দেয়ালে ঝোলানো ছবি
টুম্পার ঘুম ভাঙার পরও সে কিছুক্ষণ মনে করতে পারল না সে কোথায়। কিছু একটা সে খুঁজছে কিন্তু খুঁজে পাচ্ছে না এরকম কিছু তার মনে হতে থাকে। চারপাশে এক ধরনের কোলাহল, অপরিচিত শব্দ, শা শা করে কিছু একটা ঘুরছে, বাতাস বইছে সেখান থেকে কিন্তু তার মাঝে অদ্ভুত ভ্যাপসা এক ধরণের গরম। টুম্পা চোখ খুললো এবং হঠাৎ করে তার মনে পড়লো সে বাংলাদেশে এসেছে। সে এখানে চার সপ্তাই থাকবে, আজ তার প্রথম দিন। ছোট খালার বাসায় সুমির বিছানায় সে শুয়ে আছে, শাঁ শাঁ শব্দটা আসছে মাথার উপরের সিলিং ফ্যান থেকে। বাইরে এক ধরনের কোলাহল, গাড়ির হর্ন, বাস ট্রাকের গর্জন, রিক্সার বেল মানুষের গলার আওয়াজ, তার মাঝে একটা কাক কা কা করে ডেকে উড়ে গেল। ঠিক কী কারণ জানা নেই টুম্পার ভেতরে এক ধরনের দুঃখ দুঃখ ভাব এসে ভর করেছে। কোনো কারণ নেই তবু তার মাঝে মাঝে মন খারাপ হয়ে যায়, কীভাবে এটা হয় কে জানে? টুম্পা কিছুক্ষণ নিঃশব্দে শুয়ে রইলো, চোখ ঘুরে ঘুরে দেওয়ালে টানানো ছবিটার দিকে গেল এবং সে তখন বিছানা থেকে নেমে এল।
এক দুই বছরের একটা হাসি খুশি বাচ্চার ছবি। বাচ্চাটি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে, ঠোঁটের কোণে দুষ্টুমির এক ধরনের হাসি, ঠিক কী কারণ জানা নেই কিন্তু ছবিটাকে তার খুব পরিচিত মনে হয়। আগে যেন কোথায় দেখেছে। কলম আর তুলি দিয়ে আঁকা, ছবিটা যে এঁকেছে সে নিশ্চয়ই অসাধারণ একজন শিল্পী, ঠিক যে কয়টা কলমের আঁচড় আর যে কয়টা তুলির স্পর্শ দেয়া দরকার, ঠিক সেই কয়টা দিয়েছে, তার থেকে একটি বেশিও নেই একটি কমও নেই। ছবিটাতে অপ্রয়োজনীয় একটা দাগ নেই, একজন মানুষ কেমন করে এতো পরিচ্ছন্ন ছবি আঁকতে পারে? সবচেয়ে বড় কথা এতো অল্প আঁচড়ে যে ছবিটা এঁকেছে সেটা একটা অসাধারণ ছবি, শিশুটির চোখে এক ধরনের বিস্ময় যেটা শুধুমাত্র এই বয়সের শিশুর চোখে দেখা যায়, ঠোঁটের কোণার হাসিটুকু মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে সারা মুখে ছড়িয়ে পড়বে! কী সাধারণ একটা ছবি কিন্তু কী অসাধারণ টুম্পা মুগ্ধ বিস্ময় নিয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকে।
ঠিক তখন সাবধানে দরজা খুলে ছোট খালা ঘরে উঁকি দিলেন, টুম্পাকে দেখে খুশি খুশি গলায় বললেন, ও! তুই উঠে গেছিস?
হ্যাঁ। ছোট খালা উঠেছি। যেভাবে ঘুমাচ্ছিলি আমার মনে হচ্ছিল আজ বুঝি আর উঠবি না।
হা ছোট খালা। একেবারে মড়ার মতো ঘুমিয়েছি। এটাকেই নিশ্চয়ই বলে জেট লেগের ঘুম।
হাত মুখ ধুয়ে আয়, কিছু একটা খাবি—
টুম্পা বলল, ছোট খালা।
কী?
এই ছবিটা কে এঁকেছে?
ছোটখালা ছবিটার দিকে তাকিয়ে চোখ বড় বড় করে বললেন, ও মা! বুঝতে পারিস নি?
না তো–
এটা তোর ছবি। তোর বাবার আঁকা—
আমার বাবা? টুম্পা চমকে উঠলেন, আ-আমার-বাবা?
হ্যাঁ। তোর বাবা যদি পাগল হয়ে না যেতো তাহলে অনেক বড় আর্টিস্ট হতো।
আমার বাবা ছবি আঁকতো?
ও মা! তুই জানিস না বুঝি?
না।
তোর বাবা তো আর্টিস্ট ছিল, খুব সুন্দর ছবি আঁকতো। তুই যে এতো সুন্দর ছবি আঁকিস সেটা কী এমনি এমনি?
টুম্পা এখন ছবিটার আরেকটু কাছে এগিয়ে যায়, ছবির এক কোণে টানা হাতে সিগনেচার, বুলবুল রায়হান। তার বাবার নাম বুলবুল রায়হান, টুম্পা রায়হানের বাবা বুলবুল রায়হান। টুম্পা তার বাবার নামটুকু ছাড়া আর কিছু জানেনা। এখন বাবার হাতে আঁকা একটা ছবি দেখছে, তার নিজের ছবি। তার বাবা নিশ্চয়ই গভীর ভালোবাসায় এই ছবিটি এঁকেছিলেন, হঠাৎ করে টুম্পার চোখে পানি এসে যায়।
তোর মা তোক কোনোদিন কিছু বলে নাই?
টুম্পা আবার মাথা নাড়লো। ছোট খালার মুখটা কেমন জানি গম্ভীর হয়ে যায়, মানুষটা অসম্ভব হাসিখুশি মানুষ গম্ভীর হতে জানেই না, কষ্ট করে গম্ভীর হলে তাকে অপরিচিত মানুষের মতো দেখাতে থাকে। ছোট খালা অপরিচিত মানুষের মতো মুখ করে বললেন, তোর বাবার কারণে তোর মা অনেক কষ্ট পেয়েছে তো–
টুম্পা খপ করে ছোট খালার হাত ধরে বলল, আমাকে বলবে ছোট খালা?
ছোট খালা টুম্পাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল, বলব না কেন। নিশ্চয়ই বলব।
তাহলে বল।
এখনই শুনতে হবে কেন। কোনো একদিন সময় করে বলব।
টুম্পার গলাটা ভেঙে আসে, কোনোমতে বলল, ছোটখালা।
কী মা?
শুধু একটা জিনিস বল।
কী জিনিস?
আমার আব্বু কী এখনো বেঁচে আছেন?
ছোট খালা টুম্পাকে শক্ত করে ধরে বললেন, কে বলবে মা? তোর মা এখানে থাকতেই একবার সুইসাইড করার চেষ্টা করল। এখন কী করেছে কে জানে? বেঁচে থাকলেও কোথায় আছে কেমন আছে কে বলবে? তোর আব্বু কপালে শুধু দুঃখ নিয়ে এসেছিল। তোর মতো এতো মায়াভরা একটা মেয়ে সে দেখতে পেলো না–ছোট খালা টুম্পাকে জড়িয়ে ধরে হাউ মাউ করে কাঁদতে লাগলেন।
কান্নার শব্দ শুনেই হোক বা এমনিতেই তোক ঠিক তখন সুমি ঘরে এসে ঢুকলো, এক নজর তার মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, আম্মু! ভালো হচ্ছে না আম্মু! তুমি এইভাবে টুম্পা আপুকে টর্চার করতে পারবে না।
ছোট খালা টুম্পাকে ছেড়ে দিয়ে হাসার চেষ্টা করলেন। বললেন, ঠিক আছে যা। টর্চার করব না।
.
বিকেলবেলা সুমি টুম্পাকে নিয়ে বের হয়েছে। ছোট খাটো কয়েকটা জিনিস কিনতে হবে সেগুলো কিনে টুম্পাকে নিয়ে দোকানপাটে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এলাকাটা বড়লোকদের, দোকানগুলো ঝকঝকে তকতকে, ভেতরে সাজানো গোছানো, কিন্তু দোকান থেকে বের হলেই দেখা যায় গরিব মানুষ। টুম্পা এই গরিব মানুষগুলো থেকে চোখ সরাতে পারে না, তার মনে হতে থাকে সে বুঝি ন্যাশনাল জিওগ্রাফির একটা চ্যানেলের ভেতর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। চারপাশে এতো মানুষ, মানুষগুলোর মাঝে এক ধরনের বিবর্ণ ভাব। পথে ঘাটে ভিক্ষুক। বিকলাঙ্গ মানুষ শুয়ে শুয়ে গান করে ভিক্ষা করছে। কী আশ্চর্য লাগে দেখলে।
টুম্পাকে নিয়ে সুমি একটা হ্যাঁন্ডিক্র্যাফটের দোকানে ঢুকেছে কী একটা কিনে দাম দেয়ার জন্যে কাউন্টারে অপেক্ষা করছে, তখন টুম্পা বাইরে বের হয়ে ফুটপাথে অপেক্ষা করতে লাগলো।
সামনে রাস্তা, সেই রাস্তা দিয়ে গাড়ি বাস টেম্পু যাচ্ছে। টুম্পা এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকে। এতো ছোট একটা রাস্তা দিয়ে এতোগুলো গাড়ি এতো গায়ে গায়ে লেগে কেমন করে যেতে পারে টুম্পার সেটা বিশ্বাস হয় না।
আপা দুইটা টাকা দিবেন। রিনরিনে একধরনের গলার আওয়াজ শুনে টুম্পা চমকে উঠলো–ছোট একটি বাচ্চা মেয়ে মুখটাকে যতোটুকু সম্ভব করুণ করে তার সামনে হাত পেতে দাঁড়িয়েছে। টুম্পার জীবনে কখনো এরকম একটা কিছু ঘটে নি। সে অবাক হয়ে মেয়েটার দিকে তাকালো, মেয়েটার খালি গা, নাকে একটা নাকফুল ঠোঁট দুটো টকটকে লাল, কী দিয়ে ঠোঁটকে লাল করেছে। কে জানে। বড় বড় কালো চোখ মাথা ভরা লালচে চুল। মুখটাকে আরো করুণ করে বলল, দিবেন দুইটা টাকা? ভাত খামু।
টুম্পা থতমত খেয়ে বলল, দুই টাকা দিয়ে ভাত পাওয়া যায়?
মেয়েটা তখন ফিক করে হেসে ফেলল, এবং টুম্পা বুঝতে পারলো আসলে ভাত খাওয়ার কথাটি বলেছে সমবেদনা পাওয়ার জন্যে। দুই টাকা দিয়ে ভাত হয় না, মেয়েটা তখন বলল, তাহলে লজেন্স খামু।
এটা তবু মোটামুটি একটা যুক্তির কথা। এতো ছোট একটা বাচ্চা মেয়ে এই বয়সে ভিক্ষে করছে, টুম্পার কেমন জানি অস্বস্তি হয়। সে নরম গলায় বলল, আমার কাছে তো দুই টাকা নেই। তোমার একটা ছবি তুলে দেই?
মেয়েটার করুণ মুখ মুহূর্তে আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। বড় বড় চোখ করে বলে, দেন।
টুম্পা তার ডিজিটাল ক্যামেরাটা বের করল, বাংলাদেশে এসে এটি হবে তার প্রথম ছবি। মেয়েটি দুই হাত পাশে নিয়ে প্রায় এটেনশান হয়ে থাকার ভঙ্গীতে দাঁড়ালো, টুম্পা বলল, একটু হাসো।
মেয়েটি সাথে সাথে ফিক করে হেসে দেয়। টুম্পা শাটার টিপতেই মেয়েটির হাসি মুখ ছবিতে আটকা পড়ে যায়–চমৎকার একটা ছবি হয়েছে, দেখে টুম্পার মনটা ভালো হয়ে গেল। টুম্পা মেয়েটাকে ডাকলো, এই দেখো তোমার ছবি।
ছবিটা দেখে মেয়েটা চমৎকৃত হয়ে যায়, আমার ছবি। এইখানে দেখা যায়। ছোড়ু টেলিভিশন?
না। এটা টেলিভিশন না, এটা ক্যামেরা।
কী সুন্দর!
হ্যাঁ। অনেক সুন্দর। তোমার নাম কী?
ময়না। ময়না, তোমার ঠোঁট দুটি এরকম লাল করেছ কেমন করে?
ময়না দাঁত বের করে হেসে কোমরে গুঁজে রাখা এক টুকরো পাতলা লাল কাগজ বের করে দেখালো। এটা চিবিয়ে ঠোঁটে ঘষলেই ঠোঁট লাল হয়ে যায়!
ময়নার সাথে কথা বলার সময় কীভাবে কীভাবে জানি তার বয়সী অনেকগুলো বাচ্চা ধীরে ধীরে টুম্পাকে ঘিরে দাঁড়ালো। সবাই মুখটা করুণ করে হাত পেতে বলতে লাগলো, দুইটা টাকা দেবেন? ভাত খামু।
ময়না উত্তেজিত গলায় বলে, এই আফা ফটো তুলে। আমার ফটো তুলছে।
সাথে সাথে সবাই হাত নামিয়ে বলতে লাগলো, আমার ফটো। আমার ফটো।
টুম্পা তখন একজন একজন করে সবার ফটো তুলতে লাগলো। ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে হাসতে হবে এবং না হাসা পর্যন্ত সে ফটো তুলবে না জানার পরেও একজন কিছুতেই হাসতে রাজি হচ্ছিল না, শেষ পর্যন্ত তাকে হাসতে বাধ্য করার পর রহস্যটা বোঝা গেল, তার সামনের দুটো দাঁত নেই।
সুমি দোকান থেকে বের হয়ে দেখে টুম্পা ক্যামেরা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এবং তাকে ঘিরে একটা ছোটখাটো ভীড়! সুমি প্রথমে একটু ঘাবড়ে গেলেও একটু পরেই বুঝে গেল এখানে বড় কোনো সমস্যা নেই, টুম্পা হতদরিদ্র বাচ্চাগুলোর ছবি তুলছে। ছবি তুলে তাদের দেখাচ্ছে।
টুম্পা আর সুমি যখন বাসায় ফিরে যেতে থাকে তখন দীর্ঘসময় টুম্পা চুপ করে রইল। সুমি বলল, টুম্পা আপু তুমি কী ভাবছ?
না কিছু না। টুম্পা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, না আমি আসলে কিছু ভাবছি না।
.
ভোর রাতে টুম্পার ঘুম ভেঙে গেল, আর কিছুতেই চোখে ঘুম এল না। এটাকে নিশ্চয়ই জেট লেগ বলে, বাংলাদেশে এখন ভোর রাত তিনটা হতে পারে কিন্তু আমেরিকার সময় অনুযায়ী এখন দুপুর দুইটা। একজন মানুষ দুপুর দুইটার সময় কেমন করে ঘুমায়? টুম্পা খানিকক্ষণ বিছানায় ওলট–পালট করে উঠে পড়লো। মশারির ভেতর বসে থেকে সে চারিদিক দেখছে, কী অদ্ভুত দেখাচ্ছে। সবকিছু। বাংলাদেশে মশারির ভেতর ঘুমাতে হয় সেটা আগেই জানতো, তার ধারণা ছিল মশারির ভেতর শুতে গিয়ে তার দম বন্ধ হয়ে যাবে, কিন্তু মোটেও তা হলো না। বরং তার মনে হতে লাগলো ছোট একটা পুতুলের ঘরের মাঝে শুয়ে আছে!
টুম্পা মশারি তুলে সাবধানে বের হয়ে এল। বাসার সবাই ঘুমাচ্ছে, তাই সে কোনো শব্দ না করে পা টিপে টিপে ডাইনিং টেবিলে রাখা পানির বোতল থেকে ঢেলে এক গ্লাস পানি খেলো তারপর পা টিপে টিপে বাইরের ঘরে এল। সুইচটা খুঁজে বের করতে একটু সময় নিলো, সুইচ টিপতেই ঘরে আলো জ্বলে ওঠে ঠিক তখন কিলবিল করে কী একটা যেন দেওয়ালের ওপর দিয়ে দৌড়ে গেল, আতংকে টুম্পা প্রায় চিৎকার করে উঠছিল, অনেক কষ্ট করে নিজেকে শান্ত করলো। আজ সন্ধ্যেবেলা সে এই প্রাণীটাকে দেখেছে, এটা এক ধরনের সরীসৃপ, সবাই এটাকে ডাকে টিকটিকি। বাসার ভেতরে এই ছোট ছোট সরীসৃপগুলো ঘুরে বেড়ায় কেউ কিছু মনে করে না! টুম্পা এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে টিকটিকিটার দিকে তাকিয়ে রইলো।
বুকের ধুকপুকুনিটা একটু কমার পর সে সোফার মাঝে বসে, টেবিলে কয়েকটা খবরের কাগজ আর ম্যাগাজিন। টুম্পা তার একটা নিয়ে বসে বসে ছবিগুলো দেখতে থাকে। বাংলাদেশের মেয়েরা অসম্ভব সুন্দরী, কী সুন্দর কুচকুচে কালো চুল আর চোখগুলো কী সুন্দর।
খুট করে ঘরের ভেতর একটা শব্দ হলো, টুম্পা তাকিয়ে দেখে ছোট খালা দরজার সামনে ঘুম ঘুম চোখে দাঁড়িয়ে আছেন। অবাক হয়ে বললেন, টুম্পা! এতো রাতে বসে বসে কী করছিস?
জেট লেগ? টুম্পা হাসার চেষ্টা করে বললো, আর ঘুম আসছে না, তাই বসে বসে ম্যাগাজিন দেখছি!
ছোট খালা এগিয়ে এসে বললেন, কিছু খাবি?
টুম্পা আবিষ্কার করলো শুনে অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে কিন্তু সত্যি তার বেশ খিদে লেগেছে। সে অবশ্যি স্বীকার করলো না, জোরে জোরে মাথা নাড়লো, বলল, না ছোট খালা কিছু খাব না।
মুখটা ছোট হয়ে আছে। নিশ্চয়ই তোর খিদে পেয়েছে। কী খাবি?
না ছোট খালা, না।
আমার সাথে ভদ্রতা করবি না। পরটা ভেজে দিই? গরুর গোশত আছে, গরম করে দিই?
না, ছোট খালা না–বলার সময়েই টুম্পা আবিষ্কার করলো তার গলায় সেরকম জোর নেই!
ছোট খালা ফ্রিজ খুলে খাবার বের করে রান্নাঘরে নিয়ে চুলো জ্বালিয়ে খাবার গরম করতে লাগলেন। টুম্পা ভদ্রতা করে আরও এক–দুইবার আপত্তি করে শেষে হাল ছেড়ে দিয়ে ছোট খালাকে সাহায্য করতে লাগলো।
ছোট খালা খাবারগুলো টেবিলে সাজিয়ে কাছাকাছি বসলেন। টুম্পার প্লেটে খাবার তুলে দিতে দিতে বললেন, নে, খা। তোর মতো বয়স থাকলে আমি রাক্ষসের মতো খেতাম!
টুম্পা বলল, আমি রাক্ষসের মতোই খাচ্ছি। তুমি এখন গিয়ে ঘুমাও।
আমার ঘুম নিয়ে তোর চিন্তা করতে হবে না।
আমার খুব লজ্জা লাগছে ছোট খালা—
তুই দেখি তোর বাপের মতো শুরু করলি—
টুম্পা মুখ তুলে ছোট খালার দিকে তাকালো, বলল, আব্বুর মতোন? কী করতে আব্বু?
ছোট খালা একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলে বলল, পাগল হয়ে যাবার আগে তোর আব্বু ছিল একেবারে খাঁটি ভদ্রলোক। তোর মায়ের সাথে বিয়ে হবার পর প্রথমবার যখন শ্বশুরবাড়ি এসেছে আমরা নতুন জামাইকে কতো যন্ত্রণা করেছি মানুষটা মুখ বুজে সহ্য করেছে–
ছোট খালা।
কী?
আব্বুর কোনো ছবি আছে?
থাকার তো কথা। দাঁড়া খুঁজে বের করি– ছোট খালা শেলফ থেকে কয়েকটা এ্যালবাম নামিয়ে নিয়ে এসে খুঁজতে খুঁজতে হঠাৎ করে একটা ছবি বের করলেন। বললেন, এই যে তোর আব্বু।
টুম্পার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে, অসম্ভব সুন্দর একজন মানুষ তার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। বড় বড় এলোমেলো কালো চুল, ঝকঝকে দুটি চোখ। তার নিজের আব্বু? টুম্পার চোখে হঠাৎ পানি এসে যায়।
ছোট খালা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, তোর বাবা তোকে অসম্ভব আদর করতো। যখন পাগল হয়ে গেল তখন মাঝখানে একটা সময় তাকে শেকল দিয়ে বেঁধে রাখতে হতো। অসম্ভব ভায়োলেন্ট হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু তোকে দেখলেই একেবারে শান্ত হয়ে যেতো। তুই তখন ছোট সবাই ভয়। পেতো যদি হঠাৎ করে কিছু একটা করে ফেলে–
আব্বু পাগল হলো কেমন করে?
ছোট খালা মাথা নাড়লেন, বললেন, জানি না। আগে থেকেই মনে হয় একটু সমস্যা ছিল। মাঝে মাঝে গুম হয়ে যেতো কারো সাথে অনেকদিন কথা বলতো না। আমরা ভাবতাম শিল্পী মানুষের মুড! আস্তে আস্তে সমস্যাটা বাড়তে লাগলো রাতে ঘুমাতো না, সারারাত ছাদে হাঁটতো–
চিকিৎসার ব্যবস্থা করে নাই?
করে নাই আবার! অনেক চেষ্টা করেছ। কিছুতেই ডাক্তারের কাছে যাবে না, অনেক ধরে বেঁধে নেয়া হলো, ডাক্তার কঠিন একটা নাম বললো, সিজোফ্রেনিয়া না কী যেন–
টুম্পা বলল, স্কিৎজোফ্রেনিয়া?
হ্যাঁ তাই হবে। ওষুধ পত্র দিলো, সেগুলো খেতে চায় না। খুব বড় একটা এক্সিবিশান হবে, তার জন্যে ছবি আঁকার কথা, রাত জেগে ছবি আঁকে। সেই ছবিগুলো দেখে ভয় লাগে। মজার ব্যাপার জানিস, অনেক দাম দিয়ে সেই ছবি বিক্রি হয়ে গেল, অসাধারণ সব ছবি ছিল।
কোথায় আছে ছবিগুলো?
জানি না। বিদেশিরা কিনে নিয়ে গেছে। পত্রিকায় অনেক ভালো ভালো রিভিউ বের হয়েছিল।
আছে রিভিউগুলো?
থাকলেও খুঁজে পাব না। এই বাসায় কিছু খুঁজে পাওয়া যায় না।
টুম্পা বলল, আব্বু আর কী কী করতো ছোট খালা?
ছবি আঁকার ব্যাপারে খুব নাম করেছিল। দেশে বিদেশে এক্সিবিশান হয়েছে। মানুষটা পাগল না হয়ে গেলে এখন অনেক নাম ডাক হতো।
আম্মুর সাথে ছাড়াছাড়ি হলো কখন?
ছোট খালা একটা নিঃশ্বাস ফেললেন, বললেন, তোর মায়ের সাথে অনেকদিন থেকে সমস্যা হচ্ছিল, আমাদেরকে কিছু জানায় নি। একদিন অনেক রাতে তোর মা এসে হাজির, শরীরে মারের দাগ, ছেঁড়া জামা কাপড়। এসে হাউমাউ করে কান্না আমরা তো অবাক। প্রথমে কেউ বিশ্বাসই করতে চায় না। খোঁজ নিতে গিয়ে দেখে তোর আব্বু বাসার সব কিছু ভেঙেচুরে শেষ করে রেখেছে। সব বই ছিঁড়ে কুটি কুটি করে রেখেছে। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, চোখ লাল, এতো বড় একটা চাকু নিয়ে বসে আছে–
টুম্পা বুকের ভেতর থেকে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, সর্বনাশ!
হ্যাঁ। আমাদের মনে হলো মানুষটা মরে গেলে বুঝি আমরা কম দুঃখ পেতাম। যাই হোক ধরে বেঁধে চিকিৎসার জন্যে নিয়ে যাওয়া হলো, লাভ হলো না। শুধু চিৎকার করে টুম্পা টুম্পা–তোকে দেখার জন্যে পাগল। কিন্তু এতো ভায়োলেন্ট তাই তোকে কাছে নিতে কেউ সাহস করল না। এর মাঝে তোর মায়ের ডিভি হয়ে গেল। আমরা কেউ জানতাম না, লুকিয়ে এপ্লাই করে রেখেছিল। আমরা সবাই না করলাম, আমাদের কারো কথা শুনল না, একরকম জোর করে তোকে নিয়ে আমেরিকা চলে গেল।
আর আব্বু?
এক ক্লিনিক থেকে আরেক ক্লিনিকে। প্রথম কিছুদিন আমরা জানতাম তারপর আস্তে আস্তে আর খবর পেতাম না। মানুষটার আত্মীয় স্বজনেরা কেউ ছিল না, বন্ধু বান্ধবেরা একটু চেষ্টা করেছিল।
তোমার কী মনে হয় ছোট খালা? আব্বু কী বেঁচে আছে?
কেমন করে বলি! বেঁচে থাকলেই কেমন আছে, কে বলবে? আমাদের দেশে এরকম মানুষজনের বেঁচে থাকা খুব কঠিন।
ছোট খালা।
কী মা?
আমি কী আমার আব্বুকে খুঁজে বের করতে পারব?
হ্যাঁ।
ছোট খালা কিছুক্ষণ টুম্পার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, কেমন করে বলি? এই দেশে ছোট কাজটাই এতো কঠিন, আর কঠিন কাজটা তো অসম্ভব। তাছাড়া–
তা ছাড়া কী?
ধরা যাক তুই তোর বাবাকে খুঁজে পেলি। তারপর?
তারপর কী?
তোর যদি আরও অনেক বেশি মন খারাপ হয়ে যায়?
টুম্পা কিছুক্ষণ ছোট খালার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, তাহলে আমি সেটাই চাই ছোট খালা। আরো অনেক বেশি মন খারাপ করতে চাই। অনেক অনেক বেশি।
ছোট খালা একটু অবাক হয়ে টুম্পার দিকে তাকিয়ে রইলেন।