৩. জেন্টাইলদের প্রতি আলো
ফিলো যখন আলেকজান্দ্রিয়ায় তাঁর প্লেটোনাইজড় ইহুদিবাদ প্রচার করছেন এবং হিল্লেল ও শাম্মাই জেরুজালেমে যুক্তির জাল বিস্তার করে চলেছেন; সেই একই সময়ে একজন ক্যারিশম্যাটিক ফেইথ হীলার উত্তর প্যালেস্তাইনে কাজ শুরু করেছিলেন। জেসাস সম্পর্কে খুব কমই জানি আমরা। তাঁর জীবনের প্রথম পূর্ণাঙ্গ বিবরণী হচ্ছে সেইন্ট মার্কের গস্পেল, যা জেসাসের মৃত্যুর প্রায় চল্লিশ বছর পর আনুমানিক ৭০ সালে রচিত হয়েছিল। ততদিনে জেসাস তাঁর অনুসারীদের জন্যে যে তাৎপর্য অর্জন করেছিলেন সেগুলোর ঐতিহাসিক বাস্ত বতা পৌরাণিক উপাদানের ভারে চাপা পড়ে গিয়েছিল। সেইন্ট মার্ক এই তাৎপর্যকেই মূলত বিশ্বস্ত, সরলরৈখিক উপস্থাপনের বদলে তুলে ধরেছেন। প্রাথমিক ক্রিশ্চানরা তাকে এক নতুন মোজেস, নয়া জোশুয়া, নতুন ইসরায়েলের প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে দেখেছে। বুদ্ধের মতো জেসাসও যেন তাঁর সমসাময়িক অনেকের গভীর আকাঙ্ক্ষা ধারণ করেছেন এবং যে-স্বপ্ন ইহুদিদের শত শত বছর তাড়া করে ফিরেছিল তার বাস্তবায়ন ঘটিয়েছেন। জীবদ্দশায় প্যালেস্তাইনের ইহুদিরা তাঁকে মেসায়াহ বলে বিশ্বাস করেছিল: তিনি জেরুজালেমে প্রবেশ করেছিলেন এবং ডেভিডের পুত্র বলে তার গুণ গাওয়া হয়েছিল; কিন্তু এর মাত্র কয়েকদিন পরেই রোমানদের কষ্টদায়ক কুসিফিক্সশন নামক শাস্তি প্রয়োগ করে তাকে হত্যা করা হয় । কিন্তু সাধারণ অপরাধীর মতো মৃত্যুবরণকারী একজন মেসায়াহর কেলেঙ্কারী সত্ত্বেও অনুসারীরা বিশ্বাস করতে চায়নি যে তাঁকে বিশ্বাস করা ভুল হয়েছে। গুজব ছিল যে, তিনি মৃত অবস্থা থেকে আবার উত্থিত হয়েছিলেন। কেউ কেউ বলেছে, কুসিফিক্সশনের তিন দিন পর নাকি তাঁর কবর ফাঁকা দেখা গেছে; অন্যরা তাকে স্বপ্নে দেখেছে; এবং একবার ৫০০ মানুষ যুগপৎ দেখতে পেয়েছিল তাঁকে। অনুসারীদের বিশ্বাস ছিল যে অচিরেই তিনি ঈশ্বরের মেসিয়ানিক রাজ্য উদ্বোধন করার জন্যে আবার ফিরে আসবেন। যেহেতু এধরনের বিশ্বাস ধর্ম বিরোধী কিছু ছিল না, ওদের গোত্রটিকে হিল্লেলের পৌত্র এবং অন্যতম মহান তেন্নাইম র্যাবাই গ্যামালিয়ের মতো ব্যক্তিও প্রকৃত ইহুদি হিসাবে গ্রহণ করে নিয়েছিলেন। তাঁর অনুসারীরা খাঁটি ইহুদিদের মতো প্রতিদিন মন্দিরে উপাসনা করত। শেষ পর্যন্ত অবশ্য জেসাসের জীবন, মৃত্যু ও পুনরুত্থানে অনুপ্রাণিত নব্য ইসরায়েল এক অ-ইহুদি (জেন্টাইল) ধর্ম বিশ্বাসে পরিণত হবে, যা ঈশ্বর সম্পর্কে এর নিজস্ব সুস্পষ্ট ধারণা গড়ে তুলবে।
আনুমানিক সিই ৩০ সালে জেসাসের মৃত্যুর সময় ইহুদিরা আন্তরিকভাবে গোড়া একেশ্বরবাদী ছিল, সুতরাং মেসায়াহ স্বর্গীয় সত্তা হবেন এমনটা কেউ আশা করেনিঃ তিনি বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত হলেও একজন সাধারণ মানুষই হবেন । কোনও কোনও র্যাবাই মত প্রকাশ করেছেন যে, অনন্তকাল থেকেই ঈশ্বর তাঁর নাম ও পরিচয় জানতেন। সুতরাং, এদিক দিয়ে ভাবলে একথা বলা যেতে পারে যে, সময়ের সূচনার আগে থেকেই প্রোভাবর্স এবং এক্লেসিয়াস্টিকাসের স্বর্গীয় প্রজ্ঞার সত্তার মতো একই প্রতীকী রূপে ঈশ্বরের সঙ্গে ছিলেন মেসায়াহ্। ইহুদিরা মনোনীত সত্তা মেসায়াহকে জেরুজালেমে প্রথমবারের মতো স্বাধীন ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাকারী রাজা ও আধ্যাত্মিক নেতা রাজা ডেভিডের বংশধরকে প্রত্যাশা করেছিল। শ্লোক (Psalms) সমূহ কখনও কখনও ডেভিড বা মেসায়াহকে ঈশ্বরের পুত্র’ অ্যাখ্যা দিয়েছে, কিন্তু সেটা ছিল ইয়াহ্ওয়েহ্র সঙ্গে তাঁর অন্তরঙ্গতা বোঝানোর একটা স্বাভাবিক কায়দা। বাবিলন থেকে প্রত্যাবর্তনের পর থেকে গোয়িমদের ঘৃণিত উপাস্যদের মতো ইয়াহ্ওয়েহ্রও একজন পুত্র আছে, এটা কল্পনাও করেনি কেউ।
আদি রচনা হিসাবে সবচেয়ে বিশ্বস্ত বিবেচিত মার্কের গস্পেল জেসাসকে সম্পূর্ণ সাধারণ স্বাভাবিক মানুষ হিসাবে উপস্থাপন করেছে, যার পরিবার আছে, আছে ভাই ও বোন। কোনও দেবদূত তার জন্মের ঘোষণা দেয়নি বা তাঁর দোলনাকে ঘিরে গান করেনি। শিশু বা কৈশোরে কোনওভাবেই তাঁকে আলাদা বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত বলে মনে হয়নি। যখন তিনি শিক্ষা দান শুরু করেন, নাযারেথের শহরবাসীরা একজন সামান্য ছুতোরের ছেলের এমন প্রতিভাবান হয়ে ওঠায় বিস্মিত হয়েছিল । জেসাসের কর্মজীবন দিয়ে বর্ণনা শুরু করেছেন মার্ক। মনে হয়, তিনি সম্ভবত মূলত ভবঘুরে সন্ন্যাসী জন দ্য ব্যাপটিস্ট-এর অনুসারী ছিলেন, যিনি সম্ভবত একজন এসিন: জেরুজালেমকে মারাত্মকভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত বিবেচনা করেছেন জন এবং এর বিরুদ্ধে কঠোর ভাষায় প্রচারণা চালিয়েছেন। জনগণকে অনুশোচনা করে জর্দান নদীতে স্নান করে পবিত্র হওয়ার এসিন আচার আপন করে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন তিনি। লুক জেসাস এবং জন প্রকৃতই সম্পর্কিত ছিলেন বলে মত প্রকাশ করেছেন। জনের কাছে দীক্ষা নেওয়ার জন্যে নাযারেথ থেকে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে জুদাহয় এসেছিলেন জেসাস। মার্ক যেমন আমাদের বলছেন: “আর তৎক্ষণাৎ জলের মধ্য হইতে উঠিবার সময়ে দেখিলেন, আর স্বর্গ হইতে এই বাণী হইল, “তুমিই আমার প্রিয় পুত্র, তোমাতেই আমি প্রীত”।[১] জেসাসকে নিমেষে মেসায়াহ বলে শনাক্ত করেছেন জন দ্য ব্যাপটিস্ট। জেসাস সম্পর্কে এরপর আমরা যা শুনতে পাই তা হলো, তিনি গ্যালিলির সমস্ত গ্রাম আর শহরে ‘ঈশ্বরের রাজ্য সন্নিকট হইল’[২] ঘোষণাসহ শিক্ষা দান শুরু করেছিলেন।
জেসাসের মিশনের প্রকৃত রূপ সম্পর্কে নানান ধারণা রয়েছে। তাঁর বাণীর খুব অল্প অংশই গস্পেলসমূহে নথিভুক্ত করা হয়েছিল বলে মনে হয় এবং পরবর্তীকালের পরিমার্জনায় এসব বাণীর অনেকাংশই তার মৃত্যুর পর সেইন্ট পল প্রতিষ্ঠিত চার্চসমূহে বিকৃত বা পরিবর্তিত হয়েছে। তা সত্ত্বেও, এমন কিছু সূত্র রয়ে গেছে যেগুলো তার কর্মধারার আবশ্যকীয় ইহুদি প্রকৃতির প্রতি ইঙ্গিত দেয়। ফেইথ হীলারবা গ্যালিলির পরিচিত ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব ছিল বলে উল্লেখ করা হয়েছে: জেসাসের মতোই ভিক্ষুকের জীবন যাপন করত তারা, ধর্মপ্রচার করত, অসুস্থদের সারাত এবং দুরাত্মা তাড়াত। আবার জেসাসের মতোই এইসব গ্যালিলিয় পবিত্র ব্যক্তির বিপুল সংখ্যক নারী শিষ্য থাকতে দেখা যেত। অন্যরা যুক্তি দেখিয়ে থাকেন যে, জেসাস সম্ভবত হিল্লেল-এর মতো একই ভাবধারার ফারিজি ছিলেন, ঠিক পলের মতো, যিনি খৃস্টধর্মে দীক্ষা নেওয়ার আগে নিজেকে ফারিজি দাবি করেছিলে। তিনি র্যাবাই গামালিয়েলের শিষ্য ছিলেন বলে বর্ণিত আছে।[৩] নিঃসন্দেহে জেসাসের শিক্ষা ফারিজিদের প্রধান মতামতের অনুসারী ছিল, কারণ তিনিও বিশ্বাস করতেন যে দান ও প্রেমই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ mitzvot; ফারিজিদের মতো তোরাহুর অনুসারী ছিলেন তিনি এবং বলা হয়ে থাকে যে সমসাময়িকদের তুলনায় অনেক কঠোর অনুসরণের শিক্ষা দিতেন।[৪] হিল্লেলের সোনালি বিধির (Golden Rule) একটি ভাষ্যের শিক্ষা দিয়েছিলেন তিনি, তার যুক্তি ছিল গোটা আইনকে ‘সর্ববিষয়ে তোমরা যাহা যাহা ইচ্ছা কর যে, লোকে তোমাদের প্রতি করে, তোমরাও তাহাদের প্রতি তাহা করিও এই একটা মাত্র সাধারণ বাক্য প্রকাশ সম্ভব।’[৫] সেইন্ট ম্যাথুর গস্পেলে জেসাস ‘স্ক্রাইব ও ফারিজিদের’ বিরুদ্ধে তীব্র ও অশ্লীল মন্তব্য উচ্চারণ করেছেন, তাদেরকে ভয়ানক কপটাচারী হিসাবে তুলে ধরেছেন।[৬] এটা প্রকৃত তথ্যের বা ঘটনার বিকৃত বিবৃতি এবং জেসাসের মিশনের মূল বৈশিষ্ট্য দানের মারাত্মক লজ্জন তো বটেই সেই সঙ্গে ফারিজিদের বিরুদ্ধে তিক্ত বিষোদগারও প্রায় নিশ্চিতভাবেই অসত্যও। উদাহরণ স্বরূপ, লুক তাঁর গস্পেল এবং অ্যাক্টস অভ দ্য অ্যাপসলস উভয়েই ফারিজিদের প্রতি বেশ সুবিচার করেছেন এবং ফারিজিরা যদি সত্যি জেসাসকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া চরম শত্রু হতো তাহলে পল তার ফারিজি পটভূমি নিয়ে বাগাড়ম্বর। করতে যেতেন না। ম্যাথুর গস্পেলের অ্যান্টি-সেমিটিক সুর ৮০র দশকে ইহুদি ও ক্রিশ্চানদের মধ্যকার টানাপোড়েন তুলে ধরে। গস্পেল প্রায়ই দেখায় জেসাস ফারিজিদের সঙ্গে তর্ক করছেন, কিন্তু আলোচনা হয় আন্তরিকতাপূর্ণ কিংবা শাম্মাইয়ের অধিকতর কঠোর মতবাদের সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশ করে।
জেসাসের মৃত্যুর পর অনুসারীরা তিনি স্বর্গীয় সত্তা ছিলেন বলে সিদ্ধান্ত নেয়। ব্যাপারটি কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে ঘটেনি, আমরা যেমনটি দেখব, জেসাস মানবরূপে ঈশ্বর ছিলেন, এই মতবাদ চতুর্থ শতাব্দীর আগে চুড়ান্ত হয়নি। ক্রিশ্চানদের অবতারবাদে বিশ্বাস ধীরে ধীরে, জটিল এক প্রক্রিয়ায় তৈরি হয়েছে। জেসাস নিঃসন্দেহে কখনও নিজেকে ঈশ্বর দাবি করেননি। দীক্ষা গ্রহণের সময় স্বর্গীয় কণ্ঠস্বর তাঁকে ‘ঈশ্বর পুত্র’ বলে আহ্বান করেছিল, কিন্তু এটা হয়তো প্রিয় মেসায়াহ হিসাবে তার স্বীকৃতি ছিল। আকাশ থেকে ধ্বনিত এধরনের ঘোষণায় তেমন অস্বাভাবিক কিছু ছিল না প্রায়শঃই, র্যাবাইগণ প্রায়শঃই তাদের ভাষায় বাত কোল- আক্ষরিক অর্থে, “কণ্ঠস্বরের কন্যা”-এর অনুভূতি লাভ করতেন, যা ছিল সরাসরি পয়গম্বর সুলভ প্রত্যাদেশ প্রাপ্তির বিকল্প একধরনের অনুপ্রেরণা।[৭] পবিত্র আত্মা যখন র্যাবাই ইয়োহান্নান বেন যাক্কাই ও তার অনুসারীদের ওপর আগুনের রূপ নিয়ে অবতীর্ণ হয়ে তাঁর মিশনের স্বীকৃতি দিয়েছিলেন, সেই সময় এরকম বাত কোল শুনতে পেয়েছিলেন তিনি। জেসাস স্বয়ং নিজেকে ‘দ্য সান অভ ম্যান’ হিসাবে পরিচয়। দিতেন। এই উপাধি নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে, কিন্তু এটা মনে হয় যে মূল আরামাইক বাকধারা বার নাশা মানবীয় অবস্থার দুর্বলতা এবং মরণশীলতার উপরই জোর দিয়েছে। যদি তাই হয়, তাহলে জেসাস নিজেকে ক্রমে একদিন কষ্ট সয়ে মারা যাবেন এমন একজন অসহায় মানব সন্তান হওয়ার ব্যাপারে জোর দিয়ে বরং অপ্রত্যাশিত কাজই করে থাকবেন।
অবশ্য গস্পেলসমূহ আমাদের বলে যে, ঈশ্বর জেসাসকে নির্দিষ্ট কিছু স্বর্গীয় ‘ক্ষমতা’ (dunamis) দিয়েছিলেন যে কারণে তিনি কিছুটা মরণশীল থাকলেও রোগ মুক্ত করা ও পাপ মোচনের মতো ঈশ্বর-সম কাজ করার সমর্থ হয়েছিলেন। সুতরাং লোকে যখন জেসাসকে কর্মরত দেখেছে, তখন তারা ঈশ্বর কেমন তার জীবন্ত, চলমান মূর্তির দেখাই পেয়েছে। একবার তাঁর তিন শিষ্য স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি স্পষ্টভাবে তাঁকে দেখার দাবি করেছেন । এ কাহিনীটি তিনটি সিপনোটিক গস্পেলেই রক্ষিত আছে। পরবর্তীকালের ক্রিশ্চানদের কাছে এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। এখানে বলা হয়েছে, পিটার, জেমস এবং জন নামের তিনজন অনুসারীসহ এক উঁচু পাহাড়ে উঠেছিলেন জেসাস-ওটাকে সাধারণভাবে গ্যালিলির তাবর পাহাড় বলে মনে করা হয়। সেখানে অনুসারীদের সামনে ‘দেহের পরিবর্তন’ ঘটান তিনিঃ তাঁহার মুখ সূর্যের ন্যায় দেদীপ্যমান এবং তাহার বস্ত্র দীপ্তির ন্যায় শুভ্র হইল।[৮] আইন ও পয়গম্বরদের প্রতিভূ হিসাবে মোজেস ও এলিযা সহসা তাঁর পাশে হাজির হলেন এবং তিনজনে কথোপকথনে লিপ্ত হলেন। পিটার পুরোপুরি হতবিহ্বল হয়ে চেঁচিয়ে উঠেছিলেন, কি বলছেন বুঝতে পারেননি, এই দিব্যদর্শনকে স্মরণীয় করে রাখতে ওদের তিনখানা কুটির নির্মাণ করতে হবে। সিনাই পর্বতে মোজেসের ওপর নেমে আসা সেই উজ্জ্বল মেঘের মতো মেঘ পাহাড়চূড়া ঢেকে ফেলে এবং একটা বাত কোল ঘোষণা দেয়: ইনিই আমার প্রিয় পুন্ত্র, ইহাতেই আমি প্রীত, ইহার কথা শুন।[৯] বহু শতাব্দী পরে গ্রিক ক্রিশ্চানরা এই দিব্যদর্শনের অর্থ নিয়ে ভাবতে গিয়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে যে ঈশ্বরের ক্ষমতাই জেসাসের পরিবর্তিত দেহায়বয়বের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। তারা আরও উল্লেখ করেছে যে জেসাস কখনও এইসব স্বর্গীয় ক্ষমতা বা দিনামেইজ কেবল নিজের মাঝে সীমাবদ্ধ থাকার দাবি করেননি। জেসাস বারবার অনুসারীদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তারা বিশ্বাস রাখলে অবশ্যই এসব ‘ক্ষমতা’ ভোগ করতে পারবে। বিশ্বাস দিয়ে অবশ্যই সঠিক ধর্মতত্ত্ব গ্রহণ করার কথা বোঝননি তিনি, বরং ঈশ্বরের কাছে আত্মসমর্পণ এবং উন্মুক্ত হওয়ার এক অন্তর্গত প্রবণতার চর্চার কথা বুঝিয়েছেন। অনুসারীরা মনে কোনও রকম সন্দেহ পুষে না রেখে ঈশ্বরের কাছে উন্মুক্ত হতে পারলে তার মতো তারাও সব কিছু করতে পারবে । র্যাবাইদের মতো জেসাস একথা বিশ্বাস করতেন না যে আত্মা (Spitit) কেবল সুবিধাপ্রাপ্ত অভিজাতদের জন্যে, বরং সদিচ্ছাধারী সকল মানুষের কোনও কোনও অনুচ্ছেদে সেই র্যাবাইদের কারও কারও মতে এমনও মত প্রকাশিত হয়েছে যে, এমনকি গোয়িমরাও ‘আত্মাকে গ্রহণ করতে পারে বলে বিশ্বাস করতেন জেসাস। তাঁর অনুসারী ‘বিশ্বাস’ থাকলে তারা এমনকি আরও বড় কেরামতি দেখাতে পারবে। কেবল তারা যে পাপ মোচন ঘটাতে আর দূরাত্মা তাড়াতে পারবে তাই নয়, গোটা একটা পাহাড়কে সাগরে ছুঁড়ে ফেলতে পর্যন্ত সক্ষম হবে।[১০] তারা আবিষ্কার করবে যে তাদের নাজুক মরণশীল জীবনই মেসিয়ানিক রাজ্যে ক্রিয়াশীল ঈশ্বরের ‘ক্ষমতা’য় অলৌকিক রূপ ধারণ করেছে।
জেসাসের মৃত্যুর পর তাঁর অনুসারীরা এই বিশ্বাস ত্যাগ করতে পারেনি যে তিনি কোনও না কোনওভাবে ঈশ্বরের একটা ইমেজের ধারক ছিলেন। প্রায় সূচনা থেকেই তারা জেসাসকে উদ্দেশ্য করে প্রার্থনা শুরু করেছিল। সেইন্ট পলের বিশ্বাস ছিল, ঈশ্বরের ক্ষমতাকে গোমিয়দের কাছে গ্রহণ উপযোগি করে তোলা উচিত, তিনি তাই বর্তমান তুরস্ক, ম্যাসিদোনিয়া-এর গ্রিসে গস্পেল প্রচার করেছিলেন। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল কোনও অ-ইহুদি মোজেসের আইনের পুরোপুরি অনুসরণ না করেও নব্য ইসরায়েলের সদস্য হতে পারে। এতে অনুসারীদের মূল দলটি ক্ষুব্ধ হয়, আলাদা ইহুদি গোত্র হিসাবে পরিচিত হতে চেয়েছিল ওরা। এক আবেগময় বিরোধের পর পলের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ ঘটায় তারা। অবশ্য পলের ধর্মান্তরিতদের অধিকাংশই ছিল ডায়াসপোরার ইহুদি বা ‘গডফিয়ারার’, ফলে নব্য ইসরায়েল গভীরভাবে ইহুদিবাদী রয়ে গিয়েছিলে। পল কখনওই জেসাসকে ‘ঈশ্বর’ সম্বোধন করেননি। তিনি ইহুদি অর্থে তাঁকে ‘সান অভ গড়’ বলে ডেকেছেন; জেসাস স্বয়ং ঈশ্বরের অবতার ছিলেন, একথা তিনি বিলকুল বিশ্বাস করতেন নাঃ স্রেফ ঈশ্বরের ক্ষমতা’ আর ‘আত্মা ছিল তার আয়ত্তে যা পৃথিবীতে ঈশ্বরের কর্মকাণ্ডের প্রকাশ ঘটায় এবং স্বর্গীয় সত্তার সঙ্গে যাকে একাকার করা যায় না। এখানে বিস্ময়ের কিছু নেই যে, জেন্টাইল জগতে নব্য-ক্রিশ্চানরা এই সূক্ষ্ম পার্থক্যের বোধ বজায় রাখত না; ফলে শেষ পর্যন্ত একজন মানুষ যে দুর্বল ও মরণশীল মানবজীবনের ওপর জোর দিয়েছেন তাঁকে স্বর্গীয় বলে বিশ্বাস করা হয়েছে। জেসাসের দেহে ঈশ্বরের অবতারের ধারণা বা মতবাদ বরাবরই ইহুদিদের বিক্ষুব্ধ করেছে, এবং পরবর্তী সময়ে মুসলিমরাও ব্লাসফেমাস বলে আবিষ্কার করবে। সুনির্দিষ্ট বিপদ সম্বলিত কঠিন মতবাদ এটা। ক্রিশ্চানরা প্রায়শঃই আনাড়িভাবে একে ব্যাখ্যা করে থাকে। তারপরেও ধর্মের ইতিহাসে এ ধরনের অবতারবাদী ভক্তি মোটামুটি একটা সাধারণ বৈশিষ্ট্য: আমরা দেখব, এমনকি ইহুদি ও মুসলিমরাও আশ্চর্যরকম সাদৃশ্যপূর্ণ নিজস্ব ধর্মতত্ত্বের জন্ম দিয়েছে।
প্রায় একই সময়ে ভারতে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনাবলীর সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনার মাধ্যমে জেসাসের চমকপ্রদ স্বর্গীয়করণের পেছনে ক্রিয়াশীল ধর্মীয় প্রেরণা বুঝতে পারি আমরা। বৌদ্ধ এবং হিন্দু উভয় ধর্মে স্বয়ং বুদ্ধ এবং মানবরূপে আবির্ভূত হিন্দু দেবতার মতো উন্নত সত্তার প্রতি প্রবল ভক্তি প্রকাশের জোয়ার সৃষ্টি হয়েছিল । ভক্তি নামে পরিচিত এ ধরনের ব্যক্তিগত আনুগত্য, মানবায়িত ধর্মের জন্যে মানুষের চিরন্তন আকাক্ষার প্রকাশ বলে মনে হয়। এটা একেবারে নতুন ধরনের বিচ্যুতি হলেও উভয় ধর্মবিশ্বাসে অত্যাবশ্যকীয় শর্তাবলী বাদ না দিয়েই ধর্মের সঙ্গে যোগ করা হয়েছিল।
আনুমানিক বিসিই দুই শতাব্দীর শেষ নাগাদ বুদ্ধের মৃত্যুর পর মানুষ স্বাভাবিকভাবেই তার একটা স্মৃতিচিহ্নের আকাঙ্ক্ষা করেছিল, কিন্তু তারা এও ভেবেছে যে কোনও মূর্তি নির্মাণ সঙ্গত হবে না, কেননা নির্বাণ লাভের পর স্বাভাবিক অর্থে তাঁর আর কোনও অস্তিত্ব নেই। কিন্তু তারপরেও বুদ্ধের প্রতি ব্যক্তিগত অনুরাগ ও তার আলোকপ্রাপ্ত মানব রূপ নিয়ে ধ্যান করার প্রয়োজন এমন প্রবল হয়ে উঠেছিল যে, শেষ অবধি বিসিই প্রথম শতাব্দীতে উত্তর-পশ্চিম ভারতের গান্ধারা ও যমুনা নদী তীরবর্তী মথুরায় প্রথমবারের মতো তার মূর্তির আবির্ভাব ঘটে। এই প্রতিমাগুলো থেকে পাওয়া ক্ষমতা ও প্রেরণা বৌদ্ধ আধ্যাত্মিকতার ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, যদিও গৌতমের দেওয়া শিক্ষা অন্তরের শৃঙ্খলা ও সত্তার বাইরের কারও প্রতি ভক্তি প্রকাশ সম্পূর্ণ ভিন্ন। সব ধর্মই পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত হয়। তা না হলে সেগুলো অচল হয়ে পড়বে। অধিকাংশ বৌদ্ধের কাছে ভক্তি অপরিসীম মূল্যবান বলে মনে হয়েছে । এটা বিলুপ্তির আশঙ্কায় থাকা বেশ কিছু আবশ্যকীয় সত্য তাদের মনে করিয়ে দেয়। স্মরণ করা যেতে পারে, বুদ্ধ প্রথম আলোকপ্রাপ্ত হওয়ার পর ব্যাপারটি গোপন রাখতে প্রলুব্ধ হয়েছিলেন, কিন্তু যন্ত্রণাকাতর মানুষের প্রতি দরদ থেকে পরবর্তী চল্লিশ বছর পথ প্রদর্শনে বাধ্য হয়েছেন। তারপরেও বিসিই প্রথম শতাব্দী নাগাদ বৌদ্ধ মঙ্ক বা ভিক্ষুরা আপন নির্বাণ লাভের প্রয়াসে মঠে মঠে বন্দি হয়ে যাওয়ায় এই বিষয়টি বিস্মৃত হয়ে যাচ্ছিলেন যেন। ভিক্ষু পেশা অত্যন্ত কঠিন ছিল বলে অনেকেই একে সাধ্যের অতীত মনে করেছে। সিই প্রথম শতাব্দীতে এক নতুন ধরনের বৌদ্ধ বীরের আবির্ভাব ঘটে: বোধিসত্তা, যিনি বুদ্ধের উদাহরণ অনুসরণ করেন এবং মানুষের জন্যে নিজেকে বিসর্জন দিয়ে আপন নির্বাণ বিসর্জন দেন। দুর্গত মানুষকে যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্যে তিনি পুনর্জন্মের কষ্ট ভোগে প্রস্তুত। বিসিই প্রথম শতাব্দীর শেষ দিকে সংকলিত প্রজ্ঞা-পারমিতা সূত্ৰসমূহ (Sermons on the Perfection of Wisdom)-এ যেমন ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে বোধিসত্তারা:
আপন নির্বাণ লাভের আকাঙ্ক্ষা করেন না। বরং বিপরীতে, তাঁরা সত্তার অত্যন্ত যন্ত্রণাময় পৃথিবী জরিপ করেছেন, কিন্তু তারপরেও উচ্চমার্গের আলোক প্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষা করেন, জন্ম ও মৃত্যুর পালায় কম্পিত ওরা নন। পৃথিবীর প্রতি করুণাবশত পৃথিবীর উপকার সাধনের ব্রত নিয়েছেন ওরা, পৃথিবীকে শান্তি দেওয়ার উদ্দেশ্যে। ওরা স্থির করেছেন: ‘আমরা পৃথিবীর জন্যে আশ্রয়ে পরিণত হব, পৃথিবীর বিশ্রামের স্থল, পৃথিবীর পরম স্বস্তি, পৃথিবীর শান্তির দ্বীপ, পৃথিবীর আলোকমালা, পৃথিবীর উদ্ধারপ্রাপ্তির উপায়ের পথ প্রদর্শক।’[১১]
এছাড়াও, বোধিসত্ত্ব অপরিসীম মেধার অধিকারী হয়েছিলেন, যা আধ্যাত্মিক দিক দিয়ে দুর্বলকে সাহায্য করতে সক্ষম। বোধিসত্তার কাছে প্রার্থনাকারী বৌদ্ধ জগতের এক স্বর্গে পুনর্জন্ম গ্রহণ করতে পারবে, যেখানকার পরিবেশ আলোকপ্রাপ্তি অনেক সহজ করে দেবে ।
টেক্সট জোর দিয়েছে যে এসব ধারণা আক্ষরিক অর্থে ব্যাখ্যা করার নয়। এগুলো মামুলি যুক্তি বা পৃথিবীর ঘটনাপ্রবাহের সাথে সম্পর্কহীন, বরং স্রেফ ধরাছোঁয়ার অতীত এক সত্যের প্রতীক মাত্র। সিই দ্বিতীয় শতাব্দীর গোড়ার দিকে দার্শনিক নাগার্জুন দ্বন্দ্বমূলক শূন্য (void) মতবাদের প্রবর্তক, সাধারণ ধারাণাগত ভাষার অপূর্ণাঙ্গতা প্রকাশ করার উদ্দেশ্যে বিপরীত ও দ্বান্দ্বিক পদ্ধতির ব্যবহার করেছিলেন তিনি। তার জোরাল বক্তব্য ছিল পরম সত্য কেবল সাধনা বা ধ্যানের মাধ্যমে মানসিক শৃঙ্খলার ভেতর দিয়েই অর্জন করা। সম্ভব। এমনকি বুদ্ধের শিক্ষাও ছিল প্রথাগত, মানবসৃষ্ট ধারণা যা তিনি যে সত্য বোঝানোর প্রয়াস পেয়েছিলেন তার প্রতি সুবিচার করেনি। এই দর্শন গ্রহণকারী বৌদ্ধরা এমন ধারণা গড়ে তুলেছিল যে, আমরা যা কিছুর অভিজ্ঞতা লাভ করি তা আসলে মায়া। পশ্চিমে আমরা এদের হয়তো আদর্শবাদী বলব । সকল বস্তুর মূল সত্তা, পরম বা অ্যাবসোলিউট আসলে শূন্য, কিছু না, স্বাভাবিক জ্ঞানে যার কোনও অস্তিত্ব নেই। এই শূন্যতাকে নির্বাণের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলাটা স্বাভাবিক। যেহেতু গৌতমের মতো একজন বুদ্ধ নির্বাণ লাভ করেছেন, এর মানে অলৌকিক কোনও উপায়ে তিনি স্বয়ং নির্বাণে পরিণত হয়েছেন, পরমের সঙ্গে একীভূত হয়ে গেছেন। সুতরাং নির্বাণাকাক্ষী প্রত্যেকেই বুদ্ধদের সঙ্গে একীভূত হওয়ারও প্রত্যাশী।
বুদ্ধ এবং বোধিসত্তাদের প্রতি এই ভক্তির সঙ্গে জেসাসের প্রতি ক্রিশ্চানদের ভক্তির মিল আছে। এটা ধর্মকে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলেছে, যেমন পল ইহুদিদের গোয়িমদের কাছে পৌঁছে দিতে চেয়েছিলেন। একই সময়ে হিন্দুদের মাঝেও একই ধরনের ভক্তির একটা জোয়ার সৃষ্টি হয়েছিল, যার কেন্দ্রে ছিলেন অন্যতম বৈদিক দেবতা শিব এবং বিষ্ণু। তারপরও সাধারণ মানুষের ভক্তি উপনিষদের দার্শনিক মিতাচারের চেয়ে শক্তিশালী প্রমাণিত হয়েছিল। কার্যত, হিন্দুরা এক ত্রিত্ববাদ জন্ম দিয়েছিল: ব্রক্ষ্মা, শিব এবং বিষ্ণু ছিলেন এক একক অলৌকিক সত্তার তিন প্রতীক বা বৈশিষ্ট্য।
অনেক সময় শিবরূপে ঈশ্বরের রহস্য সম্পর্কে চিন্তাভাবনা অনেক সহজ হয়ে থাকে: তিনি একাধারে ভালো-মন্দ, উর্বরতা-সংযমের দেবতা, যিনি স্রষ্টা এবং ধ্বংসকারী। জনপ্রিয় কিংবদন্তী অনুযায়ী শিব একজন মহান যোগিও ছিলেন, আবার ভক্তবৃন্দকে তিনি ধ্যানের মাধ্যমে ঈশ্বর সম্পর্কে ব্যক্তিগত ধারণার উর্ধ্বে ওঠারও অনুপ্রেরণা যোগান। বিষ্ণু মূলত আরও দয়াময় ও কর্মতৎপর। তিনি বিভিন্ন অবতাররূপে মানুষের সামনে নিজেকে উপস্থাপন করতে পছন্দ করেন। তাঁর অন্যতম বিখ্যাত রূপ হচ্ছে কৃষ্ণ চরিত্রটি, যিনি অভিজাত পরিবারে জন্ম নিলেও বেড়ে উঠেছিলেন রাখাল হিসাবে। জনপ্রিয় কিংবদন্তীগুলোয় রাখালীনিদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের গল্প অত্যন্ত প্রিয়, এসব গল্প ঈশ্বরকে আত্মার প্রেমিক হিসাবে উপস্থাপন করেছে। তারপরেও ভগবদ গীতায় বিষ্ণু যখন কৃষ্ণরূপে রাজপুত্র অর্জুনের সামনে উপস্থিত হন সে এক, ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা:
হে ঈশ্বর, তোমার দেহে আমি দেবতাদের দেখি,
আর বহু প্রাণের অস্তিত্ব:
মহাবিশ্বের স্রষ্টা ব্রহ্মা,
বসে আছেন পদ্ম সিংহাসনে,
দেবতা সকল আর স্বর্গীয় সরিসৃপ।[১২]
যেভাবেই হোক, কৃষ্ণের দেহে সব কিছুই আছে তার কোনও আদি বা অন্ত নেই, মহাশূন্য পূর্ণ করে আছেন তিনি এবং সব সম্ভাব্য উপাস্যদের ধারণ করছেন: ‘সংক্ষুব্ধ ঝড়-দেবতা, সূর্য দেবতাগণ, উজ্জ্বল দেবতাগণ এবং ‘আচারের দেবতাগণ।’[১৩] তিনি মানুষের ক্লান্তিহীন চেতনা’, মানুষের মূল সত্তা।[১৪] সমস্ত কিছু কৃষ্ণের দিকে ধাবিত হয়: সমস্ত নদীসমূহ যেমন সাগরের দিকে ধেয়ে যায় বা আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়ে মথ। এই ভয়ানক দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে সম্পূর্ণ দিশাহারা অর্জুনের কম্পিত হওয়া আর কিছুই করার থাকে না।
ভক্তির বিকাশ পরম সত্তার সঙ্গে মানুষের যেকোনও ধরনের ব্যক্তিগত সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার গভীর চাহিদার জবাব দেয়। ব্রাক্ষ্মণকে পুরোপুরি দুয়ে হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার পর তার একেবারে দূরবর্তী হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ফলে প্রাচীন ‘স্কাই গডে’র মতো মানুষের চেতনা থেকে পুরোপুরি মুছে যেতে পারেন তিনি। বুদ্ধ ধর্মে বোধিসত্তা মতবাদ এবং বিষ্ণুর অবতারসমূহ যেন ধর্মীয় বিকাশের আরেকটি পর্যায় নির্দেশ করে, যখন মানুষ পরম সত্তা মানুষের চেয়ে নিম্ন পর্যায়ের হতে পারে না বলে জোর দিয়েছে। এইসব প্রতীকী মতবাদ এবং মিথ একটামাত্র এপিফ্যানি দিয়ে পরম সত্তাকে প্রকাশ করার ব্যাপারটি অস্বীকার করে: বোধিসত্তা এবং বুদ্ধের কোনও সীমা পরিসীমা নেই; আর অসংখ্য অবতার রয়েছে বিষ্ণুর। এসব মিথ মানুষের জন্যে আদর্শও প্রকাশ করে: মানবজাতিকে আলোকপ্রাপ্ত বা দেবতৃপ্রাপ্ত হিসাবে দেখায় এগুলো, যা মানুষের উদ্দীষ্ট।
সিই প্রথম শতাব্দী নাগাদ ইহুদিদেরও একই ধরনের স্বর্গীয় পরিব্যাপীতার তৃষ্ণা দেখা দিয়েছিল। জেসাসের ব্যক্তিসত্তা এই চাহিদা মিটিয়েছিল বলে মনে হয়। আমাদের জানা ক্রিস্টান ধর্মটির স্রষ্টা গোড়ার দিকের ক্রিশ্চান লেখক সেইন্ট পল বিশ্বাস করতেন, জেসাস জগতে ঈশ্বরের মূল প্রত্যাদেশ হিসাবে তোরাহুকে প্রতিস্থাপিত করেছেন।[১৫] তিনি একথা দিয়ে ঠিক কী বোঝাতে চেয়েছিলেন, জানা সহজ নয়। পলের পত্রাবলী এক সুসমন্বিত ধর্মতত্ত্বের বিবরণ চেয়ে বরং কিছু সুনির্দিষ্ট প্রশ্নমালার উত্তর। জেসাসকে তিনি অবশ্যই মেসায়াহ্ বলে বিশ্বাস করতেন: ‘ক্রাইস্ট’ শব্দটি হিব্রু মসিয়াক শব্দটির অনুবাদ, যার অর্থ মনোনীত জন। পল ব্যক্তি জেসাস সম্পর্কে এমনভাবে কথা বলেছেন যেন তিনি সাধারণ মানুষের চেয়ে বেশি কিছু ছিলেন, যদিও ইহুদি হিসাবে পল জেসাস ঈশ্বরের অবতার ছিলেন বলে বিশ্বাস করতেন না। জেসাস সম্পর্কে নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বারবার যিশু খৃস্টে (In christ) শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করেছেন: ক্রিশ্চানদের বাস ‘যিশু খৃস্টে’, তাঁর মৃত্যুতে তারা ব্যাপ্টাইজ হয়েছে, চার্চ কোনওভাবে তাঁর দেহ গঠন করেছে।[১৬] পল যুক্তি দিয়ে এই সত্যের পক্ষে কথা বলেননি। বহু ইহুদির মতো তিনি গ্রিক যুক্তিবাদের প্রতি বিরূপ দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেছেন, যাকে তিনি স্রেফ ‘বোকামি’[১৭] বলে বর্ণনা করেছেন। এক আধ্যাত্মিক ও অতিন্দ্রীয় অভিজ্ঞতার ফলে তিনি জেসাসকে এক ধরনের পরিবেশ হিসাবে বর্ণনা করতে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন সেখানে আমরা বাস করি, চলাফেরা করি এবং আমাদের সত্তার সন্ধান পাই।[১৮] পলের ধর্মীয় বোধের উৎসে পরিণত হয়েছিলেন জেসাস: সেই কারণেই জেসাস সম্পর্কে এমনভাবে কথা বলেছিলেন তিনি তাঁর সমসাময়িকরা যেমন করে ঈশ্বরের আলোচনা করে থাকবেন।
দায়িত্বপ্রাপ্ত ধর্ম সম্পর্কে ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে পল বলেছেন যে, ‘আমাদের পাপের’[১৯] জন্যে জেসাস কষ্ট ভোগ করেছেন এবং প্রাণ দিয়েছেন। এতে বোঝা যায় একেবারে গোড়ার দিকে জেসাসের অনুসারীরা তাঁর মৃত্যুর কেলেঙ্কারীতে হতবিহ্বল হয়ে পড়ে এবং ঘটনাটি কোনওভাবে আমাদের স্বার্থেই ঘটেছে বলে ব্যাখ্যা করে। নবম অধ্যায়ে আমরা দেখব, সপ্তদশ শতাব্দীতে অন্য ইহুদিরাও আরও এক মেসায়াহর কলঙ্কজনক পরিসমাপ্তির প্রেক্ষিতে একই রকম ব্যাখ্যা খুঁজে পাবে। গোড়ার দিকের ক্রিশ্চানরা মনে করেছে যে কোনও রহস্যময় উপায়ে জেসাস বেঁচে আছেন এবং তার ক্ষমতা এখন তাঁর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী তাদের মাঝে স্থান পেয়েছে। পলের পত্রাবলী থেকে আমরা জানি যে, গোড়ার দিকের ক্রিশ্চানরা সব ধরনের অস্বাভাবিক অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিল যা হয়তো এক নতুন ধরনের মানবতার ইঙ্গিতবাহী হয়ে থাকবে কেউ কেউ ফেইথ-হীলার-এ পরিণত হয়েছিল, কেউ আবার স্বর্গীয় ভাষায় কথা বলত, অন্যরা ঈশ্বর থেকে প্রাপ্ত বলে বিশ্বাস করা বাণীর প্রচার করত। চার্চের প্রার্থনাগুলো কোলাহলপূর্ণ জাকাল ব্যাপার ছিল, মোটেই বর্তমান কালের প্যারিশ-চার্চের সান্ধ্য উপাসনা সঙ্গীতের মতো রুচিশীল নয়। জেসাসের মৃত্যু কোনওভাবে উপকারে এসেছিল বলেই মনে হয়: এটা এক নতুন ধরনের জীবন এবং এক নতুন সৃষ্টি’ সহজ করে তুলেছিল যা পলের পত্রাবলীর স্থায়ী সুর।[২০]
কুসিফিক্সশন আদমের কোনও ‘আদি পাপের প্রায়শ্চিত্ত হওয়ার ব্যাপারে অবশ্য বিস্তারিত কোনও মতবাদ ছিল নাঃ আমরা দেখব, চতুর্থ শতাব্দীর আগে এই মতবাদ জন্ম নেয়নি এবং এটা শুধু পশ্চিমেই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। পল এবং অন্য নিউ টেস্টামেন্ট রচয়িতাগণ কখনওই তাদের নিষ্কৃতি লাভের (Salvation) স্পষ্ট, পরিষ্কার ব্যাখ্যা দেওয়ার প্রয়াস পাননি। তবু ক্রাইস্টের আত্মউৎসর্গ-সূচক মৃত্যু একই সময়ে ভারতে বিকাশ পাওয়া বোধিসত্তার আদর্শের অনুরূপ। বোধিসত্তার মতো ক্রাইস্ট কার্যত মানুষ ও পরম সত্তার মধ্যস্থতাকারীতে পরিণত হয়েছিলেন, পার্থক্য হচ্ছে, জেসাসই একমাত্র মধ্যস্থতাকারী এবং তার দেওয়া মুক্তি বোধিসত্তাদের মতো ভবিষ্যতের অনাদায়ী অনুপ্রেরণা নয়, বরং তর্কাতীত ব্যাপার। পল জোর দিয়ে বলেছেন জেসাসের ত্যাগ ছিল অনন্য। তিনি যদিও বিশ্বাস করতেন যে অন্যের স্বার্থে তাঁর নিজস্ব ভোগান্তি ছিল মঙ্গলকর, কিন্তু তাঁর স্পষ্ট বিশ্বাস ছিল জেসাসের দুর্ভোগ এবং মৃত্যু সম্পূর্ণ ভিন্ন পর্যায়ের।[২১] এখানে সুপ্ত বিপদ রয়েছে। অসংখ্য বুদ্ধ এবং ছলনাময় ও বৈপরীত্যে পূর্ণ সকল অবতার বিশ্বাসীকে মনে করিয়ে দেয় যে, পরমসত্তাকে কোনও একটা আকারে পরিপূর্ণভাবে ব্যাখ্যা বা প্রকাশ করা সম্ভব নয়। খৃস্টধর্মের একক অবতারবাদ বোঝাতে চায় যে, ঈশ্বরের অন্তহীন সত্তা মাত্র একজন মানুষের মাঝে প্রকাশ পেয়েছিল যা তাঁকে একধরনের অপরিপকু পৌত্তলিকতার দিকে ঠেলে দিতে থাকে।
জেসাস জোর দিয়ে বলে গেছেন যে, ঈশ্বরের ‘ক্ষমতা’ কেবল তার একার জন্যে নয়। জেসাস এক নতুন ধরনের মানুষের প্রথম উদাহরণ, এই যুক্তি দেখিয়ে পল এই দর্শনকে আরও বিকশিত করেছেন। প্রাচীন ইসরায়েল যা কিছু অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে তিনি কেবল সেগুলো অর্জনই করেননি, বরং এক নতুন আদমে পরিণত হয়েছেন, এক নতুন মানবতা যেখানে গোয়িমসহ সব মানুষ যেভাবেই হোক যোগ দিতে বাধ্য।[২২] আবার, এটার সঙ্গে বৌদ্ধদের বিশ্বাস, যেহেতু সকল বুদ্ধ পরমসত্তার সঙ্গে একীভূত হয়ে গেছেন, সেহেতু, এক বুদ্ধসমাজে (Buddhahood) যোগ দেওয়াই মানুষের আদর্শ হতে ভিন্ন নয়।
ফিলিপিন্থ চার্চের উদ্দেশে লেখা চিঠিতে কিছু জরুরি প্রসঙ্গ উত্থাপনকারী গোড়ার দিকের ক্রিশ্চান-হাইম বলে বিবেচিত গানের উদ্ধৃতি দিয়েছেন তিনি। নবদীক্ষিতদের তিনি বলেছেন, তাদের অবশ্যই জেসাসের মতো আত্মত্যাগের প্রবণতা থাকতে হবে,
ঈশ্বরের স্বরূপ বিশিষ্ট থাকিতে তিনি ঈশ্বরের
সমান থাকা ধরিয়া লইবার বিষয় জ্ঞান করিলেন না,
কিন্তু আপনাকে শূন্য করিলেন,
দাসের রূপ ধারণ করিলেন,
মনুষ্যদের সাহায্যে জন্মিলেন;
এবং আকারে প্রকারে মনুষ্যবৎ প্রত্যক্ষ হইয়া
আপনাকে অবনত করিলেন;
মৃত্যু পর্যন্ত, এমনকি, ক্রুশীয় মৃত্যু পর্যন্ত আজ্ঞাবহ হইলেন।
এই কারণ ঈশ্বর তাহাকে অতিশয় উচ্চ-পদান্বিতও করিলেন,
এবং তাহাকে সেই নাম দান করিলেন,
যাহা সমুদয় নাম অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ;
যেন যীশুর নামে স্বর্গ, মর্ত্য পাতালনিবাসীদের
‘সমুদয় জানু পতিত হয়, এবং সমুদয় জিহ্বা যেন স্বীকার করে’
যে যীশু খৃস্টের প্রভু (Kyrios),
এই রূপে পিতা ঈশ্বর যেন মহিমান্বিত হন।[২৩]
এই প্রার্থনা সঙ্গীতে যেন ক্রিশ্চানদের এমন একটা বিশ্বাস প্রতিফলিত হচ্ছে যে ‘আত্মশূন্য’ (Kenosis) করার ভেতর দিয়ে মানুষ হওয়ার আগে জেসাস ‘ঈশ্বরের সঙ্গে অবস্থান করছিলেন, এবং মানবরূপে বোধিসত্তার মতো মানবীয় অবস্থার দুর্ভোগের অংশীদার হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। অনন্ত কাল ধরে YHWH-এর পাশে দ্বিতীয় স্বর্গীয় সত্তা হিসাবে খৃস্টের অস্তিত্বের ধারণা গ্রহণ করা পলের মতো ইহুদির পক্ষে সম্ভব ছিল না। প্রার্থনা সঙ্গীত দেখাচ্ছে মহিমান্বিত হওয়ার পরেও জেসাস ঈশ্বরের চেয়ে ভিন্ন এবং নিম্নস্তরে রয়ে গেছেন। ঈশ্বর তাকে উন্নীত করে কাইরিয়স উপাধি দিচ্ছেন। জেসাস নিজে এই উপাধি গ্রহণ করতে পারেন না, উপাধিটি দেওয়া হয়েছে কেবল পিতা ঈশ্বরের মহিমায়।
প্রায় চল্লিশ বছর পর সেইন্ট জনের গস্পেলের রচয়িতা (রচনাকাল Ca ১০০) একই ধরনের মত প্রকাশ করেন। সূচনায় তিনি সৃষ্টির নিমিত্ত বাণী ‘শুরু হতেই ঈশ্বরের সঙ্গে’ ছিল বলে বর্ণনা করেছেন: ‘সকলেই তাঁহার দ্বারা হইয়াছিল, যাহা হইয়াছে, তাহার কিছুই তারা ব্যতিরেকে হয় নাই।’[২৪] লেখক ফিলোর মতো একই অর্থ বোঝাতে লোগোস শব্দটি ব্যবহার করছিলেন নাঃ তাঁকে হেলেনাইজড ইহুদিবাদের চেয়ে বরং প্যালেস্তাইনি ইহুদিবাদের সঙ্গে বেশি সম্পর্কিত বলে মনে হয়। এই সময়ে লিপিবদ্ধ তারগামস (Targums) নামে পরিচিত হিব্রু ঐশীগ্রন্থের আরামিক অনুবাদে মেমরা (বাণী) শব্দটি পৃথিবীতে ঈশ্বরের কর্মকাণ্ড বর্ণনা করার জন্যে ব্যবহৃত হয়েছে। প্রতাপ, ‘পবিত্র আত্মা’ ও ‘শেকিনাহ্’র মতো অন্যান্য কারিগরি পরিভাষার মতোই ছিল এর অর্থ যা পৃথিবীতে ঈশ্বরের উপস্থিতি এবং স্বয়ং ঈশ্বরের দুর্বোধ্য সত্তার পার্থক্যের উপর জোর দেয়। স্বর্গীয় প্রজ্ঞার মতো, বাণী’ ঈশ্বরের সৃষ্টির আদি পরিকল্পনাকে প্রতীকায়িত করে। পল এবং জন জেসাসের পূর্বজীবন থাকার কথা বলার সময় আসলে এটা বোঝাতে চাননি যে তিনি পরবর্তীকালে ত্রিত্ববাদী ধারণা অনুযায়ী দ্বিতীয় স্বর্গীয় ব্যক্তি ছিলেন। তাঁরা বুঝিয়েছেন, জেসাস মানবীয় এবং ব্যক্তিক অস্তিত্বের উর্ধ্বে উঠেছিলেন। যেহেতু তাঁর প্রদর্শিত ‘ক্ষমতা’ ও ‘প্রজ্ঞা’ ঈশ্বর থেকে গৃহীত কর্মকাণ্ড, তাই কোনওভাবে ‘যাত্রা হইতে তিনি ছিলেন’[২৫] বলে তা প্রকাশ করেছিলেন।
কঠোর ইহুদি পটভূমিতে এইসব ধারণা বোধগম্য ছিল, কিন্তু পরবর্তী সময়ের গ্রিক পটভূমির ক্রিশ্চানরা এগুলোকে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করবে। সিই ১০০ সালের দিকে রচিত অ্যাক্টস অভ দ্য অ্যাপসলস-এ আমরা দেখতে পাই, প্রথম দিকের ক্রিশ্চানদের তখনও ঈশ্বরের ইহুদি ধারণাই ছিল। পেন্টেস্টের ভোজে যখন সিনাই পর্বতে তোরাহ্ অবতীর্ণ হওয়ার বার্ষিকী উদযাপনের উদ্দেশ্যে ডায়াসপোরা থেকে শত শত ইহুদি জেরুজালেমে সমবেত হয়েছিল, তখন জেসাসের সঙ্গীদের ওপর পবিত্র আত্মা অবতরণ করেছিলেন। ‘হঠাৎ আকাশ হইতে প্রচণ্ড বায়ুর বেগের শব্দবৎ একটা শব্দ আসিল…এমন অনেক অগ্নিবৎ জিহ্বা তাহাদের দৃষ্টিগোচর হইল।’[২৬] এই প্রথম ইহুদি ক্রিশ্চানদের সামনে তাদের সমসাময়িক তেন্নাইমদের মতো পবিত্র আত্মা নিজেকে প্রকাশ করেছিলেন। অবিলম্বে অনুসারীরা দ্রুত বেরিয়ে গিয়ে ‘পার্থীয়, মাদীয় ও এলমীয় লোক এবং মিসমপতামিয়া, যিহুদিয়া ও কাপ্পাদকিয়া, পন্ত ও আশিয়া, ফরুগিয়া ও পাফুলিয়া, মিসর এবং লুবিয়া দেশস্থ, কুবীনির নিকটবর্তী এই অঞ্চল নিবাসী এবং প্রবাসকারী রোমীয়’[২৭] থেকে আগত ইহুদি ও গডফিয়ারারদের মাঝে প্রচারণা শুরু করে দিয়েছিলেন। সবিস্ময়ে তারা আবিষ্কার করে যে, অনুসারীরা তাদের নিজস্ব ভাষাতেই প্রচার করছে। পিটার জমায়েতের উদ্দেশে বক্তব্য রাখতে উঠে দাঁড়ানোর পর এই ঘটনাকে ইহুদিদের সর্বোচ্চ পর্যায়ের বলে তুলে ধরেন তিনি। পয়গম্বরগণ ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছেন, এমন একদিন আসবে যখন ঈশ্বর মানবজাতির ওপর তার আত্মা অবতরণ করাবেন যার ফলে এমনকি নারী ও দাসরাও দিব্যদর্শন পাবে, স্বপ্ন দেখবে।[২৮] সেইদিন মেসিয়ানিক রাজ্যের উদ্বোধন ঘটবে এবং ঈশ্বর তার জাতির সঙ্গে পৃথিবীতে বসবাস করবেন। নাযারেথের জেসাসই যে ঈশ্বর, এ দাবি করেননি পিটার। তিনি ছিলেন অদ্ভুত লক্ষণ ও চিহ্নসমূহ দ্বারা তোমাদের নিকটে ঈশ্বর কর্তৃক প্রমাণিত মনুষ্য: তাহারই দ্বারা ঈশ্বর তোমাদের মধ্যে ঐসকল কাৰ্য্য করিয়াছেন, যেমন তোমরা নিজেই জান। তার নিষ্ঠুর মৃত্যুর পর ঈশ্বর আবার তাঁকে জীবন দান করেছেন এবং ঈশ্বরের দক্ষিণ হস্ত দ্বারা উচ্চীকৃত হওয়াতে তাঁকে এক বিশেষ মর্যাদা দিয়েছেন। পয়গম্বর এবং শ্লোক রচয়িতাগণ সবাই এই ঘটনার আগেই পূর্বাভাস দিয়েছিলেন; এইভাবে ইস্রায়েলের সমস্ত কুল নিশ্চয়ই জানুক যে, জেসাসই দীর্ঘ প্রতীক্ষিত সেই মেসায়াহ।[২৯] এই বক্তৃতাটিকে গোড়ার দিকের ক্রিশ্চানদের বার্তা (Kerygma) বলে মনে হয়।
চতুর্থ শতাব্দীর শেষ নাগাদ অ্যাক্টস-এর রচয়িতার উল্লিখিত স্থানগুলোতেই খৃস্টধর্ম শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল; ডায়াসপোরার ইহুদি সিনাগগগুলোতে এর শেকড় ছড়িয়ে পড়ে যা বিপুলসংখ্যক গড়ফিয়ারার বা ধর্মান্তরিতদের আকৃষ্ট করে। পলের পরিমার্জিত বা সংস্কৃত ইহুদিবাদ যেন তাদের বহু দোদুল্যমানতার সমাধান দিয়েছিল। তারাও বিভিন্ন ভাষায় কথা বলেছে বলে ঐক্যবদ্ধ কণ্ঠস্বর এবং একটা সুসঙ্গত অবস্থানের অভাব ছিল। ডায়াসপোরার বহু ইহুদি পশুর রক্তে সিক্ত জেরুজালেম-মন্দিরকে আদিম ও বর্বর প্রতিষ্ঠান ভাবতে শুরু করেছিল। জনৈক হেলেনিস্টিক ইহুদি স্তিফেন এর গল্পের ভেতর দিয়ে অ্যাক্টস অভ দ্য অ্যাপসলস এই দৃষ্টিভঙ্গিটি ধরে রেখেছে। এই ব্যক্তি জেসাসের গোত্রে দীক্ষা নিয়েছিল এবং ব্লাসফেমির অভিযোগে তাকে ইহুদিদের শাসক সভা স্যানহেদ্রিন পাথর ছুঁড়ে হত্যা করেছিল। স্তিফেন তার আবেগময় শেষ বক্তব্যে মন্দির ঈশ্বরের প্রকৃতির বিরুদ্ধে এক অসম্মান বলে দাবি করেছিল, তথাপি তিনি পরাৎপর (Most High), তিনি হস্তনিৰ্মিত গৃহে বাস করেন না।[৩০] মন্দির ধ্বংসের পর ডায়াসপোরার ইহুদিদের কেউ কেউ র্যাবাইদের হাতে বিকশিত তলমুদিয় ইহুদিদের গ্রহণ করেছিল। অন্যারা তাদের খৃস্টধর্মের মাঝে তোরাহ্র অবস্থান এবং ইহুদিবাদের বিশ্বজনীনতা সংক্রান্ত জিজ্ঞাসার জবাব খুঁজে পেয়েছিল। এটা অবশ্যই গডফিয়ারারদের কাছে বিশেষ আকর্ষণীয় ছিল, যারা ৬১৩টি মিতযভোত-এর ভার ছাড়াই নব্য ইসরায়েলের পূর্ণ সদস্য হতে পেরেছিল।
প্রথম শতাব্দীতে ক্রিশ্চানরা ইহুদিদের মতোই সম্পর্কিত ভাবনা ও প্রার্থনা অব্যাহত রেখেছিল। তারা র্যাবাইদের মতো যুক্তি দেখিয়েছে। তাদের গির্জাগুলো সিনাগগের মতোই ছিল। আশির দশকে ক্রিশ্চানরা তোরাহ্ অনুসরণে অস্বীকৃতি জানালে সিনাগগ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বহিষ্কার করা হয় তাদের, সেসময় ইহুদিদের সঙ্গে তাদের প্রবল বিরোধ দেখা দিয়েছিল। আমরা দেখেছি যে প্রথম শতাব্দীর গোড়ার দিকের দশকগুলোয় ইহুদিবাদ বহুজনকে ধর্মান্তরিত হতে আকৃষ্ট করেছিল, কিন্তু ৭০-এর পরে ইহুদিরা রোমান সাম্রাজ্যের সঙ্গে ঝামেলায় জড়িয়ে পড়লে ওদের অবস্থানের অবনতি ঘটে। খৃস্টধর্মে গডফিয়ারাবদের পক্ষ ত্যাগ ধর্মান্তরিতদের ব্যাপারে ইহুদিদের সন্দিহান করে তোলে, তারা আর ধর্মান্তরকরণে আগ্রহ বোধ করেনি। পৌত্তলিকরা আগে যেখানে ইহুদিবাদের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছিল, এবার তারা খৃস্টধর্মের দিকে ঝুঁকে পড়ল, কিন্তু এরা ছিল প্রধানত দাস ও নিম্নশ্রেণীর সদস্য। দ্বিতীয় শতাব্দীর একেবারে শেষ দিকেই কেবল উচ্চ শিক্ষিত পৌত্তলিকরা ক্রিশ্চান ধর্ম গ্রহণ করে এবং এক সন্দিহান পৌত্তলিক সমাজের কাছে ধর্মের ব্যাখ্যা তুলে ধরতে সক্ষম হয়ে ওঠে।
রোমান সাম্রাজ্যে খৃস্টধর্মকে ইহুদিবাদেরই একটা শাখা হিসাবে দেখা হয়েছিল, কিন্তু ক্রিশ্চানরা যখন স্পষ্ট জানিয়ে দিল যে তারা আর সিনাগগের সদস্য নয়, তখন তাদের মূল ধর্মের সঙ্গে সম্পর্কচ্যুতির মহাপাপ সংঘঠনকারী ধর্মান্ধদের একটা রিলিজিও’ হিসাবে তীব্র অসন্তোষের সঙ্গে দেখা হলো। রোমানদের রীতিনীতি কঠোরভাবে রক্ষণশীল ছিল: পরিবার প্রধান এবং আদি রীতিনীতিকে শ্রদ্ধার চোখে দেখা হতো। প্রগতি’কে প্রায়ই ভবিষ্যতের দিকে নিঃশঙ্ক যাত্রা না ভেবে স্বর্ণযুগে প্রত্যাবর্তন হিসাবে দেখা হতো। অতীতের সঙ্গে ইচ্ছাকৃত সম্পর্ক চ্যুতিকে আমাদের সমাজের মতো সুপ্ত সৃজনশীল হিসাবে দেখা হতো না, আমাদের সামাজে যা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে। নতুন আবিষ্কারকে বিপজ্জনক ও রাষ্ট্রদ্রোহ হিসাবে দেখা হয়েছে। রোমানরা । ঐতিহ্যের বিধিনিষেধ ছিন্নকারী গণ-আন্দোলনের ব্যাপারে প্রবলভাবে সন্দেহপ্রবণ ছিল। নাগরিকরা যাতে ধর্মীয় হাতুড়ে’দের হাতে না পড়ে সেজন্যে সতর্কতা অবলম্বন করত। অবশ্য তখন সাম্রাজ্য জুড়ে এক ধরনের অস্থিরতা ও উদ্বেগের আবহ বিরাজ করছিল। এক বিশাল সাম্রাজ্যে বসবাসের অভিজ্ঞতা প্রাচীন ঈশ্বর বা দেবতাদের যেন তুচ্ছ ও অপর্যাপ্ত করে তুলেছিল। লোকে ভিনদেশী ও অস্বস্তিকর সংস্কৃতির ব্যাপারে সচেতন হয়ে উঠেছিল। এক নতুন আধ্যাত্মিক সমাধানের সন্ধান করেছিল তারা। প্রাচ্যের কাল্টের আমদানি ঘটেছিল ইউরোপে: রাষ্ট্রের অভিভাবক রোমের প্রথাগত দেবতাদের পাশাপাশি আইসিস ও সিমিলে-এর মতো দেবতাদের উপাসনা চলছিল। সিই প্রথম শতাব্দীতে নতুন রহস্য-ধর্মগুলো নবীশদের নিষ্কৃতি ও পরজগতের জ্ঞান দেওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে এসেছিল। কিন্তু এ সবটাই ধর্মীয় উৎসাহের কোনও প্রাচীন বিধানের প্রতি হুমকি হয়ে দাঁড়ায়নি। প্রাচ্যের দেবতারা প্রবল পরিবর্তন বা পরিচিত আচার-নিষ্ঠা ত্যাগের দাবি ওঠাননি বরং তাঁরা ছিলেন নবাগত সন্ন্যাসীর মতো, এক বৃহত্তর জগতের প্রসারিত দৃষ্টিভঙ্গি ও বোধ জাগিয়ে তুলেছেন। আপনি যত ইচ্ছা ততগুলো রহস্য কাল্টে যোগ দিতে পারতেন কিন্তু শর্ত একটাই সেখানে প্রাচীন দেবতাদের অসম্মান করতে পারবেন না এবং মোটামুটিভাবে পরিমিতি বোধ বজায় রাখতে হবে, তাহলেই কোনও প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থায় রহস্য-ধর্মগুলোকে মেনে নেওয়া হতো এবং তা অঙ্গীভূত হয়ে যেত।
ধর্ম চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে বা জীবনের অর্থের সন্ধান দেবে, এটা কেউ আশা করেনি। সে ধরনের আলোকনের জন্যে দর্শনের দারস্থ হতো মানুষ। প্রাচীন কালের রোমান সাম্রাজ্যে মানুষ দেবতাদের পূজা বা উপাসনা করত বিপদে সাহায্য কামনা, রাষ্ট্রের জন্যে স্বর্গীয় আশীর্বাদ প্রার্থনা এবং অতীতের সঙ্গে ধারাবাহিকতার নিরাময়মূলক অনুভূতির জন্যে। ধর্ম ছিল ধারণার চেয়ে বরং কাল্ট ও আচারের ব্যাপর; এর ভিত্তি ছিল আবেগ, আদর্শ বা সচেতনভাবে গৃহীত তত্ত্ব নয়। বর্তমানকালেও এটা একেবারে অপরিচিত বিষয় নয়: আমাদের সমাজে অনেকেই আছে যারা ধর্মীয় প্রার্থনা সভায় যোগ দিলেও ধর্মতত্ত্বে আগ্রহী নয়, তারা অতি অদ্ভুত কিছু চায় না, পরিবর্তনের ধারণাকেও অপছন্দ করে। এরা মনে করে প্রতিষ্ঠিত বা প্রচলিত আচার-বিধিগুলো তাদের ঐতিহ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত করে এবং একধরনের নিরাপত্তা বোধের যোগান দেয়। সারমন থেকে এরা অসাধারণ ধারণা বেরিয়ে আসার আশা করে না, শাস্ত্রারের পরিবর্তনে অস্বস্তি বোধ করে। মোটামুটি একইভাবে প্রাচীন যুগের শেষ ভাগে বহু পৌত্তলিকই পূর্বপুরুষদের মতো আদি দেবতাদের উপাসনা করতে ভালোবাসত। প্রাচীন আচার-আচরণ তাদের আত্মপরিচয়ের অনুভূতি যোগাত, স্থানীয় ঐতিহ্যের কথা মনে করিয়ে দিত এবং সবকিছু বরাবরের মতো চলার নিশ্চয়তা বলে মনে হতো। সভ্যতা যেন নাজুক অর্জন ছিল, একে অস্তিত্বের নিরাপত্তা বিধানকারী পৃষ্ঠপোষক দেবতাদের নির্বিচারের উপেক্ষা করে। হুমকির মুখে ঠেলে দেওয়া ঠিক হবে না। পূর্বপুরুষদের ধর্ম বিশ্বাস ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে কোনও কাল্ট প্রতিষ্ঠিত হতে দেখতে প্রচ্ছন্নভাবে শঙ্কিতই বোধ করত তারা। সুতরাং, খৃস্টধর্মের উভয় জগতেরই মন্দটুকু ছিল। ইহুদিবাদের মতো শ্রদ্ধাযযাগ্য প্রাচীনত্ব ছিল না এর, আবার আকর্ষণীয় পৌত্তলিকতাবাদের আচার-মালারও-যা সবার দৃষ্টিগ্রাহ্য ও উপভোগ্য ছিল-অভাব ছিল। এটা একটা প্রচ্ছন্ন হুমকিও ছিল, কেননা ক্রিশ্চানরা মাত্র একজন ঈশ্বরের কথা বলেছে, অন্য দেবতাদের আখ্যায়িত করছিল ভ্রান্তি হিসাবে। রোমান জীবনীকার গাইয়ুস সুতোনিয়াস (৭০-১৬০) খৃস্টধর্মকে অযৌক্তিক এবং উৎকেন্দ্রিক আন্দোলন মনে করেছেন, এটা একটি সুপারস্টিশিও নোভা এত্ প্রাভা-’নতুন’ বলেই এটি ‘খারাপ’। [৩১]
ধর্ম নয়, জ্ঞান ও আলোকনের জন্যে শিক্ষিত পৌত্তলিকরা দর্শমের দ্বারস্থ হতো। তাদের সাধু-সন্যাসি এবং জ্ঞানীরা হলেন প্রাচীনকালের প্লেটো, পিথাগোরাস এবং এপিকতেতাসের মতো দার্শনিকগণ। তাদের এমনকি ঈশ্বরের পুত্র হিসাবে দেখত তারা: উদাহরণ স্বরূপ, প্লেটোকে দেবতা অ্যাপোলো-পুত্র মনে করা হয়েছে। দার্শনিকগণ ধর্মের প্রতি শীতল শ্রদ্ধা বজায় রেখেছেন, তবে একে নিজেদের কর্মকাণ্ড হতে আবশ্যকীয়ভাবে আলাদা হিসাবেই দেখতেন। শ্বেত-প্রাসাদে অবস্থানকারী কেতাবী পণ্ডিত ছিলেন না ওঁরা তাঁদের একটা দায়িত্ব বা মিশন ছিল, তারা নিজস্ব মতবাদের প্রতি মানুষকে আকৃষ্ট করে সমসাময়িকদের আত্মার মুক্তি ঘটাতে ব্যাকুল ছিলেন। সক্রেটিস এবং প্লেটো দুজনই তাদের দর্শনের ব্যাপারে ধার্মিক ছিলেন, তারা বৈজ্ঞানিক ও আধ্যাত্মিক গবেষণার ফলে বিশ্বজগতের মহিমা অবলোকন করার এক দর্শনে অনুপ্রাণিত হয়েছেন বলে আবিষ্কার করেছিলেন। সিই প্রথম শতাব্দী নাগাদ তাই বুদ্ধিমান ও চিন্তাশীল ব্যক্তিরা জীবনের অর্থ খুঁজে পেতে, অনুপ্রাণিত করার মতো আদর্শের খোঁজে ও নৈতিক প্রেরণার জন্যে তাদের শরণাপন্ন হয়। খৃস্টধর্মকে বর্বরোচিত বিশ্বাস বলে মনে হয়েছে। ক্রিশ্চান ঈশ্বরকে এক ভয়ঙ্কর আদিম উপাস্যের মতো মনে হয়েছে যিনি মানুষের জীবনে অযৌক্তিকভাবে বারবার হস্তক্ষেপে করে চলেন: তার সঙ্গে অ্যারিস্টটলদের মতো দার্শনিকদের সুদূরবর্তী পরিবর্তন রহিত ঈশ্বরের কোনওই মিল নেই। প্লেটো বা আলেকজান্দার দা গ্রেটের মতো মাপের মানুষকে ঈশ্বরের পুত্র ভাবা এক কথা, কিন্তু রোমান সাম্রাজ্যের কোনও এক অচেনা-অজানা কোণে অসম্মানজনক মৃত্যু বরণকারী এক সামান্য ইহুদিকে ঈশ্বর-পুত্র কল্পনা করা সম্পূর্ণ ভিন্ন।
প্রাচীন যুগের শেষভাগে প্লেটোর মতবাদ সবচেয়ে জনপ্রিয় দর্শন ছিল। প্রথম ও দ্বিতীয় শতাব্দীর নব্য প্লেটোনিস্টরা নৈতিকতা ও রাজনৈতিক চিন্তাবিদ প্লেটোর প্রতি নয়, বরং অতিন্দ্রীয়বাদী প্লেটোর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে। তার শিক্ষা দার্শনিককে তাঁর প্রকৃত সত্তাকে দেহের বন্দিত্ব থেকে মুক্ত করে আপন সত্তাকে উপলব্ধি করতে সাহায্য করতে এবং স্বর্গীয় জগতে আরোহণে সক্ষম। করতে ইহুদিদের উপকারে আসত। এক চমৎকার ব্যবস্থা ছিল এটা, ধারাবাহিকতা ও সমরূপতার ইমেজ হিসেবেই সৃষ্টিতত্ত্বের ব্যবহার করেছে। সকল সত্তার ধারায় একেবারে চূড়ায় অবস্থানকারী সময়ের পরিবর্তনের আঁচড়ের বাইরে আপন চিন্তায় মগ্ন দ্য ওয়ান। প্রকৃত সত্তার পরিণতি হিসাবে দ্য ওয়ান হতেই সবকিছু অস্তিত্ব পেয়েছে: অনন্ত আকৃতিসমূহ দ্য ওয়ান হতে উৎসারিত হয়েছে এবং পর্যায়ক্রমে নিজস্ব বলয়ে সূর্য, নক্ষত্ররাজি এবং চাঁদকে সক্রিয় করেছে; সবশেষে দেবতাগণ যাদের এখন দ্য ওয়ানের দেবসভার মন্ত্রণা দাতা হিসাবে দেখা হচ্ছে, মানুষের পার্থিব জগতে স্বর্গীয় প্রভাব প্রেরণ করেছেন। প্লেটোনিস্টদের কোনও বর্বর উপাস্যের প্রয়োজন হয়নি যিনি অকস্মাৎ বিশ্ব সৃষ্টির সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বা মানুষের একটা ছোট দলের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপনের জন্যে প্রতিষ্ঠিত স্তরকে অগ্রাহ্য করেছেন। কোনও ক্রুশবিদ্ধ মেসায়াহর মাধ্যমে ভীতিদায়ক মুক্তির প্রয়োজন ছিল না তার। সর্বপ্রাণে জীবনদানকারী ঈশ্বরের সঙ্গে সম্পর্কিত বলে একজন দার্শনিক তার নিজস্ব যৌক্তিক শৃঙ্খলিত উপায়েই স্বর্গীয় জগতে আরোহণ করতে পারেন।
ক্রিশ্চানরা কীভাবে পৌত্তলিক সমাজে তাদের ধর্মবিশ্বাসের ব্যাখ্যা দিয়েছিল? একে দুটো আসনের মধ্যবর্তী একটা অবস্থা বলে ঠেকেছে, রোমান অর্থে ধর্মও মনে হয়নি, আবার দর্শনও নয়। তার ওপর, ক্রিশ্চানরা তাদের ‘বিশ্বাসের তালিকা প্রণয়নের ক্ষেত্রে অসুবিধার সম্মুখীন হয়ে থাকবে এবং সম্ভবত নিজেদের আলাদা বিশেষ ধরনের চিন্তাধারা গড়ে তোলার ব্যাপারে সচেতন ছিল না; এদিক দিয়ে পৌত্তলিক পড়শীদের সঙ্গে মিল ছিল তাদের। তাদের ধর্মের কোনও সুসমন্বিত ধর্মতত্ত্ব ছিল না, কিন্তু একে অঙ্গীকারের সযত্ন। বিকাশ হিসাবে অনেক সঠিকভাবে বর্ণনা করা যেত। তারা তাদের ‘ক্রীড’ আবৃত্তি করার সময় কতগুলো নির্দিষ্ট প্রস্তাবনায় সম্মতি প্রকাশ করত না। উদাহরণ স্বরূপ, ক্রীড়ার শব্দটি মনে হয় কোর দেয়ার (Cor Dare) থেকে এসেছে: যার অর্থ হৃদয় দেওয়া। যখন তারা ক্রীড়ো (Credo) শব্দটি উচ্চারণ করত (কিংবা গ্রিক ভাষার পিস্তেনো), তখন মননশীলতার চেয়ে বরং আবেগের প্রকাশ ঘটত। এভাবে সিলিসিয়ার বিশপ অভ মপসুয়েস্তিয়া থিয়োদর (৩৯২ থেকে ৪২৮) ধর্মান্তরিতদের কাছে এভাবে ব্যাখ্যা করেছেন:
যখন তুমি ঈশ্বরের সকাশে ‘আমি নিজেকে আবদ্ধ করলাম (Pisteuo) কথাটা উচ্চারণ করো, তোমরা বোঝাও তাকে তোমরা দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে থাকবে, কখনও তার সঙ্গে বিচ্ছেদ সৃষ্টি করবে না, তোমরা তার সঙ্গে থাকবে এবং জীবন কাঠামোকে অন্য যেকোনও কিছুর চেয়ে উচ্চতর মনে। করবে এবং এমনভাবে তোমাদের আচার-আচরণকে গড়ে তুলবে যাতে তা তাঁর নির্দেশাবলীর সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হয়।[৩২]
পরবর্তীকালের ক্রিশ্চানদের ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে আরও তত্ত্বীয় বিবরণ দেওয়ার প্রয়োজন দেখা দেবে এবং তারা ধর্মের ইতিহাসে বিরল ধর্মতাত্ত্বিক বিতর্কের আবেগের জন্ম দেবে। উদাহরণ স্বরূপ, আমরা দেখেছি, ইহুদিবাদে কোনও সুনির্দিষ্ট অর্থডক্সি ছিল না, বরং ঈশ্বর সম্পর্কিত সকল ধারণা আবিশ্যিকভাবে ব্যক্তিগত বিষয় ছিল। গোড়ার দিকে ক্রিশ্চানরা এই প্রবণতার অংশীদার ছিল।
অবশ্য দ্বিতীয় শতাব্দীতে খৃস্টধর্ম গ্রহণকারী কিছু সংখ্যক পৌত্তলিক তাদের ধর্মটি ঐতিহ্যের ধ্বংসাত্মক কোনও লঙ্ঘন নয় বোঝাতে অবিশ্বাসী পড়শীদের নিকটবর্তী হওয়ার প্রয়াস পায়; এসব অ্যাপোলোজিস্টের অন্যতম প্রধান ছিলেন জাস্টিন অভ সিসেরা (১০০-১৬৫)। ইনি ধর্মের জন্যে শাহাদাৎ বরণ করেছিলেন। অর্থের সন্ধানে তাঁর অস্থিরতার মাঝে আমরা সেসময়ের আধাত্মিক উৎকণ্ঠার ধারণা পাই। জাস্টিন তেমন গভীর বা মেধাবী চিন্তাবিদ ছিলেন না। খৃস্টধর্মে দীক্ষা নেওয়ার আগে তিনি স্টয়িকদের অনুগামী ভবঘুরে দার্শনিক ও পিথাগোরিয়ান ছিলেন, কিন্তু তাদের পদ্ধতির মূল কথা বুঝতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হন তিনি। দর্শনের প্রয়োজনীয় মেজাজ মেধার অভাব ছিল তার, কিন্তু কাল্টের উপাসনা ও আচার-আচরণের অতীত কিছু যেন প্রয়োজন ছিল। খৃস্টধর্মে তিনি তার সমাধান খুঁজে পান। তাঁর দুই ‘অ্যাপোলজিয়ায় (১৫০ এবং ১৫৫) তিনি যুক্তি দেখিয়েছেন যে, ক্রিশ্চানরা স্রেফ প্লেটোকে অনুসরণ করছে, যিনি ঈশ্বর মাত্র একজন বলে উল্লেখ করে গেছেন। গ্রিক দার্শনিকগণ এবং ইহুদি পয়গম্বরদের সকলেই ক্রাইস্টের আগমনের ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছেন-একটা যুক্তি যা তাঁর আমলের পৌত্তলিকদের প্রভাবিত করে থাকবে, কেননা ভবিষ্যদ্বাণীর প্রতি নতুন আগ্রহ জন্ম নিয়েছিল তখন। তিনি আরও যুক্তি দেখিয়েছেন যে, জেসাস ছিলেন লোগোস বা স্বর্গীয় কারণের মানবরূপ, স্টয়িকরা যাঁকে কসমসের শৃঙ্খলার মাঝে দেখতে পেয়েছে গোটা ইতিহাস জুড়ে লোগোস বিশ্বে ক্রিয়াশীল ছিলেন, গ্রিক এবং হিব্রুদের সমানভাবে অনুপ্রাণিত করেছেন। তিনি অবশ্য এই উন্নত ধরনের ধারণাটির কোনও ব্যাখ্যা দেননিঃ একজন মানব সন্তান কী করে লোগোসের অবতার হতে পারেন, লোগোসই কি বাইবেলের প্রতীক বাণী বা প্রজ্ঞা? একক ঈশ্বরের সঙ্গে এর সম্পর্ক কী ছিল?
অন্য ক্রিশ্চানরা আঁচ-অনুমানের প্রতি ভালোবাসা থেকে নয় বরং গভীর উদ্বেগকে প্রশমিত করার স্বার্থে আরও উগ্র ধর্মতত্ত্ব গড়ে তুলছিল। বিশেষ করে নসটিকোয়রা (জ্ঞানীগণ) স্বর্গীয় জগতের সঙ্গে বিচ্ছিন্নতার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে দর্শন ছেড়ে মিথলজির শরণাপন্ন হয়েছিল। তাদের মিথসমূহ ঈশ্বর এবং স্বর্গ সম্পর্কে অজ্ঞতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল, যাকে দুর্ভোগ ও গ্লানির উৎস হিসাবে অনুভব করেছিল তারা। ১৩০ থেকে ২৬০ সাল সময় কালে আলেকজান্দ্রিয়ায় শিক্ষা দান করেছিলেন বাসিলিদেস ও তার সমসাময়িক ভ্যালেন্তিনাসরোমে শিক্ষা দানের জন্যে মিশর ত্যাগ করেছিলেন তিনি-এরা দুজনই প্রচুর অনুসারী পেয়েছেন এবং দেখিয়েছেন যে, খৃস্টধর্ম গ্রহণকারী অনেকের মাঝেই দিশাহারা, উনুল এবং প্রবলভাবে স্থানচ্যুতির অনুভূতি ক্রিয়াশীল ছিল।
অতি দুর্বোধ্য এক সত্তার কথা বলতে শুরু করেছিল নস্টিকোয়রা, তারা এর নাম দিয়েছিল গডহেড-যেহেতু এটাই আমরা যে নিম্নতর সত্তাকে “ঈশ্বর’ বলি তাঁর উৎস। এর সম্পর্কে আমাদের বলার মতো কিছুই নাই, কেননা আমাদের মনের সীমিত সাধ্যের বাইরে এর অবস্থান। ভ্যালেন্তিনাস গডহেডের। ব্যাখ্যা দিচ্ছেন এভাবে:
নিখুঁত এবং পূর্বাহ্নেই বিদ্যমান…অদৃশ্য ও নামহীন শূন্যতায় বাসরত: এটাই সূচনার শুরু এবং পূর্বপুরুষ এবং গভীরতা। এটা আধেয় এবং অদৃশ্য, চিরন্তন এবং অজাত, অনন্তকাল থেকে এটা শান্ত এবং গভীর নিঃসঙ্গ। এর সঙ্গে ছিল ভাবনা, যাকে মহিমা আর নৈঃশব্দ্যও বলা হয়। [৩৩]
মানুষ সবসময় এই পরম বা অ্যাবসোলিউট সম্পর্কে বহু জল্পনা-কল্পনা করেছে, কিন্তু তাদের কোনও ব্যাখ্যাই পর্যাপ্ত ছিল না। গডহেডকে ব্যাখ্যা করা অসম্ভব, যা ‘ভালো’ও না আবার মন্দ’ও না; এমনকি একে ‘অস্তিত্ববান’ও বলা যাবে না। বাসিলিদেস শিক্ষা দিয়েছেন যে, একেবারে আদিতে কেবল ঈশ্বর নন, কেবল গডহেডই ছিলেন, সঠিক করে বলতে গেলে যা আসলে কিছুই না, কারণ আমাদের বোধগম্য অর্থে এর কোনও অস্তিত্ব ছিল না। [৩৪]
কিন্তু এই ‘কিছু না’ নিজেকে প্রকাশ করার ইচ্ছা পোষণ করলেন, তিনি আর গভীর এবং নৈঃশব্দ্যে একাকী অবস্থান করে সন্তোষ বোধ করছিলেন না। তখন এর অতলান্ত গভীরতায় এক অন্তস্থ আন্দোলন ঘটে যার ফলে প্রাচীন পৌত্তলিক মিথলজিতে বর্ণিত উৎসারণগুলোর মতো ধারাবাহিক উৎসারণের সৃষ্টি হয়। এইসব উৎসারণের প্রথমটি ছিলেন ‘ঈশ্বর’, যাকে আমরা চিনি এবং যার কাছে আমরা প্রার্থনা করি। কিন্তু এমনকি ঈশ্বরও আমাদের অগম্য ছিলেন এবং আরও বিশদ হওয়ার প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল। ফলস্বরূপ ঈশ্বর হতে জোড়ায় জোড়ায় আরও উৎসারণ ঘটতে থাকল, যার প্রত্যেকটি তার স্বর্গীয় গুণাবলীর প্রকাশ করেছে। ঈশ্বর লিঙ্গভেদের উর্ধ্বে, এনুমা এলিশের মতো, কিন্তু উৎসারিত প্রত্যেক জোড়ার একটি পুরুষ এবং অপরটি নারী-অধিকতর প্রথাগত একেশ্বরবাদের পৌরুষ বাচক পরিচয় দূর করার একটা প্রয়াস ছিল এটা। উৎসারিত প্রত্যেকটি জোড়া দুর্বলতর ও ক্ষীণকায় হয়ে ওঠে, কেননা এগুলো স্বর্গীয় উৎস হতে ক্রমশঃ দূরে সরে যাচ্ছিল। অবশেষে যখন এরকম ৩০টি উৎসারণ (বা ঈয়ন: যুগ) আবির্ভূত হওয়ার পর প্রক্রিয়াটির থেমে যায় এবং স্বর্গীয় জগৎ প্লেয়োমা (Pleroma) গঠিত হয়। নসটিকরা সম্পূর্ণ অবিশ্বাস্য এক সৃষ্টিতত্ত্বের প্রস্তাবনা রাখছিল না, কেননা সবাই বিশ্বাস করত যে সৃষ্টি এধরনের যুগ, অপদেবতা ও আধ্যাত্মিক ক্ষমতায় পরিপূর্ণ। সেইন্ট পল সিংহাসন, প্রাচীর (Dominations), সার্বভৌমত্ব ও ক্ষমতার কথা উল্লেখ করেছিলেন, অন্যদিকে দার্শনিকরা বিশ্বাস করতেন যে, এইসব অদৃশ্য শক্তি ছিল প্রাচীন দেবতা, এগুলোকে তারা মানুষ এবং দ্য ওয়ান-এর মাঝে মধ্যস্থতাকারীতে পরিবর্তন করেছেন।
একটা বিপর্যয়-এক আদিম পতনের ঘটনা ঘটে গিয়েছিল নসটিকরা যাকে নানাভাবে বর্ণনা করেছে। কেউ বলেছে সোফিয়া প্রেজ্ঞতা অগম্য গডহেড সম্পর্কে এক নিষিদ্ধ জ্ঞামের আকাভক্ষা করায় আশীর্বাদ বঞ্চিত হয়। তার মাত্রাছাড়া অনুমানের কারণে প্লেরোমা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পতিত হয় সে এবং তারই কষ্ট ও দুর্দশা বস্তুজগৎ গঠন করে। নির্বাসিত অবস্থায় দিশাহারা সোফিয়া স্বর্গীয় উৎসে ফিরে যাবার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে সৃষ্টিজগতে ঘুরে বেড়িয়েছে। প্রাচ্য ও পৌত্তলিকদের ধারণার মিশেল এই বিশ্বাস নসটিকদের গভীর অনুভূতি প্রকাশ করে যে, আমাদের বিশ্ব কোনওভাবে স্বর্গের বিকৃতি; অজ্ঞতা এবং স্থানচ্যুতি থেকে যার সৃষ্টি। অন্য নসটিকরা শিক্ষা দিয়েছে যে ঈশ্বর’ বস্তুজগৎ সৃষ্টি করেননি, কেননা মৌল বস্তুর সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক ছিল না। এটা কোনও এক ঈয়নের কাজ, যাকে তারা দোমিনেশন্স (Dominations) বা স্রষ্টা আখ্যায়িত করেছে। ঈশ্বরের প্রতি ঈর্ষাকাতর হয়ে প্লেরোমার কেন্দ্রে পরিণত হওয়ার আকাঙ্ক্ষী হয়ে ওঠেন ইনি। পরিণতিতে তাঁর পতন ঘটে এবং বিদ্রোহের প্রকাশ হিসাবে বিশ্ব সৃষ্টি করেন। ভ্যালেন্তিনাস যেমন ব্যাখ্যা করেছেন তিনি, জ্ঞানবিহীন থেকেই স্বর্গমণ্ডলী তৈরি করেছেন; মানুষের জ্ঞান ছাড়াই মানুষকে ছাড়াই আকার দিয়েছেন; পৃথিবীকে না বুঝেই পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন।[৩৫] কিন্তু অন্য এক ঈয়ন লোগোস উদ্ধার করতে এগিয়ে এসেছিলেন এবং নারী ও পুরুষকে আবার ঈশ্বরের কাছে প্রত্যাবর্তনের পথ বাতলে দিতে জেসাসের দৈহিক রূপ ধরে পৃথিবীতে নেমেছেন। শেষ পর্যন্ত এধরনের খৃস্টধর্ম দমিত হবে, কিন্তু আমরা দেখব, বহু শতাব্দী পরে ইহুদি, ক্রিশ্চান ও মুসলিমরা আবার এ ধরনের মিথের দ্বারস্থ হচ্ছে, কারণ এটা অর্থডক্স ধর্মতত্ত্বের চেয়ে অনেক নির্ভুলভাবে তাদের ঈশ্বর সংক্রান্ত ধর্মীয় বোধ বা অনুভূতি প্রকাশ। করেছে।
এসব মিথ কখনওই সৃষ্টি ও মুক্তিলাভের আক্ষরিক বিবরণ হিসাবে বোঝানো হয়নি, স্রেফ অন্তর্গত সত্যের এক প্রতীকী প্রকাশ ছিল এগুলো। ‘ঈশ্বর’ এবং ‘প্লেরোমা’ ‘মহাশূন্যের কোনও বাহ্যিক বাস্তবতা নন বরং অন্তরে এর অস্তিত্ব অনুসন্ধান করতে হয়:
ঈশ্বর, সৃষ্টি এবং একই ধরনের অন্যান্য বিষয়ের অনুসন্ধান ত্যাগ কর।
নিজেকে দিয়েই শুরু করে তার সন্ধান। জেনে নাও তোমার অন্তরে কে সবকিছু তার বিষয় করে নিচ্ছে, আর বলছে, “আমার ঈশ্বর, আমার মন, আমার চিন্তা, আমার আত্মা, আমার দেহ। দুঃখ, আনন্দ, প্রেম আর ঘৃণার উৎস কোথায় জান। শেখ কীভাবে ইচ্ছা ছাড়াই কেউ দেখে, ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও ভালোবাসে গভীরভাবে। এসব অনুসন্ধান কর, নিজের মাঝেই তাঁকে পাবে। [৩৬]
প্লেরোমা আত্মার একটা মানচিত্র তুলে ধরেছে। কোথায় খুঁজতে হবে তা। নসটিকের জানা থাকলে এমনকি এই অন্ধকার জগতেও স্বর্গীয় আলো অনুভব। করা সম্ভব: সোফিয়া কিংবা দেমিয়ার্জের (Demiurge) আদি পতনের সময় স্বর্গীয় আলোকচ্ছটাও প্লেরোমা থেকে ছিটকে বেরিয়ে বস্তুর মাঝে আটকা পড়ে গিয়েছে। নসটিক তার আপন আত্মার মাঝে স্বর্গীয় ছটার সন্ধান পেতে পারে, নিজের মাঝে অবস্থানরত স্বর্গীয় উপাদান সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠতে পারে, যা তাকে গন্তব্য দেখিয়ে দেবে।
নসটিকরা দেখিয়েছে যে, খৃস্টধর্মে নবদীক্ষিতদের অনেকেই ইহুদিবাদ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া ঈশ্বর সম্পর্কিত প্রচলিত ধারণায় সন্তুষ্ট ছিল না। তারা একজন দয়াময় উপাস্যের সৃষ্টি ‘ভালো’ হিসাবে পায়নি। একই ধরনের দ্বৈতবাদ এবং স্থানচ্যুতি মারসিয়নের (১০০-১৬৫) মতবাদকে বৈশিষ্ট্য দিয়েছিল। রোমে প্রতিদ্বন্দ্বী গির্জা প্রতিষ্ঠা করে প্রচুর অনুসারী পেয়েছিলেন মারসিয়ন। জেসাস বলেছিলেন, একটি ভালো গাছ ভালো ফলের জন্ম দেয়:[৩৭] পৃথিবী যেখানে মন্দ আর বেদনায় স্পষ্টভাবে পরিপূর্ণ সেখানে একজন ভালো ঈশ্বরের সৃষ্টি হয় কী করে? ইহুদি ধর্মগ্রন্থও মারসিয়নকে আতঙ্কিত করেছিল, যেখানে ন্যায়বিচারের উন্মাদনায় গোটা একটা জনগোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্নকারী রুক্ষ কঠোর ঈশ্বরের বর্ণনা রয়েছে। তিনি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন যে যুদ্ধের জন্যে উদগ্রীব’ ইহুদি-ঈশ্বরই ‘তার কর্মকাণ্ডে অস্থির এবং স্ববিরোধী’[৩৮] পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু জেসাস দেখিয়েছেন যে, আরেকজন ঈশ্বর ছিলেন ইহুদি ধর্মগ্রন্থে যার কথা কখনও উল্লেখ করা হয়নি। দ্বিতীয় এই ঈশ্বর ‘প্রসন্ন, কোমল আর স্রেফ ভালো এবং অনন্যসাধারণ।’[৩৯] তিনি পৃথিবীর বিচারক সম’ স্রষ্টার চেয়ে সম্পূর্ণই ভিন্ন। এই পৃথিবী যেহেতু তাঁর সৃষ্টি নয়, সুতরাং আমাদের উচিত তাঁকে ত্যাগ করা, কেননা এটা সেই দয়াময় উপাস্য সম্পর্কে আমাদের কিছুই জানাতে পারে না; আমাদের ‘ওল্ড টেস্টামেন্ট প্রত্যাখ্যান করা উচিৎ, কেবল জেসাসের চেতনা বহনকারী নিউ টেস্টামেন্টের পুস্তকগুলোর দিকেই মনোযোগ দেওয়া উচিত। মারসিয়নের শিক্ষার জনপ্রিয়তা দেখায় তিনি এক সাধারণ উদ্বেগের জবাব যুগিয়েছিলেন। এক সময় এমনও মনে হয়েছিল যে তিনি বুঝি ভিন্ন চার্চের প্রতিষ্ঠা করতে যাচ্ছেন। ক্রিশ্চানদের অভিজ্ঞতার এক গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় হাত দিয়েছিলেন তিনি; প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে ক্রিশ্চানরা বস্তুজগতের সঙ্গে মানিয়ে নিতে অসুবিধা বোধ করেছে, এবং এখনও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক লোক আছে যারা জানে না হিব্রু ঈশ্বর-এর কী অর্থ করা যায়।
উত্তর আফ্রিকার ধর্মতাত্ত্বিক তাতুলিয়ান (১৬০-২২০) অবশ্য দেখিয়েছিলেন যে মারসিয়নের ‘ভালো’ ঈশ্বরের সঙ্গে বাইবেলের ঈশ্বরের চেয়ে বরং গ্রিক দর্শনের ঈশ্বরের মিল বেশি। এই অটল উপাস্য যার সঙ্গে ক্রটিযুক্ত এই জগতের কোনও সম্পর্ক নেই, জেসাস ক্রাইস্টের ইহুদি ঈশ্বরের চেয়ে বর্ণিত অটল চালকের (Unmoved Mover)-এর অনেক কাছাকাছি। প্রকৃতপক্ষে, গ্রিকো-রোমান বিশ্বের অনেকেই বাইবেলিয় ঈশ্বরকে ভ্রান্তিময়, হিংস্র উপাস্য হিসাবে দেখেছে, যার উপাসনা প্রাপ্তির যোগ্যতা নেই। ১৭৮ সালের দিকে পৌত্তলিক দার্শনিক সেলসাস ক্রিশ্চানদের বিরুদ্ধে ঈশ্বর সম্পর্কে সংকীর্ণ আঞ্চলিক ধারণা পোষণ করার অভিযোগ এনেছিলেন। ক্রিশ্চানদের নিজস্ব বিশেষ প্রত্যাদেশের দাবি করার ব্যাপারটা তাঁকে হতবাক করেছিল: ঈশ্বর সকল মানুষের কাছেই সুলভ অথচ ক্রিশ্চানরা ছোট ছোট দলে জড়ো হয়ে ঘোষণা দেয়: ঈশ্বর এমনকি কেবল আমাদের প্রতি দৃষ্টি দেওয়ার জন্যে গোটা জগৎ, স্বর্গের সঞ্চালন পরিত্যাগ করেছেন, অগ্রাহ্য করেছেন বিশাল পৃথিবীকে।[৪০] রোমান কতৃপক্ষের হাতে নির্যাতিত হওয়ার সময় ক্রিশ্চানদের ধারণা রোমানদের বিশ্বাসের প্রতি ব্যাপক আক্রমণসূচক ছিল বলে তাদের বিরুদ্ধে নাস্তিক্যবাদের অভিযোগ আনা হয়েছিল। প্রচলিত দেবতাদের প্রাপ্য সম্মান দিতে ব্যর্থ হওয়ায় ক্রিস্টানরা রাষ্ট্রের বিপদ ডেকে আনবে এবং নাজুক শৃঙ্খলাকে বিনষ্ট করবে ভেবে মানুষ শঙ্কিত হয়েছিল। খৃস্টধর্মকে সভ্যতার সাফল্যকে অগ্রাহ্যকারী এক বর্বর বিশ্বাস মনে হয়েছিল।
দ্বিতীয় শতাব্দীর শেষ নাগাদ অবশ্য সত্যিকার অর্থে সংস্কৃত কিছু পৌত্তলিক খৃস্টধর্মে দীক্ষা নিতে শুরু করে। তারা গ্রিকো-রোমান আদর্শের সঙ্গে বাইবেলের সেমেটিক ঈশ্বরকে মানিয়ে নিতে সক্ষম হয়। এদের মাঝে প্রথম ছিলেন ক্লিমেন্ট অভ আলেকজান্দ্রিয়া (১৫০-২১৫), তিনি হয়তো ধর্মান্তরের আগে এথেন্সে দর্শন পাঠ করেছিলেন। ইয়াহ্ওয়েহ্ ও গ্রিক দার্শনিকদের ঈশ্বর যে একই, এব্যাপারে ক্লিমেন্টের মনে কোনও রকম সন্দেহ বা সংশয় ছিল নাঃ প্লেটোকে তিনি অ্যাটিক মোজেস বলেছেন। তবু জেসাস ও সেইন্ট পল উভয়েই হয়তো তার ধর্মতত্ত্বে অবাক মানতেন। প্লেটো ও অ্যারিস্টটলের ঈশ্বরের মতো ক্লিমেন্টের ঈশ্বর তার অ্যাপাথিয়া দিয়ে বৈশিষ্ট্যায়িত হয়েছেন: তিনি সম্পূর্ণ আবেগ কষ্টভোগ বা পরিবর্তনে অক্ষম। স্বয়ং ঈশ্বরের স্থিরতা ও নিস্পৃহতার অনুকরণ করার মাধ্যমে ক্রিশ্চানরা স্বর্গীয় জীবনে অংশ নিতে পারে। ক্লিমেন্ট জীবন যাপনের একটা নিয়ম প্রণয়ন করেছিলেন আশ্চর্যজনকভাবে যা র্যাবাইদের প্রণীত আচরণবিধির অনুরূপ, পার্থক্য একটাই স্টয়িক আদর্শের সঙ্গে এর মিল ছিল অনেক বেশি। একজন ক্রিশ্চানকে। জীবনের সব পর্যায়ে ঈশ্বরের অচঞ্চলতার অনুকরণ করতে হবে: তাকে অবশ্যই ঠিক হয়ে বসতে হবে, শান্তভাবে কথা বলতে হবে, শরীর কাঁপানো অট্টহাসি থেকে বিরত থাকতে হবে, এমনকি টেকুরও তুলতে হবে ধীরে। শান্ত থাকার এই অধ্যাবসায়ী চর্চার ভেতর দিয়ে ক্রিশ্চানরা অন্তর্গত বিপুল শান্তি সম্পর্কে সজাগ হয়ে উঠবে, যা আসলে তাদের মাঝে খোদিত ঈশ্বরেরই ইমেজ। ঈশ্বর। ও মানুষের মাঝে কোনও দূরত্ব নেই। ক্রিশ্চানরা একবার স্বর্গীয় জগতের উপযোগি হয়ে উঠলে তারা দেখবে এক স্বর্গীয় সঙ্গী আমাদের সঙ্গে একই ঘরে বাস করছে, টেবিলে বসছে, আমাদের জীবনের সকল নৈতিক প্রয়াসে অংশ নিচ্ছে। [৪১]
তারপরেও ক্লিমেন্ট বিশ্বাস করতেন জেসাসই ঈশ্বর ছিলেন। জীবিত ঈশ্বর, যিনি কষ্ট সয়েছেন এবং উপাসিত হচ্ছেন।[৪২] তিনিই ‘তাদের পা ধুইয়ে তোয়ালে দিয়ে মুছে দিয়েছিলেন, তিনি ছিলেন বিশ্বজগতের প্রভু ও নিরহঙ্কার ঈশ্বর’[৪৩] ক্রিশ্চানরা ক্রাইস্টের অনুকরণ করলে তারাও স্বর্গীয়, অপাপবিদ্ধ ও যন্ত্রণাবোধহীন উপাস্যে পরিণত হবে। প্রকৃতই ক্রাইস্ট স্বর্গীয় লোগোস ছিলেন যিনি মানব রূপ গ্রহণ করেছেন যাতে তোমরা একজন মানুষের কাছ থেকে ঈশ্বরে পরিণত হওয়ার উপায় শিখতে পার।[৪৪] পশ্চিমে বিশপ অভ লিয়ন্স ইরেনিয়াস (১৩০-২০০) একই ধরনের মতবাদ শিক্ষা দিয়েছিলেন। জেসাস ছিলেন স্বর্গীয় কারণ লোগোসের অবতার। তিনি মানব রূপ নেওয়ার পর মানুষের উন্নতির প্রত্যেকটা স্তরকে পবিত্র করেছেন এবং ক্রিশ্চানদের জন্যে আদর্শে পরিণত হয়েছেন। একজন অভিনেতা যেভাবে তার অভিনীত চরিত্রটির সঙ্গে একাত্ম হয়ে যায় বলে বিশ্বাস করা হয়, তাদেরও ঠিক সেভাবে তার অনুকরণ করতে হবে; তাহলেই তাদের মানবীয় সম্ভাবনা পূর্ণতা পাবে।[৪৫] ক্লিমেন্ট এবং ইবেনিয়াস তাদের নিজস্ব সময় ও সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্যসমূহের সঙ্গে ইহুদি ঈশ্বরকে খাপ খাইয়ে নিচ্ছিলেন। যদিও পয়গম্বরদের ঈশ্বরের-যার প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল তার করুণরস (Pathos) এবং আক্রম্যতা (Vulnerability)-সঙ্গে তেমন মিল ছিল না, তবু ক্লিমেন্টের অ্যাপ্যাথিয়া মতবাদ ঈশ্বর সম্পর্কে ক্রিশ্চানদের ধারণার মৌল বিষয়ে পরিণত হবে। গ্রিক বিশ্বে আবেগ ও পরিবর্তনের চক্র হতে ঊর্ধ্বে উঠে অতিমানবীয় স্থৈর্যের আকাক্ষা করেছে মানুষ। অন্তর্গত বৈপরীত্য সত্ত্বেও এই আদর্শ টিকে গেছে।
ক্লিমেন্টের ধর্মতত্ত্ব জটিল প্রশ্নের জবাব দেয়নি। একজন সাধারণ মানুষ কী করে লগোস বা স্বর্গীয় কারণ হয়ে থাকতে পারে? জেসাস স্বর্গীয় ছিলেন বলে ঠিক কী বোঝানো হয়েছে? লগোস ও ‘ঈশ্বর পুত্র’ কী একই আর হেলেনিক বিশ্বের এই ইহুদি উপাধি কী অর্থ প্রকাশ করেছে? একজন যন্ত্রণাবোধহীন ঈশ্বর কী করে জেসাসের মাঝে কষ্ট ভোগ করতে পারেন? ক্রিশ্চানরা কীভাবে বিশ্বাস করে যে তিনি স্বর্গীয় সত্তা ছিলেন, আবার একই সময়ে জোর দিয়ে বলে যে ঈশ্বর মাত্র একজন? তৃতীয় শতাব্দীতে ক্রিশ্চানরা এসব প্রশ্নের ব্যাপারে সচেতন হয়ে উঠতে শুরু করে। শতাব্দীর প্রথম বছরগুলোয় রোমে সাবেলিয়াস নামে প্রায় অখ্যাত এক ব্যক্তি মত প্রকাশ করেন যে, বাইবেলিয় পরিভাষার ‘পিতা, ‘পুত্র’ এবং ‘আত্মাকে’ নাটকের চরিত্র রূপায়নের জন্যে অভিনেতাদের মুখোশ (পারসোনা)-এর সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। অভিনেতারা নাটকীয় চরিত্র গ্রহণ ও তাদের কণ্ঠস্বর দর্শকদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্যে মুখোশের। আশ্রয় নেয়। সুতরাং একক ঈশ্বর এভাবেই জগতের ব্যাপারে বিভিন্ন পারসোনা গ্রহণ করেছিলেন। সাবেলিয়াস কিছু অনুসারী আকৃষ্ট করেছিলেন বটে কিন্তু অধিকাংশ ক্রিশ্চান তার তত্ত্বে বিষণ্ণ সাড়া বোধ করেছে: এখানে বোঝানো হয়েছে যন্ত্রণাবোধের অতীত ঈশ্বর পুত্রের ভূমিকা পালনের সময় কোনও ভাবে কষ্ট সয়েছেন। এ ধারণা একেবারে অগ্রহণযোগ্য বলে আবিষ্কার করেছে তারা। কিন্তু তারপরেও (২৬০ থেকে ২৭২) পল অভ সামোসাতা বিশপ অভ অ্যান্টিওক পর্যন্ত যখন বললেন যে জেসাস একজন সামান্য মানুষ ছিলেন যার মাঝে মন্দিরে থাকার মতো ঈশ্বরের বাণী এবং প্রজ্ঞার বাস ছিল-~-একেও একই রকম আন-অর্থডক্স বিবেচনা করা হলো। ২৬৪তে অ্যান্টিকের এক সিনদে পলের ধর্মতত্ত্বের নিন্দা করা হয়েছিল, যদিও রানি জেনোরিয়া অভ পালমিরার সমর্থন নিয়ে তিনি তাঁর পদ টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হন। জেসাস স্বর্গীয় ছিলেন, ক্রিশ্চানদের এই বিশ্বাসকে একই রকম জোরাল ঈশ্বর মাত্র একজন বিশ্বাসের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়াটা বেশ কঠিন হয়ে উঠছিল।
২০২ সালে বিশপ অভ জেরুজালেমের সেবায় একজন যাজক হতে ক্লিমেন্ট আলেকজান্দ্রিয়া ত্যাগ করে কাতেসেতিকাল শিক্ষালয়ে গেলে তাঁরই এক মেধাবী ছাত্র তরুণ অরিগেন তাঁর স্থলাভিসিক্ত হন। তখন তাঁর বয়স ছিল আনুমানিক বিশ বছর। তরুণ অরিগেন প্রবলভাবে বিশ্বাস করতেন যে শাহাদাৎ বরণই স্বর্গে যাবার উপায়। চার বছর আগে তাঁর বাবা লেনিদেস (Leonedes) অ্যারিনায় প্রাণ হারিয়েছিলেন, অরিগেন তাঁর সঙ্গে মিলিত হতে চেয়েছিলেন। অবশ্য পোশাক লুকিয়ে রেখে তাকে বাঁচিয়েছিলেন তাঁর মা। ক্রিশ্চান জীবনের অর্থ জগতের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো, এই বিশ্বাস নিয়ে শুরু করেছিলেন অরিগেন; কিন্তু পরে এই অবস্থান বদল করে ক্রিশ্চান প্লেটোনিজমের একটা রূপ খাড়া করেন তিনি। মাঝে এক অনতিক্রম্য দূরত্ব দেখার বদলে কেবল শাহাদাৎ বরণের মতো চরম স্থানচ্যুতি দিয়ে মানুষ ও ঈশ্বরকে সম্পর্কিত করা সম্ভব। অরিগেন এমন এক ধর্মতত্ত্বের অবতারণা করেন যেখানে বিশ্বজগতের সঙ্গে ঈশ্বরের ধারাবাহিকতার উপর জোর দেওয়া হয়েছে। তার আধ্যাত্মিকতা ছিল আলো, আশাবাদ ও আনন্দের। একজন ক্রিশ্চান পর্যায়ক্রমে সত্তার বা অস্তিত্বের ধাপ বেয়ে তার স্বাভাবিক উপাদান ও গন্তব্য ঈশ্বরের নিকটবর্তী হতে পারে।
প্লেটোনিস্ট হিসাবে ঈশ্বর ও আত্মার মাঝে সম্পর্কের ব্যাপারে দৃঢ় বিশ্বাসী ছিলেন অরিগেন: স্বর্গ সম্পর্কে জ্ঞান মানুষের স্বাভাবিক। বিশেষ অনুশীলনের মধ্য দিয়ে একে আবার সজাগ ও জাগিয়ে তোলা যায়। সেমেটিক ঐশীগ্রন্থের সঙ্গে নিজ প্লেটোনিক দর্শনের সমন্বয়ের জন্যে বাইবেল পাঠের এক প্রতীকী পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিলেন অরিগেন। এভাবে মেরির গর্ভে ক্রাইস্টের ভার্জিন বার্থকে প্রাথমিকভাবে আক্ষরিক অর্থে নেওয়া যাবে না, বরং আত্মায় স্বর্গীয় প্রজ্ঞার জন্ম হিসাবে দেখতে হবে। নসটিকদের কিছু ধারণাও গ্রহণ করেছিলেন তিনি। মূলত আধ্যাত্মিক জগতের সকল সত্তা স্বর্গীয় বাণী ও প্রজ্ঞায় লোগোস নিজেকে প্রকাশকারী অতিপ্রাকৃত ঈশ্বরেরই ধ্যান করেছিল। কিন্তু এই নিখুঁত ধ্যানে তারা ক্লান্ত হয়ে পড়ে স্বর্গীয় জগৎ থেকে দেহে পতিত হয়, দেহ তাদের পতন থামিয়ে দেয়। অবশ্য সব আশা তিরোহিত হয়ে যায়নি। মৃত্যুর পরেও অব্যাহত থাকবে এমন এক দীর্ঘ অবিরাম যাত্রায় আত্মা আবার ঈশ্বরের কাছে যেতে পারবে। এটা ক্রমশঃ দেহের শৃঙ্খল ছাড়িয়ে লিঙ্গভেদের ঊর্ধ্বে উঠে খাঁটি আত্মায় পরিণত হবে। ধ্যান (থিয়োরিয়া)-এর মাধ্যমে আত্মা ঈশ্বরের জ্ঞানে (নসিস) সমৃদ্ধ হবে, যা একে পরিবর্তন করে চলবে যতক্ষণ না, প্লেটো স্বয়ং যেমন শিক্ষা দিয়েছেন, নিজেই স্বর্গীয় রূপ নেয়। ঈশ্বর গভীর রহস্যময়, আমাদের মানবীয় ভাষা বা ধারণা কোনওটাই তাকে যথাযথভাবে প্রকাশ করতে পারে না। কিন্তু আত্মা যেহেতু ঈশ্বরের স্বর্গীয় প্রকৃতির অংশীদার; সুতরাং, ঈশ্বরকে বোঝার ক্ষমতা রয়েছে তার। লোগোসের ধ্যানমগ্ন হওয়া আমাদের স্বভাবজাত, কেননা সকল আধ্যাত্মিক সত্তা (লোগিকোই) আদিতে পরস্পরের সমান ছিল। যখন তাদের পতন ঘটে, কেবল জেসাস ক্রাইস্টের মনই স্বর্গীয় জগতে রয়ে গিয়ে পরম সন্তোষের সঙ্গে ঈশ্বরের বাণী নিয়ে ধ্যান করছিলেন এবং আমাদের নিজস্ব আত্মা ছিল তাঁরই আত্মার সমান। মানুষ জেসাসের ঐশ্বরিকতায় বিশ্বাস একটা স্তর বা পর্যায় মাত্র যা আমাদের যাত্রা পথে সাহায্য করবে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমরা ঈশ্বরকে সামনা সামনি দেখার পর তা দুয়ে হয়ে উঠবে।
নবম শতাব্দীতে অরিগেনের কোনও কোনও ধারণাকে ধর্মদ্রোহী বলে নিন্দা জানাবে চার্চ। অরিগেন বা ক্লিমেন্ট কেউই বিশ্বাস করেননি যে, ঈশ্বর শূন্য হতে জগৎ সৃষ্টি করেছেন যা পরে অর্থডক্স ক্রিশ্চান মতবাদে পরিণত হয়। জেসাসের অলৌকিতা ও মানুষের মুক্তি সম্পর্কিত অরিগেনের ধারণা স্পষ্টই পরবর্তীকালের ক্রিশ্চান শিক্ষার সঙ্গে যায় নাঃ ক্রাইস্টের মৃত্যুর ফলে আমরা। ‘রক্ষা পেয়েছি বলে বিশ্বাস করতেন না তিনি, বরং তার বিশ্বাস ছিল আমরা আমাদের নিজস্ব শক্তিতেই ঈশ্বরের দিকে উত্থিত হব। আসল কথা হচ্ছে অরিগেন ও ক্লিমেন্ট তাদের ক্রিশ্চান-প্লেটোনিজম শিক্ষা দেওয়ার সময় কোনও আনুষ্ঠানিক মতবাদ ছিল না। ঈশ্বর জগৎ সৃষ্টি করেছেন কিনা কিংবা মানুষ কীভাবে স্বর্গীয় হতে পারে নিশ্চিত করে জানত না কেউ। চতুর্থ ও পঞ্চম শতাব্দীর অস্থির ঘটনাপ্রবাহ এক যন্ত্রণাদায়ক সংগ্রামের পরেই কেবল অর্থডক্স বিশ্বাসের সংজ্ঞার পথে নিয়ে যাবে।
অরিগেন সম্ভবত তার স্ব-নপুংসীকরণের জন্যে বিখ্যাত হয়ে আছেন। গস্পেলে জেসাস বলেছেন, কেউ কেউ স্বর্গীয় রাজ্যের স্বার্থে নিজেদের পুরুষত্ব বিনষ্ট করেছে। একথা অক্ষরে অক্ষরে বিশ্বাস করেছেন অরিগেন । প্রাচীন কালের শেষ পাদে পুরুষত্ব বিনষ্টকরণ বেশ চালু একটা ব্যাপার ছিল; অরিগেন অবশ্য নিজের ওপর ছুরি চালিয়ে বসেননি, কিংবা তাঁর এ সিদ্ধান্তটি সেইন্ট জেরোমি (৪৪২-৪২০)-দের মতো কোনও কোনও পশ্চিমা ধর্মতাত্ত্বিকের বৈশিষ্ট্যে পরিণত হওয়া যৌনতার প্রতি কোনও বিকারগ্রসূত ঘৃণা থেকেও সৃষ্টি হয়নি। বৃটিশ পণ্ডিত পিটার ব্রাউন মত প্রকাশ করেছেন, এটা হয়তো তাঁর মানবীয় অবস্থার অনিশ্চয়তার মতবাদ তুলে ধরার প্রয়াস ছিল, যাকে আত্মা কর্তৃক অচিরেই ছাপিয়ে যাবার কথা। দৃশ্যত, ঈশ্বর যেহেতু নারী বা পুরুষ কোনওটাই নন, তাই স্বর্গীয়করণের দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় লিঙ্গের মতো অসংখ্য উপাদান পেছনে ফেলে যেতে হবে। যে কালে লম্বা দাড়ি (প্রজ্ঞা বা জ্ঞানের প্রতীক) দার্শনিকদের বৈশিষ্ট্য ছিল সে যুগে অরিগেনের মসৃণ গাল এবং উচ্চ কণ্ঠস্বর হয়তো বা চমকপ্রদ একটা দৃশ্য ছিল।
আলেকজান্দ্রিয়ায় অরিগেনের পুরোনো শিক্ষক অমোনিয়াম সাক্কাসের কাছে শিক্ষা নিয়েছিলেন প্রটিনাস (২০৫-২৭০) এবং পরে ভারতে আসার সুযোগ পাওয়ার আশায় রোমান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। ভারতে পড়াশোনা করতে উদগীব ছিলেন তিনি। দুর্ভাগ্যক্রমে এই অভিযানের দুঃখজনক। পরিসমাপ্তি ঘটে, অ্যান্টিওকে পালিয়ে যান প্লটিনাস। পরবর্তী সময়ে রোমে এক উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন দার্শনিক মতবাদের প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। নিজের ব্যাপারে তেমন প্রচারমুখী ছিলেন না তিনি, এমনকি জন্মদিনও পালন করতেন না, তাই তাঁর সম্পর্কে আমাদের জানার পরিধি খুব সামান্য। সেলসাসের মতো প্লটিনাসও খৃস্টধর্মকে সম্পূর্ণ আপত্তিকর বিশ্বাস বিবেচনা করেছিলেন, কিন্তু তারপরেও ঈশ্বরের তিনটি ধর্মের অসংখ্য ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। সুতরাং ঈশ্বর সম্পর্কে তাঁর দর্শনের একটু বিস্তৃত আলোচনা করা গুরুত্বপূর্ণ। প্লটিনাসকে একটা জলাধার হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে: তিনি গ্রিক ধ্যান ধারণার ৮০০ বছরের মূল ধারা আত্মস্থ করে তাকে এমন এক রূপে প্রকাশ করেছেন যা আমাদের শতাব্দীর টি. এস. এলিয়ট এবং হেনরি বার্গসনের মতো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদেরও প্রভাবিত করে গেছে। প্লেটোর ধারণার ওপর ভিত্তি করে প্লটিনাস সত্তাকে উপলব্ধি করার একটা পদ্ধতি গড়ে তুলেছিলেন। কিন্তু, মহাবিশ্বের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা খোঁজায় আগ্রহী ছিলেন না। তিনি বা জীবনের ভৌত উৎসও ব্যাখ্যা করারও প্রয়াস পাননি। একটা বস্তুনিষ্ঠ ব্যাখ্যার জন্যে মহাশূন্যের দিকে তাকানোর বদলে প্লটিনাস অনুসারীদের নিজেদের মাঝে আশ্রয় নিতে বলেছেন এবং মননের গভীরে অনুসন্ধান চালানোর তাগিদ দিয়েছেন।
মানুষ একটা ব্যাপারে সচেতন যে তাদের বর্তমান অবস্থায় কোথাও গড়মিল আছে; নিজেকে নিয়ে বা অপরের বেলায় বেকায়দা অবস্থানে আছে বলে মনে হয় তাদের, অন্তস্থ প্রকৃতির সঙ্গে যোগাযোগহীন এবং দিশাহারা। দ্বন্দ্ব ও সারল্যের ঘাটতি যেন আমাদের অস্তিত্বের বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছে। তা সত্ত্বেও আমরা ক্রমাগত বহুমাত্রিক ঘটনাবলীকে একসূত্রে গাথতে চাইছি এবং সুশৃঙ্খল সমগ্রে পরিণত করতে চাইছি। আমরা যখন কোনও ব্যক্তির দিকে চোখ ফেরাই একটা পা, একটা হাত, তারপর আরেকটা হাত, মাথা, এভাবে দেখি না, বরং আপনাআপনি এসব উপাদানকে একজন পরিপূর্ণ মানুষের মাঝে সংগঠিত করি। একতার জন্যে এই আকাক্ষা আমাদের মানসিক কাজের ধারায় মৌলিক বিষয়। আমাদের অবশ্যই, পুঁটিনাসের বিশ্বাস অনুযায়ী, বস্তুনিচয়ের মূলসুরের প্রতিফলন ঘটাতে হবে। বাস্তবতার অন্তর্নিহিত সূত্র আবিষ্কারের জন্যে আত্মাকে অবশ্যই প্লেটোর পরামর্শ অনুযায়ী পরিবর্তিত হতে হবে, পরিশুদ্ধতার একটা পর্যায় অতিক্রম করতে হবে এবং ধ্যানে (থিয়োরিয়া) মগ্ন হতে হবে, বিশ্বজগৎ ছাড়িয়ে, অনুভবের জগৎ পার হয়ে এমনকি বুদ্ধি বা মননের সীমাবদ্ধতার উর্ধ্বে উঠে বস্তুর বা সত্তার অন্তস্থল দেখার জন্যে দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে হবে। তবে এটা আমাদের বস্তুর কোনও সত্তা অভিমুখে উত্তরণ নয় বরং মনের গহীন গভীরে ডুব দেওয়া। একে বলা যায় অভ্যন্তরে আরোহন।
পরম সত্তা এক আদিম একক, প্লটিনাস যাকে দ্য ওয়ান বলেছেন। প্রতিটি বস্তু অস্তিত্বের জন্যে এই সক্ষম সত্তার কাছে ঋণী। দ্য ওয়ান যেহেতু নিজেই সরল, এর সম্পর্কে বলার কিছু নেই: এর এসেন্স বা মূলসুর হতে সুস্পষ্ট পার্থক্য সম্পন্ন এমন কিছু নেই যে সাধারণ বর্ণনা সম্ভবপর করে তুলবে। স্রেফ এটা ছিল। স্বভাবতই দ্য ওয়ান নামহীন। আমরা ‘দ্য ওয়ান’ সম্পর্কে ইতিবাচক চিন্তা করতে চাইলে, ব্যাখ্যা দিয়েছেন পুটিনাস, সেক্ষেত্রে ‘নীরবতাতেই অনেক বেশি সত্যের সন্ধান মিলব ।’[৪৬] এর অস্তিত্ব আছে, তাও বলতে পারব না আমরা, কেননা স্বত্তা স্বয়ং হওয়ায়, কোনও বস্তু নয়, বরং সকল বস্তু থেকে ভিন্ন।’[৪৭] প্রকৃতপক্ষেই, ব্যাখ্যা করেছেন প্রটিনাস, এটা ‘সবকিছু, আবার কিছুই না, অস্তিত্বমান কোনও বস্তু হতে পারে না এটা, তারপরও এটাই সব।’[৪৮] আমরা দেখব, এই ধারণাটি ঈশ্বরের ইতিহাসে একটা স্থির সুরে পরিণত হবে।
কিন্তু যেহেতু ঈশ্বর সম্পর্কে আমরা কিছুটা ধারণা লাভ করতে পারি, তাই এই নীরবতা পূর্ণাঙ্গ সত্য হতে পারে না বলে যুক্তি দেখিয়েছেন প্রটিনাস। দ্য ওয়ান তার দুর্ভেদ্য অস্পষ্টতার চাদরে আড়াল হয়ে থাকলে এটা সম্ভব হতো না। দ্য ওয়ান নিশ্চয়ই নিজেকে ছাড়িয়ে আমাদের মতো অপূর্ণ সত্তার কাছে নিজেকে বোধগম্য করে তুলতে আপন সারল্যের ঊর্ধ্বে উঠেছেন। এই স্বর্গীয় ঊর্ধ্বরোহণকে ‘পরম আনন্দ’ হিসাবে বর্ণনা করা যেতে পারে। এরকম বলার কারণ, এটা খুঁতহীন মহত্বের দিক দিয়ে ‘আপনাকে ছাড়িয়ে যাওয়া’: ‘কোনও চাওয়া নেই, কোনও কিছুর ওপর অধিকার নেই, কোনও অভাব নেই, দ্য ওয়ান নিখুঁত এবং রূপকার্থে, তিনি ছাপিয়ে গেছেন আর এর প্রাচুর্যই নতুনের সৃষ্টি করেছে।’[৪৯] এসবের মাঝে ব্যক্তিগত কিছুই ছিল না; প্লটিনাস দ্য ওয়ানকে ব্যক্তিত্বসহ সকল মানবীয় প্রকৃতির উর্ধ্বে চিন্তা করেছেন। চরম সরল এই ‘উৎস’ থেকে অস্তিত্বশীল সকল কিছুর ব্যাখ্যার করার জন্যে তিনি উৎসারণের প্রাচীন মিথের শরণাপন্ন হয়েছেন-এই প্রক্রিয়াকে বর্ণনা করার লক্ষ্যে কিছু উপমার ব্যবহার করেছেন: এ যেন সূর্যের আলো বা আগুন থেকে বিকিরিত তাপের মতো, আপনি যত উত্তাপের কেন্দ্রের দিকে যাবেন ততই উত্তপ্ততর হয়ে ওঠে। প্রটিনাসের খুব প্রিয় একটা উপমা ছিল বৃত্তের কেন্দ্রের সঙ্গে দ্য ওয়ানের তুলনা, যাতে ভবিষ্যতের সকল সম্ভাব্য বৃত্তের সম্ভাবনা রয়েছে। জলাশয়ের পানিতে পাথর ফেললে সৃষ্টি হওয়া তরঙ্গের সঙ্গে মিল আছে এর। এনুমা এলিশের মতো মিথে উল্লিখিত উৎসারণের বিপরীতে-যেখানে দেবতাদের মতো জোড়া থেকে উদ্ভূত অপর জোড়া অধিকতর নিখুঁত এবং কার্যকর হয়ে ওঠে-পুঁটিনাসের প্রকল্পের ক্ষেত্রে ব্যাপারটি ছিল একেবারে উল্টো। নসটিকদের মিথের মতো কোনও বস্তু এর উৎস দ্য ওয়ান থেকে যত দূরে সরে আসবে, সেটা ততই দুর্বল হয়ে পড়বে।
দ্য ওয়ান থেকে বিকিরিত প্রথম দুটি উৎসারণকে স্বর্গীয় হিসাবে দেখেছেন প্লটিনাস, কেননা এগুলো ঈশ্বরকে জানতে ও ঈশ্বরের জীবনধারায় আমাদেরকে অংশগ্রহণে সক্ষম করে তোলে। দ্য ওয়ানের সঙ্গে মিলে এগুলো এক স্বর্গীয় এয়ী গড়ে তুলেছে যা ট্রিনিটির চুড়ান্ত ক্রিশ্চান সমাধানের মোটামুটিভাবে বেশ কাছাকাছি। প্রটিনাসের প্রকল্পের প্রথম উৎসারণ, মন প্লেটোর ধারণা জগতের অনুরূপ। দ্য ওয়ানের সারল্যকে বোধগম্য করেছে এটা; কিন্তু জ্ঞান এখানে সহজাত ও প্রত্যক্ষ । এটা গবেষণা ও যুক্তি প্রয়োগের প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কষ্টকর উপায়ে অর্জিত নয়, বরং আমাদের অনুভূতি যেমন কোনও বস্তু সামগ্রীকে বুঝে নেয়, সেভাবে আত্মস্থ হয়েছে। আত্ম উৎসারিত হয় মন থেকে ঠিক যেমন মনের উৎসারণ দ্য ওয়ান থেকে । এটা পূর্ণাঙ্গতার চেয়ে খানিকটা দূরবর্তী, এই পর্যায়ে জ্ঞান কেবল অসংলগ্নভাবে সংগ্রহ করা যাবে, ফলে তাতে পরম সারল্য ও সামঞ্জস্যতার ঘাটতি হয় । আত্মা আমাদের চেনা বাস্তবতার সঙ্গে মানানসই: বাকি সমস্ত ভৌত ও আধ্যাত্মিক অস্তিত্বের উৎসারণ ঘটে আত্মা থেকে যা। আমাদের জগতকে এর যেটুকু ঐক্য ও সামঞ্জস্যতা আছে তার যোগান দেয় । এখানে আবার একটা বিষয় জোরের সঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে প্লটিনাস দ্য ওয়ান, মন ও আত্মার ত্রয়ীকে ‘মহাশূন্যে ঈশ্বর হিসাবে কল্পনা করেননি। স্বর্গ সকল অস্তিত্বের সম্মিলন। ঈশ্বর সর্বেসর্বা এবং নিম্নস্তরের সত্তা ততক্ষণই টিকে থাকে যতক্ষণ তারা দ্য ওয়ানের পরম সত্তায় অংশ নেয়।[৫০]
দ্য ওয়ানের দিকে প্রত্যাবর্তনের এক সমরূপ চলিষ্ণুতায় বহির্মুখী উৎসারণ রহিত হয়। আমাদের মনের কার্যধারা হতে আমরা যেমন জানি যে দ্বন্দ্ব ও বহুমাত্রিকতা থেকে অসন্তোষের কারণে সকল সত্তাই ঐক্যের আকাক্ষা করে আবার দ্য ওয়ানের কাছে ফিরে যেতে চায়। কিন্তু এটা বাহ্যিক সত্তার দিকে আরোহণ নয়, বরং মনের গভীরে অভ্যন্তরীণ অবতরণ। আত্মাকে অবশ্যই হৃত সারল্য ফিরে পেতে হবে, ফিরে যেতে হবে তার প্রকৃত সত্তায়। যেহেতু সকল আত্মাই একই সত্তা দ্বারা সজীব হয়েছে, সুতরাং মানুষকে একজন শিল্পীকে ঘিরে থাকা কোরাসের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। বিশেষ কোনও ব্যক্তির সুরভঙ্গে অসাম্য ও বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে, কিন্তু সবাই পরিচালকের দিকে মনোনিবেশ করলে গোটা সমাজ লাভবান হবে, কেননা, ‘ওরা তখন যেভাবে গান গাওয়া উচিত সেভাবেই গাইবে এবং প্রকৃতই তার সঙ্গে থাকবে।’[৫১]
দ্য ওয়ান কঠোরভাবে নৈর্ব্যক্তিক; এর কোনও লিঙ্গ পরিচয় নেই এবং আমাদের ব্যাপারে সম্পূর্ণ উদাসীন। একইভাবে ব্যাকরণগতভাবে মন পুরুষবাচক এবং আত্মা (Psyche) নারীবাচক শব্দ, এখানে লিঙ্গের ভারসাম্য ও সমতা সম্পর্কিত পৌত্তলিকদের প্রাচীন দর্শন রক্ষা করার ক্ষেত্রে প্রটিনাসের আগ্রহ প্রকাশিত হয়ে থাকতে পারে। বাইবেলিয় ঈশ্বরের বিপরীতে, এটা আমাদের সঙ্গে মিলিত হয়ে বাড়ির পথ দেখাতে আসে না, আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকে না, কিংবা ভালোবাসে না, কিংবা নিজেকে আমাদের সামনে প্রকাশ করে না। নিজ সম্পর্কে ছাড়া অন্য কিছুর জ্ঞান নেই এর।[৫২] তারপরেও মানব আত্মা কখনও কখনও দ্য ওয়ানের উপলব্ধিতে আনন্দে উদ্বেলিত হয়। প্রটিনাসের দর্শন যৌক্তিক প্রক্রিয়া নয় বরং এক আধ্যাত্মিক অনুসন্ধান ছিল:
এখানে আমাদের, আমাদের দিক থেকে, সবকিছু একপাশে সরিয়ে রেখে কেবল এর দিকে মনোনিবেশ করে আমাদের সকল বন্ধন ছেড়ে তাতেই পরিণত হতে হবে, এখান থেকে পলায়নের জন্যে অবশ্যই আমাদের তাড়াহুড়ো করতে হবে, আমাদের সকল সত্তা দিয়ে ঈশ্বরকে আলিঙ্গন করার জন্যে আমাদের পার্থিব বন্ধন নিয়ে অধৈর্য হতে হবে, যেন আমাদের কোনও অংশই ঈশ্বরের থেকে সরে না থাকে। সেখানে হয়তো আমরা ঈশ্বরকে দেখতে পাব এবং বিধি যেমন প্রকাশ করেছে যেভাবে আমাদের দেখব: বুদ্ধির আলোয় পরিপূর্ণ বা স্বয়ং আলোয়, খাঁটি, প্রফুল্ল, বায়বীয়, জাত-প্রকৃত অর্থে, সত্তা–প্রকৃত নামে দেবতা হিসাবে। [৫৩]
এই ঈশ্বর কোনও অজ্ঞাত বস্তু নন, বরং আমাদের সর্বোত্তম সত্তা, ‘জানার বা উপলব্ধির মাধ্যমে আসে না, যা কিনা বুদ্ধিমান সত্তা আবিষ্কার করে (মন বা nons-এ) বরং এটা উপস্থিতি (Parousia), যা সকল জ্ঞানকে অতিক্রম করে।[৫৪]
প্লেটোনিয় ধারণার প্রভাব বলয়ে খৃস্টধর্ম ভিন্ন অবস্থান তৈরি করে নিচ্ছিল। পরবর্তী সময়ে ক্রিশ্চান চিন্তাবিদরা যখনই নিজস্ব ধর্মীয় অনুভূতি ব্যাখ্যা করার প্রয়াস পেয়েছেন, স্বভাবতই তারা প্রটিনাস ও তাঁর পৌত্তলিক অনুসারীদের নিওপ্লেটোনিক দর্শনের আশ্রয় নিয়েছেন। এক নৈর্ব্যক্তিক, মানবীয় বৈশিষ্ট্যের অতীত, মানুষের জন্যে স্বাভাবিক আলোকপ্রাপ্তির এই ধারণা ভারতের হিন্দু-বুদ্ধ মতাদর্শের অনেক বেশি কাছাকাছি, যেখানে পড়াশোনায় গভীরভাবে আগ্রহী ছিলেন প্রটিনাস । সুতরাং বাহ্যিক পার্থক্য সত্ত্বেও পরম সত্তা সম্পর্কিত দর্শনের ক্ষেত্রে একেশ্বরবাদী ও অন্যান্য ধারণার গভীর সাদৃশ্য ছিল । লোকে পরম সত্তা সম্পর্কে ধ্যান করার সময় একই ধরনের ধারণা বা উপলব্ধি বোধ করে। কোনও এক সত্তার উপস্থিতিতে আনন্দ ও আতঙ্কের বোধ-যাকে নির্বাণ, দ্য ওয়ান, ব্রহ্মা বা ঈশ্বর বলা হয়-মনের একটা বিশেষ অবস্থা এবং প্রত্যক্ষ উপলব্ধি যা খুবই স্বাভাবিক, মানুষের অন্তহীন আকাক্ষার বিষয়।
ক্রিশ্চানদের কেউ কেউ গ্রিক বিশ্বের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তুলতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিল । অন্যরা এনিয়ে মাথা ঘামাতে চায়নি। ১৭০ সাল নাগাদ এক প্রবল নির্যাতনকালে মন্তানুস নামে এক নতুন পয়গম্বর আধুনিক তুরস্কের ফ্রাইগিয়ায় আবির্ভূত হয়ে নিজেকে স্বর্গীয় অবতার দাবি করেন: ‘আমিই প্রভু সর্বশক্তিমান ঈশ্বর, মানুষের মাঝে যিনি অবতরণ করেছেন, চেঁচিয়ে বলতেন তিনি। আমি পিতা, পুত্র ও প্যারাক্লিট।’[৫৫] তাঁর সহচর প্রিসিলা ও ম্যাক্সিমিলাও একই রকম দাবি করেছিলেন। মস্তানিজম প্রবল প্রলয়বাদী বিশ্বাস ছিল যা ঈশ্বরের এক ভীতিজনক চিত্র এঁকেছিল। এর অনুসারীরা শুধু যে ইহজাগতিক জীবন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য ছিল তা নয় বরং তাদের এও বলা হয়েছে যে ঈশ্বরের নৈকট্য লাভের একমাত্র পথ হচ্ছে শাহাদাৎ বরণ । বিশ্বাসের স্বার্থে তাদের যন্ত্রণাময় মৃত্যু ক্রাইস্টের আগমন তরান্বিত করবে: শহীদরা অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঈশ্বরের সৈনিক। ভয়ঙ্কর এই বিশ্বাস ক্রিশ্চানদের চেতনায় এক সুপ্ত চরমপন্থাকে উস্কে দিয়েছিল: ফাইগিয়া, সিরিয়া ও গলে দাবানলের মতো মস্তানিজমের বিস্তার ঘটে। উত্তর আফ্রিকায় যেখানকার জনগণ মানুষের বলী। দাবি করে, এমন দেবতায় অভ্যস্থ ছিল বলে সেখানে তা বিশেষভাবে শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল। ভূমিষ্ঠ প্রথম শিশুর উৎসর্গ দাবিকারী তাদের বাআলের কাল্ট মাত্র দ্বিতীয় শতাব্দীতে সম্রাট কর্তৃক রদ হয়েছিল। অচিরেই এই বিদ্রোহী। বিশ্বাসটি (ক্রিড) লাতিন চার্চের নেতৃস্থানীয় ধর্মতাত্ত্বিক তারতুলিয়ানের মতো ব্যক্তিকে আকৃষ্ট করেছিল। প্রাচ্যে ক্লিমেন্ট ও অরিগেন এক প্রশান্ত, প্রফুল্ল অবস্থায় ঈশ্বরে প্রত্যাবর্তনের শিক্ষা দিয়েছিলেন, কিন্তু পশ্চিমের চার্চ ঈশ্বর মুক্তির শর্ত হিসাবে ভয়ঙ্কর মৃত্যু দাবি করে বসলেন। এই পর্যায়ে পশ্চিমে ইউরোপ ও উত্তর আফ্রিকায় খৃস্টধর্মকে সংগ্রাম করে টিকে থাকতে হচ্ছিল আর একেবারে গোড়া থেকে চরমপন্থা ও জরবদস্তির একটা প্রবণতা কাজ করছিল।
কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রাচ্যে খৃস্টধর্ম দ্রুত অগ্রসর হচ্ছিল। ২৩৫ সাল নাগাদ রোমান সাম্রাজ্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ধর্মে পরিণত হয়েছিল তা। ক্রিশ্চানরা এ সময় একটি মাত্র বিশ্বাসের এমন এক মহান চার্চের কথা বলত যেখানে। চরমপন্থা বা বাড়াবাড়ির স্থান নেই। এই অর্থডক্স ধর্মতাত্ত্বিকরা নসটিক, মারসিয়নাইট, মন্তানিস্টদের নৈরাশ্যবাদী দর্শন বাতি ঘোষণা করে মধ্যপন্থা বেছে নেন। ধর্মবিশ্বাসে রহস্যময় কাল্ট ও কঠিন সন্ন্যাসব্রতের জটিলতা পরিহার গ্রিকো-রোমান বিশ্বের বোধগম্য পথে ধর্ম বিশ্বাস গড়ে তুলতে সক্ষম উচ্চ বুদ্ধিমত্তার লোকজনের কাছে আবেদন রাখতে শুরু করেছিল এটা। নতুন। এই ধর্ম নারীদেরও আগ্রহী করে তোলে: এর ঐশীগ্রন্থগুলো শিখিয়েছে যে স্রষ্টা। নারী বা পুরুষ নন এবং জোর দিয়ে বলে ক্রাইস্ট যেভাবে চার্চের আকাঙ্ক্ষা করেন ঠিক তেমনিভাবে পুরুষরা তাদের স্ত্রীদের প্রত্যাশায় থাকে। ইহুদিবাদ। এককালে যেমন অত্যন্ত আকর্ষণীয় ধর্ম হয়ে উঠেছিল, ঠিক তেমনি সব সুবিধার অধিকারী হয়ে উঠেছিল খৃস্টধর্ম, তদুপরি খত্না ও ভিনদেশী ‘আইনে’র সমস্যা ছিল না এর। চার্চগুলোর প্রতিষ্ঠিত জনকল্যাণমূলক ব্যবস্থা ও পরস্পরের প্রতি ক্রিশ্চানদের দরদী ব্যবহারে পৌত্তলিকরা বিশেষ করে আকৃষ্ট হয়েছিল। নির্যাতন থেকে রক্ষা আর ভেতরের অসন্তোষ থেকে বাঁচার দীর্ঘ সংগ্রামকালে। চার্চ এমন এক দক্ষ সংগঠন গড়ে তুলেছিল যা প্রায় একটা সাম্রাজ্যের অনুরূপ: এটা বহুগোত্রীয় ক্যাথলিক, আন্তর্জাতিক, সর্বজনীন এবং দক্ষ আমলাদের হাতে পরিচালিত হচ্ছিল।
এতে করে চার্চ স্থিতিশীলতা বজায় রাখার একটা শক্তিতে পরিণত হয়েছিল যা সম্রাট কন্সতান্তাইনের পছন্দ হয়েছিল। ৩১২ সালের মিলভিয়ান যুদ্ধের পর খৃস্টধর্ম গ্রহণ করেছিলেন তিনি এবং এর পরের বছর খৃস্টধর্মকে বৈধতা দেন। এর ফলে ক্রিশ্চানদের সম্পত্তির মালিকানা পাওয়ার অধিকার জন্মে, স্বাধীনভাবে উপাসনা করার সুযোগ পায় তারা এবং রাষ্ট্রীয় জীবনে বিশেষ অবদান রাখতে সক্ষম হয়ে ওঠে। যদিও আরও দুশো বছর ধরে পৌত্তলিকতার বিকাশ ঘটেছিল কিন্তু খৃস্টধর্মই সাম্রাজ্যের রাষ্ট্রীয় ধর্মে পরিণত হয়। বস্তুগত অগ্রগতির স্বার্থে চার্চে যাতায়াতকারীরা ধর্মান্তরিত হতে শুরু করে। সহিষ্ণুতার আবেদন নিয়ে প্রতিষ্ঠিত নির্যাতিত গোষ্ঠী এই চার্চ অচিরেই নিজস্ব আইন ও বিধি বিধানের প্রতি আনুগত্য দাবি করে বসবে। খৃস্টধর্মের বিজয়ের কারণগুলো অস্পষ্ট; রোমান সম্রাটের সমর্থন ছাড়া এটা কিছুতেই সাফল্য অর্জন করতে পারত না, যদিও অনিবার্যভাবে তা নিজস্ব সমস্যার জন্ম দিয়েছিল। পুরোপুরি প্রতিকূলতার ধর্ম বলে সমৃদ্ধির কালে কখনওই এটা তুঙ্গ অবস্থায় থাকতে পারেনি। যেসব গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার সমাধান জরুরি হয়ে পড়েছিল, তার অন্যতম ছিল ঈশ্বরের মতবাদ: কন্সতান্তাইন চার্চে শান্তি স্থাপন করার পরপরই ভেতর থেকে এক নতুন বিপদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল যা খৃস্টধর্মকে তিক্ত বিরোধে লিপ্ত দুটো শিবিরে ভাগ করে দেয়।