কী কর্তব্য, তাই ঠিক করবার জন্যে ত্রয়বাসীরা আজ সভা করছেন।
জনৈক বৃদ্ধ বললেন—হেক্তর যখন মরেছেন তখন আর কোনো আশা দেখি না। এচিলীসকে বাধা দেয় এমন কোনো বীর আমার নজরে পড়ে না। শীঘ্রই ত্রয় নগর ধ্বংস হবে; গ্রিকরা আমাদের সকলকে পুড়িয়ে মারবে। বাঘ-ভালুক, দৈত্য-দানব কেউ এচিলীসের গতিরোধ করতে পারবে না। অনর্থক ধনে-প্রাণে না মরে, হয় এখন আমরা সকলে মিলে গ্রিকদের দয়া ভিক্ষা করি, আর তা যদি না করি তাহলে ত্রয় ছেড়ে পালিয়ে যাই এই আমার যুক্তি।
প্রিয়াম রাজা বললেন–ইথিওপিয়ার রাজা যখন শীঘ্রই আমাদের সাহায্যের জন্যে আসছেন, তখন না পালিয়ে আরও কিছুদিন অপেক্ষা করো। কষ্ট যথেষ্ট হয়েছে, আরও কিছুদিন কষ্ট করি। নগর ছেড়ে পালিয়ে যাওয়াটা কি লজ্জার কথা নয়? এর চেয়ে মরণই ভালো।
জ্ঞানী পেলিমীদাস বললেন–রাজা, ইথিওপিয়ার রাজা হয়তো আমাদের সাহায্যের জন্যে আসছেন; তিনি আসবেন সত্যি, কিন্তু এ কথা কি আপনি ভাবছেন না যে, কত বড় পাপের জন্যে আমরা লড়াই করছি? অমার ইচ্ছা, বিলম্ব হলেও রানী হেলেনকে ফিরিয়ে দেওয়া উচিত–শুধু রানীকে নয়, সঙ্গে সঙ্গে ধন-রত্ন দিয়ে এ পাপের কলঙ্ক মুছে ফেলুন। এই কাজ করলে ধন-প্রাণ, মান-মর্যাদা সব রক্ষা হবে।
জ্ঞানী পেলিমীদাসের কথা শুনে সকলেই–এমন কি রাজাও খুশি হলেন।
রূপমুগ্ধ পেরিস পেলিমীদাসকে অপমানের ভাষায় বললেন–বৃদ্ধ পেলিমীদাস, নগরে এবং ছাত্রদের নিকট তোমার বুদ্ধির মূল্য থাকতে পারে, কিন্তু এখানে নয়! রাজপরিবারের ভালোমন্দ তুমি কী বোঝ? তোমার শুষ্ক ধর্মবুদ্ধি মানুষের কোনো উপকারে আসবে না। তুমি নিজে কাপুরুষ, তাই কাপুরুষের মতোই কথা বলছো। যে ক্ষমতাশালী, সে-ই উচ্চ আসন লাভ করবে–যে উপযুক্ত, সেই জগতে উত্তম জিনিসের অধিকারী। হেলেনের ন্যায় পরী লাভ করবার যোগ্যতা আমার ছাড়া এ জগতে আর কারো নেই।
ঘৃণায় পেলিমীদাস বললেন–হতভাগ্য সে, যে পরস্ত্রীকে চুরি করে।
পেরিস সরোষে বললে ভুল করে যদি তার আর কারো সঙ্গে বিয়ে হয়ে থাকে, সে জন্যে কি আমি দায়ী? আসল কথা, তলোয়ার দেখে তুমি ভয় কর। তুমি জ্ঞানী হতে পার, কিন্তু তুমি কাপুরুষ।
পেলিমীদাস বললেন–শয়তান, কাকে তুমি জ্ঞান শিখাও? তোমার সুন্দরী মাকে যদি কেউ আজ চুরি করে, তা হলে এসব তর্ক কোথায় থাকবে? জগতের সকল মানুষের চেয়ে তোমার স্থান নিচে। মানুষের সমাজে তুমি মুখ দেখিও না। তোমার জন্যেই আমাদের দুর্দশা। তোমার জন্যেই ত্রয় নগর ধ্বংস হবে। আল্লাহ যেন আমাকে তোমার মতো মাথা পাগল না করেন, যেমন আছি তেমনি থাকি।
পেরিসের আর কথা বলবার সাহস হল না। মুখে যে তর্কই করুক না কেন, ভিতরে জানতো তারই কুকর্মের জন্যে তার জাতির মাথায় এই বিপদ। হায়! সে যে হেলেনের, জন্যে একেবারে পাগল হয়ে গিয়েছিলো–সে প্রাণ দিতে পারে, কিন্তু হেলেনকে দিতে পারে না। হেলেনকে পাহারা দেবার জন্যে কিছুদিন হতে নগর প্রাচীরের সর্বত্র পাহারাদার নিযুক্ত হয়েছিলো।
পরের দিন বহু সৈন্য নিয়ে ইথিওপিয়ার রাজা এলেন। রাজা প্রিয়ায় তাকে পেয়ে মনে উৎসাহ ও আনন্দ লাভ করলেন। রাজা তাকে খুব আদর ও সম্মান করে নগরে আনলেন। আর এ পর্যন্ত যা যা ঘটেছে সব বললেন। ইথিওপিয়ার রাজা যেমন বললেন–ভাই, বড়াই করে মুখে অনেকে অনেক কথাই বলে, আমি ওসব বড়াই করতে চাই নে, যুদ্ধকালে যা করবার তা করবো–এখন খোদা ভরসা।
আবার বললেন–পথে সোলমী দেশের অধিবাসীরা আমাদেরকে বড় নাকাল করেছে, নইলে এর অনেক আগেই আসতে পারতাম।
বিলম্ব না করে পরের দিনই যেমন তার অসংখ্য সৈন্য নিয়ে যুদ্ধে নামলেন। সমুদ্রের ঢেউ যেমন করে ভয়ানক শব্দ করে কূলে সে আছাড় খেয়ে-খেয়ে পড়ে, দুই দলের সৈন্যও তেমনি করে এ ওর গায়ে এসে পড়তে লাগলো। এচিলীস দক্ষিণ দিকে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করছিলেন! সাগর-কূলে ঘূর্ণিবায়ু যেমন করে গাছ-গাছড়া উপড়ে শূন্যে তুলে আছাড় মেরে ফেলে এচিলীসও তেমনি করে হয় সৈন্যদেরকে আছাড় মেরে ফেলছিলেন।
রক্ত-স্রোতে ত্রয়ের মাঠ ভেসে গেল। উভয় দলের বহু বীর প্রাণ হারালেন। রাজা মেমন নেস্তরকে দেখে তার উপর বর্শা তুললেন। নেস্তরের ছেলে যদি হঠাৎ সম্মুখে এসে বাপকে রক্ষা না করতো তা হলে নেস্তের আর রক্ষা ছিল না। বাপকে রক্ষা করতে যেয়ে নেস্তরের ছেলে মেমনের এক প্রিয় বন্ধুকে মেরে ফেললেন। মেমন ভয়ানক রেগে এরূপ। জোরের সঙ্গে তার দীর্ঘ ধনুক তুলে নেস্তরের পুত্রের দিকে ছুঁড়লেন যে, তাতেই সে মাটিতে পড়ে মরে গেল।
চোখের সামনে পুত্রকে মরতে দেখে নেস্তর একেবারে উন্মত্ত হয়ে গেলেন, তিনি উচ্চৈঃস্বরে সঙ্গীগণকে ডেকে তার সর্বনাশের কথা বললেন। রাজা মেমন কম বীর নন–হঠাৎ তার সামনে যেতে কেউ সাহস করলে না। কেউ অগ্রসর হচ্ছে না দেখে নেস্তর নিজেই তলোয়ার ঘুরোতে ঘুরোতে রাজা মেমনের সামনে উপস্থিত হলেন। নেস্তর একে বুড়ো তার ওপর রাজা মেমনের সঙ্গে এঁটে ওঠা তার পক্ষে খুব কঠিন। তিনি প্রাণ হারাতেন নিশ্চয়ই, হঠাৎ রাজা তাকে চিনে বললেন–এ কি, বন্ধু নেস্তর যে! হায় কাঁপাল! আপনার ছেলেকে আমি হত্যা করেছি? এর চেয়ে দুঃখের বিষয় আর কী হতে পারে? আপনি যে আমার পুরাতন বন্ধু! বাস্তবিকই মেমনের রাজা বীর নেস্তরের একজন পুরাতন বন্ধু। মেমন বললেন–এখান থেকে যান আপনি, আপনার সঙ্গে আমি কিছুতেই লড়াই করতে পারবো না!
নেস্তর মাথা নত করে সে স্থান ত্যাগ করলেন। সন্তানের মৃত্যুব্যথা তার বুক ভেঙ্গে দিচ্ছিল। তিনি এচিলীসের কাছে যেয়ে বললেন–মেমন আমার ছেলেকে মেরে ফেলেছে, এর প্রতিশোধ চাই।
অবিলম্বে এচিলীস মেমনের দিকে ছুটলেন। দুই বীরে ভীষণ যুদ্ধ বেধে গেল। চারদিকের সৈন্যগণ সে ভীষণ লড়াই দেখতে লাগলো।
দুই বীর ভীষণভাবে যুদ্ধ করতে লাগলেন, মরণ-বাচনের কথা তারা ভুলে গেলেন। তলোয়ার নিক্ষেপের তালে তালে তাদের টুপির পালক কেঁপে উঠছিলো। দুজনের মুখেই। ক্রোধের আগুন ঝলকে ঝলকে জ্বলে উঠছিলো। দুজনের শরীরের ক্ষত-পথ দিয়ে রক্ত বের হতে লাগলো, কিন্তু কারও সেদিকে লক্ষ্য নেই। ওপর হতে ফেরেশতারাও এই দুই বীরের যুদ্ধ দেখছিলেন। কে জিতবে, কে হারবে–তা তাঁরাও ঠিক করতে পারছিলেন না। বাপরে। বাপ, সে কী ভয়ানক লড়াই!
হঠাৎ সূর্য অস্ত গেল, সমস্ত পৃথিবী অন্ধকারে ভরে উঠলো–দর্শকগণ ভীত-বিস্মিত হয়ে চোখ বন্ধ করলে, তার পর চোখ খুলে দেখলেন, ইথিওপিয়ার রাজা মাটিতে পড়ে আছে–আঁধার তখন কেটে গেছে, আবার সূর্য দেখা দিয়েছে। হঠাৎ আবার আঁধার হয়ে গেল, আর সেই আঁধারের মধ্যে রাজার দেহকে যেন অদৃশ্য দুটো হাত শূন্যে তুলে নিয়ে গেল। রাজা মেমনের মা ছিলেন পরী, তিনিই ছেলের মৃতদেহকে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে তুলে নিয়েছিলেন এবং শেষে সাগর-কূলে পাহাড়-মূলে অশ্রুসিক্ত চোখে মাটি দিয়েছিলেন। লোকে বলে, রাজার দেহ কতকগুলি কালো রংয়ের পাখি হয়ে উড়ে গিয়েছিল। আজো তারা সাগরের ধারে উড়ে বেড়ায়।
রাজা মেমনের মৃত্যুতে ত্রয় ও ইথিওপিয়ার সৈন্য ভয়ে যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করতে লাগলো–গ্রিক সৈন্য তাদের পশ্চাতে তাড়া করতে লাগলো। এচিলীসও ভীষণ বেগে আগের দিনকার মতো নগর দ্বারের দিকে ছুটতে লাগলেন, হঠাৎ পেরিসের একটা তীর এসে তার বুকে লাগলো, তখনই এচিলীস মাটিতে পড়ে গেলেন।
ত্রয়-সৈন্য হঠাৎ জয়োল্লাস করে ফিরে দাঁড়ালো! আজ এচিলীসের মৃত্যু হয়েছে, এ অসম্ভাবিত ঘটনায় তারা উৎসাহে-আনন্দে নেচে উঠলো। আর কে তাদের সঙ্গে পারবে! এচিলীস ছাড়া আর কে নগর দখল করবে? বাকি গুলোতে শৃগাল, এয়সৈন্য তাদেরকে মোটেই ভয় করে না।
এচিলীসের সঙ্গে বীর ওদেসিজ এবং বড় আজাকও ঘোড়া ছুটিয়ে চলছিলেন–মাথায় তাদের আকাশ ভেঙ্গে পড়লো, কিন্তু তখন শোক করবার সময় ছিল না। ফড়িংয়ের পালের মতো শত্রু-সৈন্য তাদের দিকে ছুটে আসছে।
বড় আজাক ঘোড়া হতে হঠাৎ লাফিয়ে পড়ে বললেন–ভাই, শত্রু-সৈন্য ভীষণ বেগে অগ্রসর হচ্ছে, এচিলীসের দেহকে পিঠে করে দৌড় দিচ্ছি, তুমি পেছনে পেছনে এস।
এচিলীসের বিরাট দেহ, তার লোহার জামা এবং অস্ত্র সব পিঠে করে বড় আজাক ভীষণ বেগে দৌড়াতে লাগলেন, আর ওদেসিজ পেছনে পেছনে ঘোড়া ছুটিয়ে আসতে লাগলেন।
এচিলীসের মৃত্যুতে গ্রিক সৈন্যরা এত দুঃখ করল যে, সে কথা আর বলা যায় না। কোনো বীরের মৃত্যুতে তারা এত দুঃখ করে নি।
এচিলীসকে যথাসময়ে উপযুক্ত সম্মানের সঙ্গে গোর দেওয়া হল। এচিলীসের মা, ব্রীসাস এবং অনেক পরী এসে আঁখিজলে শেষ কাজ সম্পন্ন করলেন। ছেলের যে এমন করে মৃত্যু হবে, তিতিশা পূর্ব হতেই তা জানতেন। এচিলীসের কবর এখনও রয়েছে, সেকান্দার শাহ যখন ভারত আক্রমণ করতে এসেছিলেন, তখন তিনি এচিলীসের কবরের কাছ দিয়ে এসেছিলেন।
এচিলীসের কবর দেওয়া হয়ে গেলে তিতিশা বললেন–সন্তানহারা মার মনে কী আঘাত লাগে তা আজ আমি প্রকাশ করবো না–আজ আমার বীর সন্তানের মৃত্যুতে আনন্দ করবো, সে কাপুরুষের মতো মরে নি–সে মরেছে বীরের মতো।
সেদিনকার মতো যুদ্ধ স্থগিত থাকলো। এচিলীসের বীর-জীবনের প্রশংসা গীত হতে লাগেলো। সৈন্যেরা নানা প্রকার যুদ্ধ ক্রীড়া ও আমোদ উৎসব করতে লাগলেন। বুড়ো নেস্তর বাঁশি বাজিয়ে গান করতে লাগলেন।
“তিতিশার মতো রূপবতী রমণী গ্রিস দেশে আর নেই; অনেক অনেক দিনের কথা, পেলাস তাকে সাগর কূলে পাহাড় গুহায় পেয়েছিলেন; প্রেম ও ভালবাসায় পেলাস তার আঁচল চেপে ধরেছিলেন–তিতিশা পেলাসের হাত থেকে মুক্তি পাবার বৃথা-চেষ্টা করেছিলেন, তার বিয়ের সময় পরী-মানুষ সবাই যোগ দিয়েছিলেন; তিতিশার ন্যায় জ্ঞানবতী ও গুণবতী মহিলা আর নেই–”।
“তার পুত্র এচিলীসের ন্যায় মহাবীর জগতে আর জন্মে নি।”
সৈন্যেরা সকলে সুগন্ধি শরবত খেতে সকলকে অনুরোধ করলে। পরীরা হাত-ধরাধরি করে গান করতে ও বাঁশির তালে তালে পা ফেলে নাচতে লাগলেন।
গান শেষ হল। তিতিশা নেস্তরের মধুর কণ্ঠ ও বাঁশী বাজানোর প্রশংসা করলেন।
এর পর বিস্তীর্ণ যুদ্ধক্ষেত্রে ষাঁড়ের লড়াই হল। তারপর আজাক দায়োমিদাস কুস্তী করলেন। আজাক দায়োমিদাসের মাথা ধরে চিৎ ক র ফেলতে চেষ্টা করলেন, কিন্তু দায়োমিদাস চালাকির সঙ্গে মাথাটি খসিয়ে নিয়ে আজাকের পায়ের মধ্যে পা দিয়ে তাঁকে মাটিতে ফেলে দিলেন। চতুর্দিকে উল্লাস-চিৎকার ও করতালি হতে লাগলো।
এইভাবে সারাদিন আমোদ-উৎসবে কেটে গেল।