০৪. ট্রিনিটি : ক্রিশ্চান ঈশ্বর

৪. ট্রিনিটি : ক্রিশ্চান ঈশ্বর

মোটামুটিভাবে ৩২০ সাল নাগাদ এক প্রবল ধর্মতত্ত্বীয় আবেগ মিশর, সিরিয়া এবং এশিয়া মাইনরের দেশসমূহে জোরাল হয়ে উঠেছিল। নাবিক ও পর্যটকরা জনপ্রিয় লোকসঙ্গীতের বিভিন্ন ভাষ্য গাইতে শুরু করেছিল যেখানে দাবি করা হয়েছে যে পিতা অগম্য এবং অদ্বিতীয় প্রকৃত ঈশ্বর, কিন্তু পুত্র চিরন্তনও নন এবং নন অজাতও; যেহেতু তিনি পিতার কাছ থেকে প্রাণ ও অস্তিত্ব লাভ করেছেন। স্নানাগারের একজন পরিচারকের ‘পুত্র এসেছিলেন শূন্যতা থেকে জোরের সাথে একথা বলে স্নানার্থীদের হয়রানি করার কথা শুনতে পাই, জনৈক মানিচেঞ্জার, বিনিময় হার জানতে চাওয়া হলে জবাব দেওয়ার আগে সৃষ্ট জগৎ ও অসৃষ্ট ঈশ্বরের পার্থক্য নিয়ে দীর্ঘ বক্তব্য রাখে; আরেকজন রুটিপ্রস্তুতকারী ক্রেতাকে জানায় যে, পিতা তার পুত্রের চেয়ে শ্রেয়তর । আজকের দিনে লোকে যেভাবে ফুটবল নিয়ে আলাপ করে ঠিক সেই একই রকম উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে এইসব বিমূর্ত প্রশ্ন সম্পর্কে আলোচনায় মত্ত হয়ে উঠেছিল লোকে। আলেকজান্দ্রিয়ার আরিয়াস নামের ক্যারিশম্যাটিক, সুদর্শন প্রেসবিটার এই বিতর্ককে আরও উস্কে দিয়েছিলেন। আকর্ষণীয় কোমল কণ্ঠের অধিকারী ছিলে আরিয়াস, চেহারায় দারুণ নির্বিকার ছাপ। বিশপ আলেকজান্দারকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছিলেন তিনি, বিশপ উপেক্ষাও করতে পারেননি আবার জবাব দেওয়াও হয়ে উঠেছিল তাঁর জন্যে কঠিন: পিতা ঈশ্বরের মতো একইভাবে জেসাস ক্রাইস্ট ঈশ্বর ছিলেন কীভাবে? আরিয়াস ক্রাইস্টের ঐশ্বরিকতা অস্বীকার করছিলেন না; প্রকৃতপক্ষে জেসাসকে তিনি শক্তিশালী ঈশ্বর’ এবং পূর্ণ ঈশ্বর বলেছিলেন, কিন্তু তাঁর যুক্তি ছিল জেসাসকে প্রকৃতিগতভাবে স্বর্গীয় ভাবাটা ব্লাসফেমাস হবে: জেসাস স্পষ্ট করে বলেছেন যে, পিতা তার চেয়ে শ্রেষ্ঠ। আলেকজান্দার এবং তাঁর তরুণ সহকারী আথানাসিয়াস অচিরেই বুঝতে পারলেন যে ব্যাপারটা আর সামান্য ধর্মতাত্বিক শোভনতায় সীমিত নেই। ঈশ্বরের প্রকৃতি সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলছিলেন আরিয়াস। এদিকে দক্ষ প্রচারবিদ আরিয়াস আপন ধারণায় সুর দিলেন এবং অচিরেই বিশপদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষও এসব বিশপদের মতোই প্রবল উৎসাহে বিতর্কে লিপ্ত হলো।

বিতর্ক এতই উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল যে সম্রাট কন্সতাইন বিষয়টি সুরাহা করার উদ্দেশ্যে হস্তক্ষেপ করেন এবং আধুনিক তুরস্কের নাইসিয়াতে এক সিন আহ্বান করেন। বর্তমানে আরিয়াসের নাম ধর্মোদ্রোহের প্রতিশব্দ, কিন্তু বিরোধ সৃষ্টি হওয়ার সময় কোনও আনুষ্ঠানিক অর্থডক্স অবস্থান ছিল না তার এবং কেন বা কীভাবে আরিয়াসের ভুল হয়েছে নিশ্চিত করে জানার উপায় ছিল না। তার দাবিতে নতুন কিছু ছিল নাঃ উভয় পক্ষের কাছে অতি সম্মানিত অরিগেনও একই ধরণের মতবাদ শিক্ষা দিয়েছিলেন। কিন্তু অরিগেনের আমলের চেয়ে আলেকজান্দ্রিয়ার বুদ্ধিবৃত্তিক পরিবেশে অনেক পরিবর্তন ঘটে গিয়েছিল, মানুষ প্লেটোর ঈশ্বরকে বাইবেলের ঈশ্বরের সঙ্গে সাফল্যের সঙ্গে সমন্বিত করা সম্ভব বলে বিশ্বাস করতে পারছিল না। উদাহরণস্বরূপ, আরিয়াস, আলেকজান্দার এবং আথানাসিয়াস এমন একটা মতবাদে বিশ্বাস রাখতে শুরু করেছিলেন যা যেকোনও প্লেটোবাদীকে চমকে দিত; তাঁরা ঐশীগ্রন্থের ওপর ভিত্তি করে মনে করেছেন, ঈশ্বর শূন্য হতে বিশ্বজগৎ সৃষ্টি করেছেন। আসলে, জেনেসিস এই দাবি করেনি। প্রিস্টলি লেখকগণ বোঝানোর প্রয়াস পেয়েছিলেন যে, ঈশ্বর আদিম বিশৃঙ্খলা থেকে পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন। ঈশ্বর একেবারে শূন্য হতে গোটা বিশ্বজগৎ সৃষ্টি করেছেন, এই ধারণাটি ছিল একেবারে নতুন। গ্রিক মননে এটা ছিল একেবারে আনকোরা, ক্লিমেন্ট ও অরিগেনের মতো ধর্মবিদরা যারা প্লেটোর উৎসারণ প্রকল্প বিশ্বাস করে গেছেন, তারা কখনও এমন কথা বলেননি। কিন্তু চতুর্থ শতাব্দী নাগাদ ক্রিশ্চানরা জগৎ উৎপত্তিগতভাবে নাজুক, অপূর্ণ এবং এক বিশাল গহ্বর দ্বারা ঈশ্বর হতে বিচ্ছিন্ন থাকার নসটিকদের ধারণা গ্রহণ করতে শুরু করেছিল। শূন্য হতে সৃষ্টির এই নতুন মতবাদ মহাবিশ্ব সৃষ্টিকে। অপরিহার্যভাবে ভঙ্গুর আর অস্তিত্বের জন্যে পুরোপুরি ঈশ্বরের ওপর নির্ভরশীলতার উপর জোর দেয়। গ্রিক চিন্তাধারার মতো ঈশ্বর ও মানুষ আর । নিকটবর্তী থাকল না। এক বিরাট শূন্যতা থেকে ঈশ্বর প্রতিটি সত্তাকে সৃষ্টি করেছেন, যেকোনও মুহূর্তে তিনি তাঁর হেফাযতের হাত তুলে নিতে পারেন। ঈশ্বরের নিকট হতে সত্তার চিরন্তন উৎসারণের বিশাল ধারা আর রইল না; পৃথিবীতে স্বর্গীয় মানা প্রেরণকারী আধ্যাত্মিক সত্তাসমূহের মধ্যবর্তী একটা জগৎও অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলল। আপন প্রচেষ্টায় সত্তার ধারা বেয়ে আর ঈশ্বরের কাছে পৌঁছার উপায় থাকল না। নারী ও পুরুষের একমাত্র ঈশ্বর যিনি মূলত শূন্য হতে তাদের সৃষ্টি করেছেন এবং প্রাণশক্তি বজায় রেখেছেন, কেবল তার পক্ষেই চিরকালীন মুক্তি নিশ্চিত করা সম্ভব।

ক্রিশ্চানরা জানত জেসাস ক্রাইস্ট নিজের মৃত্যু ও পুনরুত্থানের মাধ্যমে তাদের রক্ষা করেছেন; তারা বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে এবং একদিন ঈশ্বরের অস্তিত্বের মুখোমুখি হতে পারবে, যিনি স্বয়ং সত্তা এবং প্রাণ। কোনওভাবে ক্রাইস্ট ঈশ্বর ও মানবজাতিকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা দূরত্বটুকু অতিক্রম করে যেতে সক্ষম করে তুলেছেন তাদের। প্রশ্ন হলো, কাজটা কীভাবে করেছেন তিনি? মহাবিভক্তির কোন পাশে ছিলেন তিনি? প্লেরোমা, মধ্যস্থতাকারী ও ঈয়নের পূর্ণতার আর কোনও স্থান ছিল না। হয় ক্রাইস্ট, বাণী স্বর্গীয় রাজ্যের অধিবাসী ছিলেন (যেটা এখন কেবল ঈশ্বরের নিজস্ব অঞ্চল) না হয় নাজুক সৃষ্ট ব্যবস্থার অংশ ছিলেন তিনি। আরিয়াস ও আথানাসিয়াস মহাগহ্বরের বিপরীত দিকে স্থাপন করেছিলেন তাঁকে: আথানাসিয়াস রেখেছেন স্বর্গীয় অঞ্চলে এবং সৃষ্ট জগতে রেখেছেন আরিয়াস।

অদ্বিতীয় ঈশ্বর ও তার সকল সৃষ্টির মাঝে আবশ্যকীয় পার্থক্যের ওপর জোর দিতে চেয়েছিলেন আরিয়াস। বিশপ আলেকজান্দারের উদ্দেশে তিনি যেমন লিখেছিলেন, ঈশ্বর একমাত্র অজন্ম, একমাত্র চিরকালীন, একমাত্র তারই কোনও আদি নেই, তিনিই একমাত্র সত্য, একমাত্র তিনিই অমরত্বের অধিকারী, একমাত্র সর্বজ্ঞানী, সর্বোত্তম, একমাত্র স্রষ্টা। ঐশীগ্রন্থ ভালো করেই রপ্ত ছিল আরিয়াসের। ক্রাইস্ট-বাণী কেবল আমাদের মতোই সৃষ্ট জীব, এ দাবির সপক্ষে অসংখ্য দলিল উপস্থাপন করেছেন তিনি। প্রোভার্বসে দেওয়া স্বর্গীয় প্রজ্ঞার বর্ণনা ছিল তাঁর মূল অনুচ্ছেদ, যেখানে স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে যে, আদিতে ঈশ্বর প্রজ্ঞা সৃষ্টি করেছিলেন। এই টেক্সট-এ আরও বলা হয়েছে যে প্রজ্ঞা ছিল সৃষ্টির এজেন্ট। সেইন্ট জনের গস্পেলের উপক্রমণিকায় এ ধারনাটির পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে। আদিতে বাণী ছিল ঈশ্বরের সঙ্গে:

সকলেই তাঁহার দ্বারা হইয়াছিল, যাহা হইয়াছে,
তাহার কিছুই তাহা ব্যতিরেকে হয় নাই।

অন্যান্য সৃষ্ট জীবকে অস্তিত্ব দানের জন্যে ঈশ্বরের ব্যবহৃত সরঞ্জাম ছিল লোগোস । সুতরাং, এটা অন্য সকল বস্তু বা সত্তা থেকে একেবারেই ভিন্ন ও ব্যতিক্রমী উচ্চ মর্যাদার অধিকারী। কিন্তু যেহেতু ঈশ্বর একে সৃষ্টি করেছেন, সুতরাং লোগোস আবশ্যিকভাবে স্বয়ং ঈশ্বরের চেয়ে আলাদা এবং ভিন্ন।

সেইন্ট জন পরিষ্কার করে দিয়েছেন যে জেসাসই লোগোস ছিলেন, তিনি এও বলেছেন লোগোসই ছিলেন ঈশ্বর। তবু প্রকৃতিগতভাবে তিনি ঈশ্বর ছিলেন না, জোর দিয়ে বলেছেন আরিয়াস, বরং ঈশ্বর কর্তৃক স্বর্গীয় মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হয়েছেন তিনি। আমাদের বাকি সবার চেয়ে তিনি আলাদা, কারণ ঈশ্বর আগে থেকেই জানতেন যে লোগোস মানুষ হওয়ার পর নিখুঁতভাবে তাকে মানবেন এবং, বলা যায়, জেসাসের প্রতি আগাম ঐশ্বরিকতা আরোপ করেছিলেন। কিন্তু জেসাসের অলৌকিকত্ব সহজাত ছিল না। এটা ছিল স্রেফ উপহার বা পুরস্কার। এই দৃষ্টিভঙ্গির সমর্থনেও বহু বিবরণ উপস্থাপনে সফল হয়েছিলেন আরিয়াস। জেসাস ঈশ্বরকে ‘পিতা’ সম্বোধন করেছিলেন, এই ব্যাপারটাই একটা পার্থক্য থাকার কথা প্রকাশ করে; পিতৃত্বের প্রকৃতির কারণেই পূর্বঅস্তিত্ব ও পুত্রের উপর সুনির্দিষ্ট শ্রেষ্ঠত্ব বোঝায়। বাইবেলের উল্লিখিত ক্রাইস্টের অসম্মান ও দুর্বলতা সম্পর্কিত অনুচ্ছেদগুলোর প্রতিও জোর দিয়েছেন আরিয়াস। যেমনটি তার প্রতিপক্ষ দাবি করেছে, জেসাসকে অসম্মানিত করার কোনও উদ্দেশ্য আরিয়াসের ছিল না। ক্রাইস্টের গুণাবলী এবং আমৃত্যু আনুগত্য সম্পর্কে উঁচু ধারণা পোেষণ করতেন তিনি, যা আমাদের মুক্তি নিশ্চিত করেছে। আরিয়াসের ঈশ্বর গ্রিক দার্শনিকদের ঈশ্বরের কাছাকাছি ছিলেন, দূরবর্তী ও বিশ্বজগতের ঊর্ধ্বে; তিনিও মুক্তির গ্রিক ধারণার অনুসারী ছিলেন। উদাহরণ স্বরূপ, স্টয়িকরা সব সময় শিক্ষা দিয়েছে যে গুণবান মানুষের পক্ষে সবসময়ই স্বর্গীয় মর্যাদা লাভ সম্ভব। প্লেটোনিক দৃষ্টিভঙ্গিতেও এটা আবশ্যিক ছিল। আরিয়াস আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করতেন যে ক্রিশ্চানরা নিস্কৃতি পেয়েছে ও স্বর্গীয় মর্যাদা লাভ করেছে, তারা ঈশ্বরের প্রকৃতির অংশীদার। এটা সম্ভব হয়েছে কেবল জেসাস আমাদের জন্যে পথ তৈরি করে গেছেন বলে। তিনি নিখুঁত মানব জীবন যাপন করে গেছেন; আমৃত্যু এমনকি ক্রুশবিদ্ধ হওয়া পর্যন্ত ঈশ্বরের আনুগত্য করেছেন। সেইন্ট পল যেমন বলেছেন, আমৃত্যু আনুগত্য প্রদর্শনের সুবাদেই ঈশ্বর তাঁকে বিশেষ মর্যাদার আসনে উন্নীত করেছেন এবং স্বর্গীয় প্রভু (Kyrios) উপাধি দান করেছেন।’ জেসাস মানুষ না হলে আমাদের কোনও আশাই থাকত না। প্রকৃতিগতভাবে ঈশ্বর হলে তার জীবনে অসাধারণত্ব বলে কিছুই থাকত না, অনুকরণ করার মতো কিছু থাকত না আমাদের। ক্রাইস্টের পুত্রানুগত্যের আদর্শ নিয়ে ধ্যান করার মাধ্যমে ক্রিশ্চানরাও স্বর্গীয় হয়ে উঠতে পারবে। নিখুঁত সৃষ্টি ক্রাইস্টকে অনুকরণের ভেতর দিয়ে তারাও ‘অপরিবর্তনীয় ও অপনোদনযোগ্য ঈশ্বরের নিখুঁত সৃষ্টিতে পরিণত হতে পারবে।

কিন্তু মানুষের ঈশ্বরকে ধারণ করার ক্ষমতা সম্পর্কে আথানাসিয়াসের ধারণা এতটা আশাবাদী ছিল না। মানুষকে জন্মগতভাবে নাজুক হিসাবে দেখেছেন তিনিঃ শূন্য হতে এসেছি আমরা এবং পাপের ফলে আবার শূন্যতায় নিক্ষিপ্ত হয়েছি। সুতরাং ঈশ্বর যখন তাঁর সৃষ্টি নিয়ে ভাবেন তিনি,

দেখেন সকল সৃষ্ট প্রকৃতিকে এর নিজস্ব ধারায় ছেড়ে দেওয়া হলে তা বিপদাপন্ন এবং নিশ্চিহ্ন হয়ে পড়বে। এটা রোধ এবং বিশ্বজগতকে অস্তিত্ব হীনতায় নিশ্চিহ্ন হওয়ার হাত থেকে রক্ষার্থে তিনি আপন চিরন্তন লোগোস হতে সকল জিনিস সৃষ্টি করেছেন এবং সৃষ্টিকে অস্তিত্ব দিয়ে সমৃদ্ধ করেছেন।

ঈশ্বরের লোগোসের মাধ্যমে তাঁর নিকটবর্তী হয়েই কেবল মানুষ বিলুপ্তি বিনাশ এড়াতে পারে, কারণ একমাত্র ঈশ্বরই হচ্ছেন নিখুঁত সত্তা। লোগোস স্বয়ং দুর্বল সৃষ্টি হলে তার পক্ষে মানবজাতিকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করা সম্ভব হতো না। আমাদেরকে জীবনদানের জন্যে লোগোসকে দেহ দান করা হয়েছিল। তিনি মৃত্যু ও পাপের নশ্বর পৃথিবীতে নেমে এসেছিলেন আমাদেরকে ঈশ্বরের নির্লিপ্ততা ও অমরত্বের ভাগ দেওয়ার উদ্দেশ্যে। কিন্তু লোগোস স্বয়ং নাজুক সৃষ্টি হলে এটা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াত, যিনি নিজেই আবার শূন্যতায় হারিয়ে যেতে পারতেন। বিশ্বের যিনি স্রষ্টা একমাত্র তার পক্ষেই একে রক্ষা করা সম্ভব এবং তার মানে, দেহধারী লোগোসরূপী ক্রাইস্ট অবশ্যই পিতার মতো একই বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। আথানাসিয়াস যেমন বলেছেন, আমরা যাতে স্বর্গীয় হয়ে উঠতে পারি সেজন্যেই বাণী মানুষের রূপ নিয়েছিলেন।

২০শে মে, ৩২৫ তারিখে বিশপগণ যখন সংকট দূর করার লক্ষ্যে নাইনিয়াতে সমবেত হয়েছিলেন, খুব অল্প সংখ্যকই ক্রাইস্ট সম্পর্কে আথানাসিয়াসের দৃষ্টিভঙ্গির অংশীদার ছিলেন। বেশির ভাগই আথানাসিয়াস এবং আরিয়াসের মতামতের মধ্যবর্তী অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন। তা সত্ত্বেও আথানাসিয়াস আগত প্রতিনিধিদের ওপর নিজস্ব ধর্মতত্ত্ব চাপিয়ে দিতে সক্ষম হন এবং সম্রাটের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে কেবল আরিয়াস ও তার দুজন সাহসী সহচর তার ক্রীডে সাক্ষাদানে অস্বীকৃতি জানান। ফলে প্রথমবারের মতো শূন্য হতে সৃষ্টি মতবাদ সরকারী মতবাদে পরিণত হয়, যেখানে ক্রাইস্ট নগণ্য সৃষ্টি বা ঈয়ন নন বলে জোর দেওয়া হয়েছে। স্রষ্টা ও উদ্ধারকারী ছিলেন একই সত্তা।

আমরা একমাত্র ঈশ্বর,
পিতা সর্বশক্তিমানের উপর বিশ্বাস রাখি,
যিনি দৃশ্য অদৃশ্য সকল বস্তুর স্রষ্টা,
এবং বিশ্বাস করি একজন প্রভু ঈশ্বর, পুত্র জেসাস ক্রাইস্টে,
ঈশ্বরের একমাত্র সন্তান,
অর্থাৎ পিতার সত্তা (ousia) থেকে সৃষ্ট,
ঈশ্বর হতে ঈশ্বর,
আলো হতে আলো,
প্রকৃত ঈশ্বর হতে প্রকৃত ঈশ্বর,
জাত, পিতার সঙ্গে
একই বস্তু দ্বারা (homousion) সৃষ্ট নয়,
যার মাধ্যমে সকল বস্তু সৃষ্টি হয়েছে,
যেসব জিনিস স্বর্গে আছে আর
যেসব জিনিস আছে মর্ত্যে,
যিনি আমাদের জন্যে ও আমাদের
মুক্তির জন্যে মানুষের রূপ নিয়েছেন,
কষ্ট সয়েছেন,
তৃতীয় দিবসে আবার পুনরুত্থিত হয়েছেন,
আরোহণ করেছেন স্বর্গে
এবং নেমে আসবেন
জীবিত ও মৃতদের বিচারের জন্যে।
এবং আমরা বিশ্বাস করি পবিত্র আত্মায় ।

কন্সতন্তাইন ধর্মতত্ত্বীয় বিষয়াদি না বুঝলেও এই ঐকমত্যের প্রদর্শনে সন্তুষ্ট হয়েছিলেন, কিন্তু আসলে নাইসিয়ায় সর্বসম্মত সিদ্ধান্তের কোনও অস্তিত্ব ছিল না। সম্মেলন শেষ হওয়ার পর বিশপগণ আগের মতোই আবার যার যার শিক্ষাদানে ফিরে গিয়েছিলেন। পরবর্তী আরও ষাট বছর আরিয়ান সংকট অব্যাহত ছিল। আরিয়াস ও তার অনুসারীগণ পাল্টা লড়াই করে রাজকীয় অনুগ্রহ লাভে সফল হন। কমপক্ষে পাঁচবার নির্বাসিত হয়েছিলেন আথানাসিয়াস। নিজের ক্রীড টিকিয়ে রাখা খুব কষ্টকর হয়ে পড়েছিল তাঁর পক্ষে। বিশেষ করে homoonsion শব্দটি (আক্ষরিক অর্থে, একই উপাদানে তৈরি) দারুণ বিতর্কিত ছিল, কারণ এটা ঐশীগ্রন্থ বিরোধী এবং এতে বস্তুগত সংযোগ রয়েছে। এভাবে দুটো তামার মুদ্রাকে homousion বলা যেতে পারে, কেননা দুটোই একই বস্তু থেকে তৈরি ।

আবার, আথানাসিয়াসের ক্রীড বহু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের জবাব হীন। এখানে জেসাসকে স্বর্গীয় বলা হলেও ব্যাখ্যা করা হয়নি লোগোস দ্বিতীয় ঈশ্বর না হয়েও কীভাবে তিনি পিতার মতো একই উপাদানের হতে পারেন । ৩৩৯ সালে আথানাসিয়াসের বিশ্বস্ত বন্ধু ও সহকর্মী বিশপ অভ আনসিরা মার্সেলাস, যিনি এমনকি নির্বাসনে একবার তার সঙ্গীও হয়েছিলেন-যুক্তি দেখিয়েছেন যে লোগোস চিরন্তন স্বর্গীয় সত্তা হতে পারেন না। তিনি ঈশ্বরের মাঝে প্রচ্ছন্ন গুন; এ হিসাবে, নাইসিন ফরমুলাকে ত্রি-ঈশ্বরবাদের অভিযোগে অভিযুক্ত করা যেতে পারত: তিন ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাসের কথা রয়েছে এখানে: পিতা, পুত্র এবং আত্মা। বিতর্কিত homiousion শব্দের পরিবর্তে মার্সেলাস আপোস রফার জন্যে homiousion অর্থাৎ একরকম’ বা ‘একই স্বভাবের’ শব্দটি প্রস্তাব করেন। এই বিতর্কের জটিল ধারা প্রায়শঃ পরিহাসের সৃষ্টি করেছে; উল্লেখযোগ্যভাবে গিবন মনে করেছেন, তুচ্ছ বিষয়ে ক্রিস্টান ঐক্য হুমকির মুখে পড়াটা অসম্ভব একটা ব্যাপার। অবশ্য ধারণাগত দিক থেকে সংজ্ঞায়িত করা অসুবিধাজনক হওয়া সত্ত্বেও ক্রাইস্টের অলৌকিত্বের আবশ্যকতার প্রতি ক্রিশ্চানদের আঁকড়ে থাকার ব্যাপারটা বেশ চমকপ্রদ। মার্সেলাসের মতো বহু ক্রিশ্চান ঈশ্বরের একত্বের প্রতি হুমকিতে অস্বস্তিতে ভুগছিল। মার্সেলাস বোধ হয় বিশ্বাস করেছিলেন যে লোগোস কেবল একটা অতিক্রমশীল পর্যায় ছিল: সৃষ্টির সময় ঈশ্বর হতে আবির্ভূত হয়েছিল এটা, জেসাসের মাঝে স্থান করে নিয়েছে ও নিষ্কৃতি সমাপ্ত হওয়ার পর আবার স্বর্গীয় রূপে হারিয়ে যাবে, যাতে কেবল ঈশ্বরই সর্বেসর্বা রয়ে যাবেন।

শেষ পর্যন্ত আথানাসিয়াস মার্সেলাস ও তার অনুসারীদের বোঝাতে সমর্থ হন যে, তাদের পরস্পরের সঙ্গে যোগ দেওয়া উচিত, কারণ আরিয়ানদের চেয়ে তাঁদের মতের মিল অনেক বেশি। যারা বলেন যে, লোগোস পিতার মতো একই প্রকৃতির ছিল এবং যারা বিশ্বাস করেন যে তিনি প্রকৃতিগত দিক থেকে ঈশ্বরের মতো, তারা আসলে ভ্রাতৃপ্রতীম’, আমরা যা বলি, তারাও সেকথাই বোঝান, আমরা কেবল পরিভাষা নিয়ে বিতর্ক করছি। আরিয়াসের বিরোধিতায় অগ্রাধিকার দিতে হবে, যিনি ঘোষণা করেছেন যে পুত্র ঈশ্বর থেকে সম্পূর্ণ আলাদা ও মৌলিকভাবে ভিন্ন প্রকৃতির। বহিরাগত কারও চোখে এসব ধর্মতত্ত্বীয় যুক্তিতর্ককে অনিবার্যভাবে সময়ের অপচয় মনে হবে: কারও পক্ষেই কোনও কিছু স্পষ্টভাবে প্রমাণ করার উপায় ছিল না, ও বিরোধ কেবলই ভাঙনেরই কারণ হয়েছে। অবশ্য অংশগ্রহণকারীদের জন্যে এটা কোনও শুষ্ক বিতর্ক ছিল না, বরং ক্রিশ্চান উপলব্ধির প্রকৃতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একটা ব্যাপার ছিল। আরিয়াস, আথানাসিয়াস এবং মার্সেলাস, এঁদের প্রত্যেকেই উপলব্ধি করেছেন যে জেসাসের সঙ্গে একটা নতুন কিছু পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছিল । তাঁরা ধারণাগত প্রতাঁকের সাহায্যে এই উপলব্ধিকে নিজেদের এবং অন্যদের কাছে ব্যাখ্যা করার জন্যে প্রকাশ-উপযোগি করে তোলার প্রয়াসে লিপ্ত ছিলেন। ভাষা কেবল প্রতীকায়িত হতে পারে, কারণ যে সত্তাসমূহের দিকে তারা নির্দেশ করেছেন তা ছিল অনির্বচনীয়। অবশ্য দুর্ভাগ্যক্রমে খৃস্টধর্মে এক গোঁড়া অসহিষ্ণুতার অনুপ্রবেশ ঘটছিল, শেষ পর্যন্ত যা সঠিক’ বা অর্থডক্স প্রতীক মেনে নেওয়াকে গুরুত্বপূর্ণ ও বাধ্যতামূলক করে তুলবে। খৃস্টধর্মের নজীরবিহীন মতবাদ বিষয়ক এই বিকার অনায়াসে মানবীয় প্রতীক ও স্বর্গীয় সত্তার ভেতর ভুল বোঝাবুঝি বা দ্বিধার জন্ম দিতে পারত। খৃস্টধর্ম আগাগোড়াই একটি স্ববিরোধী ধর্মবিশ্বাস (Paradoxical faith): প্রথম দিকের ক্রিশ্চানদের জোরাল ধর্মীয় অনুভূতি একজন ক্রুশবিদ্ধ মেসায়াহর বেলেঙ্কারীর আদর্শগত আপত্তি বা মতবিরোধ অতিক্রম করেছিল। এবার নাইসিয়াতে একেশ্বরবাদের সঙ্গে স্পষ্ট সামঞ্জস্যহীনতা সত্ত্বেও চার্চ ইনকারনেশন বা অবতারবাদের বৈপরীত্যকে গ্রহণ করে নিয়েছিল।

বিখ্যাত মরুচারী সাধক আথানাসিয়াস তাঁর জীবনীগ্রন্থ লাইফ অভ অ্যান্টনি তে দেখানোর প্রয়াস পেয়েছিলেন যে, তাঁর নতুন মতবাদ কীভাবে খৃস্টীয় আধ্যাত্মিকতাকে প্রভাবিত করেছে। মনাস্টিসিজম-এর প্রবক্তা হিসাবে পরিচিত অ্যান্টনি মিশরিয় মরুভূমিতে কঠোর কৃচ্ছতার জীবন যাপন করতেন। তা সত্ত্বেও অজ্ঞাত পরিচয় লেখক কর্তৃক সংকলিত প্রাচীন মরু-সাধক বা মঙ্কদের নীতিকথার গ্রন্থ দ্য সেয়িংস অভ দ্য ফাদারস-এ তিনি অত্যন্ত মানবিক এবং সহজে বিচলিত ব্যক্তি হিসাবে অঙ্কিত হয়েছেন যিনি একঘেয়েমিতে ক্লান্ত, মানুষের সমস্যাদি নিয়ে বিচলিত ও উদ্বিগ্ন এবং সংজ্ঞা ও সরাসরি উপদেশ বা পরামর্শ দেন। কিন্তু জীবনীগ্রন্থে আথ্যানাসিয়াস একেবারে ভিন্ন আলোয় নিজেকে উপস্থাপন করেন। উদাহরণ স্বরূপ, তিনি আরিয়ান মতবাদের প্রবল বিরোধীতে রূপান্তরিত হয়েছেন: ইতিমধ্যেই তিনি আসন্ন দেবত্বের আস্বাদ গ্রহণ করেছেন, কেননা এক চমকপ্রদ মাত্রায় তিনি স্বর্গীয় অ্যাপাথিয়ার অংশীদার। উদাহরণ স্বরূপ, তিনি বিশ বছর অশুভ আত্মার সঙ্গে যুদ্ধ চালানোর পর যখন সমাধি থেকে উঠে আসেন, আথানাসিয়াস বলছেন, যে অ্যান্টনির দেহে বয়সের কোনও লক্ষণ দেখা যায়নি। প্রকৃত ক্রিশ্চান ছিলেন তিনি, যার অচঞ্চল এবং নিস্পৃহ বৈশিষ্ট্য তাঁকে আর সবার চেয়ে ভিন্নতা দান করেছে: তার আত্মা ছিল অবিচল, তাই তাঁর বাহ্যিক অভিব্যক্তিও ছিল শান্ত।১৩ নিখুঁতভাবে ক্রাইস্টকে অনুকরণ করেছিলেন তিনিঃ ঠিক লোেগোস যেভাবে দেহ ধারণা করে পাপী পৃথিবীতে অবতীর্ণ হয়েছেন এবং অশুভের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন, অ্যান্টনিও একইভাবে শয়তানের আস্তানায় অবতরণ করেছিলেন । আথানাসিয়াস কখনও ধ্যানের কথা বলেননি, যা কিনা ক্লিমেন্ট বা অরিগেনের মতো ক্রিশ্চান প্লেটোনিস্টদের মতবাদ অনুযায়ী দেবতৃপ্রাপ্তি ও মুক্তির উপায় ছিল। তুচ্ছ মরণশীল মানুষের পক্ষে এভাবে তাদের নিজস্ব স্বাভাবিক শক্তির বলে ঈশ্বরের সান্নিধ্যে পৌঁছানো সম্ভব বলে বিবেচিত হচ্ছিল না আর। তার বদলে ক্রিশ্চানদের অবশ্যই দেহধারী বাণীর পাপাচারপূর্ণ বস্তুজগতে অবতীর্ণ হওয়াকে অনুকরণ করতে হবে।

কিন্তু তখনও দ্বিধান্বিত ছিল ক্রিশ্চানরা: ঈশ্বর যদি একজনই হয়ে থাকেন, তাহলে লোগোস কীভাবে স্বর্গীয় হতে পারেন? অবশেষে পূর্ব তুরস্কের কাপাদোসিয়ার তিনজন অসাধারণ ধর্মবিদ এমন একটা সমাধানের প্রস্তাব নিয়ে এগিয়ে এলেন যা ইস্টার্ন অর্থডক্স চার্চকে সন্তুষ্ট করে। এঁরা হলেন বিশপ অভ সিসারিয়া বাসিল (৩২৯-৭৯), তাঁর ছোট ভাই বিশপ অভ নাইসা গ্রেগরি (৩৩৫-৯৫) এবং বন্ধু গ্রেগরি অভ নাথিযান্যাস (৩২৯-৯১)। কাপাদোসিয়ানস হিসাবে আখ্যায়িত এই ব্যক্তিগণ গভীরভাবে আধ্যাত্মিক পুরুষ ছিলেন । অনুমান ও দর্শনে এখন আনন্দ লাভ করলেও তাদের বিশ্বাস ছিল ধর্মীয় অভিজ্ঞতাই ঈশ্বর সম্পর্কিত সমস্যা সমাধানের চাবিকাঠি। গ্রিক দর্শনে প্রশিক্ষিত এঁরা তিনজনেই সত্যের বাস্তব বিষয়াদি এবং এর অধিকতর দুর্বোধ্য দিকগুলোর পার্থক্যের ব্যাপারে সচেতন ছিলেন। আদি গ্রিক যুক্তিবাদীরা এদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন: প্লেটো দর্শনের (যা যুক্তি দ্বারা উপস্থাপিত বলে প্রমাণযোগ্য ছিল) সঙ্গে পৌরাণিকভাবে প্রাপ্ত একই মাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক উপস্থাপনের ধরাছোঁয়ার বাইরের শিক্ষার পার্থক্য টেনেছেন। আমরা দেখেছি অ্যারিস্টটলও মানুষ শেখার (Mathein) জন্যে রহস্য ধর্মে আশ্রয় গ্রহণ করে না, বরং একটা কিছুর অভিজ্ঞতা (Pathein) লাভ করতে চায় বলে একই রকম পার্থক্য রেখা টেনেছিলেন। বাসিলও ডগমা ও কেরিগমা-র পার্থক্য বোঝাতে গিয়ে ক্রিশ্চান অর্থে একই দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করেছেন। ধর্মের ক্ষেত্রে উভয় ধরণের ক্রিশ্চান শিক্ষাই আবশ্যক। কেরিগমা হচ্ছে ঐশীগ্রন্থ নির্ভর চার্চের গণশিক্ষা; কিন্তু ডগমা বাইবেলিয় সত্যের গভীরতর অর্থ প্রকাশ করে যা কেবল ধর্মীয় অভিজ্ঞতা ও প্রতীকী রূপেই উপলব্ধি করা সম্ভব। গস্পেল সমূহের সরাসরি বাণীর আড়ালে বা পাশাপাশি পয়গম্বরদের কাছ থেকে ‘রহস্যময়ভাবে’ এক গোপন ও নিগূঢ় ঐহিত্য বিবরণ হস্তান্তরিত হয়েছে: এটা ‘ব্যক্তিগত এবং গোপন শিক্ষা ছিল’,

যা আমাদের পুণ্যাত্মা পূর্বপুরুষেরা নীরবে সংরক্ষণ করেছেন, যা উৎকণ্ঠা আর কৌতূহল রোধ করেছে…এই নীরবতার সাহায্যে রহস্যের পবিত্র রূপ সংরক্ষণ করার উদ্দেশ্যে। অদীক্ষিতজনদের এই শিক্ষা বহন করার অনুমোদন নেই: লিখিতরূপে এদের অর্থ প্রকাশ করা যাবে না।

.

শাস্ত্রীয় প্রতীক ও জেসাসের শিক্ষার সাবলীলতার আড়ালে ছিল অধিকতর গোপন এক ডগমা, যা ধর্মবিশ্বাসের আরও উন্নত উপলব্ধি তুলে ধরে।

নিগূঢ় এবং প্রকাশিত সত্যের মাঝে সুস্পষ্ট পার্থক্য ঈশ্বরের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়াবে। কেবল গ্রিক ক্রিশ্চানদের মাঝেই এটা সীমাবদ্ধ থাকবে না বরং ইহুদি ও মুসলিমরাও নিগূঢ় ঐতিহ্য গড়ে তুলবে। গোপন মতবাদের ধারণার পেছনে মানুষের মত বন্ধ করার উদ্দেশ্য কাজ করেনি। ফ্রিম্যাসনরির কোনও আদি ধরনের কথা বলেননি বাসিল। তিনি কেবল এই। সত্যের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন যে সকল ধর্মীয় সত্য স্পষ্ট এবং যৌক্তিকভাবে প্রকাশ উপযোগি নয়। কোনও কোনও ধর্মীয় দর্শনের অভ্যন্তরীণ অনুরণন রয়েছে যা কেবল কেউ তার একান্ত নিজস্ব সময়ে প্লেটোর সংজ্ঞানুযায়ী থিয়োরিয়া বা ধ্যানের মাধ্যমেই উপলব্ধি করতে পারে। যেহেতু সকল ধর্ম স্বাভাবিক ধারণা এবং বৈশিষ্ট্যের অতীত এক অনিবৰ্চনীয় সত্তার প্রতি নিবেদিত, সেহেতু বক্তব্য সীমাবদ্ধ এবং বিভ্রান্তিকর। আত্মার চোখ দিয়ে এসব সত্যকে না দেখলে যেসব লোক এখনও খুব অভিজ্ঞ হয়ে ওঠেনি তারা ভ্রান্ত ধারণা পেয়ে বসতে পারে। সুতরাং, আক্ষরিক অর্থের পাশাপাশি ঐশীগ্রন্থসমূহের অ্যাধ্যাত্মিক তাৎপর্যও রয়েছে যা সবসময় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। বুদ্ধও উল্লেখ করেছেন যে কিছু কিছু প্রশ্ন বা জিজ্ঞাসা ‘অসংগত’ বা বেমানান, যেহেতু এগুলো ভাষার আয়ত্তের অতীত বাস্তবতার কথা বলে। ধ্যানের এক অন্তর্মুখী কৌশলের আশ্রয় নিয়েই কেবল আপনি তা আবিষ্কার করতে পারবেন: এক অর্থে আপনাকেই তা তৈরি করে নিতে হবে। ভাষায় এগুলোর বর্ণনা দেওয়ার প্রয়াস বিতোফেনের শেষ কোয়ারটেট এর কোনও একটার মৌখিক বর্ণনা দেওয়ার মতোই অদ্ভুত হয়ে উঠতে পারে। বাসিল যেমন বলেছেন, এসব দুর্বোধ্য ধর্মীয় বাস্তবতা কেবল শাস্ত্রের প্রতীকী ভঙ্গি বা আরও ভালো, নীরবতার সাহায্যে বোঝানো যেতে পারে।

পশ্চিমের খৃস্টধর্ম আরও বাগাড়ম্বরপূর্ণ ধর্মে পরিণত হবে এবং অনিবার্যভাবে কেরিগমার ওপর নির্ভরশীল হয়ে উঠবে; এটাই হয়ে দাঁড়াবে ঈশ্বরের ক্ষেত্রে এর প্রধান সমস্যা। অবশ্য গ্রিক অর্থডক্স চার্চে উন্নত সকল ধর্মতত্ত্ব নীরব বা অ্যাপফ্যাটিক হবে। গ্রেগরি অভ নাইসা যেমন বলেছেন, ঈশ্বর সম্পর্কিত প্রতিটি ধারণাই সদস্যপূর্ণ, এক মিথ্যা সমরূপতা, প্রতিমা: এটা স্বয়ং ঈশ্বরকে প্রকাশ করতে পারে না। ক্রিশ্চানদের অবশ্যই আব্রাহামের মতো হতে হবে, যিনি গ্রেগরির উপস্থাপিত জীবনীতে ঈশ্বর সম্পর্কে সকল ধারণা বাদ দিয়ে এমন এক বিশ্বাস গ্রহণ করেছিলেন যা, যে কোনও ধারণার চেয়ে অবিমিশ্র এবং খাঁটি ছিল। গ্রেগরি তার লাইফ অভ মোজেস-এ জোর দিয়ে বলেছেন, আমরা যার প্রত্যাশা করি তার প্রকৃত দর্শন এবং জ্ঞান দেখার সঙ্গে জড়িত নয় বরং এমন এক সচেতনতার সঙ্গে সম্পর্কিত যার ফলে আমাদের লক্ষ্য সকল জ্ঞানকে ছাপিয়ে যায় এবং দুর্বোধ্যতার অন্ধকার দিয়ে সবদিক থেকে আমাদের থেকে বিচ্ছিন্ন। আমরা বুদ্ধি দিয়ে ঈশ্বরকে দেখতে পারি না, কিন্তু সিনাই পর্বতে নেমে আসা মেঘের আড়ালে নিজেদের ঢাকতে পারলেই কেবল আমরা তাঁর উপস্থিতি অনুভব করতে পারব। ঈশ্বরের সত্তা {ousia) এবং বিশ্বে তার কর্মধারা (energaiai)-র মাঝে ফিলো যে পার্থক্য টেনেছিলেন, বাসিল তারই শরণাপন্ন হয়েছেন: ‘আমরা কেবল তার কাজ (energeial) দিয়েই ঈশ্বরকে জানতে পারি, কিন্তু আমরা তার সত্তার দিকে অগ্রসর হই না। এটাই ইস্টার্ন চার্চের ভবিষ্যতের সকল মূল কথায় পরিণত হবে।

কাপাদোসিয়রা পবিত্র আত্মার ধারণা গড়ে তুলতেও বিশেষ উৎসাহী ছিলেন। তাঁদের ধারণা ছিল যে নাইসিয়ায় দায়সারাভাবে এদিকটাতে নজর দেওয়া হয়েছিল: আর আমরা বিশ্বাস করি পবিত্র আত্মায়’ কথাগুলো যেন শেষ বিবেচনায় আথানাসিয়াসের বিশ্বাসে যোগ করা হয়েছিল। পবিত্র আত্মার ব্যাপারে দ্বিধান্বিত ছিল মানুষ। এটা কি কেবল ঈশ্বরের একটি প্রতীক বা সমার্থক শব্দ নাকি আরও বেশি কিছু? কেউ কেউ একে (আত্মা) এক ধরনের কাজ ভেবেছিল,’ বলেছেন গ্রেগরি অভ নাযিয়ানস, কেউ ভেবেছে সৃষ্ট প্রাণী, কেউ ভেবেছে ঈশ্বর, কেউ বুঝে উঠতে পারেনি তাকে কি ডাকা যায়।২০ সেইন্ট পল নবায়ন, সৃষ্টি এবং পবিত্রকরণ সম্পর্কে পবিত্র আত্মার উল্লেখ করেছিলেন, কিন্তু এসব কাজ কেবল ঈশ্বর দ্বারাই সম্পাদন সম্ভব। সুতরাং বোঝা যায়, পবিত্র আত্মা, আমাদের মাঝে যার উপস্থিতিকে আমাদের মুক্তি বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে, নিশ্চয়ই স্বর্গীয়, সামান্য সৃষ্টি নন। কাপাদোসিয়রা একটা ফর্মুলা প্রয়োগ করেছিলেন যা আরিয়াসের সঙ্গে বিরোধের সময় ব্যবহার করেছেন আথানাসিয়াস: ঈশ্বরের একক সত্তা (ousia) রয়েছে যা আমাদের বোধের অতীত রয়ে গেছে-কিন্তু তিনটি অভিব্যক্তি তাঁকে জ্ঞাত করেছে।

ঈশ্বরকে তাঁর অজ্ঞেয় ousia দিয়ে চিন্তা শুরু করার বদলে কাপাদোসিয়রা মানবজাতির তার hypostases-এর অভিজ্ঞতা দিয়ে কাজ শুরু করেন। যেহেতু ঈশ্বরের ousia অপরিমেয়, আমরা কেবল পিতা, পুত্র ও আত্মারূপে আমাদের মাঝে প্রকাশের মাধ্যমেই তাকে জানতে পারি। অবশ্য এর মানে এই ছিল না যে কাপাদোসিয়রা, কোনও কোনও পশ্চিমা ধর্মবিদ যেমন মনে করেন, তিনটি স্বর্গীয় সত্তায় বিশ্বাসী ছিলেন। গ্রিক ভাষার সঙ্গে যারা পরিচিত নয় তাদের কাছে hypostasis শব্দটি ছিল বিভ্রান্তিকর, কারণ এর বহু অর্থ ছিল: সেইন্ট জেরোমির মতো কোনও কোনও লাতিন পণ্ডিত বিশ্বাস করতেন যে hvpostasis শব্দটি অর্থ ousia-র মতো এবং তারা ভেবেছিলেন গ্রিকরা তিনটি ঐশী সত্তায় বিশ্বাস করে। কিন্তু কাঁপোদোসিয়রা জোর দিয়ে বলেছেন pusia এবং hypostasis এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য রয়েছে, যা মনে রাখা অত্যাবশ্যক। এভাবে কোনও বস্তুর ousia হচ্ছে যা ওই বস্তুকে বিশেষ রূপ দিয়েছে; এটা কোনও বস্তুর ভেতরে আছে এমনভাবে প্রয়োগ করা হয়। অন্যদিকে hypostasis শব্দটি ব্যবহার করা হয় বাইরে থেকে একটি বস্তুকে প্রকাশ করার জন্যে। অনেক সময় কাঁপোদোসিয়গণ hypostasis শব্দের পরিবর্তে Prosopon শব্দটি ব্যবহারেও আগ্রহী ছিলেন। Proposon-এর আদি অর্থ ছিল ‘শক্তি’ (Force), কিন্তু বেশ কিছু গৌণ অর্থও যোগ হয়েছে: ফলে একে কোনও ব্যক্তির মনের অবস্থার বাহ্যিক প্রকাশ, চেহারার অভিব্যক্তি বোঝাতে ব্যবহার করা যেতে পারে; একে তার সচেতনভাবে গৃহীত কোনও ভূমিকা বা অভিনয়ের জন্যে বেছে নেওয়া কোনও চরিত্র বোঝাতেও ব্যবহার করা হয়ে। পরিণামে hypostasis-এর মতো Proposon-এর মানে কারও অভ্যন্তরীণ বৈশিষ্ট্যের বাহ্যিক প্রকাশ কিংবা দর্শকের চোখে উপস্থাপিত ব্যক্তিক সত্তা। সুতরাং কাপপাদোসিয়রা যখন বলেন যে, ঈশ্বর তিন hypostases-এ একজন ousia, তাঁরা বুঝিয়েছেন যে ঈশ্বর স্বয়ং একজন: স্বর্গীয় আত্ম-সচেতনতা মাত্র একটিই। কিন্তু যখন তিনি তাঁর কোনও কিছু সৃষ্ট জীবকে দেখান, তখন তিনি foa Prosopoi!

এভাবে hypostases পিতা, পুত্র এবং আত্মাকে স্বয়ং ঈশ্বরের সঙ্গে মেলানো যাবে না, কারণ গ্রেগরি অভ নাইসা যেমন ব্যাখ্যা দিয়েছেন, স্বর্গীয় সত্তা (Ousia) ভাষাতীত এবং নামকরণের অতীত’, ‘পিতা, ‘পুত্র’ ও ‘আত্মা’ হচ্ছে আমাদের ব্যবহৃত পরিভাষা’ মাত্র যা দিয়ে আমরা তার energeiai-এর কথা বলি, যার মাধ্যমে তিনি নিজেকে প্রকাশ করেছেন। কিন্তু এসব শব্দের প্রতীকী মূল্য রয়েছে, কেননা এগুলো অনির্বচনীয় বাস্তবতাকে আমাদের বোধগম্য ইমেজে তর্জমা করে। মানুষ ঈশ্বরকে দুয়ে (অগম্য আলোয় ঢাকা পিতা), সৃজনশীল (লোগোস) এবং সর্বব্যাপী (পবিত্র আত্মা) হিসাবে অনুভব করেছে। কিন্তু এই তিনটি hypostases স্বয়ং স্বর্গীয় প্রকৃতির আংশিক ও অসম্পূর্ণ আভাস মাত্র, যা এধরনের ইমেজারি ও ধারণাকরণের বহু দূরে অবস্থান করে। সুতরাং, ট্রিনিটি (ত্রিত্ব)কে আক্ষরিকভাবে সত্যি হিসাবে দেখা চলবে না, বরং একে ঈশ্বরের গোপন জীবনের প্রকৃত সত্যের সঙ্গে সম্পর্কিত উদাহরণ হিসাবে নিতে হবে।

গ্রেগরি অভ নাইসা তাঁর পত্র টু আলাবিয়াস: দ্যাট দেয়ার আর নট থ্রি গডস্-এ তিনটি স্বর্গীয় ব্যক্তি বা hypostases-এর অবিভাজ্যতা বা সহাবস্থান সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ মতবাদের রূপরেখা এঁকেছিলেন। ঈশ্বর নিজেকে তিনটি অংশে বিভক্ত করেছিলেন, এটা যেন কেউ না ভাবে, এটা ভয়ঙ্কর এবং সত্যি বলতে ব্লাসফেমাস ধারণা। ঈশ্বর যখন নিজেকে পৃথিবীতে প্রকাশ করার ইচ্ছা পোষণ করেন, তখন এই তিনটি রূপেই পরিপূর্ণ ও সম্পূর্ণভাবে প্রকাশ করেন। ট্রিনিটি এভাবে আমাদের সৃষ্টির প্রতি ঈশ্বর হতে প্রতিটি কাজের প্যাটার্নের একটা আভাস দেয়: ঐশীগ্রন্থ যেমন দেখায়, এর উৎস ছিল পিতার কাছে, পুত্রের মাধ্যমে অগ্রসর হয়েছে এবং আত্মার পরিব্যাপীতার মাধ্যমে পৃথিবীতে কার্যকর হয়েছে। কিন্তু স্বর্গীয় প্রকৃতি কাজের প্রতিটি পর্যায়ে সমানভাবে উপস্থিত। আমরা আমাদের নিজস্ব অভিজ্ঞতা দিয়ে তিনটি hypostases-এর পারস্পরিক নির্ভরশীলতা বুঝতে পারি: পুত্রের প্রকাশ না হলে আমরা কখনও পিতা সম্পর্কে জানতে পারতাম না, পুত্রকেও আমরা চিনতে পারতাম না অন্তর্গত আত্মা ছাড়া, যিনি তাঁকে আমাদের কাছে পরিচিত করেছেন। আত্মা পিতার স্বর্গীয় বাণীর সহচর, ঠিক নিঃশ্বাস (গ্রিক, নিউমা, লাতিন, স্পিরিতাস)। যেমন মানুষের কথার সঙ্গে থাকে। ঐশীরাজ্যে তিন ব্যক্তি পাশাপাশি অবস্থান করেন না। একই ব্যক্তির মনে বিভিন্ন বিষয়ের জ্ঞানের উপস্থিতির সঙ্গে আমরা তাদের তুলনা করতে পারি: দর্শন হয়তো ওষুব বিজ্ঞান হতে আলাদা হতে পারে, কিন্তু এটা চেতনার একটা আলাদা স্তরে থাকে না। বিভিন্ন বিজ্ঞান পরস্পরকে ছাপিয়ে যায়, গোটা মনকে পূর্ণ করে, কিন্তু আবার আলাদা থেকে যায়।[২৩]

কিন্তু শেষমেষ ট্রিনিটি অতিন্দ্রীয় বা অ্যাধ্যাত্মিক অনুভূতি হিসাবেই কেবল অর্থ বহন করে: একে যাপন করতে হবে, চিন্তা করা যাবে না, কারণ ঈশ্বর মানবীয় ধারণার অতীতে অবস্থান করেন। এটা যৌক্তিক বা বুদ্ধিবৃত্তিক বিবরণ নয় বরং যুক্তিকে তালগোল পাকিয়ে দেওয়া এক কাল্পনিক উদাহরণ। গ্রেগরি অভ নাযিয়ানস একের মাঝে তিনজনের ধ্যান এক গভীর ও সীমাহীন। আবেগের প্রকাশ ঘটায় যা চিন্তা এবং বুদ্ধিবৃত্তিক স্পষ্টতাকে ঘোলা করে দেওয়ার কথা বলে এই বিষয়টি পরিষ্কার করে দিয়েছেন।

আমি যখনই একজনের কথা ভাবি, সঙ্গে সঙ্গে তিনজনের মহিমায় আলোকিত হয়ে উঠি; আমি তিনজনকে আলাদা করে নেওয়ামাত্র আবার ফিরে যাই একজনে। যখন কোনও একজনের কথা ভাবি, আমি পরিপূর্ণভাবে তার কথা ভাবি; আমার চোখ পরিপূর্ণ, আমার ভাবনার বৃহৎ অংশ আমাকে ছেড়ে যায়। [২৪]

গ্রিক ও রাশিয়ান অর্থডক্স ক্রিশ্চানরা ট্রিনিটির ধ্যানকে অনুপ্রেরণাদায়ী ধর্মীয় অভিজ্ঞতা হিসাবে আবিষ্কার করে গেছে। অবশ্য বহু পশ্চিমা ক্রিশ্চানের কাছে ট্রিনিটি স্রেফ হতবুদ্ধিকর । এর কারণ হতে পারে, ওরা হয়তো কাপাদোসিয়দের অ্যাখ্যায়িত Kerygmatic গুণাবলী বিবেচনা করেছে, অথচ গ্রিকদের বেলায় এটা ছিল ডগম্যাটিক সত্য যা কেবল অন্তর দিয়ে এবং ধর্মীয় অভিজ্ঞতার

ফলাফল হিসাবে আয়ত্ত করা যায়। অবশ্য যৌক্তিকভাবে এর কোনও অর্থই হয় না। প্রথমদিকে এক সারমনে গ্রেগির অভ নাযিয়ানস ব্যাখ্যা করেছিলেন যে ট্রিনিটির ডগমার দুর্বোধ্যতাই আমাদের ঈশ্বরের পরম রহস্যের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়; আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে তাঁকে বোঝার আশা করা ঠিক নয়। এটা আমাদের ঈশ্বর সম্পর্কে সহজ সাধারণ বক্তব্য রাখা থেকে বিরত রাখে, যিনি নিজেকে প্রকাশ করার সময় এক অলৌকিক উপায়েই কেবল নিজের প্রকৃতি দেখাতে পারেন। ট্রিনিটি কীভাবে কাজ করে সেটা বুঝতে পারার পথ খুঁজে পাবার সাধ্য আছে বলে ভাবতেও আমাদের সতর্ক করে দিয়েছেন বাসিল, সোজা কথায়: উদাহরণ স্বরূপ, গডহেডের তিনটি hypostases কীভাবে এক এবং একই সঙ্গে সমরূপ ও আলাদা এই ধাঁধার জবাব খোঁজার প্রয়াস পাওয়া অনুচিত। এটা ভাষা, ধারণা ও বিশ্লেষণের মানবীয় ক্ষমতার অতীত।[২৬]

এভাবে ট্রিনিটিকে অবশ্যই আক্ষরিক অর্থে ব্যাখ্যা করা যাবে না; এটা বিমূর্ত কোনও ‘তত্ত্ব নয়, বরং থিয়োবিয়া বা ধ্যানের ফল। অষ্টাদশ শতাব্দীতে পশ্চিমের ক্রিশ্চানরা যখন এই ডগমার কারণে বিব্রত বোধ করে পরিত্যাগ করার প্রয়াস পেয়েছিল, তখন তারা ঈশ্বরকে যুক্তির যুগের (Age of Reason) সঙ্গে যৌক্তিক ও বোধগম্য করতে চেয়েছিল। এটা, যেমন আমরা দেখব, আমাদের ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর তথাকথিত ঈশ্বরের প্রয়াণের দিকে টেনে নিয়ে যাওয়া অন্যতম উপাদান। কাপাদোসিয়রা যেসব কারণে এই কল্পনা-নির্ভর উদাহরণের অবতারণা করেছিলেন তার অন্যতম ছিল ঈশ্বর যেন আরিয়াসদের মতো ধর্মদ্রোহীদের বোধের গ্রিক দর্শনের যৌক্তিক ঈশ্বরের পরিণত না হতে পারেন। আরিয়াসের ধর্মতত্ত্ব একটু বেশি স্পষ্ট ও যৌক্তিক ছিল। ট্রিনিটি ক্রিশ্চানদের মনে করিয়ে দিয়েছে যে সত্তাকে আমরা ‘ঈশ্বর’ বলি মানব বুদ্ধিতে তার নাগাল পাওয়া সম্ভব নয়। নাইসিয়ায় প্রকাশিত অবতারবাদ গুরুত্বপূর্ণ ছিল, কিন্তু তাতে সরল বহুঈশ্বরবাদীতার সূত্রপাত হতে পারত। মানুষ স্বয়ং ঈশ্বরকে অতি বেশি মানবীয় ভাবতে শুরু করে বসতে পারে: “তিনি ঠিক আমাদের মতো ভাবছেন, কাজ করছেন, পরিকল্পনা করছেন, এমন ভাবনাও শুরু হতে পারত। এরপর ঈশ্বরের ওপর সব ধরণের পূর্বধারণাপ্রসূত মতামত চাপিয়ে দিয়ে সেগুলোকে পরম রূপ দেওয়াটা খুব দূরের ব্যাপার নয়। এই প্রবণতা সংশোধনের প্রয়াস ট্রিনিটি। একে ঈশ্বর সম্পর্কিত সত্য বিবরণ হিসাবে না দেখে বরং কোনও কবিতা বা ধর্মতত্ত্বীয় নাচ হিসাবে দেখা যেতে পারে, তুচ্ছ মরণশীল মানুষ, ঈশ্বর সম্পর্কে যা বিশ্বাস করে আর গ্রহণ করেছে তার মাঝামাঝি কিছু এবং এক নীরব উপলব্ধি যে এমন যেকোনও বক্তব্য বা কেরিগমা কেবল সাময়িক হতে পারে।

“থিয়োরি’ শব্দের ব্যবহারের ক্ষেত্রে গ্রিক ও পশ্চিমাদের পার্থক্য নির্দেশমূলক। প্রাচ্যের খৃস্টধর্মে থিয়োবিয়া সবসময় চিন্তা বোঝায়। পশ্চিমে তা যৌক্তিকভাবে প্রদর্শিত যুক্তিভিত্তিক প্রকল্প বুঝিয়ে থাকে। ঈশ্বর সম্পর্কে কোনও ‘থিয়োরি’ গড়ে তোলা বোঝায় যে তাঁকে চিন্তার মানবীয় ব্যবস্থা বা পদ্ধতিতে ধারণ করা যেতে পারে। নাইসিয়ায় মাত্র তিনজন লাতিন ধর্মবিদ ছিলেন। অধিকাংশ পশ্চিমা ক্রিশ্চান আলোচনার এই মাত্রায় যোগ্য ছিলেন না, তারা কোনও কোনও গ্রিক পরিভাষা বুঝতে না পারায় ট্রিনিটি মতবাদের বেলায় অসুখী বোধ করেছেন। সম্ভবত এটা ভিন্ন বাগধারায় সম্পূর্ণ অনুবাদযোগ্য ছিল না। প্রত্যেক সংস্কৃতিকে ঈশ্বর সম্পর্কে নিজস্ব ধারণা সৃষ্টি করতে হয় । ট্রিনিটির গ্রিক ব্যাখ্যা পশ্চিমাদের কাছে অচেনা মনে হয়ে থাকলে তাদের নিজস্ব ভাষ্য নিয়ে এগিয়ে আসার প্রয়োজন ছিল।

যে লাতিন ধর্মতাত্ত্বিক লাতিন চার্চের জন্যে ট্রিনিটিকে সংজ্ঞায়িত করেছিলেন তাঁর নাম অগাস্তিন। গভীর প্লেটোবাদী ছিলেন তিনি, ছিলেন প্রটিনাসের অনুগত, ফলে পশ্চিমের অনেক সহকর্মীর চেয়ে এই মতবাদের প্রতি বিশেষ দুর্বলতা ছিল তাঁর। তাঁর ব্যাখ্যানুযায়ী, ভুল বোঝাবুঝির ব্যাপারটা প্রায়শঃই পরিভাষাগত কারণে হয়েছে:

অনির্বচনীয় বিষয়াদি প্রকাশের ক্ষেত্রে যেসব আমরা কোনওভাবে হয়তো প্রকাশ করতে পারি আমাদের অবস্থান থেকে তা কোনও ভাবেই পূর্ণভাবে কিছু প্রকাশ করে না, আমাদের গ্রিক বন্ধুগণ একজন সত্তা এবং তিনটি বস্তুর কথা বলেছেন, কিন্তু লাতিনরা বলেছেন একজন সত্তা বা বস্তু এবং তিন ব্যক্তিত্বের কথা।[২৭]

গ্রিকরা যেখানে ঈশ্বরের একক অপ্রকাশিত সত্তা বিশ্লেষণে অস্বীকৃতি জানিয়ে তাঁর তিনটি hypotases-কে বিবেচনা করে ঈশ্বরের দিকে অগ্রসর হয়েছিল, যেখানে স্বয়ং অগাস্তিন এবং তার পরবর্তী সময়ের পশ্চিমা ক্রিশ্চানরা স্বর্গীয় একত্ব দিয়ে শুরু করে তারপর এর তিনটি প্রকাশ আলোচনায় অগ্রসর হয়েছেন। অগাস্তিনকে অন্যতম ফাদার অভ দ্য চার্চ হিসাবে গ্রিকরা শ্রদ্ধা করেছে, কিন্তু তাঁর ত্রিত্ববাদী ধর্মতত্ত্বের ব্যাপারে তারা সন্দিহান ছিল, এতে করে ঈশ্বরকে তাদের কাছে বড় বেশি যৌক্তিক ও মানবরূপী মনে হয়েছে। গ্রিকদের মতো অগাস্তিনের মতবাদ বিমূর্ত (metaphysical) ছিল না, বরং তা ছিল মনস্তাত্ত্বিক ও বড় বেশি ব্যক্তিক।

অগাস্তিনকে পশ্চিমা চেতনার জনক বলা যেতে পারে। সেইন্ট পল ছাড়া আর কোনও ধর্মবিদ পশ্চিমে তাঁর মতো প্রভাব বিস্তার করতে পারেননি। প্রাচীনকালের শেষ পর্যায়ের অন্য যেকোনও চিন্তাবিদের চেয়ে তাকে অনেক অন্তরঙ্গভাবে চিনি আমরা, বিশেষ করে তাঁর রচিত ঈশ্বর আবিষ্কারের অসাধারণ এবং আবেগময় বিবরণ কনফেশনস-এর জন্য। জীবনের গোড়া থেকেই একটা ঈশ্বরবাদী ধর্মের সন্ধানে ছিলেন অগাস্তিন। ঈশ্বরকে তিনি মানবজাতির পক্ষে অত্যাবশ্যক হিসাবে দেখেছেন: আমাদের তিনি তার জন্যে সৃষ্টি করেছেন, কনফেশনস-এর শুরুতে ঈশ্বরকে বলেছেন তিনি, এবং তোমার মাঝে স্থান না পাওয়া পর্যন্ত অস্থির থাকবে আমাদের হৃদয়।২৮ কারথেজে বক্তৃতা শিক্ষা দেওয়ার সময় তিনি নসটিকবাদের মেসোপটেমিয় রূপ ম্যানিশেইজম-এর দীক্ষা নেন। কিন্তু এর সৃষ্টিতত্ত্ব তাঁকে সন্তুষ্ট করতে না পারায় পরে তা ত্যাগ করেন। অবতারের ধারণাকে তার কাছে আক্রমণাত্মক মনে হয়েছিল, ঈশ্বরের ধারণার অসম্মান; কিন্তু তিনি ইতালিতে থাকার সময় বিশপ অভ মিলান আব্রস তাকে বোঝাতে সক্ষম হন যে খৃস্টধর্ম প্লেটো ও প্লাটিনাসের সঙ্গে বেমানান নয়। কিন্তু তারপরেও অগাস্তিন চূড়ান্ত পদক্ষেপ নিয়ে দীক্ষা গ্রহণে অনীহ ছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন খৃস্টধর্মের ক্ষেত্রে কুমারব্রত গ্রহণ বাধ্যতামূলক এবং এমন সিদ্ধান্ত নেওয়াকে ঘৃণার চোখে দেখেছেন: “প্রভু, আমাকে পবিত্রতা দাও, প্রার্থনা করতেন তিনি, কিন্তু এখনই নয়।২৯।

তাঁর চূড়ান্ত পরিবর্তনের ব্যাপারটা ছিল Surm und Drang, অতীত জীবনের সঙ্গে সহিংস সম্পর্কচ্ছেদের পর কষ্টকর পুনর্জন-যা পাশ্চাত্যের ধর্মীয় অভিজ্ঞতার বৈশিষ্ট্য হয়ে আছে। একদিন মিলানে তিনি তার বন্ধু অলিপিয়াসের সঙ্গে বাগানে বসে থাকার সময় সংগ্রাম চরম পর্যায়ে উন্নীত হয়ে এক গুপ্ত গভীরতা থেকে গভীর আত্ম-মূল্যায়ন আমার সকল কষ্টকে তুলে এনে ‘আমার হৃদয়ের সামনে হাজির করল’ (শ্লোক ১৮: ১৫)। এতে এক প্রবল ঝড় ও প্রবল অশ্রু বর্ষণ সৃষ্টি হলো। গোঙানির সঙ্গে সব অশ্রু ঝরাতে আমি অলিপিয়াসের পাশ থেকে উঠে পড়লাম (কান্নার জন্যে নিঃসঙ্গতা অনেক বেশি জরুরি মনে হয়েছে) …কোনওমতে একটা ডুমুর গাছের নিচে লুটিয়ে পড়লাম, অশ্রুকে আর বাধা দিরাম না। আমার দুচোখে নদী বইতে শুরু করল, তোমার পছন্দের উৎসর্গ (শ্লোক ৫০: ১৯) এবং যদিও এই ভাষায় নয়, কিন্তু এই অর্থে-আমি বারবার তোমাকে বলেছি, আর কতদিন, হে প্রভু, আর কতদিন এমন তীব্র রাগান্বিত থাকবে?’ (শ্লোক ৬: ৪)

পশ্চিমে ঈশ্বর আমাদের কাছে খুব সহজে ধরা দেননি। অগাস্তিনের বিশ্বাস পরিবর্তনকে মনস্তাত্বিক অ্যাবরিঅ্যাকশন মনে হয়, যার পর নবদীক্ষিতের মাঝে সব আবেগ হারিয়ে ঈশ্বরের বাহুতে ক্লান্ত হয়ে লুটিয়ে পরার অনুভূতি জাগে। মাটিতে লুটিয়ে কান্নার সময় অগাস্তিন অকস্মাৎ কাছের এক বাড়ি থেকে শিশুকণ্ঠে ‘তোলে, লেগে: হাতে নাও, পড়, হাতে নাও, পড়! বাক্যটির পুনরাবৃত্তি শুনতে পান। একে প্রত্যাদেশ ধরে নিয়ে লাফিয়ে উঠে দাঁড়ান অগাস্তিন এবং বিস্মিত অবস্থায় দ্রুত অসুস্থ আলিপিয়াসের কাছে ছুটে গিয়ে তাঁর নিউ টেস্টামেন্টখানা তুলে নেন । রোমানদের উদ্দেশে রাখা সেইন্ট পলের বক্তব্যের পাতা মেলে ধরেন তিনিঃ দাঙ্গা এবং মদ্যপানের অনুষ্ঠানে নয়, যৌনতা ও নোংরামিতে নয়, যুদ্ধ-বিদ্রোহে নয়, বরং প্রভু জেসাস ক্রাইস্টকে গ্রহণ কর এবং দেহ আর এর লালসার জন্যে কোনও ব্যবস্থা রেখো না।’ এক দীর্ঘ সংগ্রামের পরিসমাপ্তি ঘটল: ‘আমার আর বেশি পড়ার প্রয়োজন বা ইচ্ছা হলো না, স্মৃতিচারণ করেছেন অগাস্তিন, এই বাক্যটির শেষ শব্দটি শেষ হওয়ামাত্রই যেন সকল উৎকণ্ঠা থেকে মুক্তির এক আলো আমার সারা হৃদয়ে ছড়িয়ে পড়ল। সন্দেহের সকল ছায়া মিলিয়ে গেল।

অবশ্য ঈশ্বর আনন্দেরও উৎস হতে পারেন: কিন্তু এই ধর্মান্তরকরণের অল্পদিন পরেই অগাস্তিন মা মনিকার সঙ্গে তিবার নদীর তীরে অসতিয়ায় এক পরম আনন্দের অনুভূতি লাভ করেন। সপ্তম অধ্যায়ে এ বিষয়টি আরও বিস্তারিত আলোচনা করব আমরা। প্লেটোবাদী হিসাবে অগাস্তিন জানতেন ঈশ্বরকে অন্তরেই পাওয়া যায়। কনফেশনস-এর দশম পর্বে তিনি তাঁর ভাষায়, মেমোরিয়া বা স্মৃতির বিষয়ে আলোচনা করেছেন। এটা মনে রাখার চেয়ে অনেক জটিল একটি প্রক্রিয়া, মনস্তাত্ত্বিকগণ যাকে বলছেন অবচেতন, তার অনেক কাছাকাছি। অগাস্তিনের কাছে স্মৃতি একসঙ্গে গোটা মন-চেতন ও অবচেতন-এর পরিচায়ক। এর জটিলতা ও বৈচিত্র্য তাঁকে বিস্ময়াভিভূত করেছিল। এটা ছিল এক ভীতি-জাগানো রহস্য, ইমেজ, আমাদের অতীত আর অসংখ্য প্রান্তর, খাদ ও গুহার অস্তিত্বে ভরা এক অপরিমেয় জগৎ। এই গিজগিজে অন্তর জগতেই ঈশ্বরের সন্ধানে অবতরণ করেছিলেন অগাস্তিন, যিনি আপাত স্ববিরোধীভাবে তার অন্তর-বাইরে দুভাবেই ছিলেন। বাহ্যিক জগতের ঈশ্বরের ভেতর এবং বাইরে দুজায়গাতেই ছিলেন। কেবল বাহ্যিক জগতে ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রমাণ খোঁজা অর্থহীন। মনের প্রকৃত জগতেই কেবল তার । সন্ধান মিলতে পারে:

আমি তোমাকে ভালোবেসেছি, সৌন্দর্য যুগপৎ কত পুরোনো আবার একেবারে নতুন, আমি তোমাকে ভালোবেসেছি। আর দেখ, তুমি ছিলে অন্তরে, আমি ছিলাম বাইরের জগতে আর সেখানে খুঁজেছি তোমাকে, আর আমার অসুন্দর অবস্থায় তোমার সৃষ্ট সুন্দর সব জিনিসের মাঝে ঝাঁপ দিয়েছি। আমার সঙ্গে ছিলে তুমি, কিন্তু আমি তোমার সঙ্গে ছিলাম না । সুন্দর সব জিনিস আমাকে তোমার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিল, অথচ তোমার মাঝে তাদের অস্তিত্ব না থাকলে তাদের কোনও অস্তিত্বই থাকত না।[৩৩]

সুতরাং ঈশ্বর কোনও বস্তুগত সত্তা বা বাস্তবতা নন, বরং আত্মার জটিল গহ্বরের আধ্যাত্মিক সত্তা। অগাস্তিন কেবল প্লেটো আর প্লাটিনাসের সঙ্গে নয়, বরং নিরীশ্বরবাদী ধর্মের বৌদ্ধ, হিন্দু এবং শামানদের অভিজ্ঞতারও অংশী হয়েছেন। তারপরেও তাঁর উপাস্য কোনও নৈর্ব্যক্তিক ঈশ্বর ছিলেন না, বরং জুদো-ক্রিস্টান ঐতিহ্যের প্রবলভাবে ব্যক্তিক ঈশ্বর । ঈশ্বর মানুষের দুর্বলতার মাঝে স্থান করে নিয়েছেন এবং তার সন্ধানে গেছেন:

আমার বধির অবস্থাকে ছিন্ন করে সজোরে আহ্বান আর চিৎকার করলে তুমি। তুমি ছিলে তীব্র উজ্জ্বল, আমার অন্ধত্বকে দূর করে দিয়েছ। সুবাসিত ছিলে তুমি, আমি শ্বাস গ্রহণ করেছি আর এখন তোমার পেছনে ছুটছি। আমি তোমার স্বাদ গ্রহণ করেছি, অনুভব করেছি আর তোমার জন্যে আমার ক্ষুধা-তৃষ্ণা মেটেনি। আমাকে তুমি স্পর্শ করেছ আর আমি তোমার শান্তির খোঁজ পেতে অগ্নিতে আক্রান্ত হয়েছি।[৩৪]

গ্রিক ধর্মবিদরা সাধারণত তাঁদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা ধর্মতত্ত্বীয় রচনায় উল্লেখ করেননি, কিন্তু অগাস্তিনের ধর্মতত্ত্ব তার একান্ত ব্যক্তিগত কাহিনী থেকে জন্ম নিয়েছে।

মনের প্রতি অগাস্তিনের দুর্বলতা তাঁকে পঞ্চম শতকের প্রথম দিকে লিখিত ত্রিত্ববাদের নিজস্ব মনস্তাত্ত্বিক প্রবন্ধগুচ্ছ দে ত্রিনিতে (De Trinitate) গড়ে তুলতে প্ররোচিত করেছে। ঈশ্বর যেহেতু নিজ প্রতিমূর্তিতে আমাদের সৃষ্টি করেছেন, সেহেতু আমাদের মনের গভীরে এক ট্রিনিটির অস্তিত্ব উপলব্ধি করতে পারা উচিত। গ্রিকরা আদিভৌতিক রহস্যময়তা ও বাহ্যিক পার্থক্য উপভোগ করত। অগাস্তিন সেদিকে না গিয়ে আমাদের অধিকাংশের প্রত্যক্ষ করা সত্যের মূহুর্ত দিয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছিলেন। আমরা যখন ‘ঈশ্বরই আলো’ বা ‘ঈশ্বরই সত্য জাতীয় কথা শুনি, তখন আমাদের আধ্যাত্মিক আগ্রহ বেড়ে ওঠা টের পাই এবং মনে করি যে ঈশ্বর আমাদের জীবনের একটা মূল্য ও অর্থ দিতে পারেন। কিন্তু ওই মুহূর্তের আলোকনের পর আমরা আবার আমাদের স্বাভাবিক মানসিক অবস্থায় ফিরে আসি, যেখানে আমরা পরিচিত এবং পার্থিব বস্তুতে’[৩৫] মোহান্ধ হয়ে থাকি। আমরা যত চেষ্টাই করি না কেন, আমাদের পক্ষে আর সেই অব্যক্ত আকাঙ্ক্ষার মুহূর্তটির নাগাল পাওয়া সম্ভব হয় না। চিন্তার স্বাভাবিক প্রক্রিয়া আমাদের কাজে আসবে নাঃ পরিবর্তে আমাদের তিনি সত্য ধরনের বাক্য দিয়ে ‘মন কী বোঝে’ সেটা বুঝতে হবে। কিন্তু যাকে চিনি না সেই সত্তাকে কি ভালোবাসা সম্ভব? অগাস্তিন দেখাতে চেয়েছেন, যেহেতু আমাদের প্রত্যেকের মনে প্লেটোর ইমেজের মতো ঈশ্বরের প্রতিবিম্ব স্বরূপ এক ট্রিনিটির অস্তিত্ব আছে, তাই আমরা আমাদের আদি রূপের-আদি নকশা–যার ভিত্তিতে আমাদের আকার দেওয়া হয়েছে-আকাক্ষা করি।

মন নিজেকে ভালোবেসেছে, এ দিয়ে যদি শুরু করি, আমরা ট্রিনিটির দেখা পাই না, দেখা মেলে দ্বিত্বের: ভালোবাসা ও মন। কিন্তু মন নিজের সম্পর্কে সজাগ না থাকলে আমরা যাকে আত্মসচেতনতা বলি সেটা সহ-নিজেকে ভালোবাসতে পারবে না। দেকার্তের আভাসে অগাস্তিন যুক্তি দেখিয়েছেন যে, আমাদের নিজেদের সম্পর্কে জ্ঞান অন্য সমস্ত নিশ্চয়তার মূল ভিত্তি। এমনকি সন্দেহের অনুভূতিও আমাদের আত্মসচেতন করে তোলে।

সুতরাং, আত্মার মাঝে তিনটি গুণের বাস: স্মৃতি, উপলব্ধি ও ইচ্ছা; যেগুলো যথাক্রমে জ্ঞান, আত্ম-জ্ঞান ও ভালোবাসার সঙ্গে সম্পর্কিত। স্বর্গীয় তিন ব্যক্তির মতো এই মানসিক কর্মকাণ্ডগুলো আবশ্যিকভাবে এক, কারণ এগুলো তিনটি আলাদা মন গঠন করে না, বরং প্রত্যেকে গোটা মনুকে পরিপূর্ণ করে রাখে ও বাকি দুটোকে আবৃত করে: ‘আমার মনে আছে যে, স্মৃতি, উপলব্ধি আর ইচ্ছা আছে আমার, আমি বুঝি যে আমি বুঝি, আমার ইচ্ছা আছে। ও আমি মনে করতে পারি। আমি আমার নিজস্ব ইচ্ছা, উপলব্ধি ও স্মৃতিশক্তিকে পরিচালিত করতে পারি।৩৮ কাপাদোসিয়দের বর্ণিত স্বর্গীয় ট্রিনিটির মতো তিনটি উপাদানের সবগুলোই, সুতরাং, একটি জীবন, একটি মন ও একটি সত্তা তৈরি করে।৩৯

তবে আমাদের মনের কর্মধারা বোঝাটা কেবল প্রথম পদক্ষেপ: আমরা আমাদের মনে যে ট্রিনিটির মুখোমুখি হই, সেটা স্বয়ং ঈশ্বর নন, বরং আমাদের স্রষ্টা ঈশ্বরের একটা চিহ্ন। আথানাসিয়াস ও গ্রেগরি অভ নাইসা উভয়ই মানুষের আত্মায় ঈশ্বরের পরিবর্তনকারী উপস্থিতি বর্ণনা করতে গিয়ে আয়নায় প্রতিফলনের তুলনা টেনেছিলেন। একে সঠিকভাবে বোঝার জন্যে আমাদের অবশ্যই স্মরণ করতে হবে যে গ্রিকরা আয়নায় সৃষ্ট প্রতিবিম্বকে বাস্তব বলে বিশ্বাস করত, দর্শকের চোখ থেকে বিচ্ছুরিত আলো বস্তু হতে আসা আলোর সঙ্গে মিলে কাঁচের গায়ে আকৃতির সৃষ্টি করে। অগাস্তিনের বিশ্বাস ছিল, মনের ট্রিনিটিও একটা প্রতিফলন যাতে ঈশ্বরের উপস্থিতি রয়েছে, যা তার দিকে গমন করে। কিন্তু কীভাবে আমরা আয়নায় গভীরভাবে সৃষ্ট প্রতিফলিত ইমেজ পেরিয়ে স্বয়ং ঈশ্বরের কাছে যেতে পারি? কেবল মানবীয় প্রয়াসে ঈশ্বর ও মানুষের মধ্যকার বিশাল দূরত্ব অতিক্রম করা সম্ভব নয়। কেবল ঈশ্বর বাণীর রূপ ধরে আমাদের সঙ্গে মিলিত হতে এসেছিলেন বলেই আমরা আমাদের মাঝে ঈশ্বরের প্রতিরূপ পুনঃস্থাপিত করতে পারি, পাপের দরুণ যা ক্ষতিগ্রস্ত বিকৃত হয়ে গিয়েছিল। নিজেদের আমরা স্বর্গীয় কর্মকাণ্ডের কাছে মেলে ধরি যা আমাদের তিন রকম শৃঙ্খলার সাহায্য বদলে দেবে, অগাস্তিন যাকে বলছেন বিশ্বাসের ট্রিনিটি: রেতিনিও (আমাদের মনে অবতারের সত্য ধারন), কনতেমপ্লাতিও (সেগুলোর কথা ভাবা) ও দাইলেকতি (সেগুলোর মাঝে আনন্দ লাভ করা)। এভাবে ক্রমশঃ আমাদের মনে ঈশ্বরের উপস্থিতির ধারাবাহিক বোধ জাগানোর ভেতর দিয়ে ট্রিনিটি প্রকাশিত হবে। এই জ্ঞান স্রেফ বুদ্ধিগত তথ্যের সংগ্রহ নয়, বরং এক সৃজনশীল অনুশীলন যা আমাদের সত্তার গভীরতর প্রদেশে এক স্বর্গীয় মাত্রার প্রকাশ ঘটিয়ে আমাদেরকে বদলে দেবে ।

পশ্চিমা বিশ্বে সেটা ছিল অন্ধকার, ভয়ানক সময়। বিভিন্ন বর্বর গোত্র ইউরোপে অনুপ্রবেশ করে রোমান সাম্রাজ্যকে ধ্বংস করে দিচ্ছিল; পশ্চিমে সভ্যতার পতন অনিবার্যভাবে সেখানে ক্রিশ্চান আধ্যাত্মিকতার ওপর প্রভাব ফেলেছিল। অগাস্তিনের মহান শিক্ষক আমব্রস এমন এক ধর্মবিশ্বাসের প্রকাশ করেছিলেন যেটা ছিল অত্যাবশ্যকীয়ভাবে আত্মরক্ষামূলক: ইস্ত্ৰেগ্ৰেতাস বা সামগ্রিকতা ছিল এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গুণ। চার্চকে এর মতবাদের অখণ্ডতা রক্ষা করতে হচ্ছিল এবং ভার্জিন মেরির নিষ্পাপ দেহের মতো বর্বরদের মিথ্যা মতবাদ হতে একে মুক্ত রাখতেই হবে (যাদের অনেকেই আরিয়ানিজমে দীক্ষা নিয়েছিল)। অগাস্তিনের পরবর্তী কালের রচনায় এক গভীর দুঃখবোধও রয়েছে। রোমের পতন তাঁর আদি পাপ-এর মতবাদকে প্রভাবিত করেছিল, পরবর্তীকালে যা পশ্চিমা বিশ্বদৃষ্টির রূপ পাবে। অগাস্তিন বিশ্বাস করতেন যে, স্রেফ আদমের পাপের কারণে ঈশ্বর মানুষকে অনন্ত নরক যন্ত্রণায় নিক্ষেপ করেছেন। এই সহজাত অপরাধ যৌন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তাঁর সকল বংশধরদের মাঝে সংক্রমিত হয়েছে, যৌনক্রিয়া আবার, অগাস্তিন যাকে বলেছেন, ‘উদগ্র-লালসায় দুষিত। উদগ্র-লালসা হচ্ছে ঈশ্বরের পরিবর্তে তুচ্ছ প্রাণীর মাঝে আনন্দ সন্ধান; যৌনক্রিয়ার সময় যখন আমাদের যুক্তিবোধ কামনা ও আবেগে পুরোপুরি ভেসে যায়, যখন ঈশ্বর পুরোপুরি বিস্মৃত হন ও প্রাণীকূল নির্লজ্জভাবে পরস্পরকে নিয়ে আনন্দে মগ্ন হয়, তখন প্রবলভাবে এটা অনুভূত হয়। শিহরণের ডামাডোল ও বেসামাল কামনায় যুক্তির এই প্রতীক বা ইমেজের পতন ঘটে। অবৈধ কামনা অস্বস্তি করভাবে বর্বরদের হাতে পশ্চিমে আইন-শৃঙ্খলার যুক্তির উৎস রোমের পতনের মতো। অগাস্তিনের কঠোর মতবাদ এ দুইকে মিলিয়ে এক নিষ্করুণ ঈশ্বরের ভয়ঙ্কর চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন:

পাপের ফলে (স্বর্গ হতে) বহিষ্কৃত আদম তার উত্তরসুরিকেও মৃত্যু ও নরকবাসের সাজায় আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে দিয়েছেন, যে উত্তরসূরিকে তিনি স্বয়ং পাপের দ্বারা একেবারে শেকড়ে বিনষ্ট করেছেন; সুতরাং (উদগ্র যৌন লালসার মাধ্যমে, যার দ্বারা অবাধ্যতার কারণে তার ওপর এক জুৎসই শাস্তি আরোপ করা হয়েছিল। তাঁর এবং তাঁর সঙ্গীনি হতে-যিনি তাঁর পাপের কারণ এবং শাস্তিভভাগোর সঙ্গীনি হতে-নতুন যে বংশধরই আসুক না কেন আদি পাপের ভার বহন করতে হবে তাঁকে যুগ যুগ ধরে, যার দ্বারা চূড়ান্ত ভাবে বিদ্রোহী দেবদূতদের সঙ্গে সীমাহীন শাস্তির মুখোমুখি না হওয়া পর্যন্ত …এটা নিজেই অসংখ্য ভ্রান্তি ও দুঃখের ভেতর দিয়ে অগ্রসর হতে থাকবে, সুতরাং, ব্যাপারটা দাঁড়াচ্ছে, মানুষের হতভাগ্য পিণ্ডটি নিথর পড়েছিল, গড়াগড়ি যাচ্ছিল অশুভের মাঝে; এক ভ্রান্তি থেকে আরেক ভ্রান্তিতে ঝাঁপিয়ে পড়ছিল; যোগ দিয়েছে পাপাচারী একদল দেবদূতের সঙ্গে, সবচেয়ে জঘন্য বিশ্বাসঘাতকতার সবচেয়ে ন্যায়সঙ্গত মাশুল গুনছে।

ইহুদি বা গ্রিক অর্থডক্স ক্রিশ্চানদের কেউই আদমের পতনকে এমন ভয়ানক দৃষ্টিতে দেখেনি; পরবর্তীকালে মুসলিমরাও আদি পাপের এমন কঠোর ধর্মতত্ত্ব গ্রহণ করেনি। পশ্চিমে অনন্য এই মতবাদ অতীতে তারতুলিয়ানের বর্ণিত ঈশ্বরের চেহারা আরও ভয়ঙ্কর করে তুলেছে।

অগাস্তিন আমাদের এক কঠিন ঐতিহ্যের উত্তরসূরি করে গেছেন। যে ধর্মটি নারী ও পুরুষকে আপন মানব সত্তাকে বংশপরম্পরায় ত্রুটিপূর্ণ হিসাবে দেখার শিক্ষা দেয়, সেটা তাদেরকে আপন থেকে দূরে সরিয়ে দিতে পারে। সাধারণভাবে যৌনতাকে খারাপ দৃষ্টিতে দেখা ও বিশেষ করে নারীদের অসম্মানে এই বিচ্ছিন্নতা অনেক বেশি স্পষ্ট। যদিও আদিতে খৃস্টধর্ম নারীদের ক্ষেত্রে ইতিবাচক ছিল, কিন্তু অগাস্তিনের সময়েই এক ধরনের পুরুষতান্ত্রিক প্রবণতায় আক্রান্ত হয়েছিল এটা। নারীদের প্রতি জেরোমির বিদ্বেষপূর্ণ চিঠিপত্রগুলোকে কখনও কখনও বিকৃতির পরিচায়ক বলে মনে হয়। তাতুলিয়ান নারীদের অশুভ প্রলোভন ও মানব জাতির জন্যে চিরকালীন বিপদ বলে অভিযুক্ত করেছিলেন:

তোমরা কী জান না যে, তোমরা প্রত্যেকেই একেকজন ইভ? বর্তমান যুগে তোমাদের লিঙ্গের ওপরই ঈশ্বরের সাজা বহাল আছে: অপরাধকে প্রয়োজনের তাগিদে থাকতে হবে। তোমরা শয়তানের দরজা; তোমরা সেই নিষিদ্ধ বৃক্ষের উন্মোচক; তোমরা স্বর্গীয় আইনের প্রথম লঙ্ঘনকারী; তোমরাই সেই শয়তান যাকে আক্রমণ করার সাহস পায়নি, তাকে প্রলুব্ধ করেছ। তোমরা ঈশ্বরের প্রতিমূর্তি মানুষকে হেলাফেলায় ধ্বংস করেছ। তোমাদের সীমালঙ্ঘনের কারণে এমনকি ঈশ্বরের পুত্রকেও মরতে হয়েছিল ৪৪

সায় দিয়েছেন অগাস্তিন; ‘মা হোক বা স্ত্রী হোক, কী এসে যায়, এক বন্ধুকে লিখেছিলেন তিনি, তারপরও এরা প্রলুব্ধকারীই, প্রত্যেক নারীর ভেতর যার অস্তিত্বের ব্যাপারে আমাদের অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে।৪৫ আসলে ঈশ্বর যে নারী সৃষ্টি করেছেন, এটা নিয়েই বিভ্রান্তিতে পড়ে গিয়েছিলেন অগাস্তিন, যদি আদমের একজন ভালো সঙ্গী ও কথা বলার মানুষের প্রয়োজন থেকেই থাকে, সেক্ষেত্রে স্বামী-স্ত্রী সৃষ্টি না করে বন্ধু হিসাবে দুজন পুরুষের ব্যবস্থা করলেই অনেক ভালো হতো। সন্তান ধারণই নারীর একমাত্র কাজ, যার ফলে যৌন রোগের মতো আদি পাপ পরবর্তী প্রজন্মে ছড়িয়ে পড়ে। যে ধর্মটি মানবজাতির অর্ধাংশকে বাঁকা চোখে দেখে আর অনিচ্ছাকৃত যেকোনও মন, হৃদয় ও দেহের নড়াচড়াকে মনে করে মারাত্মক উগ্র যৌন লালসা, সে ধর্মটি কেবল নারী ও পুরুষকে তাদের অবস্থানচ্যুতই করতে পারে। পশ্চিমা খৃস্টধর্ম কখনওই এই বিকৃত পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীদের বিন্যাসের প্রতিটি পর্যায়ে ভারসাম্যহীন প্রতিক্রিয়ায় এটা এখনও চোখে পড়ে। পুবের নারীরা যখন এই সময়ে ওইকুমিনের নারীদের বহনকারী হীনম্মন্যতার ভার বহন করছিল, তখন পশ্চিমে তাদের বোনেরা বহন করেছিল ঘৃণা ও পাপময় যৌনতার বাড়তি ছাপ; যে ঘৃণা আর আতঙ্ক তাদের সমাজ বিচ্ছিন্ন করার কারণ হয়ে দাঁড়ায় ।

ঈশ্বরের ধারণা যেখানে দেহে পরিণত হয়েছে ও আমাদের মানবীয় পরিচয়ের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে সেখানে ক্রিশ্চানদের দেহের প্রতি আরও মর্যাদাশীল হওয়া উচিত ছিল, উল্টো ব্যাপারটি ঘটা অদ্ভুত এক পরিহাস বটে। এই জটিল বিশ্বাস নিয়ে আরও বিতর্ক হয়েছিল। চতুর্থ ও পঞ্চম শতাব্দীতে আপোলিনারিয়াস নেস্টোরিয়াস ও ইউতিচেস-এর মতো ‘ধর্মদ্রোহীগণ’ কঠিন সব প্রশ্নের উত্থাপন করেছেন। সৃষ্টের ঐশ্বরিকতা কীভাবে তার মানবরূপের সঙ্গে খাপ খেয়েছে? মেরি নিশ্চয়ই ঈশ্বরের মাতা নন, বরং মানুষ জেসাসের মাতা? ঈশ্বর অসহায় ক্রন্দনরত শিশু হন কীভাবে? বরং এটাই বলা কি বেশি সঙ্গত নয় যে তিনি মন্দিরের মতো খৃস্টের বিশেষ অন্তরঙ্গ ছিলেন? স্পষ্ট সামঞ্জস্যহীনতা সত্ত্বেও অর্থডক্সরা তাদের মতবাদ আঁকড়ে ছিল । বিশপ অভ আলেকজান্দ্রিয়া সিরিল আথানাসিয়াসের বিশ্বাস পুনরাবৃত্তি করেন: ঈশ্বর প্রকৃতই আমাদের পঙ্কিল জগতে এত গভীরভাবে নেমে এসেছিলেন যে তাঁকে এমনকি মৃত্যু ও অসহায়ত্বের স্বাদ গ্রহণ করতে হয়েছে। ঈশ্বর সম্পূর্ণ যন্ত্রণার ঊর্ধ্বে, কষ্টভোগ বা পরিবর্তনে অক্ষম, এরকম দৃঢ় একটা বিশ্বাসের সঙ্গে এই বিশ্বাস মেলানো কঠিন মনে হয়েছে। প্রধানত স্বর্গীয় আপাথিয়া দিয়ে বৈশিষ্ট্যায়িত গ্রিকদের দূরবর্তী ঈশ্বরকে জেসাস ক্রাইস্টের মাঝে দেহধারণকারী ঈশ্বর হতে একেবারেই আলাদা মনে হয়েছে। অর্থডক্সরা ভেবেছে কষ্ট ভোগকারী অসহায় ঈশ্বরের ধারণাকে প্রবল আক্রমণাত্মক হিসাবে আবিষ্কারকারী ‘ধর্মদ্রোহীরা এর রহস্য ও বিস্ময়ের ঐশীরূপ বিনষ্ট করতে চেয়েছেন। অবতারবাদের বৈপরীত্যকে হেলেনিক ঈশ্বরের প্রতিষেধক মনে হয়-যিনি আমাদের আত্মতুষ্টি দূর করার জন্যে কিছুই করেননি এবং যিনি পুরোপুরি যৌক্তিক ছিলেন।

৫২৯ সালে সম্রাট জাস্তিনিয়ান অ্যাথেন্সে বুদ্ধিবৃত্তিক পৌত্তলিকতাবাদের শেষ ঘাঁটি দর্শনের প্রাচীন বিদ্যাপীঠ বন্ধ করে দেন: এর শেষ পণ্ডিত ছিলেন প্রটিনাসের বিশেষ অনুরাগী শিষ্য প্রক্লাস (৪১২-৪৮৫)। পৌত্তলিক দর্শন আড়ালে চলে যায় এবং নতুন খৃস্টধর্মের কাছে পরাস্ত হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। যাহোক, চার বছর পর চারখানা অতিন্দ্রীয়বাদী প্রবন্ধ রচনা প্রকাশিত হয় যেগুলোর রচয়িতা সেইন্ট পলের প্রথম আথেনিয় দীক্ষাপ্রাপ্ত ডেনিস দ্য আরোপাগাইত হিসাবে কথিত। আসলে এগুলো লিখেছিলেন পরিচয় গোপন করে যাওয়া জনৈক ষষ্ঠ শতকীয় গ্রিক ক্রিশ্চান। কিন্তু ছদ্মনামের একটা প্রতীকী ক্ষমতা ছিল, যা মূল লেখকের পরিচয়ের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ: ছদ্ম ডেনিস নিওপ্লেটোনিজমের দর্শনকে ব্যাপ্টাইজ করতে সক্ষম এবং গ্রিকদের ঈশ্বরের সঙ্গে বাইবেলের সেমেটিক ঈশ্বরকে মিলিয়ে দিয়েছিলেন।

ডেনিস কাপাদোসিয় পাদরিদেরও উত্তরাধিকারী ছিলেন। বাসিলের মতো তিনিও কেরিগমা ও ডগমার পার্থক্যকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছিলেন। এক চিঠিতে তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন, দুটো ধর্মতত্ত্বীয় ধারা রয়েছে এবং দুটোই অ্যাপসলদের কাছ থেকে প্রাপ্ত। কেরিগমা সম্বলিত গস্পেলসমূহ স্পষ্ট ও সহজবোধ্য এবং ডগমা সম্পর্কিত গস্পেলগুলো অস্পষ্ট ও অতিন্দ্রীয়। অবশ্য দুটোই পরস্পর হতে স্বাধীন, কিন্তু খৃস্টধর্ম বিশ্বাসের ক্ষেত্রে অত্যাবশ্যকীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ। একটা প্রতীকী ও শিষ্যত্বের কথা বলে, আর অপরটি ‘দার্শনিক ও প্রমাণের ক্ষমতা রাখে’-এবং সব কিছুর মাঝে অনির্বচনীয় বিজড়িত। কেরিগমা এর স্পষ্ট প্রকাশিত সত্য দিয়ে উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা যোগায়, কিন্তু ডগমার নীরব বা গুপ্ত ধারা এক রহস্য যা দীক্ষার দাবি করে: ‘এটা দীক্ষার মাধ্যমে আত্মাকে ঈশ্বরের সঙ্গে যুক্ত ও কার্যকর করে যা কিছু শিক্ষা দেয় না। অ্যারিস্টটলের মতোই একই ভাষায় জোর দিয়ে একথা বলেছেন ডেনিস। এক রকম ধর্মীয় সত্য আছে যা কখনও ভাষা, যুক্তি বা যুক্তিভিত্তিক আলোচনা দিয়ে স্পষ্টভাবে বোঝানো সম্ভব নয়। এর প্রকাশ ঘটে প্রতাঁকের সাহায্যে, সাহিত্যের ভাষা বা ভঙ্গির মাধ্যমে, কিংবা মতবাদ দ্বারা, যেগুলো পবিত্র আড়াল, যা অনির্বচনীয় অর্থকে দৃষ্টির আড়ালে রেখেছে কিন্তু যা আবার চরম রহস্যময় ঈশ্বরকে মানুষের প্রকৃতির সীমাবদ্ধতার সঙ্গে অভিযোজিত করে ও ধারণাগতভাবে না হলেও অন্তত কাল্পনিকভাবে বোধগম্য রূপে বাস্তবতাকে (Reality) প্রকাশ করে।

গুপ্ত বা নিগূঢ় অর্থ কেবল সুবিধাপ্রাপ্ত অভিজাতদের জন্যে নয় বরং সকল ক্রিশ্চানের জন্যে। ডেনিস কেবল সাধু সন্ন্যাসীদের উপযুক্ত কষ্টকর কোনও শৃঙ্খলার পক্ষে কথা বলেননি। সকল বিশ্বাসীর অনুসৃত শাস্ত্রাচার ঈশ্বরকে লাভ করার প্রধান উপায় । তার ধর্মতত্ত্বে এরই প্রাধান্য ছিল। এক শক্ত পর্দার আড়ালে এসব সত্য লুকায়িত থাকার উদ্দেশ্য নারী-পুরুষকে শুভ ইচ্ছা হতে বঞ্চিত করা নয়, বরং সকল ক্রিশ্চানকে অনুমান ও ধারণার বোধ থেকে ঊর্ধ্বে তুলে স্বয়ং ঈশ্বরের অব্যক্ত সত্তার কাছে পৌঁছে দেওয়া। যে বিষয় কাপাদোসিয়দের সকল ধর্মতত্ত্ব অ্যাপোফ্যাটিক হওয়া উচিত, এই দাবি করতে অনুপ্রাণিত করেছিল সেটাই ডেনিসের জন্যে অপ্রকাশযোগ্য ঈশ্বরের কাছে যাবার এক শক্তিশালী পদ্ধতিতে পরিণত হয়েছিল।

প্রকৃতপক্ষে, ডেনিস ‘ঈশ্বর’ শব্দটি ব্যবহার করারই পক্ষপাতি ছিলেন–এর কারণ সম্ভবত শব্দটি অপর্যাপ্ত ও মানুষ-সদৃশ্য একটা সুর পেয়ে গিয়েছিল। তিনি প্রক্লাসের থিউলজি কথাটি পছন্দ করতেন প্রধানত যা শাস্ত্রীয় ছিল: পৌত্তলিক জগতে থিউলজি ছিল উৎসর্গ ও স্বর্গীয়করণের মাধ্যমে স্বর্গীয় মানা আহরণের উপায় । ঈশ্বর-আলোচনায় ডেনিস এর প্রয়োগ করেছেন, যা সঠিকভাবে উপলব্ধি করা গেলে প্রকাশিত প্রতাঁকে বিজড়িত স্বর্গীয় energeiai ও উন্মুক্ত করতে পারে। তিনি কাপাদোসিয়দের সঙ্গে একমত হয়েছিলেন যে ঈশ্বরের জন্যে সকল ধারণা ও ভাষাই অপর্যাপ্ত এবং একে অবশ্যই আমাদের জ্ঞানের অতীত এক সত্তার সঠিক বিবরণ হিসাবে গ্রহণ করা যাবে না। এমনকি খোদ ‘ঈশ্বর’ শব্দটিও ত্রুটিপূর্ণ, কেননা ঈশ্বর ‘ঈশ্বরের ঊর্ধ্বে,’ ‘সত্তার অতীত এক রহস্য। ক্রিশ্চানদের অবশ্যই উপলব্ধি করতে হবে যে ঈশ্বর, নিম্নস্তরের সত্তাসমূহের সর্বোচ্চ স্তরে অধিষ্ঠিত আরেকটি সত্তা নন। মানুষ বা অন্যান্য জিনিস ঈশ্বরের বিপরীতে এক আলাদা সত্তা বা বিকল্প সত্তা হিসাবে দাঁড়ায় না, যা জানার কোনও বিষয় হতে পারে। অস্তিত্ব আছে এমন জিনিসগুলোর একটি নন ঈশ্বর; তিনি আমাদের অভিজ্ঞতাজাত যেকোনও কিছুর চেয়ে আলাদা। আসলে ঈশ্বরকে বরং কিছু না’ ডাকাই অধিক সঠিক: এমনকি তিনি আমাদের ট্রিনিটি কোনওটাই নন। তিনি যেমন সকল সত্তার ঊর্ধ্বে তেমনি সকল নামেরও ঊর্ধ্বে। তারপরেও আমরা ঈশ্বরের সঙ্গে একীভূত হওয়ার একটা পদ্ধতি হিসাবে আমাদের অক্ষমতাকে তার কথা বলার জন্যে ব্যবহার করতে পারি, যা আমাদের প্রকৃতির ‘দেবাত্বোরোপণ’ (theosis) ছাড়া আর কিছু নয়। ঈশ্বর ‘পিতা,’ ‘পুত্র’ ও ‘আত্মার মতো তার কোনও কোনও নাম ঐশীগ্রন্থে আমাদের সামনে প্রকাশ করেছেন, কিন্তু এগুলোর উদ্দেশ্য তাঁর সম্পর্কে তথ্য জানানো নয়, বরং নারী ও পুরুষকে তাঁর দিকে আকৃষ্ট করে তাদের তার স্বর্গীয় প্রকৃতির অংশ গ্রহণে সক্ষম করে তোলা।

দ্য ডিভাইন নেমস্ শিরোনামের প্রবন্ধের প্রত্যেক অধ্যায়ে ঈশ্বর প্রকাশিত একটি কেরিগমা সম্পর্কিত সত্য দিয়ে আলোচনা শুরু করেছেন ডেনিস: তাঁর মহত্ব (goodness), প্রজ্ঞা, পিতৃত্ব, ইত্যাদি। এরপর তিনি দেখাতে চেয়েছেন যে যদিও ঈশ্বর এসব উপাধি দিয়ে তাঁর একটা কিছুর প্রকাশ ঘটিয়েছেন, কিন্তু তিনি যা প্রকাশ করেছেন সেটা স্বয়ং তিনি নন। আমরা সত্যিই ঈশ্বরকে বুঝতে চাইলে আমাদেরকে অবশ্যই এসব গুণাবলী ও নাম অস্বীকার করতে এগিয়ে যেতে হবে। এভাবে আমাদের অবশ্যই বলতে হবে তিনি ঈশ্বর আবার ‘ঈশ্বর-নন, ‘ভালো’ বলেই আবার যোগ করতে হবে তিনি ‘ভালো-নন বিপরীত এই ধাক্কা, জানা ও অজানা উভয়কেই ধারণকারী একটি প্রক্রিয়া আমাদের পার্থিব ধারণাসমূহের উর্ধ্বে তুলে নেবে, আমরা স্বয়ং আপ্রকাশঅযোগ্য সত্তার কাছে পৌঁছে যাব। এভাবে আমরা একথা বলে শুরু করব যে:

তাঁর সম্পর্কে উপলব্ধি, যুক্তি, জ্ঞান, স্পর্শ, ধারণা, কল্পনা, নাম ও আরও বহু জিনিস রয়েছে। কিন্তু তাঁকে বোঝা যায় না, তাঁর সম্পর্কে কিছু বলা যায় না, তাঁকে নামও দেওয়া যায় না। তিনি বস্তুসমূহের একটি নন।

সুতরাং ঐশীগ্রন্থ পাঠ ঈশ্বর সম্পর্কে সত্য অবগত হবার কোনও প্রক্রিয়া নয় বরং কেরিগমাকে ডগমায় রূপান্তরিত এক বৈপরীত্যপূর্ণ অনুশীলন হওয়া উচিত। এই পদ্ধতি একটি থিউরজি, স্বর্গীয় ক্ষমতা ধারণ যা আমাদের স্বয়ং ঈশ্বরের কাছে আরোহণে সক্ষম করে তোলে এবং, পুঁটিনাস সব সময় যেমন শিক্ষা দিয়ে গেছেন, আমরা স্বর্গীয় হয়ে উঠি । এটা আমাদের চিন্তা বন্ধ করার একটি পদ্ধতি। আমাদেরকে ঈশ্বর সম্পর্কিত সকল ধারণা ত্যাগ করে যেতে হবে। আমরা আমাদের মনের ক্রিয়া থামাতে বলি। এমনকি ঈশ্বরের গুণাবলীর অস্বীকৃতিও পেছনে ফেলে যেতে হবে। তাহলে এবং কেবল তাহলেই আমরা ঈশ্বরের সঙ্গে পরমানন্দাদায়ক ঐক্য অর্জন করতে পারব।

পরমানন্দের কথা বলতে গিয়ে মনের বিচিত্র অবস্থা কিংবা অস্পষ্ট যোগ অনুশীলনের মাধ্যমে অর্জিত সচেতনতার বিকল্প ধরনের কথা বোঝাননি ডেনিস। এটা প্রার্থনা ও থিয়োরিয়ার বিপরীতধর্মী পদ্ধতিতে প্রত্যেক ক্রিশ্চানের আয়ত্ত করার মতো একটা ব্যাপার। এটা আমাদের কথা বন্ধ করবে এবং আমাদের নীরব স্থানে পৌঁছে দেবে। আমরা যখন বুদ্ধির অতীত সেই অন্ধকারে ঝাঁপ দেব, আমরা কেবল ভাষার অভাব দ্বারাই আক্রান্ত হব না, বরং আবিষ্কার করব যে আমরা বাকহারা ও জ্ঞানহীন হয়ে পড়েছি।৫৫ গ্রেগরি অভ নাইসার মতো তিনিও মোজেসের সিনাই পর্বতে আরোহণের কাহিনীকে উপদেশমূলক হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন। মোজেস পাহাড়ে ওঠার পর স্বয়ং ঈশ্বরকে দেখতে পাননি, কেবল ঈশ্বর যেখানে ছিলেন সেখানেই উপস্থিত হয়েছিলেন। এক ঘন মেঘের অস্পষ্টতায় ঢাকা পড়ে গিয়েছিলেন তিনি, কিছুই দেখতে পাননিঃ এভাবে আমরা যেসব দেখতে বা বুঝতে পারি সেগুলো প্রতীকমাত্র (ডেনিস Paradigm শব্দটি ব্যবহার করেছেন) যা সকল চিন্তার অতীত এক সত্তার উপস্থিতি প্রকাশ করে। মোজেস অজ্ঞতার অন্ধকারে পৌঁছে গিয়েছিলেন এবং এর ফলে এমন কিছুর সঙ্গে মিলিত হতে পেরেছেন যা সকল উপলব্ধিকে ছাড়িয়ে যায়: আমরাও একই রকম আনন্দ লাভ করতে পারব যা। আমাদেরকে আমাদের সত্তার বাইরে নিয়ে ঈশ্বরের সঙ্গে এক করে দেবে।

ঈশ্বর আমাদের সঙ্গে মিলিত হতে পর্বতশীর্ষে নেমে আসেন বলেই কেবল এটা সম্ভব। এখানেই নিওপ্লেটোনিজম থেকে সরে এসেছেন ডেনিস। নিওপ্লেটোনিজমে ঈশ্বরকে স্থির ও দূরবর্তী মনে করা হয়েছে, যিনি মানবীয় প্রয়াসে কোনও সাড়া দেন না। গ্রিক দার্শনিকগণের ঈশ্বর যেসব অতিন্দ্রীয়বাদী হঠাৎ করে তাঁর সঙ্গে আনন্দময় মিলনে সক্ষম হতো তাদের ব্যাপারে অসচেতন ছিলেন, অথচ বাইবেলের ঈশ্বর মানুষের কাছে আসেন। ঈশ্বরও এক ‘পরমানন্দ লাভ করেন যা তাঁকে নিজেকে ছাড়িয়ে সৃষ্ট সত্তার নাজুক জগতে নিয়ে আসে:

এবং আমাদেরকে সাহস করে অবশ্যই নিশ্চিত করে বলতে হবে (কেননা এটাই সত্যি) যে, বিশ্বজগতের স্রষ্টা স্বয়ং বিশ্বের প্রতি তাঁর চমৎকার ও সুন্দর আকাঙ্ক্ষা হতে…তার সদয় কার্যক্রমের মাধ্যমে আপনার মাঝে হতে বেরিয়ে আসেন সত্তা আছে এমন সব জিনিসের দিকে…এবং এভাবে সকল কিছুর ঊর্ধ্বে তাঁর অলৌকিক আসন থেকে নেমে আসেন এক আনন্দময় ক্ষমতার মাধ্যমে সকল সত্তার অন্তরে বাস করার জন্যে, এক আনন্দময় ক্ষমতায় যা সকল সত্তার উর্ধ্বে এবং যার মাধ্যমে তিনি আবার নিজের মাঝেই রয়ে যান।

.

এক স্বয়ংক্রিয়া প্রক্রিয়ার বদলে উৎসারণ ভালোবাসা প্রকাশের এক আবেগময় ও স্বতঃস্ফূর্ততায় পরিণত হয়েছিল। ডেনিসের অস্বীকৃতি ও স্ববিরোধিতার কৌশলটি আমরা করি এমন কিছু নয়, এটা এমন কিছু যা আমাদের মাঝে ঘটে।

প্রটিনাসের বেলায় ‘পরমানন্দের ব্যাপারটি ছিল খুবই আকস্মিক ব্যাপার জীবনে মাত্র দু-তিনবার এ অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন তিনি। ডেনিস পরমানন্দকে প্রত্যেক ক্রিশ্চানের সার্বক্ষণিক অবস্থা হিসাবে দেখেছেন। এটাই ঐশীগ্রন্থ বা শাস্ত্রের গুপ্ত বা নিগুঢ় বাণী, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ভঙ্গিমায় যার প্রকাশ। এভাবে পুরোহিত যখন প্রার্থনা সভার শুরুতে বেদী ছেড়ে প্রত্যাবর্তনের আগে জমায়েতের ভেতর দিয়ে পানি ছিটিয়ে সাঙ্কচুয়্যারির দিকে এগোন, সেটা কেবল পরিশুদ্ধকরণের একটা আচার থাকে না-যদিও তা একটা আচারও বটে-স্বর্গীয় আনন্দের অনুকরণ করে এটা, যার মাধ্যমে ঈশ্বর তাঁর নির্জনতা ত্যাগ করে সৃষ্ট জীবনের সঙ্গে নিজেকে মিলিয়ে দেন। ডেনিসের ধর্মতত্ত্বকে বোঝার সবেচেয়ে সেরা উপায় সম্ভবত এই যে, ঈশ্বর সম্পর্কে আমরা যতটা নিশ্চয়তা দিতে পারি এবং আমাদের বলার সত্যের সবটুকুই যে প্রতীকী এটা উপলব্ধি করার মাঝে আধ্যাত্মিক নাচ হিসাবে একে বিবেচনা করা। ইহুদিবাদের মতো ডেনিসের ঈশ্বরের দুটো বৈশিষ্ট্য রয়েছে: একটা আমাদের দিকে ফেরানো এবং জগতে নিজেকে প্রকাশ করে; অপরটি ঈশ্বরের দূরবর্তী দিক, যা সম্পূর্ণ দুর্বোধ্য থেকে যায়। তিনি তাঁর চিরকালীন রহস্যের মাঝে নিজের মধ্যেই রয়ে যান, আবার একই সময় সৃষ্টিতে সম্পূর্ণ মিশে থাকেন। জগতের অতিরিক্ত আরেকটি সত্তা নন তিনি। গ্রিক ধর্মতত্ত্বে ডেনিসের পদ্ধতিটি আদর্শে পরিণত হয়। অবশ্য পশ্চিমের ধর্মবিদরা আলোচনা ও ব্যাখ্যা অব্যাহত রাখবেন। কেউ কেউ কল্পনা করেছে যে যখন তারা ‘ঈশ্বর’ শব্দটি উচ্চারণ করে তখন স্বর্গীয় সত্তাটি মনের ধারণার সঙ্গে মিলে যায়। কেউ কেউ আবার তাদের নিজস্ব ধ্যান-ধারণা ঈশ্বরের প্রয়োগ করবে-বলবে ঈশ্বর এটা চেয়েছেন, ওটা নিষেধ করেছেন এবং সেটা পরিকল্পনা করেছেন-এক অর্থে যা বিপজ্জনক রকম পৌত্তলিকতাবাদী । কিন্তু গ্রিক অর্থডক্সের ঈশ্বর রহস্যময়ই রয়ে যাবেন ও ট্রিনিটি প্রাচ্যের ক্রিশ্চানদের কাছে তাদের মতবাদ সমূহের বৈশিষ্ট্যেও কথা মনে করিয়ে যাবে । শেষ পর্যন্ত গ্রিকরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে, প্রকৃত ধর্মতত্ত্বকে অবশ্যই ডেনিসের দুটো যোগ্যতা পূরণ করতে হবে: একে একাধারে নীরব এবং স্ববিরোধী (Paradoxical) হতে হবে।

গ্রিক ও লাতিনরাও সৃষ্টের ঐশ্বরিকতা সম্পর্কিত তাৎপর্যপূর্ণ ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলেছিল। অবতারবাদের গ্রিক ধারণাটিকে সংজ্ঞায়িত করেছিলেন বাইন্তাইন ধর্মতত্ত্বের জনক হিসাবে পরিচিত ম্যাক্সিমাস দ্য কনফেসর (৫৮০-৬৬২)। এর সঙ্গে পশ্চিমা দৃষ্টিভঙ্গির চেয়ে বরং বৌদ্ধ আদর্শের অনেক বেশি মিল। ম্যাক্সিমাস বিশ্বাস করতেন যে কেবল ঈশ্বরের সঙ্গে মিলিত হলেই মানুষ পূর্ণতা পেতে পারে, ঠিক যেমন বৌদ্ধদের বিশ্বাস ছিল, আলোকপ্রাপ্তিই মানুষের আসল গন্তব্য। এভাবে ঈশ্বর ঐচ্ছিক, মানুষের অবস্থার সঙ্গে জুড়ে দেওয়া বাহ্যিক অচেনা সত্তা বা বিষয় নন। নারী-পুরুষের অলৌকিকের যোগ্যতা রয়েছে, তা অর্জিত হলেই সে পরিপূর্ণ মানুষ হয়ে উঠবে। আদমের পাপের মোচন ঘটাতে লোগোস মানবমূর্তি ধরেননি; প্রকৃতপক্ষে আদম পাপ না করলেও অবতারের ব্যাপারটা ঘটত। লোগোসের অনুরূপে নারী-পুরুষের সৃষ্টি করা হয়েছিল, একমাত্র এই মিলটি নিখুঁত হলেই তারা পূর্ণ সম্ভাবনা অর্জন করতে পারবে। তার পাহাড়ে জেসাসের মহিমান্বিত মানবরূপ আমাদের কাঙ্খিত মানবীয় অবস্থা দেখিয়েছে। বাণীকে দেহ দান করা হয়েছে যাতে করে গোটা মানবজাতি মানবরূপী ঈশ্বরের কৃপায় ঈশ্বরে পরিণত হতে পারে সম্পূর্ণ দেহ এবং আত্মায়, প্রকৃতি ও পূর্ণ ঈশ্বরে পরিণত হওয়ার মাধ্যমে, আত্মা এবং দেহে এবং কৃপায়।[৫৭] আলোকন ও বুদ্ধত্বের ক্ষেত্রে যেমন অতিপ্রাকৃত সত্তার হস্ত ক্ষেপ অন্তর্ভুক্ত হয়নি, বরং মানুষের জন্যে স্বাভাবিক ক্ষমতা বাড়িয়ে তোলার কথা বলা হয়েছে, এখানেও দেবতায় পরিণত খৃস্ট আমাদের দেখিয়েছেন। যে ঈশ্বরের কৃপায় আমরা কোন স্তরে উঠতে পারি। ক্রিশ্চানরা বরং সেভাবেই মানব-ঈশ্বর জেসাসকে শ্রদ্ধা জানাতে পারে যেভাবে বৌদ্ধরা আলোকপ্রাপ্ত গৌতমের মূর্তিকে শ্রদ্ধা দেখায়: তিনিই (বুদ্ধ) ছিলেন মহিমান্বিত এবং সম্পূর্ণ মানুষের প্রথম উদাহরণ।

অবতারবাদের গ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি খৃস্টধর্মকে যেখানে প্রাচ্যের ঐতিহ্যের অনেক কাছাকাছি নিয়ে এসেছিল, জেসাস সম্পর্কে পাশ্চাত্যের দৃষ্টিভঙ্গি যেখানে একেবারে ভিন্ন পথ গ্রহণ করে। ধ্রুপদী ধর্মতত্ত্বের উদাতা বিশপ অভ ক্যান্টারবারি, আনসেল (১০৩৩-১১০৯) তাঁর হোয়াই গড় বিকেইম ম্যান প্রবন্ধে এই মতবাদ প্রকাশ করেন। তিনি যুক্তি দেখিয়েছেন, পাপ এত বড় মাত্রার অবমাননা ছিল যে মানবজাতিকে নিয়ে গৃহীত পরিকল্পনা বাতিল না করার জন্যে পাপ মোচন ছিল অত্যাবশ্যক। আমাদের পক্ষে প্রায়শ্চিত্ত করার জন্যে বাণীকে দেহ দান করা হয়েছিল। ঈশ্বরের বিচারের দাবি ছিল এমন একজনকে দায় শোধ করতে হবে যিনি একাধারে ঈশ্বর ও মানুষ: অপরাধের মাত্রা বুঝিয়ে দিয়েছিল যে কেবল ঈশ্বরের পুত্রই আমাদের মুক্তি নিশ্চিত করতে পারবেন, কিন্তু অপরাধী যেহেতু মানুষ ছিল, তাই মুক্তিদাতাকেও মানবজাতির সদস্য হতে হবে। এটা এক গোছানো, আইনসম্মত প্রকল্প যেখানে ঈশ্বরকে চিন্তাশীল, যাচাইকারী ও বিশ্লেষণকারী হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে, যেন তিনি একজন মানুষ। এটা নিষ্ঠুর ঈশ্বরের পাশ্চাত্য ভাবমূর্তি আরও জোরাল করেছিল, যিনি একধরনের মানব-উৎসর্গের মতো করে নিবেদিত আপন পুত্রের ভয়ঙ্কর মৃত্যুতেই সন্তুষ্ট হতে পারেন।

পাশ্চাত্য জগতে প্রায়শঃই ট্রিনিটির মতবাদকে ভুল বোঝা হয়েছে। মানুষ তিনটি আলাদা স্বর্গীয় চরিত্র কল্পনা করতে চায়, কিংবা গোটা মতবাদটিকে অগ্রাহ্য করে ঈশ্বরকে পিতার সঙ্গে মিলিয়ে ফেলে ও জেসাসকে বানায় স্বর্গীয় বন্ধু-ঠিক সমপর্যায়ের নয়। মুসলিম এবং ইহুদিরাও এ মতবাদকে বিভ্রান্তিকর, এমনকি ব্লাসফেমাস মনে করেছে। কিন্তু তারপরেও আমরা দেখব ইহুদিবাদ ও ইসলামের অতিন্দ্রীয়বাদীরা আশ্চর্যজনকভাবে একই ধরনের ঐশ্বরিক ধারণা সৃষ্টি করেছে। উদাহরণ স্বরূপ, কেনোসিসের ধারণা অর্থাৎ ঈশ্বরের নিজেকে উজার করে দেওয়ার আনন্দের ধারণাটি কাব্বালাহ এবং সুফীবাদ উভয় ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। ট্রিনিটিতে ফাদার তিনি যা তার সবটুকুই উজার করে পুত্রকে দিয়ে দেন-এমনকি ভিন্ন জগতে নিজেকে প্রকাশ করার সম্ভাবনাটুকুও। একবার বাণী উচ্চারিত হয়ে যাবার পর, বলা হয়েছে, পিতা নীরব রয়ে যান। তার সম্পর্কে আমাদের আর বলার কিছু থাকে না, যেহেতু আমরা ঈশ্বর হিসাবে কেবল লোগোস বা পুত্রকেই চিনি। সুতরাং পিতার কোনও পরিচয় নেই, স্বাভাবিক অর্থে ‘আমি’বিহীন, এবং ব্যক্তি সম্পর্কে আমাদের ধারণাকে ঘোলাটে করে দেয়। ‘পরম সত্তা’র একেবারে সূচনায় ‘কিছু না’ যে কেবল ডেনিস লক্ষ করেছেন তা নয়, প্লটিনাস, ফিলো এবং এমনকি বুদ্ধও দেখেছেন। পিতাকে যেহেতু খৃস্টধর্মের ক্ষেত্রে অনুসন্ধানের শেষ হিসাবে দেখা হয়, সুতরাং কোনও ক্রিশ্চানের যাত্রা স্থানহীন, ঠিকানাহীন এবং সত্তাহীনের দিকে অগ্রসর হওয়ায় পরিণত হয়। ব্যক্তিক ঈশ্বর বা ব্যক্তিতে পরিণত পরম বা চরম সত্তার ধারণা মানুষের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে আছে: হিন্দু ও বুদ্ধদের ভক্তির ব্যক্তি পর্যায়ের আনুগত্যের অনুমোদন দিতে হয়েছিল। কিন্তু ট্রিনিটির উদাহরণ বা প্রতীক বোঝাতে চায় যে, ব্যক্তিত্বকে অবশ্যই অতিক্রম করে যেতে হবে এবং ঈশ্বরকে মানুষের বর্ধিত রূপ ভাবা ও তাকে আমাদের মতো আচরণ বা চলাফেরা করছেন বলে কল্পনা করাটা যথেষ্ট নয়।

অবতারবাদের মতবাদকে বহুঈশ্বরবাদিতা রোধ করার আরেকটি পদক্ষেপ হিসাবেও দেখা যেতে পারে। একবার ‘ঈশ্বর’কে ‘মহাশূন্যে সম্পূর্ণ ভিন্ন সত্তা হিসাবে দেখা হলে অতি সহজেই তাঁর সামান্য মূর্তি বা প্রতাঁকে পরিণত হওয়ার সম্বাবনা থাকে, যা মানুষকে আপন বৈশিষ্ট্যর বাইরে এনে আপন সংস্কার ও আকাক্ষার উপাসনায় সক্ষম করে তোলে। অপরাপর ধর্মীয় ঐতিহ্যগুলো ব্রাক্ষ্মণ-আত্মার উদাহরণের মতো পরম সত্তা মানবীয় রূপের সঙ্গে কোনওভাবে মিশে আছেন, এমন ধারণায় জোর দিয়ে এটা ঠেকানোর প্রয়াস পেয়েছে । আরিয়াস-এবং পরে নেস্টোরিয়াস এবং ইউতিচেস-প্রত্যেকে জেসাসকে মানুষ বা ঐশী সত্তার যেকোনও একটি বানাতে চেয়েছিলেন এবং তাদের বাধা দেওয়ার পেছনে অন্যতম কারণ ছিল মানুষ ও ঐশীরূপকে আলাদা করে রাখার প্রবণতা। একথা ঠিক যে, তাদের সমাধান অনেক বেশি যুক্তিসঙ্গত ছিল, কিন্তু ডগমাকে–কেরিগমার বিপরীত-কবিতা বা সঙ্গীতের মতো পুরোপুরি প্রকাশযোগ্যতার মাঝে আটকে রাখা উচিত হবে না। অবতার মতবাদ-আথানাসিয়াস এবং ম্যাক্সিমাস কোনওভাবে যা প্রকাশ করেছেন ঈশ্বর’ এবং মানুষ যে অবিচ্ছেদ্য হতে বাধ্য সেই বিশ্বজনীয় দর্শন প্রকাশেরই এক প্রয়াস। পশ্চিমে, যেখানে অবতারবাদের ধারণার বিকাশ এভাবে হয়নি, সেখানে ঈশ্বরের একটি বাহ্যিক সত্তা ও আমাদের পরিচিত জগতের এক বিকল্প সত্তা রয়ে যাবার প্রবণতা রয়ে গেছে। পরিণামে এই ‘ঈশ্বর’কে-প্রক্ষিপ্ত করা খুব সহজ ছিল, যা সাম্প্রতিককালে অবনমিত হয়ে গেছে।

তা সত্ত্বেও জেসাসকে একমাত্র অবতার বানানোর মাধ্যমে, আমরা দেখেছি, ক্রিশ্চানরা ধর্মীয় সত্যের এক আলাদা মতবাদ গ্রহণ করেছে: জেসাস ছিলেন মানবজাতির প্রতি ঈশ্বরের প্রথম ও শেষ বাণী, যার ফলে ভবিষ্যতের প্রত্যাদেশ অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে। ফলে, ইহুদিদের মতো তারাও সপ্তম শতাব্দীতে আরবে এক পয়গম্বর আবির্ভূত হয়ে ঈশ্বরের কাছ থেকে সরাসরি প্রত্যাদেশ লাভ ও আপন জাতির জন্যে এক নতুন ঐশীগ্রন্থ আনার দাবি করলে ক্ষুব্ধ হয়েছিল। তবু শেষ পর্যন্ত একেশ্বরবাদের নতুন রূপ ‘ইসলাম’ নামে পরিচিত হয়ে অবিশ্বাস্য দ্রুততার সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকায় ছড়িয়ে পড়ে। এই ধর্মটির বহু উৎসাহী নবদীক্ষিত এখানকার (যেখানে হেলেনিজম ছিল বিদেশী মতবাদ) গ্রিক ত্রিত্ববাদ হতে স্বস্তির সঙ্গে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল, সেখানে এমন এক বাগধারায় ঈশ্বরের রহস্যকে প্রকাশ করে যা তাদের অচেনা ছিল, স্বর্গীয় সত্তার অধিকতর সেমেটিক ধারণাকেই বেছে নেয় তারা ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *