০১. ইহুদি : অগ্রপথিক (১৪৯২-১৭০০)

১. ইহুদি : অগ্রপথিক (১৪৯২-১৭০০)

১৪৯২ সালে স্পেনে তিনটি দারুণ গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে। সেই সময় এই ঘটনাগুলোকে অসাধারণ মনে করা হয়েছিল, কিন্তু পেছনে তাকিয়ে আমরা বুঝতে পারি এসব ছিল পঞ্চম, ষষ্ঠ ও সপ্তদশ শতাব্দীতে পশ্চিম ইউরোপে ধীরে ধীরে বেদনাদায়কভাবে জন্ম নিতে চলা এক নতুন সমাজেরই বৈশিষ্ট্য। এই বছরগুলো আমাদের আধুনিক পাশ্চাত্য সংস্কৃতির বিকাশ প্রত্যক্ষ করেছে। সুতরাং ১৪৯২ সাল আমাদের বেশ কিছু চিন্তা-ভাবনা ও দোলাচলেরও উপরও আলোকপাত করে। প্রথম ঘটনাটি ঘটেছিল জানুয়ারির ২ তারিখে, এই দিন ক্যাথলিক সম্রাট-সম্রাজ্ঞী রাজা ফার্দিনান্দ ও রানি ইসাবেলার সেনাবাহিনী, যাদের বিয়ে সম্প্রতি প্রাচীন ইবারিয় পেনিসুলার রাজ্য আরাগন ও ক্যাসলকে একসূত্রে বেঁধেছিল, নগর রাষ্ট্র গ্রানাদা দখল করে নেয়। গভীর আবেগের সাথে নগরবাসীরা নগর প্রাচীরে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্রিশ্চান পতাকা ওড়ানো প্রত্যক্ষ করে। খবর ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে গোটা ইউরোপ জুড়ে বিজয়ের সুরে ঘণ্টা বাজতে শুরু করে, কারণ ক্রিশ্চান বিশ্বে গ্রানাদাই ছিল শেষ মুসলিম শক্তঘাঁটি। মধ্যপ্রাচ্যে ইসলামের বিরুদ্ধে ক্রুসেডসমূহ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছিল। তবে অন্তত ইউরোপ থেকে মুসলিমদের বহিষ্কার করা গেছে। ১৪৯৯ সালে স্পেনের মুসলিমদের ক্রিশ্চান ধর্মে দীক্ষা গ্রহণ বা দেশত্যাগের মধ্যে যেকোনও একটি বেছে নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়, এরপর কয়েক শতাব্দী ধরে ইউরোপ মুসলিম শূন্য হয়ে থাকবে। গুরুত্ববহ এই বছরের দ্বিতীয় ঘটনাটি ঘটে ৩১শে মার্চ, এই দিন ফার্দিনান্দ ও ইসাবেলা এডিক্ট অভ এক্সপালশান স্বাক্ষর করেন; স্পেনকে ইহুদি মুক্ত করাই ছিল এর লক্ষ্য। ব্যাপ্টিজম বা দেশত্যাগের ভেতর যেকোনও একটি বেছে নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয় তাদের। অনেক ইহুদিই ‘আল-আন্দালুসের’ (প্রাচীন মুসলিম রাজ্যকে এ নামেই ডাকা হত) সাথে নিজেদের এমনভাবে সম্পর্কিত মনে করত যে, ক্রিশ্চান ধর্মে দীক্ষা নিয়ে স্পেনেই থেকে যায় তারা, কিন্তু আনুমানিক ৮০,০০০ ইহুদি সীমানা পেরিয়ে পর্তুগালে পাড়ি জমায়, অন্যদিকে ৫০,০০০ ইহুদি পালিয়ে যায় নতুন মুসলিম অটোমান সাম্রাজ্যে। এখানে তাদের স্বাগত জানানো হয়। তৃতীয় ঘটনাটি ক্রিশ্চানদের গ্রানাদা অধিকার করে নেওয়ার সময় উপস্থিত এক ব্যক্তির সাথে সম্পর্কিত। আগস্ট মাসে ফার্দিনান্দ ও ইসাবেলার অনুগ্রহভাজন ক্রিস্টোফার কলম্বাস ভারতের সাথে নুতন বাণিজ্য-পথ আবিষ্কারের লক্ষ্যে জাহাজ ভাসান, কিন্তু তার বদলে আমেরিকা আবিষ্কার করে বসেন তিনি।

এইসব ঘটনা যুগপৎ প্রাথমিক আধুনিক কালের মাহাত্ম্য ও বিনাশ প্ৰতিফলিত করে। কলম্বাসের অভিযান যেমন জোরালভাবে দেখিয়েছে যে, ইউরোপের জনগণ এক নতুন বিশ্বের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিল। ওদের দিগন্ত প্রসারিত হচ্ছিল, এপর্যন্ত বুদ্ধিবৃত্তিক, সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে অজানা এক ভৌগলিক বলয়ে প্রবেশ করতে যাচ্ছিল তারা। এই সাফল্য তাদের বিশ্বের অধিপতিতে পরিণত করবে। কিন্তু আধুনিকতার অন্ধকার দিকও ছিল। ক্রিশ্চান স্পেন ছিল ইউরোপের অন্যতম শক্তিশালী ও অগ্রসর রাজ্য। ক্রিশ্চান বিশ্বের অন্যান্য অংশে বিকাশমান বিভিন্ন রাষ্ট্রের মতো একটি আধুনিক কেন্দ্রিভূত রাষ্ট্র নির্মাণের পথে ছিলেন ফার্দিনান্দ ও ইসাবেলা। এমন একটি রাষ্ট্র মধ্যযুগকে বৈশিষ্ট্যায়িত করে তোলা গিল্ড, কর্পোরেশন বা ইহুদি সম্প্রদায়ের মতো প্রাচীন স্বায়ত্তশাসিত, স্ব-পরিচালিত প্রতিষ্ঠানসমূহকে সহ্য করতে পারে না। গ্রানাদা অধিকারের ভেতর দিয়ে স্পেনের একীভূতকরণের প্রক্রিয়ার পরপরই জাতিগত পরিশুদ্ধির একটি প্রক্রিয়া শেষ করা হয়। ইহুদি ও মুসলিমরা তাদের আবাস হারায়। কিছু কিছু মানুষের কাছে আধুনিকায়ন ছিল ক্ষমতায়ন, মুক্তিদায়ী এবং উত্তেজনাকর। অন্যরা একে নির্যাতনমূলক, আগ্রাসী ও প্রলয়ঙ্করী হিসাবে প্রত্যক্ষ করেছে এবং করে যাবে। পাশ্চাত্য আধুনিকতা পৃথিবীর অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে এই একই প্যাটার্ন অব্যাহত থাকবে। এই আধুনিকায়ন কর্মসূচি ছিল আলোকসৃষ্টিকারী, শেষ পর্যন্ত তা মানবিক মূল্যবোধসমূহকে উপরে তুলে ধরবে, কিন্তু তা আগ্রাসীও ছিল। বিংশ শতাব্দীতে প্রাথমিকভাবে আধুনিকতাকে আক্রমণ হিসাবে প্রত্যক্ষকারীরাই পরিণত হবে মৌলবাদীতে।

কিন্তু সেটা তখনও দূর ভবিষ্যতের গর্ভে। পঞ্চদশ শতকের শেষদিকে ইউরোপের জনগণের পক্ষে তাদের সূচিত পরিবর্তনের ব্যাপকতা উপলব্ধি করা সম্ভব ছিল না। পরবর্তী তিন শো বছরের পরিক্রমায় ইউরোপ কেবল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবেই সমাজসমূহের পরিবর্তন ঘটাবে না, বরং এক ধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক বিপ্লব সংগঠিত করবে। বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদ পরিণত হবে যুগের বিধানে, ধীরে ধীরে মন ও হৃদয়ের পুরোনো আলখেল্লাকে বিতাড়িত করবে। তৃতীয় অধ্যায়ে আমরা গ্রেট ওয়েস্টার্ন ট্রান্সফর্মেশন হিসাবে আখ্যায়িত এই সময়কালের উপর আলোকপাত করব। তবে এর পূর্ণাঙ্গ তাৎপর্য উপলব্ধির আগে প্রাক আধুনিক কালের মানুষ কীভাবে বিশ্বকে প্রত্যক্ষ করত সেটা দেখতে হবে। স্পেনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সোৎসাহে ছাত্র ও শিক্ষকগণ ইতালিয় রেনেসাঁর নানা নতুন ধারণা নিয়ে আলোচনায় মেতে ছিলেন। ম্যাগনেটিক কম্পাস বা জ্যোতির্বিজ্ঞানের নবতর ধারণার মতো বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের সাহায্য ছাড়া কলম্বাসের অভিযান সম্ভব ছিল না। ১৪৯২ সাল নাগাদ পাশ্চাত্য বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদ দর্শনীয়ভাবে কার্যকর হয়ে উঠছিল। মানুষ আগের চেয়ে ঢের বেশি পরিপূর্ণভাবে গ্রিকরা যাকে লোগোস আখ্যায়িত করেছে তার সম্ভাবনা আবিষ্কার করছিল, সব সময়ই যা একেবারে নতুন কিছুর আকাঙ্ক্ষা করছিল। আধুনিক বিজ্ঞানের কল্যাণেই ইউরোপিয়রা সম্পূর্ণ নতুন এক বিশ্ব আবিষ্কার করে, পরিবেশের উপর অভাবনীয় নিয়ন্ত্রণ লাভ করতে শুরু করে। কিন্তু তখনও তারা মিথোসকে নাকচ করে দেয়নি। বিজ্ঞানের সাথে পরিচয় ছিল কলম্বাসের, কিন্তু তখনও তিনি প্রাচীন পৌরাণিক বিশ্বেই স্বচ্ছন্দ বোধ করতেন। তিনি ধর্মান্তরিত এক ইহুদি পরিবারের সন্তান ছিলেন বলেই মনে হয়, ইহুদিবাদের মরমী ঐতিহ্য কাব্বালায় তাঁর আগ্রহ রয়ে গিয়েছিল; কিন্তু আবার ধর্মপ্রাণ ক্রিশ্চান ছিলেন তিনি; ক্রাইস্টের পক্ষে গোটা বিশ্বকে অধিকার করতে চেয়েছেন। ভারতে পৌছানোর পর জেরুজালেমের সামরিক অধিকার লাভের জন্যে সেখানে একটি ক্রিশ্চান ঘাঁটি স্থাপনের আশা করেছিলেন তিনি। ইউরোপের মানুষ আধুনিতার পথে যাত্রা শুরু করেছিল, কিন্তু আমাদের মতো পূর্ণাঙ্গ আধুনিক হয়ে ওঠেনি। ক্রিশ্চান ধর্মের বিভিন্ন মিথ যৌক্তিক ও বৈজ্ঞানিক অভিযানে তখনও ওদের কাছে অর্থ যোগাচ্ছিল।

তাসত্ত্বেও ক্রিশ্চান ধর্ম বদলে যাচ্ছিল। স্পেনিয়ার্ডরাই কাউন্সিল অভ ট্রেন্ট সূচিত কাউন্টার রিফর্মেশনের (১৫৪৫-৬৩) নেতায় পরিণত হবে। এটা ছিল পুরোনো ক্যাথলিজমকে নতুন ইউরোপের সংহত দক্ষতার সাথে এক তলে আনয়নকারী একটি আধুনিকায়ন কর্মসূচি। আধুনিক রষ্ট্রের মতো চার্চ অধিকতর কেন্দ্রিভূত সংস্থায় পরিণত হয়। কাউন্সিল পোপ ও বিশপদের ক্ষমতার সংস্কার করে, প্রথমবারের মতো মতবাদগত সমরূপতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সকল বিশ্বাসীর উদ্দেশ্যে একটি ক্যাটেশিজম জারি করা হয়। যাজকদের আরও উন্নত মানের শিক্ষিত হয়ে ওঠার প্রয়োজন ছিল, যাতে তাঁরা আরও কার্যকরভাবে ধর্ম শিক্ষা দিতে পারেন। সাধারণ মানুষের লিটার্জি ও ভক্তি প্রকাশের বিভিন্ন অনুশীলনকে যৌক্তিক করা হয়; এক শতাব্দী আগেও অর্থপূর্ণ ছিল যেসব আচার সেগুলো এখন আর নতুন যুগের জীবনযাত্রায় কাজ আসছিল না বলে বাতিল করে দেওয়া হয়। স্পেনের বহু ক্যাথলিক ওলন্দাজ মানবতাবাদী দেসিদেরিয়াস ইরাসমাসের (১৪৬৬-১৫৩০) রচনায় উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে। মৌলবিষয়ে ফিরে গিয়ে ক্রিশ্চান ধর্মকে পুনরুজ্জীবিত করে তুলতে চেয়েছিলেন তিনি। তাঁর শ্লোগান ছিল, আদ ফন্তেস: ‘ফিরে চলো ঝর্নায়!’ ইরাসমাসের বিশ্বাস ছিল প্রাথমিক চার্চের প্রকৃত ক্রিশ্চান ধর্মবিশ্বাস প্রাণহীন কিছু মধ্যযুগীয় ধর্মতত্ত্বের নিচে চাপা পড়ে গেছে। পরবর্তীকালের বিভিন্ন সংযোজন ছিন্ন করে উৎসে-বাইবেল ও ফাদার্স অভ দা চার্চ-ফেরার মাধ্যমে ক্রিশ্চানরা গস্পেলের সজীব মূল বিষয় উদ্ধার করবে ও এক নবজন্মের অভিজ্ঞতা লাভ করবে।

কাউন্টার রিফর্মেশনের প্রধান স্পেনিয় অবদান ছিল অতীন্দ্রিয়। অনেকটা মহান নাবিকদের ভৌত বিশ্বে নতুন নতুন অঞ্চল আবিষ্কার করে চলার মতো ইবারিয়ার অতীন্দ্রিয়বাদীরা আধ্যাত্মিক জগতের অভিযাত্রীতে পরিণত হয়। অতীন্দ্রিয়বাদ ছিল মিথোসের আওতাভুক্ত, যৌক্তিক অংশের কাছে দুর্গম অবচেতন জগতেই এর কর্মকাণ্ড, ভিন্ন কৌশলে প্রত্যক্ষ করতে হত একে। তাসত্ত্বেও স্পেনের অতীন্দ্রিয়বাদী সংস্কারকগণ আধ্যাত্মিকতার এই ধরনটিকে কম অগোছাল ও অন্তর্মুখী, এবং অপরিপক্ক পরামর্শকদের উপর কম নির্ভরশীল করতে চেয়েছিলেন। জন অভ দ্য ক্রস (১৫৫২-৯১) অধিকতর সন্দেহজনক ও কুসংস্কারমূলক ভক্তি উৎখাত করে অতীন্দ্রিয়বাদী প্রক্রিয়াকে অনেকটা পদ্ধতিগত রূপ দেন। নতুন কালের অতীন্দ্রিয়বাদীদের এক স্তর থেকে অন্য স্তরে অগ্রসর হওয়ার সময় কী প্রত্যাশা করতে হবে সেটা জানার প্রয়োজন ছিল, তাদের অবশ্যই অন্তস্থঃ জীবনের বিভিন্ন সংকট ও বিপদের মোকাবিলা করার কৌশল শিখতে হত ও আধ্যাত্মিক শক্তিসমূহের কার্যকর পরিমিত ব্যবহার জানতে হত।

অবশ্য আরও আধুনিক ও অত্যাসন্ন বিভিন্ন পরিবর্তনের আভাস ছিল সাবেক সৈনিক ইগনাশিয়াস অভ লায়োলা (১৪৯১-১৫৫৫) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত সোসায়েটি অভ জেসাস। এই সংঘ এমন এক ধরনের দক্ষতা ও কার্যকারিতা ধারণ করত যা আধুনিক পশ্চিমের বৈশিষ্ট্যে পরিণত হবে। ইগনাশিয়াস বাস্তব ক্ষেত্রে মিথোসের শক্তি পরীক্ষা করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। তাঁর জেস্যুইটদের জন অভ দ্য ক্রস উদ্ভাভিত দীর্ঘ ধ্যানমূলক অনুশীলনের অবকাশ ছিল না। তাঁর স্পিরিচুয়াল এক্সারসাইজ তিরিশ দিন মেয়াদী সময়-দক্ষ একটি পদ্ধতিগত নির্জনবাসের ব্যবস্থা দিয়েছিল, ফলে প্রত্যেক জেস্যুইট অতীন্দ্রিয়বাদের একটি ঝটিকা শিক্ষা লাভ করত। পরিপূর্ণভাবে যিশুতে দীক্ষা লাভের পর একজন ক্রিশ্চান তার অগ্রাধিকারসমূহ বিন্যস্ত করে নিতে পারলে, কর্মক্ষেত্রে নামতে প্রস্তুত হতে পারত। পদ্ধতি, শৃঙ্খলা ও সংগঠনের উপর এই গুরুত্বারোপ নতুন বিজ্ঞানের মতোই ছিল। ঈশ্বরকে এক গতিশীল শক্তি হিসাবে প্রত্যক্ষ করা হত, যা সারাবিশ্বের জেস্যুইটদের অনেকটা অভিযাত্রীদের মতোই পরিচালিত করত। ফ্রান্সিস হাবিয়ের (১৫০৬-৫২) জাপানকে, রবার্ট দি নোবিলি (১৫৭৭-১৬৫৬) ভারতকে, এবং মেত্তি ও রিক্কি (১৫৫২-১৬১০) চীনকে ইভাঞ্জেলাইজ করেছেন। প্রাথমিক আধুনিক স্পেনে ধর্মকে তখনও পেছনে ফেলে আসা হয়নি। নিজেকেই নিজে সংস্কারে সক্ষম ছিল তা, এবং নিজস্ব আওতা ও আদর্শকে আরও সামনের দিকে নিয়ে যেতে আধুনিকতার বিভিন্ন অন্তর্দৃষ্টি আত্মস্থ করতে পারছিল।

সুতরাং, প্রাথমিক আধুনিক স্পেন ছিল আধুনিকতার অগ্রসর প্রহরীর অংশ। তবে ফার্দিনান্দ ও ইসাবেলাকে এইসব শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়েছে। এ যাবত স্বাধীন ও বিচ্ছিন্ন বিভিন্ন রাজ্যকে একত্র করার প্রয়াস পাচ্ছিলেন তাঁরা; পরস্পরের সাথে সংযুক্ত করতে হচ্ছিল সেগুলোকে। ১৪৮৩ সালে এই দুই রাজণ্য তাঁদের একীভূত অঞ্চলে আদর্শগত সমরূপতা নিশ্চিত করতে নিজস্ব স্প্যানিশ ইনকুইজিশনের প্রচলন করেন। একটি আধুনিক পরম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করছিলেন তাঁরা, কিন্তু তখনও তাঁদের হাতে প্রজাদের অবারিত বুদ্ধিবৃত্তিক স্বাধীনতা দেওয়ার মতো সম্পদ ছিল না। ইনকুইজিটররা ভিন্নমতাবলম্বীদের খুঁজে বের করে তাদের ‘হেরেসি’ (ধর্মহীনতা) ত্যাগে বাধ্য করতেন: এই শব্দটির আদি গ্রিক অর্থ ছিল ‘কারও নিজের পথে যাওয়া। স্প্যানিশ ইনকুইজিশন অতীতের বিশ্বকে ধরে রাখার প্রাচীন কোনও প্রয়াস ছিল না। আধুনিকায়নের প্রতিষ্ঠান ছিল এটা, জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে রাজা-রানি এর পত্তন ঘটিয়েছিলেন। তাঁরা খুব ভালো করেই জানতেন, ধর্ম একটি বিস্ফোরক ও বিপ্লবী শক্তিতে পরিণত হতে পারে। ইংল্যান্ডের মতো দেশগুলোতে প্রটেস্ট্যান্ট শাসকগণ একইভাবে তাঁদের ক্যাথলিক ‘ভিন্নমতাবলম্বীদের’ প্রতি খড়গহস্ত ছিলেন; তাদেরও রাষ্ট্রের প্রতিপক্ষ বিবেচনা করা হয়েছিল। আমরা দেখব এই ধরনের নির্যাতন ছিল আধুনিকায়ন প্রক্রিয়ারই অংশ। স্পেনে ইনকুইজিশনের প্রধান শিকার ছিল ইহুদিরা; এই অধ্যায়ে আমরা আগ্রাসী আধুনিকতার প্রতি ইহুদি জনগণের সাড়াই আলোচনা করব। তাদের অভিজ্ঞতা বিশ্বের অন্যান্য অংশের মানুষ কীভাবে আধুনিকতার প্রতি সাড়া দেবে সেই সম্পর্কে বিভিন্ন উপায়ের অনেকগুলোই তুলে ধরে।

আল-আন্দালুসের পুরোনো মুসলিম এলাকার স্প্যানিশ রিকনকুইস্তা ইবারিয়ার ইহুদিদের পক্ষে ছিল রীতিমতো বিপর্যয়। ইসলামি রাষ্ট্রে ইহুদিবাদ, ক্রিশ্চানিটি ও ইসলামের মতো তিনটি ধর্ম পাঁচ শো বছরেরও বেশি কাল একসাথে সম্প্রীতির ভেতর বাস করে এসেছে। বিশেষ করে ইহুদিরা স্পেনে সাংস্কৃতিক ও আধ্যাত্মিক রেনেসাঁ উপভোগ করেছে, ইউরোপের বাকি অংশে ইহুদি জনগণের নিয়তিতে পরিণত হওয়া বিভিন্ন হত্যালীলার শিকার হতে হয়নি তাদের। কিন্তু ক্রিশ্চান সেনাবাহিনী ইসলামের আরও অনেক অনেক ভূখণ্ড অধিকার করে পেনিনসুলা ধরে ক্রমে অগ্রসর হওয়ার সাথে সাথে অ্যান্টি-সেমিটিজমকেও সাথে করে নিয়ে আসছিল তারা। ১৩৭৮ ও ১৩৯১ সালে আরাগন ও ক্যাস্তিলের ইহুদি সম্প্রদায় ক্রিশ্চানদের হাতে আক্রান্ত হয়েছিল, ইহুদিদের জোর করে দীক্ষা দানের ঝর্নার কাছে এনে মরণ যন্ত্রণা দিয়ে ক্রিশ্চান ধর্ম গ্রহণে বাধ্য করেছিল তারা। আরাগনে দোমেনিকান ফ্রায়ার ভিনসেন্ত ফেরারের (১৩৫০-১৪১৯) ধর্মপ্রচারণা নিয়মিতভাবেই অ্যান্টি-সেমিটিক দাঙ্গা উস্কে দিত। ফেরার র‍্যাবাই ও ক্রিশ্চানদের ভেতর বিভিন্ন বিতর্কেরও আয়োজন করতেন, ইহুদি ধর্মকে খাট করাই এর উদ্দেশ্য ছিল। কোনও কোনও ইহুদি নির্যাতন এড়াতে স্বেচ্ছায় ক্রিশ্চান ধর্মে দীক্ষা নিয়েছিল। সরকারীভাবে তারা কনভার্সোর্স (কনভার্টস) নামে পরিচিত ছিল, যদিও ক্রিশ্চানরা তাদের মারিনোস (‘শুয়োর’) বলে ডাকত, গালির ভাষা হলেও ধর্মান্তরিতদের কেউ কেউ একে অহঙ্কারের তকমা হিসাবে ধারণ করেছিল। র‍্যাবাইগণ ধর্মান্তরের ব্যাপারে ইহুদিদের সতর্ক করে দিয়েছিলেন, কিন্তু প্রথম দিকে ‘নিউ ক্রিশ্চানরা’-কনভাসোর্সদের যেনামে ডাকা হত-সম্পদশালী ও সফল হয়ে উঠেছিল। উচ্চপদস্থ যাজকে পরিণত হয়েছিলেন কেউ কেউ, অন্যরা সেরা পরিবারে বিয়ে করে, আবার অনেকেই ব্যবসাবাণিজ্যে লক্ষণীয় সাফল্য লাভ করে। ‘পুরোনো ক্রিশ্চান’রা ইহুদিবাদী ক্রিশ্চানদের সমাজের উপরের দিকে যাত্রা অসন্তোষের চোখে দেখায় এতে এক নতুন সমস্যা সৃষ্টি হয়। ১৪৪৯ ও ১৪৭৪ সালের মধ্যবর্তী সময়ে মারানোদের বিরুদ্ধে ঘনঘন দাঙ্গার ঘটনা ঘটেছে, তাদের হত্যা করা হয়েছে, সম্পদের বিনাশ সাধন করা হয়েছে কিংবা শহর ছাড়া করা হয়েছে।

এই ধরনের ঘটনাপ্রবাহে সতর্ক হয়ে ওঠেন ফার্দিনান্দ ও ইসাবেলা। ইহুদিদের ধর্মান্তরকরণ তাদের ঐক্যবদ্ধ রাজ্যকে কাছাকাছি আনার বদলে বরং নতুন করে বিভাজনের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছিল। ‘নতুন ক্রিশ্চানদের’ কারও কারও আবার তাদের পুরোনো ধর্মবিশ্বাসে ফিরে গোপনে ইহুদি মতে জীবনযাপন করার সংবাদে অসন্তুষ্ট বোধ করেছেন ফার্দিনান্দ ও ইসাবেলা। বলা হয়ে থাকে, তাঁরা অন্য কনভার্সোদের আবার পুরোনো ইহুদি বলয়ে ফিরিয়ে নিতে প্রলুব্ধ করতে একটা গোপন সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছিল। এই গোপন ইহুদিদের খুঁজে বের করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল ইনকুইজিটরদের, শুয়োরের মাংস খেতে অস্বীকৃতি বা শনিবারে কাজে যাবার অস্বীকৃতির মতো কর্মকাণ্ড থেকে যাদের শনাক্ত করা সম্ভব। সন্দেহভাজনরা নিজেদের অবিশ্বাস স্বীকার ও অন্যান্য গোপন ‘জুদাইযার’দের সম্পর্কে খবর না দেওয়া পর্যন্ত তাদের উপর নির্যাতন চালানো হত। এর ফলে ইনকুইজিশনের প্রথম বার বছর সময়কালে আনুমানিক ১৩,০০০ কনভার্সো নিহত হয়েছিল। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে নিহত, বন্দি বা যাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল তাদের অনেকেই ছিল বিশ্বস্ত ক্যাথলিক, তাদের মোটেই কোনওরকম ইহুদি প্রবণতা ছিল না। এই অভিজ্ঞতা বহু কনভার্সোকে তাদের নতুন ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে তিক্ত ও সংশয়বাদী করে তোলে, এবং সেটা অস্বাভাবিক নয় মোটেই।

১৪৯২ সালে ফার্দিনান্দ ও ইসাবেলা গ্রানাদা অধিকার করার সময় ওই নগর- রাষ্ট্রে একটি নতুন ও উল্লেখযোগ্য ইহুদি সম্প্রদায়কে পেয়েছিলেন তাঁরা। তাঁরা ভেবেছিলেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে, ইহুদি সমস্যার চূড়ান্ত সমাধান হিসাবে এই দুই রাজণ্য এডিক্ট অভ এক্সপালশনে স্বাক্ষর দেন। স্প্যানিশ ইহুদি সম্প্রদায় ধ্বংস করে দেওয়া হয়। আনুমানিক ৭০,০০০ ইহুদি ক্রিশ্চান ধর্ম গ্রহণ করে ইনকুইজিশনে আক্রান্ত হতে রয়ে যায়; অবশিষ্ট ১৫০,০০০ ইহুদি, আমরা যেমন দেখেছি, চলে যায় নির্বাসনে। স্পেনের ইহুদি সম্প্রদায়ের বিনাশ জেরুজালেমে ৭০ সিই’র মন্দির ধ্বংসের পর জাতির উপর নেমে আসা সবচেয়ে বিরাট বিপর্যয় হিসাবে বিশ্বজুড়ে শোকের সাথে প্রত্যক্ষ করা হয়। ইহুদিরা সেই সময় তাদের দেশ হারিয়ে প্যালেস্তাইনের বাইরে সম্মিলিতভাবে ডায়াসপোরা নামে পরিচিত বিভিন্ন বিক্ষিপ্ত সম্প্রদায়ে বাস করতে নির্বাসনে যেতে বাধ্য হয়েছিল। সেই থেকে ইহুদি জীবনে নির্বাসন এক বেদনাদায়ক লাইটমোটিফ হয়ে ছিল। ১৪৯২ সালে স্পেন থেকে বিতাড়নের ঘটনা ঘটেছিল ইউরোপের বিভিন্ন অংশ থেকে একের পর এক ইহুদিদের উৎখাতের ঘটনা ঘটার এক শতাব্দীর পর। ভিয়েনা ও লিনয থেকে ১৪২১ সালে উৎখাত করা হয় তাদের, কোলন থেকে ১৪২৪ সালে; অসবার্গ থেকে ১৪৩৯ সালে, ১৪৪২ সালে বাভারিয়া থেকে ও রাজধানী শহর মোরাভিয়া থেকে ১৪৫৪ সালে। পেরুগিয়া (১৪৮৫), ভিসেনযা (১৪৮৬), পারমা (৪৮৮), মিলান ও লুক্কা (১৪৮৯) ও ১৪৯৪ সালে তাসকানির মতো প্রধান প্রধান শহর থেকে ইহুদিদের বিতাড়ন করা হয়েছিল। আস্তে আস্তে পোল্যান্ডে পা রাখার মতো একটা শক্ত জায়গা প্রতিষ্ঠা করছে ভেবে পুবে ভেসে যেতে থাকে ইহুদিরা।’ নির্বাসনকে এই সময় ইহুদি জীবনের অপরিহার্য অসুখ বলে মনে হচ্ছিল।

নিশ্চিতভাবেই উৎখাতের পর অটোমান সাম্রাজ্যের উত্তরে বিভিন্ন আফ্রিকান ও বালকান প্রদেশে আশ্রয় নেওয়া স্প্যানিশ ইহুদিদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল এটা। মুসলিম সমাজের সাথে চলতে অভ্যস্ত ছিল তারা, কিন্তু স্পেনের-বা সেফরাদ, ওরা যেনামে ডাকত-পরাজয় এক গভীর মনস্তাত্ত্বিক ক্ষত সৃষ্টি করেছিল। এইসব সেফারদিক ইহুদিরা মনে করেছিল যে খোদ তারা ও বাকি সবকিছু ওলটপালট হয়ে গেছে। নির্বাসন যেমন আধ্যাত্মিক তেমনি ভৌত স্থানচ্যুতিও বটে। নির্বাসিতদের জগৎ সম্পূর্ণ অজানা এবং সেকারণে অর্থহীন। সমস্ত স্বাভাবিক সমর্থন ছিনিয়ে নেওয়া সহিংস উদ্বাস্তু হওয়ার ঘটনা আমাদের জগৎ ভেঙে দেয়, আমাদের পরিচয়ের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ স্মৃতিতে সংশ্লিষ্ট জায়গাগুলো থেকে আমাদের চিরকালের জন্যে ছিন্ন করে ও স্থায়ীভাবে এক অচেনা পরিবেশে ছুঁড়ে দেয়, যাতে করে আমাদের মনে এমন ধারণা সৃষ্টি করতে পারে যে খোদ অস্তিত্বই বিপদাপন্ন হয়ে পড়েছে। নির্বাসন মানুষের নিষ্ঠুরতার সাথে সম্পর্কিত হলেও একজন ন্যায়পরায়ণ ও দয়াময় ঈশ্বরের যে জগৎ নির্মাণের কথা সেখানে অশুভের সমস্যা নিয়ে নানা জরুরি প্রশ্নও উঠে আসে।

সেফারদিক ইহুদিদের অভিজ্ঞতা উৎখাত ও স্থানচ্যুতির চরম ধরন ছিল, পরবর্তীকালে মানুষ আগ্রাসী আধুনিকায়নের প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর এর স্বাদ পাবে। আমরা দেখব যে, আধুনিক পাশ্চাত্য সভ্যতা এক ভিন্ন পরিবেশে শেকড় বিস্তার করেছিল। সংস্কৃতিকে তা এমন ভীষণভাবে বদলে দিয়েছিল যে অনেক মানুষই নিজেদের বিচ্ছিন্ন ও দিশাহারা বোধ করেছে। পুরোনো পৃথিবীকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছিল আর নতুন বিশ্ব এতটাই অচেনা ছিল যে, লোকে তাদের একসময়ের চারপাশের পরিচিত পরিবেশও আর চিনতে পারছিল না। নিজেদের জীবনের কোনও অর্থ খুঁজে পাচ্ছিল না। সেফারদিকদের মতো অনেকের মনেই এই বিশ্বাস দৃঢ় হয়ে গেঁথে গিয়েছিল যে, তাদের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়েছে। এই বিভ্রান্তি ও বেদনার ভেতর অনেকেই কোনও কোনও স্প্যানিশ নির্বাসিতের মতোই আচরণ করেছে। ধর্মের শরণাপন্ন হয়েছে তারা। কিন্তু তাদের জীবনধারা সম্পূর্ণ পাল্টে যাওয়ায় তাদের প্রবলভাবে বদলে যাওয়া পরিস্থিতিতে প্রাচীন ঐতিহ্যকে ভাষা দেওয়ার জন্যে ধর্মবিশ্বাসকে নতুনভাবে বিকশিত করতে হয়েছিল।

কিন্তু এর জন্যে সময়ের প্রয়োজন হয়েছে। ষোড়শ শতকের গোড়ার দিকে নির্বাসিত ইহুদিরা জানতে পারে, প্রচলিত ইহুদি ধর্মমত তাদের জন্যে কিছুই করেনি। বিপর্যয়কে নজীরবিহীন মনে হয়েছে। তারা আবিষ্কার করে যে, পুরোনো ধার্মিকতা আর কাজে আসছে না। কেউ কেউ মেসিয়ানিজমের আশ্রয় নিয়েছে। শত শত বছর ধরে একজন মেসায়াহর অপেক্ষা করে আসছিল ইহুদিরা: রাজা ডেভিডের বংশে একজন মনোনীত রাজা, যিনি তাদের দীর্ঘ নির্বাসনের অবসান ঘটাবেন, আবার প্রতিশ্রুত ভূমিতে ফিরিয়ে নিয়ে যাবেন তাদের। ইহুদিদের কিছু কিছু ঐতিহ্যে মেসায়াহর আবির্ভাবের ঠিক আগের একটা পর্যায়ে উত্তাল এক পর্বের উল্লেখ ছিল। বালকানে আশ্রয় নেওয়া কোনও কোনও সেফারদিক নির্বাসিতের কাছে মনে হয়েছে যে, ওদের উপর ও ইউরোপে তাদের আরও অসংখ্য স্বজাতির উপর নেমে আসা এই ভোগান্তি ও নিপীড়ন কেবল একটা জিনিসই তুলে ধরতে পারে: এটা নিশ্চয়ই পয়গম্বর ও সাধুদের মুখে উচ্চারিত সেই বিচারের কাল, একে তারা ‘মেসায়াহর প্রসব বেদনা’ আখ্যায়িত করেছে, কারণ এই যন্ত্রণাদায়ক মুক্তির ভেতর দিয়েই আবির্ভাব ঘটবে নতুন জীবনের। অন্য যারা আধুনিকতার আগমনে তাদের জগৎ ধ্বংস হয়ে গেছে মনে করেছিল, তারাও মিলেনিয়াল আশার বিকাশ ঘটাবে। কিন্তু মেসিয়ানিজম সমস্যা-সঙ্কুল, কারণ এপর্যন্ত একজন অত্যাসন্ন ত্রাণকর্তার আবির্ভাবের আশা পোষণ করা প্রতিটি মেসিয়ানিক আন্দোলনই হতাশায় পর্যবসিত হয়েছে। সেফারদিক ইহুদিরা আরও সন্তোষজনক সমাধান বের করে এই টানাপোড়েন এড়িয়ে গেছে। এক নতুন মিথোস গড়ে তোলে তারা।

সেফারদিকদের একটা দল বালকান্স থেকে প্যালেস্তাইনে পাড়ি জমিয়েছিল। এখানে গালিলির সেফেদে বসতি গড়ে তারা। কিংবদন্তী প্রচলিত ছিল যে, মেসায়াহর আবির্ভাব ঘটার সময় গালিলিতেই নিজেকে প্রকাশ করবেন তিনি। সবার আগে তাঁকে স্বাগত জানাতে সেখানে হাজির থাকতে চেয়েছিল স্পেনিয় নির্বাসিতরা।” তাদের কেউ কেউ বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল যে, একজন সাধুসুলভ শীর্ণ অ্যাশকেনাযিয় ইহুদি ইসাক লুরিয়ার (১৫৩৪-৭৩) মাঝে তাঁকে পেয়েছে। সেফেদে বসতি গেড়েছিলেন তিনি। তিনিই প্রথম নতুন এই মিথ উল্লেখ করেন। এভাবে তিনি এক নতুন ধরনের কাব্বালাহর প্রতিষ্ঠা করেন যা এখনও তাঁর নাম ধারণ করে আছে। আমরা আধুনিকরা বলব যে, খোদ লুরিয়াই এই মিথ সৃষ্টি করেছিলেন, মানুষের অবচেতনে আকাঙ্ক্ষা ও ভীতির সাথে যারপরনাই নিবিড়ভাবে অভ্যস্ত থাকায় এমন একটি কাল্পনিক কাহিনী তৈরি করতে সক্ষম হয়ে উঠেছিলেন তিনি যা কেবল সেফেদের নির্বাসিতদের মাঝেই নয় বরং গোটা পৃথিবীর ইহুদিদের মাঝে স্বস্তি ও আশার সঞ্চার করতে পেরেছিল। কিন্তু আমাদের এমন কথা বলার কারণ, মূলত আমরা যৌক্তিক ভিত্তিতে কথা বলে থাকি। ফলে প্রাক-আধুনিক পৌরাণিক বিশ্বদৃষ্টিতে প্রবেশ কঠিন আবিষ্কার করি। লুরিয়ার শিষ্যরা তিনি সৃষ্টির এই মিথ তৈরি করেছেন’ মনে করেনি, বরং তারা মনে করেছে মিথটি নিজেই তাঁর মাঝে নিজেকে প্রচার করেছে। লুরিয়ানিক কাব্বালাহর আচার ও অনুশীলনে অভ্যস্ত নয় এমন কোনও বহিরাগতের কাছে এই সৃষ্টি-কাহিনী আজগুবী ঠেকে। তার উপর এই কাহিনীর সাথে বুক অভ জেনেসিসের সৃষ্টি কাহিনীর কোনওই মিল নেই; কিন্তু একজন কাব্বালিস্ট সেফেদের কাছে-লুরিয়া নির্দেশিত আচার ও ধ্যানমূলক অনুশীলনে মগ্ন, কিন্তু তারপরও নির্বাসনের পুরো এক প্রজন্ম পরেও সেই ঘটনার ধাক্কায় দিশাহারা-মিথোস নিখুঁত অর্থ প্রকাশ করেছে। এটা এমন এক সত্যকে তুলে ধরেছে বা ‘উন্মুক্ত’ করেছে যা আগে থেকেই স্পষ্ট ছিল বটে কিন্তু প্রাক-আধুনিক কালের ইহুদিদের অবস্থার সাথে এমন জোরের সাথে সাড়া দিয়েছে যে নিমেষে কর্তৃত্ব লাভ করেছে। তাদের অন্ধকার জগৎকে আলোকিত করে তুলেছে এটা ও জীবনকে কেবল সহনীয় নয়, আনন্দময়ও করে তুলেছে। লুরিয়া সৃষ্টি মিথের মুখোমুখি হওয়ামাত্র একজন আধুনিক মানুষ জানতে চাইবে, ‘সত্যিই কি এমনটা ঘটেছিল?’ ঘটনাপ্রবাহকে এতটাই অসম্ভব মনে হয় এবং যার প্রমাণ করা যাবে না বলে একে আমরা প্রমাণের দিক থেকে মিথ্যা হিসাবে নাকচ করে দেব। কিন্তু তার কারণ আমরা কেবল সত্যির যৌক্তিক ভাষ্যকে গ্রহণ করে থাকি বলে, আরও কোনও ধরন থাকতে পারার বোধ হারিয়ে ফেলায়। উদাহরণ স্বরূপ, আমরা ইতিহাসের বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ গড়ে তুলেছি, একে আমরা অসাধারণ সব ঘটনার পর্যায়ক্রমিক সংঘটন হিসাবে দেখি। কিন্তু প্রাক-আধুনিক বিশ্বে ইতিহাসের বিভিন্ন ঘটনাকে একক হিসাবে নয়, চিরন্তন বিধানের নজীর, সময়হীন স্থির বাস্তবতার প্রকাশ হিসাবে দেখা হত। কোনও ঐতিহাসিক ঘটনা বারবার সংঘটিত হওয়ার কথা ছিল, কেননা সকল পার্থিব ঘটনাপ্রবাহই অস্তিত্বের মৌল বিধান প্রকাশ করে থাকে। উদাহরণস্বরূপ, বাইবেলে একটি নদী অলৌকিকভাবে অন্তত দুটি ঘটনায় দুই ভাগ হয়ে ইসরায়েলিদের এগিয়ে যাবার সুযোগ করে দিয়েছে: ইসরায়েলের সন্তানগণ প্রায়শঃই মিশরে ‘যাতায়াত করে’ এবং তারপর প্রতিশ্রুত ভূমিতে ফিরতি যাত্রা শুরু করে। বাইবেলের অন্যতম পৌনঃপৌনিক ঘটনা নির্বাসন। স্পেনিয় বিপর্যয়ের পর যা গোটা ইহুদি অস্তিত্বকে রঞ্জিত করেছে বলে মনে হয়েছে এবং অস্তিত্বের একেবারে মূল ভিত্তিতে ভারসাম্যহীনতার প্রতিফলন ঘটিয়েছে। লুরিয়ানিক কাব্বালাহ সকল মিথোলজির বেলায় অবশ্যাম্ভাবী এইসব মৌল বিধানের অন্যতম মনে হওয়া নির্বাসনকে পরখ করে এর পূর্ণ তাৎপর্য উন্মোচনের জন্যে সূচনায় প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমে সমস্যার মোকাবিলা করেছে।

লুরিয়া’র মিথে এক স্বেচ্ছানির্বাসনের ভেতর দিয়ে সৃষ্টি প্রক্রিয়ার সূচনা ঘটছে। ঈশ্বর সর্বব্যাপী হলে কীভাবে বিশ্ব অস্তিত্বমান থাকতে পারে, এই জিজ্ঞাসার ভেতর দিয়ে এর শুরু। জবাব হচ্ছে যিমযুম (‘প্রত্যাহার’)-এর মতবাদ: অসীম ও দুর্ভেয় গডহেড, কাব্বালিস্টরা যাকে বলে এন সফ (‘অন্তহীন’), বিশ্বকে স্থান করে দিতে, যেমন বলা হয়েছে, নিজের মাঝে একটা এলাকা উন্মুক্ত করার জন্যে নিজের মাঝে নিজেই সঙ্কুচিত হতে বাধ্য হয়েছিলেন। সুতরাং, সৃষ্টির সূচনা ঘটেছিল ঐশী একটা ঘটনার ভেতর দিয়েঃ সৃষ্টির ভেতর ও তাদের সাহায্যে নিজেকে প্রকাশ করার আবেগময় ইচ্ছা থেকে এন সফ নিজেরই একটা অংশের উপর নির্বাসন চাপিয়ে দিয়েছিলেন। জেনেসিসের প্রথম অধ্যায়ে বর্ণিত শৃঙ্খলাপূর্ণ, শান্তিময় সৃষ্টির বদলে এটা ছিল আদিম বিস্ফোরণ, বিপর্যয় ও মিথ্যা সূচনা, সেফারদিক নির্বাসিতদের কাছে যাকে তাদের যাপিত বিশ্বের অনেক বেশি সঠিক মূল্যায়ন মনে হয়েছে। লুরিয় প্রক্রিয়ার গোড়ার দিকের পর্যায়ে এন সফ যিমযুমের মাধ্যমে সৃষ্ট শূন্যতাকে ঐশী আলো দিয়ে পূরণ করার প্রয়াস পেয়েছিলেন, কিন্তু আলো বয়ে নিয়ে যাবার কথা ছিল যেসব ‘পাত্র’ বা ‘নল’-এর, চাপে সেগুলো ভেঙে যায়। ঐশী আলোর স্ফুলিঙ্গসমূহ ঈশ্বর নয়, এমন সব বস্তুর মহাগহ্বরে পতিত হয়। ‘পাত্রের ভাঙনের’ পর স্ফুলিঙ্গের কিছু অংশ গডহেডের কাছে ফিরে যায়, কিন্তু অবশিষ্টগুলো অশুভ সম্ভাবনায় পরিপূর্ণ ঈশ্বরহীন বলয়ে বন্দি হয়ে থাকে, এন সফ যাকে যিমযুম প্রক্রিয়ার সময় নিজের ভেতর থেকে দূর করে দিয়েছিলেন। এই বিপর্যয়ের পর সৃষ্টিকর্ম অবিন্যস্ত হয়ে পড়ে, সবকিছু উল্টাপাল্টা জায়গায় পড়ে যায়। আদমকে সৃষ্টি করার সময় তিনি এই পরিস্থিতি শুধরে নিতে পারতেন, তাহলে প্রথম সাব্বাতেই ঐশী নির্বাসনের অবসান ঘটতে পারত। কিন্তু আদম পাপ করলেন, তারপর থেকেই ঐশী স্ফুলিঙ্গসমূহ বস্তুগত বিষয়ে বন্দি হয়ে পড়ে; আর পৃথিবীর বুকে ঈশ্বরকে উপলব্ধি করার জন্যে আমরা যে সত্তার সবচেয়ে কাছাকাছি যেতে পারি, সেই শেকিনাহ গডহেডের সাথে মিলিত হওয়ার আকাঙ্ক্ষায় এক চিরস্থায়ী নির্বাসনে জগত্ময় ঘুরে বেড়াতে থাকেন।

এটা কল্পগল্প, কিন্তু সেফেদের কাব্বালিস্টদের যদি জিজ্ঞেস করা হত যে আদৌ ব্যাপারটা এভাবেই ঘটেছিল বলে তারা বিশ্বাস করে কিনা, প্রশ্নটিকেই অপর্যাপ্ত মনে করত তারা। মিথের বর্ণিত আদিম ঘটনাটি সুদূর অতীতে কোনও এক সময় ঘটে যাওয়া একটি ঘটনামাত্র নয়। অমন একটা ঘটনা বর্ণনা করার মতো কোনও ধারণা বা শব্দ আমাদের জানা নেই, কারণ আমাদের যৌক্তিক সমাজ সময়কে কঠোরভাবে পর্যায়ক্রমিক হিসাবে দেখে। প্রাচীন গ্রিসের এলিউসিসের উপাসকদের যদি জিজ্ঞেস করা হত যে, প্লেটো সত্যিই পারসেফোনকে পাতালে নিয়ে বন্দি করে রাখায় তাঁর মা দিমিতার মেয়ের শোকে দিদ্বিদিক ঘুরে বেড়িয়েছেন কিনা, তাহলে এমনি ধারার প্রশ্নে তারা সম্ভবত বিস্মিত হয়ে যেত। তারা কেমন করে নিশ্চিত হবে যে পারসেফোনের মিথে যেভাবে উল্লেখ করা হয়েছে সেভাবে পৃথিবীতে ফিরে গিয়েছিলেন কিনা? কারণ এই মিথোসের তুলে ধরা জীবনের মৌলিক ছন্দ আসলে ঘটছিল। জমিনের ফসল তোলা হয়েছে, ভূগর্ভস্থ পাত্রে রাখা হয়েছে ভূট্টার ভীজ ঠিক সময়ে বপন করা হয়েছে এবং শেষে শস্য বেড়ে উঠেছে।১২ মিথোস ও ফসল তোলার ঘটনা, উভয়ই বিশ্ব সম্পর্কে মৌল এবং বিশ্বজনীন একটা কিছুর দিকে ইঙ্গিত দেয়, অনেকটা ইংরেজি শব্দ ‘নৌকা’ আর ফরাসি শব্দ ‘বাতেউর মতো; দুটোই এমন এক বাস্তবতার দিকে ইঙ্গিত করে যা উভয় পরিভাষার অতীত ও স্বাধীন। সেফারদিক ইহুদিরা সম্ভবত একই ধরনের জবাব দিত। নির্বাসন ছিল অস্তিত্বের মৌল বিধি। আপনি যেদিকে তাকাতেন, ইহুদিরা ছিল উন্মূল বিদেশি। এমনকি জেন্টাইলরাও ক্ষতি, হতাশা ও জগতে তারা ঠিক অভ্যস্ত নয়, এমন এক ধরনের অভিজ্ঞতার লাভ করেছে-প্রথম মানুষ জাতির আদিম স্বর্গ হতে নির্বাসিত হওয়ার বিশ্বজনীন মিথে যেমন প্রত্যক্ষ করা গেছে। লুরিয়ার জটিল সৃষ্টি কাহিনী এটা তুলে ধরেছে ও সম্পূর্ণ নতুনভাবে একে স্পষ্ট করে তুলেছে। শেকিনাহর নির্বাসন ও স্থানচ্যুত মানুষ হিসাবে তাদের নিজস্ব জীবন ভিন্ন দুটি বাস্তবতা ছিল না, বরং ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল। যিমযুম দেখিয়েছে যে সত্তার একেবারে ভিত্তি মূলেই নির্বাসন খোদাই হয়ে আছে।

লুরিয়া লেখক ছিলেন না, জীবদ্দশায় খুব সামান্য সংখ্যক লোকের কাছেই তাঁর শিক্ষা অবহিত ছিল।[১৩] কিন্তু শিষ্যরা উত্তরপুরুষের জন্যে তাঁর রচনাবলী রক্ষা করেছেন ও অন্যরা তা ইউরোপে ছড়িয়ে দিয়েছেন। ১৬৫০ সাল নাগাদ লুরিয় কাব্বালাহ এক গণআন্দোলনে পরিণত হয়; সেই সময় এটাই ছিল ইহুদিদের মাঝে সাধারণ গ্রহণযোগ্যতা লাভকারী একমাত্র আদর্শিক ব্যবস্থা।” যৌক্তিক বা বৈজ্ঞানিকভাবে একে প্রমাণ করা সম্ভব ছিল বলে এমনটা ঘটেনি, কেননা নিশ্চিতভাবেই সেটা সম্ভব ছিল না। প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই জেনেসিসের সাথে এর বিরোধ ছিল স্পষ্ট। কিন্তু আমরা যেমন দেখব, ঐশীগ্রন্থের আক্ষরিক পাঠ একটা আধুনিক ধারণা, পৌরাণিক সচেতনতার উপর যৌক্তিক মনের জয়লাভের ফলেই এর বিকাশ ঘটেছে। আধুনিক কালের আগের ইহুদি, ক্রিশ্চান ও মুসলিমরা সবাই তাদের পবিত্র টেক্সটের দারুণ রকম রূপক, প্রতীকী ও নিগূঢ় ব্যাখ্যার রসআস্বাদন করত। ঈশ্বরের বাণী অসীম হওয়ায় তার নানা রকম অর্থ নিয়ে উপস্থিত হওয়ার ক্ষমতা ছিল। সুতরাং, বাইবেলের সরলার্থ হতে লুরিয়ার সরে যাওয়া দেখে ইহুদিরা বিচলিত বোধ করেনি, যেমনটা অনেক আধুনিক ব্যক্তি করবে। তাঁর মিথ কর্তৃত্বের সাথে তাদের প্রতি সাড়া দিয়েছে, কারণ এটা তাদের জীবনকে ব্যাখ্যা করেছে, অর্থের যোগান দিয়েছে তাদের। অস্তিত্ব লাভ করতে চলা আধুনিক জগৎ হতে উৎখাত হয়ে ইহুদিদের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীতে পরিণত হওয়ার অভিজ্ঞতা ছিল অস্তিত্বের মৌল বিধানের সাথে মানানসই। এমনকি খোদ ঈশ্বর নির্বাসনে কষ্ট পেয়েছেন, একেবারে সূচনা থেকেই সৃষ্টির সমস্ত কিছুই স্থানচ্যুত হয়েছিল, ঐশী স্ফুলিঙ্গ বস্তুতে বন্দি হয়েছে আর জীবনের এক সর্বব্যাপী সত্যি অশুভের সাথে যুদ্ধ করতে বাধ্য হয়েছে শুভ। এছাড়া, ইহুদিরা প্রত্যাখ্যাত ও অস্পৃশ্য ছিল না, বরং নিস্তার প্রক্রিয়ায় তারাই কেন্দ্রিয় ভূমিকা পালনকারী। মোজেসের বিধান তোরাহর বিভিন্ন নির্দেশনার সযত্ন পালন ও সেফেদে বিকশিত বিভিন্ন আচার সম্পাদন এই বিশ্বজনীন নির্বাসনের অবসান ঘটাতে পারে। ইহুদিরা এভাবে গডহেডের সাথে শেকিনাহর ‘পুনঃস্থাপন’ (তিক্কুন), ইহুদি জাতিকে প্রতিশ্রুত ভূমিতে ফিরিয়ে নেওয়া ও বিশ্বের বাকি অংশকে তার নির্দিষ্ট জায়গায় স্থাপন করার কাজে সাহায্য করতে পারে।[১৫]

ইহুদিদের কাছে মিথটি গুরুত্বপূর্ণ রয়ে গিয়েছে। অনেকেই আবিষ্কার করেছিল যে, হলোকাস্টের ট্র্যাজিডির পর তারা ঈশ্বরকে কেবল যিমযুমের কষ্টসওয়া অক্ষম ঐশী সত্তা হিসাবে দেখছিল, যিনি আর সৃষ্টির নিয়ন্ত্রণে নেই।” বস্তুতে আটকা পড়া ঐশী স্ফুলিঙ্গের ইমেজারি ও তিক্কুনের পুনঃস্থাপনের মিশন এখনও আধুনিক মৌলবাদী ইহুদি আন্দোলনসমূহকে অনুপ্রাণিত করে চলেছে। সকল সত্যি মিথের মতো লুরিয় কাব্বালাহ ছিল এক উন্মোচন, ইহুদিদের দেখিয়ে দিয়েছিল তাদের জীবন আসলে কী, কী তার অর্থ। মিথটি এর নিজস্ব সত্যি ধারণ করে। এবং কোনও গভীর স্তরে স্বপ্রকাশিত। এটা যেমন যৌক্তিক প্রমাণ গ্রহণ করতে পারে না, তেমনি এর তার কোনও প্রয়োজনও নেই। আজকের দিনে আমাদের উচিত হবে লুরিয় কাব্বালাহকে প্রতীক বা উপমা হিসাবে আখ্যায়িত করা, কিন্তু সেটাও একে যৌক্তিকভাবে বন্দি করারই শামিল হবে। মূল গ্রিকে ‘প্রতীক’ শব্দটির মানে ছিল দুটি বস্তুকে এক করা যাতে তারা অবিচ্ছেদ্য হয়ে ওঠে। কিন্তু যখনই পশ্চিমের লোকজন কোনও আচার বা আইকন ‘কেবল প্রতীকমাত্র’ বলতে শুরু করল, তখনই এমনি বিচ্ছেদের উপর গুরুত্ব আরোপকারী আধুনিক চেতনা আবির্ভূত হয়েছিল।

প্রথাগত ধর্মে মিথ কাল্ট হতে অবিচ্ছেদ্য, বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও ধ্যানমূলক অনুশীলনের ভেতর দিয়ে তা উপাসকদের ইহজাগতিক জীবনে চিরন্তন বাস্তবতাকে হাজির করে। এর প্রতীকীবাদের শক্তি সত্ত্বেও লুরিয়ানিক কাব্বালাহ নির্বাসিতের মাঝে এক ধরনের দুয়ের বোধ জাগিয়ে তোলার মতো চমৎকার আচারের মাধ্যমে প্রকাশ করা না হলে ইহুদি অবস্থার প্রতি এতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারত না। সাফেদে কাব্বালিস্টরা লুরিয়ার ধর্মতত্ত্বকে নতুন করে নির্মাণ করতে বিশেষ ধরনের আচার উদ্ভাবন করেছিল। নিজেদের শেখিনাহর সাথে পরিচিত করে তুলতে তারা রাত জাগত, তাঁকে তারা বিশ্বময় দুর্গতের মতো ঘুর বেড়ানো ঐশী উৎসের আকাঙ্ক্ষাকারী নারী হিসাবে কল্পনা করত। মাঝ রাতে ঘুম থেকে জেগে পায়ের জুতো খুলে কান্নাকাটি করত ইহুদিরা, ধুলোয় মুখ ঘঁষত। এইসব আচরিক কর্মকাণ্ড নিজস্ব শোক ও পরিত্যাগের বোধ তুলে ধরার কাজে সহায়তা করেছে তাদের ও ঐশী সত্তার সহ্য করা ক্ষতির সাথে নিজেদের সম্পর্কিত করতে সাহায্য করেছে। সারারাত জেগে শুয়ে থাকত তারা, প্রেমিকের মতো ঈশ্বরকে ডাকত, যা নির্বাসিতের ভোগান্তির মূল মানুষের দুর্গতির মূলে অবস্থিত বিচ্ছিন্নতার যন্ত্রণায় বিলাপ করে চলত। প্রায়শ্চিত্তের অনুশীলনও—উপবাস, বেত্রাঘাত, বরফে গড়াগড়ি খাওয়া- তিরুনের অংশ হিসাবে পালন করা হত। পল্লী এলাকায় দীর্ঘ পথ হাঁটতে বের হত কাব্বালিস্টরা, শেকিনাহর মতো ঘুরে বেড়াত, নিজেদের উন্মুল বোধের অভিনয় করত। ইহুদি বিধানে জোর দেওয়া হয়েছে যে, সমবেতভাবে অন্তত দশ জন পুরুষ মিলে পালন করলে প্রার্থনা গভীরতম শক্তি ও অর্থ পেতে পারে। কিন্তু বিশ্বে তাদের বিচ্ছিন্নতা ও নাজুক দশার প্রকৃত বোধ পরিপূর্ণভাব উপলব্ধি করার জন্যে সাফেদে ইহুদিদের বিচ্ছিন্নভাবে প্রার্থনা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। এই একাকী প্রার্থনা ইহুদি ও সমাজের বাকি অংশের মাঝে কিছুটা দূরত্ব সৃষ্টি করে তাকে ভিন্ন ধরনের অভিজ্ঞতার জন্যে তৈরি করে দিয়েছে এবং ক্রমাগত ইহুদি জনগণের অস্তিত্বকে হুমকি দিয়ে চলা এক বিশ্বে বিপজ্জনক বিচ্ছিন্নতাকে নতুন করে উপলব্ধি করার বেলায় তাদের সাহায্য করেছে।১৭

কিন্তু লুরিয়া কোনও রকম উন্মত্ততাকে আশ্রয় না দেওয়ার ব্যাপারে অটল ছিলেন। অবশ্যই যতক্ষণ পর্যন্ত কিছু পরিমাণ আনন্দ লাভ না করতে পারছে ততক্ষণ কাব্বালিস্টদের শৃঙ্খলিত, পদ্ধতিগত উপায়ে বিষাদের ভেতর দিয়ে অগ্রসর হতে হবে। মাঝরাতের আচার সবসময়ই ভোরে শেকিনাহ ও এন সফের চূড়ান্ত পুনর্মিলনের উপর ধ্যানের ভেতর দিয়ে শেষ হত, যার অর্থ স্বর্গের সাথে মানুষের বিচ্ছিন্নতার অবসান। কাব্বালিস্টকে তার প্রতিটি অঙ্গ প্রত্যঙ্গই ঐশী সত্তার পার্থিব মন্দির বলে বিশ্বাস করার জন্যে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।১৮ সকল বিশ্বধর্মই জোর দিয়ে বলে যে বাস্তবিক সহানুভূতির বোধ না জাগালে কোনও আধ্যাত্মিকতাই বৈধ নয়। লুরিয়ার কাব্বালাহ এই দর্শনের প্রতি বিশ্বস্ত ছিল। অন্যদের আঘাত দেওয়া ভুল, যৌন হয়রানি, বিরূপ গুজব, কারও সতীর্থকে অসম্মান করা ও বাবা-মাকে অমর্যাদা করার ক্ষেত্রে কঠিন সাজার ব্যবস্থা ছিল। ১৯

সবশেষে অধিকাংশ বিশ্বধর্ম বিকশিত অতীন্দ্রিয় অনুশীলনের দীক্ষা দেওয়া হয়েছিল কাব্বালিস্টদের। দক্ষ কাব্বালিস্টকে তা মনের গভীরতর অঞ্চলে প্রবেশাধিকার লাভ ও স্বজ্ঞামূলক অন্তর্দৃষ্টি লাভে সাহায্য করেছে। সাফেদে ঈশ্বরের নাম গড়ে তোলা বিভিন্ন হরফের দক্ষ, বিস্তারিত বিনির্মাণের উপর ধ্যান কেন্দ্রিভুত ছিল। এই ‘মনোসংযোগ’ (কাওয়ানোত) কাব্বালিস্টকে নিজের ভেতর ঐশী সত্তার একটা আভাস লাভে সক্ষম করে তুলত। নেতৃস্থানীয় কাব্বালিস্টরা বিশ্বাস করতেন, সে একজন পয়গম্বরে পরিণত হবে, ঠিক লুরিয়ার মতোই এক নতুন মিথোস উচ্চারণে সক্ষম হয়ে উঠবে এবং এপর্যন্ত আলোর মুখ না দেখা সত্যির উন্মোচন ঘটাবে। এইসব কাওয়ানোত কাব্বালিস্টের জন্যে যারপরনাই আনন্দ বয়ে আনত। লুরিয়ার অন্যতম শিষ্য হাইম ভিতাল (১৫৪২-১৬২০) বলেছেন পরমানন্দের অবস্থায় আনন্দ ও বিস্ময়ের বোধ নিয়ে থরথর করে কেঁপেছেন তিনি। কাব্বালিস্টরা বিভিন্ন দৃশ্য দেখেছে ও আনন্দময় দুয়ের অনভূতি লাভ করেছে যা নিষ্ঠুর ও অচেনা মনে হওয়া একটা সময়ে বিশ্বকে বদলে দিয়েছে।

বাস্তব বলয়ে যৌক্তিক চিন্তাভাবনা বিস্ময়কর সাফল্য লাভ করেছে, কিন্তু তা আমাদের বিষাদ প্রশমিত করতে পারে না। স্পেনিয় বিপর্যয়ের পর কাব্বালিস্টরা আবিষ্কার করেছিল যে আল-আন্দালুসের ইহুদিদের ভেতর জনপ্রিয় দর্শনের যৌক্তিক অনুশীলন তাদের বেদনার প্রশমন ঘটাতে পারছে না।২১ জীবনকে মনে হয়েছে অর্থহীন; আর জীবনে অর্থ না থাকলে মানুষ হতাশায় ডুবে যেতে পারে। জীবনকে সহনীয় করে তুলতে মিথোস ও অতীন্দ্রিয়বাদের শরণাপন্ন হয়েছিল নির্বাসিতরা; এটা তাদের বেদনা, ক্ষতি ও আকাঙ্ক্ষার অবচেতন উৎসের সাথে সংযোগ স্থাপনে সক্ষম করে তোলে ও এমন এক দৃশ্যের সাথে তাদের জীবনকে বেঁধে দিয়েছিল যা তাদের জন্যে স্বস্তি বয়ে এনেছে।

অবশ্য এটা লক্ষণীয় যে, ইগনাশিয়াস অভ লায়োলার বিপরীতে লুরিয়া ও তাঁর শিষ্যগণ ইহুদিদের রাজনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে কোনও বাস্তব পরিকল্পনা নির্মাণ করেননি। কাব্বালিস্টরা ইসরায়েলের ভূমিতে থিতু হয়েছিল, কিন্তু তারা যায়নিস্ট ছিল না। লুরিয়া ইহুদিদের পবিত্র ভূমিতে পাড়ি জমানোর মাধ্যমে নির্বাসনের ইতি টানার তাগিদ দেননি। তিনি তাঁর মিথলজি বা অতীন্দ্রিয় দর্শনকে সক্রিয় কর্মকাণ্ডের নীলনকশা সৃষ্টি করার মতো কোনও আদর্শ গড়ে তোলার কাজে ব্যবহার করেননি। মিথোসের কাজ ছিল না এটা, এই ধরনের সমস্ত বাস্তব পরিকল্পনা ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ছিল লোগোসের এখতিয়ার-যৌক্তিক আলোচনামূলক চিন্তাভাবনা। লুরিয়া জানতেন, তাঁর মিশন হচ্ছে ইহুদিদের অস্তিত্বমূলক ও আধ্যাত্মিক হতাশা থেকে রক্ষা করা। পরে এইসব মিথকে রাজনীতির বাস্তব বিশ্বে প্রয়োগ করা হলে তার ফল ছিল প্রলয়ঙ্করী, যেমনটা আমরা এই অধ্যায়ে দেখতে পাব।

কাল্ট বিহীন, প্রার্থনা বিহীন ও আচার বিহীন মিথ ও মতবাদের কোনও অর্থ থাকে না। কাব্বালিস্টদের কাছে মিথকে বোধগম্য করে তোলা বিশেষ অনুষ্ঠান ও আচার বিনা লুরিয়ার সৃষ্টি-কাহিনী অর্থহীন একটা গল্পই রয়ে যেত। কেবল কোনও ধরনের ধর্মীয় শাস্ত্রীয় পরিপ্রেক্ষিতেই একটি ধর্মীয় বিশ্বাস অর্থপূর্ণ হয়ে ওঠে। মানুষ যদি এই ধরনের আধ্যাত্মিক কর্মকাণ্ড থেকে বঞ্চিত হয়, তারা তবে বিশ্বাস হারাবে। ক্রিশ্চান ধর্মে দীক্ষা নিয়ে ইবারিয় পেনিনসুলায় থেকে যাবার সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী কিছু সংখ্যক ইহুদির বেলায় ঠিক তাই ঘটেছিল। ধ্যান করে না, আচার অনুষ্ঠান পালন করে না বা আনুষ্ঠানিক লিটার্জিতে অংশ নেয় না, এমনি অনেক আধুনিক মানুষের বেলায়ও একই ঘটনা ঘটেছে যারা পরে আবিষ্কার করেছে যে ধর্মের মিথগুলো তাদের কাছে কোনও অর্থ বহন করছে না। কনভার্সোদের অনেকেই নিজেদের ক্যাথলিসিজমের সাথে একাত্ম করে নিতে পেরেছিল। কেউ কেউ প্রকৃতপক্ষেই, যেমন সংস্কারক হুয়ান দে ভালদেস (১৫০০-৪১) ও হুয়ান লুইস ভিভে (১৪৯২- ১৫৪০)-এর মতো ব্যক্তিরা কাউন্টার রিফর্মেশনের নেতায় পরিণত হয়েছিলেন ও প্রাথমিক কালের আধুনিক সংস্কৃতিতে তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রেখেছেন ঠিক যেভাবে কার্ল মার্ক্স, সিগমান্ড ফ্রয়েড, এমিলি দার্কহেইম, আলবার্ট আইনস্টাইন ও লুদভিগ ভিগেইস্তাইনের মতো সেক্যুলারায়িত ইহুদিরা মূলধারার সমাজে একীভূত হওয়ার পর পরবর্তীকালের আধুনিকতায় অবদান রেখেছেন।

এই প্রভাবশালী কনভার্সোদের অন্যতম বর্ণাঢ্য ব্যক্তি ছিলেন তেরেসা অভ আভিলা (১৫১৫-৮২), জন অভ দ্য ক্রসের শিক্ষক ও পরামর্শদাতা এবং ডক্টর অভ চার্চ উপাধি লাভকারী প্রথম নারী। স্পেনে আধ্যাত্মিকতার সংস্কারের ক্ষেত্রে অন্যতম অগ্রপথিক ছিলেন তিনি। তিনি বিশেষ করে ভালো শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত ও প্রায়শঃই অদক্ষ আধ্যাত্মিক নির্দেশকদের হাতে অস্বাস্থ্যকর অতীন্দ্রিয় অনুশীলনের শিকার হওয়া নারীদের ধর্মীয় বিষয়ে যথাযথ শিক্ষার ব্যবস্থা করার বিষয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন। তিনি জোর দিয়ে বলেছিলেন যে, হিস্টিরিয়াসুলভ ঘোর, দিব্যদৃষ্টি ও উন্মত্ততার সাথে পবিত্রতার কোনও সম্পর্ক নেই। অতীন্দ্রিয়বাদ চরম দক্ষতা, শৃঙ্খলিত মনোসংযোগ, ভারসাম্যপূর্ণ ব্যক্তিত্ব ও প্রফুল্ল, বিচক্ষণ শারীরিক অবস্থা দাবি করে এবং তাকে অবশ্যই নিয়ন্ত্রিত ও সতর্কভাবে স্বাভাবিক জীবনে সংশ্লিষ্ট থাকতে হবে। জন অভ দ্য ক্রসের মতো তেরেসা ছিলেন আধুনিকায়নকারী ও মেধাসম্পন্ন অতীন্দ্রিয়বাদী, তবু তিনি ইহুদি ধর্মে থেকে গেলে তাঁর পক্ষে এই গুণটি গড়ে তোলা সম্ভব হত না, কারণ কেবল পুরুষদেরই কাব্বালাহ অনুশীলনের অনুমতি ছিল। তারপরেও কৌতূহলোদ্দীপকভাবে তাঁর আধ্যাত্মিকতা ইহুদিবাদীই রয়ে গিয়েছিল। দ্য ইন্টেরিয়র ক্যাসল-এ সাতটি স্বগীয় দরবারের ভেতর দিয়ে আত্মার ঈশ্বরের কাছে পৌঁছানোর যাত্রাপথের বিবরণ দিয়েছেন তিনি। এই প্রকল্পের সাথে ইহুদি বিশ্বে একেবারে প্রথম থেকে শুরু করে দ্বাদশ শতাব্দী সিই পর্যন্ত বিকশিত থ্রোন মিস্টিসিজমের লক্ষণীয় সাদৃশ্য রয়েছে। নিবেদিতপ্রাণ ও বিশ্বস্ত ক্যাথলিক ছিলেন তেরেসো, কিন্তু তারপরেও ইহুদির কায়দায় প্রার্থনা করতেন, নানদেরও একইভাবে প্রার্থনা করার শিক্ষা দিতেন।

তেরেসার ক্ষেত্রে ইহুদিবাদ ও ক্রিশ্চানিটি সফলভাবে মিশে যেতে পেরেছিল, কিন্তু কম মেধা সম্পন্ন অন্য কনভার্সোর্রা বিরোধ মোকাবিলা করেছে। এমনি একটি ঘটনা হচ্ছে প্রথম গ্র্যান্ড ইনকুইজিটর তোমাস দে তোরকেমাদা (১৪২০-৯৮)-র। ২২ তিনি যেমন উৎসাহ নিয়ে স্পেন থেকে ইহুদিবাদের শেষ চিহ্নটুকু মুছে ফেলতে চেয়েছিলেন সেটা হয়তো অবচেতনভাবে তাঁর নিজের মন থেকেই পুরোনো ধর্মবিশ্বাসকে উৎক্ষিপ্ত করার প্রয়াস হয়ে থাকবে। বেশিরভাগ মারানোই নিপীড়নের মুখে ক্রিশ্চান ধর্ম গ্রহণ করেছিল। মনে হয় তাদের অনেকেই কখনওই পুরোপুরিভাবে নতুন ধর্মবিশ্বাস মেনে নিতে পারেনি। এটা মোটেও তেমন বিস্ময়কর নয়; কেননা দীক্ষা দেওয়ার পর ইনকুইজিটরদের নিবিড় পর্যবেক্ষণের অধীনে ছিল তারা, তুচ্ছ অভিযোগে যখন তখন আটক হওয়ার ভয়ে ছিল। শুক্রবার সন্ধ্যায় মোমবাতি জ্বালানো, কিংবা শেলফিশ খেতে অস্বীকৃতি কারাদণ্ড, নির্যাতন, মৃত্যু কিংবা আর কিছু না হোক সম্পত্তি বাজেয়াপ্তির মতো ব্যাপারে পর্যবসিত হতে পারত। ফলে অনেকেই ধর্ম থেকে সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। তাদের জীবনকে দুর্দশাগ্রস্ত করে তোলা ক্যাথলিক মতবাদের সাথে নিজেদের সম্পূর্ণভাবে মানিয়ে নিতে না পারেনি তারা। ১৪৯২ সালে স্পেন থেকে ব্যাপক উৎখাতের পর স্পেনে আর ধর্মাচারী ইহুদির কোনও অস্তিত্ব ছিল না। মারানোরা গোপনে ইহুদি ধর্ম চর্চা করতে চাইলেও ইহুদি বিধান বা অনুশীলন শিক্ষার কোনও উপায় ছিল না তাদের হাতে। এর পরিণামে কোনও ধর্মের প্রতিই সত্যিকারের আনুগত্য ছিল না তাদের। সেক্যুলারিজমের বহু আগেই নাস্তিক্যবাদ ও ধর্মের প্রতি নির্লিপ্ততা বাকি ইউরোপে মামুলি ব্যাপারে পরিণত হয়। আমরা ইবারিয় পেনিনসুলার মারানো ইহুদিদের ভেতর এইসব আবিশ্যিকভাবে আধুনিক প্রবণতার উদাহরণ দেখতে পাই।

ইসরায়েলি পণ্ডিত ইরমিয়াহু ইয়োভেলের মতে ধর্মের প্রতি সন্দিহান হয়ে ওঠাটা মারানোদের পক্ষে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ছিল।২৩ এমনকি ১৪৯২ সালের ব্যাপক উচ্ছেদের আগেও বিখ্যাত স্প্যানিশ পরিবারের সদস্য পেদ্রো এবং ফার্নান্দো দে লা কাবেল্লেরিয়ার মতো কেউ কেউ নিজেদের স্রেফ রাজনীতি, শিল্পকলা ও সাহিত্যে জড়িয়ে নেন, ধর্মে তাদের কোনও রকম আগ্রহ না থাকার আভাস দেন তাঁরা। প্রকৃতপক্ষেই পেদ্রো প্রকাশ্যে ভুয়া ক্রিশ্চান হওয়ার ব্যাপারে গলাবাজি করতেন; তিনি দাবি করতেন ব্যাপারটা তাঁকে পবিত্র আইন ও নিয়মকানুন নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে স্বাধীনভাবে চলার সুযোগ করে দিয়েছে।২৪ ১৪৯২ সালের অল্প কিছুদিন আগে আলবারো দে মন্তালবান নামে এক লোককে লেন্টের সময় পনির ও মাংস খাওয়ার অপরাধে ইনকুইজিটরদের সামনে হাজির করা হয়; এভাবে সে কেবল ক্রিশ্চান উপবাসই ভঙ্গ করেনি, বরং ইহুদি বিধানও লঙ্ঘন করেছে, যেখানে মাংস ও দুধ জাতীয় খাবার একসাথে খাওয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। স্পষ্টই কোনও ধর্মের প্রতিই তার কোনও অঙ্গীকার ছিল না। এই ক্ষেত্রে আলবারো জরিমানা দিয়ে পার পেয়ে যায়। ক্যাথলিসিজমে ঠেলে দেওয়ায় তার আর তেমন একটা উষ্ণ বোধ হওয়ার কারণ ছিল না। গোপনে ইহুদি ধর্মাচার পালনের দায়ে ইনকুইজিশনের হাতে নিহত হয়েছিল তার বাবা-মা। ওদের লাশ কবর থেকে তুলে আনার পর হাড়গোড় পোড়ানো হয়; সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়।২৫ ইহুদি ধর্মের সাথে এমনকি ক্ষীণ সম্পর্ক রাখতে ব্যর্থ হয়ে আলবারো ধর্মীয় শূন্যতার দিকে ঝুঁকে পড়তে বাধ্য হয়েছিল। সত্তর বছর বয়স্ক বৃদ্ধ হিসাবে শেষ পর্যন্ত পরকালের মতবাদের ইচ্ছাকৃত ও পৌনঃপৌনিক অস্বীকৃতির অপরাধে ইনকুইজিশনের হাতে কারাবন্দি হয় সে। ‘আমাকে এখানেই আরামে থাকতে দাও,’ একাধিকবার বলেছিল সে। কারণ এর পর আর কিছু আছে কিনা আমার জানা নেই।’২৬

আলবারোর বিশ্বাস বোঝায় যে তার মেয়েজামাই ট্র্যাজিকমিক রোমান্স লা সেলেস্তিনা’র রচয়িতা ফার্নান্দো দে রোয়াসও (c. ১৪৬৫-১৫৪১) সন্দেহের আওতায় এসে পড়েছিল। ফলে সম্মানিত ক্রিশ্চানিটির একটা সযত্ন ভাব ধারণ করেছিল সে। কিন্তু ১৪৯৯ সালে প্রথম প্রকাশিত তাঁর লা সেলেস্তিনায় স্থূল বাড়াবাড়ির আড়ালে এক ধরনের ক্ষীণ সেক্যুলারিজমের আভাস দেখতে পাই আমরা। ঈশ্বর বলে কেউ নেই। ভালোবাসাই সবচেয়ে বড় মূল্যবোধ। কিন্তু ভালোবাসার মরণ ঘটলে বিরান ভুমিতে পরিণত হয় বিশ্ব। নাটকের শেষে প্লেবেরিও মেয়ের আত্মহত্যার জন্যে মাতম করছে, কেবল সেই তাকে জীবনের একটা অর্থ যোগাত। ‘হে পৃথিবী, হে পৃথিবী,’ উপসংহার টানছে সে, ‘যখন তরুণ ছিলাম, ভেবেছিলাম তোমাকে আর তোমার কর্মকাণ্ডকে পরিচালনার কোনও নিয়ম কানুন আছে।’ কিন্তু এখন

তোমাকে ভ্রান্তি, ভীতিকর মরুভূমি, বুনো জানোয়ারের আস্তানা, লোকে কেবল ঘুরে বেড়ায় এমন একটা খেলার মতো লাগছে…পাথুরে প্রান্তর, সাপে ভরা ময়দান, ফুলে ভরা কিন্তু বিরান বাগিচা, উদ্বেগের ফোয়ারা, অশ্রুজলের নদী, কষ্টের সাগর, ব্যর্থ আশা মনে হচ্ছে।২৭

পুরোনো ধর্ম পালন করতে না পেরে, ইনকুইজিশনের অত্যাচারে নতুন ধর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে রোয়াস এমন এক হতাশায় ডুবে গিয়েছিল যে নিয়মকানুনের আর কোনও অর্থ খুঁজে পাচ্ছিল না সে, পাচ্ছিল না কোনও পরম মূল্যও।

ফান্দিনান্দ ও ইসাবেলা ইহুদিদের আর যাই হোক সংশয়বাদী অবিশ্বাসী হয়ে যাবার ব্যাপারটা চাননি মোটেই। কিন্তু আমাদের সম্পূর্ণ কাহিনী জুড়ে আমরা দেখতে পাই যে তাঁরা যে ধরনের নিপীড়ন আরোপ করেছিলেন সেটা নেতিবাচক ফল দিয়েছে। ইচ্ছার বিরুদ্ধে মানুষকে তৈরি হওয়ার আগেই চলমান বিশ্বাস গ্রহণ করতে বাধ্য করার প্রয়াস এমন সব ধারণা বা চর্চার পথ খুলে দেয় যা কিনা খোদ নিপীড়নকারী কর্তৃপক্ষের চোখে দারুণভাবে অনাকাঙ্ক্ষিত হয়ে দাঁড়ায়। ফার্দিনান্দ ও ইসাবেলা ছিলেন আগ্রাসী আধুনিকায়নবাদী, সব ধরনের ভিন্ন মত দমন করতে চেয়েছিলেন তাঁরা, কিন্তু তাঁদের ইনকুইজিশনাল পদ্ধতি গোপন ইহুদি দল গঠন ও প্রথমবারের মতো ইউরোপে সেক্যুলারিজম ও নাস্তিক্যবাদের ঘোষণার দিকে চালিত করেছে। পরে কিছু সংখ্যক ক্রিশ্চানও এই ধরনের ধর্মীয় স্বেচ্ছাচারে এতটাই বিতৃষ্ণ হয়ে উঠেছিল যে তারাও প্রত্যাদিষ্ট ধর্মে আস্থা হারিয়ে ফেলে। কিন্তু সেক্যুলারিজমও সমান হিংস্র হতে পারে। বিংশ শতাব্দীতে প্রগতির নামে সেক্যুলার রীতিনীতি আরোপ উগ্র মৌলবাদের উত্থানের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসাবে কাজ করেছে, অনেক সময় সংশ্লিষ্ট সরকারগুলোর পক্ষে যা মারাত্মক হয়ে দাঁড়িয়েছে।

১৪৯২ সালে খৃস্টধর্ম গ্রহণে অস্বীকৃতি জানানো প্রায় ৮০,০০০ ইহুদিকে পর্তুগালে আশ্রয় দিয়েছিলেন রাজা দ্বিতীয় হোয়াও। এইসব পর্তুগিজ ইহুদি এবং তাদের উত্তরপুরুষদের ভেতরই নাস্তিক্যবাদের সবচেয়ে প্রত্যক্ষ নাটকীয় নজীর দেখতে পাই। এই ইহুদিদের কেউ কেউ মরিয়াভাবে তাদের ইহুদি ধর্মকে আঁকড়ে থাকার চেষ্টা করছিল, কিন্তু পর্যাপ্ত কাল্ট না থাকায় সেটা অসম্ভব বা কঠিন আবিষ্কার করেছে। ১৪৯২ সালে পর্তুগালে পালিয়ে যাওয়া ইহুদিরা স্প্যানিশ কনভার্সোদের চেয়ে কঠিন ছিল: বিশ্বাস ত্যাগ করার বদলে দেশান্তরী হওয়ার পথ বেছে নিয়েছিল তারা। ১৪৯৫ সালে প্রথম ম্যানুয়েল সিংহাসনে আসীন হলে শ্বশুর-শাশুড়ির কারণে তিনি রাজ্যের ইহুদিদের জোর করে ব্যাপ্টাইজ করার নির্দেশ দিতে বাধ্য হন, তবে এক প্রজন্মের জন্যে তাদের ইনকুইজিশন থেকে রেহাই দিয়ে আপোস করেন। এই পর্তুগিজ মারানোরা গোপন সংগঠন গড়ে তোলার জন্যে প্রায় পঞ্চাশ বছর সময় পেয়েছিল, এই সংগঠনে একটি সংখ্যালঘু অংশ গোপনে ইহুদি ধর্ম পালন করে চলে ও অন্যদেরও পুরোনো ধর্মবিশ্বাসে ফিরিয়ে আনার প্রয়াস পায় ২৮

কিন্তু ইহুদি ধর্মান্তরিত এইসব মারানো বাকি ইহুদি বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল। ক্যাথলিক শিক্ষা লাভ করেছিল তারা, ফলে তাদের কল্পনার জগৎ ক্রিশ্চান প্রতীক ও মতবাদে পরিপূর্ণ ছিল। প্রায়শঃই তারা ক্রিশ্চান পরিভাষায় ইহুদি ধর্ম নিয়ে কথা বলত। উদাহরণ স্বরূপ, তারা বিশ্বাস করত, জেসাস নয় বরং মোজেসের আইনের কারণেই তারা রক্ষা পেয়েছে, ইহুদি ধর্মে এই ধারণার তেমন কোনও মূল্য নেই। ইহুদি বিধানের অনেক কিছুই তারা বিস্মৃত হয়েছিল। বছর পেরুনোর সাথে সাথে ইহুদিবাদ সম্পর্কে তাদের উপলব্ধিও ক্রমে ক্ষীণ হয়ে আসে। অনেক সময় অ্যান্টি- সেমিটিক ক্রিশ্চানদের বিভিন্ন যুক্তি সম্বলিত রচনাই ছিল তাদের ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে ধারণা লাভের একমাত্র উৎস। শেষ পর্যন্ত তারা যার চর্চা শুরু করে সেটা হচ্ছে সঙ্কর ধর্মবিশ্বাস যা প্রকৃত ইহুদি বা ক্রিশ্চান ধর্মের কোনওটাই ছিল না।২৯ এদের এই টানাপোড়েন আজকের দিনে উন্নয়নশীল বিশ্বের অনেক লোকের টানাপোড়েনের চেয়ে ভিন্ন নয়, যাদের কেবল পাশ্চাত্য সংস্কৃতি সম্পর্কে ভাসা ভাসা ধারণা রয়েছে, কিন্তু আধুনিকতার আগ্রাসনে তাদের জীবন যাত্রার প্রথাগত ধারা অবদমিত হওয়ার ফলে তারা আর প্রাচীন পদ্ধতির সাথেও খাপ খাওয়াতে পারছে না। একই রকম বিচ্ছিন্নতার বোধে আক্রান্ত হয়েছিল পর্তুগালের মারানো ইহুদিরা। তাদের অন্তস্থঃ সত্তার সাথে অনুরণিত হয়নি এমন এক আধুনিকায়িত সংস্কৃতিতে নিজেদের মিলিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছিল তারা।

ষোড়শ শতাব্দীর শেষ দিকে কিছু সংখ্যক ইহুদিকে ইবারিয় পেনিনসুলা ছেড়ে চলে যাবার অনুমতি দেওয়া হয়। স্প্যানিশ কলোনীগুলোর কোনও কোনওটায় এবং সেইসাথে দক্ষিণ ফ্রান্সে ইতিমধ্যে একটা মারানো ডায়াসপোরা গড়ে উঠেছিল। কিন্তু এখানকার ইহুদিদের তখনও তাদের ধর্ম পালন করতে দেওয়া হচ্ছিল না। অবশ্য সপ্তদশ শতাব্দীতে ইহুদি ধর্মপ্রচারকারী মারানোরা ভেনিস, হামবুর্গ ও-পরে-লন্ডনের মতো বিভিন্ন জায়গায় অভিবাসন করে। এইসব জায়গায় তারা প্রকাশ্যে ইহুদি ধর্মে প্রত্যাবর্তন করতে পেরেছিল। সবচেয়ে বড় কথা, ইনকুইজিশনের কবল থেকে পালিয়ে ইবারিয় শরণার্থীরা আমস্টার্ডামে হাজির হতে শুরু করেছিল, এটা তাদের নতুন জেরুজালেমে পরিণত হয়। নেদারল্যান্ডস ছিল ইউরোপের সহিষ্ণুতম দেশ। বিকাশমান বাণিজ্যিক সাম্রাজ্যের একটি প্রজাতন্ত্র দেশটি স্পেন থেকে স্বাধীনতা লাভের সংগ্রামের সময় ইবারিয় মূল্যবোধের বিপরীতে এক ধরনের উদার পরিচয় গড়ে তোলে। ১৬৩৭ সালে ইহুদিরা এই দেশের পূর্ণ নাগরিকত্ব লাভ করে। বেশির ভাগ ইউরোপিয় শহরের মতো এখানে তারা আর ঘেটো-বন্দি ছিল না। ওলন্দাজরা ইহুদিদের বাণিজ্যিক দক্ষতাকে কাজে লাগিয়েছে। ফলে ইহুদিরা বিশিষ্ট ব্যবসায়ীতে পরিণত হয়ে জেন্টাইলদের সাথে মুক্তভাবে মেলামেশা শুরু করে। প্রাণবন্ত সামাজিক জীবন, অসাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থা ও সমৃদ্ধ হয়ে ওঠা প্রকাশনা শিল্প ছিল তাদের।

অনেক ইহুদিই সন্দেহাতীতভাবে সামাজিক ও অর্থনৈতিক সুযোগ লাভের জন্যেই আমস্টারডামে পাড়ি জমিয়েছিল, কিন্তু একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ইহুদি ইহুদিবাদের পূর্ণাঙ্গ চর্চা বজায় রাখতে উদগ্রীব ছিল। সেটা অবশ্য সহজ ছিল না। ইবারিয়া থেকে আগত ‘নব্য ইহুদিদের’ ব্যাপকভাবে অজ্ঞ হয়ে থাকা ধর্ম সম্পর্কে নতুন করে শিক্ষা নিতে হচ্ছিল। ওদের ফিরিয়ে আনার এক চ্যালেঞ্জিং কাজ পেয়েছিলেন র‍্যাবাইরা, ঐতিহ্যের সাথে আপোস না করেই বিভিন্ন বাস্তব সমস্যার জন্যে ওদের রেয়াত দিচ্ছিলেন তাঁরা। তাঁদের কল্যাণেই কিছু প্রাথমিক উদ্বেগ সত্ত্বেও বেশির ভাগ ইহুদিই ফিরে আসতে পেরেছিল। পূর্বপুরুষের ধর্মে প্রত্যাবর্তন উপভোগ করছে বলে আবিষ্কার করেছিল তারা। উল্লেখযোগ্য নজীর ছিলেন মেটাফিজিক্সের প্রফেসর ওরোবিও দে কাস্ত্রো, বছরের পর বছর স্পেনে গোপন ইহুদি ধর্ম প্রচারক রয়ে গিয়েছিলেন তিনি। ইনকুইজিশনের হাতে আটক ও অত্যাচারিত হয়েছেন, তিনি বিশ্বাস প্রত্যাহার করেছেন ও ভুয়া ক্রিশ্চান হিসাবে তুলুজে চিকিৎসা বিজ্ঞান শিক্ষা দিয়েছেন। শেষে প্রতারণা ও দ্বৈত জীবন কাটাতে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে ১৬৩০ সালে ইহুদিবাদের শক্তিশালী অ্যাপোলজিস্ট ও অন্য প্রত্যাবর্তনকারী মারানোদের শিক্ষক হতে আমস্টারডামে চলে আসেন তিনি।৩১

ওরোবিও অবশ্য একটা পূর্ণ জনগোষ্ঠীর বর্ণনা দিয়েছেন যারা প্রথাগত ইহুদিবাদের আইনকানুন ও রীতিনীতির সাথে মানিয়ে ওঠা কঠিন আবিষ্কার করেছে, ওদের কাছে তা অর্থহীন ও অযথা ভার মনে হয়েছে। ওরোবিওর মতোই ইবারিয়ায় যুক্তিবিজ্ঞান, পদার্থবিদ্যা, গণিত ও ওষুধবিজ্ঞানের মতো আধুনিক বিজ্ঞান পাঠ করেছে তারা। কিন্তু, অধৈর্যভাবে জানাচ্ছেন ওরোবিও, ‘ওদের ছিল অনেক অহঙ্কার, গর্ব ও ঔদ্ধত্য, দারুণভাবে সব বিদ্যা অর্জন করার ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী।’

ওরা মনে করে পবিত্র আইনে প্রকৃত শিক্ষিতদের কাছ থেকে শিখতে রাজি হলে ওরা শিক্ষিত মানুষের পরিচয় হারিয়ে ফেলবে, তাই তারা যেসব বিষয় বোঝে না সেগুলোকে অস্বীকার করে বিরাট জ্ঞানীর ভাব ধরে।৩২

দশকের পর দশক ধর্মীয় বিচ্ছিন্নতায় বাসকারী এইসব ইহুদি তাদের নিজস্ব যৌক্তিক ক্ষমতার উপর নির্ভর করতে বাধ্য হয়েছিল। তাদের কোনও লিটার্জি, সাম্প্রদায়িক ধর্মীয় জীবন ও তোরাহর ‘পবিত্র আইন’ পালনের আচরিক অভিজ্ঞতা ছিল না। অবশেষে আমস্টারডামে পৌঁছানোর পর প্রথমবারের মতো পূর্ণাঙ্গ কার্যকর ইহুদি সম্প্রদায়ের মাঝে নিজেদের আবিষ্কার করে স্বাভাবিকভাবেই বিস্মিত বোধ করেছে। বহিরাগত কারও চোখে পেন্টাটিউকের ৬১৩টি নির্দেশনাকে খামখেয়ালি ও প্রাচীন ঠেকেছে। কোনও কোনও নির্দেশনা অচল হয়ে গিয়েছিল, কারণ সেগুলো পবিত্র ভুমির চাষাবাদ বা মন্দিরের লিটার্জির সাথে সম্পর্কিত ছিল, ডায়াসপোরায় যা আর প্রয়োগযোগ্য ছিল না। দুর্বোধ্য খাদ্য বিধি ও পবিত্রতা অর্জনের নিয়মের মতো অন্যান্য বিধিবিধানও নিশ্চয়ই আধুনিক পর্তুগিজ মারানোদের চোখে বর্বরোচিত ও অর্থহীন মনে হয়েছে; যৌক্তিকভাবে চিন্তাভাবনা করতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল বলে র‍্যাবাইদের ব্যাখ্যা মেনে নেওয়া কঠিন ঠেকেছে তাদের কাছে। কমন এরার প্রথম শতাব্দীতে সংকলিত মৌখিক সাঙ্কেতিক আইন হালাখাহ আরও বেশি অযৌক্তিক ও খামখেয়ালি বলে মনে হয়েছে, তার কারণ এর এমনকি বাইবেলিয় অনুমোদন পর্যন্ত ছিল না।

কিন্তু মোজেসের আইন তোরাহর নিজস্ব একটা মিথোস ছিল। এটি ছিল লুরিয় কাব্বালাহর মতোই নির্বাসনের স্থানচ্যুতির প্রতি সাড়া। বিসিই ষষ্ঠ শতাব্দীতে মন্দির ধ্বংস করে, ওদের ধর্মীয় জীবনকে পর্যুদস্ত করে ইসারয়েলের জনগণকে বাবিলনে নির্বাসনে পাঠানো হলে আইনের টেক্সট এক নতুন ‘মন্দিরে’ পরিণত হয়েছিল। স্থানচ্যুত জনগণ এখানে ঐশী সত্তার একটা বোধকে লালন করেছে। বিশ্বকে পরিচ্ছন্ন ও নোংরা, পবিত্র ও অপবিত্র হিসাবে গ্রন্থিত করা ছিল বিধ্বস্ত জীবনকে আবার সুশৃঙ্খলিত করার কাল্পনিক পুনঃস্থাপন। নির্বাসনে থাকার সময় ইহুদিরা আবিষ্কার করেছিল যে, আইনের পাঠ তাদের এক ধরনের গভীর ধর্মীয় অভিজ্ঞতার যোগান দেয়। আধুনিক মানুষের মতো ইহুদিরা স্রেফ তথ্যের জন্যে টেক্সট পাঠ করত না: এটা ছিল পাঠের প্রক্রিয়া-প্রশ্ন-উত্তর, উত্তপ্ত বিতর্ক ও সূক্ষ্ম বিষয়ে মগ্ন হওয়া—যা তাদের ঐশী সত্তার বোধ যোগাত। তোরাহ ছিল ঈশ্বরের বাণী, এতে গভীরভাবে মগ্ন হয়ে, মোজেসের কাছে স্বয়ং ঈশ্বরের উচ্চারিত বাণী অন্তর দিয়ে স্মৃতিতে গেঁথে নিয়ে সেগুলোকে জোরে উচ্চারণ করে নিজেদের সত্তার ভেতর ঐশী সত্তাকে টেনে আনছিল ওরা, প্রবেশ করছিল পবিত্র বলয়ে। আইন একটা প্রতীকে পরিণত হয়েছিল, এখানেই ওরা শেখিনাহর দেখা পেয়েছিল। ওদের জীবনের সূক্ষ্মতম ক্ষেত্রে আইনের পালন স্বর্গীয় স্বজ্ঞা নিয়ে আসত: যখন তারা খেত, হাতমুখ ধুতো, প্রার্থনা করত বা স্রেফ সাব্বাথের সময় পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বিশ্রাম করত।

মারানোদের বাধ্য হয়ে জীবনভর যার উপর নির্ভর করতে হয়েছিল এর কোনওটাই হুট করে সেই যৌক্তিক চিন্তাভাবনা দিয়ে উপলব্ধি করা সম্ভব ছিল না। এই ধরনের পৌরাণিক ও কাল্টসুলভ অনুশীলন ছিল অজানা। নব্য ইহুদিদের কেউ কেউ, অভিযোগ করেছেন ওরোবিও, ‘বর্ণনার অতীত নাস্তিকে’ পরিণত হয়েছিল। ওরা, এটা নিশ্চিত যে, আমাদের বিংশ শতাব্দীর ধারণা মোতাবেক নাস্তিক ছিল না, কারণ তখনও তারা দুয়ে উপাস্যে বিশ্বাস করছিল। কিন্তু বাইবেলের ঈশ্বর ছিলেন না তিনি। মারানোরা পরবর্তীকালের আলোকন ফিলোসফদের” উদ্ভাবিত ডেইজমের মতো একটি সম্পূর্ণ যৌক্তিক বিশ্বাস গড়ে তুলেছিল। এই ঈশ্বর ছিলেন সমস্ত কিছুর প্রথম কারণ, অ্যারিস্টটল যাঁর অস্তিত্ব যৌক্তিকভাবে তুলে ধরেছিলেন। সব সময়ই ইনি যৌক্তিকভাবে আচরণ করে এসেছেন। তিনি মানুষের ইতিহাসে ভ্রান্তিপূর্ণভাবে হস্তক্ষেপ করেন না, বিচিত্র অলৌকিক কাণ্ড ঘটিয়ে প্রকৃতির বিধিবিধানকে লঙ্ঘন করেন না বা পর্বতশীর্ষে অস্পষ্ট বিধান অবতীর্ণ করেন না। তাঁর বিশেষ ধরনের আইনি বিধান প্রকাশ করার প্রয়োজন পড়েনি, কারণ প্রকৃতির নিয়মকানুন সবারই বোধগম্য ছিল। মানুষের যুক্তি স্বাভাবিকভাবে এই ধরনের ঈশ্বরের ধারণাই কল্পনা করতে চেয়ে এসেছে। অতীতে ইহুদি ও মুসলিম দার্শনিকগণ বলতে গেলে ঠিক এমনই একজন উপাস্যকে হাজির করেছিলেন। কিন্তু সাধারণভাবে বিশ্বাসীদের কাছে তা কখনওই খুব ভালোভাবে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠেনি। ধর্মের দিকে থেকে তা ব্যবহারযোগ্য ছিল না, কেননা প্রথম কারণ মানুষের অস্তিত্ব সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন কিনা তাতেই সন্দেহের অবকাশ ছিল, কারণ তাঁর পক্ষে পূর্ণাঙ্গ নয় এমন কোনও কিছুর কথা ভাবাও সম্ভব ছিল না। এমন একজন ঈশ্বরের পক্ষে মানুষের দুঃখদুর্দশার বেলায় কোনও কিছু বলার ছিল না। সেজন্যে আপনার প্রয়োজন পৌরাণিক ও কাল্টিক আধ্যাত্মিকতা, মারানোদের সেটা অজানা ছিল।

আমস্টারডামে ধর্মবিশ্বাসে ফিরে যাওয়া বেশির ভাগ মারানো কোনও কোনও মাত্রায় হালাখিয় আধ্যাত্মিকতা শিখতে সক্ষম হয়। কিন্তু কারও কারও বেলায় পরিবর্তন অসম্ভব ঠেকেছে। করুণতম ঘটনাগুলোর অন্যতম ছিল, উরিয়েল দা কোস্তার ঘটনা। কনভার্সো পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন তিনি, শিক্ষা লাভ করেছিলেন জেস্যুইটদের কাছে, কিন্তু ক্রিশ্চান ধর্মকে তিনি নির্যাতনমূলক, নিষ্ঠুর ও গস্পেলের সাথে সম্পর্ক বিবর্জিত সম্পূর্ণ মানব রচিত নিয়ম ও মতবাদে নির্মিত বলে আবিষ্কার করেছিলেন। দা কোস্তা ইহুদি ঐশীগ্রন্থের শরণাপন্ন হন ও নিজের জন্যে ইহুদি ধর্মের খুবই আদর্শগত যৌক্তিক ধারণা গড়ে তোলেন। সপ্তদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে আমস্টারডামে পৌঁছানোর পর সমসাময়িক ইহুদিধর্মমত ঠিক ক্যাথলিক মতবাদের মতোই মানব রচিত আবিষ্কার করে হতবাক হয়ে যান, কিংবা তাই দাবি করেছিলেন তিনি।

সম্প্রতি পণ্ডিতগণ দা কোস্তার বক্তব্যে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। তাঁরা যুক্তি তুলে ধরেছেন যে, প্রায় নিশ্চিতভাবেই যতটা আবছাই হোক না কেন ইহুদিবাদের হালাখিয় ধরনের সাথে আগেও তার সাক্ষাৎ ঘটেছিল, যদিও সম্ভবত হালাখাহ কতটা গভীরভাবে স্বাভাবিক ইহুদি জীবনযাত্রাকে প্রভাবিত করেছিল সেটা তিনি উপলব্ধি করে উঠতে পারেননি। তবে আমস্টারডামের ইহুদি জীবনধারার সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে দা কোস্তার অক্ষমতার বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। পরকালের জীবন সংক্রান্ত মতবাদ ও ইহুদি বিধানের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালিয়ে একটি নিবন্ধ লিখেছিলেন তিনি। এখানে তিনি ঘোষণা করেন, তিনি কেবল মানবীয় যুক্তি ও প্রকৃতিক বিধানেই বিশ্বাস করেন। অনেক বছর র‍্যাবাইরা একঘরে করে রেখেছিলেন তাঁকে। সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ার আগ পর্যন্ত করুণ বিচ্ছিন্ন জীবন যাপন করেছিলেন দা কোস্তা, পরে তাঁকে আবার গ্রহণ করা হয়, আবার সমাজে ফিরিয়ে নেওয়া হয়। কিন্তু আসলে দা কোস্তা তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাননি। কোনও রকম যৌক্তিক অর্থ সৃষ্টি করে না এমন সব আচার মেনে চলা অসম্ভব ঠেকেছিল তাঁর পক্ষে। আরও দুবার সমাজচ্যুত হয়েছিলেন তিনি। অবশেষে ১৬৪০ সালে হতাশায় পরাস্ত, ভগ্ন অবস্থায় নিজেই নিজের মাথায় গুলি করে আত্মহত্যা করেন।

দা কোস্তার ট্র্যাজিডি দেখায় যে, ইউরোপে তখনও পর্যন্ত ধর্মীয় জীবনের বিকল্প কোনও সেক্যুলার রীতির অস্তিত্ব ছিল না। আপনি অন্য ধর্ম গ্রহণ করতে পারতেন বটে, কিন্তু খুবই ব্যতিক্রমী মানুষ না হলে (দা কোস্তা যা ছিলেন না), ধর্মীয় সম্প্রদায়ের বাইরে টিকে থাকতে পারতেন না। সমাজচ্যুত থাকার বছরগুলোতে দা কোস্তা চরমভাবে নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করেছেন, ইহুদি ও ক্রিশ্চানরা তাঁকে সমানভাবে বর্জন করেছিল, পথেঘাটে বাচ্চারা তাঁকে টিটকারী মারত।৩৫

কিছুটা কম করুণ হলেও মোটামুটি সমান বাঙ্ময় ছিল হুয়ান দা প্রাদোর ঘটনা। ১৬৫৫ সালে আমস্টারডামে আসেন তিনি। প্রায়ই দা কোস্তার পরিণতি নিয়ে চিন্তা- ভাবনা করতেন। বিশ বছর পর্তুগালের গোপন ইহুদি সংগঠনের সদস্য ছিলেন তিনি, কিন্তু ধারণা করা হয়, ১৬৪৫ সালের দিকেই ডেইজমের মারানো ধরনের কাছে নতি স্বীকার করেছিলেন তিনি। মেধাবী বা পদ্ধতিগত চিন্তাবিদের কোনওটাই ছিলেন না প্রাদো। তবে তাঁর অভিজ্ঞতা দেখায়, কেবল যুক্তির উপর নির্ভর করে ইহুদিবাদের মতো কনফেশনাল কোনও ধর্ম মেনে চলা অসম্ভব। উপাসনার জীবন, কাল্ট ও অতীন্দ্রিয় গুরুত্ববিহীন প্রাদো কেবল এই উপসংহারে উপনীত হতে পেরেছিলেন যে, ‘ঈশ্বর’ কেবল প্রকৃতির বিধানের অনুরূপ। তারপরেও আরও দশ বছর তিনি গোপন কর্মকাণ্ড অব্যাহত রেখেছিলেন। তাঁর কাছে ‘ইহুদিধর্ম’ যেন বন্ধুবর্গের মতো; একটা নিবিড়ভাবে গঠিত দলে তাঁর দেখা নিবিড় বন্ধনের অভিজ্ঞতা যা তাঁর জীবনের অর্থ যোগান দিয়েছে, কারণ তিনি যখন আর্মস্টারডামে পৌঁছে সেখানকার র‍্যাবাইদের প্রতি বিরূপ ধারণা লাভ করেন, তারপরেও ইহুদি সম্প্রদায়ের অভ্যন্তরেই থাকতে চেয়েছিলেন। দা কোস্তার মতো প্রাদো অনেক বছর নিজের চিন্তাভাবনার স্বাধীনতা ও পছন্দমতো উপাসনা করার অধিকার টিকিয়ে রেখেছিলেন। ‘ইহুদি ধর্ম’ সম্পর্কে তাঁর নিজস্ব ধারণা ছিল। আসল ব্যাপারের মুখোমুখি হয়ে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন তিনি। জোরালভাবে আপত্তি তুলে ধরেছিলেন প্রাদো। ইহুদিরা কেন ভাবে যে ঈশ্বর কেবল তাদেরই বেছে নিয়েছেন? এই ঈশ্বর আসলে কী? ঈশ্বরকে বর্বরোচিত কাণ্ডজ্ঞানহীন কতগুলো আইন চাপিয়ে দেওয়া এক ব্যক্তি না ভেবে বরং প্রথম কারণ হিসাবে চিন্তা করাই কি অনেক বেশি যুক্তিসঙ্গত নয়? প্রাদো পরিণত হন বিব্রতকারীতে। র‍্যাবাইরা ইবারিয়া থেকে আগত নব্য ইহুদিদের শিক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন (অনেকের সাথেই প্রাদোর ভাবনার মিল ছিল), তাঁর ডেইজম বরদাশত করতে পারছিলেন না তাঁরা। ১৪ই ফেব্রুয়ারি, ১৬৫৭ তারিখে তাঁকে সমাজচ্যুত করা হয়; কিন্তু তারপরেও সমাজ ত্যাগে অস্বীকার গেছেন তিনি।

এটা ছিল সম্পূর্ণ সমন্বয়ের অতীত দুটো দৃষ্টিভঙ্গির সংঘাত। তাঁদের নিজস্ব দৃষ্টিকোণ থেকে প্রাদো ও র‍্যাবাইগণ, উভয়ই সঠিক ছিলেন। প্রচলিত ইহুদিবাদের কোনও অর্থ করতে পারেননি প্রাদো, মনের অতীন্দ্রিয় ছাঁচ হারিয়ে ফেলেছিলেন; কাল্ট ও আচারের মাধ্যমে ধর্মের গভীরতম অর্থ খুঁজে বের করার সুযোগ পাননি কোনওদিন। সব সময়ই তাঁকে যুক্তি ও নিজস্ব অন্তর্দৃষ্টির উপর নির্ভর করতে হয়েছে; এখন আর তা পরিত্যাগ করতে পারেননি। তবে র‍্যাবাইরাও সঠিক ছিলেন। প্রাদোর ডেইজমের সাথে তাঁদের চেনা ইহুদিবাদের কোনও ধরনের সাথেই মিল ছিল না। প্রাদো একজন ‘সেক্যুলার ইহুদি’ হতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সপ্তদশ শতাব্দীতে এই ধরনের কোনও কিছুর অস্তিত্ব ছিল না। প্রাদো বা র‍্যাবাইদের কারও পক্ষেই একে সঠিকভাবে গড়ে তোলা সম্ভব ছিল না। এটা ছিল একদিকে পুরোপুরিভাবে যৌক্তিক বিশ্বদৃষ্টি ও অন্যদিকে কাল্ট ও মিথে গড়ে ওঠা ধর্মীয় মানসিকতার সংঘাতের একটি ধারার প্রথমটি।

এইসব নীতিগত সংঘাতে প্রায়শঃ যেমন হয়, কোনও পক্ষই খুব ভালো আচরণ করেনি। উদ্ধত মানুষ ছিলেন প্রাদো, র‍্যাবাইদের প্রকাশ্যে গালি দিতেন। একবার তলোয়ার নিয়ে সিনাগগে তাঁদের উপর হামলে পড়ারও হুমকি দিয়েছিলেন। র‍্যাবাইরাও কম সম্মানের সাথে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন। প্রাদোর পেছনে গুপ্তচর লাগিয়েছিলেন তাঁরা। এই গুপ্তচর তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি আরও রেডিক্যাল রূপ নেওয়ার খবর দিয়েছিল। সমাজচ্যুত হওয়ার পর তিনি মন্তব্য করেছিলেন, ধর্ম হচ্ছে আবর্জনা; এবং তথাকথিত ‘প্রত্যাদেশ’ নয়, যুক্তিই হবে সব সময় সত্যের একক বিচারক। প্রাদো কীভাবে শেষ জীবন কাটিয়েছিলেন সেটা কেউ জানে না। তাঁকে সমাজ ত্যাগে বাধ্য করা হয়েছিল। অ্যান্টওয়ার্পে আশ্রয় নিয়েছিলেন তিনি। কেউ কেউ বলেন, তিনি এমনকি ক্যাথলিক চার্চের সাথে আপোসরফায় পৌঁছুনোর প্রয়াসও পেয়েছিলেন। তাই যদি হয়, তা ছিল মরিয়া পদক্ষেপ, যা আবারও দেখায় যে সপ্তদশ শতাব্দীতে একজন সাধারণ গঠনের মানুষের পক্ষে ধর্মের সীমানার বাইরে অবস্থান করা কতখানি অসম্ভব ছিল।৩৬

প্রাদো ও দা কোস্তা, এরা দুজনই ছিলেন আধুনিক চেতনার অগ্রদূত। তাঁদের কাহিনী দেখায়, কনফেশনাল ধর্মের মিথোস মনের অধিকতর স্বজ্ঞামূলক অংশের চর্চাকারী প্রার্থনা ও আচারের আধ্যাত্মিক অনুশীলন ছাড়া টিকে থাকতে পারে না। কেবল যুক্তি দুর্বল ডেইজমের জন্ম দিতে পারে, অচিরেই যা প্রত্যাখ্যাত হয়, কারণ আমরা যখন বিষাদের মুখোমুখি হই বা বিপদে পড়ি তখন তা কোনও কাজে আসে না। প্রাদো ও দা কোস্তা বিশ্বাস হারিয়েছিলেন কারণ তাঁরা ধর্ম অনুশীলনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত ছিলেন। কিন্তু আমস্টারডামের আরেক মারানো ইহুদি দেখিয়েছেন যে খোদ যুক্তির অনুশীলনই এতটা আকর্ষণীয় ও আনন্দদায়ক হয়ে উঠতে পারে যার ফলে মিথের প্রয়োজন কমে আসে। এই পৃথিবীই ধ্যনের একমাত্র বস্তুতে পরিণত হয়। এবং মানুষই, ঈশ্বর নন, সব বস্তুর মানদণ্ডে পরিণত হয়। কোনও ব্যতিক্রমী নারী বা পুরুষের মাঝে খোদ যুক্তি চর্চা এক ধরনের অতীন্দ্রিয় আলোকন এনে দিতে পারে। এটাও আধুনিক অভিজ্ঞতারই অংশ ছিল।

র‍্যাবাইরা প্রাদোকে সমাজচ্যুত করার সময়ই বারুচ স্পিনোযার বিরুদ্ধে বিচার কাজেরও সূচনা করেছিলেন। তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র তেইশ বছর। প্রাদোর বিপরীতে স্পিনোযা আমস্টারডামে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। পর্তুগালে ইহুদি ধর্মপ্রচারকের জীবন যাপন করেছিলেন তাঁর বাবা-মা। আমস্টারডামে আসার পর তাঁরা অর্থডক্স ইহুদিবাদে ধর্মান্তরিত হতে পেরেছিলেন। ফলে স্পিনোযাকে কখনওই ধাওয়া বা নির্যাতনের শিকার হতে হয়নি। সব সময়ই উদার আমস্টারডামে বাস করেছেন তিনি, জেন্টাইল বিশ্বের বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনে যাতায়াত ছিল। বিনা বাধায় নিজ ধর্মবিশ্বাসের চর্চা করার সুযোগ ছিল। অসাধারণ কেতার তোরাহ স্কুলে প্রথাগত শিক্ষা লাভ করেন তিনি। তবে আধুনিক গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞান ও পদার্থবিদ্যায় পড়াশোনা করেছেন। ব্যবসা বাণিজ্যের জীবন স্থির হয়েছিল স্পিনোযার, তাঁকে নিবেদিতপ্রাণ ধার্মিক বলেই মনে হয়েছিল। কিন্তু ১৬৫৫ সালে আমস্টাডামে প্রাদোর আগমনের অল্প পরেই আকস্মিকভাবে সিনাগগে প্রার্থনায় যাওয়া বন্ধ করে দেন তিনি, সন্দেহের কথাকে ভাষা দিতে শুরু করেন। তিনি উল্লেখ করেন যে বাইবেলের তিনি টেক্সটে স্ববিরোধিতা রয়েছে, তাই ঐশী উৎসের নয়, এটা মানব রচিত বলেই প্রমাণিত হয়। তিনি প্রত্যাদেশের সম্ভাবনা উড়িয়ে দিয়ে যুক্তি দেখান যে ‘ঈশ্বর’ স্রেফ খোদ প্রকৃতির সামগ্রিকতা। শেষ পর্যন্ত ২৭শে জুলাই, ১৬৫৬ তারিখে র‍্যাবাইগণ স্পিনোযার বিরুদ্ধে সমাজচ্যুতির ফরমান জারি করেন। প্রাদোর বিপরীতে স্পিনোযা সমাজে থাকার অনুরোধ জানাননি। চলে যেতে পেরে খুশি ছিলেন, ইউরোপে প্রতিষ্ঠিত ধর্মের আওতার বাইরে সফলভাবে স্বাধীনভাবে জীবনযাপনকারী প্রথম ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছিলেন তিনি।

প্রাদো বা দা কোস্তার চেয়ে স্পিনোযার পক্ষে জেন্টাইল বিশ্বে বেঁচে থাকা অনেকাংশে সহজতর ছিল। মেধাবী ছিলেন তিনি, পরিষ্কারভাবে নিজের অবস্থান তুলে ধরতে পারতেন এবং প্রকৃত স্বাধীন মানুষ হিসাবে এর সাথে সম্পর্কিত অনিবার্য নৈঃসঙ্গকে ধারণ করতে পেরেছেন। নেদারল্যান্ডসে অভ্যস্ত ছিলেন তিনি, ক্ষমতাশালী পৃষ্ঠপোষকগণ তাঁকে যুক্তিসঙ্গত রেয়াত দিয়েছেন। ফলে হতদরিদ্র অবস্থায় জীবন কাটাতে হয়নি তাঁকে। প্রায়শঃ যেমন মনে করা হয়, স্পিনোযা বেঁচে থাকার তাগিদে লেন্স ঘঁষতে বাধ্য হননি, বরং অপটিক্সে নিজের কৌতূহল নিবৃত্ত করতেই একাজ করেছিলেন। তখনকার সময়ের বেশ কয়েকজন নেতৃত্বস্থানীয় জেন্টাইল বিজ্ঞানী, দার্শনিক ও রাজনীতিবিদের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলতে পেরেছিলেন তিনি। কিন্তু তারপরেও বিচ্ছিন্ন ব্যক্তি রয়ে গিয়েছিলেন। ইহুদি ও জেন্টাইলরা সমানভাবে তাঁর ধর্মহীনতাকে হয় ভয়ঙ্কর বা অসামঞ্জস্যপূর্ণ হিসাবে আবিষ্কার করেছে। ৩৭

কিন্তু তাসত্ত্বেও স্পিনোযার নাস্তিক্যবাদে আধ্যাত্মিকতা ছিল, কারণ জগৎকে তিনি ঐশী ভাবতেন। জাগতিক বাস্তবতায় ব্যাপ্ত ঈশ্বরের একটা ছবিই স্পিনোযাকে বিস্ময় ও শ্রদ্ধায় পূর্ণ করে রেখেছিল। শর্ট ট্রিটাইজ অন গড-এ (১৬৬১) যেমন ব্যাখ্যা করেছেন, দার্শনিক গবেষণা ও চিন্তাভাবনাকে এক ধরনের প্রার্থনা মনে করতেন তিনি। এই উপাস্য জানবার মতো কোনও বস্তু নন, বরং আমাদের ভাবনার নীতি। এ থেকে অগ্রসর হয়ে বলা হয়েছে, আমরা যখন জ্ঞান অর্জন করে আনন্দ বোধ করি সেটা ঈশ্বরের প্রতি বুদ্ধিবৃত্তিক ভালোবাসা মাত্র। প্রকৃত দার্শনিক, স্পিনোযা বিশ্বাস করতেন, তিনি যাকে স্বজ্ঞামূলক জ্ঞান বলেছেন, তার চর্চা করবেন, অন্তর্দৃষ্টির একটা ঝলক আলোচনার ভেতর দিয়ে সংগ্রহ করা তার সমস্ত তথ্যকে সমন্বিত করবে, এবং এটা ছিল এমন এক অভিজ্ঞতা স্পিনোযা যাকে ঈশ্বর বলে বিশ্বাস করেছেন। এই অভিজ্ঞতাকে তিনি বলেছেন ‘স্বর্গসুখ’ (বিটিচ্যুড): এই পর্যায়ে দার্শনিক বুঝতে পারেন যে তিনি ঈশ্বর হতে অবিচ্ছেদ্য ও মানুষের মাধ্যমেই ঈশ্বর অস্তিত্ববান। এটা ছিল অতীন্দ্রিয় দর্শন, জন অভ দ্য ক্রস ও তেরেসা অভ আভিলার চর্চিত আধ্যাত্মিকতার যৌক্তিক ভাষ্য হিসাবে দেখা যেতে পারত একে। কিন্তু এই ধরনের ধর্মীয় অন্তর্দৃষ্টির কোনও ফুরসত স্পিনোযার ছিল না। তিনি বিশ্বাস করতেন একজন দুয়ে ঈশ্বরের আকাঙ্ক্ষা করতে গিয়ে মানুষ তার নিজ প্রকৃতি হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। পরবর্তী কালের দার্শনিকগণ স্পিনোযার স্বর্গসুখের পরমানন্দের অনুসন্ধানকে বিব্রতকর আবিষ্কার করে ঈশ্বরকে সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যান করবেন। তা সত্ত্বেও এ বিশ্ব জগতের প্রতি মনোসংযোগ ও অতিপ্রাকৃতকে অস্বীকার যাওয়ার ভেতর স্পিনোযা ইউরোপের অন্যতম প্ৰথম সেক্যুলারে পরিণত হয়েছিলেন।

অনেক আধুনিক মানুষের মতো স্পিনোযা সব ধরনের আনুষ্ঠানিক ধর্মকে বিতৃষ্ণার সাথে দেখতেন। তাঁর সমাজচ্যুতির অভিজ্ঞতা বিবেচনা করলে একে তেমন একটা বিস্ময়কর বলা যাবে না। প্রত্যাদিষ্ট ধর্মবিশ্বাসসমূহকে ‘বিশ্বাসপ্রবণতা ও কুসংস্কারের স্তূপ’ ও ‘অর্থহীন রহস্যের জটলা’ হিসাবে নাকচ করে দিয়েছেন তিনি।৩৮ বাইবেলিয় টেক্সটে নিজেকে মগ্ন করে নয়, যুক্তির বাধাহীন ব্যবহারে আনন্দ লাভ করেছেন; ফলে ঐশীগ্রন্থসমূহকে তিনি সম্পূর্ণই বস্তুগত দৃষ্টিতে দেখেছেন। একে স্বর্গীয় প্রত্যাদেশ হিসাবে দেখার বদলে স্পিনোযা জোরের সাথে বলেছেন যে, বাইবেলকে অন্য যেকোনও টেক্সটের মতোই পড়তে হবে। বৈজ্ঞানিকভাবে বাইবেল পাঠকারীদের ভেতর তিনি ছিলেন অন্যতম। তিনি এর ঐতিহাসিক পটভূমি পরীক্ষা করেছেন, সাহিত্যিক ঘরানা পরখ করেছেন, ও রচয়িতার বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। আপন রাজনৈতিক ধারণা পরখ করতেও বাইবেল ব্যবহার করেছেন। পাশ্চাত্য আধুনিকতার অন্যতম বৈশিষ্ট্যে পরিণত হতে চলা ইউরোপের সেক্যুলার, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের আদর্শ তুলে ধরা ব্যক্তিদের ভেতর অন্যতম ছিলেন স্পিনোযা। তিনি যুক্তি দেখিয়েছেন যে, প্রিস্টরা ইসরায়েলের রাজার চেয়ে বেশি ক্ষমতা হাতে পাবার পর রাষ্ট্রের আইন-কানুন শাস্তিমূলক ও প্রতিবন্ধক হয়ে ওঠে। আদিতে ইসরায়েল রাজ্য ধর্মতান্ত্রিক ছিল, কিন্তু স্পিনোযার দৃষ্টিভঙ্গিতে, ঈশ্বর ও সাধারণ জনগণ একই থাকায় মানুষের কণ্ঠস্বরই ছিল সার্বভৌম। পুরোহিতরা ক্ষমতা কেড়ে নেওয়ার পর আর ঈশ্বরের কণ্ঠস্বর শোনা যায়নি৷ কিন্তু স্পিনোযা লোকানুবর্তী ছিলেন না। অধিকাংশ প্রাক আধুনিক দার্শনিকের মতোই অভিজাতবাদী ছিলেন তিনি, সাধারণ জনগণকে যৌক্তিক চিন্তাভাবনায় অক্ষম মনে করতেন। তাদের কোনও ধরনের আলোকন যোগাতে এক জাতীয় ধর্মের প্রয়োজন পড়বে, কিন্তু প্রত্যাদিষ্ট আইনের ভিত্তিতে নয়, বরং ন্যায়বিচার, ভ্রাতৃত্ববোধ ও উদারতার স্বাভাবিক নীতিমালার ভিত্তিতে এই ধর্মকে অবশ্যই সংস্কার করতে হবে। ৪১

সন্দেহাতীতভাবে স্পিনোযা ছিলেন আধুনিক চেতনার অন্যতম বাহক। পরবর্তী সময়ে সেক্যুলার ইহুদিদের এক ধরনের নায়কে পরিণত হবেন তিনি। ধর্ম থেকে নীতির ভিত্তিতে তাঁর যাত্রাকে তারা শ্রদ্ধা করেছে। কিন্তু জীবদ্দশায় স্পিনোযার কোনও ইহুদি অনুসারী ছিল না; যদিও এটা স্পষ্ট যে, বহু ইহুদিই তখন মৌলিক পরিবর্তনের জন্যে প্রস্তুত ছিল। মোটামুটি স্পিনোযার সেক্যুলার যুক্তিবাদ গড়ে তোলার সময়টিতেই এক মেসিয়ানিক উন্মাদনায় আক্রান্ত হয়েছিল ইহুদি জগৎ যুক্তিকে যা হাওয়ায় উড়িয়ে দেবে বলে মনে হয়েছে। আধুনিক কালের অন্যতম প্রথম মিলেনিয়াল আন্দোলন ছিল এটা, নারী-পুরুষকে পবিত্র অতীতের সাথে বিচ্ছেদ সৃষ্টি করে সম্পূর্ণ নতুন কিছুর দিকে অগ্রসর হতে ধর্মীয় উপায় যুগিয়েছিল। আমাদের কাহিনীতে প্রায়ই এটা লক্ষ করব আমরা। অল্প সংখ্যক লোকই আধুনিকতার সেক্যুলারিস্ট দর্শন উপস্থাপনকারী অভিজাত দার্শনিকদের বুঝতে সক্ষম ছিল। বেশির ভাগই ধর্মের উপর ভরসা করে নতুন বিশ্বে যাত্রা করেছিল, যা তাদের অতীতের সাথে এক ধরনের সান্ত্বনামূলক ধারাবাহিকতার বোধ দিয়েছে ও পৌরাণিক কাঠামোয় আধুনিক লোগোসকে ভিত্তি দিয়েছে।

এটা প্রতীয়মান যে, সপ্তদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি নাগাদ অনেক ইহুদিই বিচ্ছিন্নতার একটা অবস্থায় পৌঁছে গিয়েছিল। আমস্টারডামের মারানো সম্প্রদায়ের মতো ইউরোপের আর কোনও ইহুদিই স্বাধীনতা ভোগ করেনি। স্পিনোযা জেন্টাইলদের সাথে মিশতে পেরেছিলেন ও নতুন বিজ্ঞান পড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন বলেই তাঁর রেডিক্যাল নতুন প্রস্থান সম্ভব হয়েছিল। ক্রিশ্চান জগতের অন্যান্য জায়গায় ইহুদিরা মূলধারার সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল। ষোড়শ শতাব্দী নাগাদ কোনও ইহুদিই ‘ঘেটো’ নামে পরিচিত বিশেষ ইহুদি এলাকার বাইরে থাকতে পারত না। এর মানে ছিল ইহুদিদের অনিবার্যভাবে অন্তর্মুখী জীবন যাপন করতে হত। বিচ্ছিন্নতা অ্যান্টিসেমিটিক সংস্কার উস্কে দিয়েছিল। ইহুদিরা স্বভাবতই নিপীড়নকারী জেন্টাইল বিশ্বের বিরুদ্ধে তিক্ততা ও সন্দেহের মাধ্যমে সাড়া দিয়েছিল। ঘেটোগুলো স্বয়ংসম্পূর্ণ জগতে পরিণত হয়। ইহুদিদের নিজস্ব স্কুল, নিজস্ব সামাজিক ও দাতব্য প্রতিষ্ঠান, নিজস্ব স্নানঘর, কবরস্থান ও কসাইখানা ছিল। ঘেটোগুলো স্বায়ত্তশাসিত ও স্বপরিচালিত ছিল। নির্বাচিত র‍্যাবাই ও প্রবীনদের কেহিলা (গোষ্ঠীগত সরকার) ইহুদি আইন মোতাবেক নিজস্ব আদালত পরিচালনা করত। কার্যত ঘেটো ছিল রাষ্ট্রের ভেতরে রাষ্ট্র, পৃথিবীর ভেতরে আরেক পৃথিবী। বাইরের জেন্টাইল সমাজের সাথে ইহুদিদের যোগাযোগ ছিল-প্রায়শঃ তাদের সেই ইচ্ছাও ছিল কম। কিন্তু সপ্তম শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় নাগাদ মনে হয় যে অনেকেই তাদের সীমাবদ্ধতায় বিরক্ত হয়ে উঠেছিল। সাধারণত অস্বাস্থ্যকর, নোংরা এলাকায় ছিল ঘেটোগুলোর অবস্থান। উঁচু দেয়ালে ঘেরাও করা ছিল সেগুলো, যার মানে ছিল জনসংখ্যার আধিক্য, কিন্তু সীমানা সম্প্রসারণের কোনও সম্ভাবনা ছিল না। এমনকি রোম বা ভেনিসের অপেক্ষাকৃত বড় ঘেটোতেও বাগান করার মতোও কোনও জায়গা ছিল না। নিজেদের জন্যে জায়গা বাড়ানোর একটা উপায়ই ছিল ইহুদিদের: আগের দালানের উপর নতুন করে আরেক তলা নির্মাণ, এবং প্রায়শঃই সেটা অপর্যাপ্ত ফাউন্ডেশনের উপর, ফলে সবকিছু ধসে পড়ত। অগ্নিকাণ্ড ও রোগশোকের হুমকি ছিল সারাক্ষণ। ইহুদিদের ভিন্ন পোশাক পরতে বাধ্য করা হত। অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতার মোকাবিলা করতে হয়েছে তাদের। প্রায়শঃই ফেরিঅলা বা দর্জির কাজই ছিল তাদের সামনে একমাত্র উন্মুক্ত পেশা। বৃহৎ আকারের কোনও বাণিজ্যিক উদ্যোগের অনুমতি ছিল না। ফলে জনসংখ্যার একটা বিরাট অংশ দানের উপর নির্ভর করে থাকত। সূর্যালোক ও প্রকৃতির সাথে সম্পর্করহিত ইহুদিরা শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে। ওরা মানসিকভাবেও বন্দি ছিল। ইউরোপের বিজ্ঞান ও শিল্পকলার সাথে তাদের কোনও যোগাযোগ ছিল না। ওদের নিজস্ব স্কুলগুলো ভালো ছিল, কিন্তু পঞ্চদশ শতাব্দীর পরে ক্রিশ্চান জগতের শিক্ষাকার্যক্রম আরও উদার হয়ে উঠছিল যখন, ইহুদিরা তখনও কেবল তোরাহ ও তালমুদে পাঠে মগ্ন ছিল। কেবল নিজস্ব টেক্সট ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে মগ্ন থাকায় ইহুদিদের শিক্ষায় চুলচেরা বিশ্লেষণ ও সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয়ে মনোযোগ দেওয়ার একটা প্রবণতা ছিল। ৪২

ইসলামি বিশ্বের ইহুদিরা ক্রিশ্চান বিশ্বের ইহুদিদের মতো নিষেধাজ্ঞার অধীন ছিল না। জিম্মি’র (‘প্রতিরক্ষা প্রাপ্ত সংখ্যালঘু’) মর্যাদা পেয়েছিল তারা, যতক্ষণ ইসলামি রাষ্ট্রের আইন ও সার্বভৌমত্ব স্বীকার করছে ততক্ষণ এটা তাদের নাগরিক ও সামরিক প্রতিরক্ষা দিয়েছে। ইসলামের ইহুদিরা নির্যাতিত হয়নি; অ্যান্টি- সেমিটিজমের কোনও ঐতিহ্য ছিল না, জিম্মিরা দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হলেও পূর্ণ ধর্মীয় স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছিল ওদের, নিজেদের আইন অনুযায়ী নিজস্ব কর্মকাণ্ড চালাতে পারত ওরা; ইউরোপের ইহুদিদের তুলনায় ঢের ভালোভাবে মূলধারার সংস্কৃতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যে অংশ নিতে পারত। কিন্তু ঘটনাপ্রবাহ দেখাবে, এমনকি ইসলামি বিশ্বের ইহুদিরাও অস্থির হয়ে উঠছিল, আরও বৃহত্তর মুক্তির সন্ধান করছিল তারা। ১৪৯২ সাল থেকে ইউরোপে একের পর এক বিপর্যয়ের সংবাদ পাচ্ছিল তারা, তারপর ১৬৪৮ সালে পোল্যান্ডে ইহুদিদের বিরুদ্ধে পরিচালিত নির্যাতনের খবরে রীতিমতো সম্ভ্রন্ত ওঠে। বিংশ শতাব্দীর আগে আর যার কোনও তুলনা মিলবে না।

পোল্যান্ড সম্প্রতি বর্তমানের ইউক্রেনের সিংহভাগ এলাকা অধিভুক্ত করে নিয়েছিল; এখানে নিজস্ব প্রতিরক্ষা গড়ে তুলতে কৃষক সমাজ অশ্বারোহী বাহিনী গড়ে তুলেছিল। এই ‘কস্যাক’রা পোলিশ ও ইহুদিদের সমানভাবে ঘৃণা করত, এরা প্রায়শঃই পোলিশ অভিজাত গোষ্ঠীর মধ্যস্বত্বভোগী হিসাবে জমিন দেখাশোনা করত। ১৬৪৯ সালে কস্যাক নেতা বরিস শমিয়েলনিকি পোলদের বিরুদ্ধে এক বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন। পোলিশ ও ইহুদি সম্প্রদায়ের উপর সমান তালে আক্রমণ পরিচালনা করা হয় তখন। ১৬৬৭ সালে অবশেষে যুদ্ধের অবসান ঘটলে, বিবরণী আমাদের জানায়, ১,০০,০০০ ইহুদিকে হত্যা করা হয়েছিল ও ৩০০ ইহুদি মহল্লা ধ্বংস করে ফেলা হয়েছিল। এই সংখ্যাগুলো অতিরঞ্জিত হয়ে থাকলেও শরণার্থীদের চিঠি ও কাহিনী বিশ্বের অন্যান্য এলাকার ইহুদিদের ত্রস্ত করে তোলে। এইসব চিঠি আর কাহিনীতে ইহুদিদের বিরুদ্ধে চালানো হত্যালীলার কথা বলা হয়; ইহুদিদের জবাই করা হয়েছে, গণকবরে ইহুদি নারী-শিশুকে জ্যান্ত পুঁতে মারা হয়েছে, ইহুদিদের হাতে রাইফেল ধরিয়ে দিয়ে একজনকে অন্যের উপর গুলি চালানোর হুকুম দেওয়া হয়েছে। অনেকেই বিশ্বাস করেন যে, এইসব ঘটনা নিশ্চয়ই দীর্ঘ প্রতিক্ষিত সেই ‘মেসায়াহর প্রসব বেদনাই’ হবে। ফলে মেসিয়ানিক নিস্তারকে ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে লুরিয় কাব্বালাহর বিভিন্ন আচার ও প্রায়শ্চিত্তমূলক অনুশীলনকে মরিয়া হয়ে আঁকড়ে ধরেছিল তারা।৪৪

মিয়েলনিকি হত্যাকাণ্ডের খবর বর্তমান তুরস্কের স্মিরনায় এসে পৌঁছলে শহরের বাইরে হাঁটতে হাঁটতে ধ্যানমগ্ন এক যুবক এক স্বর্গীয় কণ্ঠস্বর শুনতে পান। কণ্ঠস্বর তাঁকে বলছিল যে, স্বয়ং তিনি ‘ইসরায়েলের ত্রাণকর্তা, মেসায়াহ, ডেভিডের ছেলে, জ্যাকবের ঈশ্বরের মনোনীতজন।৪৫ শাব্বেতাই যেভি ছিলেন তরুণ পণ্ডিত ও কাব্বালিস্ট (যদিও এই পর্যায়ে লুরিয় কাব্বালাহয় অভিজ্ঞ ছিলেন না): ছোট একটা অনুসারী গোষ্ঠীর সাথে নিজের চিন্তভাবনা নিয়ে আলোচনা করবেন তিনি। আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন তিনি; কিন্তু আনুমানিক বিশ বছর বয়সে পৌঁছানোর পরপরই এমন সব লক্ষণ দেখাতে শুরু করেছিলেন বর্তমানে আমরা যাকে ম্যানিক ডিপ্রেসিভ হিসবাবে আখ্যায়িত করব। কিছুদিনের জন্যে নিখোঁজ হয়ে যেতেন তিনি, অন্ধকার ছোট কামরায় প্রবল দুঃখে ডুবে যেতেন, কিন্তু বিষণ্নতার এই পর্যায়গুলো ‘আলোকনের’ এক উন্মত্ত পর্যায়ে প্রতিস্থাপিত হত। এই সময় অস্থির হয়ে উঠতেন তিনি, ঘুমোতে পারতেন না, তাঁর মনে হত কোনও উচ্চতর শক্তির সংস্পর্শে চলে গেছেন। অনেক সময় তোরাহর বিভিন্ন নির্দেশনা অমান্য করতে বাধ্য হতেন, যেমন প্রকাশ্যে ঈশ্বরের নিষিদ্ধ নাম উচ্চারণ করতেন; বা অকোশার খাবার খেতেন। কেন এইসব ‘অদ্ভুত কাজ’ করছেন বলতে পারতেন না তিনি, তবে তাঁর মনে হত ঈশ্বর কোনও কারণে তাঁকে দিয়ে এসব করাচ্ছেন।৪৬ পরে তিনি নিশ্চিত হয়ে যান যে, এইসব নৈতিকতা বিরোধী কর্মকাণ্ড নিস্তারমূলক: ঈশ্বর ‘অচিরেই জগৎকে ঠিক করার জন্যে নতুন আইন ও নতুন নির্দেশনা দেবেন তাঁকে।’৪৭ এইসব লঙ্ঘন ছিল ‘পবিত্র পাপ’; এগুলোকে লুরিয় কাব্বালিস্টরা তিনের কর্মকাণ্ড বলে অভিহিত করত। এমন হতে পারে যে, এসব প্রথাগত ইহুদি জীবন ধারার বিরুদ্ধে এক ধরনের বিদ্রোহ তুলে ধরেছে ও সম্পূর্ণ নতুন কিছুর জন্যে অবদমিত আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটিয়েছে।

শেষ পর্যন্ত শাব্বেতাইয়ের আচার-আচরণ স্মিরনার ইহুদিদের পক্ষে সহ্যের অতীত হয়ে দাঁড়ায়। ১৬৫০ সালে শহর ত্যাগ করতে বাধ্য হন তিনি। এরপর পনের বছর মেয়াদী একটা পর্বের সূচনা করেন। পরে একে ‘অন্ধকার বছর’ আখ্যায়িত করেছিলেন। এই সময় অটোমান সাম্রাজ্যের বিভিন্ন প্রদেশে ঘুরে বেড়িয়েছেন তিনি, এক শহর থেকে চলে গেছেন আরেক শহরে। নিজের মেসিয়ানিক বৃত্তি সম্পর্কে কাউকে কিছু বলেননি, হয়তো বা বিশেষ ব্রতের ধারণাই বিসর্জন দিয়ে থাকতে পারেন। ১৬৬৫ সালের দিকে নিজের দানোর কাছ থেকে মুক্ত হয়ে র‍্যাবাই হতে চেয়েছিলেন তিনি।৪৮ চিকিৎসক হিসাবে নিজেকে পরিচিত করে তোলা গাযার এক মেধাবী কাব্বালিস্টের কথা জানতে পেরে তাঁর সাথে দেখা করতে রওয়ানা হয়ে যান। এই র‍্যাবাই নাথান আগেই শাব্বেতাইয়ের কথা শুনেছিলেন; সম্ভবত একই সময়ে পরস্পরের কাছে অপরিচিত অবস্থায় জেরুজালেমে থাকার সময়। শাব্বেতাইয়ের ‘অদ্ভুত কাজকর্মের’ একটা কিছু নিশ্চয়ই নাথানের কল্পনায় ঠাঁই করে নিয়েছিল, কারণ অতিথির আগমনের অল্প আগে তাঁর সম্পর্কে একটা দৈববাণী পান তিনি। সম্প্রতি লুরিয় কাব্বালাহয় দীক্ষা নিয়েছিলেন তিনি, এবং পুরিমের ঠিক আগে নিজেকে বন্দি করে উপবাস পালন করে শ্লোক আবৃত্তি করার মাধ্যমে ধ্যানে বসেছিলেন। এই ধ্যানের সময় শাব্বেতাইকে দিব্যচোখে দেখতে পান তিনি ও স্বকণ্ঠে তাঁকে চিৎকার করে ভবিষ্যদ্বাণী উচ্চারণ করতে শুনতে পান। ‘আর প্রভু এইরকম কহেন! তোমার ত্রাণকর্তার আবির্ভাব প্রত্যক্ষ করো। শাব্বেতাই যেভি তাঁর নাম। তিনি ক্রন্দন করবেন, হ্যাঁ, গর্জন করবেন, আমার শত্রুকে পরাস্ত করবেন।৪৯ সত্যিই শাব্বেতাই যখন তাঁর বাড়ির দরজায় এসে হাজির হলেন, নাথান একে কেবল ভবিষ্যদ্বাণীসুলভ সেই দিব্যদর্শনের প্রমাণ হিসাবেই কল্পনা করতে পেরেছিলেন।

কেমন করে নাথানের মতো একজন মেধাবী মানুষ এই বিষণ্ন, বিপর্যস্ত মানুষটিকে নিজের ত্রাতা ভাবতে পেরেছিলেন? লুরিয় কাব্বালাহ মোতাবেক একেবারে সূচনাতেই মেসায়াহ যিমযুমের আদি প্রক্রিয়ার সময় সৃষ্ট ঈশ্বরহীন বলয়ে আটকা পড়ে গিয়েছিলেন। সুতরাং ‘অন্য পক্ষের’ অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করতে বাধ্য হয়েছিলেন মেসায়াহ। কিন্তু এখন, কাব্বালিস্টদের প্রায়শ্চিত্তমূলক অনুশীলনের কল্যাণে নাথান বিশ্বাস করেছিলেন, এই দানবীয় শক্তিগুলো মেসায়াহর উপর নিয়ন্ত্রণ হারাতে শুরু করেছে। সময়ে সময়ে তাঁর আত্মা নিজেকে মুক্ত করে শূন্যে ভেসে যায় এবং মেসিয়ানিক যুগের নতুন বিধান অবতীর্ণ করে। কিন্তু এখনও বিজয় সম্পূর্ণ হয়নি। সময়ে সময়ে মেসায়াহ আবারও অন্ধকারের শিকারে পরিণত হন। এসবই শাব্বেতাইয়ের ব্যক্তিত্ব ও অভিজ্ঞতার সাথে যেন নিখুঁতভাবে মিলে গিয়েছিল বলে মনে হয়েছে। তিনি পৌঁছানোর পর নাথান তাঁকে বললেন, সমাপ্তি আসন্ন। অচিরেই অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে তাঁর বিজয় পূর্ণাঙ্গ রূপ নেবে, ইহুদি জনগণের পক্ষে মুক্তি নিয়ে আসবেন তিনি। পুরোনো আইন রদ হয়ে যাবে, এক সময়ের নিষিদ্ধ কাজ ও পাপ পবিত্র হয়ে যাবে।

প্রথমে নাথানের এই কল্পনা-বিলাসের সাথে তাল মেলাতে রাজি হননি শাব্বেতাই, কিন্তু ক্রমে তরুণ র‍্যাবাইয়ের বাগ্মীতার কাছে পরাস্ত হন তিনি, এসব অন্তত তাঁর বিচিত্র আচরণের একটা ব্যাখ্যা যুগিয়েছিল তাঁকে। ২৮শে মে, ১৬৬৫ নিজেকে মেসায়াহ ঘোষণা করেন শাব্বেতাই। আর নাথানও সাথে সাথে অচিরেই ত্রাণকর্তা অটোমান সুলতানকে পরাস্ত করবেন, ইহুদিদের নির্বাসনের অবসান ঘটাবেন ও তাদের আবার পবিত্র ভূমিতে ফিরিয়ে আনবেন, সকল জেন্টাইল জাতি তাঁর কাছে নতি স্বীকার করবে ঘোষণা দিয়ে মিশর, আলেপ্পো ও স্মিরনায় চিঠি পাঠান।৫১ দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে এই খবর। ১৬৬৬ সাল নাগাদ ইউরোপের প্রায় সমস্ত বসতি, অটোমান সাম্রাজ্য ও ইরানে শেকড় গেড়ে বসে মেসিয়ানিক উন্মাদনা। উন্মত্ত সব দৃশ্যের সৃষ্টি হয়েছিল: ইহুদিরা সহায়সম্পদ বিক্রি করে প্যালেস্তাইনে পাড়ি জমানোর প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছিল। ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির হয়ে পড়ে। সময়ে সময়ে মেসায়াহ কোনও উপবাস দিনের প্রথা বাতিল করেছেন বলে শুনতে পেত তারা, তখন মিছিল করে নেমে আসত রাস্তায়, নাচত। নাথান এই বলে নির্দেশ জারি করেছিলেন যে, ইহুদিদের সাফেদের প্রায়শ্চিত্তমূলক আচার পালন করে সমাপ্তিকে ত্বরান্বিত করতে হবে। ইউরোপ, মিশর, ইরান, বালকান, ইতালি, আমস্টারডাম, পোল্যান্ড ও ফ্রান্সে ইহুদিরা উপবাস পালন করে, রাত্রি জাগরণ করে, বরফ শীতল পানিতে ডুবে থাকে, বিছুটি পাতায় গড়াগড়ি খায় এবং গরীবদের ভিক্ষা দিতে থাকে। এটা ছিল আধুনিকতার গোড়ার দিকে সূচিত অনেকগুলো মহাজাগরণের (গ্রেট অ্যাওয়াকেনিং) অন্যতম। এই সময় লোকে সহজাত প্রবৃত্তির বশেই বড় ধরনের পরিবর্তন আসার কথা জানতে পারে। খোদ শাব্বেতাই সম্পর্কে খুব অল্প লোকই বিস্তারিত জানত। আর নাথানের দুর্বোধ্য কাব্বালিস্টিক দিব্যদর্শন সম্পর্কে ওয়াকিবহালের সংখ্যা ছিল আরও কম; মেসায়াহ এসেছেন এবং দীর্ঘ প্রতীক্ষিত আশা পূরণ হতে চলেছে, এটা জানাই যথেষ্ট ছিল। এইসব আনন্দমুখর মাসে ইহুদিরা এতটাই আশা ও প্রাণশক্তিতে জেগে উঠেছিল যে ঘেটোর কর্কশ, সীমিত জীবন মিলিয়ে গেছে বলে মনে হয়েছে। সম্পূর্ণ ভিন্ন কিছুর স্বাদ লাভ করেছিল তারা, অনেকের জীবনই আর কখনও আগের মতো হবে না। নতুন সম্ভাবনার আভাস পেয়েছিল ওরা, একেবারে নাগালের ভেতর মনে হয়েছে সেটা। নিজেদের মুক্ত ভেবে অনেক ইহুদিই ধরে নিয়েছিল পুরোনো জীবন চিরকালের জন্যে বিদায় নিয়েছে।৫৩

শাব্বেতাই বা নাথানের প্রত্যক্ষ প্রভাবের অধীনে আগত ইহুদিরা পরিচিত জীবনধারার পূর্ণাঙ্গ প্রত্যাখ্যান বোঝানো সত্ত্বেও তোরাহকে বাতিল করতে প্রস্তুত আছে বলে দেখিয়েছে। মেসায়াহর রাজকীয় জোব্বা গায়ে সিনাগগে গিয়ে শ্যাব্বেতাই যখন কোনও উপবাস প্রথা বাতিল করেছেন, ঈশ্বরের নিষিদ্ধ নাম উচ্চারণ করেছেন, অকোশার খাবার খেয়ছেন বা সিনাগগে ঐশীগ্রন্থ পাঠ করার জন্যে মহিলাকে আহ্বান জানিয়েছেন, লোকে পরমানন্দে মেতে উঠেছে। তবে সবাই গ্রস্ত হয়নি অবশ্যই-প্রত্যেক মহল্লাতেই র‍্যাবাই ও সাধারণ মানুষ ছিলেন যাঁরা এইসব পরিবর্তনে রীতিমতো শঙ্কিত হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু ধনী-গরীব সকল শ্রেণীর মানুষ শাব্বেতাইকে গ্রহণ করে নিয়েছিল ও তাঁর নৈতিকতা বিরোধিতাকে স্বাগত জানিয়েছে। আইন ইহুদিদের রক্ষা করতে পারেনি, এখনও তাতে অক্ষম বলেই মনে হচ্ছে। ইহুদিরা এখনও নির্যাতিত। এখনও নির্বাসিত; জাতি নতুন মুক্তির জন্যে প্রস্তুত হয়ে ছিল।৫৪

অবশ্য, খুবই বিপজ্জনক ছিল ব্যাপারটা। লুরিয় কাব্বালাহ ছিল মিথ, বাস্তব রাজনৈতিক কর্মসূচিতে এইভাবে এর রূপায়নের কথা ছিল না, বরং আত্মার অন্তস্থঃ জীবন আলোকিত করে তোলার কথা ছিল। মিথোস ও লোগোস সম্পূরক কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন স্তরের উপাদান, এদের ভিন্ন ভিন্ন ভূমিকা ছিল। রাজনীতি ছিল যুক্তি ও যৌক্তিকতার এখতিয়ার। মিথ একে অর্থ যুগিয়েছে। কিন্তু নাথান যেভাবে ইসাক লুরিয়ার অতীন্দ্রিয়বাদী দিব্যদৃষ্টিকে তরজমা করেছেন, সেভাবে আক্ষরিকভাবে অনূদিত হবে বলে মনে করা হয়নি। ইহুদিরা নিজেদের শক্তিশালী, মুক্ত ও নিয়তির নিয়ন্তা ভেবে থাকতে পারে, কিন্তু তাদের পরিপার্শ্ব বদলায়নি। তখনও দুর্বল, নাজুক ও শাসকদের সুনামের উপর নির্ভরশীল ছিল তারা। অন্ধকারের শক্তির সাথে লড়াইয়ে লিপ্ত মেসায়াহর লুরিয়ানিক ইমেজ ছিল অশুভের বিরুদ্ধে সর্বজনীন সংগ্রামের শক্তিশালী প্রতীক, কিন্তু যখন এই ইমেজকে বাস্তব, আবেগের দিক থেকে অপ্রকৃতিস্থ কোনও ব্যক্তিতে কঠিন চেহারা দেওয়ার প্রয়াস পাওয়া হয়, তার ফল কেবল বিপর্যয়করই হতে পারে।

সত্যিই তাই প্রমাণিত হয়েছিল। ১৬৬৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে নাথানের আশীর্বাদ নিয়ে সুলতানের মুখোমুখি হতে রওয়ান হন শাব্বেতাই। বোধগম্যভাবেই বুনো ইহুদি উৎসাহের ব্যাপারে সতর্ক ছিলেন সুলতান, যৌক্তিকভাবেই বিদ্রোহের আশঙ্কা করছিলেন তিনি। গ্যালিপোলির কাছে শাব্বেতাই অবতরণ করার পর তাঁকে গ্রেপ্তার করে ইস্তাম্বুলে নিয়ে যাওয়া হয়, হাজির করা হয় সুলতানের সামনে। মৃত্যুদণ্ড বা ইসলাম ধর্ম গ্রহণের ভেতর যেকোনও একটি বেছে নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয় তাঁকে। সারা পৃথিবীর ইহুদিদের সন্ত্রস্ত করে ইসলাম বেছে নেন শাব্বেতাই। ধর্মদ্রোহীতে পরিণত হন মেসায়াহ।

এখানেই ব্যাপারটার সমাপ্তি ঘটা উচিত ছিল। বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ শাব্বেতাইয়ের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, প্রবল গ্লানি নিয়ে আবার স্বাভাবিক জীবন ও তোরাহর পূর্ণাঙ্গ অনুসরণে ফিরে যায় তারা; পুরো দুঃখজনক ব্যাপারটাকে ভুলে যাওয়া প্রয়াস পায়। কিন্তু উল্লেখযোগ্য সংখ্যালঘু একটা দল মুক্তির স্বপ্ন বিসর্জন দিতে পারেনি। ওরা বিশ্বাস করতে পারেনি যে, ওই উত্তেজনাকর মাসগুলোয় ওদের মুক্তির অভিজ্ঞতা স্রেফ কুহক ছিল, এক ধর্মদ্রোহী মেসায়াহর সাথে মানিয়ে নিতে পেরেছিল তারা, ঠিক আদি ক্রিশ্চানরা যেভাবে সাধারণ অপরাধীর মতো মৃত্যুবরণকারী একজন মেসায়াহর একই রকম কেলেঙ্কারীজনক ধারণাকে মেনে নিয়েছিল।

প্রবল বিষণ্নতার একটা সময় পার করে নিজস্ব ধর্মতত্ত্বে পরিবর্তন আনেন নাথান। মুক্তির সূচনা ঘটেছে, ব্যাখ্যা করেছেন তিনি, কিন্তু একটা বিপর্যয় ঘটে গেছে। অপবিত্রতার আরও গভীর বলয়ে অবতরণে বাধ্য হয়েছেন শাব্বেতাই, স্বয়ং তিনি অশুভের রূপ ধারণ করেছেন। এটাই ছিল ‘চূড়ান্ত পবিত্র পাপ,’ তিক্কুনের শেষ কাজ।৫ শাব্বেতাইয়ের প্রতি বিশ্বস্ত রয়ে যাওয়া শাব্বেতিয়রা ভিন্ন ভিন্নভাবে এই পরিবর্তনের প্রতি সাড়া দেয়। আমস্টারডামে খুবই জনপ্রিয় ছিল নাথানের ধর্মতত্ত্বঃ এবার মেসায়াহ ইহুদিবাদের মূলকে আঁকড়ে থেকে মারানোতে পরিণত হয়েছেন, বাইরে বাইরে ইসলামের অনুসারী হওয়ার ভান করছেন।৫৬ অনেক আগে থেকেই তোরাহ নিয়ে সমস্যায় আক্রান্ত মারানোরা মুক্তি সম্পূর্ণ হওয়ামাত্র এর অবসান কামনা করেছে। অন্য ইহুদিরা বিশ্বাস করেছে যে, মোসায়াহ সম্পূর্ণ মুক্তি না আনা পর্যন্ত তাদের তোরাহ অনুসরণ করতে হবে; তবে এরপর এক নতুন আইনের প্রবর্তন করবেন তিনি, যা সবদিক থেকেই পুরোনো আইনের বিরোধিতা করবে। রেডিক্যাল শাব্বেতিয়দের একটা ছোট গোষ্ঠী আরও সামনে অগ্রসর হয়েছিল। সাময়িক ভিত্তিতেও আর পুরোনো আইনে প্রত্যাবর্তন করতে পারছিল না তারা, তাদের বিশ্বাস ছিল ইহুদিদেরও মেসায়াহকে অনুসরণ করে অশুভের বলয়ে গিয়ে ধর্মদ্রোহীতে পরিণত হতে হবে। মুলধারার ধর্ম বিশ্বাস বেছে নেয় তারা—ইউরোপে ক্রিশ্চান ধর্ম এবং মধ্যপ্রাচ্যে ইসলাম-কিন্তু আপন ঘরের সীমানায় ইহুদিই রয়ে গেছে।৫৭ এই রেডিক্যাল ইহুদিরা একটা আধুনিক সমাধানও দেখতে পেয়েছিল: অনেক ক্ষেত্রেই বহু ইহুদি জেন্টাইল সংস্কৃতির সাথে মিশে যাবে, কিন্তু ভিন্ন স্তরে বিচ্ছিন্ন রেখে নিজেদের বিশ্বাস ব্যক্তিকরণ করেছে।

শাব্বেতিয়রা ভেবেছিল শাব্বেতাই বুঝি মহাকষ্টে তাঁর দ্বৈত জীবন যাপন করছেন, কিন্তু আসলে মুসলিম পরিচয়ে দারুণ সন্তুষ্ট ছিলেন তিনি। ইসলামের পবিত্র আইন শরীয়াহ পাঠ করে দিন কাটাচ্ছিলেন আর সুলতানের আধ্যাত্মিক উপদেষ্টাদের ইহুদি ধর্ম সম্পর্কে শিক্ষা দিচ্ছিলেন। অতিথিদের সাথে দেখা করার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল তাঁকে, দরবার বসাতেন তিনি, সারা দুনিয়ার বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা ইহুদি প্রতিনিধি দলের সাথে সাক্ষাৎ করতেন। শাব্বেতাইয়ের অনন্য ধার্মিকতার কথা বলত তারা। অনেক সময় শাব্বেতাইকে নিজের বাড়িতে তোরাহ স্ক্রোল হাতে হাইম গাইতে দেখা যেত; লোকে তাঁর ভক্তি ও অন্য লোকের অনুভূতিতে তাঁর সহানুভূতির সাথে প্রবেশের ক্ষমতায় বিস্ময়ে অভিভূত হত।৫৮ শাব্বেতাই গোষ্ঠীর ধারণা আর নাথান গোষ্ঠীর ধারণা একেবারেই ভিন্ন ছিল এবং জেন্টাইলদের প্রতি ঢের বেশি ইতিবাচক। শাব্বেতাই যেন সকল ধর্মবিশ্বাসকেই বৈধ বিবেচনা করেছিলেন। নিজেকে ইসলাম ও ইহুদিবাদের ভেতর সেতুবন্ধ হিসাবে কল্পনা করেছেন তিনি; আবার খৃস্টধর্ম ও জেসাসকে নিয়েও অভিভূত ছিলেন। অতিথিরা জানিয়েছেন যে, অনেক সময় তিনি মুসলিমের মতো আচরণ করতেন, অবার অনেক সময় র‍্যাবাইয়ের মতো। অটোমানরা ইহুদি উৎসব পালনের অনুমতি দিয়েছিল তাঁকে। শাব্বেতইকে প্রায়ই এক হাতে কোরান ও অন্য হাতে তোরাহ স্ক্রোল নিতে দেখা যেত।৫৯ সিনাগগে শাব্বেতাই ইহুদিদের ইসলামে ধর্মান্তরিত করার চেষ্টা করতেন; কেবল তাহলেই, বলতেন তিনি, পবিত্র ভূমিতে ফিরে যেতে পারবে তারা। ১৬৬৯ সালে লেখা এক চিঠিতে বাধ্য হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণের ব্যাপারটি জোরের সাথে অস্বীকার করেন শ্যাব্বতাই, তিনি মন্তব্য করেন, ইসলাম ধর্ম ‘প্রকৃতই সত্যি,’ তাঁকে জেন্টাইল ও ইহুদি উভয় পক্ষের জন্যে মেসায়াহ হিসাবে পাঠানো হয়েছে।

১৬৭৬ সালের ১৭ই সেপ্টেম্বর শাব্বেতেইয়ের মৃত্যু ছিল শাব্বেতিয়দের জন্যে এক প্রবল আঘাত, কারণ এতে মুক্তির সমস্ত আশাই তিরোহিত হয়ে গেছে বলে মনে হয়েছে। তাসত্ত্বেও গোষ্ঠীটি গোপনে অস্তিত্ব বজায় রাখে; তারা দেখিয়ে দেয় যে মেসিয়ানিক বিস্ফোরণ কোনও হুজুগে ঘটনা ছিল না; বরং ইহুদি অভিজ্ঞতার কোনও মৌলিক জায়গা স্পর্শ করেছে। অনেকের কাছে এই ধর্মীয় আন্দোলন একটা সেতুবন্ধ ছিল যা তাদের পরে যৌক্তিক আধুনিকতায় উত্তরণের কঠিন পর্ব পার হতে সাহায্য করবে। অনেকেই যেমন দ্রুততার সাথে তোরাহকে বিসর্জন দিতে প্ৰস্তুত ছিল, এবং এক নতুন বিধানের স্বপ্ন দেখার বেলায় শাব্বেতিয়দের অটলতা দেখায় যে পরিবর্তন ও সংস্কারের জন্যে তৈরি ছিল তারা।৬১ শাব্বেতাই ও শাব্বেতিয় মতবাদের উপর বেশ কয়েকটি গ্রন্থের লেখক গারশোম শোলেম যুক্তি দেখিয়েছেন যে, এই ক্ষুদ্র শাব্বেতিয় গোষ্ঠীই ইহুদি আলোকন বা সংস্কার আন্দোলনের অগ্রপথিকে পরিণত হবে। প্রাগের জোসেফ হোয়াইটের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন তিনি। উনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে তিনিই প্রথম পূর্ব ইউরোপে আলোকনের ধারণার বিস্তার ঘটিয়েছিলেন। শাব্বেতিয় ছিলেন তিনি। হাঙেরিতে সংস্কার আন্দোলন সূচিতকারী আরন শোভিনও তরুণ বয়সে শাব্বেতিয় ছিলেন।৬২ শোলেমের তত্ত্বের বিরোধিতা করা হয়েছে; একে প্রত্যক্ষভাবে সত্যি বা মিথ্যা প্রমাণ করা সম্ভব নয়। তবে সাধারণভাবে এটা মেনে নেওয়া হয় যে, শাব্বেতিয়বাদ প্রচলিত রাব্বিনিক কর্তৃত্বকে খাট করার বেলায় ভালো ভুমিকা রেখেছে এবং ইহুদিদের টাবু ও অসম্ভব মনে করা পরিবর্তনের কথা ভাবতে শিখিয়েছে।

শাব্বেতাইয়ের মৃত্যুর পর দুটো রেডিক্যাল শাব্বেতিয় আন্দোলন ইহুদিদের প্রধান ধর্মে গণ ধর্মান্তরের দিকে চালিত করেছিল। ১৬৮১ সালে অটোমান তুরস্কের আনুমানিক ২০০ পরিবার ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। দোনমেহদের (‘ধর্মান্তরিত’) এই গোষ্ঠীটির নিজেদের সিনাগগ ছিল, তবে মসজিদেও প্রার্থনা করত তারা। উনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগে তুঙ্গ সময়ে গোষ্ঠীর সদস্য সংখ্যা দাঁড়ায় ১১৫,০০০ জনে। উনবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে এটি ভেঙে যেতে শুরু করে, সদস্যরা এই সময় আধুনিক সেক্যুলার শিক্ষা লাভ করছিল ও ধর্মের প্রয়োজন আছে মনে করছিল না। কিছু সংখ্যক দোনমেহ তরুণ ১৯০৮ সালের সেক্যুলারিস্ট তরুণ তুর্কি বিদ্রোহে সক্রিয় হয়ে ওঠে। এই আন্দোলনগুলোর দ্বিতীয়টি ছিল আরও ভয়ঙ্কর ও তা মিথের আক্ষরিক অনুবাদের ফলে গড়ে ওঠা নৈরাজ্যবাদের নজীর দেখিয়েছে। জ্যাকব ফ্রাংক (১৭২৬-৯১) বালকান সফরের সময় শাব্বেতিয়বাদে দীক্ষা লাভ করেন। নিজ দেশ পোল্যান্ডে ফেরার পর এক গোপন গোষ্ঠী গড়ে তোলেন তিনি যার সদস্যরা প্রকাশ্যে ইহুদি বিধান পালন করত, কিন্তু গোপনে নিষিদ্ধ যৌন কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থাকত। ১৭৫৬ সালে তাঁকে সমাজচ্যুত করা হলে ফ্রাংক প্রথমে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন (তুরস্কে এক সফরকালে) এবং সদলবলে আবার ক্যাথলিক মতবাদে দীক্ষা নেন।

ফ্রাংক স্রেফ তোরাহর নিষেধাজ্ঞা ঝেড়ে ফেলেননি, বরং ইতিবাচকভাবে অনৈতিকতাকে আলিঙ্গন করেছেন। তাঁর দৃষ্টিতে তোরাহ কেবল সেকেলেই নয়, বরং বিপজ্জনক ও অর্থহীন হয়ে গেছে। কমান্ডমেন্টসমূহ মৃত্যুর আইন, সুতরাং একে অবশ্যই পরিত্যাগ করতে হবে। পাপ ও লজ্জাহীনতাই মুক্তি লাভ ও ঈশ্বরকে পাওয়ার একমাত্র পথ। নির্মাণ করতে নয়, বরং ‘ধ্বংস ও নিশ্চিহ্ন করতেই’৬৪ এসেছেন ফ্রাংক। তাঁর অনুসারীরা সকল ধর্মীয় বিধানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত ছিল: ‘তোমাদের বলে দিচ্ছি, যোদ্ধাদের অবশ্যই ধর্মহীন হতে হবে, যার মানে তোমাদের অবশ্যই নিজের শক্তিতে মুক্তি লাভ করতে হবে। আজকের দিনের অনেক রেডিক্যাল সেক্যুলারিস্টের মতো ফ্রাংক সকল ধর্মকেই ক্ষতিকর হিসাবে দেখেছেন। তাঁর আন্দোলন গড়ে ওঠার সাথে সাথে ফ্রাংকবাদীরা রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে, এক বিরাট বিপ্লবের স্বপ্ন দেখেছিল তারা যার ভেতর দিয়ে অতীত ভেসে যাবে, জেগে উঠবে এক নতুন পৃথিবী। ফরাসী বিপ্লবকে তারা তাদের স্বপ্নের সত্যতার আলামত ও তাদের পক্ষে ঈশ্বরের হস্তক্ষেপ ভেবেছে।৬৬

ইহুদিরা আধুনিক কালের বহু ভঙ্গিমারই আভাস দিয়েছে। ইউরোপের আগ্রাসীমূলক আধুনিকায়নের সমাজের সাথে বেদনাদায়ক সংঘাত তাদের সেক্যুলারিজম, সংশয়বাদ, নাস্তিক্যবাদ, যুক্তিবাদ, নৈরাজ্যবাদ, বহুত্ববাদ ও ধর্মের ব্যক্তিকরণের মতো নানা ধারণার দিকে চালিত করেছে। অধিকাংশ ইহুদির কাছে পশ্চিমে গড়ে উঠতে থাকা উন্নয়নের পথটি ধর্মের ভেতর দিয়েই অগ্রসর হয়েছে, কিন্তু এই ধর্ম বিংশ শতাব্দীতে আমরা যে ধর্মের সাথে অভ্যস্ত তা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিল। অনেক বেশি পৌরাণিক ভিত্তিক ছিল তা; আক্ষরিকভাবে ঐশীগ্রন্থ পাঠ করত না এবং নতুন নতুন সমাধান নিয়ে এগিয়ে আসতে সম্পূর্ণ প্রস্তুত ছিল, যেগুলোর কোনও কোনওটা নতুন কিছুর সন্ধানের ক্ষেত্রে ভয়ঙ্কর মনে হয়েছে। প্রাক আধুনিক সমাজে ধর্মের ভূমিকা বোঝার জন্যে আমাদের মুসলিম জগতের দিকে নজর দিতে হবে, আধুনিকতার গোড়ার দিককার নিজস্ব উত্থান-পতনের পর্যায় অতিক্রম করছিল এই ধর্ম এবং ভিন্ন ধরনের আধ্যাত্মিকতা গড়ে তুলছিল যা আধুনিক কালেও মুসলিমদের প্রভাবিত করে চলবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *