০৩. ক্রিশ্চান: সাহসী নতুন জগৎ (১৪৯২–১৮৭০)

৩. ক্রিশ্চান: সাহসী নতুন জগৎ (১৪৯২–১৮৭০)

ইহুদিরা যখন স্পেন থেকে তাদের বহিষ্কারের বেদনাদায়ক পরিণতি নিয়ে সংগ্রাম করছে এবং মুসলিমরা তিনটি মহান সাম্রাজ্য গড়ে তুলছিল সেই একই সময়ে পশ্চিমের ক্রিশ্চানরা এমন এক পথে পা রাখতে যাচ্ছিল যা তাদের প্রাচীন বিশ্বের পবিত্রতা ও নিশ্চয়তা থেকে অনেক দূরে নিয়ে যাবে। এটা ছিল এক উজেনাময় কাল, আবার অস্বস্তিকরও বটে। চতুর্দশ ও পঞ্চদশ শতাব্দীতে ক্রিশ্চান জগতের এক তৃতীয়াংশ অধিবাসীর প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল প্লেগের মহা মড়ক এবং ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের ভেতরকার শত বর্ষের যুদ্ধ ও ইতালিয় গৃহযুদ্ধের মতো অব্যাহত সংগ্রামে বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছিল ইউরোপের দেশগুলো। ইউরোপিয়রা ১৪৫৩ সালে অটোমানদের হাতে ক্রিশ্চান বাইযান্তিয়ামের অধিকার, আভিগনন ক্যাপ্টিভিটির পাপাল কেলেঙ্কারী ও মহাবিবাদ প্রত্যক্ষ করার অভিজ্ঞতা লাভ করেছিল—এই সময় অন্তত তিনজন পন্টিফ একই সময়ে নিজেদের সেইন্ট পিটারের উত্তরাধিকারী দাবি করে বসেছিলেন-অনেককেই যা প্রাতিষ্ঠানিক চার্চের উপর বিশ্বাস হারাতে প্ররোচিত করেছিল। সাধারণ মানুষ অস্পষ্টভাবে নিজেদের আর নিরাপদ ভাবতে পারছিল না, এখন আর আগের মতো করে ধার্মিক হতে পারছে না বলে আবিষ্কার করেছিল তারা। কিন্তু তারপরেও এটা আবার মুক্তি ও ক্ষমতায়নেরও একটা কাল ছিল। ইবারিয় অভিযাত্রীরা এক নতুন জগৎ আবিষ্কার করেছিল: জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা স্বর্গ উন্মুক্ত করছিলেন এবং এক নতুন কারিগরি দক্ষতা পরিবেশের উপর ইউরোপিয়দের হাতে বৃহত্তর নিয়ন্ত্রণ তুলে দিচ্ছিল এর আগে যা কেউই অর্জন করতে পারেনি। রক্ষণশীল চেতনা যেখানে নারী-পুরুষকে সতর্কতার সাথে নির্ধারিত সীমানার ভেতর অবস্থান করার শিক্ষা দিয়েছিল, পাশ্চাত্য ক্রিশ্চান জগতের নতুন সংস্কৃতি সেখানে দেখিয়ে দিয়েছিল, পরিচিত জগতের বাইরে পা রাখা সম্ভব, সেটা কেবল বেঁচে থাকার জন্যে নয়, বরং সমৃদ্ধি অর্জনের জন্যেও। শেষ পর্যন্ত প্রাচীন পৌরাণিক ধর্মকে অসম্ভব করে তুলবে তারা এবং পাশ্চাত্য আধুনিকতাকে আসলে উৎসগতভাবে ধর্মবিশ্বাসের প্রতি বৈরী ছিল মনে হবে।

কিন্তু তাসত্ত্বেও পাশ্চাত্য সমাজের পরিবর্তনের এই প্রাথমিক পর্যায়ে ব্যাপারটা এমন ছিল না। ক্রান্তিকালের অভিযাত্রী, বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদদের অনেকেই বিশ্বাস করেছিলেন যে ধর্মকে সম্পূর্ণ উৎখাত করার বদলে তাঁরা আসলে ধার্মিক হওয়ার নতুন নতুন পথ আবিষ্কার করছেন। এই অধ্যায়ে আমরা তাঁদের কিছু সমাধান পর্যালোচনা করে সেগুলোর গভীরতর তাৎপর্য বিবেচনা করব। তবে স্পষ্ট করে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে আধুনিক চেতনার যাঁরা মুখপাত্রে পরিণত হয়েছিলেন তাঁরা নিজেরা এটা সৃষ্টি করেননি। ষোড়শ শতাব্দী নাগাদ ইউরোপে এবং পরে এর আমেরিকান উপনিবেশসমূহে একটি জটিল প্রক্রিয়া কার্যকর ছিল যা সাধারণ মানুষের চিন্তাভাবনা ও জগৎকে দেখার দৃষ্টিকে বদলে দিচ্ছিল। প্রায়শঃই পরিবর্তন ধীরে ধীরে ও অলক্ষে ঘটেছে। অসংখ্য বিভিন্ন ক্ষেত্রে ঠিক সেই মুহূর্তে চূড়ান্ত পরিবর্তনকারী মনে হয়নি এমন আবিষ্কার ও উদ্ভাবনের ঘটনা ঘটছিল, কিন্তু সেগুলোর সম্মিলিত প্রভাব হয়ে দাঁড়াবে চূড়ান্ত। এসব আবিষ্কারই একটা বাস্তবভিত্তিক, বৈজ্ঞানিক চেতনায় বৈশিষ্ট্যায়িত ছিল, যা ক্রমশঃ রক্ষণশীল পৌরাণিক রীতিনীতি অচল করে দিয়েছে এবং বেশ উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষকে ঈশ্বর, ধর্ম, রাষ্ট্র, ব্যক্তি ও সমাজ সম্পর্কে নতুন নতুন ধ্যান-ধারণা গ্রহণে প্ররোচিত করেছে। ইউরোপ ও আমেরিকান উপনিবেশসমূহকে বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যবস্থায় এইসব পরিবর্তনকে স্থান করে দিতে হয়েছে। সুদূরপ্রসারী অন্য যেকোনও সামাজিক পরিবর্তনের কালের মতো সহিংস সময় ছিল এটা। চলছিল বিধ্বংসী যুদ্ধ এবং বিপ্লব, সহিংস উচ্ছেদ, প্রত্যন্ত এলাকায় বিরাজনীতিকরণ ও জঘন্য ধর্মীয় সংঘাত। তিন বছরের পরিক্রমায় ইউারোপিয় ও আমেরিকানদের তাদের সমাজ আধুনিকায়িত করতে নিষ্ঠুর পদ্ধতি প্রয়োগ করতে হয়েছে। রক্তপাত, নির্যাতন, ইনকুইজিশন, বিতাড়ন, দাসত্বে বন্দি এবং নিষ্ঠুরতার ঘটনা ঘটেছে। যেসব দেশ বর্তমানে আধুনিকায়নের বেদনাদায়ক প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে, উন্নয়নশীল বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সেই একই রক্তাক্ত উত্তেজনা প্রত্যক্ষ করছি আমরা।

কৃষির যৌক্তিকীকরণ ছিল এই প্রক্রিয়ার একটা ছোট্ট অংশ মাত্র, কিন্তু বর্ধিত ফসল ও স্বাস্থ্যবান গবাদিপশুর দল প্রত্যেকের জীবনের উপর প্রভাব ফেলেছে। অন্য আরও বিশেষায়িত উন্নয়নও ছিল। সূক্ষ্ম যন্ত্রপাতি বানাতে শুরু করেছিল মানুষ: কম্পাস, টেলিস্কোপ, ম্যাগনিফাইং লেন্স, ইত্যাদি এক নতুন জগৎকে তুলে ধরেছে এবং আরও উন্নত ম্যাপ, চার্ট ও নৌপরিচালনার কৌশল তৈরির কাজে লাগানো হয়েছে। সপ্তদশ শতাব্দীর ওলন্দাজ মাইক্রোস্কোপিস্ট আন্তনি ভ্যান লিভেনহোক প্রথমবারের মতো ব্যাক্টেরিয়া, স্পারমাতোযা এবং অন্যান্য অণুজীব প্রত্যক্ষ করেন; তাঁর পর্যবেক্ষণ একদিন প্রজনন ও বিকৃতির প্রক্রিয়ার উপর নতুন আলো ফেলবে। কেবল রোগ দুরীকরণেই এর বাস্তবভিত্তিক প্রভাব পড়বে না, বরং জীবন-মৃত্যুর মৌলিক এলাকাগুলোকেও পৌরাণিক উপাদান হতে বিচ্ছিন্ন করে দেবে। ওষুধ বিজ্ঞান সমৃদ্ধ হয়ে উঠতে শুরু করেছিল; উনবিংশ শতাব্দীর বেশ অনেকটা সময় পর্যন্ত অন্ধের মতো থেরাপি প্রয়োগ অব্যাহত থাকলেও সপ্তদশ শতাব্দীতে পয়ঃনিষ্কাষণের ব্যাপারে সচেতনতা বেড়ে উঠছিল এবং প্রথমবারের মতো বেশ কিছু রোগ শানাক্ত করা হয়েছিল। ভূ-বিজ্ঞানের বিকাশ সূচিত হয়েছিল, ভূমিকম্প ও আগ্নেয়গিরির মতো বিভিন্ন ঘটনা নিয়ে আলোচনা এইসব ঘটনা সংক্রান্ত পৌরাণিক বিবেচনাকে পিছনের কাতারে ঠেলে দেবে। যান্ত্রিক সরঞ্জামের উন্নতি ঘটে। ঘড়ি ও হাতঘড়ি আরও বেশি মাত্রায় নির্ভরযোগ্য হয়ে ওঠে। এই উন্নয়ন সময়ের সেক্যুলারাইজেশনের দিকে নিয়ে যাবে। গাণিতিক ও পরিসংখ্যানিক কৌশলের প্রয়োগ ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সম্পূর্ণ নতুন ধারণা যোগাচ্ছিল: ১৬৫০ ও ১৬৬০ এর দশকে ‘সম্ভাব্য’ শব্দটির অর্থ বদলে যেতে শুরু করে। এটা আর রক্ষণশীল কালের মতো ‘কর্তৃপক্ষের সমর্থনপুষ্ট’ বোঝানোর বদলে ‘সব আলামতের ভিত্তিতে সম্ভাব্য’ হয়ে দাঁড়াল। ভবিষ্যত সম্পর্কে এই স্বাধীন দৃষ্টিভঙ্গি ও আস্থা বৈজ্ঞানিক প্রমাণ ও আমলাতান্ত্রিক যৌক্তিকীকরণের এক নতুন যাত্রায় প্ররোচিত করবে। ব্রিটিশ পরিসংখ্যানবিদ উইলিয়াম পেরি এবং জন গ্রান্ট বিশেষ করে জীবায়ুর ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন। অষ্টাদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে ইউরোপের লোকজন জীবন বীমা গ্রহণ করতে শুরু করেছিল।’ এসবই উৎসগতভাবে রক্ষণশীল চেতনার পরিপন্থী।

এসব উন্নয়নের কোনওটিকেই আলাদাভাবে চূড়ান্ত মনে হয়নি, কিন্তু সামগ্রিকভাবে এসবের প্রভাব ছিল আমূল পরিবর্তন সুলভ। ১৬০০ সাল নাগাদ ইউরোপে এমন ব্যাপক মাত্রায় উদ্ভাবন ঘটছিল যে প্রগতিকে অপরিবর্তনীয় মনে হয়েছে। কোনও একটি ক্ষেত্রে আবিষ্কার প্রায়শঃই অন্য ক্ষেত্রে আবিষ্কার উস্কে দিত। প্রগতি অপ্রতিরোধ্য গতিবেগ অর্জন করেছিল। জগতকে অপরিবর্তনীয় ও মৌলিক বিধির অধীন ভাবার বদলে ইউরোপিয়রা আবিষ্কার করছিল যে প্রকৃতিকে বিস্ময়করভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে তারা। পরিবেশকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে, এমনভাবে তাদের বস্তুগত প্রয়োজন মেটাচ্ছে যেমনটা আগে কখনও পারেনি। কিন্তু জনগণ জীবনের যৌক্তিকীরণের সাথে অভ্যস্ত হয়ে ওঠার সাথে সাথে লোগোস গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল ও মিথোস হয়ে গেল তুচ্ছ। ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আগের চেয়ে অনেক বেশি নিশ্চিত হয়ে উঠেছিল মানুষ। ভীতিকর পরিণাম ছাড়াই পরিবর্তনকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে পারছিল তারা। উদাহরণ স্বরূপ, অব্যাহত উদ্ভাবনের উপর ভিত্তি করে এবং বাণিজ্য বৃদ্ধি পাবার দৃঢ় আশাবাদ নিয়ে পদ্ধতিগতভাবে পুনর্বিনিয়োগে প্রস্তুত ছিল ধনীকশ্রেণী। পুঁজিবাদী অর্থনীতি পাশ্চাত্যকে অনির্দিষ্টভাবে এর সম্পদ প্রতিস্থাপিত করতে সক্ষম করে তুলেছে, ফলে কৃষি ভিত্তিক প্রাচীন সমাজগুলোর সীমাবদ্ধতা হতে মুক্ত হয়ে গেছে। সমাজের এই যৌক্তিকীকরণ ও প্রযুক্তিকরণ শিল্প বিপ্লবের জন্ম দিয়েছে যখন, সেই সময় নাগাদ পশ্চিমারা অব্যাহত প্রগতি সম্পর্কে এতটাই আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছিল যে অনুপ্রেরণার জন্যে তারা অতীতের দিকে তাকানোর বদলে জীবনকে বরং ভবিষ্যতের আরও বৃহত্তর সাফল্যের দিকে ভীতিহীন অগ্রযাত্রা হিসাবে দেখেছে।

এই প্রক্রিয়ায় সামাজিক পরিবর্তন জড়িত ছিল। এজন্যে বেশ উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ব্যক্তিকে বেশ নিচু স্তরে আধুনিকায়নের প্রক্রিয়ায় অংশ গ্রহণ করতে হয়েছে। সাধারণ লোক প্রিন্টার, মেশিনিস্ট ও ফ্যাক্টরির শ্রমিকে পরিণত হয়েছিল, তাদেরও কিছু মাত্রায় দক্ষতার আধুনিক মানদণ্ড অর্জন করতে হয়েছিল। অধিক সংখ্যক লোকের কিছু পরিমাণ শিক্ষার প্রয়োজন ছিল। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক লোক সাক্ষরতা অর্জন করে, আর এটা ঘটার পর তারা অনিবার্যভাবেই সমাজের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় বৃহত্তর ভূমিকা দাবি করতে থাকে। আরও অধিকতর গণতান্ত্রিক ধারার সরকার আবশ্যক হয়ে উঠবে। কোনও জাতি তার সকল জনশক্তিকে আধুনিকায়িত করে এর উৎপাদনশীলতা বাড়াতে চাইলে তাকে ইহুদিদের মতো এ যাবৎ বিচ্ছিন্ন ও প্রান্তিকায়িত গোষ্ঠীসমুহকে মূলধারার সংস্কৃতিতে নিয়ে আসতে হবে। নব্য শিক্ষিত শ্রমিক শ্রেণী আর কখনওই প্রাচীন ক্ষমতা পরম্পরার কাছে নতি স্বীকার করবে না। পাশ্চাত্য সেক্যুলার সংস্কৃতিতে পবিত্র মূল্যবোধে পরিণত হওয়া গণতন্ত্র, সহিষ্ণুতা ও সর্বজনীন মানবাধিকারের আদর্শসমূহ জটিল আধুনিকায়ন প্রক্রিয়ার অংশ হিসাবে আবির্ভূত হয়েছিল। এসব স্রেফ রাষ্ট্রনায়ক ও রাজনীতিবিদদের স্বপ্নের চমৎকার আদর্শ ছিল না, বরং অন্তত অংশত হলেও আধুনিক রাষ্ট্রের প্রয়োজনের তাগিদে সৃষ্টি হয়েছিল। প্রাথমিক আধুনিক ইউরোপে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক পরিবর্তন ছিল আন্তসম্পর্কযুক্ত প্রক্রিয়ারই অংশ, প্রতিটি উপাদান অন্যটির উপর নির্ভরশীল ছিল। কোনও আধুনিক সমাজকে সংগঠিত করার ক্ষেত্রে গণতন্ত্রই সবচেয়ে দক্ষ ও ফলপ্রসু উপায় বলে প্রতীয়মান হয়েছিল, যেসব পূর্ব ইউরোপিয় দেশ গণতান্ত্রিক রীতিনীতি গ্রহণ না করে বাইরের গোষ্ঠীসমূহকে মূলধারায় আনতে অধিকতর নির্মম কৌশল বেছে নিয়েছিল প্রগতির মিছিলে তাদের অনেক পেছনে পড়ে যাওয়া থেকেই এটা স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়।

সুতরাং, এটা ছিল একটা মুগ্ধকারী কাল, আবার কষ্টকর রাজনৈতিক পরিবর্তনের কালও ছিল তা, লোকে ধার্মিকতার সাথে একে আত্মস্থ করার প্রয়াস পেয়েছিল। এমনি পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে স্পষ্টভাবে কাজ করছিল না বলে ধর্মবিশ্বাসের প্রাচীন মধ্যযুগীয় ধরনগুলো আর স্বস্তি যোগাতে পারছিল না। ষোড়শ শতাব্দীর ক্যাথলিক সংস্কারের মতো ধর্মকে আরও দক্ষ ও সংহত করে তোলারও প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। কিন্তু প্রাথমিক আধুনিক কালের সংস্কার দেখিয়েছে যে, ষোড়শ শতাব্দীতে আধুনিকায়নের প্রক্রিয়া বেশ ভালোভাবে ক্রিয়াশীল থাকলেও ইউরোপিয়রা তখনও রক্ষনশীল চেতনা ধারণ করছিল। আমাদের বিবেচিত মহান মুসলিম সংস্কারকদের মতো প্রটেস্ট্যান্ট সংস্কারকগণও অতীতে ফিরে যাবার মাধ্যমেই পরিবর্তনের কালে নতুন সমাধান খোঁজার প্রয়াস পাচ্ছিলেন। মার্টিন লুথার (১৪৮৩-১৫৩৬), জন কালভিন (১৫০৯-৬৪) ও হালদ্রিচ যিইংউলি (১৪৮৪- ১৫৩১), এঁরা প্রত্যেকেই ক্রিশ্চান ট্র্যাডিশনের ঝর্নাধারা আদ ফন্তাসের দিকে দৃষ্টি ফিরিয়েছেন। ইবন তাঈমিয়াহ কোরান ও সুন্নাহর খাঁটি ইসলামে প্রত্যাবর্তনের লক্ষ্যে যেখানে মধ্যযুগীয় ধর্মতত্ত্ব ও ফিকহ প্রত্যাখ্যান করেছেন, মার্টিন লুথার সেখানে একইভাবে মধ্যযুগীয় স্কলাস্টিক ধর্মতাত্ত্বিকদের আক্রমণ করে বাইবেল ও ফাদারস অভ চার্চের খাঁটি ক্রিশ্চান ধর্মে ফিরে যেতে চেয়েছেন। সুতরাং, রক্ষণশীল মুসলিম সংস্কারকদের মতো প্রটেস্ট্যান্ট সংস্কারকগণ ছিলেন একাধারে বিপ্লবী ও প্রতিক্রিয়াশীল। তখনও তাঁরা আসন্ন নতুন বিশ্বের অধীনে ছিলেন না, বরং বেশ ভালোভাবেই প্রাচীন কালে প্রোথিত ছিলেন।

কিন্তু তাসত্ত্বেও নিজ কালেরই মানুষ ছিলেন তাঁরা, এটা ছিল পরিবর্তনের সময়। গোটা এই গ্রন্থ জুড়ে আমরা দেখব, আধুনিকায়নের প্রক্রিয়া নিদারুণ উদ্বেগের সৃষ্টি করতে পারে। জগৎ বদলে যাবার সাথে সাথে মানুষ নিজেদের দিশাহারা ও পরাস্ত আবিষ্কার করে। ইন মিদিয়াস রেস-এ বসবাস করে সমাজ কোন দিকে এগোচ্ছে বুঝে উঠতে পারে না তারা, বরং সামঞ্জস্যহীনভাবে পরিবর্তনের অভিজ্ঞতা লাভ করে। পরিবর্তনের ব্যাপক চাপে তাদের জীবনকে কাঠামো ও তাৎপর্য প্রদানকারী প্রাচীন মিথোলজি ভেঙে চুরমার হয়ে যাবার সাথে সাথে তারা আত্মপরিচয় হারানো ও বিবষকারী হতাশার অভিজ্ঞতা লাভ করে। আমরা যেমন দেখব, সবচেয়ে সাধারণ আবেগসমূহ হচ্ছে অসহায়ত্ব, নিশ্চিহ্নতার আতঙ্ক চরম পরিস্থিতিতে যা সহিংসতায় বিস্ফোরিত হতে পারে। লুথারের মাঝে আমরা এর খানিকটা দেখতে পাই। জীবনের গোড়ার দিকে যন্ত্রণাকর হতাশার শিকারে পরিণত হয়েছিলেন তিনি। মধ্যযুগীয় কোনও ধর্মীয় আচারঅনুষ্ঠান ও অনুশীলনই তাঁকে মৃত্যুভয়ে সন্ত্রন্ত করে তোলা, তাঁর ভাষায়, ত্রিস্তিশিয়া (‘বিষাদ’)-কে স্পর্শ করতে পারছিল না, মৃত্যুকে তিনি সামগ্রিক নিশ্চিহ্নকরণ মনে করতেন। যখনই তাঁর উপর এই কালো ত্রাস নেমে আসত, তিনি আর ৯০ নম্বর শ্লোক পাঠ করতে পারতেন না, যেখানে মানব জীবনের বিস্তৃতির বর্ণনা দেওয়া হয়েছে ও মানুষকে ঈশ্বরের ক্রোধ ও ক্ষোভ দ্বারা সাজাপ্রাপ্ত হিসাবে তুলে ধরা হয়েছে। গোটা জীবন মৃত্যুকে ঈশ্বরের ক্রোধের প্রকাশ হিসাবে দেখে এসেছেন লুথার। তাঁর বিশ্বাসে প্রতিপন্ন করার ধর্মতত্ত্বে মানবজাতিকে নিজ নিষ্কৃতি লাভে সম্পূর্ণ অক্ষম ও ঈশ্বরের দয়ার উপর পুরোপুরিভাবে নির্ভরশীল বলে বর্ণনা করেছেন। কেবল নিজেদের অক্ষমতা উপলব্ধি করেই তারা রক্ষা পেতে পারে। বিষণ্ণতা থেকে মুক্তি পেতে পৃথিবীতেই যতবেশি ভালো কাজ করা সম্ভব সেটা করতে ভয়ঙ্কর এক কর্মযজ্ঞে মেতে উঠেছিলেন লুথার, কিন্তু ঘৃণায়ওo আচ্ছন্ন ছিলেন তিনি। তাঁর ঘৃণা পোপ, তুর্কি, ইহুদি, নারী ও বিদ্রোহী কৃষকদের উপরও চালিত হয়েছে-ধর্মতাত্ত্বিক সকল প্রতিপক্ষের কথা না বললেও চলে-লুথারের ক্রোধ আমাদের কালের অন্য সংস্কারকদের অনুরূপ হয়ে দাঁড়াবে, যাঁরা এক নতুন বিশ্বের বেদনার সাথে সংগ্রাম করেছেন এবং যাঁরা এমন এক ধর্ম বিকশিত করেছেন যেখানে ঈশ্বরের প্রতি ভালোবাসা প্রায়শঃই অন্য মানুষের প্রতি ঘৃণা দিয়ে ভারসাম্য লাভ করে।

যিউইংলি ও কালভিনও তাঁদের মাঝে নবজন্ম লাভ করার বোধ জাগানো এক নতুন ধর্মীয় দর্শনের দেখা পাওয়ার আগে চরম অক্ষমতার অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁরা দুজনই নিশ্চিত ছিলেন যে নিজেদের নিস্তার লাভের জন্যে তাঁদের করার মতো কিছুই নেই, মানবীয় অস্তিত্বের দুঃখকষ্টের সামনে তাঁরা সম্পূর্ণ অসহায়। দুজনই ঈশ্বরের পরম সার্বভৌমত্বের উপর জোর দিয়েছেন, আধুনিক মৌলবাদীরা পরবর্তী সময়ে প্রায়ই যেমন করবে। লুথারের মতো যিউইংলি ও কালভিনকে নিজেদের ধর্মীয় জগৎ পুনর্নির্মাণ করতে হয়েছে। এমনকি অলক্ষে কিন্তু অপরিবর্তনীয়ভাবে ব্যাপক পরিবর্তনের অধীন হয়ে পড়া বিশ্বের পরিস্থিতির সাথে ধর্মকে মানানসই করে তোলার জন্যে অনেক সময় চরম ব্যবস্থার আশ্রয়ও নিতে হয়েছে তাঁদের।

সেই সময়ের মানুষ হিসাবে সংস্কারকগণ ঘটে যাওয়া পরিবর্তনসমূহকে তুলে ধরেছেন। রোমান ক্যাথলিক চার্চ ত্যাগ করে তাঁরা এই পর্যায় থেকে পাশ্চাত্য ইতিহাসকে তুলে ধরা অন্যতম প্রাথমিক স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। আমরা যেমন দেখব, নতুন রীতি স্বায়ত্তশাসন ও পূর্ণাঙ্গ মুক্তির দাবি করেছে এবং এই বদলে যাওয়া পৃথিবীতে প্রটেস্ট্যান্ট সংস্কারকগণও ক্রিশ্চানদের পক্ষে একই দাবি করেছেন, যাদের অবশ্যই চার্চের শাস্তিমূলক নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই পছন্দ মোতাবেক বাইবেল পাঠ ও ব্যাখ্যা করার স্বাধীনতা থাকতে হবে। (অবশ্য তাঁদের শিক্ষার বিরোধিতাকারীর বেলায় তিন জনই অনমনীয় হয়ে উঠতে পারতেন: লুথার বিশ্বাস করতেন যে ‘ধর্মদ্রোহমূলক’ বই পুড়িয়ে ফেলা উচিত, আর কালভিন ও যিউইংলি ভিন্নমতাবলম্বীদের হত্যা করতে প্রস্তুত ছিলেন)। তিনজনই দেখিয়েছেন যে, এই যুক্তির কালে ধর্মের প্রাচীন প্রতীকী উপলব্ধি ভেঙে পড়তে যাচ্ছিল। রক্ষণশীল আধ্যাত্মিকতায় কোনও প্রতীক ঈশ্বরের বাস্তবতায় অংশ গ্রহণ করত, নারী-পুরুষ পার্থিব বস্তুতে পবিত্রকে অনুভব করত; প্রতীক ও পবিত্র এভাবে ছিল অবিচ্ছেদ্য। মধ্যযুগে ক্রিশ্চানরা সাধুদের রেলিক্সে স্বর্গীয় অভিজ্ঞতা লাভ করেছে ইউক্যারিস্টিক রুটি ও মদকে অতীন্দ্রিয়ভাবে ক্রাইস্টের সাথে অবিচ্ছেদ্য মনে করেছে। কিন্তু এখন সংস্কারগণ ঘোষণা দিয়েছেন যে, রেলিক্সগুলো আসলে প্রতিমা, ইউক্যারিস্ট ‘স্রেফ’ প্রতীক, ধর্মসভা একে অতীন্দ্রিয়ভাবে উপস্থিত করা ক্যালভারির উৎসর্গের স্মারক নয়, বরং একটা সাধারণ স্মৃতিচিহ্নমাত্র। তাঁরা এমনভাবে ধর্মের মিথ নিয়ে কথা বলতে শুরু করেছিলেন যেন সেগুলো লোগোই; মানুষ যেমন দ্রুততার সাথে সংস্কারকদের অনুসরণ করেছে তাতে বোঝা যায় ইউরোপের ক্রিশ্চানদের অনেকেই অতীন্দ্রিয় সংবেদনশীলতা খোয়াতে শুরু করেছিল।

ধীরে ধীরে সেক্যুলারাইজ হতে শুরু করেছিল ইউরোপের জীবন। প্রটেস্ট্যান্ট সংস্কারকগণ ধর্মীয় প্রয়াসের প্রাবল্য সত্ত্বেও সেক্যুলারাইজ হতে চলছিলেন। সংস্কারকগণ রক্ষণশীলের মতোই প্রাথমিক উৎস অর্থাৎ বাইবেলে ফিরে যাবার দাবি করলেও আধুনিক কায়দায় ঐশীগ্রন্থ পাঠ করছিলেন তাঁরা। সংস্কৃত ক্রিশ্চানদের স্রেফ নিজের বাইবেলের উপর ভরসা করে একাকী ঈশ্বরের সামনে দাঁড়াতে হয়েছে, কিন্তু মুদ্রণের উদ্ভাবনের ফলে প্রত্যেকের পক্ষে একটা বাইবেল যোগাড় সহজ হয়ে ওঠা ও তাদের বাইবেল পাঠে সক্ষম করে তোলা সেই সময়ের বিকাশ লাভ করা সাহিত্যের আগে এটা সম্ভব ছিল না। ক্রমবর্ধমান হারে তথ্যের অনুসন্ধানে ঐশীগ্রন্থসমূহ আক্ষরিকভাবে পাঠ করা হচ্ছিল, ঠিক যেভাবে আধুনিকায়িত প্রটেস্ট্যান্টরা অন্যান্য টেক্সট পাঠ শিখছিল। নীরব, একাকী পাঠ ক্রিশ্চানকে ব্যাখ্যার ট্র্যাডিশনাল পদ্ধতি ও ধর্মীয় বিশেষজ্ঞদের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত করবে। ব্যক্তিগত বিশ্বাসের উপর গুরুত্বারোপ সত্যকে আধুনিক পাশ্চাত্য মানসিকতার বৈশিষ্ট্য অধিকতর ভাবগত করে তুলতে সাহায্য করবে। কিন্তু বিশ্বাসের গুরুত্বের প্রতি জোর দিলেও লুথার ভীষণভাবে যুক্তিকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি যেন বুঝতে পেরেছিলেন যুক্তি আসন্ন প্রয়োগের ক্ষেত্রে বিশ্বাসের প্রতি বৈরী হয়ে উঠতে পারে। তাঁর রচনায়-যদিও কালভিনের রচনায় নয়-আমরা দেখতে পাই, যুক্তি ও মিথলোজির প্রাচীন সম্পূরকতার দৃষ্টিভঙ্গি ক্ষয়ে যাচ্ছিল। স্বভাবজাত ঝগড়াটে কায়দায় লুথার সঘৃণায় অ্যারিস্টটল সম্পর্কে কথা বলেছেন, ইরাসমাসের বিরুদ্ধে নিন্দা ঝেড়েছেন, যাকে তিনি যুক্তির মূর্ত রূপ মনে করতেন, তিনি নিশ্চিত ছিলেন যুক্তি কেবল নাস্তিক্যবাদের দিকেই ঠেলে দিতে পারে। যুক্তিকে ধর্মীয় বলয় থেকে সম্পূর্ণ উৎখাত করতে গিয়ে লুথারই ছিলেন একে সেকুলারাইজকারী অন্যতম প্রথম ইউরোপিয়।

লুথারের চোখে ঈশ্বর যেহেতু চরম রহস্যময় ও গোপন, সুতরাং জগৎ ঐশী অস্তিত্ব হতে শূন্য। লুথারের দিউস অ্যাবসকন্দিতাসকে মানবীয় প্রতিষ্ঠান বা ভৌত বাস্তবতায় আবিষ্কার করা যাবে না। মধ্যযুগীয় ক্রিশ্চানরা চার্চে পবিত্রের অনুভূতি লাভ করেছিল, লুথার যাকে এখন অ্যান্টিক্রাইস্ট ঘোষণা করেছেন। এখন কি স্কলাস্টিক ধর্মতত্ত্ববিদদের (লুথারের তীব্র ক্রোধের লক্ষ্যও বটে) মতো করে মহাবিশ্বের অলৌকিক শৃঙ্খলা লক্ষ করে ঈশ্বরের জ্ঞান লাভ করা যাবে?’ লুথারের রচনায় ঈশ্বর এখন ধর্মীয় তাৎপর্যহীন হয়ে ওঠা ভৌত জগৎ থেকে সরে যেতে শুরু করেছিলেন। লুথার রাজনীতিকেও সেক্যুলারাইজ করেছেন। জাগতিক বাস্তবতা যেহেতু আধ্যাত্মিক বাস্তবতার সম্পূর্ণ বিরোধী, চার্চ ও রাষ্ট্রকে অবশ্যই স্বাধীনভাবে কাজ করতে হবে, প্রত্যেককে অন্যের সঠিক কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্রকে সম্মান করতে হবে। লুথারের আন্তরিক ধর্মীয় দর্শন তাঁকে চার্চ ও রাষ্ট্রের বিচ্ছিন্নতার পক্ষে কথা বক্তব্য দানকারী অন্যতম প্রথম ইউরোপিয়তে পরিণত করেছিল। কিন্তু তবু ধার্মিক হওয়ার এক নতুন উপায় হিসাবেই রাজনীতির সেক্যুলাইজেশন শুরু হয়েছিল।

লুথারের ধর্ম ও রাজনীতির পৃথকীকরণের বিষয়টি এসেছিল রোমান ক্যাথলিক চার্চের নিপীড়নমূলক পদ্ধতি সম্পর্কে তাঁর চরম বিতৃষ্ণা থেকে, নিজস্ব বিধি ও অর্থডক্সি চাপিয়ে দেওয়ার জন্যে চার্চ রাষ্ট্রকে ব্যবহার করছিল। ঈশ্বর বিহীন পৃথিবী সংক্রান্ত লুথারের দৃষ্টিভঙ্গির অংশীদার ছিলেন না কালভিন। যিউইংলির মতো তিনি বিশ্বাস করতেন, মঠে আশ্রয় নেওয়ার বদলে ক্রিশ্চানদের উচিত হবে রাজনীতি ও সামাজিক জীবনে অংশ নিয়ে তাদের ধর্মবিশ্বাসকে প্রকাশ করা। কালভিন উদীয়মান পুঁজিবাদী শ্রমনীতিকে শ্রমকে পবিত্র আহ্বান আখ্যা দিয়ে ব্যাপ্টাইজ করেছিলেন, মধ্যযুগীয় ভাবনার মতো একে পাপের স্বর্গীয় শাস্তি হিসাবে দেখেননি। কালভিন স্বাভাবিক জগতের প্রতি লুথারের বিতৃষ্ণারও অংশীদার ছিলেন না। তিনি বিশ্বাস করতেন, ঈশ্বরকে তাঁর সৃষ্টির মাঝে প্রত্যক্ষ করা সম্ভব; জ্যোতির্বিজ্ঞান, ভূগোল ও প্রাণীবিদ্যা পাঠ করার পরামর্শ দিয়েছিলেন তিনি। প্রাথমিক আধুনিক কালের কালভিনবাদীরা প্রায়শঃই ভালো বিজ্ঞানী ছিলেন। কালভিন বিজ্ঞান ও ঐশীগ্রন্থের ভেতর কোনও বিরোধিতা লক্ষ করেনি। তিনি বিশ্বাস করতেন, বাইবেল ভূগোল বা বিশ্ব সৃষ্টি সম্পর্কে কোনও আক্ষরিক জ্ঞান প্রচার করছে না, বরং সীমাবদ্ধ মানুষের বোধগম্য ভাষায় অনির্বচনীয়কে প্রকাশ করার চেষ্টা করছে। বাইবেলিয় ভাষা হচ্ছে বালবাতিভ (‘বালসুলভকথা’), অন্য কোনওভাবে প্রকাশ করার পক্ষে যারপরনাই জটিল সত্যের পরিকল্পিত সরলীকরণ।

প্রাক আধুনিক কালের মহান বিজ্ঞানীরা কালভিনের আস্থার অংশীদার ছিলেন। নিজেদের গবেষণা ও আলোচনাকে তাঁরা পৌরাণিক, ধর্মীয় কাঠামোতে দেখেছেন। পোলিশ জ্যোতির্বিজ্ঞানী নিকোলাস কোপার্নিকাস (১৪৭৩-১৫৪৩) বিশ্বাস করতেন তাঁর বিজ্ঞান ‘মানুষের চেয়েও বেশি ঐশ্বরিক।১০ কিন্তু তাসত্ত্বেও তাঁর হেলিওসেন্ট্রিক বিশ্বের মতবাদ প্রাচীন পৌরাণিক ধারণার ক্ষেত্রে প্রচণ্ড আঘাত ছিল। তাঁর বিস্ময়কর প্রকল্প এতটাই চরম ছিল যে, তাঁর নিজ সময়ে খুব অল্প সংখ্যক লোকই তা হজম করতে পেরেছে। তিনি বোঝাতে চেয়েছেন, মহাবিশ্বের কেন্দ্ৰে অবস্থানের বদলে পৃথিবী ও অন্যান্য গ্রহ আসলে সূর্যের চারপাশে প্রচণ্ড গতিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমরা যখন আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবি যে স্বর্গীয় বস্তুসমূহ চলছে, সেটা স্রেফ উল্টোদিকে পৃথিবীর ঘোরার প্রক্ষেপণ। কোপার্নিকাসের তত্ত্ব অসম্পূর্ণ রয়ে গিয়েছিল, কিন্তু জার্মান পদার্থবিদ ইয়োহানেস কেপলার (১৫৭১-১৬৩০) এর সমর্থনে গাণিতিক প্রমাণ যোগাতে সক্ষম হন, অন্যদিকে পিসিয় জ্যোতির্বিজ্ঞানী গালিলিও গালিলি (১৫৬৪-১৬৪২) টেলিস্কোপের সাহয্যে গ্রহ-নক্ষত্র পর্যবেক্ষণ করে কোপার্নিকাসের প্রকল্প হাতে কলমে পরীক্ষা করেছিলেন। তিনি নিজেই এই যন্ত্রটির উন্নতি সাধন করেন। ১৬১২ সালে গালিলিও যখন তাঁর আবিষ্কারের কথা প্রকাশ করলেন, বিশাল আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন তিনি। ইউরোপের সমস্ত লোক নিজেরা টেলিস্কোপ বানিয়ে স্বর্গ পর্যবেক্ষণ শুরু করেছিল।

ইনকুইজিশন গালিলিওকে স্তব্ধ করে দেয়। মত প্রত্যাহারে বাধ্য করে তাঁকে। কিন্তু তাঁর কিছুটা রগচটা স্বভাবও সাজা প্রাপ্তিতে কিছু অবদান রাখে। প্রাথমিক আধুনিক কালে মানুষ সহজাতভাবে বিজ্ঞানকে প্রত্যাখ্যান করেনি। কোপার্নিকাস যখন ভাটিকানে প্রথমবারের মতো তাঁর প্রকল্প পেশ করেন, পোপ একে অনুমোদন দিয়েছিলেন। এই তত্ত্বে কালভিনের কোনও সমস্যা হয়নি। বিজ্ঞানীগণ তাঁদের অনুসন্ধানকে আবিশ্যিকভাবে ধর্মীয় বিবেচনা করেছেন। এযাবত কোনও মানুষেরই জানার সুযোগ হয়নি, এমন সব রহস্য উন্মোচন করে চলার সময় কেপলার নিজেকে ‘স্বর্গীয় উন্মাদনায়’ আচ্ছন্ন মনে করেছেন, গালিলিও নিশ্চিত ছিলেন যে তাঁর গবেষণা ঐশী অনুপ্রেরণাজাত।” তখনও তাঁরা নিজেদের বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদকে ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির সাথে মানানসই দেখতে পাচ্ছিলেন, মিথোস যেমন ছিল লোগোস-এর সম্পূরক।

তারপরেও বিপ্লবের সূচনা ঘটিয়েছিলেন কোপার্নিকাস। মানুষ আর কখনওই আর আগের মতো তাদের দেখতে বা তাদের ধারণাকে বিশ্বাস করতে পারবে না। এতদিন পর্যন্ত লোকে নিজেদের ইন্দ্রিয়জ প্রমাণের উপর নির্ভর করতে সক্ষম ভাবত। বিশ্বের বাহ্যিক বৈশিষ্ট্যের দিকে তাকিয়ে অদৃশ্যকে আবিষ্কারের চেষ্টা করেছে তারা, তবে এইসব বাহ্যিক চেহারা একটি বাস্তবতার অংশ বলে নিশ্চিত ছিল। জীবনের মৌলিক বিধান সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করার জন্যে বিকশিত মিথসমূহ তাদের অভিজ্ঞতার সত্যের সাথে মানানসই ছিল। ইলিউসিসের গ্রিক উপাসকরা পারসেফোনের কাহিনীকে তাদের পালন উপযোগি ফসলের মৌসুমের সাথে মেলাতে পেরেছিল; কাবাহকে ঘিরে প্রতীকীভাবে দৌড়ে বেড়ানো আরবরা পৃথিবীকে ঘিরে গ্রহ-নক্ষত্রের গতিপথের সাথে নিজেদের এক রেখায় নিয়ে আসতে পারত এবং এভাবে অস্তিত্বের মৌল নীতিমালার সাথে ছন্দবদ্ধ থাকার কথা ভাবত। কিন্তু কোপার্নিকাসের পর সন্দেহের বীজ রোপিত হয়েছিল। প্রমাণ হয়ে গিয়েছিল যে, পৃথিবী, যাকে স্থির মনে হয়েছিল, আসলে প্রবল বেগে চলছে; গ্রহগুলোকে ঘুরছে মনে হওয়ার কারণ লোকে সেগুলোর প্রতি তাদের নিজস্ব দৃষ্টি প্রক্ষেপিত করছিল: যাকে বাস্তবভিত্তিক ধরে নেওয়া হয়েছিল তা আসলে সম্পূর্ণই ভাবগত ছিল। যুক্তি আর মিথ আর এক তলে রইল না; প্রকৃতপক্ষে বিজ্ঞানীর আবিষ্কৃত নিবিড় লোগোস যেন সাধারণ মানুষের ধারণাকে অবমূল্যায়িত করতে শুরু করেছিল এবং ক্রবর্ধমান হারে তাদের শিক্ষিত বিশেষজ্ঞদের উপর নির্ভরশীল করে তুলছিল। মিথ যেখানে মানুষের কর্মকাণ্ড জীবনের অত্যাবশ্যক অর্থের সাথে আবদ্ধ হিসাবে দেখিয়েছে, নতুন বিজ্ঞান হঠাৎ করেই নারী-পুরুষকে মহাবিশ্বের এক প্রান্তিক অবস্থানে ঠেলে দিয়েছিল। তারা আর বস্তুনিচয়ের কেন্দ্রে ছিল না, বরং মহাবিশ্বের এক বৈশিষ্ট্যহীন গ্রহে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল তাদের, যা আর তাদের প্রয়োজনকে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছিল না। এক বিষণ্ণ দৃশ্য ছিল এটা, যার সম্ভবত নতুন সৃষ্টিবিজ্ঞানকে পুরোনটির মতো অর্থপূর্ণ করে তোলার জন্যে একটা মিথের প্রয়োজন ছিল কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞান মিথলজিকে অপদস্থ করতে শুরু করেছিল। ব্রিটিশ বিজ্ঞানী স্যার আইজাক নিউটন (১৬৪২-১৭২৭) পরীক্ষণ ও রহস্য উদ্ধারের বিকাশমান বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির প্রবল ব্যবহারের

ব্যবহারের সাহায্যে পূর্বসুরিদের আবিষ্কারসমূহের সংশ্লেষ ঘটিয়েছিলেন। অভিকর্ষের ধারণাকে গোটা সৃষ্টিকে একসাথে ধরে রাখা এবং স্বর্গীয় বস্তুগুলোকে পরস্পরের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়া থেকে বিরতকারী বিশ্বজনীন শক্তি ধরে নিয়েছিলেন নিউটন। তিনি নিশ্চিত ছিলেন, এই ব্যবস্থা ঈশ্বর, অর্থাৎ মহান ‘মেকানিকের’ অস্তিত্বের প্রমাণ রাখে, যেহেতু মহাবিশ্বের জটিল পরিকল্পনা দুর্ঘটনাক্রমে আবির্ভূত হয়নি।১২ প্রাক আধুনিক বিজ্ঞানীদের মতো নিউটন মানুষের কাছে তাঁর ধারণামতে জগৎ সম্পর্কে সম্পূর্ণ নতুন ও নিশ্চিত ধারণা পৌছে দিয়েছিলেন। তিনি নিশ্চিত ছিলেন যে তাঁর ‘ব্যবস্থা’ বস্তুগত বাস্তবতার সাথে সম্পূর্ণ মিলে গেছে এবং মানবীয় জ্ঞানকে আগের চেয়ে বহুদূর নিয়ে গেছে। কিন্তু লোগোসের জগতে সম্পূর্ণ মগ্ন নিউটনের পক্ষে মানুষকে এক ধরনের সত্যির পথ দেখানোর মতো অন্য আরও কোনও স্বজ্ঞা প্রসূত ধারণার অস্তিত্বে বিশ্বাস করা কঠিন করে তুলেছিল। তাঁর চোখে মিথলজি ও রহস্য ছিল চিন্তার আদিম ও বর্বর কায়দা। ‘এটা ধর্মের ক্ষেত্রে মানবজাতির উত্তপ্ত ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন অংশ,’ বিরিক্তর সাথে লিখেছেন তিনি। ‘সব সময়ই রহস্য প্রিয় হওয়ায় যেটা তারা সবচেয়ে কম বোঝে তাকেই বেশি পছন্দ করে। ১৩

ক্রিশ্চান ধর্মবিশ্বাস থেকে পৌরাণিক মতবাদসমূহকে উৎখাত করার প্রশ্নে এক রকম বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন নিউটন। তিনি নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলেন যে, ট্রিনিটি ও ইনকারনেশনের অযৌক্তিক মতবাদ ষড়যন্ত্র, জালিয়াতি ও প্রতারণার ফলমাত্র। তাঁর মহান গ্রন্থ ফিলোসোফিয়া নেচারালিস প্রিন্সিপিয়া (১৬৮৭) রচনার সময় ফিলোসফিকাল অরিজিন অভ জেন্টাইল ফিলোসফি নামে এক বিচিত্র নিবন্ধ লিখতে শুরু করেছিলেন নিউটন, যেখানে যুক্তি দেখানো হয়েছে যে, নোয়াহ এক কুসংস্কারমুক্ত ধর্ম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যেখানে কোনও প্রত্যাদিষ্ট ঐশীগ্রন্থ, রহস্য ছিল না, বরং কেবল একজন উপাস্য ছিলেন যাঁকে প্রাকৃতিক বিশ্বের যৌক্তিক ধ্যানের সাহায্যে জানা সম্ভব ছিল। পরের প্রজন্মসমূহ এই খাঁটি ধর্মকে কলুষিত করেছে। চতুর্থ শতাব্দীতে বিবেকহীন ধর্মবেত্তাদের হাতে কুসংস্কারাচ্ছন্ন ট্রিনিটি ও ইনকারনেশনের মতবাদ যোগ হয়েছে এতে। প্রকৃতপক্ষেই, বুক অভ রেভেলেশন ট্রিনিটি মতবাদের উদ্ভবের ভবিষ্যদ্বাণী করেছে—‘তোমাদের পাশ্চাত্যের এই অদ্ভুত ধর্ম,’ ‘তিনটি সমান ঈশ্বরের কাল্ট’–ধ্বংসের অশ্লীলতা।” কিন্তু তারপরেও ধার্মিক লোক ছিলেন নিউটন এবং তখনও একটি যৌক্তিক আদিম ধর্মের অনুসন্ধানে একটা মাত্রা পর্যন্ত রক্ষণশীল চেতানায় বন্দি ছিলেন। কিন্তু আগের প্রজন্মের মতো নিজের ধর্ম বিশ্বাস প্রকাশ করতে পারছিলেন না তিনি। চতুর্থ শতাব্দীর গ্রিক অর্থডক্স ধর্মবিদগণ যে পরবর্তীকালের ইহুদি কাব্বালিস্টরা যেভাবে মিথোস তৈরি করেছিল ঠিক সেভাবে ট্রিনিটি মতবাদ সৃষ্টি করেছিলেন, এটা বুঝতে অক্ষম ছিলেন তিনি। গ্রেগরি অভ নিসা যেমন ব্যাখ্যা করেছেন, পিতা, পুত্র ও পবিত্র আত্মার তিনটি হিপোস্তাসে কোনও বস্তুগত সত্য নয়, বরং স্রেফ স্বর্গীয় প্রকৃতি (অউসা) মানবীয় মনের সীমাবদ্ধতার সাথে যেভাবে খাপ খাইয়ে নেন তাকে বর্ণনা করার জন্যে ‘আমাদের ব্যবহৃত পরিভাষা’ মাত্র।১৫ প্রার্থনা, ধ্যান ও লিটার্জির কাল্টিক পরিপ্রেক্ষিতের বাইরে এটা কোনও অর্থ প্রকাশ করে না। কিন্তু নিউটন কেবল ট্রিনিটিকে যৌক্তিক পরিভাষায় দেখেছেন, মিথের ভূমিকা সম্পর্কে তাঁর কোনও ধারণা ছিল না, তাই এই মতবাদকে বাদ দিতে বদ্ধ পরিকর ছিলেন তিনি। আজকের দিনে বহু ক্রিশ্চানের ট্রিনিটির ধর্মতত্ত্ব নিয়ে সমস্যার মুখে পড়ার বিষয়টি দেখায় যে, যুক্তির দিক দিয়ে তারা নিউটনের পক্ষপাতিত্বের অংশীদার। নিউটনের অবস্থান সম্পূর্ণ বোধগম্য। তিনি ছিলেন পশ্চিমের অন্যতম প্রথম সারির ব্যক্তি যিনি বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদের পদ্ধতি ও অনুশীলন সম্পূর্ণ আত্মস্থ করতে পেরেছিলেন। তাঁর সাফল্য ছিল আকাশ-ছোঁয়া আর এর ফল ছিল যেকোনও ধর্মীয় অভিজ্ঞতার মতোই আচ্ছন্নকারী। তিনি গবেষণার সময় বলতে অভ্যস্ত ছিলেন যে, ‘হে ঈশ্বর, আমার ধারণা আপনিই আপনার কথা ভাবেন!’১৬ আক্ষরিকভাবেই স্বজ্ঞাপ্রসূত অতীন্দ্রিয় সচেতনতার পক্ষে কোনও সময় ছিল না, যেটা হয়তো তাঁর প্রগতিকে ব্যাহত করতে পারত। পাশ্চাত্য পরীক্ষানিরীক্ষার চোখ ধাঁধানো ও প্রবল সাফল্যের কারণে মানুষের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো যুক্তি ও মিথ পরস্পরের বেমানান হয়ে উঠছিল।

সপ্তদশ শতাব্দী নাগাদ প্রগতি এতটাই নিশ্চত হয়ে ওঠে যে, বহু ইউরোপিয়ই তখন সম্পূর্ণ ভবিষ্যৎমুখী হয়ে উঠেছিল। অতীতকে সম্পূর্ণ নাকচ করে নতুন করে শুরু করার জন্যে প্রস্তুত থাকার বিষয়টি আবিষ্কার করছিল তারা। আগ্রসর হওয়ার গতিবেগ ছিল রক্ষণশীল চেতনার ভিত্তিভূমি পৌরাণিক পশ্চাদপসরণের ঠিক বিপরীত। নতুন বিজ্ঞানকে ভবিষ্যৎমুখী হতে হয়েছে: এভাবেই তা কাজ করে। কোপার্নিকাসের তত্ত্ব কার্যকরভাবে প্রমাণিত হয়ে যাওয়ার পর টলেমিয় সৃষ্টি ব্যবস্থায় প্রত্যাবর্তন আর সম্ভব ছিল না। পরে নিউটনের নিজস্ব ব্যবস্থা না হলেও তাঁর নিজের পদ্ধতি বাদ পড়ে যাবে। ইউরোপিয়রা সত্যি সম্পর্কে এক নতুন ধারণা গড়ে তুলছিল। নতুন নতুন আবিষ্কার সব সময়ই পুরোনো সত্যিকে প্রতিস্থাপিত করতে পারে বলে সত্য কখনওই পরম হতে পারে না; একে অবশ্যই বাস্তবে, বস্তুনিষ্ঠভাবে প্রমাণ করার প্রয়োজন ছিল এবং বাস্তব জীবনে এর কার্যকারিতা দিয়ে পরিমাপ করতে হত। প্রাথমিক কালের বিজ্ঞানের সাফল্য একে এমন কর্তৃত্ব দান করেছিল যা পৌরাণিক সত্যের চেয়ে অনেক শক্তিশালী হয়ে উঠতে শুরু করেছিল, যা এই যোগ্যতার কোনওটাই পূরণ করতে পারেনি।

ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম জেমসের কাউন্সিলর ফ্রান্সেস বেকন (১৫৬১-১৬২৬) রচিত দ্য অ্যাডভান্সমেন্ট অভ লার্নিং-এ এটা ইতিম্যধ্য স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। বেকন জোরের সাথে বলেছেন সত্যি, এমনকি ধর্মের পবিত্রতম মতবাদকেও অভিজ্ঞতামূলক বিজ্ঞানের কঠোর সমালোচনামূলক পদ্ধতির অধীনে নিয়ে আসতে হবে। প্রমাণিত তথ্যে ও আমাদের ইন্দ্রিয়জ প্রমাণের বিরোধিতা করলে তাকে অবশ্যই ছুঁড়ে ফেলতে হবে। মানবজাতির জন্যে এক সুমহান ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার পথে অতীতের কোনও মহান দর্শনকেই বাধা হয়ে দাঁড়াতে দেওয়া যাবে না। বিজ্ঞানের নানা আবিষ্কার মানবজাতির সব রকম ভোগান্তির অবসান ঘটাবে বলে বিশ্বাস করতেন বেকন, তিনি মনে করতেন এভাবে এই মাটির পৃথিবীতেই পয়গম্বরদের ভবিষ্যদ্বাণীর সেই রাজ্যের উদ্বোধন ঘটবে। বেকনের রচনায় আমরা নতুন যুগের উত্তেজনার দেখা পাই। তিনি এতটাই আত্মবিশ্বাসী ছিলেন যে, বিজ্ঞান ও বাইবেলের ভেতর কোনও বিরোধই লক্ষ করেননি। গালিলিও নিন্দিত হওয়ার অনেক বছর আগেই বিজ্ঞানের কর্মীদের পক্ষে সম্পূর্ণ বুদ্ধিবৃত্তিক স্বাধীনতার দাবি তুলেছিলেন তিনি, যাদের কর্মকাণ্ড সাধারণ মনমানসিকতার যাজককুলের কারণে বাধাপ্রাপ্ত হওয়ার মতো তুচ্ছ ব্যাপার নয়। দ্য অ্যাডভান্সমেন্ট অভ লার্নিং মিথ থেকে মুক্তির সন্ধান ও কেবল বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদই মানবজাতিকে সত্যের পথে নিয়ে যাবার শক্তির কথা ঘোষণাকারী স্বাধীনতার ঘোষণার মতো ছিল।

এক গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত ছিল এটা, আজকের আধুনিক পশ্চিমে আমরা বিজ্ঞানকে যেভাবে জানি তার সূচনাকে তুলে ধরে। এর আগে পর্যন্ত বৈজ্ঞানিক ও যৌক্তিক ব্যাখ্যাকে সব সময়ই এইসব আবিষ্কারের ব্যাখ্যা তুলে ধরা এক ধরনের সামগ্রিক মিথলজির সীমানায় পরিচালনা করা হত। চলমান মিথ সব সময়ই এইসব আবিষ্কারের নিয়ন্ত্রণ করত, তাদের প্রয়োগের উপর বাধা আরোপ করত, রক্ষণশীল সমাজের সীমাবদ্ধতার দাবি ছিল এমনই। কিন্তু সপ্তদশ শতাব্দী নাগাদ ইউরোপিয় বিজ্ঞানীরা প্রাচীন বাধা থেকে নিজেদের মুক্ত করে নিতে শুরু করেছিলেন। কৃষিভিত্তিক সমাজকে পেছনে টেনে ধরা বিভিন্ন উপাদান ধীরে ধীরে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হওয়ায় তাদের আর এসবের কোনও প্রয়োজন ছিল না। বেকন জোরের দিয়ে বলেছিলেন, বিজ্ঞানই একমাত্র সত্যি। একথা স্বীকার্য, বিজ্ঞান সম্পর্কে তাঁর ধারণা আমাদের চেয়ে বেশ ভিন্ন ছিল। বেকনের চোখে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ছিল প্রধানত তথ্য ও উপাত্ত সংগ্রহের একটা ব্যাপার, বৈজ্ঞানিক গবেষণায় অনুমান ও প্রকল্পের গুরুত্ব হিসাবে নেননি তিনি। তবে সত্যি সম্পর্কে বেকনের সংজ্ঞা বিশেষ করে ইংরেজিভাষী দেশগুলাতে দারুণ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, কেবল আমাদের পঞ্চেন্দ্রিয় থেকে পাওয়া তথ্যের উপরই আমরা নিরাপদভাবে নির্ভর করতে পারি, বাকি সব স্রেফ কল্পনা। বাস্তব ক্ষেত্রে প্রমাণ করা সম্ভব নয় বলে দর্শন, মেটাফিজিক্স, ধর্মতত্ত্ব, শিল্পকলা, কল্পনা, অতীন্দ্রিয়বাদ এবং মিথলজিকে কুসংস্কার হিসাবে বাতিল করে দেওয়া হয়েছিল।

জীবনের এই সম্পূর্ণ যৌক্তিক ধারায় বিশ্বাস করেও আবার ধার্মিক হতে চেয়েছে যারা, ঈশ্বর ও আধ্যাত্মিকতা নিয়ে চিন্তা করার নতুন পথ খুঁজে পেতে হয়েছে তাদের। আমরা ফরাসি বৈজ্ঞানিক রেনে দেকার্তের (১৫৯৬-১৬৫০) দর্শনে পৌরাণিক দৃষ্টিভঙ্গির মৃত্যু প্রত্যক্ষ করি। তিনি কেবল লোগোই, যুক্তির ভাষায় কথা বলতে পারতেন। নিঃসঙ্গতার দর্শন ছিল তাঁর। দেকার্তের চোখে মহাবিশ্ব প্রাণহীন একটা যন্ত্র, ভৌত জগৎ অনড় ও মৃত। স্বর্গ সম্পর্কে কোনও সংবাদ দেওয়ার ক্ষমতা এর নেই। মহাবিশ্বে একমাত্র মানুষের মনই জীবিত বস্তু, কেবল নিজের উপর নির্ভর করেই তা নিশ্চয়তা খুঁজে পেতে পারে। এমনকি আমাদের নিজস্ব সন্দেহ ও ভাবনার বাইরে আর কোনও কিছুর অস্তিত্ব আছে কিনা সে ব্যাপারে ও আমরা নিশ্চিত হতে পারি না। নিবেদিত প্রাণ ক্যাথলিক ছিলেন দেকার্তে, ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়ে নিজেকে সন্তুষ্ট করতে চেয়েছিলেন তিনি; কিন্তু মিথ ও কাল্টের আদিম কাল্পনিক অতীতে ফিরে যেতে অস্বীকার গেছেন। পয়গম্বর ও পবিত্র টেক্সটের দর্শনের উপরও নির্ভর করতে পারেননি তিনি। নতুন যুগের মানুষ হিসাবে চলমান ধারণা মেনে নিতে পারেননি, বৈজ্ঞানিককে অবশ্যই তাঁর মনকে তেবুলা রাসা-য় পরিণত করতে হবে। গণিত বা অনস্বীকার্যভাবে ঠিক ‘যা হয়ে গেছে তাকে আর বদলানো যাবে না’ ধরনের স্বতঃসিদ্ধ প্রস্তাব থেকে যা পাওয়া যেতে পারে সেটাই একমাত্র সত্যি। যেহেতু পেছনে যাবার পথ রুদ্ধ, দেকার্তে কেবল একটু একটু করে সমনেই যেতে পেরেছেন।

একদিন সন্ধ্যায় কাঠের চুলোর পাশে বসে থাকার সময় কোগিতো, এরগো সাম আপ্তবাক্যটি তৈরি করেন দেকার্তে। একে স্বপ্রকাশিত বলে বিশ্বাস করতেন তিনি। আমরা কেবল আমাদের মনের সন্দেহের অভিজ্ঞতার বিষয়েই নিশ্চিত হতে পারি। কিন্তু এটা মানুষের মনের সীমাবদ্ধতা তুলে ধরে এবং ‘সীমাবদ্ধতার’ এই চিন্তা কোনও অর্থ প্রকাশ করবে না যদি আমাদের ‘সম্পূর্ণতা’ সম্পর্কে কোনও পূর্বধারণা না থাকে। অস্তিত্বহীন সম্পূর্ণতা তত্ত্বগতভাবে স্ববিরোধী হয়ে দাঁড়াবে। এরগো-চূড়ান্ত সম্পূর্ণতা-ঈশ্বর—অবশ্যই বাস্তব হতে বাধ্য।’ এই তথাকথিত প্রমাণে কোনও আধুনিক অবিশ্বাসীর সন্তুষ্ট হওয়ার কথা নয়। এখানে এই জাতীয় প্রসঙ্গের ক্ষেত্রে খাঁটি যুক্তির অক্ষমতাও দেখা যায়। জগতে আমাদের কার্যকর কর্মকাণ্ড পরিচালনার ক্ষেত্রে যৌক্তিক চিন্তাভাবনা অপরিহার্য। দেকার্তের মতো কোনও বাস্তবভিত্তিক লক্ষ্যে পরিচালিত হলে বা আমরা জাগতিক বিশ্ব থেকে নিজেদের সরিয়ে নিয়ে যতদূর সম্ভব বস্তুনিষ্ঠভাবে কোনও কিছু বিবেচনা করতে চাইলে সবচেয়ে ভালোভাবে প্রয়োগ সম্ভব। কিন্তু আমরা যখন জানতে চাই এই জগৎ কেন টিকে আছে (আদৌ থাকলে!) বা জীবনের কোনও অর্থ আছে কিনা, যুক্তি খুব বেশি অগ্রসর হতে পারে না, আর আমাদের চিন্তার বিষয়টিও আমাদের কাছে অদ্ভুত হয়ে উঠতে পারে। শীতল বিশ্বে চুলোর পাশে আপন অনিশ্চয়তায় বন্দি দেকার্তে এমন একটি ‘প্রমাণ’ উচ্চারণ করেছেন যা কিনা আধুনিক মানুষের আধ্যাত্মিক টানাপোড়েন তুলে ধরা মানসিক ধাঁধার চেয়ে সামান্য বেশি কিছু।

এভাবে বিজ্ঞান ও বাধাহীন যুক্তিবাদ একসাথে সামনে অগ্রসর হওয়ার এমন একটা সময়ে মানুষের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো মিথলজিহীন বাস করতে বাধ্য হওয়া বেশ উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষের কাছে জীবন হয়ে পড়ছিল অর্থহীন। ব্রিটিশ দার্শনিক টমাস হবস (১৫৮৮-১৬৭৯) বিশ্বাস করতেন যে, ঈশ্বর একজন ছিলেন, কিন্তু সকল বাস্তবসঙ্গত কারণেই ঈশ্বর নাও থাকতে পারেন। লুথারের মতো হবস ভৌত বিশ্বকে ঈশ্বরহীন মনে করেছেন। হবস বিশ্বাস করতেন, মানব ইতিহাসের উষা লগ্নে ঈশ্বর নিজেকে প্রকাশ করেছিলেন, আবার একেবারে অন্তিমে তাই করবেন। কিন্তু সেই সময় পর্যন্ত আমাদের তাঁকে ছাড়াই এগিয়ে যেতে হবে, যেমন বলা হয়েছে, অপেক্ষা করতে হবে, অন্ধকারে।” প্রচণ্ডভাবে ধার্মিক মানুষ ফরাসি দার্শনিক ব্লেইজ পাসকার্ল (১৬২৩-৬২)-এর চোখে আধুনিক বিজ্ঞানের হাতে উন্মুক্ত অসীম বিশ্বজগতের শূন্যতা ও ‘চিরন্তন নীরবতা’ নিখাঁদ ভীতির জাগরণ ঘটিয়েছে:

যখন মানুষের অন্ধ ও করুণ অবস্থা দেখি, যখন গোটা মহাবিশ্বকে মৃতের মতো ও মানুষকে আলোহীন দেখি, যেন তাকে মহাবিশ্বের এক কাণে ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে, যেন কে তাকে ওখানে নিয়ে গেছে তার জানা নেই, তাকে কী করতে হবে, মৃত্যুর পর কী পরিণতি হবে, কোনও কিছুই জানার মতো ক্ষমতা তার নেই, ঘুমের ভেতর কোনও ভয়াল নির্জন দ্বীপে নিয়ে যাওয়া কারও মতো সত্রাসে আলোড়িত হই আমি, পালানোর কোনও উপায় ছাড়াই জেগে উঠে দিশাহারা অবস্থা হয় যার। তখনই এমন করুণ অবস্থাও মানুষকে হতাশায় ঠেলে দেয় না দেখে বিস্মিত হই।১৯

এক বিশাল বাস্তব উপায়ে আধুনিক বিশ্বে যুক্তি ও লোগোস নারী-পুরুষের অবস্থার পরিবর্তন ঘটাচ্ছিল, কিন্তু মানবীয় প্রকৃতির কারণেই এপর্যন্ত মিথোসের এখতিয়ারে থাকা উদ্ভূত বিভিন্ন চূড়ান্ত প্রশ্নের মোকাবিলা করার যোগ্যতা মানুষের ছিল না। এর ফলে পাসকাল বর্ণিত হতাশা ও বিচ্ছিন্নতা আধুনিক অভিজ্ঞতার অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

তবে সবার জন্যে নয়। অষ্টাদশ শতাব্দীর দার্শনিক আলোকনের অন্যতম পথিকৃৎ জন লক (১৬৩২-১৭২৪)-এর পাসকালের মতো অস্তিত্বমূলক কোনও উদ্বেগ ছিল না। জীবন ও মানুষের যুক্তির উপর তাঁর বিশ্বাস ছিল প্রশান্ত ও আস্থাময়। ঈশ্বরের অস্তিত্বের ব্যাপারে কোনও সন্দেহ ছিল না তাঁর মনে, যদিও তিনি বুঝতেন আমাদের ইন্দ্রিয়জ অভিজ্ঞতার বাইরে অবস্থানকারী একজন উপাস্যের বাস্তবতা প্রমাণ করা বেকনের অভিজ্ঞতাজাত পরীক্ষায় উতরে যায় না। সম্পূর্ণ যুক্তির উপর নির্ভরশীল লকের ধর্ম কোনও কোনও মারানোর উদ্ভাবিত ডেইজম-এর অনুরূপ ছিল। তিনি পুরোপুরি নিশ্চিত ছিলেন, স্বাভাবিক প্রকৃতি একজন স্রষ্টার অস্তিত্বের পক্ষে যথেষ্ট প্রমাণ তুলে ধরে এবং যুক্তিকে ঠিক মতো মুক্তভাবে প্রকাশিত হতে দেওয়া হলে সবাই নিজ থেকেই সত্যি আবিষ্কার করতে পারবে। মিথ্যা ও কুসংস্করাচ্ছন্ন বিভিন্ন ধারণা এই পৃথিবীতে অনুপ্রবেশ করার একমাত্র কারণ পুরোহিতরা তাঁদের অর্থডক্সি মানুষের উপর জোর করে চাপিয়ে দিতে ইনকুইজিশনের মতো নিষ্ঠুর ও স্বেচ্ছাচারী বিভিন্ন কৌশল প্রয়োগ করেছেন। সুতরাং, সত্যিকারের প্রকৃত ধর্মের খাতিরে রাষ্ট্রকে অবশ্যই সকল ধরনের বিশ্বাসকে সহ্য করতে হবে এবং স্রেফ বাস্তব প্রশাসন ও সরকার নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হবে। চার্চ ও রাষ্ট্রকে অবশ্যই আলাদা থাকতে হবে। একজনের কাজে আরেকজন হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। এটা ছিল যুক্তির কাল। মানব ইতিহাসে প্রথমবারের মতো, বিশ্বাস করেছিলেন লক, নারী-পুরুষ স্বাধীন হয়ে উঠবে এবং সত্য উপলব্ধি করতে পারবে।২০

এমনি উদার দৃষ্টিভঙ্গি আলোকনের সুর স্থির করে দিয়েছিল, আধুনিক, সেক্যুলার, সহিষ্ণু রাষ্ট্রের অনুপ্রেরণাদানকারী আদর্শে পরিণত হয়েছিল। ফরাসি ও জার্মান আলোকন দার্শনিকরাও ডেইজমের যৌক্তিক ধর্মে অবদান রেখেছেন, প্রাচীন পৌরাণিক প্রত্যাদিষ্ট ধর্মগুলোকে সেকেলে বিবেচনা করেছেন তাঁরা। যুক্তিই যেহেতু সত্যির একমাত্র কষ্টিপাথর, ‘প্রত্যাদেশে’র কাল্পনিক ধারণার উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত পুরোনো ধর্মগুলো এইসব প্রাকৃতিক ধর্মের আনাড়ী ভাষ্য বলে সেগুলোকে প্রত্যাখ্যান করতে হবে। বিশ্বাসের যৌক্তিক হওয়া উচিত, যুক্তি দেখিয়েছেন ব্রিটিশ ধর্মবেত্তা ম্যাথ্যু টিন্ডাল (১৬৫৫-১৭৩৩) ও রোমান ক্যাথলিক থেকে ডেইস্টে পরিণত আইরিশ জন টোল্যান্ড (১৬৭০-১৭২২)। আমাদের স্বাভাবিক যুক্তিই পবিত্র সত্যে পৌছানোর একমাত্র নির্ভরযোগ্য উপায়, ক্রিশ্চান ধর্মকে অবশ্যই রহস্যময়, অতিপ্রাকৃত ও অলৌকিক থেকে মুক্ত করতে হবে। প্রত্যাদেশের কোনও প্রয়েজন নেই, কারণ যে কোনও সাধারণ মুনষের পক্ষেই স্বাধীন যুক্তিজ্ঞানের বদৌলতে সত্যে উপনীত হওয়া খুবই সম্ভব।২১ নিউটন যেমন তুলে ধরেছেন, ভৌত মহাবিশ্বের পরিকল্পনা নিয়ে বাইবেলেই একজন স্রষ্টা ও প্রথম কারণের অস্তিত্বের পক্ষে পর্যাপ্ত প্রমাণ মেলে। মহাদেশে জার্মান ইতিহাসবিদ হারমান স্যামুয়েল রেইমারাস (১৬৯৪- ১৭৬৮) যুক্তি দেখিয়েছেন যে, জেসাস কখনওই নিজেকে ঐশী সত্তা বলে দাবি করেননি। তাঁর লক্ষ্য সম্পূর্ণ রাজনৈতিক ছিল। একটি ‘অসাধারণ, সরল, মহান ও বাস্তব ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা’ জেসাসকে স্রেফ একজন মহান নেতা হিসাবে শ্রদ্ধা করা উচিত। ২২

মিথোসের প্রাচীন সত্যসমূহকে এখন এমনভাবে ব্যাখ্যা করা হচ্ছিল যেন সেগুলো লোগোই, এটা ছিল সম্পূর্ণ নতুন পরিবর্তন, শেষ পর্যন্ত হতাশ করতে বাধ্য।

কারণ ঠিক যে সময়ে এই ধর্মবেত্তা, দার্শনিক ও ইতিহাসবিদগণ যুক্তির প্রাধান্য দাবি করছিলেন, ঠিক তখন জার্মান যুক্তিবাদী ইম্যানুয়েল কান্ট (১৭২৩-১৮০৪) গোটা আলোকনের প্রকল্পকেই খাট করে দেন। কান্ট একদিকে প্রাথমিক আধুনিকতার স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। মানুষকে অবশ্যই শিক্ষক, চার্চ ও কর্তৃপক্ষের উপর নির্ভরশীলতা ছুঁড়ে ফেলে নিজে থেকেই সত্যি সন্ধান করতে হবে। ‘আলোকন হচ্ছে মুনষের নিজে থেকে সৃষ্টি করা অভিভাবকত্ব থেকে মুক্তি, ‘ লিখেছেন তিনি। ‘অভিভাবকত্ব হচ্ছে অন্যের কাছ থেকে নির্দেশনা না পেয়ে নিজের মতো করে নিজের বোধকে কাজে লাগানোর অক্ষমতা। ২৩ কিন্তু আবার অন্যদিকে ক্রিটিক অভ পিউর রিজন (১৭৮১)-এ কান্ট যুক্তি দেখিয়েছেন যে, আমরা প্রকৃতিতে যে শৃঙ্খলা আবিষ্কার করি বলে ভাবি তার সাথে বাইরের কোনও বাস্তবতার সম্পর্ক থাকার ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া অসম্ভব। এই শৃঙ্খলা’ আমাদের নিজস্ব মনের সৃষ্টি মাত্র, এমনকি নিউটনের তথাকথিত বৈজ্ঞানিক নিয়মকানুনও সম্ভবত বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের চেয়ে বরং মানুষের মনস্তত্ত্ব সম্পর্কেই বেশি তথ্য যোগায়। মন বিভিন্ন ইন্দ্রিয়জ অভিজ্ঞতার সাহায্যে তার বাইরের কেনও তথ্য সংগ্রহ করার সময় এর ভেতর থেকে একটা অর্থ বের করতে একে তার নিজস্ব অন্তস্থঃ কাঠামো অনুযায়ী শনাক্ত করতে হয়। নিজের জন্যে একটি টেকসই যৌক্তিক দর্শন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে মনের ক্ষমতার উপর দরুণ আস্থাশীল ছিলেন কান্ট। কিন্তু বাস্তবে মানুষের পক্ষে তার মনস্তত্ত্ব থেকে পালানো অসম্ভব দেখিয়ে তিনি এটাও স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, পরম সত্য বলে কিছু নেই। আমাদের সব ধারণাই আবিশ্যিকভাবে বস্তুনিষ্ঠ ও ব্যাখ্যামূলক। দেকার্তে যেখানে মানুষের মনকে এক মৃত পৃথিবীতে নিঃসঙ্গ নাগরিক হিসাবে দেখেছেন, কান্ট জগৎ ও মানুষের ভেতরের সম্পর্ক সম্পূর্ণ ছিন্ন করে দিয়ে তাকে আমাদের নিজেদের মাথার ভেতর বন্দি করেছেন।২৪ মানুষকে অভিভাবকত্ব থেকে মুক্ত করার পাশাপাশি এক বন্দিশালায় আটক করেছেন। প্রায়শঃই আধুনিকতা এভাবে এক হাতে কিছু দিয়ে আরেক হাতে কেড়ে নিয়েছে। যুক্তি আলোক ও মুক্তিদায়ী ছিল, কিন্তু তা নারী-পুরুষকে যে জগৎ তারা কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে শিখছিল সেখান থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছিল।

পরম সত্যি বলে কিছুই যদি না থাকবে তাহলে ঈশ্বরের কী হবে? অন্যান্য ডেইস্টদের বিপরীতে কান্ট বিশ্বাস করতেন যে, উপাস্য ইন্দ্রিয়র নাগালের বাইরে অবস্থান করেন বলে মানুষের মনের অগম্য ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করা অসম্ভব।২৫ পরমের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যুক্তির আসলে একাকী কিছুই করার থাকে না। একমাত্র যে সান্ত্বনা কান্ট যোগাতে পেরেছিলেন সেটা হলো, একই যুক্তিতে ঈশ্বরের অস্তিত্বহীনতা প্রমাণ করা অসম্ভব। কান্ট স্বয়ং ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি ছিলেন, নিজের ধারণাসমূহকে ধর্মের প্রতি বৈরী মনে করেননি; তিনি ভেবেছিলেন, এসব ধারণা ধর্মবিশ্বাসকে যুক্তির উপর নেহাত অযথার্থ নির্ভরশীলতা থেকে মুক্ত করবে। ক্রিটিক অভ প্র্যাক্টিকাল রিজন-এর শেষে তিনি লিখেছেন, প্রত্যেক মানুষের অন্তরে নৈতিক বিধান খোদাই করার ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলেন তিনি, স্বর্গের বিশালতার মতো যা তাঁকে বিস্ময় আর ভয়ে পরিপূর্ণ রাখে। কিন্তু ডেইস্ট ঈশ্বরের অস্তিত্বের পক্ষে একমাত্র যে যৌক্তিক ভিত্তি তুলে ধরতে পেরেছিলেন তিনি সেটা খুবই সন্দেহজনক যুক্তি যে, এমন একজন উপাস্য ছাড়া ও পরকালের সম্ভাবনা না থাকলে আমাদের নৈতিক আচরণ করার কোনও কারণ দেখতে পান না তিনি। একেও প্রমাণ হিসাবে অসন্তোষজনকই বলতে হবে।২৬ কান্টের ঈশ্বর ছিলেন মানবীয় অবস্থায় জুড়ে দেওয়া পশ্চাদভাবনামাত্র। অন্তস্থঃ বিশ্বাস ছাড়া একজন যুক্তিবাদী কেন বিশ্বাস করতে যাবে তার কোনও প্রকৃত কারণ নেই। ডেইস্ট ও যুক্তিবাদী মানুষ হিসাবে অতীত কালের নারী-পুরুষ যুক্তির উপর নির্ভরশীলতা ছাড়াই কেবল প্রচলিত প্রতীক বা রেওয়াজের মাধ্যমে এক ধরনের পবিত্রের অনুভূতি জাগিয়ে তুলতে পারত- সেসবে কান্টের কোনও অবকাশ ছিল না। স্বর্গীয় আইনের ঘোরতর বিরোধী ছিলেন কান্ট, তাঁর চোখে এটা ছিল মানুষের স্বায়ত্তশাসনের বর্বোরোচিত অস্বীকৃতি, তিনি অতীন্দ্রিয়বাদ, প্রার্থনা বা আচার অনুষ্ঠানের ভেতর যুক্তি খুঁজে পাননি।২৭ কাল্টের অস্তিত্ব ছাড়া ধর্ম ও স্বর্গের ধারণা ক্ষীণ, শুষ্ক ও সমর্থনের অযোগ্য।

কিন্তু তারপরেও পশ্চিমে, বৈপরীত্যমূলকভাবে সত্যের একমাত্র মাপকাঠি হিসাবে যুক্তির আবির্ভাব ধর্মীয় অযৌক্তিতার বিস্ফোরণের সাথে মিলে গিয়েছিল। ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীতে বহু প্রটেস্ট্যান্ট ও ক্যাথলিক দেশ ও আমেরিকান কলোনিগুলোতে সংক্ষিপ্ত সময়ে জন্যে আবির্ভূত ব্যাপক উইচ ক্রেজ দেখিয়ে দিয়েছিল যে, বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদের কাল্টও সব সময় অন্ধকার শক্তিকে দূরে ঠেলে রাখতে পারে না। অতীন্দ্রিয়বাদ ও মিথলজি নারী-পুরুষকে অবচেতন বিশ্বের মোকাবিলা করতে শিখিয়েছিল। এটা দুর্ঘটনামূলক নাও হতে পারে যে, এমন একটা সময় ধর্মীয় বিশ্বাস এই ধরনের আধ্যাত্মিকতা বিসর্জন দিতে শুরু করলে অবচেতন উচ্ছৃঙ্খল হয়ে উঠেছিল। উইচ ক্রেজকে গোটা ক্রিশ্চান বিশ্বে নারী, পুরুষ ও ইনকুইজিটরদের সম্মিলিত ফ্যান্টাসি হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে। লোকে বিশ্বাস করে বসেছিল যে, দানোর সাথে তাদের যৌন সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে ও কোনও শয়তানি আচার আর বিকৃত অনুষ্ঠানে যোগ দিতে রাতের অন্ধকারে তাদের উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ধরে নেওয়া হয়েছিল, ডাইনীরা ধর্মসভার বিকৃতিতে ঈশ্বরের বদলে শয়তানের উপাসনা করছে-প্রচলিত ধর্মের প্রতি ব্যাপকবিস্তারি অবচেতন বিদ্রোহ ফুটিয়ে তোলা পরিবর্তন হতে পারে। ঈশ্বরকে এত দূরবর্তী, অচেনা আর চাহিদা সম্পন্ন মনে হচ্ছিল যে, কারও কারও কাছে দানবীয় হয়ে উঠছিলেন তিনি; অবচেতেন ভীতি ও আকাঙ্ক্ষাসমুহ মানুষের দানবীয় রূপে ফুটিয়ে তোলা শয়তানের কাল্পনিক মূর্তিতে প্রক্ষিপ্ত হয়েছে।২৮ খোদ ক্রেজের অবসান হওয়ার আগ পর্যন্ত উইচক্র্যাফটের দায়ে দণ্ডিত হাজার হাজার নারী-পুরুষকে হয় ফাঁসি দেওয়া হয়েছে নয়তো শূলে চড়িয়ে মারা হয়েছে। মনের এইসব গভীর স্তরসমূহকে বিবেচনায় না নেওয়া নতুন বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদ এই বিকারগ্রস্ত বিস্ফোরণকে সামাল দিতে ছিল অক্ষম। এক বিশাল ভীতিকর ও ধ্বংসাত্মক যুক্তিহীনতাও আধুনিক অভিজ্ঞতার অংশ ছিল।

অতলান্তিকের উভয় পাড়ের মানুষের জন্যেই ভীতিকর সময় ছিল এটা। সংস্কার ছিল ইউরোপকে ভয়ঙ্করভাবে বৈরী শিবিরে বিভক্ত করে দেওয়া ভীতিকর বিচ্ছেদ। ইংল্যান্ডে প্রটেস্ট্যান্ট ও ক্যাথলিকরা পরস্পরের উপর নির্যাতন চালিয়েছে: ফ্রান্সে প্রটেস্ট্যান্ট ও ক্যাথলিকদের মধ্যে গৃহযুদ্ধের ঘটনা (১৫৬২-৬৩) এবং ১৫৭২ সালে দেশব্যাপী প্রটেস্ট্যান্টদের গণহারে হত্যা ঘটেছে। তিরিশ বছর মেয়াদী যুদ্ধ (১৬১৮-৪৮) একের পর এক দেশকে টেনে এনে ইউরাপকে ধ্বংস করে দিয়েছে, শক্তিশালী ধর্মীয় মাত্রায় পরিচালিত ক্ষমতার সংঘাত ইউরোপের ঐকবদ্ধ হওয়ার যে কোনও আশা তিরোহিত করে দিয়েছে। রাজনৈতিক অস্থিরতাও ছিল। ১৬৪২ সালে গৃহযুদ্ধে জর্জরিত হয়ে ওঠে ইংল্যান্ড, এরই পরিণতিতে রাজা প্রথম চার্লস নিহত হন (১৬৪৯) এবং পিউরিটান সাংসদ অলিভার ক্রমওয়েলের অধীনে একটি প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৬৬০ সালে রাজতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হলে সংসদ কর্তৃক এর ক্ষমতা খর্ব করা হয়। পশ্চিমে আরও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের রক্তাক্ত ও বেদনাদায়ক আবির্ভাব ঘটছিল। ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লব আরও অনেক বেশি বিপর্যয়কর ছিল, এর অব্যবহিত পরবর্তী সময়ে নেপোলিয়নের অধীনে শৃঙ্খলার পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে ত্রাস ও সামরিক স্বৈরাচারের একটা রাজত্ব চলেছে। আধুনিক বিশ্বে ফরাসি বিপ্লবের উত্তরাধিকার দ্বিমুখী: স্বধীনতা, সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের আলোকন আদর্শের বিকাশ ঘটানোর পাশাপাশি আবার সমানভাবে প্রভাবশালী রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের ভয়াবহ স্মৃতিও রেখে গেছে। আমেরিকান উপনিবেশগুলোতেও সাত বছর মেয়াদী যুদ্ধ (১৭৩৬-৬৩)-যেখানে ফ্রান্স ও ব্রিটেন তাদের সাম্রাজ্যবাদী অধিকার নিয়ে পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল-আমেরিকার পূর্ব উপকূলে ধ্বংসলীলা চালিয়েছে, ভীতিকর ধ্বংসলীলার সৃষ্টি হয়েছে তাতে। এটা সরাসরি স্বাধীনতা যুদ্ধের পথে নিয়ে গেছে (১৭৭৫-৮৩) যার ফলে আধুনিক বিশ্বে সর্ব প্রথম সেক্যুলার রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা লাভ করে। পশ্চিমে আরও ন্যায়বিচারভিত্তিক ও সহিষ্ণু সামাজিক ব্যবস্থার আবির্ভাব ঘটছিল, কিন্তু সেটা অর্জন সম্ভব হয়েছিল প্রায় দুই শতাব্দীব্যাপী সহিংসতার পর।

এই টালমাতাল সময়ে মানুষ ধর্মের দিকে ঝুঁকে পড়েছিল এবং কেউ কেউ এমনি নতুন পরিস্থিতিতে বিশ্বাসের প্রাচীন ধরন আর কাজ করছে না বলে আবিষ্কার করেছিল। পরবর্তীকালে ইহুদি ধর্মের শ্যাব্বেতিয় আন্দোলনের মতো নৈতিকতা বিরোধী আন্দোলন অতীতের সাথে বন্ধন ছিন্ন করে সামঞ্জস্যহীনভাবে নতুন কিছু লাভ করার প্রয়াস পেয়েছিল। সপ্তম শতাব্দীর ইংল্যান্ডে গৃহযুদ্ধের পর জ্যাকব বথিউমলি ও লরেন্স ক্লার্কসন (১৬৩০) এক ধরনের প্রাথমিক নাস্তিক্যবাদের প্রচার চালান। একজন বিচ্ছিন্ন, দূরবর্তী উপাস্য বহুঈশ্বরবাদ ছাড়া আর কিছুই নয়, দ্য লাইট অ্যান্ড ডার্ক সাইড অভ গড (১৬৫০)-এ যুক্তি দেখিয়েছেন ক্লার্কসন; জেসাস ছাড়াও অন্য ব্যক্তির মাঝে মানবরূপ গ্রহণ করেছিলেন ঈশ্বর; সবকিছুতেই, এমনকি পাপেও স্বর্গীয় সত্তার অস্তিত্ব রয়েছে। দ্য সিঙ্গল আই-তে ক্লার্কসনের চোখে পাপ মানবীয় কল্পনামাত্র, আর অশুভ ঈশ্বরের একটি প্রকাশ। রেডিক্যাল ব্যাপ্টিস্ট অ্যাবিয়েযার কোপে (১৬১৯-৭২) প্রকাশ্যে যৌনতার টাবু ভঙ্গ করবেন ও জনসমক্ষে খিস্তিখেউর করবেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, ‘মহান সমতাবিধানকারী’ ক্রাইস্ট ফিরে এসে বর্তমানের পচা ভণ্ডামীপূর্ণ ব্যবস্থাকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করবেন। ২৯ নিউ ইংল্যান্ডের আমেরিকান কলোনিগুলোতেও নৈতিকতা বিরোধী মতবাদ চলছিল। ১৬৩৫ সালে ম্যাসাচুসেটসে পৌঁছানো জনপ্রিয় পিউরিটান যাজক জন কটন (১৫৮৫-১৬২৩) জোর দিয়ে বলেছেন, ভালো কাজের কোনও অর্থ নেই, সৎ জীবন যাপন অর্থহীন; এইসব মানব সৃষ্ট নিয়মনীতি ছাড়াই ঈশ্বর আমাদের উদ্ধার করার ক্ষমতা রাখেন। তাঁর শিষ্য অ্যানি হাচিনসন (১৫৯০-১৬৪৩) দাবি করেছিলেন, ঈশ্বরের কাছ থেকে ব্যক্তিগত প্রত্যাদেশ লাভ করেছেন তিনি, তাই বাইবেল পাঠ বা ভালো কাজ করার কোনও প্রয়োজন বোধ করেন না। এই বিদ্রোহীরা সম্ভবত জীবন মৌলিকভাবে বদলে যেতে থাকা নুতন বিশ্বব্যবস্থায় প্রাচীন বিধিনিষেধ আর কাজ না করার সেই অপরিণত ভাবনাই প্রকাশ করার প্রয়াস পাচ্ছিলেন। অবিরাম উদ্ভাবনের একটা কালে কেউ কেউ ধর্মীয় ও নৈতিক স্বাধীনতার জন্যে পা বাড়িয়ে আবার উদ্ভাবন থেকেও নিস্তার চাইবে, এটাই স্বাভাবিক।  

অন্যরা নতুন যুগের আদর্শসমূহকে ধর্মীয় ভঙ্গিতে প্রকাশের প্রয়াস পেয়েছে। সোসায়েটি অভ ফ্রেন্ডস-এর প্রতিষ্ঠাতা জর্জ ফক্স (১৬২৪-৯১) এমন এক আলোকনের প্রচার করেছেন যা পরবর্তীকালের কান্টের মতবাদ থেকে খুব বেশি ভিন্ন ছিল না। তাঁর কোয়াকারদের নিজের অন্তস্তলেই আলোর সন্ধান করতে হবে। ফক্স তাদের ‘অন্যের কাছে নির্দেশনা নেওয়ার বদলে নিজের মতো করে উপলব্ধি অর্জন করতে’৩১ শিখিয়েছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, ধর্মকে এই বিজ্ঞানের যুগে অবশ্যই ‘পরীক্ষামূলক’ হতে হবে; কোনও কর্তৃত্ববাদী প্রতিষ্ঠান নয়, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় সত্যায়িত হতে হবে।৩২ সোসায়েটি অভ ফ্রেন্ডস এক নতুন গণতান্ত্রিক আদর্শের প্রচারণা চালিয়েছে: সব মানব সন্তানই সমান। কোয়াকারদের আর কারও সামনে মাথার টুপি খোলার প্রয়োজন নেই। অশিক্ষিত নারী-পুরুষকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিধারী যাজকদের সমীহ করার প্রয়োজন নেই, বরং তাদের অবশ্যই নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করতে হবে। একইভাবে জন ওয়েসলি (১৭০৩- ৯১) আধ্যাত্মিকতায় বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ও ব্যবস্থার প্রয়োগ ঘটাতে চেয়েছিলেন। তাঁর ‘মেথডিস্ট’ অনুসারীরা প্রার্থনার কঠোর নিয়ম মেনে চলত: বাইবেল পাঠ, উপবাস পালন ও দান। কান্টের মতো ওয়েসলি যুক্তি থেকে ধর্মবিশ্বাসের মুক্তিকে স্বাগত জানিয়েছেন। তিনি ঘোষণা করেছিলেন, ধর্ম মস্তিষ্কের কোনও মতবাদ নয়, বরং হৃদয়ের বিশ্বাস। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ক্রিশ্চান ধর্মের যৌক্তিক ও ঐতিহাসিক প্রমাণসমূহ ‘আবদ্ধ ও বন্দি’ হয়ে পড়াটা এমনকি এক ধরনের আশীর্বাদও হতে পারে। এটা নারী-পুরুষকে মুক্ত করবে, তাদের ‘নিজেদের দিকে চোখ ফেরাতে বাধ্য করবে ও হৃদয়ের মাঝে উজ্জ্বল হয়ে জ্বলন্ত আলোকে দেখতে বাধ্য করবে।’৩

ক্রিশ্চানরা বিভক্ত হতে শুরু করেছিল: কেউ কেউ ফিলোসফসদের অনুসরণ করে ধর্মবিশ্বাসকে রহস্যমুক্ত ও যৌক্তিক করার প্রয়াস পাচ্ছিল, অন্যরা যুক্তিকে পুরোপুরি বাদ দিয়ে দিয়েছিল। এটা ছিল উদ্বেগজনক একটা ব্যাপার, বিশেষ করে আমেরিকান কলোনিগুলোতে বেশি দৃশ্যমান ছিল। উনবিংশ শতাব্দীর শেষ নাগাদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মৌলবাদের বিকাশ এই বিভাজনের অন্যতম প্রতিক্রিয়া হয়ে উঠবে। প্রথম দিকের বছরগুলোতে পিউরিটান নিউ ইংল্যান্ড ছাড়া অধিকাংশ কলোনি ধর্মের প্রতি নিস্পৃহ ছিল; মনে হয়েছিল যেন সপ্তদশ শতাব্দীর শেষ নাগাদ কলোনিগুলো বুঝি সম্পূর্ণ সেকুলারাইজড হয়ে উঠবে। কিন্তু অষ্টাদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে আবার প্রটেস্ট্যান্টদের আধিপত্য পুনরুজ্জীবিত হয়, পুরোনো পৃথিবীর তুলনায় নুতন বিশ্বে ক্রিশ্চানদের জীবনধারা অনেক বেশি আনুষ্ঠানিক হয়ে ওঠে। মূলত যাজকীয় কর্তৃত্ব প্রত্যাখ্যান করে যার যার নিজস্ব নেতৃত্ব অনুসরণের উপর জোরদানকারী কোয়াকার, ব্যাপ্টিস্ট ও প্রেসবিটারিয়ানদের মতো উপদলগুলো ফিলাদেলফিয়া অ্যাসেম্বলি স্থাপন করেছিল। এই অ্যাসেম্বলি স্থানীয় জনগোষ্ঠীর উপর তীক্ষ্ণ নজর রাখত, যাজক সম্প্রদায়কে নির্দেশনা দিত ও যেকোনও রকম ধর্মদ্রোহীতাকে দমন করত। এই নির্যাতনমূলক অথচ আধুনিকায়ন প্রক্রিয়ার ফলে তিনটি গোষ্ঠীই সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে ও এদের সংখ্যা নাটকীয়ভাবে বাড়তে থাকে। একই সময়ে মেরিল্যান্ডে চার্চ অভ ইংল্যান্ড প্রতিষ্ঠিত হয়, জাঁকাল দর্শন চার্চ নিউ ইয়র্ক সিটি, বস্টন ও চার্লসটনের দিগন্ত রেখাকে আমূল বদলে দেয়।৩৫

কিন্তু একদিকে যখন বৃহত্তর নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা আরোপের লক্ষ্যে প্রয়াস চলছিল, তখন এই যৌক্তিক বিধিনিষেধের বিরুদ্ধে তৃণমূল পর্যায়ে প্রচণ্ড প্রতিক্রিয়ারও সৃষ্টি হয়েছিল। রক্ষণশীল ধর্ম সব সময়ই মিথলজি ও যুক্তিকে পরিপূরক হিসাবে দেখেছে, একটি ছাড়া অন্যটি হীন হয়ে পড়বে। ধর্মীয় ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা তাই ছিল, যেখানে যুক্তিকে প্রায়ই গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করার সুযোগ করে দেওয়া হত। কিন্তু কোনও কোনও নতুন প্রটেস্ট্যান্ট আন্দোলনে (এই পরিবর্তনকে মার্টিন লুথারের সময় পর্যন্ত টেনে নেওয়া যেতে পারে) যুক্তিকে সাইড লাইনে ঠেলে দেওয়ার বা এমনকি পুরোপুরি বাতিল করার প্রবণতা অস্বস্তিকর যুক্তিহীনতার দিকে টেনে নিয়ে গেছে। কোয়াকারদের এ নামে অভিহিত করার কারণ ছিল গোড়ার দিকে প্রায়শঃই তারা তাদের ধর্মীয় পরিবর্তন প্রকাশ করার জন্যে কাঁপত, হুঙ্কার ছাড়ত আর চিৎকার করত—জনৈক পর্যবেক্ষক লক্ষ করেছেন-ফলে কুকুর ডেকে উঠত, গরুছাগল পাগলের মতো ছোটাছুটি করত আর শুয়োরের পাল আতঙ্কে চেঁচামেচি জুড়ে দিত। রেডিক্যাল কালিভিনিস্ট পিউরিটানদেরও-চার্চ অভ ইংল্যান্ডের ‘সম্পত্তি’ বলে তাদের ধরণার সবকিছুর বিরোধিতা করে যাদের শুরু হয়েছিল—একই ধরনের চরম, কোলাহলময় আধ্যাত্মিকতা ছিল। তাদের ‘নতুন জন্মে’র খিঁচুনী প্রায়শঃই আচ্ছন্ন ধরনের ছিল, আনন্দের সাথে ঈশ্বরের বাহুতে ডুব দিয়ে সফল হওয়ার আগে অনেকেই অপরাধরোধ, ভীতি ও অবশ করা সন্দেহের যন্ত্রণা বোধ করেছে। ধর্মান্তরকরণ বিপুল শক্তিতে আদি আধুনিককালে নেতৃত্বস্থানীয় ভূমিকা রাখতে সক্ষম করে তুলেছিল তাদের। তারা ভালো পুঁজিবাদী ও প্রায়শঃই ভালো বিজ্ঞানী ছিলেন। কিন্তু অনেক সময় মহত্বের প্রভাব ফুরিয়ে যেত, পিউরিটানরা তখন এক ধরনের পুনঃপতনে আক্রান্ত হত, অবিরাম বিষণ্ণতার চক্রে পড়ে যেত তারা। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এমনকি তারা আত্মহত্যাও করেছে। ৩৭

এইদিক থেকে রক্ষণশীল ধর্ম উন্মাদনাগ্রস্ত ছিল না। মানুষকে আস্থার সাথে সম্পর্কিত করে তোলার জন্যেই এর আচারানুষ্ঠান ও কাল্টের পরিকল্পনা করা হত। বাকানালিয় কাল্ট ও উন্মত্ত পরমানন্দের ঘটনা নিশ্চিতভাবেই ঘটেছে বটে, কিন্তু তাতে সংখ্যাগরিষ্ঠের চেয়ে বরং অল্প কিছু লোক প্রভাবিত হয়েছে। অতীন্দ্রিয়বাদ ব্যাপক জনসাধারণের জন্যে ছিল না। সর্বোচ্চ অবস্থায় এটা এক থেকে অন্যকে শিক্ষা দেওয়ার পদ্ধতি: এখানে শিক্ষাব্রতীতে সযত্নে তত্ত্বাবধান করা হয় যাতে সে কোনও মানসিক অস্বাস্থ্যকর অবস্থায় না পড়ে। অবচেতনে অবতরণের ব্যাপারটি এক ধরনের নৈপূণ্য; ব্যাপক দক্ষতা, বুদ্ধিমত্তা ও শৃঙ্খলা দাবি করে। দক্ষ নির্দেশক পাওয়া না গেলে ফল নিন্দনীয় হয়ে উঠতে পারে। প্রায়শঃই পর্যাপ্ত আধ্যাত্মিক নির্দেশনার অভাবে কারণে ঘটে যাওয়া মধ্যযুগীয় ক্রিশ্চান সাধুদের উন্মত্ত ও পাগলামিসুলভ আচরণ মনের বিকল্প অবস্থার চর্চার ক্ষেত্রে শৃঙ্খলাহীনতার বিপদই তুলে ধরেছে। এই ধরনের অপচয় রোধ করার জন্যেই তেরেসা অভ আভিলা ও জন অভ দ্য ক্রসের সংস্কার পরিকল্পিত ছিল। অতীন্দ্রিয় যাত্রা গণহারে হাতে নেওয়া হলে শাব্বেতিয়দের নিশ্চিহ্নবাদ বা কিছু সংখ্যক পিউরিটানের মানসিক ভারসাম্যহীনতার মতো সমবেত হিস্টিরিয়ায় পর্যবসিত হতে পারে।

আবেগীয় বাড়াবাড়ি অষ্টাদশ শতাব্দীতে আমেরিকার ধর্মীয় জীবনের বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছিল। প্রথম মহাজাগরণে এই বিষয়টি বিশেষভাবে স্পষ্ট ছিল। ১৭৩৪ সালে কানেক্টিকাটের নর্থদাম্পটনে বিস্ফোরিত হয়েছিল এই আন্দোলন; বিজ্ঞ কালভিনিস্ট যাজক জোনাথান এডওয়ার্ডস (১৭০৩-৫৮) এর বিবরণ লিপিবদ্ধ করে গেছেন। মহাজাগরণের আগে, ব্যাখ্যা করেছেন এডওয়ার্ডস, নর্দাম্পটনের লোকেরা তেমন ধার্মিক ছিল না, কিন্তু ১৭৩৪ সালে সহসা দুই তরুণ মারা যায়। এর ধাক্কা, (এডওয়ার্ডসের নিজস্ব আবেগ প্রবণ প্রচারণার সমর্থনে) গোটা শহর উন্মত্ত ধার্মিকতায় পতিত হয়, মহামারীর মতো ম্যাসাচুসেটস ও লঙ আইল্যান্ডে ছড়িয়ে পড়ে তা। লোকজন কাজ ফেলে সারাদিন বাইবেল পড়ে সময় কাটাতে শুরু করে। ছয় মাসের মধ্যেই শহরের তিনশো লোক বেদনাদায়ক ‘পুনর্জন্মের দীক্ষা লাভ করে। পরম আনন্দ ও ভীষণ বিষণ্নতার মাঝে ওঠানামা করছিল তারা; অনেক সময় সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ত আর ‘তারা ঈশ্বরের ক্ষমা লাভের অযোগ্য ভাবতে তৈরি হয়ে যাওয়ার মতো অপরাধবোধের অনুভূতিতে ডুবে যেত।’ অন্যান্য সময়ে তারা ‘হাসিতে ফেটে পড়ত, একই সময়ে আবার স্রোতের মতো চোখে অশ্রু গড়িয়ে পড়ত, মাঝেমাঝে প্রচণ্ড বিলাপে ফেটে পড়ত।৩৮ এই পুনর্জাগরণ মিলিয়ে যেতে শুরু করেছিল, এমন সময় এক ইংরেজ মেথডিস্ট যাজক জর্জ হুইটফিল্ড (১৭১৪- ৭০) বিভিন্ন উপনিবেশে সফর করে দ্বিতীয় দফা জোয়ার সৃষ্টি করেন। তাঁর সারমনের সময় লোকে অচেতন হয়ে যেত, কাঁদত, চিৎকার ছাড়ত; যারা রক্ষা পেয়েছে মনে করত তাদের চিৎকারে কেঁপে উঠত চার্চের অন্দর মহল আর নিজেদের নিশ্চিত সাজাপ্রাপ্ত ধরে নেওয়া দুর্ভাগাদের গোঙানি শোনা যেত। কেবল সাধারণ ও অশিক্ষিতরাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। হার্ভার্ড ও ইয়েলে আনন্দমুখর সংবর্ধনা লাভ করেন হুইটফিল্ড। ১৭৪০ সালে একটি গণমিছিলের মাধ্যমে তাঁর সফরের সমাপ্তি টানেন তিনি, সেখানে বস্টন কমনের ৩০,০০০ লোকের সামনে সারমন দিয়েছিলেন।

এডওয়ার্ডস তাঁর বিবরণে এই ধরনের আবেগপ্রবণতার বিপদ তুলে ধরেছেন। নর্দাম্পটনে পুনর্জাগরণে ভাটা পড়লে একজন এতটাই বিমর্ষ হয়ে পড়েছিল যে পরমানন্দমূলক আনন্দের হারিয়ে যাওয়ার মানে হতে পারে কেবল তার অবশ্যাম্ভবী নরক বাস, এটা নিশ্চিত হয়ে আত্মহত্যা করে বসে সে। অপরাপর শহরেও ‘অসংখ্য মানুষ…জোরালভাবে এটা বুঝিয়েছে বলে মনে হয়েছে, ওদের উপর চাপ সৃষ্টি করেছে, যেন কেউ একজন তাদের উদ্দেশে বলছে, “তোমার গলা কেটে ফেল, এটাই সেরা সুযোগ। এখন!” দুজন লোক ‘অদ্ভুত উৎসাহভরা বিভ্রমে পাগল হয়ে গেছে। এডওয়ার্ডস জোরের সাথে বলেছেন যে অধিকাংশ লোক জাগরণের আগে অপেক্ষাকৃত শান্ত ও চুপচাপ ছিল, কিন্তু তাঁর অ্যাপোলোজিয়া ধর্মকে কেবল হৃদয়ের একটা ব্যাপার কল্পনা করা কতখানি বিপজ্জনক হতে পারে সেটাই দেখিয়ে দেয়। ধর্মকে একবার অযৌক্তিক ধরে নিয়ে সেরা রক্ষণশীল আধ্যাত্মিকতার অন্তস্থঃ বাধাসমূহকে বাতিল করে দেওয়া হলে লোকে সব ধরনের বিভ্রমে পতিত হতে পারে। কাল্টের বিভিন্ন আচার আচরণ এমনভাবে পরিকল্পিত যাতে লোকে কোনও আঘাতের ভেতর দিয়ে অগ্রসর হয়ে স্বাস্থ্যবান হয়ে অপর প্রান্ত দিয়ে বের হয়ে আসতে পারে। লুরিয় কাব্বালাহয় এই বিষয়টি খুবই স্পষ্ট, এখানে অতীন্দ্রিয়বাদীকে বিষাদ ও পরিত্যাগ দেখানোর সুযোগ দেওয়া হয়, কিন্তু আনন্দের সাথে অভিযাত্রা শেষ করানো হয়। একইভাবে হুসেইনের সম্মানে আয়োজিত প্রচলিত শিয়া মিছিল মানুষকে তাদের হতাশা ও ক্রোধ প্রকাশ করার একটা পথ তৈরি করে দেয়, তবে একটা আচরিক রূপে: অনুষ্ঠান শেষে তারা উন্মত্তের মতো ছোটাছুটি শুরু করে না, ধনী ও ক্ষমতাশালীদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেয় না। কিন্তু নর্দাম্পটনে লোকজনকে অগ্রসর হওয়ার পথে সাহায্য করতে কোনও পরিকল্পিত কাল্ট ছিল না। সবকিছু ছিল স্বতঃস্ফুর্ত ও বিশৃঙ্খল। লোকজনকে তাদের সম্পূর্ণ আবেগের ভেতর দিয়ে অগ্রসর হতে এবং এমনকি তাতে জড়িত হতেও দেওয়া হয়েছে। মুষ্টিমেয় কিছু লোকের পক্ষে তা মারাত্মক প্রমাণিত হয়েছে।

তাসত্ত্বেও এডওয়ার্ডস নিশ্চিত ছিলেন যে, জাগরণ ঈশ্বরেরই কাজ ছিল। আমেরিকায় এক নতুন ভোরের সূচনা দেখিয়েছে তা, বিশ্বের বাকি অংশে ছড়িয়ে পড়বে এটা। প্রত্যেক পুনর্জাগরণের মাধ্যমে, এডওয়ার্ডস নিশ্চিত ছিলেন, ক্রিশ্চানরা পৃথিবীর বুকে ঈশ্বরের রাজ্য প্রতিষ্ঠা করবে, সমাজে সত্য ও স্বয়ং ঈশ্বরের ন্যায়বিচারের প্রতিফলন ঘটাবে। জাগরণে রাজনৈতিকভাবে রেডিক্যাল কিছু ছিল না। এডওয়ার্ডস ও হুইটফিল্ড শ্রোতাদের ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে, গণতান্ত্রিক সরকারের পক্ষে প্রচারণা বা সম্পদের সুষম বণ্টনের দাবি তোলার তাগিদ দিতে যাননি; তবে এই অভিজ্ঞতা আমেরিকান বিপ্লবের পথ তৈরিতে সাহায্য করেছে। পরমান্দময় অভিজ্ঞতা বিপ্লবী নেতাদের ডেইস্ট আলোকন আদর্শের সাথে নিজেদের সম্পর্কিত করতে পারবে না এমন বহু আমেরিকানকে এক ধরনের স্বাধীনতার আনন্দময় স্মৃতির অনুভূতি যুগিয়েছে। ‘মুক্তি’ শব্দটি দীক্ষা ও স্বাভাবিক জীবনের ব্যথা ও বেদনা থেকে মুক্তির আনন্দ বোঝাতে ব্যাপক ব্যবহৃত হয়েছে। হুইটফিল্ড ও এডওয়ার্ডস, উভয়ই যাঁর যাঁর সমাবেশকে যারা পুনর্জন্ম লাভ করেনি এবং উন্মত্ততাকে যুক্তিবাদী নিরাসক্ততার সাথে দেখেছে সেই অভিজাত গোষ্ঠীর চেয়ে তাদের পরমানন্দময় বিশ্বাসকে উঁচু মানের ভাবতে উৎসাহিত করেছেন। পুনর্জাগরণের নিন্দাকারী যাজকদের ঔদ্ধত্যের কথা যাদের মনে ছিল তাদের অনেকেই বহু আমেরিকান কালভিনিস্টের ক্রিশ্চান অভিজ্ঞতায় পরিণত হওয়া প্রাতিষ্ঠানিক কর্তৃপক্ষের প্রতি দারুণ অবিশ্বাস গড়ে তুলেছিল। জাগরণ আমেরিকার ইতিহাসে প্রথম গণআন্দোলন ছিল। সাধারণ লোকজনকে দুনিয়াবিদারী ঘটনাপ্রবাহে অংশ গ্রহণের হঠকারী অভিজ্ঞতার সুযোগ করে দিয়েছিল যা ইতিহাসের ধারা পাল্টে দেবে বলে বিশ্বাস করেছিল তারা।

কিন্তু জাগরণ উপনিবিশের কালভিনিস্ট গোষ্ঠীগুলোকেও সরাসরি দ্বিধা বিভক্ত করে দিয়েছিল। বস্টন যাজক জনাথান মেহিউ (১৭২০-৬০) ও চার্লস চন্সি (১৭০৫-৮৭)-এর মতো ওল্ড লাইটস নামে পরিচিত হয়ে ওঠা ব্যক্তিগণ বিশ্বাস করতেন ক্রিশ্চান ধর্মকে যৌক্তিক, আলোকিত ধর্মবিশ্বাস হতে হবে পুনর্জাগরণবাদীদের উন্মত্ততায় ভীত হয়ে উঠেছিলেন তাঁরা, তাদের বুদ্ধিবৃত্তি বিরোধী পক্ষপাতিত্বের প্রতি সন্দিহান ছিলেন।৪২ ‘ওল্ড লাইটস’দের সমাজের অধিকতর সমৃদ্ধ অংশ থেকে আসার প্রবণতা ছিল, অন্যদিকে নিচু শ্রেণীর লোকজন দলত্যাগী নিউ লাইট চার্চের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল। ১৭৪০-এর দশকে দুই শোরও বেশি সমাবেশ বর্তমান গোষ্ঠী ত্যাগ করে নিজস্ব চার্চ প্রতিষ্ঠা করেছিল।৪৩ ১৭৪১ সালে প্রেসবিটারিয়ান নিউ লাইট প্রেসবিটারিয়ান সিনদ থেকে বের হয়ে গিয়ে যাজকদের প্রশিক্ষণের লক্ষ্যে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রিন্সটনের নিউ জার্সিতে নাসান হলে নিজস্ব কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছিল। পরে ভাঙন জোড়া লাগলেও মধ্যবর্তী সময়ে নিউ লাইটস একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয় লাভ করে নিয়েছিল যা উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে মৌলবাদী আন্দোলনের আবির্ভাবের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।

মহাজাগরণ সবাইকে টলিয়ে দিয়েছিল। এর পর থেকে এমনকি ওল্ড লাইটস ও চলমান ঘটনাপ্রবাহে প্রলয়বাদী তাৎপর্য আরোপ করতে তৈরি ছিল। ১৭৫৫ সালের নভেম্বরে যুগপৎভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে কয়েকটি ভূমিকম্পের ঘটনা ঘটলে জোনাথান মেহিউ বিশ্বাস করেছিলেন যে, ‘মহান বিপ্লব আসন্ন,’; ‘বিশ্বের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক অবস্থায় লক্ষযোগ্য পরিবর্তনের’৪৪ অপেক্ষায় ছিলেন তিনি। সহজাত প্রবৃত্তির বশেই মেহিউ সাত বছর মেয়াদী যুদ্ধের সময় প্রটেস্ট্যান্ট ব্রিটেন ও ক্যাথলিক ফ্রান্সের আমেরিকায় উপনিবেশের অধিকার নিয়ে সাম্রাজ্যবাদী সংঘাতকে পারলৌকিক দৃষ্টিতে দেখেছিলেন। তিনি বিশ্বাস করেছেন, এর ফলে অ্যান্টিক্রাইস্ট শেষ যুগের মহাভণ্ড পোপের ক্ষমতা হ্রাসের ভেতর দিয়ে ক্রাইস্টের দ্বিতীয় আগমন ত্বরান্বিত হবে।৫ সাত বছর মেয়াদী যুদ্ধে নিউ লাইটস অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে মহাজাগতিক লড়াইয়ে আমেরিকাকে সামনের কাতারে লড়াই করতে দেখেছে। মোটামুটি এই সময়ে পোপ দিবস (নভেম্বর ৫) ছুটির দিনে পরিণত হয়, তখন উচ্ছৃঙ্খল জনতা পান্টিফের অফিস পুড়িয়ে দিয়েছিল।৪৬ ভীতিকর ও সহিংস সময় ছিল এটা। আমেরিকানরা তখনও জীবনকে অর্থ যোগাতে ও তাদের উপর নেমে আসা ট্র্যাজিডির ব্যাখ্যা করতে প্রাচীন মিথলজির শরণাপন্ন হচ্ছিল। তবে যেন আসন্ন পরিবর্তনেরও আলামত টের পাচ্ছিল তারা। সেকারণে ফ্রান্স ও রোমান ক্যাথলিক চার্চকে ন্যায়নিষ্ঠ আমেরিকান রীতিনীতির প্রতি শয়তানি ও ভীষণভাবে বৈরী বিবেচনা করে ঘৃণার ধর্ম গড়ে তুলেছিল।৪৭ এইসব প্রলয়বাদী ফ্যান্টাসির বিকাশ ঘটানোর সময় তারা যেন বুঝতে শুরু করেছিল যে, যতক্ষণ না সম্পত্তির বিনাশ সাধন করা হচ্ছে ততক্ষণ আসলে কোনও নিষ্কৃতি, চূড়ান্ত নাজাত বা স্বাধীনতা ও মিলেনিয়াল শান্তি আসছে না। নতুন এই বিশ্বকে অস্তিত্ব দিতে হলে রক্তাক্ত শুদ্ধিকরণের প্রয়োজন হবে। আমরা দেখব যে, উদীয়মান আধুনিকতার প্রতি সাড়া হিসাবে প্রায়শঃই ক্রোধের ধর্মতত্ত্ব মাথা চাড়া দিয়ে উঠবে। আমেরিকানরা বুঝতে পেরেছিল, পরিবর্তন অত্যাসন্ন, কিন্তু তখনও প্রাচীন বিশ্বে বাস করছিল তারা। সাত বছর মেয়াদী যুদ্ধের অর্থনৈতিক প্রভাব ব্রিটিশ সরকারকে আমেরিকান উপনিবেশগুলোর উপর নতুন করভার চাপাতে বাধ্য করে। বিপ্লবাত্মক সঙ্কট উস্কে দেয় তা যা ১৭৭৫ সালে আমেরিকান স্বাধীনতা যুদ্ধে পর্যবসিত হয়। প্রলম্বিত এই যুদ্ধের সময় আমেরিকানরা আধুনিক রীতির ক্ষেত্রে কেন্দ্রিয় উপাদান অতীতের সাথে চরম বিচ্ছেদের সেই বেদনাদায়ক প্রক্রিয়ার সূচনা ঘটিয়েছিল, তাদের ঘৃণার ধর্ম এই বিকাশে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করবে।

বিপ্লবের নেতৃবৃন্দ-যেমন, জর্জ ওয়াশিংটন, জন ও স্যামুয়েল অ্যাডামস, টমাস জেফারসন এবং বেঞ্জামিন ফ্রাংকলিন-বিপ্লবকে সেক্যুলার ঘটনা হিসাবে প্রত্যক্ষ করেছেন। তাঁরা ছিলেন যুক্তিবাদী, আলোকনের পুরুষ, জন লক, স্কটিশ কমনসেন্স দর্শন বা রেডিক্যাল উইং আদর্শের মতো আধুনিক আদর্শে অনুপ্রাণিত। ডেইস্ট হওয়ায় প্রত্যাদেশ ও ক্রাইস্টের ঐশ্বরিকতার ব্যাপারে অধিকতর অর্থডক্স ক্রিশ্চানদের চেয়ে দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে আলাদা। সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে সংযমী, বিচক্ষণ লড়াই পরিচালনা করছিলেন তাঁরা, ধীরে অনীহার সাথে বিপ্লবের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন। নিজেদের অবশ্যই অ্যান্টিক্রাইস্টের বিশাল বাহিনীর বিরুদ্ধে মহাজাগতিক সংঘাতে লিপ্ত ভাবেননি। ব্রিটেনের সাথে বিচ্ছিন্নতা অনিবার্য হয়ে উঠলে, তাঁদের লক্ষ্য বাস্তব ভিত্তিক ও আঞ্চলিক উদ্দেশ্যে সীমিত ছিল: ‘সম্মিলিত উপনিবেশগুলো অধিকার বলে মুক্ত ও স্বাধীন রাষ্ট্র হবে।’ জন অ্যাডামস ও ফ্রাংকলিনের সাথে জেফারসন কর্তৃক খসড়া করা স্বাধীনতার ঘোষণা ৪ঠা জুলাই ১৭৭৬ তারিখে কলোনিয়াল কংগ্রেসে গৃহীত হয়, এটা ছিল লক-প্রচারিত স্ব- প্রকাশিত মানব অধিকারের আদর্শভিত্তিক একটি আলোকন দলিল। এইসব অধিকারকে ‘জীবন, মুক্তি ও সুখের সন্ধান’ হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। এই ঘোষণা প্রকৃতির ডেইস্ট ঈশ্বরের নামে স্বাধীনতা, স্বায়ত্তশাসন ও সাম্যের আধুনিক আদর্শের প্রতি আবেদন রেখেছে। অবশ্য রাজনৈতিকভাবে রেডিক্যাল ছিল না এই ঘোষণা। এখানে সমাজের সম্পদের পুনর্বণ্টনের বা মিলেনিয়াল ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার কোনও ইউটোপিয় কথাবার্তার স্থান ছিল না। এটা ছিল সুদূর প্রসারী স্থিতিশীল কর্মপরিকল্পনা তুলে ধরা বাস্তব, যৌক্তিক লোগোস।

কিন্তু আমেরিকান প্রজাতন্ত্রের ফাউন্ডিং ফাদারগণ ছিলেন অভিজাত গোষ্ঠীর অংশ, তাঁদের ধারণা মামুলি ধরনের ছিল না। সংখ্যাগরিষ্ঠ আমেরিকানরা কালভিনিস্ট ছিল, তারা এই যৌক্তিক রীতির সাথে তাল মিলিয়ে উঠতে পারেনি। প্রকৃতপক্ষেই, তাদের অনেকেই ডেইজমকে শয়তানি আদর্শ মনে করেছে। ৮ প্রাথমিকভাবে অধিকাংশ উপনিবেশবাসী ঠিক তাদের নেতাদের মতোই ব্রিটেনের সাথে সম্পর্কচ্যুতিতে অনীহ ছিল। সবাই বিপ্লবী সংগ্রামে যোগ দেয়নি। প্রায় ৩০,০০০ এর মতো ব্রিটিশের পক্ষে যুদ্ধ করেছে এবং যুদ্ধের পর ৮০,০০০ থেকে ১০০,০০০-এর মতো নতুন রাষ্ট্র ছেড়ে কানাডা, ওয়েস্ট ইন্ডিজ বা ব্রিটেনে চলে গেছে।৪৯ স্বাধীনতার জন্যে যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যারা, তারা একদিকে যেমন প্রাচীন মিথ ও ক্রিশ্চান ধর্মের মিলেনিয়াল স্বপ্নে প্রণোদিত হয়েছিল তেমনি ফাউন্ডারদের সেক্যুলারিস্ট আদর্শেও অনুপ্রাণিত ছিল। আসলে ধর্মকে রাজনৈতিক ডিসকোর্স থেকে আলাদা করা ছিল কঠিন। সেক্যুলারিস্ট ও ধর্মীয় আদর্শ সৃজনশীলভাবে মিশে গিয়ে আমেরিকার জন্যে নানামুখী আশার ধারক উপনিবেশবাসীদের ইংল্যান্ডের সাম্রাজ্যবাদী মহাশক্তি বিরোধী শক্তিতে যোগ দিতে সক্ষম করে তুলেছে। আমরা ইরানের ইসলামি বিপ্লবে (১৯৭৮-৭৯) একই ধরনের ধর্মীয় ও সেক্যুলারিস্ট মৈত্রী গড়ে উঠতে দেখব, এটাও সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে স্বাধীনতার ঘোষণা ছিল।

বিপ্লবী সংগামের প্রথম দশকে সাধারণ লোক অতীতের সাথে রেডিক্যাল বিচ্ছেদ ঘটানো ঘৃণা করছিল। ব্রিটেনের সাথে সম্পর্কচ্যুতি অচিন্তনীয় মনে হয়েছে। অনেকেই আশা করেছিল যে ব্রিটিশ সরকার তাদের নীতির পরিবর্তন ঘটাবে। কেউই উত্তেজনার সাথে ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে ছিল না বা এক নতুন বিশ্বব্যবস্থার স্বপ্ন দেখছিল না। বেশির ভাগ আমেরিকান তখনও সহজাতভাবে প্রাচীন প্রাক আধুনিক কায়দায় সংকটের প্রতি সাড়া দিচ্ছিল: নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতে এক আদর্শ অতীতের শরণাপন্ন হচ্ছিল তারা। বিপ্লবী নেতৃবৃন্দ ও যাঁরা আরও সেক্যুলার রেডিক্যাল হুইগ আদর্শ গ্রহণ করেছিলেন তাঁরা ১০৬৬ সালে আগ্রাসী নরমানদের বিরুদ্ধে সাক্সনদের সংগ্রাম বা ইংরেজদের গৃহযুদ্ধকালীন পিউরিটান পার্লামেন্টারিয়ানদের সাম্প্রতিক সংগ্রাম থেকে অনুপ্রেরণা গ্রহণ করেছিলেন। কালভিনিস্টরা নিউ ইংল্যান্ডে পুরোনো ইংল্যান্ডে স্বৈরাচারী অ্যাংলিকান প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে পিউরিটান সংগ্রামের কথা স্মরণ করে তাদের সোনালি অতীতের শরণাপন্ন হয়েছে; আমেরিকার বুনো এলাকায় একটি ধর্মনিষ্ঠ সমাজ গড়ে তোলার ভেতর দিয়ে নতুন বিশ্বে নির্যাতন থেকে মুক্তি ও স্বাধীনতার সন্ধান করেছিল তারা। এই সময়ের (১৭৬৩-৭৩) সারমন ও বিপ্লবী বক্তৃতা-বিবৃতি অতীতের নাজুক সাফল্যকে ধরে রাখার উপর গুরুত্ব দিয়েছে। রেডিক্যাল পরিবর্তনের চিন্তা অবনতি ও ধ্বংসের ভীতি জাগিয়ে তুলেছে। পুরোনো রক্ষণশীল চেতনা অনুযায়ী উপনিবেশবাসীরা ঐতিহ্য রক্ষা করতে চেয়েছিল। অতীতকে খুবই সহজ সরল হিসাবে তুলে ধরা হয়েছে, ভবিষ্যৎকে উৎসগতভাবে ভীতিকর। বিপ্লবী নেতৃবৃন্দ ঘোষণা করেছিলেন যে, ট্র্যাডিশন থেকে প্রবলভাবে বিচ্ছিন্ন হলে অনিবার্যভাবে আবির্ভূত বিপর্যয়কে ঠেকানোর জন্যেই তাঁদের কর্মপরিকল্পনার নকশা করা হয়েছে। বাইবেলের প্রলয়বাদী ভাষা ব্যবহার করে ভীতির সাথে ব্রিটিশ নীতিমালার সম্ভাব্য পরিণতির কথা বলেছেন তাঁরা।°

তবে এর পরিবর্তন ঘটেছিল। ব্রিটিশরা নাছোড়বান্দার মতো সাম্রাজ্যবাদী নীতিমালা আঁকড়ে থাকলে উনিবেশবাসীরা তাদের নৌকা পুড়িয়ে দিয়েছিল। বস্টন টি পার্টি (১৭৭৩) ও লুক্সমবার্গ এবং কনকর্ডের যুদ্ধের (১৭৭১) পর আর পেছনে যাবার উপায় ছিল না। স্বাধীনতার ঘোষণা প্রাচীন ব্যবস্থার সাথে সম্পর্ক চ্যুতি ঘটিয়ে এক নজীরবিহীন ভবিষ্যতের পথে যাত্রা শুরুর সাহসী প্রতিজ্ঞা প্রকাশ করেছে। এই দিক থেকে ঘোষণাটি ছিল আধুনিকায়নের দলিল, রাজনৈতিক পরিভাষায় ইউরোপে বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের বৈশিষ্ট্য বুদ্ধিবৃত্তিক স্বাধীনতা ও প্রতিমাবিরোধিতাকে প্রকাশ করেছে। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ উপনিবেশবাসী জন লকের চেয়ে বরং ক্রিশ্চান ভবিষ্যদ্বাণীর বিভিন্ন মিথে বেশি অনুপ্রাণিত ছিল। পরিচিত, তাদের গভীরতর বিশ্বাসের সাথে অনুরণিত এবং এই কঠিন যাত্রাকে সফল করে তোলা মনস্তাত্ত্বিক শক্তি খুঁজে পেতে সক্ষম করে তোলা পৌরাণিক মোড়কে আধুনিক রাজনৈতিক স্বায়ত্তশাসনের দিকে চালিত হওয়ার প্রয়োজন ছিল তাদের। আমরা যেমন প্রায়শঃই আবিষ্কার করব, ধর্ম প্রায়শঃই আধুনিকতার বেদনাদায়ক অভিযাত্রায় প্রয়োজনীয় উপকরণ যোগান দেয়।

এভাবে মুলধারার চার্চের বহু যাজক (এমনকি অ্যাংলিকানরাও স্যাম অ্যাডামসের মতো জনপ্রিয় নেতাদের বিপ্লবী বাগাড়ম্বরকে ক্রিশ্চান রূপ দিয়েছেন। তাঁরা সরকারে সদগুণ ও দায়িত্বের গুরুত্বের কথা বলার সময় ব্রিটিশ কর্মকর্তাদের দুনীতির বিরুদ্ধে অ্যাডামসের জ্বালাময়ী প্রত্যাখ্যান অর্থপূর্ণ হয়ে উঠত। ১ মহাজাগরণের আগেই নিউ লাইটস কালভিনিস্টদের প্রতিষ্ঠানের প্রতি সতর্ক এবং পরিবর্তন সাধনের ক্ষেত্রে নিজেদের ক্ষমতায় আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছিল। বিপ্লবী নেতারা ‘স্বাধীনতা’র কথা বলার সময় এমন পরিভাষা ব্যবহার করতেন যেটা আগেই ধর্মীয় অর্থে সম্পৃক্ত ছিল: এটা মহত্ম, গস্পেলের স্বাধীনতা ও ঈশ্বর পুত্রের সমাবেশ ধারণ করত। এটা ঈশ্বরের রাজ্যের মতো, যেখানে সকল নিপীড়নের অবসান ঘটবে, এবং মনোনীত জাতির মিথ, যারা বিশ্বের পবির্তনের বেলায় ঈশ্বরের অস্ত্রে পরিণত হবে, এমনি সব ধারণার সাথে সম্পর্কিত ছিল।৫২ ইয়েল ইউনির্ভার্সিটর প্রেসিডেন্ট টিমোথি ডিউইট (১৭৫২-১৮১৭) সোৎসাহে ‘ইম্যানুয়েল ল্যান্ডে’র আগমন ঘোষণাকারী বিপ্লব ও আমেরিকার ‘সেই নতুন, সেই বিচিত্র রাজ্যের প্রধান ঘাঁটি হওয়ার’ কথা বলতেন যা ‘পরম ঈশ্বরের সাধুদের প্রদান করা হবে।’৫৩ ১৭৭৫ সালে কানেক্টিকাটের যাজক ইবেনেযার বল্ডউইন জোর দিয়ে বলেছিলেন, যুদ্ধের বিপর্যয়ই কেবল ঈশ্বরের নতুন বিশ্বের পরিকল্পনাকে তরান্বিত করতে পারে। জেসাস আমেরিকায় মহান রাজ্যের গোড়াপত্তন করবেন: স্বাধীনতা, ধর্ম ও শিক্ষাকে ইউরোপ থেকে বিতাড়িত করা হয়েছে, আটলন্টিক পাড়ি দিয়ে সেসব পশ্চিমে যাত্রা করেছে। বর্তমান সঙ্কট বর্তমান দুনীতিগ্রস্ত ব্যবস্থার শেষ দিনের জন্যে পথ তৈরি করে দিচ্ছে। ফিলাদেলফিয়ার প্রোভোস্ট উইলিয়াম স্মিথের চোখে উপনিবেশবাসীরা ছিল ‘মুক্তি, শিল্পকলা ও স্বর্গীয় জ্ঞানের’৫৪ ঈশ্বর মনোনীত স্থান।

কিন্তু চার্চের লোকেরা রাজনীতিকে সেক্যুলারাইজ করে থাকলেও সেক্যুলার নেতৃবৃন্দ ক্রিশ্চান ইউটোপিয়বাদের ভাষা ব্যবহার করেছেন। জন অ্যাডামস আমেরিকার বসতিকে গোটা মানবজাতির আলোকনের জন্যে ঈশ্বরের পরিকল্পনা মনে করেছেন।৫৫ টমাস পেইন নিশ্চিত ছিলেন যে, ‘পৃথিবীর নতুন করে শুরু করার মতো ক্ষমতা আমাদের আছে। সেই নোয়াহর আমল থেকে এই পর্যন্ত এমন পরিস্থিতি আর সৃষ্টি হয়নি। নতুন বিশ্বের জন্মলগ্ন এলো বলে।৫৬ কেবল নেতৃবৃন্দের প্রয়োগবাদ সাধারণ লোকজনকে অজানা ভবিষ্যতের পথে যাত্রা ও মাতৃভূমির সাথে সম্পর্কচ্ছেদে সাহায্য করতে পারেনি। ক্রিশ্চান পরকালতত্ত্বের উৎসাহ, ইমেজারি ও মিথলজি বিপ্লবী সংগ্রামে অর্থ যুগিয়েছে ও সেক্যুলারিস্ট ও কালভিনিস্টদের ট্র্যাডিশনের সাথে চূড়ান্ত স্থানচ্যুতকারী বিচ্ছেদ ঘটাতে সমানভাবে সাহায্য করেছে।

সাত বছর মেয়াদী যুদ্ধের সময় বিস্ফোরিত ঘৃণাও একই কাজ করেছে। মোটামুটি একই ভাষায় ইরানিরা ইসলামি বিপ্লবের সময় আমেরিকাকে যেভাবে ‘মহাশয়তান’ আখ্যায়িত করেছে বিপ্লবী সংকটকালে ঠিক সেভাবেই ব্রিটিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে শয়তানের সাথে হাত মেলানোর অভিযোগ তোলা হয়েছিল। কুখ্যাত স্ট্যাম্প অ্যাক্ট পাশ হওয়ার পর দেশাত্মবোধক কবিতা ও গানে এর প্রবক্তা লর্ডস বুট, গ্রেনভিল ও নর্থকে আমেরিকানদের শয়তানের চিরন্তন রাজ্যে প্রলুব্ধ করার ষড়যন্ত্রকারী শয়তানের চ্যালা হিসাবে তুলে ধরেছিল। স্ট্যাম্পকে ‘পশুর চিহ্ন’ হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে, বুক অভ রেভেলেশন অনুযায়ী যা শেষ দিবসে সাজাপ্রাপ্তদের উপর খোদাই করা হবে। রাজনৈতিক মিছিলে শয়তানের ছবির পাশে ব্রিটিশ মন্ত্রীদের কুশপুত্তলিকা বহন করা হয় আর গোটা উপনিবেশ জুড়ে ‘স্বাধীনতা বৃক্ষে’ ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। ১৭৭৪ সালে রাজা তৃতীয় জর্জ সাত বছর মেয়াদী যুদ্ধের সময় ইংল্যান্ডের অধিকৃত কানাডিয় এলাকার ফরাসি ক্যাথলিকদের ধর্মীয় স্বাধীনতা দান করলে তাঁকে অ্যন্টিক্রাইস্টের সাথে সম্পর্কিত করা হয়। এবার তাঁর ছবিও পাপাল অ্যান্টিক্রাইস্ট ও শয়তানের সাথে স্বাধীনতা বৃক্ষে শোভা পেতে থাকে।৫৮ এমনকি অধিকতর শিক্ষিত উপনিবেশবাসীরা এই গোপন মহাজাগতিক ষড়যন্ত্রের ভীতিতে আক্রান্ত হয়েছিল। হার্ভার্ড ও ইয়েলের প্রেসিডেন্টদ্বয় বিশ্বাস করতেন যে, উপনিবেশগুলো শয়তানি শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করছে; ‘স্বেচ্ছাচারী শক্তির পছন্দনীয় ধর্ম’ পাপাসির আসন্ন পরাজয়ের অপেক্ষা করেছেন তাঁরা। পাপাল অ্যান্টিক্রাইস্টকে ধ্বংস করার লক্ষ্যে ঈশ্বরের বিধানকৃত পরিকল্পনার অংশে পরিণত হয়েছিল স্বাধীনতা যুদ্ধ, নিশ্চিতভাবেই যা আমেরিকায় ঈশ্বরের মিলেনিয়াল রাজ্যের আবির্ভাব ঘোষণা করবে। ব্যাপক বিস্তৃত এই ভ্রমাত্মক দৃষ্টিভঙ্গি ও সাধারণ রাজনৈতিক বিরোধকে শুভ ও অশুভ শক্তির মহাজাগতিক সংঘাত হিসাবে দেখার প্রবণতা দুর্ভাগ্যক্রমে মানুষ নুতন বিশ্বে পা রাখতে গিয়ে বিপ্লবী সংগ্রামে অংশ গ্রহণ করার সময় প্রায়শঃই ঘটে। এই শয়তানি মিথলজি উপনিবেশবাসীদের প্রাচীন বিশ্ব থেকে নিশ্চিতভাবে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে নিতে সাহায্য করেছে, যার প্রতি তখন ও তাদের একটা জোরাল দুর্বলতার অবশেষ রয়ে গিয়েছিল। ইংল্যান্ডকে দানবায়িতকরণ, একে প্রতিপক্ষমূলক ‘অপর’, আমেরিকার বিপরীত মেরুতে পরিণত করে উপনিবেশবাসীদের নিজেদের জন্যে একটা স্পষ্ট পরিচয় গড়ে তুলতে সক্ষম করে তুলেছে এবং যে নতুন ব্যবস্থাকে বাস্তব রূপ দিতে তারা যুদ্ধ করছিল তাকে ভাষা দিতে সাহায্য করেছে।

এভাবে ধর্ম প্রথম আধুনিক সেক্যুলার প্রজাতন্ত্রের পত্তনে মুল ভুমিকা পালন করেছে। বিপ্লবের পর অবশ্য, সদ্য স্বাধীন রাজ্যসমূহ তাদের সংবিধান প্রণয়ন করার সময় ঈশ্বরের নাম সেখানে নেহাতই দায়সারাভাবে উল্লেখ করা হয়। ১৭৮৬ সালে টমাস জেফারসন ভার্জিনিয়ার অ্যাংলিকান চার্চ ভেঙে দেন; তাঁর বিলে ঘোষণা করা হয় যে, ধর্মের ব্যাপারে নিপীড়ন ‘পাপপূর্ণ ও স্বেচ্ছাচারমূলক,’ জনগণকে তাদের নিজস্ব মতামত ধারণ করতে দিলে সত্য বিজয়ী হবে এবং ধর্ম ও রাজনীতির ভেতর একটা ‘বিচ্ছিন্নতার দেয়াল থাকবে’। এই বিলে ভার্জিনিয়ার ব্যাপ্টিস্ট, মেথডিস্ট ও প্রেসবিটারিয়ান চার্চ সমর্থন দেয়, রাষ্ট্রে চার্চ অভ ইংল্যান্ডের সুবিধাজনক অবস্থানে অসন্তুষ্ট ছিল এরা। পরে অন্যান্য রাজ্য ভার্জিনিয়াকে অনুসরণ করে তাদের নিজস্ব চার্চগুলো ভেঙে দেয়, ১৮৩৩ সালে ম্যাসাচুসেটস সবার শেষে এ কাজটি করে। ১৭৮৭ সালে ফিলাদেলফিয়া সম্মেলনে ফেডারেল সংবিধান গৃহীত হলে সেখানে ঈশ্বরের কোনও উল্লেখই ছিল না; সংবিধানের প্রথম সংশোধনী বিল অভ রাইটস (১৭৮৯) আনুষ্ঠানিকভাবে ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন করে: ‘কংগ্রেস ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের প্রতি সম্মান দেখিয়ে কোনও আইন প্রণয়ন করবে না বা এর স্বাধীন চর্চায় বাধাও দেবে না। এর পর থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ধর্মবিশ্বাস একটি ব্যক্তিগত স্বেচ্ছাকৃত বিষয়ে পরিণত হবে। বিপ্লবী পদক্ষেপ ছিল এটা, যুক্তির কালের অন্যতম সাফল্য হিসাবে তা প্রশংসিত হয়েছে। এর পেছনের ভাবনাচিন্তা অবশ্যই আলোকনের সহিষ্ণু দর্শনে অনুপ্রাণিত ছিল, কিন্তু ফাউন্ডিং ফাদারগণ আবার অধিকতর বাস্তব বিবেচনায়ও আলোড়িত হয়েছেন। তাঁরা জানতেন, রাজ্যসমূহের ঐক্য ধরে রাখতে ফেডারেল সংবিধান খুবই জরুরি, তবে তাঁরা এও বুঝতে পেরেছিলেন যে, সরকার কোনও একটি বিশেষ প্রটেস্ট্যান্ট গোষ্ঠী প্রতিষ্ঠা করে তাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রধর্মে পরিণত করলে সংবিধান অনুমোদন পাবে না। উদাহরণ স্বরূপ, কংগ্রেশনাল ম্যাসাচুসেটস কোনওদিনই অ্যাংলিকান চার্চ প্রতিষ্ঠাকারী সংবিধানে সম্মতি দেবে না। এটাও সংবিধানের ধারা-৬; উপধারা-৩- এর মাধ্যমে ফেডারেল সরকারের অফিসে নিয়োগের ক্ষেত্রে ধর্মীয় পরীক্ষা বাতিল করার কারণ। ধর্মকে আসনচ্যুত ও রাজনীতিকে সেকুলার করার ব্যাপারে ফাউন্ডার ফাদারদের সিদ্ধান্তে আদর্শ ছিল, কিন্তু নতুন জাতি কোনও একটি উপদলীয় গোষ্ঠীর উপর ভিত্তি করে পরিচয় নির্ধারণ করে বাকি সব প্রজার আনুগত্য ধরে রাখতে পারত না। আধুনিক রাষ্ট্রের প্রয়োজন একে সহিষ্ণু এবং সেই সুবাদে সেক্যুলার হওয়ার দাবি করেছে।৬১

অবশ্য বৈপরীত্যমূলকভাবে উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি নতুন সেক্যুলারিস্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রবলভাবে ক্রিশ্চান রাষ্ট্রে পরিণত হয়। ১৭৮০-র দশক এবং ১৭৯০-র দশকে আরও বেশি করে সমস্ত চার্চ নতুন সমৃদ্ধির অভিজ্ঞতা লাভ করে ও ফাউন্ডিং ফাদারদের আলোকন আদর্শকে চ্যালেঞ্জ করতে শুরু করে। এবার আমেরিকান স্বাধীনতাকে পবিত্র করণ করে তারা: নতুন প্রজাতন্ত্রকে ঈশ্বরের সাফল্য বলে যুক্তি দেখায় তারা। বিপ্লবী লড়াই স্বর্গের বিরুদ্ধে নরকের আদর্শ ছিল কেবল প্রাচীন ইসরায়েলই ইতিহাসে এমন প্রত্যক্ষ স্বর্গীয় হস্তক্ষেপের অভিজ্ঞতা লাভ করেছিল। সংবিধানে ঈশ্বরের নাম উল্লেখ না হয়ে থাকতে পারে, তীর্যক ভাষায় উল্লেখ করেছেন টিমোথি ডিউইট, কিন্তু ছাত্রদের তাগিদ দিয়েছেন, ‘তোমাদের দেশের ইতিহাসের দিকে তাকাও [তাহলেই]…মিশরে ইসরায়েল জাতিকে দেখানো স্বর্গীয় প্রতিরক্ষা ও নিস্তারের তুলনায় কম মহান ও বিস্ময়কর প্রমাণ দেখবে না।’৬৪ যাজকগোষ্ঠী আত্মবিশ্বাসের সাথে ঘোষণা করেছিল, আমেরিকার জনগণ আরও ধার্মিক হয়ে উঠবে; সীমানার বিস্তারকে রাজ্যের আগমনের আভাস হিসাবে দেখেছে তারা। গণতন্ত্র মানুষকে সার্বভৌম করে তুলেছিল, সুতরাং নতুন রাজ্যসমূহকে জনপ্রিয় শাসনের সহজাত বিপদ থেকে রক্ষা পেতে হলে তাদের আরও ধার্মিক হয়ে উঠতে হবে। আমেরিকান জনগণকে অবশ্যই রাজনৈতিক নেতাদের অধার্মিক ‘ডেইজম’ থেকে রক্ষা করতে হবে। চার্চের লোকেরা ‘ডেইজম’কে শয়তানি শত্রু হিসাবে দেখেছে, শিশুরাষ্ট্রের সব ধরনের ব্যর্থতার দায় এর উপর চাপিয়ে দিতে চেয়েছে। ডেইজম, জোরের সাথে বলেছেন তারা, নাস্তিক্যবাদ ও বস্তুবাদের বিকাশ ঘটাবে; জেসাস ক্রাইস্টের বদলে এটা প্রকৃতি ও যুক্তির পুজা করেছে। “বাভারিয়ান ইল্লিউমিনাতি’ নামে এক রহস্যময় গুপ্ত সংগঠন থেকে ষড়যন্ত্রের ভীতির বিভ্রম বিকাশ লাভ করে; এরা নাস্তিক ও ফ্রিম্যাসন ছিল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ক্রিশ্চান ধর্মকে বিতাড়িত করার প্রয়াস পাচ্ছিল। ১৮০০ সালে টমাস জেফারসন প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সময় দ্বিতীয়বারের মতো অ্যান্টিডেইস্ট আন্দোলন হয়, এই আন্দোলন জেফারসন ও ঈশ্বরবিহীন ফরাসী বিপ্লবের নাস্তিক্যবাদী ‘জ্যাকোবিনদের’ ভেতর একটা সম্পর্ক আবিষ্কারের চেষ্টা করেছে।

নতুন রাজ্যসমূহের ঐক্য ভঙ্গুর অবস্থায় ছিল। আমেরিকানরা-সেক্যুলারিস্ট ও প্রটেস্ট্যান্ট-উভয়ই নতুন জাতির জন্যে সম্পূর্ণ ভিন্ন ভিন্ন আশা লালন করেছিল। দুটোই সমানভাবে স্থায়ী প্রমাণিত হয়েছিল। আমেরিকানরা তখনও তাদের সংবিধানকে সম্মান ও ফাউন্ডিং ফাদারদের শ্রদ্ধা করছিল, কিন্তু আমেরিকাকে ‘ঈশ্বরের নিজ রাষ্ট্র’ হিসাবেও দেখেছে তারা; আমরা যেমন দেখব, কোনও কোনও প্রটেস্ট্যান্ট ‘সেক্যুলার মানবতাবাদ’কে প্রায় শয়তানি ধরনের অশুভ বিবেচনা করা অব্যাহত রাখবে। বিপ্লবের পর জাতি তিক্তভাবে বিভক্ত ছিল। সংস্কৃতি কী হওয়া উচিত সেই সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে আমেরিকানদের অভ্যন্তরীণ বিবাদে জাড়িয়ে পড়তে হয়েছিল। কার্যত উনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকের বছরগুলোতে ‘দ্বিতীয় বিপ্লব’ সংঘটিত করেছিল তারা। বহু কষ্ট ও সাহসের সাথে আমেরিকানরা অতীতকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে; একটি পরিবর্তনকারী সংবিধান রচনা করেছিল তারা, একটি নতুন জাতির জন্ম দিয়েছিল। কিন্তু চাপ, টানাপোড়েন ও বৈপরীত্য জড়িত ছিল তাতে। জনগণ তখনও ঠিক করে উঠতে পারছিল না কোনও শর্তে তারা আধুনিক বিশ্বে প্রবেশ করবে, কম সুবিধাপ্রাপ্ত উপনিবেশবাসীদের অনেকেই অভিজাত আলোকন গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক আধিপত্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে প্রস্তুত ছিল। ব্রিটিশদের পরাস্ত করার পর তখনও সাধারণ আমেরিকানদের বিপ্লব কী অর্থ বহন করে সেই সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রয়োজন ছিল। তাদের কি ফাউন্ডারদের শীতল, মার্জিত যুক্তিবাদ মেনে নিতে হবে নাকি অধিকতর কর্কশ ও বেশি জনপ্রিয় প্রটেস্ট্যান্ট পরিচয় বেছে নেবে?

ফাউন্ডিং ফাদার ও মূলধারার চার্চের যাজকগোষ্ঠী একটি আধুনিক, সেক্যুলার প্রজাতন্ত্র সৃষ্টিতে পরস্পরের সহযোগিতা করেছিলেন, কিন্তু উভয়ই তখনও অনেক গুরুত্বপূর্ণ দিক দিয়ে প্রাচীন রক্ষণশীল বিশ্বের মানুষ ছিলেন। তাঁরা ছিলেন অভিজাত ও সম্ভ্রান্ত গোষ্ঠী। তাঁরা বিশ্বাস করতেন, আলোকিত রাষ্ট্রনায়ক হিসাবে জাতিকে উপর থেকে নেতৃত্ব দান করা তাঁদের দায়িত্ব। নিচ থেকে পরিবর্তন আসার কথা ভাবেননি তাঁরা। তখনও মহান ব্যক্তিদের হাতে ঐতিহাসিক পরিবর্তন সাধিত হওয়ার কথা ভেবেছেন, যাঁরা অতীতের পয়গম্বরদের মতো মানবজাতির পথনির্দেশক হিসাবে কাজ করেন ও ইতিহাস ঘটতে বাধ্য করেন। তারা তখনও বুঝতে পারেননি যে, একটা সমাজ অনেক সময় নৈর্ব্যক্তিক প্রক্রিয়ায়ও সামনে অগ্রসর হতে পারে: পরিবেশগত, অর্থনৈতিক ও সামাজিক শক্তিসমূহ সবচেয়ে কার্যকর নেতাদের পরিকল্পনা ও প্রকল্প বিনাশ করে দিতে পারে।৬৭ ১৭৮০ ও ১৭৯০-র দশকে গণতন্ত্রের প্রকৃতি নিয়ে ঢের আলোচনা হয়েছে। জনগণের কতখানি ক্ষমতা থাকা উচিত? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিতীয় প্রেসিডেন্ট জন অ্যাডামস উচ্ছৃঙ্খল শাসনের দিকে চালিত করতে পারে ও ধনীদের সম্পদ হ্রাস করতে পারে এমন যেকোনও রাজনীতির ব্যাপারে সন্দিহান ছিলেন।৬৮ কিন্তু অধিকতর চরমপন্থী জেফারসনবাদীরা অভিজাত গোষ্ঠী কীভাবে বহুজনের পক্ষে কথা বলতে পারে সেটা জানতে চেয়েছে। অ্যাডামস সরকারের স্বেচ্ছাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছে তারা এবং যুক্তি দেখিয়েছে যে, জনগণের কথা অবশ্যই শুনতে হবে। বিপ্লবের সাফল্য বহু আমেরিকানকে এক ধরনের ক্ষমতায়নের বোধ দিয়েছিল; এটা তাদের দেখিয়ে দিয়েছিল যে প্রতিষ্ঠিত কর্তৃপক্ষ পতনযোগ্য এবং কোনওভাবেই অপরাজেয় নয়। দৈত্যকে আর বোতলে ভরে রাখা সম্ভব ছিল না। জেফারসনপন্থীরা বিশ্বাস করত যে, সাধারণ জনগণেরও ফিলোসফদের প্রচারিত স্বাধীনতা ও স্বায়ত্তশাসন উপভোগ করা উচিত। নতুন পত্রপত্রিকায় ডাক্তার, আইনজীবী, যাজককুল ও অন্যান্য বিশেষজ্ঞদের পরিহাস করা হত। এইসব তথাকথিত ‘বিশেষজ্ঞ’দের যেন কেউ বিশ্বাস না করে। আইন, ওষুধ বিজ্ঞান ও ধর্মের সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানের ব্যাপার সকলের নাগালে থাকা হওয়া উচিত। ৬৯

বিশেষত সীমান্ত এলাকায় এমনি অনুভূতি ছিল জোরাল, যেখানে সাধারণ মানুষ রিপাবলিকান সরকারের হাতে অপদস্থ হয়েছে বলে মনে করেছে। ১৭৯০ দশক নাগাদ মোটামুটি ৪০ শতাংশ আমেরিকান মাত্র তিরিশ বছর আগে শ্বেতাঙ্গ উপনিবেশবাদীদের বসতি স্থাপিত হওয়া এলাকায় বাস করত। সীমান্তবাসীরা শাসক অভিজাত গোষ্ঠীর উপর অসন্তুষ্ট বোধ করছিল, ওদের কষ্টের ভাগিদার ছিল না তারা, কিন্তু ব্রিটিশদের মতোই উচ্চহারে ওদের উপর কর আরোপ করেছে এবং পূর্ব উপকূলীয় আয়েস ও পরিমার্জিত সভ্যতা ছেড়ে আসার কোনও ইচ্ছা ছাড়াই সীমান্ত এলাকার জমিজিরাত বিনিয়োগের জন্যে কিনে নিচ্ছিল। তারা এক নতুন ধরনের যাজকের বক্তব্যে কান পাততে ইচ্ছুক হয়ে উঠেছিল যারা দ্বিতীয় মহাজাগরণ নামে পরিচতি পুনর্জাগরণ উস্কে দিতে সাহায্য করেছে। প্রথমটির চেয়ে রাজনৈতিকভাবে ঢের বেশি চরম ধরনের ছিল এটা। এইসব পয়গম্বর কেবল আত্মাকে রক্ষার প্রশ্নে উদ্বিগ্ন ছিলেন না, বরং এমনভাবে সমাজ ও ধর্মকে রূপ দিতে চেয়েছিলেন যা ফাউন্ডারদের কল্পিত যেকোনও কিছু থেকে ভিন্ন।

নব্য পুনর্জাগরণবাদীরা ইয়েল ও অক্সফোর্ডে পড়াশোনা করা জনাথান এডওয়ার্ডস ও জর্জ হুইটফিল্ডের মতো পণ্ডিত ছিলেন না। একাডেমিয়াকে ঘৃণা করতেন তাঁরা, জোর দিয়ে বলতেন ধর্মতাত্ত্বিক বিশেষজ্ঞদের কাছে নতজানু না হয়ে ক্রিশ্চানদের নিজেদের মতো করে বাইবেল ব্যাখ্যা করার অধিকার আছে। এই পয়গম্বরগণ সংস্কৃত মানুষ ছিলেন না; প্রচারণার সময় তাঁরা সাধারণ মানুষের বোধগম্য ভাষায় কথা বলতেন, প্রায়শঃই জাগতিক রসিকতা আর খিস্তিখেউরের সাথে অঙ্গভঙ্গি করতেন। তাঁদের বয়ান শোভন ও অলঙ্কারিক নয়, বরং শোরগোলময়, উচ্ছৃঙ্খল ও দারুণভাবে আবেগময় ছিল। তাঁরা এক ধরনের জনপ্রিয় কেতায় ক্রিশ্চান ধর্মকে রূপ দিচ্ছিলেন যা কিনা যুক্তির কালের পরিমার্জিত রীতিনীতি থেকে বহু আলোকবর্ষ দূরে। মশাল মিছিল আর জনসভা করেছেন তাঁরা, শহরের বাইরে বিশাল তাঁবু খাঁটিয়েছেন, যাতে পুনর্জাগরণ এক বিশাল ক্যাম্পসাইটের রূপ নিয়েছিল। গস্পেল সঙ্গীতের নতুন ধারা শ্রোতাদের পরমানন্দে পৌছে দিত, ফলে তারা কাঁদত, ভীষণভাবে সামনে পেছনে আন্দোলিত হত আর আনন্দে চিৎকার জুড়ে দিত। ধর্মকে যৌক্তিক রূপ দেওয়ার বদলে পয়গম্বরগণ স্বপ্ন ও দিব্যদর্শন, নিদর্শন ও অলৌকিক ঘটনার উপর নির্ভর করেছেন-আলোকন যুগের বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিকগণ যেসব বিষয়ের নিন্দা করেছেন। তারপরেও জেফারসনপন্থীদের মতো, রক্ষণশীল কায়দায় অতীতকে প্রজ্ঞার আধার হিসাবে দেখতে অস্বীকার গেছেন তাঁরা। আধুনিক ছিলেন তাঁরা। জনগণের প্রাজ্ঞ ট্র্যাডিশনে আটকে থাকা উচিত হবে না। ঈশ্বরপুত্রের স্বাধীনতা রয়েছে তাদের; কাণ্ডজ্ঞানের ভেতর দিয়ে ঐশীগ্রন্থের সাধারণ অর্থের উপর ভিত্তি করে নিজেরাই সত্য জানতে পারবে। অভিজাতগোষ্ঠী, প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষিত যাজকদের বিরুদ্ধে জোট পাকিয়েছেন এই নতুন যাজকগোষ্ঠী। নিউ টেস্টামেন্টের সাম্যবাদী প্রবণতার উপর জোর দিয়েছেন তাঁরা, যেখানে বলা হয়েছে যে ক্রিশ্চান কমনওয়েলথে শেষজন হবে প্রথম ও প্রথমজন শেষ। ঈশ্বর তাঁর অন্তর্দৃষ্টি পাঠিয়েছেন দরিদ্র ও নিরক্ষরদের কাছে: জেসাস ও তাঁর শিষ্যদের কোনও কলেজের ডিগ্রি ছিল না।

ধর্ম ও রাজনীতি ছিল একই দর্শনের দুটি অংশ। ঝাঁকড়া চুল আর ক্ষ্যাপা চকচকে চোখে লরেনসো দাউকে আধুনিক কালের জন দ্য ব্যাপ্টিস্টের মতো লাগত। ঝড়কে তিনি ঈশ্বরের প্রত্যক্ষ কাজ হিসাবে দেখতেন, অন্তর্দৃষ্টির জন্যে স্বপ্ন ও দিব্যদর্শনের উপর নির্ভর করতেন। আবহাওয়ার কোনও পরিবর্তন আসন্ন প্রলয়ের কোনও রকম ‘নিদর্শন’ হয়ে থাকতে পারে; ভবিষ্যৎ বলে দেওয়ার ক্ষমতা থাকার দাবি করেছিলেন তিনি। মোট কথা তাঁকে মনে হত আধুনিকতার নতুন বিশ্বের ঠিক বিপরীত। কিন্তু তারপরেও তিনি জেফারসন বা টমাস পেইনের উদ্ধৃতি দিয়েই সারমন শুরু করতেন এবং প্রকৃত আধুনিকতাবাদীর মতো জনগণকে কুসংস্কার ও অজ্ঞতার শেকল ছুঁড়ে ফেলার, পণ্ডিত প্রতিষ্ঠানের কর্তৃত্ব অস্বীকার ও নিজেদের মতো করে ভাবনা চিন্তা করার তাগিদ দিতেন। সংবিধানে যাই বলা হয়ে থাকুক না কেন, নতুন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ধর্ম ও রাজনীতি একই মুদ্রার দুই পিঠ বলে মনে হচ্ছিল, একটার সাথে অন্যটাকে সহজেই মিলিয়ে দেওয়া যেত। এভাবে এলিয়াস স্মিথ প্রথম জেফারসনের প্রেসিডেনশাল প্রচারণার সময় রাজনৈতিক পরিবর্তনের অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন, তিনি তখন রেডিক্যাল সাম্যবাদীতে পরিণত হন। কিন্তু এরপরই নতুন ও গণতান্ত্রিক চার্চ প্রতিষ্ঠা করতে অগ্রসর হন তিনি। একইভাবে জেমস ও’কেলি বিপ্লবে যুদ্ধ করেছিলেন, ব্রিটিশদের হাতে বন্দিত্ব বরণ করেছেন। আগাগোড়া রাজনৈতিক ছিলেন তিনি, অধিকতর সমান চার্চ চাইতেন ও নিজস্ব ‘রিপাবলিকান মেথডিস্ট’ চার্চ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মূল ধারা থেকে বের হয়ে গিয়েছিলেন। বার্টন স্টোন প্রেসবিটারিয়ানদের থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার সময় তাঁর বিচ্ছেদকে ‘স্বাধীনতার ঘোষণা’ আখ্যায়িত করেছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষালাভকারী আলেকজান্দার ক্যাম্পবেল (১৭৮৮-১৮৬৬) আমেরিকায় অভিবাসনের পর তাঁর স্কটিশ প্রেসবিটারিয়ান মতবাদ ত্যাগ করেছিলেন এমন একটি গোষ্ঠী প্রতিষ্ঠা করার জন্যে যা সাম্যবাদী আদিম চার্চের খুব কাছাকাছি ছিল।২ আরও বেশি রেডিক্যাল ছিলেন জোসেফ স্মিথ (১৮০৫-৪৪)। বাইবেল পাঠ করে সন্তুষ্ট হতে পারেননি তিনি, বরং সম্পূর্ণ নতুন এক ঐশীগ্রন্থ আবিষ্কারের দাবি তুলেছিলেন। দ্য বুক অভ মরমন ছিল উনবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে প্রাঞ্জল সামাজিক প্রতিবাদ; ধনী, শক্তিশালী ও শিক্ষিতদের বিরুদ্ধে এক শক্তিশালী প্রত্যাখ্যান সূচিত করেছিল।৩ স্মিথ ও তাঁর পরিবার প্রায় দুস্থ দশায় বাস করেছিলেন, সাহসী নতুন প্রজাতন্ত্রে তাদের কোনও স্থান নেই বলে ধরে নিয়েছিলেন তাঁরা। প্রথম মরমন দীক্ষিতরাও সমান দরিদ্র, প্রান্তিকায়িত ও বেপরোয়া ছিল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে এক্সোডাস ও প্রতীকী প্রত্যাখানে প্রস্তুত ছিল তারা। মরমনরা শেষ পর্যন্ত তাদের নিজস্ব রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিল-প্রথমে ইলিনয়ে এবং শেষে ইউটাহয়।

দাউ, স্টোন ও জোসেফ স্মিথের প্রতি বিতৃষ্ণার সাথে নজর দিয়েছে প্রতিষ্ঠান; তাদের আধুনিক বিশ্বকে দেওয়ার মতো কিছুই নেই এমন বক্তৃতাজীবী মনে করেছে। যাজকদের বর্বোরোচিত পশ্চাদপসরণকারী, আদিম হারিয়ে যাওয়া পৃথিবীর রেলিক্স মনে হয়েছে। মূলধারার যাজক ও আমেরিকান অভিজাত গোষ্ঠীর পরবর্তীকালের এই পয়গম্বরদের প্রতি সাড়ার দেওয়ার সাথে আজকের দিনে উদারপন্থী ও সেক্যুলারিস্টরা যেভাবে সাড়া দিয়ে থাকে তার সাথে খুব একটা অমিল নেই। কিন্তু তাঁদের নাকচ করে দিয়ে ভুল করেছিলেন তারা। দাউ, জোসেফ বা স্মিথের মতো ব্যক্তিদের গ্রাম্য-মেধাবী হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে।৭৪ তাঁরা গণতন্ত্র, সাম্য, বাকস্বাধীনতা ও স্বাধীনতার মতো আধুনিক অধর্মসমূহকে এমন এক বাগধারায় সাধারণ অশিক্ষিত মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে সক্ষম ছিলেন যাতে তারা বুঝে সেটাকে আপন করে নিতে পারে। আমেরিকায় জন্ম নিতে চলা নতুন বিশ্বে আবশ্যক হয়ে উঠতে যাওয়া এইসব নতুন আদর্শ এক পৌরাণিক প্রেক্ষাপটে কম সুবিধাপ্রাপ্ত সংখ্যাগরিষ্ঠের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল যা সেগুলোকে অর্থ যুগিয়েছে এবং উত্তাল ও বিপ্লবী উত্থানপতনের এই সময়ে প্রয়োজনীয় ধারাবাহিকতা যুগিয়েছে। নতুন পয়গম্বরগণ স্বীকৃতি দাবি করেছেন, তাঁরা প্রতিষ্ঠিত অভিজাত গোষ্ঠীর পরিহাসের শিকার হলেও সাধারণ জনগণের কাছে তাঁদের সমাদর দেখিয়েছে যে প্রকৃত প্রয়োজনে সাড়া দিয়েছিলেন তাঁরা। প্রথম মহাজাগরণের যাজকদের মতো ব্যক্তিগত ধর্মান্তরে সন্তুষ্ট ছিলেন না তাঁরা, বরং সমাজের পরিবর্তন চেয়েছেন। জনগণকে দেশব্যাপী গণআন্দোলনে সমবেত করার ক্ষমতা রাখতেন তাঁরা, জনপ্রিয় সঙ্গীত ও প্রভাবকে নিপুণ করে তুলতে নতুন যোগাযোগ মাধ্যম কাজে লাগাতেন। ফাউন্ডিং ফাদারদের মতো উপর থেকে আধুনিক রীতিনীতি চাপিয়ে দেওয়ার বদলে তাঁরা জমিন থেকে উপর দিকে গড়ে তুলেছেন ও অনেকটা যুক্তিবাদী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে তৃণমূল পর্যায়ে বিদ্রোহ সংগঠিত করেছেন। দারুণভাবে সফল ছিলেন তাঁরা। উদাহরণ স্বরূপ, এলিয়াস স্মিথ, ও’কেলি, ক্যাম্পবেল ও স্টোন প্রতিষ্ঠিত গোষ্ঠীগুলো ক্রাইস্টের ‘ডিসাইপল’দের সমবেত করতে সম্মিলিত হয়েছিল। ১৮৬০ সাল নাগাদ ডিসাইপলদের মোট সদসসংখ্যা ২০০,০০০-এর দাঁড়ায় এবং তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পঞ্চম বৃহত্তম প্রটেস্ট্যান্ট গোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছিল।৫ মরমনদের মতো ডিসাইপলরা এমন একটা জনপ্রিয় অসন্তোষকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে পেরেছিল প্রতিষ্ঠান যাকে উপেক্ষা করতে পারেনি।

কিন্তু আলোকনের বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদের বিরুদ্ধে রেডিক্যাল ক্রিশ্চান বিদ্রোহের আরও বেশি গভীর প্রভাব ছিল। দ্বিতীয় মহাজাগরণ বহু আমেরিকানকে ফাউন্ডিং ফাদারদের ক্লাসিকাল প্রজাতন্ত্র থেকে আরও বেশি অশ্লীল গণতন্ত্র ও রূঢ় ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদের দিকে টেনে নিয়ে গেছে যা আজকের আমেরিকান সংস্কৃতিকে বৈশিষ্ট্যায়িত করে। শাসক অভিজাত শ্রেণীর বিরুদ্ধে প্রতিযোগিতা করে উল্লেখযোগ্য বিজয় লাভ করেছে তারা। আমেরিকান চেতনায় এক ধরনের টানাপোড়েন ছিল যা যুক্তির কালের শীতল রীতিনীতির চেয়ে বরং উনবিংশ শতকের লোকানুবর্তী ও প্রতি-বুদ্ধিজীবীবাদের কাছাকছি। দ্বিতীয় মহাজাগরণের শোরগোলময়, দর্শনীয় পুনর্জাগরণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পৃথক রাজনৈতিক স্টাইলের উপর স্থায়ী ছাপ রেখে গেছে, যাদের গণমিছিল, অনিরুদ্ধ অনুভূতি ও লোকদেখানো ক্যারিশমা ইউরোপিয়দের কাছে দারুণ বিস্ময়কর ছিল। আজকের বহু মৌলবাদী আন্দোলনের মতো দ্বিতীয় মহাজাগণের এই পয়গম্বরগণ নতুন রাষ্ট্রে নিজেদের যারা অধিকার বঞ্চিত ও শোষিত মনে করেছে অধিকতর সুবিধাপ্রাপ্ত অভিজাত গোষ্ঠীর কানে তাদের কণ্ঠস্বর পৌছাতে সাহায্য করেছেন। তাঁদের আন্দোলন জনগণকে মার্টিন লুথারের ভাষায় ‘কেউ একজন হওয়ার অনুভূতি’৭৬ দিয়েছিল, অনেকটা আজকের দিনে মৌলবাদী গ্রুপগুলো যেমন করে থাকে। মৌলবাদী আন্দোলনের মতো এই নতুন গোষ্ঠীগুলোর প্রত্যেকে আদিম ব্যবস্থার শরণাপন্ন হয়েছে, ধর্মবিশ্বাসকে নতুন করে গড়ে তুলতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিল তারা; সবাই ঐশীগ্রন্থের দিকে সম্পূর্ণ নতুন চোখে নির্ভর করেছে, একে তারা আক্ষরিক ও প্রায়শঃই লঘু করে ব্যাখ্যা করেছে। স্বৈরাচারী প্রবণতাও দেখিয়েছে তারা। উনবিংশ শতাব্দীর আমেরিকায় এটা ছিল একটা বৈপরীত্য, উনবিংশ শতকের শেষের দিকে মৌলবাদী আন্দোলনসমূহের মতো স্বাধীনতা, স্বায়ত্তশাসন ও সমতার প্রতি আকাঙ্ক্ষা বিপুল সংখ্যক লোককে আভাসে ধর্মীয় বক্তৃতাবাজদের মেনে চলতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। নাগরিক অধিকার সংক্রান্ত এতসব কথাবার্তায় জোসেফ স্মিথ কার্যত এক ধর্মীয় স্বৈরাচার সৃষ্টি করেছিলেন এবং আদি চার্চের সাম্যবাদী ও সাম্প্রদায়িক আদর্শের প্রতি তারিফ সত্ত্বেও আলেকজান্দার ক্যাম্পবেল পশ্চিম ভার্জিনিয়ার সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছিলেন, দলের লোকদের লৌহমানবের মতো শাসন করেছেন তিনি।

দ্বিতীয় মহাজাগরণ মানুষ তাদের সমাজকে আধুনিকায়নের কষ্টকর উত্থানপতনের ভেতর দিয়ে যাওয়ার সময় কী ধরনের সমাধান সাধারণ জনগণ আকর্ষণীয় বোধ করে সেটাই তুলে ধরে। আধুনিক মৌলবাদীদের মতো দ্বিতীয় মহাজাগরণের পয়গম্বরগণ শাসক গোষ্ঠীর বিজ্ঞ যুক্তিবাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ সংগঠিত করেছিলেন এবং অধিকতর ধর্মীয় পরিচয়ের উপর জোর দিয়েছেন। একই সময়ে তাঁরা দেকার্তে, নিউটন বা জন লকের রচনা পড়ার সুযোগ পায়নি এমন মানুষের কাছে আধুনিকায়নের রীতিনীতি বোধগম্য করে তুলেছেন। এই আমেরিকান পয়গম্বরদের ভবিষদ্বাণীসুলভ বিদ্রোহ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একাধারে স্থায়ী ও সফল হয়েছিল, এর মানে, বর্তমানে আধুনিকায়ন প্রক্রিয়ার অধীন সমাজগুলোয় আধুনিক মৌলবাদী আন্দোলনসমূহ স্বল্পস্থায়ী বা বিদায়ী ‘পাগলামি’ বলে আশা করা উচিত হবে না আমাদের। নতুন আমেরিকান গোষ্ঠীগুলোকে প্রতিষ্ঠানের চোখে অদ্ভুত ঠেকে থাকতে পারে, কিন্তু এগুলো আবিশ্যিকভাবে আধুনিক ও নতুন বিশ্বের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল। এটা নিশ্চিতভাবেই নিউ ইয়র্ক কৃষক উইলহেম মিলারের প্রতিষ্ঠিত মিলেনিয়াল আন্দোলানের বেলায় সত্যি; তিনি বাইবেলিয় ভবিষ্যদ্বাণী খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পাঠ করে সতর্ক হিসাবের পর ১৮৩১ সলে প্রকাশিত একটি প্যামফ্লেটে ‘প্রমাণ’ করেছিলেন যে ক্রাইস্টের দ্বিতীয় আগমন ঘটবে ১৮৪৩ সালে। মিলার বাইবেলকে চিরন্তন বাস্তবতার পৌরাণিক, প্রতীকী বিবরণ হিসাবে না দেখে আবিশ্যিকভাবেই আধুনিক দৃষ্টিতে দেখেছেন। মিলার ধরে নিয়েছিলেন, বুক অভ রেভেলেশনের এই ধরনের বিবরণ আসন্ন ঘটনাবলীর নির্ভুল ভবিষ্যদ্বাণী, যা বৈজ্ঞানিক ও গাণিতিক নির্ভুলতার সাথে হিসাব কষে বের করা সম্ভব। লোকে এখন তথ্যের জন্যে টেক্সট পাঠ করছিল। সত্যকে অবশ্যই যৌক্তিক, বৈজ্ঞানিক প্রকাশের উপযুক্ত হতে হবে। মিলার ঐশীগ্রন্থের মিথোসকে এমনভাবে দেখছিলেন যেন তা লোগোস; যাকে তিনি ও তাঁর সহকারী জোশুয়া হাইনস মিলারের অনুসন্ধানের পদ্ধতিগত ও বৈজ্ঞানিক প্রকৃতি বলে চাপ দিচ্ছিলেন। আন্দোলন গণতান্ত্রিকও ছিল: যেকেউ নিজে বাইবেলের ব্যাখ্যা করতে পারে। মিলার অনুসারীদের তাঁর হিসাব চ্যালেঞ্জ করতে অনুপ্রাণিত করেছেন, নিজস্ব তত্ত্ব খাড়া করতে বলেছেন।

আন্দোলনকে অসম্ভব ও বিচিত্র ঠেকলেও মিলারবাদ আশু আবেদন সৃষ্টি করতে পেরেছিল। প্রায় ৫০,০০০ আমেরিকান নিশ্চিত মিলারবাদীতে পরিণত হয়েছিল, অন্যদিকে আরও হাজার হাজার সেভাবে যোগ না দিলেও সহানুভূতিশীল ছিল।৭৯ অবশ্য অনিবার্যভাবে বাইবেলের মিথোসকে আক্ষরিকভাবে ব্যাখ্যা করার বিশেষ নজীরে পরিণত হয়েছিল মিলারবাদ। প্রতিশ্রুতি মোতাবেক ১৮৪৩ সালে ক্রাইস্ট ফিরে আসতে ব্যর্থ হয়েছেন এবং মিলারবাদ বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। তাসত্ত্বেও এই ব্যর্থতার মানে এই ছিল না যে মিলেনিয়ালিজমের অবসান ঘটেছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তা প্রধান আবেগে পরিণত হয় এবং এখনও অব্যাহত আছে। ১৮৪৩ সালের ‘মহা হতাশা’ থেকে সেভেন্থ ডে অ্যাডভেন্টিস্টের মতো অন্যান্য গোষ্ঠীগুলো আবির্ভূত হয়। এরা প্রলয়বাদী সময়সূচিকে সমন্বিত করে। নিখুঁত পূর্বাভাস এড়িয়ে গিয়ে নতুন আমেরিকার নতুন প্রজন্মগুলোকে ইতিহাসের আসন্ন অবসানের অপেক্ষায় থাকতে সক্ষম করে তুলেছে তারা।

প্রথম প্রথম এই নতুন কর্কশ ও গণতান্ত্রিক ক্রিশ্চানিটি দরিদ্র ও বেশি অশিক্ষিত শ্রেণীর ভেতর সীমাবদ্ধ ছিল, কিন্তু ১৮৪০-র দশকে আমেরিকান ধর্মের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব চার্লস ফিনি (১৭৯২–১৮৭৫) একে মধ্যবিত্ত শ্রেণীতে তুলে আনেন। এভাবে উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি একে গস্পেলের আক্ষরিক পাঠের উপর নির্ভরশীল ও সেক্যুলার ধারণাকে ক্রাইস্টের উপর বর্তানোর ইচ্ছুক এই ‘ইভাঞ্জেলিকাল’ ক্রিশ্চানিটিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান ধর্মবিশ্বাসে পরিণত করতে সাহায্য করেন তিনি।° ফিনি প্রাচীন পয়গম্বরদের অমার্জিত, বর্বর পদ্ধতি কাজে লাগান, কিন্তু আইনবিদ, ডাক্তার, ও বণিকদের প্রত্যক্ষভাবে প্রতিষ্ঠানের মধ্যস্ততা ছাড়া ক্রাইস্টকে উপলব্ধি করার তাগিদ দেন, নিজেদের মতো করে ভাবতে ও বিভিন্ন গোত্রের বিজ্ঞ ধর্মবেত্তাদের বিরুদ্ধে বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে বলেন। মধ্যবিত্ত শ্রোতাদের সমাজের সামাজিক সংস্কারে অন্যান্য ইভাঞ্জেলিকালদের সাথেও যোগ দিতে বলেন।৮১

বিপ্লবের পর রাষ্ট্র ধর্ম হতে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিল, একই সময়ে সকল গোষ্ঠীর ক্রিশ্চান রাষ্ট্র থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নিতে শুরু করে। মিলেনিয়াম বয়ে আনতে ব্যর্থ বিপ্লব নিয়ে স্বপ্নভঙ্গ ও মোহমুক্তির ব্যাপার ছিল। প্রটেস্ট্যান্টরা ডেইস্ট রিপাবলিকান সরকারের থেকে দূরে থেকে নিজস্ব ধর্মীয় ‘স্থান’ সংরক্ষণের উপর জোর দিতে শুরু করে। ফেডারেল প্রতিষ্ঠানের অংশ নয়, তারা ছিল ঈশ্বরের সম্প্রদায়। প্রটেস্ট্যান্টরা তখনও বিশ্বাস করছিল যে আমেরিকার ধার্মিক জাতি হওয়া উচিত এবং জনকল্যাণমূলক কর্মকাণ্ডকে ক্রমবর্ধমানহারে অরাজনৈতিক বিবচনা করা হচ্ছিল;৮২ সমাজের মুক্তির লক্ষ্যে রাষ্ট্র থেকে স্বাধীনভাবে ১৮২০-র দশকে দ্বিতীয় মহাজারণের পর উত্তরের রাজ্যগুলোয় গড়ে ওঠা বিভিন্ন চার্চ, স্কুল ও সংস্থায় কাজ করাই শ্রেয়তর। ক্রিশ্চানরা একটি ভালো পৃথিবী গড়ে তোলার লক্ষ্যে কাজ করতে থাকে। তারা দাসপ্রথা ও মদের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালায় ও প্রান্তিক গোষ্ঠীগুলোর উপর নির্যাতন বন্ধের দাবি জানায়। মিলারবাদীদের অনেকেই মিতাচার, দাসপ্রথা উচ্ছেদ ও নারীবাদী সংস্থার সাথে সংশ্লিষ্ট ছিল।৩ এসব কিছুর ভেতর নিশ্চিতভাবেই সামাজিক নিয়ন্ত্রণের উপাদান ছিল। এছাড়া প্রটেস্ট্যান্টদের মিতব্যায়িতা, সংযম ও পরিষ্কার জীবন যাপনের গুণের উপর গুরুত্ব আরোপের ভেতর অপ্রীতিকরভাবে সংরক্ষণবাদের অনুপ্রেরণাও ছিল। প্রটেস্ট্যান্টরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ক্যাথলিকদের বিপুল অভিবাসনে অস্বস্তিতে ভুগছিল। বিপ্লবের সময় আমেরিকা প্রটেস্ট্যান্ট দেশ ছিল। ক্যাথলিকরা ছিল মোট জনসংখ্যার মাত্র এক শতাংশ। কিন্তু ১৮৪০-র দশক নাগাদ আমেরিকায় ক্যাথলিকের সংখ্যা দাঁড়ায় ২.৫ মিলিয়নেরও বেশি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রোমান ক্যাথলিক মতবাদ বৃহত্তম ক্রিশ্চান গোষ্ঠীতে পরিণত হয়।৮৪ পোপকে দীর্ঘদিন ধরে অ্যান্টিক্রাইস্ট ভেবে আসা কোনও দেশের ক্ষেত্রে বিপজ্জনক পরিবর্তন ছিল এটা। ইভাঞ্জেলিকাল প্রয়াসের কিছু কিছু নিশ্চিতভাবেই এই ক্যাথলিক প্রভাবকে ঠেকানোর প্রয়াস ছিল। উদাহরণ স্বরূপ, মিতাচার নতুন পোলিশ, আইরিশ ও ইতালিয় আমেরিকানদের মদপানের অভ্যাসের বিরোধিতা করার লক্ষ্যে প্রচারিত হয়েছিল।৮৫

তাসত্ত্বেও এইসব ইভাঞ্জেলিকাল সংস্কার আন্দোলনসমূহ ইতিবাচক ও আধুনিকায়নকারীও ছিল। প্রতিটি মানব সন্তানের গুরুত্বের উপর জোর দেওয়া হয়েছিল। সক্রিয়ভাবে তারা সাম্যবাদের সমর্থন করে গেছে যাতে, উদাহরণ স্বরূপ, উত্তরের রাজ্যগুলোতে দাসপ্রথা অসহনীয় করে তুলতে সাহায্য করা যায়, কিন্তু দক্ষিণে নয়; দ্বিতীয় মহাজাগরণের বলতে গেলে ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গিয়েছিল তা, গৃহযুদ্ধে অনেক পরেও তা প্রাক আধুনিক আভিজাত্যবাদী সামাজিক কাঠামো ধরে রেখেছিল।৮৬ সংস্কার আন্দোলনগুলো সাধারণ মানুষকে ক্রিশ্চান প্যাকেজে অন্তত উত্তরে অবিচ্ছেদ্য মানবাধিকারসমূহকে ঠাঁই করে দিতে সাহায্য করেছে। ইভাঞ্জেলিকাল ক্রিশ্চানদের সূচিত নারীবাদ ও শাস্তিমূলক এবং শিক্ষার জন্যে আন্দোলনগুলোও প্রগতিশীল ছিল। খোদ সংস্কারবাদী দলগুলোও মানুষকে আধুনিক চেতনা ধারণে সাহায্য করেছে। সদস্যরা কোনও সংগঠনে যোগ দেওয়ার সচেতন, স্বেচ্ছামূলক সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং কীভাবে পরিকল্পনা, সংগঠন করতে হয় এবং আধুনিক ও যৌক্তিক উপায়ে একটি সুস্পষ্ট সংজ্ঞায়িত লক্ষ্য অর্জনের চেষ্টা করতে হয় সেটা শিখেছে। শেষ পর্যন্ত ইভাঞ্জেলিকাল ক্রিশ্চানরা হুইগ পার্টির (ব্যাপক দিক থেকে পরবর্তীকালের রিপাবলিকান পার্টি যার উত্তরাধিকারী) মেরুদণ্ড গড়ে তুলবে, অন্যদিকে তাঁদের প্রতিদ্বন্দ্বী (ওল্ড লাইটস ও ক্যাথলিকরা) ডেমোক্রেটিক পার্টির দিকে ঝুঁকে পড়বে। হুইগ/রিপাবলিকানরা আলোকনের বদলে ধার্মিক গুণাবলীর ভিত্তিতে আমেরিকায় একটি ‘ন্যায়নিষ্ঠ সাম্রাজ্য’ সৃষ্টি করতে চেয়েছিল।

সুতরাং, উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি নাগাদ, ইভাঞ্জেলিকালরা আর প্রান্তি কায়িত ও অধিকারবঞ্চিত ছিল না। সেকুলারিস্ট প্রতিষ্ঠানকে চ্যালেঞ্জ করে বক্তব্য প্রতিষ্ঠা করেছে তারা। এবার আমেরিকার সমাজের ক্রিশ্চান রিকনকুইস্তায় নিয়োজিত হয়েছিল তারা, একে কঠোরভাবে প্রটেস্ট্যান্ট রীতিনীতির অধীনে ফিরিয়ে নিতে বদ্ধপরিকর ছিল। নিজেদের সাফল্যে গর্বিত বোধ করেছে তারা। আমেরিকান সংস্কৃতির উপর অনেপনীয় প্রভাব বিস্তার করেছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেক্যুলার সংবিধান সত্ত্বেও এখন যা আগের যেকোনও সময়ের চেয়ে ঢের বেশি ক্রিশ্চান। ১৭৮০ ও ১৮৬০ সালের ভেতর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ক্রিশ্চান গোষ্ঠীসমূহের লক্ষণীয় বৃদ্ধি ঘটে, জাতীয় জনসংখ্যার বৃদ্ধির হারকে অনেকাংশে ছাড়িয়ে গিয়েছিল তা। ১৭৮০ সালে সমাবেশের সংখ্যা ছিল মাত্র ২,৫০০ টি, ১৮২০ সাল নাগাদ তা ১১,০০০ টিতে দাঁড়ায়; এবং ১৮৬০ সাল নাগাদ উল্লেখযোগ্য ৫২,০০০-এ-প্রায় ২১ গুন বৃদ্ধি পায়। তুলনামূলকভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনসংখ্যা ১৭৮০ সালের আনুমানিক চার মিলিয়ন থেকে ১৮২০ সালে দশ মিলিয়নে দাঁড়ায় ও ১৮৬০ সালে দাঁড়ায় ৩১ মিলিয়নে-আটগুনেরও কম বৃদ্ধি।৭ ইউরোপে ধর্মকে ক্রমবর্ধমানহারে প্রতিষ্ঠানের সাথে এক করে দেখা হচ্ছিল। সাধারণ লোক বিকল্প আদর্শের দিকে ঘুরে দাঁড়াচ্ছিল, কিন্তু আমেরিকায় প্রটেস্ট্যানিজম সাধারণ লোককে প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ক্ষমতাশালী করে তুলেছিল; এই প্রবণতা অব্যাহত থাকে, ফলে এখন আমেরিকায় এমন একটি জনপ্রিয় আন্দোলন খুঁজে বের করা কঠিন যা কোনওভাবে ধর্মের সাথে সম্পর্কিত নয়। ১৮৫০-র দশক নাগাদ আমেরিকায় ক্রিশ্চান ধর্ম ছিল সজীব, ভবিষ্যতের বিজয়ের জন্যে তৈরি বলে মনে হয়েছে।

সম্পূর্ণ ভিন্ন কাহিনী ছিল ইউরোপে। সেখানে জনগণকে আধুনিক বিশ্বের দিকে চালিতকারী প্রধান আদর্শগুলো ছিল সেক্যুলারিস্ট, ধর্মীয় নয়। ক্রমবর্ধমানহারে পরকালের চেয়ে ইহকালের দিকে সাধারণ মানুষের মনোযোগ নিক্ষিপ্ত হচ্ছিল। জর্জ উইলিয়াম ফ্রেডেরিখ হেগেলের (১৭৭০-১৮৩১) রচনায় এই বিষয়টি স্পষ্ট। তিনি দুয়ে ঈশ্বরকে মাটিতে টেনে নামিয়ে তাঁকে মানুষে পরিণত করেছিলেন। অতিপ্রাকৃতের মাঝে নয়, সম্পূর্ণতার সন্ধান মিলবে এই মাটিতেই; হেগেলের ফেনোমেনোলজি অভ মাইন্ড-এ (১৮০৭) বিশ্বজনীন আত্মা কেবল স্থান ও সময়ের সীমিত অবস্থায় নিজেকে স্থাপন করলেই এর পূর্ণ ক্ষমতা অর্জন করতে পারে; মানব মনেই তা সবেচেয়ে বেশি পূর্ণভাবে বাস্তবায়িত হয়েছে। সুতরাং, মানবজাতিকেও নিজেদের ঐশী বলে উপলব্ধি করার খাতিরে ঈশ্বরের প্রাচীন দুয়ের ধারণা বিসর্জন দিতে হবে। এই মিথ, অবতারবাদের নতুন ক্রিশ্চান মতবাদকে বহু আধুনিক মানুষের অভিজ্ঞতার জগৎ থেকে বিচ্ছেদের একটা প্রতিষেধক হিসাবেও দেখা যেতে পারে। এটা ছিল ঐশী সত্তা হতে বঞ্চিত হয়ে পড়া এক বিশ্বকে আবার পবিত্রকরণের প্রয়াস; এবং দেকার্তে ও কান্টের দর্শনে মানুষের মনের যে ক্ষমতা ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে বলে মনে হয়েছে, তার দৃষ্টিকে প্রসারিত করাও। কিন্তু সবার উপরে হেগেলের মিথ আধুনিকতার গতিশীল অভিঘাতও প্রকাশ করেছে। সোনালি যুগের কথা ভাববার কোনও ব্যাপার ছিল না এখানে। হেগেলের বিশ্ব অবিরাম নিজেকে পুনঃসৃষ্টি করছিল। প্রাচীন রক্ষণশীল বিশ্বাস অর্থাৎ, আগেই সবকিছু বলা হয়ে যাবার ধারণার বদলে হেগেল এক দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়ার কথা কল্পনা করেছেন যেখানে মানুষ অতীতের এককালে পবিত্র ও অপরিবর্তনীয় ধারণা ধ্বংস করার কাজে নিয়োজিত রয়েছে। এই দ্বান্দ্বিকতায় সত্তার প্রতিটি অবস্থাই এর বিপরীতটি নিয়ে আসে; বিপরীত এই সত্তাগুলোর সংঘাত বাধে ও আরও উন্নত সংশ্লেষে সেগুলো সমন্বিত হয়। এরপর আবার সেই একই প্রক্রিয়ার পুনরাবৃত্তি ঘটে। এই দৃষ্টিভঙ্গিতে মৌলে ফিরে যাবার কোনও উপায় নেই, এটা বরং সম্পূর্ণ নতুন ও নজীরবিহীন সত্যির দিকে অবিরাম বিবর্তন।

হেগেলের দর্শনে রক্ষণশীল চেতনাকে অপরিবর্তনীয়ভাবে পেছনে ফেলে আসা আধুনিককালের চালক আশাবাদের প্রকাশ ঘটেছে। তবে অনেকে হেগেল কেন ঈশ্বরের ব্যাপারে মাথা ঘামাতে গেছেন বুঝতে পারেননি। ধর্ম ও মিথলজিকে কোনও কোনও ইউরোপিয়র কাছে কেবল সেকেলেই নয়, বরং ক্ষতিকর মনে হয়েছিল। আমাদের বিচ্ছিন্নতার বোধকে প্রশমিত করার বদলে এগুলোকে তা আরও জটিল করে তোলে বলে মনে করা হয়েছে। ঈশ্বরকে মানবজাতির বিপরীত সত্তা হিসাবে স্থাপন করে হেগেলের শিষ্য লুদভিগ ফয়েরবাখ (১৮০৪-৭২) যুক্তি দেখিয়েছেন যে, ‘ধর্ম মানুষকে তার নিজের থেকেই বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে…ঈশ্বর সম্পূর্ণ, মানুষ অসম্পূর্ণ, ঈশ্বর চিরন্তন, মানুষ ক্ষণস্থায়ী, ঈশ্বর সর্বশক্তিমান, মানুষ দুর্বল।৮৮ কার্ল মার্ক্সের (১৮১৮-৮৩) চোখে, ধর্ম অসুস্থ সমাজের লক্ষণ, এমন এক মাদক যা রোগাক্রান্ত সামাজিক ব্যবস্থাকে সহনীয় করে তোলে ও এই জগৎ থেকে অন্য জগতে মনোযোগ সরিয়ে নিয়ে এর একটি প্রতিষেধক বের করার ইচ্ছা নষ্ট করে ফেলে।৮৯

উঁচু নৈতিক ভিত্তি লাভ করছিল নাস্তিকরা। ১৮১৯ সালে চার্লস ডারউইনের লেখা দ্য অরিজিন অভ স্পিসিজ বাই মিনস অভ নেচারাল সিলেকশন প্রকাশিত হওয়ার পর এটা স্পষ্ট হয়ে যায়। গ্রন্থটি আধুনিক বিজ্ঞানের এক নতুন পর্যায় তুলে ধরেছিল। বেকনের পরামর্শ মোতাবেক তথ্য সংগ্রহের বদলে ডারউইন একটি প্রকল্প তুলে ধরেছেন: পশু, গাছপালা ও মানুষ সম্পূর্ণ আকারে সৃষ্টি হয়নি (বাইবেল যেমনটা বুঝিয়েছে), বরং পরিবেশের সাথে অভিযোজনের ভেতর দিয়ে বিবর্তনের দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় উন্নত হয়ে উঠেছে। দ্য ডিসেন্ট অভ ম্যান (১৮৭১)-এ ডারউইন প্রস্তাব রাখেন যে, হোমো সেপিয়েন্সরা ওরাংউটান, গরিলা ও শিম্পাঞ্জির আদিপুরুষ একই আদি নরমানব থেকে উদ্ভুত হয়েছে। মৌলবাদী বলয়ে ডারউইনের নাম নাস্তিক্যবাদের প্রতিশব্দে পরিণত হয়েছে, কিন্তু অরিজিন-কে ধর্মের উপর আক্রমণ হিসাবে চিন্তা করা হয়নি, বরং তা ছিল বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের শোভন, সযত্ন ব্যাখ্যা। স্বয়ং ডারউইন অ্যাগনস্টিক ছিলেন, কিন্তু ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রতি সব সময়ই শ্রদ্ধাশীল ছিলেন তিনি। তাসত্ত্বেও অরিজিন ছিল সন্ধিক্ষণ। প্রকাশের দিনই ১৪০০ কপি বিক্রি হয়েছিল। নিশ্চিতভাবে এটা ও ডারউইনের পরবর্তীকালের কাজ মানুষের আত্ম-মর্যাদা বোধের উপর প্রচণ্ড আঘাত হেনেছিল। কোপার্নিকাস মানুষকে বিশ্বজগতের কেন্দ্র থেকে উৎখাত করেছিলেন, দেকার্তে ও কান্ট মানুষকে ভৌত পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন করেন, আর এবার ডারউইন মত প্রকাশ করলেন যে মানুষ স্রেফ আরেকটা পশুমাত্র। ঈশ্বরের হাতে বিশেষভাবে সৃষ্টি হয়নি তারা, বরং বাকি সমস্ত কিছুর মতো বিবর্তিত হয়েছে। প্রকৃতপক্ষেই সৃষ্টি প্রক্রিয়ায় যেন ঈশ্বরের কোনও স্থান নেই বলে মনে হয়েছে, ‘রক্তাক্ত থাবা ও দাঁতঅলা’ পৃথিবীর কোনও ঐশী লক্ষ্য নেই।

কিন্তু তাসত্ত্বেও অরিজিন প্রকাশিত হওয়ার পর ধর্মীয় প্রতিক্রিয়া ছিল চাপা। সাতজন অ্যাংলিকান যাজক সাধারণ পাঠকের জন্যে সর্বশেষ বাইবেলিয় সমালোচনা সহজলভ্য করে তোলা এসেজ অ্যান্ড রিভিউজ প্রকাশ করলে পরের বছর বেশি শোরাগোল হয়েছিল। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিক থেকে জার্মান পণ্ডিতগণ বাইবেলের ক্ষেত্রে সাহিত্যিক বিশ্লেষণ, প্রত্নতত্ত্ব ও তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বের নতুন কৌশল প্রয়োগ শুরু করেছিলেন। বৈজ্ঞানিকভাবে প্রয়োগযোগ্য পদ্ধতির অধীনে নিয়ে এসেছিলেন একে। তাঁরা যুক্তি দেখিয়েছেন যে, বাইবেলের প্রথম পাঁচটি পুস্তক, প্রচলিতভাবে যেগুলোর রচয়িতা মোজেস বলে উল্লেখ করা হয়, আসলে অনেক পরে বেশ কয়েক জন ভিন্ন ভিন্ন লেখকের হাতে রচিত; বুক অভ ইসায়াহর অন্তত দুটো ভিন্ন ভিন্ন উৎস রয়েছে, রাজা ডেভিড সম্ভবত শ্লোক রচনা করেননি। বাইবেলের বর্ণিত বেশির ভাগ অলৌকিক কাণ্ডই স্রেফ সাহিত্যিক হেঁয়ালি, আক্ষরিকভাবে বোঝার উপায় নেই; বাইবেলিয় বহু ঘটনা প্রায় নিশ্চিতভাবেই ঐতিহাসিক নয়। এসেজ অ্যান্ড রিভিউজ-এ ব্রিটিশ যাজকগণ যুক্তি দেখান, বাইবেলের কোনও বিশেষ মর্যাদা পাওয়া উচিত নয়, একে বরং আর পাঁচটা টেক্সটের মতোই সমান সমালোচনার বিষয়ে পরিণত করতে হবে। নতুন ‘হাইয়ার ক্রিটিসিজম’ মিথের বিরুদ্ধে লোগোসের যৌক্তিক ডিসকোর্সের বিজয় তুলে ধরেছে। যৌক্তিক বিজ্ঞান বাইবেলের মিথোই-কে রেডিক্যাল নিরীক্ষার অধীনে নিয়ে এসে আবিষ্কার করেছে যে, এর কোনও কোনও দাবি ‘মিথ্যা’। বাইবেলিয় কাহিনীসমূহ কেবলই ‘মিথ’, জনপ্রিয় আলোচনায় এখন যার মানে দাঁড়ায়, ওসব সত্যি নয়। হাইয়ার ক্রিটিসিজম ক্রিশ্চান মৌলবাদীদের পক্ষে জুজুতে পরিণত হবে। কারণ একে ধর্মের উপর বড় ধরনের হামলা মনে হয়েছে, তবে এর একমাত্র কারণ পাশ্চাত্যের জনগণ অতীন্দ্রিয়ের মূল বোধ হারিয়ে ফেলেছিল, তারা ধরে নিয়েছিল যে মতবাদ ও ঐশীগ্রন্থের বিবরণসমূহ লোগোই, যেসব বিবরণ তথ্যগতভাবে সঠিক হওয়ার কথা ও যেসব ঘটনা বৈজ্ঞানিকভাবে তদন্তযোগ্য। কিন্তু বাইবেল সম্পূর্ণ আক্ষরিক অর্থে পাঠ করা যে কতখানি কঠিন সেটা প্রকাশ করে হাইয়ার ক্রিটিসিজম আধুনিক ক্রিশ্চানদের ধর্মবিশ্বাসকে বৈজ্ঞানিক’ করে তোলার ক্রমবর্ধমান প্রবণতার বিরুদ্ধে একটি স্বাস্থ্যকর পাল্টা ভারসাম্যের যোগানও দিতে পারত।

ডারউইনের প্রকল্প ও জেনেসিসের প্রথম অধ্যায়ের বিভিন্ন অমিল তুলে ধরে ডারউইনের আমেরিকান বন্ধু ও সতীর্থ বৈজ্ঞানিক আসা গ্রে (১৮১০-৮৮)-র মতো কিছু ক্রিশ্চান জেনেসিসের আক্ষরিক পাঠের সাথে প্রাকৃতিক নির্বাচনকে খাপ খাওয়ানোর প্রয়াস পেয়েছিলেন। পরে ক্রিয়েশন সায়েন্স নামে পরিচিত হয়ে ওঠা এই প্রকল্পটি জেনেসিসকে বৈজ্ঞানিকভাবে সম্মানজনক করে তোলার জন্যে আরও অনেক দূর অগ্রসর হবে। কিন্তু এটা ছিল আসল সত্যি বাদ দিয়ে যাওয়া, কারণ মিথ হিসাবে বাইবেলের সৃষ্টিকাহিনী প্রাণের বিকাশের ঐতিহাসিক বিবরণ নয় বরং খোদ জীবনের পরম তাৎপর্যের আধ্যাত্মিক প্রতিফলন ছিল; যার সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক লোগোসের বলার মতো কিছুই নেই।

ডারউইন না চাইলেও অরিজিনের প্রকাশনা সত্যিই ধর্ম ও বিজ্ঞানের ভেতর প্রাথমিক সংঘাতের কারণ হয়েছিল। কিন্তু প্রথম গুলি ছোঁড়া হয়েছিল অধিকতর সেক্যুলারিস্টদের তরফ থেকে। ইংল্যান্ডে টমাস এইচ. হাক্সলি (১৮২৫-৯৫) ও মহাদেশে কার্ল ফোগত (১৮১৭–৯৫), লুদভিগ বাকনার (১৮২৪–৯৯), জ্যাকব মোলেস্ট (১৮২২-৯৩) ও আর্নস্ট হেকেল (১৮৩৪-১৯১৯) বহু সফর করে বিপুল সংখ্যক দর্শকের সামনে বিজ্ঞান ও ধর্মকে পরস্পর বেমানান প্রমাণ করে ডারউইনের মতবাদকে জনপ্রিয় করে তোলেন। আসলে তাঁরা ধর্মের বিরুদ্ধে এক ক্রুসেডের প্রচার করছিলেন।

হাক্সলি স্পষ্ট অনুভব করেছিলেন, তাঁর সামনে লড়াই অপেক্ষা করছে। তিনি জোর দিয়ে বলেছেন, যুক্তিকেই সত্যির একমাত্র মাপকাঠি হতে হবে। মানুষকে মিথলজি ও যৌক্তিক বিজ্ঞানের ভেতর যে কোনও একটাকে বেছে নিতে হবে। এখানে কোনও আপোস হতে পারে না: ‘অজ্ঞাত মেয়াদের সংগ্রামের পর একটার অন্যটিকে গ্রাস করে নিতেই হবে। হাক্সলির কাছে বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদ ছিল এক নতুন সেক্যুলার ধর্ম; পরিবর্তন ও সম্পূর্ণ অঙ্গীকার দাবি করেছে তা। “বুদ্ধিমত্তার ক্ষেত্রে, নিজের যুক্তিকে অনুসরণ করো, তোমাকে তা যতদূরে নিয়ে যাক, আর কোনও বিবেচনাকে মাথায় নিয়ো না,’ শ্রোতাদের আর্জি জানিয়েছেন তিনি। ‘আর নেতিবাচকভাবে, বুদ্ধিমত্তার বেলায়, প্রকাশ করা হয়নি বা প্রমাণযোগ্য নয় এমন সিদ্ধান্তকে নিশ্চিত ধরে নিয়ো না।৯৪ লক্ষণীয় সাফল্য লাভ করে নিজেকে আগ্রাসীভাবে সত্যির একক শানাক্তকারী হিসাবে দাবিকারী আধুনিক প্রগতিশীল সংস্কৃতির অভিঘাতের পূর্ণ সমর্থন ছিল হাক্সলির পেছনে। কিন্তু সত্যিকে ‘প্রকাশিত ও প্রমাণযোগ্য’ সীমিত করে ফেলা হয়েছিল; যা ধর্ম বাদেও শিল্পকলা ও সঙ্গীতের সত্যিকে বিসর্জন দেবে। হাক্সলির চোখে অন্য কোনও সম্ভাব্য পথ থাকতে পারে না। যুক্তিই একমাত্র সত্যি, ধর্মের মিথসমূহ অর্থহীন। এটা ছিল রক্ষণশীল সীমাবদ্ধতা থেকে চূড়ান্ত স্বাধীনতা ঘোষণা। যুক্তিকে আর উচ্চ আদালতে নিজেকে সমর্পণ করতে হবে না। একে নৈতিকতা দিয়ে সীমাবদ্ধ করে রাখা যাবে না, বরং ‘অন্যান্য বিবেচনাকে পরোয়া না করে’ শেষ পর্যন্ত ঠেলে নিয়ে যেতে হবে। মহাদেশের ক্রুসেডাররা ধর্মের বিরুদ্ধে যুদ্ধে আরও বহুদূর এগিয়ে গিয়েছিল। বাকনারের বেস্টসেলার ফোর্স অ্যান্ড ম্যাটার-খোদ হাক্সলির অপছন্দ আনাড়ী গ্রন্থ-যুক্তি তুলে ধরে যে, মহাবিশ্বের কোনও উদ্দেশ্য নেই, পৃথিবীর সমস্ত কিছুই একটি মাত্র কোষ থেকে উদ্ভুত হয়েছে, কেবল নির্বোধই ঈশ্বরে বিশ্বাস রাখতে পারে। কিন্তু এ বইয়ের বিরাট সংখ্যক পাঠক ও হেকেলের ভাষণ শুনতে সমবেত বিপুল দর্শক দেখিয়েছে যে, ইউরোপে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ বিজ্ঞানের কথা শুনতে চেয়েছে এবং চিরকালের জন্যে ধর্মকে বাতিল করে দিয়েছে।

এর কারণ ধর্মীয় সত্যিকে যৌক্তিক লোগোই-এর মতো বিবেচনা করে আধুনিক বিজ্ঞানী, সমালোচক ও দার্শনিকগণ সেগুলোকে অবিশ্বাস্য করে তুলেছিলেন। ১৮৮২ সালে ফ্রেডেরিখ নিৎশে (১৮৪৪-১৯০০) ঈশ্বরের প্রয়াণ ঘটেছে ঘোষণা করবেন। দ্য গ্রে সায়েন্স-এ তিনি এক উন্মাদের কাহিনী বলেছেন, একদিন সকালে সে বাজার এলাকায় ছুটে এসে চিৎকার করে বলতে থাকে ‘আমি ঈশ্বরকে খুঁজছি!’ আমোদিত ও উন্নাসিক পথচারীরা যখন জানতে চাইল, সে কি ভেবেছে ঈশ্বর নির্বাসনে গেছেন বা সটকে পড়েছেন, চোখ পাকিয়ে তাকাল সে। ‘ঈশ্বর কোথায় গেছেন?’ জানতে চাইল সে। ‘আমরা তাঁকে হত্যা করেছি-তোমরা আর আমি! আমরা সবাই তাঁর ঘাতক!৯৫ গুরুত্বপূর্ণ এক অর্থে ঠিকই বলেছিলেন নিৎশে। মিথ, কাল্ট, আচার ও প্রার্থনা ছাড়া পবিত্রের অনুভূতি অনিবার্যভাবে মারা যায়। ‘ঈশ্বর’কে সম্পূর্ণ মতগত সত্যিতে পরিণত করে কিছু আধুনিক বিশ্বাসীর প্রয়াসের মতো কেবল বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে ঐশী সত্তার নাগাল পাওয়ার চেষ্টা করতে গিয়ে আধুনিক নারী- পুরুষ নিজেরাই এঁকে হত্যা করেছে। তাদের ভবিষ্যৎমুখী সংস্কৃতি পবিত্রের প্রতি অগ্রসর হওয়ার প্রচলিত পথকে দার্শনিকভাবে অসম্ভব করে তুলেছে। এর আগে ইহুদি মারানোদের মতো, সম্পূর্ণ ভিন্ন কারণে যাদের ধর্মীয় শূন্যতায় ঠেলে দেওয়া হয়েছিল, অনেক আধুনিক নারী-পুরুষ ধর্মের সত্যিকে ক্ষীণ, খেয়ালি ও দুর্বোধ্য বলে আবিষ্কার করছিল।

নিৎশে’র উন্মাদ বিশ্বাস করত, ঈশ্বরের প্রয়াণ মানবজাতিকে এর শেকড় থেকে উপড়ে দিয়েছে, পৃথিবীকে এর কক্ষপথ থেকে উৎক্ষিপ্ত করে একে মহাশূন্যের পথহীন অঞ্চলে ভাসিয়ে দিয়েছে। যা কিছু মানুষকে একসময় পথের দিশা দিত তার সবই উধাও হয়ে গেছে। ‘এখনও কি আকাশ ও জমিন আছে?’ জানতে চেয়েছে সে। ‘আমরা কি অসীম শূন্যতার ভেতর দিয়ে ভেসে চলার মতো বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়িনি?’৯৬ এক গভীর ত্রাস, অর্থহীনতার বোধ আধুনিক অভিজ্ঞতার অংশ হয়ে দাঁড়াবে। নিৎশে এমন এক সময় লিখছিলেন যখন আধুনিকতার অতিরিক্ত উল্লাস নামহীন ভীতির সঞ্চার করছিল। এটা কেবল ইউরোপের ক্রিশ্চানদেরই প্রভাবিত করবে না, বরং আধুনিকায়নের প্রক্রিয়ায় টেনে আনা ইহুদি ও মুসলিম যারা একে সমানভাবে বিভ্রান্তিকর বলে আবিষ্কার করেছে, তাদেরও প্রভাবিত করবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *