসলে ধর্মদ্রোহী ছিলেন, কারণ তাঁরা শরীয়াহর বদলে নিজেদের বিধান মোতাবেক শাসন করেছেন। * মিশরের বর্তমান শাসক, ঘোষণা করেছেন ফারাজ, মঙ্গোলদের চেয়েও খারাপ। মঙ্গোল বিধানে অন্ততপক্ষে কিছু পরিমাণ ক্রিশ্চান ও ইহুদি আইনের অস্তিত্ব ছিল, কিন্তু মিশরের আইনি ব্যবস্থা আজ ‘অবিশ্বাসের আইনের’ উপর ভিত্তি করে রচিত, বিধর্মীরা এর সৃষ্টি করেছে, উপনিবেশবাদীদের মাধ্যমে মুসলিমদের উপর আরোপ করা হয়েছে।৫°

বর্তমান যুগের শাসকগণ ইসলাম হতে বিচ্ছিন্ন। সাম্রাজ্যবাদের টেবিলে বেড়ে উঠেছে এরা, সেটা ক্রুসেডারিজমই হোক বা কমিউনিজম অথবা যায়নবাদ। নাম ছাড়া তারা ইসলামের কোনও কিছুই ধারণ করে না, যদিও তারা প্রার্থনা করে ও উপবাস পালন করে ও নিজেদের মুসলিম দাবি করে।৫১

১৯৮০ সালে যেসব ছাত্র সালাদিন মসজিদ দখল করেছিল, তারাও সাদাতকে মঙ্গোল শাসকদের সাথে তুলনা করেছিল। ফারাজের ধারণাসমূহ চরমপন্থীদের একটা ছোট গ্রুপের মাঝে সীমিত ছিল বলে মনে হয় না। ১৯৮০-র দশক নাগাদ তা চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে এবং ব্যাপকভাবে আলোচিত হতে থাকে।

ফারাজ স্বীকার করেছেন যে, ইসলামি আইনে জিহাদ সমবেত দায়িত্ব হিসাবে সংজ্ঞায়িত হয়েছে। পবিত্র যুদ্ধ শুরু করা কোনও ব্যক্তি বিশেষের কাজ নয়, বরং তা এমন এক সিদ্ধান্ত যা কেবল সম্প্রদায় সম্মিলিতভাবেই গ্রহণ করতে পারে। কিন্তু, জোর দিয়ে বলেছেন ফারাজ, উম্মাহ বাইরের শক্তির হাতে আক্রান্ত হলেই কেবল এই আইন প্রযোজ্য হতে পারে। আজকের দিনের পরিস্থিতি ঢের বেশি খারাপ, কারণ বিধর্মীরা আসলে মিশর দখল করে নিয়েছে। সুতরাং, যুদ্ধ করার যোগ্যতা রাখে এমন প্রতিটি মুসলিমের পক্ষেই জিহাদ দায়িত্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে। এভাবে ইসলামের গোটা জটিল ঐতিহ্য একটা মাত্র বিন্দুতে সংকীর্ণ হয়ে গেছে: সাদাতের মিশরে ভালো মুসলিম হওয়ার একমাত্র উপায় শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সহিংস যুদ্ধে অংশগ্রহণ।

তরুণ শিষ্যদের অস্বস্তিতে ফেলে দেওয়া প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন ফারাজ। গুপ্তহত্যার পরিকল্পনা করলেও জিহাদের সদস্যরা যতদূর সম্ভব নৈতিক আচরণ করার প্রয়াস পাচ্ছিল। পরিকল্পনা গোপন রাখার স্বার্থে কী মিথ্যা বলা গ্রহণযোগ্য হবে? অপরাধী শাসকদের হত্যার সাথে সাথে নিরীহ দর্শকদের হত্যার বেলায় কী হবে? মিশরে, পারিবারিক কর্তৃত্ব যেখানে দারুণ গুরুত্বপূর্ণ, তরুণতর সদস্যরা জানতে চাইছিল, বাবা-মার অনুমতি ছাড়াই এই ষড়যন্ত্রে যোগ দেওয়া কি ঠিক হচ্ছে?৫৩ ইসরায়েলের হাত থেকে জেরুজালেম মুক্ত করার আগে সাদাতের বিরুদ্ধে জিহাদে নামার প্রশ্নে নিশ্চিতভাবেই উদ্বেগ ছিল: কোনটা প্রাধান্য পাবে? ফারাজ উত্তর দিয়েছেন, জেরুজালেমের জন্যে জিহাদ কেবল একজন নিবেদিত প্রাণ মুসলিম নেতার নেতৃত্বেই হতে পারে, বিধর্মীর হাতে নয়। তিনি আল্লাহ’র প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে মারাত্মক আস্থাও প্রকাশ করেছেন। একবার সত্যিকারের ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা পেলে, জেরুজালেম আপনাআপনিই মুসলিম শাসনে ফিরে আসবে কোরানে আল্লাহ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, মুসলিমরা অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করলে, ‘তোমাদের হাতে আল্লাহ ওদেরকে শাস্তি দেবেন, ওদেরকে অপদস্থ করবেন, ওদের বিরুদ্ধে তোমাদের জয়ী করবেন ও বিশ্বাসীদের চিত্ত প্রশান্ত করবেন।’৫৫ (কোরান ৯:১৪) এই টেক্সটের আক্ষরিক পাঠ থেকে ফারাজ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, মুসলিমরা পদক্ষেপ গ্রহণ করলে আল্লাহ ‘হস্তক্ষেপ করবেন [এবং] প্রাকৃতিক বিধান পাল্টে দেবেন।’ জঙ্গীবাদীরা কি অলৌকিক সাহায্য আশা করতে পারে? ফারাজ বিষণ্নভাবে জবাব দিয়েছিলৈন, ‘হ্যাঁ।’৫৬

সাদাতের হত্যাকাণ্ডের পর কোনও ফলোআপ না হতে দেখে পর্যবেক্ষকরা দারুণ বিস্মিত হয়েছিলেন। ষড়যন্ত্রকারীরা অভ্যুত্থানের কোনও পরিকল্পনা করেনি বলে মনে হয়েছে, কিংবা গণ বিক্ষোভের আয়োজনেরও চেষ্টা করেনি। এর কারণ ছিল সম্ভবত প্রেসিডেন্টকে হত্যা করে প্রথম পদক্ষেপ গ্রহণ করার পর মুসলিমদের ঐশী হস্তক্ষেপের উপর আস্থা। ফারাজ যেন একে নিশ্চিত ধরে নিয়েছিলেন। ষড়যন্ত্রকারীরা বিরাট অসম্ভাব্যতার মুখোমুখী দাঁড়ানোর কথা জানলেও,৫৭ ফারাজ একে ব্যর্থতার ‘নির্বোধ’ ভীতি হিসাবে দেখেছেন। মুসলিমের কাজ আল্লাহ’র নির্দেশ পালন করা। ‘ফলাফলের জন্যে আমরা দায়ী নই।’ ‘বিধর্মীদের শাসনের অবসান ঘটলে, সবকিছু মুসলিমদের আয়ত্তে এসে যাবে। ৫৮

আরও বহু মৌলবাদীর মতো অক্ষরবাদী ছিলেন ফারাজ। তিনি এমনভাবে ঐশীগ্রন্থ পাঠ করেছেন যেন তার প্রতিটি ক্ষেত্রে তা অক্ষরে অক্ষরে সত্যি, এবং তাকে প্রতিদিনের জীবনে সহজে প্রত্যক্ষভাবে প্রয়োগ করা যাবে। এটা ঐশীগ্রন্থের মিথোসকে বাস্তব কর্মতৎপরতার নীলনকশা হিসাবে ব্যবহার করার আরেক বিপদ তুলে ধরে। প্রাচীন আদর্শ ছিল মিথোস ও লোগোসকে আলাদা রাখা: রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ছিল যুক্তির এখতিয়ার। বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদের আধিপত্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে গিয়ে এই সুন্নি মৌলবাদীরা যুক্তিকে বিসর্জন দিয়ে তিক্ত সত্য জানতে পেরেছিল এমনকি সাদাতের ঘাতকরা তাদের বিশ্বাস মতে আল্লাহ’র আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করলেও আল্লাহ হস্তক্ষেপ করে ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেননি। সাদাতের মৃত্যুর পর কোনও রকম ঝামেলা ছাড়াই প্রেসিডেন্ট হন হোসনি মোবারক, আর সেক্যুলারিস্ট সরকারই এখন পর্যন্ত ক্ষমতায় বহাল আছে।

দ্য নেগলেক্টেড ডিউটি-র চিন্তাভাবনা চরমপন্থীদের ছোট একটি দলের ভেতর সীমাবদ্ধ ছিল না বলেই মনে হয়, বরং পর্যবেক্ষকদের ধারণার চেয়ে ব্যাপকহারে সেই সময় মিশরিয় সমাজে ছড়িয়ে পড়েছিল ৫৯ অল্প সংখ্যক মিশরিয়ই সত্যিকার অর্থে সাদাতের হত্যা চেয়েছিল, বেশির ভাগই হত্যাকাণ্ডে দুঃখ পেয়েছে, কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পর তাদের অটল ভাব ছিল রীতিমতো লক্ষণীয় ও হিমশীতল। উদাহরণ স্বরূপ, আল-আযহারের শায়খগণ হত্যাকাণ্ডের নিন্দা করলেও সাদাতের বিদায়ে তাঁদের শোকাহত মনে হয়নি। হত্যাকাণ্ডের অব্যবহিত পরপর প্রকাশিত আযহারিয় পত্রিকায় সাদাতের কোনও ছবি ছিল না, হত্যার কথা দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় তীর্যকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল। দ্য নেগলেক্টেড ডিউটি-র বিরুদ্ধে জোরালভাবে ও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় দাঁড়ানো একমাত্র ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সদস্য হচ্ছেন মুফতি, ফারাজের নিবন্ধের বিস্তারিত উত্তর দিয়েছেন তিনি। তিনি ঘোষণা দেন যে, অন্য একজন আচার পালনকারী মুসলিমকে ধর্মদ্রোহী ঘোষণা করা নিষিদ্ধ। তাকফিরের (সমাজচ্যুতি) চর্চা কখনওই ইসলামে প্রচলিত ছিল না, কারণ কেবল আল্লাহ’র পক্ষেই কারও অন্তরের খবর রাখা সম্ভব। তিনি তরবারীর পঙক্তিসমূহকে সেগুলোর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে আলোচনা করেছেন, সপ্তম শতাব্দীর মদিনার বিশেষ পরিবেশের প্রতি সাড়া হিসাবে সেগুলোর উদ্ভব হয়েছে বলে দেখিয়েছেন। মিশরের বিংশ শতাব্দীর পরিস্থিতিতে অক্ষরে অক্ষরে সেগুলোকে প্রয়োগ করা যাবে না। তারপরও ১৯৮১ সালের ডিসেম্বরে প্রধান সুফি সাময়িকী জার্নাল অভ ইসলামিক মিস্টিসিজম-এ প্রকাশিত এক নিবন্ধে মুফতি এটা নিশ্চিতভাবে ধরে নিয়েছিলেন যে, তাঁর পাঠকরা ফারাজের শিক্ষার সাথে পরিচিত থাকবেন, যদিও দ্য নেগলেক্টেড ডিউটি কেবল প্রকাশিত হয়েছিল, সবার পক্ষে তা পড়া সম্ভব ছিল না। এইসব ভাবনা সম্ভবত ভক্ত বলয়ে প্রচারিত হয়ে সাধারণ বুলিতে পরিণত হয়েছিল। মিশরিয়দের বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ হত্যাকাণ্ডকে মহাপাপ মনে করলেও অনেকেই সাদাতের বেলায় নিরাসক্ত বোধ করেছে। নাসেরের মৃত্যুর পর অবস্থা অনেক বদলে গিয়েছিল। মিশরিয়রা এখন তাদের নেতাদের মাঝে সত্যিকারের ইসলামি গুণের দেখা পেতে চাচ্ছিল, সেক্যুলারিস্ট রীতি থেকে দূরে সরে যাচ্ছিল তারা।

মুবারককে দেশের ধর্মীয় ঝোঁক উপলব্ধি করতে হয়েছিল। তিনি অবিলম্বে ১৯৮১ সালে সাদাতের ক্র্যাকডাউনের সময় আটক সকল বন্দিকে ছেড়ে দেন। ইসলামি আন্দোলনসমূহকে নিয়ন্ত্রণের জোর চেষ্টা করে গেছেন তিনি, কিন্তু কেবল নির্দিষ্ট গ্রুপকে টার্গেট করেছেন। মুসলিম ব্রাদারহুডকে (সরকারীভাবে তখনও স্বীকৃতি পায়নি) দলীয় নির্বাচনে অংশ নিতে এবং সরকারে নিজেদের পক্ষে একটা অবস্থান সৃষ্টি করার অনুমতি দিয়েছেন। সোসায়েটির নতুন রাজনৈতিক সংগঠন দ্য ইসলামিক অ্যালায়েন্স যত্নের সাথে চরমপন্থীদের সাথে দূরত্ব তৈরি করে, মিশেরের কপ্টিক ক্রিশ্চানদের সাথে সম্পর্কন্নোয়ন এবং ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে শান্তিপূর্ণ উপায়ে কাজ করার প্রয়াস পায়। মিশর এখন খুবই ধর্মীয় রাষ্ট্র। বর্তমানে ১৯৬০-র দশকের নাসেরবাদের মতোই ইসলাম প্রাধান্য বিস্তার করেছে। ব্রাদারস-এর শ্লোগান ‘ইসলামই সমাধান’ ক্রমবর্ধমান সংখ্যাক মানুষের কাছে আবেদন সৃষ্টি করছে বলে মনে হয়।৬১ ব্যক্তিগত ধার্মিকতা সংক্রান্ত প্রশ্নাবলী এখন ম্যাগাজিন ও সাময়িকীর চিঠিপত্রের পাতায় প্রাধান্য বিস্তার করছে, প্রচার মাধ্যমে ইসলামি ইস্যু নিয়ে প্রাণবন্ত আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। ধর্মীয় পোশাক এখন সর্বত্র, নারী-পুরুষ ক্লাসরুমে নিয়মিতভাবে বিচ্ছিন্ন থাকে, সাধারণ জীবনে প্রার্থনার নির্দিষ্ট স্থান এখন সাধারণ ব্যাপার।৬২ মিশরকে পূর্ণ ইসলামি আইনে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার ও ইসলামকে সংবিধানের ভিত্তি করে তোলার ব্যাপক আকাঙ্ক্ষা এখনও রয়েছে। প্রতিটি নির্বাচনে ধর্মীয় প্রার্থীরা শক্তিশালী হয়ে উঠছেন। মিশর মোটামুটি বহুদলীয়, গণতান্ত্রিক দেশ, কিন্তু দুর্নীতি এখনও ব্যাপক বিস্তৃত, নির্বাহী স্বৈরাচারী এবং রাষ্ট্রীয় দল কেবল শাসক দল হিসাবে থাকতে রাজি নয়। সন্দেহ আছে যে সুষ্ঠু নির্বাচন হলে জনগণ অধিকতর ধার্মিক নেতাদের পক্ষে ভোট দেবে। এর ফলে ইসলাম মুবারকের সরকারের প্রধান চ্যালেঞ্জে পরিণত হয়েছে।

১৯৭০-র দশকের ধর্মীয় পুনর্জাগরণ পরিপক্কতা লাভ করেছে। মূলধারার অনেকেই, সব বয়স ও সব শ্রেণীর মিশরিয়রা এর অন্তর্ভুক্ত, এখন মৌলবাদের এক ধরনের মডারেট রূপ গ্রহণ করেছে। বেশির ভাগই রাজনীতিতে আগ্রহী নয়, তবে ধর্মের প্রতি আগ্রহের কারণে সামাজিক বা অর্থনৈতিক সংকটের কালে ইসলামি নেতাদের পক্ষে তাদের সংগঠিত করা অনেক সহজ। তরুণদের অনেকেই অবশ্য এখনও মনে করে যে, আধুনিক মিশরিয় সমাজ তাদের স্বার্থের কথা অন্তর দিয়ে ভাবে না। বিজ্ঞান, প্রকৌশল ও গণিতের ছাত্ররা এখন অধিকতর চরমপন্থী গ্রুপের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে। তারা দেখছে কঠোর ইসলামি জীবন ধারা সেক্যুলারিস্ট পছন্দের চেয়ে একটা গ্রহণযোগ্য বিকল্পের যোগান দিচ্ছে, গ্রাম্য সংস্কৃতি থেকে আধুনিক শহুরে সংস্কৃতিতে কষ্টকর অভিযাত্রায় সাহায্য করছে এবং এক ধরনের খাঁটিত্ব ও অংশগ্রহণের বোধ দিচ্ছে।৬৪ এটা তাদের আধুনিক সমাজে অর্জন করা খুবই কঠিন অথচ মানবীয় চাহিদার পক্ষে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা গোষ্ঠীরও যোগান দিচ্ছে। ঘড়ির কাঁটা পেছনে ঘোরানোর কোনও চেষ্টা করছে না তারা, বরং বর্তমান অবস্থায় শত শত বছর ধরে মুসলিমদের কাজে আসা ইসলামি প্যারাডাইম প্রয়োগের নতুন পথের সন্ধান করছে।

সাদাতের হত্যাকাণ্ডের ভেতর দিয়ে ভীতিকরভাবে বিস্ফোরিত গভীর অসন্তোষ আজও হুসনি মুবারকের দুই দশকের সীমিত উদারীকরণ ও গণতন্ত্রের আংশিক বাস্তবায়নের পরও তলে তলে ধিকিধিকি জ্বলছে। পার্থক্য হচ্ছে, ইসলামিস্টরা এখন অনেক বেশি সংগঠিত। আমেরিকান আরব বিশেষজ্ঞ প্যাট্রিক গাফনি ১৯৯১ সালে আবার মিনিয়া সফর করেছিলেন। তিনি লক্ষ করেছেন, মূল সড়কের পাশের ক্ষুদে মৌলবাদী মসজিদে শুক্রবারে নামাজের উদ্দেশ্যে সমবেত জনতা ১৯৭০-র দশকের তুলনায় এখন ঢের বেশি শৃঙ্খলাপরায়ণ। সেই পুরোনো জরাজীর্ণ ভাব ও উচ্ছৃঙ্খল ঔদ্ধত্য বিদায় নিয়েছে। অংশগ্রহণকারীদের অনেকেরই বয়স ছিল তিরিশ থেকে চল্লিশের কোঠায়; তারা সর্বজনীন জালাবিয়াহ পোশাক পরেছে, সঠিক ইসলামি টুপি মাথায় দিয়েছে। দেখে মনে হয়েছে নিজস্ব দিক ও পরিচয়সহ একটি ভিন্ন ও সুনির্দিষ্ট উপসংস্কৃতি গড়ে তুলতে যাচ্ছে তারা। গাফনি আরও লক্ষ করেছেন যে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন কার্যালয়ের অবস্থান বিশাল নতুন সরকারী ভবন রাষ্ট্রের প্রবল প্রতাপ ফুটিয়ে তোলার কথা বুঝিয়েছে। সাবেক ঝামেলার জায়গায় নিয়ন্ত্রণের প্রতীক, এর সাথে কায়রোর চেয়ে বরং মক্কামুখী নিবেদিত প্রাণ ইসলামপন্থীদের কোনও সম্পর্ক নেই বলে মনে হয়েছে।৬৫ মিশরে উপশমের কোনও লক্ষণ ছাড়াই এক সিযোফ্রেনিক দূরত্বে পাশাপাশি দুটি বলয় অবস্থান করেছে।

এটা বিস্ময়কর নয় যে, ‘দুই জাতির’ ভেতর যুদ্ধ চলছে। সাময়িক ভিত্তিতে পুলিস ও অতি চরমপন্থী মুসলিম গ্রুপগুলোর ভেতর গুলি বিনিময়ের খবর পাওয়া যায়। সংখ্যাগরিষ্ঠ ইসলামপন্থীরা যেখানে সেক্যুলার সমাজ থেকে মৌলবাদী বিচ্ছিন্নতায় সন্তুষ্ট, একটি সংখ্যালঘু অংশ সেখানে ত্রাসের আশ্রয় নিচ্ছে। ১৯৮৬ সাল থেকে আমেরিকান, ইসরায়েলি ও বিশিষ্ট মিশরিয়দের উপর রাজনৈতিক উদ্দশ্যে প্রণোদিত আক্রমণের ঘটনা ঘটছে। ১৯৮৭ সালে ইসলামপন্থীরা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন সাবেক মন্ত্রী হাসান আবু বাওহা ও সাপ্তাহিক পত্রিকা আল- মুসাওয়ারের সম্পাদক নবাবি আহমেদকে গুলি করে। ১৯৯০ সালের অক্টোবরে তারা মিশরিয় পার্লামেন্টের স্পিকার রিফাত মাহজুবকে হত্যা এবং ১৯৯২ সালে কট্টর সেক্যুলারিস্ট ফারাজ ফোদাকে গুলি করে হত্যা করে। সেই বছরই প্রথম বারের মতো ইউরোপিয় ও আমেরিকান পর্যটকদের উপর হামলার ঘটনা ঘটে।৬৬ অর্থনীতির ক্ষেত্রে পর্যটন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় হামলা ও নির্বিচার, আনাড়ী গণগ্রেপ্তারের পথ ধরেন মুবারক, ফলে আগুনে যেন ঘি ঢালা হয়। ১৯৯৭ সাল নাগাদ মানবাধিকার গ্রুপগুলো ২০,০০০ সন্দেহভাজন গেরিলাকে বিনা বিচারে মিশরিয় কারাগারে বন্দি রাখার দবি তোলে, অনেককে আবারও-কেবল নিরীহ প্যামফ্ল্যাট রাখা বা কোনও সভায় যোগদানের ঠুনকো অপরাধে আটক করা হয়েছিল। ১৯৯৭ সালের ১৭ই নভেম্বর সন্ত্রাসী দল জামাত আল ইসলামিয়াহ লক্সরে ‘এই হামলাই শেষ হামলা নয়, কারণ সরকার যতদিন নিপীড়ন অব্যাহত রাখবে ও ইসলামি আন্দোলনের সন্তানদের হত্যা করে চলবে ততদিন মুজাহিদিনরা কাজ চালিয়ে যাবে’৬৭ বলে আটান্ন জন বিদেশী পর্যটক ও মিশরিয়কে হত্যা করে। যুদ্ধ চলছে। মরিয়া ভাব ও অসহয়ত্ব সুন্নি মুসলিমদের সংখ্যালঘু অংশকে হত্যার ন্যায্যতা প্রতিপন্ন করার লক্ষ্যে ইসলামকে এমন এক মতাদর্শে পরিণত করতে অনুপ্রাণিত করে চলেছে যা ধর্মের সামগ্রিক বিকৃতি।

*

মিশরের মতো ইসরায়েলও আরও বেশি করে ধর্মীয় দেশে পরিণত হতে চলেছিল। ১৯৮০-র দশকে হেরেদিমের রাজনৈতিক উত্থানের মতো আর কোথাওই তা এতখানি প্রকট ছিল না। আল্ট্রা-অর্থডক্স ইহুদিদের একটি সংখ্যালঘু অংশ ইসরায়েল রাষ্ট্রকে সহজাতভাবে অশুভ ভেবে এসেছে, ‘এমন দূষণ যা সকল দূষণকে আবৃত করে, এক সামগ্রিক ধর্মদ্রোহীতা যা অন্যসব ধর্মদ্রোহীকে অন্তর্ভুক্ত করে।’ ‘এর একেবারে মূলে যায়নবাদ আমাদের ধর্মের আবিশ্যিক বিষয়গুলোকে অস্বীকার করে,’ ১৯৭৫ সালে নেচারেই কারতার নিউজ লেটারে লিখেছেন ইয়েরামিয়ে দোম্ব। ‘এ এক পরম অস্বীকৃতি যা খুব গভীরে, একেবারে ভিত্তিতে, শেকড়ে গিয়ে পৌঁছেছে।’৬৯ তবে অধিকাংশ হেরেদিম এতদূর পর্যন্ত অগ্রসর হয়নি। তারা স্রেফ রাষ্ট্রটিকে ধর্মীয় তাৎপর্যবিহীন মনে করেছে ও একে দারুণ নিস্পৃহতার সাথে দেখেছে। এই নিরপেক্ষতা তাদের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে সক্ষম করে তুলেছিল। হাসিদিম এমনকি তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডকে রাষ্ট্রের সেক্যুলার প্রতিষ্ঠানে আটকা পড়া স্বর্গীয় স্ফুলিঙ্গের নিষ্কৃতি লাভ হিসাবে ধর্মীয় আলোকেও দেখতে পেরেছে। শুয়োরের মাংস নিষিদ্ধকরণ বা আরও কঠোর সাব্বাথ পালন উৎসাহিত করণের মতো বিধান জারির লক্ষ্যে চাপ প্রয়োগ করে তারা ইসরায়েলকে মেসিয়ানিক পরিবর্তনের পথে আরও উপযুক্ত করে তুলতে পারবে। লিথুয়ানিয় মিসনাগদিমের আরও বাস্তব সম্মত প্রবণতা ছিল। নিজেদের আগের যেকোনও সময়ের চেয়ে গভীরভাবে ইয়েশিভা বিশ্বে আবদ্ধ করেছিল তারা এবং নিজেদের প্রতিষ্ঠানকে রক্ষা করার লক্ষ্যে রাষ্ট্রকে ব্যবহার করেছে। রাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা, অভ্যন্তরীণ বা বিদেশ নীতির প্রশ্নে তারা সম্পূর্ণ নিরাসক্ত ছিল। কোনও একটি দলের পরিবর্তে অন্য কোনও দলকে সমর্থনের ক্ষেত্রে তাদের একমাত্র বিবেচনার বিষয় ছিল ইয়েশিভোতের জন্যে এর দেওয়া তহবিলের পরিমাণ ও রাজনৈতিক সমর্থন দানের ইচ্ছা।৭০

টিকে থাকাই ছিল হেরেদিমের প্রধান উদ্দেশ্য। ১৯৬০-র দশকে থেকেই জেন্টাইল বিশ্বের প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে কঠোরতা এসেছিল। ১৯৬১ সালে জেরুজালেমে অ্যাডল্ফ এইখমানের বিচার হলোকাস্টের প্রতি নতুন সচেতনতা বোধের দিকে চালিত করেছিল, ফলে হেরেদিম নিজেদের গোয়েশি সংস্কৃতি ও এতে অংশগ্রহণকারী সেক্যুলার ইহুদিদের সাথে দূরত্ব বজায় রাখার ব্যাপারে আরও প্রতিজ্ঞ হয়ে ওঠে। নিজেদের তারা আধুনিক সভ্যতার বিরুদ্ধে যুদ্ধরত হিসাবে দেখেছে, জেন্টাইল বা ইহুদিবাদ সম্পর্কে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি মানে না এমন ধার্মিক বা সেক্যুলার ইহুদির প্রতি বলার মতো কিছুই ছিল না তাদের। আরও একবার দমন ও নির্যাতনের অভিজ্ঞতা ধর্মীয় দিগন্তের সংকীর্ণকরণের দিকে চালিত করেছে ও আদর্শিক সমরূপতার উপর নতুন জোর দিয়েছে। ক্রমবর্ধমানহারে ইয়েশিভোত বা হাসিদিক দরবারের বাইরে অর্থপূর্ণ যোগাযোগ স্থাপনের ভাষা বা ধারণার কোনওটাই আর হেরেদিমের ছিল না।১ নিজেদের ইসরায়েলি পড়শী ও ডায়াসপোরায় তাদের পূর্বপুরুষদের মতোই জেন্টাইল বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন মনে করেছে তারা।

কিন্তু হলোকাস্ট সম্পর্কে নতুন সচেতনতা ইহুদিবাদের নাজুক অবস্থা সম্পর্কে তাদের যারপরনাই সজাগ করে তোলে। তোরাহ রক্ষার লক্ষ্যে তারা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় যোগ দিতে ইচ্ছুক হয়ে উঠেছিল। ১৯৫০ সালে এদাহ হেরেদিসের একজন সদস্যের মুখে তাদের প্রবণতা সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ পেয়েছে:

আমরা দুর্বল; শক্তিশালী সরঞ্জাম রয়েছে আমাদের প্রতিপক্ষের হাতে; বিচ্ছিন্ন ও বিভক্ত হয়ে আমরা আমাদের নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার হুমকি সৃষ্টিকারী ঝড়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ছি, ঈশ্বর না করুন। আমাদের অন্তকরণকে ক্ষতবিক্ষতকারী আইন আমাদের অবস্থা আরও করুণ ও অসহনীয় করে তুলবে। আমাদের অবশ্যই নিজেদের রক্ষা করতে হবে ও সরকারের তরফ থেকে আমাদের উদ্দেশ্যে পরিচালিত আক্রমণ প্রতিহত করতে হবে।২

কিন্তু ১৯৫০-র দশকে অবস্থা জুৎসই ছিল না। আইডিএফ-এ নারী নিয়োগের প্রশ্নে আগুদাত ইসরায়েল ১৯৫২ সালে শ্রমিক দলীয় সরকার হতে বের হয়ে এসেছিল। সেই থেকে নেসেটে তাদের আর প্রতিনিধিত্ব ছিল না। কিন্তু ১৯৭৭ সালে লিকুদ পার্টির বিজয়ের পর আগুদাত কোয়ালিশন সরকারের সদস্যে পরিণত হয়। আগুদাতের উপদেষ্টা পরিষদ মোয়েতজেত গ’দোলায় হা-তোরাহ (কাউন্সিল অভ তোরাহ সেজেস) এভাবে যায়নবাদীদের হাতে মানসিকভাবে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত প্রবীন র‍্যাবাইদের ক্ষমতার একেবারে কাছে নিয়ে আসে। কিন্তু কয়েক দশক ধরে হাসিদিম ও মিসনাগদিমের পুরোনো বৈরিতা চাপা থাকলেও কাউন্সিলে তা ফের মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে; একই উৎস থেকে পাওয়া তহবিলের জন্যে প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে পরস্পরকে শত্রু হিসাবে দেখতে শুরু করেছিল তারা। ফলে নতুন নতুন হেরেদি পার্টি ও নতুন রাজনৈতিক কুশীলবের আবির্ভাব ঘটতে থাকে।

উদাহরণ স্বরূপ, পোনোভ্যে ইয়েশিভার প্রধান ও ইসরায়েলে লিথুয়ানিয় ইহুদিদের নেতা র‍্যাবাই এলিয়েযার শ্যাচ ১৯৪৮ সালে আরব দেশগুলো থেকে অভিবাসনকারী সেফারদিক ইহুদিদের প্রভাবের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন 1 সেফারদিকদের অনেকেই আগুদাত ইসরায়েলের হাসিদিক সদস্যদের প্রভাবে প্রভাবিত হচ্ছিল, বর্ধিত হাসিদিক ভোট মিসনাগদিক ইয়েশিভোত থেকে তহবিল অন্যদিকে নিয়ে যাবে ভেবে ভয় পাচ্ছিলেন শ্যাচ। এই বিপদ মোকাবিলা ও সেফারদিকদের প্রলুব্ধ করতে সেফারদিক প্রধান র‍্যাবাই ভোদিয়া ইয়োসেফের সাথে একটি নতুন সেফারদিক পার্টি শাস তোরাহ গার্ডিয়ান্স গঠন করেন তিনি। ইউরোপিয় ইহুদিদের মতো সেফারদিকদের যায়নবাদের প্রতি সমান বিতৃষ্ণা ছিল না। ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র সৃষ্টির আগ পর্যন্ত মুসলিম বিশ্বে তারা নির্যাতিত হয়নি এবং ঘেটো মানসিকতা গড়ে তোলেনি। রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের ব্যাপারে বা সানন্দে রাজনৈতিক জীবনে অংশ নেওয়ার ব্যাপারে তাদের ভেতর কোনও খুঁতখুঁতানি ছিল না। ১৯৮৪ সালের নির্বাচনে শাস নেসেটে চারটি আসনে জয় লাভ করেছিল।

অবশ্য ১৯৮৮ সালে সপ্তম লুবাভিচার র‍্যাবাই র‍্যাবাই শ্যাচ ও মিসনাগদিমের প্রভাব ঠেকানোর সিদ্ধান্ত নেন। তিনি তাঁর সকল অনুসারীকে আসন্ন নির্বাচনে আগুদাতের পক্ষে ভোট দেওয়ার নির্দেশ দেন। ৭৩ তিনি চাইছিলেন আগুদাত যেন ইহুদিত্বের আরও কঠোর সংজ্ঞা প্রদানের জন্যে সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করে। এই পদক্ষেপ ইসরায়েল রাষ্ট্রের রাজনৈতিক কল্যাণের প্রতি হেরেদিমের নিস্পৃহতা তুলে ধরেছে। ইসরায়েলি সরকার রেব্বের ইচ্ছা পূরণ করে মিশ্র বিয়ের ফলে জন্মলাভ করা সন্তান বা সংস্কার র‍্যাবাই কতৃক ধর্মান্তরিত কাউকে অইহুদি ঘোষণা করলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দারুণ সাফল্যের সাথে ইসরায়েলেল পক্ষে লবিং করেছে এমন বহু আমেরিকান ইহুদিকে ক্ষিপ্ত করে তোলা হত। ইসরায়েলের অস্তিত্বের পক্ষে আমেরিকার সমর্থন যারপরনাই গুরুত্বপূর্ণ ছিল, কিন্তু লুবাভিচার রেব্বে তার পরোয়া করেননি। তিনি স্রেফ নিজের ব্রতকে ইহুদি বিশ্বে প্রসারিত করতে চেয়েছেন। তাঁর কোনও কোনও প্রতিনিধি নিজেদের ইহুদি মনে করলেও হালাখীয় মানদণ্ড পূরণ করে না এমন সাধারণ লোকদের বেলায় সমস্যায় পড়েছে। ইসলায়েল রাষ্ট্র শেষ পর্যন্ত এই ধরনের লোকদের অ-ইহুদি ঘোষণা করলে লুবাভিচের পক্ষে জীবন অনেক সহজ হয়ে যেত। তবে আগুদাতের হাসিদিক সদস্যদের ভেতর রেব্বের হস্তক্ষেপ বেশ বৃদ্ধি পেয়েছিল, সুতরাং এর বিরোধিতা করতে র‍্যাবাই শ্যাচ একটি নতুন মিসনাগদিক পার্টি দেগেল হা-তোরাহ (তোরাহ ব্যানার) গঠন করেন।

ইসরায়েলি জনগণকে বিস্মিত করে ১৯৮৮ সালের নির্বাচনে ধর্মীয় দলগুলো রেকর্ড সংখ্যক আঠারটি আসনে বিজয়ী হয়। ফলাফলে দেখা যায় শ্রমিক ও লিকুদ পার্টির ভেতর ক্ষমতার ভারসাম্য তাদের হাতে রয়েছে। এর আগ পর্যন্ত যারা অর্থডক্সদের ঘৃণা ও তাদের অর্থহীন পশ্চাদপদতা হিসাবে বিবেচনা করে এসেছিল তারাই এবার সরকার গঠনে সাহায্য করার জন্যে তাদের সাথে যোগ দেওয়ার অনুরোধ জানাতে উপঢৌকনসহ হাজির হয়েছিল। হাসিদিম এত গভীরভাবে ইসরায়েল রাষ্ট্রের বিরোধী ছিল যে তারা তখনও সেক্যুলার ইহুদিরা ধর্মকে ধ্বংস করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ বলে বিশ্বাস করছিল। তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডকে তারা প্রয়োজনীয় অশুভ, আত্মরক্ষার প্রয়াস হিসাবে বিবেচনা করেছে। একে ‘শত্রু-শিবিরে অনুপ্রবেশ হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা যেতে পারে,’ ১৯৯১ সালে লিথুয়ানিয় পত্রিকা ইয়েতেদ নিমানে লিখেছেন র‍্যাবাই নাথান গ্রসমান। কিন্তু, প্রায় অনিচ্ছা সত্ত্বেও যে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে ভেবেছিল তারই সরকারে ব্যাপক ক্ষমতার অধিকারী হয়ে ওঠে হেরেদিম। হলোকাস্টের পর থেকে হেরেদিম হারানো ইউরোপিয় ইহুদি সম্প্রদায়কে ফের গড়ে তোলার সংগ্রাম করে আসছিল। পূর্ব ইউরোপের পুরোনো জীবনকে স্বর্ণযুগ মনে করত তারা, অতীতের মহান র‍্যাবাইদের মাঝে অনুপ্রেরণার সন্ধান করেছে। কিন্তু ১৯৮০-র দশকের শেষ নাগাদ নিজেদের অতিক্রম করে গিয়েছিল তারা। ৭০সিই-তে মন্দির ধ্বংসের পর র‍্যাবাই শ্যাচের মতো আর কোনও ধার্মিক ইহুদিই এতখানি ক্ষমতার অধিকারী হতে পারেননি। ১৯৮৮ সাল নাগাদ দুটি রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি ও তাঁর সিদ্ধান্তমূলক ভোটের জন্যে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর প্রশ্রয় লাভ করেছেন।৭৫

২৬শে মার্চ, ১৯৯০ নাটকীয়ভাবে এই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তেল আভিভের ইয়াদ এলিয়াহু বাস্কেটবল স্টেডিয়াম ইসরায়েলের সেক্যুলার সংস্কৃতির প্রতীকী মন্দির। ইসরায়েলে বাস্কেট বল বলতে গেলে জাতীয় ধর্মের মতোই। এই খেলাটি যায়নবাদীদের নব্য ইহুদি স্বপ্ন তুলে ধরে, এখন আর ঘোলাটে ইয়েশিভা তোরাহর স্তূপের উপর বিষণ্ণ চেহারায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে থাকে না সে, অর্থডক্সির কালো জোব্বায় আবৃত নয়, বরং কাজের জন্যে উন্মুক্ত, তামাটে, উপযুক্ত, স্বাস্থ্যবান এবং গোয়িমদের সাথে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতায় সক্ষম এবং তাদেরই খেলায় তাদের পরাস্ত করার ক্ষমতা রাখে। ১৯৯০ সালের মার্চের সেই সন্ধ্যায় স্টেডিয়াম ম্যাকাবীদের (জাতীয় বাস্কেটবল দল) সমর্থকে নয়, বরং দশ হাজার দাড়িঅলা কাফতান পরা হেরেদিম সমর্থকে পরিপূর্ণ ছিল। আল্ট্রা-অর্থডক্সরা সেক্যুলার ইসরায়েলের আঁতে ঘা দিয়েছে, অন্তত ওই সন্ধ্যায় এর একটি প্রধান দুর্গ অধিকার করে নিয়েছিল। তাছাড়া, ঘটনাটি টেলিভিশনে সম্প্রচারিত হয়, সারা দেশে রুদ্ধশ্বাসে ধার্মিক ও সেক্যুলার ইসরায়েলিরা দেখেছে। উপলক্ষ্য? র‍্যাবাই শ্যাচ তাঁর অনুসারীদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দেবেন ও আগামী নির্বাচনে কীভাবে ভোট দিতে হবে সে সংক্রান্ত নির্দেশনা দেবেন। ক্ষমতার ভারসাম্য সেক্যুলার শ্রোতাদের পক্ষে প্রায় দুর্বোধ্য এক অদ্ভুত হিব্রু, আরামাইক ও ইদ্দিশ মেশানো ভাষায় কথা বলা টপহ্যাট আর বাবড়ি চুলধারী র‍্যাবাইয়ের হাতে থাকার ব্যাপারে জাতি সজাগ হয়ে উঠেছিল। সেদিন সন্ধ্যায় র‍্যাবাই শ্যাচের শ্রমিক ও লিকুদ পার্টির ভাগ্য নির্ধারণ করবেন।

ইসরায়েল ও প্যালেস্তাইনের ভেতর শান্তি প্রক্রিয়া কষ্টকর গতিতে অগ্রসর হচ্ছিল, কিন্তু জাতীয় কোয়ালিশন সরকারে তা ভাঙন ধরিয়েছিল। শ্রমিক ও লিকুদ পার্টি ছোট ছোট দলগুলোর সাথে মৈত্রী স্থাপনের প্রয়াস পাচ্ছিল, ধর্মীয় দলগুলোই এককভাবে বৃহত্তর গোষ্ঠী ছিল। শ্রমিক দল আগুদাত ও শাসের সাথে অনানুষ্ঠানিক চুক্তি করে, কিন্তু শাসের অন্যতম নেতা র‍্যাবাই ইয়োসেফ শ্রমিক মৈত্রী দলের ভাঙন ধরাবে ভেবে ভয় পাচ্ছিলেন। সেফারদিকরা অতিজাতীয়তাবাদ প্রবণ, আরবদের ঘৃণা করে, শ্রমিক দলের পরিকল্পিত আঞ্চলিক ছাড়ের প্রবল বিরোধী ছিল তারা। শাসের সহপ্রতিষ্ঠাতা র‍্যাবাই শ্যাচ উদ্ধার করতে এগিয়ে এসেছিলেন। তিনি শাস ও দেগেল হা-তোরাহয় তাঁর অনুসারীদের উদ্দেশে ভাষণ দেবেন ও আসন্ন কোয়ালিশন আলোচনার কথা জানাবেন তাদের।

র‍্যাবাইর দশ মিনিটের ভাষণ বিস্ময়কর ছিল না, তবে টেলিভিশন সেটের সামনে বসে শোনা ইসরায়েলিদের কাছে অস্পষ্টভাবে অস্বস্তিকর ছিল। সরাসরি কোয়ালিশন আলোচনার কথা উল্লেখ করেননি তিনি, বাকি জাতিকে আচ্ছন্ন করে রাখা কোনও ইস্যু ওঠাননি। স্পষ্টতই প্যালেস্তইনিদের অধিকার, জাতীয় প্রতিরক্ষা বা শান্তির লক্ষ্যে ভূমি বিনিময়ের সম্ভাব্যতা সম্পর্কে সম্পূর্ণ নিরাসক্ত ছিলেন তিনি। ইসরায়েল রাষ্ট্র সম্পর্কে একটাও ভালো কথা বলেননি। ইহুদি রাষ্ট্রকে ত্রাতা হিসাবে দেখার বদলে হেরেদিম এখন কি ‘ভয়ঙ্কর ও ভয়াবহ’ সময় কাটাচ্ছে বিষণ্ণভাবে তার উল্লেখ করেছেন। আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ নয়, র‍্যাবাইয়ের উদ্বেগের বিষয় ছিল ধর্মের বিরুদ্ধে যায়নবাদীদের সূচিত যুদ্ধ। ‘আমরা আজ যে যুদ্ধে লিপ্ত রয়েছি [ঐতিহ্যের বিরোধিতাকারীদের বিরুদ্ধে], সেটা আজ শুরু হয়নি, সেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ই এর সূচনা, কেবল মহাবিশ্বের প্রভু জানেন কী আশা করা যেতে পারে,’ প্রবল আবেগের সাথে বলেছেন র‍্যাবাই। কিন্তু পরিণতি নিয়ে সন্দেহের কোনও অবকাশ ছিল না: ‘ইহুদিকে ধ্বংস করা যাবে না। তাকে হত্যা করা যেতে পারে, কিন্তু তার সন্তান তোরাহর প্রতি অনুগত থেকে যাবে।’

তাদের শত্রু হিসাবে চিন্তা করাটাই যথেষ্ট খারাপ ছিল, কিন্তু তাদের হতাশ করে শ্রমিকদলীয়রা তাদের পবিত্র সংগঠনসমূহ ও নিজেদের কেবল অ-ইহুদিই নয় বরং বিশেষভাবে ইহুদিবিরোধী হিসাবে প্রত্যাখ্যাত হতে শুনেছে। শ্রমিকরা কি আদৌ পবিত্র?’ পরিহাসের সুরে জানতে চেয়েছেন র‍্যাবাই। ‘তারা কি নিজেদের অতীত থেকে বিচ্ছিন্ন করে একটি নতুন তোরাহর সন্ধান করেনি?’ এইসব কিব্বুত্যনিক জেন্টাইলদের চেয়ে উন্নত নয়; তারা এমনকি সাব্বাথ বা ইয়োম কিপ্পুর কী তাই জানে না। কেমন করে এই ধরনের লোকদের ‘ইহুদি জনগণের জটিল ও আবিশ্যিক বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়া যায়?’ শ্রমিক দলীয় রাজনীতিকদের সাথে কোনও রফা হতে পারে না। ‘ওরা নেসেটে থাকার সময় ধার্মিকতাকে জোরাল করার কোনও আগ্রহ তাদের ছিল না। বরং উল্টো, তারা এমন সব আইন পাশ কারানোর চেষ্টা করেছে যেগুলো ইহুদি ধর্মকে ধ্বংস করে দেবে।’৭৬ ইয়াদ এলিয়াহু স্টেডিয়ামে সেদিনের সন্ধ্যার তাৎপর্য কেবল র‍্যাবাই শ্যাচের একা, বিনা সহযোগিতায় অনায়াসে ক্ষমতার ভারসাম্য লিকুদ পার্টির দিকে চালিত করাতেই নিহিত ছিল না, বরং তা হেরেদিমের ঘৃণিত অস্পৃশ্য গ্রুপ হতে ক্ষমতার কেন্দ্রে অসাধারণ অভিযাত্রাও চিহ্নিত করেছিল। ঘটনাটি আবার ইসরায়েলে ‘দুটি জাতির’ অস্তিত্বও তুলে ধরেছে, যারা একে অন্যের ভাষা বোঝে না বললেই চলে এবং তাদের কোনও সম-উদ্বেগও নেই। কেবল জেন্টাইলদের উদ্দেশে পরিচালিত ক্রোধ নয়, বরং সতীর্থ ইহুদিদের বিরুদ্ধেও অসংখ্য হেরেদিমের ধার্মিকতাকে অনুপ্রাণিতকারী গভীর ঘৃণাও তুলে ধরেছে এটা।

চরমপন্থী ধার্মিক যায়নবাদী ও গাশ এমুনিমের সদস্যরাও যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত ছিল। তারা বিদ্রোহী ছিল, একদিকে তাদের দৃষ্টিতে সেক্যুলার জাতীয়তাবাদ ও অন্যদিকে অর্থডক্সির বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান সংগঠিত করছিল। ইহুদিদের পক্ষে জীবন ব্যাপকভাবে বদলে গিয়েছিল। তারা বুঝতে পারছিল যে, ডায়াসপোরার সাথে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ঐতিহ্যের সাথে ইহুদিদের বেঁধে রাখার আর প্রয়োজন নেই, কারণ মেসিয়ানিক যুগের সূচনা হয়েছে। এটা ছিল শাব্বেতেই যেভির পর প্রথম প্রধান ইহুদি প্রাদুর্ভাব। সেই সময়েও ইহুদিরা নিজেদের ক্রান্তিকালের অধীন ভেবেছে এবং বিশ্বাস করেছে যে, নজীরবিহীন পরিবর্তন প্রত্যক্ষ করতে যাচ্ছে তারা। কিন্তু শাব্বেতিয়রা যেখানে ঘেটোর বিধিনিষেধের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল, গাশ সদস্যরা আঞ্চলিকভাবে নিজেদের সীমাবদ্ধ মনে করেছে। শাব্বেতিয়দের মতোই সীমানার ব্যাপারে দারুণ আচ্ছন্ন ছিল, এবং এরেযত ইসরায়েলের সীমানার প্রতিই বেশি নজর দিলেও তারাও ইহুদিবাদের সীমানা ও সীমা নির্ধারণের জন্যে লড়াই করছিল। সেক্যুলার ও ধার্মিক ইহুদিদের ভেতরকার বাধা অপসারণ করতে চেয়েছে তারা।৭৭

হেরেদিমরা যাই ভেবে থাকুক না কেন, কুকবাদীদের বিশ্বাস ছিল যে, একই সাথে অর্থডক্স ও যায়নবাদী হওয়া সম্ভব। তারা সেক্যুলারিস্টদের বিরুদ্ধে ধর্মীয় মাত্রা ছাড়া যায়নবাদ অসম্পূর্ণ বলেও জোর দিয়েছিল তারা। কিন্তু কঠিন বছর ছিল এগুলো। কুকবাদীরা লিকুদ সরকার কর্তৃক বেঈমানির শিকার হয়েছে বলে ভেবেছে, ইয়ামিত থেকে তাদের বহিষ্কার করেছিল তারা, এবং আরবদের সাথে শান্তি স্থাপন করে নিস্তার প্রক্রিয়াকে থমকে দিয়েছে। ১৯৮৭ সালে সূচিত ইন্তিফাদা (‘ঝাঁকুনি দেওয়া’ বোঝাতে আরবী পরিভাষা ) হিসাবে পরিচিত প্যালেস্তাইনি গণবিদ্রোহ শেষ পর্যন্ত শ্রমিক দলকে পশ্চিম তীরের পবিত্র ভূখণ্ডের নির্দিষ্ট অংশ ছেড়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি থাকায় কুকবাদীদের চোখে ক্যাম্প ডেভিডের চেয়েও অগ্রহণযোগ্য মনে হওয়া শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরে বাধ্য করলে আগের যেকোনও সময়ের চেয়ে তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল বলে মনে হয়েছে। কুকবাদীরা ক্রমবর্ধমানহারে নিজেদের বৈরী জেন্টাইল বিশ্ব দিয়ে আবদ্ধ মনে করছিল-অনেকটা ডায়াসপোরার ইহুদিদের মতো-কিন্তু আবার সতীর্থ ইহুদিদের দিয়েও, যারা তাদের সাধ্যের রয়েছে বলে মনে হওয়া সম্পূর্ণতা অর্জন থেকে ওদের পিছু টানছিল।

এর ফলে ভূমিতে গাশের অতীন্দ্রিয় আনন্দ ক্রোধের তুরীয় আনন্দে পরিণত হয়েছিল, অনেক সময় যা ভীতিকর সহিংসতায় বিস্ফোরিত হতে পারে, প্রথম নজীর আরবদের বিরুদ্ধে। অতীতের আরও আশাবাদী দিনে গাশ বসতি স্থাপনকারীরা অধিকৃত এলাকায় প্যালেস্তাইনিদের ‘সাহায্য’ ও দুই জাতির মধ্যকার ‘ঘৃণার প্রাচীর’ ভেঙে ফেলার জন্যে আগমনের ঘোষণা দিয়েছিল, যদিও এই প্রস্তাবের সাথে জড়িত শর্তাবলী অনেপনীয় বৈরিতা তুলে ধরে: ‘আমরা এসেছি হত্যার পরিবেশ থেকে তোমাদের পরিশুদ্ধ করতে যাতে তোমরা অভ্যস্ত হয়ে উঠেছ,’ ১৯৭০-র দশকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন লেভিংগার।” তাঁর আচরণ ক্রমবর্ধমানহারে উস্কানীমূলক হয়ে উঠেছিল। পশ্চিম তীরের আরব শহরে অস্ত্র হাতে আগ্রাসীভাবে হাঁটাচলা করতেন তিনি। কোনও বসতিতে প্যালেস্তাইনি আক্রমণের ঘটনা ঘটলে তিনি তখন অ্যক্টিভিস্টদের প্রতিশোধমূলক, ভিজিলান্তে হামলায় নেতৃত্ব দিতেন, গাড়ির কাঁচ ভাঙতেন বা দোকান পাটে আগুন লাগিয়ে দিতেন। ইন্তিফাদার সূচনা ঘটার পর তিনি বলেছিলেন, যখনই তিনি হেব্রনের কাছে যান, ‘আমার ভেতর এক উন্মত্ত চেতনা জেগে ওঠে আমাকে যা শান্তি দেয় না।’৭৯ ১৯৮৮ সালে, হেব্রনে তাঁর গাড়ির উপর ইটপাটকেল মারা হলে লেভিংগার ঝটপট বের হয়ে হামলাকারীদের উপর গুলি বর্ষণ শুরু করেন, নিজের জুতোর দোকানের সামনে স্রেফ দাঁড়িয়ে থাকা সালাহকে হত্যা করেন, পাথর ছোঁড়ায় তার ভূমিকা ছিল না। পরে উন্মত্ত হয়ে ওঠেন লেভিংগার, নির্বিচারে গুলি ছুঁড়তে থাকেন, তরকারীর গাড়ি উল্টে দেন এবং চড়া গলায় মুখখিস্তি করতে থাকেন। বিচারে তিনি বলেছিলেন, কাউকে হত্যা না করলেও ‘একজন আরবকে হত্যা করার সম্মান’ পেলে খুশিই হতেন তিনি।

এরেত্য ইসরায়েলে আরবদের ব্যাপারে কী করা যেতে পারে সে সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন তত্ত্ব ছিল গাশ সদস্যদের। সকলেই একমত ছিল যে, প্যালেস্তাইনিদের এই দেশের উপর কোনও অধিকার নেই, এখানে ওদের জন্যে শান্তিও নিই। ঘৃণা ও বর্জনের এই ধর্মতত্ত্ব অবশ্যই ইহুদি ধর্মবিশ্বাসের বিকৃতি। ইসরায়েলের পয়গম্বরগণ, তোরাহ ও তালমুদের রাব্বিনিক সাধুগণ সকলেই এমনকি যে তাদের জাতির অংশ নয়, কিন্তু তাদের দেশে বাসকারী ‘আগন্তুকের’ প্রতিও ন্যায় বিচার ও প্রেমময় দয়ার উপর জোর দিয়েছেন।৮১ জেসাসের প্রবীন সমসাময়িক র‍্যাবাই হিল্লেল স্বর্ণবিধিতে ইহুদিবাদের শিক্ষার সারমর্ম টেনেছেন: ‘তোমার নিজের প্রতি যে আচরণ আশা করো না, অন্যের সাথেও সেই আচরণ করো না।৮২ তবে মৌলবাদী নৈর্বাচনিকতা নিয়ে কুকবাদীরা কেবল আরও আক্রমণাত্মক বাইবেলিয় অনুচ্ছেদের প্রতি দৃষ্টি দিয়েছে, যেখানে ঈশ্বর ইসরায়েলিদের প্রতি প্রতিশ্রুত ভূমি থেকে স্থানীয় অধিবাসীদের বিতাড়িত করার নির্দেশ দিয়েছিলেন, তাদের সাথে কোনও চুক্তি না করতে বলেছেন ও এমনকি তাদের নিশ্চিহ্ন করতে বলেছেন।৩ ইহুদিরা ঈশ্বরের মনোনীত জাতির ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বোঝাতে চেয়েছে অন্য জাতির পক্ষে অবশ্য পালনীয় আইন কানুনের অধীন নয় তারা, বরং তারা অনন্য, পবিত্র, এবং ভিন্ন। ভূমি দখলের ঈশ্বরের নির্দেশনা, যুক্তি দেখিয়েছেন শ্লোমো আভিনার, আমাদের দেশের জেন্টাইলদের মানবিক ও জাতীয় অধিকার বিবেচনার চেয়ে ঢের বেশি গুরুত্বপূর্ণ।১৮৪

অধিকাংশ কুকবাদী বিশ্বাস করত যে, আরবদের এরেত্য ইসরায়েলে থাকবার অনুমতি দেওয়া উচিত, তবে কেবল গেরিন তোশাভিম (‘অধিবাসী বিদেশী’) হিসাবে। যতক্ষণ ইসরায়েল রাষ্ট্রকে মানছে, তাদের সাথে অবশ্যই শোভন আচরণ করতে হবে, কিন্তু কোনওদিনই নাগরিকত্ব বা রাজনৈতিক অধিকার পাবে না তারা। অন্যরা প্যালেস্তাইনিদের এই অধিকারটুকুও দিতে রাজি ছিল না, তাদের অভিবাসী হতে চাপ দিয়েছে। একটি ক্ষুদ্র সংখ্যালঘু গোষ্ঠী আমেলাকাইটদের নজীর টেনে নিশ্চিহ্নকরণের প্রস্তাব দিয়েছিল-এমনই নিষ্ঠুর জাতি যে ইসরায়লিদের তাদের করুণাহীনভাবে নিশ্চিহ্ন করার নির্দেশ দিয়েছিলেন ঈশ্বর।৮৫ ১৯৮০ সালে র‍্যাবাই ইসরায়েল হেস বার-ইলান ইউনির্ভার্সিটির সরকারী ম্যাগাজিনে ‘জেনোসাইড: আ কামান্ডমেন্ট অভ দ্য তোরাহ’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ প্রকাশ করেন। এখানে তিনি যুক্তি দেখান, আলোর কাছে যেমন অন্ধকার প্যালেস্তাইনিরা ইসরায়েলিদের কাছে তাই, তারা আমেলাকাইটদের মতো একই নিয়তি ভোগ করার যোগ্য।৮৬ একই বছর, গাশ বসতি স্থাপনকারী হাইম তযুরিয়া লেখেন যে, ঘৃণা ‘স্বাভাবিক ও স্বাস্থ্যকর’:

প্রতি প্রজন্মে আমরা আমাদের নিশ্চিহ্ন করার জন্যে রুখে দাঁড়ানোদের পেয়েছি। সুতরাং, প্রত্যেক প্রজন্মেরই আমালেক রয়েছে। আমাদের প্রজন্মের আমেলাকিজম নিজেকে আমাদের পূর্ব পুরুষের ভূমিতে আমাদের জাতীয় রেনেসাঁর প্রতি আরবদের ঘৃণায় গভীরভাবে প্রকাশিত।৮৭

১৯৮০ সালের ৩রা মে হেব্রনে ছয়জন ইয়েশিভা ছাত্র খুন হয়। এতে চরমপন্থী কিছু কুকবাদী প্রতিশোধ নিতে অনুপ্রাণিত হয়ে ওঠে। কিরিয়াত আরবার এক বসতিকারী মেনাচেম লিভনি ও প্রবীন গাশ বসতিস্থাপনকারী ইয়েহুদা এতযিয়ন পাঁচজন আরব মেয়রের গাড়িতে হত্যার উদ্দেশ্যে নয়, বরং তাদের পঙ্গু করে দেওয়ার লক্ষ্যে বোমা পুঁতে রাখে, যাতে তারা ইহুদি বিরোধী সন্ত্রাসের পরিণতির স্মারক হয়ে থাকেন। এই খবর শোনার পর আনন্দে ফেটে পড়েছিলেন র‍্যাবাই হাইম দ্রুকমান: ‘এভাবেই যেন ইসরায়েলের শত্রুরা ধ্বংস হয়!৮৮ অবশ্য বেশির ভাগ ইসরায়েলি এই আক্রমণের ফলে ভীতবিহ্বল হয়ে পড়েছিল, শেষ পর্যন্ত এই ঘটনায় লক্ষ্যবস্তুর মাত্র দুজন মেয়র আহত হন। লিভনি ও এতযিয়নের পক্ষে এই সন্ত্রাসী তৎপরতা সাইডলাইন মাত্র শুনে আরও বেশি বিতৃষ্ণা বোধ করেছে তারা। ১৯৮৪ সালের এপ্রিল মাসে সরকার ইসরায়েলে ইসলামি বিশ্বের তৃতীয় পবিত্রতম স্থান ডোম অভ দ্য রক উড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনাকারী ইহুদি আন্ডারগ্রাউন্ড দলের অস্তিত্বের খবর প্রকাশ করে।

১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধের সময় আইডিএফ জর্দান থেকে পূর্ব জেরুজালেম ও পুরোনো শহর জয় ও অধিকার করে নেয়। যুদ্ধের অল্পদিন পরে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আপত্তি উপেক্ষা করে ইসরায়েল এই এলাকাগুলো অধিগ্রহণ ও জেরুজালেমকে ইহুদি রাষ্ট্রের চিরন্তন রাজধানী ঘোষণা করে। বিতর্কিত সিদ্ধান্ত ছিল এটা, কেননা ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘ জেরুজালেম আন্তর্জাতিক এলাকা হবে বলে ঘোষণা করেছিল; ছয় দিনের যুদ্ধের পর বৈরিতার সময় দখল করা জেরুজালেমসহ বিভিন্ন অঞ্চল ইসলায়েলকে ছেড়ে দেওয়ার দাবি করেছিল। ৬৩৮ সাল থেকে সংক্ষিপ্ত ক্রুসেডার শাসনের সময়টুকু ছাড়া (১০৯৯-১১৮৭) জেরুজালেম ছিল মুসলিম শহর; জেরুজালেম, মুসলিমরা যাকে আল-কুদস (‘পবিত্র’) বলে, মক্কা-মদিনার পর ইসলামি বিশ্বের তৃতীয় পবিত্রতম স্থান। ৬৯১ সালে নির্মাণ সম্পন্ন হওয়া ডোম অভ দ্য রক ছিল প্রধান মুসলিম নির্মিত সৌধ, একে আব্রাহামের ছেলেকে উৎসর্গ করার স্থান হিসাবে বিশ্বাস করা হয়; পরবর্তীকালের ট্র্যাডিশন উল্লেখ করেছে যে পয়গম্বর মুহাম্মদ (স) এই রক থেকেই স্বর্গে অতীন্দ্রিয় যাত্রা শুরু করেছিলেন। এই স্থানটি ইহুদি বিশ্বের কাছেও গভীরভাবে পবিত্র, কারণ টেম্পেল মাউন্টের উপর এই ডোম নির্মিত হয়েছে, রাজা সলোমন নির্মিত মন্দিরের স্থান হিসাবে বিশ্বাস করা হয় একে।

অবশ্য শত শত বছর ধরে জেরুজালেমে মুসলিম ও ইহুদিদের ভেতর টানাপোড়েন ছিল না; ইহুদিরা বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল যে, ৭০ সিই-তে রোমানদের হাতে বিধ্বস্ত তাদের মন্দিরটি কেবল মেসায়াহর হাতেই আবার পুনর্নির্মিত হতে পারে, সুতরাং মুসলিমদের হারাম আল-শরীফ (সবচেয়ে মহান অভয়স্থান) আখ্যায়িত এই এলাকা নিয়ে তাদের কোনও পরিকল্পনা ছিল না। ষষ্ঠ শতাব্দী থেকে ইহুদি বিশ্বের পবিত্রতম স্থান ছিল ডোম অভ দ্য রকের ঠিক নিচে প্রথম শতাব্দী সিই-তে সম্রাট হেরোদ নির্মিত মন্দিরের শেষ চিহ্ন পশ্চিম প্রাচীর। অটোমান সুলতান সুলেইমান দ্য ম্যাগনিফিশেন্ট (১৪৯৪-১৫৬৬) ইহুদিদের এটাকে আনুষ্ঠানিক স্যাংকচুয়ারি বানানোর অনুমতি দেন এবং বলা হয়ে থাকে, তাঁর দরবারের স্থপতি সিনান সেখানে সাধারণ উপাসনালয়ের নকশা করেছিলেন।

আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ পবিত্র নগরে মুসলিম ও ইহুদিদের এই সম্প্রীতির কালের অবসান ঘটায়, এবং ১৯২০-র দশকে থেকে পবিত্র এলাকাটি বহু সহিংসতা প্রত্যক্ষ করেছে। ১৯৪৮ থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত পূর্ব জেরুজালেম ও পুরোনো শহর জর্দানের অধিকারে থাকার সময় ইহুদিদের পশ্চিম প্রাচীর সফরের অনুমতি ছিল না, পুরোনো শহরের ইহুদি এলাকার প্রাচীন সিনাগগগুলো ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছিল। ১৯৬৭ সালে ইহুদিদের পশ্চিম প্রাচীরে প্রত্যাবর্তন ছিল ছয় দিনের যুদ্ধের অন্যতম আবেগঘন দৃশ্য, এমনকি সেক্যুলার ইহুদিদের কাছেও গভীরভাবে আধ্যাত্মিক ঘটনা হিসাবে তা অনুভূত হয়েছে।

যুদ্ধের পর ইসরায়েল জেরুজালেম অধিগ্রহণ করার সময় কথা দিয়েছিল যে, ক্রিশ্চান ও মুসলিমরা তাদের পবিত্র স্থানে অনিরুদ্ধ প্রবেশাধিকার পাবে। মুসলিমরা হারাম আল-শরীফের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখে, যদিও সরকারী এই নীতি অতিজাতীয়তাবাদী ইসরায়েলি ও অতি চরমপন্থী ধার্মিক যায়নবাদীদের কারওই পছন্দ ছিল না, তাদের কথা ছিল একে ইহুদিদের ফিরিয়ে দেওয়া উচিত। অবশ্য আনুষ্ঠানিক ইহুদি অবস্থান অপরিবর্তিত থেকে গিয়েছিল। মেসায়াহ নিষ্কৃতি না আনা পর্যন্ত মন্দির নির্মাণ করা যাবে না; এটা ছিল শত বছরের পরিক্রমায় টাবুর শক্তি অর্জনকারী নিষেধাজ্ঞা।

অবশ্য ১৯৮০-র দশকের গোড়ার দিকে এর পরিবর্তন ঘটতে শুরু করে। লিভনি ও এতযিয়ন নিষ্কৃতির ভূমিকা হিসাবে মন্দির পুনর্নির্মাণে উৎসাহী একমাত্র ইহুদি চরমপন্থী ছিল না। পবিত্র স্থান ডোম অভ দ্য রক ‘দূষিত’ অবস্থায় কেমন করে সেখানে মেসায়াহ ফিরতে পারেন? অন্য মৌলবাদীদের মতো তাদের বিশ্বাস ছিল, সকল সতর্কতা উড়িয়ে তাদেরই পদক্ষেপ নিতে হবে ও মেসায়াহর জন্যে পথ তৈরি করার লক্ষ্যে টেম্পল মাউন্ট থেকে এই মুসলিম উপসনালয়টিকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে হবে। তারা প্রথম পদক্ষেপ নিলে, ঈশ্বর নিশ্চিতভাবেই বিশ্বাসের এই কর্মকে পুরস্কৃত করে ইতিহাসে হস্তক্ষেপ করবেন, দীর্ঘ প্রতীক্ষিত মেসায়াহকে প্রেরণ করে উদ্ধার করবেন ইসরায়েল জাতিকে। লিভনি ও এতযিয়ন ও তাদের সতীর্থ ষড়যন্ত্রকারীরা বিশ্বাস করত, ইসরায়েলি সরকার আরবদের হারাম আল-শরীফ, টেম্পল মাউন্টের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে দিয়ে মহাপাপ করেছে। তাদের চোখে ডোম অভ দ্য রক ছিল এক ধরনের ‘অশ্লীলতা’ ও ‘আমাদের প্রজন্মের সকল আধ্যাত্মিক ভ্রান্তির মূল কারণ।৮৯

ইহুদি আন্ডারগ্রাউন্ডের অন্যতম প্রধান আদর্শিক নেতা ভদ্র, মৃদুভাষী কাব্বালিস্ট ইয়েগুয়া বেন শোশান বিশ্বাস করতেন ডোম অভ দ্য রক নিষ্কৃতিকে ব্যহতকারী তাঁর চোখে শয়তানি প্রভাবে অনুপ্রাণিত ‘অপরপক্ষের’ অশুভ শক্তির আবাস। তিনিই ক্যাম্প ডেভিড আলোচনার সময় লিভনি ও এতযিয়নের কাছে ‘অশ্লীলতা’ দূর করার প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছিলেন। ডোমের ধ্বংসের ভেতর দিয়ে তাদের শক্তি নষ্ট হবে, নিমেষে বন্ধ হয়ে যাবে অভিশপ্ত শান্তি প্রক্রিয়া। আর কিছু না হোক, এই নাটকীয় কাজটি বিশ্বব্যাপী ইহুদি জনগণকে ধর্মীয় দায়িত্ব সম্পর্কে সঠিকভাবে সচেতন করে তুলবে ও শত্রুর সাথে এই সমন্বয়ের আলোচনা পরিত্যাগে বাধ্য করবে।

এক সংকট মুহূর্ত ছিল এটা। ডোম অভ দ্য রকের বোমা বর্ষণে শান্তি কেবল প্রক্রিয়ারই অবসান ঘটাত না, নিশ্চিতভাবেই প্রথম বারের মতো গোটা মুসলিম বিশ্বের ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ শক্তিতে মিলিত হওয়ার যুদ্ধের সূচনা ঘটাত। ওয়াশিংটনের কৌশলবিদগণ একমত প্রকাশ করেছেন যে, ঠাণ্ডাযুদ্ধের পটভূমিতে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আরব ও ইসরায়েলের সমর্থক থাকায় ডোম অভ দ্য রকের ধ্বংস তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধেরও সূচনা ঘটাতে পারত। পারমাণবিক বিপর্যয়ের অপচ্ছায়া অবশ্য এই কুকবাদীদের বিচলিত করেনি। তারা নিশ্চিত ছিল, এই পৃথিবীর বুকে প্রলয়ের সূচনা ঘটিয়ে ঐশী জগতে শক্তিকে সক্রিয় করে তুলে ঈশ্বরকে তাদের পক্ষে হস্তক্ষেপে ও ইসরারেয়লকে বাঁচাতে মেসায়াহকে পাঠাতে ‘বাধ্য’ করবে।৯১

কাব্বালিস্টিক ভাবনার উন্মত্ত রূপ এটা। কর্মতৎপরতার নীল নকশা হিসাবে মৌলবাদীদের মিথলজিকে ব্যবহারের ভীতিকর নজীর। বাস্তব ক্ষেত্রে ষড়যন্ত্রকারীদের পরিকল্পনায় অযৌক্তিক কিছুই ছিল না। লিভনি আইডিএফ-এর বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ হিসাবে প্রশিক্ষণ লাভ করেছিল। দুবছর ধরে হারাম আল- শরীফকে নিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পড়াশোনা এবং গোলান মালভূমির সামরিক শিবির থেকে বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক সংগ্রহ করেছিল। আটাশটি নিখুঁত বোমা বানিয়েছিল সে যেগুলো দিয়ে ডোম ধ্বংস হলেও আশপাশের এলাকার কোনও ক্ষতি হত না। আক্রমণের জন্যে সম্পূর্ণ প্রস্তুত ছিল ওরা। কেবল কাজের অনুমোদন দেওয়ার মতো একজন র‍্যাবাই না পাওয়ায় আটকে ছিল।

ডোম অভ দ্য রক পরিকল্পনা যুক্তি বর্জন, অলৌকিকের উপর আস্থা ও ইহুদি রাষ্ট্রকে ধ্বংস করে দেওয়ার মতো এক ধরনের নিহিলিজমের নজীর তুলে ধরেছে। এই বিপর্যয়কর মেসিয়ানিজম আধুনিক অভিজ্ঞতার দীর্ঘদিনের অংশ মৃত্যুতৃষাকে প্রকাশ করেছে। গাশ এমুনিমের বিশ্বাসযোগ্যতাকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করায় এটা আবার আত্মবিনাশীও ছিল। স্বর্ণযুগে ইসরায়েলি সাধারণের কোনও কোনও অংশের মাঝে অর্জিত আস্থা আর কোনও দিন উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।

র‍্যাবাই মেয়ার কাহানে প্রতিষ্ঠিত আন্দোলন নৈতিক নিহিলিজমে বৈশিষ্ট্যায়িত ছিল। অধিকাংশ ইসরায়েলিদের ভীত করে ১৯৮৪ সালে ১.২ শতাংশ ভোটে নেসেটে নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি।৯৩ নিউ ইয়র্ক সিটিতে শুরু হয়েছিল তাঁর কর্মজীবন, এখানে ইহুদিদের উপর কৃষ্ণাঙ্গ তরুণদের পরিচালিত হামলার বদলা নিতে ইহুদি প্রতিরক্ষা সংগঠিত করেছিলেন তিনি। ১৯৭৪ সালে ইসরায়েলে পৌঁছান তিনি, এবং শেষ পর্যন্ত কিরিয়াত আরবায় থিতু হন, এখানে সংগঠনের নাম পাল্টে কাচ (‘এভাবে!’) রাখেন। এবার তাঁর উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়ায় আরবদের হয়রানি করে এরেত্য ইসরায়েল থেকে বিদায়ে বাধ্য করা। কাহানের মৌলবাদ প্রায় আদিআদর্শমূলক ছিল। তাঁর ইহুদিবাদ এতটাই রিডাকশনিস্ট ও নিষ্ঠুরভাবে নৈর্বাচনিক ছিল যে তা ধর্মবিশ্বাসের মারাত্মক ক্যারিকেচারে পরিণত হয়েছিল। ‘ইহুদিবাদে একাধিক বাণী নেই,’ একজন সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীকে বলেছিলেন তিনি। ‘বাণী একটাই। এবং সেই বাণী হচ্ছে ঈশ্বর যা চান তাই করা।’ বাণী স্রেফ এই: ‘ঈশ্বর এই দেশে এসে আমাদের একটি ইহুদি রাষ্ট্র সৃষ্টি করতে বলেছেন।৪ পবিত্রতার ইহুদি মতবাদ (কোদেশ: ‘বিচ্ছিন্নতা’, ‘আলাদাভাবে অবস্থান করা’), আচারের ভেতর দিয়ে প্রতীকীভাবে বিভিন্ন বস্তুর মধ্যকার পার্থক্যকে উদযাপন করেছিল, এখন কাহানের ব্যাখ্যায় তা অনন্যভাবে রাজনৈতিক অর্থ নিয়েছিল: ‘ঈশ্বর চান আমরা আমাদের নিজেদের দেশে বিচ্ছিন্নভাবে বাস করি, যাতে বিদেশীদের সাথে আমাদের সম্ভাব্য কম সম্পর্ক থাকে।’৯৫ অর্থাৎ, আরবদের বিদায় নিতে হবে। আব্রাহামের কাছে দেওয়া প্রতিশ্রুতি গোত্রপিতাদের আমলের মতো আজও বৈধ রয়েছে, সুতরাং আরবরাই দখলদার। ৬ জেনেসিসের মিথোস এভাবে জাতিগত শুদ্ধি অভিযানের রাজনৈতিক কর্মসূচির ভিত্তিতে পরিণত হয়েছিল। এই রিডাকটিভ দৃষ্টিভঙ্গি যুক্তিসঙ্গতভাবেই ভয়ানক সন্ত্রাসের মেসিয়ানিক দর্শনের দিকে চালিত করে। ছয় দিনের যুদ্ধের বিজয়ের পর ইহুদিরা ‘নিষ্কৃতির উপান্তে এসে দাঁড়িয়েছিল। ইহুদিবাদের একক নির্দেশনার কারণে তাদের ব্রত পরিষ্কার। তাদের উচিত ছিল এলাকা অধিকার করে আরবদের বহিষ্কার করে ‘টেম্পল মাউন্ট থেকে জেন্টাইলদের বিভীষিকা’ দূরীভূত করা। তারা কাজটা করলে অনায়াসে সানন্দে উপস্থিত হত নিষ্কৃতি। ইসরায়েল ব্যর্থ হওয়ায় মেসায়াহ আসবেন বটে, কিন্তু সেটা হবে হলোকাস্টের চেয়েও ভয়ানক ব্যাপক অ্যান্টি-সেমিটিক বিপর্যয়ের ভেতর দিয়ে, শেষ পর্যন্ত যা সকল ইহুদিকে ঈশ্বরের নির্দেশনা মানতে ও ইসরায়েল বাস করতে বাধ্য করবে।৯৭

ধ্বংস ও মৃত্যুর এই অন্ধকার দর্শন গভীরভাবে নিহিলিস্টিক। এটা ঘৃণা ও প্রতিশোধের আকাঙ্ক্ষায়ও ভরপূর। ধর্ম সম্পর্কে কাহানের ভীতিকর বিকৃত দর্শন নির্যাতন ও দমনের দীর্ঘকালীন অভিজ্ঞতার প্রভাব তুলে ধরে, সুযোগ দিলে যা আত্মার গভীরে প্রবেশ করে তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলতে পারে। কাহানের ধর্মতত্ত্ব সর্বত্র শত্রু দেখতে পায়, ক্রিশ্চান, নাৎসি, কৃষ্ণাঙ্গ, রাশিয়ান বা আরব যাই হোক না কেন, শত্রু শেষ পর্যন্ত এক এবং অদ্বিতীয়। সবকিছুই ইহুদি ভোগান্তি এবং সেই ভোগান্তির বিরুদ্ধে প্রতিশোধের অবস্থান থেকে দেখা হয়। ইসরায়েল রাষ্ট্র ইহুদিদের জন্যে কোনও আশীর্বাদ ছিল না, বরং জেন্টাইলদের বিরুদ্ধে ঈশ্বরের প্রতিশোধ

ঈশ্বর ইহুদির জন্যে বা তার ন্যায়বিচার ও ভালো কাজের পুরস্কার হিসাবে এই রাষ্ট্র সৃষ্টি করেননি। এর কারণ তিনি, সব প্রশংসা তাঁর, স্থির করেছেন যে তাঁর পক্ষে আর তাঁর নামের অপবিত্রকরণ এবং তাঁর নামে নামকরণকৃত জাতিকে নিয়ে পরিহাস, অসম্মান ও নির্যাতন সহ্য করা সম্ভব নয়, সুতরাং, তিনি ডায়াসপোরার সম্পূর্ণ বিপরীত ইসরায়েল রাষ্ট্রকে অস্তিত্ব দিয়েছেন।৯৮

যখনই জেন্টাইলের হাতে কোনও ইহুদি প্রহৃত বা ধর্ষিত হচ্ছে, ঈশ্বরের নাম অপবিত্র হচ্ছে: ‘ইহুদি অপমানিত হলে ঈশ্বর গ্লানি বোধ করেন! তবে এর উল্টোটাও সত্য। সহিংস প্রতিশোধ কিদ্দুশ হা-শেম, ঈশ্বরের নামের পবিত্রকরণ : ‘বিস্মিত জেন্টাইল বিশ্বের মুখের উপর একজন ইহুদির মুঠাঘাত গত দুই সহস্ৰ বছরে দেখা যায়নি, এটাই কিদ্দুশ হা-শেম। ১৯৯

এই আদর্শই একজন কাহানেবাদী বারুচ গোল্ডস্তেইনকে ২৫শে ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৪ কেভ অভ দ্য প্যাট্রিয়ার্কে পুরিম উৎসবের সময় উনত্রিশ জন প্যালেস্তাইনি উপাসককে হত্যায় উদ্বুদ্ধ করেছিল। ২৪শে আগস্ট, ১৯২৯ প্যালেস্তাইনিদের হাতে নিহত উনষাট জন ইহুদির প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিল সে। প্রতিশোধের এই কাজটি খোদ ইসরায়েলে ইসলামি অনুপ্রাণিত সন্ত্রাসের বৃদ্ধি ডেকে এনেছিল।

১৯৬৭ সালের পর বিশ্বব্যাপী মুসলিম ধর্মীয় পুনর্জাগরণে প্যালেস্তাইনিরা জড়িত হয়নি। আরবদের পরাজয়ে তাদের সাড়া রাজনৈতিক, সেক্যুলারিস্ট, ও জাতীয়তাবাদী ছিল। ইয়াসির আরাফাত প্যালেস্তাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনকে পুনর্গঠিত করেন এবং প্যালেস্তাইনি সমস্যার সমাধানের লক্ষ্যে গেরিলা অপারেশন, সন্ত্রাস ও কূটনীতির সূচনা করেন। এটা চরমভাবে সেক্যুলার আন্দোলন ছিল। কিন্তু ১৯৭১ সালে পিএলও জাতীয়তাবাদীরা গাযা স্ট্রিপে আরিয়াল শ্যারন কর্তৃক দমনের শিকার হলে শেখ আহমাদ ইয়াসিন মুজামাহ (‘কংগ্রেস’) নামে একটি মুসলিম সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন; এই প্রতিষ্ঠানটি মুসলিম ব্রাদারহুডের সাথে সম্পর্কিত ধরনের কল্যাণ কর্মসূচি হাতে নিয়েছিল। ১৯৮৭ সাল নাগাদ মুজামাহ স্ট্রিপে যাকাত (ইসলামি কর), তেল সমৃদ্ধ উপসাগরীয় দেশগুলো ও মুজামাহকে সমর্থন করেন পিএলওকে খাট করার আশায় ইসরায়েলের সমর্থনে তারা একটি দাতব্য সাম্রাজ্য গড়ে তোলে, যার ভেতর ক্লিনিক, মাদকাসক্তি নিরাময় কার্যক্রম, তরুণ সংঘ, ক্রীড়া প্রতিষ্ঠান ও কোরান ক্লাস অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই পর্যায়ে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে আগ্রহী ছিলেন না ইয়াসিন। তিনি সংস্কারক ছিলেন, ইসলামি প্রেক্ষাপটে গাযায় আধুনিকতার ফল বয়ে আনতে চেয়েছিলেন। জাতীয়তাবাদীদের বিরুদ্ধে প্যালেস্তাইনের আত্মার পক্ষেও লড়াই করছিলেন তিনি: তাঁর বিশ্বাস ছিল, প্যালেস্তাইনি জনগণের সাংস্কৃতিক পরিচয় সেক্যুলার না হয়ে মুসলিম হওয়া উচিত। মুজামাহর জনপ্রিয়তা দেখায় যে, বহু প্যালেস্তাইনি একমত হয়েছিল। আরাফাতকে নিয়ে তারা গর্ব করলেও তাঁর সেক্যুলারিস্ট রীতি কেবল পাশ্চাত্য আধুনিক শিক্ষার সুফল লাভ করা এক অভিজাত গোষ্ঠীর কাছেই অর্থপূর্ণ ছিল।১০০

মিশরের জিহাদ সংগঠনের অনুরূপ আন্ডারগ্রাউন্ড সেলের নেটওয়ার্ক ইসলামিক জিহাদের আদর্শ ছিল আবার সম্পূর্ণ ভিন্ন। ইসলামিক জিহাদ প্যালেস্তাইনি ট্র্যাজিডিকে ধর্মীয় পরিভাষায় ব্যাখ্যা করে সায়ীদ কুতবের আদর্শ প্রয়োগ করেছে। তাদের বিশ্বাস ছিল, বর্তমানে প্যালেস্তাইনের সেক্যুলার সমাজ জাহিলি। ইসলামিক জিহাদের সদস্যরা নিজেদের ভ্যানগার্ড মনে করেছে, ‘ঔদ্ধত্যের শক্তির বিরুদ্ধে-সারা বিশ্বের সমস্ত উপনিবেশবাদী শক্তির বিরুদ্ধে’ যুদ্ধ করছে, ব্যাখ্যা করেছেন তাদের আদর্শিক নেতা শেখ আউদা। উম্মাহর ভবিষ্যতের স্বার্থে লড়াই করছে তারা। মুজামাহর বিপরীতে ইসলামিক জিহাদ ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধে আগ্রহী ছিল। এর লক্ষ্য ছিল ধর্মীয়। উদাহরণ স্বরূপ, ১৯৮৫ সালের অক্টোবর মাসে পশ্চিম প্রাচীরে আইডিএফ-এর এক পরিচিতি অনুষ্ঠানে সৈনিক ও সাধারণ মানুষের সমাবেশে হ্যান্ড গ্রেনেড ছুঁড়ে এর কর্মীরা এক নবনিযুক্তের পিতাকে হত্যা: করে। এই সময় পর্যন্ত সংগঠনটি গাযা থেকে পশ্চিম তীর পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছিল।১০১

১৯৮৭ সালের ৯ই ডিসেম্বর ইন্তিফাদা নামে পরিচিত জনপ্রিয় প্যালেস্তাইনি গণজাগরণ গাযায় শুরু হয়ে পূর্ব জেরুজালেম ও পশ্চিম তীরে ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৬৭ সাল থেকে প্যালেস্তাইনিদের একটা গোটা প্রজন্ম ইসরায়েলি দখলদারিত্বের অধীনে এইসব অঞ্চলে বেড়ে উঠেছে; প্যালেস্তাইনি স্বাধীনতা আনতে ব্যর্থ পিএলও নেতৃত্বের উপর অধৈর্য এবং তাদের চোখে এক নিপীড়ক বিদেশী শক্তির অধীনে বাস করে প্রতিদিন অপমান ও ভোগান্তির শিকার হয়ে হতাশার শিকার হয়ে পড়েছিল তারা। ইসরায়েলিদের আশা ছিল তাদের শাসনাধীনে অধিকৃত এলাকার আরবরা এক সময় হাল ছেড়ে দেবে। কিন্তু ১৯৮৭ সাল নাগাদ ইসরায়েলের বিরুদ্ধে অসন্তোষ বিস্ফোরণোন্মুখ অবস্থায় পৌছে গিয়েছিল। একটি প্যালেস্তাইনি রাষ্ট্রের আকাঙ্ক্ষা প্রবল হয়ে ওঠে। এই নতুন বিদ্রোহের তরুণ নেতৃত্ব দখলদারিকে খাট করার দিকে প্রযুক্ত হয়; প্রতিটি প্যালেস্তাইনিকে অংশ গ্রহণে উৎসাহিত করে তারা, তো নারী ও শিশু বন্দুক ও শক্তির শ্রেষ্ঠত্বের পরোয়া না করে ইসরায়েলি সৈন্যদের লক্ষ্য করে ইটপাথর ছুঁড়েছে। ইন্তিফাদা আরব বিশ্ব ও অভ্যন্তরীণ সম্প্রদায়কে মুগ্ধ করেছিল; ইসরায়েলি শান্তি আন্দোলনেরও গতি বাড়িয়েছিল তা, কারণ এটা জোরালভাবে প্যালেস্তাইনিদের যেকোনও মূল্যে ইসরায়েলি আধিপত্য থেকে স্বাধীনতা ও মুক্তি লাভের ইচ্ছা তুলে ধরেছিল। ইন্তিফাদা ইত্যহাক রাবিনের মতো অপেক্ষাকৃত কট্টরপন্থীদের উপরও প্রভাব রেখেছিল, সৈনিক হিসাবে আইডিএফ ব্যবহার করে নারী ও শিশুদের নতি স্বীকার করানোর অসম্ভাব্যতা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন তিনি। ১৯৯২ সালে প্রধানমন্ত্রী হলে রাবিন পিএলও-র সাথে আলোচনায় বসার প্রস্তুতি নেন, এবং পরের বছর ইসরায়েল ও পিএলও অসলো চুক্তিতে স্বাক্ষর করে।

কিন্তু ইন্তিফাদার গোড়ার দিকের দিনগুলোতে প্যালেস্তাইনি সংগ্রামকে নিশ্চিতভাবে নিহিলিস্টিক ইসলামি মাত্রা দিয়ে একটি নতুন সংগঠন গড়ে উঠেছিল। ইন্তিফাদার নেতৃত্ব সেক্যুলারিস্ট ছিল, কিন্তু মুজামাহর কিছু সদস্য হামাস (হাকামাত আল-মুকাওয়ামাহ আল-ইসলামিয়াহ: ইসলামি রেনেসাঁ মুভমেন্ট) প্রতিষ্ঠা করেন, এই সংগঠন ইসরায়েলি দখলদারি ও প্যালেস্তাইনি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের বিরুদ্ধে একই সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। প্যালেস্তাইনের মুসলিম পরিচয়ের স্বার্থে সেক্যুলারিস্টদের বিরুদ্ধে লড়ছিল তারা, তরুণরা দল বেঁধে হামাসে যোগ দিয়েছে। অনেকেই শরণার্থী শিবির থেকে আগত, বাকিরা ছিল মধ্যবিত্ত ও উচু পদের কর্মী। আবারও, নির্যাতনের মুখে জন্ম নেওয়া সহিংস আন্দোলন ছিল এটা। ১৯৯০ সালের ৮ই অক্টোবর হারাম আল-শরীফে সতের জন প্যালেস্তাইনি উপাসককে হত্যার পর হামাস সন্ত্রাস বেড়ে ওঠে। নিশ্চিহ্নতার ভীতিতে তাড়িত হামাস ইসরায়েলের দালাল ধরে নিয়ে প্যালেস্তাইনিদের উপরও হামলা করে। ‘আমাদের শত্ররা সকল শক্তি দিয়ে আমাদের জাতির অস্তিত্ব মুছে ফেলার চেষ্টা করছে,’ ১৯৯৩ সালে ব্যাখ্যা করেছিলেন একজন মুখপাত্র। সুতরাং ইসরায়েলের সাথে যেকোনও রকমের সহযোগিতাই ‘মারাত্মক অপরাধ।’১০২ ইসলামিক জিহাদের মতো হামাস আরব- ইসরায়েল বিরোধকে ধর্মীয় দৃষ্টিতে দেখেছে। এর সদস্যদের বিশ্বাস ছিল, জনগণের ধর্মীয় দায়িত্ব অবহেলাই প্যালেস্তাইনি ট্র্যাজিডি সৃষ্টির কারণ; কেবল ইসলাম ফিরে গেলেই প্যালেস্তাইনিরা ইসরায়েলি শাসন ঝেড়ে ফেলতে সক্ষম হবে।১০৩ হামাস বিশ্বাস করেছে যে, ইহুদি ধর্মের কারণেই ইসরায়েলের সাফল্য এসেছে, ইসরায়েল ইসলামের ধ্বংস নিশ্চিত করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।১০৪ সুতরাং, আত্মরক্ষার স্বার্থে যুদ্ধ করার দাবি তুলেছে তারা। বারুচ গোল্ডস্তেইন হেব্রনে প্যালেস্তাইনি উপসকদের হত্যা করার পর হামাস জীবনের বিনিময়ে জীবন নেওয়ার শপথ করেছিল। অ্যাক্টিভিস্টরা শোকের চল্লিশ দিন পেরুনোর অপেক্ষা করার পর একজন আত্মঘাতী বোমাবর্ষণকারী অধিকৃত এলাকায় নয়, মূল ইসরায়েলের আফুলায় সাতজন ইসরায়েলি নাগরিককে হত্যা করে। এক সপ্তাহ পরে, ১৯৯৪ সালের ১৩ই এপ্রিল, আরেকজন আত্মঘাতী বোমাবর্ষণকারী হাদেরায় এক জনাকীর্ণ বাসে পাঁচজন ইসরায়েলিকে হত্যা করে। সহিংসতা নতুন সহিংসতার জন্ম দেয়।

এই আত্মঘাতী বোমাবর্ষণকারীরা আগের বছর স্বাক্ষরিত অসলো চুক্তি সম্পর্কে বহু ইসরায়েলিকে সতর্ক করে তোলে। এই চুক্তির ভেতর দিয়ে পিএলও ১৯৪৮ সালের সীমানার ভিত্তিতে ইসরায়েলের অস্তিত্ব মেনে নিয়ে সহিংসতা ও সন্ত্রাসের অবসান ঘটানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। বিনিময় পাঁচ বছরের জন্যে পশ্চিম তীর ও গাযা স্ট্রিপে প্যালেস্তাইনিদের সীমিত স্বায়ত্ত শাসন দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। এই সময় অতিবাহিত হওয়ার পর অধিকৃত এলাকায় ইসরায়েলি বসতি, প্যালেস্তাইনি শরণার্থীদের জন্যে ক্ষতিপূরণ ও জেরুজালেমের ভবিষ্যতের মতো বিষয়গুলো নিয়ে চূড়ান্ত অবস্থানগত আলোচনা শুরু হবে। কিন্তু ইসরায়েলে আত্মঘাতী বোমাবর্ষণকারীদের অস্তিত্ব ইঙ্গিত বহণ করেছে যে আরাফাত তাঁর সেক্যুলারিস্ট সরকারের বিরোধিতাকারী ইসলামি জঙ্গীদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি এবং কোনও কোনও ইসরায়েলি, বিশেষ করে রাজনৈতিক বর্ণালীর ডানে অবস্থানকারীরা অসলোয় ইসরায়েলি নিরাপত্তা জলাঞ্জলি দেওয়ার জন্যে রাবিনকে দোষারোপ করেছে।

কুকবাদী র‍্যাবাইগণ অসলো চুক্তিতে বিশেষভাবে ক্ষুব্ধ ছিলেন: পবিত্র ভূমি বিসর্জন দিয়ে সরকার শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছে। ফলে ১৯৯৫ সালের জুলাই মাসে আইডিএফ অধিকৃত এলাকা হতে লোকজন সরিয়ে নিতে শুরু করলে র‍্যাবাই অভ্রাহাম শাপিরা এবং চৌদ্দজন গাশ র‍্যাবাই সৈনিকদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশ অগ্রাহ্য করার নির্দেশ দেন। এটা গৃহযুদ্ধ ঘোষণারই সামিল ছিল। অন্য র‍্যাবাইরা প্রশ্ন তুলেছেন রাবিন রোদেফ (‘অনুসারীতে’) পরিণত হয়েছেন কিনা, যিনি সক্রিয়ভাবে ইহুদির জীবনকে হুমকির মুখে ফেলে দেন এবং সে কারণে ইহুদি আইন মোতাবেক মৃত্যুদণ্ড পাবার যোগ্য ১০৫ ৪ঠা নভেম্বর, ১৯৯৫, হেসদার ইয়েশিভার সাবেক ছাত্র দুর্দান্ত সেনা সদস্য ও বার ইলান ইউনিভার্সিটির ছাত্র ইয়েল আমির তেল আভিভে এক শান্তি মিছিলের সময় রাবিনকে হত্যা করে। পরে সে বলেছে ইহুদি পাঠ তাকে রাবিনের ইহুদি জাতির শত্রু রোদেফ হওয়ার ব্যাপারটি বিশ্বাস করতে প্ররোচিত করেছে; তাঁকে হত্যা করা তার দায়িত্ব ছিল। ১০৬

সাদাতের হত্যাকাণ্ডের মতো রাবিনের হত্যাকাণ্ডও মধ্যপ্রাচ্যে দুটি যুদ্ধ চলার কথা তুলে ধরেছে। একটা আরব-ইসরায়েল বিরোধ; অন্য যুদ্ধটি ইসরায়েল ও মিশরের মতো নির্দিষ্ট দেশের অভ্যন্তরে সেক্যুলারিস্ট ও ধার্মিকদের ভেতর। কেবল ধার্মিক ইহুদিরা এক গভীর স্তরে নির্যাতিত ও আক্রান্ত হওয়ার বোধ লালন করছিল না। ইসলায়েলের সেক্যুলারিস্টরাও একইভাবে ধার্মিক ইহুদিদের হাতে প্রত্যাখ্যাত ও আক্রান্ত মনে করেছে। জেরুজালেমের হেরেদি এলাকায় চলাচলের সময় জনপ্রিয় ইসরায়েলি লেখক আমোস ওয স্মৃতিচারণ করেছেন যে, আদি যায়নবাদীরা অর্থডক্স ইহুদিবাদকে ঘৃণা করত এবং এই বাস্তবতাকে চারপাশের বিশ্ব ও তাদের অন্তর থেকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চাইত। ঘৃণা ও বিতৃষ্ণার এক বিস্ফোরণে তারা বিশ্বকে ‘জলাভূমি, মৃত শব্দের স্তূপ ও নিভন্ত প্রাণ হিসাবে বর্ণনা করেছে। এমনি সেক্যুলার ঘৃণার প্রতি হেরেদিম করুণার সাথে সাড়া দিয়েছে। নেচারেই কারতার সদস্যদের আবাস এক মহল্লার দেয়ালে ওয কালো স্বস্তিকা ও গ্রাফিতি দেখতে পান: ‘যায়নবাদী হিটলারপন্থীদের মৃত্যু চাই।’ ‘টেডি কোলেক [জেরুজালেমের শ্রমিক দলীয় মেয়র] নিপাত যাক!’ শিক্ষক দোভ সাদানের কথাও মনে পড়ে গিয়েছিল ওযের। তিনি যুক্তি দেখিয়েছিলেন, যায়নবাদ স্রেফ ইহুদিবাদের ইতিহাসে সাময়িক পর্ব, অর্থডক্স ইহুদবাদ আবার ফিরে আসবে, ‘যায়নবাদকে হজম করে নেবে।’ এই আল্ট্রা অর্থডক্স পাড়ায় হাঁটতে গিয়ে ওয হেরেদি ইহুদিবাদের শক্তি দেখে বিপর্যস্ত ও অভিভূত বোধ করেছেন, ‘ফুলে ফেঁপে উঠে আপনার নিজের আধ্যাত্মিক অস্তিত্বকেই হুমকি দিচ্ছে ও আপনার নিজস্ব জগতের শেকড় কুরে কুরে খাচ্ছে, আপনার এবং আপনার মতো যারা তাদের বিদায়ের পর এর সমস্ত কিছু অধিকার করে নিতে তৈরি হচ্ছে।১০৭ সেক্যুলারিস্ট ইসরায়েলিরাও যেন ধার্মিক প্রতিপক্ষের মুখোমুখি হয়ে নিশ্চিহ্নতা ও অযৌক্তিক ত্রাসের বোধে আক্রান্ত হয়।

সমস্যার মূলে স্পর্শ করেছেন ওয। মৌলবাদী ও সেক্যুলারিস্টরা-যেকোনও ধর্মেরই হোক-যুদ্ধে লিপ্ত থাকার কারণ তারা সম্পূর্ণভাবে ভিন্ন পবিত্রতার ধারণা লালন করে। গাশ এমুনিমের প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে ওয একে ‘একটি নিষ্ঠুর ও অনমনীয় গোষ্ঠী’ আখ্যায়িত করেছেন, ‘ইহুদিবাদের অন্ধকার কোণে’ যার জন্ম হয়েছে এবং ‘আমাদের কাছে যা কিছু পবিত্র ও প্রিয় তাকে ধ্বংস করার হুমকি দিচ্ছে।’ সেক্যুলারিস্ট উদারপন্থীদের পক্ষে-তারা ইহুদি, ক্রিশ্চান বা মুসলিমই হোক-ব্যক্তির স্বয়ত্তশাসন ও বুদ্ধিবৃত্তিক মুক্তির মতো আলোকন মূল্যবোধসমূহ অলঙ্ঘণীয় ও পবিত্র। এই ধরনের ইস্যুতে তারা আপোস বা ছাড় দিতে পারে না। উদারবাদী বা সেক্যুলার পরিচয়ের পক্ষে এই নীতিমালা এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে সেগুলো হুমকির মুখে পড়লে লোকে মনে করে তাদের খোদ অস্তিত্বই বিপন্ন হয়ে পড়েছে। মৌলবাদীরা যেমন সেক্যুলারিস্টদের হাতে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার ভয়ে আক্রান্ত থাকে, ঠিক তেমনি ওযের মতো একজন উদারপন্থীও গাশকে হুমকি মনে করেছেন ‘আমাদের উপর এক বর্বর ও উন্মাদ রক্ততৃষা টেনে আনবে’। গাশের আসল লক্ষ্য, তিনি বলেছেন, নাবলুস বা হেব্রন অধিকার নয়, বরং,

ইসরায়েল রাষ্ট্রের উপর ইহুদিবাদের কৃৎসিত ও বিকৃত ভাষ্য চাপিয়ে দেওয়া। এই কাল্টের আসল মতলব হচ্ছে আরবদের বহিষ্কার করা যাতে পরে ইহুদিদের উপর নির্যাতন চালানো যায়, তাদের মিথ্যা পয়গম্বরদের নিষ্ঠুরতার অধীনে আমাদের সবাইকে টেনে নিয়ে যাওয়া যায়।১০৮

ধার্মিক ও সেকুলারিস্টদের প্রত্যেকেই পরস্পরের দিকে ভীতির সাথে তাকায়। কেউ অপরকে স্পষ্ট দেখতে পায় না। উভয় পক্ষই অপর পক্ষের বাড়াবাড়ি, নিষ্ঠুরতা ও অহিষ্ণুতার কথা বলে এবং অন্তস্তলে আঘাত করে, শান্তি স্থাপন করতে পারে না।

*

আমেরিকাতেও মেরুকরণ ও বৈরিতা ছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ধর্মীয় মৌলবাদীদের অনেক বেশি সংযত ও আইননিষ্ঠ মনে হয়েছে। মৌলবাদীরা তাদের প্রেসিডেন্টকে হত্যা করেনি, বিপ্লবে নেতৃত্ব দেয়নি বা জিম্মি আটক করেনি। কিন্তু তাসত্ত্বেও আমেরিকান ধর্মের ক্ষেত্রে এক গভীর খাদ অস্তিত্ববান ছিল। জরিপে দেখা গেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ধার্মিক জনগণ পরিষ্কার প্রায় সমান পরস্পর বৈরী শিবিরে বিভক্ত। ১৯৮৪ সালে পরিচালিত এক গ্যালপ পোলে দেখা গেছে ৪৩ শতাংশ আমেরিকান নিজেদের ‘উদারপন্থী’ আখ্যায়িত করেছে এবং ৪১ শতাংশ ‘রক্ষণশীল’; এবং প্রধান গোষ্ঠীগুলো ঠিক মাঝখানে বিভক্ত ছিল। অধিকাংশ অংশগ্রহণকারীই বিভাজন ‘মারাত্মক’ বলে দাবি করেছে; ‘অপর পক্ষ’ সম্পর্কে তারা নেতিবাচক ধারণা পোষণ করে, যা অন্যান্য কুসংস্কারের মতোই বৃহত্তর যোগাযোগ স্থাপিত হলেও হ্রাস পায়নি।১০৯ অন্যান্য জরিপে দেখা গেছে মাত্র ৯ শতাংশ আমেরিকান নিজেদের ‘মৌলবাদী’ বলে স্বীকার করলেও প্রটেস্ট্যান্ট মৌলবাদের মৌল বিধিগুলো আরও ব্যাপকভাবে পালন করা হয়েছে।

৪৪ শতাংশ বিশ্বাস করে জেসাস ক্রাইস্টের মাধ্যমেই নিষ্কৃতি এসেছে।

৩০ শতাংশ নিজেদের ‘পুনর্জন্মলাভকারী’ হিসাবে বর্ণনা করেছে।

২৮ শতাংশ বিশ্বাস করে বাইবেলের প্রতিটি শব্দ আক্ষরিকভাবেই পড়তে হবে।

২৭ শতাংশ বাইবেলে বৈজ্ঞানিক বা ঐতিহাসিক ভ্রান্তি থাকার বিষয়টি অস্বীকার করেছে।১১০

আমেরিকান মৌলবাদের সাফল্য সম্পূর্ণ জেরি ফলওয়েল ও অন্য টেলিভেঞ্জালিস্টদের দক্ষ বিপনন কার্যক্রমের ফলে হয়নি। আমেরিকান সংস্কৃতি ও ধর্মীয় জীবনে ধর্মবিশ্বাসের এই অক্ষরবাদী ধরনের উপাদানের অস্তিত্ব ছিল, যা এক উর্বর ভূমির যোগান দিয়েছে।১১১

১৯৮০-র দশকে অবশ্য মৌলবাদ এক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছিল। কোনও প্রেসিডেন্টের হত্যাকাণ্ড ঘটেনি, বা সন্ত্রাসী কোনও অভিযানের ব্যাপার ছিল না। তার বদলে মৌলবাদী আদর্শ চরিত্রগতভাবে বিধ্বংসী ও নিহিলিস্টিক এক কেলেঙ্কারীর কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, টেলিভেঞ্জালিস্টদের তা তুচ্ছতা, অর্থ-লুণ্ঠন ও যৌন ষড়যন্ত্রের এক অথৈ সাগরে নিক্ষেপ করেছিল। ১৯৮৭ সালের টেলিভিশন কেলেঙ্কারীর পেছনে আমেরিকান মৌলবাদের প্রকৃতির কোনও অবদান সংক্রান্ত কিছু কি ছিল?

মতবাদের ক্রিশ্চান উদ্বেগের কারণে প্রটেস্ট্যান্ট মৌলবাদ আমাদের বিবেচিত অন্যান্য আন্দোলন থেকে এক ভিন্ন দিক গ্রহণ করেছিল। অনুশীলনের উপর ইহুদি ও মুসলমিদের গুরুত্ব আরোপের মানে ছিল এই দুটি ধর্মের মৌলবাদীরা তাদের ঐতিহ্যের মিথকে আদর্শে পরিণত করেছে। এইসব মিথলজিকে বাস্তব জাগতিক কর্মকাণ্ডে প্রয়োগের প্রয়াস পেয়েছিল বলেই তাদের কোনও কোনও বাড়াবাড়ির ঘটনা ঘটেছিল। তারা দক্ষতার আধুনিক মানদণ্ডকে অর্জন করতে চেয়েছে, যেখানে কোনও ‘সত্য’কে গুরুত্বের সাথে নিতে হলে তাকে কার্যকর হতে হয়। ইহুদি ও মুসলিম মৌলবাদীরা বাস্তব ফল অর্জনের জন্যে তাদের মিথোইকে বাস্তব লোগোইতে পরিণত করেছিল। প্রটেস্ট্যান্ট মৌলবাদীরা মিথকে ভিন্নভাবে বিকৃত করেছে। তারা ক্রিশ্চান মিথকে বৈজ্ঞানিক সত্যে পরিণত করে এমন এক সংকরের সৃষ্টি করেছিল যা ভালো বিজ্ঞান বা ভালো ধর্মের কোনওটাই নয়। এটা গোটা আধ্যাত্মিকতার ট্র্যাডিশনকে পাল্টে দিয়েছে; ফলে বিরাট চাপের সৃষ্টি হয়েছে, কারণ ধর্মীয় সত্য প্রকৃতিগতভাবে যৌক্তিক নয় এবং তাকে বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণ করাও সম্ভব নয়। প্রটেস্ট্যান্ট মৌলবাদীরা স্বজ্ঞামূলক ও অতীন্দ্রিয়কে উপেক্ষা করতে চায় বলে তারা অবচেতন, ব্যক্তিত্বের গভীরতর প্রবণতার সাথে সম্পর্কও হারিয়ে ফেলেছিল। এর ফলে আমেরিকান পুনর্জাগরণ অনেক সময় অরাজক ও উন্মাদসুলভ ছিল। ১৯৮০-র দশকের শেষের দিকে কোনও কোনও মৌলবাদী এই যৌক্তিক ধর্মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার জন্যে তৈরি হয়েছিল। আমরা যেমন দেখেছি, যৌনতা মৌলবদীদের পক্ষে সমস্যা-সঙ্কুল ছিল, তাদের অনেককেই সক্ষমতা ও লিঙ্গ সীমা সম্পর্কে উদ্বিগ্ন মনে হয়েছে। সম্ভবত বিদ্রোহ শুরু হওয়ার পর সেটার যৌন রূপ পরিগ্রহ করার ব্যাপারটি বিস্ময়কর ছিল না।

টেলিভিশন ও এর সাথে অনেক সময় দেখা দেওয়া গণতোষামোদ আধ্যাত্মিকভাবে অসতর্কদের পক্ষে ফাঁদ হয়ে দাঁড়ায়। ব্যক্তিত্বের কাল্টে সংশ্লিষ্ট নার্সিসিজম আধ্যাত্মিক অনুসন্ধানকে বৈশিষ্ট্যায়িত করা অহমকে অতিক্রম করার সাথে কেবল বেমানানই নয়, বরং টেলিভেঞ্জালিস্টরা বাস্তবের সাথেও সম্পর্ক খোয়াতে পারেন। সফল নেটওয়ার্কগুলো যে বিপুল অংকের টাকাকড়ির মালিক হতে পেরেছিল তার সাথে পার্থিব সম্পদ পুঞ্জীভূত করার প্রয়াস ত্যাগের গস্পেল দাবি খাপ খায় না। উত্তর ক্যারোলিনার পিটিএল (প্রেইজ দ্য লর্ড অ্যন্ড পিপল দ্যাট লাভ)-এর জিমি ও টামি ফেই বেকার তাদের অতি বিলাসী জীবনযাত্রার কারণে বিরূপ সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন। শার্লোট অবজার্ভার বেশ কয়েক বছর ধরে বলে আসছিল যে, দর্শকদের উৎসর্গ করা ও টাকাপয়সা দরিদ্রদের বিলিয়ে দেওয়ার তাগিদ দিলেও বেকারদ্বয এক ওশান ফ্রন্ট কন্ডোমিনিয়ামের পেছনে ৩৭৫,০০০ ডলার ও মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত উঁচু আয়নার পেছনে ২২,০০০ ডলার খরচ করেছেন।১১২ এসবই লিঞ্চবার্গের জেরি ফলওয়েলের গোষ্ঠীর চেয়ে দুরস্ত, সংযম ও আত্মনিয়ন্ত্রণই যার বৈশিষ্ট্য।

বেকারদ্বয় প্রধানত তাদের ক্রিশ্চান থিম পার্ক হেরিটেজ ইউএসএ-র জন্যে পরিচিত, ডিজনি কায়দায় আমেরিকায় ইভাঞ্জেলিকাল অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছে, বিপুল সংখ্যক দর্শককে তা আকৃষ্ট করেছে। এক কৌতূহলোদ্দীপক নিবন্ধে আমেরিকান নৃতত্ত্ববিদ সুসান হার্ডিং বলেছেন, বেকারদ্বয় খুবই সচেতনভাবে ফলওয়েলের সাধারণ জ্ঞানের ধার্মিকতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে মৌলবাদকে এক নতুন উত্তর আধুনিক পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছেন।১১৩ উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিক থেকেই আমেরিকান মৌলবাদীরা আধুনিকতার চ্যলেঞ্জের প্রতি তাদের বিশ্বাসকে সম্পূর্ণ যৌক্তিক করে তোলার মাধ্যমে সাড়া দিয়ে এসেছে। তারা যুক্তির গুণ ও কাণ্ডজ্ঞানের উপর জোর দিয়েছে; কল্পনা ও ফ্যান্টাসিকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া এক ধরনের শোভন অক্ষরবাদকে আলিঙ্গন করেছে; বিশ্বকে একটি আবদ্ধ কক্ষে পরিণত করেছে তারা যেখানে সত্যি ভ্রান্তি থেকে একেবারেই ভিন্ন ও স্পষ্ট, সত্যিকারের বিশ্বাসীরা সেক্যুলারিস্ট ও উদার ক্রিশ্চানদের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের। বিচ্ছিন্নতার নীতি ছিল তাদের; মৌলবাদীরা এমন এক প্রতি-সংস্কৃতি গড়ে তুলেছিল যার ঈশ্বরহীন মূলধারা যা নয় তার সবই হওয়ার কথা ছিল: এটা এমন এক বিশ্বাস যা সন্দেহ, উন্মুক্ত প্রশ্ন ও আধুনিক বিশ্বের পরিবর্তনশীল ভূমিকা চ্যালেঞ্জ করতে ইস্পাত কঠিন নিশ্চয়তা ও ক্ষমতাক্রমের যোগান দেয়। হেরিটেজ ইউএসএ অবশ্য অন্যান্য প্রাক আধুনিক সংস্কৃতির মতো বিভিন্ন ঘরানা, নাটক, আমোদ ও জাঁকাল দৃশ্য দিয়ে বৈশিষ্ট্যায়িত ছিল।

ধর্মবিশ্বাসকে যৌক্তিক ও বৈজ্ঞানিক করে তুলে মৌলবাদীরা ধর্মকে অস্বাভাবিক চেহারা দিয়েছিল। প্রকল্প ও স্বাধীন অনুসন্ধান ভিত্তিক ডারউইনের বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার সময় মৌলবাদীরা যেমন বেকনিয় আদর্শ আঁকড়ে ছিল ঠিক তেমনি এখন বেকারদ্বয় ফলওয়েলদের মতো প্রাচীনপন্থী মৌলবাদীদের যুক্তিবাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করছিলেন। হার্ডিং যেমন দেখিয়েছেন, আমেরিকান ইতিহাসের বর্ণনায় হেরিটেজ ইউএসএ বিচিত্র মিশ্রণে বিভিন্ন ধরনের একটা মিশেল। সত্য বাস্তবভিত্তিক বলে জোর দেওয়ার বদলে হেরিটেজ ইউএসএ-র প্রদর্শন সামগ্রীগুলো পার্কে তাদের কৃত্রিম ও অস্বাভাবিক সংযোজন তুলে ধরে। শপিং মল ছিল ভিক্টোরিয়ান ও উপনিবেশিক স্থাপত্যের জগাখিঁচুরি, স্টাইল ও কালের সারগ্রাহী মিশ্রণ যা সত্য প্রতিপাদনের কোনও প্রয়াস পায়নি। প্রবেশ পথে বিলি গ্রাহামের ‘আসল’ আবাস প্রদর্শিত হয়েছে, কিন্তু আদি স্থান থেকে স্থানান্তরের অংশ হিসাবে তার দেয়ালে থিম পার্কে এর ভাঙা ও পুনর্নির্মাণের ছবি ছিল। জেরুজালেমের উপরের কামরার একটা ‘হুবহু’ প্রতিলিপি রয়েছে (যেখানে জেসাস লাস্ট সাপারে অংশ গ্রহণ ও ইউক্যারিস্ট সূচনা করেছিলেন বলে বিশ্বাস করা হয়), কিন্তু ইচ্ছা করেই একে রিপ্রোডাকশনের মতো তৈরি করা হয়েছে। এক টেলিভিশন স্টুডিওতে চার্চ সার্ভিস অনুষ্ঠিত হত, আর ফলওয়েলের বিপরীতে বেকরদ্বয় কখনওই নিয়মিত কমিউনিয়ন সার্ভিস বা সারমন সম্প্রচারের ব্যবস্থা করেননি। সবসময়ই আক্ষরিক মৌলবাদী বিশ্বের চেয়ে পারফরম্যান্স, দর্শন ও ফ্যান্টাসির উপর জোর দেয়া হয়েছে।

হার্ডিং মত প্রকাশ করেছেন যে, বেকারদ্বয় ঈশ্বরের অন্তহীন ভালোবাসার উপর জোর দিলেও এক অন্তহীন ক্ষমার লোকজ ধর্মতত্ত্বও গড়ে তুলছিলেন, যা আগেই স্বর্গীয় ক্ষমার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে বলে প্রায় পাপকে নাকচ করার মতোই ছিল। ১১৪ আমরা দেখেছি, অতীতে নৈতিকতা বিরোধী বিদ্রোহ অনেক সময় ক্রান্তিকালেই সূচিত হয়েছে। কোনও কোনও বিশ্বাসীর কাছে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে প্রাচীন নিয়ম ও জীবনধারা মানানসই বোধ হয় না, নিজেদের রুদ্ধ ভেবে নতুন কিছুর আকাঙ্ক্ষা করে তারা। প্রাচীন টাবু লঙ্ঘন করে স্বস্তি পায়। অনেকে এমনকি ‘পবিত্র পাপে’র মতো ধর্মতত্ত্বও গড়ে তুলেছে। ১৯৮১ সালের মার্চে জাতিকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখা কেলেঙ্কারীর সংবাদ প্রকাশ পাওয়ার পর মনে হয়েছিল এই ধরনের কিছু একটা পিটিএল বলয়েও ঘটে থাকতে পারে। শার্লট অবজার্ভার অভিযোগ তোলে যে ১৯৮০ সালে জিম বেকার লং আইল্যান্ডের এক চার্চ সেক্রেটারি জেসিকা হানকে মাদক সেবণ করিয়ে বলাৎকার করার পর তার মুখ বন্ধ রাখতে ২৫০,০০০ ডলার দিয়েছেন।১১৫ এই পর্যবেক্ষণের পথ বেয়েই জানা যায় যে ট্যামি ফেই কান্ট্রি ও ওয়েস্টার্ন সিঙ্গার গ্যারি প্যাক্সটনের প্রতি এতটাই আসক্ত হয়ে উঠেছিলেন যে বিয়ে বিচ্ছেদ ঘাটিয়েছিলেন তিনি। এমনি নোংরা সত্য প্রকাশ পেলেও বেকারদ্বয় অবশ্য গ্লানিতে কুকড়ে যাননি, বরং তাদের বিশাল টেলিভিশনে ঈশ্বরের ভালোবাসা ও ক্ষমার কথা বলে জনগণের সামনে অনুশোচনা করেছেন।

লিঞ্চবার্গে ফলওয়েলের গোষ্ঠীর রক্ষণশীল প্রাক আধুনিক ধর্মের বিধিনিষেধ আঁকড়ে থাকার প্রয়াস ছিল; মানুষকে প্রয়োজনীয় সীমাবদ্ধতা মেনে নিতে সাহায্য করেছে। এইসব বিধিনিষেধ সম্পূর্ণ নাকচ করে দেওয়া হলে কী ঘটে বেকারদের কাহিনী সেটাই তুলে ধরে। অন্য মৌলবাদী আন্দোলন যেখানে দমনের অভিজ্ঞতা থেকে উদ্ভুত হয়েছে, বেকারদের উত্তর আধুনিক ক্রিশ্চানিটি বিংশ শতাব্দীর শেষপাদের ‘সবকিছুই চলা’র বিশ্বাস তুলে ধরেছে। হাতে বিপুল পরিমাণ অর্থ থাকায় বেকাররা মনে করেছিলেন তাঁরা যা ইচ্ছে করতে পারেন। কোনও সীমা নেই, হেরিটেজ ইউএসএ সত্য ও কল্পনার মতোই ভালো-খারাপের প্রাচীন শ্রেণী বিভাগ অনায়াসে মুছে ফেলা সম্ভব। খৃস্টধর্মের বিকৃতি তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

এরপর নতুন আতঙ্ক আলোর মুখ দেখে। জিম বেকার পিটিএল থেকে ইস্তফা দেন এবং জেরি ফলওয়েলকে সাময়িক কেয়ার টেকারের ভূমিকা পালন করে নেটওয়ার্কটিকে বাঁচাতে বলেন। জিম এরপর কেলেঙ্কারী ফাঁসকারী জিমি সোয়াগার্টের উপর চড়াও হয়ে বলেন যে, সোয়াগার্ট পিটিএল দখল করে নেওয়ার ষড়যন্ত্র করছিলেন। সোয়াগার্ট তাঁর দিক থেকে বিধিনিষেধ লঙ্ঘনের কাজ করে যাচ্ছিলেন। এই সময় সোয়াগার্ট সম্ভবত সবচেয়ে সফল টেলিভেঞ্জালিস্ট ছিলেন। ১৪৫টি দেশে তাঁর শো প্রদর্শিত হওয়ার দাবি ছিল তাঁর, পৃথিবীর অর্ধেক বাড়িতেই দেখা যায়। কিন্তু লুইসিয়ানার বাটন রঁশে এক পতিতার বাড়িতে যাতায়াত শুরু করেছিলেন তিনি। পরে গল্প বিক্রি করে দেওয়া এই মহিলা এটা স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, সোয়াগার্ট আচরিক অসম্মান ও অমর্যাদা করার চেয়ে যৌনতায় কম আগ্রহী ছিলেন। তিনি আত্মবিনাশকেও আলিঙ্গন করছিলেন বলে মনে হয়েছে, কারণ তিনি জানতেন মোটেলে লোকে তাঁকে দেখেছে ও চিনতে পেরেছে, কিন্তু তারপরেও সবকিছু ভেঙে পড়ার আগ পর্যন্ত সেখানে যাওয়া অব্যাহত রেখেছেন। আরেক যাজক মারভিন গোরমান মারফত তাঁর অসঙ্গত আচরণ ফাঁস হয়েছিল, নিজের শোতে তাঁকে আক্রমণ করেছিলেন সোয়াগার্ট ১১৬

সোয়াগার্ট পেন্টাকোস্টালিস্ট ছিলেন। আগের দিনে পেন্টাকোস্টালিজম ছিল মৌলবাদের সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুর, যুক্তিকে পাশ কাটিয়ে স্বর্গীয় সত্যকে অনির্বচনীয়তা দেওয়ার প্রয়াস। সুতরাং, যুক্তি বিসর্জন দেওয়ার সাথে সম্পর্কিত অবচেতনে প্রবেশের শৃঙ্খলাহীন বিপদকে আলিঙ্গন করার ঝুঁকি সব সময়ই ছিল। কিন্তু সর্বোচ্চ অবস্থায় আদি পেন্টাকোস্টালিজম অন্তর্ভুক্তি ও জাতিগত ও শ্রেণী বিভেদের সহানুভূতিপূর্ণ ভাঙন দিয়ে বৈশিষ্ট্যায়িত হয়েছিল। তবে সোয়াগার্ট ঘৃণার আদর্শ প্রচার করেছেন। সমকামীদের বিরুদ্ধে জঘন্য ভাষায় মুখখিস্তি করে বিখ্যাত হয়েছিলেন তিনি, প্রায় নিশ্চিতভাবেই নিজস্ব যৌন প্রবণতা সম্পর্কিত অবদমিত উদ্বেগই তুলে ধরেছে। তিনি অন্যান্য যাজক ও প্রতিদ্বন্দ্বী ইভাজেঞ্জালিস্টদের উপরও ভীষণভাবে চড়াও হয়েছিলেন, মরাল মেজরিটির জাজমেন্টাল ক্রুসেডেও যোগ দিয়েছিলেন। দয়া ও যুক্তির শৃঙ্খলার কারণে আরোপিত সংযম ঝেড়ে ফেলে সোয়াগার্ট এমন এক ধার্মিকতা বেছে নিয়েছিলেন যা আমাদের বিবেচিত অন্যান্য কিছু আন্দোলনের মতো নিজস্ব দিক থেকে আত্মবিনাশী ও নিহিলিস্টিক।

আমেরিকান সাংবাদিক লরেন্স রাইট সোয়াগার্টের আবেগময় প্রচারণার কায়দায় আকৃষ্ট বোধ করেছিলেন। তাঁর মনে হয়েছে সোয়াগার্ট যৌক্তিক আধুনিকতার কঠোরতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করছেন। এটা ‘উদ্ধতভাবে আবেগময়’ ছিল, রাইটের ছেলেবেলার ধর্মের ‘উষর বুদ্ধিবৃত্তিক পরিশোধন’ থেকে আলোক বর্ষ দূরে। তিনি আবিষ্কার করেছিলেন, তাঁর একটা অংশ সোয়াগার্টের ‘আমার নিজস্ব ব্যস্ত, বিচারিক, পরিহাসময় মানসিকতার পরমানন্দময় পরিত্যাগের’১১’র প্রতি আকর্ষণ বোধ করেছে। এবং সোয়াগার্টের দর্শকরাও তাই, যারা তাঁর অর্গাজিমিক প্রাচরণায় তুরীয় আনন্দে সাড়া দিয়েছিল:

নিজের অবচেতনের গভীর থেকে গভীরে ডুবে যান তিনি, যুক্তি ও সচেতন অর্থকে পাশ কাটিয়ে গভীরে বুদ্বুদ তুলতে থাকা ছিন্নভিন্ন আবেগ, অবদমিত ভীতি ও নামহীন আকাঙ্ক্ষায় অবতরণ করেন। তাঁর কণ্ঠস্বর ওঠানামা করতে থাকে, কাঁপে, তাঁর ব্যাকরণ বিধ্বস্ত হয়ে যায়, কিন্তু তারপরেও আকাঙ্ক্ষার ভীতু কাঁচা স্নায়ু বেয়ে উঠে যান। তিনি জানেন সেটা কোথায় থাকে। লোকে তাঁকে টানা ভীতি ও আকাঙ্ক্ষা নিয়ে দেখে, কারণ এই স্নায়ুই বিশ্বাসের সাথে বাঁধা। ভালোবাসা ও উদ্ধার পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা-তিনি শেষে যখনই স্নায়ু স্পর্শ করেন, তখনই অশ্রু বইতে শুরু করে, দর্শক হাত তুলে উঠে দাঁড়ায়, কাঁদে, প্রভুর তারিফ করে, অজানা ভাষায় কথা বলতে থাকে, আর এই রোমাঞ্চকর পাবলিক এক্সপোজারের আনন্দ ও বেদনায় কাঁপতে থাকে। ১১৮

জন অভ দ্য ক্রস, ইসাক লুরিয়া বা মোল্লাহ সদরার মতো সেরা প্রাক আধুনিক আধ্যাত্মিকতা এর সাথে ধর্মের কোনওই সম্পর্ক নেই দাবি করে এই ধরনের আবেগীয় বাড়াবাড়ি এড়িয়ে গেছেন; তাঁরা জোর দিয়ে বলেছেন, অন্তস্থঃ যাত্রা ছিল শান্ত, শৃঙ্খলিত এবং যুক্তি দিয়ে সম্পূর্ণ। অন্তত চল্লিশ বছর বয়স এবং বিবাহিত না হওয়া পর্যন্ত কাউকেই কাব্বালায় যোগ দানের অনুমতি দেওয়া হত না, তাকে যৌন ভারসাম্য অর্জন করতে হত। জ্ঞানের অধিকতর স্বজ্ঞাপ্রসূত পথ অবহেলাকারী আধুনিক বিশ্ব অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই অতীন্দ্রিয় লোককথা হারিয়ে ফেলেছে। সোয়াগার্টের সাফল্য এক অতি যৌক্তিক বিশ্বে লোকের পরমানন্দের জন্যে আকাঙ্ক্ষা তুলে ধরে, তবে আবার এই ধরনের অনুসন্ধানের ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ার বিষয়টিও তুলে ধরেছে। সোয়াগার্টের উন্মাদনার সাথে আধ্যাত্মিকতার চেয়ে তাঁর যৌন চাহিদারই বেশি সম্পর্ক ছিল বলে মনে হয়, যা তাঁকে বাটন রুশ মোটেলে (ভিন্ন প্রেক্ষাপটে রাইটের ভাষা ব্যবহার করে বলা যায়) ‘রোমাঞ্চকর পাবলিক এক্সপোজারে’র দিকে ঠেলে দিয়েছিল।

কিন্তু তারপরেও মৌলবাদী বিশ্বাসের ব্যর্থতা কেলেঙ্কারীর সময় টেলিভেঞ্জালিস্টদের পরস্পরের প্রতি প্রদর্শিত ক্রোধ ও ঘৃণার চেয়ে অন্য কোনও কিছুতেই এত স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠেনি। জেসিকা হানের সাথে বেকারের যৌন সম্পর্কের খবর পাওয়ার পর সোয়াগার্ট ‘ফ্রেঞ্চ পুডলের উপর পিট বুলডগের মতো জিমি বেকারের উপর হামলে পড়েছিলেন,’ স্মৃতিচারণ করেছেন সোয়াগার্টের এক সাবেক সহকারী। ‘স্রেফ তাঁকে ছিঁড়ে কুটিকুটি করে ফেলেছেন। ১১৯ এরপর পিটিএলকে উদ্ধার করতে এগিয়ে আসা জেরি ফলওয়েলের উপ চড়াও হন বেকার, তাঁর বিরুদ্ধে নেট ওয়ার্কের নিয়ন্ত্রণ পেতে পরিস্থিতিকে কাজে লাগানোর অভিযোগ আনেন। সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে এর প্রতিশোধ নেন ফলওয়েল, এখানে জি বেকারের সাথে সমকামী সম্পর্ক ছিল এমন দাবিদারদের শপথ গ্রহণের পর দেওয়া এফিডেফিট উপস্থাপন করেন তিনি, তার সাথে ট্যামি ফেইর একটা চিরকুট, চুপ থাকার জন্যে পিটিএল-এর কাছে থেকে তিনি কী পেয়েছেন তার একটা তালিকা: জিমের জন্যে বছরে ৩০০,০০০ ডলার, ও নিজের জন্যে ১০০,০০০ ডলার; পিটিএল-এর সব রেকর্ড ও বইয়ের রয়্যালটি; ওদের ৪০০,০০০ ডলারের ম্যানশন, দুটি গাড়ি, নিরাপত্তা প্রহরী, আইনি ফি, এবং সেই সাথে বেকারদের দারুণভাবে অনিয়মিত আর্থিক অবস্থাকে সামাল দেওয়ার প্রয়াসরত অ্যাকাউন্ট্যান্টদের পারিশ্রমিক। মহা মৌলবাদী প্রতিষ্ঠানটি যেন এক বন্ধ্যা, রুচিহীন কুল-দে-স্যাকে পরিণত হয়েছিল। কেলেঙ্কারীর আগের বছর আস্থায় পরিপূর্ণ ছিলেন ফলওয়েল। মরাল মেজরিটির নতুন রাম রেখেছিলেন, ‘দ্য লিবার্টি ফেডারেশন’ এবং এর বহু সদস্য ১৯৮৮ সালের নির্বাচনে স্থানীয়, রাজ্য ও ফেডারেল পর্যায়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু পিটিএল বিপর্যয়ের পর ১৯৮৭ সালের ৪ঠা নভেম্বর মরাল মেজরিটি ও লিবার্টি ফেডারেশন-এর প্রেসিডেন্সি থেকে ইস্তফা দেন ফলওয়েল; তাঁর রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যাবার ঘোষণা দেন। রোনাল্ড রেগানের বেলায় যেমন করেছিলেন সেভাবে আর কখনওই কোনও প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর পক্ষে কাজ করবেন না ও কোনও আইনের পক্ষে লবি করবেন না। কেলেঙ্কারীর পথ ধরেই তাঁর নিজস্ব ওল্ড টাইম গস্পেল আওয়ারের আয় কমে যায়, তাঁর নিজস্ব গস্পেল মিনিস্ট্রিতে ফিরে যেতে বাধ্য হন ফলওয়েল।১২০ আজও মাঝে মাঝে জাতির অসুস্থতা নিয়ে বিলাপ করার জন্যে আবির্ভূত হন বটে, কিন্তু ঝড়ের বেগে আমেরিকাকে দখল করে নেওয়ার মতো ধর্মীয় রক্ষণশীলদের একটা আসন্ন কোয়ালিশন গড়ে তোলার মতো আশা করতে পারেন না। প্যাট রবার্টসনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দাঁড়ানোর প্রয়াস ব্যর্থ হলে ১৯৭৯ সালে সূচিত মৌলবাদী আক্রমণও ব্যর্থ হয়েছে বলে মনে হয়। অপদস্থ নিউ ক্রিশ্চান রাইট অমর্যাদাকরভাবে উবে গেছে বলে মনে হয়েছে। ক্রিশ্চানরা ব্যক্তিগতভাবে ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে আনার চেষ্টা ও লবি করে গেলেও সাধারণভাবে মৌলবাদী হুমকির অবসান ঘটেছে বলেই ধরে নেওয়া হয়।

অবশ্য, মৌলবাদের মৃত্যু ঘটেনি। সত্যি বলতে অমেরিকায় তা এক নতুন ও চরম পর্যায়ে প্রবেশ করেছে। ২৮শে নভেম্বর, ১৯৮৭, আপস্টেট নিউ ইয়র্কের এক নবজন্ম লাভকারী ক্রিশ্চান র‍্যান্ডাল টেরি তিন শো ‘উদ্ধারকারীকে’ নেতৃত্ব দিয়ে নিউ জার্সির চেরি হিলের এক অ্যাবর্শন ক্লিনিকে নিয়ে আসে। এখানে প্রায় এগার ঘণ্টা ধরে প্রার্থনা, শ্লোক গাওয়া এবং মহিলাদের ক্লিনিকে প্রবেশে বাধা দিয়ে তাদের বর্ণনা মতে ‘নরকের দ্বারপ্রান্তে’ ধর্মসভার আয়োজন করে। দিন শেষে ‘উদ্ধারকারীদের’ ২১১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়, তবে বিজয়ীর সুরে উল্লেখ করে টেরি, ‘কোনও শিশু প্রাণ হারায়নি। ১২১ এটা ছিল মূলধারার সংস্কৃতিকে সহজাতভাবে খুনে বর্ণনা করে এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণাকারী অপারেশন রেসকিউর প্রথম অ্যাকশন। ইমেজারি ছিল জঙ্গী। ১৯৮৮ সালে আটলান্টায় ডেমোক্রেটিক কনভেনশনের সময় এই আন্দোলনটি টেরির ভাষায় ‘আটলান্টা অবরোধ’ শুরু করেছিল, তখন শহরের অ্যাবরশন ক্লিনিকে প্রবেশে বাধা দানের অপরাধে তের শোরও বেশি বিক্ষোভকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। তখন থেকেই কানাডা ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে উদ্ধার দিবস পালন করে আসছে তারা এবং সম্ভাব্য উদ্ধারকারীদের জন্যে নারীবাদ ও উদার সরকারের অশুভের উপর ও তাদের লবিং কৌশল শেখাতে প্রশিক্ষণ লেকচারের ব্যবস্থা করেছে। নিজেদের ‘অপারেশনকে তারা ‘বাইবেলিয় ঔদ্ধত্য’ বলে বর্ণনা করেছে। ফলওয়েল ও রবার্টসনের বিপরীতে আইনের বাইরে গিয়ে কাজ করতে প্রস্তুত ছিলেন টেরি। তাঁর লক্ষ্য ছিল মৌলবাদী: এমন এক ‘রাষ্ট্র গড়ে তোলা যেখানে আবারও জুডো-ক্রিশ্চান নীতি আমাদের রাজনীতি, আমাদের বিচার ব্যবস্থা ও আমাদের সরকারী নৈতিকতার ভিত্তি হবে; মানবতাবাদের অনিশ্চিত সাগরে ভাসমান কোনও জাতি নয়, বরং এমন এক দেশ ‘হাইয়ার ল’ যার অটল তলদেশ।’

কেবল অ্যাবরশন নিয়েই অভিযান ছিল না, ঠিক যেমন স্কোপস ট্রায়াল স্রেফ বিবর্তন সংক্রান্ত ছিল না। ১৯২০-র দশকের উইলিয়াম জেনিংস ব্রায়ানের মতো টেরি ও তাঁর উদ্ধারকারীদের বিশ্বাস ছিল যে, তাঁরা সেক্যুলার আধুনিকতার সবচেয়ে নিষ্ঠুর প্রকাশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছেন। টেরি বিশ্বাস করেছেন যে, অপারেশন রেসকিউ সফল না হলে, ‘আমেরিকা টিকে থাকবে না।’ কিন্তু আত্মবিশ্বাসী ছিলেন তিনি: ‘আমাদের রয়েছে জনগণের সেনাদল,’ জোর দিয়েছেন তিনি, এবং এই অপারেশনের ফলে “শিশু হত্যা হ্রাস পাবে, শিশু নীল ছবি ও নীল ছবি, ইচ্ছা মৃত্যু, শিশু হত্যাকে অনুসরণ করবে…আমরা সংস্কৃতিকে আবার ফিরিয়ে নেব। ১২২ এটা ছিল আসন্ন বিপর্যয়কে প্রতিহত করে আমেরিকার সভ্যতাকে উদ্ধার করার লড়াই।

টেক্সাসের অর্থনীতিবিদ গ্যারি নর্থ ও তাঁর শ্বশুর রোউসাস জন রাশদুনি প্রতিষ্ঠিত রিকনস্ট্রাকশন আন্দোলনও সেক্যুলার মানবতাবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত ছিল, তবে মরাল মেজরিটির চেয়ে ঢের বেশি চরম রূপে। পুনর্গঠনবাদীরা আরও অধিকতর উদ্দীপ্তকারী আদর্শের খাতিরে প্রাচীন প্রিমিলেনিয়াল নৈরাশ্যবাদ বিসর্জন দিয়েছিল। মুসলিম মৌলবাদীদের মতো নর্থ ও রাশদুনি মূলত ঈশ্বরের সার্বভৌমত্ব নিয়েই উদ্বিগ্ন ছিলেন। এমন একটি ক্রিশ্চান সভ্যতা প্রতিষ্ঠা করতে হবে যা অবশ্যই শয়তানকে পরাস্ত করে মিলেনিয়াল রাজ্যের উদ্বোধন ঘটাবে। পুনর্গঠনবাদের মূল ধারণা ছিল আধিপত্য। ঈশ্বর অ্যাডাম ও পরে নোয়াহকে বিশ্বকে পরাস্ত করার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। ক্রিশ্চানরা উত্তরাধিকারসূত্রে এই নির্দেশ লাভ করেছে, ক্রাইস্টের দ্বিতীয় আগমনের আগেই পৃথিবীর বুকে জেসাসের শাসন কায়েমের দায়িত্ব রয়েছে তাদের উপর। তবে ঈশ্বর যেহেতু আধুনিক রাষ্ট্রকে এক ভয়াবহ বিপর্যয়ের মাধ্যমে ধ্বংস করে দেবেন তাই এটা অর্জনের জন্যে ক্রিশ্চানের কোনও তৎপরতা চালাতে হবে না। ক্রিশ্চানরা স্রেফ ঈশ্বরের দেওয়া বিজয় লুফে নেবে।

ইতিমধ্যে পুনর্গঠনবাদীরা সেক্যুলার রাষ্ট্র ধ্বংস হয়ে যাবার পর অধিকার করে নেওয়ার জন্যে নিজেদের প্রশিক্ষিত করে তুলছে।১২৩ সহানুভূতির রীতি বিসর্জনের ভেতর দিয়ে তাদের এই দৃষ্টিভঙ্গি ক্রিশ্চান ধর্মের সম্পূর্ণ বিকৃতিতে পরিণত হয়েছে। রাজ্যের আগমন ঘটার পর চার্চ ও রাষ্ট্রের আর কোনও বিভাজন থাকবে না। গণতন্ত্রের আধুনিক ধর্মদ্রোহীতার বিনাশ ঘটবে এবং কঠোর বাইবেলিয় ধারায় সমাজ নতুন করে সংগঠিত হবে। এর মানে বাইবেলের প্রতিটি আইনকে আক্ষরিকভাবে প্রয়োগ করতে হবে। দাস প্রথা সূচিত হবে; জন্মনিয়ন্ত্রণ থাকবে না (কারণ বিশ্বাসীদের অবশ্যই ‘বৃদ্ধি ও বহুগুন’ হতে হবে); ব্যাভিচারী, সমকামী, ব্লাসফেমাস, জ্যোতির্বিদ ও ডাইনীদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে। বাইবেল যেমন নির্দেশ দিয়েছে, অবিরাম অবাধ্য শিশুদের পাথর ছুঁড়ে হত্যা করতে হবে। কঠোর পুঁজিবাদী অর্থনীতি আরোপ করতেই হবে; সমাজবাদী ও বামপন্থার দিকে যারা ঝুঁকে আছে তারা পাপী। ঈশ্বর দরিদ্রদের পক্ষে নন। প্রকৃতপক্ষে, নর্থ যেভাবে ব্যাখ্যা করেছেন, দুষ্কৃতি ও দারিদ্র্যের ভেতর নিবিড় সম্পর্ক’১২৪ রয়েছে। করের অর্থ কল্যাণমূলক কাজে ব্যবহার করা যাবে না, কারণ, ‘অলসদের ভর্তুকী দান অশুভকে ভর্তুকী দানেরই শামিল।১২৫ তৃতীয় বিশ্বের ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে, নৈতিক বিকৃতি, পৌত্তলিকতা ও ডাকিনীবিদ্যার প্রতি আসক্তির কারণেই নিজেদের উপর অর্থনৈতিক সমস্যা ডেকে এনেছে তারা। বাইবেলে বিদেশী সাহায্য নিষিদ্ধ করা হয়েছে।১২৬ বিজয়ের অপেক্ষা করার মুহূর্তে-হয়তো এখনও বেশ সময় লাগবে বলে স্বীকার করেছেন নর্থ-ক্রিশ্চানদের অবশ্যই ঈশ্বরের নীল নকশা অনুযায়ী পৃথিবীকে গড়ে তোলার জন্যে প্রস্তুত হতে হবে এবং এইসব বাইবেলিয় রীতির সাথে খাপ খাওয়া সরকারী নীতিমালার সমর্থন করতে হবে।

নর্থ ও রাশদুনির কল্পিত ডোমিনিয়ন ছিল সমগ্রবাদী। অন্য কোনও দর্শন বা নীতির কোনও স্থান নেই, প্রতিদ্বন্দ্বী দলসমূহের জন্যে গণতান্ত্রিক সহিষ্ণুতার লেশমাত্র নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই আদর্শের জনপ্রিয়তা লাভের সম্ভাবনা নিশ্চিতভাবেই ক্ষীণ; তবে বলা হয়েছে পরিবেশগত বা বড় ধরনের অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের ক্ষেত্রে একটি কর্তৃত্বপরায়ণ রাষ্ট্রীয় চার্চ আলোকনের উদার রাজনীতিকে প্রতিস্থাপিত করতে পারে। ক্রিশ্চানিটি হাজার হোক পুঁজিবাদের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে সক্ষম হয়েছিল, জেসাসের বহু শিক্ষার ক্ষেত্রেই তা আগন্তুক ছিল। ব্যাপকভাবে পরিবির্তিত পরিস্থিতিতে জনশৃঙ্খলা বজায় রাখার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ফ্যাসিস্ট আদর্শকে সমর্থনের কাজেও একে ব্যবহার করা যেতে পারে।১২৭

রাশদুনি পেন্টাকোস্টালিজমকে বিতৃষ্ণার সাথে দেখলেও অধিকতর রক্ষণশীল কিছু পেন্টাকোস্টালিস্ট রিকন্সট্রাকশন ধর্মতত্ত্বে আগ্রহ দেখিয়েছিল। প্যাট রবার্টসনকে একজন ক্রান্তিকালীন ব্যক্তিত্ব মনে হয়েছে। পেন্টাকোস্টালিজম ও পুনর্জাগরণবাদের ঝোঁক বিশিষ্ট ব্যাপ্টিস্ট ছিলেন তিনি। নর্থের মতো তাঁর বিশ্বাস ছিল যে, দ্বিতীয় আগমন দূরবর্তী হতে পারে—এই বিশ্বাস তাঁকে প্রচলিত প্রিমিলেনিয়াল মৌলবাদ থেকে আলাদা করেছিল।১২৮ রবার্টসন বিশ্বাস করতেন যে, ইতিমধ্যে ক্রিশ্চানদের বাইবেলিয় নিয়মের ভিত্তিতে একটি সমাজ গড়ে তুলতে ক্ষমতায় নিজেদের অবস্থান তৈরি করা উচিত। ১২৯ ভার্জিনিয়া বিচের তাঁর ইউনিভার্সিটির নাম পাল্টে রিজেন্ট ইউনিভার্সিটি রেখেছিলেন তিনি; রিজেন্ট হচ্ছেন, ব্যাখ্যা দিয়েছেন, “যিনি সার্বভৌমের অনুপস্থিতিতে শাসন করেন।’ কলেজটির উদ্দেশ্য রাজ্যের আগমন ঘটলে এর সাত শো ছাত্রকে দায়িত্ব নেওয়ার জন্যে তৈরি করা।১৩০ আমেরিকায় দ্য ফান্ডামেন্টালস (১৯১০-১৫) প্রকাশ পাওয়ার পর থেকেই মৌলবাদ পাল্টে গেছে। একদিকে উত্তর আধুনিক, উন্মুলতার প্রবণতা দেখানোর পাশাপাশি অন্যের সমগ্রবাদী দৃষ্টিভঙ্গিও তুলে ধরেছে।

মৌলবাদ অদৃশ্য হয়ে যাবে না। আমেরিকায় ধর্ম দীর্ঘ দিন ধরে সরকারের বিরোধী পক্ষকে আকার দিয়ে এসেছে। এর উত্থান-পতন সব সময়ই আবর্তনমূলক ছিল, এবং গত কয়েক বছরের ঘটনাপ্রবাহ দেখায় যে, এখনও রক্ষণশীল ও উদারপন্থীদের ভেতর মধ্যবর্তী যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছে, যা অনেক সময় প্রকাশ হয়ে পড়েছে। ১৯৯২ সালে এখনও প্রাচীনপন্থী মৌলবাদ আঁকড়ে থাকা জেরি ফলওয়েল ঘোষণা করেছিলেন, বিল ক্লিন্টনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার ভেতর দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শয়তানের মুক্তি ঘটেছে। ক্লিন্টন, বজ্রকণ্ঠে বলেছেন ফলওয়েল, ‘সমকামীদের’ ক্ষমতা দখল করার সুযোগ করে দিয়ে সামরিক বাহিনী ও জনগণকে ধ্বংস করে দেবেন। ফেডারেল আর্থিক সাহায্যপ্রাপ্ত ক্লিনিকে অ্যাবরশনের অনুমতি দান, ভ্রূণ টিস্যু নিয়ে গবেষণা, সমকামীদের অধিকারের সরকারী অনুমোদন “ঈশ্বরের বিরুদ্ধে আমেরিকার যুদ্ধ ঘোষণার’১৩১ আলামত।

১৯৯৩ সালে যুদ্ধে ক্ষয়ক্ষতির ঘটনা ঘটে। ১৯৯৩ সালের ২৮শে ফেব্রুয়ারি ব্যুরো অভ অ্যালকোহল, টোব্যাকো অ্যান্ড ফায়ার আর্মস টেক্সাসের ওয়াকোয় ডেভিড কোরেশের ব্রাঞ্চ ডেভিডিয়ানের সীমানায় হানা দেয়, কারণ তিনি অস্ত্র মওজুত করছেন বলে জানা গিয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে, বহু টেক্সান ও ব্রাঞ্চ ডেভিডিয়ানের মতো (সেভেন্থ ডে অ্যাডভেন্টিস্ট-এর একটি দলছুট অংশ) দর্শনীয় অস্ত্রভাণ্ডার থাকলেও সরকারের বিরুদ্ধে তাদের কোনও বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের পরিকল্পনা ছিল না বলেই মনে হয়। আক্রমণের উদ্দেশ্য ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের ক্ষমতা ও বৈধতা প্রদর্শন। কিন্তু তা উল্টো ফল দেয়। পরিণামে এফবিআই কর্তৃক চৌহদ্দী ঘেরাও হয়ে যায়, ডেভিডিয় দালানকোঠা পোড়ানো হয় ও আশিজন নারী, পুরুষ ও শিশুর মৃত্যু ঘটে। আসলে প্রদর্শিত হয়েছিল গোষ্ঠীটি সম্পর্কে সরকারের অজ্ঞতা, অবরুদ্ধ ডেভিডিয়দের সামনে নিজেদের অসহায়ত্ব এবং ঘটনাপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণের করুণ অপারগতা।

অন্যদিকে অধিকতর চরমপন্থী ক্রিশ্চানরা নিশ্চিতভাবেই সেক্যুলার সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। একটি ফ্যাসিস্ট গ্রুপ ক্রিশ্চান আইডেন্টিটি-র কথা এই গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়নি, তার কারণ তা মৌলবাদকে অনেক পেছনে ফেলে এসেছে তারা এবং প্রকৃতপক্ষে মৌলবাদকে নাকচ করে দেয়। আইডেন্টিটির সদস্যরা তুরীয় আনন্দের ধারণাকে ঘৃণা করে, তাদের বিশ্বাস এর ফলে আমেরিকান ধর্ম নপুংসক হয়ে গেছে: উত্তাল সময়ে তারা অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে অকুস্থলে উপস্থিত থাকতে চায়। ভীষণভাবে অ্যান্টি-সেমিটিক এই গোষ্ঠীটি যায়নবাদের পক্ষে মৌলবাদীদের সমর্থন ঘৃণা করে, একে তারা মহাপাপ মনে করে। তাদের দৃষ্টিতে ইহুদিরা আর্য জাতির কাছ থেকে মনোনীত জাতির উপাধী কেড়ে নিয়েছিল এবং এখন পবিত্র ভূমিও চুরি করেছে, ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের অধীনেই থাকা উচিত ছিল এর। অন্তিম কালের যুদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যে ঘটবে, এটা তারা বিশ্বাস করে না, বরং সেটা ঘটবে আমেরিকায়। এক নতুন হলোকাস্টের ভবিষ্যদ্বাণী করে তারা, এতে শ্বেতাঙ্গ জাতি ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। সুতরাং, তারা নিজেদের সেই বিপর্যয়ের জন্যে প্রস্তুত করছে। ফেডারেল সরকারের অত্যাসন্ন ধ্বংস দেখতে পাচ্ছে তারা, যাকে তারা শয়তান ও ইহুদিদের আধিপত্যে থাকা এবং আর্য জাতির ধ্বংসের লক্ষ্যে নিবেদিত যগ (যায়নিস্ট অকুপেশন গভর্নমেন্ট) আখ্যায়িত করে। কেউ কেউ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর পশ্চিম দূরবর্তী কোণে উগপন্থী গ্রুপে নিজেদের সংগঠিত করেছে। এখানে তারা আত্মরক্ষার কৌশল শেখে, অস্ত্র ও গোলাবারুদ সংগ্রহ করে ও শেষ যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়। কেউ কেউ ‘যগে’র উপর প্যারামিলিটারি হামলা চালায়, সরকারী কর্মচারীদের হত্যা করে। অন্যরা অ্যাবরশন ক্লিনিকে বোমাবর্ষণ করে, অগ্নিসংযোগ করে।১৩২ এই ধরনের আদর্শই ১৯৯৫ সালের ১৯শে এপ্রিল টিমোথি ম্যাকভেইকে ওকলাহোমা সিটিতে ফেডারেল বিল্ডিংয়ের উপর বোমা হামলায় প্ররোচিত করেছিল।

ক্রিশ্চান আইডেন্টিটির কর্মকাণ্ড ও আদর্শ চিত্রায়িত করা কঠিন। এটা কোনও একরৈখিক আন্দোলন নয়, বরং বিভিন্ন সম্পর্কিত সংগঠনের একটা মৈত্রী। এদের সদস্য সংখ্যা কম, মাত্র হাজার পঞ্চাশেক হতে পারে।১৩৩ কিন্তু প্রবণতা হিসাবে ক্রিশ্চান আইডেন্টিটি উদ্বেগজনক। মৌলবাদীদের মতো তারা ভীতি ও অসন্তোষের কারণে জগৎ থেকে পিছু হটেছে এবং আবার দখল করে নেওয়ার পরিকল্পনা করছে। অধিকাংশ চরম ধরনের মৌলবাদীর মতো এর সদস্যরা সর্বত্র ষড়যন্ত্রের গন্ধ পায় এবং ক্রোধ ও অসন্তোষের ধর্মতত্ত্ব গড়ে তোলে। কিন্তু অতি ফ্যাসিবাদী আদর্শ, মার্কিন যুক্তিরাষ্ট্রের সরকারের প্রতি খাঁটি ঘৃণা ও আধুনিক বিশ্ব থেকে প্রত্যাহারের চরম রূপের কারণে মৌলবাদীদের ছাড়িয়ে গেছে তারা। এখন আর বাইবেলিয় ভ্রান্তিহীনতা ও মতবাদ নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে ক্রিশ্চান আইডেন্টিটি আমেরিকায় নিজেদের জন্যে একটি আলাদা আর্য রাষ্ট্র সৃষ্টি করতে চায়। ক্রিশ্চান আইডেন্টিটি আমেরিকার ইতিহাসে নজীরবিহীন বিচ্ছিন্নতা ও ত্রাসের আদর্শ গড়ে তুলেছে। পুনর্গঠনবাদের মতো আইডেন্টিটি সম্প্রদায়ের শিথিল কনফেডারেশনটি ছোট, কিন্তু তারপরও ভবিষ্যতে অসহায়ত্ব, হতাশা ও অসন্তোষ প্রকাশ করার জন্যে ধর্মকে ব্যবহার করার অস্বস্তিকর ইঙ্গিত। সেক্যুলারিস্ট প্রতিষ্ঠান ও মূলধারার গোষ্ঠীগুলো মনে করতে পারে যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মৌলবাদী হুমকি মিলিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু কিছু সংখ্যক ক্রিশ্চানের ধারণা মতো যুদ্ধ এখনও চলছে, ফেডারেল সরকারকে অবশ্যই ধ্বংস করতে হবে, এবং সংঘাত নিশ্চিতভাবেই একবিংশ শতাব্দীতে অব্যাহত থাকবে।

ধর্ম শেষ পর্যন্ত অদৃশ্য হয়ে যায়নি। কোনও কোনও মহলে অন্য যেকোনও সময়ের চেয়ে তা উগ্র হয়ে উঠেছে। তিনটি একেশ্বরবাদী ধর্মের সবকটাতেই মৌলবাদীরা ধর্মকে ব্যক্তি পর্যায়ে অবনত করার বা একে দমনের বিরুদ্ধে সক্রোধে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে এবং তাদের বিশ্বাস মতো একে ধ্বংস থেকে উদ্ধার করে এনেছে। কঠিন সংগ্রাম ছিল এটা এবং এই প্রক্রিয়ায় ধর্মবিশ্বাস প্রায়শঃই বিকৃত হয়েছে; এটা ধর্মের পরাজয় তুলে ধরে। কিন্তু মৌলবাদ এখন আধুনিক বিশ্বের অংশে পরিণত হয়েছে। এটা ব্যাপক হতাশা, বিচ্ছিন্নতা, উদ্বেগ ও ক্রোধ তুলে ধরে যা কোনও সরকারই নিরাপদে উপেক্ষা করতে পারে না। এই পর্যন্ত মৌলবাদের সাথে সামলে ওঠার প্রয়াস খুব একটা সফল হয়নি; অতীত থেকে আমরা কী শিক্ষা নিতে পারি যা আমাদের ভবিষ্যতে আরও সৃজনশীলভাবে মৌলবাদের ধারণ করা ভীতিকে সামাল দিতে সাহায্য করবে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *