সেই যে ঈদা পাহাড়ের যুবরাজ পেরিস পরী এথেন ও হেরার কথা শুনলেন না–ফুটফুটে বৌকে পাবার লোভে তাঁর মতিভ্রম হল–এতে এথেন ও হেরার বড় রাগ হল।
এইবার হেরা ঝগড়ার ঠাকুর এরিসকে দিয়ে দ্রুত মেনেলাসের কাছে সংবাদ পাঠিয়ে দিলেন–দুষ্ট পেরিস তার বৌকে নিয়ে পালিয়েছে, শিগগির বাড়ি এসে যা হয় ব্যবস্থা করুন।
মেনেলাস এই দারুণ সংবাদ পেয়ে শোকে অস্থির হলেন। অতিথির বিশ্বাসঘাতকতা। স্মরণ করে সংসারকে নিতান্ত খারাপ স্থান বলে তাঁর মনে হতে লাগলো। অবিলম্বে বাড়ি ফিরে এসে দেখলেন–ঘর-দোর দালান-কোঠা সব খালি। পত্নী হেলেন নাই।
কি যে ব্যথা তাঁর মনকে কাঁদিয়ে তুললে তা আর বলে কী হবে? আহা, তাঁর জীবনের সঙ্গিনী কী করে তাকে ফেলে চলে গেল? মেনেলাস ভাবলেন–এ সংসারে আমার কেউ নেই। বৃথা আমার টাকা-কড়ি।
দুঃখের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মনে খুব ক্রোধ হল। দারুণ উত্তেজনায় তাঁর চোখ রক্তময় হল–শরীরের প্রত্যেক পেশী ভীষণ প্রতিশোধের জন্য গরম হয়ে উঠলো। কোথায় সেই নেমকহারাম, শয়তান পেরিস–সে যে বহু দূরে–সেই অকূল সাগরের পারে।
হোক সাগরের পারে। তাঁকে বিনাশ করে হেলেনকে ফিরিয়ে আনতে হবে। যে শয়তান তার বুকে এমনি করে আগুন জ্বেলেছে তার কলিজার রক্ত দিয়ে স্নান করতে হবে।
রাগে দুঃখে মেনেলাস যেন পাগল হয় উঠলেন। তোমরা কি মেনেলাসের মনের অবস্থাটা ঠিক বুঝতে পাচ্ছ?
কত সুখ, কত প্রেমে মেনেলাস হেলেনের সঙ্গে এতকাল বাস করেছেন! এতটুকু অবিশ্বাস তার মনে কোনোদিন আসে নি। এই কঠিন বেদনা–এই নিষ্ঠুর আঘাতই যদি স্বামীকে দেবে, তবে ওগো হেলেন, কেন মিথ্যা-প্রণয়ে মেনেলাসকে আপন করেছিলে?
মেনেলাস মহিসেন নগরে যেয়ে তাঁর ভাই এগামেমননকে সব কথা বলে জিজ্ঞাসা করলেন–এখন কী করি?
এগামেমনন ভাইয়ের দুঃখে যার পর নাই মর্মাহত হয়ে বললেন–দুষ্ট পেরিস সহজে হেলেনকে ফিরিয়ে দেবে না। এগামেমননের কাছে বীর নেস্তর ছিলেন। পেরিসের কুকাজের কথা সমস্ত শুনে বললেন–সমস্ত গ্রিসবাসীকে এই কুকাজের প্রতিশোধের জন্য লড়াই করতে হবে। এগামেমনন জিজ্ঞাসা করলেন–কেমন করে তা সম্ভব বলুন। আপনি জ্ঞানী। আপনার সুপরামর্শ ছাড়া আমরা কিছু বুঝতে পাচ্ছি না।
নেস্তর বললেন–আমাদের সকলের মুরুব্বি পালমিদাসের কাছে চলুন। তারপর গ্রিসের যে রাজপুত্র, রাজা নীরজের কাছে শপথ করেছিল তাদের কছে যাবো। মেনেলাসের এই বিপদে তাকে সাহায্য করতে তারা বাধ্য। পরী হেরা ও এথেন রাজপুত্র পেরিসের উপর খুব বিরক্ত হয়েছিলেন–তাঁরা এখন সারা গ্রিসের ভিত পরিসের বিরুদ্ধে একটা উত্তেজনা সৃষ্টি করতে লাগলেন।
গ্রিস ক্ষেপে উঠল। পেরিসের দেশ, ত্রয় নগর, পুড়িয়ে ছাই করে হেলেনকে উদ্ধার করতে হবে, এই হল তাদের প্রতিজ্ঞা। যে কথা সেই কাজ। হাজার হাজার জাহাজ সমুদ্রকূলে জমা হল। লক্ষ লক্ষ বীর যুবক যুদ্ধসজ্জায় বন্দরে এসে উপস্থিত হল।
প্রতিশোধের একটা বিরাট বিপুল আয়োজন দেখে এহগামেমননের মন গর্বে পূর্ণ হয়ে উঠলো। পেরিসের পরাজয়ের কথা চিন্তা করে তাঁর মনে গভীর আনন্দ হল।
বীরবর ওদেসিজ প্রথমে এই যাত্রায় যোগ দেন নি। বিয়ের পরই যুদ্ধে যাবার ডাক পড়ল কি না নববধূকে ছেড়ে যেতে তার মন সরছিল না। যেন পাগল হয়েছেন, এই ভান করে তিনি সমুদ্রকূলে যেয়ে লাঙ্গল চাষ আরম্ভ করলেন–কিন্তু তাঁর এই চালাকি জ্ঞানবৃদ্ধ পালমিদাস বুঝতে পারলেন। জব্দ করবার জন্য তিনি ওদেসিজের খোকা তেলিমেকাকে নিয়ে লাঙ্গলের সামনে ফেলে দিলেন, ওদেসিজ অমনি লাঙ্গল থামিয়ে ফেললেন। পাগলের কি জ্ঞান থাকে?–পালমিদাস হেসে ওদেসিজকে বললেন–দাদা, তোমার চালাকি বুঝতে পেরেছি-যুদ্ধে তোমাকে যেতেই হবে। ওদেসিজ শেষে যুদ্ধে যেতে বাধ্য হলেন। কিন্তু তাঁর মনে বড় রাগ হল। পরে এইজন্যে ওদেসিজ পালমিদাসকে খুব জব্দ করেছিল।
তোমাদের মনে আছে–রাজা পেলাস পরী-কুমারীকে বিয়ে করেছিলেন। এর নাম তিতিশা। পরে দেখবে, এই বিয়ে হতেই এই কাহিনীর সব অনর্থ শুরু হয়েছে। যাই হোক, এঁদের এক ছেলে হয়েছিল–তাকে সবাই নাম দিয়েছিলেন এচিলীস (খরগোস)। এচিলীস ভারি তুখোড় ছেলে–পরীর বাচ্চা কি না! দৌড়াতে, ঘোড়ায় চড়তে, তীর ছুঁড়তে, লেখা পড়ায় সকল দিক দিয়েই শ্রেষ্ঠ। চোহারাও অতি সুন্দর। তাই এই তামাসার নাম। এখন এচিলীসকেও যুদ্ধে যেতে হচ্ছে। ছেলে জন্মাবার পরই পণ্ডিত এনে মা তার কপাল গুনেছিলেন। তারা গুনে বলেছিলেন–এই ছেলের যশে পৃথিবী ভরে উঠবে, কিন্তু যুবক বয়সেই তাকে মৃত্যুবরণ করতে হবে। মা এই কথা শুনে মনে করে ছেলেকে কিছুতেই যুদ্ধে পাঠাতে ইচ্ছা কচ্ছিলেন না। কিন্তু দেশের লোকের কথা তো না করা যায় না। তাই তিনি গোপনে এচিলীসকে বহু দূরে–এক রাজার বাড়িতে পাঠিয়ে দিলেন।
এই রাজার কয়েকটি মেয়ে ছিল। কী করে এচিলীসকে গোপন করে রাখা যায়, এই চিন্তায় তিনি অনেকটা বিব্রত হয়ে উঠলেন। শেষে এক অভিনব কৌশল অবলম্বন করলেন। রাজার সাত মেয়ে ছিল, তিনি এচিলীসকে বালিকার পোশাক পরিয়ে তাদের সঙ্গে রাখলেন। কেউ বুঝতে পারলো না। এচিলীস মেয়ে-মানুষের পোশাকে এখানে লুকিয়ে আছে।
রাজার সেজো মেয়ে যেমন পরীর মতো খুবসুরত তেমনি সৎস্বভাব। এচিলীস তারই সঙ্গে বেশি করে মিশতেন। তার মিষ্টি কথা, তার সরল ব্যবহার এচিলীসেকে মুগ্ধ করে দিলো–তিনি তাকে বড় ভালবাসলেন। তাঁর জীবনের লক্ষ্যের কথা, দেশের কথা সব ভুলে গেলেন। একটা রঙ্গিন স্বপ্নে তাঁর দিনগুলি সুখে কেটে যেতে লাগলো।
একদিন হঠাৎ এক বিদেশী কতকগুলি পণ্যদ্রব্য এনে রাজপ্রাসাদে ঢুকলো। কত রং বেরং-এর কাপড়, কত বিচিত্র পোশাক-পরিচ্ছদ তাঁর ঝাঁকার মধ্যে স্তরে স্তরে সাজান ছিল। মেয়েরা ঘিরে সেই সব জিনিসপত্র দেখতে লাগলো।
এচিলীসও নারীবেশে মেয়েদের মাঝে দাঁড়িয়ে সেই ঝাঁকার দিকে তাকিয়েছিলেন। তিনি নারীর পোশাক পরলেও অন্তরে তাঁর পুরুষের তেজ ঘুমিয়েছিল। মেয়েরা সুদৃশ্য হার, গয়না
আর জরির পোশাক নাড়া-চাড়া করছিলেন–এচিলীস সে সব ফেলে একখানা তলোয়ার তুলে তার ধার পরীক্ষা করতে লাগলেন। ব্যস! আর যাবেন কোথায়? যাকে তোমরা সওদাগর বলে মনে করছ, ইনি হচ্ছেন গ্রিসের বড় বীর ওদেসীজ। মিথ্যা সাজে এচিলীসের খোঁজে বের হয়েছেন। ওদেসীজ এচিলীসের হাত ধরে বললেন–তোমাকে চিনেছি। এখন নারীর পোশাক রেখে তীর তলোয়ার হাতে করে বেরিয়ে পড়। সমস্ত গ্রিসের বীর যুদ্ধের জন্য রওয়ানা হচ্ছে আর তুমি এইখানে মেয়ে-মানুষের পোশাক পরে লুকিয়ে আছ?
যথা সময়ে হাজার হাজার বীর ত্রয় দেশের দিকে যাত্রা করলেন। সে কী দৃশ্য! অগণিত তীর, তলোয়ারের আস্ফালন, সহস্র মুখের মিলিত ধ্বনি। এগামেমননের মনে তা দেখে অহঙ্কার হল, তাঁর মনে হল তিনি যেন সমস্ত দুনিয়া জয় করতে পারবেন। গর্বে খোদার নামটি পর্যন্ত ভুলে গেলেন–অহঙ্কার করে আল্লাহকে উপহাস করে কথা বলতে লাগলেন।
একদিন গভীর রাত্রে সমুদ্রবক্ষে নাবিকেরা দিগৃহারা হয়ে গেল–এত করে তারা ঠিক পথে জাহাজ চালাতে চেষ্টা করলো, কিন্তু সব চেষ্টা বৃথা হল। সাত দিন সাত রাত্রি তারা কিছুই ঠিক করতে না পেরে শেষে সমুদ্রকূলের এক পাহাড়ের কাছে এসে উপস্থিত হল। সেই পাহাড়ে ভীষণ জঙ্গল ছিল। বীরগণ ভাবতে লাগলেন–কোথায় হয় নগরে যুদ্ধ করে গৌরব অর্জন করবো, তানা, কোথায় পথ ভুলে এসে উপস্থিত হলাম। এখন উপায় কী?
জাহাজ খুলে পুনরায় পথের সন্ধানে যে তারা বের হবেন সে সুবিধা হল না, কারণ উল্টো দিক থেকে এমন প্রবলভাবে বাতাস বইতে লাগলো যে, কার সাধ্য জাহাজ এক রশি চালায়। তার পর তারা একমনে আল্লাহকে ডাকতে লাগলেন।
একদিন ওদেসিজ স্বপ্ন দেখলেন–এক ব্যক্তি তাঁকে বলছেন, এগামেমননের পাপে তোমাদের সকলকে শাস্তি ভোগ করতে হচ্ছে। এগামেমনন বড় অহঙ্কারের পরিচয় দিয়েছে এবং সেই কারণে তোমাদের মাথায় এই অভিশাপ পড়েছে। জান তো, খোদা অহঙ্কার ভালবাসেন না। ওদেসিজ সেই স্বপ্নপুরুষকে জিজ্ঞাসা করলেন–তা হলে এই অভিশাপ হতে কী করে মুক্ত হই? দয়া করে বলে দিন।
সেই পুরুষ বললেন–মুক্তির পথ আছে। সে কাজ কি করতে পারবে? ওদেসিজ বললেন-পারবো, নিশ্চয় পারবো।
স্বপ্ন পুরুষ–তোমাদের মুক্তির পথ বলে দেবার জন্যেই আজ আমি এখানে এসেছি। আমার দেরি করার যো নেই। শোন, এগামেমননের কুমারী কন্যাকে যদি কোরবানি দিতে পার, তা হলেই তোমরা মুক্তি পাবে, নইলে নয়। এই কথা বলেই স্বপ্ন পুরুষ অদৃশ্য হলেন।
প্রাতঃকালে উঠে ওদেসিজ বন্ধু ও দলপতিগণকে সব বৃত্তান্ত বললেন। সকলেই স্বপ্ন পুরুষের কথা বিশ্বাস করেন। সকলে দল বেঁধে এগামেমননের কাছে যেয়ে বললেন–তোমার মেয়েকে কোরবানি দিয়ে আমাদের উদ্ধার করো। গত রাত্রে এক মহাপুরুষ স্বপ্নে ওদেসিজকে বলে গেছেন তোমার কুমারী কন্যার জীবন দানের উপর শুধু আমাদের নয়, জাতির সম্মান নির্ভর করছে।
এগামেমনন একবার মুখ তুলে দলপতির রক্তচক্ষুর পানে তাকালেন। তাঁদের মুখে কঠিন ইচ্ছার ছায়া দেখে এগামেমননের মনে ভয় হল।
এগামেমননকে চুপ করে থাকতে দেখে তাঁরা রেগে বললেন–কাপুরুষ, জাতির সম্মানের জন্য, খোদার উদ্দেশ্যের পথে কন্যার হৃদয়রক্ত দান করতে সঙ্কোচ বোধ করছো? গ্রিক জাতির মুখে কালি দিয়ে, লক্ষ নর-নারীর মাথা অপমানে নত করে তুমি তোমার কন্যাকে বাঁচাবে? এই তোমার বীর জীবনের ইচ্ছা? বল, তোমার ইচ্ছা কী? এগামেমনন মৃদু কণ্ঠে বললেন–রাজি আছি।
এগামেমননের পত্নীর কাছে লোক গেল। কন্যাকে কোরবানি করা হবে, এ কথা না বলে, লোকটি বললে–বীরবর এচিলীসের সঙ্গে আপনার মেয়ের বিয়ে হবে। আপনার স্বামী অবিলম্বে মেয়েকে নিয়ে যেতে বলেছেন। মা মহাআনন্দে মেয়েকে পাঠিয়ে দিলেন।
মেয়ে এসে দেখলেন, বিয়ের কোনো উৎসব হচ্ছে না। বাঁশির গান, ফুলের মালা কিছুই নেই। কতকগুলি রাজা ছুরি হাতে করে দাঁড়িয়ে আছে।
যথাসময়ে তাকে সব কথা বলা হল–পিতার পাপের জন্য তাঁর জীবন নেওয়া হবে। কন্যা ভীত হলেন না। তিনি নির্ভীক চিত্তে ঘাতকের ছুরির মুখে গলা এগিয়ে দিলেন। সমুদ্রের নীল পানি চতুর্দিকে থই থই করছিল। একবার মেয়ে বাপের মুখের দিকে তাকালেন–তার পর বীরবালার মতো বললেন–চালাও। ছুরি উঠাতেই কোথা থেকে একটা ঝড় এসে মেয়েকে কোথায় উড়িয়ে নিয়ে গেল। খোদা তাকে বাঁচালেন,–খোদার ইচ্ছায় যে প্রাণ দিতে যায়, খোদা তাকে রক্ষা করেন।