ঘরের বাইরে
খাবার টেবিলে টুম্পার প্লেটে ছোট খালা একটা বড় ইলিশ মাছের টুকরো দিলেন, টুম্পা আপত্তি করতে গিয়ে থেমে গেল। তার ইলিশ মাছ খুব ভালো লাগে, কাটা বেছে খেতে খুব সময় লাগে তবুও সে ধৈর্য ধরে ইলিশ মাছ খায়।
সুমি বলল, টুম্পা আপু আজকাল রাত না হলে তোমার সাথে দেখা হয়
আই এম সরি–
সুমি বলল, না–না–তুমি সরি হবে কেন। মেজো খালুর সাথে তোমার দেখা হয়েছে শুনে আমাদের যে কী ভালো লাগছে। আমাদেরও মেজো খালুকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে।
আব্বুর সাথে দেখা করা এতো সোজা হবে না! স্কিৎজোফ্রেনিয়া আছে তো–খুব খারাপ অবস্থা!
রুমি বলল, দেখা না হলেও ঠিক আছে। তোমার কাছ থেকে গল্প শুনতেই এতো মজা লাগে আমার!
সুমি বলল হ্যাঁ। টুম্পা আপু তুমি এতো মজা করে গল্প করতে পার। আজকে কী হয়েছে বলবে আপু! সবকিছু
ছোট খালা একটা ধমক দিলেন, বললেন, মেয়েটাকে খেতে দে দেখি। সারাক্ষণ নিজেরাও বকর বকর করবি অন্যদেরকেও বকর বকর করাবি?
টুম্পা হেসে বলল, আমারও বকর বকর করতে খুব ভালো লাগে ছোট খালা?
এতো ভালো লাগিয়ে কাজ নেই, আগে খা। এখানে এসে যদি শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাস তোর আম্মু আমাকে কাঁচা খেয়ে ফেলবে।
টুম্পা মাথা নাড়লো, বলল, না ছোট খালা, আরও খুশি হবে। আমেরিকাতে শুকনা থাকা হচ্ছে স্টাইল। যে যত শুকনা সে তত সুন্দরী। কিন্তু তোমার সেইটা নিয়ে চিন্তা করতে হবে না– আমি রাক্ষসের মতো খাচ্ছি। শুধু যদি ইলিশ মাছে এতো কাটা না থাকতো–
দেব আমি কাটা বেছে?
না না ছোট খালা–
আমার সাথে ঢং করিস না। দে বেছে দিই–বলে সত্যি সত্যি টুম্পার মাছটা নিয়ে কাটা বেছে দিতে লাগলেন। সুমি আর রুমি চোখ বড় বড় করে টুম্পার দিকে তাকিয়েছিল, টুম্পা বলল, তোমরা এইভাবে আমার দিকে তাকাচ্ছ কেন? আগে কখনো কাউকে মাছের কাঁটা বেছে দিতে দেখ নাই? নাকি তোমাদের হিংসা হচ্ছে।
রুমি মাথা নাড়ল, না টুম্পা আপু মোটেও হিংসা হচ্ছে না।
টুম্পা খুব সখ করে ইলিশ মাছ খেতে খেতে বলল, ছোট খালু, এখানে ভালো আর্ট সাপ্লাই কোথায় পাওয়া যায়?
ছোট খালু জিজ্ঞেস করলেন, কী রকম আর্ট সাপ্লাই?
আমি আব্বুকে দিয়ে ছবি আঁকানোর চেষ্টা করছিলাম, আব্বু দেখি কিছুতেই আঁকতে চান না। তাই ভাবছিলাম একটা ইজেল, কয়েকটা ক্যানভাস আর এক্রেলিক পেইন্ট কিনে দিই। সবগুলো রং থাকলে মনে হয় আঁকতে ইচ্ছে করবে। কোথায় পাওয়া যাবে ছোট খালু?
নিউ মার্কেট। এসবের জন্যে নিউ মার্কেট সবচেয়ে ভালো।
টুম্পা ছোট খালাকে বলল, আমাকে একটু নিউ মার্কেট নিয়ে যাবে ছোট খালা?
সুমি বলল, আমিও যাব তোমার সাথে।
রুমি বলল, তাহলে আমিও যাব।
টুম্পা একবার রুমির দিকে আরেকবার সুমির দিকে তাকিয়ে বলল, আই এম রিয়েলি সরি।
কেন তুমি রিয়েলি সরি?
কোথায় আমাদের সবাই মিলে কক্সবাজার রাঙ্গামাটি যাবার কথা, তার বদলে আমরা যাচ্ছি নিউমার্কেটে রং কিনতে!
না, টুম্পা আপু–
আমার খুব খারাপ লাগছে! তোমাদের সবার সব রকম প্ল্যান আমার জন্যে উল্টাপাল্টা হয়ে গেল।
সুমি বলল, না টুম্পা আপু, তুমি এরকম বলো না। কক্সবাজার রাঙ্গামাটি গেলে আমাদের যত আনন্দ হতো তোমাকে এতো খুশি দেখে আমাদের তার চেয়ে বেশি আনন্দ হচ্ছে।
ছোট খালু বললেন, সুমি কথাটা ভুল বলে নাই। ঠিকই বলেছে। আমরাও যদি কিছু করতে পারতাম তাহলে আরও ভালো লাগতো।
ছোট খালু, আপনাদের আর কিছু করতে হবে না। আমার এই সব সহ্য করছেন সেইটাই অনেক বেশি। থ্যাংকু। থ্যাংকু থ্যাংকু।
ছোট খালা ইলিশ মাছের আরেকটা বড় টুকরো প্লেটে নিয়ে বললেন, আরে এই মেয়েটাকে নিয়ে দেখি মহা মুশকিল। কথায় কথায় খালি বলে থ্যাংকু।
.
টুম্পা যখন ঘাড়ে করে বড় ইজেলটা নিয়ে ঢুকলো আব্বু একটু অবাক হয়ে টুম্পার দিকে তাকালেন। টুম্পা বলল, দেখো তোমার জন্যে কী এনেছি।
আব্বুর চোখ কেমন যেন চক চক করে উঠলো। ইজেলটা ধরে তার উপরে হাত বুলালেন। টুম্পা বগল থেকে ফ্রেমে লাগনো ক্যানভাসগুলো নামাতে নামাতে বলল, কয়েক সাইজের ক্যানভাস এনেছি। তোমার যেরকম ইচ্ছা করবে সেরকম আঁকবে।
ইজেলের মাঝে মাঝারী সাইজের একটা ক্যানভাস লাগিয়ে বলল, এই দেখো কী সুন্দর। দেখলেই ছবি আঁকার জন্যে হাত চুলবুল করে, তাই না আব্বু?
আব্বু কোনো কথা না বলে সাবধানে ক্যানভাসের উপর হাত বুলালেন। টুম্পা তার পিঠ থেকে ব্যাকপেকটা নামিয়ে ভেতর থেকে এক্রেলিক রংগুলো বের করে বলল, বারোটা রঙয়ের একটা সেট এনেছি। ইন্ডিয়ান। দোকানদার বলেছে কোয়ালিটি না কী ভালোই, সবাই এগুলোই ব্যবহার করে। জার্মান রংগুলোর দাম অনেক বেশি।
টুম্পা চারটা আলাদা আলাদা সাইজের তুলি বের করে বলল, আব্বু এই তুলিগুলো এনেছি তোমার জন্যে। কাজ চলবে না?
আব্বু তুলিগুলো খুটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন, কোনো কথা বললেন না। টুম্পা ইজেলটা টেনে জানালার কাছে নিয়ে পর্দাটা টেনে দিতেই ঘরের ভেতর এক ঝলক আলো এসে ঢুকলো। আব্বু হাত দিয়ে চোখ আড়াল করে দুইপা পিছিয়ে গিয়ে একটা ভয়ের মতো শব্দ করলেন। টুম্পা বলল, কী হয়েছে?
জানালাটা বন্ধ কর। কেউ দেখে ফেলবে।
কেউ দেখবে না আব্বু। আর দেখলেও কোনো ক্ষতি নেই।
কেন ক্ষতি নেই?
টুম্পা শান্ত গলায় বলল, আব্বু, তুমি তো খুব স্মার্ট একজন মানুষ, তাই আব্বু?
কেন?
তুমি আগে বল, তুমি স্মার্ট মানুষ কী না? যদি তুমি স্মার্ট না হতে তাহলে তুমি কী এতো বড় আর্টিস্ট হতে পারতে? এতো কম বয়সে জাতীয় পুরস্কার পেতে? বল।
এর সাথে স্মার্ট হওয়ার কোনো সম্পর্ক নাই।
আছে। টুম্পা মাথা নাড়ল, বলল, সম্পর্ক আছে। তোমার একটা জিনিষ বুঝতে হবে।
কী জিনিষ?
তোমার একটা অসুখ আছে সেইটার নাম স্কিৎজোফ্রেনিয়া। খুব ভয়ংকর অসুখ। তোমার সেই অসুখটা নিয়ে বাঁচা শিখতে হবে।
আব্বুকে কেমন জানি অসহায় দেখালো, মাথা নেড়ে বললো, টুম্পা, তোর কোনো কথা আমি বুঝতে পারছি না।
তুমি সব সময় বল তোমাকে সি.আই.এ. মার্ডার করার জন্যে আসছে। তুমি নিশ্চয়ই মাঝে মাঝে তাদের দেখতে পাও। পাও না?
হ্যাঁ। দেখতে না পেলে কখনো বলতাম?
তোমার এখন বুঝতে হবে যে আসলে তারা নাই। তোমার তাদের দেখা পাওয়াটা হচ্ছে তোমার অসুখ। তোমার স্কিৎজোফ্রেনিয়া আছে বলে সেটা তুমি দেখো। এটাই তোমার অসুখ।
তুই কী বলছিস আবাল তাবোল?
আমি আবোল তাবোল বলছি না আব্বু, আমি একেবারে সত্যি কথা বলছি। তুমি যখন দেখবে কোনো সি.আই.এ. তোমাকে মার্ডার করতে আসছে তখন তুমি নিজেকে বলবে, আসলে এরা মিথ্যা। আমি এদেরকে দেখতে পাচ্ছি কিন্তু এরা মিথ্যা। আমার স্কিৎজোফ্রেনিয়া আছে বলে আমি এদেরকে দেখি। মিথ্যা মিথ্যা দেখি।
আব্বু অবাক হয়ে টুম্পার দিকে তাকিয়ে রইলেন। টুম্পা আব্বুর হাত ধরে বলল, আব্বু। আমি তোমার মেয়ে। তোমাকে আমি অসম্ভব ভালোবাসি। অসম্ভব অসম্ভব ভালোবাসি। অমি কী তোমাকে মিথ্যা কথা বলব?
আব্বু মাথা নাড়লেন, বললেন, না। তাহলে? আব্বু কোনো কথা না বলে টুম্পার দিকে তাকিয়ে রইলেন। টুম্পা বলল, আব্বু, তুমি আমার কথা বিশ্বাস কর। আমি চাই তুমি আস্তে আবার নরমাল হয়ে যাও। হাসো, কথা বল, ঘর থেকে বের হওঁ, সবার বাসায় বেড়াতে যাও, আর সবচেয়ে বড় কথা– তুমি আবার ছবি আঁকা শুরু করো।
আব্বু একটা নিঃশ্বাস ফেললেন। টুম্পা আব্বুকে হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে বলল, আমি জানি তুমি পারবে আব্বু। তুমি পারবেই পারবে। তুমি চেষ্টা করো ছবি আঁকতে। নাও এই তুলিটা ধরো–।
টুম্পা আব্বু হাতে তুলিটা ধরিয়ে দিয়ে বললো, বল তুমি আগে তোমাকে কোন রংটা গুলে দেব। বল।
আব্বু কিছু বললেন না তুলি হাতে সাদা ক্যানভাসটার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, ক্যানভাসে আঁকার আগে সেটা মাথার ভেতরে আঁকতে হয়। ছবিটার কথা ভাবতে হয়।
টুম্পা উজ্জ্বল মুখে বলল, তুমি সেটা ভাব আব্বু। আমি তো সেইটাই চাই।
সেটার জন্যে তো সময় লাগে।
তুমি সময় নাও আব্বু। তোমার যত সময় লাগে তুমি ততো সময় নাও। আমি তোমাকে তাড়াহুড়া করবো না।
আব্বু তখন ক্যানভাসটার দিকে তাকিয়ে রইলেন, টুম্পা দেখলো তার আব্বুর চোখ জ্বল জ্বল করছে, ভুরুগুলো কুঁচকে আছে দেখে মনে হচ্ছে তার কষ্ট হচ্ছে। খুব কষ্ট হচ্ছে। টুম্পা ঠিক বুঝতে পারল না, সে কী না জেনে তার আব্বুকে কোনো বিপদের মাঝে ঠেলে দিচ্ছে?
আব্বু অনেকক্ষণ ক্যানভাসের সামনে দাঁড়িয়ে রইলেন তারপর একটা নিঃশ্বাস ফেলে তার বিছানায় বসে বললেন, পারছি না।
আব্বুর মুখ দেখে টুম্পার খুব মায়া হলো। টুম্পা বলল, থাক আব্বু আজ থাক। যখন তোমার ইচ্ছে করবে তখন তুমি আঁকবে।
আব্বু আবার আরেকটা নিঃশ্বাস ফেললেন, আগেরটা থেকেও বড়, তারপর বললেন, আমি মনে হয় আর কোনোদিনই ছবি আঁকতে পারব না।
কেন এরকম কথা বলছ আব্বু?
কততদিন আমি ছবি আঁকি না জানিস? জোর করে কী আর ছবি আঁকা যায়?
ঠিক আছে তোমার জোর করে ছবি আঁকতে হবে না। যেদিন তোমার ইচ্ছে করবে সেদিন আঁকবে। চল এখন আমরা বাইরে থেকে হেঁটে আসি।
আব্বু চোখ বড় বড় করে বললেন, হেঁটে আসি? বাইরে থেকে?
হ্যাঁ। তুমি কী সারা জীবন দরজা জানালা বন্ধ করে ঘরে বসে থাকবে না। কী? তোমাকে ঘর থেকে বের হতে হবে না?
কিন্তু–
আব্বু আমি তোমার কোনো কিন্তু শুনব না। চল আমার সাথে। একটু হেঁটে আসি। তারপর কোনো এটা ফাস্টফুডের দোকানে বসে আমরা খাব। বাবা এবং মেয়ের নিরিবিলি লাঞ্চ!
আব্বু আবার বললেন, কিন্তু–
কোনো কিন্তু না। চল আব্বু চল। ঘর থেকে বের হলেই তুমি দেখবে আসলে তোমার সব ভয় হচ্ছে মিথ্যা।
টুম্পা শেষ পর্যন্ত সত্যি সত্যি আব্বুকে ঘর থেকে বের করে নিয়ে এল। অভ্যাস নেই বলে সিঁড়ি দিয়ে নামতে আব্বুর রীতিমতো অসুবিধে হচ্ছিল, টুম্পা সাবধানে আব্বুকে হাত ধরে নামালো। গেট খুলে বের হবার সময় টুম্পা লক্ষ করল আব্বু অল্প অল্প কাঁপছেন। টুম্পা আব্বুর হাত ধরে রাখে, হাতটি বরফের মতো ঠাণ্ডা। আবুকে ধরে ধরে টুম্পা রাস্তায় নিয়ে আসে। রাস্তার দুই পাশে দোকান, দোকানের ভেতরে মানুষ। ফুটপাথ ধরে মানুষ হাঁটছে। রাস্তায় রিকশা, সি.এন.জি. ক্যাব আর গাড়ি শব্দ করতে করতে যাচ্ছে সেগুলোর ভেতরেও মানুষ। আব্বুকে দেখে মনে হচ্ছে প্রত্যেকটা মানুষকেই আব্বু সন্দেহ করছেন, তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছেন তারা আব্বুকে খুন করতে চাইছে কী না। টুম্পা নরম গলায় আব্বুর সাথে কথা বলতে থাকে, বলে, আব্বু তুমি অনেক টেন্সড আপ হয়ে আছ। একটু রিলাক্স করো আব্বু, দেখো তোমার ভয়ের কিছু নেই। ঐ ছোট বাচ্চাটাকে দেখো আব্বু কতো কিউট, দেখেছ? এইটুকুন ছোট বাচ্চা পত্রিকা বিক্রি করছে, দেখে কী মায়া লাগে, তাই না? আমেরিকা থেকে এই দেশে এসে আমার সবচেয়ে বেশি অবাক লেগেছে কী জান? এই দেশে ছোট বাচ্চাদের কতো কষ্ট! খুব মায়া লাগে।
আব্বু টুম্পার কোনো কথা শুনছিলেন কী না বোঝা যাচ্ছিল না, টুম্পার হাত ধরে আস্তে আস্তে হাঁটতে থাকলেন। টুম্পা অনুভব করল আব্বু খুব ধীরে ধীরে একটু সহজ হয়েছেন। পুরো শরীরটা এতোক্ষণ শক্ত হয়েছিল শেষ পর্যন্ত সেটা একটু শিথিল হয়েছে, এতোক্ষণ মনে হয় নিঃশ্বাস আটকে রেখেছিলেন, এখন সহজ ভাবেই নিঃশ্বাস নিচ্ছেন। শুধু ভয়ে ভয়ে মানুষের মুখের দিকে না তাকিয়ে এখন অন্য সব কিছুই দেখছেন। একটা গরু হেলতে দুলতে যাচ্ছিল আব্বু খুব মনোযোগ দিয়ে সেটা দেখলেন এবং একটু হেসে ফেললেন। রাস্তার পাশে ময়লা জমে আছে সেখানে কয়েকটা কাক জোরে জোরে কা কা শব্দ করে ঝগড়া করছিল আব্বু সেটাও খুব মনোযোগ দিয়ে দেখলেন। হাঁটতে হাঁটতে থেমে গিয়ে আকাশের দিকে তাকালেন, তারপর ইলেকট্রিক তারের দিকে তাকালেন, ঘরের কার্নিশে বসে থাকা চড়ুই পাখিগুলো দেখলেন। দেখে খুব মজা পেলেন বলে মনে হলো।
টুম্পা জিজ্ঞেস করল, আব্বু, তুমি কোথাও বসবে?
কেন?
তোমার তো হেঁটে অভ্যাস নেই। টায়ার্ড হয়ে যাও নাই?
না। টায়ার্ড হই নাই।
টায়ার্ড হলে বলো, তাহলে আমরা কোথাও রেস্ট নেবো।
ঠিক আছে, বলব।
দুজনে আরও কিছুক্ষণ হাঁটলো। রাস্তার পাশে একটা আধুনিক শপিং মল পাওয়া গেল। আব্বু ঢুকতে রাজী হচ্ছিলেন না টুম্পা বুঝিয়ে শুনিয়ে ভিতর নিয়ে গেল। ভিতরে ঢুকে অবশ্যি আব্বু খুব মজা পেলেন বলে মনে হলো, খুব আগ্রহ নিয়ে দোকানগুলোকে দেখলেন। একটা বইয়ের দোকানের ভেতরে সাহস করে ঢুকে অনেক সময় নিয়ে বইগুলো দেখলেন।
একটু পরে টুম্পার নিজেরই খিদে লাগতে লাগলো, সে আব্বুর হাত ধরে বলল, আব্বু খিদে লেগেছে।
খিদে লেগেছে?
হ্যাঁ আব্বু। খাব।
আব্বুকে একটু দুশ্চিন্তিত দেখায়, কোথায় খাবি?
এই যে বাইরে একটা ফাস্ট ফুডের দোকান আছে।
ফাস্ট ফুড? আব্বুকে দেখে মনে হলো আব্বু ফাস্ট ফুড কথাটাও ঠিক ভালো করে বুঝতে পারলেন না।
হ্যাঁ। ফাস্ট ফুড। আস আমার সাথে। টুম্পা তার আব্বুর হাত ধরে বাইরে নিয়ে আসে। একটু হেঁটে ফাস্ট ফুডের দোকানটা খুঁজে বের করে দুজনে ভিতরে ঢুকলো। আব্বুকে এক জায়গায় বসিয়ে সে গেল খাবার আনতে।
.
দুজনে খেয়ে যখন বের হয়েছে তখন আব্বু বললেন, এখন বাসায় যাব।
টুম্পা মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ। বাসায় গিয়ে তুমি এখন ঘুমাবে।
আব্বু বাধ্য ছেলের মতো মাথা নাড়লেন। ফিরে যেতে শুরু করায় একটু পরেই টুম্পা আবিষ্কার করলো সে রাস্তা হারিয়ে ফেলেছে। খানিকদূর গিয়ে বুঝতে পারলো ভুল রাস্তায় এসেছে তখন আবার আগের জায়গায় ফিরে এসে নূতন করে রওনা দিতে হলো। খানিকদুর গিয়ে টুম্পার মনে হতে লাগলো রাস্তাটা অপরিচিত মনে হচ্ছে। টুম্পা তবুও আরেকটু এগিয়ে যায় অবাক হয়ে দেখে রাস্তাটা কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা মনে হচ্ছে। আব্বু মনে হয় ঠিক বুঝতে পারছেন না, টুম্পার সাথে সাথে অন্যমনস্ক ভাবে হাঁটছেন। টুম্পা তখন আবার ফিরে যাবার জন্যে রওনা দিতে যাচ্ছিল তখন হঠাৎ কোথা থেকে কয়েকজন মানুষ ছুটে আসতে থাকে। তাদের ছুটে আসার ভঙ্গিটা দেখে টুম্পার বুকটা হঠাৎ ধ্বক করে ওঠে। সামনের মানুষটার হাতে একটা রিভলবার সেটা উঁচু করে রেখেছে। কিছু বোঝার আগইে মানুষগুলো তাদের দুজনকে ঘিরে ফেলল। রিভলবার হাতে মানুষটা আব্বুর বুকের কাপড় ধরে মাথার মাঝে রিভলবার লাগিয়ে চিৎকার করে বলল, যা আছে বের কর শূওরের বাচ্চা!
দুইজন এসে টুম্পাকে ধরে ফেলেছে, একজন তার গলায় লকেটটা ধরে হ্যাঁচকা টান দিয়ে সেটা ছিঁড়ে নিয়েছে। টুম্পা কিছুই বুঝতে পারছে না। শুধু টের পাচ্ছে ভয়াবহ একটা আতংকে তার সমস্ত শরীর অবশ হয়ে যাচ্ছে। কেউ একজন একটা চাকু বের করে তার গলায় ধরে বলছে, মোবাইল দে। মোবাইল দে ছেমড়ি।
টুম্পা কোনোমতে বলল, মোবাইল নাই।
খবরদার মিছা কথা বলবি না, জবাই কইরা ফালামু—
টুম্পা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তার আগেই একজন তার আব্বুকে বুকে ধাক্কা দিয়ে বলল, মানি ব্যাগ বের কর–, আব্বু একেবারেই প্রস্তুত ছিলেন না। একেবারে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলেন, কপালের কাছে একটু কেটে গেল কিন্তু একটুও শব্দ করলেন না, তার চোখের মাঝে অদ্ভুত একটা শূন্য দৃষ্টি। মানুষগুলো আব্বুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে রিভলবারটা দিয়ে আব্বুর মাথায় মেরে বলল, মানিব্যাগ দে শূওরের বাচ্চা, দে মানিব্যাগ! আব্বু কিছু একটা বলার চেষ্টা করলেন কিন্তু কিছু বলতে পারলেন না– ঠোঁট দুটো শুধু নড়তে লাগলো।
টুম্পা টের পেলো কেউ একজন তার ব্যাগটা হ্যাঁচকা টান দিয়ে নিয়ে নিয়েছে– খামচি দিয়ে তার চুল ধরে পিছনে টেনে নিতে গিয়ে ছেড়ে দিল। কিছু বোঝার আগে মানুষগুলো হঠাৎ করে তাদের ছেড়ে দিয়ে ধুপধাপ করে দৌড়ে চলে যেতে শুরু করে– টুম্পা তখনও পরিষ্কার করে কিছু বুঝতে পারছে না, মনে হয় একটা ভয়াবহ ঘোরের মাঝে আছে, মনে হচ্ছে বুঝি একটা ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন দেখছে। টুম্পা তার আব্বুর কাছে গিয়ে আব্বুর হাত ধরলো, আব্বুর শরীর থরথর করে কাঁপছে, চোখ মুখে একটা অসহায় আতংক। কপাল কেটে রক্ত বের হচ্ছে, মুখের একটা পাশ রক্তে মাখামাখি হয়ে গেছে। টুম্পা মুখ তুলে তাকালো, একটা গাড়ি আসছে, গাড়িটা তাদের পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিল হঠাৎ করে থেমে গেল। দরজা খুলে একজন মানুষ নেমে এসেছে, অবাক হয়ে বলল, কী হয়েছে?
টুম্পা আব্বুকে ধরে রেখে বলল, আমার আব্বু– আমার আব্বু—
মানুষটা আবার জিজ্ঞেস করল, ছিনতাই?
টুম্পা মাথা নাড়ল, বলল একটা ফোন করে দেবেন, প্লিজ?
মানুষটা পকেট থেকে মোবাইল বের করে বলল কত নম্বর? টুম্পা ছোট খালার নম্বরটা দেয়, শুধু এই নম্বরটা তার জানা আছে। মানুষটি ছোট খালার কাছে যখন ফোন করছে টুম্পা তখন তার আব্বুকে ডাকলো, আব্বু! আব্বু!
আব্বু মাথা ঘুরিয়ে টুম্পার দিকে তাকালেন, টুম্পাকে দেখে হঠাৎ ভয় পেয়ে চিৎকার করে উঠে মুখ ঢেকে ফেললেন, মাথা নেড়ে বলতে থাকলেন, না—না-না।
আমি টুম্পা, অমি টুম্পা—
আব্বু মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, চলে যাও–চলে যাও তুমি চলে যাও।
আব্বুর কথা শুনে হঠাৎ টুম্পার বুকটা ভেঙে গেল। তাকে তুমি করে বলছেন কেন? চলে যেতে বলছেন কেন?
গাড়ি থেকে নেমে আসা মানুষটা তার মোবাইল টেলিফোনটা টুম্পার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, নাও। কথা বলো–
টুম্পা টেলিফোনটা হাতে নেয়, তাকিয়ে দেখে তাদের ঘিরে একদল মানুষের ভীড় জমে উঠছে। একটু আগে রাস্তাটা ফাঁকা ছিল, এখন হঠাৎ করে এতো মানুষ কোথা থেকে এসেছে? টুম্পা টেলিফোনটা হাতে নিতেই শুনতে পেল অন্যপাশ থেকে ছোট খালা চিৎকার করে বলছেন, কী হয়েছে টুম্পা? কী হয়েছে?
টুম্পা ভাঙ্গা গলায় বলল, ছোটখালা– তারপর ভেউ ভেউ করে কাঁদতে লাগলো।
.
হাসপাতালের বারান্দায় টুম্পা দাঁড়িয়েছিল, টুম্পার হাত ধরে রেখেছে সুমি। টুম্পাকে সান্ত্বনা দিয়ে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল ঠিক তখন ভেতর থেকে ডাক্তার সাহেব, ছোট খালা, ছোট খালু, শুভ চৌধুরী এবং আরো দুয়েকজন বের হয়ে এলেন। টুম্পা একটু এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, আব্বু কেমন আছেন?
ডাক্তার সাহেব বললেন, ভালো।
মাথায় যে ব্যথা পেয়েছেন—
ডাক্তার সাহেব হাত দিয়ে ওটা উড়িয়ে দিয়ে বললেন, ওটা খুব মাইনর একটু কাট। সারফেস উন্ড। ব্লিডিং হয়েছিল বলে সবাই ঘাবড়ে গেছে। কোনো স্টিচ পর্যন্ত লাগে নি।
টুম্পা বুক থেকে আটকে থাকা একটা নিঃশ্বাস বের করে দেয়। ডাক্তার সাহেব বললেন, তবে–
তবে কী?
তোমার আব্বুর সমস্যাটা কিন্তু মাথার কাটাটা না। সমস্যা সম্পূর্ণ অন্য জায়গায়।
টুম্পা ভয় পাওয়া গলায় বলল, সমস্যা কোথায়?
তোমাকে বলেছি যে তোমার আব্বুর স্কিৎজোফ্রেনিয়া আছে। তার একটা ইলিউশন আছে যে তাকে কিছু মানুষ মেরে ফেলতে চেষ্টা করছে। আজকের ঘটনার পরে তোমার আব্বুর ধারণা একবোরে কনফার্ম হয়েছে। তার ধারণা–
কী ধারণা?
ডাক্তার সাহেব একটু ইতস্ততঃ করে বললেন, আমি ঠিক কীভাবে বলব বুঝতে পারছি না।
শুভ চৌধুরী একটু এগিয়ে এসে বললেন, আমি বলছি। তারপর টুম্পার দিকে তাকালেন। ডান হাত দিয়ে মাথার চুলগুলো সোজা করতে করতে বললেন, দেখো মেয়ে আমি কোনো ভূমিকা না করে সোজাসুজি বলি। তুমি বুলবুলের মেয়ে, থাকো আমেরিকায়। দুইদিনের জন্যে দেশে বেড়াতে এসে বুলবুলের জীবন নষ্ট করার তোমার কোনো রাইট নাই।
ছোট খালা বাধা দিয়ে বললেন, আরে! আপনি কী বলছেন?
শুভ চৌধুরী চোখ কটমট করে ছোট খালার দিকে তাকিয়ে বললেন, দেখেন–আপনারা কোনো কথা বলবেন না। গত দশ বছর এই মানুষটার কেউ খোঁজ খবর নেয় নাই। খোঁজ নিয়েছি আমি। বুঝেছেন? তাই আপনারা বড় বড় কথা বলবেন না।
শুভ চৌধুরী টুম্পার দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি সেদিনের বাচ্চা মেয়ে এখানে এসে বুলবুলকে ঘর থেকে বের করে নিয়ে গেলে কোন সাহসে?
টুম্পার মুখ রক্তশূন্য হয়ে গেল। সে ফ্যাকাসে মুখে শুভ চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে রইলো। চৌধুরী বললেন, লাইফটা একটা নাটক না যে তুমি দুইদিনের জন্যে আমেরিকা থেকে এসে একটা পার্ট করে চলে গেলে। এই মানুষটাকে তোমরা কেউ দেখে রাখবে না। তাকে দেখে রাখব আমরা। কাজেই তোমরা যখন খুশি এসে তাকে নিয়ে ইমোশনাল ব্ল্যাক মেলিং করতে পারবে না।
টুম্পা ফিস ফিস করে বলল, আই এম সরি।
শুভ চৌধুরী বলল, তুমি জান তুমি তোমার আব্বুর কতো বড় ড্যামেজ করেছ? চারজন মানুষ মিলে ধরে রাখতে পারে না। হাসপাতালের বেডে জন্তুর মতো দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখতে হয়েছে। সিডেটিভ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখতে হয়েছে– ঘুম থেকে ওঠে কী করবে কেউ জানে না। ডু ইউ নো?
টুম্পার চোখ থেকে এক ফোঁটা পানি বের হয়ে গাল বেয়ে নিচে নেমে এল। শুভ চৌধুরী সেটা লক্ষ্য করল বলে মনে হলো না, নিষ্ঠুরের মতো বললেন, তোমার কী লাভ হলো? তোমার আব্বু নিজে এখন বিশ্বাস করে তুমি তাকে খুন করার জন্যে নিয়ে গেছো। তোমার মুখ দেখলে মানুষটা ভয়ে চিৎকার। করতে থাকে! এই সব কিছু হয়েছে তোমার জন্যে। বুঝেছ?
টুম্পা মাথা নিচু করে ঠোঁট কামড়ে ধরল, ডাক্তার সাহেব বললেন, ঠিক আছে, ঠিক আছে যথেষ্ট হয়েছে।
না না যথেষ্ট হয় নাই। শুভ চৌধুরী রেগে ওঠে বললেন, দশ বছর কেউ মানুষটার কোনো খোঁজ নেয় নাই। এখন হঠাৎ করে এসে মানুষটাকে নিয়ে নাটক? শোনো মেয়ে, আমি তোমাকে স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই। হাসপাতাল থেকে বুলবুল যখন রিলিজ পাবে, সে যখন তার বাসায় যাবে আমি তোমাকে তার ধারে কাছে দেখতে চাই না। বুঝেছ?
টুম্পা হাত দিয়ে চেপে চোখ মুছতে মুছতে বলল, বুঝেছি।
তুমি তোমার আপুকে যদি শেষবার দেখে যেতে চাও, তাহলে যাও কেবিনের ভেতরে গিয়ে দেখে আস। যখন ঘুমিয়ে আছে তখন। মানুষটা জেগে উঠলে তুমি আর তার সামনে যেতে পারবে না– দড়ি দিয়ে একটা মানুষকে বেঁধে রাখলে মানুষকে কেমন দেখায় সেটাও তুমি দেখে আস।
টুম্পা মুখ তুলে সবার দিকে তাকাল, তারপর বলল, ঠিক আছে। আমি আপুকে গুড বাই বলে আসি।
সবাই বাইরে দাঁড়িয়ে রইল, টুম্পা বড় একটা নিঃশ্বাস নিয়ে কেবিনের ভেতর ঢুকে গেল। ছোট খালা ভেতরে ঢুকতে গিয়ে থেমে গেলেন, ভেতর থেকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার আওয়াজ আসছে। এই মায়াবতী মেয়েটির কষ্ট নিজের চোখে দেখতে চান না ছোট খালা।