রানী-হেলেন (উপন্যাস)
লুৎফর রহমান
০১.
অনেক কাল আগে গ্রীস দেশে স্পার্থা শহরে এক রাজা ছিলেন। তার নাম তানীরজ। হেলেন নামে তার এক মেয়ে ছিল। হেলেন বড় খুবসুরত মেয়ে, একেবারে চাঁদের মতো। চুলগুলি মেঘের মতো কালো আর পা পর্যন্ত লম্বা। মেয়ের রূপের প্রশংসা সমস্ত গ্রিসে ছড়িয়ে পড়লো,–স্পার্থা শহর তো নয়, গ্রিস দেশে আর অমন সুন্দরী মেয়ে দ্বিতীয় ছিল না।
ক্রমে মেয়ে সেয়ানা হলেন। নানা দেশ থেকে রাজপুত্রেরা এসে হেলেনকে বিয়ে করবার জন্য রাজার কাছে দরবার করা শুরু করলেন। সকলেই রাজাকে বললেন–“কন্যাটি আমাকেই দিন; যদি না দেন তা হলে যাকে দেবেন; তার নিস্তার নেই, তাকে খুন করবো, কন্যার মা-বাবাকেও ছাড়বো না।”
রাজা একে বুড়ো তার উপর বড় দুর্বল। তিনি মহাবিপদে পড়লেন। শেষে এক মতলব এঁটে সব রাজপুত্রকে ডেকে একদিন বললেন, বাপু সকল, তোমরা এক কাজ করো, এতে তোমাদের সকলের পক্ষেই সুবিধা হবে। আমার মেয়েকে যদি বিয়ে করতে চাও, তা হলে তোমাদেরকে একরার করতে হবে। একরারটি হচ্ছে, যে হেলেনকে বিয়ে করবে তার কেউ ক্ষতি করতে পারবে না, কেউ ক্ষতি করতে এলে সকলে মিলে তাকে জব্দ করবে! সকলেই প্রতিজ্ঞা করলেন–হ্যাঁ, তাই হবে।
তারপর রাজা মেয়েকে বললেন, মা, এখন তুমি, জের পছন্দমতো বর খুঁজে নাও। মেয়ে এগামেমননের ভাই মেলাসকে স্বামীরূপে গ্রহণ করেন। এগামেমনন লোকটা কে তা জান? ইনি হচ্ছেন হেলেনের ভগ্নীপতি। এর সঙ্গে হেলেনের বড় বোনের বিয়ে হয়েছিল।
মেয়ের বিয়ের পর জামাইকে রাজ্য দিয়ে বুড়ো রাজা বিশ্রাম করতে লাগলেন।
গ্রিসের পূর্ব দিকে সমুদ্র পাড়ে এশিয়া মাইনরে ত্রয় বলে এক নগর ছিল। এখানকার রাজা ছিলেন প্রিয়াম। প্রিয়াম বড় জবরদস্ত রাজা–ঘর বাড়ি দালান কোঠা যে কত তার ছিল, তার ইয়ত্তা নেই। পেরিস বলে তার এক ছেলে হলে, রানী স্বপ্ন দেখলেন যেন শিশু পেরিস একটা জ্বালানো মশাল নিয়ে আকাশ থেকে নেমে এসেছে, সেই মশাল দিয়ে সারা। ত্রয় শহরে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে।
রানী স্বপ্ন দেখে ভীত হয়ে উঠলেন, রাজাও রানীর মুখে স্বপ্নের কথা শুনলেন। শুনে বললেন, এই ছেলে দেশে মহাবিপদ টেনে আনবে, অতএব একে মেরে ফেলাই ভালো। ছেলে কি না, গলা টিপে মেরে ফেলতে রাজা-রানীর বড় মায়া হল, শেষে রানী শিশুকে দূরে ইদা নামক পাহাড়ের জঙ্গলে রেখে এলেন।
খোদার মরজি! একটা গরিব মানুষ সেই পথ দিয়ে যাচ্ছিলো। সে মেষ চরিয়ে খেতো। সে শুনতে পেলো, বনের মধ্যে যেন একটা শিশু মিহিসুরে পিপি করে কাঁদছে। একটু এগিয়ে লোকটা দেখলে, একটা সোনার বরণ শিশু কাঁটার মধ্যে পড়ে কাঁদছে। তার বড় মায়া হল, বুকে করে তুলে এনে সে শিশুকে মানুষ করতে লাগলো। গরিব মানুষটা শিশুর নাম রাখলো পেরিস। পেরিস ক্ৰমে বড় হতে লাগলেন। বেড়ে বেড়ে শেষে যুবক হয়ে উঠলেন। পেরিস যে রাজার ছেলে এ কথা তিনি বা কেউ জানলো না। তিনি আর কী করবেন?–পাহাড়ে মেষ চরাতেন আর বাঁশি বাজিয়ে গান করতেন। তাঁর শ্রী দেখে পাহাড়ের মাঝেকার একটা পরী তাকে ভালবাসতে লাগলো–এই পরীটার নাম ওনোন।
তোমরা পরীর কথা অনেকে শুনেছ, কেমন? একবার স্পার্থা নগরের কাছে এক যুবক এক পরীকে খাঁচায় আটক করে বললে, আমাকে যদি বিয়ে না কর তা হলে কিছুতেই তোমাকে ছাড়ছি নে। পরীটা আর কি করবে, শেষে রাজি হল। এমনটি আর কখনও হয় নি–পরীর সঙ্গে মানুষের বিয়ে! বিয়ের উৎসবে হাজার হাজার জিন-পরী এসে যোগ দিলেন। কত মানুষ এসে সভার আনন্দ বর্ধন করতে লাগলেন। খানা-মজলীশে কত মিঠাই, কত ছানা, কত দই, কত হালুয়া, কত পোলাও-কোর্মা সে আর কী বলবো।
পরীদের রাজার তিনটি মেয়েও সে সভায় এসেছিলেন। তাঁরা হচ্ছেন হেরা, এথেন এবং এফ্রোদাইত।
একটা শয়তান জিন, তার নাম এরিস, সে কেবল সকলের মাঝে ঝগড়া বাঁধিয়ে। বেড়াতো। তাকে কেউ ভালবাসতো না। তাকে এই উৎসবে দাওয়াত করা হয় নি বলে সে। মনে মনে ঠিক করলে, বেশ, মজা দেখাচ্ছি।
সে রাজার তিনটি মেয়ের সামনে একটি সোনার আতা ফেলে দিল–আতায় লেখা ছিলো, যে সকলের চেয়ে দেখতে ভালো–সে-ই এই আতা পাবে। তিন বোনের প্রত্যেকেই আতা দাবি করলেন। শেষে রাজার তিন মেয়ের মধ্যে কে বেশি সুন্দরী এই নিয়ে মহাঝগড়া আর দলাদলি আরম্ভ হল। তিন বোনের বাপ ঝগড়া থামাবার জন্য বললেন, তোমরা ইদা পাহাড়ে রাজা প্রিয়ামের ছেলে পেরিসের কাছে যাও, সে যাকে অধিক সুন্দরী বলবে, তারই জয় হবে–সে-ই আতা পাবে।
এদিকে ইদা পাহাড়ে যুবক পেরিস গাছের ছায়ায় ঘুমোচ্ছিলেন।দূরে বনের আড়ালে পরী বলিকা ওনোন দাঁড়িয়ে ছিলেন। মেষগুলি নিঝরের পাশে একটার উপর আর একটা গা রেখে আরাম করছিল। এমন সময় হঠাৎ পেরিস চোখ খুলে দেখলেন, পরী রাজার তিনটি মেয়ে তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। সমস্ত বনভূমি তাঁদের আলোক-পুলকে পূর্ণ হয়ে উঠেছে।
প্রথমেই হেরা মুখ খুলে বললেন–দেখ, পেরিস, আমাদের মধ্যে কে বেশি সুন্দরী তাই তোমাকে বিচার করতে হবে, প্রামণস্বরূপ তাকে এই সোনার আতাটি দেবে। তুমি যে রাজা প্রিয়ামের ছেলে তা হয়তো জান না। আমি তোমাকে জগতের মধ্যে শ্রেষ্ঠরাজা করবো, পৃথিবীর সকল রাজা তোমার কাছে কৃপা ভিক্ষা করবে, অসংখ্য গাড়ি ঘোড়া হাতি সৈন্য তোমার হবে। হাজার হাজার সৈন্য, সেনাপতির মালিক হবে তুমি। শস্য ভরা মাঠ, কত গিরি, দুর্গ, কত মহিষ, গাভী, কত পাল দেওয়া জাহাজ তোমাকে দেবো; জীবনে তোমার সুখের অবধি থাকবে না। এখন যদি বুদ্ধিমান হও তবে আমাকে অসন্তুষ্ট করো না, সোনার আতাটি আমাকেই দাও।
এথেন বললেন–দেখ পেরিস, হেরার কথা শুনো না, আতাটি আমাকে দাও। আমি তোমাকে জগতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী হবার সুবিধা করে দেব। তোমার পুণ্য জীবনের গৌরব পৃথিবীর সর্বত্র ছড়িয়ে পড়বে। ছার ঐশ্বর্যের লোভ করো না, সাধুর জীবনের তুলনায় রাজার। জীবনের কোনো মূল্য নেই।
ওনোন ফিস ফিস্ করে পেরিসের কানে বলতে যাচ্ছিল–এঁকেই আতাটি দাও–অমনি এফ্রোদাইত বললেন–আমাকে যদি সোনার আতাটি দাও তা হলে জগতের মধ্যে। শ্রেষ্ঠ সুন্দরী মেয়ে তোমাকে ভালবাসবে। সকলের কথাই তুমি শুনেছ, এখন যা ইচ্ছে কর।
পেরিস এফ্রোদাইতকে আতাটি দিলেন। তার পর পরীরা চলে গেলেন।
পেরিস যখন বুঝতে পারলেন তিনি রাজার ছেলে, তখন আর তার সে জায়গা ভালো লাগলো না। পরী বালিকা ওনোনকে তিনি ভুলে গেলেন। একেবারে রাজা প্রিয়ামের কাছে। এসে পেরিস নিজের পরিচয় দিলেন। হাজার হলেও ছেলে–রাজা রানী সন্তানকে বুকে তুলে নিলেন। তার পর সুখে দিন কাটাতে লাগলো, কিন্তু একটা চিন্তা পেরিসকে কষ্ট দিতে থাকলো–কি করে তিনি সেই সুন্দরী কন্যাটিকে খুঁজে বের করবেন। একদিন পেরিস বাপের কাছে বললেন–বাপজান, নানা দেশ ও নগর দেখবার সাধ আমার হয়েছে। আমি জাহাজে চড়ে দেশ ভ্রমণে যাব। কন্যা খুঁজতে বের হওয়াই তার আসল ইচ্ছা। অবিলম্বে রাজার হুকুমে বড় বড় জাহাজ তৈরি হতে লাগলো।
জাহাজ তৈরি হলে পেরিস যাত্রা করবেন, এমন সময় তার ভাই ও বোন বাধা দিয়ে বললেন–ভাইজান, দেশ দেখা দিয়ে কাজ নেই, আমাদের মনে হচ্ছে তোমার এই যাত্রা অনেক অশুভের কারণ হবে। অতএব এই মন্দ কাজ করো না। পেরিস হেসে বললেন তোমরা পাগল!
তার পর একদিন বড় বড় জাহাজে পাল খাঁটিয়ে মহা আড়ম্বরে এজিয়ন সাগরের বুকের উপর পেরিস জাহাজ ভাসিয়ে দিলেন।
কত দ্বীপ, কত নীল জল অতিক্রম করে পেরিস স্পার্থার রাজা মেনেলাসের রাজ্যে এসে উপস্থিত হলেন। অতিথিকে অভ্যর্থনা করে বাড়িতে আনবার জন্যে রাজা মেনেলাস পত্নী ও পরিজনসহ পেরিসের জাহাজের কাছে এসে বললেন–আসুন যুবরাজ, আমাদের। বাড়িতে দুটি নুন-ভাত খাবেন। পেরিস খুব খুশি হয়ে মেনেলাসের সঙ্গে তাঁর বাড়িতে এলেন। অতিথির আদর-আপ্যায়নের জন্য মেনেলাসের প্রাসাদে দিবা-রাত্রি পান-ভোজন চলতে লাগলো। রানী হেলেন নিজ হস্তে সকলের পরিবেশন করতে লাগলেন।
পেরিস দেখলে রানী হেলেনের মতো সুন্দরী ত্রিভুবনে আর নেই। ভাবলেন, এই তো সেই কনে, যার কথা এফ্রোদাইত বলেছিলেন, কিন্তু কী করে একে হাত করা যায়? হেলেন যে আর এক জনের পত্নী।
কয়েকদিনের জন্যে মেনেলাস অতিথিকে রানীর কাছে রেখে ক্রেতা দ্বীপে একটু বেড়াতে গেলেন। ব্যস, সুযোগ পেয়ে পেরিস রানীকে বললেন–রানী, আমার সঙ্গে চল, ত্রয় নগরে তোমাকে নিয়ে যাই। বিশ্বাসঘাতক রানী বললেন–বেশ চল।
রাজার অনুপস্থিতিতে রানীকে নিয়ে পেরিস ত্রয় নগর অভিমুখে যাত্রা করলেন।