বৃষ্টির ঠিকানা
মিসেস হেনরিকসন
জ্যামিতি ক্লাশটাকে টুম্পার সবচেয়ে বেশি খারাপ লাগে। ক্লাশটা পড়ান মি. কিনবারো, তবে ক্লাশের সবাই তাকে ডাকে মি, ক্যাঙ্গারু। সত্যি সত্যি মি. কিনবারোর মাঝে একটা ক্যাঙ্গারু ক্যাঙ্গারু ভাব আছে–মানুষটা কেমন জানি লাফিয়ে লাফিয়ে হাঁটেন। ক্লাশের ভেতর কথা বলতে বলতে তাঁদের কান একেবারে ঝালাপালা করে দেন কিন্তু কী নিয়ে কথা বলেন তারা কেউ কিছু বোঝেনা। মি. ক্যাঙ্গারুর গুরু হচ্ছেন ইউক্লিড, ক্লাশে কথায় কথায় ইউক্লিডের উদাহরণ দেন আর প্রত্যেকবার ইউক্লিডের নাম উচ্চারণ করার সময় তার চোখ বন্ধ হয়ে যায়, গলা কাঁপতে থাকে আর তাকে দেখে মনে হয় এক্ষুণি বুঝি হাঁটু ভাঁজ করে মাটিতে শুয়ে একটা সালাম করে দেবেন। টুম্পার যা হাসি পায় সেটা আর বলার মতো নয় কিন্তু এত কিছুর পরেও মি, ক্যাঙ্গারুর ক্লাশের মাঝে কোনো রস কস নেই। এক ঘন্টার ক্লাশটাকে মনে হয় এক বছর লম্বা, সারাক্ষণ টুম্পার চোখ ঘুরে ঘুরে দেওয়ালের ঘড়িটার দিকে চলে যায় সে অপেক্ষা করতে থাকে কখন মিনিটের কাঁটা নয়ের মাঝে পৌঁছাবে আর পি.এ. সিস্টেম থেকে ক্লাশ শেষ হওয়ায় মধুর একটা বেলের শব্দ ভেসে আসবে।
মি. ক্যাঙ্গারু খুব সময় মেনে চলার চেষ্টা করেন। ক্লাশের সবাই দেখেছে মানুষটা ক্লাশ শুরু হবার দুই এক মিনিট আগে এসে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে থাকেন। মিনিট আর সেকেন্ডের কাঁটাটা ঠিক যখন বারোটার ওপর হাজির হয় তখন মি, ক্যাঙ্গারু দড়াম করে দরজাটা খুলে ভেতরে ঢুকে নাটকীয়ভাবে বলেন, গুড মর্নিং মাই ডিয়ার স্টুডেন্টস! এমন হাস্যকর ব্যাপার যে সেটা বলার মতো নয়।
আজকে অবশ্য অন্য ব্যাপার, সময় অনেকক্ষণ আগে পার হয়ে গেছে এখনো মি, ক্যাঙ্গারুর দেখা নেই, নিশ্চয়ই সাংঘাতিক কিছু একটা ঘটেছে। যে মানুষ কখনো এক সেকেন্ড দেরী করে না তার জন্যে পাকা দশ মিনিট দেরি করা সোজা কথা নয়–প্রায় অসম্ভব একটা ব্যাপার। ক্লাশের ছেলেমেয়েরা একটু অস্থির হয়ে উঠছে, কেভিন কাগজ দিয়ে প্লেন তৈরী করে এদিক–সেদিক ছুড়ে মারতে শুরু করেছে। জেসিকা চেয়ারের ওপরে দাঁড়িয়ে কোমর দুলিয়ে গান গাওয়ার ভঙ্গী করছে তার দুই পাশে দাঁড়িয়ে মাইকেল আর জিম অদৃশ্য একটা গিটার বাজাচ্ছে। পিটার একটা রাবার ব্যান্ডের মাঝে কাগজের ছোট ছোট গুটলি লাগিয়ে আশেপাশের ছেলেমেয়েদের নাক নিশানা করে টার্গেট প্র্যাকটিস করার চেষ্টা করছে।
এইভাবে যখন আরও পাঁচ মিনিট পার হয়ে গেছে তখন মোটামুটি সবাই বুঝে গেল আজ কিছু একটা গোলমাল হয়েছে, ক্লাশে মি. ক্যাঙ্গারু বা অন্য কেউই আসবে না। তারা হৈ হৈ করে যখন বইপত্র তুলে ক্লাশ থেকে বের হয়ে যাবার জন্যে দাঁড়ালো ঠিক তখন দরজা খুলে একজন মধ্যবয়স্কা মহিলার মাথা ক্লাশের মাঝে উঁকি দেয়। মাথায় কাঁচা–পাকা চুল, চোখে সোনালি রঙের একটা চশমা। কেউ যে পকেটের পয়সা খরচ করে এরকম পুরানো মডেলের একটা চশমা কিনতে পারে টুম্পা নিজের চোখে না দেখলে সেটা বিশ্বাস করতো না। চশমাটা নিশ্চয়ই এই মহিলার খুব প্রিয় চশমা কারণ সেটা কটকটে হলুদ রঙের একটা স্ট্র্যাপ দিয়ে বাঁধা যেন নাকের ডগা থেকে লাফ দিয়ে সেটা বের হয়ে চলে যেতে না পারে! মহিলাটি ক্লাশের ভেতরে এক নজর দেখে খানিকটা অপ্রস্তুত ভঙ্গীতে ভেতরে ঢুকলেন। তাকে দেখে সবাই বুঝে গেল আজকে মি. ক্যাঙ্গারু আসছেন না তার বদলে এই মহিলা হবেন তাদের সাবস্টিটিউট টিচার। সাবস্টিটিউট টিচার মানেই হচ্ছে সময় নষ্ট তাই সবাই নাকের ভেতর দিয়ে ফোঁস করে একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে নিজেদের চেয়ার টেবিলে বসতে শুরু করলো।
মধ্যবয়স্কা মহিলাটি ক্লাশের ভেতরে ঢুকে টেবিলের উপর তার হাতের কাগজগুলো রেখে সবাইকে নিজের চেয়ার টেবিলে বসে যাবার সময় দিলেন তারপর সবার দিকে তাকিয়ে একটু হাসার চেষ্টা করলেন। মানুষ নার্ভাস হলে সবসময় একটু হাসার চেষ্টা করে কিন্তু এই মহিলাকে একটুও নার্ভাস মনে হলো না।
মহিলাটি চশমার ওপর দিয়ে ক্লাশের সবার দিকে তাকিয়ে বললেন, আমি ক্রিস্টিনা হেনরিকসন। তোমরা এতক্ষণে নিশ্চয়ই বুঝে গেছো আমি তোমাদের সাবস্টিটিউট টিচার।
ক্লাশের ছেলেমেয়েরা কেউ জোরে কেউ আস্তে মাথা নাড়ল, কেউ গলা দিয়ে কেউ নাক দিয়ে একরকম শব্দ বের করল। তবে সবার চোখে মুখেই এক ধরনের হাল ছেড়ে দেবার মতো ভাবভঙ্গী। মি. ক্যাঙ্গারু তাদের নিয়মিত টিচার তার ক্লাশেই সবার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যায় আর সোনালি রঙের চশমা পরা এই সাবস্টিটিউট টিচারের ক্লাশে কী হবে সেটা আন্দাজ করা মোটেই কঠিন নয়। মিসেস হেনরিকসন পুরো ক্লাশের দিকে এক নজর তাকিয়ে বললেন, মজাটা কী হয়েছে শোনো–
মজার কথা শুনে ক্লাশের সবাই অবশ্যি নড়েচড়ে বসে মিসেস হেনরিকসনের দিকে তাকালো। মিসেস হেনরিকসন বললেন, আজকে তোমাদের দরকার একজন জ্যামিতির টিচার কিন্তু আমি হচ্ছি ভূগোলের টিচার।
এর ভেতরে মজার বিষয়টা কী কেউ ধরতে পারল না। একজন ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করল, তাহলে তোমাকে এনেছে কেন?
জিওমেট্রির টিচার আনতে গিয়ে ভুল করে জিওগ্রাফির টিচার নিয়ে চলে এসেছে। কথাটা শেষ করে মিসেস হেনরিকসন হি হি করে হাসতে শুরু করলেন। কথাটা এমন কিছু হাসির কথা নয় কিন্তু মিসেস হেনরিকসনের এরকম বাচ্চাদের মতো হাসি দেখে সবাই তার সাথে হাসতে শুরু করে দিল।
মিসেস হেনরিকসন শেষ পর্যন্ত হাসি থামালেন, চোখ মুছে বললেন, এখন বল তো কী করি? আমি তো তোমাদের জ্যামিতি পড়াতে পারব না। যদি চেষ্টা করি তাহলে ইউক্লিড তার কবরে ওলট–পালট খেতে থাকবে।
জেসিকা বলল, আমাদের একটা গান গেয়ে শোনাও।
জেসিকা ফাজিল ধরনের মেয়ে, কথা বলার ঢংটিও ছিল একটু গায়ে জ্বালা ধরানোর মতো কিন্তু মিসেস হেনরিকসন সেটা লক্ষ করলেন বলে মনে হলো না, জেসিকার কথা শেষ হবার সাথে সাথে দুই হাতে চুটকি দিতে দিতে সুরেলা গলায় গেয়ে উঠলেন,
আই এ্যাম লাইক এ বার্ড
আই অ্যাম গোয়িং টু ফ্লাই এ্যাওয়ে আই ডোন্ট নো হোয়র মাই সোল ইজ সোল ইজ আই ডোন্ট নো
হোয়র মাই হোম ইজ…।
মিসেস হেনরিকসনের মতো মধ্যবয়সী একজন মহিলা এতো সুন্দর করে গানটি গেয়ে উঠলেন যে সবাই কেমন যেন ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। জেসিকা মুগ্ধ হয়ে বলল, মিসেস হেনরিকসন! তুমি কী সুন্দর গান গাইতে পার!
মিসেস হেনরিকসন বললেন, আমি যখন ছোট ছিলাম তখন ভেবেছিলাম বড় হয়ে গায়িকা হব। আর দেখো বড় হয়ে আমি হয়েছি ভূগোলের টিচার। মিসেস হেনরিকসন আবার ছোট বাচ্চাদের মতো হি হি করে হেসে উঠলেন যেন গায়িকা হতে চেয়ে ভূগোলের টিচার হয়ে যাওয়া খুব মজার ব্যাপার।
কেভিন জিজ্ঞেস করল, তোমার ভূগোল ভালো লাগে না?
লাগবে না কেন? খুব ভালো লাগে। ভূগোল মানে তো শুধু জায়গার কথা। সেই জায়গার মানুষেরও কথা–
মিসেস হেনরিকসন ক্লাশের সবার মুখের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে বললেন, তোমাদের ক্লাশের দিকে তাকিয়ে দেখো, পৃথিবীর কতো দেশের কতো মানুষ! জিমের গায়ের রং কুচকুচে কালো, তার দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার পূর্বপুরুষ এসেছিল আফ্রিকা থেকে, জেনীর চোখ ছোট ছোট নাক একটু চাপা, তার দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার পূর্বপুরুষ এসেছে এশিয়া থেকে। সম্ভবত পূর্ব এশিয়া। কেভিনের খাড়া নাক, নীল চোখ, সোনালি চুল, তার দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার পূর্বপুরুষ নিশ্চয়ই এসেছে স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশ থেকে! মরিয়মের বড় চোখ, কালো চুল, তার দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার পূর্বপুরুষ নিশ্চয়ই মধ্যপ্রাচ্যের, তাই না?
মরিয়ম মাথা নাড়লো এবং মিসেস হেনরিকসন এমন ভাব করলেন যেন তিনি যুদ্ধ জয় করে ফেলেছেন। তিনি ক্লাশের ছাত্র–ছাত্রীদের মুখের দিকে তাকাতে তাকাতে টুম্পার দিকে চোখ ফিরিয়ে বললেন, আর তুমি নিশ্চয়ই এসেছ ইন্ডিয়া থেকে।
টুম্পা মাথা নাড়ল, বলল, না মিসেস হেনরিকসন। আমি এসেছি বাংলাদেশ থেকে।
বলতে গিয়ে টুম্পার গলা একটু কেঁপে গেল কারণ এই দেশের বেশিরভাগ মানুষ বাংলাদেশকে চেনে না। যারা চেনে তারা শুধু বাংলাদেশের খারাপ খারাপ জিনিসগুলোর কথা জানে। দেশটার নমিও ভালো করে বলতে পারে না, বলে, বাংলাডেশ। টুম্পা একটু শংকিত চোখে মিসেস হেনরিকসনের দিকে তাকিয়ে রইল, এখন কী এরকম কিছু ঘটবে? কিন্তু সেরকম কিছু ঘটল না বরং মিসেস হেনরিকসনের চোখ কেমন জানি উজ্জ্বল হয়ে উঠল, মুখে হাসি ফুটিয়ে বললেন, বাহ্! কী চমৎকার। আমাদের দেশে বাংলাদেশের একজন মেয়ে আছে।
টুম্পা অবাক হয়ে দেখল মিসেস হেনরিকসন ব্যাংলাডেশ বলেন নাই, একেবারে শুদ্ধ করে বলেছেন বাংলাদেশ। খানিকক্ষণ কী যেন ভাবলেন তারপর বললেন, যতদূর মনে পড়ে সত্তুরের দিকে জর্জ হ্যারিসন, জোন বায়াজ, রবি শংকর সবাই মিলে একটা কনসার্ট করেছিল বাংলাদেশের জন্যে। মিসেস হেনরিকসন টুম্পার দিকে তাকিয়ে বললেন, তাই না?
কিসের কনসার্ট সেটা সম্পর্কে টুম্পা কিছুই জানে না, সে কী বলবে বুঝতে না পেরে অনিশ্চিত ভঙ্গীতে মাথা নাড়ল, যার উত্তর হ্যাঁ, বা না দুটোই হতে পারে। মিসেস হেনরিকসন সেটা খেয়াল করলেন বলে মনে হলো না চোখ বড় বড় করে বললেন, নিইউয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে সেই কনসার্ট হয়েছিল, আমি তখন টিনএজার। সেই কনসার্টে গিয়ে সবার গান শুনে একেবারে সারা জীবনের জন্যে পাল্টে গিয়েছি। তখন বাংলাদেশে যুদ্ধ হচ্ছে। কমবয়সী গেরিলারা যুদ্ধ করছে, দশ মিলিয়ন মানুষ উদ্বাস্তু কী কষ্ট মানুষের। এলেন গিনসবার্গ সেটার উপর একটা কবিতা লিখেছেন, জেসোর রোড, অসাধারণ কবিতা!
টুম্পা কেমন যেন ভ্যাবাচেকা খেয়ে মিসেস হেনরিকসনের দিকে তাকিয়ে রইল। এলেন গিনসবার্গটা কে? জেসোর রোড কবিতাটি কী? সে তো এগুলো কিছু জানে না।
মিসেস হেনরিকসন একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, বাংলাদেশের মানুষের সংখ্যা একশ চল্লিশ মিলিয়ন–পৃথিবীর মোট মানুষের শতকরা দুই ভাগ। যার অর্থ পৃথিবীর যে কোনো পঞ্চাশজন মানুষকে নিলে তার মাঝে একজন হবে বাংলাদেশের। এতোগুলো মানুষ থাকে কতোটুকু জায়গার মাঝে তোমরা জান?
টুম্পা অস্বস্তি অনুভব করে, তার জানা উচিৎ ছিল, কিন্তু সে জানে না। অনেক ছোট থাকতে সে তার আম্মুর সাথে আমেরিকা চলে এসেছে। বাংলাদেশ সম্পর্কে সে কিছুই জানে না। মিসেস হেনরিকসন সেটা নিয়ে মাথা ঘামালেন না, বললেন, বাংলাদেশের সাইজ আমাদের উইসকনসিনের মতো!
ক্লাশের সবাই একটা বিস্ময়ের মতো শব্দ করল। মিসেস হেনরিকসন টুম্পার দিকে তাকিয়ে বললেন, তাই না?
টুম্পা আবার অনিশ্চিতের মতো মাথা নাড়ল যার উত্তর হ্যাঁ কিংবা না দুটোই হতে পারে। মিসেস হেনরিকসন আবার একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, পশ্চিমা প্রেস সবসময় বাংলাদেশের খারাপ পাবলিসিটি করেছে তার কারণ তারা আসলে এই জাতিটার শক্তিটা ধরতে পারে নি। জিম জানতে চাইল, সত্যিকারের শক্তিটা কী?
বাংলাদেশ হচ্ছে একটা বদ্বীপ। এমন একটা জায়গা যেখানে প্রায় প্রত্যেক বছর একটা বন্যা না হয় একটা ঘূর্ণিঝড় হয়। তারা যেরকম বন্যা আর ঘূর্ণিঝড়ের মাঝে টিকে থাকে আমরা সেটা কল্পনাও করতে পারব না। প্রকৃতি কিছুতেই তাদের হারাতে পারে না। এই জাতি অসম্ভব কষ্টসহিষ্ণু, প্রকৃতি তাদের শুইয়ে দেবার চেষ্টা করে, তারা আবার মাথা তুলে দাঁড়ায়। ফ্যান্টাস্টিক। আমাদের একটা মাত্র ঘূর্ণিঝড় হয়েছিল ক্যাটারিনা তখন আমাদের কী অবস্থা হয়েছিল মনে আছে?
সবাই মাথা নাড়ল, তাদের মনে আছে। মিসেস হেনরিকসনের হঠাৎ করে কিছু একটা মনে পড়ল, চোখ বড় বড় করে বললেন, তোমরা সবাই নিশ্চয় এই বছরের নোবেল পুরস্কারের কথা শুনেছ। শান্তির জন্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছে বাংলাদেশের একজন।
টুম্পা এবারে মাথা নাড়ল, সে এই তথ্যটা জানে। দেখা গেল আরো কয়েকজনও সেটা জানে। মাইকেল বলল, প্রফেসর উনুস।
টুম্পা শুদ্ধ করে দিল, বলল, না। উচ্চারণ ইউনূস। প্রফেসর ইউনূস।
মিসেস হেনরিকসন বললেন, দারিদ্র্য কীভাবে দূর করা যায় তার উপর অসাধারণ কাজ করেছেন প্রফেসর ইউনূস। তোমাদের সবারই সেটা জানা দরকার। আমাদের দেশে এতো সম্পদ তারপরেও এখানে অনেক গরিব মানুষ আছে, এটা ঠিক না। জাতি হিসেবে এটা আমাদের ব্যর্থতা। খুব বড় ব্যর্থতা।
মিসেস হেনরিকসন এমনভাবে মাথা নাড়লেন যেন এই পুরো ব্যর্থতাটা তার নিজেরই, তিনি নিজেই যেন এই দোষটা করে ফেলেছেন।
বাংলাদেশের এতো প্রশংসা করার পর নিজের দেশের ব্যর্থতার কথা বলা হচ্ছে দেখে কেভিনের মনে হলো একটু রাগ হলো, সে গম্ভীর গলায় বলল, আমাদের অনেক সাফল্যও আছে মিসেস হেনরিকসন।
মিসেস হেনরিকসন সুন্দর করে হাসলেন, বললেন, অবশ্যই আছে। একশোবার আছে। তোমরা যদি ইউরোপ যাও কিংবা এশিয়া যাও দেখবে তারা আমাদের আমেরিকানদের শুধু সমালোচনা করছে। কিন্তু মজার ব্যাপার কী জান?
কী মিসেস হেনরিকসন?
তারা চোখ বন্ধ করে আমাদের অনুকরণ করে। আমরা যেটা করি সেটাই। হয়ে যায় পৃথিবীর কালচার। ভুল হোক আর শুদ্ধ হোক তাতে কিছু আসে যায় না। মিসেস হেনরিকসন আবার হি হি করে হাসতে থাকলেন, যেন এর থেকে মজার ব্যাপার আর কিছু হতে পারে না।
ক্লাশের ছেলেমেয়েরাও হাসবে কী না সেটা বুঝতে পারল না, কয়েকজন একটু চেষ্টা করে থেমে গেল কারণ মিসেস হেনরিকসন হঠাৎ হাসি থামিয়ে গম্ভীর হয়ে গেছেন। গম্ভীর হয়েই বললেন, আচ্ছা বল দেখি, আমাদের সবচেয়ে বড় শক্তি কী?
জিম বলল, এটম বোমা।
উহুঁ। মিসেস হেনরিকসন মাথা নাড়লেন, বোমা কখনো কোনো জাতির শক্তি হতে পারে না।
জেসিকা বলল, গণতন্ত্র।
সেটা একটা শক্তি, কিন্তু পৃথিবীর আরো অনেক দেশে গণতন্ত্র আছে। সত্যি কথা বলতে কী পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গণতন্ত্র হচ্ছে ভারতবর্ষে–এক বিলিয়ন থেকেও বেশি মানুষের গণতন্ত্র।
জেনি বলল, কম্পিউটার–
মিসেস হেনরিকসন মাথা নাড়লেন, বললেন, উহুঁ। এই সায়েন্স, টেকনোলজি কালচার এগুলোই শক্তি কিন্তু সেটা নির্ভর করে মানুষগুলোর উপর। আমাদের শক্তি হচ্ছে এই দেশের মানুষ। কেন জান?
জেসিকা জিজ্ঞেস করল, কেন?
কারণ এই দেশের মানুষের একটা খুব বড় বৈশিষ্ট্য আছে। পৃথিবীর সব দেশ আসলে শুধু একটা দেশ। সেই দেশে শুধু সেই দেশের মানুষ থাকে। জার্মানিতে থাকে জার্মানরা, ফ্রান্সে থাকে ফ্রেঞ্চরা, ইন্ডিয়াতে থাকে ইন্ডিয়ানরা, চায়নাতে থাকে চীনারা–শুধু আমেরিকাতে থাকে সব দেশের মানুষ। এখানে জার্মানরা থাকে। ফ্রেঞ্চরা থাকে। ইন্ডিয়ানরা থাকে। চাইনিজরা থাকে। বাংলাদেশিরা থাকে। ইরাকিরা থাকে। ইরানিরা থাকে। আমেরিকা আসলে একটা দেশ না, এটা আসলে ছোট একটা পৃথিবী। সব দেশের মানুষ এখানে পাশাপাশি থাকে, সবাই নিজের কালচারকে বাঁচিয়ে রাখে, আবার এখানকার কালচার গ্রহণ করে। এটা হচ্ছে সারা পৃথিবীর মানুষের একটা মিলন মেলা…
মিসেস হেনরিকসনের চোখগুলো কেমন যেন ঢুলু ঢুলু হয়ে গেল, কথা বলার সময় মনে হলো ঠিক যেন কথা বলছেন না, যেন একটা কবিতা আবৃত্তি করছেন, কিংবা নিচু গলায় গান গাইছেন! টুম্পা এর আগে এরকম মানুষ দেখেছে বলে মনে করতে পারে না। আমেরিকা দেশটা কতো মহান সেটা নিয়ে সবাই অনেক বড় বড় কথা বলে কিন্তু এরকমভাবে সে কখনো কাউকে কথা বলতে দেখে নি! টুম্পা অবাক হয়ে আবিষ্কার করল এর আগে সে যাদের আমেরিকা নিয়ে কথা বলতে শুনেছে তারা সবাই বলেছে অহংকার নিয়ে। কিন্তু মিসেস হেনরিকসন বলছেন কৃতজ্ঞতা নিয়ে। তিনি যেন কতো কৃতজ্ঞ যে পৃথিবীর সব দেশের মানুষ দয়া করে এই দেশে এসেছে! পুরো বিষয়টা যে এভাবে দেখা যায় টুম্পা আগে কখনো চিন্তা করে নি।
মিসেস হেনরিকসন হঠাৎ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন, ও মা! দেখো কত সময় বকবক করে কাটিয়ে দিলাম। মানুষ বয়স হলে এমনিতেই বেশি কথা বলে, আর তার উপরে আমি টিচার, আমি একবার মুখ খুললে আর মুখ বন্ধ করতে পারি না। অন্য কথা থাকুক, এবার তাহলে পড়ালেখার কথা বলি।
জেসিকা বলল, কিন্তু মিসেস হেনরিকসন, তুমি তো বলেছ তুমি জ্যামিতি জান না। তুমি কেমন করে জ্যামিতি পড়াবে?
মিসেস হেনরিকসন চোখ মটকে বললেন, দেখতে চাও কেমন করে পড়াব?
একটা মজার গন্ধ পেয়ে সবাই বলল, দেখতে চাই।
চমৎকার। মিসেস হেনরিকসন একটা চক হাতে নিয়ে বোর্ডের সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, তাহলে বল, জ্যামিতির জনক কাকে বলা হয়?
ক্লাশের সবাই বলল, ইউক্লিড।
চমৎকার। মিসেস হেনরিকসন বোর্ডে চক দিয়ে লিখলেন ইউক্লিড। তারপর ঘুরে ক্লাশের দিকে তাকিয়ে বললেন, এবারে বলে ইউক্লিড কোন দেশের মানুষ?
ক্লাশের বেশিরভাগ ছেলেমেয়ে চিৎকার করে বলল, গ্রিস।
চমৎকার! এবার তাহলে চলো আমরা দেখি গ্রিস দেশটা কোথায়! সেটা জানার জন্যে দরকার একটুখানি ভূগোল!
মিসেস হেনরিকসনের কথা শুনে সবাই হাসতে শুরু করে। মিসেস হেনরিকসন হাসলেন না, মুখ শক্ত করে বললেন, তার আগে দেখা যাক তোমাদের মাঝে গ্রিক কেউ আছে কি না।
পিছন থেকে জর্জিওস তার হাত তুললো। জর্জিওসকে সবাই জর্জিওস হিসেবেই জানতো সে যে আসলে কি সেটা কেউ জানতো না। মিসেস হেনরিকসন চোখ বড় বড় করে বললেন, পৃথিবীর সবচেয়ে চমকপ্রদ জাতি হচ্ছে গ্রিক জাতি। তাদের ঐতিহ্য হচ্ছে মহান ঐতিহ্য! জ্ঞানে বিজ্ঞানে এই জাতি পৃথিবীকে যা দিয়েছে পৃথিবী তার ঋণ কখনো শোধ করতে পারবে না–
টুম্পা আবিষ্কার করল, একটু আগে মিসেস হেনরিকসন বাংলাদেশ সম্পর্কে যে রকম সুন্দর সুন্দর কথা বলেছেন এখন ঠিক সেরকম গ্রিকদের নিয়ে সুন্দর সুন্দর কথা বলছেন। এমন ভাবে বলছেন যে পুরো গ্রিক দেশটাই যেন চোখের সামনে ভেসে উঠছে। টুম্পা অবাক হয়ে দেখলো জর্জিওস নিজেও চোখ বড় বড় করে মিসেস হেনরিকসনের দিকে তাকিয়ে তার কথা শুনছে। টুম্পা যেরকম বাংলাদেশ সম্পর্কে কিছু জানে না, জর্জিওসও মনে হয় গ্রিস দেশ সম্পর্কে কিছুই জানে না। মিসেস হেনরিকসন ঠিকই বলেছেন, সবাই মনে হয় নিজের দেশের কথা ভুলে এই দেশে এসে জমা হয়েছে!
টুম্পা অন্যমনস্কভাবে মিসেস হেনরিকসনের কথা শুনতে শুনতে খাতার পৃষ্ঠায় আঁকিবুকি করতে থাকে। নিজের অজান্তেই সে কখন মিসেস হেনরিকসনের ছবি আঁকতে শুরু করেছে সে জানে না। নাকের ডগায় চশমা, কৌতূহলী চোখ ঠোঁটের কোণায় একটা বিচিত্র হাসি, কাঁচাপাকা এলোমেলো চুল, দুই হাত উপরে তুলে কথা বলছেন–
এই মেয়ে, তুমি কী করছ?
মিসেস হেনরিকসনের কথা শুনে টুম্পা চমকে উঠে তার কাগজটা আড়াল করার চেষ্টা করল, কিন্তু মিসেস হেনরিকসন ছবিটা দেখে ফেললেন। এগিয়ে এসে বললেন, দেখি। দেখি।
টুম্পার কোনো উপায় থাকল না, কাগজটা দেখাতে হলো। মিসেস হেনরিকসন কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে অবাক হয়ে বললেন, ও মা! তুমি কী সুন্দর ছবি এঁকেছ আমার।
পাশে বসে থাকা এলিজাবেথ বলল, আমাদের ঠোম্পা খুব সুন্দর ছবি আঁকে মিসেস হেনরিকসন! ঠোম্পা আমাদের ক্লাশ–আর্টিস্ট!
টুম্পা অনেক চেষ্টা করেও তার ক্লাশের ছেলেমেয়েদেরকে টুম্পা বলানো শেখাতে পারে নি। সবাই তাকে ডাকে ঠোম্পা।
মিসেস হেনরিকসন ছবিটা তুলে সবাইকে দেখালেন, বললেন, দেখেছ?
জিম বলল, এটা বেশি ভালো হয় নাই, ঠোম্পা আরও অনেক ভালো আঁকতে পারে।
কী বলছ ভালো হয় নাই? মিসেস হেনরিকসন বললেন, তোমরা শুধু ওর স্কেচটা দেখছ আসল জিনিসটা দেখছ না! সে আমার চরিত্রটাকে ধরে ফেলেছে– দেখে তাকিয়ে!
টুম্পা কী বলবে বুঝতে পারল না, আসলে মিসেস হেনরিকসন ঠিকই বলেছেন, ছবিতে মানুষের চেহারা ফুটিয়ে তোলা সহজ। তার চরিত্রটা ছবিতে আনতে পারাটা কঠিন। টুম্পা সবসময় চেষ্টা করে একটা মানুষের আসল চরিত্রটা ছবিটার মাঝে নিয়ে আসতে, অনেকক্ষণ ধরে কাউকে লক্ষ্য করতে পারলে সে বেশ খানিকটা করতে পারে।
মিসেস হেনরিকসন বললেন, তোমার নামটা হচ্ছে–
টুম্পা। টুম্পা রায়হান।
বাহ্। কী সুন্দর নাম। টুম্পা রায়হান।
টুম্পা একটু অবাক হয়ে দেখলো মিসেস হেনরিকসন তার নামটা ঠিক ঠিক উচ্চারণ করেছেন, অন্য কেউ হলে টুম্পা রায়হান না বলে বলতো ঠোম্পা ডাইহান! তবে তার নামটা আসলে সুন্দর না, তার একেবারেই পছন্দ না। কেন জানি তার মনে হয় গুরুত্ব দিয়ে নামটা রাখা হয় নাই।
মিসেস হেনরিকসন একটু এগিয়ে এসে বললেন, টুম্পা, তোমার এই ছবিটা আমাকে দেবে?
কেন দেব না! টুম্পা থতমত খেয়ে বলল, তুমি চাইলে একশোবার দেব। কিন্তু এই ছবিটাতো আসলে বেশি ভালো হয় নাই–আরেকটু সময় পেলে আরো ভালো করে, এঁকে দিতে পারতাম!
এটাই যথেষ্ট ভালো হয়েছে। তাড়াহুড়া করে তুমি যেটা এঁকেছু সেটাই আমি চাই। মিসেস হেনরিকসন ছবিটা টুম্পার ডেস্কের উপর রেখে বললেন, তুমি ছবির নিচে আজকের তারিখ দিয়ে একটা সিগনেচার করে দাও!
টুম্পা অবাক হয়ে বলল, সিগনেচার?
হ্যাঁ, সিগনেচার। তুমি যখন অনেক বিখ্যাত হয়ে যাবে তখন আমি এটা সবাইকে দেখাব।
টুম্পা একটু হেসে ছবির নিচে তার নামটা লিখে দিল। মিসেস হেনরিকসন তখন সেটা হাতে নিয়ে বললেন, থ্যাংক ইউ টুম্পা। থ্যাংক ইউ ভেরিমাচ। তারপর এক ধরনের মুগ্ধ বিস্ময় নিয়ে ছবিটার দিকে তাকিয়ে রইলেন।