০৬. বুলবুল রায়হান

বুলবুল রায়হান

রুমি টেবিলে একটা কাগজ রেখে একটা কলম নিয়ে বসেছে। তার পাশে বসেছে সুমি আর টুম্পা। রুমি বলল, প্রথমে দেখা যাক ঢাকায় দেখার মতো কী কী আছে! এক নম্বর, স্মৃতিসৌধ।

সুমি বলল, স্মৃতিসৌধ ঢাকায় তোকে কে বলেছে? স্মৃতিসৌধ হচ্ছে সাভারে।

সাভার আর ঢাকা তো কাছাকাছিই হলো।

সুমি বলল, কোনোদিন কাছাকাছি না। সাভার অনেকদূর।

মোটেও দূর না।

দুই ভাই বোনে তর্কাতর্কি লেগে যাচ্ছিল টুম্পা তাদেরকে থামালো। তখন রুমি বলল, শহীদ মিনার।

সুমি বলল, সংসদ ভবন।

রুমি বলল, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর।

সুমি মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর।

রুমি প্রশ্ন করল, চিড়িয়াখানা?

সুমি হাসার ভঙ্গি করে বলল, ধূর! আমেরিকায় কতো ফাটাফাটি চিড়িয়াখানা আছে। এইখানে শুকনা শুকনা আধমরা কয়টা জন্তু দেখে কী করবে?

রুমি মাথা নাড়ল, বলল, তা ঠিক।

সুমি বলল, টুম্পা আপুকে একটা কাঁচা বাজারে নিয়ে যেতে হবে।

টুম্পা জানতে চাইলো, কাঁচা বাজার কী?

কাঁচা বাজারে মাছ মাংস শাক সবজি বিক্রি হয়। তুমি নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করবে না। আম্মুকে নিয়ে যেতে হবে তাহলে দেখবে কেমন করে দরদাম করতে হয়!

টুম্পা বলল, আমি একটা আর্ট মিউজিয়ামেও যেতে চাই। বাংলাদেশের আর্টিস্টদের আঁকা ছবি দেখতে চাই।

সুমি চোখ বড় বড় করে বলল, দাঁড়াও!

কী হয়েছে?

একটা বড় পেইন্টিং এক্সিবিশন শুরু হবে। চারুকলায়।

কবে থেকে?

দাঁড়াও দেখি। সুমি খবরের কাগজ নিয়ে এসে বিজ্ঞাপনটা দেখে বলল, আজ থেকে শুরু। তিনটার সময় ওপেনিং। চারুকলায়।

টুম্পা খবরের কাগজটা হাতে নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখে বলল, আচ্ছা সুমি, এই খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিতে কতো লাগে তুমি জান?

বিজ্ঞাপন?

হ্যাঁ।

কিসের বিজ্ঞাপন?

না এমনিই, ছোট একটা বিজ্ঞাপন।

সুমি কিছু একটা জিজ্ঞেস করতে গিয়ে থেমে গেল। টুম্পা একটু ইতস্তত করে বলল, তুমি একটু খোঁজ নিতে পারবে?

পারব। আমি ফোন করলে আমাকে পাত্তা দিবে না। আম্মুকে দিয়ে ফোন করাতে হবে।

টুম্পা মাথা নাড়ল, বলল, ঠিক আছে।

.

সাভারের স্মৃতিসৌধ দেখে ফিরে আসতে আসতে তাদের দেরি হয়ে গেল। তাদের ইচ্ছে ছিল চারুকলায় ছবি প্রদর্শনীর শুরু অনুষ্ঠানটি দেখবে। এসে দেখে অনুষ্ঠানটি শেষ, সবাই এক্সিবিশান দেখছে। টুম্পা খুব আগ্রহ নিয়ে গ্যালারির ভেতরে ঢুকে গেল, ছবির প্রদর্শনী দেখতে তার খুব ভালো লাগে। প্রথম দিন বলে অনেক কয়টা টেলিভিশন ক্যামেরা এসেছে, শিল্পীরা ছবির সামনে গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে থাকার ভঙ্গী করতে লাগলেন আর সাংবাদিকেরা তাঁদের ছবি নিতে লাগলো। টুম্পা সেই ভীড়ের ভেতর দিয়ে হেঁটে হেঁটে ছবিগুলো দেখতে থাকে। এতোদিন সে যত ছবি দেখেছে সবগুলো পশ্চিমা দেশের এই দেশের ছবির যে একটা অন্য ধারা আছে সেটা সে জানতো না, দেখে তার খুব মজা লাগতে থাকে। পার্থক্যটা ঠিক কোথায় সে বুঝতে পারে নাকিন্তু অনুভব করতে পারে, ভারি বিচিত্র সেই অনুভূতি।

ছবিগুলো দেখতে দেখতে টুম্পা একটা ছবির সামনে দাঁড়িয়ে গেল, বিশাল একটা ক্যানভাসের মাঝে রংগুলো সব উজ্জ্বল। হালকা নীল রঙের একটা মানুষের ছায়া কেমন যেন ভঁজ হয়ে শুয়ে আছে পাশে একটা ছোট সবুজ গাছ। টুম্পা চোখে হাত দিয়ে সবুজ গাছটা আড়াল করে দেখলো ছবিটাকে তখন কেমন জানি সাদা মাটা মনে হয়, এই ছোট গাছটা এই রং দিয়ে ঠিক এইখানে বসানোর জন্যে ছবিটা অন্যরকম হয়ে গেছে। আর্টিস্ট মানুষটি কেমন করে বুঝতে পারে এটি করতে হবে? সে কী কখনো এরকম একজন আর্টিস্ট হতে পারবে?

কী দেখছ তুমি এমন করে?

মাঝ বয়সী একজন মানুষ টুম্পার দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেছে, টুম্পা একটু থতমত খেয়ে গেল। বলল, না, মানে ইয়ে দেখছি।

ভালো লাগছে ছবিটা?

জি। খুব ভালো লাগছে। আগে কখনো এরকম ছবি দেখি নাই।

কেন? তুমি এক্সিবিশানে আস না?

টুম্পা মাথা নাড়ল, বলল, না আমি আসলে বাংলাদেশে থাকি না।

তাই তো বলি–তোমার বাংলা উচ্চারণের এই অবস্থা কেন! মানুষটি হা হা করে হাসতে হাসতে তার পিঠে হাত দিয়ে বললেন, কিন্তু বাংলা বলছ এইটাই অনেক। সেইজন্যে কগ্রাচুলেশন।

থ্যাংক ইউ।

নাও। ছবি দেখো। ভদ্রলোক চলে যাচ্ছিলেন টুম্পা জিজ্ঞেস করল, এই ছবিটা কে এঁকেছে?

আমি।

আপনি! টুম্পা উচ্চসিত হয়ে ওঠে, ইশ! আপনি কী সুন্দর ছবি আঁকতে পারেন। আমি যদি আপনার মতো ছবি আঁকতে পারতাম!

সখ থাকলে পারবে না কেন, একশোবার পারবে। শিল্পী ভদ্রলোক টুম্পার দিকে তাকিয়ে বলল, ছবি আঁক তুমি?

জি চেষ্টা করি। কোনো ট্রেনিং নাই আমার। এমনি আঁকি।

ভেরি গুড। টুম্পার কী মনে হলো কে জানে, বলল, আমার আব্বুও আর্টিস্ট ছিলেন।

কী নাম তোমার আব্বুর?

বুলবুল রায়হান।

শিল্পী মানুষটি মনে হলো একটা ইলেকট্রিক শক খেলেন, চমকে উঠে বললেন, তু–তুমি বুলবুলের মেয়ে?

আপনি আমার আব্বুকে চিনেন?

টুম্পার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কেমন আছে এখন বুলবুল?

আমি তো জানিনা। আমার আব্বু কোথায় তাও তো জানিনা। আসলে আসলে–

আসলে কী?

আসলে আমার আব্বু বেঁচে আছেন কী না সেইটাও জানি না।

শিল্পী মানুষটা গম্ভীর মুখ করে বললেন, বেঁচে আছে নিশ্চয়ই। বেঁচে না থাকলে আমরা খবর পেতাম।

আমার আব্বুকে কোথায় খুঁজে পাব আপনি জানেন?

না। আমি তো জানিনা—

আপনি কী কাউকে চিনেন যে জানে?

ভদ্রলোক কিছুক্ষণ ভাবলেন, তারপর বলল, বুলবুল আমাদের থেকে দুই বছর জুনিয়র ছিল। শামীমের সাথে তার খাতির ছিল। আর জাহেদ। তাদের সাথে যোগাযোগ করলে হয়তো বলতে পারবে।

তাদের কোথায় পাব?

শামীম তো এখানেই আছে। এক্সিবিশনে শামীমের ছবিও আছে। আস আমার সাথে, দেখি খুঁজে পাই কী না।

বাইরে এক জায়গায় চা কফির আয়োজন করা হয়েছে, সেখানে কয়েকজন সিগারেট খেতে খেতে গল্প করছিল। ভদ্রলোক টুম্পাকে নিয়ে সেখানে হাজির হলেন, ছোটখাটো একজন মানুষকে ডেকে বলল, শামীম, এই যে এই মেয়েটি বুলবুলের মেয়ে!

কোন বুলবুল?

মনে নেই? বুলবুল রায়হান।

তাই নাকি? ছোটখাটো মানুষটা এগিয়ে আসে, তুমি বুলবুলের মেয়ে?

হ্যাঁ।

আমি তো জানতাম ওর ওয়াইফ মেয়েটাকে নিয়ে আমেরিকা চলে গেছে।

জি। আমি আমেরিকা থেকে এসেছি।

ও! মানুষটা টুম্পার দিকে ভালো করে তাকিয়ে বলল, কী নাম তোমার?

টুম্পা। টুম্পা রায়হান।

হ্যাঁ। তাইতো। বুলবুলের মেয়ের নাম ছিল টুম্পা! তুমি এতো বড় হয়েছ?

টুম্পার নিঃশ্বাস আটকে যায়, আমার আব্বু কোথায় আছে আপনি জানেন?

মোহাম্মদপুরের দিকে থাকতো। বছর দুয়েক আগের কথা। এখন যে কোথায় আছে–

কেউ কী বলতে পারবে? আপনি জানেন?

ছোট মানুষটা সিগারেট টানতে টানতে কী যেন ভাবল, ভেবে বলল, তোমার টেলিফোন নাম্বারটা দাও আমি একটু খোঁজ নিয়ে দেখি। আসলে সমস্যাটা কী জান?

কী?

বুলবুল তো নরমাল না, কারো সাথে দেখা করে না কথা বলে না।

তা হোক– টুম্পা বলল, আমি শুধু দেখতে চাই।

সে তো বটেই। তোমার বাবা, তুমি তো দেখতেই চাইবে। অসাধারণ শিল্পী ছিল বুলবুল। অসম্ভব ক্রিয়েটিভ–আমি বুঝি না বেশি ক্রিয়েটিভ মানুষেরই এই সমস্যা হয় নাকি এই সমস্যা হলেই বেশি ক্রিয়েটিভ হয়।

টুম্পা একটা কাগজ বের করে সেখানে তার নাম লিখলো তারপর ছোট খালার টেলিফোন নম্বর লিখলো লিখে শামীম নামের ছোটখাটো মানুষটার হাতে দিয়ে বলল, আপনার টেলিফোন নম্বরটা দিবেন?

হ্যাঁ দিচ্ছি। দাঁড়াও তোমাকে আমার একটা কার্ড দিই।

কার্ডটা হাতে নিয়ে টুম্পা বলল, আপনি কখন আমাকে খোঁজ দিতে পারবেন বলে মনে হয়? আসলে আমি তো মাত্র অল্প কয়দিনের জন্যে এসেছি।

হ্যাঁ, দেখি। দুই–এক দিন সময় দাও।

আমি ভেবেছিলাম আব্বুর ছবি দিয়ে পেপারে একটা বিজ্ঞাপন দেব। তাহলে আমি আপনার জন্যে দুইদিন অপেক্ষা করি?

হ্যাঁ। দুইদিন অপেক্ষা কর—

টুম্পা বিদায় নিয়ে চলে যাবার জন্যে মাত্র ঘুরেছে ঠিক তখন সুমি আর রুমি উদ্বিগ্ন মুখে ছুটে এল। সুমি বলল, আপু তুমি এখানে? আমরা তোমাকে সব জায়গায় খুঁজেছি।

না আমি একটু কথা বলছিলাম।

রুমি হাসি হাসি মুখ করে বলল, আপু! তুমি কোনো পেইন্টিং কিনবে নাকি?

টুম্পা হাসল, বলল, পেইন্টিং তো না, খালি ক্যানভাস কেনার টাকা আছে আমার!

সুমি হি হি করে হেসে বলল, খারাপ না আইডিয়াটা একটা ক্যানভাস কিনে নিচে লিখে রাখবে–এইখানে বিখ্যাত একটা পেইন্টিং আঁকা হবে!

সুমির উত্তরে রুমি জানি কী একটা বলল, তার উত্তরে আবার সুমি। টুম্পা তাদের কথা কিছুই শুনতে পাচ্ছিল না, তার বুকের ভেতর ধুকপুক করছে। সত্যিই কী সে তার আব্বুকে খুঁজে পাবে? তার আব্বু সত্যিই আছেন? কেমন আছেন? তার সাথে কথা বলবেন? প্রথম যখন দেখা হবে কী বলবে সে তার আধুকে?

খাবার টেবিলে ছোট খালু টুম্পাকে জিজ্ঞেস করলেন, টুম্পা, তোমার অবস্থা কী রকম?

কেন ছোট খালু?

তোমাকে নিয়ে ঢাকা শহর থেকে বের হই। কক্সবাজার রাঙ্গামাটি ঘুরে আসি।

রুমি মনে করিয়ে দিল, আর সুন্দরবন।

উহুঁ। সুন্দরবন মনে হয় এখন হবে না। সুন্দরবন যেতে হয় শীতকালে। এখন সমুদ্র খুব আনপ্রেডিক্টেবল।

সেটাই তো ভালো। ঝড়ের মাঝে সমুদ্র একেবারে ফাটাফাটি।

সুমি বলল, হয়েছে। একটু বৃষ্টি হলেই ভয়ে বাথরুমে দৌড়াদৌড়ি শুরু করে দেয়, আর সে ঝড়ের মাঝে যাবে সমুদ্রে!

কোনোদিন আমি বাথরুমে গেছি?

হয়েছে! ছোট খালু দুইজনকে থামালেন, আগে দিনগুলি ঠিক করি। টুম্পা আছে মাত্র চার সপ্তাহ, দেখবি দেখতে দেখতে সময়টা কেটে যাবে।

পরশুদিন বৃহস্পতিবার, আমরা রাত্রে রওনা দিতে পারি। টুম্পা একটু ইতস্তত করে বলল,  ছোট খালু–

কী হলো? আমরা আর কয়েকটা দিন পরে যাই? পরে? হ্যাঁ।

ছোট খালু কয়েক মুহূর্ত টুম্পার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, ঠিক আছে! এখন তাহলে আমরা ঢাকা শহর আর তার আশেপাশে যাই।

টুম্পা মাথা নাড়ল, বলল, ঠিক আছে।

.

গভীর রাতে ছোট খালার ঘুম ভেঙে গেল। বাইরের ঘরে আলো জ্বলছে। ছোট খালা আস্তে আস্তে বাইরে এলেন, টুম্পা সোফায় পা তুলে বসে আছে, তার কোলে এ্যালবামটা, তার আব্বুর ছবিটা বের করে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। ছোট খালা নরম গলায় ডাকলেন, টুম্পা।

টুম্পা মুখ তুলে তাকালো, ছোট খালা!

ঘুম আসছে না?

টুম্পা হাসার চেষ্টা করে বলল, ঘুম এসেছিল, ভেঙে গেছে। জেট লেগ, আমেরিকাতে এখন দুপুর।

ও! ছোট খালা পাশে এসে বসলেন, খিদে পেয়েছে? কিছু খাবি?

না না ছোট খালা। খাব না। কিছু খাব না।

সত্যি?

জি ছোট খালা। টুম্পা এ্যালবামটা বন্ধ করে রাখতে রাখতে বলল, ছোট খালা।

বল।

সেদিন যে পেইন্টিং এক্সিবিশনে গিয়েছিলাম সেখানে যারা আর্টিস্ট ছিলেন, তারা–

তারা?

তারা আব্বুকে চিনে।

সত্যি?

হ্যাঁ ছোট খালা। তাদের কাছে আমি তোমাদের বাসার টেলিফোন নম্বর দিয়েছি। আব্বুর খোঁজ পেলে আমাকে জানাবে।

ছোট খালা এক ধরনের অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে টুম্পার দিকে তাকিয়ে রইলেন, ফিস ফিস করে বললেন, সত্যি?

আমার খুব অস্থির লাগছে ছোট খালা! যদি সত্যি তারা আব্বুকে পেয়ে যায় তখন আমি কী করব ছোট খালা?

ছোট খালা হাত দিয়ে টুম্পাকে নিজের কাছে টেনে এনে বললেন, সব ঠিক হয়ে যাবে টুম্পা। সব ঠিক হয়ে যাবে!

তুমি আমার সাথে যাবে ছোট খালা?

যাব। তোকে আমি নিয়ে যাব।

থ্যাংকু ছোট খালা। টুম্পা ছোট খালাকে ধরে ফিস ফিস করে বলল, আমার খুব ভয় করছে ছোট খালা। খুব ভয় করছে।

ভয়ের কিছু নেই। ছোট খালা টুম্পার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ভয়ের কিছু নেই টুম্পা সোনা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *