সবুজ দেশ
প্লেনের জানালাটা উপরে তুলে টুম্পা বাইরে তাকায়। চারিদিক অন্ধকার তার মাঝে বহুদূরে বিস্তৃত একটা পর্বতমালা সোনালি আলোতে চকচক করছে। প্লেনটা এখন নেপালের পাশ দিয়ে যাচ্ছে কাজেই এটা নিশ্চয়ই হিমালয় পর্বতমালা। এর মাঝে কোনো একটা নিশ্চয়ই এভারেস্ট, টুম্পা এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকে। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পর্বতমালাকে সে দেখছে, নিজের চোখে না দেখলে সে কী জানতো ভোর রাতে সূর্যের প্রথম আলোতে হিমালয় পর্বতের রঙ হয় কাঁচা সোনার মতো?
টুম্পা এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে একটা নিঃশ্বাস ফেলল। তার এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না যে সে সত্যি সত্যি বাংলাদেশে যাচ্ছে। একা। তাকে যেতে দেবেই না এবং সে যাবেই–এই নিয়ে গত কয়েকটা সপ্তাহ যে কীভাবে কেটেছে সেটা শুধু টুম্পাই বলতে পারবে। সে যখন প্রথমবার বলেছিল একদিন সে বাংলাদেশে বেড়াতে যাবে সেটা ছিল একটা কথার কথা। কথাটা সে খুব জোর দিয়ে বলে নি, বিষয়টা ছিল অনেকটা ভবিষ্যৎ কল্পনার মতো। তার নতুন বাবা যখন তার সেই কল্পনাটাকে নিয়ে টিটকারি দিতে শুরু করলেন তখন সেই কল্পনাটা আস্তে আস্তে কীভাবে জানি সত্যিকারের একটা প্রতিজ্ঞা হয়ে গেল। কীভাবে যাবে সে জানতো না, তার বাবা কোনো দিনই তার পিছনে এতোগুলো টাকা খরচ করবে না কিন্তু তারপরেও টুম্পা জানতো সে একদিন বাংলাদেশে যাবেই যাবে। আটলান্টিক সিটিতে আর্ট কম্পিটিশনে দ্বিতীয় পুরস্কার হিসেবে দেড় হাজার ডলার পেয়ে যাবার পর হঠাৎ করে টুম্পা আবিষ্কার করলো তার বহুদূরের একটা কল্পনা সত্যি হয়ে যাবার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। আর পুরো ঝামেলাটাই শুরু হয়েছে তখন।
নতুন বাবার সাথে টুম্পার কখনোই একটা আন্তরিক সম্পর্ক হয় নি। যখন তার মায়ের সাথে বিয়ে হয় সে ছিল অনেক ছোট, পুরো ব্যাপারটা ছিল এক ধরনের বিভীষিকার মতো। সে ধরেই নিয়েছিল যে মানুষটি আম্মুকে তার কাছ থেকে আলাদা করে ফেলেছে সেই মানুষটি ভালো মানুষ না। তার নতুন বাবা কোনোদিন সেই ভুল ভাঙানোর চেষ্টা করেন নি। যত দিন গিয়েছে টুম্পা টের পেয়েছে তার নতুন বাবা আসলে তার সত্যিকার বাবা না, তার আম্মুকে বিয়ে করা একজন মানুষ! তার নতুন বাবা কোনোদিন তাকে সত্যিকার অর্থে আদর করেন নি, বড়জোর তাকে সহ্য করেছেন। বড় একজন মানুষ হয়েও ছোট একটি মেয়েকে তাচ্ছিল্য করেছেন। টুম্পার অনেক ছোটখাটো সখকে গলা টিপে মেরেছেন। বাংলাদেশে যাওয়া নিয়ে তার সখটুকুকে টুম্পা প্রথমবার মরে যেতে দেয় নি। সেটার জন্যে রীতিমতো যুদ্ধ করেছে। বাবা কথাবার্তায় অনেকবার বলেছেন বাংলাদেশটা কতো ভয়ংকর সেটা টুম্পাকে বোঝানোর জন্যে তাকে একদিন বাংলাদেশ পাঠাবেন, কিন্তু যখন টুম্পা নিজেই বাংলাদেশ যাবার জন্যে প্রস্তুত হলো বাবা পুরোপুরি বেঁকে বসলেন। ঠিক কারণটা কী বাবাও পরিষ্কার করে বলেন না টুম্পাও বুঝতে পারে না। কীভাবে কী হলো কে জানে টুম্পাও গো ধরে বসল সে বাংলাদেশে বেড়াতে যাবেই! দুজনের মাঝে রীতিমতো যুদ্ধ, অনেকটা কে হারে কে জেতে অবস্থা!
শেষ পর্যন্ত কী হতো কে জানে কিন্তু আম্মু বিষয়টাকে সামলে নিয়েছেন। দেশে ছোট বোনের সাথে কথা বলে বাংলাদেশে টুম্পার থাকার ব্যবস্থা করেছেন এবং বাবাকে অনেক কষ্টে রাজী করিয়েছেন। টুম্পা তার নিজের টাকা দিয়ে প্লেনের টিকেট কিনেছে। বাংলাদেশ কনসুলেট থেকে পাশপোর্টে ভিসার প্রয়োজন নেই সিল বসিয়েছে। দেশে তার ছোট খালা আর খালাতো ভাইবোনের জন্যে উপহার কিনেছে। ছবি তোলার জন্যে ডিজিটাল ক্যামেরা কিনেছে তারপর একদিন জে,এফ.কে এয়ারপোর্ট থেকে প্লেনে চেপে বসেছে। এখন গ্রীষ্মকালীন ছুটি, টুম্পা যাচ্ছে মাত্র চার সপ্তাহের জন্যে কিন্তু তারপরেও প্লেনে ওঠার সময় আম্মুর চোখ ছল ছল করতে লাগলো।
টুম্পা প্লেনের সিটে হেলান দিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেললো। বাংলাদেশে তার এই ভ্রমণটা আসলে শুধু ভ্ৰমণ না, এটা একদিক দিয়ে একটা চ্যালেঞ্জ অন্যদিক দিয়ে একটা তীর্থযাত্রায় যাবার মতো! সে এখান থেকে ঘুরে গিয়ে বলতে চায় যেখানে আমার জন্ম হয়েছিল আমি সেই জায়গাটা দেখে এসেছি। আমি সেই মাটিতে পা রেখেছি, সেই বাতাসে নিঃশ্বাস নিয়েছি সেই পানিতে শরীর ভিজিয়েছি। কেন সে এটা করতে চায় সে জানে না। সেটা নিয়ে টুম্পা মাথাও ঘামায় না, সবকিছুরই যে একটা ব্যাখ্যা থাকবে সেটা কে বলেছে? টুম্পা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে, খুব ধীরে ধীরে বাইরে আলো হয়ে আসছে। সে সেখান থেকে আসছে সেখানে দিন শেষ হয়ে এখন অন্ধকার নেমে আসছে আর এখানে ঠিক তার উল্টো বিষয়টা চিন্তা করেই টুম্পার কেমন জানি অবাক লাগতে থাকে! জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকতে থাকতে একসময় ছাড়াছাড়া একধরনের ঘুমে টুম্পার দুই চোখ বন্ধ হয়ে আসে।
টুম্পার যখন ঘুম ভাঙলো তখন বিশাল প্লেনটা নিচে নামার জন্যে প্রস্তুতি নিচ্ছে। টুম্পা জানালা দিয়ে নিচে তাকায়, যতদূর চোখ যায় শুধু সবুজ আর সবুজ। বিশাল নদী তার ভেতর দিয়ে একেবেকে যাচ্ছে। প্লেনটা ধীরে ধীরে নিচে নামছে একটু পর পর কালো মেঘে ঢেকে যাচ্ছে চারিদিক, পরের মুহূর্তে আবার সব মেঘ কেটে ঝকঝকে নীল আকাশ। টুম্পা এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে প্লেনের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল। এটিই সেই দেশ? যে দেশে তার জন্ম হয়েছিল?
প্লেনটা শেষ পর্যন্ত রানওয়েতে ল্যান্ড করলো তারপর ধীরে ধীরে ট্যাক্সি করে টার্মিনালের দিকে এগুতে থাকে। টুম্পা মনে মনে অনুমান করেছিল দেখবে ছোট একটা এয়ারপোর্ট, কিন্তু আসলে বেশ বড়। অনেকগুলো ছোট বড় প্লেন সারি বেধে দাঁড়িয়ে আছে।
প্লেনটা থামার সাথে সাথে যাত্রীদের সবার মাঝেই বেশ একটা হুটোপুটি লেগে গেল, সবাই নিজের ব্যাগ নামিয়ে হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে যায় আর কিছুক্ষণের মাঝেই সবাই প্লেন থেকে নামতে শুরু করে। প্লেন থেকে নামার সাথে সাথে তাকে গরমের একটা হলকা এসে আঘাত করে। এটাই তাহলে বাংলাদেশের গরম? সবাই ব্যস্ত ভঙ্গীতে হাঁটছে তাদের পিছু পিছু বেশ খানিকটা জায়গা এসে টুম্পা একটা বড় হলঘরের মতো জায়গায় হাজির হলো, সেখানে অনেক মানুষ তারা ইমিগ্রেশনের ভেতর দিয়ে যেতে চেষ্টা করছে। টুম্পা অবাক হয়ে গেল–এতো সকালে এততো মানুষ কোথা থেকে এসেছে?
টুম্পার আমেরিকান পাসপোর্ট, তাই সে বিদেশীদের জন্যে আলাদা লাইনটিতে দাঁড়িয়েছে। এই লাইনের মানুষগুলোর শুধু পাসপোর্টগুলোই বিদেশী, মানুষগুলোর বেশিরভাগই এই দেশেরই। টুম্পা ধৈর্য ধরে দাঁড়িয়ে থাকে এবং খুব ধীরে ধীরে লাইনটা এগুতে থাকে। তার পাশে অনেকগুলো লাইন বাংলাদেশের মানুষের জন্যে, সেগুলোতে খুব ঝামেলা হচ্ছে, লাইনগুলো মোটেই এগুচ্ছে না এবং যারা দাঁড়িয়ে আছে আস্তে আস্তে তাদের মেজাজ গরম হয়ে উঠছে। টুম্পা কারণটা কিছুক্ষণের মাঝেই বুঝে গেল, যে পুলিশগুলো এখানে দাঁড়িয়ে আছে তারাই ঝামেলা করছে। ভালো পোশাক পরা মানুষগুলোকে লাইন ভেঙে সামনে নিয়ে যাচ্ছে। মিলিটারির অনেকগুলো মানুষ এসে লাইন ভেঙে সবার আগে চলে গেল, টুম্পা বাজী ধরে বলতে পারে এই মানুষগুলোকে সারাজীবন শুধু নিয়ম মেনে চলার কথা শেখানো হয়েছে, অন্য কেউ নিয়ম ভাঙলে তারা নিশ্চয়ই রেগে আগুন হয়ে যায় অথচ এখন তারাই কী সুন্দর নিয়ম ভেঙে সবার সামনে দিয়ে দাঁড়াচ্ছে! টুম্পা পাশের লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা একজন মানুষকে জিজ্ঞেস করলো, আপনি কোথা থেকে এসেছেন?
মানুষটি বলল, এ্যাঁ?
টুম্পা বুঝতে পারল সে প্রশ্নটা করে ফেলেছে ইংরেজিতে। এই মানুষটা একেবারে সাধারণ চেহারার মানুষ, নিশ্চয়ই ইংরেজি জানে না। তাই এবার বাংলাতে জিজ্ঞেস করল, আপনি কোথা থেকে এসেছেন?
মানুষটা বলল, দুবাই।
ও! এখন হঠাৎ করে টুম্পা বুঝতে পারলো এতো সকালে এয়ারপোর্টে কেন এত ভীড়। ইন্টারনেট থেকে সে জেনেছে বাংলাদেশের অনেক মানুষ মিডলইস্টে কাজ করতে যায়, সেরকম মানুষদের নিয়ে নিশ্চয়ই একটা প্লেন এসেছে। এই মানুষগুলো নিশ্চয়ই সেই প্রবাসী শ্রমিক। টুম্পা আবার কিছু একটা জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল তখন হঠাৎ কোথা থেকে একটা পুলিশ এসে এই মানুষগুলোকে যাচ্ছেতাই ভাবে গালাগাল করতে লাগলো, টুম্পা এতো অবাক হলো বলার নয়, বাংলাদেশের পুলিশরা এরকম কেন? আমেরিকাতে পুলিশেরা তো খুব ভদ্র ব্যবহার করে। টুম্পা খানিকক্ষণ চেষ্টা করলো বোঝার জন্যে পুলিশটা কেন মিডল ইস্ট থেকে ফিরে আসা শ্রমিকের সাথে কেন এতো খারাপ ব্যবহার করছে। বুঝতে না পেরে পুলিশটাকে জিজ্ঞেস করলো, আপনি এই প্যাসেঞ্জারের সাথে এরকম ব্যবহার করছেন কেন?
আর বলবেন না। পুলিশটা মুখ খিঁচিয়ে বলে, এই যন্ত্রনারা মিডল ইস্টে গিয়ে ঘর ঝাড়ু দেয়, আর দেশে এসে ভাব করে যেন একেকজন একটা লাট সাহেব!
টুম্পা খুব অবাক হলো তার কথা শুনে, বলল, আপনি জানেন এরা বাংলাদেশের জন্যে কতো ফরেন কারেন্সি আনেন?
পুলিশটা একটু থতমত খেয়ে হাত নেড়ে বিষয়টা উড়িয়ে দেবার ভঙ্গী করল, সেটা দেখে টুম্পার মেজাজ আরো গরম হয়ে গেল। সে গলা উঁচিয়ে বলল, এরা বাংলাদেশে রেমিটেন্স পাঠান আট বিলিয়ন ডলার। আট। এক বিলিয়ন ডলার কতো টাকা জানেন? সাত হাজার কোটি টাকা। বুঝেছেন?
পুলিশটা কী বুঝেছে কে জানে, সে একবার চোখ পিট পিট করে তাকালো। টুম্পা বলল, আপনার এই সুন্দর পোশাক, এই এয়ারপোর্ট, আপনার বেতন সবকিছু এই মানুষগুলো উপার্জন করে আনে, আর আপনারা তাদের সাথে এরকম খারাপ ব্যবহার করেন? ছিঃ!
টুম্পা মনে হয় গলা একটু উঁচিয়ে কথা বলে ফেলেছিল, কারণ দেখা গেল রেগে খাপ্পী হয়ে থাকা শ্রমিকেরা অনেকেই কান পেতে টুম্পার কথাটা শুনলো তারপর সবাই একটা গর্জন করে উঠলো, কেউ একজন বলল, ধর শালা পুলিশকে! কতো বড় সাহস আমাদের সাথে খারাপ ব্যবহার করে?
সাথে সাথে পুরো এয়ারপোর্টে একটা তুলকালাম কাণ্ড শুরু হয়ে গেল, টুম্পা বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থাকে, দেখে কেউ একজন খপ করে পুলিশটার কলার ধরে ফেললো এবং তাকে টেনে নিয়ে যেতে থাকে। হৈ চৈ চেঁচামেচি গোলমাল, আরো অনেক পুলিশ কোথা থেকে হাজির হয় পুলিশের বাঁশি বাজতে থাকে, মানুষজনের চিৎকার দাপাদাপি হুটোপুটিতে পুরো এলাকাটা সরগরম হয়ে যায়।
টুম্পার সামনে একজন বিদেশিনী দাঁড়িয়ে পুরোটা অবাক হয়ে দেখছিল, সে ঘুরে টুম্পার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, তুমি কী বলে এই সবমানুষগুলোকে এভাবে খেপিয়ে দিলে?
টুম্পা মাথা নাড়ল, বলল, আমি এমন কিছু বলি নাই! মানুষগুলো মনে হয় খেপেই ছিল।
খেপে ওঠার কারণে অবশ্যি একটু লাভ হলো। আরো কয়েকটা কাউন্টার খুলে তাড়াতাড়ি সবাইকে বের করে দেয়ার ব্যবস্থা করে দেয়া হলো।
টুম্পা ইমিগ্রেশন থেকে বের হয়ে কনভেয়ার বেল্টের উপর থেকে খুঁজে তার স্যুটকেস দুটো বের করে একটা কার্টের উপর তুলে ঠেলে ঠেলে বের হতে থাকে। কাঁচের দেয়ালের অন্যপাশে অনেকে দাঁড়িয়ে আছে, তাদের ভেতর কেউ একজন নিশ্চয়ই তার ছোট খালা, কিন্তু সে তাদের কাউকে চেনে না! প্রথমে বের হওয়া যাক, তারপর খুঁজে বের করবে।
কাস্টমসের মানুষগুলো উদাসভাবে বসে ছিল, টুম্পাকে কিন্তু জিজ্ঞেস করলো না এবং টুম্পা তার স্যুটকেস নিয়ে বের হয়ে এল। বাইরে এসে সে যখন এদিক সেদিক তাকাচ্ছে তখন হঠাৎ কোথা থেকে টকটকে ফর্সা মোটা সোটা একজন মহিলা এবং তার পিছু প্রায় টুম্পার বয়সী দুজন ছেলেমেয়ে তার দিকে ছুটে এল। মোটাসোটা মহিলাটি বললেন, টুম্পা? টুম্পা কোনো উত্তর দেবার আগেই মহিলাটি তাকে জাপটে ধরে ফেলে তার চোখেমুখে এবং ঘাড়ে চুমু খেতে শুরু করলেন। টুম্পা শুনলো চুমু খাবার ফাঁকে ফাঁকে বলছেন, ও মা! তুই কতো বড় হয়েছিস! কতো বড় আর কত সুন্দর! তোকে আর আমি যেতে দেব না। একটা সুন্দর দেখে জামাই খুঁজে বের করে তোর বিয়ে দিয়ে দেব। ঘরজামাই করে দেব–
টুম্পার বয়সী মেয়েটা বিব্রত হয়ে বলল, আম্মু, কী করছ তুমি? কী করছ?
মহিলাটি নিশ্চয়ই ছোট খালা হবেন, মেয়েটির কথাকে এতোটুকু পাত্তা দিলেন না, টুম্পাকে আরো জোরে জাপটে ধরে বললেন, তুই একেবারে এতটুকুন ছিলি। জন্মের পর আমি সবার আগে তোকে কোলে নিয়েছি, কথা নেই বার্তা নেই তুই ঝির ঝির করে পেশাব করে দিলি–
এবার মেয়েটি আসলেই খুব বিরক্ত হলো, মাকে টেনে সরানোর চেষ্টা করতে করতে বলল, আম্মু তুমি এখন থামবে?
ছোট খালা আমার কোনো লক্ষণ দেখালেন না, টুম্পার চোখে মুখে মাথায় চুমু খেতে খেতে বললেন, কতোদিন তোরে দেখি না! আহারে! এই খালার কথা তোর একবারও মনে পড়ে নাই?
দুই ভাই বোন মিলে এবারে তার মা আর টুম্পাকে টেনে আলাদা করে বলল, ছেলেটা বলল, টুম্পা আপু তুমি কিছু মনে করো না! তুমি বাংলাদেশে আসছ খবর পাবার পর থেকে আম্মুর মোটামুটি মাথা খারাপ হয়ে গেছে!
মেয়েটা বলল, আমাদের কথা সব ভুলে গেছে। এখন খালি তোমার কথা বলে আর কিছু বলে না!
ছেলেটা বলল, ও! আচ্ছা, আপু তুমি বাংলা বুঝো তো?
টুম্পা মাথা নাড়ল, বলল, বুঝি।
গুড। ছেলেটা বলল, আমার নাম রুমি। আমি তোমার কাজিন। খালাতো ভাই।
মেয়েটা বলল, আমি সুমি। তোমার খালাতো বোন।
ছেলেটা বলল, আর এই যে মহিলাটা তোমাকে চেপে ধরে চুমু খাচ্ছে সেটা হচ্ছে আমাদের আম্মু। তোমার খালা।
টুম্পা বলল, আমি সেটা আন্দাজ করেছি।
টুম্পার ছোট খালা আবার টুম্পাকে চেপে ধরে চুমু খেতে লাগলেন। রুমি আর সুমি অনেক কষ্ট করে তার মাকে টেনে আলাদা করল। ঠিক কী কারণ জানা নেই টুম্পার মনে হলো বাংলাদেশের মাটিতে ঠিক এভাবেই কোনো একজনের এসে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরার কথা ছিল, ঠিক এইভাবে তার ঘাড়ে আর মাথায় চুমু খাবার কথা ছিল।
শেষ পর্যন্ত গাড়িতে উঠে তারা যখন রওনা দিয়েছে তখন ছোট খালা একটানা কথা বলে যেতে লাগলেন, ঐ দেখ এয়ারপোর্টে আরবিতে নাম লিখে রেখেছে, আরবিতে কেন নাম লিখতে হবে? যারা আরব দেশে থাকে এটা কী তোদের দেশের এয়ারপোর্ট? তারা কী তাদের দেশের এয়ারপোর্টের নাম বাংলাতে নাম লিখাবে? তাহলে আমরা কেন আরবিতে লিখব? সবুজ বেবিট্যাক্সিগুলি দেখেছিস? এগুলির নাম সি.এন.জি.। খবরদার একা কখনো সি.এন.জি.–তে উঠবি না। উঠলেই তোকে ছিনতাই করে ফেলবে। ছিনতাই করে চোখে গুল লাগিয়ে দেবে। গুল কী জানিস? এক রকম মলম। চোখে লাগালে চোখ জ্বলতে থাকবে, চোখ খুলতে পারবি না। আর এই যে সি.এন.জি. দেখেছিস এক মন্ত্রী প্রতি সি.এন.জি.–তে এক লাখ টাকা করে ঘুষ খেয়েছে। এই মোটা এক মন্ত্রী। তোদের আমেরিকাতে কি সি.এন.জি. আছে? নাই! আমি জানতাম থাকবে না। যত ভেজাল জিনিষ সব আমাদের দেশে। দ্যাখ টুম্পা তাকিয়ে দেখ রাস্তার পাশে খেজুর গাছ লাগিয়েছে। কেন লাগিয়েছে জানিস? মিডল ইস্ট বানানোর জন্যে। বাংলাদেশ কী মিডল ইস্ট? এখানে রাস্তার পাশে খেজুর গাছ লাগাবে কেন? বুঝলি টুম্পা দেশটাকে জঙ্গীরা দখল করার প্ল্যান করছে। কথা নাই বার্তা নাই খালি বোমা। তোদের আমেরিকাতেও জঙ্গী আছে? আছে না? টেলিভিশনে দেখালো এতো বড় বড় দুইটা দালান গুড়া করে দিল। জঙ্গীদের উৎপাত আর ভালো লাগে না। টুম্পা, তোরা কী খাস ওখানে? ভাত খাস তো? আমি ভাত রেধে রেখেছি তার সাথে মুরগি। দেশি মুরগি। ফার্মের মুরগি আমি দুই চোখে দেখতে পারি না। তোদের ওখানে তো সব ফার্মের মুরগি। তাই না? দেশি মুরগি খেয়ে দেখিস। স্বাদ একেবারে জিবে লেগে থাকবে। তবে যা দাম–খালি মুরগি না সব কিছুর দাম। তুই বিশ্বাস করবি না একবার শুনি কাঁচা মরিচের কেজি চুরাশি টাকা। চুরাশি বুঝিস তো? এইটি ফোর। তুই বিশ্বাস করবি? আমি নিজের চোখে দেখেছি…
রুমি আর সুমি অনেক কষ্ট করে তার মাকে থামালো থামিয়ে জিজ্ঞেস করলো, প্লেনে কোনো অসুবিধে হয় নি তো?
টুম্পা মাথা নাড়লো, না। হয় নি।
সুমিই জিজ্ঞেস করলো, বাংলাদেশ কেমন লাগছে?
ভালো। খুব ভালো। শুধু গরম একটু বেশি। আর—
আর কী? মানুষ অনেক বেশি।
রুমি হি হি করে হেসে বলল, এখানে মানুষ কোথায়। এটা তো ফাঁকা, তোমাকে একদিন নিয়ে যাব বঙ্গবাজারে দেখবে কতো মানুষ!
সুমি জিজ্ঞেস করলো, তুমি কয়দিন থাকবে?
ছোট খালা ধমক দিয়ে বললেন, মেয়েটা এখনো পৌঁছায় নাই, এখনই যাবার কথা বলছিস কেন?
টুম্পা বলল, না, না, ঠিক আছে।
চার সপ্তাহ থাকব।
মাত্র চার সপ্তাহ?
চার সপ্তাহ মোটেই মাত্র না। আঠাইশ দিন।
সুমি বলল, অনেক মজা হবে আমাদের। অনেক মজা।
টুম্পা মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ অনেক মজা।
.
বাসায় পৌঁছানোর পর ড্রাইভার স্যুটকেস দুটি টেনে টেনে উপরে নিয়ে গেল। রুমি সুমির বাবা, টুম্পার ছোট খালু বের হয়ে এলেন, শুকনো পাতলা মানুষ, নাকের নিচে বড় বড় গোঁফ, মাথার চুল সামনের দিকে পাতলা হয়ে এসেছে। টুম্পাকে দেখে মুখে হাসি ফুটিয়ে বললেন, এসো মা, এসো। ওয়েলকাম টু বাংলাদেশ!
টুম্পা বলল, থ্যাংক ইউ।
আমি শুনে খুবই অবাক হয়েছি, তুমি নাকি বাংলাদেশে আসার জন্যে একেবারে টুথ এন্ড নেইল ফাঁইট করেছ!।
টুম্পা কিছু বলল না, একটু হাসার মতো ভঙ্গি করল। ছোট খালু বললেন, সবসময়ে তো উল্টোটা দেখি! মানুষ আমেরিকা যাবার জন্যে টুথ এন্ড নেইল ফাঁইট করে।
টুম্পা আবার একটু হাসির মতো ভঙ্গী করল। ছোট খালু বললেন, তুমি এতো সখ করে বাংলাদেশে এসেছ, তোমাকে এখন আমরা কোথায় নিয়ে যাই? এই দেশে তো সেরকম কিছুই নেই। ইন্ডিয়ায় কতো কী দেখার আছে– তাজমহল আছে, অজন্তা ইলোরা আছে, শান্তি নিকেতন আছে–
টুম্পা বলল, আমি কিছু দেখতে আসি নি ছোট খালু। আমি শুধু বাংলাদেশে আসতে চেয়েছি।
সেটা অবশ্যি এসে গেছ, তোমার মিশন কমপ্লিট।
টুম্পা হাসল, বলল, মিশন কমপ্লিট।
রুমি বলল, না আপু, তুমি মিশন কমপ্লিট বল না। আব্বু আম্মু আমাদের কোথাও নিয়ে যায় না–এখন তোমাকে নিয়ে যেতে হবে তোমার সাথে সাথে আমরা যাব। কক্সবাজার যাব, রাঙ্গামাটি যাব, সুন্দরবন যাব–
ছোট খালু বললেন, টুম্পাকে নিয়ে যাবার কথা, তোদের নিতে হবে কে বলেছে?
সুমি বলল, আমাদের না নিয়ে কোথাও যাবার খালি চেষ্টা করে দেখো একবার!
ছোট খালা বললেন, ব্যাস অনেক হয়েছে। টুম্পা মা যা, গোসল করে ফ্রেশ হয়ে আয়। তুই সুমির ঘরে থাকবি, তোর সুটকেস নিয়ে গেছে তোর ঘরে।
টুম্পা স্যুটকেস খুলে পরিষ্কার কাপড় বের করে বাথরুমে গেল গোসল করতে। বাথরুম ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে রেখেছে কিন্তু তার পরেও কেমন জানি একধরনের বিবর্ণ ভাব রয়েছে। তাদের বাথরুমে গোসল করার আলাদা জায়গা থাকে, গোসল করার সময় শুধু সেই জায়গাটা ভিজে বাকিটুকু সবসময় শুকনো থাকে। এখানে সেটা নেই গোসল করলেই পুরো বাথরুম ভিজে থই থই করতে থাকে!
টুম্পা অনেকক্ষণ সময় নিয়ে গোসল করল, এক ধরনের ভ্যাপসা গরম, শাওয়ারের ঠাণ্ডাপানিতে শরীর জুড়িয়ে গেল। কিন্তু বাথরুম থেকে বের হবার পর আবার ভ্যাপসা গরম। কী আশ্চর্য!
টুম্পা তার ঘর থেকে বের হয়ে দেখে ডাইনিং টেবিলের উপর দশ রকম খাবার। টুম্পা চোখ বড় বড় করে বলল, সর্বনাশ! এতো খাবার কে খাবে?
ছোট খালা বললেন, তুই খাবি। বাংলাদেশে এসেছিস বাংলাদেশের খাবার খাবি না?
ছোটখালা আমি কিন্তু আমেরিকাতেও বাংলাদেশের খাবার খাই। আম্মু রান্না করে।
তোর আম্মুর রান্না! তাহলেই হয়েছে। সে আবার রান্না করতে পারে নাকি?
রুমি বলল, টুম্পা আপু, আমাদের আম্মু দুইটা জিনিস খুব ভালো পারে। একটা হচ্ছে রান্না। আরেকটা–
আরেকটা কী?
সেটা সকালে দেখ নাই? কথা বলা—
ছোট খালা হাত তুলে বললেন, চুপ কর বেয়াদপ ছেলে।
যতক্ষণ প্লেনে ছিল সারাক্ষণই কিছু না কিছু খেয়েছে কিন্তু বেশ অবাক ব্যাপার টুম্পার বেশ খিদে পেয়ে গেছে। সে সবার সাথে বসে খুব সখ করে খেলো। পরটা, কাবাব, সবজি, ডাল, মিষ্টি, পায়েশ, আম দই, কী নেই টেবিলে। ছোট খালা সারাক্ষণই প্লেটে খাবার তুলে দিচ্ছিলেন–কাজেই যেটুকু খাওয়ার কথা টুম্পা খেলো তার থেকে অনেক বেশি।
খেতে খেতে ছোট খালু বললেন, তোমাকে প্রথমেই খাওয়া সংক্রান্ত তিনটি গ্রাউন্ড–রুল শিখিয়ে দিই তাহলে কখনোই বিপদে পড়বে না। রুল নাম্বার ওয়ান : কখনোই বাইরে কিছু খাবে না
সুমি চোখ বড় বড় করে বলল, তার মানে নো চটপটি?
নো চটপটি। নো ঝালমুড়ি।
সুমি যন্ত্রণার মতো একটা শব্দ করল যেটা শুনে মনে হতে পারে রাস্তায় চটপটি আর ঝালমুড়ি খাওয়া বাংলাদেশ ভ্রমণের সবচেয়ে বড় অংশ!
ছোটখালু বললেন, রুল নাম্বার টু : রান্না করা জিনিস ছাড়া আর কিছু খাবে। তার মানে নো কাঁচা শাকসবজি। নো সালাদ।
সুমি এবার আনন্দের মতো একটা শব্দ করল। ছোটখালু না শোনার ভান করে বললেন, রুল নাম্বার থ্রি : সিদ্ধ করা পানি ছাড়া আর কোনো পানি খাবে না। এই তিনটা নিয়ম মেনে চললে মোটামুটি ভাবে তুমি বাংলাদেশে টিকে যাবে।
রুমি বলল, ছিনতাই নিয়ে একটা বক্তৃতা দেবে না? হরতাল নিয়ে? সন্ত্রাস নিয়ে?
ছোট খালা বললেন, আহা! মেয়েটা মাত্র এসে পৌঁছেছে এর মাঝে যত খারাপ খারাপ কথা সব বলতে শুরু করেছিস! তোরা একটু থামবি?
রুমি বলল, ঠিক আছে থামছি। কিন্তু এর পরে টুম্পা আপু যদি বাইরে গিয়ে ছিনতাই হয়ে যায় আমাকে দোষ দিও না!
খাওয়ার পর টুম্পা তার স্যুটকেস খুলে উপহারগুলো বের করলো। ছোট খালুর জন্যে ইলেকট্রিক রেজর, ছোটখালার জন্যে সোয়েটার আর চামুচের সেট, সুমির জন্যে কানের দুল, রুমির জন্যে একটা বাইনোকুলার! এছাড়া সবার জন্যে চকলেটের প্যাকেট, কফির টিন, শ্যাম্পু, বডি লোশান, বলপয়েন্ট কলম, স্টেপলার খুঁটিনাটি একশো রকম জিনিস! টুম্পা কিছু একটা বের করা মাত্র রুমি সুমি তার উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে টানাটানি শুরু করে দেয়। সবাই মিলে যখন হৈ চৈ হচ্ছে তখন আমেরিকা থেকে ফোন এল, টুম্পা ঠিকমতো পৌঁছেছে কী না জানার জন্যে আম্মু ফোন করছেন! ছোটখালা টুম্পাকে ফোনটা ধরিয়ে দিলেন, টুম্পাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সবকিছু বলতে হলো!
কথা শেষ হবার পর ছোট খালা জিজ্ঞেস করলেন, এখন আমেরিকাতে কয়টা বাজে?
রাত বারোটা!
সর্বনাশ, তোর নিশ্চয়ই খুব ঘুম পেয়েছে! তুই শুয়ে একটু বিশ্রাম নে।
না, ছোট খালা, আমি প্লেনে অনেক ঘুমিয়েছি।
প্লেনে আবার মানুষ ঘুমায় কেমন করে? বিছানায় শুয়ে ঘুমা।
ছোট খালা রীতিমতো জোর করে টুম্পাকে তার ঘরে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলেন। তখন হঠাৎ করে টুম্পা বুঝতে পারলো আসলেই তার খুব ঘুম পেয়েছে। বিছানায় শুতেই তার চোখ বন্ধ হয়ে এল, তার এখনও বিশ্বাস হয় না, পৃথিবীর একেবারে উল্টো দিকে সে চলে এসেছে। এখানে অত্যন্ত বিচিত্র এক ধরনের ভ্যাপসা গরম, মাথার উপরে সিলিং ফ্যান নামে একটা বিচিত্র জিনিষ পাই পাঁই করে ঘুরে তাকে বাতাস দেবার চেষ্টা করছে, কিন্তু কোনো লাভ হচ্ছে না। এই গরমকে দূর করা যায় না, এই গরমে অভ্যস্ত হয়ে যেতে হয়।
টুম্পা চোখ বন্ধ করার আগে ঘরটির চারপাশে তাকালো, একটা আলমিরা, পড়ার ডেস্ক, দেওয়ালে কয়েকটা ছবি। একটা ছবিতে তার চোখ আঁটকে গেল। ছোট একটা বাচ্চার ছবি। ছবিটাকে তার পরিচিত মনে হচ্ছে, কোথায় দেখেছে সে এই ছবি? প্রাণপণে মনে করার চেষ্টা করতে করতে গভীর ঘুমে ঢলে পড়ল টুম্পা।