০৯. আলোকন

৯. আলোকন

ষোড়শ শতাব্দীর শেষ নাগাদ পাশ্চাত্য কারিগরিকরণের এক প্রক্রিয়ায় পা রাখে যা একেবারে ভিন্ন ধরনের সমাজ ও মানবতার জন্যে এক নতুন আদর্শের জন্ম দেবে। অনিবার্যভাবেই এটা ঈশ্বরের ভূমিকা ও প্রকৃতি সম্পর্কিত পাশ্চাত্যের ধ্যান-ধারণাকে প্রভাবিত করবে। সদ্য শিল্প-উন্নত ও দক্ষ পশ্চিমের সাফল্য বিশ্বের ইতিহাসের ধারাকেও বদলে দিয়েছিল । ওইকুমিনের অন্যান্য দেশ ক্রমবর্ধমান হারে পশ্চিমা জগতকে উপেক্ষা করা কঠিন বলে আবিষ্কার করেছিল, অতীতে যেমন অন্যান্য প্রধান সভ্যতার অনেক পেছনে পড়েছিল এরা, কিংবা কিছুতেই মানিয়ে নিতে পারছিল না। কারণ আর কোনও সমাজ অনুরূপ সাফল্য অর্জন করতে পারেনি, পশ্চিম একেবারে নিজস্ব সমস্যার সৃষ্টি করছিল, সে কারণে সেগুলোর মোকাবিলাও ছিল অত্যন্ত দুরূহ। যেমন অষ্টাদশ শতাব্দীর আগে পর্যন্ত আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য ও ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে ইসলামি শক্তিই ছিল প্রধান। যদিও পঞ্চদশ শতাব্দীর রেনেসাঁ পাশ্চাত্যের ক্রিশ্চান জগতকে কোনও কোনও ক্ষেত্রে ইসলামি বিশ্ব হতে অগ্রবর্তী অবস্থানে পৌঁছে দিয়েছিল । বিভিন্ন মুসলিম শক্তি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় অনায়াসে সক্ষম ছিল। অটোমানদের ইউরোপের অভ্যন্ত রে অগ্রযাত্রা অব্যাহত ছিল। মুসলিমরা তাদের পথ অনুসরণকারী পর্তুগীজ অভিযাত্রী ও বণিকদের বিরুদ্ধে নিজস্ব অবস্থান ধরে রাখতে পারছিল । যা হোক, অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে ইউরোপ বিশ্বে প্রাধান্য বিস্তার শুরু করে; এর সাফল্যের প্রকৃতিই বুঝিয়ে দিয়েছিল যে অবশিষ্ট পৃথিবীর পক্ষে ইউরোপের সঙ্গে তাল মেলানো অসম্ভব। বৃটিশরা ভারতের নিয়ন্ত্রণও করায়ও করেছিল; তারা বিশ্বের যতটা সম্ভব অধিকার করে নেওয়ার জন্য তৈরি ছিল। পাশ্চাত্যকরণ এবং এর সঙ্গেই ঈশ্বর হতে মুক্তির দাবিকারী পাশ্চাত্যের সেকুলারিজমের কাল্টের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল ।

আধুনিক কারিগরী সমাজের উপাদান বা বৈশিষ্ট্য কী ছিল? অতীতের সকল সভ্যতা কৃষির উপর নির্ভরশীল ছিল। নাম থেকেই যেমন বোঝা যায়, সভ্যতা ছিল নগরেরই সাফল্য বা অর্জন, যেখানে এক অভিজাত গোষ্ঠী কৃষকদের উৎপাদিত পণ্যের উদ্বৃত্তের ওপর নির্ভর করে জীবনযাপন করত; বিভিন্ন সংস্কৃতির জন্ম দেওয়ার মতো অবকাশ ও সম্পদ তাদের ছিল। অন্যান্য প্রধান ধর্মীয় মতাদর্শের মতো মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের একই সময়ে নগরাঞ্চলে এক ঈশ্বরের ওপর বিশ্বাসের জন্ম নেয়। অবশ্য কৃষি-নির্ভর এইসব সমাজ ছিল নাজুক প্রকৃতির। ফসল, উৎপাদন, আবহাওয়া ও ভূমি ক্ষয়ের মতো বিভিন্ন চলকের ওপর নির্ভরশীল ছিল। এক একটি সাম্রাজ্যের বিস্তার ঘটার সঙ্গে সঙ্গে এর অঙ্গীকার ও দায়িত্বসমূহেরও প্রসার ঘটায় শেষ অবধি প্রাপ্ত সম্পদ অপ্রতুল হয়ে পড়েছে। সমৃদ্ধি ও ক্ষমতার চরম শিখরে ওঠার পর অনিবার্যভাবে শুরু হয়েছে অবক্ষয় বা পতনের। নতুন পশ্চিম কিন্তু কৃষির ওপর নির্ভরশীল ছিল না। প্রযুক্তির ওপর এর নিয়ন্ত্রণ ও দক্ষতার অর্থ ছিল পশ্চিম স্থানীয় পরিস্থিতি এবং বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ সময়গত পরিবর্তনের উপর নির্ভরশীল নয়। পুঞ্জীভূত মূলধন অর্থনৈতিক সম্পদে গঠন করা ও-অতিসাম্প্রতিক কাল পর্যন্ত–অনির্দিষ্টকাল পর্যন্ত নবায়নযোগ্য মনে হয়েছে। আধুনিকীকরণ প্রক্রিয়ায় পশ্চিম বেশ কিছু গভীর পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে এগিয়েছে: এটা শিল্পায়নের দিকে চালিত করেছে। পরিণতিতে কৃষিক্ষেত্রে সূচিত হয়েছে পরিবর্তন, বুদ্ধিবৃত্তিক আলোকন ঘটেছে। রাজনৈতিক সামাজিক বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই এইসব মোটা দাগের পরিবর্তন নারী-পুরুষকে নিজেদের দেখার ধারণায় প্রভাব ফেলেছে ও ঐতিহ্যগতভাবে যে সত্তাকে তারা ঈশ্বর আখ্যায়িত করত তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক পর্যালোচনা করতে বাধ্য করেছে।

পশ্চিমা কারিগরী জ্ঞানভিত্তিক এই সমাজে বিশেষায়ন অত্যন্ত জরুরি ছিল: অর্থনৈতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে সকল আবিষ্কার বা উদ্বাবন বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষ ধরনের দক্ষতার দাবি করেছে। যেমন, বিজ্ঞানীরা যন্ত্রপাতি সরঞ্জাম প্রস্তুতকারীদের বর্ধিত কর্মদক্ষতার উপর নির্ভরশীল ছিলেন; শিল্পের জন্যে প্রয়োজন ছিল নতুন মেশিন ও শক্তির উৎসের পাশাপাশি বিজ্ঞানের তরফ থেকে পাওয়া তত্ত্বগত অবদান। বিভিন্ন ধরনের বিশেষায়ন ক্রমশঃ পরস্পর মিলিত হতে হতে একে অপরের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে: একটি অপরটিকে বিভিন্ন এবং হয়তো ইতিপূর্বে সম্পর্কহীন ক্ষেত্রে অনুপ্রাণিত করেছে। এটা ছিল এক পুঞ্জীভবন প্রক্রিয়া। একটি বিশেষ ক্ষেত্রে বিশেষায়ণের সাফল্য অন্য ক্ষেত্রে ব্যবহারের ফলে আরও ব্যাপক হয়েছে ও তা ফের এর দক্ষতার উপর প্রভাব ফেলেছে। অব্যাহত উন্নয়নের ভিত্তিতে মূলধন পদ্ধতিগতভাবে পুনঃবিনিয়োজিত হয়ে স্পষ্টতই অপ্রতিরোধ্য গতিবেগ অর্জন করে। ক্রমবর্ধমনে সংখ্যক বলয়ে বিভিন্ন স্তরের মানুষ আধুনিকীকরণ প্রক্রিয়ায় আকৃষ্ট হতে শুরু করেছিল। সভ্যতা ও সাংস্কৃতিক সাফল্য আর মুষ্টিমেয় অভিজাত শ্রেণীর অধিকারে রইল না, বরং তা কারখানা-শ্রমিক, কয়লার খনির শ্রমিক, ছাপাখানার কর্মচারী ও কেরানী শ্রেণীর ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ল, সেটা কেবল তারা শ্রমিক বলে নয় বরং ক্রমবর্ধমান বাজারের ক্রেতা হিসাবেও। শেষ পর্যন্ত দক্ষতার তীব্র প্রয়োজনকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে এই নিম্নশ্রেণীর লোকদের শিক্ষিত ও একটা মাত্রা পর্যন্ত সমাজের সম্পদের অংশীদার হওয়ার প্রয়োজন দেখা দেবে। উৎপাদনশীলতার ব্যাপক বৃদ্ধি, পুঁজির পুঞ্জীভবন, পণ্য বাজারের সম্প্রসারণ ও সেইসঙ্গে বিজ্ঞানের নতুন বুদ্ধিবৃত্তিক অগ্রগতি সামাজিক বিপ্লবের সূচনা ঘটিয়েছে। ভূ-স্বামীদের ক্ষমতা হ্রাস পায়; বুর্জোয়াদের অর্থনৈতিক বিশাল শক্তি তাদের স্থান অধিকার করে নেয়। সামাজিক সংগঠনের ক্ষেত্রে নতুন ক্ষমতার ছাপ অনুভূত হয়েছিল-যা ক্রমেই পশ্চিমকে চীন ও অটোম্যান সাম্রাজ্যের মতো বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের মানের কাছাকাছি মানে পৌঁছে দিয়েছে ও পরে তাদের ছাড়িয়ে যেতে সক্ষম করেছে। ফরাসি বিপ্লবের বছর ১৭৮৯ সাল নাগাদ সরকারি সেবা যাচাই করা হয়েছে দক্ষতা ও উপযোগিতার আলোকে। ইউরোপের বিভিন্ন সরকার আধুনিকতার ক্রমপরিবর্তনশীল অবস্থার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে নিজেদের পুনঃসংগঠিত করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে আইন-কানুন সংশোধনে ন্যস্ত হয়েছে।

প্রাচীন কৃষিনির্ভর পরিবেশে এমন কিছু কল্পনাও করা যেত না যখন আইনকে অপরিবর্তনীয় ও স্বর্গীয় মনে করা হতো। এটা ছিল প্রযুক্তিকরণের ফলে পশ্চিমে আসন্ন নয়া স্বায়ত্তশাসনের একটা লক্ষণ: নারী-পুরুষ মনে করেছে, তারাই তাদের ভাগ্য নিয়ন্তা যা আগে কখনও মনে হয়নি। আমরা দেখেছি, প্রথাগত সমাজে উদ্ভাবন ও পরিবর্তন কেমন আতঙ্কের সৃষ্টি করে, যেখানে সভ্যতাকে নাজুক অর্জন হিসাবে দেখা হয় ও অতীতের সঙ্গে ধারাবাহিকতার যে কোনও বিচ্ছেদকে প্রতিহত করা হয়েছে। কিন্তু পশ্চিমে সুচিত আধুনিক যান্ত্রিক সমাজ অব্যাহত উন্নয়ন ও প্রগতির প্রত্যাশার উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। পরিবর্তনকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়ে অনিবার্য বলে মেনে নেওয়া হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষেই লন্ডন রয়্যাল সোসায়েটির মতো প্রতিষ্ঠানগুলো প্রাচীন জ্ঞানের স্থলাভিষিক্ত করার জন্যে নতুন জ্ঞান আহরণে নিজেদের নিবেদিত করেছিল। বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞদের এই প্রক্রিয়ায় সাহায্য করার জন্যে তাদের বিভিন্ন আবিষ্কারকে একত্রিত করার উৎসাহ দেওয়া হয়েছে । নতুন নতুন আবিষ্কার গোপন রাখার বদলে নতুন বৈজ্ঞানিক প্রতিষ্ঠানসমূহ তাদের নিজস্ব ও অন্যান্য ক্ষেত্রে ভবিষ্যৎ প্রগতি হুরান্বিত করার লক্ষ্যে জ্ঞান ছড়িয়ে দিতে চেয়েছে। সুতরাং, ওইকুমিনের প্রাচীন রক্ষণশীল চেতনা অব্যাহত উন্নয়ন অনুশীলনযোগ্য এরকম বিশ্বাস ও পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা দিয়ে প্রতিস্থাপিত হয়েছে। আগের দিনে প্রবীনরা যেখানে তরুণ প্রজন্ম গোল্লায় যাচ্ছে ভেবে শঙ্কিত বোধ করেছে, সেখানে প্রবীন প্রজন্মের মাঝেও প্রত্যাশা জেগেছে যেন তাদের সন্তানরা আরও উন্নত জীবনযাপন করতে পারে। ইতিহাস পর্যালোচনা এক নতুন মিথের প্রভাবান্বিত হয়: প্রগতি। এর সাফল্য ব্যাপক, কিন্তু এখন প্রকৃতির যে ক্ষতি এতে হয়েছে তাতে করে আমরা উপলব্ধি করেছি এই জীবন পদ্ধতিও অতীতের জীবন ধারার মতো নাজুক ও সম্ভবত যেন বুঝতে শুরু করেছি, শত শত বছর ধরে মানুষকে অনুপ্রাণিতকারী অন্যান্য মিথলজির মতোই কাল্পনিক।

সম্পদ ও আবিষ্কার একীভূত করার ফলে মানুষ একদিকে ঐক্যবদ্ধ হচ্ছিল, তখন নতুন বিশেষায়ন ভিন্ন ও অনিবার্যভাবে তাদের বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। এতদিন পর্যন্ত একজন বুদ্ধিজীবীর পক্ষে বিজ্ঞানের সকল শাখা সম্পর্কেই ওয়াকিবহাল থাকা সম্ভব ছিল। উদাহরণস্বরূপ, মুসলিম ফায়লাসুফরা। পশ্চিমা দর্শন, নন্দনতত্ত্বে বেশ দক্ষ ছিল। প্রকৃতপক্ষেই, ফালসাফাহ্ এর অনুসারীদের এক সামঞ্জস্যপূর্ণ ও পূর্ণাঙ্গ সামগ্রিক বাস্তবতা সম্পর্কে জ্ঞান দিয়েছিল। সপ্তদশ শতাব্দী নাগাদ পশ্চিমা সমাজের বিশেষ বৈশিষ্ট্য পরিগণিত হয়ে ওঠা বিশেষায়ন নিজ উপস্থিতি জানান দিতে শুরু করেছিল। জ্যোতির্বিজ্ঞান, রসায়ন, জ্যামিতির অসংখ্য শাস্ত্র ক্রমশঃ স্বাধীন ও স্বায়ত্তশাসিত হয়ে উঠেছিল। শেষ পর্যন্ত আমাদের আমলে এসে কোনও এক বিষয়ে বিশেষজ্ঞের পক্ষে অন্য কোনও বিষয়ে যোগ্যতার পরিচয় রাখাটা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। এখানে বলা যায় যে, প্রত্যেক প্রধান বুদ্ধিজীবী নিজেকে প্রথার রক্ষাকারী হিসাবে না দেখে অগ্রপথিক বিবেচনা করেছেন। তিনি ছিলেন অভিযাত্রী, নাবিকদের মতো বিশ্বের নতুন নতুন অংশে প্রবেশকারী । আপন সমাজের স্বার্থে এতদিন পর্যন্ত অজানা এলাকায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন। সাফল্যের নতুন ক্ষেত্র আবিষ্কারের জন্য কল্পনার প্রয়াস নেন ও এই প্রক্রিয়ায় প্রাচীন পবিত্রতার ধারণাকে নাকচ করে তিনি পরিণত হয়েছেন সাংস্কৃতিক নায়কে। এক কালে যে প্রকৃতি মানব জাতিকে দাসত্বের শৃঙ্খলে আটকে রেখেছিল, তার নিয়ন্ত্রণ প্রবলভাবে আয়ত্তে চলে আসায় নতুন করে মানুষের আশা জেগে উঠেছিল । মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল যে, উন্নত শিক্ষা ও উন্নত আইন মানবাত্মাকে আলোকিত করে তুলতে পারে। মানুষের সহজাত ক্ষমতার ওপর এই নতুন আস্থার মানে ছিল তারা বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল যে, তার নিজস্ব প্রয়াসের সাহায্যেই সে আলোকপ্রাপ্ত হতে পারে। তাদের মনে আর এই ধারণা থাকেনি যে সত্য আবিষ্কার করার জন্যে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত প্রথা বা ঐতিহ্য, কোনও প্রতিষ্ঠান বা অভিজাত গোষ্ঠী-বা এমনকি ঈশ্বর হতে প্রাপ্ত প্রত্যাদেশের ওপর নির্ভর করতে হবে।

তা সত্ত্বেও বিশেষায়নের অভিজ্ঞতার অর্থ ছিল বিশেষায়ন প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভূক্ত মানুষ সমগ্রকে প্রত্যক্ষ করায় ক্রমবর্ধমান হারে ব্যর্থ হচ্ছিল। এরই পরিণামে উদ্ভাবনী শক্তিসম্পন্ন বিজ্ঞানী ও দার্শনিকরা ফের গোড়া থেকে জীবন ও ধর্ম সম্পর্কিত নিজস্ব তত্তব গড়ে তোলার দায়িত্ব অনুভব করেছেন। তাঁদের মনে হয়েছে বর্ধিত জ্ঞান ও দক্ষতা তাঁদের ওপর বাস্তবতা সম্পর্কে প্রচলিত ব্যাখ্যার দিকে দৃষ্টিপাত করার ও একে হালনাগাদ করার দায়িত্ব অর্পণ করেছে। নতুন বৈজ্ঞানিক চেতনা ছিল গবেষণামূলক, স্রেফ পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষার ওপর নির্ভরশীল। আমরা দেখেছি, ফালসাফাহর প্রাচীন যুক্তিবাদ এক যৌক্তিক মহাবিশ্বের অস্তিত্বের ওপর প্রাথমিক বিশ্বাসের ওপর নির্ভরশীল ছিল। পশ্চিমা বিজ্ঞানীরা এভাবে কোনও কিছু নিশ্চিত ধরে নিতে পারেননি; অগ্রগামীরা ক্রমবর্ধমানহারে ভুলের কুঁকি গ্রহণ বা বাইবেল, চার্চ ও ক্রিশ্চান প্রথাদির মতো প্রতিষ্ঠানসমূহকে আঘাত করতে ছিলেন প্রস্তুত। ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কে পুরোনো প্রমাণসমূহ’ আর পুরোপুরি সন্তোষজনক ছিল না, প্রকৃতি বিজ্ঞানী ও দার্শনিকগণ গবেষণামূলক পদ্ধতিতে প্রবল উৎসাহী থাকায় অন্যান্য বিষয় যেভাবে প্রমাণ করেছিলেন সেভাবেই ঈশ্বরের বস্তুগত সত্তা যাচাই করার দায়িত্ব বোধ করলেন।

নাস্তিক্যবাদ তখনও ঘৃণার বিষয় ছিল। আমরা দেখব, আলোকন পর্বের অধিকাংশ ফিলোসফ মোটামুটি অবচেতনে ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাসী ছিলেন। কিন্তু তারপরেও মুষ্টিমেয় কিছু ব্যক্তি মনে করতে শুরু করেছিল যে, এমনকি ঈশ্বরের অস্তিত্বও নিশ্চিত ধরে নেওয়া যায় না। সম্ভবত প্রথম যিনি এ বিষয়টি উপলব্ধি করে নাস্তিক্যবাদকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছিলেন তিনি ফরাসি পদার্থ বিজ্ঞানী, গণিতজ্ঞ ও ধর্মতাত্ত্বিক ব্লেইজ পাসকাল (১৬২৩-৬২)। অসুস্থ কিন্তু নির্ধারিত বয়সে পৌঁছার আগেই পরিণতিপ্রাপ্ত বালক হিসবে তাকে অন্যান্য শিশুদের থেকে আলাদা করে নেওয়া হয়েছিল। বিজ্ঞানী পিতা শিক্ষা দিয়েছিলেন তাঁকে, যিনি জানতে পারেন যে ১১ বছর বয়সী ব্লেইজ গোপনে ইউক্লিদের প্রথম তেইশটি প্রতিপাদ্যের সমাধান করে ফেলেছেন। ষোল বছর বয়সে জ্যামিতির উপর একটা রচনা প্রকাশিত হয় তার, বিজ্ঞানী দেকার্তে যেটাকে এত অল্প বয়সী কারও রচনা বলে বিশ্বাস করতে চাননি। পরবর্তীকালে তিনি গণনাযন্ত্র, ব্যারোমিটার ও হাইড্রোলিক প্রেসের নকশা প্রণয়ন করেছিলেন। পাকজল পরিবার তেমন ধার্মিক ছিল না, কিন্তু ১৬৪৬ সালে তারা জানসেনিজমে দীক্ষা নিয়েছিল। ব্লেইজের বোন জ্যাকুলিন দক্ষিণ-পশ্চিম প্যারিসের পোর্ট-রয়্যাল জানসেনিস্ট কনভেন্টে যোগ দিয়ে ক্যাথলিক গোষ্ঠীর তীব্র সমর্থকে পরিণত হন। ২৩ নভেম্বর, ১৬৫৪ তারিখে রাতে স্বয়ং ব্লেইজ ‘রাত সাড়ে দশটা থেকে শুরু করে মধ্যরাতের আধঘণ্টা পর পর্যন্ত স্থায়ী এক ধর্মীয় অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন, যা দেখিয়ে দিয়েছিল যে, তাঁর বিশ্বাস খুবই দূরবর্তী এবং পুঁথিগত। মৃত্যুর পর এই প্রত্যাদেশের স্মৃতিচারণ তাঁর ডাবলেটের সঙ্গে সেলাই করা অবস্থায় পাওয়া যায়:

আগুন

‘আব্রাহামের ঈশ্বর, ইসাকের ঈশ্বর, জ্যাকবের ঈশ্বর’ দার্শনিক এবং
পণ্ডিতদের ঈশ্বর নয়।
নিশ্চয়তা, নিশ্চয়তা, আন্তরিক, আনন্দ, শান্তি।
জেসাস ক্রাইস্টের ঈশ্বর
জেসাস ক্রাইস্টের ঈশ্বর
আমার ঈশ্বর ও তোমার ঈশ্বর
‘তোমার ঈশ্বরই হবেন আমার ঈশ্বর।’
জগৎ বিস্মৃত হয়েছে এবং ঈশ্বর ছাড়া সবকিছু।
একমাত্র গস্পেলে প্রদর্শিত পথেই তাকে পাওয়া যেতে পারে।’

অত্যাবশ্যকীয়ভাবে অতিন্দ্রীয় এই অভিজ্ঞতা বুঝিয়েছে যে, পাসকালের ঈশ্বর বর্তমান অধ্যায়ে আমাদের আলোচ্য অন্যান্য বিজ্ঞানী ও দার্শনিকদের ঈশ্বর হতে আলাদা ছিলেন। এই ঈশ্বর দার্শনিকদের ঈশ্বর নন; প্রত্যাদেশের ঈশ্বর ধর্মান্তরকরণের অদম্য শক্তি পাসকালকে জেসুইটদের বিরুদ্ধে তাদের চরম প্রতিপক্ষ জানসেনিস্টদের পক্ষে ঠেলে দিয়েছিল ।

ইগনেশিয়াস যেখানে গোটা বিশ্বকে ঈশ্বরময় দেখেছিলেন এবং জেসুইটদের মাঝে ঐসী সর্বব্যাপীতা ও সর্বজ্ঞতার বোধের চর্চা করার উৎসাহ জুগিয়েছিলেন, পাসকাল এবং জানসেনিস্টরা সেখানে জগতকে বিষণ্ণ ও ফাঁপা হিসাবে দেখেছেন-ঈশ্বরবিহীন মনে করেছেন। প্রত্যাদেশ সত্ত্বেও পাসকালের ঈশ্বর ‘গোপন ঈশ্বর’ রয়ে গেছেন, যৌক্তিক প্রমাণ দিয়ে যাঁকে আবিষ্কার করা যাবে না। ১৬৬৯ সালে তার মৃত্যুর পর প্রকাশিত ধর্মীয় বিষয়াদি নিয়ে পাসকালের সংকলন পেনসিস-এ মানুষের অবস্থা সম্পর্কে গভীর নৈরাশ্যবাদ প্রকাশ পেয়েছে। মানুষের নীচতা এক অব্যাহত বিষয়, স্বয়ং ক্রাইস্টও যার অপসারণের অক্ষম, যিনি পৃথিবীর ধ্বংস পর্যন্ত যন্ত্রণায় ভুগবেন। বিচ্ছিন্নতার অনুভূতি ও ঈশ্বরের ভীতিকর অনুপস্থিতি নতুন ইউরোপের আধ্যাত্মিকতার বড় ধরনের বৈশিষ্ট্য পরিণত হয়েছিল। পেনসিস-এর অব্যাহত জনপ্রিয়তা দেখায় যে, পাসকালের বিষাদময় আধ্যাত্মিকতা ও তার গোপন ঈশ্বর পশ্চিমের ধর্মীয় চেতনার গুরুত্বপূর্ণ কোনও স্থানে টোকা দিয়েছে বা আবেদন সৃষ্টি করেছে।

সুতরাং পাসকালের বৈজ্ঞানিক অর্জনগুলো তাকে মানুষের অবস্থা সম্পর্কে কোনও সান্ত্বনার বাণী শোনায়নি। বিশ্বের বিশালত্বের বিষয়টি চিন্তা করতে গিয়ে আতঙ্কে আড়ষ্ট হয়ে পড়েছেন তিনি:

আমি যখন মানুষের অন্ধ ও দোমড়ানো অবস্থা দেখি, যখন আমি মুক হয়ে গোটা বিশ্ব ও কোনও আলোক ছাড়াই একাকী পড়ে থাকা মানুষকে জরিপ করি, যেন বিশ্বজগতের এই কোণে হারিয়ে গেছে সে, কে তাকে এখানে এনেছে, কী কারণে এখানে এসেছে সে, মৃত্যুর পর তার কী পরিণতি হবে na জেনেই, কোনও কিছু জানারই ক্ষমতা নেই তার, তখন আতঙ্কে কেঁপে উঠি, যেন কোনও মানুষকে ঘুমন্ত অবস্থায় এক ভয়ঙ্কর নির্জন দ্বীপে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, তারপর সে জেগে উঠেছে উদ্ধার পাওয়ার কোনও উপায় ছাড়াই দিশাহারা অবস্থায়। তারপর আমি এই ভেবে অবাক হয়ে যাই যে এমন করুণ অবস্থায়ও মানুষ হতাশায় নিমজ্জিত হয় না।

বৈজ্ঞানিক যুগের অতি আশাবাদকে আমরা যেন সরলীকরণ না করি এটা তার এক অসাধারণ স্মারক। পরম অর্থ বা তাৎপর্যরহিত ফাঁকা মনে হওয়া বিশ্বের অস্তিত্বের আতঙ্ক পুরোপুরি ধারণ করতে পেরেছিলেন পাসকাল। মানুষকে সব সময় তাড়া করে ফেরা অচেনা কোনও জগতে জেগে ওঠার আতঙ্কের খুব কমই এমন চমৎকারভাবে প্রকাশ পেয়েছে। পাসকাল নিজের প্রতি নিষ্ঠুর রকম সৎ ছিলেন; অধিকাংশ সমসাময়িকদের বিপরীতে তিনি বিশ্বাস করতেন যে, ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করার কোনও উপায় নেই। স্বভাবজাতভাবে বিশ্বাসে অক্ষম কারও সঙ্গে তর্ক করার কথা কল্পনা করার সময় তাকে বিশ্বাস করানোর মতো যুক্তি খুঁজে পাননি তিনি। একেশ্বরবাদের ইতিহাসে এটা ছিল এক নতুন পর্যায়। এর আগে পর্যন্ত কেউই গুরুত্বের সঙ্গে ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করেনি। পাসকালই প্রথম ব্যক্তি যিনি মেনে নিয়েছিলেন যে, এই বেপরোয়া নতুন বিশ্বে ঈশ্বরে বিশ্বাস কেবল ব্যক্তিগত পছন্দের বিষয় হতে পারে। এ ক্ষেত্রে তিনিই ছিলেন প্রথম আধুনিক।

তাৎপর্যের দিক থেকে ঈশ্বরের অস্তিত্ব সংক্রান্ত পাসকালের সমস্যাটি বিপ্লবাত্মক, কিন্তু সরকারিভাবে কোনও চার্চ একে কখনও মেনে নেয়নি। সাধারণভাবে ক্রিশ্চান অ্যাপোলজিস্টরা এই অধ্যায়ের শেষে আলোচিত লেনার্দ লেসিয়াসের যৌক্তিক পদ্ধতিই পছন্দ করেছিলেন। কিন্তু এই পদ্ধতি কেবল দার্শনিকদের ঈশ্বরের দিকেই নিয়ে যেতে পারে, পাসকাল অনুভূত প্রত্যাদেশের ঈশ্বর নয়। বিশ্বাস, জোর দিয়ে বলেছেন, তিনি, ‘যৌক্তিক সম্মতি নয় বরং সাধারণ বুদ্ধির ওপর নির্ভরশীল। এটা একটা জুয়া। ঈশ্বর আছেন প্রমাণ করা অসম্ভব আবার যুক্তির কারণেই তার অস্তিত্ব অস্বীকার করাও সমানভাবে অসম্ভব: ‘তিনি (ঈশ্বর) কী বা তিনি আছেন কিনা জানার ক্ষমতা আমাদের নেই… যুক্তি এই প্রশ্নের জবাব দিতে পারে না। অসীম হট্টগোল আমাদের বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। এই অসীম দূরত্বের শেষ প্রান্তে একটা মুদ্রাকে শূন্যে। ছুঁড়ে দেওয়া হয়েছে যেটা কোনও একদিক দিয়ে নেমে আসবে। তুমি কোন দিকে বাজি ধরবে? অবশ্য এই বাজি পুরোপুরি অযৌক্তিক নয়। ঈশ্বরের পক্ষে বাজি ধরায় জয় লাভের সম্ভাবনাই বেশি। ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস স্থাপন বেছে নেওয়ায় কথা বলেছেন পাসকাল, ঝুঁকি সীমিত, কিন্তু লাভ অসীম । একজন ক্রিশ্চান বিশ্বাস নিয়ে অগ্রসর হলে এক অব্যাহত আলোকন, ঈশ্বরের উপস্থিতির সচেতনতা সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে সে, যা কিনা মুক্তির নিশ্চিত লক্ষণ। বাহ্যিক কর্তৃপক্ষের ওপর নির্ভর করা অর্থহীন; প্রত্যেক ক্রিশ্চান একা।

পাসকালের নৈরাজ্যবাদের বিরুদ্ধে পেনসিস-এ এক ক্রমবর্ধমান উপলব্ধি জেগে উঠেছে যে একবার বাজি ধরার পর গোপন ঈশ্বর তার সন্ধানকারীর কাছে নিজেকে প্রকাশ করেন। পাসকাল ঈশ্বরকে দিয়ে বলিয়েছেন, “আগেই যদি না পেতে তাহলে আমাকে খুঁজতে না তুমি।” একথা সত্যি যে, যুক্তি ও তর্ক প্রয়োগ করে বা প্রাতিষ্ঠানিক গির্জার শিক্ষা নিয়ে মানুষের পক্ষে দূরবর্তী ঈশ্বরের কাছে পৌঁছার পথ পাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু ঈশ্বরের কাছে আত্মসমর্পণের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভেতর দিয়ে বিশ্বাসীদের মনে পরিবর্তনের বোধ জাগে, ‘বিশ্বাসী, সৎ বিনয়ী, কৃতজ্ঞ, সৎ কর্মশীল এবং প্রকৃত বন্ধু হয়ে ওঠে সে। কোনওভাবে বিশ্বাস স্থাপন ও অর্থহীনতা আর হতাশার মাঝে ঈশ্বরানুভূতি গঠনের মাধ্যমে একজন ক্রিশ্চান আবিষ্কার করবে যে জীবনের অর্থ ও তাৎপর্য খুঁজে পেয়েছে। কার্যকর বলেই ঈশ্বর একটি বাস্তবতা। বিশ্বাস বুদ্ধিবৃত্তিক নিশ্চয়তা নয়, বরং অন্ধকারে ঝাঁপিয়ে পড়া ও এমন এক অভিজ্ঞতা লাভ যা নৈতিক আলোকন নিয়ে আসে।

আরেকজন নতুন মানুষ রেনে দেকার্তে (১৫৯৬-১৬৫০) ঈশ্বর আবিষ্কারে মনের ক্ষমতার ওপর আরও বেশি আস্থাবান ছিলেন। প্রকৃতপক্ষেই তিনি জোরের সঙ্গে বলেছেন যে, স্রেফ বুদ্ধিমত্তাই আমরা যে নিশ্চয়তার সন্ধান করি। তা দিতে পারে। পাসকালের বাজি ধরার ধারণা অনুমোদন করতেন না তিনি, যেহেতু এটা একেবারেই ভক্তিমূলক অভিজ্ঞতা বা অনুভূতির ওপর নির্ভরশীল ছিল; যদিও ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কিত তাঁর প্রমাণ অন্য ধরনের ভক্তির উপর নির্ভরশীল ছিল। ফরাসি প্রবন্ধকার মাইকেল মনতেইনের (১৫৩৩-৯২) সংশয়বাদের বিরোধিতা করতে উদগ্রীব ছিলেন তিনি। মনতেইন কোনও কিছুর নিশ্চয়তা বা সম্ভাব্যতা অস্বীকার করেছিলেন। গণিতবিদ ও বিশ্বাসী ক্যাথলিক দেকার্তে এ ধরনের সংশয়বাদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য নয়া গবেষণামূলক যুক্তিবাদ আনার দায়িত্ব অনুভব করেছিলেন। লেসিয়াসের মতো দেকার্তে ভেবেছিলেন, কেবল যুক্তিই মানুষকে ধর্ম ও নৈতিকতার সত্য গ্রহণে রাজি করাতে পারে যাকে তিনি সভ্যতার ভিত্তি হিসাবে দেখেছেন। বিশ্বাস আমাদের এমন কিছুই বলে না যা যৌক্তিকভাবে প্রমাণ করা যাবে নাঃ সেইন্ট পল স্বয়ং রোমানদের উদ্দেশে রচিত তার এপিল-এ ঠিক এ রকম মত প্রকাশ করেছিলেন: কারণ ঈশ্বর সম্পর্কে যা জানা সম্ভব তা মানুষের কাছে পরিষ্কার, কেননা ঈশ্বরই তা স্পষ্ট করে দিয়েছেন। বিশ্ব সৃষ্টির পর থেকেই ঈশ্বরের চিরন্তন ক্ষমতা ও অলৌকিকত্ব–যত অদৃশ্যই হোক–তার সৃষ্ট বস্তুসমূহের মনের চোখে দেখার জন্যে বিরাজ করছে। দেকার্তে আরও যুক্তি দেখিয়েছেন যে, অস্তিত্বমান অন্য যে কোনও কিছুর চেয়ে সহজ ও নিশ্চিতভাবে ঈশ্ববকে জানা সম্ভব (facilius certius)। এটা পাসকালের বাজি ধরার মতোই বিপ্লবাত্মক, যেহেতু বিশেষতঃ দেকার্তের প্রমাণ পলের উল্লেখিত বাহ্যিক জগতের সাক্ষ্য প্রত্যাখ্যান করেছে। সেইন্ট পল মনের প্রতিক্রিয়াজাত অন্তমুখী চিন্তাকে জাগাতে এই প্রমাণ টেনেছিলেন।

নিজ সর্বজনীন গণিতের প্রয়োগিক পদ্ধতি ব্যবহার করে যৌক্তিকভাবে সরল বা প্রথম নীতিমালার দিকে অগ্রসর দেকার্তে ঈশ্বরের অস্তিত্বের একই রকম বিশ্লেষণমূলক প্রমাণ দেওয়ার প্রয়াস পেয়েছিলেন, কিন্তু অ্যারিস্টটল, সেইন্ট পল ও অতীতের সকল একেশ্বরবাদী দার্শনিকদের বিপরীতে তিনি সৃষ্টিকে পুরোপুরি ঈশ্বরবিহীন আবিষ্কার করেছেন। প্রকৃতিতে কোনও পরিকল্পনা নেই। প্রকৃতপক্ষে গোটা বিশ্ব বিশৃঙ্খল, বুদ্ধিমান পরিকল্পনার কোনও চিহ্নই প্রকাশ করে না। সুতরাং, আমাদের পক্ষে প্রকৃতি হতে প্রথম নীতিমালা সম্পর্কে কোনও রকম নিশ্চয়তা বের করা অসম্ভব। সম্ভাব্যতা বা সম্ভাবনার পেছনে নষ্ট করার মতো সময় দেকার্তের ছিল নাঃ তিনি গণিত দিয়ে প্রতিষ্ঠা করা যায় এমন নিশ্চয়তার সন্ধান করতে চেয়েছিলেন। এটা সহজ ও স্বব্যাখ্যাত প্রস্তাবনায়ও পাওয়া যেতে পারে, যেমন: ‘যা হয়ে গেছে তা আর বদলানো যাবে না,’ অনস্বীকার্যভাবে সত্য। এইভাবে তিনি একটা লাকড়ির চুলোর পাশে বসে ধ্যান করার সময় সেই বিখ্যাত প্রবাদের সন্ধান পেয়েছিলেন: Cogito, crgo sum; আমি চিন্তা করি, তাই আমি আছি। প্রায় বার শতাব্দী আগের অগাস্তিনের মতো মানবীয় চেতনায় ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রমাণ পেয়েছেন দেকার্তে; এমনকি সন্দেহও সন্দেহকারীর অস্তিত্ব প্রমাণ করে! বাহ্যিক জগতের কোনও কিছু সম্পর্কে আমরা নিশ্চিত হতে পারি না, কিন্তু আমাদের অন্তরের অনুভূতি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যেতে পারে। দেকার্তের যুক্তি আনসেল্ম-এর অন্টোলজিক্যাল প্রমাণেরই পুনরাবৃত্তিতে পরিণত হয়। আমরা যখন সন্দেহ করি, তখন অহমের সীমাবদ্ধতা ও প্রকৃতি প্রকাশিত হয়। তা সত্ত্বেও সম্পূর্ণতা সম্পর্কে আমাদের পূর্ব ধারণা না থাকলে আমরা ‘অসম্পূর্ণতা’র ধারণায় পৌঁছতে পারি না। আনসেন্মের মতো দেকার্তেও উপসংহারে পৌঁছেছিলেন যে, অস্তিত্বহীন সম্পূর্ণতার এক পর্যায়ে স্ববিরোধীতে পরিণত হবে। সুতরাং, আমাদের সন্দেহের অনুভূতি আমাদের বলে যে এক পরম ও সম্পূর্ণ সত্তা-ঈশ্বর-থাকতে বাধ্য।

ঈশ্বরের অস্তিত্বের এই প্রমাণ থেকে দেকার্তে ঈশ্বরের রূপ বা প্রকৃতি সম্পর্কে সত্য উদ্ধারে অগ্রসর হয়েছেন, ঠিক যেভাবে গাণিতিক প্রমাণ তুলে ধরেছিলেন। তাঁর ডিসকোর্স অন মেথড-এ তিনি যেমন বলেছেন, অন্তত এটা নিশ্চিত যে সম্পূর্ণ সত্তা, জ্যামিতির যে কোনও সম্ভাব্য উপস্থাপনের মতোই। আছেন। ইউক্লিদিয় ত্রিভূজের তিন কোণের সমষ্টি যেমন দুই সমকোণের সমান হতে বাধ্য, ঠিক তেমনি দেকার্তের সম্পূর্ণ সত্তার নির্দিষ্ট কিছু গুণাবলী থাকতে বাধ্য। আমাদের অভিজ্ঞতা বলে, আমাদের এই বিশ্বের একটা বস্তুগত বাস্তবতা ও একজন সম্পূর্ণ ঈশ্বর রয়েছেন, যিনি অবশ্যই সত্যময় এবং আমাদের প্রতারিত করবেন না। ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণে জগতকে ব্যবহার করার বদলে দেকার্তে বিশ্বের বাস্তবতায় বিশ্বাস অর্জনের জন্যে ঈশ্বরের ধারণাকে ব্যবহার করেছেন। দেকার্তে তার নিজস্ব পদ্ধতিতে পাসকালের মতো একই মাত্রায় জগৎ হতে বিচ্ছিন্নতা অনুভব করেছিলেন । পৃথিবীর দিকে হাত বাড়ানোর বদলে তার মন অন্তরমূখী হয়েছে। যদিও ঈশ্বরের ধারণা মানুষকে তার আপন অস্তিত্ব সম্পর্কে নিশ্চয়তা দেয় ও তা দেকার্তের জ্ঞানতত্ত্বের জন্যে অত্যাবশ্যক ছিল কিন্তু কার্টেসিয়ান পদ্ধতি এক বিচ্ছিন্নতা ও স্বায়ত্তশাসনের ইমেজ তুলে ধরে আমাদের শতকে যা মানুষের পাশ্চাত্য ভাবমূর্তির কেন্দ্রীয় বিষয়ে পরিণত হয়েছে। জগৎ হতে বিচ্ছিন্নতা ও এক গর্বিত সম্পূর্ণতা বহু নারী-পুরুষকে নির্ভরশীল করে তোলা ঈশ্বরের সামগ্রিক ধারণাটিকেই প্রত্যাখ্যানে প্ররোচিত করবে।

একেবারে সূচনা থেকেই ধর্ম মানুষকে পৃথিবীর সঙ্গে সংযোগ স্থাপন ও এর মাঝে শেকড় বিস্তারে সাহায্য করে এসেছে। পবিত্র স্থানের কাল্ট জগৎ সম্পর্ক সকল ভাবনার পূর্ববর্তী ছিল এবং নারী-পুরুষকে এক ভীতিকর বিশ্বে একটা লক্ষ্য খুঁজে পেতে সাহায্য করেছে। প্রাকৃতিক শক্তিসমূহের ওপর দেবত্ব আরোপ বিস্ময় ও ভয়ের প্রকাশ হিসাবে কাজ করেছে যা জগতের প্রতি মানুষের সাড়া প্রদানের অংশ ছিল। এমনকি অগাস্তিনও বেদনাময় আধ্যাত্মিকতা সত্ত্বেও পৃথিবীকে বিস্ময়কর সৌন্দর্যে ভরপুর আবিষ্কার করেছিলেন। দেকার্তে, যার দর্শন অগাস্তিনের অন্তর্মুখী ট্র্যাডিশনের ওপর প্রতিষ্ঠিত, বিস্ময় প্রকাশের অবকাশ ছিল না তাঁর; যে কোনও মূল্যে রহস্যময়তার অনুভূতি এড়িয়ে যেতে হবে, কারণ তা সভ্য মানুষ অতিক্রম করে এসেছে। তাঁর লেস মেতিওরেস নিবন্ধের সূচনায় তিনি ব্যাখ্যা করেছেন, ‘আমাদের সমপর্যায়ের বা নিম্নস্তরের বস্তুর চেয়ে উচ্চ পর্যায়ের জিনিসের প্রতি বেশি শ্রদ্ধা থাকাটা আমাদের পক্ষে স্বাভাবিক। সুতরাং কবি ও শিল্পীগণ মেঘমালাকে ঈশ্বরের আসন হিসাবে তুলে ধরেছেন, কল্পনা করেছেন ঈশ্বর মেঘের ওপর শিশির কণা ঝরাচ্ছেন বা নিজ হাতে পাথরের ওপর বিদ্যুৎ নিক্ষেপ করেছেন;

এটা আমার মনে এই আশার সৃষ্টি করেছে যে, আমি যদি এমনভাবে মেঘের প্রকৃতি বর্ণনা করি যেখানে আমাদের ও এগুলোর মাঝে দেখা কোনও কিছুর বা ওগুলো থেকে নেমে আসা কোনও কিছুর প্রতি বিস্ময়ের দৃষ্টিতে তাকানোর অবকাশ থাকবে না, তাহলে আমরা সহজেই বিশ্বাস করব যে, একইভাবে পৃথিবীর ওপর সবচেয়ে শ্রদ্ধেয় সবকিছুর মূল কারণ একইভাবে আবিষ্কার করা সম্ভব।

মেঘ, বাতাস, কুয়াশা ও বিদ্যুৎকে তুচ্ছ ঘটনা হিসাবে ব্যাখ্যা করেছেন দেকার্তে, ‘বিস্ময়ের যে কোনও কারণ’ অপসারণ করার জন্যে ব্যাখ্যা করেছেন তিনি। অবশ্য দেকার্তের ঈশ্বর ছিলেন দার্শনিকদের ঈশ্বর যিনি পার্থিব ঘটনাপ্রবাহের কোনও আম দেননি। ঐশীগ্রন্থে বর্ণিত অলৌকিক ঘটনাবলীর মাঝে নয় বরং তাঁর প্রতিষ্ঠিত চিরন্তন বিধির মাঝেই নিজেকে প্রকাশ করেন তিনিঃ লেস মোতিওরেস-এ প্রাচীন ইসরায়েলিরা মরুভূমিতে যে মান্না গেয়েছিল তাকে এক ধরনের শিশির বলেও বর্ণনা করেছেন দেকার্তে। এভাবেই জন্ম হয়েছিল বিভিন্ন অলৌকিক ঘটনা ও মিথের যৌক্তিক ব্যাখ্যা খুঁজে বার করার ভেতর দিয়ে বাইবেলের ‘সত্যতা প্রমাণ করার অসম্ভব ধরনের অ্যাপোলজেটিক্সের। উদাহরণ স্বরূপ, জেসাসের পাঁচ হাজার মানুষকে খাওয়ানোর ঘটনাটিকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে উপস্থিত জনতাকে গোপনে খাবার নিয়ে আনায় জেসাসের ভৎর্সনা করে সবার সঙ্গে ভাগ করে খাবার নির্দেশ হিসাবে। এর পেছনের উদ্দেশ্য মহৎ ছিল সন্দেহ নেই, কিন্তু এখানে বাইবেলিয় বিবরণের মূল সূর-প্রতীকধর্মীতা-ক্ষুণ্ণ হয়েছে।

দেকার্তেই সব সময় রোমান ক্যাথলিক চার্চের বিধি-বিধান মানার ব্যাপারে সতর্ক ছিলেন। নিজেকে অর্থডক্স ক্রিশ্চান ভাবতেন তিনি। বিশ্বাস ও যুক্তির মাঝে কোনও বিরোধ দেখেননি। তিনি তার নিবন্ধ ডিসকোর্স অন মেথড-এ যুক্তি দেখিয়েছেন যে, এমন একটা পদ্ধতি আছে যা মানবজাতিকে সকল সত্য খুঁজে পেতে সক্ষম করে তুলবে। কোনও কিছুই এর নাগালের বাইরে নয়। সে জন্যে যা প্রয়োজন-যে কোনও শাস্ত্রের ক্ষেত্রেই-সেই পদ্ধতি ব্যবহার করলেই জ্ঞানের একটি নির্ভরযোগ্য রূপ গড়ে তোলা সম্ভব হবে যার ফলে সকল বিভ্রান্তি ও অজ্ঞতা দূর হয়ে যাবে । রহস্যময়তা তালগোলে পরিণত হয়েছিল, এবং যে ঈশ্বরকে পূর্ববর্তী যুক্তিবাদীরা অন্য ঘটনাবলী হতে আলাদা হিসাবে দেখার ব্যাপারে যত্নবান ছিল সেগুলোকেই এবার মানবীয় চিন্তাশক্তির অধীনে নিয়ে আসা হয়েছে। সংস্কারের গোঁড়ামিপূর্ণ আলোড়ন সৃষ্টির আগে ইউরোপে রহস্যময়তা শেকড় গেড়ে ওঠার অবসর পায়নি। ফলে রহস্য ও মিথলজির ওপর নির্ভর করে টিকে থাকা আধ্যাত্মিকতা, নামেই বোঝা যায় এর সঙ্গে রহস্য ও মিথলজি গভীর সম্পর্ক রয়েছে, পশ্চিমের বহু ক্রিশ্চানের কাছে অচেনা ছিল। এমনকি দেকার্তে চার্চের অতিন্দ্রীয়বীর সংখ্যা ছিল বিরল, তাদের সন্দেহের চোখে দেখা হতো। ধর্মীয় অভিজ্ঞতার ওপর অস্তিত্ব নির্ভরশীল অতিন্দ্রীয়বাদীদের ঈশ্বর দেকার্তের মতো ব্যক্তির কাছে একেবারেই অচেনা ছিলেন, যার কাছে ধ্যানের অর্থ ছিল পুরোপুরি বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকাণ্ড।

ঈশ্বরকে নিজস্ব যান্ত্রিক ব্যবস্থায় সীমিতকারী ইংরেজ পদার্থ বিজ্ঞানী ইসাক নিউটন (১৬৪২-১৭২৭) একইভাবে ক্রিস্টান ধর্মকে রহস্যময়তা হতে মুক্ত করতে উদগ্রীব ছিলেন। গণিত নয়, তার সূচনা বিন্দু ছিল মেকানিক্স, কেননা জ্যামিতিতে দক্ষতা অর্জনের আগে একজন বিজ্ঞানীকে নিখুঁতভাবে বৃত্ত আঁকা শিখতে হয়। দেকার্তে যেখানে সত্তা, ঈশ্বর, এই প্রাকৃতিক জগতের অস্তিত্ব, এই ক্রমানুসারেই প্রমাণ করেছিলেন, সেখানে নিউটন শুরু করেছিলেন ভৌত জগৎ ব্যাখ্যার প্রয়াস দিয়ে যেখানে ঈশ্বর এক অত্যাবশ্যকীয় অংশ। নিউটনের পদার্থ বিজ্ঞানে প্রকৃতি সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয়, ঈশ্বরই ছিলেন সকল ক্রিয়াকর্মের একক উৎস। এভাবে অ্যারিস্টটলের মতবাদের মতো ঈশ্বর ভৌত নিয়মনীতির ধারাবাহিকতা মাত্র। নিউটন তাঁর বিখ্যাত রচনা ফিলোসফিয়া নেচারালিস প্রিন্সিপিয়া (দ্য প্রিন্সিপলস্ অভ ন্যাচারাল ফিলোসফি) (১৬৮৭)য় গাণিতিক পরিভাষায় এমনভাবে বিভিন্ন মহাজাগতিক ও পার্থিব বস্তুর সম্পর্ক বর্ণনা করার প্রয়াস পেয়েছেন যাতে একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ ও পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থা গঠন করা যায়। নিউটন আবিস্কৃত মহাকর্ষ বলের ধারণা তার ব্যবস্থার বিভিন্ন অংশ বা উপাদানকে একত্রিত করেছে। মহাকর্ষ বলের ধারণায় কোনও কোনও বিজ্ঞানী রুষ্ট হয়েছিলেন, নিউটনের বিরুদ্ধে অ্যারিস্টটলের বস্তুর আকর্ষণী ক্ষমতার ধারণায়। ফিরে যাবার অভিযোগ তুলেছিলেন তাঁরা। এমন দৃষ্টিভঙ্গি ঈশ্বরের সার্বভৌমত্ব সম্পর্কিত প্রটেস্ট্যান্ট ধারণার সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ ছিল। নিউটন এ অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেন: এক সার্বভৌম ঈশ্বরই ছিলেন তার ব্যবস্থার মূল, কেননা এমন একজন স্বর্গীয় মেকানিকের অস্তিত্ব ছাড়া এর অস্তিত্বই থাকত না।

মহাবিশ্ব নিয়ে চিন্তা করার সময় পাসকাল ও দেকার্তের বিপরীতে নিউটন নিশ্চিত ছিলেন যে, তাঁর কাছে ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রমাণ রয়েছে। মহাজাগতিক বস্তুগুলো পারস্পরিক মহাকর্ষ বলের টানে এক বিশাল গোলাকৃতি বস্তুপিণ্ডে পরিণত হয়নি কেন? কারণ এ ব্যাপারটি ঠেকাতেই এগুলোকে অসীম মহাশূন্যে যথেষ্ট বা পর্যাপ্ত দূরত্ব বজায় রেখে সযত্নে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তিনি তাঁর বন্ধু সেইন্ট পল-এর ডিন রিচার্ড বেন্টলির কাছে যেমন ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন, একজন স্বর্গীয় তত্ত্বাবধায়ক’ ছাড়া এটা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াত: ‘আমার মনে হয় না কেবল প্রাকৃতিক শক্তি দিয়ে এর ব্যাখ্যা করা সম্ভব, বরং আমি এর জন্যে একে স্বেচ্ছাপ্রণোদিত এজেন্টের পরামর্শ ও হস্তক্ষেপ স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছি। একমাস পর, বেন্টলিকে আবার লিখেছিলেন তিনিঃ ‘অভিকর্ষ গ্রহগুলোকে চলমান করে থাকতে পারে, কিন্তু একটি ঐশী ক্ষমতা ছাড়া ওগুলো যেভাবে সূর্যের চরদিকে ঘুরছে তেমন ঘূর্ণন অর্জন সম্ভব ছিল না, সুতরাং এ কারণে এবং অন্যান্য যুক্তি দিয়েও আমি এই ব্যবস্থা’র জন্যে একজন বুদ্ধিমান এজেন্টের উপস্থিতি মানতে বাধ্য হচ্ছি। উদাহরণস্বরূপ, পৃথিবী নিজের অক্ষের ওপর ঘণ্টায় এক হাজার মাইলের বদলে মাত্র একশ মাইল বেগে ঘুরলে রাতের দৈর্ঘ্য হতো দশগুণ বেশি আর পৃথিবী এত ঠাণ্ডা থাকত যার ফলে প্রাণের অস্তিত্ব সম্ভব হতো নাঃ দীর্ঘ দিনের সময় প্রচণ্ড উত্তাপ সমস্ত খেতখামার পুড়িয়ে দিত। যে সত্তাটি সবকিছু এত নিখুঁতভাবে পরিকল্পনা করেছেন তিনি মহাবুদ্ধিধর একজন মেকানিক হতে বাধ্য। বুদ্ধিমান হওয়া ছাড়াও এই এজেন্টকে এই বিশাল বস্তুসমূহকে সামাল দিতে যথেষ্ট শক্তিমান হতে হয়েছে। নিউটন উপসংহার টেনেছেন: এই অসীম ও জটিল ব্যবস্থাকে গতি দানকারী আদিম শক্তি ছিল দোমিনেশিও যা বিশ্বজগৎ সৃষ্টির জন্যে দায়ী, যা ঈশ্বরকে স্বর্গীয় করেছে। অক্সফোর্ডের আরবী ভাষার প্রথম অধ্যাপক এডওয়ার্ড পোকক নিউটনকে জানিয়েছিলেন যে লাতিন শব্দ ডিউস আরবী দু-প্রভু-শব্দ হতে নেওয়া হয়েছে। সুতরাং ডেমিনিয়ন হচ্ছে ঈশ্বরের অত্যাবশ্যকীয় গুণ, সম্পূর্ণতা নয়, যা দেকার্তের ঈশ্বর আলোচনার সূচনা বিন্দু ছিল । প্রিন্সিপিয়ার উপসংহার ‘জেনারেল শালিয়ামে’ নিউটন ঈশ্বরের প্রচলিত গুণাবলীকে তাঁর বুদ্ধিমত্তা ও ক্ষমতা হতে উদ্ধার করেছেন:

সূর্য, গ্রহ ও ধূমকেতুসমূহের এই সুন্দরতম ব্যবস্থা কেবল এক বুদ্ধিমান ও শক্তিশালী সত্তার নির্দেশ ও কর্তৃত্ব হতেই সৃষ্টি হতে পারে…তিনি অনন্ত ও অসীম, সর্বশক্তিমান ও সর্বজ্ঞ; অর্থাৎ তার স্থায়িত্ব অনাদি হতে অনন্তকাল পর্যন্ত; তার অস্তিত্ব অসীম হতে অসীমে, তিনি সকল বস্তুকে নিয়ন্ত্রণ করেন, যা কিছু আছে বা থাকতে পারে তার সবই জানেন…আমরা কেবল তাঁর প্রাজ্ঞ ও অনন্য পরিকল্পনা ও চূড়ান্ত কারণ দ্বারাই তাঁকে জানি; আমরা তাঁকে তাঁর সম্পূর্ণতার জন্যে শ্রদ্ধা করি, কিন্তু আমরা তাঁকে তাঁর কর্তৃত্বের জন্যে সম্মান ও মান্য করি: কারণ আমরা তাঁর দাস হিসাবে তাঁকে মান্য করি এবং কর্তৃত্ব, দূরদর্শিতা ও চূড়ান্ত কারণ বিহীন একজন ঈশ্বর নিয়তি ও প্রকৃতি ছাড়া আর কিছুই নন। অন্ধ মেটাফিজিক্যাল প্রয়োজন, যা অবশ্যই সর্বত্র ও সবসময় এক রকম, বস্তুর মাঝে বৈচিত্র্য সৃষ্টি করতে পারে না। প্রাকৃতির বস্তুসমূহে আমরা যে বৈচিত্র প্রত্যক্ষ করি, যা বিভিন্ন কালে ও স্থানের সঙ্গে মানানসই তা কেবল অত্যাবশ্যকীয়ভাবে অস্তিতৃমান সত্তার ধারণা আর ইচ্ছা হতেই সৃষ্টি হতে পারে।

নিউটন বাইবেলের উল্লেখ করেননিঃ আমরা কেবল জগৎ সম্পর্কে ধ্যানের মাধ্যমেই ঈশ্বরকে জানতে পারি। এতদিন পর্যন্ত সৃষ্টি সংক্রান্ত মতবাদ এক আধ্যাত্মিক সত্য প্রকাশ করে এসেছিল: ইহুদিবাদ ও খৃস্টধর্ম উভয়েই দেরিতে সংযুক্ত হয়েছে এটা এবং বরাবরই কিছুটা সমস্যাসঙ্কুল ছিল। নতুন বিজ্ঞান এবার সৃষ্টিকে মঞ্চের কেন্দ্রে নিয়ে এল এবং ঈশ্বর সংক্রান্ত ধারণার ক্ষেত্রে মতবাদের আক্ষরিক ও যান্ত্রিক উপলব্ধিকে মূল বিষয়ে পরিণত করল । আজকের দিনে মানুষ ঈশ্বরের অস্তিত্ব অস্বীকার করার সময় প্রায়শঃই নিউটনের বিশ্ব জগতের স্রষ্টা এবং প্রতিপালক ঈশ্বরকেই প্রত্যাখ্যান করে থাকে। বিজ্ঞানীরা এই ঈশ্বরকে আর মেনে নিতে পারছেন না।

নিজের ব্যবস্থায় ঈশ্বরকে স্থান দেওয়ার জন্যে স্বয়ং নিউটন কিছু বিস্ময়কর সমাধানের আশ্রয় নিয়েছিলেন, তার ব্যবস্থাটি প্রকৃতির কারণেই স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার প্রয়োজন ছিল। মহাশূন্য অপরিবর্তনীয় ও অসীম হলে-তার ব্যবস্থার দুটো প্রধান বৈশিষ্ট্য-সেখানে ঈশ্বরের স্থান কোথায়? মহাশূন্যই এক অর্থে স্বর্গীয় নয়, যেহেতু এর অনন্ত ও অসীমতার গুণ আছে? এটা কী তবে দ্বিতীয় স্বর্গীয় সত্তা, সময়ের সূচনা কাল হতেই যা ঈশ্বরের সঙ্গে বিরাজমান ছিল? এই সমস্যা সম্পর্কে আগাগোড়া সচেতন ছিলেন নিউটন। প্রথমদিকের রচনা দে গ্রাভিতেশনে এত্ অ্যাকিউপন্দিও ফ্লুইদোরাম-এ তিনি উৎসারণের প্লেটোনিক তত্ত্বে ফিরে গিয়েছিলেন। ঈশ্বর যেহেতু অসীম, নিশ্চয়ই তিনি সর্বত্র বিরাজমান। মহাশূন্য ঈশ্বরের অস্তিত্বের ফল, ঐশী সর্বব্যাপীতা হতে চিরন্তনভাবে উৎসারিত হচ্ছে। তাঁর ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ হিসাবে এর সৃষ্টি হয়নি, বরং তাঁর সর্বব্যাপী সত্তার অনিবার্য পরিণতি বা বিস্তার হিসাবে এটা অস্তিত্বমান ছিল। একইভাবে, স্বয়ং ঈশ্বর সময় ও স্থান গঠন করেছেন যার মাঝে আমরা বাঁচি, চলাফেরা করি, অস্তিত্ব লাভ করি। অন্যদিকে সৃষ্টির প্রথম দিনে স্বতঃপ্রণোদিতভাবে ঈশ্বর কর্তৃক বস্তুর সৃষ্টি। কেউ চাইলে, একথা বলতে পারে যে, তিনি মহাশূন্যের কোনও কোনও স্থানকে আকার, ঘনত্ব, স্পর্শবোধ ও সহিষ্ণুতা দিয়ে গুণান্বিত করেছেন। শূন্য হতে সৃষ্টির খৃস্টীয় মতবাদের পাশে দাঁড়ানো সম্ভব, কেননা ঈশ্বর মহাশূন্য হতে বস্তগত বিষয়সমূহকে অস্তিত্ব দিয়েছেন: শূন্য হতেই বস্তু উৎপাদন করেছেন তিনি।

দেকার্তের মতো নিউটনেরও রহস্যময়তার প্রতি দুর্বলতা ছিল না, একে তিনি অজ্ঞতা ও কুসংস্কারের সমতুল্য বলেছেন। খৃস্টধর্মকে অলৌকিকতা থেকে মুক্ত করতে উদগ্রীব ছিলেন তিনি, তাতে খৃস্টীয় ঐশ্বরিকতার মতো গুরুত্বপূর্ণ মতবাদসমূহের সঙ্গে বিরোধ সৃষ্টি হলেও। ১৬৭০ দশকে তিনি গুরুত্বের সঙ্গে ট্রিনিটির মতবাদ নিয়ে ধর্মতত্ত্বীয় গবেষণা শুরু করেছিলেন। তিনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, আথানাসিয়াস প্যাগান ধর্মান্তরিতদের আকৃষ্ট করার জন্যে এটাকে চার্চের ওপর আরোপ করেছিলেন। আরিয়াসই সঠিক ছিলেন: জেসাস ক্রাইস্ট অবশ্যই ঈশ্বর ছিলেন না; ওল্ড টেস্টামেন্টের সেসব অনুচ্ছেদ ট্রিনিট্রির মতবাদ ও অবতারের ধারণা প্রমাণের জন্যে ব্যবহৃত হয়েছিল সেগুলো সঠিক নয়। আথানাসিয়াস ও তাঁর সহকর্মীরা এগুলো বানিয়ে ঐশীগ্রন্থে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন এবং এভাবে সাধারণ মানুষের। মূল, আদিম কল্পনায় আবেদন সৃষ্টি করেছিলেন: মানুষের মনের উত্তপ্ত ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন অংশটি ধর্মীয় ব্যাপারে রহস্যময়তার প্রতি চিরদিনই দুর্বল; এ কারণে তারা যা সবচেয়ে কম বোঝে সেটাই বেশি পছন্দ করে। খৃস্টধর্ম থেকে এই বিভ্রান্তি দূর করা নিউটনের এক বিকারে পরিণত হয়েছিল। ১৬৮০ দশকের গোড়ার দিকে প্রিন্সিপিয়া প্রকাশের অল্পদিন আগে একটা প্রবন্ধের কাজ শুরু করেছিলেন নিউটন, তিনি যেটার নাম দিয়েছিলেন, দ্য ফিলোসফিক্যাল অরিজিন্স অভ জেন্টাইল থিওলজি। এখানে তিনি যুক্তি দেখিয়েছেন, নোয়াহ আদিম ধর্ম-এক জেন্টাইল ধর্মতত্ত্ব-প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যা কুসংস্কারমুক্ত ছিল এবং এক একক ঈশ্বরের যৌক্তিক প্রার্থনার পক্ষে কথা বলেছেন। একমাত্র নির্দেশনা ছিল ঈশ্বরের ভালোবাসা ও প্রতিবেশীর প্রতি ভালোবাসা। মানুষের প্রতি ঈশ্বরের একমাত্র মন্দির প্রকৃতি নিয়ে ভাবার নির্দেশ ছিল। পরবর্তী প্রজন্মগুলো এই অবিমিশ্র ধর্মটিকে অলৌকিক আজগুবি গল্প দিয়ে দুষিত করেছে। কেউ কেউ আবার বহুঈশ্বরবাদীতা ও কুসংস্কারের দিকে প্রত্যাবর্তন করেছে। তা সত্ত্বেও ঈশ্বর বারবার মানুষকে আবার সঠিক পথে পরিচালনা করার জন্য পয়গম্বরদের প্রেরণ করেছেন। পিথাগোরাস এই ধর্ম সম্পর্কে জানতে পেরে তা পশ্চিমে নিয়ে আসেন। মানুষকে সত্য পথে ফিরিয়ে আনার জন্যে প্রেরিত পয়গম্বরদের একজন ছিলেন জেসাস, কিন্তু তাঁর খাঁটি ধর্ম আথানাসিয়াস ও তাঁর সহচররা দূষিত করেছেন। বুক অভ রিভেলেশনে ত্রিত্ববাদের উত্থানের ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে-’তোমাদের পশ্চিমের অদ্ভুত এই ধর্ম,’ ‘তিনজন সমান ঈশ্বরের কাল্ট’-ধ্বংসের বিভীষিকা হিসাবে।[১৫]

পশ্চিমে ক্রিশ্চানরা ট্রিনিটির মতবাদ বরাবরই জটিল বলে আবিষ্কার করেছে। তাদের নতুন যুক্তিবাদ আলোকন পর্বের দার্শনিক ও বিজ্ঞানীদের এটা পরিত্যাগে উদগ্রীব করে তোলে। ধর্মীয় জীবনে রহস্যময়তার ভূমিকা নিউটনের বোধের অতীত ছিল। গ্রিকরা ট্রিনিটিকে মনকে বিস্ময়াভিভূত করে রাখতে এবং মানুষের বুদ্ধি দিয়ে ঈশ্বরের প্রকৃতি উপলব্ধি করা কখনও সম্ভব নয়, একথা মনে করিয়ে দিতে ব্যবহার করেছিল। নিউটনের মতো বৈজ্ঞানিকের পক্ষে অবশ্য এই ধরনের মনোভাব পোষণ করা খুবই কঠিন ছিল। বিজ্ঞানের সুবাদে মানুষ শিখছিল যে, সত্য জানার জন্যে তাদেরকে একেবারে গোড়া থেকে শুরু করার জন্যে অতীতকে বাতিল করতে তৈরি থাকতে হবে। অবশ্য শিল্পকলার মতো ধর্মের ক্ষেত্রেও বর্তমানকে দেখার একটা দৃষ্টিকোণ পাওয়ার জন্যে অতীতের সঙ্গে সংলাপ সংশ্লিষ্ট । ঐতিহ্য বা প্রথা নারী-পুরুষকে একটা সূচনা বিন্দু হতে অগ্রসর হতে সক্ষম করে তোলে যার ফলে সে জীবনের চূড়ান্ত অর্থ সম্পর্কে চিরন্তন। জিজ্ঞাসা নিয়ে ভাবতে পারে। সুতরাং, ধর্ম ও শিল্পকলা বিজ্ঞানের মতো কাজ করে না। অবশ্য, অষ্টাদশ শতাব্দীতে ক্রিশ্চানরা খৃস্টধর্ম বিশ্বাসের ক্ষেত্রে নতুন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রয়োগ শুরু করে নিউটনের মতো একই সমাধানে পৌঁছে। ইংল্যান্ডের ম্যাথু টিল্ডাল ও জন টোল্যান্ডের মতো চরমপন্থী ধর্মতাত্ত্বিকগণ ফের। মূলে ফিরে যাবার জন্য ব্যাকুল ছিলেন, খৃস্টধর্মকে রহস্যমুক্ত করে সত্য ধর্ম প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন তাঁরা। ক্রিশ্চানিটি নট মিস্ট্রিয়াস (১৬৯৬)-এ টোল্যান্ড যুক্তি দেখিয়েছেন যে, রহস্য কেবল ‘স্বেচ্ছাচারিতা ও কুসংস্কারের দিকে চালিত করে। ঈশ্বর নিজেকে স্পষ্টভাবে প্রকাশে অক্ষম চিন্তা করা হবে আক্রমণাত্মক। ধর্মকে অবশ্যই যৌক্তিক হতে হবে। ক্রিশ্চানিটি অ্যাজ ওল্ড অ্যাজ ক্রিয়েশন (১৭৩০)-এ নিউটনের মতো আদি ধর্ম সৃষ্টি ও পরবর্তীকালের সংযোজনসমূহ বাদ দেওয়ার প্রয়াস পেয়েছিলেন টিল্ডাল। যৌক্তিকতাই ছিল। সকল সত্য ধর্মের কষ্টিপাথর: ‘সৃষ্টির আদি থেকেই আমাদের সবার হৃদয়ে। প্রকৃতি ও যুক্তির একটা ধর্ম হয়ে আছে যার মাধ্যমে মানুষকে অবশ্যই। প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মকে বিচার করে দেখতে হবে। পরিণাম হিসাবে প্রত্যাদেশ অপ্রয়োজনীয়, কেননা আমাদের নিজস্ব যৌক্তিক অনুসন্ধানের মাধ্যমে সত্য জানা। সম্ভব; ট্রিনিটি ও অবতারবাদের মতো রহস্যগুলোর নিখুঁত যৌক্তিক ব্যাখ্যা আছে; এগুলোকে সাধারণ বিশ্বাসীদের কুসংস্কার ও প্রাতিষ্ঠানিক গীর্জার দাস করে রাখার জন্যে ব্যবহার করা উচিত নয়।

এসব চরম ধারণা গোটা মহাদেশে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করলে একদল নতুন ইতিহাসবিদ বস্তুনিষ্ঠভাবে চার্চের ইতিহাস পর্যালোচনা শুরু করেছিলেন। এভাবে ১৬৯৯ সালে গটফ্রাইড আরনল্ড তার নিরপেক্ষ হিস্ট্রি অভ দ্য চার্চেস ফ্রম দ্য বিগিনিং অভ দ্য নিউ টেস্টামেন্ট টু সিক্সটিন এইটি এইট প্রকাশ করেছিলেন। এখানে তিনি যুক্তি দেখান যে, বর্তমানে যাকে অর্থডক্স বিবেচনা করা হচ্ছে আদিম চার্চে তার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। ইয়োহান লরেন ফন মোশিম (১৬৯৪-১৭৫৫) তাঁর কর্তৃত্বপূর্ণ রচনা ইন্সটিটিউশনস অভ এক্লিসিয়েস্টিক্যাল হিস্ট্রি (১৭২৬)-তে পরিকল্পিতভাবে ইতিহাসকে ধর্মতত্ত্ব হতে আলাদা করে নেন এবং সত্যতা প্রতিপাদন ছাড়াই মতবাদের বিকাশ তুলে ধরেন। জর্জ ওয়ালশ জিওভান্নি বাট ও হেনরি নরিসের মতো ইতিহাসবিদগণ আরিয়ানিজম, ফিলিওক বিরোধ এবং চতুর্থ ও পঞ্চম শতাব্দীর বিভিন্ন খৃষ্টতত্ত্বীয় বিতর্ক ও জটিল মতবাদগত বিতর্কের ইতিহাস পর্যালোচনা করেন। ঈশ্বর ও ক্রাইস্টের প্রকৃতি সংক্রান্ত মৌলিক ডগমাসমূহ শত শত বছর সময় পরিক্রমায় সৃষ্টি হয়েছে, নিউ টেস্টামেন্টের এগুলো অস্তিত্ব নেই জানতে পেরে বহু বিশ্বাসী অস্বস্তিতে পড়ে গিয়েছিল; তর মানে কি এগুলো ভুয়া ছিল? অন্যরা আরও অগ্রসর হয়ে খোদ নিউ টেস্টামেন্টের ক্ষেত্রেই নতুন বস্তুনিষ্ঠতা প্রয়োগ করেছে। হারমান স্যামুয়েল রিমারাস (১৬৯৪-১৭৬৮) স্বয়ং জেসাসের একটি সমালোচনামূলক জীবনী রচনারই প্রয়াস পেয়েছিলেন: ক্রাইস্টের মানব রূপের প্রশ্নটি আর অতিন্দ্রীয়বাদী বা মতবাদগত বিষয় ছিল না বরং যুক্তির কালে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার বিষয়ে পরিণত হয়েছিল। এ ঘটনা ঘটার পর সত্যিকার অর্থে সংশয়বাদের আধুনিক কাল সুচিত হলো। রিমারাস যুক্তি দেখিয়েছিলেন যে, জেসাস কেবল একটি ঈশ্বরের রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন; কিন্তু তাঁর মেসিয়ানিক মিশন ব্যর্থ হলে তিনি হতাশায় মৃত্যুবরণ করেন। তিনি উল্লেখ করেন, গস্পেলে জেসাস কখনও মানব জাতির পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে আসার কথা বলেননি যা পাশ্চাত্য খৃস্টধর্মের মূল বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এই ধারণা কেবল খৃস্টধর্মের আসল প্রতিষ্ঠাতা সেইন্ট পল পর্যন্ত চিহ্নিত করা যায়। সুতরাং, জেসাসকে ঈশ্বর হিসাবে মানা উচিত হবে না আমাদের, বরং তাকে একজন ‘উল্লেখযোগ্য, সাধারণ, মহান ও ব্যবহারিক ধর্মের শিক্ষকের মর্যাদা দেওয়া যেতে পারে।

এসব বস্তুনিষ্ঠ গবেষণা ঐশীগ্রন্থের আক্ষরিক অর্থ উপলব্ধির ওপর নির্ভরশীল ছিল এবং এখানে ধর্ম বিশ্বাসের প্রতীকী বা উপমাগত প্রকৃতি অগ্রাহ্য করা হয়েছে। এ ধরনের সমালোচনা শিল্পকলা বা কাব্যের সমালোচনার মতোই অপ্রাসঙ্গিক বলে আপত্তি জানাতে পারেন কেউ। কিন্তু বহু লোকের কাছে বৈজ্ঞানিক চেতনা মানদণ্ডে পরিণত হওয়ার পর অন্য কোনওভাবে গস্পেল পাঠ তাদের জন্যে কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। পশ্চিমের ক্রিশ্চানরা তাদের ধর্মবিশ্বাসের আক্ষরিক উপলব্ধির প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ হয়ে মিথ থেকে অপরিবর্তনীয়ভাবে পিছু হটে আসে: কোনও গল্প বাস্তবিকই সত্য হবে নইলে সেটি বিভ্রান্তি। ধর্মের মূল সম্পর্কিত প্রশ্ন, বলা যায়, বুদ্ধদের চেয়ে ক্রিশ্চানদের কাছে অনেক বেশি গুরুত্ববহ ছিল, কারণ তাদের একেশ্বরবাদী ট্র্যাডিশন সবসময় দাবি করে এসেছে যে, ঈশ্বর ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহে প্রকাশিত হয়েছেন। সুতরাং, বৈজ্ঞানিক যুগে ক্রিশ্চানদের সংহতি বজায় রাখতে হলে এসব প্রশ্নের মোকাবিলার প্রয়োজন ছিল। টিন্ডাল বা মারসের তুলনায় প্রচলিত বিশ্বাস লালনকারী কোনও কোনও ক্রিশ্চান ঈশ্বর সম্পর্কে পশ্চিমের প্রচলিত উপলব্ধিকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে শুরু করে। লুথারান জন ফ্রাইডম্যান মেয়ার তাঁর উইটেনবার্গস ইনোসেন্স অভ আ ডাবল মার্ডার (১৬৮১)-এ লেখেন যে, আনসেল্ম বর্ণিত প্রায়শ্চিত্তের প্রচলিত মতাবাদ যেখানে ঈশ্বরকে আপন পুত্রের মৃত্যু কামনাকারী হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে সেটি ঐশী সত্তা সম্পর্কে অসম্পূর্ণ ধারণা তুলে ধরে। তিনি ন্যায়পরায়ণ ঈশ্বর’, ‘ক্ষুব্ধ ঈশ্বর’ ও ‘তিক্ত ঈশ্বর’ যার কঠিন ক্ষতি পূরণের দাবি বহু ক্রিশ্চানকে আতঙ্কে ভরিয়ে তুলেছে এবং তাদের নিজস্ব ‘পাপপূর্ণতা’ হতে সরে আসার শিক্ষা দিয়েছে। ক্রিশ্চান ইতিহাসের এসব নিষ্ঠুরতা দেখে ক্রিশ্চানরা অধিক হারে বিব্রত বোধ করেছে যে ন্যায়পরায়ণ ঈশ্বরের নামে ইতিহাসের ভীতিকর ক্রুসেড, ইনকুইজিশন ও অত্যাচার চালানো হয়েছে। অর্থডক্স মতবাদে বিশ্বাস করার জন্যে মানুষের ওপর অত্যাচার চালানোর ব্যাপারটি বিশেষ করে উদারতা ও বিবেকের স্বাধীনতার প্রতি অনুরক্ত একটা সময়ে আতঙ্কজনক মনে হয়েছে। সংস্কারের কারণে সূচিত রক্তপাত ও এর পরবর্তী পরিস্থিতি যেন ছিল শেষ অবলম্বন।

যুক্তিকেই একমাত্র উত্তর মনে হয়েছে। তারপরেও রহস্যময়তাহীন একজন ঈশ্বর যে রহস্য তাকে শত শত বছর অন্যান্য ধর্মের কার্যকর ধর্মীয় মূল্যে পরিণত করে করেছে, অধিকতর কল্পনাশক্তির ও সহজাত প্রকৃতির অধিকারী ক্রিশ্চানদের কাছে আবেদন রাখতে পারবেন? পিউরিটান কবি জন মিল্টন (১৬০৮-৭৪) চার্চের অসহিষ্ণুতার রেকর্ড জেনে বিশেষভাবে বিব্রত বোধ করেছিলেন। আপন সময়ের প্রকৃত মানুষ মিল্টন তাঁর অপ্রকাশিত প্রবন্ধ অন ক্রিশ্চান ডকট্রিন-এ সংস্কারকে সংস্কার করার প্রয়াস পেয়েছিলেন ও নিজের জন্যে এমন একটি ধর্মীয় বিশ্বাস আবিষ্কার করতে চেয়েছিলেন যা অন্যদের বিশ্বাস ও বিবেচনার উপর নির্ভরশীল নয়। ট্রিনিটির মতো প্রচলিত মতবাদসমূহ সম্পর্কেও সন্দিহান ছিলেন তিনি। তা সত্ত্বেও এটা তাৎপর্যপূর্ণ যে তাঁর মাস্টারপিস প্যারাডাইস লস্ট-এর প্রকৃত নায়ক স্বয়ং স্যাটান, ঈশ্বর নন, মানুষের কাছে যার কাজ ন্যায্য প্রতিপন্ন করতে চেয়েছেন তিনি। ইউরোপের নতুন মানুষের বহু গুণাগুণ রয়েছে স্যাটানের: সে কর্তৃত্ব অগ্রাহ্য করে, অজানার বিরুদ্ধে নিজেকে স্থাপন করে ও নরক হতে নতুন সৃষ্ট পৃথিবীর ভেতর দিয়ে যাত্রার সময় প্রথম অভিযাত্রীতে পরিণত হয়। অবশ্য মিল্টনের ঈশ্বর যেন পশ্চিমের অক্ষরবাদিতার সহজাত অবাস্তবতা প্রকাশ করেন। ট্রিনিটির অতিন্দ্রীয়বাদী উপলব্ধি ছাড়া পুত্রের অবস্থান এই কবিতায় একেবারে দ্ব্যর্থবোধক রয়ে যায়। এটা মোটেই পরিষ্কার নয় যে, তিনি দ্বিতীয় স্বর্গীয় সত্তা নাকি দেবদূতদের মতো সৃষ্টি, যদিও কিছুটা উচ্চ মর্যাদার। যে কোনও অবস্থায় তিনি ও পিতা দুটো সম্পূর্ণ আলাদা সত্তা যাদের পরস্পরের উদ্দেশ্য জানতে ক্লান্তিকর দীর্ঘ কথোপথনে লিপ্ত হতেই হবে, যদিও পুত্র পিতার স্বীকৃত বাণী ও প্রজ্ঞা।

তবে পৃথিবীর ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে ঈশ্বরের পূর্ব-ধারণা নিয়ে মিল্টনের ভূমিকা তাঁর স্রষ্টাকে অবিশ্বাস্য করে তুলেছে। যেহেতু প্রয়োজনের খাতিরেই ঈশ্বর আগে থেকে আদম ও ইভের পতন হবে বলে জানতেন-এমনকি স্যাটান পৃথিবীতে পৌঁছার আগেই তিনি নিশ্চয়ই সেই ঘটনার আগে নিজের কাজের ন্যায্যতা যাচাইয়ে মন দিয়েছেন। চাপিয়ে দেওয়া আনুগত্যে আনন্দ পাবেন না তিনি, পুত্রের কাছে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তিনি আদম ও ইভকে স্যাটানের মোকাবিলা করার ক্ষমতা দিয়েছিলেন। সুতরাং, তারা, আত্মরক্ষামূলক যুক্তি দেখিয়েছেন ঈশ্বর, ন্যায্যত অভিযুক্ত করতে পারবে না :

তাদের স্রষ্টাকে বা তাদের সৃষ্টিকে বা তাদের নিয়তিকে
যেন পূর্ব নির্ধারিত নিয়তি
তাদের ইচ্ছাকে বাতিল করে দিয়েছে,
চূড়ান্ত আদেশ বা উচ্চ পূর্ব-জ্ঞানে পরিত্যক্ত হয়েছে; তারা নিজেরাই
নিজেদের বিদ্রোহের ঘোষণা দিয়েছে; আমি নই:
যদি আমি আগে জানতাম,

তাদের অপরাধ বা ভুলের ওপর পূর্বজ্ঞানের কোনও প্রভাব ছিল না;
যা নির্দিষ্ট কিছু পূর্বে অজানাকে প্রমাণ করেছে…

আমি তাদের স্বাধীনভাবে সৃষ্টি করেছি,
অবশ্যই ওদের মুক্তই থাকতে হবে,
যতক্ষণ না নিজেরাই নিজেদের বন্দি করছে; না হয় আমাকে অবশ্যই
তাদের স্বভাব পাল্টে দিতে হবে ও অপরিবর্তনীয় চিরন্তন, পরম নির্দেশকে
নাকচ করতে হতো
যা তাদের স্বাধীন ইচ্ছাকে প্রতিষ্ঠিত করেছে;
তারা নিজেরাই নিজেদের পতন ডেকে এনেছে।

এই নিরস ভাবনাকে সম্মান দেখানো শুধু কঠিনই নয়, বরং ঈশ্বর আবির্ভূত হচ্ছেন একজন ঠাণ্ডা, আত্ম-নিরপেক্ষ ও সমবেদনাবিহীন সত্তা হিসাবে অথচ তাঁর ধর্মের সমবেদনাই জাগিয়ে তোলার কথা। ঈশ্বরকে আমাদের কারও মতো করে ভাবতে ও কথা বলতে বাধ্য করার মাঝে ঐশী সত্তাকে মানবরূপ ও ব্যক্তিক ধারণায় উপস্থাপনের ঘটনাও তুলে ধরে। এমন একজন ঈশ্বরের মাঝে এত বেশি স্ববিরোধিতা রয়েছে তিনি সামঞ্জস্যপূর্ণ থাকেন না, তাই তাঁর শ্রদ্ধা পাবারও যোগ্যতা থাকে না।

ঈশ্বরের সর্বজ্ঞতার মতো মতবাদসমূহের আক্ষরিক উপলব্ধি কোনও কাজে আসবে না। মিল্টনের ঈশ্বর কেবল শীতল আর আইননিষ্ঠই নন, তিনি ব্যাপকভাবে অনুপযুক্ত। প্যারাডাইস লস্টের শেষ দুই পর্বে ঈশ্বর আর্চঅ্যাঞ্জেল মাইকেলকে প্রেরণ করেন আদমকে তাঁর বংশধরদের মুক্তি লাভের ব্যাপারটি দেখিয়ে তাকে পাপের সান্ত্বনা দিতে। কতগুলো দৃশ্যের মাধ্যমে আদমের সামনে মুক্তির গোটা ইতিহাস উন্মোচিত হয়, যার ধারা বিবরণী দেন মাইকেল; তিনি কেইনের হাতে আবেলের মৃত্যু দেখেন, প্লাবন ও নোয়াহর কিস্তি, টাওয়ার অভ বাবেল, আব্রাহামের আহবান, মিশর হতে এক্সোডাস ও সিনাই পর্বতে আইনের অবতরণ দেখতে পান। তোরাহ্র অসম্পূর্ণতা, যা শত শত বছর ধরে ঈশ্বরের মনোনীত হতভাগ্য জাতিকে নিপীড়ন করেছে, মিকাইল ব্যাখ্যা দিচ্ছেন, আরও আধ্যাত্মিক আইনের আকাঙ্ক্ষা করানোর একটা কৌশল । পৃথিবীর ভবিষ্যৎ মুক্তি লাভের এই বিবরণ অগ্রসর হওয়ার সময় রাজা ডেভিডের বীরত্বপূর্ণ ঘটনাবলী, বাবিলনে এক্সোডাস, খৃস্টের জন্ম লাভ, ইত্যাদির মাধ্যমে-পাঠকের মনে হয় মানুষকে উদ্ধার করার নির্ঘাৎ আরও সহজ ও অধিকতর প্রত্যক্ষ উপায় ছিল। এই ক্রমাগত ব্যর্থতা ও ভ্রান্তিময় সূচনা সম্বলিত অত্যাচারী পরিকল্পনাটি আগাম নির্ধারিত-এই সত্যটি এর প্রণেতার বুদ্ধিমত্তা সম্পর্কে গভীর সন্দেহ সৃষ্টি করে। মিল্টনের ঈশ্বর সামান্য আস্থাই সঞ্চার করেন। এটা নিশ্চয়ই তাৎপর্যপূর্ণ যে প্যারাডাইস লস্টের পর আর কোনও প্রধান ইংরেজ সৃজনশীল লেখক অতিপ্রাকৃত জগত বর্ণনার প্রয়াস পাননি। এরপর আর কোনও স্পেন্সারস বা মিল্টনের দেখা মেলেনি। এরপর অতিপ্রাকৃত ও আধ্যাত্মিক বিষয় জর্জ ম্যাকডোনাল্ড এবং সি, এস, লুইসের মতো অধিকতর প্রান্তিক লেখকদের জগতে পরিণত হয়। তারপরেও কল্পনার কাছে আবেদন সৃষ্টিতে অক্ষম ঈশ্বর বিপদাপন্ন হয়ে পড়েন।

প্যারাডাইস লস্টের একেবারে শেষে আদম ও ইভ নিঃসঙ্গভাবে স্বর্গোদ্যান ছেড়ে পৃথিবীতে নেমে আসেন। পশ্চিমের ক্রিশ্চানরা অধিকতর সেকুলার যুগের দোড়গোড়ায় পৌঁছে গিয়েছিল, যদিও তখনও ঈশ্বর বিশ্বাস আঁকড়ে রেখেছিল তারা। যুক্তির নতুন ধর্ম ডেইজম (Deism) নামে পরিচিত হবে। অতিন্দ্রীয়বাদ ও মিথের কল্পনা-নির্ভর অনুশীলনের কোনও অবকাশ এর ছিল না। প্রত্যাদেশের মিথ ও ট্রিনিটির মতো প্রচলিত ‘রহস্যসমূহে’র দিকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল এই ধর্ম, যা কিনা বহুদিন মানুষকে কুসংস্কারের শৃঙ্খলে বন্দি করে রেখেছিল। তার বদলে এটা নৈর্ব্যক্তিক ‘ডিউসের প্রতি আনুগত্যের ঘোষণা দেয়, যাকে নিজের প্রয়াস দিয়েই আবিষ্কার করতে পারে মানুষ। ফ্রাঁসোয়া মেরি দে ভলতেয়ার ছিলেন পরবর্তীকালে আলোকন হিসাবে পরিচিত হয়ে ওঠা এই আন্দোলনের প্রতিমূর্তি; তাঁর ফিলসফিক্যাল ডিকশনারি (১৭৬৪) তে এই আদর্শ ধর্মের সংজ্ঞা দিয়েছেন তিনি। এটা সর্বোপরি যথাসম্ভব সহজ হবে।

যা বেশি নৈতিকতা শিক্ষা দেয় এবং সেটাই কি হওয়া উচিত নয়? যেটা মানুষকে অবাস্তব পরিণত না করেই গড়ে তুলতে চায়? যেটা কাউকে অসম্ভব, স্ববিরোধী ও অলৌকিকের প্রতি অবিবেচক এমন কিছুতে বিশ্বাস করার নির্দেশ দেয় না, যা জাতির জন্যে ক্ষতিকর ও যা সাধারণ জ্ঞান থাকার অপরাধে কাউকে চিরকালীন শাস্তি ও ভয় দেখাতে যায় না? সেটাই হওয়া উচিত নয় যেটি ঘাতকদের দ্বারা বিশ্বাস রক্ষা করে না এবং পৃথিবীকে বুদ্ধিহীন জ্ঞানের জন্যে রক্তের বন্যায় ভাসিয়ে দেয় না?… যা কেবল একজন ঈশ্বরের উপাসনার ন্যায় বিচার, সহিষ্ণুতা ও মানবতার শিক্ষা দেয়?

এই অস্বীকৃতির জন্যে চার্চগুলোর নিজেদের ছাড়া আর কাউকে দোষারোপ করার উপায় ছিল না, কেননা শত শত বছর ধরে তারা বিশ্বাসীর ওপর হাজারো মতবাদের বোঝা চাপিয়ে দিয়ে এসেছে। প্রতিক্রিয়া ছিল অনিবার্য এবং ইতিবাচকও হতে পারে।

অবশ্য আলোকন পর্বের দার্শনিকরা ঈশ্বরের ধারণা প্রত্যাখ্যান করেননি। তারা মানুষকে চিরন্তন আগুনের ভয় দেখিয়ে হুমকি দানকারী অর্থডক্সদের নিষ্ঠুর ঈশ্বরকে অস্বীকার করেছিলেন। যুক্তির কাছে পরাজিত ঈশ্বর সংক্রান্ত রহস্যময় মতবাদসমূহ প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। কিন্তু পরম সত্তায় তাঁদের বিশ্বাস অটুট রয়ে গিয়েছিল। ফারনিতে একটা শ্যাপেল নির্মাণ করেছিলেন ভলতেয়ার যার লিন্টেলে খোদাই করা ছিল ‘দেও এরেক্সিত ভলতেয়ার’ এবং তিনি এ পর্যন্ত বলেছিলেন যে, ঈশ্বরের অস্তিত্ব না থাকলে তাঁকে সৃষ্টি করার প্রয়োজন হয়ে দাঁড়াত। ফিলসফিক্যাল ডিকশনারিতে তিনি যুক্তি দেখিয়েছেন, অসংখ্য উপাস্যে বিশ্বাস করার চেয়ে একজন ঈশ্বরে বিশ্বাস করা মানুষের পক্ষে বেশি যৌক্তিক ও স্বাভাবিক ছিল। আদিতে বিচ্ছিন্ন গ্রাম আর সমাজে জীবনযাপনকারী মানুষ মেনে নিয়েছিল যে একজন দেবতা তাদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করেন: বহুঈশ্বরবাদীতা পরবর্তীকালের সংযোজন। বিজ্ঞান ও যুক্তিভিত্তিক দর্শন উভয়ই পরম সত্তার অস্তিত্বের কথা বলে: ‘এসব থেকে কী সিদ্ধান্তে আসতে পারি আমরা?’ ডিকশনারির নাস্তিকবাদ’-রচনার শেষে প্রশ্ন রেখেছেন ভলতেয়ার। তিনি নিজেই জবাব দিচ্ছেন:

নাস্তিক্যবাদ যারা শাসন করে তাদের অন্তরের এমনকি শিক্ষিত মানুষের মাঝেও এক অশুভ দানবীয় শক্তি, যদি তাদের জীবন নিষ্পাপও হয়ে থাকে, কেননা তারা তাদের গবেষণা থেকে দায়িত্ববান ব্যক্তিদের ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারেন; এবং এটা ঘৃণিত ধর্মান্ধতা না হলে গুণাবলীর ক্ষেত্রে এক মারাত্মক আঘাত। সর্বোপরি, আমাকে একথা যোগ করার সুযোগ দিন যে, বর্তমানে নাস্তিকের সংখ্যা সর্বকালের নিম্নতম, কেননা দার্শনিকরা জানতে পেরেছেন যে, জীবাণু ছাড়া কোনও বর্ধিষ্ণু সত্তা থাকতে পারে না, পরিকল্পনা ছাড়া কোনও জীবাণু থাকতে পারে না, ইত্যাদি।

ভলতেয়ার নাস্তিক্যবাদকে কুসংস্কার ও ধর্মান্ধতার সঙ্গে এক কাতারে স্থান দিয়েছেন, দার্শনিকগণ যা দূর করতে উদগ্রীব ছিলেন। ঈশ্বর নন, তাঁর কাছে সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছিল যুক্তির পবিত্র মানকে আক্রমণকারী ঈশ্বর সম্পর্কিত মতবাদসমূহ ।

ইউরোপের ইহুদিরাও নতুন ধারণায় প্রভাবিত হয়েছিল। স্প্যানিশ বংশোদ্ভুত ডাচ ইহুদি বারুচ স্পিনোযা (১৬৩২-৭৭) তোরাহ পাঠ করতে গিয়ে অসন্তুষ্ট হয়ে জেইন্টাইল মুক্তচিন্তাবিদদের এক চক্রে যোগ দিয়েছিলেন। তিনি এমন সব ধারণার জন্ম দিয়েছিলেন যেগুলো প্রচলিত ইহুদিমতবাদ হতে সম্পূর্ণ আলাদা ছিল এবং যেগুলো দেকার্তের মতো বৈজ্ঞানিক চিন্তাবিদ ও ক্রিশ্চান স্কলাস্টিকদের দ্বারা প্রভাবিত ছিল। ১৬৫৬ সালে চব্বিশ বছর বয়সে তাঁকে আনুষ্ঠানিকভাবে আমস্টারডামের সিনাগগ থেকে বহিস্কার করা হয়। বহিষ্কারাদেশ পাঠ করার সময় সিনাগগের বাতিগুলো ক্ষীণ হতে হতে এক সময় গোটা সমাবেশকে অন্ধকারে ডুবিয়ে দেয়। এভাবে এক ঈশ্বরহীন পৃথিবীতে স্পিনোযার আত্মার অন্ধকারাচ্ছন্নতা প্রত্যক্ষভাবে অনুভব করেছে তারা:

দিন ও রাতের অভিশাপ পড়ক তার ওপর; অভিশপ্ত হোক সে নিদ্রা ও জাগরণে, ঘরে ও বাইরে। ঈশ্বর যেন আর কখনও তাকে ক্ষমা না করেন বা কাছে টেনে না নেন। এখন থেকে যেন ঈশ্বরের কোপানলে দগ্ধ হতে হয় তাকে; ঐশীগ্রন্থে লিখিত সকল অভিশাপ পতিত হোক তার ওপর, জগৎ থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাক তার নাম।

এরপর স্পিনোযা আর ইউরোপের কোনও ধর্মীয় গোষ্ঠীরই সদস্য থাকলেন। না। সুতরাং তিনি ছিলেন স্বাধীন, সেকুলার দৃষ্টিভঙ্গির আদিরূপ, যা ইউরোপের সাধারণ ধারায় পরিণত হবে। বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে অনেকেই আধুনিকতার নায়ক হিসাবে স্পিনোকে তার প্রতীকী নির্বাসন, বিচ্ছিন্নতা ও সেকুলার যুক্তির সন্ধানের সঙ্গে একাত্ম বোধ করে সম্মান করত।

স্পিনোযাকে নাস্তিক হিসাবে দেখা হয়েছে, কিন্তু একজন ঈশ্বরে বিশ্বাস করতেন তিনি, যদিও সে ঈশ্বর বাইবেলের ঈশ্বর নন। ফায়সুফদের মতো প্রত্যাদেশের ধর্মকে তিনি দার্শনিকদের আহরিত ঈশ্বর সংক্রান্ত বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের চেয়ে নিম্ন পর্যায়ের মনে করেছেন। ধর্মীয় বিশ্বাসের ধরণকে ভুল বোঝা হয়েছে, আ থিওলজিকো-পলিটিক্যাল ট্রিটিজ-এ যুক্তি দিয়েছেন তিনি। এটা একেবারে বিশ্বাস আর কুসংস্কারের একটা মিশেলে পরিণত হয়েছে, কতগুলো অর্থহীন রহস্যের গুচ্ছ।২৪ বাইবেলিয় ইতিহাসের দিকে তীর্যক চোখে তাকিয়েছেন তিনি। ইসরায়েলিরা তাদের বোধের অতীত যে কোনও কিছুকে ‘ঈশ্বর’ ডেকে বসত। যেমন, অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা ও পবিত্রতা সম্পন্ন মানুষ হওয়ায় পয়গম্বর ঈশ্বরের আত্মা দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছেন বলা হতো। কিন্তু এ ধরনের অনুপ্রেরণা বিশেষ কোনও গোষ্ঠীর ভেতর সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং স্বাভাবিক যুক্তি দিয়ে প্রত্যেকের নাগালে ছিল: বিশ্বাসের আচার ও প্রতীকসমূহ। বৈজ্ঞানিক ও যৌক্তিক চিন্তায় অক্ষম সাধারণ মানুষকেই কেবল সাহায্য করতে পারে।

দেকার্তের মতো ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রমাণের ক্ষেত্রে অন্টোলজিক্যাল প্রমাণের দ্বারস্থ হয়েছেন স্পিনোযা। খোদ ‘ঈশ্বরের ধারণাটিই ঈশ্বরের অস্তিত্বকে প্রমাণ করে, কেননা অস্তিত্বহীন একটি সম্পূর্ণ সত্তা এক্ষেত্রে স্ববিরোধী হয়ে পড়ত। ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রয়োজনীয় ছিল, কারণ বাস্তবতা সম্পর্কিত অন্যান্য সিদ্ধান্ত নেওয়ার বেলায় প্রয়োজনীয় নিশ্চয়তা ও আস্থা কেবল এখান থেকেই মেলে। বিশ্বজগৎ সম্পর্কে আমাদের বৈজ্ঞানিক উপলব্ধি দেখায় যে, হাজারো নিয়ম-নীতি একে নিয়ন্ত্রণ করছে। স্পিনোর চোখে ঈশ্বর মৌলিক আইন বা নিয়ম মাত্র, অস্তিত্বমান সকল চিরন্তন আইনের সারৎসার। ঈশ্বর একটি বস্তুগত সত্তা, বিশ্বজগতকে নিয়য়ন্ত্রণকারী নিয়মের সমতুল্য ও অনুরূপ। নিউটনের মতো স্পিনোযাও উৎসারণের প্রাচীন দার্শনিক মতবাদের কাছে ফিরে গেছেন! ঈশ্বর যেহেতু সকল বস্তুতে-বস্তুগত ও আধ্যাত্মিক-মিশে আছেন এবং পরিব্যাপ্ত করে রেখেছেন, সুতরাং এঁকে এসব বস্তুর অস্তিত্ব নির্দেশকারী নিয়ম হিসাবে শনাক্ত করা যেতে পারে । জগতে ঈশ্বরের কর্মধারা আলোচনা করার অর্থ অস্তিত্বের গাণিতিক ও কার্যকারণ সংক্রান্ত নীতিমালার বর্ণনা দান। এটা ছিল দুয়েতার চরম অস্বীকৃতি।

মতবাদটিকে অনুজ্জ্বল মনে হয়, কিন্তু স্পিনোর ঈশ্বর প্রকৃত অতিন্দ্রীয়বাদী বিস্ময়ে অনুপ্রাণিত করেছিলেন। অস্তিত্বমান সকল বিধি-বিধানের সমন্বয় হিসাবে ঈশ্বর সম্পূর্ণ নিখুঁত, যিনি সবকিছুকে ঐক্য ও ছন্দে সম্পর্কিত করেছেন। মানুষ যখন দেকার্তের নির্দেশিত পথে তাদের মনের কর্মধারা নিয়ে ভাবে, তখন নিজেদের ভেতর ঈশ্বরের চিরন্তন ও অসীম সত্তাকে সক্রিয় হতে উন্মুক্ত করে দেয়। প্লেটোর মতো স্পিনোযা বিশ্বাস করতেন, সহজাত ও স্বতঃস্ফুর্ত জ্ঞান পরিশ্রম সাপেক্ষ সত্য আহরণের চেয়ে ঢের প্রবলভাবে ঈশ্বরের উপস্থিতিকে প্রকাশ করে। জ্ঞানে আমাদের আনন্দ ও সুখ ঈশ্বরের ভালোবাসার সমান, এই উপাস্য চিন্তার কোনও বাহ্যিক বস্তু নন বরং প্রত্যেক মানুষের মনের গভীরে মিশে থাকা চিন্তারই কারণ ও নীতি। প্রত্যাদেশ বা স্বর্গীয় আইনের কোনও প্রয়োজন নেই: এই ঈশ্বর গোটা মানবজাতির জন্যে সহজগম্য আর কেবল তোরাই প্রকৃতির চিরন্তন আইন। স্পিনোযা প্রাচীন মেটাফিজিক্সকে নতুন বিজ্ঞানের সঙ্গে একই কাতারে নিয়ে এসেছিলেন: তাঁর ঈশ্বর নিওপ্লেটোনিস্টদের ঈশ্বরের মতো অতীত নন বরং আকুইনাসের মতো দার্শনিকদের বর্ণিত পরম সত্তার কাছাকাছি। কিন্তু এই ঈশ্বর আবার অর্থডক্স একেশ্বরবাদীদের অনুভূত অতিন্দ্রীয়বাদী ঈশ্বরেরও নিকটবর্তী। ইহুদি, ক্রিশ্চান ও দার্শনিকরা স্পিনোযাকে নাস্তিক ভাবতে চেয়েছে: এই ঈশ্বরের মাঝে ব্যক্তিক কিছু নেই, যিনি বাকি বাস্তবতা হতে অবিচ্ছেদ্য। প্রকৃতপক্ষে স্পিনোযা ঈশ্বর

শব্দটি ব্যবহার কেরছিলেন কেবল ঐতিহাসিক কারণে; তিনি নাস্তিকদেও সাথে একমত প্রকাশ করেছেন, যাদের দাবি ছিল বাস্তবতাকে ‘ঈশ্বর’ আর ‘ঈশ্বর’ নন এভাবে ভাগ করা যায় না। ঈশ্বরকে অন্য কিছু থেকে আলাদা করা না গেলে প্রচলিত অর্থে তিনি আছেন বলা অসম্ভব হয়ে পড়ে। স্পিনোযা আসলে যা বলতে চেয়েছিলেন সেটা হলো, আমরা সাধারণত যে অর্থে ব্যবহার করি সেই। অর্থের সঙ্গে মানানসই কোনও ঈশ্বর নেই। অবশ্য অতিন্দ্রীয়বাদী ও দার্শনিকরা শত শত বছর ধরে একথাই বলে আসছিলেন। কেউ কেউ বলেছে আমাদের জানা জগতের বাইরে আর কিছুই নেই। দুয়ে এন সফের অনুপস্থিতি না। থাকলে স্পিনোর সর্বেশ্বরবাদ কাব্বালাহর সঙ্গে মিলে যেত; আমরা চরম। অতিন্দ্রীয়বাদ ও আসন্ন নতুন নাস্তিক্যবাদের মাঝে সম্পর্ক অনুভব করতে পারতাম।

জার্মান দার্শনিক মোজেস মেলেসন (১৭২৯-৮৬) আধুনিক ইউরোপে ইহুদিদের প্রবেশের পথ খুলে দিয়েছিলেন, যদিও গোড়াতে নির্দিষ্ট ইহুদি-দর্শন গড়ে তোলার ইচ্ছা তার ছিল না। ধর্মের মতো মনস্তত্ত্ব ও নন্দনতত্ত্বে আগ্রহী ছিলেন তিনি। তাঁর প্রথমদিকের রচনা ফিদন ও মর্নিং আওয়ার্স জার্মান আলোকনের বৃহত্তর প্রেক্ষাপটেই রচিত হয়েছিল: এগুলোয় যৌক্তিক ভিত্তিতে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা হয়েছে, ইহুদি দৃষ্টিকোণ থেকে প্রশ্নটিকে বিবেচনা করেনি । ফ্রান্স ও জার্মানির মতো দেশগুলোয় আলোকনের উদার ধারণাসমূহ মুক্তি আনে ও ইহুদিদের সমাজে যোগ দেওয়ায় সক্ষম করে। এই মাস্কিলিমদের–আলোকপ্রাপ্ত ইহুদিদের এভাবে আখ্যায়িত করা হতো–জার্মান আলোকনের ধর্মীয় দর্শন গ্রহণে অসুবিধা ছিল না। ইহুদি মতবাদে খৃস্টধর্মের মতো একই রকম মতবাদ সংক্রান্ত বিকার কখনওই ছিল না। এর মৌল বিষয়গুলো বস্তুত আলোকনের যৌক্তিক ধর্মের অনুরূপই ছিল: জার্মানিতে যা

তখনও ঘটনার ধারণা ও মানবীয় কর্মকাণ্ডে ঈশ্বরের হস্তক্ষেপ মেনে নিয়েছে। মনিং আওয়ার্স-এ মেন্ডেলসনের দার্শনিক ঈশ্বর বাইবেলের ঈশ্বরের খুবই কাছাকাছি। ইনি মেটাফিজিক্যাল বিমূর্ত কিছু নন, একজন ব্যক্তিক ঈশ্বর। প্রজ্ঞা, মহত্ব, ন্যায়বিচার, প্রেমময় দয়া ও বুদ্ধিমত্তার মতো মানবীয় বৈশিষ্ট্যবালী সর্বোচ্চ মাত্রায় এই পরমসত্তায় প্রয়োগ করা যায়।

কিন্তু এর ফলে মেন্দেলসনের ঈশ্বর একেবারে আমাদের মতো হয়ে যান। তাঁর ধর্মটি টিপিক্যাল আলোকনের বিশ্বাস ছিল; শীতল নিরাবেগ এবং ধর্মীয় অভিজ্ঞতার প্যারাডক্স ও দ্ব্যর্থবোধকতাসমূহ যেন উপেক্ষা করতে চায়। মেলেসন ঈশ্বর বিহীন জীবনকে অর্থহীন মনে করেছেন, কিন্তু তাঁর এই ধর্ম আবেগময় ধর্ম নয়: তিনি যুক্তি দিয়ে আহরণযোগ্য ঈশ্বরের জ্ঞানেই সম্পূর্ণ সন্তুষ্ট ছিলেন। ঈশ্বরের মহত্বের ওপরই ধর্মতত্ত্ব টিকে থাকে। মানুষকে কেবল প্রত্যাদেশের ওপর নির্ভর করে থাকতে হলে, যুক্তি উত্থাপন করেছেন মেলেসন, সেটা ঈশ্বরের মহত্বের সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন হয়ে পড়ত, কারণ অসংখ্য মানুষ দৃশ্যতঃ ঐশী পরিকল্পনা থেকে বাদ পড়ে গিয়েছে। সুতরাং তাঁর দর্শন ফালসাফাহুর দাবিকৃত দুর্বোধ্য বুদ্ধিবৃত্তিক দক্ষতা যা কেবল মুষ্টিমেয়দের পক্ষে অর্জন-সম্ভব–বাদ দিয়ে প্রত্যেকের আয়ত্তাধীন বোধশক্তির ওপর নির্ভর করেছে। অবশ্য, এই ধরনের পদ্ধতির বিপদ রয়েছে, কারণ তা এমন এক ঈশ্বরকে আমাদের নিজস্ব সংস্কারাদির সঙ্গে এক করে সেগুলোকে পরম করে তোলা খুবই সহজ হয়ে যায়।

১৭৬৭ সালে যখন ফিদন প্রকাশিত হয়, আত্মার অমরত্বের পক্ষে এর দার্শনিক যুক্তি ইতিবাচকভাবে, আবার কখনও কখনও পৃষ্ঠপোষকতার সঙ্গে জেন্টাইল বা ক্রিশ্চান বলয়ে গৃহীত হয়েছিল। এক তরুণ সুইস প্যাস্টর ইয়োহান ক্যাস্পার লেভের লেখেন যে, লেখক খৃস্টধর্ম গ্রহণে প্রস্তুত আছেন; মেলেসনকে তিনি প্রকাশ্যে তাঁর ইহুদিবাদের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরার জন্যে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন । মেন্দেলসন তখন প্রায় ইচ্ছার বিরুদ্ধেই ইহুদিবাদের পক্ষে যৌক্তিক বিতর্কে অবতীর্ণ হন, যদিও মনোনীত জাতি বা প্রতিশ্রুত ভূমির মতো প্রচলিত বিশ্বাস লালন করতেন না তিনি। তাঁকে একটা সীমারেখা টানতে হয়েছিল: তিনি স্পিনোযার পথে যেতে চাননি বা ইহুদিবাদের পক্ষে তাঁর যুক্তি বেশি সফল হলে ক্রিশ্চানদের আক্রোশ নেমে আসুক, তাও নয়। অন্যান্য ডেইস্টের মতো তিনি যুক্তি তুলে ধরেছিলেন যে, সত্যিসমূহ যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করা গেলেই কেবল প্রত্যাদেশ গ্রহণ করা যেতে পারে । ট্রিনিটির মতবাদ তার নির্ধারিত যোগ্যতা অর্জন করেনি। ইহুদিবাদ প্রত্যাদিষ্ট ধর্ম ছিল না, বরং প্রত্যাদিষ্ট আইন। ঈশ্বর সম্পর্কে ইহুদিদের ধারণা গোটা মানব জাতির স্বাভাবিক ধর্মের ঈশ্বরের ধারণায় অনুরূপ, স্বাধীন যুক্তি দিয়েই প্রমাণ করা যেতে পারে। মেন্দেলসন প্রাচীন সৃষ্টি তত্ত্বীয় ও অন্টোলজিক্যাল প্রমাণের ওপর নির্ভর করেছেন; এই বলে যুক্তি দিয়েছেন যে, আইনের ভূমিকা ছিল ইহুদিদের ঈশ্বর সম্পর্কে সঠিক ধারণা গড়ে তোলা ও বহুঈশ্বরবাদীতা এড়াতে সাহায্য করা । সহিষ্ণুতার আবেদন জানিয়ে বক্তব্য শেষ করেছিলেন তিনি। ইহুদিবাদসহ যুক্তি ভিত্তিক বিশ্বজনীন ধর্ম ঈশ্বরকে জানার অন্যান্য উপায়কে শ্রদ্ধা করতে শেখাবে, এটাই প্রত্যাশিত; ইউরোপের চার্চগুলো শত শত বছর ধরে যার ওপর নিপীড়ন চালিয়ে এসেছে।

ইহুদিরা মেন্দেলনের চেয়ে ইম্যানুয়েল কান্টের দর্শনে অনেক বেশি প্রভাবিত হয়েছিল; তার ক্রিটিক অভ পিউর রিজন (১৭৮১) মেন্দেলসনের জীবনের শেষ দশকে প্রকাশিত হয়। কান্ট আলোকনের সংজ্ঞা দিয়েছেন ‘মানুষের স্ব-আরোপিত অভিভাবকত্ব হতে এক্সোডাস’ বা বাহ্যিক কর্তৃত্বের ওপর আস্থা স্থাপন’২৫ বলে। স্বায়ত্তশাসিত নৈতিক বিবেকের মাধ্যমে অগ্রসর হওয়াই ঈশ্বরকে জানার একমাত্র উপায়, যাকে তিনি বলেছেন ‘ব্যবহারিক যুক্তি। তিনি চার্চের কর্তৃত্ব, প্রার্থনা ও আচারাদির মতো ধর্মের অনেক আনুষ্ঠানিকতা বাদ দিয়েছেন, মানুষকে যেগুলো আপন ক্ষমতায় নির্ভর করা হতে বিরত রাখে ও অন্যের ওপর নির্ভর করতে উৎসাহিত করে। কিন্তু কান্ট ঈশ্বরের ধারণার বিরুদ্ধে ছিলেন না। কয়েক শতাব্দী আগের আল-গাযযালির মতো তিনি যুক্তি দেখিয়েছেন যে, ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কিত প্রচলিত যুক্তিগুলো অর্থহীন, কারণ আমাদের মন কেবল স্থান বা কালে অস্তিত্বমান বস্তুকেই বুঝতে পারে; এর বাইরে অবস্থানকারী বস্তুনিচয় বিবেচনা করার যোগ্যতা রাখে না। তবে তিনি একথা মেনে নিয়েছিলেন যে, মানুষের এই সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে যাবার স্বাভাবিক প্রবণতা রয়েছে; সে ঐক্যের একটা নীতির সন্ধান করে যা আমাদের সামঞ্জস্যপূর্ণ সমগ্র হিসাবে বাস্তবতার একটা দর্শন দেবে। এটাই ঈশ্বরের ধারণা। যুক্তি দিয়ে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়, আবার উল্টোটিও প্রমাণ করা অসম্ভব। ঈশ্বরের ধারণা আমাদের জন্যে অত্যাবশ্যক ছিল: এটা আদর্শ সীমা প্রকাশ করেছে যা আমাদের জগৎ সম্পর্কে সামগ্রিক ধারণা লাভে সক্ষম করে তুলেছে।

সুতরাং, কান্টের ক্ষেত্রে ঈশ্বর একটি সুবিধা বা সুযোগ মাত্র যার অপব্যবহার হতে পারে। প্রাজ্ঞ ও সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের ধারণা বৈজ্ঞানিক গবেষণাকে ক্ষুণ্ণ করতে পারে ও দেউস এক্স মেশিনা (deus ex machina)র উপর অলস নির্ভরতার দিকে ঠেলে দেবে। এটা অপ্রয়োজনীয় রহস্যময়তার উৎসও হয়ে দাঁড়াতে পারে যা চার্চের ইতিহাসকে ক্ষতবিক্ষতকারী সেই দুঃসহ বিবাদের মতো বিবাদ সৃষ্টি করে । কান্ট হয়তো নিজেকে নাস্তিক মানতেন না। সমসাময়িকেরা তাঁকে ধার্মিক হিসাবে বর্ণনা করেছেন, যিনি অশুভের প্রতি মানুষের ক্ষমতার ব্যাপারে গভীরভাবে সজাগ ছিলেন। এটাই তার কাছে ঈশ্বরের ধারণাকে অত্যাবশ্যকীয় করে তুলেছিল। তিনি তার ক্রিটিক অভ প্র্যাকটিক্যাল রিজন-এ যুক্তি দিয়েছেন যে, নৈতিক জীবন যাপন করার জন্যে নারী ও পুরুষের একজন পরিচালনাকারী দরকার, যিনি সগুণকে সুখ দিয়ে পুরস্কৃত করবেন। এই দৃষ্টিকোণে, ঈশ্বরকে স্রেফ দ্বিতীয় চিন্তা হিসাবে নীতি ব্যবস্থার সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। ধর্মের কেন্দ্রবিন্দু এখন আর ঈশ্বরের রহস্য নয়, বরং খোদ মানুষ। ঈশ্বর এক কৌশলে পরিণত হলেন যিনি আমাদের আরও দক্ষতার সঙ্গে ও নৈতিকতা মেনে কাজ করতে সক্ষম করে তোলেন, তিনি আর সকল সত্তার মূল থাকলেন না। অচিরেই কিছু মানুষ তার স্বাধীনতার আদর্শকে আরেক কদম বাড়িয়ে এই প্রায় ক্ষীণকায় ঈশ্বরকে পুরোপুরি বাদ দেবে। কান্ট ছিলেন পশ্চিমের প্রথম কয়েকজনের অন্যতম যারা প্রচলিত প্রমাণের বৈধতার প্রতি সন্দেহ প্রকাশ করেছেন, দেখিয়ে দিয়েছেন আসলে এগুলো কিছু প্রমাণ করে না । এসব প্রমাণ আর কখনওই আগের মতো বিশ্বাসযোগ্য প্রতীয়মান হবে না।

অবশ্য, কোনও কোনও ক্রিশ্চানের কাছে একে মুক্তিদায়ী মনে হয়েছিল, যারা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করত যে, ঈশ্বর বিশ্বাসের একটি পথ বন্ধ করেছেন আরেকটি খুলে দেওয়ার জন্যে। আ প্লেইন অ্যাকাউন্ট অভ জেনুইন ক্রিশ্চানিটি তে জন ওয়েসলি (১৭০৩-৯১) লিখেছেন:

কখনও কখনও আমি প্রায় বিশ্বাস করে বসেছি যে, ঈশ্বরের প্রজ্ঞা অনেক পরবর্তীকালে খৃস্টধর্মের বাহ্যিক প্রমাণকে অধিকতর কম প্রতিবন্ধক বা বাধা হিসাবে কাজ করার অনুমতি দিয়েছেন যাতে মানুষ (বিশেষ করে চিন্তাশীলরা) এখানেই আটকে না থেকে নিজেদের মাঝেও দৃষ্টিপাত করতে বাধ্য হয় ও তাদের অন্তরে দেদীপ্যমান আলো খুঁজে পায়।[২৬]

আলোকন পর্বের যুক্তিবাদের পাশাপাশি এক নতুন ধরনের ধার্মিকতার বিকাশ ঘটেছিল, যাকে প্রায়ই হৃদয় বা অন্তরের ধর্ম হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়। যদিও মগজের চেয়ে অন্তরেই এটার অবস্থান ছিল, কিন্তু এর সঙ্গে ডেইজম-এর অনেক পূর্বশর্তের মিল ছিল। নারী ও পুরুষকে বাহ্যিক প্রমাণ ও কর্তৃত্ব ত্যাগ করে প্রত্যেকের হৃদয় ও ক্ষমতায় বিরাজমান ঈশ্বরকে আবিষ্কারের তাগিদ দিয়েছে এটা। বহু ডেইস্টের মতো ওয়েসলি ভাইরা বা জার্মান পিয়েটিস্ট কাউন্ট নিকোলাস লুদভিগ ফন যিযেন (১৭০০-৬০)-এর অনুসারীরা শত শত বছরের সংযোজন ঝেড়ে ফেলে ও প্রাথমিক ক্রিশ্চানদের ‘সহজ এবং ‘খাঁটি খৃষ্টধর্মে প্রত্যাবর্তন করছে বলে ভেবেছে।

জন ওয়েলসলি আগাগোড়া আন্তরিক ক্রিশ্চান ছিলেন। অক্সফোর্ডের লিংকন কলেজের তরুণ ফেলো থাকতে ভাই চালর্সকে নিয়ে আন্ডার গ্রাজুয়েটদের এটা সমিতি গঠন করেছিলেন তিনি, যা হোলি ক্লাব নামে পরিচিত ছিল। পদ্ধতি ও শৃঙ্খলার ব্যাপারে খুব কঠোর ছিল এই সমিতি, তাই এর সদস্যরা মেথডিস্ট বলে পরিচিত ছিলেন। ১৭৩৫ সালে জন ও চার্লস মিশনারি হিসাবে আমেরিকার কলোনি জর্জিয়ার উদ্দেশে যাত্রা করেন, কিন্তু দু’বছর পর অশান্ত অবস্থায় ফিরে আসেন জন, ডায়েরিতে লেখেন, ‘আমি আমেরিকায় গিয়েছিলাম ইন্ডিয়ানদের দীক্ষিত করতে, কিন্তু হায়, আমাকে দেবে কে দীক্ষা?”২৭ যাত্রাকালীন সময় ওয়েসলি মোরাভিয় গোষ্ঠীর কয়েকজন মিশনারি দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন, এই গোষ্ঠীটি সকল মতবাদ এড়িয়ে ধর্মকে হৃদয়ের ব্যাপার বলে জোর দিয়েছিল। ১৭৩৮ সালে লন্ডনে অ্যাল্ডারগেট স্ট্রীটের চ্যাপেলে মোরাভিয়দের এক সমাবেশ চলাকালীন ধর্মান্তর-এর অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন তিনি যা থেকে তার মনে বিশ্বাস জন্মে, এই নতুন ধরনের খৃস্টধর্ম প্রচারের জন্য তিনি সরাসরি ঈশ্বরের কাছ থেকে নির্দেশ পেয়েছেন। সেই থেকে তিনি ও তাঁর অনুসারীরা দেশময় ঘুরে বাজার আর ক্ষেত-খামারের শ্রমিকশ্রেণী ও কৃষকদের মাঝে ধর্মপ্রচার শুরু করেছিলেন।

‘আবার জন্মলাভে’র অনুভূতিটি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ঈশ্বর অবিরাম মানুষের আত্মায়, যেমন বলা হয়েছে, শ্বাস-প্রশ্বাস নিচ্ছেন বোধ করাটা খুবই দরকার, ক্রিশ্চানকে যা ঈশ্বরের প্রতি ধারাবাহিক ও কৃতজ্ঞতাময় ভালোবাসায় ভরিয়ে দেয় যা সচেতনভাবে অনুভূত হয় ও একে স্বাভাবিক ও এক অর্থে ঈশ্বর পুত্রদের প্রত্যেককের জন্যে দয়া, কোমলতা ও দীর্ঘ কষ্টভোগের সাহায্যে ভালোবাসতে শেখায়। ঈশ্বর সম্পর্কিত মতবাদসমূহ অপ্রয়োজনীয় ও ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়াতে পারে। বিশ্বাসীর মনে ক্রাইস্টের বাণীর মনস্তাত্ত্বিক প্রভাবই ধর্মের খাঁটিত্বের সেরা প্রমাণ। পিউরিটানবাদে যেমন আবেগসঞ্জাত অনুভূতিই প্রকৃত বিশ্বাসের ও সেদিক থেকে মুক্তির একমাত্র প্রমাণ। কিন্তু সর্বজনীন এই অতিন্দ্রীয়বাদ বিপজ্জনক হতে পারে। অতিন্দ্রীয়বাদীরা সব সময় আধ্যাত্মিক পথের বিপদসঙ্কুলতার ওপর জোর দিয়েছে, হিস্টেরিয়ার বিরুদ্ধে সতর্ক করেছে: শান্তি ও স্থিরতা ছিল অতিন্দ্রীয়বাদের চিহ্ন। এবং নবজন্ম” খৃস্টবাদ কুয়াকার্স ও শেকার্সদের উন্মত্ত আচরণের মতো উন্মত্ততার জন্ম দিতে পারে। ফলে হতাশারও সৃষ্টি হতে পারে: কবি উইলিয়াম কাউপার উদ্ধার পাননি ভেবে উন্মাদ হয়ে গিয়েছিলেন, তাঁর অনুভূতির ঘাটতিকে অভিশপ্ত হওয়ার লক্ষণ ভেবেছেন।

হৃদয়ের ধর্মের ক্ষেত্রে ঈশ্বর সম্পর্কিত মতবাদসমূহ অন্তৰ্গত আবেগের অবস্থায় পরিবর্তিত হয়। এইভাবে সাকসানিতে নিজস্ব এস্টেটে বসবাসকারী বিভিন্ন ধর্মীয় সংগঠনের পৃষ্ঠপোষক কাউন্ট ফন নিযেনদর্ফ ওয়েসলির মতো যুক্তি দিয়েছেন যে, ধর্মবিশ্বাসের অবস্থান চিন্তায় বা মস্তিষ্কে নয় বরং হৃদয়ের আলোকিত এক প্রদীপে। পণ্ডিতগণ ‘ট্রিনিটির রহস্য নিয়ে আলোচনায় মেতে থাকতে পারেন, কিন্তু এই মতবাদের অর্থ তিনটি সত্তার পারস্পরিক সম্পর্কে নয়, বরং আমাদের কাছে তাদের তাৎপর্য।৩০ অবতার ব্যক্তি পর্যায়ে ক্রিশ্চানের নবজন্মের প্রকাশ করেছে, ক্রাইস্ট যখন হৃদয়ের অধিশ্বরে পরিণত হয়েছেন। আবেগ-নির্ভর আধ্যাত্মিকতা জেসুইট ও প্রশাসন যন্ত্রের তীব্র বিরোধিতার মুখে প্রতিষ্ঠা লাভ করা স্যারেড হার্ট অভ জেসাসের প্রতি নিবেদিত রোমান ক্যাথলিক চার্চেও দেখা দিয়েছিল। জেসুইট ও প্রশাসন এর পৌনঃপৌনিক আবেগপ্রবণ অনুভূতির বাড়াবাড়িকে সন্দেহের চোখে দেখত। আজও তা টিকে আছে: বহু রোমান ক্যাথলিক চার্চে ক্রাইস্টের উন্মুক্ত বুকে অগ্নিশিখায় পরিবেষ্টিত কণ্ডাকৃতি হৃদয় দেখানো মূর্তি আছে। এরকম দৈহিক রূপ নিয়েই তিনি ফ্রান্সের প্যারেয়-লে মনিয়ালস্থ কনভেন্টে মার্গারিট-মেরি অ্যালাকোক (১৬৪৭-৯০)-এর সামনে দেখা দিয়েছিলেন। এই ক্রাইস্টের সঙ্গে গস্পেলের ক্ষতবিক্ষত চারিত্রের কোনও মিল নেই। আত্ম-করুণার সময় তিনি মস্তিষ্ককে বাদ দিয়ে কেবল হৃদয়ের দিকে মনোনিবেশ করার বিপদকে তুলে ধরেছেন। ১৬৮২ সালে মার্গারিট মেরি লেন্ট এর সূচনায় জেসাসের আবির্ভাবের প্রসঙ্গ স্মরণ করেছেন:

সমস্ত শরীর ক্ষত, রক্তাক্ত। তাঁর পবিত্র রক্ত স্রোতের মতো বেরিয়ে আসছিল চারপাশ থেকে: ‘আমাকে কেউই, বিষণ্ণ ও দুঃখভরা কণ্ঠে বলেছেন তিনি, করুণা করবে না, দয়া দেখাবে না, আমার দুঃখের সঙ্গী হবে না, যে করুণ অবস্থায় পাপীরা আমাকে নামিয়ে এনেছে, বিশেষ করে এই সময়।[৩১]

প্রচণ্ড রকম উত্তেজিত স্নায়ুর মহিলা মার্গারিট-মেরি যৌনতার প্রতি নিজের চরম ঘৃণার কথা স্বীকার গেছেন, খাবারের অসুস্থতায় ভুগেছেন, পবিত্র হৃদয়ের প্রতি নিজের ভালোবাসা দেখাতে মর্ষকামী আচরণ করেছেন, তাঁর আচরণ দেখায়, কেবল হৃদয়ের ধর্ম কীভাবে জটিল হয়ে উঠতে পারে। তাঁর ক্রাইস্ট প্রায়শঃই ইচ্ছাপূরণের অতিরিক্ত কিছু নন, যার পবিত্র হৃদয় যে ভালোবাসা তিনি কখনও পাননি তা পুষিয়ে দেয়: ‘আজীবন তুমি এর প্রিয় শিষ্য থাকবে, এর আনন্দের সামগ্রী ও ইচ্ছার শিকার বলেছেন তাঁকে জেসাস, এটা তোমার দোষ-ত্রুটি শুধরে দেবে, তোমার হয়ে দায়িত্ব পালন করবে।৩২ কেবল মানুষ জেসাসের প্রতি গুরুত্ব আরোপের এরকম ধর্মানুরাগ এক অভিক্ষেপ মাত্র, যা কোনও ক্রিশ্চানকে নিউরোটিক ইগোটিজমে বন্দি করে ফেলে।

আমরা আলোকনের শীতল যুক্তিবাদ ছেড়ে অনেক দূরে এসে পড়েছি, কিন্তু সর্বোত্তম অবস্থায় হৃদয়ের ধর্মের সঙ্গে ডেইজমের একটা যোগসূত্র রয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ, পিয়েটিস্ট হিসাবে কমিগসবার্গে বেড়ে উঠেছিলেন কান্ট, এই লুথারান গোষ্ঠীতে যিযেনদর্কেরও মূল প্রোথিত ছিল। কান্টের প্রস্ত বিত স্বাধীন যুক্তির সীমানায় ধর্ম পিয়েটিস্টদের কর্তৃত্ববাদী চার্চের মতবাদসমূহের মাঝে প্রতিষ্ঠিত প্রত্যাদেশের চেয়ে ‘আত্মার একেবারে গভীরভাবে স্থাপিত ধর্মের অনেক কাছাকাছি। কান্ট যখন তাঁর ধর্ম সম্পর্কে চরম দৃষ্টিভঙ্গির জন্য পরিচিত হয়ে উঠলেন, তখন বলা হয়, তিনি তার পিয়েটিস্ট সেবকদের এই বলে আশ্বস্ত করেছিলেন যে, কেবল বিশ্বাসের জন্য স্থান তৈরি করতে উগমাকে ধ্বংস করেছেন তিনি। জন ওয়েসলি আলোকন মোহিত ছিলেন ও বিশেষভাবে স্বাধীনতার আদর্শের প্রতি সহানুভূতি পোষণ করতেন। বিজ্ঞান ও কারিগরী শিক্ষায় আগ্রহী ছিলেন তিনি, শখ বশতঃ বৈদ্যুতিক পরীক্ষা-নীরিক্ষা চালিয়েছেন এবং মানুষের প্রকৃতি ও প্রগতির সম্ভাবনা নিয়ে আলোকন পর্বের আশাবাদের অংশীদার ছিলেন। আমেরিকান পণ্ডিত অ্যালবার্ট সি.আউটলার দেখিয়েছেন, নতুন হৃদয়ের ধর্ম ও আলোকন পর্বের যুক্তিবাদ, উভয়ই প্রশাসন বিরোধী ছিল এবং উভয়ই বাহ্যিক কর্তকে অবিশ্বাস করেছে; উভয়ই প্রাচীনের বিরুদ্ধে নিজেদের আধুনিকদের কাতারে ফেলেছে, উভয়ই অমানবিকতাকে ঘৃণা করেছে ও জনসেবার প্রতি উৎসাহ দেখিয়েছে। প্রকতৃপক্ষে এমন মনে হয় যেন চরম ধর্মানুরাগ আসলেই ইহুদি ও ক্রিশ্চানদের মাঝে আলোকন পর্বের আদর্শসমূহের শিকড় গেড়ে বসার পথকে প্রশস্ত করেছিল। এই দুটো চরমপন্থী আন্দোলনের মাঝে লক্ষণীয় মিল রয়েছে। এই গোষ্ঠীগুলোর অনেকেই বিভিন্ন ধর্মীয় টাবু বা প্রথা লংঘনের মাধ্যমে সময়ের ব্যাপক পরিবর্তনে সাড়া দিয়েদিল বলে মনে হয়। কেউ কেউ ব্লাসফেমাস হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে: কাউকে নাস্তিক আখ্যা দেওয়া হয়েছে, আবার কারও নেতারা নিজেদের ঈশ্বরের অবতার দাবি করে বসেছেন। এই গোষ্ঠী দুটোর অনেকেরই হাবভাবে মেসিয়ানিক সুর ছিল ও এক সম্পূর্ণ নতুন পৃথিবী আগমন অত্যাসন্ন দাবি করেছে।

১৬৪৯ সালে রাজা প্রথম চার্লসের হত্যাকাণ্ডের পর বিশেষ করে অলিভার ক্রমওয়েলের পিউরিটান সরকারের শাসনামলে ইংল্যান্ডে এক প্রলয়বাদী উত্তেজনার প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছিল। পিউরিটান কর্তৃপক্ষের পক্ষে সেনাবাহিনীর সদস্য ও সাধারণ মানুষের মাঝে দেখা দেওয়া ধর্মীয় উন্মাদনাকে বাগ মানানো কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছিল, এদের অনেকের মাঝেই দৃঢ়বিশ্বাস জেগে উঠেছিল যে, প্রভুর রাজ্য প্রতিষ্ঠার দিন সমাগত। বাইবেলে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ঈশ্বর তাঁর জাতির ওপর আত্মা অবতীর্ণ করবেন ও খোদ ইংল্যান্ডেই আপন রাজ্য স্থাপন করবেন। ১৬২০-এর দশকে নিউ ইংল্যান্ডে বসতি স্থাপনকারী পিউরিটানদের মতো ক্রমওয়েল স্বয়ং যেন একই ধরনের আশা পোষণ করেছিলেন। ১৬৪৯ সালে জেরার্ড উইন্সট্যানলি সারের কবহ্যামে তার কমিউনিটি অভ ‘ডিগার্স প্রতিষ্ঠা করেন, তিনি স্বর্গোদ্যানে যখন আদম চাষ। করেছেন, মানব জাতিকে সেই আদিম অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলেন। তাঁর নতুন সমাজে ব্যক্তিগত সম্পত্তি, শ্ৰেণী বৈষম্য ও মানবীয় কর্তৃত্ব অস্তিত্ব হারাবে। কোয়াকারস–জর্জ ফক্স ও জেমস নায়লর ও তাদের অনুসারীরা-প্রচার করেন যে, সকল নারী-পুরুষ সরাসরি ঈশ্বরের নৈকট্য লাভ করতে পারে। প্রত্যেকের হৃদয়ে এক অন্তস্থঃ আলো আছে, একবার এর সন্ধান পাওয়ার পর পরিচর্যা করা হলে শ্রেণী ও পদমর্যাদা নির্বিশেষে প্রত্যেকে এই পার্থিব জগতেই মুক্তি লাভ করতে পারবে। ফক্স স্বয়ং তার সোসাইটি অভ ফ্রেন্ডস-এর জন্যে শান্তিবাদ, অহিংসা ও চরম সাম্যতার নীতি প্রচার করেছিলেন। প্যারিসবাসীরা বাস্তিলে হানা দেওয়ার প্রায় ১৪০ বছর আগেই ইংল্যান্ডে স্বাধীনতা, সাম্য ও সৌভ্রাতৃত্ববোধের ধারণা জন্ম লাভ করেছিল।

এই নতুন ধর্মীয় চেতনার সবচেয়ে চরম রূপটির সঙ্গে মধ্যযুগের শেষ পাদের ব্রেদরেন অভ দ্য স্পিরিট নামে পরিচিত ধর্মদ্রোহীদের অনেক ক্ষেত্রেই মিল রয়েছে। বৃটিশ ইতিহাসবিদ নরম্যান কন তার দ্য পারসুট অভ দ্য মিলেনিয়াম, রেভুলেশনারি মিলেনারিয়ানস অ্যান্ড মিস্টিক্যাল অ্যানারকিস্ট অভ দ্য মিডল এজেস-এ যেমন ব্যাখ্যা করেছেন, প্রতিপক্ষ ব্রেদরেন-এর বিরুদ্ধে সর্বেশ্বরবাদের অভিযোগ তুলেছিল। তারা এটা বলতে দ্বিধা করেনি যে: ‘সবকিছুই ঈশ্বর, প্রতিটি পাথরে ও মানব দেহের প্রতিটি অঙ্গে ঈশ্বর রয়েছেন, ঠিক ইউক্যারিস্টের রুটির মতো যা সন্দেহাতীত “সৃষ্ট প্রতিটি বস্তুই স্বর্গীয়”।৩৫ এটা ছিল প্লাটিনাসের দর্শনের নব ব্যাখ্যা। দ্য ওয়ান হতে উৎসাহিত সকল বস্তুও চিরন্তন সত্তা, স্বর্গীয়। অস্তিত্বমান সবকিছুই স্বর্গীয় উৎসে ফিরে যেতে চায় ও শেষ পর্যন্ত আবার ঈশ্বরের মাঝে বিলীন হবে: এমনকি ট্রিনিটি তিনটি সত্তাও শেষ অবধি আদি একত্বে বিলীন হবে। এই পৃথিবীতে আপন স্বর্গীয় প্রকৃতির স্বীকৃতির মাধ্যমে মুক্তি অর্জিত হয়। রাইনের কাছে এক কুটিরের সেলে পাওয়া জনৈক ব্রেদরেনের রচিত এক প্রবন্ধে ব্যাখ্যা করা হয়েছে: ‘স্বর্গীয় সত্তা আমার সত্তা আর আমার সত্তাই স্বর্গীয় সত্তা। ব্রেদরেন বারবার ঘোষণা দিয়েছে: প্রতিটি যুক্তিবাদী প্রাণী প্রকৃতি বা স্বভাবগত কারণেই আশীর্বাদ প্রাপ্ত।৬ এটা যতটা দার্শনিক বিশ্বাস তারচেয়ে বেশি মানবীয় সীমাকে অতিক্রম করার আবেগময় আকাক্ষা। স্ট্রাসবর্গের বিশপ যেমন বলেছেন, দেরেনরা বলে স্বভাবগত কারণে তারা ঈশ্বর, কোনওরকম পার্থক্য নেই। তারা বিশ্বাস করে স্বর্গীয় সকল সম্পূর্ণতা রয়েছে তাদের মাঝে, তারা চিরন্তন এবং চিরকালীন।[৩৭]

কন যুক্তি দেখিয়েছেন, ক্রমওয়েলের ইংল্যান্ডের কোয়াকার্স, লেবেলার্স ও র‍্যান্টার্স এর মতো চরমপন্থী গোষ্ঠীগুলো আসলে চতুর্দশ শতকের ধর্মদ্রোহী ফ্রি স্পিরিট গোষ্ঠীটিরই পুনর্জাগরণ ছিল। অবশ্যই এটা সচেতন পুনর্জাগরণ ছিল না, তবে সপ্তদশ শতকের এই উৎসাহীরা স্বাধীনভাবে এক সর্বেশ্বরবাদী দর্শন অর্জন করেছিল যাকে অচিরেই স্পিনোযা আবিস্কৃত দার্শনিক সর্বেশ্বরবাদের জনপ্রিয় ভাষ্য হিসাবে দেখাটা কঠিন। উইনস্ট্যানলি খুব সম্ভব একজন দুয়ে ঈশ্বরের অস্তিত্বে মোটেই বিশ্বাস করতেন না, যদিও তিনি অন্য চরমপন্থীদের মতো-আপন বিশ্বাসকে ধারণাগতভাবে প্রণয়নে অনিচ্ছুক ছিলেন। এইসব বিপ্লবী গোষ্ঠীর কেউই আসলে তারা তাদের মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক জেসাসের নিবেদিত প্রায়শ্চিত্তের কাছে ঋণী থাকার কথা বিশ্বাস করত না। তাদের কাছে জেসাস এমন একজনের উপস্থিতি বোঝায় যিনি গোষ্ঠীর সদস্যদের মাঝে মিশে আছেন, যাকে আসলে পবিত্র আত্মা হতে আলাদা করা যায় না। প্রত্যেকে একথা স্বীকার করেছে, পয়গম্বরত্বই ঈশ্বর লাভের প্রধান উপায় এবং আত্মার কাছে থেকে প্রাপ্ত প্রত্যক্ষ অনুপ্রেরণা প্রতিষ্ঠিত ধর্মগুলোর শিক্ষার চেয়ে শ্রেয়তর। ফক্স তার অনুসারীদের নীরবতার মাঝে ঈশ্বরের প্রতীক্ষা করার শিক্ষা দিয়েছিলেন, যা গ্রিক হেসিচ্যাজম বা মধ্যযুগীয় দার্শনিকদের ভায়া নেগেতির কথা মনে করিয়ে দেয়। ট্রিনিটারি ঈশ্বরের পূর্বতন ধারণা বিলুপ্ত হচ্ছিল: সর্বব্যাপী এই স্বর্গীয় সত্তাকে তিনটি সত্তায় ভাগ করা যায় না। একত্ব ছিল এর মূল সুর, যা বিভিন্ন গোষ্ঠীর একতা ও সাম্যতার নীতির মাঝে ফুটে উঠেছে। ব্রেদরেনদের মতো ব্ল্যান্টার্সদের কেউ কেউ নিজেদের স্বর্গীয় ভেবেছে: কেউ কেউ নিজেকে ক্রাইস্ট বা ঈশ্বরের নতুন অবতার দাবি করেছে। মোসায়াহ হিসাবে তারা এক বিপ্লবাত্মক মতবাদ ও নতুন বিশ্ব ব্যবস্থার কথা প্রচার করেছে। এভাবে প্রেসবিটেরিয়ান সমালোচক টমাস এডওয়াডর্স তার যুক্তিপূর্ণ রচনা গ্রাগ্রায়েনা অর আ ক্যাটালগ অ্যান্ড ডিসকভারি অভ মেনি অভ দ্য এরোটর্স, হেরেসিজ, ব্লাসফেমিজ, অ্যান্ড পারনিশাস প্র্যাকটিসেস অভ দ্য সেক্টারিয়ানস অভ দিস টাইম (১৬৪০) র‍্যান্টার্সদের বিশ্বাসের সার কথা তুলে ধরেছেন;

সৃষ্টির প্রথম প্রত্যেক সৃষ্টিই ঈশ্বর ও প্রতিটি সৃষ্টিই ঈশ্বর, প্রাণ আছে ও শ্বাসপ্রশ্বাস নেয়, এমন প্রতিটি সৃষ্টিই ঈশ্বরের নিকট হতে নির্গত এবং আবার ঈশ্বরে প্রত্যাবর্তন করবে, সাগরের বুকে জলবিন্দুর মতো আবার মিশে যাবে তার সঙ্গে…পবিত্র আত্মায় দীক্ষিত মানুষ ঈশ্বর যেমন সব জানেন, ঠিক সেভাবে সবকিছু জানে, যা এক গভীর রহস্যময়। ব্যাপার…মানুষ যদি অন্তর থেকে জানে যে সে আশীর্বাদ পেয়েছে, যদি সে হত্যা করে বা মাতাল হয়ে পড়ে, ঈশ্বর তার মাঝে পাপ দেখেন না… গোটা পৃথিবীই সাধু, ভালো মানুষের একটা সমাজ থাকা প্রয়োজন ও সাধুদের উচিত সজ্জন এবং এ জাতীয় মানুষের সঙ্গে একই স্থানে বসবাস করা।  

স্পিনোযার মতো র‍্যান্টার্সদের বিরুদ্ধেও নাস্তিক্যবাদের অভিযোগ উঠেছে। তারা তাদের উদারপন্থী বিশ্বাসে স্বেচ্ছায় ক্রিশ্চান টাবু লঙ্ঘন করে ব্লাসফেমাসের মতো দাবি করেছে, ঈশ্বর ও মানুষের মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই। কান্ট বা স্পিনোযার মতো বৈজ্ঞানিক বিমূর্ততা বোঝার ক্ষমতা সবার ছিল না, কিন্তু র‍্যান্টার্সদের আত্ম-পরমানন্দ বা কোয়াকারদের ‘অন্তরের আলোয় বহু শতাব্দী পরে ফরাসি বিপ্লবীদের প্রকাশিত আকাঙ্ক্ষার মিল দেখা যাওয়া সম্ভব। যারা দেবনিচয়ে যুক্তি দেবীকে অধিষ্ঠিত করেছিল।

র্যান্টার্সদের বেশ কয়েকজন নিজেদের মেসায়াহ, ঈশ্বরের পুর্ণাবতার দাবি করেছেন-যিনি এক নতুন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করবেন। তাদের জীবনের যে বিবরণ আমাদের কাছে রয়েছে তাতে কারও কারও ক্ষেত্রে মানসিক বৈকল্যের লক্ষণ দেখা যায়, তা সত্ত্বেও তারা অনুসারীদের একটা দল পেয়েছিলেন, এটা নিঃসন্দেহে সে সময়ের ইংল্যান্ডের আধ্যাত্মিক ও সামাজিক প্রয়োজন মিটিয়েছিল। এভাবেই ১৬৪৬ সালে প্লেগে পরিবারের সদস্যদের হারিয়ে এক সম্মানীয় গৃহস্থ উইলিয়াম ফ্রাঙ্কলিন মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। নিজেকে ঈশ্বর ও ক্রাইস্ট দাবি করে সতীর্থ ক্রিশ্চানদের হতবিহ্বল করে দেন তিনি, পরে অবশ্য নিজের দাবি প্রত্যাহার করে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। তাঁকে পুরোপুরি সুস্থ মনে হলেও স্ত্রীকে ছেড়ে অন্য নারীদের শয্যাসঙ্গী হতে শুরু করেছিলেন তিনি, যাপন করছিলেন নিন্দাহঁ ভিক্ষুকের জীবন। এইসব নারীদের একজন, মেরি গ্যাডবারি দিব্য দর্শন লাভ এবং কণ্ঠস্বর শুনতে শুরু করে এবং ভবিষ্যদ্বাণী করে এক নতুন সামাজিক ব্যবস্থার যা সকল শ্রেণী বৈষম্য দূর করে দেবে। ফ্রাঙ্কলিনকে নিজের প্রভু ও ক্রাইস্ট হিসাবে গ্রহণ করে সে। তারা বেশ উল্লেখযোগ্য সংখ্যক অনুসারী পেয়েছিলেন বলে মনে হয়; কিন্তু ১৬৫০ সালে তাদের গ্রেপ্তার, প্রহার ও ব্রিডওয়েলে কারাবন্দি করা হয়। মোটামুটি প্রায় একই সময়ে জনৈক জন রবিনসও ঈশ্বরের মর্যাদা লাভ করেছিল; নিজেকে পিতা ঈশ্বর দাবি করেছিল সে, তার বিশ্বাস ছিল শিগগিরই তার স্ত্রী জগৎ পরিত্রাতার জন্মও দেবে।

ইতিহাসবিদদের কেউ কেউ রবিনস ও ফ্রাঙ্কলিনদের মতো লোকদের র‍্যান্টার্স হিসাবে মানতে চান না, তাঁরা বলেন, আমরা কেবল প্রতিপক্ষের কাছ থেকেই তাদের কর্মকাণ্ড সম্পর্ক জানতে পারি, যারা হয়তো ধর্মীয় যুক্তির কারণে তাদের বিশ্বাসের বিকৃতি ঘটিয়েছে। কিন্তু জ্যাকব বথিউমলি, রিচার্ড কপিন এবং লরেন্স ক্লার্কসনের মতো উল্লেখযোগ্য র‍্যান্টার্সদের বিবরণ রক্ষা পেয়েছে যেখানে একই রকম জটিল ধারণা দেখা যায় তারাও এক বিপ্লবী সামাজিক বিশ্বাসের প্রচার করেছেন। দ্য লাইট অ্যান্ড দ্য ডার্ক সাইডস অভ গড় (১৬৫০) শীর্ষক নিবন্ধে বথিউমালি এমন ভাষায় ঈশ্বর সম্পর্কে আলোচনা করেছেন যা ঈশ্বর তাঁকে স্মরণকরী মানুষের চোখ, কান আর হাত হয়ে যান-এই সুফী বিশ্বাসের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়; হে ঈশ্বর, তোমাকে কী বলব আমি?’ তিনি জানতে চান। কারণ যদি বলি আমি তোমাকে দেখি, তাহলে সেটা তোমার নিজেকে দেখা ছাড়া আর কিছু না; কারণ আমার মাঝে নিজেকে দেখা ছাড়া তোমাকে দেখার কোনও ক্ষমতা নেই: যদি বলি তোমাকেই জানি, সেটা নিজেকে জানা ছাড়া আর কিছু না।৩৯ যুক্তিবাদীদের মতো ট্রিনিটি মতবাদ প্রত্যাখ্যান করেছেন বথিউমলি; সুফীর মতো করেই একথা বলে ক্রাইস্টের ঐশ্বরিকতায় নিজের বিশ্বাসকে নিয়ন্ত্রিত করেছেন যে, ক্রাইস্ট স্বর্গীয় হলেও মাত্র একজন ব্যক্তিতে ঈশ্বর প্রকাশিত হতে পারেন নাঃ তিনি মানুষ ক্রাইস্টের মাঝে অবস্থানের মতোই প্রকৃত ও বস্তুগতভাবে অন্য মানুষ ও প্রাণীর দেহে অবস্থান করেন। সুস্পষ্ট স্থানীয় কোনও ঈশ্বরের উপাসনা বহুঈশ্বরবাদীতার একটা ধরণ: স্বর্গ কোনও স্থান নয়, বরং ক্রাইস্টের আধ্যাত্মিক উপস্থিতি। বথিউমলি বিশ্বাস করতেন, ঈশ্বরের বাইবেলিয় ধারণা অপর্যাপ্ত: পাপ কোনও কর্ম নয়, বরং একটা অবস্থা, আমাদের স্বর্গীয় প্রকৃতির। ঘাটতি । কিন্তু তারপরেও রহস্যজনকভাবে ঈশ্বর পাপেও উপস্থিত আছেন, যা সোজা কথায় ঈশ্বরের অন্ধকার দিক, আলোর কিঞ্চিৎ অভাব মাত্র। প্রতিপক্ষ বথিউমলিকে নাস্তিক বলে নিন্দা জানিয়েছে, কিন্তু তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ফক্স, ওয়েসলি এবং যিযেনবার্গ চেতনা হতে দূরবর্তী নয়, যদিও বেশ। চাঁছাছোলাভাবে প্রকাশ করা হয়েছে। পরবর্তী সময়ের পিয়েটিস্ট ও মেথডিস্টদের মতো তিনি দূরবর্তী ও অমানবিকভাবে বস্তুনিষ্ঠ হয়ে ওঠা এক ঈশ্বরকে অন্তরীকরণ করার প্রয়াস পেয়েছিলেন ও প্রচলিত মতবাদকে ধর্মীয় অনুভূতিতে পরিবর্তন করতে চেয়েছিলেন। পরবর্তীকালে আলোকন পর্বের দার্শনিক ও হৃদয়ের ধর্মের অনুসারীদের কর্তৃত্বের প্রত্যাখ্যান ও অত্যাবশ্যকীয়ভাবে মানবতার আশাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির অংশীদার ছিলেন।

পাপের পবিত্রতার গভীরভাবে উত্তেজক ও বিদ্রোহী মতবাদ নিয়ে কাজ করছিলেন বথিউমলি। ঈশ্বর যদি সবকিছু হন, পাপ কিছুই নয়-লরেন্স ক্লার্কসন এবং অ্যালাস্টেয়ার-এর মতো র‍্যান্টার্সরা প্রচলিত যৌন আচরণ বিধি লঙ্ঘন বা প্রকাশ্যে মুখখিস্তি ও ব্লাসফেমি করে এই বিষয়টি তুলে ধরার প্রয়াস পেয়েছিলেন। কপ বিশেষত মাতলামী ও ধূমপানের জন্যে বিখ্যাত ছিলেন। র‍্যান্টার হওয়ার পর তিনি স্পষ্টতই দীর্ঘদিন দমিয়ে রাখা ইচ্ছা পূরণ করেছিলেন গালিগালাজ আর মুখখিস্তি করে। আমরা শুনতে পাই, তিনি লন্ডনে এক চার্চের পুলপিটে দাঁড়িয়ে টানা এক ঘন্টা গালিগালাজ করেছিলেন এবং এক ট্যাভার্নের হোস্টেসকে এমন জঘন্য মুখ খারাপ করেছিলেন যে বেচারি পরে কয়েক ঘন্টা ধরে আতঙ্কে কেঁপেছে। এটা মানব জাতির পাপময়তার ওপর অস্বাস্থ্যকর মনোযোগ সম্পন্ন নিপীড়ক পিউরিটান নৈতিকতার প্রতিক্রিয়া হয়ে থাকতে পারে। ফক্স ও তাঁর কোয়াকাররা জোরের সঙ্গে বলেছেন, পাপ কোনভাবেই অনিবার্য ছিল না। তিনি অবশ্যই বন্ধুদের পাপে উৎসাহ দেননি, র‍্যান্টার্সদের উদ্ধৃঙ্খলতাকে তিনি ঘৃণা করতেন, কিন্তু তারও আশাব্যঞ্জক নৃতত্ত্ব প্রচার এবং ভারসাম্য আনতে চেয়েছিলেন। লরেন্স ক্লার্কসন তাঁর রচনা সিঙ্গল আই-তে যুক্তি দিয়েছেন যে, ঈশ্বর যেহেতু সকল বস্তুকে ভালো অবস্থায় সৃষ্টি করেছেন, সেহেতু কেবল মানুষের কল্পনাতেই পাপে’র অবস্থান। ঈশ্বর স্বয়ং বাইবেলে দাবি করেছেন যে, তিনি অন্ধকারকে আলোয় পরিণত করবেন। একেশ্বরবাদীরা সবসময় পাপের বাস্তবতাকে মেনে নিতে অসুবিধার সম্মুখীন হয়ে এসেছে, যদিও অতিন্দ্রীয়বাদীরা আরও অধিকতর হলিস্টিক দর্শন আবিষ্কারের প্রয়াস পেয়েছে। নরউইচের জুলিয়ান বিশ্বাস করতেন যে, পাপ মানানসই ও কোনওভাবে প্রয়োজনীয়। কাব্বালিস্টরা মত দিয়েছিল যে, রহস্যজনকভাবে পাপ ঈশ্বরের মাঝে প্রোথিত। ক্লার্কসন ও কপদের মতো ব্যান্টার্সদের চরম উদারবাদকে একজন ক্রুদ্ধ প্রতিশোধপরায়ণ ঈশ্বরের মাধ্যমে বিশ্বাসীকে আতঙ্কিত করে তোলা নিপীড়ক খৃস্টধর্মকে ঝেড়ে ফেলার প্রয়াস হিসাবে দেখা যেতে পারে। যুক্তিবাদী ও ‘আলোকিত’ ক্রিশ্চানরাও ঈশ্বরকে নিষ্ঠুর কর্তৃত্বময় চরিত্র হিসবে উপস্থাপনকারী ধর্মের সংযোজন ঝেড়ে ফেলার প্রয়াস পাচ্ছিল। একজন কোমলতর উপাস্য আবিষ্কার করতে চেয়েছে তারা।

সামাজিক ইতিহাসবিদগণ উল্লেখ করেছেন যে, পাশ্চাত্যের খৃস্টবাদ এর সময়ান্তরে নিপীড়ক ও সহনশীল চরিত্রে ব্যাপক পরিবর্তনের জন্যে বিশ্ব ধর্মগুলোরা মাঝে অনন্য। তাঁরা আরও উল্লেখ করেছেন, নিপীড়ক পর্যায়গুলো সাধারণত ধর্মীয় পূনর্জাগরণের সঙ্গে মিশে গেছে। আলোকন পর্বের অধিকতর নৈতিক আবহাওয়া পশ্চিমের বহু স্থানে ভিক্টোরিয়ান কালের নিপীড়নের ফলে পরিবর্তিত হয়েছে, যার সঙ্গে অধিকতর মৌলবাদী ধার্মিকতার জোয়ার যোগ হয়। আমাদের নিজস্বকালে আমরা ১৯৬০-এর দশকের সহনশীল সমাজকে ১৯৮০র দশকের অধিকতর পিউরিটান নৈতিকতার পথ খুলে দিতে দেখেছি যা

পশ্চিমে খৃস্টীয় মৌলবাদের উত্থানেরও সমসাময়িক। এটা একটা জটিল ঘটনা, সন্দেহ নেই এর পেছনে একাধিক কারণ ক্রিয়াশীল ছিল। অবশ্য এর সঙ্গে ঈশ্বরের ধারণাকে যুক্ত করার প্রলোভন জাগে, পশ্চিমবাসীরা যাকে অসুবিধাপূর্ণ হিসাবে আবিষ্কার করেছে। মধ্যযুগের ধর্মবিদ ও অতিন্দ্রীয়বাদীরা হয়তো একজন প্রেমময় ঈশ্বরের প্রচারণা চালিয়েছিলেন, কিন্তু ক্যাথেড্রলের দরজায় দরজায় আঁকা আতঙ্ক জাগানো অভিশপ্তদের ওপর অত্যাচারের ছবি ভিন্ন কাহিনী বলে। আমরা যেমন দেখেছি, পাশ্চাত্যে প্রায়শঃই ঈশ্বর অনুভূতি অন্ধকার ও সগ্রাম দিয়ে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করা হয়েছে। ক্লার্কসন ও কপের মতো র‍্যান্টার্সরা যখন ক্রিশ্চান টাবু অস্বীকার করছিলেন, পাপের পবিত্রতার ঘোষণা দিচ্ছিলেন, ঠিক সেই একই সময়ে ইউরোপের নানান দেশে উইচক্র্যাফটের উন্মাদনা বয়ে যাচ্ছিল। ক্রমওয়েলের ইংল্যান্ডের চরমপন্থী ক্রিশ্চানরা অতি চাহিদা সম্পন্ন ও ভয় জাগানো একজন ঈশ্বর ও ধর্মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করছিল।

সপ্তম ও অষ্টম শতাব্দীতে পশ্চিমে আবির্ভূত নব-জন্ম লাভের খৃস্টধর্ম প্রায়শঃই অস্বাস্থ্যকর ছিল। এর বৈশিষ্ট্য ছিল প্রবল এবং কখনও কখনও বিপজ্জনক আবেগ ও পরিবর্তন। ১৭৩০-এর দশকে গোটা নিউ ইংল্যান্ডে ছড়িয়ে পড়া গ্রেট অ্যাওয়াকেনিং নামে পরিচিত ধর্মীয় উন্মাদনার মাঝে এ ব্যাপারটি দেখতে পাই আমরা। ওয়েসলির অনুসারী ও সহযোগী জর্জ হুইটফিন্ডের ইভেস্ক্রিলিক্যাল প্রচারণা ও ইয়েলে শিক্ষাপ্রাপ্ত জোনাথান এডওয়ার্ডসের (১৭০৩-৫৮) অনলবর্ষী সারমনে এটা অনুপ্রাণিত হয়েছিল। এডওয়ার্ডস তাঁর রচনায় এই জাগরণের বিবরণ দিয়েছেন কানেক্টিকাটের নর্দামটনে ঈশ্বরের বিস্ময়কর লীলার বিশ্বস্ত বিবরণ। সেখানে তিনি তার প্যারিশনারদের সাধারণের চেয়ে ভিন্ন কিছু নয় বলে উল্লেখ্য করেন; তারা নম্র, সুশৃঙ্খল এবং ভালো; কিন্তু ধর্মীয় উৎসাহ-উদ্দীপনাহীন। অন্যান্য কলোনির নারী-পুরুষের তুলনায় ভালো বা খারাপ কোনওটাই নয়। কিন্তু ১৯৩৪ সালে দুই তরুণের আকস্মিক অপমৃত্যু ঘটে। এঘটনায় (পরে মনে হয়েছে স্বয়ং এডওয়ার্ডসের ভয়ঙ্কর কথাবার্তায় উস্কানি পেয়ে) গোটা শহর ধর্মীয় উন্মাদনায় মত্ত হয়ে উঠেছিল। মানুষ ধর্ম ছাড়া অন্য আর কিছুই আলোচনা করতে পারছিল না। কাজকর্ম ফেলে সারাদিন বাইবেল পড়ে কাটাচ্ছিল তারা। মোটামুটি ছয় মাসের মধ্যেই সমাজের সকল শ্রেণীর মানুষের ভেতর প্রায় তিন শো নবজন্মলাভকারী নবদীক্ষিত ক্রিশ্চান দেখা গেছে: কখনও কখনও সপ্তাহে পাঁচজনকেও ধর্মান্তরিত হতে দেখা গেছে। এই উন্মাদনাকে এডওয়ার্ডস স্বয়ং ঈশ্বরের প্রত্যক্ষ ভূমিকা হিসাবে দেখেছিলেন; একেবারেই আক্ষরিক অর্থেই কথাটা প্রয়োগ করেছেন তিনি, এটা সামান্য ধার্মিকতার facon de Parler ছিল। না। বারবার তিনি যেমন বলেছেন, নিউ ইংল্যান্ডে ঈশ্বর যেন তাঁর প্রচলিত ভূমিকা ছেড়ে সরে এসে এখানকার মানুষকে অবিশ্বাস্য ও অলৌকিক উপায়ে পরিচালিত করছেন। অবশ্য এটা বলা প্রয়োজন, পবিত্র আত্মা কখনও কখনও অনেকটা হিস্টেরিক্যাল লক্ষণের ভেতর দিয়ে নিজেকে প্রকাশ করে থাকেন। অনেক সময়, আমাদের বলছেন এডওয়ার্ডস, তারা ঈশ্বরের ভয়ে একবারে ‘ভেঙে পড়ে আর ঈশ্বরের অনুকম্পার অতীত পাপবোধের চাপে অতল গহবরে হারিয়ে যায়। এরপর আসবে একই রকম পরম উল্লাসের পালা, যখন তাদের মনে আকস্মিক মুক্তি লাভের বোধ জাগে। তারা একই সময় প্রবল হাসিতে ভেঙে পড়ত; প্রায়ই বানের জলের মতো অশ্রু বর্ষিত হতো, হাসির সঙ্গে মিশে যেত সশব্দ কান্না। কখনও কখনও সশব্দে কেঁদে ওঠা ঠেকাতে পারত না তারা। সকল প্রধান ধর্মের অতিন্দ্রীয়বাদীরা শান্ত নিয়ন্ত্রণকে প্রকৃত আলোকনের প্রধান বৈশিষ্ট্য হিসাবে বিশ্বাস করেছে, আমরা তা থেকে অনেক দূরে সরে এসেছি।

এই প্রবল আবেগগত পরিবর্তন আমেরিকার ধর্মীয় জাগরণের বৈশিষ্ট্য রয়ে গিয়েছিল। এটা ছিল যন্ত্রণা আর প্রয়াসের প্রবল খিচুনী যুক্ত এক নতুন জন্ম, ঈশ্বরের সঙ্গে সম্রামের নতুন পাশ্চাত্য রূপ। এই অ্যাওয়াকেনিং সংক্রামক রোগের মতো আশপাশের শহর-গ্রামগুলোয় ছড়িয়ে পড়েছিল, ঠিক যেমন বহু শতাব্দী পরে ধর্মীয় উন্মাদনার আঁচে স্বভাবগতভাবে দগ্ধ নিউইয়র্ক রাজ্যকে ‘বানর্ড-ওভার ডিস্ট্রিক্ট’ বলে অভিহিত করা হবে। এই মহিমান্বিত অবস্থায়। এডওয়ার্ডস লক্ষ করেছেন যে, তাঁর নবদীক্ষিতরা সমগ্র দুনিয়াকেই আনন্দময়। অনুভব করেছে। নিজেদের তারা বাইবেল থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারত না। অনেক সময় নাওয়া-খাওয়া ভুলে যেত। সম্ভবত এখানে বিস্ময়ের কিছু নেই যে, মোটামুটি দুই বছর পর তাদের আবেগ প্রশমিত হয়ে যায়, যখন এডওয়ার্ডস লক্ষ করেন, ঈশ্বরের আত্মার আমাদের ছেড়ে ক্রমশঃ চলে যাওয়াটা বেশ যৌক্তিকভাবেই সূচিত হয়েছে। তিনি কিন্তু রূপকার্থে বলছিলেন না একথা: ধর্মীয় বিষয়ে এডওয়ার্ডস খাঁটি পশ্চিমা অক্ষরবাদী ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করেছেন, অ্যাওয়াকেনিং প্রকৃতই তাদের মাঝে ঈশ্বরের প্রত্যক্ষ প্রকাশ ছিল, প্রথম পেন্টেকস্টে পবিত্র আত্মার বাস্তব কর্মকাণ্ডের মতো। ঈশ্বর যখন আগমনের মতোই আচমকা সরে গেলেন, আবার তার স্থান আক্ষরিক অর্থেই স্যাটান দখল করে নিল। পরম আনন্দের পর এল আত্মহননের মতো হতাশা। প্রথম এক বেচারা নিজের গলা কেটে আত্মহত্যা করল। এই ঘটনার পর এ শহর এবং অন্যান্য শহরের জনতার মাঝে যেন প্রবল ধারণার সৃষ্টি হলো, এই লোককে অনুসরণ করার জন্যে কেউ যেন তাদের ওপর চাপ প্রয়োগ করছিল। অনেকের মনে এমন প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছিল যে, যেন কেউ তাদের বলছিল, ‘গলা কেটে ফেল, এখনই সুবর্ণ সুযোগ। এখনই! দুজন লোক ‘অদ্ভুত, উদ্দীপনাময় বিভ্রান্তির কারণে উন্মাদ হয়ে যায়। এরপর আর কেউ ধর্মান্তরিত হয়নি। তবে যারা এই অভিজ্ঞতার পরে বেঁচে ছিল তারা অ্যাওয়াকেনিংয়ের আগের সময়ের তুলনায় আরও শান্ত ও প্রফুল্ল হয়ে উঠেছিল, কিংবা এডওয়ার্ডস তেমনটিই আমাদের বিশ্বাস করাতে চান। এমন অস্বাভাবিকতা ও দূরবস্থার মধ্যে নিজেকে প্রকাশকারী জোনাথান এডওয়ার্ডস ও তার ধর্মান্ত রিতদের ঈশ্বর বরাবরের মতোই ভীতিকর; মানুষের সঙ্গে আচরণে স্বেচ্ছাচারী। আবেগের অস্বাভাবিক পরিবর্তন, উন্মাদময় আনন্দ ও গম্ভীর হতাশা দেখায় যে, আমেরিকার বহু কম সুবিধাপ্রাপ্ত ব্যক্তি ঈশ্বরের সঙ্গে মিলিত হওয়ার ক্ষেত্রে ভারসাম্য বজায় রাখতে অসুবিধার সম্মুখীন হয়েছে। এটা নিউটনের বৈজ্ঞানিক ধর্মে আমরা যেমন দেখি পৃথিবীর ঘটনাবলীর জন্যে, তা যত অদ্ভুতই হোক, ঈশ্বর প্রত্যক্ষভাবে দায়ী, এই বিশ্বাসকে তুলে ধরে।

এই প্রবল ও অযৌক্তিক ধর্মানুরাগকে ফাউন্ডিং ফাদারদের পরীক্ষিত স্থৈর্যের সঙ্গে মেলানো কঠিন। এডওয়ার্ডসের বহু প্রতিপক্ষ ছিলেন যারা অওয়াকেনিংয়ের তীব্র সমালোচনা করেছেন। উদারপন্থীদের দাবি মানুষের জীবনে প্রবল আলোড়নের ভেতর দিয়ে নয় ঈশ্বর কেবল যৌক্তিকভাবেই নিজেকে প্রকাশ করতে পারেন। কিন্তু রিলিজিয়ন অ্যান্ড দ্য আমেরিকান মাইন্ড: ফ্রম দ্য গ্রেট অ্যাওয়াকেনিং টু দ্য রিভোলুশন-এ অ্যালান হেইমার্ট যুক্তি দেখিয়েছেন, অ্যাওয়াকেনিং-এর নব-জন্ম সুখ অনুসন্ধানের আলোকন পর্বের আদর্শের ইভেস্ক্রিলিক্যালরূপ। এটা এমন এক জগৎ হতে অস্তিত্বের মুক্তি তুলে ধরেছে, যেখানে সবকিছুই শক্তিশালী অনুভূতি জাগিয়ে তোলে। দরিদ্র উপনিবেশগুলোয় অ্যাওয়াকেনিং-এর ব্যাপারটা ঘটেছিল, যেসব স্থানে অনন্য আলোকনপর্বের আশাবাদ সত্ত্বেও মানুষের মাঝে এ জগতে সুখ লাভের প্রত্যাশা ছিল সামান্যই। পুনর্জন্ম লাভের অনুভূতি, এডওয়ার্ডস যুক্তি দেখিয়েছেন, আনন্দের এক ধরনের অনুভূতি ও সুন্দরের বোধ জাগিয়ে তোলে যা যে কোনও স্বাভাবিক অনুভূতির চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন। সুতরাং অ্যাওয়াকিং-এ এক ঈশ্বর-অনুভূতি নতুন বিশ্বের আলোকন উপনিবেশ সমূহের কতিপয় সফল ব্যক্তির চেয়ে বেশিসংখ্যক মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছিল। আমাদের আরও স্মরণ করা দরকার যে, দার্শনিক আলোকনও আধা-ধর্মীয় মুক্তি হিসাবে অনুভূত হয়েছিল। Eclaircissement ও Aufklarung শব্দ দুটোর সুনির্দিষ্ট ধর্মীয় দ্যোতনা রয়েছে। জোনাথান এডওয়ার্ডসের ঈশ্বর ১৭৭৫ সালের বিপ্লবী উদ্দীপনায়ও অবদান রেখেছিলেন। পুনর্জাগরণবাদীদের চোখে ব্রিটেন পিউরিটান বিপ্লবের সময় অত্যুজ্জল নতুন আলো হারিয়ে ফেলেছিল, সেটাকে পতনোমুখ ও পাশ্চাদগামী মনে হচ্ছিল। এডওয়ার্ডস ও তার সহকর্মীরাই নিম্নশ্রেণীর আমেরিকানদের বিপ্লবের পথে প্রথম পদক্ষেপ নিতে উদ্দীপিত করেছিলেন। এডওয়ার্ডসের ধর্মের অত্যাবশ্যক উপাদান ছিল মেসিয়ানিজম; মানবীয় প্রয়াস নতুন পৃথিবীতে অর্জনযোগ্য ও অত্যাসন্ন ঈশ্বরের রাজত্বের আগমন তরান্বিত করবে। খোদ অ্যাওয়াকেনিং (এর করুণ পরিসমাপ্তি সত্ত্বেও) মানুষকে বিশ্বাস করিয়েছিল যে, বাইবেলে বর্ণিত প্রক্রিয়া ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। ঈশ্বর এ ক্ষেত্রে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ। এডওয়ার্ডস ট্রিনিটির মতবাদের একটি রাজনৈতিক ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন: পুত্র হলেন ঈশ্বরের উপলব্ধি দ্বারা সৃষ্ট উপাস্য এবং এভাবে নতুন কমনওয়েলথের নীল নকশা; আত্মা হচ্ছেন উপাস্যের কার্যে বর্তমান থাকা’ যিনি যথাসময়ে এই মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করবেন।২৫ আমেরিকার নতুন বিশ্বে এভাবে পৃথিবীর বুকেই ঈশ্বর তাঁর সম্পূর্ণতা চিন্তা করতে পারবেন। খোদ সমাজ ঈশ্বরের মহত্ত্ব (Excellencies) প্রকাশ করবে। নিউ ইংল্যান্ড হবে ‘পর্বতচূড়ার শহর’, জেন্টাইলদের জন্যে আলোকবর্তিকা, জিহোবার প্রতাপ যেখানে জ্বলজ্বল করবে, সবার জন্যে আকর্ষণীয় ও তীব্র হয়ে উঠবে। সুতরাং, এডওয়ার্ডসের ঈশ্বর এভাবে কমনওয়েলথে মূর্ত হয়ে উঠবেন; ক্রাইস্টকে এক আদর্শ সমাজে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকা অবস্থায় দেখা হয়েছে।

অন্য কালভিনিস্টরা প্রগতির যানে আসীন ছিল; আমেরিকার শিক্ষাক্রমে রসায়ন অর্ন্তভুক্ত করেছিল তারা; এডওয়ার্ডসের দৌহিত্র টিমোথি ডিউইট বৈজ্ঞানিক জ্ঞানকে মানুষের চরম সম্পূর্ণতার ক্ষেত্রে পূর্বশর্ত হিসাবে দেখেছেন। আমেরিকার উদারপন্থীরা যেমনটি অনেক সময় কল্পনা করেছে, তাদের ঈশ্বর সর্বতোভাবে জ্ঞানার্জনে বাধাদানকারী ছিলেন না। কালভিনিস্টরা নিউটনের সৃষ্টিতত্ত্ব অপছন্দ করত, একবার কর্মধারা শুরু হয়ে যাবার পর এখানে ঈশ্বরের আর তেমন কিছু করণীয় ছিল না। আমরা যেমন দেখেছি, পৃথিবীতে আক্ষরিক অর্থে সক্রিয় একজন ঈশ্বরের পক্ষে ছিল তারা। তাদের পূর্ব নির্ধারিত নিয়তির মতবাদ দেখিয়েছে, তাদের দৃষ্টিতে মর্ত্যে ভালো-মন্দ যাই ঘটুক সেগুলোর জন্যে ঈশ্বরই আসলে দায়ী। এর অর্থ বিজ্ঞান কেবল সেই ঈশ্বরকে প্রকাশ করতে পারবে, সৃষ্ট বস্তুর কর্মকাণ্ডে যাঁকে অনুভব করা যায়-প্রাকৃতিক, সামাজিক, ভৌত ও আধ্যাত্মিক-এমনকি যেসব ঘটনা আকস্মিক বা আপতিক মনে হয় সেসবের ভেতরও। কোনও কোনও ক্ষেত্রে কালভিনিস্টিরা চিন্তা ভাবনার দিক দিয়ে উদারপন্থীদের চেয়ে বেশি এগিয়ে ছিল, যারা তাদের পুনর্জাগরণবাদের বিরোধিতা করত এবং অনুমান নির্ভর,’ জটিল ধারণার বদলে সহজ বিশ্বাসের পক্ষপাতি ছিল; এ ধরণের ধারণা পুনর্জাগরণবাদী হুইটফিল্ড এডওয়ার্ডসের প্রচারণায় থাকায় তারা অস্বতি বোধ করেছে। অ্যালান হেইমার্ট যুক্তি দেখিয়েছেন, আমেরিকার সমাজে অ্যান্টিইন্টেলেকচুয়ালিজমের মূল কালভিনিস্ট ও ইভেঙিলিকালদের সঙ্গে ছিল না হয়তো, বরং অধিকতর যুক্তিবাদী চার্লস চন্সি বা স্যামুয়েল কুইন্সি-র মতো বস্টনিয়দের সঙ্গেই বেশি। সম্পর্কিত, যারা ঈশ্বর সম্পর্কিত সেই ধারণা পছন্দ করতেন যেগুলো বেশি সহজ ও স্পষ্ট।

ইহুদিবাদেও লক্ষণীয়ভাবে একই ধরনের কিছু অগ্রগতি ঘটেছিল যা ইহুদিদের ভেতর যুক্তিবাদী আদর্শের বিস্তার লাভের পথ তৈরি করে ও অনেককেই ইউরোপের জেন্টাইল অধিবাসীদের সাথে মিশে যেতে সক্ষম করে তোলে। প্রলয়ের বছর ১৬৬৬ সালে জনৈক ইহুদি মেসায়াহ ঘোষণা দেন যে মুক্তি একেবারে কাছে এসে পড়েছে। সারা বিশ্বের ইহুদিরা তার দাবি আনন্দের সঙ্গে নেয়। ১৬২৬ সালে মন্দির ধ্বংসের বার্ষিকীতে এশিয়া মাইনরের স্মিরনায়। এক সম্পদশালী সেফার্দিক ইহুদি পরিবারে শ্যাব্বেতাই যেভি জন্ম নেন। বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে তার ভেতর এমন একটা প্রবণতা গড়ে উঠেছিল আজকের দিনে যাকে আমরা হয়তো ম্যানিক ডিপ্রেসিভ’ হিসাবে শনাক্ত করতাম। মাঝে মাঝে গম্ভীর হতাশায় ডুবে যেতেন তিনি, তখন সংসার ত্যাগ করে বিচ্ছিন্ন জীবন যাপন করতেন। বিষণ্ণতার পর আসত এক রকম আনন্দ, যা ছিল মোহাবেশের কাছাকাছি। এইসব ‘উন্মাদকালীন সময়ে মাঝে মাঝে তিনি স্বেচ্ছায় ও দর্শনীয়ভাবে মোজেসের আইন ভঙ্গ করতেন প্রকাশ্যে নিষিদ্ধ খাদ্য খেতেন, ঈশ্বরের পবিত্র নাম উচ্চারণ করতেন আর এক বিশেষ প্রত্যাদেশের মাধ্যমে এমনটি করার নির্দেশ পেয়েছেন বলে দাবি করতেন। তার বিশ্বাস ছিল তিনিই দীর্ঘ প্রতীক্ষিত মেসায়াহ। র‍্যাবাইরা শেষ পর্যন্ত সহ্য করতে না পেরে ১৬৫৬ সালে শ্যাব্বেইকে শহর থেকে বহিষ্কার করেন। এরপর অটোমান সাম্রাজ্যে ইহুদি জনগোষ্ঠীর মাঝে ভবঘুরে হয়ে যান তিনি। ইস্তাম্বুলে থাকার সময় এমনি এক উন্মাদনা কালে তোরাহ্ বাতিল ঘোষণা দিয়ে বসেন, চিৎকার করে বলেন, “হে আমাদের প্রভু, আমাদের ঈশ্বর, তুমি আশীর্বাদ প্রাপ্ত, যিনি নিষিদ্ধকে সিদ্ধ করেছেন! কায়রোতে একহিলাকে বিয়ে করে আলোড়ন সৃষ্টি করেন তিনি, এই নারী ১৯৪৮ সালে পোলান্ডে সংঘটিত হত্যালীলা এড়িয়ে পালিয়ে ইস্তাম্বুলে এসে বেশ্যাবৃত্তি করছিল। ১৬৬২ সালে জেরুজালেমের উদ্দেশে যাত্রা করেন শ্যাব্বেই: এই সময় বিষণ্ণ কাল অতিক্রম করছিলেন তিনি; তাঁর মনে দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, নির্ঘাৎ দুরাত্মা ভর করেছে তার ওপর। প্যালেস্তাইনে নাথান নামে এক তরুণ শিক্ষিত র‍্যাবাইয়ের কথা জানতে পারেন তিনি, এই র‍্যাবাই দক্ষ এক্সরসিস্ট ছিলেন, গাযায় তার বাড়ির খোঁজে বেড়িয়ে পড়েন শ্যাতোই।

শ্যাব্বেইয়ের মতো নাথানও ইসাক লুরিয়ার কাব্বালাহ পাঠ করেছিলেন। স্মিরনা থেকে আগত অসুস্থ ইহুদির সঙ্গে দেখা হওয়ার পর লক্ষণ দেখে তাঁকে জানালেন, মোটেই দুরাত্মার আসর হয়নিঃ তাঁর গম্ভীর হতাশাই প্রমাণ করে যে তিনি প্রকৃতই মেসায়াহ। যখন তিনি এইসব গভীরতায় অবতরণ করেন, তখন ‘অপর দিকে’র অশুভ শক্তির সঙ্গে সংঘর্ষ হতে থাকে তাঁর, যার ফলে কেলিপদের অঞ্চলে স্বর্গীয় লিঙ্গ নির্গত হয়, যা কেবল স্বয়ং মেসায়াহ উদ্ধার করতে পারেন। ইসরায়েলের চূড়ান্ত মুক্তি অর্জনের আগে শ্যাব্বেইয়ের নরকে নামার এক মিশন রয়েছে। শুরুতে শ্যাব্বেইয়ের এসবের প্রতি আগ্রহ ছিল না, কিন্তু নাথানের বাকচাতুর্য শেষ পর্যন্ত তাঁকে পরাস্ত করে। ৩১মে ১৬৬৫ তারিখে আকস্মিকভাবে এক উন্মাদ আনন্দে আক্রান্ত হন তিনি এবং নাথানের প্ররোচনায় নিজের মেসিয়ানিক মিশনের ঘোষণা দেন। নেতৃস্থানীয় র‍্যাবাইগণ এসবকে বিপজ্জনক পাগলামি বলে নাকচ করে দেন। কিন্তু বহু ইহুদি শ্যাব্বেইয়ের চারপাশে ভিড় জমায়; অচিরেই পুনর্গঠিতব্য ইসরায়েল গোত্রসমূহের বিচারক হবার জন্যে বারজন অনুসারীকে বেছে নেন শ্যাব্বেতাই। এই সুখবর ইতালি, হল্যান্ড, জার্মানি ও পোল্যান্ডের পাশাপাশি অটোমান সাম্রাজ্যের বিভিন্ন নগরে চিঠি লিখে জানিয়ে দেন নাথান। মেসিয়ানিক উত্তেজনা দাবানলের মতো সারা ইহুদি বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। শত শত বছরের নিপীড়ন-নির্যাতন আর সমাজচ্যুতি ইউরোপের মূল স্রোতধারা হতে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল ইহুদিদের। এই অস্বাস্থ্যকর অবস্থা বহু ইহুদির মনে এ বিশ্বাস জাগিয়ে তুলেছিল যে পৃথিবীর ভবিষ্যৎ কেবল ইহুদিদের ওপর নির্ভর করছে। স্পেনীয় ইহুদিদের উত্তরসূরি সেফার্দিরা লুরিয়ার কাব্বালাহকে অন্তর দিয়ে গ্রহণ করেছিল; অনেকেই প্রলয় দিবস অত্যাসন্ন বলে বিশ্বাস করেছিল। এসবই শ্যাব্বেইয়ের কাল্টকে সহযোগিতা যুগিয়েছে। ইহুদিদের ইতিহাস জুড়ে বহু মেসায়ার দাবিদার ছিল, কিন্তু তাদের কেউই এরকম সমর্থন আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়নি। শ্যাব্বেইয়ের বিপক্ষে যাদের অবস্থান ছিল তাদের পক্ষে মুখ খোলা বিপজ্জনক হয়ে পড়েছিল। সমাজের সকল স্তরেই তাঁর সমর্থক ছিল; ধনী-দরিদ্র, শিক্ষিত-শিক্ষিত। প্ল্যামফ্লেট আর সংবাদপত্র ইংরেজি, ডাচ, জার্মান ও ইতালিয় ভাষায় আনন্দ সংবাদ ছড়িয়ে দিয়েছিল। পোল্যান্ড ও লিথুয়ানিয়ায় তার সম্মানে গণমিছিল বের হয়েছে। অটোমান সাম্রাজ্যে পয়গম্বররা রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে দিব্যদর্শনে শ্যাব্বেইকে সিংহাসনে আসীন দেখার বর্ণনা দিয়ে বেড়িয়েছেন। সকল কাজকর্ম বন্ধ হয়ে গেল; অশুভ লক্ষণের মতো ইহুদিরা সাব্বাথ প্রার্থনা থেকে সুলতানের নাম বাদ দিয়ে শ্যাব্বেইয়ের নাম জুড়ে দিল। শেষমেষ ১৬৬৬ সালের জানুয়ারি মাসে। শ্যাব্বেতাই ইস্তাম্বুলে পৌঁছলে তাঁকে বিদ্রোহী হিসাবে গ্রেপ্তার করে গ্যালিপলির কারাগারে আটক করা হয়।

শত শত বছরের নিপীড়ন, নির্বাসন ও অপমানের পর আশার সঞ্চার হয়েছিল। পৃথিবী জুড়ে ইহুদিরা এমন এক অভ্যন্তরীণ মুক্তি আর স্বাধীনতার বোধে ভরে উঠেছিল যা কাব্বালিস্টরা সেফিরদের রহস্যময় জগৎ নিয়ে ধ্যানে মগ্ন হয়ে কয়েক মুহূর্তের জন্যে যে মোহাবিষ্টতার অনুভূতি অর্জন করত তার মতো ছিল। মুক্তির অভিজ্ঞতাটি এখন আর মুষ্টিমেয় সুবিধাপ্রাপ্তদের একচেটিয়া অধিকারভুক্ত রইল না, বরং সাধারণ মানুষের সম্পত্তিতে পরিণত হয়েছে । প্রথমবারের মতো ইহুদির মনে বোধ জেগেছিল যে, তাদের জীবনের একটা। মূল্য আছে; প্রায়শ্চিত্ত বা মুক্তি অর্জন এখন আর ভবিষ্যতের অস্পষ্ট কোনও ব্যাপার নয়, বরং বর্তমানেই তা উপস্থিত ও বাস্তব। মুক্তি এসে গিয়েছিল। আকস্মিক এই পরিবর্তন অনেপনীয় প্রভাব বিস্তার করে। গোটা ইহুদি সম্প্রদায়ের নজর আবদ্ধ হয়েছিল গ্যালিপলির দিকে যেখানে আটককারীর ওপরও প্রভাব বিস্তার করেছিলেন শ্যাব্বেতাই। তুর্কী উযির বেশ আরাম আয়েসেই রাখার ব্যবস্থা করেছিলেন তাঁকে। শ্যাব্বেতাই তাঁর লেখা চিঠিপত্রে ‘আমি তোমাদের প্রভু ঈশ্বর শ্যাব্বেতাই যেভি’ লিখে স্বাক্ষর শুরু করেছিলেন। কিন্তু তাঁকে যখন বিচারের জন্যে ফের ইস্তাম্বুলে ফিরিয়ে আনা হলো, ফের বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হয়ে পড়লেন তিনি। সুলতান তাঁকে ইসলাম বা মৃত্যুদণ্ডের যে কোনও একটি বেছে নেওয়ার সুযোগ দিলেন: শ্যাব্বতাই ইসলাম গ্রহণ করলেন; অবিলম্বে মুক্তি দেওয়া হলো তাকে। রাজকীয় ভাতা দেওয়া হয়েছিল তাঁকে; দৃশ্যতঃ বিশ্বস্ত মুসলিম হিসাবেই ১৭ সেপ্টেম্বর, ১৬৭৬ তারিখে তিনি মারা যান।

এই ভয়ঙ্কর সংবাদে স্বভাবতই তার সমর্থকরা দিশাহারা হয়ে পড়েছিল, যাদের অনেকেই নিমেষে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। র‍্যাবাইগণ পৃথিবীর বুক থেকে তাঁর স্মৃতি মুছে ফেলার চেষ্টা করেছেন: শ্যাব্বেতাই সম্পর্কে যেখানে যত চিঠি, প্যামফ্লেট বা রচনা উদ্ধার করা গেছে সব ধ্বংস করে ফেলেন তারা। আজও বহু ইহুদি এই মেসিয়ানিক বিপর্যয় নিয়ে বিব্রত বোধ করে। এর সঙ্গে মানিয়ে উঠতে কষ্ট বোধ করে। র‍্যাবাই ও যুক্তিবাদী এ দুই দলই সমানভাবে এর তাৎপর্যকে খাটো করে দেখিয়েছেন। অবশ্য সাম্প্রতিককালে পণ্ডিতগণ এই বিচিত্র ঘটনার অর্থ ও অধিকতর তাৎপর্যময় ভবিষ্যৎ ফল উপলব্ধি করার প্রয়াসে প্রয়াত গারশম শোলেমের পথ অনুসরণ করেছেন। বিস্ময়কর মনে হতে পারে, কিন্তু শ্যাব্বেইয়ের ধর্ম ত্যাগের কেলেঙ্কারী সত্ত্বেও বহু ইহুদি মেসায়াহর অনুগত রয়ে গিয়েছিল। মুক্তি লাভের অনুভূতি এতটাই গভীর ছিল যে, তারা বিশ্বাসই করতে পারেনি ঈশ্বর তাদের বিভ্রান্ত হবার অবকাশ দিতে পারেন। এটা ঘটনা ও যুক্তির অগ্রবর্তী স্থান গ্রহণকারী মুক্তি লাভের ধর্মীয় অনুভূতির অন্যতম চমকপ্রদ উদাহরণ। সদ্য প্রাপ্ত আশা ত্যাগ বা ধর্মত্যাগী মেসায়াহর যে কোনও একটি বেছে নিতে গিয়ে সকল শ্রেণীর অবিশ্বাস্য সংখ্যক ইহুদি ইতিহাসের কঠিন সত্য মেনে নিতে অস্বীকার করে। গাযার নাথান বাকি জীবন শ্যাব্বেইয়ের রহস্য প্রচার করে কাটিয়ে দিয়েছিলেন; ইসলাম গ্রহণ করে তিনি (শ্যাব্বেই) অশুভের বিরুদ্ধে আজীবন সংগ্রাম অব্যাহত রেখেছেন। আবার, কেলিপদকে মুক্ত করতে অন্ধকার জগতে অবতরণের উদ্দেশ্যে আপন জনগণের গভীরতম পবিত্রতা লঙ্ঘন করতে বাধ্য হয়েছেন তিনি। তার মিশনের দুঃখজনক ভার বহন করেছেন তিনি; ভেতর থেকেই ঈশ্বরহীনতার জগতকে জয় করতে সর্বনিম্ন গভীরতায় নেমেছেন। তুরস্ক ও গ্রিসে প্রায় দুশো পরিবার শ্যাব্বেইয়ের অনুগত রয়ে যায় তার মৃত্যুর পর। অশুভের বিরুদ্ধে যুদ্ধ অব্যাহত রাখতে তার নজীর অনুসরণের সিদ্ধান্ত নিয়ে ১৬৮৩ সালে গণহারে ইসলাম গ্রহণ করে। তারা গোপনে ইহুদিবাদের প্রতি বিশ্বস্ত থেকে র‍্যাবাইদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার পাশাপাশি পরস্পরের বাড়িতে গোপন সিনাগগে জমায়েতে মিলিত হতে থাকে। ১৬৮৯ সালে তাদের নেতা জ্যাকব কুয়েরিতে মক্কায় হজ পালন করেন এবং মেসায়াহর বিধবা স্ত্রী ঘোষণা দেয় যে, কুয়েরিতেই শ্যাঝেতাই যেভির অবতার। তুরস্কে তখনও দনমেই (ধর্মত্যাগী) একটা ছোট দল ছিল যারা বাইরে বাইরে খাঁটি ইসলামী আচার আচরণ দেখালেও গোপনে প্রবলভাবে ইহুদিবাদ আঁকড়ে ছিল।

অন্য শ্যাব্বতায়িরা অবশ্যই এতটা বাড়াবাড়ি না করে মেসায়াহ্ ও সিনাগগের প্রতি বিশ্বস্ত রয়ে যায়। সময়ে যেমন বিশ্বাস করা হয়েছে, গোপন শ্যান্বেয়িদের সংখ্যা তারচেয়ে বেশি বলেই মনে হয়। উনবিংশ শতাব্দীতে ইহুদিদের অধিকতর উদার রূপ গ্রহণকারী বা যোগদানকারী বহু ইহুদি শ্যাব্বেতিয় পূর্ব-পুরুষ থাকাটাকে লজ্জাকর মনে করেছে, তবে এটা প্রতীয়মান হয় যে, অষ্টাদশ শতকের বহু বিশিষ্ট ব্যাবাই শ্যাব্বেইকে প্রকৃত মেসায়াহ হিসাবে বিশ্বাস করেছেন। শশালেম যুক্তি দেখিয়েছেন, এই মেসিয়ানিজম কখনওই ইহুদিবাদে গণআন্দোলনের রূপ না নিলেও এর সংখ্যাকে খাটো করে। দেখা ঠিক হবে না। ম্যারাননাদের কাছে বিশেষ আবেদন ছিল এর, স্প্যানিশরা জোর করে এদের খৃস্টধর্ম গ্রহণে বাধ্য করলেও এরা শেষ পর্যন্ত আবার ইহুদিবাদে প্রত্যাবর্তন করেছিল। মরক্কো, বলকান অঞ্চল, ইতালি ও লিথুয়ানিয়ায় সেফার্দিম জনগোষ্ঠীর মাঝে শ্যাব্বইবাদ সাড়া জাগিয়েছিল। রেজিওর বেঞ্জামিন কন ও মোদেনার আব্রাহাম রোরিগোর মতো বিশিষ্ট কাব্বালিস্টরা এই আন্দোলনের সঙ্গে গোপন যোগাযোগ বজায় রেখেছিলেন। বালকান অঞ্চল থেকে মেসিয়ানিক গোষ্ঠী পোল্যান্ডের অ্যাশকেনাজিয় ইহুদিদের মাঝে বিস্তৃত হয়, যারা পূর্ব ইউরোপের ক্রমবর্ধমান অ্যান্টিসেমিটিজমের কারণে মনোবল হারিয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছিল। ১৭৫৯ সালে অদ্ভুত ও ভয়ঙ্কর পয়গম্বর। জ্যাকব ফ্রাঙ্কের অনুসারীরা তাদের মেসায়াহর পথ অনুসরণ করে সদলে খৃস্টধর্ম গ্রহণ করে গোপনে ইহুদিবাদের অনুসরণ অব্যাহত রাখে।

শোলেম খৃস্টধর্মের উদ্ভাসিত করা তুলনার কথা বলেছেন। প্রায় ষোল শো বছর আগে ইহুদিদের আরেকটি দল এক কলঙ্কময় মেসায়াহর আশা ছাড়তে পারেনি। এই মেসায়াহ সাধারণ অপরাধীর মতো জেরুজালেমের কারাগারে প্রাণ হারান। সেইন্ট পল যাকে ‘ক্রসের কেলেঙ্কারি’ আখ্যায়িত করেছিলেন। সেটা একজন ধর্মত্যাগী মেসায়াহর কেলেঙ্কারির মতোই হতবুদ্ধিকর ছিল। উভয় ক্ষেত্রেই অনুসারীরা পুরোনো ইহুদিবাদের জায়গায় স্থান করে নেওয়া এক নতুন ধরনের ইহুদিবাদের জন্মের ঘোষণা দিয়েছিল; এক বৈপরীত্যময় বিশ্বাসকে আলিঙ্গন করে তারা। ক্রিশ্চানদের বিশ্বাস, ক্রসের পরাজয় বরণের ভেতর এক নতুন জীবন লাভ ঘটেছে, তেমনি শ্যাব্বেতিয়দেরও বিশ্বাস ছিল, ধর্মত্যাগ এক পবিত্র রহস্য। দুটো গোষ্ঠীই বিশ্বাস করত যে, ফল বহন করার জন্যে গমের বীজকে অবশ্যই মাটিতে পচতে হয়; তাদের বিশ্বাস ছিল, তোরাহর মৃত্যু ঘটেছে; আত্মার নতুন নিয়ম সে জায়গা অধিকার করেছে। উভয়ই ঈশ্বরের ত্রিত্ব ও অবতারণবাদের ধারণা গড়ে তুলেছিল।

সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীর বহু ক্রিশ্চানের মতো শ্যাব্বেতিয়রা বিশ্বাস করত, এক নতুন পৃথিবীর দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আছে তারা। কাব্বালিস্টরা বারবার বলেছে যে, নির্বাসনকালে অস্পষ্ট রয়ে যাওয়া ঈশ্বরের প্রকৃত রহস্য অন্তিমকালে উন্মোচিত হবে। মেসিয়ানিক যুগে বসবাস করার বিশ্বাস লালনকারী শ্যাব্বেতিয়রা ঈশ্বরের প্রচলিত ধারণা ত্যাগে কোনওই দ্বিধা করেনি, এমনকি তার মানে আপাতঃ ব্লাসফেমাস ধর্মতত্ত্ব বেছে নেওয়া হচ্ছে মনে। হলেও। এভাবেই ক্রিস্টান ধর্মতত্ত্ব পাঠ দিয়ে যাত্রা শুরু করা মারানো বংশোদ্ভূত আব্রাহাম কারদাযো (১৭০৬) বিশ্বাস করতেন, পাপের কারণেই সকল ইহুদির ধর্মত্যাগ পূর্ব নির্ধারিত হয়েছিল। এটাই তাদের শাস্তি হওয়ার কথা। কিন্তু ঈশ্বর মেসায়াহকে তাদের পক্ষে চরম আত্মত্যাগের সুযোগ দিয়ে তাদের এই ভয়ঙ্কর নিয়তি হতে রক্ষা করেছেন। তিনি ভীতিকর উপসংহারে পৌঁছেছেন যে, নির্বাসিত থাকা অবস্থায় ইহুদিরা ঈশ্বরের সকল প্রকৃত জ্ঞান বিস্মৃত হয়েছে।

ক্রিশ্চান ও আলোকন পর্বের ডেইটিস্টদের মতো কারদাযো ধর্ম হতে তাঁর দৃষ্টিতে ভ্রান্ত সংযোজনসমূহ বাদ দিয়ে বাইবেলের খাঁটি ধর্মে প্রত্যাবর্তনের প্রয়াস পেয়েছিলেন। স্মরণ করা যেতে পারে, দ্বিতীয় শতাব্দীতে ক্রিশ্চান নাস্তিকরা জেসাস ক্রাইস্টের ‘গোপন ঈশ্বর’কে পৃথিবী সৃষ্টির জন্য সমস্ত ইহুদিদের নিষ্ঠুর ঈশ্বর থেকে আলাদা করে এক ধরনের মেটাফিজিক্যাল অ্যান্টি-সেমিটিজম গড়ে তুলেছিল। কারদাযযা এবার সেই প্রাচীন ধারণা পুনরুজ্জীবিত করলেন তবে উল্টে দিয়ে। তিনি এও শিক্ষা দিয়েছেন যে, ঈশ্বর ছিলেন দুজন: এদের যিনি নিজেকে ইসরায়েলের কাছে প্রকাশ করেছেন আর অপরজন সাধারণ জনগণের ঈশ্বর। প্রত্যেক সভ্যতায় মানুষ ‘আদি কারণে’র অস্তিতের প্রমাণ করেছে: এই উপাস্যের কোনও ধর্মীয় তাৎপর্য ছিল না; তিনি জগৎ সৃষ্টি করেননি, মানব জাতির ব্যাপারে তার কোনও মাথা ব্যাথা ছিল না; সুতরাং তিনি বাইবেলে নিজেকে প্রকাশ করেননি, বাইবেলে কখনও তাঁর নাম উল্লেখ হয়নি। নিজেকে আব্রাহাম, মোজেস ও অন্যান্য পয়গম্বরদের কাছে প্রকাশকারী দ্বিতীয় ঈশ্বর সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের: তিনি শূন্য হতে পৃথিবী বা জগৎ সৃষ্টি করেছেন, ইসরায়েলকে উদ্ধার করেছেন এবং তিনিই এর ঈশ্বর। অবশ্য, নির্বাসিত অবস্থায় সাআ’দিয়া ও মায়মমানিদসের মতো দার্শনিকরা গোয়িমদের, ঘেরাওয়ে থাকায় তাদের কিছু কিছু ধারণা গ্রহণ করেছিলেন। পরিণামে তারা । দুই ঈশ্বরকে গুলিয়ে ফেলে ইহুদিদের শিক্ষা দেন যে, তারা দুজন এক ও অভিন্ন। ফলে ইহুদিরা দার্শনিকদের ঈশ্বরের উপাসনা শুরু করে যেন তিনি তাদের পূর্বপুরুষদের ঈশ্বর।

দুজন ঈশ্বর পারস্পরের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিলেন কীভাবে? ইহুদি একেশ্বরবাদ বাদ না দিয়েই বাড়তি এই ঈশ্বরকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে কারদাযযা একটি ত্রিত্ববাদী ধর্মতত্ত্বের জন্ম দিয়েছিলেন। তিনটি হিপোস্তাসে (অবয়ব) বা পারযুফিম সম্পন্ন একজন গডহেড ছিলেন: এগুলোর প্রথমটির নাম ছিল আতিকা কাদিশা, পবিত্র প্রাচীনজন। ইনি ছিলেন প্রথম কারণ। প্রথমটি হতে উৎসারিত দ্বিতীয় পারযুফ, মালকা কাদিশা নামে আখ্যায়িত; তিনি ছিলেন ইসরায়েলের ঈশ্বর। তৃতীয় পারযুফটি শেকিনাহ, যিনি, ইসাক লুরিয়া যেমন বলেছেন, গডহেড হতে নির্বাসিত হয়েছিলেন। কারদাযযা বলেছেন, এই ধর্মের তিনটি গেরো, তিনটি আলাদা ঈশ্বর ছিলেন না, বরং রহস্যজনকভাবে এক, যেহেতু তারা একই গডহেডে প্রকাশিত। মধ্যপন্থী শ্যাব্বেতিয় ছিলেন কারদাযযা। ধর্ম পরিবর্তনকে দায়িত্ব ভাবেননি। তিনি, কারণ শ্যাব্বেতাই যেভিই তাঁর পক্ষে এই যন্ত্রণাদায়ক কাজটি সম্পন্ন করেছেন। কিন্তু ট্রিনিট্রির প্রস্তাবনা রেখে একটা টাবু ভঙ্গ করছিলেন তিনি। শত শত বছর ধরে ইহুদিরা ট্রিনিটির মতবাদকে ঘৃণা করে এসেছে, তারা একে ব্লাসফেমাস ও বহুঈশ্বরবাদীতা হিসাবে দেখেছে। কিন্তু বিস্ময়কর সংখ্যায় ইহুদি এই নিষিদ্ধ দর্শনে আকৃষ্ট হয়েছিল । পৃথিবীর কোনও পরিবর্তন ছাড়াই বছরের পর বছর পেরিয়ে যাওয়ায় শ্যাব্বেতিয়রা তাদের মেসিয়ানিক প্রত্যাশায় পরিবর্তন আনতে বাধ্য হয়েছিল। নেহেমিয়াহ হায়িম, স্যামুয়েল প্রিমো ও জোনাথান ইবেস্যদের মতো শ্যাব্বেতিয়রা সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন যে, ‘গডহেডের রহস্য (সদ হা-ইলাহাত) ১৬৬৬ সালে পুরোপুরি প্রকাশিত হয়নি। লুরিয়ার ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী শেকিনাহ ‘ধুলি হতে উঠতে শুরু করেছিল, কিন্তু শেষতক গডহেডে প্রত্যাবর্তন করেনি। মুক্তিলাভ এক ধারাবাহিক প্রক্রিয়া; পরিবর্তনের এই সময়ে পুরাতন নিয়ম অনুসরণ ও সিনাগগে প্রার্থনা অনুমোদিত, পাশাপাশি মেসিয়ানিক মতবাদ গোপনে পালন করে যেতে হবে। পরিবর্তিত এই শ্যাব্বেতিয়বাদ ব্যাখ্যা করে যে, শ্যাব্বেইকে মেসায়াহ হিসাবে বিশ্বাস লালনকারী কতজন র‍্যাবাই অষ্টাদশ শতাব্দীতে পালপিটে টিকে থাকতে সক্ষম হয়েছিলেন।

ধর্মান্তরিত চরমপন্থীরা অবতারবাদের এক ধর্মতত্ত্বের আশ্রয় গ্রহণ করেছিল এবং এভাবে আরেকটি ইহুদি টাবু ভঙ্গ করছিল। তারা বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল যে, শ্যাঝেতাই যেভি কেবল মেসায়াহই নয় বরং ঈশ্বরের অবতারও ছিলেন। খৃস্টধর্মের মতো ক্রমে এই বিশ্বাস বিবর্তিত হয়েছে। আব্রাহাম কারদাযযা একটি মতবাদের শিক্ষা দিয়েছিলেন যা পুনরুত্থানের পর সেইন্ট পলের জেসাসের মহিমান্বিতকরণের বিশ্বাসের অনুরূপ: ধর্ম ত্যাগের সময় যখন উদ্ধার লাভ পর্বের সূচনা ঘটেছে তখন শ্যাব্বেতাই পারযুফিমের ট্রিনিটিতে উন্নীত হয়েছেন; ‘পবিত্ৰজন (মালকা কাদিশা) আশীর্বাদপ্রাপ্ত হলেন, নিজেকে উঠিয়ে নিয়েছেন এবং শ্যাব্বেতাই যেভি উর্ধারোহণ করে ঈশ্বরও হওয়ার জন্যে তাঁর স্থান গ্রহণ করেছেন। সুতরাং, কোনওভাবে তিনি স্বর্গীয় স্তরে উন্নীত হয়েছেন ও ইসরায়েলের ঈশ্বরের অর্থাৎ দ্বিতীয় পরযুফের স্থান অধিকার করেছেন। অচিরেই ইসলাম ধর্মগ্রহণকারী দনমেহরা এ ধারণাটিকে আরেকটু আগে বাড়িয়ে সিদ্ধান্ত পৌঁছে যে, ইসরায়েলের ঈশ্বর পৃথিবীতে অবতীর্ণ হয়ে শ্যাব্বেইয়ের মাঝে দেহরূপ ধারণ করেছেন। যেহেতু তারা এও বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল যে তাদের সব নেতাই মেসায়াহর একেকজন অবতার, ফলে এটাই দাঁড়ায় যে তারাও অবতারে পরিণত হয়েছে, সম্ভবত ঠিক শিয়াহ্ ইমামদের মতো। সুতরাং ধর্মত্যাগীদের প্রত্যেক প্রজন্মের একজন নেতা ছিলেন যিনি স্বর্গীয় সত্তার অবতার ।

১৭৫৯ সালে অ্যাশকেনাযিয় অনুসারীদের ব্যাপ্টিজমে নেতৃত্বদানকারী জ্যাকব ফ্রাঙ্ক (১৭২৬-১৭৯১) বোঝাতে চেয়েছিলেন যে, গোড়া থেকেই তিনি ঈশ্বরের অবতার ছিলেন। ইহুদিবাদের গোটা ইতিহাসে তাঁকে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর চরিত্র হিসাবে উল্লেখ করা হয়। অশিক্ষিত ছিলেন তিনি এবং এ নিয়ে তাঁর গর্বের শেষ ছিল না; তবে এক রহস্যময় ধর্মতত্ত্ব গড়ে তোলার ক্ষমতা ছিল তাঁর যা এমন একদল ইহুদিকে আকৃষ্ট করেছিল যাদের কাছে ধর্ম বিশ্বাস ফাঁকা ও অসন্তোষজনক মনে হয়েছিল। ফ্রাঙ্ক প্রচার করেন, পুরাতন নিয়ম রদ হয়ে গেছে। প্রকতৃপক্ষেই, সকল ধর্মকে ধ্বংস করতে হবে যাতে ঈশ্বর স্পষ্টভাবে প্রতিভাত হয়ে উঠতে পারেন। তাঁর স্লোয়া প্যানস্কিতে (সদাপ্রভুর বাণী) তিনি শ্যাব্বেতিয়বাদকে নিহিলিজম-এর পর্যায়ে নিয়ে গেছেন। সমস্ত কিছুকে ভেঙে চুরমার করে ফেলতে হবে: ‘আদম যেখানে পদচারণা করেছেন, নগর গড়ে উঠেছে: কিন্তু আমি যেখানেই পা রাখব, সেখানকার সবকিছু ধ্বংস হয়ে যাবে, কারণ আমি এ পৃথিবীতে এসেছি কেবল ধ্বংস আর বিনাশ সাধনের জন্যে। ক্রাইস্টের কিছু কিছু বক্তব্যের সঙ্গে অস্বস্তি কর সাযুস্য রয়েছে, তিনিও দাবি করেছিলেন যে শান্তি নয় বরং তরবারি আনার জন্যে তার আগমন ঘটেছে। অবশ্য জেসাস ও সেইন্ট পলের বিপরীতে ফ্রাঙ্ক পুরোনো পবিত্রতার জায়গায় নতুন কিছু স্থাপনের প্রস্তাব রাখেননি। তাঁর নিহিলিস্টিক বিশ্বাস সমসাময়িক তরুণ মারকিস দে স্যাদের ধারণা হতে খুব বেশি ভিন্ন ছিল না। কেবল মর্যাদাহানির সর্বনিম্ন স্তরে অবতরণের ভেতর দিয়েই মানুষ শুভ ঈশ্বরের কাছে ঊর্ধ্বারোহণ করতে পারে। এটা কেবল সকল ধর্মের প্রত্যাখ্যান নয়, বরং ‘অদ্ভুত’ সূচনা যার। পরিণতি স্বেচ্ছাপ্রণোদিত মর্যাদাহানি ও চরম নির্লজ্জতা।

ফ্রাঙ্ক কাব্বালিস্ট ছিলেন না, কিন্তু কারদাযোর ধর্মতত্ত্বের রূঢ় ভাষ্য প্রচার করেছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, শ্যাব্বেতিয় ট্রিনিটির তিন পারযুফিমের প্রত্যেকটি ভিন্ন মেয়াহর সারফত পৃথিবীতে উপস্থাপিত হবেন। শ্যাব্বেতাই যেভি, ফ্রাঙ্ক ‘প্রথম জন’ আখ্যায়িত করেছেন, ছিলেন ‘শুভ ঈশ্বরের অবতার, যিনি কারদাযোর আতিকা কাদিশা (পবিত্র প্রাচীনজন); স্বয়ং তিনি ইসরায়েলের ঈশ্বর দ্বিতীয় পারযুফের অবতার ছিলেন। তৃতীয় মেসায়াহ, যিনি শেকিনাহকে ধারণ করবেন, তিনি হবেন একজন মহিলা, ফ্রাঙ্ক যাকে ‘দ্য ভার্জিন’ আখ্যায়িত করেছেন। বর্তমানে অবশ্য পৃথিবী অশুভ শক্তির করায়ত্ত রয়েছে। মানুষ যতক্ষণ না ফ্রাঙ্কের নিহিলিস্টিক গস্পেল মেনে নিচ্ছে ততক্ষণ মুক্তি মিলবে না । জ্যাকবের মই ছিল ইংরেজি ‘V আকৃতির: ঈশ্বরের কাছে আরোহণ করার জন্যে আগে জেসাস ও শ্যাব্বেইয়ের মতো অতলে নামতে হবে: ‘এটুকু আমি তোমাদের বলি, ঘোষণা দিয়েছেন ফ্রাঙ্ক, তোমরা জান, ক্রাইস্ট বলেছেন, তিনি শয়তানের কবল হতে পৃথিবীকে উদ্ধার করতে এসেছেন, কিন্তু আমি এসেছি পৃথিবীকে সব ধরনের নিয়ম ও প্রথা থেকে মুক্তি দিতে। আমার দায়িত্ব এসব কিছুকে ধ্বংস করা যাতে শুভ ঈশ্বর নিজেকে প্রকাশ করতে পারেন।[৫১] ঈশ্বরকে যারা আবিষ্কার করতে চায় ও অশুভ শক্তির হাত থেকে নিজেদের মুক্ত করতে চায় তাদের নেতাকে পবিত্র বিবেচিত সকল নিয়ম-কানুন লজ্ঞান করে অতলে নামতে হবে: ‘আমি তোমাদের বলছি, যোদ্ধাদের অবশ্যই ধর্মহীন হতে হবে, যার মানে, তাদের নিজস্ব ক্ষমতায়ই মুক্তি লাভ করতে হবে।[৫২]

এই শেষ কথাটার ভেতর আমরা ফ্রাঙ্কের রহস্যময় দর্শন ও যুক্তিবাদী আলোকন পর্বের যোগাযোগ বুঝতে পারি। যেসব পোলিশ ইহুদি তাঁর গস্পেল গ্রহণ করেছিল তারা স্পষ্টই ইহুদিদের জন্যে আর নিরাপদ নয় বলে বিবেচিত পৃথিবীর ভীতিকর পরিস্থিতিতে মানিয়ে নেওয়ার বেলায় ধর্মের কোনও রকম সাহায্য বা সহযোগিতা পাচ্ছিল না। ফ্রাঙ্কের মৃত্যুর পর ফ্রাঙ্কবাদ এর নৈরাজ্যবাদের সিংহভাগই হারিয়ে ফেলে, রয়ে গিয়েছিল কেবল ঈশ্বরের অবতার হিসাবে ফ্রাঙ্কের ওপর বিশ্বাস ও শোলেম যাকে বলেছেন ‘এক প্রবল, আলোকময় মুক্তির অনুভূতি।[৫৩] ফরাসী বিপ্লবকে তারা তাদের পক্ষে ঈশ্বরের নির্দশন হিসাবে দেখেছে: রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য নীতিশাস্ত্র বিরোধিতা ত্যাগ করে পৃথিবীকে নতুনভাবে গড়ে তুলবে এমন এক অভ্যুত্থানের স্বপ্ন দেখেছে। একইভাবে বিংশ শতাব্দীর প্রাথমিক বছরগুলোয় ইসলাম ধর্ম গ্রহণকারী দনমেহদের প্রায়শঃই সক্রিয় তরুণ তুর্কি হতে দেখা গেছে; অনেকেই কামাল আতাতুর্কের সেকুলার তুরস্কে পুরোপুরি মিশে গিয়েছিল । বাহ্যিক অনুসরণের প্রতি সকল শ্যাব্বেতিয়বাদীর অনুভূত বৈরিতা ছিল এক অর্থে গোটা পরিবেশের প্রতি বিদ্রোহ। পশ্চাদপদ ও অস্পষ্ট ধর্ম হিসাবে প্রতীয়মান শ্যাব্বেতিয়বাদ প্রাচীন পন্থা থেকে নিজেদের মুক্ত করে নতুন নতুন ধারণা গ্রহণে সক্ষম করে তুলেছিল তাদের। বাহ্যিকভাবে ইহুদিবাদের প্রতি বিশ্বস্ত রয়ে যাওয়া মধ্যপন্থী শ্যাব্বেতিয়রা প্রায়শঃই ইহুদি আলোকনের অগ্রপথিক ছিল; ঊনবিংশ শতাব্দীতে সংস্কৃত ইহুদিবাদ সৃষ্টিতেও সক্রিয় ছিল তারা। প্রায়শঃই এইসব মাসকিলিমদের ধারণা প্রাচীন ও নতুন ধারণার মিশেল হতে দেখা গেছে। এভাবেই প্রাগের জোসেফ ওয়েস্ত, ১৮০০ সালের দিকে লিখছিলেন তিনি, বলেছেন, মোজেস মেলেসন, ইম্যানুয়েল কান্ট, শ্যাব্বেতাই যেভি ও ইসাক লুরিয়া তার আদর্শ ছিলেন। সবার পক্ষে বিজ্ঞান ও দর্শনের কঠিন পথ ধরে আধুনিকতায় উত্তোরণ সম্ভব নয়; চরমপন্থী ক্রিশ্চান ও ইহুদিদের অতিন্দ্রীয়বাদী বিশ্বাস তাদের এক ধর্মনিরপেক্ষতার দিকে অগ্রসর হতে সক্ষম করে তুলবে।

জ্যাকব ফ্রাঙ্ক যখন তার নিহিলিস্টিক গস্পেল প্রণয়ন করছিলেন, ঠিক সেই একই সময়ে অন্য পোলিশ ইহুদিরা একেবারে ভিন্ন এক মেসায়াহুকে আবিস্কার। করেছিল। ১৬৪৮ সালের হত্যালীলার পর থেকে পোলিশ ইহুদিদের ভেতর স্থানচ্যুতি ও মনোবলহীনতার এমন এক বোধ জেগে উঠেছিল যা স্পেন থেকে সেফার্দিমের নির্বাসনের মতোই তীব্র ছিল। পোল্যান্ডের বহু শিক্ষিত ও আধ্যাত্মিক পরিবার হয় নিহত কিংবা পশ্চিম ইউরোপের তুলনামূলকভাবে নিরাপদ অঞ্চলে অভিভাসী হয়েছিল। হাজার হাজার ইহুদি উনুল, উদ্বাস্ত হয়ে গিয়েছিল, তাদের অনেকেই যাযাবরে পরিণত হয়, স্থায়ী বসতি গড়ে তোলার পথ রুদ্ধ হয়ে যাওয়ায় শহর থেকে শহরে ঘুরে বেরিয়েছে তারা। সেসব র‍্যাবাই রয়ে গিয়েছিলেন, তাঁরা ছিলেন নিম্নমানের এবং গবেষণা দিয়ে বাইরের জগতের রূঢ় বাস্তবতার থেকে নিজেদের আড়াল করার প্রয়াস পেয়েছিলেন তাঁরা। ভবঘুরে কাব্বালিস্টরা ঈশ্বর হতে বিচ্ছিন্ন আক্রা সিত্ৰা বা অপর পক্ষের ভয়ঙ্কর অন্ধকার-এর কথা বলে বেড়িয়েছে। শ্যাঝেতাই যেভি বিপর্যয়ও সাধারণের মাঝে বিভ্রান্তি ও বৈষম্যের ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছিল। ইউক্রেনের কিছু সংখ্যক ইহুদি ক্রিশ্চান পিয়েটিস্ট আন্দোলনে প্রভাবিত হয়েছিল, রাশিয়ান অর্থডক্স চার্চেও যার প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছিল। ইহুদিরাও একই রকম ক্যারিশমাটিক ধর্ম প্রণয়ন শুরু করেছিল। ইহুদিদের ভেতর মোহাবিষ্টতা বা পরমান্দের অনুভূতির কথাবার্তা শোনা যাচ্ছিল, প্রার্থনার সময় হাততালি দিয়ে গান গাইছিল তারা। ১৭৩০-এর দশকে ঐ মোহাবিষ্টদের একজন এই অন্তরের ইহুদি ধর্মের অবিসংবাদিত নেতা হিসাবে আবির্ভূত হন ও হাসিবাদ নামে পরিচিত দর্শনের প্রতিষ্ঠা করেন।

ইসরায়েল বেন এলিয়ের পণ্ডিত ছিলেন না। তালমুদ পাঠের চেয়ে বরং বনে জঙ্গলে হাঁটতে ও বাচচাঁদের গল্প শোনাতেই বেশি পছন্দ করতেন। কার্পেথিয়ান পর্বতের দক্ষিণে পোল্যান্ডে একটা কুটিরে সস্ত্রীক অতি গরীবি হালে থাকতেন তিনি। কিছুদিন চুনাপাথর খুঁড়ে তুলে কাছের শহরে লোকজনের কাছে বিক্রি করেছেন। এরপর স্বামী-স্ত্রী মিলে একটা সরাইখানা দেখাশোনা করেন। অবশেষে মোটামুটি ছত্রিশ বছর বয়সে তিনি দাবি করে বসেন যে, তিনি ফেইদ হীলার ও একসরসিস্টে পরিণত হয়েছেন। পোল্যান্ডের গ্রামে গ্রামে ঘুরে ঘুরে কৃষক ও শহরবাসীদের ভেষজ ওষুধ, তাবিজ ও প্রার্থনার মাধ্যমে চিকিৎসা করে সুস্থ করে তোলেন তিনি। সেই সময় এরকম বহু হীলার ঈশ্বরের নামে রোগমুক্তির দাবি করেছিল। এ সময়ে ইসরায়েল এবার ‘বাআল শেম তোভ’ (শুভ নামের পণ্ডিত)-এ পরিণত হন। নিজে কখনও দাবি না করলেও অনুসারীরা তাকে র‍্যাবাই ইসরায়েল বাআল শেম হতাভ বা সোজা কথায় দ্য বেশট ডাকতে করতে শুরু করে। অধিকাংশ হীলার জাদুটোনাতেই সন্তুষ্ট থাকলেও ‘বেশট’ অতিন্দ্রীয়বাদীও ছিলেন। শ্যাব্বেতাই যেভি ঘটনা তাঁকে অতিন্দ্রীয়বাদের সঙ্গে মেসিয়ানিজমকে মিলিয়ে ফেলার বিপদ সম্পর্কে শিক্ষা দিয়েছিল বলে তিনি কাব্বালাবাদের এমন একটি পুরোনো রূপের আশ্রয় নিয়েছিলেন যা কোনও গোষ্ঠী বিশেষের নয় বরং সবার উপযোগী ছিল। স্বর্গীয় লিঙ্গের পৃথিবীতে পতনকে বিপর্যয় হিসাবে না দেখে বেশট তার হাসিদিমদের ইতিবাচক দিকে দৃষ্টি দেওয়ার শিক্ষা দিয়েছিলেন। এই স্ফুলিঙ্গগুলো সৃষ্টির প্রতিটি জিনিসের সঙ্গে মিশে আছে; এর মানে গোটা পৃথিবী ঈশ্বরের সত্তায় পরিপূর্ণ। একজন নিবেদিতপ্রাণ ইহুদি দৈনন্দিন জীবনের খুঁটিনাটি প্রতিটি কাজে-খাওয়া দাওয়া, পান করা বা স্ত্রীকে ভালোবাসা-ঈশ্বরকে অনুভব করতে পারে, কারণ স্বর্গীয় স্ফুলিঙ্গ সর্বত্রই বিরাজ করে। সুতরাং, নারী ও পুরুষ দূরাত্মা দিয়ে ঘেরাও হয়ে নেই, বরং ঈশ্বর পরিবেষ্টিত; হাওয়ার প্রতিটি ধাক্কা বা ঘাসের ডগায় যিনি উপস্থিত আছেন; তিনি চান ইহুদিরা আস্থা ও আনন্দের সাথে তাঁর শরণাপন্ন হোক।

বিশ্বের মুক্তির লুরিয়া প্রস্তাবিত মহাপ্রকল্প ত্যাগ করেছেন বেশট। হাসিদ কেবল তার ব্যক্তি জীবনে আটকে পড়া-তার স্ত্রী, দাস, আসবাব ও খাদ্য ইত্যাদি বিভিন্ন বস্তুতে স্বর্গীয় স্ফুলিঙ্গের পুনর্মিলনের জন্যে দায়ী। বেশটের অন্যতম অনুসারী হিল্লেল যিতলিন যেমন ব্যাখ্যা করেছেন, তার বিশেষ পরিবেশে হাসিদের এক অনন্য দায়িত্ব রয়েছে, যা কেবল সে একাই অনুসরণ করতে পারে: প্রত্যেক মানুষ তার আপন জগতের ত্রাণকর্তা। সে কেবল নিজেকেই ধারণ করে ও কেবল সেই ব্যক্তিগতভাবে যা ধারণ ও অনুভব করার জন্যে নির্ধারিত হয়েছে তা ধারণ ও অনুভব করতে দায়বদ্ধ।৫৪ কাব্বালিস্টরা অতিন্দ্রীয়বাদীকে যেদিকে চোখ ফেরানো যায় সেখানেই ঈশ্বরের উপস্থিতি সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠতে সহায়তা করার জন্যে মনোসংযোগের এক অনুশীলন আবিষ্কার করেছিল। সপ্তদশ শতাব্দীর এক সেফেদ কাব্বালিস্ট যেমন ব্যাখ্যা করেছেন, অতিন্দ্রীয়বাদীদের নির্জনে বসে তোরাহ্ পাঠে বিরতি দিয়ে মাথার ওপর শেকিনাহ্র দ্যুতি কল্পনা করতে হবে, যেন তা চারদিকে প্রবাহিত হয়ে চলেছে আর তারা সেই জ্যোতির মাঝখানে বসে আছে।৫৫ ঈশ্বর-উপস্থিতির অনুভূতি তাদের মাঝে কম্পমান মোহাবেশময় আনন্দ বয়ে আনত। বেশট অনুসারীদের শিক্ষা দিয়েছিলেন যে, এই পরমান্দ কেবল সুবিধাপ্রাপ্ত অতিন্দ্রীয়বাদী গোষ্ঠীর জন্যে নির্ধারিত নয়, বরং প্রত্যেক ইহুদির দায়িত্ব রয়েছে দেভেকুদের চর্চা করে সর্বত্র ঈশ্বরের উপস্থিতি সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠা: আসলে দেভেকুদে ব্যর্থতা বহুঈশ্বরবাদীতারই শামিল, ঈশ্বর ছাড়া যে আর কোনও কিছুর প্রকৃত অস্তিত্ব নেই তার অস্বীকৃতি। এতে করে প্রশাসনের সঙ্গে বেশটের বিরোধ সৃষ্টি হয়, যাদের ভয় হয়েছিল যে, ইহুদিরা হয়তো কার্যত বিপজ্জনক ও আত্মকেন্দ্রীক এসব ভক্তিবাদে সাড়া দিয়ে তোরাহ্ পাঠ বর্জন করে বসবে।

অবশ্য হাসিদিম দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিল, কেননা তা আশাহীন ইহুদিদের মাঝে আশার বাণী নিয়ে এসেছিল: এই আদর্শ গ্রহণকারীদের অনেকেই ছিল প্রাক্তন শ্যাব্বেতিয়। বেশট চাননি তাঁর অনুসারীরা তোরাহ্ বর্জন করুক বরং এর এক নতুন অতিন্দ্রীয়বাদী ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন তিনিঃ মিতযভাহ (নির্দেশনা) একটা বন্ধন বোঝায়। কোনও হাসিদ যখন দেভেকুদ অনুশীলনের সময় আইনের একটি নির্দেশনা পালন করে তখন সে সকল সত্তার মূল ঈশ্বরের সঙ্গে নিজেকে আবদ্ধ করে, আবার একই সময়ে সে তার জীবন বা বস্তু সামগ্রীতে বিরাজমান স্বর্গীয় লিঙ্গকে গডহেডের সঙ্গে পুনর্মিলিত করে। তোরাহ্ বহু আগে হতেই ইহুদিদের মিতযভোতের অনুশীলন করে জগতকে পরিশুদ্ধ করায় উৎসাহ দিয়ে এসেছে। বেশট কেবল এর অতিন্দ্রীয়বাদী ব্যাখ্যা দিচ্ছিলেন। জগতকে রক্ষা করার অতিউৎসাহের কারণে হাসিদিম কখনও কখনও কিছুটা সন্দেহজনক পথেও অগ্রসর হয়েছে: অনেকেই তামাকে অবস্থান করা স্ফুলিঙ্গকে উদ্ধার করতে অতি-ধূমপায়ীতে পরিণত হয়েছিল! বেশটের আরেকজন পৌত্র মেদযিযের বারুচ (১৭৫৭-১৮১০), আসবাব ও অন্যান্য বস্তুর বিশাল সংগ্রহ ছিল, এসব অসাধারণ জিনিসের স্রেফ স্ফুলিঙ্গের ব্যাপারে নিজেকে আগ্রহী বলে। ওসব বিলাস সামগ্রী রাখার ন্যায্যতা প্রতিপন্ন করার প্রয়াস পেয়েছিলেন তিনি। অ্যাপট-এর আব্রাহাম জোশুয়া হেশেল (মৃ. ১৮২৫) খাবারের স্ফুলিঙ্গকে পুনরুদ্ধার করতে প্রচুর খাবার খেতেন।৫৬ এই হাসিদিয় প্রয়াসকে নিষ্ঠুর ও বিপদসঙ্কুল পৃথিবীতে পথ খোঁজার প্রচেষ্টা হিসাবে দেখা যেতে পারে। দেভেকুদের অনুশীলনসমূহ অভ্যন্তরীণ মহিমা আবিষ্কারের লক্ষ্যে জগতের পরিচয়ের পর্দা খসানোর কল্পনা নির্ভর প্রয়াস ছিল। এই প্রয়াস সমসাময়িক ইংরেজ রোমান্টিক্স উইলিয়াম ওঅর্ডসওঅর্থ (১৭৭০ ১৮৫০) ও স্যামুয়েল টেয়লর কোলরিজ (১৭৭২-১৮৩৪)-এর কল্পনানির্ভর দৃষ্টিভঙ্গির চেয়ে দুরবর্তী ছিল না যাঁরা দৃশ্যমান সবকিছু একত্রিতকারী ‘একক জীবনে’র উপলব্ধি করেছিলেন। নির্বাসন ও নিপীড়ন-নির্যাতনের দুঃখ সত্ত্বেও হাসিবাদ তাদের প্রত্যক্ষ করা প্রতিটি জিনিসকে সৃষ্ট জগতের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত স্বর্গীয় শক্তি হিসাবে দেখার বিষয়ে সচেতন হয়ে উঠেছিল, যা জগতকে এক মহিমাময় স্থানে পরিণত করেছে। ক্রমশঃ বস্তু জগৎ তাৎপর্যহীনতায় পর্যবসিত হবে; সমস্ত কিছু এপিফ্যানিতে পরিণত হবে। উহ্যালির মোজেস তেইতেলবম (১৭৫৯-১৮৪১) বলেছেন, মোজেস যখন ‘জ্বলন্ত ঝোঁপ’ দেখেছিলেন, তিনি কেবল স্বর্গীয় উপস্থিতি প্রত্যক্ষ করেছেন যা প্রতিটি ঝোঁপকে পুড়িয়ে আবার এর সত্তা টিকিয়ে রাখেন। গোটা পৃথিবী যেন মহাজাগতিক আলোয় ভরে আছে বলে মনে হয়; হাসিদিম মোহাবিষ্টতার আনন্দে চিৎকার করে ওঠে, হাততালি দেয়, গান গাইতে শুরু করে। কেউ কেউ এমনকি ডিগবাজিও খায়, দেখিয়ে দেয় যে তাদের দিব্য দর্শনের প্রতাপ গোটা পৃথিবীকে উল্টে দিয়েছে।

স্পিনোযা ও অপরাপর কিছু চরমপন্থী ক্রিশ্চানের বিপরীতে বেশট সবকিছুকে ঈশ্বর দাবি করেননি, বরং বলেছেন সকল সত্তা ঈশ্বরে বিরাজমান ছিল, যিনি তাদের প্রাণ ও সত্তা দিয়েছেন। তিনি সকল বস্তুর অস্তিত্ব বজায় রাখা মূল শক্তি। তিনি এটা মনে করতেন না যে দেভেকুদ অনুশীলনের মাধ্যমে হাসিদিম স্বর্গীয় হয়ে যাবে বা ঈশ্বরের সঙ্গে মিশে যাবে-এ ধরনের নির্বুদ্ধিতা সকল ইহুদি অতিন্দ্রীয়বাদীদের চোখেই বাড়াবাড়ি ঠেকেছে। বরং হাসিদিম ঈশ্বরের নিকটবর্তী হয়ে তার উপস্থিতি সম্পর্কে সজাগ হবে। বেশিরভাগ মানুষই ছিল সাধারণ, গড়পড়তা; প্রায়শঃই নিজেদের তারা জাকের সঙ্গে প্রকাশ করেছে, কিন্তু একটা ব্যাপারে তারা সচেতন ছিল: তাদের মিথলজিকে আক্ষরিক অর্থে নেওয়া যাবে না । দার্শনিক বা তালমুদিয় আলোচনার চেয়ে গল্প কাহিনী বেশি পছন্দ করত তারা; গল্প-কাহিনীকে সত্য ও যুক্তির সঙ্গে সম্পর্কহীন অভিজ্ঞতা বা অনুভূতিকে বোঝানোর সেরা উপায় হিসেবে দেখেছে। ঈশ্বর ও মানবজাতির পারস্পরিক নির্ভরশীলতাকে তুলে ধরার এক কল্পনানির্ভর প্রয়াস ছিল তাদের দর্শন। ঈশ্বর কোনও বাহ্যিক বস্তুগত সত্তা ছিলেন নাঃ প্রকৃতপক্ষে হাসিদিমের বিশ্বাস ছিল যে, তারা ঈশ্বরের বিলুপ্তির পর এক অর্থে তাকে আবার নতুন করে গড়ে তুলছে। নিজেদের মাঝে ঈশ্বর-তুল্য স্ফুলিঙ্গের উপস্থিতি সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠে তারা আরও পূর্ণাঙ্গ মানুষ হয়ে উঠবে। এই অন্তদৃষ্টি কাব্বালাহর পরিভাষায় প্রকাশ করেছে তারা। বেশটের উত্তরসুরি দোব বায়ের বলেছেন, ঈশ্বর ও মানুষ একক সত্তা ছিল; সৃষ্টির সময় ঈশ্বর যেমন ইচ্ছা করেছিলেন, মানুষ কেবল তখনই আদমে পরিণত হবে, যেদিন সে অস্তিত্বের বাকি অংশের সঙ্গে বিচ্ছেদের অনুভূতি বিস্মৃত হয়ে “ইযেকিয়েলের প্রত্যক্ষ করা সিংহাসনে আসীন আদিম মানুষের মহাজাগতিক অবয়বে’৫৮ পরিণত হবে। এটা ছিল মানুষকে তার নিজস্ব দুজ্ঞেয় মাত্রায় সচেতন করে তোলা আলোকনের গ্রিক বা বুদ্ধ বিশ্বাসের পরিপূর্ণ ইহুদি প্রকাশ।

গ্রিকরা ক্রাইস্টের অবতারবাদ ও দেবতায় পরিণত হবার মতবাদের। মাধ্যমে এর প্রকাশ ঘটিয়েছিল। হাসিদিম অবতারদের নিজস্ব ধরণ প্রতিষ্ঠা করেছিল। হাসিদিয় র‍্যাবাই-যাদ্দিক তাঁর সময়ের অবতারে পরিণত হয়েছেন, স্বর্গ পৃথিবীর একটি যোগসূত্র তিনি, স্বর্গীয় সত্তার প্রতিনিধি। চেরনোবিলের র‍্যাবাই মেনাহিম নাহুম (১৭৩০-১৭৯৭) যেমন লিখেছেন, যাদ্দিক ‘প্রকৃতই ঈশ্বরের অংশ এবং যেমন বলা হয়েছে, তার সঙ্গেই অবস্থান করেন।৫৯ ক্রিশ্চানরা যেমন ঈশ্বরের নিকটবর্তী হতে ক্রাইস্টকে অনুকরণ করে, তেমনি একজন হাসিদ যাদ্দিককে অনুকরণ করেছে, যিনি ঈশ্বরের কাছে আরোহণ করেছেন ও নিখুঁতভাবে দেভেকুদ অনুশীলন করেছেন। আলোকন যে সম্ভব তিনি তার জীবন্ত নজীর বা প্রমাণ। এই যাদ্দিক যেহেতু ঈশ্বরের নিকটবর্তী, সেহেতু একজন হাসিদ তার মাধ্যমে বিশ্ব জগতের প্রভুর কাছে পৌঁছতে পারে । যাদ্দিক যখন বেশট সম্পর্কে কোনও গল্প বলতেন বা তোরাহ্র কোনও পঙক্তির ব্যাখ্যা দিতেন, চারপাশে ভিড় করে প্রতিটি শব্দ যারপরনাই মনোযোগের সাথে শুনত তারা। অত্যুৎসাহী ক্রিশ্চান গোষ্ঠীগুলোর মতো হাসিদিজম ব্যক্তিগত পর্যায়ের ধর্ম ছিল না, বরং গভীরভাবে সামাজিক ছিল। দলবদ্ধভাবে হাসিদিমরা গুরুর সঙ্গে পরম একত্মতায় আরোহণের জন্যে যাদ্দিককে অনুসরণ করার প্রয়াস পেত। এখানে বিস্ময়ের কিছু নেই যে, পোল্যান্ডের অপেক্ষাকৃত বেশি। অর্থডক্স র‍্যাবাইগণ দীর্ঘদিন যাবত তোরাহর অবতার হিসেবে বিবেচিত শিক্ষিত র‍্যাবাইদের এড়িয়ে যাওয়া এই ব্যক্তিক কাল্টের ব্যাপারে শঙ্কিত হয়ে উঠেছিলেন। বিরোধী পক্ষের নেতৃত্বে ছিলেন ভিলনা একাডেমি অভ গান বা প্রধান র‍্যাবাই এলিযাহ বেন সলোমন যালমান (১৭২০-১৭৯৭)। শ্যাব্বেতাই বিপর্যয় বহু ইহুদিকে অতিন্দ্রীয়বাদের প্রতি বৈরী ভাবাপন্ন করে তুলেছিল। ভিলনার গাওনকে প্রায়শঃই অধিকতর যৌক্তিক ধর্মের প্রবক্তা হিসাবে দেখা হয়েছে। তা সত্ত্বেও তিনি ছিলেন প্রবলভাবে কাব্বালিস্ট ও তালমুদ বিশেষজ্ঞ। তাঁর ঘনিষ্ঠ অনুসারী ভোলোঝিনের র‍্যাবাই হাঈম ‘গোটা দ্য যোহারের ওপর পাণ্ডিত্যের প্রশংসা করেছেন…যা তিনি প্রেমের শিখা ও স্বর্গীয় আভিজাত্যের ‘চমৎকার দেভেকুদ ও পবিত্রতা এবং নির্ভেজালত্বের সঙ্গে পাঠ করেছেন।৬০ যখনই ইসাক লুরিয়ার কথা বলতেন, সারা দেহ থরথর কেঁপে উঠত তাঁর। অসাধারণ স্বপ্ন ও প্রত্যাদেশের অভিজ্ঞতা ছিল তার, তাসত্ত্বেও জোর দিয়ে। বলতেন তোরাহ্ পাঠই ঈশ্বরের সঙ্গে মিলিত হবার তাঁর প্রধান উপায় ছিল । অবশ্য সুপ্ত অনুভূতি প্রকাশ করার ক্ষেত্রে স্বপ্নের উদ্দেশ্যের চমৎকার উপলব্ধি দেখিয়েছিলেন তিনি। র‍্যাবাই হাঈম আরও বলেছেন: “তিনি বলতেন কেবল এ কারণেই ঈশ্বর নিদ্রার সৃষ্টি করেছেন, মানুষ যাতে অন্তদৃষ্টি অর্জন করতে পারে, যা আত্মা দেহের সঙ্গে আবদ্ধ থাকা অবস্থায় প্রচুর পরিশ্রম ও প্রয়াস সত্ত্বেও অর্জন করতে পারে না, কারণ দেহ হচ্ছে পৃথককারী কোনও পর্দার মতো।

আমরা যেমন ভাবতে চাই আসলে কিন্তু অতিন্দ্রীয়বাদ ও যুক্তিবাদের মধ্যে তেমন বিশাল পার্থক্য নেই। ঘুম সম্পর্কে গাওনের মন্তব্য অবচেতন মনের ভূমিকার পরিষ্কার ধারণা তুলে ধরে আমরা সবাই আমাদের বন্ধু-বান্ধবকে কাজের সময় সমাধান মেলে না এমন সমস্যার সমাধানের আশায় ‘sleep on’-এর তাগিদ দিই। আমাদের মন গ্রাহী ও প্রসন্ন অবস্থায় থাকলে মনের গভীর থেকে বিভিন্ন ধারণা উঠে আসে। আর্কিমিদিসের মতো বৈজ্ঞানিকদের বেলায়ও এ ধরনের অভিজ্ঞতা দেখা গেছে, গোসলের চৌবাচ্চায় তার বিখ্যাত সূত্রটি আবিষ্কার করেছিলেন তিনি। একজন সৃজনশীল দার্শনিক বা বিজ্ঞানীকে অতিন্দ্রীয়বাদীর মতো অসৃষ্ট বাস্তবতা ও অজ্ঞাত মেঘ ভেদ করার আশায় অন্ধকার জগতের মুখোমুখি হতে হয়; যতক্ষণ যুক্তি আর ধারণা নিয়ে নাড়াচাড়া করেন, ততক্ষণ স্বভাবতই প্রতিষ্ঠিত চিন্তার ধরন বা ধারণায় বন্দি হয়ে থাকেন তাঁরা। প্রায়শঃই তাঁদের আবিষ্কারসমূহকে বাইরে থেকে প্রদত্ত মনে হয়। তারা অনুপ্রেরণা ও দিব্যদৃষ্টির কথা বলেন। এভাবেই এডওয়ার্ড গিবন (১৭৩৭-৯৫) ধর্মীয় উদ্দীপনাকে ঘৃণা করলেও রোমে ক্যাপিটোলের ধ্বংসাবশেষের মাঝে ঘুরে বেড়ানোর সময় মুহূর্তের জন্যে অনেকটা স্বপ্নবিষ্ট হয়ে পড়েন যা তাঁকে দ্য ডিক্লাইন অ্যান্ড ফল অভ দ্য রোমান এম্পায়ার রচনায় অনুপ্রাণিত করেছিল। এই অনুভূতির ওপর মন্তব্য করতে গিয়ে বিংশ শতাব্দীর ইতিহাসবিদ আর্নল্ড টয়েনবি একে কমিউনিয়ন’ হিসাবে বর্ণনা করেছেন: ‘নিজের মাঝে বয়ে যাওয়া ইতিহাসের জোরাল ধারা সম্পর্কে প্রত্যক্ষভাবে সচেতন ছিলেন তিনি; এক বিশাল তরঙ্গের ধারায় নিজের জীবন ফুঁসে ওঠার ব্যাপারেও সজাগ ছিলেন। এই ধরনের অনুপ্রেরণার মুহূর্ত, উপসংহার টেনেছেন টয়েনিব, “বিটিফিক ভিশনের বা স্বর্গ সুখ দিব্যদৃষ্টির অভিজ্ঞতা লাভকারীরা যেমন বর্ণনা দিয়েছে তার অনুরূপ।৬২ আলবার্ট আইনস্টাইনও বলেছেন, অতিন্দ্রীয়বাদ সকল প্রকৃত শিল্পকলা ও বিজ্ঞানের বীজ বপনকারী’:

আমাদের কাছে যা জানা দুঃসাধ্য তার অস্তিত্ব আছে বলে জানা, যা সর্বোচ্চ প্রজ্ঞা ও অনন্য সৌন্দর্য হিসাবে নিজেকে প্রকাশ করে, আমাদের সমস্ত মনপ্রাণ যাকে কেবল একেবারে আদিম অবস্থায় উপলব্ধি করতে পারে-এই জ্ঞান, এই অনুভূতি সকল প্রকৃত ধর্মের মূল কথা। এই অর্থে এবং কেবল এই অর্থে আমি সমস্ত ধার্মিক মানুষের দলভুক্ত।[৬৩]

এই অর্থে বেশট-এর মতো অতিন্দ্রীয়বাদীদের আবিস্কৃত ধর্মীয় আলোকনকে যুক্তির কালের অন্যান্য অর্জনের অনুরূপ হিসাবে দেখা যেতে পারে; এটা সাধারণ নারী ও পুরুষকে আধুনিকতার নতুন জগতে কল্পনা নির্ভর পরিবর্তনে সক্ষম করে তুলছিল ।

১৭৮০র দশকে লিয়াদে-র র‍্যাবাই শেয়ুর যালমান (১৭৪৫-১৮১৩) হাসিদিজমের আবেগের বাহুল্যকে বুদ্ধিবৃত্তিক অনুসন্ধানের দূরবর্তী হিসাবে দেখেননি। এক নতুন ধরনের হাসিদিজম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি যা ছিল অতিন্দ্রীয়বাদকে যৌক্তিক ধ্যানের সঙ্গে মেশানোর প্রয়াস। এটা হাবাদ নামে পরিচিত হয়ে উঠেছিল, ঈশ্বরের তিনটি গুণ: হোখমাহ (প্রজ্ঞা) বিনাহ (বুদ্ধিমত্তা) এবং দা’আর্ত (জ্ঞান)-এর একটি গোলোকধাঁধা বিশেষ। দর্শনকে আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে সংযুক্তকারী পূর্ববর্তী অতিন্দ্রীয়বাদীদের মতো যালমান বিশ্বাস করতেন মেটাফিজিক্যাল অনুমান অত্যাবশ্যকীয় পূর্বশর্ত, কারণ এটা বুদ্ধিমত্তার সীমাবদ্ধতা প্রকাশ করে। সর্ববস্তুতে ঈশ্বর উপস্থিতির মৌল হাসিদিয় দর্শন থেকে সূচিত তাঁর কৌশল এক প্রক্রিয়ায় অতিন্দ্রীয়বাদীকে উপলব্ধি করতে শেখায় যে, ঈশ্বর একমাত্র বাস্তবতা বা সত্তা। যালমান ব্যাখ্যা করেছেন: ‘অসীমের অবস্থান থেকে তিনিই আশীর্বাদপ্রাপ্ত, বাকি সমস্ত কিছু যেন আক্ষরিক অর্থেই কিছু না ও অস্তিত্বহীন।[৬৪] অপরিহার্য শক্তি ঈশ্বর ছাড়া সৃষ্ট জগতের কোনও অস্তিত্ব নেই। আমাদের সীমাবদ্ধ ধারণার কারণেই এর আলাদা অস্তিত্ব রয়েছে বলে মনে হয়, কিন্তু এটা একটা মায়া বা বিভ্রান্তি। সুতরাং, ঈশ্বর আসলে বাস্তবতার বিকল্প বলয় অধিকারকারী দুয়ে সত্তা নন: তিনি জগতের বাইরের কিছু নন। প্রকৃতপক্ষেই ঈশ্বরের দুয়েতার মতবাদ আমাদের মনের আরেকটি বিভ্রান্তি, যা বোধের অতীতে গমন অসম্ভব মনে করে। হাবাদের অতিন্দ্রীয়বাদী অনুশীলন ইহুদিদের অনুভূতিজাত ধারণা অতিক্রম করে সমস্ত কিছুকে ঈশ্বরের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে সাহায্য করবে। অনালোকিত কারও চোখে বিশ্বকে ঈশ্বর-শূন্য মনে হয়: কাব্বালাহর ধ্যান আমাদের চারপাশের জগতে মিশে থাকা ঈশ্বরকে আবিষ্কারে সাহায্য করার জন্যে যৌক্তিক সীমারেখা ভেঙে দেবে।

ঈশ্বরের নিকটবর্তী হাওয়ার জন্যে মানুষের মনের সামর্থের আলোকনের আস্থার অংশীদার হাবাদ, তবে এক্ষেত্রে প্যারাডক্স ও অতিন্দ্রীয়বাদ মনোসংযোগের প্রাচীন পদ্ধতির শরণাপন্ন হয়েছে। বেশটের মতো যালমানও বিশ্বাস করতেন, যে-কেউ ঈশ্বরের দর্শন লাভ করতে পারে: হাবাদ বিশেষ অভিজাত অতিন্দ্রীয়বাদী গোষ্ঠীর জন্যে ছিল না। এমনকি মানুষের আধ্যাত্মিক মেধার অভাব আছে মনে হলেও সে আলোকপ্রাপ্ত হতে পারবে। কাজটা অবশ্য কঠিন। যালমানের ছেলে, লুবাভিচের র‍্যাবাই দোভ বায়ের (১৭৭৩-১৮২৭), তাঁর ট্রাক্ট অন এক্সট্যাসি-তে যেমন ব্যাখ্যা করেছেন, শুরু করতে হবে অপূর্ণতার নিষ্ঠুর উপলব্ধি দিয়ে। কেবল বুদ্ধিবৃত্তিক ধ্যান যথেষ্ট নয়। এর সঙ্গে আত্ম-বিশ্লেষণ, তোরাহ পাঠ ও প্রার্থনা যুক্ত থাকতে হবে। জগৎ সম্পর্কে আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক ও কল্পনানির্ভর সংস্কার ত্যাগ করা কষ্টকর, অধিকাংশ মানুষই তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ত্যাগে অনীহ থাকে। একবার এই অহম বোধের ঊর্ধ্বে উঠতে পারলে, হাসিদ উপলব্ধি করতে পারবে যে, ঈশ্বর ছাড়া ভিন্ন। কোনও সত্তা নেই। ফানার অভিজ্ঞতা অর্জনকারী সুফীর মতো হাসি পরমানন্দ লাভ করবে। বায়ের ব্যাখ্যা করেছেন, নিজেকে সে অতিক্রম করে যাবে: তার গোটা সত্তা এমনভাবে বিলীন হয়ে যায় যে কিছুই অবশিষ্ট থাকে না, তার আত্ম-সচেতনতা বলতে কিছুই নেই।[৬৫] হাবাদের অনুশীলন কাব্বালাহকে মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ ও আত্ম-জ্ঞানের একটা কৌশলে পরিণত করেছে, হাসিদকে পর্যায়ক্রমে অবতরণের শিক্ষা দিয়েছে যতক্ষণ না সে তার সত্তার কেন্দ্রে পৌঁছাচ্ছে। সেখানেই সে একমাত্র সত্য সত্তা ঈশ্বরকে আবিষ্কার করে। যুক্তি ও কল্পনার অনুশীলন দিয়ে মন ঈশ্বরকে আবিষ্কার করতে পারে, কিন্তু সেটা ফিলোসফস বা নিউটনের মতো বিজ্ঞানীদের বস্তুগত ঈশ্বর হবেন না, বরং সত্তার অবিচ্ছেদ্য অন্তস্থঃ সত্তা।

সপ্তম ও অষ্টাদশ শতাব্দী দুটি ছিল রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনে বিপ্লবাত্মক উত্থান-পতনে ফুটে ওঠা যন্ত্রণাময় উগ্রতা ও চৈতন্যের উত্তেজনার একটা পর্যায়। মুসলিম বিশ্বে এসময়ে তুলনাযোগ্য কিছু ছিল না, যদিও কোনও পশ্চিমরা মানুষের পক্ষে এটা নির্ণয় করা কঠিন, কেননা অষ্টাদশ শতাব্দীর মুসলিম চিন্তা-চেতনা নিয়ে তেমন একটা গবেষণা হয়নি। সাধারণভাবে পাশ্চাত্য পণ্ডিতরা একে মামুলি বলে নাকচ করে থাকেন। এমনটি মনে করা হয় যে, ইউরোপে যখন আলোকন পর্ব চলছে তখন পতন শুরু হয়েছিল ইসলামের। অবশ্য সাম্প্রতিককালে এই দৃষ্টিভঙ্গি বড় বেশ সরলীকরণ বলে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে। ১৭৬৭ সালে ব্রিটিশরা ভারতের নিয়ন্ত্রণ লাভ করলেও মুসলিম বিশ্ব তখনও পাশ্চাত্যের চ্যালেঞ্জের ব্যাপারে পুরোপুরি সজাগ হয়ে ওঠেনি। ভারতীয় সুফী দিল্লীর শাহ ওয়ালিউল্লাহ (১৭০৩-৬২) সম্ভবত প্রথম এই নতুন চেতনা অনুভব করেছিলেন। প্রভাবশালী চিন্তাবিদ ছিলেন তিনি, সংস্কৃতির বিশ্বজনীনতায় সন্দেহ ছিল তাঁর, তবে বিশ্বাস করতেন যে, ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে মুসলিমদের ঐক্যবদ্ধ হওয়া উচিত। শিয়াহ মতবাদ পছন্দ না করলেও তিনি শিয়াহ্ ও সুন্নীদের একটা ঐকমত্যে পৌঁছার প্রয়োজনীয়তায় বিশ্বাস করতেন। ভারতের নতুন অবস্থার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে তিনি শরীয়াহর সংস্কারের প্রয়াস পেয়েছিলেন। ওয়ালিউল্লাহ্র যেন উপনিবেশবাদের পরিণাম সম্পর্কে পূর্বধারণা ছিল। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে জিহাদে তাঁর পুত্র নেতৃত্ব দেবেন। তাঁর ধর্মীয় চিন্তা অধিকতর রক্ষণশীল ইবন আল আরাবীর ওপর দারুণভাবে নির্ভরশীল ছিল: ঈশ্বর ছাড়া মানুষ তার পূর্ণ সম্ভাবনায় বিকশিত হতে পারে না। ধর্মীয় বিষয়ে মুসলিমরা তখনও অতীতের সাফল্যের শরণেই তৃপ্ত ছিল, আর সুফীবাদ কতটা শক্তি অনুপ্রাণিত করতে পারে ওয়ালিউল্লাহ তার একটা নজীর। অবশ্য বিশ্বের বহু স্থানেই সুফীবাদ খানিকটা লুপ্ত হয়ে এসেছিল; আরবে এক নতুন সংস্কার আলোকন অতিন্দ্রীয়বাদ হতে সরে আসার আভাস দিয়েছে যা ঊনবিংশ শতাব্দীতে ঈশ্বর সম্পর্কে মুসলিম ধারণার বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয় ও পশ্চিমের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ইসলামি সাড়ার আদর্শ হয়ে দাঁড়ায়।

ষোড়শ শতাব্দীর ক্রিশ্চান সংস্কারবাদীদের মতো আরবীয় পেনিনসুলার নজদের একজন জুরিস্ট মুহাম্মদ ইবন আল-ওয়াহাব (মৃত্যু, ১৭৮৪) পরবর্তীকালের সকল সংযোজন হতে মুক্ত করে ইসলামকে এর সূচনালগ্নের খাঁটি রূপে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন। তিনি বিশেষভাবে অতিন্দ্রীয়বাদীদের প্রতি বৈরী ভাবাপন্ন ছিলেন। সুফী সাধক ও শিয়াহ্ ইমামদের প্রতি ভক্তি প্রকাশসহ অবতারবাদ মূলক ধর্মতত্ত্বের সকল ধারণার নিন্দা করা হয়। এমনকি মদিনায় পয়গম্বরের রওযার কাল্টেরও বিরোধিতা করেন তিনিঃ একজন মানুষ, তিনি যত মহানই হোক, ঈশ্বর হতে মনোযোগ বিক্ষিপ্ত করতে পারেন না। আল-ওয়াহাব মধ্য-আরবের এক ক্ষুদে রাজ্যের শাসক মুহাম্মদ ইবন সউদকে কাছে টানতে সক্ষম হন। দুজনে মিলে এক সংস্কার আন্দোলন শুরু করেন যা ছিল পয়গম্বর ও তাঁর সহচরদের প্রথম উম্মাহর পুনর্জন্ম দেওয়ার একটা প্রয়াস। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ওপর নির্যাতন, বিধবা ও এতিমদের দুর্দশার প্রতি নির্লিপ্ততা, অনৈতিকতা ও বহু-ঈশ্বরবাদীতার বিরুদ্ধে আক্রমণ হানেন তারা। তুর্কীরা নয়, আরবদেরই মুসলিম জাতির নেতৃত্ব দেওয়া উচিত মনে করে তারা অটোমান সাম্রাজ্যের শাসকদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেন। অটোমান নিয়ন্ত্রণ হতে হিজাযের উল্লেখযোগ্য অংশ দখল করে নিতে সক্ষম হন তাঁরা, যা ১৮১৮ সালের আগে আর তুর্কীরা পুনর্দখল করতে পারেনি; নতুন গোষ্ঠীটি ইসলামি বিশ্বের বহু মানুষের কল্পনার জগতে প্রভাব বিস্তার করেছিল। মক্কায় আগত তীর্থযাত্রীরা এই নতুন ধর্মানুরাগে মুগ্ধ হয়েছিল, যাকে প্রচলিত সুফীবাদের চেয়ে ঢের সজীব ও অনেক বেশি জোরালো মনে হয়েছে। উনবিংশ শতাব্দীতে ওয়াহাবি মতবাদ প্রভাবশালী ইসলামি ভাবধারা হয়ে ওঠে, অন্যদিকে সুফীবাদ ক্রমবর্ধমান হারে প্রান্তিক হয়ে পড়ে। এর পরিণামে তা আরও বিকৃত ও কুসংস্কারপুর্ণ হয়ে ওঠে। ইহুদি ও ক্রিশ্চানদের মতো মুসলিমরাও অতিন্দ্রীয়বাদী আদর্শ হতে সরে এসে অধিকতর যুক্তিবাদী ধরনের ধার্মিকতা গ্রহণ করতে শুরু করেছিল।

ইউরোপে অল্পসংখ্যক মানুষ স্বয়ং ঈশ্বরের কাছ থেকে সরে আসতে শুরু করছিল। ১৭২৯ সালে একজন পল্লী পুরোহিত জ্যাঁ মেসলিয়ার আদর্শ জীবন যাপন করার পর নাস্তিক অবস্থায় মারা যান। ভলতেয়ার তার রেখে যাওয়া স্মৃতিকথা প্রচার করেছিলেন। মানুষের প্রতি তাঁর বিরক্তি ও ঈশ্বরে বিশ্বাস রাখার অপারগতার কথা বলেছেন তিনি। মেসনিয়ার বিশ্বাস করতেন যে, নিউটনের অসীম মহাশূন্যই একমাত্র চিরন্তন বাস্তবতা: বস্তু ছাড়া আর কোনও কিছুর অস্তিত্ব নেই। দরিদ্রদের ওপর নির্যাতন চালানো ও তাদের ক্ষমতাহীন রাখার জন্য ধনীদের ব্যবহৃত অস্ত্র হচ্ছে ধর্ম। খৃস্টধর্ম ত্রিত্ববাদ ও অবতারবাদের মতো হাস্যকর মতবাদের কারণে আলাদা বৈশিষ্ট্য পেয়েছে। ঈশ্বরে তাঁর অবিশ্বাস এমনকি ফিলোসফদের কাছেও হজমের অতীত ঠেকেছিল। ভলতেয়ার বিশেষভাবে নাস্তিক্যবাদী অনুচ্ছেদগুলো বাদ দিয়ে আব্বিকে একজন ডেইস্ট-এ রূপান্তরিত করেছিলেন। শতাব্দীর শেষ নাগাদ অবশ্য কয়েকজন দার্শনিক সগর্বে নিজেদের নাস্তিক দাবি করেছেন, যদিও তাঁদের সংখ্যা ছিল বেশ কম। এটা ছিল একেবারে নতুন ধরনের একটা ব্যাপার । এতদিন পর্যন্ত নাস্তিক ছিল গালির ভাষা, আপনার শত্রুর উদ্দেশ্যে ছুঁড়ে দেওয়ার জন্যে নোংরা কথা বিশেষ। এবার তা গৌরবের তকমায় পরিণত হতে শুরু করছিল। স্কটিশ দার্শনিক ডেভিড হিউম (১৭১১-১৭৭৬) নতুন ধারণাটিকে যৌক্তিক উপসংহারে পৌঁছে দেন। বস্তুর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার উর্ধ্বে যাবার কোনওই প্রয়োজন নেই। আমাদের বোধের অতীত কোনও কিছুতে বিশ্বাস স্থাপনেরও দার্শনিক কোনও ভিত্তি নেই। ডায়ালগস কনসারনিং ন্যাচারাল রিলিজিয়ন-এ হিউম বিশ্বজগতের নকশা থেকে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণের যুক্তি প্রত্যাখ্যান করে বলেন, এটা সাদৃশ্যের যুক্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত যা অসম্পূর্ণ। যে কেউ বলতে পারে যে, প্রকৃতিতে আমরা যে নিয়ম শৃঙ্খলা অনুভব করি তা একজন বুদ্ধিমান তত্ত্বাবধায়কের দিকে ইঙ্গিত করে, কিন্তু তাহলে অশুভ ও প্রকাশিত বিশৃঙ্খলার ব্যাখ্যা দেওয়া হবে কীভাবে? এর কোনও যুক্তিপূর্ণ জবাব ছিল না; ১৭৫০ সালে ডায়ালগস-এর রচনাকারী হিউম বুদ্ধিমানের মতো অপ্রকাশিত রেখে দিয়েছিলেন। এর বছর খানেক আগে সাধারণ মানুষের কাছে পূর্ণাঙ্গ নাস্তিক্যবাদকে তুলে ধরা আ লেটার টু দ্য ব্লাইন্ড ফর দ্য ইউজ অভ দোজ হু সি-তে একই প্রশ্ন উত্থাপন করার দায়ে ফরাসি দার্শনিক দেনিস দিদেরো (১৭১৩-৮৪) কারারুদ্ধ হয়েছিলেন।

দিদেরো নিজেকে নাস্তিক হিসাবে স্বীকার করেননি। তিনি কেবল বলেছেন, ঈশ্বর আছেন কি নেই তা নিয়ে তিনি মাথা ঘামাননি। ভলতেয়ার তাঁর সম্পর্কে আপত্তি করলে তিনি জবাব দিয়েছিলেন: “আমি ঈশ্বরে বিশ্বাস করি, যদিও, নাস্তিকদের সঙ্গে ভালোভাবেই চলতে পারি… বিষকে সুগন্ধী। লতাগুল্ম না ভাবাটা অত্যন্ত জরুরি; তবে ঈশ্বরে বিশ্বাস করা বা না করাটা মোটেই গুরুত্বপূর্ণ নয়। একেবারে নির্ভুলভাবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের দিকে ইঙ্গিত করেছিলেন দিদেরো। ঈশ্বর যখন প্রবলভাবে অন্তরের বোধ হিসাবে থাকেন না, তখন আর তিনি অস্তিত্ববান নন। একই চিঠিতে দিদেরো যেমন তুলে ধরেছেন, দার্শনিকদের ঈশ্বর যিনি কখনও পৃথিবীর ব্যাপারে নাক গলান না, তাঁকে বিশ্বাস করা অর্থহীন। গোপন ঈশ্বর দিউস অতিসাসে পরিণত হয়েছেন: ‘ঈশ্বর থাকুন বা না থাকুন, তিনি সবচেয়ে সূক্ষ্ম ও অপ্রয়োজনীয় সত্যসমূহের সারিতে পৌঁছে গেছেন।[৬৬] পাসকালের বিপরীত সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন তিনি; যিনি বাজি ধরার ব্যাপারটাকে অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ হিসাবে দেখেছিলেন, যা অগ্রাহ্য করা পুরোপুরি অসম্ভব। ১৭৪৬ সালে প্রকাশিত পেনসিস ফিলোসফিকস-এ দিদেরো পাসকালের ধর্মীয় অনুভূতিকে অতিমাত্রায় ভক্তিমূলক বলে নাকচ করে দিয়েছিলেন তিনি ও জেসাইটরা প্রবলভাবে ইশ্বর নিয়ে ভেবেছেন, কিন্তু ঈশ্বর সম্পর্কে তাঁদের ধারণা সম্পূর্ণ ভিন্ন। এঁদের মাঝে কাকে বেছে নেওয়া যাবে? এমন একজন ঈশ্বর মর্জির একটা ব্যাপার ছাড়া আর কিছুই নন। এই পর্যায়ে, আ লেটার টু দ্য ব্লাইন্ড বেরুনোর তিন বছর আগে দিদেরো বিশ্বাস করতেন, বিজ্ঞান-একমাত্র বিজ্ঞান-নাস্তিক্যবাদকে বাতিল করতে পারে। পরিকল্পনা হতে সৃষ্টির যুক্তির এক নতুন মনোগ্রাহী ব্যাখ্যা খাড়া করেছিলেন তিনি। বিশ্বজগতের গতি পরীক্ষা করার বদলে মানুষের প্রতি তিনি প্রকৃতির অন্তর্গত কাঠামো পরীক্ষা করার তাগিদ দিয়েছিলেন। একটা বীজ প্রজাপতি বা কোনও পতঙ্গের গঠন এত জটিল যে দুর্ঘটনাবশত এর সৃষ্টি অসম্ভব। পেনসিস-এও দিদেরো বিশ্বাস করেছেন, যুক্তি ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রমাণ দিতে পারে। নিউটন ধর্মের সকল বোকামি ও কুসংস্কার ঝেড়ে ফেলেছিলেন: অলৌকিক ঘটনার জন্মদানকারী ঈশ্বর বাচ্চাদের আমরা যেসব দানোর কথা বলে ভয় দেখাই তাদের কাতারের।

অবশ্য তিন বছর পরে নিউটনকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন দিদেরো; তিনি বাহ্যিক জগৎ ঈশ্বরের অস্তিত্বের পক্ষে কোনওরকম সাক্ষ্য দেয় বলে আর মানতে পারেননি। তিনি স্পষ্ট বুঝতে পেরেছিলেন, নবলব্ধ বিজ্ঞানের সঙ্গে ঈশ্বরের কোনওই সম্পর্ক নেই। এই বিপ্লবাত্মক ও উত্তেজনাকর চিন্তাকে কেবল গল্পের ঢঙেই তুলে ধরতে পেরেছেন তিনি। আ লেটার টু দ্য ব্লাইন্ড-এ দিদেরো ‘মিস্টার হোমস’ নামের এক নিউটনবাদীর সঙ্গে ছোট বেলায় দৃষ্টিশক্তি হারানো ক্যামব্রিজের প্রয়াত গণিতজ্ঞ নিকোলাস সন্ডারসনের (১৬৮২-১৭৩৯) বিতর্কের কল্পনা করেছেন। সন্ডারসনের মুখে হোমসকে জিজ্ঞাসা করিয়েছেন দিদেরো, পরিকল্পনার যুক্তিকে কীভাবে তিনি তাঁর মতো (সন্ডারসন) ‘দানব’ ও দুর্ঘটনার সঙ্গে খাপ খাওয়াবেন, যিনি বুদ্ধি ও উদার পরিকল্পনা ছাড়া আর সবই প্রকাশ করেন;

এ জগৎ কী, মিস্টার হোমস, জটিল, পরিবর্তনের চক্রের অধীন, যার সবকিছুই ধ্বংসের অবিরাম প্রবণতা দেখায়। একের পর এক আগত বস্তু দ্রুত বিকশিত হয় ও হারিয়ে যায়; এক তুচ্ছ অস্থায়ী সামঞ্জস্য ও শৃঙ্খলার ক্ষণস্থায়ী ধারা।[৬৭]

নিউটন ও সত্যি বলতে বহু প্রথাগত ক্রিশ্চানের ঈশ্বর, আক্ষরিকভাবেই যার সমস্ত ঘটনার জন্যে দায়ী হওয়ার কথা, তিনি কেবল অযৌক্তিকই নন বরং এক ভয়ঙ্কর ধারণা। বর্তমানে আমরা ব্যাখ্যা দিতে পারি না এমন জিনিসের ব্যাখ্যা দেওয়ার জন্যে ঈশ্বর’-কে উপস্থাপন করা একটি ব্যর্থতা। প্রিয় বন্ধু মিস্টার হোমস, উপসংহার টানছেন দিদেরের সন্ডারসন, তোমার অজ্ঞতা স্বীকার করো।’

দিদেরোর দৃষ্টিতে স্রষ্টার কোনও প্রয়োজন ছিল না। নিউটন ও প্রটেস্ট্যান্টরা যেমন ভেবেছেন বস্তু তেমন নিষ্ক্রিয় তুচ্ছ বিষয় নয়, বরং এর নিজস্ব গতি রয়েছে, যা আপন নিয়ম মেনে চলে। বস্তুর নিয়মই-স্বর্গীয় মেকানিক নন-আমরা যে পরিকল্পনা দেখি বলে মনে করি তার জন্যে দায়ী। বস্তু ছাড়া আর কিছুরই অস্তিত্ব নেই। স্পিনোকে আরেক কদম সামনে নিয়ে গেছেন দিদেরো । প্রকৃতি ছাড়া আর কোনও ঈশ্বর নেই না বলে দিদেরো দাবি করেছেন যে কেবল প্রকৃতিই আছে, ঈশ্বর বলে কিছু নেই। তার এই বিশ্বাসে একা ছিলেন না তিনি। আব্রাহাম ট্রেম্বলি ও জন টার্বেভিল নীডহ্যামের মতো। বিজ্ঞানীরা সৃজনী বস্তুর নীতি আবিষ্কার করেছিলেন, যা জীববিজ্ঞান, অনুবিজ্ঞান, প্রাণীবিদ্যা, প্রাকৃতির ইতিহাস ও ভূতত্ত্বের ক্ষেত্রে প্রকল্প হিসাবে আবির্ভূত হচ্ছিল। অবশ্য অল্প সংখ্যকই ঈশ্বরের সঙ্গে চূড়ান্ত সম্পর্কচ্ছেদের জন্যে প্রস্তুত ছিলেন। এমনকি হলবাখের ব্যারন পলা হেইনরিখের (১৭২৩-৮৯) স্যালনে নিয়মিত যাতায়াতকারী দার্শনিকরাও প্রকাশ্যে নাস্তিক্যবাদের পৃষ্ঠপোষকতা করেননি, যদিও তারা খোলামেলা আলোচনা উপভোগ করতেন। এসব বিতর্ক হতেই হলবাখের গ্রন্থ দ্য সিস্টেম অভ নেচার: লজ অভ দ্য মোরাল অ্যান্ড ফিজিক্যাল ওয়ার্ল্ড (১৭৭০) বেরিয়ে আসে, যা নাস্তিক্যবাদী বস্তুবাদের বাইবেল হিসাবে পরিচিত হয়ে ওঠে। প্রকৃতির কোনও অতিপ্রাকৃত বিকল্প নেই, যা, হলবাখ যুক্তি দেখিয়েছেন, কারণ ও ফলের এক বিশাল ধারা যা অবিরাম একটি থেকে অন্যটিতে প্রবাহিত হয়। ঈশ্বরের বিশ্বাস অসততা এবং আমাদের প্রকৃত অস্তিত্বকে অস্বীকার করা। এটা হতাশারও পরিচায়ক। ধর্ম দেবতাদের সৃষ্টি করেছে, কারণ এই পৃথিবীর জীবনের দুঃখকষ্টে সান্ত্বনা পাওয়ার জন্যে মানুষ আর কোনও ব্যাখ্যা খুঁজে পায়নি। তারা নিয়ন্ত্রণের এক ভ্রান্ত বোধ সৃষ্টির প্রয়াসে ধর্ম ও দর্শনের কাল্পনিক সান্ত্বনার শরণ নিয়েছে, আতঙ্ক ও বিপর্যয় প্রতিরোধ করার জন্যে নেপথ্যে ক্রিয়াশীল এক কাল্পনিক এজেন্সিকে প্রসন্ন করার প্রয়াস পেয়েছে। অ্যারিস্টটল ভুল করেছিলেন: দর্শন জ্ঞান অর্জনের মহৎ আকাক্ষার ফল ছিল না, বরং দুঃখ এড়ানোর ভীরু ইচ্ছার পরিণতি। সুতরাং ধর্মের আশ্রয় হচ্ছে অজ্ঞতা ও আতঙ্ক, একজন পরিণত আলোকিত মানুষকে অবশ্যই একে অতিক্রম করে আসতে হবে।

হলবাখ তার নিজস্ব ঈশ্বরের ইতিহাস প্রণয়নের প্রয়াস পেয়েছিলেন। আদিম মানুষ প্রকৃতির বিভিন্ন শক্তির উপাসনা করেছে। আদিম অ্যানিমিজম গ্রহণযোগ্য ছিল, কেননা তা এই জগতের উর্ধ্বে যাওয়ার কোনও চেষ্টা করেনি। মানুষ যখন নিজেদের ইমেজ ও পছন্দের আদলে ঈশ্বর সৃষ্টির জন্যে সূর্য, সাগর ও বাতাসকে ব্যক্তিরূপ দিতে শুরু করে তখনই পচনের সূচনা ঘটেছিল। শেষে তারা এসব দেবতাকে এক বিশাল উপাস্যে পরিণত করে, যা আসলে একটা

অভিক্ষেপ ও বৈপরীত্যের স্তূপ বৈ আর কিছুই নয়। শত শত বছর ধরে কবি ও ধর্মবিদরা।

কেবল সুবিশাল পরিবর্ধিত মানুষ তৈরি করা ছাড়া আর কিছু করেননি। যাকে তারা বেমানান সব গুণাবলী একত্রিত করার মাধ্যমে অনন্য সাধারণ করেছেন মানুষ। যা ঈশ্বরের মাঝে কখনওই দেখবে না, বরং মানবজাতির একটা সত্তার, মাঝে তারা বিভিন্ন অনুপাতকে বাড়িয়ে তোলার প্রয়াস পাবে, যতক্ষণ না দুর্বোধ্য একটা সত্তা সৃষ্টি হচ্ছে।

ইতিহাস দেখায়, ঈশ্বরের তথাকথিত মহানুভবতাকে তাঁর সর্বশক্তিমানতার সঙ্গে সমন্বিত করা অসম্ভব। কারণ এখানে সঙ্গতির অভাব রয়েছে, তাই ঈশ্বরের ধারণা বিনষ্ট হতে বাধ্য। দার্শনিক ও বিজ্ঞানীরা এঁকে রক্ষা করার যথাসাধ্য চেষ্টা চালিয়েছেন, কিন্তু তাঁরা কবি ও ধর্মতাত্ত্বিকদের চেয়ে ভালো সাফল্য দেখাতে ব্যর্থ হয়েছেন। দেকার্তে যে hautes perfections প্রমাণ করার দাবি করেছিলেন সেটা কেবল তার কল্পনাসঞ্জাত ব্যাপার ছিল। এমনকি মহান নিউটনও তাঁর ছোটবেলার সংস্কারের দাস’ ছিলেন। তিনি পরম শূন্যতা আবিষ্কার করেছিলেন এবং শূন্য হতে একজন ঈশ্বর সৃষ্টি করেছেন যিনি স্রেফ un homme Puissant; এক স্বর্গীয় শাসক যিনি সৃষ্ট মানুষকে ভয় দেখিয়ে দাসের পর্যায়ে নামিয়ে আনেন।

সৌভাগ্যক্রমে আলোকন পর্ব মানুষকে তার এই শিশু অবস্থা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম করে তুলবে। বিজ্ঞান ধর্মের স্থান গ্রহণ করবে। প্রকৃতি সম্পর্কে অজ্ঞতা ঈশ্বরের জন্ম দিয়ে থাকলে তাঁকে ধ্বংস করার জন্যে প্রকৃতির জ্ঞান প্রণয়ন করা হচ্ছে। সর্বোচ্চ সত্য বা গোপন নকশা বলে কিছু নেই, নেই বিশাল কোনও পরিকল্পনা। একমাত্র প্রকৃতি অস্তিত্বমান;

প্রকৃতি কোনও সৃষ্টি নয়; আগাগোড়াই স্বয়ং-অস্তিত্ববান, তার মাঝেই সমস্ত কিছু পরিচালিত হয়; সমস্ত মালমসলাসহ এক বিশাল পরীক্ষাগার সে, প্রয়োজন অনুযায়ী নিজেই সকল যন্ত্রপাতি প্রস্তুত করে। তার সকল কাজ আপন শক্তির ফলাফল এবং সেইসব এজেন্ট বা কারণের পরিণতি যা সে সৃষ্টি করে, ধারণ করে ও কর্মে প্রয়োগ করে।

ঈশ্বর যে কেবল অপ্রয়োজনীয় তাই নয়, বরং নিশ্চিতভাবে ক্ষতিকর। শতাব্দীর শেষ দিকে পিয়েরে-সাইমন দে লাপ্লেস (১৭৪৯-১৮২৭) পদার্থ বিজ্ঞান হতে ঈশ্বরকে উৎক্ষিপ্ত করেন। সৌরজগৎ ক্রমশঃ শীতল হয়ে আসা সূর্যের বিক্ষিপ্ত অংশসমূহে পরিণত হয়েছিল। নেপোলিয়ন যখন তাঁর কাছে জানতে চাইলেন: এ সবের স্রষ্টা কে? লাপ্লেস সোজাসুজি জবাব দিয়েছিলেন: ‘le n’avais pas besoin de cette hypothe’se-la.”

শত শত বছর ধরে ঈশ্বর ধর্মের একেশ্বরবাদীরা বরাবর বলে এসেছে– ঈশ্বর আরেকটি সত্তা মাত্র নন। তিনি আমাদের অনুভূত অন্যান্য বস্তুর মতো অবস্থান করেন নাই। পশ্চিমে অবশ্য ক্রিস্টান ধর্মবিদরা ঈশ্বর সম্পর্কে এমনভাবে আলোচনায় অভ্যস্থ হয়ে পড়েছিলেন যেন তিনি প্রকৃতই অন্যান্য অস্তিত্বমান বস্তুর মতো ছিলেন। তারা ঈশ্বরের বস্তুগত সত্যতা প্রমাণের জন্যে নতুন বিজ্ঞানকে আঁকড়ে ধরেছিলেন, যেন তাকে অন্যান্য জিনিসের মতো পরীক্ষা ও বিশ্লেষণ করা যাবে। দিদেরো, হলবাখ ও লাসে এই প্রয়াসকে উল্টে দিয়েছেন এবং অধিকতর চরম অতিন্দ্রীয়বাদীর মতো একই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন: মহাশূন্যে কিছু নেই। অচিরেই অন্যান্য বিজ্ঞানী ও দার্শনিকও সগর্বে ঘোষণা দিয়েছেন যে ঈশ্বরের প্রয়াণ ঘটেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *