০৬. মৌলবিষয় (১৯০০-২৫)

৬. মৌলবিষয় (১৯০০-২৫)

ফ্রান্সের ল্যান্ডস্কেপকে দুঃস্বপ্নের মতো নরকে পরিণত করা ১৯১৪ সালে ইউরোপে সূচিত মহাযুদ্ধ আধুনিক চেতনার ভয়ঙ্কর ও আত্মবিনাশী প্রবণতা তুলে ধরে। তরুণদের একটা গোটা প্রজন্ম ধ্বংস করে এই যুদ্ধ ইউরোপকে একেবারে এর মুলে ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল, যাতে সম্ভবত কোনওদিনই তা সামলে উঠতে না পারে। যুদ্ধের পর সভ্যতার অগ্রগতির ব্যাপারে কোনও চিন্তাশীল মানুষই আর ঠাণ্ডা মাথায় আশাবাদী থাকতে পারেনি। ইউরোপের সবচেয়ে সংস্কৃত অগ্রসর দেশগুলো নতুন সামরিক প্রযুক্তির সাহায্যে নিজেদের পঙ্গু করে দিয়েছিল। যুদ্ধকে যেন এমনি সম্পদ আর শক্তি এনে দেওয়া যান্ত্রিকীকরণের হীন প্যারোডি মনে হয়েছে। সৈন্যসামন্ত নিয়োগ, সেনাবাহিনী পরিবহন ও অস্ত্রশস্ত্র নির্মাণের ব্যবস্থা চালু হয়ে যাবার পর নিজস্ব গতিবেগ অর্জন করেছিল যাকে থামানো ছিল কঠিন। ট্রেঞ্চ যুদ্ধের অর্থ ও যুক্তিহীনতা যুগের যুক্তি ও যুক্তিবাদকে অগ্রাহ্য করেছে, এর সাথে মানবীয় চাহিদার কোনওই সম্পর্ক ছিল না। পাশ্চাত্যের অধিবাসীরা অনেক দশক ধরে কারও কারও প্রত্যক্ষ করে আসা শূন্যতার দিকে সরাসরি চোখ ফিরিয়েছে। পশ্চিমের অর্থনীতিতেও ধস নামতে শুরু করেছিল, ১৯১০ সালে এমনভাবে তার অবনতি ঘটতে থাকে যে তা ১৯৩০-র দশকের মহামন্দায় পর্যবসিত হবে। পৃথিবী যেন অকল্পনীয় কোনও বিপর্যয়ের দিকে ধেয়ে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছিল।। আইরিশ কবি ড, বি. ইয়েটস (১৮৬৫-১৯৩৯) ‘দ্বিতীয় আগমন’কে ন্যায়নিষ্ঠতা ও শান্তির বিজয় হিসাবে নয়, বরং বুনো অতলান্ত যুগের জন্ম হিসাবে প্রত্যক্ষ করেছেন:

সবকিছু ভেঙে পড়ে, মুল আর ধরে রাখতে পারছে না
দুনিয়ার বুকে নেমে এসেছে তুচ্ছ অরাজকতা,
রক্ত-রঙা স্রোত ধেয়ে আসছে, সর্বত্র
নিষ্কলুষতার উৎসব নিমজ্জিত হয়েছে;
সেরারাও সব বিশ্বাস খুইয়েছে, আর খারাপরা
আবেগময় প্রবল্যে পরিপূর্ণ।১

তবে শিল্পকলা ও বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এক নজীরবিহীন সৃজনশীলতা ও বিস্ময়কর সাফল্যের কালও ছিল এটা, আধুনিক চেতনার পূর্ণ বিকাশ তুলে ধরেছে তা। সকল ক্ষেত্রে সবচেয়ে সুজনশীল চিন্তাবিদগণ যেন বিশ্বকে একেবারে নতুন করে গড়ে তোলার ইচ্ছায় আচ্ছন্ন হয়েছিলেন, অতীতের সকল ধরন ছুঁড়ে ফেলে মুক্ত হতে চেয়েছেন। আধুনিক মানুষ সম্পূর্ণ ভিন্ন মানসিকতা গড়ে তুলেছিল, পৃথিবীকে আর আগের মতো করে দেখতে পারছিল না। অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতাব্দীর উপন্যাস কাজ ও কারণের শৃঙ্খলিত অগ্রগতি তুলে ধরা এক বর্ণনা কৌশল গড়ে তুলেছিল; আধুনিক বর্ণনা ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে, কী ঘটেছে বা কী ভাবতে হবে সে সম্পর্কে পাঠককে ধন্ধে ফেলে দিয়েছে। পাবলো পিকাসোর (১৮৮১-১৯৭৩) মতো চিত্রশিল্পীরা বিষয়বস্তুকে ভেঙেচুরে ফেলেন বা একই সময়ে তা দুটি ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে প্রত্যক্ষ করেন; তাঁরা যেন ইচ্ছাকৃতভাবে দর্শকের প্রত্যাশাকে তাচ্ছিল্য করছিলেন, নতুন দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োজনীয়তার কথা ঘোষণা করছিলেন। শিল্পকলা ও বিজ্ঞানে প্রাথমিক নীতিমালায়, বিভাজনের অতীত মূলে ফিরে যাওয়ার এবং এই শূন্য ভিত্তিমূল থেকে ফের শুরু করার একটা ইচ্ছা জেগে উঠেছিল। বিজ্ঞানীরা এখন অণু বা পার্টিকলের সন্ধান করছিলেন, সমাজবিজ্ঞানী ও নৃতাত্ত্বিকগণ আদিম সমাজ বা আদিম দ্রব্যসামগ্রীতে ফিরে গেছেন। এটা আদ ফন্তাসে রক্ষণশীল প্রত্যাবর্তনের মতো ছিল না, কারণ অতীতকে নতুন করে গড়ে তোলার লক্ষ্য ছিল না এখানে বরং একে চুরমার করে দেওয়ার ইচ্ছাই কাজ করেছে, অ্যাটমকে ভাঙা, সম্পূৰ্ণ নতুন কিছুকে সামনে নিয়ে আসা।

এইসব প্রয়াসের কোনও কোনওটার লক্ষ্য ছিল ঈশ্বর বা অতিপ্রাকৃত বিহীন আধ্যাত্মিকতা তৈরি। বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকের পেইন্টিং, ভাস্কর্য, কবিতা এবং নাটক ছিল এক অবিন্যস্ত পরিবর্তনশীল বিশ্বের অর্থের অনুসন্ধান; তাঁরা ধারণার উন্নত উপায় ও আধুনিক মিথ সৃষ্টির চেষ্টা করছিলেন। সিগমান্ড ফ্রয়েডের মনোবিশ্লেষণমূলক বিজ্ঞান অবচেতনের সবচেয়ে মৌলিক স্তর উন্মোচনের প্রয়াস পেয়েছে যা ছিল নতুন অন্তর্দৃষ্টি ও আধ্যাত্মিক শক্তির উৎসে প্রবেশের প্রয়াস। প্রথাগত ধর্মের প্রতি কোনও আগ্রহ ছিল না ফ্রয়েডের, একে বিজ্ঞানের লোগোসের সবচেয়ে মারাত্মক শত্রু কল্পনা ভাবতেন তিনি। তবে তিনি গ্রিকদের প্রাচীন মিথের একটা আধুনিক অর্থ খাড়া করার চেষ্টা করেছেন, এমনকি নিজস্ব পৌরাণিক কাহিনীও তৈরি করেছেন। আধুনিক অভিজ্ঞতার ত্রাস ও ভীতির অনেকটাই মানুষকে হতাশা থেকে বাঁচাতে পারার মতো এক ধরনের অদৃশ্য তাৎপর্যের সন্ধানে তাগিদ দিয়েছে যা যুক্তিপূর্ণ অবিন্যস্ত ভাবনার প্রক্রিয়ায় অর্জন করা সম্ভব নয়। প্রকৃতপক্ষেই ফ্রয়েড বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদের প্রতি তাঁর সমস্ত ভক্তি সত্ত্বেও দেখিয়েছেন যে, যুক্তি কেবল গভীরভাবে আমাদের আচরণকে প্রভাবিতকারী কিন্তু আমাদের নিয়ন্ত্রণের অতীত অবচেতন, অযৌক্তিক ও আদিম প্রবণতার এক জ্বলন্ত পাত্রকে ঢেকে রাখা মনের একেবারে বাইরের আবরণকে তুলে ধরে।

ধার্মিক লোকজনও মৌলিক বিষয়ের উপর নতুন দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলার প্রয়াস পাচ্ছিল। সবচেয়ে দূরদর্শীরা বুঝতে পেরেছিল যে সম্পূর্ণ আধুনিক মানুষকে আগের মতো ধার্মিক করে তোলা সম্ভব নয়। এই প্রতিমাবিরোধী ভবিষ্যতমুখী পরিবেশে মানুষকে অত্যাবশ্যক সীমাবদ্ধতার সাথে খাপ খাইয়ে চলমান পরিস্থিতিকে মেনে নিতে সাহায্যকারী রক্ষণশীল আধ্যাত্মিকতা সাহায্য করবে না। তাদের ভাবনা ও ধারণার গোটা চেহারাই পাল্টে গিয়েছিল। পশ্চিমে সম্পূর্ণ যৌক্তিক শিক্ষার অধিকারী অনেকেই অতীতের মূল্যের উপর একটা দুর্জ্জয় অনুভূতি সৃষ্টিকারী পৌরাণিক, অতীন্দ্রিয়বাদী ও কাল্টিক আচারের জন্যে প্রস্তুত ছিল না। পেছনে যাওয়ার কোনও উপায় ছিল না। ধার্মিক হতে চাইলে বিভিন্ন আচার, বিশ্বাস ও অনুশীলন সৃষ্টি করার প্রয়োজন ছিল যা তাদের যারপরনাই বদলে যাওয়া পরিস্থিতিতে কথা বলবে। ধার্মিক হওয়ার নতুন উপায়ের সন্ধান করছিল বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে মানুষ। প্রথম অ্যাক্সিয়াল যুগের (c.৭০০-২০০ বিসিই) মানুষ যেমন আবিষ্কার করেছিল যে প্রাচীন প্যাগান মতবাদ আর তাদের কালের নতুন অবস্থার সাথে খাপ খাচ্ছে না, ঠিক তেমনি এই দ্বিতীয় অ্যাক্সিয়াল যুগেও একই রকম চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি হয়েছিল। অন্য যেকোনও সৃজনশীল উদ্যোগের মতো আধুনিক (এবং পরে উত্তরাধুনিক) বিশ্বাসের অনুসন্ধান দারুণভাবে কঠিন ছিল। সন্ধান চলছিল, তখনও পর্যন্ত কোনও সুনির্ধারিত বা এমনকি সন্তোষজনক সমাধান বের হয়ে আসেনি। আমরা যাকে ‘মৌলবাদ’ বলি সেই ধার্মিকতা কেবল তেমনি একটি প্রয়াসের নাম।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রটেস্ট্যান্টরা বেশ কিছুকাল থেকেই নতুন কিছুর প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সজাগ ছিল। উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে বিভিন্ন গোষ্ঠীতে মেরুকরণ ঘটেছিল, কিন্তু ধর্মদ্রোহীদের বিচার ও বহিষ্কার প্রত্যক্ষকারী ১৮৯০-র দশকের সংকট যেন উৎরে গেছে বলে মনে হচ্ছিল। শতাব্দীর গোড়ার দিকে বছরগুলোয় উদারপন্থী ও রক্ষণশীলরা তথাকথিত প্রগতিশীল কালের (১৯০০-২০) কল্যাণমূলক কাজে সংশ্লিষ্ট ছিল; শিল্পের দ্রুত ও অনিয়ন্ত্রিত উন্নতি ও শহুরে জীবনের কারণে সৃষ্ট বিভিন্ন সমস্যার সমাধানের প্রয়াস পাচ্ছিল তারা। মতবাদগত বিবাদ সত্ত্বেও সকল গোষ্ঠীর প্রটেস্ট্যান্টরা প্রগতিশীল আদর্শের প্রতি নিবেদিত ছিল, বিদেশী মিশন ও নিষিদ্ধকরণ অভিযান বা উন্নত শিক্ষাকার্যক্রমে পরস্পরের সাথে সহযোগিতা করেছে। প্রবল সমস্যা মোকাবিলা করা সত্ত্বেও অধিকাংশই নিজেদের আত্মবিশ্বাসী মনে করেছে। আমেরিকা ১৯১২ সালে ‘খৃস্টায়িত’ হয়েছিল, লিখেছেন উদার ধর্মবেত্তা ওয়াল্টার রশেনবুশ; বাকি ছিল কেবল ব্যবসা ও শিল্পের ‘ক্রাইস্টের আত্মা ও ভাবনায়’ পরিবর্তিত হওয়া। 8

প্রটেস্ট্যান্টরা ঈশ্বরহীন শহর ও কলকারখানাকে পবিত্র করে তোলার লক্ষ্যে তাদের ভাষায় ‘সোশ্যাল গস্পেল’ সৃষ্টি করেছিল। তাঁদের চোখে এটা ছিল হিব্রু পয়গম্বর ও স্বয়ং ক্রাইস্টের মৌলিক শিক্ষায় ফিরে যাওয়ার একটা প্রয়াস, যিনি তাঁর অনুসারীদের বন্দিদের দেখতে, নগ্নকে কাপড় দিতে ও ক্ষুধার্তকে খাদ্য দেওয়ার শিক্ষা দিয়েছিলেন। সোশ্যাল গস্পেলঅলারা তাদের ভাষায় দরিদ্র ও নতুন অভিবাসীদের সেবা ও বিনোদনমূলক সুবিধা দিতে ‘প্রাতিষ্ঠানিক চার্চ” প্রতিষ্ঠা করেছিল। ১৯১১ সালে নগরীর অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ ও বেপরোয়া মহল্লায় নিউ ইয়র্ক টেম্পল প্রতিষ্ঠাকারী চার্লস স্টেলযলের মতো উদারপন্থী প্রটেস্ট্যান্টরা সমাজতন্ত্রকেই ব্যাপ্টাইজ করার প্রয়াস পেয়েছেন ক্রিশ্চানদের বাইবেলের অনুপুঙ্ক্ষ ইতিহাস পাঠের বদলে শহুরে ও শ্রমিকদের সমস্যা নিয়ে পড়াশোনা করতে হবে এবং শিশুশ্রমের মতো অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়তে হবে।o শতাব্দীর গোড়ার দিকের বছরগুলোয় রক্ষণশীল ক্রিশ্চানরাও একইভাবে উদারপন্থী প্রটেস্ট্যান্টদের মতো সামাজিক কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিল, যদিও তাদের আদর্শ ছিল ভিন্ন। তারা হয়তো সামাজিক ক্রুসেডকে শয়তানের বিরুদ্ধে লড়াই বা চলমান বস্তুবাদের বিরুদ্ধে আধ্যাত্মিক চ্যালেঞ্জ হিসাবে দেখে থাকবে, কিন্তু আবার উদারপন্থী স্টেলফলের মতো নিম্ন-মজুরি, শিশুশ্রম ও অনুন্নত কর্মপরিবেশের ব্যাপারেও উদ্বিগ্ন ছিল তারা। রক্ষণশীলরা পরে সোশ্যাল গস্পেলের প্রখর সামালোচনায় মেতে উঠে যুক্তি দেখাবে যে অভিশপ্ত পৃথিবীকে বাঁচানোর চেষ্টা অর্থহীন। তারপরেও শতাব্দীর গোড়ার দিকে বছরগুলোয় এমনকি ১৯০২ সালে নর্থওয়েস্টার্ন বাইবেল কলেজের প্রতিষ্ঠাতা উইলিয়াম বি. রাইলির মতো জাত রক্ষণশীলগণও মিনেপোলিসকে পরিচ্ছন্ন করার জন্যে সামাজিক সংস্কারকদের সাথে কাজ করতে ইচ্ছুক ছিলেন। তিনি মন্দিরে ভাষণ দেওয়ার জন্যে লিয়ন ট্রটস্কি ও এমা গোল্ডম্যানকে আমন্ত্রণকারী স্টেলফলের মতো সোশ্যাল গস্পেলঅলারদের কর্মকৌশল মেনে নিতে পারেননি, তবে রক্ষণশীলরা তখনও রাজনীতির বর্ণালীর ডান পাশে সরে যায়নি, গোটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে তারা তাদের কল্যাণমূলক কাজ চালিয়ে যাচ্ছিল।

কিন্তু ১৯০৯ সালে হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির প্রফেসর এমিরিতাস চার্লস এলিয়ট ‘দ্য ফিউচার অভ রিলিজিয়ন’ শিরোনামের ভাষণ দেন; অধিকতর রক্ষণশীলদের মনে তা আঘাত হানে। এটা ছিল সহজ মূল আদিমূল্যবোধে প্রত্যাবর্তনের আরেকটি প্রয়াস। এলিয়টের বিশ্বাস ছিল নতুন ধর্মের একটাই নির্দেশনা থাকবে: অন্যের প্রতি বাস্তবমুখী সেবায় প্রতিফলিত ঈশ্বরের প্রতি ভালোবাসা। চার্চ বা ঐশীগ্রন্থ বলে কিছু থাকবে না; পাপের কোনও ধর্মতত্ত্ব থাকবে না, প্রয়োজন থাকবে না উপাসনার। ঈশ্বরের উপস্থিতি এতটাই নিশ্চিত ও অভিভূতকারী হবে যে, লিটার্জিরও আর দরকার থাকবে না। বিজ্ঞানী, সেক্যুলারিস্ট বা ভিন্ন ধর্মের যারা অনুসারী তাদের ধ্যানধারণাও সমানভাবে বৈধ হয়ে যাওয়ায় সত্যির উপর ক্রিশ্চানদের একচেটিয়া অধিকার থাকবে না। অন্য মানুষের প্রতি দয়ার কারণে ভবিষ্যতের এই নতুন ধর্ম গণতন্ত্র, শিক্ষা, সামাজিক সংস্কার বা প্রতিশোধকমূলক ওষুধের মতো সেক্যুলার ধারণা থেকে ভিন্ন হবে।’ সোশ্যাল গস্পেলের এই চরম ভাষ্য ছিল সাম্প্রতিক দশকগুলোর মতবাদগত বিরোধ থেকে পিছু হটা। কেবল যুক্তি বা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণযোগ্য সত্যিকে মূল্যদানকারী সমাজে ডগমা সমস্যায় পরিণত হয়। ধর্মতত্ত্ব অনায়াসে অনির্বচনীয় ও বর্ণনার অতীত কোনও বাস্তবতার প্রতীক হওয়ার বদলে নিজেই পরম মূল্যে পরিণত হওয়া প্রতিমূর্তি অন্ধসংস্কারে পরিণত হতে পারে। মতবাদকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার প্রয়াস পেলেও এলিয়ট তাঁর চোখে মূলে ফিরে যাবার চেষ্টা করছিলেন: ঈশ্বর ও প্রতিবেশীর প্রতি ভালোবাসা। সকল বিশ্বধর্মই সামাজিক ন্যায়বিচার ও দুর্বলের প্রতি সদয় আচরণের উপর গুরুত্ব দিয়েছে। সকল ট্র্যাডিশনেই, যতক্ষণ ভালোমানুষি দেখানোর অহমের প্রয়াসে পরিণত না হচ্ছে, পবিত্রতার অনুভূতি সৃষ্টি করার জন্যে বাস্তবিকভাবে প্রকাশিত সুশৃঙ্খলিত সহানুভূতি লক্ষ করা গেছে। এলিয়ট এভাবে অর্থডক্স বিশ্বাসের চেয়ে বরং অনুশীলনের উপর বেশি নির্ভরশীল একটি বিশ্বাস সৃষ্টি করে আধুনিক বিশ্বে ক্রিশ্চানদের আসল টানোপোড়েনের সমাধানের প্রয়াস পেয়েছিলেন।

রক্ষণশীলরা অবশ্য ভীত হয়ে উঠেছিল। তাদের চোখে অনির্বচনীয় মতবাদ বিহীন বিশ্বাস ক্রিশ্চান ধর্মই নয়, তারা এই উদার বিপদ প্রতিহত করতে বাধ্য হয়েছে। ঐশীগ্রন্থের ভ্রান্তিহীনতার মতবাদ প্রদানকারী প্রিন্সটনের প্রেসবিটারিয়ানরা ১৯১০ সালে পাঁচটি ডগমার একটি তালিকা প্রকাশ করেন, তাঁদের চোখে এগুলো ছিল আবশ্যক: (১) ঐশীগ্রন্থের নির্ভুলতা, (২) ক্রাইস্টের ভার্জিন বার্থ, (৩) আমাদের পাপের কারণে ক্রসে ক্রাইস্টের প্রায়শ্চিত্ত, (৪) তাঁর দৈহিক পুনরুত্থান ও (৫) তাঁর অলৌকিক কর্মকাণ্ডের বস্তুগত বাস্তবতা। (শেষের এই মতবাদটি পরে প্রিমিলেনিয়ালিজমের শিক্ষা দিয়ে প্রতিস্থাপিত হবে)। এর পর হাইয়ার ক্রিটিসিজমকে প্রতিরোধ করার জন্যে ১৯০৮ সালে লস অ্যাঞ্জেলিসে বাইবেল কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অয়েল মিলিয়নিয়ার লাইম্যান ও মিল্টন স্টুয়ার্ট বিশ্বাসীদের ধর্মের মৌলিক বিশ্বাসসমূহ শিক্ষা দিতে একটি প্রকল্পের অর্থ যোগান দেন। ১৯১০ সাল থেকে ১৯১৫ সালের ভেতর তাঁরা দ্য ফান্ডামেন্টালস শিরোনামে বারটি পেপারব্যাক প্যামফ্ল্যাটের একটা সিরিজ প্রকাশ করেন; এসব প্যামফ্ল্যাটে ধর্মবেত্তারা ট্রিনিটির মতো মতবাদের বোধগম্য বিবরণ, হাইয়ার ক্রিটিসিজমের প্রত্যাখ্যান ও গস্পেলের সত্যি প্রকাশের উপর গুরুত্ব দেন। প্রতিটি খণ্ডের আনুমানিক তিন মিলিয়ন করে কপি বিনে পয়সায় প্রত্যেক আমেরিকান প্যাস্টর, প্রফেসর ও ধর্মততেত্ত্বর ছাত্রের কাছে পাঠানো হয়। পরে এই প্রকল্প এক বিশাল প্রতীকী তাৎপর্য অর্জন করবে, কেননা মৌলবাদীরা একে তাদের আন্দোলনের প্রাণ বিবেচনা করবে। অবশ্য, এই সময় এই প্যামফ্ল্যাটগুলো তেমন একটা আগ্রহ জাগায়নি। এগুলোর সুর রেডিক্যাল বা বিশেষভাবে উগ্রও ছিল না।

কিন্তু মহাযুদ্ধের সময় রক্ষণশীল প্রটেস্ট্যান্টবাদে ত্রাসের একটা উপাদানের অনুপ্রবেশ ঘটে ও তা মৌলবাদী হয়ে ওঠে। আমেরিকানদের সব সময়ই বিরোধকে প্রলয়বাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখে আসার প্রবণতা ছিল। মহাযুদ্ধ তাদের অনেকেরই প্রিমিলেনিয়াল বিশ্বাসে স্থির প্রত্যয় জাগিয়েছিল। এমন ভয়াবহ মাত্রায় এমনি ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড, সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে তারা, কেবল প্রলয়েরই লক্ষণ হতে পারে। এটা নিশ্চিতভাবেই বুক অভ রেভেলেশনে বর্ণিত সেই যুদ্ধ। ১৯১৪ সাল থেকে ১৯১৮ সালের ভেতর তিনটি বিশাল প্রফিসি কানফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়। অংশগ্রহণকারীরা ‘সময়ের আরও আলামতের খোঁজে’ স্কোফিল্ড রোফারেন্স বাইবেল আঁতিপাতি করে অনুসন্ধান চালায়। সবকিছু ইঙ্গিত করে যে, এই পূর্বাভাসগুলো আসলেই সত্যি হতে যাচ্ছে। হিব্রু পয়গম্বরগণ ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন যে, প্রলয়ের আগে ইহুদিরা স্বদেশে ফিরে যাবে, সুতরাং ব্রিটিশ সরকার প্যালেস্তাইনে ইহুদি বাসভূমির পক্ষে সমর্থনের অঙ্গীকারের বেলফোর ঘোষণা (১৯১৭) প্রকাশ করলে প্রিমিলেনিয়ালিস্টরা একাধারে ভীতি ও আনন্দে আক্রান্ত হয়েছিল। স্কোফিল্ড বলেছিলেন, রাশিয়াই আরমাগেদনের অব্যবহিত আগে ইসরায়েলকে আক্রমণকারী ‘উত্তরের শক্তি’,১০ নাস্তিক্যবাদী কমিউনিজমকে রাষ্ট্রীয় আদর্শে রূপান্তরকারী বলশেভিক বিপ্লব (১৯১৭) যেন এই বিষয়টিকেই নিশ্চিত করেছিল। লীগ অভ নেশনস-এর প্রতিষ্ঠা নিশ্চিতভাবেই রেভেলেশন ১৬: ১৪-এর ভবিষ্যদ্বাণীকে বাস্তবে পরিণত করেছিল: রোমান সাম্রাজ্যকে পুনরুজ্জীবিত করেছে তা, অচিরেই অ্যান্টিক্রাইস্ট এর নেতৃত্ব গ্রহণ করবে। বিশ্ব ঘটনাপ্রবাহ পর্যবেক্ষণ করার সময় প্রিমিলেনিয়াল প্রটেস্ট্যান্টরা রাজনৈতিকভাবে আরও সচেতন হয়ে উঠছিল। উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে যা গোষ্ঠীতে উদারপন্থীদের সাথে স্রেফ মতবাদগত বিরোধ ছিল সেটাই সভ্যতার ভবিষ্যতের জন্যে সংগ্রামের রূপ নিচ্ছিল। অচিরেই বিশ্বকে ধ্বংস করে দিতে চলা শয়তানি শক্তির বিরুদ্ধে নিজেদের সামনের কাতারে অবস্থান করতে দেখেছিল তারা। যুদ্ধের সময় এবং এর অব্যবহিত পরে জার্মান নিষ্ঠুরতার অবিশ্বাস্য সব গল্পকাহিনী যেন রক্ষণশীলদের হাইয়ার ক্রিটিসিজমের জন্মদাতা জাতিকে প্রত্যাখ্যান করে ঠিক কাজ করার প্রমাণ হিসাবে প্রতীয়মান হয়েছে।১১

কিন্তু এক গভীর ভীতি থেকেই এই দৃষ্টিভঙ্গির জন্ম হয়েছিল। এটা ছিল জাতিগত ঘৃণার একটা ব্যাপার; ক্যাথলিক, কমিউনিস্ট ও হাইয়ার ক্রিটিকদের মাধ্যমে জাতির অন্তরে বিদেশী প্রভাবের অনুপ্রবেশের ভীতি। মৌলবাদী এই বিশ্বাস আধুনিক বিশ্ব থেকে গভীর পশ্চাদপসরণ তুলে ধরে। রক্ষণশীল প্রটেস্ট্যান্টরা গণতন্ত্র সম্পর্কে পুরোপুরি দোনোমনো হয় উঠেছিল: এর ফলে ‘মব শাসন’ সৃষ্টি হবে, ‘লাল প্রজাতন্ত্রের দিকে’ নিয়ে যাবে, ‘এমন শয়তানি শাসন দুনিয়া আর দেখেনি।’১২ লীগ অভ নেশনস-এর মতো শান্তিরক্ষী প্রতিষ্ঠানসমূহ এর পর থেকে মৌলবাদীদের চোখে সম্পূর্ণভাবে অশুভে পরিপূর্ণ ঠেকবে। লীগ নিশ্চিতভাবেই অ্যান্টিক্রাইস্টের আস্তানা, সেইন্ট পল বলেছিলেন, বিশ্বাসযোগ্য মিথ্যাবাদী হবে সে, সবাইকে প্রতারণা করবে। বাইবেল বলেছে, শান্তি নয়, অন্তিমকালে যুদ্ধ বাধবে, তো লীগ বিপজ্জনকভাবে ভুল পথে রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে অ্যান্টিক্রাইস্টেরই শান্তিরক্ষী হওয়ার কথা।১৩ লীগ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে মৌলবাদীদের বিতৃষ্ণা আধুনিকতার কেন্দ্রিয়করণের প্রতি অন্তরের ভীতি ও বিশ্ব সরকারের মতো যেকোনও কিছুর প্রতি ত্রাসের বিষয়টি তুলে ধরে। আধুনিক সমাজের বিশ্বজনীনতার মুখোমুখি হয়ে কিছু কিছু লোক সহজাত প্রবৃত্তির বশে গোত্রীয়বাদে ফিরে গেছে।

মানুষকে প্রাণ বাঁচাতে লড়াই করার বোধ জাগানো এই ধরনের ষড়যন্ত্র ভীতি অনায়াসেই আগ্রাসী হয়ে উঠতে পারে। জেসাস আর ডিউইট মুডির প্রচারিত প্রেমময় উদ্ধারকর্তা ছিলেন না। নেতৃস্থানীয় প্রিমিলেনিয়ালিস্ট আইজ্যাক এম. হালদম্যান যেমন ব্যাখ্যা করেছেন, বুক অভ রেভেলেশনের ক্রাইস্ট ‘এমন একজন হিসাবে এসেছেন যিনি আর বন্ধুত্ব বা ভালোবাসার আকাঙ্ক্ষী নন… তাঁর পোশাকে রক্তের ধারা, অন্যের রক্ত। নেমে এসেছেন যেন মানুষের রক্ত ঝরাতে পারেন।১৪ যুদ্ধের জন্যে তৈরি ছিল রক্ষণশীলরা, এমনি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে আক্রমণে নেমেছিল উদার প্রটেস্ট্যান্টরা।

ঈশ্বরের রাজ্যের দিকে পৃথিবীর এগিয়ে যাওয়ার দৃষ্টিভঙ্গিকে চ্যালঞ্জ করে বসা যুদ্ধের বেলায় উদারপন্থীদেরও নিজস্ব সমস্যা ছিল। এই যুদ্ধকে সব যুদ্ধের অবসান ঘটানোর, বিশ্বকে গণতন্ত্রের পক্ষে নিরাপদ করে তোলা যুদ্ধ হিসাবে দেখেই কেবল সামাল দেওয়ার উপায় ছিল তাদের। প্রিমিলেনিয়ালিজমের সহিংসতা, গণতন্ত্রের প্রতি এর বিধ্বংসী সমালোচনা ও লীগ অভ নেশনসের কারণে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে উঠেছিল তারা। এইসব মতবাদকে কেবল অ-আমেরিকানই নয়, বরং খোদ ক্রিশ্চান ধর্মের অস্বীকৃতি মনে হয়েছে। আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তারা; এবং ভালোবাসা ও সহানুভূতির গস্পেল সত্ত্বেও তাদের অভিযান ছিল ভয়াবহ ও ভারসাম্যহীন। ১৯১৭ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উদারনৈতিক ক্রিশ্চান ধর্মবিশ্বাসের নেতৃত্বস্থানীয় স্কলাস্টিক প্রতিষ্ঠান ইউনিভার্সিটি অভ শিকাগোর ডিভিনিটি স্কুলের ধর্মতাত্ত্বিকগণ শহরের অপর প্রান্তের মুডি বাইবেল কলেজকে আক্রমণ করতে শুরু করেন।১৫ প্রফেসর শার্লি জ্যাকসন চেজ প্রিমিলেনিয়ালিস্টদের বিরুদ্ধে দেশের সাথে বেঈমানি ও জার্মানদের কাছ থেকে অর্থ নেওয়ার অভিযোগ তোলেন। আলভা এস. টেইলর বলশেভিকদের সাথে তুলনা করেন তাদের, যারা তাদের মতোই একদিনেই পৃথিবীকে নতুন করে তৈরি করতে চায়। ক্রিশ্চান রেজিস্টারের সম্পাদক আলফ্রেড দিফেনবাখ প্রিমিলেনিয়ালিজমকে ‘ধর্মীয় চিন্তাভাবনার জগতে সবচেয়ে বিস্ময়কর মানসিক স্খলন’১৬ আখ্যায়িত করেন।

মুডি বাইবেল ইন্সটিটিউটের নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষকদের কেবল তাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষই নয় বরং যাদের শয়তানসুলভ মনে করত সেই শত্রুর সাথে তুলনা করে উদারবাদীরা একেবারে আঁতে ঘা দেয়। মুডি বাইবেল ইন্সটিটিউট মান্থলি’র সম্পাদক জেমস এম. গ্রে পাল্টা জবাবে বলেন, উদারবাদীদের শান্তিবাদই অস্ত্র প্রতিযোগিতায় আমেরিকাকে জার্মানদের পিছনে ফেলে দিয়েছে, সুতরাং তারা যুদ্ধের প্রয়াসকে বিপর্যস্ত করেছে।১৭ দ্য কিংস বিজনেস নামে একটি প্রিমিলেনিয়াল ম্যাগাজিনে টমাস সি. হর্টন যুক্তি দেখান যে, উদারপন্থীরাই আসলে জার্মানদের সাথে ঘোঁট পাকিয়েছে, কারণ ডিভিনিটি স্কুলে তাদের শিক্ষা দেওয়া হাইয়ার ক্রিটিসিজমই যুদ্ধের জন্যে দায়ী ও জার্মানিতে তা সুকোমল মূল্যবোধের ধস নামিয়েছে।১৮ অন্যান্য রক্ষণশীল নিবন্ধে কথিত জার্মান নিষ্ঠুরতার জন্যে যুক্তিবাদ ও বিবর্তবাদের তত্ত্বকে দায়ী করা হয়।১৯ বাইবেল ইন্সটিটিউট অভ লস অ্যাঞ্জেলিসের হাওয়ার্ড ডব্লু. কেলগ জোর দিয়ে বলেন যে, বিবর্তনের দর্শন ‘বিশ্ব আধিপত্য বিস্তারের দানবীয় পরিকল্পনা, সভ্যতার বিনাশ ও খোদ ক্রিশ্চান ধর্মের বিলুপ্তির জন্যে দায়ী।২০ তিক্ত ও উভয় পক্ষের ক্ষেত্রেই অক্রিশ্চানসূলভ বিরোধ স্পষ্টতই সংবেদনশীল স্নায়ু স্পর্শ করেছিল এবং নিশ্চিহ্নতার এক গভীর ভীতি জাগিয়ে দিয়েছিল। হাইয়ার ক্রিটিসিজমের বেলায় সমন্বয়ের আর কোনও সম্ভাবনা ছিল না, রক্ষণশীলদের চোখে যা পরম অশুভের আভা ধারণ করেছে বলে মনে হচ্ছিল। ঐশীগ্রন্থের আক্ষরিক সত্যি খোদ ক্রিশ্চান ধর্মের পক্ষে জীবন-মরণ প্রশ্নে পরিণত হয়েছিল। বাইবেলের উপর সমালোচনামূলক আক্রমণ অরাজকতার জন্ম দেবে, গোটা সভ্যতা ধ্বংস হয়ে যাবে, ‘উইল নিউ ইয়র্ক বি ডেস্ট্রয়েড ইফ ইট ডাজ নট রিপেন্ট?’ শিরোনামের এক বিখ্যাত নিবন্ধে ঘোষণা করেন ব্যাপ্টিস্ট যাজক জন স্ট্র্যাটন।২১ বিরোধ আয়ত্তের বাইরে চলে গিয়েছিল। ভাঙন হ্রাস করা প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠবে।

১৯১৭ সালের আগস্টে উইলিয়াম বেল রাইলি ঐশীগ্রন্থের আক্ষরিক ব্যাখ্যা ও প্রিমিলেনিয়ালিজমের ‘বৈজ্ঞানিক’ মতবাদসমূহ প্রচারের লক্ষ্যে একটি সংগঠন গড়ে তোলার জন্যে দ্য ফান্ডামেন্টালস-এর অন্যতম সম্পাদক এ. সি. ডিক্সন (১৮৫৪-১৯২৫) ও পুনর্জাগরণবাদী রিউবেন টরির (১৮৫৬-১৯২৮) সাথে আলোচনায় বসেন। ১৯১৯ সালে রাইলি সকল প্রটেস্ট্যান্ট গোষ্ঠীর ছয় হাজার রক্ষণশীল ক্রিশ্চানের অংশগ্রহণে ফিলাদেলফিয়ায় এক বিশাল সম্মেলনের আয়োজন করেন ও আনুষ্ঠানিকভাবে ওয়ার্ল্ডস ক্রিশ্চান ফান্ডামেন্টালস অ্যাসোসিয়েশন (ডব্লুসিএফএ) প্রতিষ্ঠা করেন। এর পরপরই রাইলি অসাধারণভাবে সংগঠিত গস্পেল কণ্ঠশিল্পীসহ চৌদ্দজন বক্তার একটি দলকে নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে এক সফরের ব্যবস্থা করেন, এরা আঠারটি শহরে সফর করে। উদারপন্থীরা এমনি আক্রমণের জন্যে মোটেই প্রস্তুত ছিল না, মৌলবাদী বক্তাদের প্রতি সাড়া এতটাই উৎসাহব্যঞ্জক ছিল যে রাইলি ধরে নিয়েছিলেন এক নতুন সংস্কারের সূচনা করেছেন তিনি।২২ মৌলবাদী প্রচারণাকে যুদ্ধ মনে করা হয়েছিল। নেতৃবৃন্দ অবিরাম সামরিক পরিভাষা ইমেজারি ব্যবহার করছিলেন। ‘আমার বিশ্বাস সময় হয়েছে,’ ক্রিশ্চান ওয়ার্কার্স ম্যাগাজিনে লিখেছেন ই.এ. ওলাম, ‘এদেশের ইভাঞ্জেলিস্টিক শক্তির বিশেষ করে বাইবেল ইন্সটিটিউটের কেবল বিশ্বাসের প্রতিরক্ষাকেই শক্তিশালী করা নয় বরং একে ঐক্যবদ্ধ ও আক্রমণাত্মক শক্তিতে পরিণত হতে হবে।’ এই সংখ্যায় জেমস এম. গ্রে ‘চার্চে প্রতিরক্ষা ও আক্রমণাত্মক জোটের আহ্বান’ জানিয়ে একমত প্রকাশ করেন।২৩ ১৯২০ সালে নর্দার্ন ব্যাপ্টিস্ট কনভেনশনের এক সভায় কার্টিস লি ‘মৌলবাদীদের’ অ্যান্টিক্রাইস্টের কাছে হারানো অঞ্চল উদ্ধার ও ‘বিশ্বাসের মৌলবিষয়গুলোর পক্ষে মহাযুদ্ধে প্রস্তুত’ হিসাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন।২৪ রাইলি আরও এগিয়ে যান। এটা কোনও বিচ্ছিন্ন যুদ্ধ নয়, ‘এটা এমন এক যুদ্ধ যার থেকে কোনও রেহাই নেই।২৫

মৌলবাদীদের পরের পদক্ষেপ ছিল গোষ্ঠী থেকে উদারবাদীদের বহিষ্কার করা। বেশির ভাগ মৌলবাদীই ব্যাপ্টিস্ট বা প্রেসবিটিরিয়ান ছিল, এখানেই অনুষ্ঠিত হয়েছিল প্রবল লড়াই। সবচেয়ে প্রভাবশালী মৌলবাদী প্রেসবিটারিয়ান ধর্মতাত্ত্বিক জে. গ্রিশাম মাচেন (১৮৮১-১৯৩৭) তাঁর জনপ্রিয় গ্রন্থ ক্রিশ্চানিটি অ্যান্ড লিবারিলিজম (১৯২৩)-এ যুক্তি দেখান যে, উদারপন্থীরা প্যাগান, ভার্জিন বার্থের মতো মৌল বিশ্বাস অগ্রাহ্য করে খোদ ক্রিশ্চান ধর্মকেই অস্বীকার করেছে। মৌলবাদী প্রেসবিটারিয়ানরা চার্চের উপর তাদের পাঁচ দফা ক্রিড চাপিয়ে দেওয়ার প্রয়াস পেলে বিভিন্ন গোষ্ঠীর সাধারণ সভায় ভীষণ লড়াই বেধে যায়; এক বিশেষ তিক্ত বিরোধের পর রাইলি ব্যাপ্টিস্ট সভা থেকে বের হয়ে এসে কট্টরপন্থীদের নিয়ে নিজস্ব বাইবেল ব্যাপ্টিস্ট ইউনিয়ন গঠন করেন। কিছু সংখ্যক মৌলবাদী ব্যাপ্টিস্ট মূল সংগঠনে রয়ে যায়, ভেতর থেকে সংস্কারের আশা করেছিল তারা, কিন্তু কেবলই রাইলির তীব্র ঘৃণার পাত্র হয়েছে। ২৬

অভিযান অব্যাহত থাকে। অনুভূতি এমন পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল যে, সমন্বয়ের যেকোনও প্রয়াস অবস্থার আরও অবনতি ঘটিয়েছে। শান্তিবাদী মানুষ ও সেই সময়ের আমেরিকার অন্যতম প্রভাবশালী যাজক হ্যারি ইমারসন ফসডিক (১৮৭৮-১৯৬৯) ১৯২২ সালের ব্যাপ্টিস্ট কনভনশনে প্রদত্ত সারমনে সহিষ্ণুতার আবেদন জানালে (পরে দ্য ব্যাপ্টিস্ট-এ ‘শ্যাল দ্য ফান্ডামেন্টালিস্টস উইন’ শিরোনামে প্রকাশিত) প্রতিক্রিয়ার তীব্রতা উদারবাদী ধারণার ফলে সৃষ্ট ভীষণ বিতৃষ্ণা তুলে ধরে।২৭ অন্য গোষ্ঠীতেও তা ছড়িয়ে পড়ে। সারমনের পর মৌলবাদী শিবিরের দিকে যেন ভূমিধস স্রোত নেমেছিল বলে মনে হয়েছে: অধিকতর রক্ষণশীল ডিসাইপলস অভ দ্য ক্রাইস্ট, সেভেন্থ-ডে অ্যাডভেন্টিস্টস, পেন্টাকোস্টালস, মরমন ও স্যালভেশন আর্মি মৌলবাদী আদর্শের পক্ষে এসে দাঁড়ায়। এমনকি বিতর্ক থেকে দূরত্ব বজায় রাখা মেথডিস্ট ও এপিস্কোপালিয়ানরাও স্ব স্ব গোষ্ঠীর মৌলবাদীদের ‘ক্রিশ্চান ধর্মের গুরুত্বপূর্ণ ও চিরন্তন সত্যসমূহকে সংজ্ঞায়িত ও বাধ্যতামূলক ঘোষণা’ করার জন্যে৮ চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। ১৯২৩ সালের দিকে মনে হচ্ছিল যেন মৌলবাদীরাই আসলে জিতবে ও উদারবাদীদের বিপদ থেকে গোষ্ঠীগুলোকে মুক্ত করবে। কিন্তু এরপরই এক নতুন অভিযান জাতির মনোযোগ কেড়ে নেয় ও শেষ পর্যন্ত গোটা মৌলবাদী আন্দোলনকেই দুর্নামের মুখে ফেলে দেয়।

১৯২০ সালে গণতান্ত্রিক রাজনীতিক ও প্রেসবিটারিয়ান উইলিয়াম জেনিংস ব্রায়ান (১৮৬০-১৯২৫) স্কুল ও কলেজে বিবর্তনবাদের শিক্ষার বিরুদ্ধে ক্রুসেড শুরু করেন। তাঁর চোখে হাইয়ার ক্রিটিসিজম নয়, বরং ডারউইনবাদই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের নৃশংসতার জন্যে দায়ী ছিল।২৯ ব্রায়ান জার্মান সামরিকবাদ ও বিবর্তনবাদের ভেতর যোগসূত্র স্থাপনের দাবিকারী দুটি গ্রন্থে বেশ মুগ্ধ হয়েছিলেন: বেঞ্জামিন কিড-এর দ্য সয়েন্স অভ পাওয়ার (১৯১৮) ও ভার্নন এল. কিলোগে-এর হেডকোয়ার্টার নাইটস (১৯১৭)। এ দুটি বইতে জার্মানদের যুদ্ধে ঠেলে দেওয়ার বেলায় বিবর্তনবাদের প্রভাবের বর্ণনা দেওয়া জার্মান অফিসারদের সাক্ষাৎকার অর্ন্তভুক্ত ছিল। শক্তিমানই টিকে থাকবে, এই ধারণা কেবল ‘ইতিহাসের সবচেয়ে রক্তাক্ত যুদ্ধের পটভূমি তৈরি করেনি,’ বরং, উপসংহার টেনেছেন ব্রায়ান, ‘সৈনিকদের শ্বাস রোধ করে হত্যার জন্যে বিষাক্ত গ্যাস আবিষ্কারকারী সেই একই বিজ্ঞান প্রচার করছে যে, মানুষের রয়েছে নিষ্ঠুর পূর্ব ইতিহাস এবং বাইবেল থেকে অলৌকিক ও আধ্যাত্মিকতাকে নিশ্চিহ্ন করে দিচ্ছে। একই সময়ে, ব্রায়ান মঅর মনস্তাত্ত্বিক জেমস এইচ. লিউবা তাঁর গ্রন্থ বিলিফ ইন গড অ্যান্ড ইমমর্টালিটি-তে পরিসংখ্যান তুলে ধরেন যাতে ‘প্রমাণিত’ হয়েছে যে কলেজ শিক্ষা ধর্মীয় বিশ্বাসকে বিপদাপন্ন করে তুলেছে। ডারউইনবাদ তরুণ-তরণীদের ঈশ্বর, বাইবেল ও ক্রিশ্চান ধর্মের অন্যান্য মৌল মতবাদে বিশ্বাস হারানোর কারণ হচ্ছে। টিপিক্যাল মৌলবাদী ছিলেন না ব্রায়ান। তিনি যেমন প্রিমিলেনিয়ালিস্ট ছিলেন না তেমনি ঐশীগ্রন্থকেও নতুন কট্টর অক্ষরবাদ মোতাবেক পাঠ করতেন না। কিন্তু ‘গবেষণা’ তাঁকে নিশ্চিত করেছিল যে বিবর্তনবাদের তত্ত্ব নৈতিকতা, ভব্যতা ও সভ্যতার টিকে থাকার পক্ষে উপযুক্ত নয়। দ্য মিনেস অভ ডারউনিজম’ শীর্ষক ভাষণ দেওয়ার জন্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরের সময় বিপুল দর্শক ও ব্যাপক প্রচার মাধ্যমের কাভারেজ আকৃষ্ট করেছিলেন তিনি।

ব্রায়ানের উপসংহার ছিল উপরিগত, আনাড়ী ও ভ্রান্ত, কিন্তু লোকে তাঁর কথা শুনতে প্রস্তুত ছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ বিজ্ঞানের সাথে মধুচন্দ্রিমার কালের অবসান ঘটিয়েছিল, এর ভীতিকর সম্ভাবনা নিয়ে এক ধরনের অস্বস্তি কাজ করছিল, কোনও কোনও মহলে একে সীমানার ভেতর আটকে রাখারও চিন্তাভাবনা চলছিল। ডারউইনের বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব কোনও কোনও বিজ্ঞানীর ‘কাণ্ডজ্ঞান’কে অগ্রাহ্য করার বিব্রতকর প্রবণতার একটা প্রধান নজীর ছিল। যারা সহজ সাধারণ ধর্মের সন্ধান করত, বিবর্তনবাদ প্রত্যাখ্যান করার জন্যে তাদের বোধগম্য বিশ্বাসযোগ্য কারণ আবিষ্কারে দারুণ আগ্রহী ছিল তারা। ব্রায়ান তাদের সেটা দিয়েছিলেন এবং একা হাতে বিবর্তনের প্রসঙ্গটিকে মৌলবাদী এজেন্ডার শীর্ষে তুলে দিয়েছেন। ডারউইনবাদ ঐশীগ্রন্থের আক্ষরিক সত্যির বিরোধিতা করে বলে এটা ছিল নতুন মৌলবাদী রীতির প্রতি আবেদন সৃষ্টি করা একটা কারণ। এর প্রভাব সম্পর্কে ব্রায়ানের বিকৃত ব্যাখ্যা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর প্রকাশিত নতুন ভীতিকে ধারণ করতে পেরেছিল। পঞ্চাশ বছর পরে চার্লস হজ যেমন যুক্তি দেখিয়েছেন, ডারউইনের প্রকল্প মৌলবাদীদের বেকনিয় মানসিকতার বিরোধী ছিল, তখনও তারা প্রাক আধুনিক কালের বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিকে আঁকড়ে ছিল। ইয়েল ও হার্ভার্ড ও অন্যান্য বড় বড় শহরের বুদ্ধিজীবী ও সফিস্টিকেটরা উৎসাহের সাথে এইসব নতুন ধারণা অনুসরণ করে থাকতে পারেন, কিন্তু বহু ছোট শহরের আমেরিকানদের কাছে এসব ছিল অজ্ঞাত, তারা ভেবেছিল সেক্যুলারিস্ট প্রতিষ্ঠানসমূহ তাদের সংস্কৃতি গ্রাস করে নিচ্ছে। কিন্তু তারপরেও বিবর্তনের বিরুদ্ধে অভিযান হয়তো কোওনদিনই হাইয়ার ক্রিটিজিমকে প্রতিস্থাপিত করতে পারত না যদি না এযাবৎ মৌলবাদীদের যুদ্ধে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকা দক্ষিণে এক নাটকীয় পরিবর্তন ঘটত।

দক্ষিণবাসীদের পক্ষে মৌলবাদী হয়ে ওঠার কোনও কারণই ছিল না। এই পর্যায়ে দক্ষিণের রাজ্যগুলো উত্তরের তুলনায় বেশ রক্ষণশীল ছিল, মৌলবাদী প্রচারণা শুরু করার পক্ষে দক্ষিণের গোষ্ঠীগুলোতে উদারপন্থীদের সংখ্যা ছিল খুবই কম। কিন্তু পাবলিক স্কুলে বিবর্তবাদের শিক্ষা নিয়ে দক্ষিণবাসীরা উদ্বিগ্ন ছিল। এটা ছিল অজানা আদর্শের কাছে সমাজের ‘উপনিবেশীকরণের’ নজীর। ফ্লোরিডা, মিসিসিপি, লুইসিয়ানা ও আরকান-স’র রাজ্য সভায় ডারউইনের মতবাদের শিক্ষাদান নিষিদ্ধ করার লক্ষ্যে বিল উত্থাপন করা হয়েছিল। টেনিসির বিবর্তনবাদ বিরোধী আইন ছিল বিশেষভাবে কঠোর। তাদের পরীক্ষা করতে এবং বাক স্বাধীনতা ও প্রথম সংশোধনীর পক্ষে প্রতীকী আঘাত হানতে ছোট শহর ডেটনের এক তরুণ শিক্ষক জন স্কোপস একবার স্কুলের প্রিন্সিপালের বদলে জীববিজ্ঞান বিষয়ে ক্লাস নিতে গিয়ে আইন ভঙ্গ করার স্বীকারোক্তি দিয়ে বসেন। ১৯২৫ সালের জুলাই মাসে তাঁকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়, নতুন আমেরিকান সিভিল লিবার্টিজ ইউনিয়ন (এসিএলইউ) তাঁর পক্ষে মামলা লড়ার জন্যে একটি প্রতিনিধি দল পাঠায়, এর নেতৃত্বে ছিলেন যুক্তিবাদী আইনবিদ ও

আইনবিদ ও প্রচারক ক্লারেন্স ডাররো (১৮৫৭-১৯৩৮)। রাইলি ও অন্যান্য মৌলবাদী নেতার অনুরোধে উইলিয়াম জেনিংস ব্রায়ান আইনের সমর্থন করতে সম্মত হন। ডাররো ও ব্রায়ান জড়িয়ে পড়ার পর মামলাটি স্রেফ নাগরিক স্বাধীনতার ব্যাপার রইল না, তা পরিণত হলো ঈশ্বর ও বিজ্ঞানের এক প্রতিযোগিতায়।

স্কোপস ট্রায়াল ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটি দৃষ্টিভঙ্গির সংঘাত।১ ডাররো ও ব্রায়ান গুরুত্বপূর্ণ আমেরিকান মূল্যবোধের পক্ষে লড়ছিলেন। ডাররো বাক স্বাধীনতার পক্ষে, অন্যদিকে ব্রায়ান সাধারণ মানুষের অধিকারের পক্ষে-যারা দীর্ঘদিন ধরে বিজ্ঞ দক্ষ ও বিশেষজ্ঞদের প্রভাবের বেলায় খারাপ চিন্তা লালন করে আসছিল। ব্রায়ানের রাজনৈতিক প্রচারণা সাধারণ মানুষের পক্ষে ছিল। ইন হিজ ইমেজ-এর সমালোচনায় ডারউনের প্রতি ব্রায়ান তাঁর জবাবে দাবি করেছিলেন যে তিনি ‘সংখ্যার দিক থেকে বিশেষ করে মূক এক বিশাল জনসংখ্যার মুখপাত্র। আসলে একমাত্র তিনিই তাদের ধ্যানধারণার প্রকাশকারী যাদের শোনার ক্ষমতা রয়েছে। তারা ব্যাপক রাজনীতির অংশ ও কোনওভাবেই উপেক্ষা বা “উন্মাদসম প্রান্তিক” লোকজনের পরিহাসের পাত্র হবার নয়।২ নিঃসন্দেহে কথাটা সঠিক ছিল, কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এইসব অপরিণত ও অস্পষ্ট উদ্বেগকে ঠিকমতো ভাষা দিতে পারেননি ব্রায়ান। কিন্তু ডাররো বিজ্ঞানের নিজেকে প্রকাশ ও সামনে এগিয়ে যাবার অধিকারের পক্ষে দারুণভাবে যুক্তি তুলে ধরতে পেরেছিলেন। প্রেসবিটারিয়ান ও বেকনিয় ব্রায়ান জোরের সাথে বলেন যে, সুনির্দিষ্ট প্রমাণের অভাবে অনৈতিক প্রভাবের কারণে ডারউইনবাদের মতো ‘অসমর্থিত প্রকল্প’ প্রত্যাখ্যান করার অধিকার মানুষের রয়েছে। স্বয়ং স্কোপস যেখানে গোটা বিচারটিকেই একটা প্রহসন ধরে নিয়েছিলেন, ডাররো ও ব্রায়ান সেখানে প্রাণপণে তাদের চোখে পবিত্র অলঙ্ঘনীয় মূল্যবোধের পক্ষে লড়ে চলছিলেন। কিন্তু ডাররো ব্রায়ানকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর পর তাঁর নিষ্ঠুর জেরার মুখে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির নির্বোধ ও অতিসরল চেহারা বের হয়ে আসে। কোণঠাসা অবস্থায় ব্রায়ান ডাররোর কাছে স্বীকার করতে বাধ্য হন যে বাইবেলের আক্ষরিক পাঠে যেমন বোঝায় পৃথিবীর বয়স তার চেয়ে ছয় হাজার বছরের বেশি, জেনেসিসে বর্ণিত সৃষ্টির ‘ছয়’ দিনের প্রতিটি দিন চব্বিশ ঘণ্টার চেয়ে বেশি এবং তিনি কোনওদিনই বাইবেলের টেক্সটের সৃষ্টির বিররণ পড়েননি, অন্য কোনও ধর্মে তাঁর আগ্রহ নেই, এবং সবশেষে ‘আমি যেসব বিষয় নিয়ে মাথা ঘামাই না সেগুলো নিয়ে মাথা ঘামাতে যাই না’ এবং ‘মাঝেমাঝে’ যেসব নিয়ে ভাবেন কেবল সেগুলো নিয়ে মাথা ঘামান ৩৪ এটা ছিল চরম পরাজয়। স্পষ্ট যৌক্তিক ধ্যানধরণার নায়ক হিসাবে আদালত থেকে বের হয়ে আসেন ডাররো, আর প্রবীন ব্রায়ান বাকোয়াজ, অযোগ্য ও পশ্চাদপন্থী মানুষ হিসাবে অপদস্থ হন; বিচারের অল্প দিন বাদে তাঁর প্রয়াসের পরিণতিতে মারা যান তিনি।

স্কোপস দোষী সব্যস্ত হন, কিন্তু এসিএলইউ তাঁর পক্ষে জরিমানা পরিশোধ করে, ডেটনে ডাররো ও আধুনিক বিজ্ঞান ছিল সন্দোহতীতভাবে বিজয়ী। পত্রপত্রিকাগুলো সানন্দে ব্রায়ান ও তাঁর সমর্থকদের হতাশাব্যঞ্জক পশ্চাদপন্থী হিসাবে চিত্রিত করে। বিশেষ করে সাংবাদিক এইচ. এল. মেনককেন মৌলবাদীদের জাতির জঞ্জাল হিসাবে প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি জোরের সাথে বলেন যে, মুখ ব্যাদান করে থাকা আপল্যান্ড উপত্যকার আদিম মানুষসহ গ্রামের লোকজনকে যেহেতু ভালোবাসতেন, তাই ব্রায়ানের এক ‘এক-ঘোড়া টেনিসি গ্রামে’ মারা যাওয়াটাই ভালো হয়েছে।’ সর্বত্রই আছে মৌলবাদীরা।

তারা গ্যাস কারখানার নোংরা পথের মতোই পুরু। সব জায়গাতেই আছে তারা মরণশীল মনের পক্ষে ভার বহন করা খুবই কঠিন শিক্ষা, এমনকি ছোট স্কুলহাউসের ছাদের আবছা, করুণ শিক্ষাও। ৩৫

মৌলবাদীরা অতীতের অধিবাসী; বিজ্ঞান ও বুদ্ধিবৃত্তিক স্বাধীনতার শত্রু ছিল তারা, আধুনিক বিশ্বে অংশ নেওয়ার অযোগ্য। দ্য ওয়ার অন মডার্ন সায়েন্স (১৯২৭)-এ মেয়নার্ড শিপলি যেমন যুক্তি দেখিয়েছেন যে, মৌলবাদীরা গোষ্ঠীতে ক্ষমতা অধিকার করতে পারলে এবং আইন করে মানুষের উপর তাদের বিধিবিধান চাপিয়ে দিলে আমেরিকানরা তাদের সংস্কৃতির সেরা অংশ খোয়াবে, আবার ফিরে যাবে অন্ধকার যুগে। সংস্কৃতি সব সময়ই প্রতিযোগিতার বিষয়, বিভিন্ন গোষ্ঠী যার যার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি টিকিয়ে রাখার লড়াই করছে। মৌলবাদীদের উপর ভর্ৎসনা চাপিয়ে দিয়ে ডেটনে সেকুলারিস্টরা যুদ্ধে জয়লাভ করেছে, প্রমাণ করেছে তাদের গুরুত্বের সাথে নেওয়ার প্রয়োজন নেই বা উচিত হবে না। স্কোপস ট্রায়ালের পর মৌলবাদীরা নীরব ছিল, উদারপন্থীরা গোষ্ঠীতে নিয়ন্ত্রণ তুলে নিয়েছিল, এক ধরনের আঁতাত হয়েছিল বলে মনে হয়। উইলিয়াম বেল রাইলি ও তাঁর অনুসারীরা লড়াই তুলে রেখেছিলেন বলে মনে হচ্ছিল; দশকের শেষ নাগাদ রাইলি উদারপন্থী হ্যারি ফসডিকের সাথে আলোচনায় বসতে রাজি হন।

তবে মৌলবাদীরা আসলে পুরোপুরি বিদায় হয়নি। প্রকৃতপক্ষে বিচারের পর আরও চরম হয়ে উঠেছিল তারা। নিজেদের তিতিবিরক্ত মনে করে মূলধারার সংস্কৃতির বিরুদ্ধে গভীর ক্ষোভ লালন করছিল। ডেটনে তারা-বিশ্রীভাবে-ধর্ম প্রাচীন প্রাসঙ্গিকতাহীন বিষয় ও কেবল বিজ্ঞানই গুরুত্বপূর্ণ, রেডিক্যাল সেক্যুলারিস্টদের এমনি চরম দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে লড়ার প্রয়াস পেয়েছিল। এই দৃষ্টিভঙ্গিকে সঠিকভাবে তুলে ধরতে পারেনি তারা, কাজটা করার জন্যে ভুল প্ল্যাটফর্ম বেছে নিয়েছিল। ব্রায়ানের জার্মান-বিরোধী ভীতি ছিল ভ্ৰান্তিপূর্ণ, ডারউইনকে দানোবে পরিণত করাও ভুল ছিল। কিন্তু ধর্মের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক ঔচিত্যবোধসমূহ মানুষের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ এবং তাকে বল্গাহীন যুক্তিবাদের স্বার্থে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে অবিবেচকের মতো ছুঁড়ে ফেলা উচিত হবে না। বিজ্ঞান ও নীতির সম্পর্কের বিষয়টি সব সময়ই জ্বলন্ত উদ্বেগের বিষয় হয়েছিল। কিন্তু মৌলবাদীরা ডেটনে মামলায় হেরে গিয়েছিল, অসন্তোষের সাথে আচরণ করে সমাজের প্রান্তে ঠেলে দেওয়া হয়েছে বলে মনে হয়েছিল তাদের। পঞ্চাশ বছর আগে নিউ লাইটসরা আমেরিকায় সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল; স্কোপস ট্রায়ালের পর তারা পরিণত হয় বহিরাগতে। কিন্তু মেনককেনের মতো সেক্যুলার ক্রুসেডারদের পরিহাস ছিল উল্টো ফলদায়ী। মৌলবাদী ধর্মবিশ্বাস গভীর ভীতি ও উদ্বেগে প্রোথিত যা কেবল খাঁটি যৌক্তিক যুক্তি দিয়ে প্রশমিত হওয়ার নয়। ডেটনের পর আরও উগ্র হয়ে ওঠে তারা।৩৬ বিচারের আগে বিবর্তন তাদের কাছে কোনও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল না, এমনকি চার্লস হজের মতো অক্ষরবাদীরা পর্যন্ত পৃথিবীর বয়স বাইবেলে যাই বলা হোক না কেন ছয় হাজার বছরের বেশি, এটা মেনে নিয়েছিলেন। নিউ ফান্ডামেন্টালিস্টরা জেনেসিসকে সম্পূর্ণভাবে বৈজ্ঞানিক দিক থেকে নির্ভুল আখ্যায়িতকারী তথাকথিত ‘সৃষ্টিবিজ্ঞান’ বিশ্বাস করত। কিন্তু ডেটনের পর মৌলবাদীরা আরও বেশি করে মানসিকভাবে নিজেদের রুদ্ধ করে ফেলে, সৃষ্টিবিজ্ঞানবাদ ও অটল বাইবেলিয় অক্ষরবাদ মৌলবাদী মানসিকতায় মূল বিষয়ে পরিণত হয়। তারা রাজনৈতিক বর্ণালীর আরও ডানে সরে যায়। যুদ্ধের আগে রাইলি ও জন আর. স্ট্র্যাটনের (১৮৭৫-১৯২৯) মতো মৌলবাদীরা সামাজিক সংস্কারের লক্ষ্যে বামপন্থীদের সাথে মিলে কাজ করতে আগ্রহী ছিলেন। এবার সোশ্যাল গস্পেল গোষ্ঠীতে তাদের পরাস্তকারী উদারবাদীদের সাথে সংশ্লিষ্টতার কারণে চিহ্নিত হয়ে গিয়েছিল। এটা আমাদের কাহিনীর একটা অব্যাহত থিম হয়ে থাকবে। মৌলবাদ আগ্রাসী উদারবাদ বা সেক্যুলারিজমের সাথে এক প্রতীকী সম্পর্কের ভেতর অবস্থান করে। আক্রান্ত হলে অনিবার্যভাবে আরও চরম, তিক্ত ও আগ্রাসী হয়ে ওঠে।

ডাররো ও মেন্ককেন মৌলবাদীদের সম্পূর্ণ ভিন্ন জগতের অধিকবাসী ভেবে ভুল করেছিলেন। তাদের দিক থেকে মৌলবাদীরা আন্তরিক আধুনিকবাদী। ‘মৌলে’ ফিরে যাবার প্রয়াসে তারা বিংশ শতাব্দীর অন্যান্য বুদ্ধিবৃত্তিক ও বৈজ্ঞানিক ধারার সাথেই একাত্ম ছিল।৩৭ অন্য যেকোনও আধুনিকতাবাদীর মতোই বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদে আসক্ত ছিল, যদিও কান্টিয় না হয়ে বরং বেকনিয় ছিল তারা। ১৯২০ সালে এ.সি. ডিক্সন যেমন ব্যাখ্যা করেছেন, তিনি ক্রিশ্চান ‘কারণ আমি চিন্তাশীল, যুক্তিবাদী, বৈজ্ঞানিক।’ ধর্ম বিশ্বাস অন্ধাকারে ঝাঁপ দেওয়া নয়, বরং ‘সঠিক পর্যবেক্ষণ ও সঠিক চিন্তার উপর’ নির্ভরশীল।৩৮ মতবাদসমূহ কেবল ধর্মতাত্ত্বিক আঁচঅনুমান নয়, বরং সত্যি। এটা সম্পূর্ণই আধুনিক ধর্মীয় বিকাশ ছিল, রক্ষণশীল কালের প্রাক আধুনিক আধ্যাত্মিকতা থেকে বহু আলোকবর্ষ দূরে। মৌলবাদীরা এমন এক কালে ধার্মিক হওয়ার উপায়ের সন্ধান করছিল যখন বিজ্ঞানের লোগোসকে সব কিছুর উপরে মূল্য দেওয়া হচ্ছিল। সময়ই বলে দেবে ধর্মীয়ভাবে এইসব প্রয়াস কতখানি সফল হবে, তবে ডেটন দেখিয়ে দিয়েছিল যে মৌলবাদ অপবিজ্ঞান, বিংশ শতাব্দীর বৈজ্ঞানিক মাণদণ্ডের সাথে খাপ খাওয়ার উপযুক্ত নয়।

মৌলবাদীরা যখন আধুনিক ধর্ম বিশ্বাস গড়ে তুলছিল, ঠিক সেই সময় পেন্টাকোস্টালিস্টরা আলোকনের যৌক্তিক আধুনিকতাকে তৃণমূল পর্যায়ে প্রত্যাখান তুলে ধরা ‘উত্তর আধুনিক’ দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলছিল। মৌলবাদীরা যেখানে তাদের দৃষ্টিতে ক্রিশ্চান ধর্মের মতবাদগত ভিত্তিতে ফিরে যাচ্ছিল, পেন্টাকোস্টালিস্টরা সেখানে, যাদের ডগমায় কোনও আগ্রহ ছিল না, আরও বেশি মৌল স্তরে প্রত্যাবর্তন করিছিল: ধর্মবিশ্বাসের ক্রিডাল ফর্মুলেশনের নিচে অবস্থিত খাঁটি ধার্মিকতার কেন্দ্রে ফিরে যাচ্ছিল। মৌলবাদীরা যেখানে ঐশীগ্রন্থের লিখিত বাণীর উপর বিশ্বাস স্থাপন করে, পেন্টাকোস্টালিস্টরা ভাষাকে এড়িয়ে গিয়েছে-অতীন্দ্রিয়বাদীরা সব সময়ই যেমন জোর দিয়েছে যে, ভাষা ধারণা ও যুক্তির অতীতে অবস্থানকারী বাস্তবতাকে প্রকাশ করতে পারে না। তাদের ধর্মীয় ডিসকোর্স মৌলবাদীদের লোগোস ছিল না, সেটা ছিল বাণীর অতীত। পেন্টাকোস্টালিস্টরা ‘বিভিন্ন ভাষায়’ কথা বলত, তাদের বিশ্বাস ছিল পবিত্র আত্মা পেন্টাকোস্টের ইহুদি ভোজ সভায় অ্যাপসলদের উপর যেভাবে অবতীর্ণ হয়েছিলেন ঠিক সেভাবেই তাদের উপর অবতীর্ণ হয়েছেন। যখন ঐশী উপস্থিতি স্বয়ং আগুনের জিহ্বায় নিজেকে প্রকাশ করেছিলেন আর অ্যাপসলদের অদ্ভুত ভাষায় কথা বলতে সক্ষম করে তুলেছিলেন। ৩৯

পেন্টাকোস্টালিস্টদের প্রথম দলটি ৯ই এপ্রিল ১৯০৬ তারিখে লস অ্যাঞ্জেলিসের এক ছোট বাড়িতে আত্মার অভিজ্ঞতা লাভ করে। দলের নেতা ছিলেন উইলিয়াম জোসেফ সিমুর (১৮৭০-১৯১৫), দীর্ঘদিন ধরে অধিকতর আনুষ্ঠানিক শ্বেতাঙ্গ প্রটেস্ট্যান্ট গোষ্ঠীতে যতটা সম্ভব তার চেয়ে আন্তরিক ও নির্বোধ ধরনের ধর্মের সন্ধানকারী গৃহযুদ্ধের পর মুক্তিলাভকারী দাসদের সন্তান। ১৯০০ সাল নাগাদ হলিনেস আধ্যাত্মিকতায় দীক্ষা নিয়েছিলেন তিনি, এর বিশ্বাস ছিল পয়গম্বর জোয়েলের ভবিষ্যদ্বাণী মোতাবেক আদিম চার্চের উপভোগ করা নিরাময়, পরমানন্দ, ভাষা আর ভবিষ্যদ্বাণীর ক্ষমতা অন্তিম কালের অব্যবহিত আগে ঈশ্বরের জাতির উপর পুনঃস্থাপিত হবে। সিমুর ও তাঁর বন্ধুরা আত্মার অভিজ্ঞতা লাভ করলে দাবানলের মতো সেই সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে। আফ্রিকান আমেরিকান ও শ্বেতাঙ্গ অবহেলিতরা দলে দলে এত বিপুল সংখ্যায় পরের সভায় এসে হাজির হতে শুরু করেছিল যে আয়ুসা স্ট্রিটের একটা পুরোনো গুদাম ঘরে সরে যেতে হয়েছিল তাদের। চার বছরের ভেতর সারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তিন শো পেন্টাকোস্টাল গ্রুপ গড়ে ওঠে, পঞ্চাশটি দেশে ছড়িয়ে পড়ে এই আন্দোলন ৪১ প্রথম পেন্টাকোস্টাল জোয়ার ছিল আধুনিক কালের বিভিন্ন সময়ে বিস্ফোরিত আরও একটি জনপ্রিয় মহাজাগরণ, যখন লোকে অন্তস্তল থেকে বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল যে পরিবর্তন একেবারেই হাতের নাগালে। সিমুর ও প্রথম পেন্টাকোস্টালিস্টদের দৃঢ় বিশ্বাস জন্মে ছিল যে শেষের দিনগুলো শুরু হয়ে গেছে, শিগগিরই আরও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ নির্মাণের জন্যে জেসাস আবির্ভূত হবেন। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর যখন মনে হলো যতটা দ্রুত মনে হয়েছিল জেসাস তত তাড়াতাড়ি ফিরছেন না, পেন্টাকোস্টালিস্টরা তখন ভিন্ন ভাষায় কথা বলার ক্ষমতাকে অন্যভাবে ব্যাখ্যা করতে শুরু করে। একে এবার ঈশ্বরের সাথে কথা বলার এক নতুন কায়দা মনে করতে থাকে। সেইন্ট পল ব্যাখ্যা করেছিলেন যে, ক্রিশ্চানরা যখন প্রার্থনা করা কষ্টকর আবিষ্কার করে, ‘তখন স্বয়ং আত্মা আমাদের সাথে সকল উচ্চারণের অতীত গোঙানির ভেতর দিয়ে মধ্যস্ততা করে।৪২ ভাষার অতীতে অবস্থানকারী এক ঈশ্বরের দিকে হাত বাড়াচ্ছিল তারা।

এই প্রাথমিক বছরগুলোয় সত্যিই এইসব পেন্টাকোস্টালিস্ট ধর্মসভায় এক নতুন বিশ্ব ব্যবস্থার আবির্ভাব ঘটতে যাচ্ছে বলে মনে হয়েছে। অর্থনেতিক নিরাপত্তাহীনতা ও বর্ধিত বিদেশীদের নিয়ে আতঙ্কের একটা কালে কালো ও শাদারা একসাথে প্রার্থনা করেছে ও পরস্পরকে আলিঙ্গন করেছে। সিমুর বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলেন যে, ভিন্ন ভাষায় কথার বলার ক্ষমতার চেয়ে বরং জাতিগত এই সংহতিই শেষ জমানার সূচনার চূড়ান্ত লক্ষণ।৪৩ প্রশান্ত ব্যাপার ছিল না এটা। এখানে পুনর্জাগরণবাদী ও উপদলের অস্তিত্ব ছিল, কোনও কোনও শাদা পেন্টাকোস্টালিস্ট তাদের নিজস্ব ভিন্ন চার্চ গঠন করেছিল।88 কিন্তু সম্পূর্ণ সাধারণ মানুষের ভেতর অসাধারণ দ্রুত গতিতে ছড়িয়ে পড়া পেন্টাকোস্টালিস্ট আন্দোলন স্থিতাবস্থার বিরুদ্ধে ব্যাপক বিদ্রোহকে প্রতিফলিত করেছে। পেন্টাকোস্টালিস্ট সভায় নারী-পুরুষ ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় কথা বলত, ঘোরে চলে যেত, পরমানন্দমূলক তুরীয় অবস্থায় যেত, দেখা যেত তারা শূন্যে ভাসছে, এবং তাদের মনে হত অনির্বচনীয় আনন্দে তাদের শরীর হাসছে। বাতাসে উজ্জ্বল আলোকময় চিহ্ন দেখতে পেত লোকে, যেন প্রতাপের চাপে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে বলে মনে হত।৫ এমনি বুনো তুরীয় আনন্দ সহজাতভাবে বিপজ্জনক ছিল। কিন্তু গোড়ার দিকের এই সময়ে লোকে অন্তত মহাজাগরণের সময়ের মতো হতাশা ও বিষণ্নতায় আক্রান্ত হয়নি। আফ্রিকান-আমেরিকানরা পরমানন্দমূলক আধ্যাত্মিকতায় ঢের বেশি দক্ষ ছিল। যদিও পরে আমরা যেমন দেখব, কিছু শাদা পেন্টাকোস্টালিস্ট মনের অস্বাস্থ্যকর ও বিনাশী অবস্থায় পতিত হবে। শিশু অবস্থায় আন্দোলন ভালোবাসা ও সহানুভূতির মনোভাবের উপর গুরুত্ব দিয়েছে, যা একে নিজস্ব শৃঙ্খলা যুগিয়েছে। সিমুর সাধারণত বলতেন: ‘ক্রুদ্ধ হলে বা বাজে কথা বললে বা পরনিন্দা করলে, তুমি কতগুলো ভাষায় কথা বলতে পারছ আমি তার পরোয়া করি না, আসলে পবিত্ৰ আত্মায় দীক্ষিত হওনি তুমি।’৪৬ ‘সকল দরিদ্র ও অস্পৃশ্যকে এক করে আমাদের সবাইকে ভালোবাসতে শেখাতে ঈশ্বর এই বিলম্বিত বৃষ্টি বর্ষণ করেছেন, ১৯১০ সালে ব্যাখ্যা করেছেন পেন্টাকোস্টালিজমের গোড়ার দিকের ভাষ্যকার ডি.ডব্লু. মাইল্যান্ড। ‘ঈশ্বর ঘৃণিত বস্তু, ইতর বস্তু গ্রহণ করে নিজেকে তাতে মহান করে তুলছেন।’৪৭ অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সহানুভুতিশীল ভালোবাসার উপর গুরুত্ব আরোপ মৌলবাদী ক্রিশ্চান ধর্মের সাথে লক্ষণীয় পার্থক্য তুলে ধরে। যেকোনও ধার্মিকতার চূড়ান্ত পরীক্ষা যদি বদান্যতাই হয়ে থাকে, এই পর্যায়ে পেন্টাকোস্টালিস্টরা সামনে এগিয়ে ছিল।

পেন্টাকোস্টালিস্টবাদের এক আলোকসঞ্চারী গবেষণায় আমেরিকান পণ্ডিত হার্ভে কক্স যেমন যুক্তি দেখিয়েছেন, এই আন্দোলনটি ছিল আধুনিক পাশ্চাত্যের প্রত্যাখ্যান করা বহু অভিজ্ঞতা পুনরুদ্ধারের একটা প্রয়াস।” একে যুক্তির আধুনিক কাল্টের বিরুদ্ধে তৃণমূল পর্যায়ের বিদ্রোহ হিসাবে দেখা যেতে পারে। পেন্টাকোস্টালিজম এমন এক সময়ে শেকড় বিস্তার করেছিল যখন লোকে বিজ্ঞান সম্পর্কে সন্দিহান হয়ে উঠতে শুরু করেছে, যখন ধার্মিক লোকজন কেবল যুক্তির উপর নির্ভরশীলতা ঐতিহ্যগতভাবে অধিকতর স্বজ্ঞামূলক, কল্পনানির্ভর ও নন্দনতাত্ত্বিক মানসিক অনুশীলনের উপর নির্ভরশীল ধর্মবিশ্বাসের উপর উদ্বেগ সৃষ্টিকারী তাৎপর্য থাকার ব্যাপারে অস্বস্তির সাথে সজাগ হয়ে উঠতে শুরু করেছিল। মৌলবাদীরা যেখানে বাইবেল ভিত্তিক ধর্মকে সম্পূর্ণ যুক্তিসঙ্গত ও বৈজ্ঞানিক প্রমাণ করার প্রয়াস পাচ্ছিল, পেন্টাকোস্টালিস্ট সেখানে ধার্মিকতার মূলে ফিরে যাচ্ছিল, কক্স যাকে ‘মনের সেই ব্যাপক অপ্রক্রিয়জাতকৃত নিউক্লিয়াস’ হিসাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন, ‘যেখানে উদ্দেশ্যের বোধ ও তাৎপর্যের জন্যে অন্তহীন সংগ্রাম চলতে থাকে।৪৯ মৌলবাদীরা যেখানে যৌক্তিকভাবে প্রমাণিত ডগমার সাথে ধর্মবিশ্বাসকে মিলিয়ে ফেলে ধর্মীয় অনুভূতিকে মনের একেবারে বাইরের বুদ্ধিবৃত্তিক বলয়ে সীমিত করে ফেলছিল, পেন্টাকোস্টালিস্টরা সেখানে পুরাণ ও ধার্মিকতার অবচেতন উৎসে ফিরে যাচ্ছিল। মৌলবাদীরা যেখানে বাণী ও আক্ষরিক অর্থের উপর জোর দিয়েছে সেখানে পেন্টাকোস্টালিস্টরা প্রথাগত ভাষা এড়িয়ে গিয়ে কোনও ঐতিহ্যের ক্রেডাল ভিত্তির অতীতে অবস্থিত আদিম আধ্যাত্মিকতায় প্রবেশের প্রয়াস পেয়েছে। আধুনিক রীতি যেখানে নারী-পুরুষকে বাস্তবভিত্তিকভাবে কেবল এই জগতের প্রতিই জোর দিতে বলে, পেন্টাকোস্টালিস্টরা সেখানে মানুষের তুরীয় আনন্দ ও দুয়ে অনুভূতি লাভের আকাঙ্ক্ষা তুলে ধরেছে। বিশ্বাসের এমনি ধূমকেতুসুলভ বিস্ফোরণ দেখায় যে, সবাই আধুনিকতার বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদে মোহিত হয়নি। আধুনিকতার বহু মূল বিষয় থেকে এমনি সহজাত পশ্চাদপসরণ বহু লোকের পাশ্চাত্যের সাহসী নতুন বিশ্বে একটা কিছু হারিয়ে যাওয়ার অনুভূতি বোধ করার বিষয়টি তুলে ধরে।

আমাদের এই কাহিনীতে আমরা প্রায়শঃই লক্ষ করব যে, আধুনিকতার প্রধান সুবিধাভোগী নয় এমন মানুষের ধর্মীয় আচরণ অনেক সময়ই সেক্যুলারিস্ট সমাজে বর্জন বা প্রান্তিক অবস্থায় ঠেলে দেওয়া আধ্যাত্মিকতার জোরাল চাহিদা তুলে ধরে। আমেরিকান সমালোচক সুজান সন্টাগ পূর্ব ও পশ্চিম ইউরোপের সভ্যতায় যখনই ‘চিন্তাভাবনা একটা বিশেষ কষ্টকর জটিলতা ও আধ্যাত্মিক গাম্ভীর্যের’ পর্যায়ে পৌঁছেছে, তখনই ‘ভাষার সাথে স্থায়ী অসন্তোষ সৃষ্টির’ কথা উল্লেখ করেছেন। এমন অবস্থায় লোকে মানবীয় ভাষার ক্ষমতা নিয়ে অতীন্দ্রিয়বাদীর অধৈর্যের অংশীদার হয়ে যায়। সকল ধর্মবিশ্বাসের অতীন্দ্রিয়বাদীরা জোরের সাথে বলেছে যে, চূড়ান্ত সত্তা শেষ পর্যন্ত অনির্বচনীয় ও প্রকাশের অতীত। কেউ কেউ মানুষ পবিত্র ও দুয়ের উপস্থিতিতে থাকার সময় ভাষা ও তার প্রকাশিত যৌক্তিক ধারণা যখন কোনও কাজে আসে না, তখন শিক্ষাব্রতীকে অনুভূতি গড়ে তুলতে সাহায্য করতে পেন্টাকোস্টলিস্টদের নানা ভাষায় কথা বলার অনুরূপ তুরীয় আনন্দসুলভ উচ্চারণের উপায় গড়ে তুলেছে: উদাহরণ স্বরূপ, তিব্বতের সাধুরা দ্বৈত গম্ভীর আওয়াজ তোলেন, হিন্দু গুরুরা নাকি সুর তোলেন।৫১ আসা স্ট্রিটের পেন্টাকোস্টালিস্টরা স্বতঃস্ফুর্তভাবে এমন একটা প্রতিষ্ঠিত পদ্ধতি খুঁজে পেয়েছিল যার সাহায্যে বিভিন্ন ঐতিহ্য ঐশীসত্তাকে মানবীয় ভাবনা প্রক্রিয়ার অধীন হওয়ার হাত থেকে রক্ষার প্রয়াস পেয়েছে। মৌলবাদীরা অবশ্য সম্পূর্ণ ভিন্ন পথে অগ্রসর হচ্ছিল। কিন্তু তারপরেও পেন্টাকোস্টালিস্ট ও মৌলবাদীরা তাদের স্ব স্ব কায়দায় বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে বছরগুলোর বাস্তবতা অনুযায়ী এক নজীর বিহীন জটিলতায় পৌঁছে যাওয়া পাশ্চাত্য ডিসকোর্সের প্রতি প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছিল। স্কোপস ট্রায়ালে সাধারণ মানুষের ‘কাণ্ডজ্ঞানের’ পক্ষে লড়াই করেছিলেন ব্রায়ান, চেষ্টা করেছেন বিশেষজ্ঞ ও পণ্ডিতদের স্বেচ্চারিতার বিরুদ্ধে আঘাত হানার। পেন্টাকোস্টালিস্টরা যুক্তির আধিপত্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করছিল, কিন্তু মৌলবাদীদের মতোই স্বল্প শিক্ষিত মানুষের কথা বলার ও তাদের বক্তব্য শোনার অধিকারের উপর জোর দিচ্ছিল।

বৰ্জনবাদী ও নিন্দাবাদী ধার্মিকতার ধার্মিকতার প্রতি বিশ্বস্ত মৌলবাদীরা পেন্টাকোস্টালিস্টদের দারুণ ঘৃণা করেছে। ওয়ারফিল্ড যুক্তি দেখিয়েছেন যে, অলৌকিক ঘটনার দিন শেষ হয়ে গেছে; ঈশ্বর নিয়মিত ভিত্তিতে প্রকৃতির নিয়ম কানুন পাল্টে দেন এমন বিশ্বাসের ক্ষেত্রে পেন্টাকোস্টালিস্টরা রোমান ক্যাথলিকদের চেয়েও খারাপ। পেন্টাকোস্টালিস্টদের যুক্তিহীনতা মৌলবাদীদের কাছে বৈরী প্রতীয়মান বিশ্বে টিকে থাকা নিশ্চিত করার জন্যে বিশ্বাসের উপর আরোপের করার প্রয়াস চালানো বৈজ্ঞানিক ও মৌখিক নিয়ন্ত্রণের প্রতি আক্রমণ ছিল। অন্য মৌলাবাদীরা পেন্টাকোস্টালিস্টদের বিরুদ্ধে কুসংস্কার ও ধর্মান্ধতার অভিযোগ এনেছে; একজন তো এমনকি আন্দোলনকে শয়তানের শেষ বমি’ পর্যন্ত বলেছেন।৫২ কটুকাটব্য ও চূড়ান্ত বিচারের বৈশিষ্ট্য ছিল নতুন প্রটেস্ট্যান্ট মৌলবাদের সবচেয়ে আকর্ষণীয় গুণ। স্কোপস ট্রায়ালের পর গস্পেলের চেতনা থেকে বহুদূরের নিন্দাবাদের এই প্রবণতা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠবে। কিন্তু মতানৈক্য সত্ত্বেও মৌলবাদী ও পেন্টাকোস্টালিস্টরা আধুনিক পাশ্চাত্য বিশ্বে আধুনিকতার বিজয়ের ফলে রয়ে যাওয়া শূন্যতা পূরণের প্রয়াস পাচ্ছিল। ভালোবাসার প্রতি গুরুত্ব আরোপ ও মতবাদের প্রতি সতর্কতা অবলম্বন করে পেন্টাকোস্টালিস্টরা এমনি প্রাথমিক কালে মধ্যবিত্ত উদারপন্থী প্রটেস্ট্যান্টদের অনেক কাছাকাছি ছিল, যদিও শতাব্দীর শেষের দিকে, আমরা যেমন দেখব, কেউ কেউ আরও চরম কট্টরপন্থী মৌলবাদী শিবিরে সরে গিয়ে দানের শ্রেষ্ঠত্বের কথা বিস্মৃত হবে।

*

ইহুদি বিশ্বেও উনবিংশ শতাব্দীতে গড়ে ওঠা অতিরিক্ত যৌক্তিক ধরনের ধর্মবিশ্বাস থেকে লোকের পিছিয়ে আসার লক্ষণ ফুটে উঠতে শুরু করেছিল। জার্মানিতে হারমান কোন (১৮৪২-১৯১৮) ও ফ্রান্য রোজেনভিগের (১৮৮৬-১৯২৯) মতো দার্শনিকগণ আলোকনের মূল্যবোধসমূহকে টিকিয়ে রাখার প্রয়াস পেয়েছেন, যদিও রোজেনভিগ আধুনিক মানুষের উপলব্ধি করার উপযোগি করে প্রাচীন মিথলজি ও আচার আচরণগুলোকে পুনরুজ্জীবিত করে তোলার চেষ্টা করেছিলেন। সব সময় যৌক্তিকভাবে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নাও হতে পারে তোরাহর এমন বিভিন্ন নির্দেশনাকে নিজেদের অতীতে ঐশী সত্তার দিকে ইঙ্গিতকারী প্রতীক হিসাবে উল্লেখ করেছেন তিনি। আচার এক অন্তস্থঃ প্রবণতা সৃষ্টি করেছে ইহুদিদের যা পবিত্রতার সম্ভাবনার উন্মেষ ঘটাতে সাহায্য করেছে, তাদের শোনার ও অপেক্ষা করার প্রবণতার চর্চায় সাহায্য করেছে। সৃষ্টি ও প্রত্যাদেশের বাইবেলিয় কাহিনীগুলো বাস্তব নয়, বরং আমাদের অন্তস্থঃ জীবনের আধ্যাত্মিক বাস্তবতার প্রকাশ। মার্টিন বুবের (১৮৭৮-১৯৬৫) ও গারশোম শোলেমের (১৮৯৭-১৯৮২) মতো পণ্ডিতগণ যুক্তিবাদী ইতিহাসবিদগণ যে ধরনের ধর্মবিশ্বাসকে নাকচ করে দিয়েছিলেন সেগুলোর দিকে আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করেছেন। বুবের হাসিদবাদের সমৃদ্ধি তুলে ধরেছেন আর কাব্বালাহর জগৎ আবিষ্কার করেছেন শোলেম। তবে ভিন্ন জগতের বিষয় প্রাচীন এই আধ্যাত্মিকতাগুলো যৌক্তিক চেতনায় অনুপ্রাণিত ইহুদিদের পক্ষে ক্রমেই অস্পষ্ট হয়ে উঠছিল।

যায়নবাদীরা প্রায়শঃ এমনভাবে তাদের স্পর্ধিত সেক্যুলারিস্ট আদর্শকে উপলব্ধি করেছে যাকে এক সময় ধর্মীয় বলে অভিহিত করা হয়েছিল। বিনাশী হতাশাকে এড়াতে মানুষকে কোনওভাবে আধ্যাত্মিক শূন্যতাকে পূরণ করতে হয়েছে। প্রথাগত ধর্ম কাজ না করলে তারা জীবনকে এক দুজ্ঞেয় অর্থে ভরে তুলবে এমন একটা সেক্যুলারিস্ট আধ্যাত্মিকতা সৃষ্টি করবে। অন্যান্য আধুনিক আন্দোলনের মতো যায়নবাদ ইহুদি হওয়ার এক নতুন উপায় তুলে ধরা একক, মৌল মূল্যবোধে প্রত্যাবর্তন ছিল। স্বদেশভূমিতে ফিরে যাওয়ার মাধ্যমে ইহুদিরা নিজেদের কেবল কারও কারও কাছে মনে হওয়া অত্যাসন্ন অ্যান্টি-সেমিটিক বিপর্যয়ের হাত থেকেই রক্ষা করবে না, বরং ঈশ্বর, তোরাহ বা কাব্বালাহ ছাড়াই এক মনস্তাত্ত্বিক নিরাময় আবিষ্কার করবে। যায়নবাদী লেখক আশার গিন্সবার্গ (১৮৫৬-১৯২৭), আহাদ হা-আম (‘জনগণের একজন’) ছদ্মনামে লেখালেখি করতেন, তিনি বিশ্বাস করতেন যে, ইহুদিদের জগৎ পর্যবেক্ষণ করার আরও যৌক্তিক ও জ্ঞানভিত্তিক পদ্ধতি গড়ে তুলতে হবে। কিন্তু একজন প্রকৃত আধুনিকের মতো তিনি ইহুদিবাদের ন্যূনতম সত্তায় ফিরে যেতে চেয়েছেন, যা ইহুদিরা কেবল তাদের শেকড়ে ফিরে গিয়ে প্যালেস্তাইনে আবাস শুরু করলেই পাওয়া যাবে। তিনি বিশ্বাস করতেন, ধর্ম ইহুদিবাদের বাহ্যিক আবরণ মাত্র। পবিত্র ভূমিতে ইহুদিদের গড়ে তোলা নতুন চেতনাই এককালে ঈশ্বর ওদের জন্যে যা করেছিলেন সেটা করবে। এটা পরিণত হবে ‘জীবনের সকল পর্যায়ের এক দিক দর্শন,’ ‘হৃদয়ের অন্তস্থলে,’ পৌঁছে যাবে ও ‘অনুভূতির সাথে যোগসূত্র স্থাপন’ করবে। এভাবে যায়নে প্রত্যাবর্তন এককালের কাব্বালিস্টের সেই অন্তস্থঃ যাত্রার মতো হয়ে দাঁড়াবে: একাত্মতা অর্জনের লক্ষ্যে মনের গভীরে অবতরণ।

ধর্মকে প্রায়শঃই ঘৃণাকারী যায়নবাদীরা তাদের আন্দোলন সম্পর্কে সহজাত প্রবৃত্তির বশেই অর্থডক্স পরিভাষায় কথা বলত। ‘অভিবাসন’ বোঝাতে তাদের ব্যবহৃত হিব্রু শব্দ আলিয়াহ আদিতে সত্তার উচ্চতর পর্যায়ে আরোহণকে বোঝাতে ব্যবহার করা হত। অভিবাসীদের তারা বলত ওলিম (‘যারা উর্দ্ধারোহণ করেছে,’ বা ‘তীর্থযাত্রী’)। নতুন কৃষি বসতিতে যোগদানকারী কাউকে বলা হত চালু – নিষ্কৃতি, মুক্তি ও উদ্ধার লাভ বোঝানো জোরাল ধর্মীয় দ্যেতনা বিশিষ্ট শব্দ।৫৪ জাফা বন্দরে পৌঁছানোর পর যায়নবাদীরা প্রায়শঃই জমিনে চুমু খেত; অভিবাসনকে তারা নবজন্ম বিবেচনা করত, অনেক সময় বাইবেলিয় গোত্রপিতাদের মতো ক্ষমতায়নের বোধ প্রকাশ করতে নামও পাল্টে ফেলত।

লেবর যায়নিজমের আধ্যাত্মিকতা আহারন ডেভিড গর্ডনের (১৮৫৬-১৯২২) হাতে সবচেয়ে বাঙ্ময় ও জোরালভাবে প্রকাশিত হয়েছে। ১৯০৪ সালে তিনি প্যালেস্তাইনে পৌছানোর পর গালিলির দেগানিয়ার এক নতুন সমবায় বসতিতে কাজ করেন। এখানে এমন অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন ধার্মিক ইহুদিরা যাকে বলবে শেখিনাহর অভিজ্ঞতা। অর্থডক্স ইহুদি ও কাব্বালিস্ট হলেও কান্ট, শোপেনহাওয়ার, নিৎশে, মার্ক্স ও তলস্তয়ের ছাত্র ছিলেন গর্ডন। তিনি বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলেন, আধুনিক শিল্পায়িত সমাজ নারী-পুরুষকে তাদের নিজেদের কাছ থেকেই নির্বাসনে পাঠিয়ে দিয়েছে। জীবন সম্পর্কে একপেশে ও অতিযৌক্তিক উপলব্ধি গড়ে তুলেছে তারা। একে ভারসাম্য দিতে তাদের অবশ্যই নিজেদের যতখানি সম্ভব প্ৰকৃতিক ল্যান্ডস্কেপের জীবনে সংশ্লিষ্ট করার মাধ্যমে চাভায়াহর পবিত্রের খুব কাছের অতীন্দ্রিয় অভিজ্ঞতা-চর্চা করতে হবে, কারণ এখানেই নিজেকে মানুষের কাছে প্রকাশ করেন অন্তহীন। ইহুদিদের ক্ষেত্রে এই ল্যান্ডস্কেপকে অবশ্যই প্যালেস্তাইন হতে হবে। ‘ইহুদির আত্মা,’ জোর দিয়ে বলেছেন গর্ডন, ‘ইসরায়েল দেশের স্বাভাবিক পরিবেশের সন্তান।’ কেবল সেখানেই একজন ইহুদি, কাব্বালিস্টরা যাকে ‘স্পষ্টতা, অন্তহীনভাবে পরিষ্কার আকাশ, স্পষ্ট দৃষ্টিকোণ, বিশুদ্ধতার কুয়াশা বলেছে, তার সন্ধান পেতে পারে। শ্রমের (আভোদাহ) মাধ্যমে একজন অগ্রগামী ‘অজ্ঞাত ঐশীসত্তাকে’ চিনতে পারবে ও অতীন্দ্রিয়বাদীরা যেভাবে আধ্যাত্মিক অনুশীলনে নিজেদের নতুন করে নির্মাণ করেছিলেন সেভাবে গড়ে তুলতে পারবে। জমিনে কাজ করে, ‘অপ্রাকৃতিক, ত্রুটিপূর্ণ, বিচ্ছিন্ন মানুষ’ ডায়াসপোরাতে তার যা পরিণতি হয়েছে, তা থেকে পরিবর্তিত হয়ে ‘প্রাকৃতিক, সম্পূর্ণ মানব সত্তায় পরিণত হবে, যে নিজের কাছে অনুগত।’৬ গর্ডনের কাছে মন্দিরের লিটার্জিতে ‘শ্রম’ বা ‘সেবার’র জন্যে আভোদাহ শব্দ ব্যবহৃত হওয়াটা বিস্ময়ের ছিল না। যায়নাবাদীদের পক্ষে পবিত্রতা ও সামগ্রিকতা আর প্রথাগত ধর্মীয় আচারে পাওয়ার বিষয় ছিল না, বরং গালিলিতে পাহাড় ও খামারে কঠোর পরিশ্রমেই মিলছিল।

সেক্যুলারকে আধ্যাত্মিকতায় পরিবর্তনের অন্যতম বেপরোয়া ইহুদি প্রয়াস রূপ লাভ করেছিল র‍্যাবাই আব্রাহাম ইত্যহাক কুকের হাতে (১৮৬৫-১৯৩৫)। তিনিও ১৯০৪ সালে নতুন বসতির সম্প্রদায়ের র‍্যাবাই হওয়ার উদ্দেশ্যে প্যালেস্তাইনে অভিবাসন করেছিলেন। এক অদ্ভুত নিয়োগ ছিল এটা। বেশির ভাগ অর্থডক্সের বিপরীতে যায়নবাদী আন্দোলনে গভীরভাবে আন্দোলিত ছিলেন কুক। কিন্তু ১৮৯৮ সালে বাসেলে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় যায়নবাদী কংগ্রেসে যোগদানকারী প্রতিনিধিদের ‘যায়নবাদের সাথে ধর্মের কোনও সম্পর্ক’ না থাকার ঘোষণায় আতঙ্কিত হয়ে উঠেছিলেন।৫৭ তীব্র ভাষায় এর নিন্দা জানান তিনি। ‘অসাধারণ নতুন আন্দোলনটিকে এর খোদ জীবন ও সৌন্দর্যের আলোর উৎস থেকে বিচ্ছিন্ন করে উপর-নিচে মৃত্যুর ভয়ঙ্কর কালো ছায়া ছড়িয়ে দিচ্ছে। এটা ‘এক ধরনের অমর্যাদা ও বিকৃতি,’ যায়নবাদকে বিনষ্টকারী ‘বিষ’, এর ‘পচন ও কীটপতঙ্গের নিচে চাপা পড়ে যাবার’ কারণ হচ্ছে। এর ফলে যায়নবাদ কেবল ‘শূন্য গর্ভ পাত্রে পরিণত হতে পারে…ধ্বংসশীলতা ও সংঘাতের চেতনায় পরিপূর্ণ ৫৮ প্রায়শঃই প্রাচীনকালের পয়গম্বরদের ভাষায় কথা বলতেন কুক, কিন্তু তাঁর চিন্তার বহু উপাদান ছিল আধুনিক। তিনি ছিলেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বহু আগেই জাতীয়তাবাদ মারাত্মক হয়ে ওঠার ও পবিত্রতার বোধ ছাড়া রাজনীতির দানবীয় চেহারা নিতে পারার সম্ভাবনা উপলব্ধি করতে সক্ষম অন্যতম ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব। ফরাসী বিপ্লবের প্রতি ইঙ্গিত করেছিলেন তিনি, এই ধরনের আদর্শ নিয়েই সূচনা ঘটেছিল তার, কিন্তু রক্তপাত ও নিষ্ঠুরতার বুনো উৎসবে পরিণত হয়েছে শেষে। নিখাঁদ সেক্যুলারিস্ট আদর্শ নারী ও পুরুষের ভেতরের স্বর্গীয় ইমেজকে মাড়িয়ে যেতে পারে; একেই রাষ্ট্র পরম মূল্য দিলে তখন একজন শাসককে তাঁর দৃষ্টিতে জাতির উন্নতির পথে বাধা সৃষ্টিকারী বলে মনে হওয়া সেইসব প্রজাদের বিনাশ করা থেকে বিরত রাখা যায় না। ‘যখন কেবল জাতীয়তাবাদই জনগণের মাঝে শেকড় গেড়ে বসে,’ সতর্ক করে বলেছেন তিনি, ‘তখন তা চেতনাকে উন্নত করার মতো তাদের চেতনাকে অবনমিত ও অমানবীয়করণও করতে পারে।’৫৯

অবশ্যই অতিপ্রাকৃত কিছুর শরণাপন্ন না হয়েও প্রতিটি মানুষের মাঝে পবিত্র অলঙ্ঘনীয়তার বোধ জাগাতে মানুষকে সাহায্য করার জন্যে সেক্যুলারিস্ট ধারণাও ছিল। ধর্মও যেকোনও সেক্যুলার আদর্শের মতোই ভয়ানক খুনে হতে পারে। কিন্তু সময়োপযোগী সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছিলেন কুক, কেননা গোড়া থেকে শেষ পর্যন্ত বিংশ শতাব্দী একের পর এক গণহত্যার কর্মকাণ্ডে বৈশিষ্ট্যায়িত হয়েছে, জাতীয়তাবাদী, সেক্যুলার শাসকগণই করেছেন একাজ। কুক যায়নবাদেরও সমান নিপীড়নকারী পরিণত হওয়ার ও ইহুদিদের অবস্থা বিপজ্জনক রকম বহুঈশ্বরবাদী হয়ে ওঠার ভয় করেছেন। ইহুদিরা জানুক বা না জানুক, তারা অস্তিত্বগতভাবে ঐশীসত্তার সাথে সম্পর্কিত ছিল বলে ঈশ্বর অভিশপ্ত হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি প্যালেস্তাইনে পৌঁছুনোর পর কুকের অন্যতম প্রথম দায়িত্ব ছিল করুণভাবে অল্প বয়সে পরলোকগত থিওদর হােেলর সম্মানে প্রশংসাবাক্য উচ্চারণ করা। প্যালেস্তাইনের অর্থডক্স সম্প্রদায়ের হিংস্রতার মুখে যায়নবাদকে সহজাতভাবে অশুভ মনে করেছেন তিনি, হার্যেলকে জনপ্রিয় ইহুদি পরলোকতত্ত্বে ইহুদিদের শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে মেসিয়ানিক যুগের শুরুর দিকে আবির্ভূত হবেন বলে প্রত্যাশিত একজন অভিশপ্ত ত্রাণকর্তা জোসেফের বংশের মেসায়াহ হিসাবে তুলে ধরেন কুক, যিনি জেরুজালেমের তোরণে মারা যাবেন। তবে তাঁর প্রচারণা ডেভিডের বংশের প্রকৃত ত্রাণকর্তার আগমনের পথ পরিষ্কার করবে, যিনি নিস্তার নিয়ে আসবেন। হার্যেলকে এভাবেই দেখেছেন কুক। তাঁর বহু সাফল্য ছিল গঠনমূলক, কিন্তু নিজের আদর্শ থেকে ধর্মকে মুছে ফেলার চেষ্টার কারণে তাঁর কাজ এপর্যন্ত ক্ষতিকর ছিল। জোসেফীয় মেসায়াহর প্রয়াসের মতো নিশ্চিত ব্যর্থতায় পর্যবসিত হওয়ার মতো ছিল এটা। কুক এও যুক্তি দেখিয়েছেন যে যায়নবাদের বিরোধী অর্থডক্সরা সমানভাবে ধ্বংসাত্মক; নিজেদের ‘বস্তুগত পরিবর্তনের শত্রু’-তে পরিণত করে ইহুদি জাতিকে দুর্বল করে দিয়েছে তারা। ধার্মিক ও সেক্যুলারিস্ট ইহুদিদের পরস্পরের প্রয়োজন ছিল; একটি বাদে অন্যটি টিকতে পারত না।

এটা প্রাচীন রক্ষণশীল দর্শনকে নতুন করে তুলে ধরেছে। প্রাক আধুনিক বিশ্বে ধর্ম ও যুক্তি ভিন্ন কিন্তু সম্পূরক বলয় অধিকার করেছিল। দুটোই প্রয়োজনীয় ছিল এবং একটিকে ছাড়া অন্যটি হীন হয়ে পড়ত। কুক কাব্বালিস্ট ছিলেন, এক রক্ষণশীল কালের পুরাণ ও অতীন্দ্রিয়াবাদে অনুপ্রাণিত ছিলেন তিনি। কিন্তু আমাদের আলোচিত অন্য কয়েকজন সংস্কারকের মতো তিনি এই বিশ্বাসে আধুনিক ছিলেন যে পরিবর্তনই এখন জীবনের বিধি, যত বেদনাদায়কই হোক না কেন কৃষিভিত্তিক সংস্কৃতির সীমাবদ্ধতাসমূহকে এখন ছুঁড়ে ফেলতেই হবে। তিনি বিশ্বাস করতেন, তরুণ যায়নবাদী বসতি স্থাপনকারীরা ইহুদিদের সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবে-শেষ পর্যন্ত-নিষ্কৃতি নিয়ে আসবে। তাদের নিষ্ঠুর রকম বাস্তবভিত্তিক আদর্শ ছিল লোগাস; এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে ও কার্যকরভাবে কাজ করার জন্যে মানুষের যা প্রয়োজন। কিন্তু একে সৃজনশীলভাবে ইহুদিবাদের মিথোসের সাথে সম্পর্কিত করা না গেলে তা অর্থ খোয়াবে, জীবনের উৎস থেকে বিচ্ছিন্ন হবে ও ক্রমে হারিয়ে যাবে।

প্যালেস্তাইনে পৌঁছানোর পর প্রথমবারের মতো এইসব সেক্যুলারিস্টের সাথে কুকের পরিচয় হয়। কয়েক বছর আগে তাদের ধর্ম প্রত্যাখ্যান তাঁকে ভীত করেছিল, কিন্তু পবিত্র ভূমিতে কাজ করতে যেতে দেখার পর তাঁর ধারণা পরিবর্তন করতে বাধ্য হন তিনি। তিনি আবিষ্কার করেন তাদের নিজস্ব আধ্যাত্মিকতা রয়েছে। হ্যাঁ, ওরা বেপরোয়া ও উদ্ধত বটে, কিন্তু ওদের ‘দয়া, সততা, স্বচ্ছতা ও করুণা…এবং [ওদের মাঝে] জ্ঞানের চেতনা ও উর্ধ্বারোহণের মহান গুণাবলী ও আদর্শও রয়েছে।’ সবেচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, ‘বিশ্বব্যবস্থায় বাসকারী ও মধ্যপন্থী ও ভদ্রলোকদের ব্যথিতকারী ওদের বিদ্রোহী ভাব’ ইহুদি জনগণকে সামনে ঠেলে দেবে; ইহুদিরা প্রগতি অর্জন করতে চাইলে এবং তাদের নিয়তিকে পূরণ করতে চাইলে ওদের গতিশীলতা জরুরি।৬১ যায়নবাদী অগ্রপথিকদের তারিফ করার সময় তিনি এমন সব গুণ বেছে নিয়েছিলেন যেগুলো প্রাক আধুনিক কালে দারুণভাবে ঘৃণিত বিবেচিত হত, যখন লোকে চলমান ব্যবস্থার ছন্দ ও সীমা মেনে নিতে বাধ্য ছিল, যেখানে সীমা অতিক্রমকারী ব্যক্তিবিশেষ সমাজকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারত।৬২

এই প্রবল প্রাণগুলো কোনও রকম সীমায় নিজেদের বন্দি হতে দিতে অস্বীকার করে নিজেদের সংহত করেছে,…শক্তিশালী জানে যে শক্তির এই প্রকাশ আসে বিশ্বকে পরিশুদ্ধ করতে, জাতি, মানবতা ও বিশ্বকে উজ্জীবিত করতে। কেবল সূচনার লগ্নেই এটা বিশৃঙ্খলার ও রূপে আবির্ভূত হয়েছিল।৬৩

তালুমুদিয় কালে র‍্যাবাইরা কী ভবিষ্যদ্বাণী করেননি যে ‘ঔদ্ধত্য ও স্পর্ধার একটা কাল[৬৪] আসবে যখন তরুণরা প্রবীনদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে? এই বেদনাদায়ক বিদ্রোহ স্রেফ ‘মেসায়াহর পদক্ষেপ…গম্ভীর পদক্ষেপ, বিশুদ্ধ আনন্দময় অস্তিত্বের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।

কুক ছিলেন নতুন সেক্যুলারিজমকে আলিঙ্গন করতে পারা প্রথম গভীরভাবে ধর্মীয় চিন্তকদের অন্যতম; যদিও যায়নবাদী উদ্যোগ প্যালেস্তাইনে এক ধৰ্মীয় নবায়নের দিকে চালিত করবে বলে বিশ্বাস করতেন তিনি। ধার্মিক সেক্যুলারিস্টদের- মিথোস ও লোগোসের প্রতিভূ-শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করছে না ভেবে নিষ্কৃতির সিন্থেসিসের দিকে চালিতকারী দুটি বিপরীতমুখী দর্শনের দ্বান্দ্বিক সংঘাতের হেগেলিয় দর্শন গড়ে তুলেছিলেন তিনি। সেক্যুলারিস্টরা ধার্মিকদের সাথে সংঘাতে লিপ্ত কিন্তু এই বিদ্রোহে যায়নবাদীরা ইতিহাসকে এক নতুন পরিপূর্ণতার দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। গোটা সৃষ্টি, প্রায়শঃ বেদনাদায়কভাবে, ঈশ্বরের সাথে চূড়ান্ত মিলনের লক্ষ্যে অগ্রসর হচ্ছে। যে কেউ প্রথাগত ধারণাকে ধ্বংস করেছে বলে মনে হলেও এক নতুন উপলব্ধির দিকে নিয়ে যাওয়া আধুনিক বিজ্ঞানের বর্ণিত বিবর্তনের প্রক্রিয়ায় বা কোপার্নিকাস, ডারউইন বা আইনস্টাইনের বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের ক্ষেত্রে এটি লক্ষ করতে পারে বলে বিশ্বাস করতেন কুক। এমনকি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বেদনাকেও লুরিয় পরিভাষায় শেষ পর্যন্ত আমাদের জগতে পবিত্রকে পুনঃস্থাপিতকারী ‘ব্রেকিং অভ দ্য ভেসেলস’, সৃজনশীল প্রক্রিয়ার অংশ হিসাবে দেখা যেতে পারে।৬৬ ধার্মিক ইহুদিদের এভাবেই যায়নবাদী বিদ্রোহকে বিবেচনা করা উচিত। ‘এমন কিছু সময় আসে যখন তোরাহর বিধিবিধানকে অবশ্যই লঙ্ঘন করতে যেতে হয়,’ ঔদ্ধত্যের সাথে যুক্তি দিয়েছেন কুক। মানুষ যখন ভিন্ন পথের সন্ধান করছে, যখন সমস্ত কিছুই নতুন ও নজীরবিহীন, তখন ‘বৈধ পথ দেখিয়ে দেওয়ার নেই কেউ, তখন লক্ষ্য অর্জিত হয় সব সীমা ছিন্ন করার ভেতর দিয়ে। এটা ‘বাহ্যিকভাবে শোকাবহ, কিন্তু ভেতরে ভেতরে আনন্দের একটা উৎস! ৬৭

কুক সমস্যাগুলোকে এড়িয়ে যাননি। ধার্মিক ও সেক্যুলার ইহুদিদের ভেতর ‘একটা বিরাট যুদ্ধ চলছে।’ দুটো শিবিরই তাদের দিক থেকে সত্যি: যায়নবাদীরা অপ্রয়োজনীয় বিধিনিষেধের বিরুদ্ধে ন্যায়সঙ্গতভাবেই লড়াই করছে, আবার অর্থডক্সরা বোধগম্যভাবেই ঐতিহ্যের অসময়োচিত বিসর্জনের ফলে দেখা দেওয়া বিশৃঙ্খলা এড়াতে উদগ্রীব। কিন্তু দুই পক্ষই আংশিক সত্য ধারণ করেছে। ৬৮ এদের মধ্যকার বিরোধ এক অসাধারণ সংশ্লেষের দিকে চালিত করবে যাতে কেবল ইহুদিরাই নয়, বরং সারা বিশ্বের সকল মানুষ উপকৃত হবে। ‘বিশ্বের সকল সভ্যতা আমাদের আত্মার পুনর্জাগরণের ভেতর দিয়ে উদ্দীপ্ত হয়ে উঠবে,’ ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন তিনি; ‘সকল ধর্মই নতুন ও মূল্যবান পোশাক পরিধান করবে, নোংরা, ঘৃণ্য ও অপরিচ্ছন্ন সবকিছু ছুঁড়ে ফেলে দেবে।৬৯ মেসিয়ানিক স্বপ্ন ছিল এটা। কুক সত্যিই বিশ্বাস করতেন, তিনি শেষ যুগে বাস করছেন, অচিরেই মানব ইতিহাসের চূড়ান্ত সম্পূর্ণতা প্রত্যক্ষ করবেন।

কাব্বালাহর সময়হীন প্রতীকের সাথে তাঁর যুগের অসাধারণ বিকাশকে সমন্বিত করার মাধ্যমে এক নতুন মিথ গড়ে তুলছিলেন কুক। কিন্তু আধুনিক কালের মানুষ হিসাবে এই মিথকে ভবিষ্যতের দিকে চালিত করেছেন; এখান ইতিহাসকে সামনের দিকে ঠেলে নিয়ে চলা বেদনাদায়ক ও উত্তাল গতিময়তা দেখানো হয়েছে। ইহুদি পাঠকদের পরিস্থিতির স্থিতাবস্থা ও যেমন হওয়ার কথা তাকেই মিনে নিতে সম্মত করার বদলে কুক যুক্তি দেখিয়েছেন যে, অতীতের সমস্ত পবিত্র আইন উপেক্ষা করে নতুন করে শুরু করা প্রয়োজন। কিন্তু আধুনিক চাপ সত্ত্বেও কুকের মিথ তারপরেও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক থেকে প্রাক আধুনিক বিশ্বের অংশ। তাঁর দুটি শিবিরের দৃষ্টিভঙ্গি, ধার্মিক ও সেক্যুলার যায়নবাদী, মিথোস ও লোগাসের প্রাচীন ধারণার খুবই কাছাকাছি, শ্রমের সমান বিভাজন তুলে ধরে। যুক্তিবাদী বাস্তববাদীরাই ইতিহাসকে সামনের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে, লোগোস সব সময়ই যেমন করে থাকে, অন্যদিকে ধার্মিক, মিথোস ও কাল্টের প্রাচীন বিশ্বে প্রতিনিধিত্বকারীরা এই কর্মকাণ্ডের ব্যাখ্যা দেয়। ‘আমরা তেফেলিন [ফিল্যাক্ট্রিজ] সাজাই,’ অর্থডক্স বুলি উচ্চারণ করতে পছন্দ করতেন কুক। ‘আর অগ্রগামীরা ইঁট সাজায়। মিথ ছাড়া যায়নবাদীদের কর্মকাণ্ড কেবল অর্থহীনই নয়, বরং দারুণভাবে দানবীয় প্রকৃতির। যায়নবাদীরা সেটা না বুঝতে পারে, বিশ্বাস করতেন কুক, ‘কিন্তু তারা ঈশ্বরেরই হাতের পুতুল, স্বর্গীয় নির্ধারিত পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সাহায্য করছে। কেবল এভাবেই তাদের ধর্মীয় বিদ্রোহকে গ্রহণযোগ্য করে তোলা যেতে পারে; অচিরেই—তাঁর জীবদ্দশাতেই এমনটা ঘটার ইঙ্গিতও দিয়েছেন কুক-পবিত্র ভূমিতে এক আধ্যাত্মিক বিপ্লব ঘটবে, ইতিহাসের নিষ্কৃতি ঘটবে।

রক্ষণশীল যুগের শৃঙ্খলার প্রতি নিবেদিত কুক চাননি তাঁর মিথ কোনও আদর্শ বা কর্মকাণ্ডের নীলনকশায় রূপান্তরিত হোক। সে যাই হোক, তাঁর অনুসারীর সংখ্যা ছিল খুবই কম, জীবদ্দশায় তাঁকে অনেকটা উন্মাদ ঠাওড়ানো হয়েছিল। কুক প্যালেস্তাইনে যায়নবাদীদের কর্মকাণ্ডের চলমান সমস্যাগুলোর কোনও রাজনৈতিক সমাধান দেননি। ঈশ্বরের কাছে সবকিছু তৈরি রয়েছে। ভবিষ্যতের ইহুদি রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ধরন সম্পর্কে কুক যেন নিদারুণভাবে নিস্পৃহ ছিলেন। ‘আমার দিক থেকে বলতে পারি, আমি পবিত্রতায় প্রোথিত আধ্যাত্মিক বিষয়বস্তু নিয়েই বেশি ভাবিত,’ ছেলে ভি ইয়েহুদাকে (১৮৯১–১৯৮১) লিখেছিলেন তিনি। ‘আমার কাছে এটুকু পরিষ্কার, সরকারী পর্যায়ের পরিস্থিতি যেমনই হোক না কেন, আত্মা শক্তিশালী হলে তা কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌছে দিতে পারবে, কারণ মুক্ত, উজ্জ্বল পবিত্রতার মহান প্রকাশের ভেতর দিয়ে আমরা সরকারের চলার পথকে আলোকিত করে তুলতে পারব।’৭১ বর্তমান নিষ্কৃতিহীন যুগে রাজনীতি দূর্নীতিগ্রস্ত, নিষ্ঠুর। ‘অশুভ কালের শাসনের ভয়ঙ্কর বৈষম্য’ দেখে বিতৃষ্ণ ছিলেন কুক। সৌভাগ্যক্রমে ৭০ সিইতে পবিত্র ভূমি হারিয়ে নির্বাসনে যাবার পর ইহুদিরা আর রাজনৈতিক ভুমিকা পালন করতে পারেনি; পৃথিবী নৈতিক ও আধ্যাত্মিকভাবে পরিবর্তিত না হওয়া পর্যন্ত ইহুদিদের উচিত রাজনীতির বাইরে থাকা। ‘যতক্ষণ রক্তপাতের ঘটনা ঘটছে, যতক্ষণ এখানে দুষ্টবুদ্ধির প্রয়োজন থাকছে, জ্যাকোবের সরকারে সংশ্লিষ্ট হওয়া চলবে না।’ তবে অচিরেই ‘বিশ্ব পরিশুদ্ধ হবে, এবং সেটা যখন ঘটবে, ইহুদিরা তাদের ইচ্ছামতো রাজনীতি ও বাস্তবসম্মত নীতিমালা বাস্তবায়ন করতে পারবে। ‘ঈশ্বরের সকল জাতি যখন কোনও নিশ্চিত উপায়ে তাদের দেশে থিতু হবে, তখন একে খাঁদ মুক্ত করতে, এর মুখ থেকে রক্ত মুছে ফেলতে জন্যে ও দাঁতের ফাঁক থেকে সকল আবর্জনা পরিষ্কার করার জন্যে [ভূ]রাজনৈতিক বলয়ে নজর দিতে পারবে তারা। প্রাক আধুনিক বিশ্বে মিথের বাস্তবক্ষেত্রে অনূদিত হওয়ার কথা ছিল না; সেটা ছিল লোগোসের কাজ—কুকের প্রকল্পে-অগ্রগামীদের

কুকের এখনও ধারণা বর্তমান কালে রাজনীতি ও ধর্ম পরস্পর মানানসই নয়, অর্থডক্স বিশ্বে এই বিশ্বাস টাবুর শক্তি ধারণ করেছিল। ধর্মকে পরিত্যাগকারী যায়নবাদীরা সমস্ত বাস্তব কাজ করছিল।

ইসরায়েল রাষ্ট্র সৃষ্টি হওয়ার তের বছর আগে, ১৯৩৫ সালে মারা যান কুক। আরব প্যালেস্তাইনে নিজেদের একটা রাষ্ট্র গড়ে তোলার জন্যে ইহুদিরা কী ভয়ঙ্কর কলাকৌশলের ভেতর দিয়ে যাবার অনুভূতি বোধ করেছে সেটা দেখার জন্যে বেঁচে ছিলেন না। তিনি কোনওদিনই ১৯৪৮ সালে স্বদেশভূমি থেকে ৭৫০,০০০ প্যালেস্তাইনের উৎখাত প্রত্যক্ষ করেননি, আরব ইসরায়েল যুদ্ধে আরব ও ইহুদিদের রক্ত ঝরতেও দেখেননি। তাঁকে ইসরায়েল রাষ্ট্র সৃষ্টির পঞ্চাশ বছর পরে পবিত্র ভূমির অধিকাংশ ইহুদি এখনও সেক্যুলারিস্ট রয়ে যাওয়ার বাস্তবতাও প্রত্যক্ষ করতে হয়নি। তাঁর ছেলে ভি ইয়েহুদা এইসব ব্যাপার প্রত্যক্ষ করবেন, এবং বুড়ো বয়সে বাবার মিথোসকে বাস্তব, রাজনৈতিক কর্মসূচিতে পরিণত করে মৌলবাদী আন্দোলন গড়ে তুলবেন।

কিন্তু এই ভীষণ সময়ে ইহুদিদের পক্ষে রাজনৈতিক জীবন বজায় রাখা কি সম্ভব ছিল? আধুনিক সমাজ কেবল ক্রমবর্ধমান হারে অ্যান্টি-সেমিটিক হয়ে উঠছিল না, বরং সেক্যুলারিজম ইহুদি সমাজের অভ্যন্তরে ভীষণভাবে ঢুকে পড়ছিল, প্রচলিত জীবনধারাকে করে তুলছিল অচল। পূর্ব ইউরোপে আধুনিকায়ন সূচিত হচ্ছিল মাত্র। রাশিয়া ও পোল্যান্ডের কিছু সংখ্যক র‍্যাবাই নতুন বিশ্বের দিকে মুখ ফিরিয়ে রেখে নিজেদের রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে রাখেন। কেমন করে ইহুদি পদবাচ্য কেউ একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের আধুনিক রাজনৈতিক জীবনের অবিশ্যিক অংশ দরকষাকষি ও আপোসে অংশ নিতে পারে? জেন্টাইলদের সাথে চুক্তি করে ও তাদের রাজনৈতিক সংগঠনে যোগ দিয়ে ইহুদিরা সম্প্রদায়ে অপবিত্র বিশ্বকে ডেকে আনবে; অনিবার্যভাবে একে তা দূষিত করবে। কিন্তু মহান মিসনাগদিক ইয়েশিভোত ও পোলিশ শহর গারের হাসিদিম দ্বিমত পোষণ করে। তারা বুঝতে পেরেছিল যে বিভিন্ন যায়নাবদী দল ও ইহুদি সমাজতান্ত্রিক দল ইহুদিদের এক ঈশ্বরবিহীন জীবনে প্রলুব্ধ করে চলেছে। সেক্যুলারিজমের দিকে এই স্রোত ও মিশেল রুদ্ধ করতে চেয়েছিল তারা। তারা বিশ্বাস করত এইসব আবিশ্যিকভাবে বিপজ্জনক আধুনিক বিপদগুলোকে তাদের কায়দাতেই আধুনিক উপায়ে মোকাবিলা করতে হবে। ধার্মিক ইহুদিদের অবশ্যই সেক্যুলারিস্টদের বিরুদ্ধে তাদের অস্ত্র দিয়েই লড়তে হবে। এর মানে ছিল অর্থডক্স স্বার্থ রক্ষার জন্যে একটা আধুনিক রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা। তারা যুক্তি দেখাল, এটা মোটেই আনকোরা কোনও ধারণা নয়। কিছু সময়ের জন্যে রাশিয়া ও পোল্যান্ডের ইহুদিরা ইহুদি সম্প্রদায়ের স্বার্থ রক্ষা ও কল্যাণের জন্যে সরকারের সাথে শ্াদলানাত (রাজনৈতি সংলাপ বা আলোচনা)-এ যোগ দিয়েছিল। নতুন অর্থডক্সি পার্টি এই কাজটিই অব্যাহত রাখবে, তবে আরও দক্ষ ও সংগঠিতভাবে।

১৯১২ সালে মিসনাগদিক রোশি ইয়েশিভোত ও গার হাসিদিম একটা নতুন দল আগুদাত ইসরায়েল (‘দ্য ইউনিয়ন অভ ইসরায়েল’) প্রতিষ্ঠা করে। ১৯০১ সালে র‍্যাবাই ইসাক জ্যাকব রেইনস (১৮৩৯-১৯১৫) প্রতিষ্ঠিত ‘ধার্মিক যায়নবাদীদের’ সংগঠন মিযরাচির সদস্যরা এতে যোগ দেয়। মিযরাচি প্যালেস্তাইনে সেক্যুলার যায়নাবাদী উদ্যোগকে গভীরভাবে ধর্মীয় বিকাশ বিবেচনাকারী র‍্যাবাই কুকের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন ও কম রেডিক্যাল ছিল। আরও কঠোর অর্থডক্স রেইনস একমত পোষণ করেননি: যায়নবাদীদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথে ধর্মীয় কোনও তাৎপর্য জড়িত নেই, তবে ইহুদি স্বদেশ ভূমির সৃষ্টি নির্যাতিত মানুষের পক্ষে বাস্তব সম্মত সমাধান, সেকারণে অর্থডক্সদের সমর্থনের দাবিদার। প্যালেস্তাইনে এক সময় একটা দেশ প্রতিষ্ঠিত হলে, মিরযাচির দৃষ্টিতে তা হয়তো আধ্যাত্মিক নবায়নের দিকে চালিত করবে ও সেখানে তোরাহর আন্তরিক অনুসরণ ঘটাবে। ১৯১১ সালে অবশ্য প্যালেস্তাইনে ধর্মীয় স্কুল পরিচালনার জন্যে কংগ্রেস সমপরিমাণ তহবিল বরাদ্দ দিতে ব্যর্থ হলে মিযরাচির প্রতিনিধিরা বাসেলে অনুষ্ঠিত, দশম যায়নিস্ট কংগ্রেস থেকে বের হয়ে আসেন। রেডিক্যাল সেক্যুলারিজমের প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ মনে হওয়া মূলধারার যায়নবাদের সাথে সহযোগিতা করতে না পারায় অচিরেই পূর্ব ও পশ্চিম ইউরোপে শাখা বিস্তারকারী আগুদাত ইসরায়েলের সাথে গাটছড়া বাঁধতে তৈরি ছিল তারা।

কিন্তু পশ্চিমের আগুদাতের সদস্যরা আন্দোলনকে রাশিয়ান ও পোলিশ ইহুদিদের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে দেখেছিল, প্রত্যক্ষ কর্মতৎপরতার ব্যাপারে তখনও খুবই সতর্ক বোধ লালন করছিল তারা। রাশিয়া ও পোল্যান্ডের ইহুদিরা আগুদাতকে স্রেফ একটা আত্মরক্ষামূলক সংগঠন হিসাবে দেখেছে; এর কাজ স্রেফ পূর্ব ইউরোপের সরকারের আধুনিকায়নের প্রয়াস পাওয়ার এমনি গুরুত্বপূর্ণ সময়ে ইহুদিদের স্বার্থ রক্ষা করা। কর্মকাণ্ডকে একেবারে ন্যূনতম পর্যায়ে সীমিত রাখে তারা, আধুনিক রাজনৈতিক কাঠামোয় ইহুদিদের ভাগ্য পরিবর্তনের চেষ্টা করে, যায়নাবাদকে পরিহার করে ও পোলিশ রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য প্রচার করে। কিন্তু পশ্চিমে, আধুনিকায়ন যেখানে অনেক দূর অগ্রসর হয়ে গিয়েছিল, ভিন্ন কিছুর জন্যে তৈরি ছিল ইহুদিরা। পশ্চিমের বেশির ভাগ আগুদাত সদস্য ছিল নিও-অর্থডক্স, এটা নিজেই ছিল ইহুদিবাদের আধুনিকায়িত ধরন। আধুনিক বিশ্বের সাথে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল তারা, তারা কেবল এই নতুনের ধাক্কা সামাল দিতে চাওয়ার বদলে বরং একে বদলে দিতে চেয়েছে। দলকে একটি আত্মরক্ষামূলক সংগঠন হিসাবে না দেখে কেউ কেউ চেয়েছে আগুদাত আক্রমণাত্মক ভূমিকা পালন করুক, এক প্রাথমিক মৌলবাদের বিকাশ ঘটাচ্ছিল তারা।

জ্যাকব রোসেনহেইমের (১৮৭০-১৯৬৫) চোখে আগুদাতের প্রতিষ্ঠা পুবের ইহুদিদের মতো কেবল কিছুটা অনুশোচনাযোগ্য প্রয়োজনীয়তা ছিল না, বরং এক মহাজাগতিক ঘটনা। ৭০ সিই-র পর এই প্রথমবারের মতো ইহুদিরা ‘একটা ঐক্যবদ্ধ ও ইচ্ছা-নির্ধারক কেন্দ্র’৭৫ লাভ করেছে। আগুদাত ইসরায়েলের উপর ঈশ্বরের শাসনকে প্রতীকায়িত করে, এর ইহুদি বিশ্বের কেন্দ্রে পরিণত হওয়া উচিত। তা সত্ত্বেও রাজনীতির ব্যাপারে কিছুটা অস্বস্তি বোধ করছিলেন রোসেনহেইম, তিনি চেয়েছিলেন আগুদাত ইহুদিদের স্কুল রক্ষণাবেক্ষণ ও ইহুদিদের অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষার কাজে নিজেকে সীমিত রাখুক। তরুণ সদস্যরা ছিল আরও রেডিক্যাল, প্রোটেস্ট্যান্ট মৌলবাদীদের অনেক কাছাকাছি ছিল তাদের চেতনা। ইসাক ব্রুয়ার (১৮৮৩-১৯৪৬) চেয়েছিলেন ইহুদি সমাজের সংস্কার ও সেক্যুলারাইজেশনের লক্ষ্যে আগুদাত উদ্যোগ নিয়ে প্রচারণায় নামুক। প্রিমিলেনিয়লিস্টদের মতো বিশ্বে ঈশ্বরের কর্মকাণ্ডের ‘নিদর্শন’ দেখতে পাচ্ছিলেন তিনি। মহাযুদ্ধ ও বেলফোর ঘোষণা ‘মেসায়াহর পদক্ষেপ’ ছিল। ইহুদিদের অবশ্যই বুর্জোয়া সমাজের দূষিত মূল্যবোধকে প্রত্যাখ্যান করতে হবে, ইউরোপের সরকারগুলোর সাথে আর সহযোগিতা করা যাবে না, পবিত্র ভূমিতে তাদের নিজস্ব পবিত্র ছিটমহল গড়ে তুলতে হবে, যেখানে তারা তোরাহ ভিত্তিক ধর্মতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ে তুলতে পারবে। ইহুদি ইতিহাস ওলটপালট হয়ে গেছে। পবিত্ৰ ঐতিহ্য থেকে ইহুদিরা বিচ্যুত হয়েছে। এখন সময় এসেছে ইতিহাসকে ফের আগের পথে ফিরিয়ে নেওয়ার; ইহুদিরা প্রথম পদক্ষেপ গ্রহণ করে দুর্নীতিগ্রস্ত ডায়াসপোরা থেকে নির্বাসনে গেলে ও নিজস্ব ভূমিতে তোরাহ অনুযায়ী জীবন যাপন করে আদি মূল্যবোধে ফিরে গেলে ঈশ্বর মেসায়াহকে প্রেরণ করবেন।৭৬

ইহুদি পণ্ডিত অ্যালান এল. মিটেলমান উল্লেখ করেছেন যে, আগুদাতের প্রাথমিক অভিজ্ঞতা মৌলবাদের কাজের ধারা তুলে ধরে। এটা আধুনিক সেক্যুলার সমাজের প্রতি কোনও অবিলম্ব প্রবল ধরনের প্রতিক্রিয়া নয়, বরং আধুনিকায়ন বেশ কিছুদূর অগ্রসর হওয়ার পরেই এর বিকাশ ঘটে। প্রথম প্রথম ঐতিহ্যবাদীরা- আগুদাতের পূর্ব ইউরোপিয় সদস্যদের মতো-স্রেফ নতুন চ্যালেঞ্জের সাথে নিজেদের ধর্মবিশ্বাসকে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা করে। তারা কিছু কিছু আধুনিক ধারণা ও প্রতিষ্ঠানকে গ্রহণ করে, প্রমাণ করার চেষ্টা করে যে এসব ট্র্যাডিশনের পক্ষে নতুন নয়, ধর্মবিশ্বাস এইসব পরিবর্তন আত্মস্থ করে নেওয়ার মতো যথেষ্ট শক্তি রাখে। কিন্তু সমাজ যখন আরও অধিকতরভাবে সেক্যুলার ও যৌক্তিক হয়ে ওঠে, কেউ কেউ তখন এর উদ্ভাবনসমূহকে অগ্রহণযোগ্য মনে করে। তারা বুঝতে শুরু করে সেক্যুলার আধুনিকতার সম্পূর্ণ ধাক্কা রক্ষণশীল প্রাক আধুনিক ধর্মের ছন্দের সম্পূর্ণ বিপরীত, এটা অত্যাবশ্যক মূল্যবোধকে হুমকি দিচ্ছে। তখন তারা ‘মৌলবাদী’ সমাধান খুঁজে বের করে যা প্রথম নীতিমালায় ফিরে যায় এবং পাল্টা হামলার পরিকল্পনা গ্রহণ করে।

*

আমাদের বিবেচনাধীন মুসলিমরা তখনও এই পর্যায়ে পৌঁছেনি। মিশরে আধুনিকায়ন শেষ হতে তখনও ঢের বাকি ছিল, আর ইরানে সেভাবে শুরুই হয়নি। মুসলিমরা তখনও হয় ইসলামি পরিপ্রেক্ষিতে নতুন ধ্যানধারণাকে আত্মস্থ করার প্রয়াস পাচ্ছিল বা সেক্যুলারিস্ট আদর্শ গ্রহণ করছিল। এইসব প্রাথমিক কলাকৌশল কোনও কোনও মুসলিমের চোখে অপর্যাপ্ত প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত ইসলামি বিশ্বে মৌলবাদের আবির্ভাব ঘটবে না। তারা সেক্যুলারিজমকে ইসলাম ধ্বংসের একটি প্রয়াস মনে করবে এবং প্রকৃতপক্ষে বিদেশী প্রেক্ষাপটেই মধ্যপ্রাচ্যে বাস্তবায়িত হতে চলা পাশ্চাত্য আধুনিকতাকে প্রায়শঃই সত্যিকার অর্থেই আক্রমণাত্মক মনে হয়েছে।

নব্য সেক্যুলার রাষ্ট্র তুরস্কে এটা একেবারেই স্পষ্ট ছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানির পক্ষে যুদ্ধ অংশগ্রহণকারী অটোমান সাম্রাজ্য ইউরোপিয় মিত্রপক্ষের কাছে পরাস্ত হয়, সাম্রাজ্য ছিন্নভিন্ন করে প্রাচীন অটোমান প্রদেশগুলোয় ম্যান্ডেট ও প্রটেক্টরেট প্রতিষ্ঠা করে তারা। আনাতোলিয়া ও প্রাচীন অটোমান প্রাণকেন্দ্ৰে আগ্রাসন চালায় গ্রিকরা। ১৯১৯ সাল থেকে ১৯২২ সাল পর্যন্ত মুস্তাফা কামাল আতাতুর্ক (১৮৮১-১৯৩৮) স্বাধীনতার লড়াইতে তুর্কি জাতীয়তাবাদী শক্তির নেতৃত্ব দেন। তিনি ইউরোপিয়দের তুরস্ক থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে সক্ষম হন এবং আধুনিক ইউরোপিয় কায়দায় পরিচালিত একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। ইসলামি বিশ্বে নজীর বিহীন পদক্ষেপ ছিল এটা। ১৯৪৭ সাল নাগাদ তুরস্ক একটি দক্ষ আমলাতন্ত্র ও পুঁজিবাদী অর্থনীতির অধিকার লাভ করে, পরিণত হয় মধ্যপ্রাচ্যের প্রথম বহুদলীয় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে। কিন্তু এই সাফল্য শুরুই হয়েছিল এক জাতিগত শুদ্ধি অভিযানের সাথে। ১৮৯৪ সাল থেকে শুরু করে ১৯২৭ সালের ভেতর অটোমান ও তুর্কি সরকারের ধারাগুলো পদ্ধতিগতভাবে বিদেশী উপাদানের হাত থেকে নিস্তার পাবার জন্যে আনাতোলিয়ার গ্রিক ও আর্মেনিয়দের বহিষ্কার, দেশান্তর বা হত্যা করে, এরা ছিল বুর্জোয়া সমাজের শতকরা ৯০ ভাগ। এই শুদ্ধিকরণ নতুন রাষ্ট্রকে কেবল স্পষ্ট তুর্কি জাতীয় পরিচয়ই দেয়নি, বরং আতাতুর্ককে সম্পূর্ণ তুর্কি বাণিজ্যিক শ্রেণী নির্মাণের সুযোগ করে দিয়েছে যা তাঁকে আধুনিক শিল্পায়িত অর্থনীতি গড়ে তুলতে সাহায্য করবে। ৭৮ অন্ততপক্ষে এক মিলিয়ন আর্মেনিয়র হত্যাকাণ্ড ছিল বিংশ শতাব্দীর প্রথম গণহত্যা, এবং র‍্যাবাই কুকের আশঙ্কা সত্যি প্রমাণ করে দেখিয়েছে যে, সেক্যুলার জাতীয়তাবাদ ক্রুসেড ও ধর্মের নামে পরিচালিত শুদ্ধি অভিযানের মতোই সমান ভয়ঙ্কর ও নিশ্চিতভাবেই বিপজ্জনক হতে পারে।

আতাতুর্কের তুরস্কের সেক্যুলারাইজেশন আগ্রাসীও ছিল। ইসলামকে ‘পাশ্চাত্যকৃত’ করে একে আইনি, রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক প্রভাবহীন ব্যক্তিগত বিশ্বাসে পরিণত করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন তিনি। ধর্মকে অবশ্যই রাষ্ট্রের অধীনে থাকতে হবে। বিভিন্ন সুফি ব্যবস্থাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়; সকল মাদ্রাসা ও কোরান স্কুলগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়; আইন করে পাশ্চাত্য পোশাক চালু করা হয়; নারীদের বোরখা পরা ও পুরুষদের ফেয মাথায় দেওয়া নিষিদ্ধ করা হয়। নকশবন্দি সুফি ব্যবস্থার নেতা শায়খ সাইদ সুরসি বিদ্রোহের নিতৃত্ব দিলে ইসলাম আত্মরক্ষার শেষ প্রয়াস পেয়েছিল, কিন্তু দ্রুত ও দক্ষতার সাথে আতাতুর্ক মাত্র দুই মাসে তা দমন করেন। পশ্চিমে সেক্যুলারাইজেশন মুক্তিদায়ী হিসাবে অনুভূত হয়েছিল; প্রাথমিক পর্যায়ে একে এমনকি ধার্মিক হওয়ার নতুন ও ভালো উপায় মনে করা হয়েছে। সেক্যুলারিজম ছিল অধিকাংশ ক্ষেত্রে বৃহত্তর সহিষ্ণুতার দিকে নিয়ে যাওয়া ইতিবাচক পরিবর্তন। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যে সেক্যুলারাইজেশন ছিল সহিংস ও নিপীড়নমূলক আক্রমণ। পরবর্তীকালের মুসলিম মৌলবাদীরা সেক্যুলারিজম ইসলামের বিনাশ ছিল দাবি করতে গিয়ে প্রায়শঃই আতাতুর্কের নজীর তুলে ধরবে।

মিশর তুরস্কের মতো দ্রুত স্বাধীনতা বা গণতন্ত্রের কোনওটাই পায়নি। প্ৰথম বিশ্বযুদ্ধের পর মিশরিয় জাতীয়তাবাদীরা স্বাধীনতার দাবি তুলেছিল; ইংরেজদের উপর আক্রমণ চালানো হয়, রেললাইন উপড়ে ফেলা হয়, টেলিগ্রাফের তার কেটে ফেলা হয়। ১৯২২ সালে ব্রিটেন মিশরকে কিছুমাত্রায় স্বাধীনতা দেয়। খেদিভ ফুয়াদ পরিণত হন নতুন রাজায়; মিশরকে একটি আদর্শ সংবিধান ও একটি প্রতিনিধিত্বশীল সংসদীয় সংগঠন দেওয়া হয়। কিন্তু সত্যিকারের গণতন্ত্র ছিল না এটা। ব্রিটেন প্রতিরক্ষা ও বিদেশনীতি নিজের নিয়ন্ত্রণে রেখে দিয়েছিল, ফলে সত্যিকারের স্বাধীনতা বলতে কিছু ছিল না। ১৯২৩ সাল থেকে ১৯৩০ সালের মধ্যে জনপ্রিয় ওয়াফদ পার্টি উদার সংবিধানের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে তিনটি বড় আকারের বিজয় লাভ করে, কিন্তু ব্রিটিশ বা রাজার তরফ থেকে চাপের কারণে প্রতিবারই পদত্যাগে বাধ্য হয়।” নতুন গণতান্ত্রিক কাঠামোগুলো ছিল স্রেফ প্রসাধন, এই স্বাধীনতা আধুনিক চেতনার পক্ষে আবশ্যক স্বায়ত্তশাসন গড়ে তোলার বেলায় মিশরিয়দের কোনও কাজে আসত না। তাছাড়া, ব্রিটিশরা যতই নির্বাচনী প্রক্রিয়া নিয়ে ছলচাতুরি খেলছিল ততই গণতান্ত্রিক আদর্শ দূষিত মনে হতে শুরু করেছিল।

তাসত্ত্বেও বিংশ শতাব্দীর প্রথম তিন দশকে নেতৃস্থানীয় মিশরিয় চিন্তাবিদগণ যেন সেক্যুলার আদর্শের দিকেই ঝুঁকে ছিলেন বলে মনে হয়েছে। আব্দুহ’র অন্যতম শিষ্য লুফতি আল-সায়ীদের (১৮৭২-১৯৬৩) রচনাবলীতে ইসলাম খুবই সামান্য ভূমিকা রেখেছে। জাতীয়তাবাদের আদর্শই পাশ্চাত্যের সাফল্যের গোপন সূত্র থাকার ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত ছিলেন, ইসলামি ভিত্তিতে আধুনিক প্রতিষ্ঠানসমূহ রোপন করা জরুরি মনে করেছেন। ইসলাম সম্পর্কে লুফতির দৃষ্টিভঙ্গি ছিল সম্পূর্ণ প্রায়োগিক। ধর্ম অবশ্যই আধুনিক জাতীয় ঐকমত্য গড়ার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে, কিন্তু এটা অন্যান্য উপাদানের একটি মাত্র। ইসলামের বিশেষ বা ভিন্ন কিছু দেওয়ার নেই। অধিকাংশ মিশরিয় মুসলিম বলেই এটা মিশরের রাষ্ট্রীয় ধর্ম হয়েছে; এটা তাদের নাগরিক গুণাবলী চর্চায় সাহায্য করবে, কিন্তু ভিন্ন সমাজে অন্য কোনও ধর্মবিশ্বাস ঠিক একাজই করবে।” আলি আব্দ আল-রাযিকের (১৮৮৮-১৯৬৬) আল-ইসলাম ওয়া উসুল আল-হুকুম (‘ইসলাম অ্যান্ড দ্য বেসেস অভ পাওয়ার’, ১৯২৫) বইটি ছিল আরও রেডিক্যাল, এখানে যুক্তি দেখানো হয়েছে যে, ইসলামের সাথে মিশরের সম্পর্ক চ্যুতি ঘটানো উচিত। তিনি যুক্তি তুলে ধরেন যে, খেলাফতের প্রতিষ্ঠানসমূহ কোরানে উল্লেখিত হয়নি আর পয়গম্বর মুহাম্মদ (স) বিংশ শতাব্দীর দৃষ্টিভঙ্গিতে রাষ্ট্রপ্রধান বা সারকার প্রধান ছিলেন না, সুতরাং সম্পূর্ণ সেক্যুলারিস্ট মিশরিয় ধরনের রাজনীতি প্রতিষ্ঠার বেলায় মিশরিয়দের ঠেকানোর মতো কোনও কারণ নেই।৮১

আল-রাযিকের বইয়ের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রতিবাদের ঝড় উঠেছিল। বিশেষ করে সাংবাদিক রশিদ রিদাহ (১৮৬৫-১৯৩৫) ঘোষণা করেছিলেন যে, এই ধরনের চিন্তাভাবনা কেবল মুসলিম জাতির ঐক্যই দুর্বল করবে না বরং তাদের আরও সহজে পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদের শিকারে পরিণত করবে। সেক্যুলার পথ বেছে নেওয়ার বদলে রিদাহই প্রথম শরীয়াহ ভিত্তিক সম্পূর্ণ আধুনিকায়িত ইসলামি রাষ্ট্রের কথা উচ্চারণ করেছিলেন। তাঁর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রচনা আল-খালিফা (১৯২২-২৩)-য় খেলাফতের পুনঃপ্রতিষ্ঠার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন তিনি। রিদাহ ছিলেন আব্দুহর জীবনীকার ও বিশাল ভক্ত, কিন্তু পাশ্চাত্য ভাবনা সম্পর্কে ব্যাপক ওয়াকিবহাল হলেও তিনি কখনওই আব্দুহর মতো ইউরোপিয়দের সাথে স্বচ্ছন্দ বোধ করেননি। খেলাফত প্রয়োজন, কারণ তা মুসলিমদের কার্যকরভাবে পশ্চিমের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে সাহায্য করবে, কিন্তু এটা দীর্ঘমেয়াদী সমাধান নয়। একটা সত্যিকারের আধুনিক খেলাফত প্রতিষ্ঠার আগে প্রস্তুতির দীর্ঘ সময় প্রয়োজন হবে। রিদাহ ভবিষ্যৎ খলিফাকে একজন মহান মুজতাহিদ হিসাবে কল্পনা করেছেন, যিনি ইসলামি আইনে এতটাই বিশেষজ্ঞ হবেন যে, শরীয়াহকে শিথিল না করেই একে আধুনিক করতে সক্ষম হবেন। এভাবে তিনি মুসলিমদের সত্যিকার অর্থে পালন করার মতো আইন-কানুন সৃষ্টি করতে পারবেন, কারণ সেগুলো সত্যিকার অর্থেই বিদেশ থেকে আমদানি করার বদলে তাদের নিজস্ব ঐতিহ্য ভিত্তিক হবে।৮২

রিদাহ ছিলেন ইবন তাঈমিয়াহ ও আব্দ আল-ওয়াহাবের ধারার টিপিক্যাল মুসলিম সংস্কারক। আদ ফন্তেসে প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমে বিদেশী হুমকির মোকাবিলা করতে চেয়েছেন তিনি। কেবল সালাফের-প্রথম প্রজন্মের মুসলিম-আদর্শে প্রত্যাবর্তনের ভেতর দিয়েই আধুনিক মুসলিমরা নতুন ও সজীব ইসলাম তৈরি করতে পারবে। কিন্তু রিদাহর সালাফিয়াহ আন্দোলন অতীতে দাসত্বমূলক প্রত্যাবর্তন ছিল না। আধুনিকায়ন প্রক্রিয়ার প্রাথমিক পর্যায়ের অন্যান্য সংস্কারকের মতো ইসলামি প্রেক্ষাপটে স্থাপন করার মাধ্যমে আধুনিক পশ্চিমের শিক্ষা ও মূল্যবোধসমূহকে আত্মস্থ করার প্রয়াস পাচ্ছিলেন তিনি। তিনি একটি সেমিনারি প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন যেখানে ছাত্ররা আন্তর্জাতিক আইন, সমাজবিজ্ঞান, বিশ্ব- ইতিহাস, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সংগঠন এবং পাশ্চাত্য বিজ্ঞানের সাথে পরিচিত হতে পারবে; আবার একই সময়ে ইসলামি জুরিসপ্রুডেন্স নিয়েও গবেষণা করতে পারবে। এভাবে এক নতুন শ্রেণীর উলেমার বিকাশ ঘটবে, যারা হবে আযহারের পণ্ডিতদের বিপরীতে (রিদাহ তাদের হতাশাব্যঞ্জকভাবে পশ্চাদবর্তী মনে করতেন) সত্যিকারের সময়ের মানুষ, ঐতিহ্যের প্রতি বিশ্বস্ত উদ্ভাবনী ইজতিহাদের চর্চা করতে পারবে। একদিন এই নতুন উলেমার একজন হয়তো খলিফায় পরিণত হবেন।৮৪ রিদাহ মোটেই মৌলবাদী ছিলেন না; পাল্টা ডিসকোর্স সৃষ্টির বদলে ইসলাম ও আধুনিক পশ্চিমা সংস্কৃতির বন্ধন সৃষ্টির চেষ্টা করছিলেন তিনি, কিন্তু তাঁর রচনা ভবিষ্যতের মৌলবাদীদের উপর প্রভাব বিস্তার করবে। জীবনের শেষ দিকে রিদাহ ক্রমবর্ধমানহারে মিশরিয় জাতীয়তাবাদীদের কাছ থেকে সরে যান। সেক্যুলারিজমকে সমাধান মনে করেননি তিনি। আতাতুর্কের নিষ্ঠুরতায় ভীত বোধ করেছেন। রাষ্ট্র চরম মূল্যে পরিণত হলে এবং একজন শাসককে জাতীর স্বার্থ উদ্ধারের লক্ষ্যে বাস্তবভিত্তিক অথচ নিষ্ঠুর নীতি গ্রহণে বাধা দেওয়ার মতো কিছু না থাকলে এমনটাই কি ঘটে? রিদাহ বিশ্বাস করতেন, মধ্যপ্রাচ্যে-ক্রিশ্চান পাশ্চাত্যে যদি নাও হয়-ধর্মের অবনতির কারণেই নির্যাতন ও অসহিষ্ণুতার ঘটনা ঘটছে।*৫ অনেক নেতৃস্থানীয় মিশরিয় চিন্তাবিদ যখন ইসলাম থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছিলেন সেই সময়ে রিদাহ বিশ্বাস করেছিলেন যে, আধুনিক মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর আগের চেয়ে বেশি না হলেও সমান পরিমাণ ধর্মীয় বাধা থাকা প্রয়োজন।

মিশরের জনগণ যদি জাতীয়তাবাদই ইউরোপের সাফল্যের গোপন সূত্র বলে বিশ্বাস করতে শুরু করে থাকে, ইরানিরা বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকের বছরগুলোয় বিশ্বাস করেছে যে, ‘সাংবিধানিক’ সরকারই ছিল এই গোপন সূত্র। এই পর্যায়ে বহু মিশরিয়র মতো ইরানিরা পশ্চিমের মতো হতে চেয়েছে। ১৯০৪ সালে সম্প্ৰতি সাংবিধানিক সরকার বেছে নেওয়া জাপান রাশিয়ার উপর শোচনীয় পরাজয় চাপিয়ে দিয়েছিল। বহুদিন ধরেই জাপান ছিল ইরানের মতোই অজ্ঞ ও পশ্চাদপদ, সংস্কারকগণ যুক্তি দেখিয়েছেন, কিন্তু এখন সংবিধানের কল্যাণে তারা ইউরোপিয়দের মতো একই স্তরে উঠে এসেছে, এবং তাদের নিজস্ব খেলায় হারাতে পারছে। এমনকি কোনও কোনও উলেমা শাহদের স্বেচ্ছাচারী শাসন রুদ্ধ করার জন্যে প্রতিনিধিত্বমূলক সরকারের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে নিশ্চিত ছিলেন। উদার মুজতাহিদ সায়ীদ মুহাম্মদ তাবাতাবাদি যেমন ব্যাখ্যা করেছেন:

আমরা নিজেদের সাংবিধানিক শাসন দেখিনি। কিন্তু আমরা এর কথা শুনেছি, সাংবিধানিক সরকার প্রত্যক্ষকারীরা আমাদের বলেছেন যে, সাংবিধানিক শাসন দেশে নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধি নিয়ে আসবে। এটা আমাদের মাঝে এক ধরনের তাগিদ ও উৎসাহ সৃষ্টি করেছে।১৬

আত্মরক্ষামুলকভাবে মাদ্রাসার জগতে পিছু হটা মিশরিয় উলেমাদের বিপরীতে ইরানি উলেমাগণ প্রায়শঃই পরিবর্তনের পুরোধা ছিলেন, আসন্ন ঘটনাপ্রবাহে চূড়ান্ত ভুমিকা পালন করবেন তাঁরা।

১৯০৫ সালের ডিসেম্বর মাসে তেহরানের গভর্নর সরকারী নির্দেশ মোতাবেক মূল্য হ্রাস না করায় কয়েকজন চিনি ব্যবসায়ীর পায়ে আঘাত হানার নির্দেশ দেন। উচ্চ আমদানি শুল্কই উচ্চ মূল্য রাখা প্রয়োজনীয় করে তোলার যুক্তি দেখিয়েছিল তারা। প্রধানমন্ত্রী আইন আল-দৌলাহ কর্তৃক উৎখাত হওয়ার আগ পর্যন্ত উলেমা ও বাজারিদের এক বিশাল দল তেহরানের রাজকীয় মসজিদে আশ্রয় নেন। সাথে সাথে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মোল্লাহ তাবাতাবাদিকে অনুসরণ করে একটা প্রধান উপাসনালয়ে উপস্থিত হয়ে দাবি করেন যে, শাহকে একটি প্রতিনিধিত্বমূলক ‘হাউস অভ জাস্টিস’ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। শাহ সম্মত হন, উলেমাগণ আবার তেহরানে ফিরে যান, কিন্তু প্রধানমন্ত্রী প্রতিশ্রুতি পূরণের কোনও রকম আভাস না দেওয়ায় দাঙ্গা বেধে যায়, সেখানে ও বিভিন্ন প্রদেশে দাঙ্গা বেধে যায় এবং জনপ্রিয় যাজকগণ মিম্বর থেকে সরকারের প্রচণ্ড নিন্দাবাদ উচ্চারণ করতে থাকেন, সাধারণ মানুষকে উত্তেজিত করে তোলেন তাঁরা। অবশেষে ১৯০৬ সালের জুলাই মাসে তেহরানের মোল্লাহরা কুমের উদ্দেশে গণঅভিযাত্রার আয়োজন করেন, অন্যদিকে প্ৰায় ১৪,০০০ বণিক ব্রিটিশ লিগেশনে আশ্রয় নেয়। বিক্ষোভকারীরা আইন আল-দৌলাহর বরখাস্ত করণ ও একটি মজলিসের (‘প্রতিনিধিত্বমূলক সংসদ’) প্রতিষ্ঠার দাবি জানাতে থাকে, আরও বিজ্ঞ সংস্কারকগণ মাশরুতেহ (‘সংবিধান’) নিয়ে আলোচনা শুরু করেন।৮৭

সাংবিধানিক বিপ্লব প্রাথমিকভাবে সফল ছিল। প্রধানমন্ত্রীকে জুলাইয়ের শেষের দিকে বরখাস্ত করা হয়, এবং অক্টোবরে তেহরানে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক উলেমা অন্ত র্ভুক্তকারী প্রথম মজলিস উদ্বোধন করা হয়। এক বছর পরে নয়া শাহ মোহাম্মদ আলি বেলজিয়ান সংবিধানের আদলে প্রস্তুত ফান্ডামেন্টাল ল’ স্বাক্ষর করেন। এর ফলে সকল গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে রাজার মজলিসের কাছ থেকে অনুমোদন নেওয়া প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল: সকল নাগরিক (ভিন্ন ধর্মবিশ্বাস লালনকারীসহ) আইনের চোখে সমান অধিকার ভোগ করেছে এবং সংবিধান ব্যক্তিগত অধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করেছে। গোটা ইরান জুড়ে উদার কর্মকাণ্ডের একটা জোয়ার শুরু হয়েছিল। প্রথম মজলিস সংবাদপত্রের স্বাধীনতা দিয়েছিল, এবং অবিলম্বে সমালোচনামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হতে শুরু করেছিল। নতুন বিভিন্ন সমাজ গড়ে ওঠে, একটি জাতীয় ব্যাংক প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়, একটা নতুন মিউনিপ্যাল কাউন্সিল নির্বাচিত হয়। তাব্রিযের মেধাবী তরুণ ডেপুটি সায়ীদ হাসান তাকিযাদেহ মজলিসে বামপন্থী গণতান্ত্রিক দলের নেতৃত্ব দেন, অন্যদিকে মুজতাহিদ আয়াতোল্লাহ তাবাতাবাদি ও সায়ীদ আব্দাল্লাহ বেহবেহানি শরীয়াহর মর্যাদা রক্ষা করতে কিছু ধারা সংযোজনে সক্ষম হওয়া রক্ষণশীল দলের নেতৃত্বে ছিলেন।

কিন্তু উদারপন্থী যাজকগোষ্ঠী ও সংস্কারকদের ভেতর এই সহযোগিতার প্রদর্শনী সত্ত্বেও প্রথম মজলিস এক গভীর বিভাজন তুলে ধরেছিল। সাধারণ ডেপুটিদের অনেকেই ছিলেন মালকুম খান বা কিরমানির সাথে সংশ্লিষ্ট ভিন্নমতাবলম্বী, এরা উলেমাদের প্রতি কেবল অসন্তোষই বোধ করতেন। তাঁদের প্রায়শঃই বিপ্লবী ধ্যানধারনার প্রচার চালাতে গঠিত আনজুমান-(‘গোপন গোষ্ঠী’)- এর সদস্য হতে দেখা যেত, এমনকি অধিকতর রেডিক্যাল যাজকের সাথে এইসব দলের সম্পর্ক ছিল, সংস্কারকগণ সাধারণত উলেমাদের প্রগতির পথে বাধা হিসাবে বিবেচেনা করতেন। সংস্কারকদের সাথে যোগ দেওয়া উলেমাগণ শরীয়াহকে সংবিধানে রাষ্ট্রীয় বিধানে পরিণত করার প্রত্যাশা করে থাকলে হতাশ হয়েছিলেন তাঁরা। প্রথম মজলিস অবিলম্বে শিক্ষার মতো বিষয়ে যাজকগোষ্ঠীর ক্ষমতা হ্রাস করার পদক্ষেপ গ্রহণ করে; পরিহাসের ব্যাপার, অসংখ্য মোল্লাহর সমর্থন লাভকারী সাংবিধানিক বিপ্লব দেশে তাঁদের ব্যাপক ক্ষমতার অবসানের সূচনা প্রত্যক্ষ করেছিল।৮৮

শিয়া উলেমা কখনওই এর আগে রাজনীতিতে এমন সক্রিয় ভূমিকা রাখেননি। কোনও কোনও পণ্ডিত বিশ্বাস করেন যে, তারা প্রধানত নিজেদের অধিকার ও স্বার্থ রক্ষা ও বিধর্মী পশ্চিমকে ঠেকানোর আশা নিয়েই বেশি অনুপ্রাণিত ছিলেন। * অন্যরা যুক্তি দেখিয়েছেন যে, শাহগণের স্বৈরাচারী ক্ষমতা খর্ব করবে এমন একটি সংবিধানের পক্ষাবলম্বন করতে গিয়ে অধিকতর উদার উলেমাগণ স্বৈাচারের বিরোধিতা করার প্রাচীন শিয়া দায়িত্বই পালন করছিলেন। সাধারণ সংস্কারকগণ উলেমাদের বিশাল ক্ষমতার কথা মনে রেখে বিপ্লবের সময় মুসলিম অনুভূতিতে আঘাত না দেওয়ার ব্যাপারে সতর্ক ছিলেন, তবে যাজকদের প্রতি বহু আগে থেকেই বৈরী ভাবাপন্ন ছিলেন তাঁরা, তাই ক্ষমতা লাভ করামাত্র আইন ব্যবস্থা ও শিক্ষাকে সেক্যুলারাইজ করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। এই সেক্যুলারাইজেশনের বিপদ শনাক্তকারীদের অন্যতম প্রথম ছিলেন তেহরানের প্রধান তিন যাজকের একজন শায়খ ফদলুল্লাহ নুরি (১৮৪৩-১৯০৯)। ১৯০৭ সালে তিনি সংবিধানের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু করেন। তিনি যুক্তি তুলে ধরেছিলেন যে, গোপন ইমামের অনুপস্থিতিতে সরকারের বৈধতা না থাকায় নতুন সংসদ অনৈসলামিক। মজলিস নয়, মুজতাহিদগণই ইমামের ডেপুটি, তাঁদেরই আইন প্রণয়ন ও জনগণের স্বার্থ রক্ষা করা উচিত। এই নতুন ব্যবস্থার অধীনে অবশ্য যাজকরা স্রেফ ‘অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মতো হয়ে দাঁড়াবেন, তাঁরা আর জনগণের প্রধান আধ্যাত্মিক পথপ্রদর্শক থাকবেন না, ধর্ম বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়বে। নুরি দাবি জানালেন, মজলিস অন্ততপক্ষে শরীয়াহর উপর ভিত্তি করে আইন-কানুন প্রণয়ন করুক। তাঁর আপত্তির মুখে সংবিধানে সংশোধন আনা হয় : মজলিস কর্তৃক ইসলামি আইনের সাথে বিরোধিতাকারী আইনে ভেটো দেওয়ার ক্ষমতাসহ নির্বাচিত পাঁচজন উলেমার একটি প্যানেল গঠন করা হয়।৯১

তাসত্ত্বেও নুরি সংখ্যালঘুর দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছেন। নাজাফের বেশিরভাগ মুজতাহিদ সংবিধান সমর্থন করেছিলেন, তাঁরা সেটা অব্যাহত রাখবেন। তাঁরা গোপন ইমামের প্রত্যক্ষ নির্দেশনা ছাড়া আইন সঠিকভাবে প্রয়োগ সম্ভব নয় দাবি করে শরীয়াহকে রাষ্ট্রীয় আইনে পরিণত করার নুরির দাবির বিরোধিতা করেন। আরও একবার শিয়াহ অন্তর্দৃষ্টি রাষ্ট্রব্যবস্থার সেক্যুলারাইজেশনকে অনুপ্রাণিত করেছে এবং এখনও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে ধর্মের সাথে বেমানান বিবেচনা করেছে। বহু যাজক কাজারদের বিদেশীদের কাছে অগ্রহণযোগ্য অর্থিক কনসেশন দিতে ও ব্যয়বহুল ঋণ গ্রহণে বাধ্য করা দরবারের ক্রমবর্ধমান দুর্নীতি ও সরকারের অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতায় বিতৃষ্ণ ছিলেন। তাঁরা লক্ষ করেছিলেন, এমনি অদূরদর্শী আচরণ মিশরকে সামরিক দখলদারির দিকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল। কাজারদের নির্যাতনমূলক নীতিমালাকে সংবিধানের মাধ্যমে সীমিত করা সম্ভব বলে মনে হয়েছিল। এই শায়খ মুহাম্মদ হুসেইন নাইনি (১৮৫০-১৯৩৬)-এর অ্যডমোনিশন টু দ্য নেশন অ্যান্ড এক্সপোজিশন টু দ্য পিপল-এ এই দৃষ্টিভঙ্গি জোরের সাথে প্রকাশিত হয়। ১৯০৯ সালে নাজাফে এটি প্রকাশিত হয়। নাইনি যুক্তি দেখান যে, গোপন ইমামের পর প্রতিনিধিত্বমূলক সরকারই সেরা উপায়; স্বৈরাচারী শাসককে নিয়ন্ত্রণে সক্ষম সংসদ প্রতিষ্ঠা স্পষ্টতই শিয়াহদের উপযুক্ত কাজ। স্বৈরাচারী শাসক ইসলামের চরম পাপ বহুঈশ্বরবাদীতার (শিরক) অপরাধে অপরাধী, কারণ তিনি ঐশী ক্ষমতার প্রতি উদ্ধত আচরণ করেছেন এবং খোদ ঈশ্বরের মতো আচরণ করেছেন, যেন প্রজাকূলের অধিপতি। ফারাওর শক্তিকে ধ্বংস করার জন্যে পয়গম্বর মোজেসকে পাঠানো হয়েছিল। ফারাও জনগণের উপর নির্যাতন চালিয়েছেন, তাদের দাসত্বের শৃঙ্খলে বন্দি করেছিলেন। মোজেস তাঁকে আল্লাহর আইন মেনে নিতে বাধ্য করেছিলেন। একই ভাবে ধর্মীয় বিশেষজ্ঞদের প্যানেলের সাহায্যে নতুন মজলিসকে শাহদের ঈশ্বরের আইন মানা নিশ্চিত করতে হবে।৯৩

তবে উলেমাদের তরফ থেকে নয় বরং নতুন সংবিধানের সবচেয়ে মারাত্মক বিরোধিতা এসেছিল নতুন শাহর কাছ থেকে; রাশিয়ান কস্যাক ব্রিগেডের সহায়তায় ১৯০৮ সালের জুনে একটি সফল অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেন তিনি এবং মজলিস বন্ধ করে দেন; সবচেয়ে রেডিক্যাল ইরানি সংস্কারক ও উলেমাদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। কিন্তু তাব্রিযের পপুলার গার্ড শাহর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় এবং বখতিয়ারি গোত্রের সহায়তায় পরের মাসে পাল্টা অভ্যুত্থান পরিচালনা করে শাহকে গদিচ্যুত করে তাঁর নাবালক পুত্র আহমাদকে একজন উদার রিজেন্টের সাথে সিংহাসনে বসায়। দ্বিতীয় মজলিস নির্বাচিত হয়, কিন্তু মিশরের মতো এই দুর্বল সংসদীয় ব্যবস্থাটি ইউরোপিয় শক্তিগুলোর হাতে বিধ্বস্ত হয়ে যায়। মজলিস একজন আমেরিকান ফিনান্সিয়ার মরগান শুস্টারকে নিয়োগ দিয়ে ব্রিটেন ও রাশিয়ার দীর্ঘদিন ধরে ইরানের উপর যে শৃঙ্খল চাপিয়ে রেখেছিল সেটা থেকে বের হয়ে আসার প্রয়াস পেলে রাশিয়ান বাহিনী তেহরানে হাজির হয় ও ১৯১১ সালের ডিসেম্বরে মজলিস রুদ্ধ করে দেয়। আরও তিন বছর পর মজলিসকে আবার অধিবেশন ডাকার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। এই সময়ের ভেতর অনেকেই তিক্ত ও মোহমুক্ত হয়ে গিয়েছিল। সংবিধান তাদের প্রত্যাশা মোতাবেক কোনও মহৌষধ ছিল না, বরং স্রেফ ইরানের মৌলিক অক্ষমতাকে নিষ্ঠুর ও স্পষ্ট রূপ দান করেছে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ইরানের পক্ষে দারুণ বিঘ্নকারী ছিল, ফলে বহু ইরানি শক্তিশালী সরকারের আকাঙ্ক্ষা করতে শুরু করেছিল। ১৯১৭ সালে ব্রিটিশ ও রাশিয়ান বাহিনী দেশটি দখল করে নেয়। বলশেভিক বিপ্লবের পর রাশিয়ানরা প্রত্যাহৃত হয়, কিন্তু দেশের উত্তরাঞ্চলে তাদের ছেড়ে দেওয়া এলাকায় ব্রিটিশরা এগিয়ে যায়, আবার দক্ষিণে নিজেদের ঘাঁটিগুলোয়ও দখল অব্যাহত রাখে। ইরানকে একটি প্রটেক্টরটে পরিণত করতে উদগ্রীব ছিল ব্রিটিশ। ১৯০৮ সালে এদেশে তেল আবিষ্কৃত হয়েছিল, একজন ব্রিটিশ নাগরিক উইলিয়াম কক্স ডি’আরসিকে কনশেসন দেওয়া হয়েছিল; ১৯০৯ সালে অ্যাংলো-পারসিয়ান অয়েল কোম্পানি গঠন করা হয়, ইরানি তেল ব্রিটিশ নৌবাহিনীর জ্বালানির সরবরাহ করতে শুরু করে। ইরান পরিণত হয়েছিল এক বিরাট লোভনীয় বস্তুতে। কিন্তু মজলিস ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণ প্রতিহত করতে শুরু করে। ১৯২০ সালে সারা দেশে ব্রিটিশ বিরোধী বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়, মজলিস সোভিয়েত রাশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে সাহায্য চেয়ে পাঠায়। ব্রিটেন পরিকল্পনা বাদ দিতে বাধ্য হয়। তবে ইরানিরা করুণভাবে সচেতন হয়ে উঠেছিল যে কেবল অন্য শক্তির শরণাপন্ন হয়েই স্বাধীনতা বজায় রাখতে পারছে তারা, যাদের আবার ইরানের তেল নিয়ে নিজস্ব পরিকল্পনা রয়েছে। ইরানের একটি সংবিধান ও প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার ছিল বটে, কিন্তু মজলিসের প্রকৃত কোনও ক্ষমতা না থাকায় তা ছিল অর্থহীন। এমনকি আমেরিকানরাও লক্ষ করেছিল যে, ব্রিটিশরা অব্যাহতভাবে নির্বাচনে কারচুপি করে চলেছে ও ইরানিদের ‘বর্তমান সামরিক আইন ও নিয়ন্ত্রণাধীন সংবাদপত্রের মাধ্যমে মতামত বা কোনওভাবে অনুভূতি প্রকাশে বাধা দেওয়া হচ্ছে।’৯৪

অসন্তোষের চলমান মনোভাব জনৈক বেসামরিক ব্যক্তিত্ব সায়ীদ জিয়া আদ- দিন তাবতাবাতি ও শাহর কস্যাক ব্রিগেডের কমান্ডার রেযা খানের (১৮৭৭-১৯৪৪) নেতৃত্বে ক্ষুদ্র একটি দলের পক্ষে সরকারকে উৎখাত করা সহজ করে দিয়েছিল। ১৯২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জিয়া আদ-দিন প্রধানমন্ত্রী হন, রেযা খান পান আইন মন্ত্রীর দায়িত্ব। জিয়া আদ-দিন বিটিশপন্থী হিসাবে পরিচিত থাকায় ব্রিটিশরা এটা মেনে নিয়েছিল, তারা আশা করেছিল তাঁর নির্বাচনের ফলে প্রটেক্টরেট বানানোর পরিকল্পনা অগ্রসর হবে। পুরোপুরি পরিকল্পনা পরিত্যাগ করেনি তারা। কিন্তু দুই নেতার ভেতর রেযা খান ছিলেন অধিকতর শক্তিশালী, অচিরেই জিয়াকে নির্বাসনে পাঠাতে সক্ষম হন তিনি, একটি নতুন কেবিনেট গঠন করেন এবং পরিণত হন একক শাসকে। সাথে সাথে দেশের আধুনিকায়নের কাজে হাত দেন রেযা। জনগণ নিদারুণভাবে হতাশ ও পরিবর্তনের জন্যে প্রস্তুত থাকায় তাঁর পূর্বসুরিরা যেখানে ব্যর্থ হয়েছিলেন তিনি সেখানে সফল হন। সামাজিক সংস্কার বা দরিদ্রদের নিয়ে তাঁর কোনও মাথাব্যথা ছিল না। তাঁর লক্ষ্য ছিল স্রেফ দেশকে কেন্দ্রিভূতকরণ, সেনাবাহিনী ও আমলাতন্ত্রকে শক্তিশালী করা এবং ইরানকে আরও দক্ষতার সাথে কার্যকর করে তোলা। যেকোনও ধরনের বিরোধিতাকে কঠোর হাতে দমন করা হয়েছে। একেবারে গোড়া থেকেই রেযা ব্রিটিশদের হাত থেকে দেশকে উদ্ধার করার জন্যে রাশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তোয়াজ করে চলছিলেন। আমেরিকান কারিগরি পরামর্শ ও বিনিয়োগের বিনিময়ে স্ট্যান্ডার্ড অয়েল কোম্পানি অভ নিউ জার্সিকে তেলের কনসেশন দেওয়া হয়েছিল। ১৯২৫ সালে রেযা শেষ কাজার শাহকে ক্ষমতা ত্যাগে সম্মত করার মতো যথেষ্ট শক্তিশালী হয়ে ওঠেন। তবে মূল লক্ষ্য ছিল একটি প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা, কিন্তু উলেমারা আপত্তি তোলেন। মজলিসে আয়াতোল্লাহ মুদ্দারিস ঘোষণা করেন, প্রজাতন্ত্র অনৈসলামিক। আতাতুর্কের সাথে সংশ্লিষ্টতার কারণে দূষিত। যাজকগোষ্ঠীর কোনও ইচ্ছাই ছিল না ইরানও তুরস্কের মতো একই পথের পথিক হোক। রেযার শাহ হওয়ার বেলায় কোনও আপত্তি ছিল না। তখনও যাজকদের দরবারকে তোয়াজ করে চলতে উদগ্রীব ছিলেন তিনি। তিনি তাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, সরকার ইসলামের মর্যাদা রক্ষা করবে, এর বিধিবিধানসমূহ শরীয়াহর সাথে বিরোধে যাবে না। এরপর জনাকীর্ণ মজলিস পাহলভী বংশের পক্ষে রায় দেয়। কিন্তু শাহ রেযা পাহলভীর উলেমাদের কাছে দেওয়া প্রতিশ্রুতি ভাঙতে দেরি হবে না, তিনি কেবল আতাতুর্কের নিষ্ঠুর সেক্যুলারাইজেশনের সমানই হয়ে উঠবেন না বরং তাঁকে অতিক্রম করে যাবেন।

বিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকের শেষ নাগাদ মনে হয়েছিল সেক্যুলারিজমের বিজয় ঘটতে যাচ্ছে। ব্যাপক ধর্মীয় কর্মকণ্ডের উপস্থিতি ছিল বটে, যদিও অধিকতর রেডিক্যাল আন্দোলনসমূহকে দমন করায় সেগুলো সেক্যুলার নেতৃত্বের জন্যে কোনও রকম হুমকি ছিল না। কিন্তু এই বছরগুলোতে রোপিত বীজ আধুনিক সেক্যুলারিস্ট পরীক্ষানিরীক্ষার কিছু কিছু সীমাবদ্ধতা স্পষ্ট হয়ে ওঠার পর শেকড় ছড়াতে শুরু করবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *