০৭. অতিন্দ্রীয়বাদীদের ঈশ্বর

৭. অতিন্দ্রীয়বাদীদের ঈশ্বর

ইহুদিবাদ, খৃস্টধর্ম এবং-কিছুটা সীমিত পরিসরে-ইসলাম, সকল ধর্মই ব্যক্তিক ঈশ্বরের ধারণা গড়ে তুলেছে; সুতরাং আমরা একথা ভাবতে পারি যে, এই আদর্শই ধর্মকে সবচেয়ে চমৎকারভাবে তুলে ধরে। ব্যক্তিক ঈশ্বর একেশ্বরবাদীদের ব্যক্তির পবিত্র ও অবিচ্ছেদ্য অধিকারসমূহকে মূল্য দিতে এবং মানুষের ব্যক্তিত্বের উপলব্ধি অর্জনে সাহায্য করেছে। এভাবে জুদো-ক্রিশ্চান ঐতিহ্য পশ্চিমকে উদারবাদী মানবতাবাদের আদর্শ অর্জনে সাহায্য করেছে, যেটাকে তারা এত গুরুত্ব দেয়। এসব মূল্যবোধ আদিতে একজন ব্যক্তিক ঈশ্বরের মাঝে আরোপ করা হয়েছিল, যিনি মানুষ যা যা করে তার সবই করে থাকেন তিনি আমাদের মতো ভালোবাসেন, বিচার করেন, শাস্তি দেন, দেখেন, শোনেন, সৃজন করেন ও ধ্বংস করেন। ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌র শুরু হয়েছিল মানুষের মতো প্রবল পছন্দ-অপছন্দ সংবলিত ব্যক্তিরূপ উপাস্য হিসাবে। পরে দুজ্ঞেয় সত্তার প্রতাঁকে পরিণত হন তিনি, যার চিন্তা আমাদের চিন্তা ছিল না এবং যার পথ আমাদের পথ থেকে অনেক উর্ধ্বে, যেমন স্বর্গ পৃথিবীর চেয়ে দূরে। ব্যক্তি ঈশ্বরের ধারণা এক গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় দর্শন প্রকাশ করে কোনও চরম মূল্যবোধ মানুষের চেয়ে নিম্ন পর্যায়ের হতে পারে না। এভাবে ব্যক্তিবাদ ধর্মীয় ও নৈতিক উন্নতির জন্যে গুরুত্বপূর্ণ এবং অনেকের ক্ষেত্রেই অপরিহার্য পর্যায় হিসাবে বিবেচিত হয়েছে। ইসরায়েলের পয়গম্বরগণ তাদের নিজস্ব আবেগ ও কামনা বাসনা ঈশ্বরে আরোপ করেছিলেন; বৌদ্ধ এবং হিন্দুদের সর্বোত্তম সত্তায় ভক্তি দেখাতে অবতারদের প্রতি ব্যক্তিগত শ্রদ্ধা প্রদর্শনের প্রয়োজন হয়েছে। খৃস্টধর্ম একজন ব্যক্তিকে এমনভাবে ধর্মীয় জীবনের কেন্দ্রে স্থাপন করেছে ধর্মের ইতিহাসে যা নজিরবিহীন: এটা ইহুদিবাদের সহজাত ব্যক্তিবাদকে চরম পর্যায়ে নিয়ে গেছে। এমন হতে পারে যে, এ ধরনের মিশ্রণ ও একাত্ম হওয়ার একটা মাত্রা ছাড়া হয়তো ধর্ম প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না।

তারপরেও ব্যক্তিক ঈশ্বর বিরাট দায়ে পরিণত হতে পারেন। আমাদের নিজস্ব কল্পনায় খোদাই করা তুচ্ছ এক মূর্তি আমাদের সীমাদ্ধ চাহিদা, আতঙ্ক ও আকাঙ্ক্ষারও অভিক্ষেপে পরিণত হতে পারেন তিনি। আমরা ধরে নিতে পারি যে আমরা যা ভালোবাস তিনি তাই ভালোবাসেন এবং আমাদের ঘৃণার বস্তু তারও ঘৃণার বস্তু, সংস্কারের ঊর্ধ্বে ওঠায় বাধ্য করার বদলে সংস্কারের পক্ষে দাঁড় করাতে পারেন। যখন তিনি কোনও দুর্যোগ ঠেকাতে ব্যর্থ হন কিংবা মনে হয় যে বিপদ ঘটানোর ইচ্ছা করছেন, তখন তাকে খুবই শীতল ও নিষ্ঠুর মনে হতে পারে। বিপদ-আপদ ঈশ্বরের ইচ্ছায় ঘটে, এরকম সহজ বিশ্বাস আমাদেরকে মৌলিকভাবে অগ্রহণযোগ্য বিষয় মেনে নিতে বাধ্য করতে পারে। ব্যক্তি রূপে ঈশ্বরের লিঙ্গ আছে, এ সত্যটিও তাঁকে সীমাবদ্ধ করে দেয়: এর মানে নারীদের বাদ দিয়ে মানবজাতির অর্ধেকাংশের যৌন পরিচয় পবিত্র রূপ দেওয়া হয়েছে এবং তাতে মানুষের যৌন আচরণে এক ধরনের বিকৃত ও অসম্পূর্ণ ভারসাম্যহীন অবস্থা দেখা দিতে পারে। সুতরাং একজন ব্যক্তিক ঈশ্বর হয়ে উঠতে পারেন বিপজ্জনক। সীমাবদ্ধতা হতে উদ্ধার করার বদলে তিনি আমাদের সেই সীমাবদ্ধতার মাঝেই আত্মতুষ্টির সঙ্গে রয়ে যেতে উৎসাহ যোগাতে পারেন; আমাদের তিনি’ নিষ্ঠুর করে তুলতে পারেন, করতে পারেন শীতল, আত্ম-সন্তুষ্ট ও পক্ষপাতদুষ্ট। যে সহমর্মিতার অনুভূতি সকল উন্নত অগ্রসর ধর্মের বৈশিষ্ট্য হওয়ার কথা, আমাদের মাঝে সেটা জাগিয়ে তোলার বদলে তিনি আমাদের বিচার করতে, নিন্দা জানাতে ও এক পাক্ষিক হতে অনুপ্রাণিত করতে পারেন। সুতরাং, এটা মনে হয় যে ব্যক্তিক ঈশ্বরের ধারণা আমাদের ধর্মীয় অগ্রগতির ক্ষেত্রে একটা পর্যায় হতে পারে মাত্র। বিশ্বের সকল প্রধান ধর্ম যেন এই বিপদকে শনাক্ত করতে পেরেছে এবং মহান সত্তার ব্যক্তিক ধারণার ঊর্ধ্বে উঠতে চেয়েছে।

পরিমার্জনার ইতিহাস হিসাবে ও পরবর্তীকালে ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌র গোত্রীয় ও ব্যক্তিক রূপ ত্যাগ করে YHWH হয়ে ওঠার কাহিনী হিসাবেও ইহুদিদের ধর্মগ্রন্থ পাঠ করা যেতে পারে। তর্ক সাপেক্ষে একেশ্বরবাদী ধর্ম বিশ্বাসের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ব্যক্তিক ধর্ম বিশ্বাস খৃস্টধর্ম ট্রিনিটির অভিব্যক্তিক মতবাদের সাহায্যে দেহধারী ঈশ্বরের বিশ্বাসকে প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াস পেয়েছে। মুসলিমরা অচিরেই কোরানের যেসব অনুচ্ছেদে ঈশ্বর দেখেন, ‘শোনেন এবং বিচার করেনে’র মতো মানবীয় কাজের কথা বুঝিয়েছে সেগুলোর ক্ষেত্র সমস্যা আক্রান্ত হয়ে পড়েছে। তিনটি একেশ্বরবাদী ধর্মই অতিন্দ্রীয়বাদী ধারার জন্ম দিয়েছে যা তাদের ঈশ্বরকে ব্যক্তি পর্যায়ের ঊর্ধ্বে তুলে নির্বাণ ও ব্রহ্ম-আত্মার অনুরূপ নৈর্ব্যক্তিক সত্তায় পরিণত করতে সাহায্য করেছে। খুব নগণ্য সংখ্যক মানুষই প্রকৃত অতিন্দ্রীয়াবাদের চর্চার যোগ্যতা রাখে, কিন্তু তিনটি ধর্ম বিশ্বাসেই (পাশ্চাত্য খৃস্টধর্ম বাদে) অতিন্দ্রীয়বাদের উপলব্ধির ঈশ্বরই অতিসাম্প্রতিক কাল পর্যন্ত বিশ্বাসীদের মাঝে শেষমেষ আদর্শ বিবেচিত হয়েছে।

ঐতিহাসিক একেশ্বরবাদ আদিতে অতিন্দ্রীয়বাদী ছিল না। আমরা বুদ্ধের মতো ধ্যানী ও পয়গম্বরদের অভিজ্ঞতার পার্থক্য আলোচনা করেছি। ইহুদিবাদ, খৃস্টধর্ম ও ইসলাম আবশ্যিকভাবেই সক্রিয় ধর্ম এবং আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করে যে, স্বর্গের মতোই পৃথিবীতে ঈশ্বরের অভিপ্রায় বাস্তবায়িত হয়েছে। পয়গম্বর আনীত এইসব ধর্মের কেন্দ্রীয় মটিফ হচ্ছে ঈশ্বর ও মানুষের মাঝে ব্যক্তিগত সাক্ষাৎ বা সংঘাত। এই ঈশ্বর কর্মের আদেশ রূপে অনুর্ভুত হন; তিনি আমাদের নিজের দিকে আহ্বান করেন; আমাদেরকে তার ভালোবাসা ও মনোযোগ গ্রহণ বা প্রত্যাখ্যান করার অবকাশ দেন। নীরব ধ্যানের বদলে এই ঈশ্বর সংলাপের মাধ্যমে মানুষের সঙ্গে সম্পর্কিত হন। তিনি এক বাণী উচ্চারণ করেন যা ভক্তির মূলবিন্দুতে পরিণত হয়, যাকে পার্থিব জীবনের ত্রুটিময় ও করুণ অবস্থার সঙ্গে অত্যন্ত কষ্টকর প্রয়াসে বাস্তবায়িত করতে হয়। তিনটি ধর্মের মাঝে সবচেয়ে ব্যক্তিরূপ খৃস্টধর্মে ভালোবাসা দিয়ে ঈশ্বরের সঙ্গে সম্পর্ককে বৈশিষ্ট্যায়িত করা হয়েছে। কিন্তু ভালোবাসার শর্ত হলো কিছু মাত্রায় অহমবোধকে বিনাশ করতে হবে। সংলাপ বা ভালোবাসা, উভয়ক্ষেত্রেই অহমবোধ একটা চিরন্তন সম্ভাবনা। খোদ ভাষাই একটা সীমিতকারী বিষয় হতে পারে, যেহেতু এটা আমাদের পার্থিব অভিজ্ঞতার ধ্যান-ধারণায় আমাদের আবদ্ধ রাখে।

পয়গম্বরগণ মিথলজির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন: মিথের পবিত্র আদিমকালে নয়, বরং তাদের ঈশ্বর ইতিহাস এবং চলতি ঘটনাপ্রবাহে সক্রিয় ছিলেন। অবশ্য একেশ্বরবাদীরা যখন অতিন্দ্রীয়বাদের শরণাপন্ন হয় তখন মিথলজি ধর্মীয়বোধের প্রধান বাহনের স্থান নতুন করে দখল করে নেয়। মিথ’ (myth), অতিন্দ্রীয়বাদ (mysticism) ও ‘রহস্য’ (mystery) শব্দ তিনটির মাঝে ভাষাগত সম্পর্ক রয়েছে। সবগুলো শব্দই এসেছে গ্রিক ক্রিয়াপদ মাস্তে ইয়ন (musteion) হতে: যার অর্থ মুখ বা চোখ বন্ধ করা। সুতরাং তিনটি শব্দই অন্ধকার ও নৈঃশব্দ্যের অনুভূতির মাঝে প্রোথিত। আজকের পশ্চিমে এগুলো জনপ্রিয় শব্দ নয়। উদাহরণস্বরূপ, মিথ শব্দটি প্রায়শঃ মিথ্যার সমার্থক হিসাবে ব্যবহার করা হয়: চলতি কথায় মিথ হচ্ছে এমন কিছু যা সত্য নয়। কোনও রাজনীতিক বা চিত্রতারকা তাদের নামে রটনা বা সংবাদকে মিথ’ বলে নাকচ করে দেবেন এবং পণ্ডিতগণ অতীত সম্পর্ক ভ্রান্তিমূলক দৃষ্টিভঙ্গিকে পৌরাণিক (mythical) বলে উল্লেখ করবেন। আলোকন পর্বের পর থেকে, ‘রহস্য’কে উদঘাটনযোগ্য বিষয় হিসাবে দেখা হয়েছে। প্রায়শঃ একে স্থবির চিন্তার সঙ্গে সম্পর্কিত করা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা কাহিনীকে বলা হয় ‘রহস্য’ (mystery) এবং এই ঘরানার মূল কথা হচ্ছে সমস্যার সন্তোষজনক সমাধান বের করা। আমরা দেখব, এমনকি আলোকন পর্বের সময় ধার্মিক ব্যক্তিরা রহস্য’কে বাজে শব্দ হিসাবে দেখতে শুরু করেছিল। একইভাবে অতিন্দ্রীয়বাদকে বাতিক, জোচচুরি বা অসংঙ্গত সুখানুভূতির সঙ্গে সম্পর্কিত করা হয়। পশ্চিমা জগৎ যেহেতু কখনওই, এমনকি বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলে এর জোয়ারের সময়ও না, অতিন্দ্রীয়বাদে ব্যাপারে আগ্রহী ছিল না, সেজন্যে এ ধরনের আধ্যাত্মিকতার ক্ষেত্রে অপরিহার্য বুদ্ধিমত্তা ও অনুশীলনের ব্যাপারে পরিষ্কার ধারণা এখানে নেই।

তারপরেও লক্ষণ দেখে মনে হচ্ছে, হয়তো স্রোত ঘুরছে। ১৯৬০ দশকের দিক থেকে পাশ্চাত্যের জনগণ বিশেষ ধরনের যোগ ও বুদ্ধ ধর্মের মতো ধর্মের বিশেষ সুবিধা বা উপকার সম্পর্কে সজাগ হয়ে উঠতে শুরু করেছে, যেগুলোর অপর্যাপ্ত ঈশ্বরবাদ দুষিত না হওয়ার সুবিধা রয়েছে। ফলে ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বেশ সাড়া ফেলতে সক্ষম হয়েছে তা। মিথলজি নিয়ে প্রয়াত আমেরিকান পণ্ডিত জোসেফ ক্যাম্পবেলের রচনাবলী সম্প্রতি কদর পেয়েছে। পশ্চিমে সাম্প্রতিকালের সাইকোঅ্যানালিসেসের প্রতি প্রবল উৎসাহকে অতিন্দ্রীয়বাদের প্রতি এক ধরনের ঝোঁক হিসাবে দেখা যেতে পারে, কারণ এ দুটো বিষয়ের মাঝে আমরা লক্ষণীয় সাদৃশ্য লক্ষ করব। মিথলজিকে প্রায়ই মনের অন্তস্থ অবস্থা ব্যাখ্যা করার উপায় হিসাবে ব্যবহার করা হয়। ফ্রয়েড এবং জাং উভয়ই স্বতঃপ্রণোদিতভাবে তাদের নতুন বিজ্ঞান ব্যাখ্যা করার জন্যে গ্রিক কাহিনী ঈদিপাস-এর মতো প্রাচীন মিথের সহায়তা নিয়েছেন। পশ্চিমের জনগণ হয়তো জগৎ সম্পর্কে সম্পূর্ণ নিখাদ বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির বদলে একটা বিকল্পের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছে।

অতিন্দ্রীয়বাদী ধর্ম অনেক প্রত্যক্ষ ও অধিকতর বুদ্ধিবৃত্তিক ধর্ম বিশ্বাসের চেয়ে দুঃসময়ে বেশি কাজে আসে। অতিন্দ্রীয়বাদ অনুশীলন শিক্ষার্থীকে আদি সূচনা দ্য ওয়ানের দিকে প্রত্যাবর্তনে ও স্বর্গীয় সত্তার অব্যাহত বোধ জাগাতে সাহায্য করে। কিন্তু তারপরেও দ্বিতীয় ও তৃতীয় শতাব্দীতে গড়ে ওঠা প্রাথমিক ইহুদি অতিন্দ্রীয়বাদ ইহুদিদের পক্ষেও বেশ কঠিন ছিল, ঈশ্বর ও মানুষের মাঝে ব্যবধানের দিকেই যেন জোর দিয়েছিল তা। ইহুদিরা যে পৃথিবীতে নিপীড়নের শিকার হচ্ছে সেখান থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে আরও শক্তিশালী স্বর্গীয় জগতে যেতে চেয়েছিল। ঈশ্বরকে এক পরাক্রমশালী রাজা হিসেবে দেখেছে তারা। সপ্তম আকাশে বিপদসঙ্কুল যাত্রার ভেতর দিয়েই কেবল যার দিকে অগ্রসর হওয়া যেতে পারে। র‍্যাবাইদের সহজ প্রত্যক্ষ কৌশল ব্যবহারের বদলে নিজেদের প্রকাশ করার জন্যে অতিন্দ্রীয়বাদীরা সুললিত অলঙ্কারিক ভাষা ব্যবহার করেছে। র‍্যাবাইরা এই আধ্যাত্মিকতাকে ঘৃণা করেছেন ও অতিন্দ্রীয়বাদীরা র‍্যাবাইদের বৈরী না করে তোলার ব্যাপারে উদগ্রীব ছিল। তবুও এই থ্রোন মিস্টিসিজম’, যেভাবে আখ্যা দেওয়া হয়েছে, নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ কোনও চাহিদা মিটিয়েছিল, কারণ দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ শতাব্দীতে শেষ পর্যন্ত নতুন ইহুদি অতিন্দ্রীয়বাদের কাব্বালাহর অন্তর্ভুক্ত হওয়ার আগে মহান । র‍্যাবাইনিয় একাডেমিগুলোর পাশাপাশি এর বিকাশ অব্যাহত ছিল। পঞ্চম ও ষষ্ঠ শতাব্দীতে বাবিলনে সম্পাদিত থ্রোন মিস্টিসিজমের ক্লাসিক বিবরণ বোঝায়, নিজেদের অভিজ্ঞতার ব্যাপারে সংযত অতিন্দ্রীয়বাদীরা র‍্যাবাইদের বিবরণের সঙ্গে জোরাল নৈকট্য অনুভব করত, যেহেতু তারাও র‍্যাবাই আকিভা, র‍্যাবাই ইশমায়েল ও র‍্যাবাই ইয়োহান্নানের মতো মহান তান্নাইমদের আধ্যাত্মিকতার গুরু বানিয়েছে। আপন জাতির পক্ষে ঈশ্বরমুখী এক নতুন পথ নির্মাণে ইহুদি চেতনার নতুন চরম পন্থা বের করেছিলেন তাঁরা।

আমরা যেমন দেখেছি, র‍্যাবাইদের বেশ উল্লেখযোগ্য ধর্মীয় অভিজ্ঞতা। ছিল। র‍্যাবাই ইয়োহান্নান ও তার অনুসারীদের ওপর অগ্নিরূপে স্বর্গ থেকে। পবিত্র আত্মা অবতীর্ণ হওয়ার মুহূর্তে স্পষ্টতই তারা ইযেকিয়েলের ঈশ্বরের রথের অদ্ভুত দিব্যদর্শনের অর্থ নিয়ে আলোচনায় মগ্ন ছিলেন। রথ ও সিংহাসনে আসীন যে অবয়বকে ইযেকিয়ে দেখেছিলেন সেটাই যেন প্রাথমিককালের নিগূঢ় ভাবনা বা অনুমানের মূল বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। রথ সম্পর্কিত গবেষণাকে (Ma’aseh Markavah) প্রায়ই সৃষ্টির কাহিনীর (Ma’aseh Bereskit) সঙ্গে সম্পর্কিত করা হয়েছে। সর্বোচ্চ স্বর্গে অবস্থিত ঈশ্বরের সিংহাসনে পৌঁছার অতিন্দ্রীয়বাদী অভিজ্ঞতার প্রাচীন যে বিবরণ আমরা পাই সেখানে এই আধ্যাত্মিক যাত্রার অপরিসীম বিপদের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে:

র‍্যাবাইগণ আমাদের শিক্ষা দিয়েছেন: চারজন এক উদ্যানে প্রবেশ করলেন এবং এঁরা হলেন: বেন আযযাই, বেন যোমা, আহের এবং র‍্যাবাই আকিতা । র‍্যাবাই আকি তাদের বললেন: “আপনারা খাঁটি মর্মর পাথরের কাছে পৌঁছে “পানি পানি!” বলে চিৎকার করবেন না, কারণ বলা হয়: যে। ব্যক্তি অসত্য উচ্চারণ করে সে আমার দৃষ্টির সামনে প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে না।’ ‘ৰেন আযযাই তাকালেন এবং প্রাণ হারালেন। ঐশীগ্রন্থ তাঁর সম্পর্কে বলছে: ‘প্রভুর দর্শন লাভের পর মৃত্যু সাধুদের জন্যে অপরিসীম মূল্যবান। বেন যোমা তাকালেন এবং আঘাত পেলেন। ঐশীগ্রন্থ তাঁর সম্পর্কে বলছে: ‘তুমি কী মধু পেয়েছ? তোমার যতটা প্রয়োজন খেয়ে নাও, কিন্তু বেশি খেয়ে বমি করো না।’ আহের ধারা বন্ধ করে দিলেন [অর্থাৎ ধর্মদ্রোহী হয়ে গেলেন। বাবাই আকি শান্তিতে বিদায় নিলেন।

একমাত্র র‍্যাবাই আকিভাই অতিন্দ্রীয়বাদী পথে কোনও রকম ক্ষতির শিকার না হয়ে রক্ষা পেয়েছেন। মনের গভীরতম প্রদেশে অভিযাত্রায় অনেক বড় ধরণের ব্যক্তিগত ঝুঁকি জড়িত, কারণ ওখানে আমরা যার দেখা পাব সেটা সহ্যের অতীত হয়ে দাঁড়াতে পারে। এ কারণেই সকল ধর্ম অভিজ্ঞতাকে পর্যালোচনা করতে পারবেন, বিপদসঙ্কুল এলাকাসমূহ অতিক্রমে শিক্ষানবীশকে সাহায্য করবেন এবং সে নিজের সাধ্য পেরিয়ে গিয়ে বেন আযযাইয়ের মতো মৃত্যুবরণ বা বেন যোমার মতো পাগল হয়ে যাবেন না, এমন একজন বিশেষজ্ঞের অধীনে অতিন্দ্রীয় যাত্রা শুরু করার ওপর গুরুত্ব দিয়েছে। অতিন্দ্রীয়বাদীদের সকলেই বুদ্ধিমত্তা ও মানসিক স্থৈর্যের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছে। জেন (Zen) গুরুরা বলেন, কোনও মস্তিষ্ক বিকৃত লোকের পক্ষে ধ্যানের মাধ্যমে সুস্থতার সন্ধান করা অর্থহীন, কারণ এতে সে আরও অসুস্থ হয়ে পড়বে। অতিন্দ্রীয়বাদী হিসাবে সম্মানিত কয়েকজন ইউরোপিয় ক্যাথলিক সেইন্টের অদ্ভুত ও অস্বাভাবিক আচরণকে অবশ্যই ভ্রান্তি হিসাবে দেখতে হবে। তালমুদিয় সাধুদের এই প্রতীকী কাহিনী দেখায়, ইহুদিরা গোড়া থেকেই বিপদ সম্পর্কে সচেতন ছিল: পরবর্তীকালে সম্পূর্ণ সাবালক হয়ে ওঠার আগে তরুণদের আর কাব্বালার চর্চায় যোগ দিতে দেয়নি তারা। একজন অতিন্দ্রীয়বাদীকে অবশ্যই বিবাহিত হতে হতো, যৌনজীবনে তার সুস্থতা নিশ্চিত করার জন্যে।

পৌরাণিক সাতটি স্বর্গের রাজ্য দিয়ে অতিন্দ্রীয়বাদীকে ঈশ্বরের আসনের দিকে যাত্রা করতে হতো। কিন্তু সম্পূর্ণই কাল্পনিক যাত্রা ছিল সেটা। একে কখনও আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করা হয়নি, বরং মনের রহস্যময় অঞ্চলে প্রতীকী উর্ধ্বারোহণ হিসাবে দেখা হয়েছে। র‍্যাবাই আকিভার ‘খাঁটি মর্মর পাথর সম্পর্কিত সাবধানবাণী সম্ভবত অতিন্দ্রীয়বাদীর কাল্পনিক যাত্রার বিভিন্ন জটিল পর্যায়ে উচ্চারণ করার সাংকেতিক শব্দের প্রতিই ইঙ্গিত করে। এক বিশদ অনুশীলনের অংশ হিসাবে এসব ইমেজ কল্পনা করা হতো। আজকাল আমরা জানি যে অবচেতন মন অসংখ্য ইমেজারিতে পূর্ণ যা স্বপ্ন, দৃষ্টি বিভ্রম ও অস্বাভাবিক মনস্তাত্ত্বিক বা মস্তিষ্ক বিকৃতি, যেমন মৃগী রোগ বা সেযোফ্রেনিয়ার সময় প্রকাশ পায়। ইহুদি অতিন্দ্রীয়বাদীরা সত্যি সত্যি আকাশের ভেতর দিয়ে ওড়া বা ঈশ্বরের প্রাসাদে প্রবেশের কথা কল্পনা করেনি, বরং এক ধরনের নিয়ন্ত্রিত ও সুশৃঙ্খল উপায়ে তাদের মনে জেগে ওঠা ধর্মীয় ইমেজকে বিন্যস্ত করছিল। এর জন্যে চরম দক্ষতা ও নির্দিষ্ট মাত্রার মেজাজ ও প্রশিক্ষণের প্রয়োজন ছিল। জেন (Zen) বা যোগ অনুশীলনের মতো এখানেও একই রকম মনোসংযোগের প্রয়োজন, শিক্ষাব্রতাঁকে যা মনের গোলকধাঁধার মতো পথে সঠিকভাবে অগ্রগর হতেও সাহায্য করে। বাবিলনিয় সাধু হাই গাওন (৯৩৯ ১০৩৮) তুলনামূলক অতিন্দ্রীয়বাদী চর্চার সাহায্যে চার জন সাধুর কাহিনীর ব্যাখ্যা করেছেন: উদ্যান ঈশ্বরের প্রাসাদের স্বর্গীয় কক্ষসমূহে’ (bekhalot) আত্মার অতিন্দ্রীয়বাদী আরোহণের কথা বোঝায়। ঈশ্বর যাত্রায় আগ্রহী যে কাউকে অবশ্যই উপযুক্ত এবং বিশেষ গুনে গুনান্বিত হতে হবে, যদি সে ‘স্বর্গীয় রথের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে চায় এবং স্বর্গের ঊর্ধ্বের যেবেদূতদের দরবার দেখতে চায়। এটা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঘটবে না। তাকে এমন নির্দিষ্ট কিছু অনুশীলন করতে হবে যা সারা বিশ্বের যোগি ও ধ্যানীদের অনুশীলনের অনুরূপ:

তাকে অবশ্যই নির্দিষ্ট কিছু দিন উপবাস পালন করতে হবে, অবশ্যই দুহাঁটুর মাঝখানে মাথা রেখে মাটির দিকে মুখ করে আপনমনে নিচু কণ্ঠে ঈশ্বরের প্রশংসাসূচক বিভিন্ন শব্দ উচ্চারণ করতে হবে। এর ফল হিসাবে সে আপন হৃদয়ের অন্তস্তলে দৃষ্টি দিতে পারবে, তার মনে হবে যেন নিজ চোখে সে সাতটি দরবার দেখতে পাচ্ছে, দরবার হতে দরবারে ঘুরে বেড়াচ্ছে ও সেখানে যা কিছু আছে দেখছে।

যদিও এই ‘থ্রোন মিস্টিসিজম’-এর সবচেয়ে প্রাচীন টেক্সটের সময়কাল দ্বিতীয় বা তৃতীয় শতাব্দী বলে বিরোচিত, কিন্তু এই ধরনের ধ্যান-কৌশল সম্ভবত আরও প্রাচীন। এভাবে সেইন্ট পল ‘মেসায়াহর অধীন’ এক বন্ধুর প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছেন, যিনি মোটামুটি চৌদ্দ বছর আগে তৃতীয় স্বর্গ পর্যন্ত পৌঁছতে পেরেছিলেন। এই দিব্য দর্শনকে ব্যাখ্যা করার উপায় বুঝতে পারেননি সেইন্ট পল, কিন্তু বিশ্বাস করেছেন যে, ঐ ব্যক্তি স্বর্গে আটকা পড়েছিলেন আর এমন কিছু শুনেছেন যা মানবীয় ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না এবং করা সম্ভব নয়।

দিব্যদর্শনগুলোই শেষ কথা নয় বরং এক অনির্বচনীয় ধর্মীয় অনুভূতির উপায় যা স্বাভাবিক ধারণাকে অতিক্রম করে যায়। এখনও অতিন্দ্রীয়বাদী নির্দিষ্ট ধর্মীয় ঐতিহ্যের মাধ্যমে একজন ইহুদি দিব্যদ্রষ্টা সপ্ত-স্বর্গের দৃশ্য দেখবে, কারণ তার ধর্মীয় কল্পনার রাজ্য এসব বিশেষ প্রতাঁকে পরিপূর্ণ। বৌদ্ধরা বুদ্ধ এবং বোধিসত্তাদের নানা রকম প্রতিরূপ দেখে; ক্রিশ্চানরা দেখে ভার্জিন মেরিকে। এসব মানসিক অপচ্ছায়াগুলোকে বস্তুগত বা দুয়ে প্রতাঁকের অতিরিক্ত কিছু হিসাবে দেখা দিব্যদ্রষ্টার পক্ষে ভুল হবে। দৃষ্টিবিভ্রম যেহেতু অস্বাভাবিক অবস্থা, তাই গভীর ধ্যান ও আত্মবিশ্লেষণের সময় আবির্ভূত প্রতীকসমূহকে সামাল দেওয়া ও ব্যাখ্যা করার জন্যে বিশেষ ক্ষমতা ও মানসিক ভারসাম্য দরকার।

এইসব প্রাথমিক ইহুদি দিব্যদর্শনের সবচেয়ে বিচিত্র এবং সর্বাধিক বিতর্কিতটির দেখা মেলে পঞ্চম শতাব্দীর টেক্সট শিউর কোমাহয় (The Measurement of the Height) যেখানে ঈশ্বরের আসনে ইযেকিয়েলের দেখা অবয়বের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। শিউর কোমাহ এই সত্তাকে ইয়াতযরেন। আমাদের স্রষ্টা বলছে। এই ঈশ্বর দর্শনের অদ্ভুত বিবরণ সম্ভবত র‍্যাবাই আকিভার সবচেয়ে প্রিয় বাইবেলিয় টেক্সট সং অভ সংস-এর একটি অনুচ্ছেদের ভিত্তিতে রচিত। নববধু তার প্রেমিকের বর্ণনা দিচ্ছে:

আমার প্রিয়তম শ্বেত ও রক্তবর্ণ;
তিনি দশ সহস্রের মধ্যে অগ্রগণ্য,
তাহার মস্তক নিৰ্ম্মল সুবর্ণের ন্যায়,
তাহার কেশপাশ কুঞ্চিত ও দাঁড়কাকের ন্যায় কৃষ্ণবর্ণ ।
তাহার নয়নযুগল জলপ্রণালীর তীরস্থ
কপোত যুগলের ন্যায়,
যাহারা দুধ্যে মাত ও পয়ঃপূর্ণ স্থানে উপবিষ্ট ।
তাঁহার গণ্ডদেশ সুগন্ধি ওষধির চৌকা ও আমোদকারী লতার স্তম্ভস্বরূপ,
তাঁহার ওষ্ঠাধর শোশন পুষ্পের ন্যায়,
দ্রব গন্ধরস ক্ষরণকারী।
তাহার হস্ত বৈদ্যুৰ্য্যমণিতে খচিত সুবর্ণের অঙ্গুরীয় স্বরূপ;
তাঁহার কায় নীলকান্ত মণিতে খচিত গজদন্তময় শিল্পকর্মের ন্যায়।
তাঁহার উরুদ্বয় সুবর্ণ চুঙ্গিতে বসান শ্বেত প্রস্তরময়
স্তম্ভ দ্বয়ের ন্যায়,
তাঁহার দৃশ্য লিবানোনের সদৃশ,
এরস বৃক্ষের ন্যায় উৎকৃষ্ট।

কেউ কেউ একে ঈশ্বরের বর্ণনা হিসাবে দেখেছে: ইহুদিদের প্রজন্মান্তরের আতঙ্ক সত্ত্বেও শিউর কোমাহ এখানে উল্লিখিত ঈশ্বরের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে পরিমাপ করে গেছে। এই অদ্ভুত টেক্সটে ঈশ্বরের পরিমাপসমূহ হতবৃদ্ধিকর। মন কুলিয়ে উঠতে পারে না। পারাসাং’ (প্রাচীন পারসিয় মাপের একক)-মূল একক-১৮০ ট্রিলিয়ন ‘ফিংগার’-এর সমান এবং প্রতি ‘ফিংগার পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আরেক অপর প্রান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত। এই সুবিশাল মাত্ৰা মনকে স্তম্ভিত করে দেয় যা আর সামনে বাড়তে পারে না, এমন বিশাল আকারের কোনও কিছু বুঝতে পারে না। এটাই মূল কথা। শিউর কোমাহ আমাদের বলার চেষ্টা করছে যে, ঈশ্বরকে পরিমাপ করা বা মানবীয় পরিভাষায় ধারণ অসম্ভব। তেমন কিছু করার সামান্য প্রয়াসই উদ্যোগের অসম্ভাব্যতা দেখিয়ে দেয় এবং ঈশ্বরের দুয়েতা সম্পর্কে আমাদের নতুন বোধ যোগায়। এখানে বিস্ময়ের কিছু নেই যে, বহু ইহুদিই সম্পূর্ণ আধ্যাত্মিক ঈশ্বরকে পরিমাপের বেমানান প্রয়াসকে ব্লাসফেমাস হিসাবে আবিষ্কার করেছে। এ কারণেই শিউরের মতো একটা নিগূঢ় রচনা অসতর্কদের কাছে গোপন রাখা হয়েছিল। এই প্রেক্ষাপটে সঠিক প্রেক্ষিতে শিউর কোমাহ্ আধ্যাত্মিক নির্দেশকের পরিচালনায় সঠিকভাবে অগ্রসর হতে প্রস্তুতি নেওয়া নবীশদের সকল মানবীয় মান ছাড়িয়ে যাওয়া ঈশ্বরের দুজ্ঞেয়তা সম্পর্কে এক নতুন অন্তদৃষ্টি যোগাবে। এটা অবশ্যই আক্ষরিত অর্থে গ্রহণ করার জন্যে বোঝানো হয়নি; নিশ্চিতভাবেই কোনও গোপন তথ্যও জানায় না। এটা স্বেচ্ছায় মনের এমন একটা অবস্থা সৃষ্টি যা বিস্ময় ও আতঙ্কের একটা বোধ সৃষ্টি করে।

শিউর ঈশ্বরের অতিন্দ্রীয় প্রতিকৃতির দুটি অত্যাবশ্যকীয় উপাদানের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেয় যা তিনটি ধর্ম বিশ্বাসেই দেখা যায়। প্রথমত, এটা আবশ্যিকভাবে কল্পনা-নির্ভর; দ্বিতীয়ত, এটা অনির্বচনীয়। শিউর-এ বর্ণিত অবয়ব ঈশ্বরের প্রতিবিম্ব, অতিন্দ্রীয়বাদীরা যাকে তাদের উধ্বারোহণের শেষ পর্যায়ে সিংহাসনে আসীন অবস্থায় দেখতে পায়। এই ঈশ্বরের মাঝে কোমল, ভালোবাসা বা ব্যক্তিগত কিছু নেই; প্রকৃতপক্ষে তার পবিত্রতাকে দূরবর্তী মনে হয়। অবশ্য তাকে প্রত্যক্ষ করার পর অতিন্দ্রীয়বাদী গান গেয়ে উঠে যা ঈশ্বর সম্পর্কে খুব সামান্যই জানায় আমাদের, তবে প্রভাব রেখে যায়।

পবিত্রতার গুণ, ক্ষমতার গুণ, এক আতঙ্কময় গুণ, এক শাপময় গুণ, ভয়ের গুণ, এক ভীতির গুণ, এক ত্রাসের গুণ, স্রষ্টা, আদোনাই, ইসরায়েলের ঈশ্বরের পোশাকের গুণ, যিনি মাথায় মুকুট পরে আপন প্রতাপের সিংহাসনে আসেন;
তাঁর পোশাকের ভেতর বাইরে খোদাই করা আর YHwH, YHwH দিয়ে সম্পূর্ণ ঢাকা।
একে ধারণ করার ক্ষমতা কোনও চোখের নেই, সে চোখ রক্ত মাংসের হোক, বা তার দাসদের চোখই হোক।

আমরা ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌র আলখেল্লা কেমন সেটাই কল্পনা করতে না পারলে ঈশ্বরকে ধারণ করার চিন্তা করব কীভাবে?

পঞ্চম শতাব্দীর সেফার ইয়েহি (দ্য বুক অভ ক্রিয়েশন)ই সম্ভবত প্রাথমিককালের ইহুদি অতিন্দ্রীয়বাদী টেক্সটের ভেতর সবচেয়ে বিখ্যাত। এখানে বাস্তবানুগভাবে ইহুদি সৃজনশীল প্রক্রিয়া বর্ণনার কোনও প্রয়াস নেই; বিবরণ সঙ্কোচহীনভাবে প্রতীকী এবং সেটা দেখায় যে, ঈশ্বর ভাষা দিয়ে বিশ্ব সৃষ্টি করছেন, যেন কোনও গ্রন্থ লিখছিলেন তিনি। কিন্তু ভাষা আবার সম্পূর্ণ ভিন্ন রূপ নিয়েছে; সৃষ্টির বাণী আর স্পষ্ট নেই। হিব্রু বর্ণমালার প্রত্যেকটা অক্ষরকে একটা করে সংখ্যা মূল্য দেওয়া হয়েছে: হরফগুলোকে পবিত্র সংখ্যার সঙ্গে সমন্বিত করে অতিন্দ্রীয়বাদী সেগুলোর সীমাহীন বিন্যাসের ভেতর দিয়ে বিশ্বের স্বাভাবিক সুর হতে নিজের মনকে সরিয়ে নেয়। এর উদ্দেশ্য ছিল বুদ্ধিবৃত্তিকে পাশ কাটানো ও ইহুদিদের স্মরণ করিয়ে দেওয়া যে, কোনও শব্দ বা ধারণা ঈশ্বর নামের বাস্তবতার প্রতিনিধিত্ব করতে পারে না। আবার ভাষাকে এর শেষ সীমায় ঠেলে দেওয়া ও একে ভাষাবিহীন তাৎপর্য সৃষ্টিতে বাধ্য করায় ঈশ্বরের অনন্যতার একটা অনুভূতি সৃষ্টি হতো। সহানুভূতিশীল বন্ধু ও পিতা হিসাবে নয় বরং এক অদম্য পবিত্র রূপ হিসাবে দেখা ঈশ্বরের সঙ্গে সরাসরি কথোপকথনে লিপ্ত হতে চায়নি অতিন্দ্রীয়বাদীরা ।

থ্রোন মিস্টিসিজম অন্যন্য কোনও ব্যাপার ছিল না। পয়গম্বর মুহাম্মদ (স) আরব থেকে জেরুজালেমের টেম্পল মাউন্টে রাত্রি যাত্রা করার সময়ও ঠিক একই রকম অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন বলে বর্ণিত আছে। ঘুমন্ত অবস্থায় জিব্রাইল কর্তৃক স্বর্গীয় ঘোড়ায় করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তাকে। টেম্পল মাউন্টে পৌঁছানোর পর আব্রাহাম, মোজেস, জেসাস ও অন্য পয়গম্বররা তাকে স্বাগত জানিয়েছেন। মুহাম্মদকে (স) তাঁর পয়গম্বরত্বের জীবনের নিশ্চয়তা দিয়েছেন। এরপর জিব্রাইল ও মুহাম্মদ (স) সাত স্বর্গের ভেতর দিয়ে একটা মই (মিরাজ) বেয়ে বিপদ সঙ্কুল ঊর্ধ্বারোহণ শুরু করেন, যার প্রতিটির দায়িত্বে ছিলেন একজন করে পয়গম্বর। অবশেষে স্বর্গীয় বলয়ে পৌঁছান মুহাম্মদ (স)। প্রাথমিক সূত্রগুলো সশ্রদ্ধভাবে চূড়ান্ত দর্শন সম্পর্কে নীরবতা বজায় রেখেছে, কোরানের নিচে উল্লেখ করা পঙক্তিগুলোয় ঘটনার উল্লেখ করা হয়েছে বলে বিশ্বাস করা হয় :

নিশ্চয়ই সে তাহাকে* আরেকবার দেখিয়াছিল অন্তবর্তী বদরীয় বৃক্ষের নিকট, যাহার নিকট অবস্থিত বাসোদ্যান।**
যখন বৃক্ষটি যা দ্বারা আচ্ছাদিত হইবার, তা দ্বারা ছিল আচ্ছাদিত***। তাহার দৃষ্টি বিভ্রম হয় নাই। দৃষ্টি লক্ষ্যচ্যুতও হয় নাই। সে তো তাহার প্রতিপালকের মহান নিদর্শনাবলী দেখিয়াছিল।

[*রাসুলুল্লাহ (স) দ্বিতীয়বার মিরাজে জিব্রাঈল (আ) কে দেখেছিলেন তাঁর পূর্ণ অবয়বে ষষ্ঠ বা সপ্তম আকাশে কুল গাছের কাছে। সূত্র, পবিত্র কুরআনুল করীম : ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ।
**অবস্থানের জায়গায়, বেহেশত, মুমিনদের বাসস্থান-বাগানবাড়ি, তাই বাসোদ্যান। সূত্র: পবিত্র কুরআনুল করীম, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ।
*** কুল গাছ আল্লাহর নূরে আচ্ছাদিত। সূত্র: পবিত্র কুরআনুল করীম, বাংলাদেশ ইসলামিক ফাউন্ডেশন।]

মুহাম্মদ (স) স্বয়ং ঈশ্বরকে দেখেননি, কেবল স্বর্গীয় সত্তাকে নির্দেশকারী প্রতীকসমূহ প্রত্যক্ষ করেছেন। হিন্দু ধর্ম বিশ্বাসে লোত বৃক্ষ যৌক্তিক চিন্তার শেষসীমা নির্দেশ করে। চিন্তা বা ভাষার স্বাভাবিক অভিজ্ঞতা ঈশ্বর দর্শনের আবেদন সৃষ্টি করার মতো সুযোগ নেই। স্বৰ্গ আরোহন মানবীয় চেতনার দূরতম বিন্দুর প্রতীক, যা পরম অর্থের নৈকট্য নির্দেশ করে।

উর্ধ্বারোহণের ইমেজারি খুব সাধারণ। সেইন্ট অগাস্তিন অস্টিয়ায় মায়ের সঙ্গে ঈশ্বরের নিকট অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন, প্লটিনাসের ভাষায় যার বর্ণনা দিয়েছেন তিনি :

স্বয়ং চিরন্তন সত্তার দিকে এক প্রবল আকর্ষণে আমাদের মন উত্থিত হয়েছিল। ধাপের পর ধাপ বেয়ে আমরা সকল সংশ্লিষ্ট বস্তু ও স্বর্গ অতিক্রম করে গেলাম যেখানে সূর্য, চাঁদ ও তারা পৃথিবীতে আলো বিতরণ করে। আরও ওপরে উঠে গেলাম আমরা। মনের ভাবনা ও কথোপকথন এবং আপনার সৃষ্টির বিস্ময়ে আরও উপরে উঠলাম এবং প্রবেশ করলাম আমাদের মনের গভীরে।

অগাস্তিনের মন সাত স্বর্গের সেমেটিক ইমেজের জায়গায় সত্তার অসীম ধারাবাহিকতার গ্রিক ইমেজারিতে পূর্ণ ছিল। এটা মহাশূন্যের কোনও ঈশ্বরের দিকে শূন্যের ভেতর দিয়ে আক্ষরিক অর্থে কোনও অভিযাত্রা ছিল না, বরং ছিল অন্তরের সত্তার দিকে মানসিক আরোহণ। আনন্দময় যাত্রা যেন কোনও কিছু ছাড়াই একটা কিছু দিয়েছে মনে হয় যখন তিনি বলেন, আমাদের মন উত্থিত হয়েছিল যেন মনিকা এবং তিনি আশীর্বাদের নিষ্ক্রিয় গ্রাহক, কিন্তু ‘চিরন্তন সত্তার দিকে ক্রমারোহণে এক ধরনের বিবেচনা রয়েছে। একই রকম কল্পনিক উধ্বরোহণের কথা সাইবেরিয়া হতে তিয়েরা দেল ফুয়েগো পর্যন্ত অঞ্চলের শামানদের ঘোরের অভিজ্ঞতার মাঝে উল্লেখ আছে, জোসেফ ক্যাম্পবেল যেমন বলেছেন।

ঊর্ধ্বরোহণের প্রতীক ইঙ্গিত করে যে, জাগতিক অনুভূতি পেছনে ফেলে আসা হয়েছে। শেষ পর্যন্ত অর্জিত ঈশ্বরের অভিজ্ঞতা চরমভাবে বর্ণনার অতীত, কেননা স্বাভাবিক ভাষার প্রয়োগ আর চলে না। ইহুদি অতিন্দ্রীয়বাদীরা ঈশ্বর ছাড়া আর সবকিছুরই বিবরণ দেয়। তারা ঈশ্বরের আলখেল্লা, তার প্রাসাদ, স্বর্গীয় দরবার এবং যে আবরণ তাকে মানুষের দৃষ্টির আড়ালে রাখে যা তার চিরন্তন আদি রূপের প্রকাশ করে, সেসবের কথা বলে। যেসব মুসলিম মুহাম্মদের (স) স্বর্গ অভিমুখে যাত্রা সম্পর্কে ভাবে তারা চূড়ান্ত ঈশ্বর দর্শনের স্ববিরোধী প্রকৃতির গুরুত্ব দিয়ে থাকে: তিনি স্বর্গীয় সত্তাকে দেখেছেন আবার দেখেননি। অতিন্দ্রীয়বাদী যখন নিজের মনের ইমেজারির জগৎ অতিক্রম করে যায়, তখন এমন এক পর্যায়ে পৌঁছায় যেখানে ধারণা বা কল্পনা কোনওটিই তাকে আর দূরে নিয়ে যেতে পারে না। অগাস্তিন ও মনিকা উভয়ই তাদের যাত্রার ক্লাইমেক্স সম্পর্কে সংযত, এর স্থান, কাল ও সাধারণ জ্ঞানের উর্ধ্বে অবস্থানের ওপর জোর দিয়েছেন। তারা ঈশ্বরের জন্যে কথা বলেছেন এবং হাঁপিয়েছেন এবং হৃদয়ের সামগ্রিক একাগ্রতার মুহূর্ত দিয়ে অল্প মাত্রায় একে স্পর্শ করেছেন। তারপর স্বাভাবিক ভাষায় ফিরে আসতে হয়েছে তাদের যেখানে একটি বাক্যের শুরু, মধ্যাংশ ও সমাপ্তি আছে:

সুতরাং আমরা বললাম: যদি কারও জন্যে দেহের কম্পন স্তব্ধ হয়ে গিয়ে থাকে, যদি মাটি, জল ও বাতাসের ইমেজসমূহ স্থির থাকে, যদি স্বৰ্গসমূহ আপনাআপনি বন্ধ হয়ে যায়, এবং যদি খোদ আত্মা কোনও শব্দ না করে এবং নিজ সম্পর্কে চিন্তা বাদ দিয়ে একে অতিক্রম করে, যদি কল্পনায় সকল স্বপ্ন আর দৃশ্য বাদ দেওয়া হয়, যদি সকল ভাষা ও ক্ষণস্থায়ী সবকিছু নীরব থাকে-কারণ এরপর যদি কেউ এটা শুনতে পায়, তাহলে এদের সবাই বলবে, “আমরা আমাদের সৃষ্টি করিনি, আমাদের সৃষ্টি করেছেন তিনি যিনি চিরকাল আছেন।’ (শ্লোক ৭৯ : ৩, ৫) …এভাবেই যখন আমরা আমাদের সাধ্য প্রসারিত করলাম তখন মানসিক শক্তির এক ঝলকে সকল সত্তার অতীত চিরকালীন এক প্রজ্ঞা অর্জন করলাম।

এটা কোনও ব্যক্তিক ঈশ্বরের স্বাভাবিক দর্শন ছিল নাঃ বলা যায়, তারা প্রাকৃতিক যোগাযোগের স্বাভাবিক কোনও পদ্ধতিতে সাধারণ কণ্ঠে, দেবদূতের কণ্ঠে, প্রকৃতির মাধ্যমে বা কোনও স্বপ্নের প্রতাঁকে তাঁর কণ্ঠস্বর শোনেননি, তারা সকল সত্তার অতীত বাস্তবতাকে স্পর্শ করেছেন বলে মনে হয়।

এটা স্পষ্টতই সংস্কৃতির শর্তাধীন হলেও এ ধরনের উর্ধ্বারোহণ’কে জীবনের তর্কাতীত সত্য বলেই মনে হয়। আমরা একে যেভাবেই ব্যাখ্যা করি না কেন, সারা বিশ্বের ও ইতিহাসের সকল পর্যায়ে মানুষ এই ধরনের ধ্যানমুখী অভিজ্ঞতার দেখা পেয়েছে। একেশ্বরবাদীরা এই পরম অন্তদৃষ্টিকে ঈশ্বরের দর্শন’ আখ্যায়িত করেছে। প্লাটিনাস একে দ্য ওয়ানের উপলব্ধি ধরে নিয়েছেন, বুদ্ধরা একে বলবে নির্বাণের দর্শন লাভ। এখানে মূল বিষয় হচ্ছে, এটা এমন কিছু যা বিশেষ আধ্যাত্মিক ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তি সবসময়ই অর্জন করতে চেয়েছে। ঈশ্বর সংক্রান্ত অতিন্দ্রীয়বাদী অভিজ্ঞতার কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা সকল ধর্ম বিশ্বাসের ক্ষেত্রেই এক রকম। এটা সত্তার বাইরে নির্দিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ধারণা নয়, বরং এক ধরনের ভক্তিপূর্ণ অভিজ্ঞতা যার জন্যে অন্তরে যাত্রা করার প্রয়োজন হয়। মনের চিত্রকল্প গঠনকারী অংশের সাহায্যে এই প্রক্রিয়াটি অনুসৃত হয় প্রায়শঃই যাকে বলা হয় কল্পনা-অধিকতর বুদ্ধিবৃত্তিক যৌক্তিক অংশ দিয়ে নয়। এবং শেষ পর্যন্ত এটা এমন কিছু যা অতিন্দ্রীয়বাদী নারী বা পুরুষ ইচ্ছাকৃতভাবে নিজ সত্তায় সৃষ্টি করে থাকে: নির্দিষ্ট কিছু শারীরিক বা মানসিক অনুশীলন চরম দর্শন লাভ ঘটায়; আচমকা কারও ওপর ঘটে যায় না।

অগাস্তিন সম্ভবত ধারণা করেছিলেন যে, বিশেষ সৌভাগ্যবান ব্যক্তিরা কখনও কখনও জীবদ্দশায়ই ঈশ্বরের সাক্ষাৎ পেতে পারে। মোজেস ও সেইন্ট পলকে উদাহরণ হিসাব উল্লেখ করেছেন তিনি। আধ্যাত্মিক জীবনের স্বীকৃত শুরু এবং ক্ষমতাশালী প্রধান যাজক পোপ গ্রেগরি দ্য গ্রেট (৫৪০-৬০৪) দ্বিমত পোষণ করেছেন। বুদ্ধিজীবী ছিলেন না তিনি, বরং টিপিক্যাল রোমান হিসাবে আধ্যাত্মিকতা সম্পর্কে অনেক বেশি বাস্তবসম্মত দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী ছিলেন। ঈশ্বর সম্পর্কে মানুষের জ্ঞানের সামগ্রিক অস্পষ্টতা বোঝাতে মেঘ, কুয়াশা বা অন্ধকারের উপমা ব্যবহার করেছেন। তার ঈশ্বর দুর্ভেদ্য অন্ধকারে মানুষের দৃষ্টির আড়ালে রয়ে গিয়েছেন, এই অন্ধকার গ্রিক ক্রিশ্চান গ্রেগরি অভ নাইসা ও ডেনিসের মেঘের দুর্বোধ্য অনুভূতির চেয়ে ঢের কষ্টকর। গ্রেগরির বেলায় ঈশ্বরের অভিজ্ঞতা ছিল হতাশাজনক। তিনি জোর দিয়ে বলেছেন, ঈশ্বরের নৈকট্য লাভ দূরূহ। আমাদের পক্ষে তাঁর সম্পর্কে পরিচিতের মতো কোনও কিছু উচ্চারণ করার জো নেই। এমন নয় যে, আমাদের সঙ্গে তার কোনও মিল আছে। আমরা ঈশ্বর সম্পর্কে কিছুই জানি না। আমরা মানুষ সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানের ভিত্তিতে ঈশ্বরের আচরণ সম্পর্কে কোনওরকম পূর্ব ধারণাই করতে পারি নাঃ ‘তো যখন আমরা বুঝতে পারি আমাদের পক্ষে ঈশ্বর সম্পর্কে পুরোপুরিভাবে কিছু জানা সম্ভব নয়, একমাত্র তখনই তার বিষয়ে আমরা সত্যের কাছাকাছি থাকি। গ্রেগরি ক্রমাগত ঈশ্বরকে লাভ করার প্রয়াস ও বেদনার কথা বলেছেন। প্রচণ্ড সগ্রামের পর মাত্র কয়েক মুহূর্তের জন্যে ধ্যানের আনন্দ উপভোগ করা যেতে পারে। ঈশ্বরের মধুর স্বাদ পাওয়ার আগে আত্মাকে এর স্বাভাবিক উপাদান অন্ধকার ছুঁড়ে বেরিয়ে আসার জন্যে লড়াই করতে হয়: এটা নিজের মাঝে চকিত দৃষ্টিতে যে জিনিসটা দেখেছে তার ওপর দৃষ্টি স্থির রাখতে পারে না, কারণ আপন স্বভাবের কারণেই এটা নিমজ্জিত হতে বাধ্য হয়। নিজেকে ছাড়িয়ে যাবার জন্যে এটা হাঁপায়, সংগ্রাম করে, বারবার প্রয়াস পায়, কিন্তু আবার ডুবে যায়, ক্লান্তির ভারে চিরচেনা অন্ধকারে।[১৫]

কেবল মনের প্রবল প্রয়াসের পরেই ঈশ্বরকে লাভ করা যেতে পারে, মনকে তার সঙ্গে যুঝতে হয়; যেভাবে জ্যাকব যুদ্ধ করেছিলেন দেবদূতের সঙ্গে। ঈশ্বরের কাছে যাবার পথ অপরাধ, অশ্রু ক্লান্তিময়; মন তাঁর নিকটবর্তী হলে, কান্না ছাড়া আর কিছু করার থাকে না আত্মার। ঈশ্বরের নৈকট্য লাভের আকাক্ষায় ‘নিপীড়িত’ আত্মা কেবল ক্লান্ত হয়ে অশ্রুতেই শান্তি খুঁজে পায়।[১৬] দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আধ্যাত্মিক পথ প্রদর্শক ছিলেন গ্রেগরি; স্পষ্টতই পশ্চিমের বাসিন্দারা ঈশ্বরকে চাপ হিসেবেই আবিষ্কার করে গেছে।

প্রাচ্যে ঈশ্বর সম্পর্কিত ক্রিশ্চানদের অভিজ্ঞতা অন্ধকারের বদলে আলোর বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। গ্রিকরা এক ভিন্ন ধরনের অতিন্দ্রীয়বাদ গড়ে তুলেছিল, যা সারা বিশ্বে দেখা যায়। এ পদ্ধতি ইমেজারি ও দিব্য দর্শনের ওপর নির্ভরশীল ছিল না, বরং ডেনিস দ্য আরোপাগাইতের উল্লেখ করা অ্যাপোফ্যাটিক বা নীরব অভিজ্ঞতা ভিত্তিক ছিল। স্বভাবতই ঈশ্বরের সকল যৌক্তিক ধারণাই ছড়িয়ে গেছে সেসব। কমেন্টারি অন দ্য সং অভ সংস-এ গ্রেগরি অভ নাইসা যেমন ব্যাখ্যা দিয়েছেন: ‘অনুসন্ধিৎসুর সন্ধানের পথে মনে আঁকড়ে রাখা প্রত্যেকটা ধারণা বাধা হয়ে দাঁড়ায়। ধ্যানীর লক্ষ্য সকল ধারণার উর্ধ্বে যাওয়া তো বটেই, সেই সঙ্গে যেকোনও রকম ইমেজের অতীতে পৌঁছানো, কারণ এগুলো বিক্ষেপের কারণ সৃষ্টি করতে পারে। এরপর একটা বিশেষ উপস্থিতির অনুভূতি অর্জন করবে সে, যা সংজ্ঞাতীত এবং নিঃসন্দেহে অন্য কোনও মানুষের সঙ্গে সম্পর্কের যে অনুভূতি তার অতীত। এই মনোভাবকে বলা হয়েছে ‘হেসিচিয়া প্রশান্তি বা অন্তরের নীরবতা। যেহেতু ভাষা, ধারণা এবং বিভিন্ন ইমেজ আমাদের কেবল জাগতিক বিশ্বে স্থান ও কাল আটকে রাখে, সুতরাং মনকে অবশ্যই মনোনিবেশের কৌশল প্রয়োগ করে স্বেচ্ছায় অটল করতে হয়, যাতে তা অপেক্ষমান নৈঃশব্দ্য গড়ে তুলতে পারে। কেবল তাহলেই এটা এমন এক সত্তার আকাভক্ষা করার আশা করতে পারবে যা এর ধারণার যেকোনও কিছুর উর্ধ্বে।

দুর্বোধ্য একজন ঈশ্বরকে জানা সম্ভব ছিল কীভাবে? গ্রিকরা এ ধরনের প্যারাডক্স ভালোবাসত এবং হেসিচ্যাস্টরা ঈশ্বরের সত্তা (Ousia) ও তাঁর শক্তি’ (energetai) বা জগতে তাঁর ক্রিয়াকর্মের সেই প্রাচীন পার্থক্যে ফিরে গেছে যা আমাদের ঈশ্বর সম্পর্কে কিছুটা জানতে সক্ষম করেছে। আমরা ঈশ্বরকে যেহেতু তার আপন সত্তায় কখনওই জানতে পারব না, সেহেতু প্রার্থনার সময় আমরা আসলে তার শক্তি’কে অনুভব করি, ‘সত্তা’কে নয়। একে পৃথিবীকে আলোকিত করে তোলা ঈশ্বর হতে বর্ষিত রশ্মি হিসাবে বর্ণনা করা যেতে পারে; কিন্তু সূর্য রশ্মি যেমন সূর্য হতে আলাদা তেমনি এগুলোকেও ঈশ্বর হতে আলাদা স্বর্গীয় সত্তার । এগুলো এক চরম নীরব ও দুয়ে ঈশ্বরকে প্রকাশ করে। সেইন্ট বাসিল যেমন বলেছিলেন: “শক্তির সাহায্যে আমরা আমাদের ঈশ্বরকে জানতে পারি, আমরা তাঁর সত্তার নিকটবর্তী হওয়ার কথা। বলি না, কারণ তাঁর শক্তি আমাদের মাঝে অবতীর্ণ হয়, কিন্তু সত্তা দুর্গম রয়ে যায়।১৮ ওল্ড টেস্টামেন্টে এই স্বর্গীয় শক্তি’কে ঈশ্বরের ‘প্রতাপ’ (কভোদ) বলা হয়েছে। নিউ টেস্টামেন্টে তাবর পর্বতে ব্যক্তি ক্রাইস্টের মানবরূপ স্বর্গীয় রশ্মি দিয়ে বদলে যাওয়ার সময় (Transfigured) দেদীপ্যমান হয়েছিল। এবার সেই রশ্মি সারা বিশ্ব জগতে ছড়িয়ে পড়ে রক্ষাপ্রাপ্তদের দেবত্ব দান করেছিল। শক্তি’ বা ‘এনার্জিয়াই’ শব্দটি যেমন বোঝায়, এটা ঈশ্বর সম্পর্কিত সক্রিয় ও গতিময় ধারণা ছিল। পশ্চিমে যখন ঈশ্বরকে তাঁর চিরন্তন গুণাবলী-তার মহত্ব বিচার, প্রেম ও সর্বশক্তিমানতা-দিয়ে নিজেকে প্রকাশ করতে দেখবে, তখন গ্রিকরা ঈশ্বরকে বিরামহীন তৎপরতার মাঝে কোনওভাবে উপস্থিত থাকার ভেতর দিয়ে নিজেকে সুগম্য করে তুলতে দেখেছে।

সুতরাং, আমরা যখন প্রার্থনায় শক্তিসমূহকে অনুভব করি, তখন এক অর্থে সরাসরি ঈশ্বরের সঙ্গেই সম্পর্ক স্থাপন করি, যদিও জ্ঞানাতীত সত্তা স্বয়ং অস্পষ্টতার ঘেরাটোপে রয়ে যান। নেতৃস্থানীয় হেচিসচাস্ট ইভাগ্রিয়াস পন্তাস (মৃত্যু, ৩৯৯) জোর দিয়ে বলেছেন, প্রার্থনায় আমরা ঈশ্বরের যেটুকু জ্ঞান লাভ করি তাঁর সঙ্গে ধারণা বা ইমেজের কোনওই সম্পর্ক নেই, বরং এসবের অতীত এক প্রত্যক্ষ স্বর্গীয় অনুভূতি। সুতরাং, হেসিচ্যাস্টদের পক্ষে আত্মাকে উন্মুক্ত করে তোলা অত্যন্ত জরুরি ছিল: ‘প্রার্থনা করার সময়, সন্ন্যাসীদের উদ্দেশে বলেছেন তিনি, “নিজের ভেতর উপাস্যের কোনও রূপ গড়ে তুলবে না, আবার মনকে কোনও রূপ দিয়ে আকৃতি গড়তেও দেবে না। বরং তার বদলে তাদের উচিত হবে ‘অবস্তুগতভাবে অবস্তুর দিকে অগ্রসর হওয়া।”১৯ ইভাগ্রিয়াস অনেকটা ক্রিশ্চান যোগের প্রস্তাব রাখছিলেন। এটা চিন্তার কোনও প্রক্রিয়া ছিল; প্রকৃতপক্ষে, প্রার্থনার মানে হচ্ছে চিন্তা দূর করা।২° এটা বরং ঈশ্বরের সহজাত উপলব্ধি ছিল। এর ফলে সকল বস্তুর ঐক্যের বোধ সৃষ্টি হবে, বিক্ষোভ ও জটিলতা হতে নিস্তার মিলবে এবং অহমের বিনাশ ঘটবে-এই অভিজ্ঞতা বুদ্ধ মতবাদের মতো নিরীশ্বরবাদী ধর্মসমূহের ধ্যানের মাধ্যমে সৃষ্ট অভিজ্ঞতার মতো। সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুসরণ করে অহংস্কার, লোভ, বিপদ বা ক্রোধ এর মতো প্রবল আবেগ যা তাদের অহমের সঙ্গে আটকে রাখে তা থেকে মনকে সরিয়ে এনে হেসিচ্যাস্টরা নিজেদের অতিক্রম করে যাবে এবং ঐশী শক্তি’তে তাবর পাহাড়ে রূপান্তরিত জেসাসের মতো একই রকম দেবত্ব লাভ করবে ।

পঞ্চম শতাব্দীর ফটিসের বিশপ দিওদোকাস জোর দিয়ে বলেছেন যে, এই দেবত্ব প্রাপ্তি পরকালের জন্যে অপেক্ষা করে না, বরং সচেতনভাবে ইহজগতেই অর্জন করা যেতে পারে। তিনি মনোসংযোগের একটা পদ্ধতি শিক্ষা দিয়েছিলেন যার সঙ্গে শ্বাস-প্রশ্বাসের সম্পর্ক ছিল: শ্বাস গ্রহণের সময় হেসিচ্যাস্টরা প্রার্থনা করবে: ‘জেসাস ক্রাইস্ট, ঈশ্বর-পুত্র’; শ্বাস ত্যাগ করতে করতে উচ্চারণ করতে হবে: ‘আমাদের মার্জনা করুন। পরবর্তীকালের হেসিচ্যাস্টরা এই অনুশীলনের পরিমার্জনা করে: ধ্যানীকে কাঁধ মাথা নিচু করে বুক বা নাভীর দিকে দৃষ্টি নিবন্ধ করতে হবে। মনের গভীরে হৎপিণ্ডের মতো নির্দিষ্ট কোনও শারীরিক অংশের দিকে মনোযোগ দেওয়ার জন্যে খুব ধীরে। ধীরে শ্বাস নিতে হবে। খুব কঠিন অনুশীলন ছিল এটি, অবশ্যই অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে প্রয়োগ করতে হবে; একমাত্র অভিজ্ঞ গুরুর অধীনেই নিরাপদে এর চর্চা করা যেতে পারে। ক্রমে কোনও বৌদ্ধ ভিক্ষুর মতো হেসিচ্যাস্ট নারী বা পুরুষ আবিষ্কার করবে যে সে যৌক্তিক চিন্তাভাবনা আস্তে করে এক পাশে সরিয়ে রাখতে পারছে: মনে ভিড় জমানো ইমেজারি মিলিয়ে যাবে এবং হেসিচ্যাস্ট প্রার্থনায় বিলীন হয়ে যাবার বোধ পাবে । গ্রিক ক্রিশ্চানরা নিজেরাই এমন কৌশল আবিষ্কার করেছিল যা প্রাচ্য দেশীয় ধর্মগুলোয় শত শত বছর ধরে অনুসৃত হয়ে আসছিল। প্রার্থনাকে তারা মানসিক বিকারজাত শারীরিক প্রক্রিয়া হিসাবে দেখেছে, অন্যদিকে অগাস্তিন ও গ্রেগরির মতো পাশ্চাত্যবাসীরা মনে করেছেন প্রার্থনায় শরীর হতে আত্মার মুক্তিলাভ ঘটা উচিত। ম্যাক্সিমাস দ্য কনফেসর জোর দিয়েছেন: ‘সম্পূর্ণ মানুষকে ঈশ্বরে পরিণত মানুষের কৃপায় ঈশ্বরে পরিণত হতে হবে, প্রকৃতিগত দিক দেহ-আত্মায় সম্পূর্ণ মানুষ, প্রকৃতিগত দিক দিয়ে পরিণত হবে সম্পূর্ণ মানুষ, আত্মা আর দেহ। এমন শক্তিশালী ও জোরাল শক্তি আর স্পষ্টতার অনুভূতি লাভ করবে হেসিচ্যাস্ট যা ঐশ্বরিক না হয়ে পারে না। আমরা যেমন দেখেছি, গ্রিকরা এই ‘দেবতৃপ্রাপ্তিকে মানুষের পক্ষে স্বাভাবিক আলোকন হিসাবে দেখেছে। তাবর পর্বতে রূপান্তরিত ক্রাইস্টের মাঝে অনুপ্রেরণার সন্ধান পেয়েছিল তারা, ঠিক বৌদ্ধরা যেমন মানব সত্তার পূর্ণাঙ্গ বোধ লাভকারী বুদ্ধের প্রতিমূর্তি দেখে অনুপ্রাণিত হয়। প্রাচ্যের অর্থডক্স চার্চসমূহের ক্ষেত্রে রূপান্তরের দ্য ফিস্ট অভ ট্রান্সফিগারেশন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, একে এপিফ্যানি, ঈশ্বরের অভিব্যক্তি বলা হয়। পশ্চিমের সতীর্থদের বিপরীতে গ্রিকবা ঈশ্বর-অনুভূতি লাভের ক্ষেত্রে মানসিক চাপ, শুষ্কতা ও নৈঃসঙ্গকে অনতিক্রম্য পূর্বশর্ত হিসাবে দেখেনিঃ এগুলো তুচ্ছ বিকৃতি মাত্র এবং অবশ্যই নিরাময় করতে হবে। গ্রিকদের মাঝে আত্মার কৃষ্ণপক্ষের কোনও বিশ্বাস ছিল না। গেথসেমেন বা/এবং ক্যালভারি নয়, জোরাল মোটিফটি ছিল তাবর।

অবশ্য সবার পক্ষে এই সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছানো সম্ভব নয়, তবে প্রতিমার মাঝে অন্য ক্রিশ্চানরা এই অতিন্দ্রীয় অভিজ্ঞতার খানিক ছটা দেখতে পাবে। পাশ্চাত্যে ধর্মীয় শিল্পকর্ম প্রবলভাবে প্রতিনিধিত্বশীল হয়ে উঠছিল: জেসাস বা সাধুদের জীবনের বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহের ঐতিহাসিক বিবরণ তুলে ধরছিল তা । অবশ্য, বাইযান্তিয়ামে ইহজগতের কোনও বিষয়কে তুলে ধরার জন্যে মূর্তি ব্যবহার করা হতো না, বরং অতিন্দ্রীয়বাদীদের অনুপ্রাণিত করার জন্যে হেসিচ্যাস্টদের অতিন্দ্রীয় অভিজ্ঞতা চিত্রায়িত করার প্রয়াস ছিল এটা। ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ পিটার ব্রাউন যেমন ব্যাখ্যা করেছেন, ‘গোটা প্রাচ্য ক্রিশ্চান জগতে প্রতিমা ও দিব্যদর্শন একে অপরটিকে বৈধতা দান করেছে…সমন্বিত কল্পনার একটি নির্দিষ্ট বিন্দুতে গভীর সন্নিবেশ…ষষ্ঠ শতাব্দী নাগাদ অনিবৰ্চনীয়তা একটা স্পষ্ট চেহারা লাভ করে, স্বপ্নে ও প্রতিটি মানুষের কল্পনায় যেখানে সাধারণভাবে এটা শিল্পে তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিমা এক বাস্তবায়িত স্বপ্নের। বৈধতা ছিল। প্রতিমাসমূহ বিশ্বাসীকে উপদেশ দেওয়া বা কোনও তথ্য, ধারণা বা মতবাদ শিক্ষা দেওয়ার জন্যে ছিল না। এগুলো ছিল ধ্যানের (থিয়োরিয়া) একটা কেন্দ্রবিন্দু, বিশ্বাসীকে স্বর্গীয় জগতের এক ধরনের জানালার ব্যবস্থা করে দিত।

অবশ্য অষ্টম শতাব্দী নাগাদ ঈশ্বরের বাইন্তানীয় অভিজ্ঞতা এমন মূল বিষয়ে পরিণত হয় যে, সেগুলো গ্রিক চার্চে মতবাদ বিষয়ের প্রবল বিতর্কের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। লোকে প্রশ্ন করতে শুরু করেছিল যে, ক্রাইস্টকে আঁকতে গিয়ে শিল্পী আসলে ঠিক কী ওঁকেছেন। তাঁর ঐশ্বরিকতাকে তুলে ধরা অসম্ভব, কিন্তু শিল্পী যদি দাবি করেন যে, তিনি কেবল মানুষ জেসাসকে আঁকছেন, তাহলে নেস্টরিয়বাদের দোষে অপরাধী হবেন তিনি জেসাসের মানব ও স্বর্গীয় প্রকৃতি সম্পূর্ণ ভিন্ন, এই ধর্মদ্রোহী বিশ্বাস। প্রতিমা বিরোধীরা সব রকম প্রতিমা ধ্বংস করতে চেয়েছিল, কিন্তু নেতৃস্থানীয় দুজন সাধু বেথেলহেমের নিকটবর্তী মার সাব্বাস মঠের জন অভ দামাস্কাস (৬৫৬-৭৪৭) ও কন্সতান্তিনোপলের নিকটস্থ স্তাদিয়াস মঠের থিয়োদর (৭৫৯-৮২৬) প্রতিমার পক্ষে দাঁড়ান। ক্রাইস্টের মূর্তি গড়ায় নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রতিমা বিরোধীর প্রয়াস ভুল বলে যুক্তি দেখান তাঁরা। আবতার পর্বের পর বস্তুজগৎ ও মানবদেহকে স্বর্গীয় মাত্রা দান করা হয়েছে। সুতরাং, শিল্পী এই নতুন ধরনের দেবত্বপ্রাপ্ত মানুষকে আঁকতে পারেন। ক্রাইস্ট দ্য লগোস ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ ঈশ্বরের প্রতিমূর্তি। সুতরাং, শিল্পী ঈশ্বরের প্রতিমূর্তিও আঁকছেন। ভাষা বা মানবীয় ধ্যান-ধারণায় ঈশ্বরকে তুলে ধরা সম্ভব নয়, কিন্তু শিল্পীর কলম বা শাস্ত্রের প্রতীকী ভঙ্গিতে তাঁকে বর্ণনা করা। যেতে পারে।

গ্রিকদের ধর্মানুরাগ প্রতিমার ওপর এত বেশি নির্ভরশীল ছিল যে ৮২০। সাল নাগাদ প্রতিমা বিরোধীরা জনতার কাছে পরাস্ত হয়েছিল। তবে ঈশ্বর এক অর্থে বর্ণনাযোগ্য ঘোষণা ডেনিসের অ্যাপেফ্যাটিক ধর্মতত্ত্বের প্রত্যাখ্যান ছিল। না। গ্রেটার অ্যাপলজি ফর দ্য হলি ইমেজেস-এ সাধু নিসেফোরাস দাবি করেন। প্রতিমাসমূহ ঈশ্বরের নীরবতার প্রকাশক, নিজেদের মাঝে সত্তার উধ্বের এক রহস্যের অনিবৰ্চনীয়তাকে তুলে ধরে রুদ্ধ না হয়ে বক্তব্যহীন থেকে ধর্মতত্ত্বের তিনগুণ অলৌকিক সুরে ঈশ্বরের মহানুভবতার প্রশংসা করে।২৩ বিশ্বাসীকে চার্চের ডগমার অধীনস্ত হবার নির্দেশ দেওয়ার বদলে আপন ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে সাবলীল ধারণা গড়ে তুলতে সাহায্য করার জন্যে প্রতিমাসমূহ তাদের এক রহস্যময়তার ভেতর ধরে রাখে। এইসব ধর্মীয় চিত্রকলার প্রভাব বর্ণনা করতে গিয়ে নিসেফোরাস এর সঙ্গে কেবল সঙ্গীতেরই তুলনা টানতে পেরেছেন যা শিল্পকলার সবচেয়ে অনির্বচনীয় ও সম্ভবত সবচেয়ে প্রত্যক্ষ ধরণ। সঙ্গীতের মাধ্যমে আবেগ ও অনুভূতি এমনভাবে প্রবাহিত হয় যা ভাষা ও ধারণাকে পাশ কাটিয়ে যায়। উনবিংশ শতাব্দীতে ওয়াল্টার প্যাটার উল্লেখ করেছিলেন, সকল চিত্রকলা সঙ্গীতের মতো অবস্থা সৃষ্টি করে; নবম শতাব্দীতে বাইযান্তিয়ামে গ্রিক ক্রিশ্চানরা ধর্মতত্ত্বকে মূর্তিবিদ্যার অনুরূপ হিসাবে দেখেছে। তারা দেখেছে যে, যৌক্তিক আলোচনার চেয়ে শিল্পকর্মেই বরং ঈশ্বরকে ভালোভাবে তুলে ধরা যায়। চতুর্থ ও পঞ্চম শতাব্দীর চরম ভাষানির্ভর খৃস্টতত্ত্বীয় বিতর্কের পর তারা ক্রিশ্চানদের কল্পনানির্ভন অনুভূতির ওপর নির্ভরশীল এক ঈশ্বরের অবয়ব গড়ে তুলছিল।

এ বিষয়টির সুনির্দিষ্টভাবে প্রকাশ করেছিলেন কন্সতান্তিনোপলের ক্ষুদে মঠ সেইট ম্যাকবাস এর অ্যাবট সিমিয়ন (৯৪৯-১০২২)। নিউ থিয়োলজিয়ান’ হিসাবে পরিচিত হয়ে ওঠেন তিনি। নতুন ধরনের এই ধর্মতত্ত্বে ঈশ্বরের সংজ্ঞা দেওয়ার কোনও প্রয়াস ছিল না। এটা, জোর দিয়ে বলেছেন সিমিয়ন, ধৃষ্টতাপূর্ণ ব্যাপার হবে। প্রকৃতপক্ষেই ঈশ্বর সম্পর্কে যেভাবেই যা কিছু বলা হোক না কেন, তাতে বোঝাবে যে, “যা দুর্বোধ্য তা আসলে বোধগম্য।২৫ ঈশ্বরের স্বরূপ সম্পর্কে যৌক্তিক বক্তব্য রাখার বদলে নতুন ধর্মতত্ত্ব প্রত্যক্ষ ব্যক্তিগত ধর্মীয় অনুভূতির উপর নির্ভর করেছে। ধারণাগতভাবে ঈশ্বরকে জানা অসম্ভব, যেন তিনি আরেকটি সত্তা মাত্র যার সম্পর্কে আমরা ধারণা করতে পারি। ঈশ্বর এক রহস্য। ক্রাইস্টের রূপান্তরিত মানবদেহে নিজেকে প্রকাশকারী ঈশ্বরের সচেতন অনুভূতি লাভকারী ব্যক্তিই প্রকৃত ক্রিশ্চান । সিমিয়ন পার্থিব জীবন থেকে আকস্মিকভাবে পাওয়া এক অভিজ্ঞতার সাহায্যে ধ্যানের জগতে প্রবেশ করেছিলেন। প্রথমে কী ঘটছে সে সম্পর্কে কোনও ধারণাই করতে পারেননি তিনি, কিন্তু ক্রমে বুঝতে পেরেছেন, তাঁর মাঝে পরিবর্তন ঘটছে, আলোয় বিলীন হয়ে যাচ্ছেন তিনি, যা আসলে স্বয়ং ঈশ্বর। এ আলো অবশ্যই আমাদের চেনা আলো নয়, এটা ‘আকার, ইমেজ বা উপস্থাপনের অতীত; কেবল প্রার্থনার মাধ্যমে সহজাতভাবে অনুভব করা। সম্ভব।২৫ কিন্তু এই অভিজ্ঞতা কেবল অভিজাত বা সাধু শ্রেণীর জন্যে ছিল না; ফলে ক্রাইস্ট ঘোষিত রাজ্য হচ্ছে ঈশ্বরের বিলীন হওয়া যা পরকালের জন্যে অপেক্ষা না করেই সবাই ইহজগতেই অর্জন করতে পারে।

সুতরাং, সিমিয়নের কাছে ঈশ্বর জ্ঞাত ও অজ্ঞাত, কাছের ও দূরের । কেবল ভাষার সাহায্যে অনিবৰ্চনীয় বিষয়কে’২৬ বর্ণনার করার দুঃসাধ্য প্রয়াসের বদলে তিনি সাধুদের প্রতি নিজস্ব আত্মায় যা পরিবর্তনশীল সত্তা হিসাবে অনুভব করা সম্ভব সেদিকে মনোযোগ দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। এক দিব্যদর্শনের সময় ঈশ্বর সিমিয়নকে যেমন বলেছিলেন: ‘হ্যাঁ, আমিই ঈশ্বর, যে তোমাদের সাথেই মানুষে রূপান্তরিত হয়েছিল। আর দেখ, আমি তোমাদের সৃষ্টি করেছি, যেমন দেখতে পাচ্ছ; আর আমি তোমাকে ঈশ্বরে পরিণত করব।২৭ ঈশ্বর বাহ্যিক, বস্তুগত সত্য নন বরং আবশ্যিকভাবে অন্ত রের এবং ব্যক্তিগত আলোকপ্রাপ্তি ছিলেন। কিন্তু ঈশ্বর সম্পর্কে আলোচনায় অস্বীকৃতির কারণে সিমিয়নের সঙ্গে অতীতের ধর্মতত্ত্বীয় দর্শনের বিচ্ছেদ ঘটেনি। তাঁর নতুন ধর্মতত্ত্ব ফাদার্স অভ দ্য চার্চ-এর শিক্ষার ওপর দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত ছিল। হইমস অভ ডিভাইন লাভ-এ সিমিয়ন আথানাসিয়াস ও ম্যাক্সিমাস বর্ণিত মানুষের দেবত্বপ্রাপ্তির গ্রিক মতবাদ প্রকাশ করেছেন:

হে আলো, কেউ যার নাম বলতে পারে না, কারণ এর কোনও নামই নেই।
হে আলো, বহু নামধারী, কারণ এটা সব বস্তুতেই ক্রিয়াশীল…
ঘাসের সঙ্গে কীভাবে মেলাও তুমি নিজেকে?
কীভাবে, অপরিবর্তিত থেকে একেবারে দুর্গম হয়ে ঘাসের ধর্ম অটুট রাখ
তুমি?[২৮]

এই পরিবর্তন সম্পাদনকারী ঈশ্বরের সংজ্ঞা দেওয়া অর্থহীন, কারণ তিনি ভাষা ও বর্ণনার অতীত। তারপরেও মানুষের অখণ্ডতাকে অটুট রেখে তাকে পরিপূর্ণ ও বদলে দেওয়া অভিজ্ঞতা হিসাবে ‘ঈশ্বর এক তর্কাতীত বাস্তবতা। গ্রিকরা ঈশ্বর সম্পর্কে ট্রিনিটি ও ইনকারনেশনের মতো ধারণা গড়ে তুলেছিল যা তাদের অন্য একেশ্বরবাদীদের থেকে আলাদা করে দিয়েছে। তাসত্ত্বেও তাদের অতিন্দ্রীয়বাদীদের অভিজ্ঞতার সঙ্গে ইহুদি ও মুসলিমদের অতিন্দ্রীয় অভিজ্ঞতার প্রচুর মিল ছিল।

এমনকি পয়গম্বর মুহাম্মদ (স) প্রধানত একটা ন্যায়বিচার ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় মনোযোগি ছিলেন, কিন্তু তিনি ও তাঁর ঘনিষ্ঠ সহচরদের কয়েকজন অতিন্দ্রীয়বাদের দিকে ঝুঁকে ছিলেন। মুসলিমরা খুব দ্রুত নিজস্ব আলাদা অতিন্দ্রীয়বাদী ট্র্যাডিশন গড়ে তুলেছিল । অষ্টম ও নবম শতাব্দীতে ইসলামের অন্যান্য গোষ্ঠীর পাশাপাশি একটা ভাববাদী রূপও বিকাশ লাভ করেছিল; এই ভাববাদীরা রাজদরবারের আঁক ও উম্মাহর প্রাথমিককালের কৃচ্ছ্বতার অনুশীলন ত্যাগের ব্যাপারে মুতাযিলি ও শিয়াহদের মতোই উদ্বিগ্ন ছিল। পয়গম্বরের পছন্দ বলে কথিত উলের [আরবী সফ (sWF) তৈরি কর্কশ পোশাকে মদীনার আদি মুসলিমদের সরল জীবন ধারায় প্রত্যাবর্তনের প্রয়াস পেয়েছে তারা। পরবর্তীকালে এরাই সুফী’ নামে পরিচিতি পায়। সামাজিক ন্যায়বিচারের ব্যাপারটি এদের ধর্মানুরাগের মূল বিষয় রয়ে যায়, প্রয়াত ফরাসি পণ্ডিত লুই ম্যানিন যেমন ব্যাখ্যা দিয়েছেন:

অতিন্দ্রীয় আহ্বান নিয়ম হিসাবে সামাজিক অনাচারের বিরুদ্ধে বিবেকের অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহের ফল, কেবল অন্যদের নয়, বরং প্রধানত ও বিশেষভাবে নিজের অপরাধের বিরুদ্ধে, অন্তরের পরিশুদ্ধতার মাধ্যমে যেকোনও মূল্যে ঈশ্বরকে লাভ করার আকাঙ্ক্ষায় যা জোরদার হয়ে ওঠে।[২৯]

শুরুর দিকে অন্যান্য গোষ্ঠীর সঙ্গে সুফীদের অনেক মিল ছিল। এভাবে বিশিষ্ট মুতাযিলি যুক্তিবাদী ওয়াসিল ইবন আতা (মৃত্যু, ৭৪৮) পরবর্তীকালে সুফীবাদের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে পরিগণিত মদীনার দরবেশ হাসান আল-বসরির (মৃত্যু, ৭২৮) শিষ্য ছিলেন।

উলেমাগণ ইসলামকে একক ও সত্য ধর্ম হিসাবে বিবেচনা করে একে অন্যান্য ধর্ম হতে সম্পূর্ণ আলাদা করে নিচ্ছিলেন, কিন্তু সুফীগণ সঠিক পথে পরিচালিত সকল ধর্মের এক্যের কোরানের দর্শন মোটামুটি অনুসরণ করে গেছে। উদাহরণ স্বরূপ, জেসাস বহু সুফীর অভ্যন্তরীণ জীবনের পয়গম্বর হিসাবে সম্মানিত হয়েছেন। কেউ কেউ এমনকি ‘আল্লাহ্ ছাড়া আর কোনও প্রভু নেই এবং জেসাস তার বার্তাবাহক, উচ্চারণ করার জন্যে বিশ্বাসের ঘোষণা শাহাদা পরিবর্তন করেছে যা কৌশলগত দিক থেকে শুদ্ধ কিন্তু উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে তর্কোদ্দীপক। কোরান যেখানে আতঙ্ক ও ভয় জাগানো ন্যায়বিচারের ঈশ্বরের কথা বলে, সেখানে প্রাথমিক ভাববাদী নারী রাবিয়াহ (মৃত্যু, ৮০১) এমনভাবে ভালোবাসার কথা বলেছেন, ক্রিশ্চানরা তাঁকে পরিচিত আবিষ্কার করত:

দুভাবে আমি তোমায় ভালোবাসি: স্বার্থপরের মতো,
এবং তারপর, যা তোমার উপযুক্ত।
আমার ভালোবাসা স্বার্থপর ভালোবাসা নয়,
কেবল সারাক্ষণ আমি তোমারই কথা ভাবি।
নিখাদ এই ভালোবাসা যখন তুমি তুলে ধর
আমার বিমুগ্ধ দৃষ্টির আবরণ।
সেখানে বা এতে আমার প্রশংসা নেই:
উভয় প্রশংসাই তোমার, আমি বিশ্বাস করি।

এটা তাঁর সুবিখ্যাত প্রার্থনার কাছাকাছিঃ ‘হে প্রভু! যদি আমি নরকের শাস্তির ভয় থেকে তোমার উপাসনা করি, আমাকে নরকের আগুনে পুড়িয়ে; যদি স্বর্গের প্রলোভনে উপাসনা করি, আমাকে স্বর্গ হতে বঞ্চিত করো, কিন্তু যদি কেবল তোমার জন্যেই উপাসনা করি, তোমার চিরন্তন সৌন্দর্য থেকে বঞ্চিত করে রেখো না।” ঈশ্বর-প্রেম সুফীবাদের মূল সুরে পরিণত হয়েছে। সুফীরা হয়তো বা নিকট প্রাচ্যের ক্রিশ্চান ভাববাদীদের দ্বারা ভালোভাবেই প্রভাবিত হয়ে থাকবে, তবে মুহাম্মদ (স) ব্যাপক প্রভাব বিস্তারকারী হিসাবে বয়ে গেছেন। প্রত্যাদেশ পাওয়ার সময় মুহাম্মদের (স) যেমন অনুভূতি হয়েছিল অবিকল সেই অনুভূতি লাভের আকাঙ্ক্ষা করেছে তারা। স্বাভাবতই, তার অতিন্দ্রীয় স্বর্গারোহণের ঘটনার দ্বারাও অনুপ্রাণিত হয়েছেন তারা, যা তাদের ঈশ্বর বোধের আদর্শে পরিণত হয়।

সচেতনতার এক বিকল্প অবস্থা অর্জনে গোটা দুনিয়ার অতিন্দ্রীয়বাদীদের সাহায্যকারী কৌশল ও অনুশীলনও আবিষ্কার করেছে তারা। মুসলিম আইনের মৌল চাহিদার অতিরিক্ত উপবাসের রেওয়াজ, রাত্রি জাগরণ ও মন্ত্রের মতো স্বর্গীয় নাম জপার বিষয় যোগ করেছে। এইসব চর্চার ফলে মাঝে মাঝে এমন সব আচরণের সৃষ্টি হতো যাকে অদ্ভুত ও অনিয়ন্ত্রিত মনে হতো। এসব অতিন্দ্রীয়বাদীরা ‘মাতাল’ সুফী হিসাবে পরিচিত ছিল। এদের মাঝে সর্বপ্রথমজন ছিলেন আবু ইয়াযিদ বিস্তামি (মৃত্যু, ৮৭৪), রাবিয়াহর মতো প্রেমিক রূপে ঈশ্বরের নৈকট্য প্রত্যাশা করেছিলেন তিনি। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, মানবীয় প্রেমের ক্ষেত্রে নারীকে খুশী করার মতোই আল্লাহকে খুশি করতে প্রয়াস পেতে হবে যাতে নিজের সমস্ত প্রয়োজন ও চাহিদা বিসর্জন দিয়ে প্রেমাস্পদের মাঝে বিলীন হয়ে যেতে পারেন। কিন্তু অর্জনের জন্যে যে অন্ত মূখী অনুশীলনের আবিষ্কার করেছিলেন সেটা তাকে তার ব্যক্তিরূপ ঈশ্বরের ধারণার ঊর্ধ্বে নিয়ে গিয়েছিল । আপন পরিচয়ের অন্তস্তলে পৌঁছে আবিষ্কার করেছেন যে, ঈশ্বর ও তার মাঝে কোনও বাধা নেই; প্রকৃতপক্ষে যা কিছু তিনি ‘সত্তা’ হিসাবে জানতেন, তা যেন বিলীন হয়ে গেছে:

সত্যের চোখ দিয়ে আমি আল্লাহর দিকে তাকালাম এবং তাঁকে বললাম: ‘কে এটা? তিনি বললেন: “আমিও নই, আবার আমি ছাড়া অন্য কেউও নয়। আমি ছাড়া আর কোনও প্রভু নেই। তারপর আমাকে আমার পরিচয় হতে পরিবর্তিত করে তার সত্তায় গ্রহণ করলেন….তারপর আমি তার মুখের জিহ্বার সাহায্যে তার সঙ্গে ভাব বিনিময় করলাম, বললাম আমার সঙ্গে তোমার কী ঘটেছে?’ তিনি বললেন, তোমার মাঝেই আমি; তুমি ছাড়া আর কোনও প্রভু নেই।৩২

কিন্তু আবারও, মানবজাতির মহাকাশে বাহ্যিক কোনও উপাস্য ছিল না এটা। ঈশ্বর রহস্যজনকভাবে গভীরতম সত্তার সঙ্গে একীভূত অবস্থায় আবিষ্কৃত হয়েছেন। অহমবোধের পদ্ধতিগত বিনাশ এক বৃহৎ অনির্বচনীয় সত্তায় বিলীন হওয়ার অনুভূতির দিকে নিয়ে যায়। বিলীন (ফানা) হয়ে যাবার এই অবস্থাটি সুফী আদর্শের মূল বিষয়ে পরিণত হয়। অন্য বহু মুসলিম কোরান নির্দেশিত প্রকৃত ইসলামের উপলব্ধি হিসাবে স্বীকার করে না নিলে বিস্তামি যেভাবে শাহাদার নতুন। ব্যাখ্যা তুলে ধরেছেন তাকে ব্লাসফেমাস বলেই অভিহিত করা হতে পারত।

‘সোবার’ সুফী বলে পরিচিত অপর অতিন্দ্রীয়বাদীরা অপেক্ষাকৃত কম কোলাহলময় আধ্যাত্মিকতার পক্ষপাতি ছিল। ভবিষ্যতের সকল ইসলামি অতিন্দ্রীয়বাদীদের মূল নকশা প্রণয়নকারী বাগদাদের আল জুনায়েদ (মৃ. ৯১৯) বিশ্বাস করতেন যে, বিস্তামির চরম পন্থা বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়াতে পারে। তিনি শিক্ষা দিয়েছিলেন যে ফানা (বিলীন) কে অবশ্য বাকা-এক বর্ধিত সত্তায় প্রত্যাবর্তন করা-দ্বারা অনুসৃত হতে হবে। ঈশ্বরের সঙ্গে মিলনে আমাদের স্বাভাবিক ক্ষমতাবলী ধ্বংস হওয়া চলবে না, বরং তা সম্পূর্ণতা পাবে: আপন সত্তার গভীর মর্মমূলে স্বর্গীয় সত্তা আবিষ্কার করার জন্যে প্রতিবন্ধক অহমবোধকে ছিন্নভিন্নকারী একজন সুফীর বাড়তি আত্মোপলব্ধি ও আত্মনিয়ন্ত্রণবোধের অধিকারী হওয়ার কথা। সে আরও বেশি করে সম্পূর্ণ মানুষ হয়ে উঠবে। সুতরাং, সুফীরা যখন ‘ফানা ও বাকা’র অনুভূতি তর্জন করেছে তখন এমন এক অবস্থা অর্জন করেছিল গ্রিক ক্রিশ্চানরা যাকে ‘দেবত্বপ্রাপ্তি’ বলবে। আল জুনায়েদ গোটা সুফী অনুসন্ধানকে সৃষ্টির মুহূর্তে মানুষের আদিম রূপে প্রত্যাবর্তন হিসাবে দেখেছেন: সে ঈশ্বরের কাক্ষিত আদর্শ মানব সত্তায় ফিরে যাচ্ছে। আপন সত্তা বা অস্তিত্বের উৎসেও ফিরে যাচ্ছে সে। প্লেটোনিক বা নস্টিক অভিজ্ঞতার মতো বিচ্ছিন্ন হওয়া এবং দূরত্ব সৃষ্টি সুফীদের কাছেও মৌলিক বিষয় ছিল: এটা সম্ভবত আজকাল ফ্রয়েডিয় ও ক্লিনিয়রা যে বিচ্ছিন্নতার কথা বলে তা থেকে আলাদা নয়, যদিও সাইকোঅ্যানালিস্টরা এর পেছনে নিরীশ্বরবাদী উৎসের কথা বলেন। আল জুনায়েদ শিক্ষা দিয়েছেন, তাঁর মতো অভিজ্ঞ ও দক্ষা সুফী শিক্ষকের (পির) তত্ত্বাবধানে একজন মুসলিম স্রষ্টার সঙ্গে মিলিত হয়ে ঈশ্বরের প্রত্যক্ষ উপস্থিতির অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারে, কোরান অনুসারী যে অভিজ্ঞতা আদমের কুঁচকি থেকে তাঁকে বিচ্ছিন্ন করার সময় সে অর্জন করছিল। এটা বিচ্ছিন্নতা ও বিষাদের সমাপ্তি। এটা গভীর সত্তার সঙ্গে মিলন, যে সত্তা বিশেষ নারী বা পুরুষটির হওয়ার কথা ছিল। ঈশ্বর বিচ্ছিন্ন বাহ্যিক কোনও সত্তা ও বিচারক নন, বরং কোনওভাবে প্রতিটি সত্তার মূলে একীভূত:

এখন আমি জানতে পেরেছি, হে প্রভু,
কী আছে আমার অন্তরে;
গোপনে, গোটা জগৎ হতে বিচ্ছিন্ন,
আমার জিভ আমার পূজনীয়র সাথে কথা বলেছে।
সুতরাং, এক অর্থে আমরা
আমরায় একীভূত, এবং এক;
কিন্তু অন্যভাবে বিচ্ছেদ
আমাদের চিরকালীন অবস্থা।

যদিও আমার দৃষ্টির সামনে
থেকে তোমার সত্তার গভীর আতঙ্ক আড়াল করে রেখেছ,
বিস্ময়ভরা ও প্রবল ভারময় আশীর্বাদে
আমি অনুভর করি আমার গভীর ভিত্তি ছুঁয়েছ তুমি।

একত্বের ওপর গুরুত্ব আরোপ কোরানের তৌহীদের আদর্শের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়: আপন তুচ্ছ অমোঘ মত্ত সত্তাকে নিয়ন্ত্রণের ভেতর দিয়ে অতিন্দ্রীয়বাদী ব্যক্তিগত সংহতিতে স্বর্গীয় সত্তা অনুভব করবে।

অতিন্দ্রীয়বাদের বিপদ সম্পর্কে গভীরভাবে সচেতন ছিলেন আল জুনায়েদ। পিরের পরামর্শ লাভ করেনি ও কঠিন সুফী প্রশিক্ষণবিহীন ব্যক্তিদের পক্ষে অতিন্দ্রীয়বাদী পরমানন্দের অনুভূতিকে ভুল বোঝা খুবই সহজ হয়ে দাঁড়াতে পারে; নিজেকে তখন ঈশ্বরের সঙ্গে বিলীন হয়ে যাওয়ার কথা বলতে গিয়ে হয়তো খুব সরল অর্থ করে বসবে সে। আল-বিস্তামির মতো ব্যক্তিদের অসংজত দাবি নিঃসন্দেহে শাসকযন্ত্রের বিরক্তি সৃষ্টি করেছিল। একেবারে গোড়ার দিকে সুফীবাদ একটি সংখ্যালঘু আন্দোলনে সীমিত ছিল। উলেমাগণ প্রায়ই একে অসত্য আবিষ্কার হিসাবে বিবেচনা করেছেন। জুনায়েদের বিখ্যাত শিষ্য হুসেইন ইবন মনসুর (সাধারণভাবে ইনি আল-হাল্লাজ বা উল-কার্ডার নামে পরিচিত) অবশ্য সকল সাবধানতা হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়েছিলেন; পরিণত হয়েছিলেন অতিন্দ্রীয়বাদী বিশ্বাসের শহীদ। খেলাফতের উৎখাত ও এক নতুন সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার আন্দোলন চালিয়ে গোটা ইরাক ঘুরে বেড়াতে গিয়ে কর্তৃপক্ষের হাতে প্রথমে বন্দি এবং পরে তাঁর আদর্শ জেসাসের মতো ক্রুশবিদ্ধ হয়ে জীবন দিয়েছিলেন তিনি। পরমানন্দের মুহূর্তে আল-হাল্লাজ চিৎকার করে বলে উঠছিলেন: “আমিই সত্য।’ গস্পেলসমূহের বিবরণ অনুযায়ী জেসাসও নিজেকেই পথ, সত্য ও জীবন বলে আখ্যা দিয়ে একই দাবি করেছিলেন । ক্রাইস্টের দেহে ঈশ্বরের অবতারের খৃস্টিয় বিশ্বাসকে কোরান বারবার ব্লাসফেমাস বলে নিন্দা জানিয়েছে, সুতরাং আল-হাল্লাজের আনন্দ-চিৎকারে মুসলিমদের আশঙ্কিত হয়ে ওঠাটা বিচিত্র কিছু নয়। আল-হক আল্লাহর অন্যতম নাম, তুচ্ছ মরণশীল কারও পক্ষে এ উপাধি দাবি করাটা বহুঈশ্বরবাদীতার শামিল । আর-হাল্লাজ আল্লাহর সঙ্গে তার একীভূত হওয়ার অনুভূতিকে প্রকাশ করেছিলেন যাকে কিনা নিজেকে তাঁর একীভূত হওয়ার মতো মনে হয়েছিল । তিনি তাঁর এক কবিতায় যেমন বলেছেন:

আমিই সে যাকে আমি ভালোবাসি, এবং আমি যাকে ভালোবাসি সে আমি:
আমরা এক দেহে দুটি আত্মা।
যদি তুমি আমাকে দেখ, তাকে দেখতে পাবে,
যদি তাকে দেখতে পাও, তাহলে আমাদের দুজনকেই দেখবে।

গুরু আল-জুনায়েদ সত্তার বিলোপ ও ঈশ্বরের সঙ্গে মিলিত হওয়ার অনুভূতিকে ফানা আখ্যায়িত করেছেন, এটা তাঁরই দুঃসাহসী প্রকাশ। ব্লাসফেমির অভিযোগে অভিযুক্ত আল-হাল্লাজ তার দাবি প্রত্যাহারে অস্বীকৃতি জানিয়ে প্রকৃত সন্ন্যাসীর মৃত্যুকে বেছে নেন।

ক্রুশবিদ্ধ করার জন্যে নিয়ে যাওয়া হলে ক্রুশ ও শূল দেখার পর সমবেত জনতার দিকে তাকিয়ে তিনি এক প্রার্থনাবাণী উচ্চারণ করেন, যার সমাপ্তিটুকু ছিল এরকম: “আর তোমার যেসব দাস তোমার ধর্মের রক্ষায় ও তোমার করুণা লাভের উদ্দেশ্যে আমাকে কতল করবে বলে সমবেত হয়েছে, হে প্রভু, তোমার করুণায় তাদের ক্ষমা করে দাও, তাদের ওপর দয়া বর্ষণ কর; কারণ নিশ্চয়ই তুমি আমার কাছে নিজেকে যেভাবে প্রকাশ করেছ সেভাবে ওদের সামনে প্রকাশিত হলে, ওরা যা করেছে তা করতে পারত না; আজ ওদের কাছে যা গোপন রেখেছ তা যদি তুমি আমার কাছেও গোপন রাখতে তাহলে আমাকে এই দুর্দশার মুখোমুখি হতে হতো না। তোমার সকল কাজই মহিমান্বিত এবং তোমার সকল ইচ্ছাই মহান।’[৩৫]

আল-হাল্লাজের উচ্চারণ আনা আল-হক:-’আমিই সত্য!’-দেখায় যে, অতিন্দ্রীয়বাদীদের ঈশ্বর বস্তুগত সত্তা নন বরং গভীরভাবে ভক্তিমূলক। পরে আল-গাযযালি যুক্তি দেখিয়েছেন, আল-হাল্লাজ ব্লাসফেমি করেননি, বরং অনভিজ্ঞদের বিভ্রান্ত করতে পারে এমন একটি নিগূঢ় সত্য প্রকাশ করে অপরিপক্কতার পরিচয় দিয়েছেন মাত্র। যেহেতু আল্লাহ্ ছাড়া আর কোনও সত্তা নই-শাহাদাহ্ যেমনটি বুঝিয়ে থাকে-সকল মানুষই অত্যাবশ্যকীয়ভাবে স্বর্গীয়। কোরান শিক্ষা দিয়েছে, ঈশ্বর তাঁর অবিকল প্রতিমূর্তিতে আদমকে সৃষ্টি করেছেন যাতে তিনি আয়নায় নিজেকে দেখার মতো করে ধ্যানমগ্ন হতে পারেন। সেকারণেই তিনি ফেরেশতাদের প্রথম মানুষের সামনে মাথা নত করে উপাসনার নির্দেশ দিয়েছিলেন। সুফীরা যুক্তি দেখিয়েছে যে, ক্রিশ্চানরা মাত্র একজন ব্যক্তিকে গোটা স্বর্গীয় সত্তা ধারণকারী হিসাবে গ্রহণ করে ভুল করেছিল। আপন সত্তার মাঝে ঈশ্বরের মূল দর্শন আবিষ্কারকারী অতিন্দ্রীয়বাদী সৃষ্টির প্রথম দিনে যেমন ছিল নিজের মাঝেই তেমনি নতুন করে স্বর্গীয় ইমেজ আবিষ্কার করছে। সুফীদের অত্যন্ত পছন্দের পবিত্র বিবরণী হাদিসে কুদসি দেখায়, ঈশ্বর মুসলিমদের এমনভাবে নিজের দিকে আকর্ষণ করেন যে মনে হয় তিনি তাঁর প্রত্যেক দাসের মাঝে স্থান করে নিয়েছেন: আমি যখন তাকে ভালোবাসি, আমি তার কান হয়ে যাই, যা দিয়ে সে শোনে, চোখ হই যা দিয়ে সে দেখে, হাতে পরিণত হই যা দিয়ে সে ধরে এবং পা হয়ে যাই যা দিয়ে সে হাঁটে।’ আল-হাল্লাজের কাহিনী অতিন্দ্রীয়বাদী ও ধর্মীয় প্রশাসনের সম্ভাব্য গভীর বৈরিতাকেও তুলে ধরে, যাদের ঈশ্বর ও প্রত্যাদেশ সম্পর্কে ভিন্ন ধারণা রয়েছে। অতিন্দ্রীয়বাদীর কাছে প্রত্যাদেশ এমন একটি ঘটনা যা তার আপন আত্মায় সংঘটিত হয়, কিন্তু প্রথাগত ধারণায় যারা বিশ্বাসী, যেমন উলেমাহদের বেলায় এ ঘটনা সম্পূর্ণই অতীতের ব্যাপার। কিন্তু আমরা দেখেছি, একাদশ শতাব্দীতে ইবন সিনা ও স্বয়ং আল গাযযালির মতো মুসলিম দার্শনিকরা ঈশ্বরের বস্তুনিষ্ঠ বিবরণ অসন্দোষজনক আবিষ্কার করে অতিন্দ্রীয়বাদের শরণাপন্ন হয়েছেন। আল-গাযযালি সুফীবাদকে এস্টাবলিশমেন্টের কাছে গ্রহণীয় করে তুলেছিলেন; দেখিয়েছিলেন যে, এটাই মুসলিম আধ্যাত্মিকতার সবচেয়ে খাঁটি রূপ। দ্বাদশ শতাব্দীতে ইরানী দার্শনিক ইয়াহিয়া সুহরাওয়ার্দি এবং স্প্যানিশ বংশোদ্ভুত মুঈদ আদ-দিন ইবন আল-আরাবী ইসলামি ফালসাফাহকে অতিন্দ্রীয়বাদের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত করে ইসলামি সাম্রাজ্যের বহু স্থানেই অতিন্দ্রীয়বাদীদের অনুভূত ঈশ্বরকে সাধারণ মাপকাঠিতে পরিণত করেন। অবশ্য আল-হাল্লাজের মতো সুহরাওয়ার্দিও ১৯৯১ সালে আলেপ্পোতে অস্পষ্ট কারণে উলেমাদের হাতে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছিলেন। তিনি তাঁর ভাষায় আদি ‘প্রাচ্য ধর্মকে ইসলামের সঙ্গে যুক্ত করাকে জীবনের ব্রত হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন এবং এভাবে ইবন সিনা প্রস্তাবিত প্রকল্পের সমাপ্তি টানতে চেয়েছেন। তাঁর দাবি ছিল প্রাচীন কালের সকল সাধুই একটিমাত্র মতবাদ প্রচার করে গেছেন। আদিতে হারমিসের-সুহরাওয়ার্দী যাকে কোরানে উল্লেখিত পয়গম্বর ইদ্রিস এবং বাইবেলে বর্ণিত ইনোক বলে শনাক্ত করেছেন-কাছে প্রকাশিত হয়েছিল; গ্রিক বিশ্বে প্লেটো ও পিথাগোরাস এবং মধ্যপ্রাচ্যে যরোস্ট্রীয় ম্যাজাইদের মাধ্যমে প্রচারিত হয়েছিল। অবশ্য অ্যারিস্টটলের পরবর্তী সময় থেকে এটা অপেক্ষাকৃত সংকীর্ণ বুদ্ধিবৃত্তিক ও মস্তিষ্কজাত দর্শনের ফলে চাপা পড়ে যায়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত আল-বিস্তামি ও আল-হাল্লাজ হয়ে স্বয়ং সুহরাওয়ার্দির কাছে পৌঁছানোর আগে পর্যন্ত সাধু পরম্পরায় গোপনে বাহিত হয়ে আসছিল। এই চিরন্তন দর্শন অতিন্দ্রীয়বাদী ও কল্পনানির্ভর কিন্তু যুক্তিকে বিসর্জন দিতে বলেনি। সুহরাওয়ার্দি বুদ্ধিবৃত্তির দিক থেকে আল-ফারাবির মতোই কঠোর নিয়মনিষ্ঠ ছিলেন, কিন্তু তেমনি আবার সত্যের অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে অনুভূতির গুরুত্বের ওপর জোর দিয়েছেন। কোরান যেমন শিক্ষা দিয়েছে: সকল সত্য ঈশ্বর হতে আগত এবং সর্বত্রই সত্যের সন্ধান করা উচিত। একেশ্বরবাদের মতো পৌত্তলিকতাবাদ ও যরোস্ট্রিয়বাদেও এর দেখা মিলতে পারে। গোঁড়া ধর্মের বিপরীতে, নিজেকে যা গোত্রীয় বিরোধের দিকে ঠেলে দেয়, অতিন্দ্রীয়বাদ প্রায়শঃই দাবি করে যে, মানুষের মতো ঈশ্বরের কাছে যাবারও অসংখ্য পথ রয়েছে। সুফীবাদ বিশেষ করে অন্যদের ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রতি অসাধারণ উপলব্ধি গড়ে তুলেছে।

সুহরাওয়ার্দিকে প্রায়শঃই শেখ আল-ইশরাক বা আলোকনের গুরু আখ্যায়িত করা হয়। গ্রিকদের মতো আলো রূপে ঈশ্বরের অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন তিনি। আরবী ভাষায় ইশরাক বলতে পুব আকাশে দেখা দেওয়া ভোরের প্রথম আলো ও আলোকন বোঝায়। সুতরাং প্রাচ্য ভৌগলিক কোনও স্থান নয়, বরং আলো ও শক্তির উৎস। সুতরাং সুহরাওয়ার্দির প্রাচ্য ধর্ম বিশ্বাসে মানুষ অস্পষ্টভাবে আপন উৎসকে স্মরণ করতে পারে, এই ছায়াচ্ছন্ন জগতে অস্বস্তিবোধ করে সে এবং আদি-আশ্রয়ে ফিরে যাবার আকাঙ্ক্ষায় থাকে। সুহরাওয়ার্দি দাবি করেছেন যে, তার দর্শন মুসলিমদের কল্পনার সাহায্যে চিরন্তন প্রজ্ঞাকে পরিশুদ্ধ করার জন্যে সত্য অবস্থান খুঁজে পেতে সাহায্য করবে।

সুহরাওয়ার্দির অসম্ভব জটিল দর্শন বা পদ্ধতির উদ্দেশ্য ছিল গোটা বিশ্বের সকল ধর্মীয় দর্শনকে একটি মাত্র আধ্যাত্মিক ধর্মে সংযুক্ত করা। যেখানে পাওয়া যায় সেখানেই সত্যের সন্ধান করতে হবে। পরিণামে তাঁর দর্শন ইসলাম-পূর্ব ইরানি সৃষ্টিতত্ত্বকে টলেমিয় প্ল্যানেটারি সিস্টেম ও উৎসারণের নিওপ্লেটোনিক প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত করেছিল। তা সত্ত্বেও অন্য কোনও ফায়লাসুফ এত ব্যাপকভাবে কোরান হতে উদ্ধৃতি দান করেনি। সৃষ্টিতত্ত্ব আলোচনার সময় সুহরাওয়ার্দি প্রাথমিকভাবে বিশ্বজগতের বস্তুগত উৎস সম্পর্কে আগ্রহ দেখাননি। তাঁর অসাধারণ রচনা দ্য উইজডম অভ ইল্লিউমিনেশন-এ সুহরাওয়ার্দি পদার্থবিদ্যা ও প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের সমস্যা নিয়ে আলোচনা শুরু করেছেন, কিন্তু সেটা ছিল কেবল তাঁর রচনার অতিন্দ্রীয়বাদী অংশের ভূমিকা মাত্র। ইবন সিনার মতো তিনিও ফালসাফাহ্র সম্পূর্ণ যৌক্তিক এবং বস্তুনিষ্ঠতায় অসন্তুষ্ট হয়ে উঠেছিলেন, যদিও সামগ্রিক সত্তার অনুধাবনে যৌক্তিক ও মেটাফিজিক্যাল আঁচ-অনুমানের স্থান আছে বলে মনে করতেন তিনি। তাঁর মতে একজন প্রকৃত সাধু দর্শন ও অতিন্দ্রীয়বাদ উভয় ক্ষেত্রেই সফল। পৃথিবীতে এমন একজন সাধু সবসময়ই থাকেন। শিয়াদের ইমামবাদের খুব কাছাকাছি এক তত্ত্বে সুহরাওয়ার্দি তাঁর বিশ্বাস তুলে ধরেছেন যে, এই আধ্যাত্মিক নেতাই প্রকৃত খুঁটি যার উপস্থিতি ছাড়া এই পৃথিবী টিকে থাকতে পারত না, যদি তিনি আড়ালেও থাকেন। সুহরাওয়ার্দির ইশরাকি অতিন্দ্রীয়বাদের চর্চা এখনও ইরানে চালু আছে। বিশেষ ধরনের বলেই নিগূঢ় ব্যবস্থা নয় এটি বরং এতে ইসমায়েলি ও সুফীদের মতো বিশেষ আধ্যাত্মিক ও কল্পনানির্ভর প্রশিক্ষণের প্রয়োজন হয়।

গ্রিকরা হয়তো সুহরাওয়ার্দির পদ্ধতিকে কোরিগম্যাটিক না বলে ডগম্যাটিক আখ্যায়িত করত। তিনি সকল ধর্ম ও দর্শনের মূলে লুকায়িত কল্পনানির্ভর মূল বিষয়টি আবিষ্কারের প্রয়াস পেয়েছিলেন। যদিও যুক্তিকে যথেষ্ট মনে করেননি, তবুও গভীরতম রহস্যসমূহ নিয়ে অনুসন্ধানের অধিকার অস্বীকার যাননি কখনও। নিগূঢ় অতিন্দ্রীয়বাদের মতো বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদেও সত্যের সন্ধান করতে হবে। সমালোচনামূলক বুদ্ধিবৃত্তির সাহায্যে অনুভূতিকে জ্ঞাত ও অনুপ্রাণিত করে তুলতে হবে।

নাম হতে যেমন বোঝায়, ইশরাকি দর্শন মূল বিষয় আলোর প্রতীক যাকে ঈশ্বরের নিখুঁত সমার্থক হিসাবে দেখা হয়েছে। এটা (অন্তত দ্বাদশ শতাব্দীতে) অবস্তুগত ও সংজ্ঞাতীত ছিল, কিন্তু তারপরও জীবনের সবচেয়ে বড় সত্যও ছিল: সম্পূর্ণভাবে স্বপ্রকাশিত; এর সংজ্ঞা দেওয়ার কোনও প্রয়োজন ছিল না; কিন্তু জীবন ধারণ সম্ভব করে তোলা উপাদান হিসাবে সবার উপলব্ধিতে ছিল। এটা ছিল সর্বব্যাপী: বস্তুর সমস্ত ঔজ্জ্বল্য সরাসরি তাদের বহিস্ত এক উৎস। আলোর কাছ থেকে পাওয়া। সুহরাওয়ার্দি উৎসারণবাদী সৃষ্টিতত্ত্বে আলো সমূহের আলো ফায়লাসুফদের প্রয়োজনীয় সত্তার সমার্থক, যা অবিমিশ্র সরল । এটা নিম্নমুখী ধারাক্রম অনুযায়ী পর্যায়ক্রমিকভাবে নিম্নতর আলো তৈরি করে; প্রতিটি আলো আলোসমূহের আলোর ওপর নিজের নির্ভরশীলতা উপলব্ধি করে। একটা ছায়া-সত্তা গঠন করে যা টলেমিয় বলয়সমূহের অনুরূপ বস্তুজগতের উৎস। এটা ছিল মানুষের দুর্দশার এক উপমা। আমাদের সবার মাঝেই এরকম আলো-আঁধারের সমাবেশ রয়েছে। পবিত্র আত্মার মাধ্যমে (ইবন সিনার প্রকল্পে আমাদের জগতের আলো জিব্রাইল ফেরেশতা বলেও পরিচিত) জ্বণে । আলো বা আত্মা প্রবিষ্ট করানো হয় । আত্মার আলোর সর্বোচ্চ জগতের সঙ্গে মিলিত হবার আকাঙ্ক্ষায় থাকে। নির্দিষ্ট সময়ে কুতব (সাধু) বা তাঁর কোনও শিষ্যের হাতে সঠিকভাবে নির্দেশনা লাভ করলে ইহজগতেই তার পক্ষে এর একটা আভাস লাভ সম্ভব।

সুহরাওয়ার্দি হিকমাত-এ তাঁর আপন আলোকনের অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়েছেন। জ্ঞান-বিজ্ঞানের তাত্ত্বিক সমস্যায় আক্রান্ত ছিলেন তিনি, কিন্তু কোনও সুরাহা খুঁজে পাচ্ছিলেন নাঃ গ্রন্থগত বিদ্যা হতে কিছুই জানতে পারেননি। তখন সহসা ইমাম, বা কুতব, আত্মার আরোগ্যকারীর দর্শন লাভ করেন।

সহসা কোমলতায় আবৃত হলাম আমি; চোখ ধাঁধানো ঝলক দেখলাম, তারপর মানুষের মতো স্বচ্ছ আলো চোখে পড়ল। মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগলাম আমি, এবং ওই যে তিনি…আমার কাছে এগিয়ে এলেন তিনি, এত কোমলভাবে স্বাগত জানালেন যে আমার বিস্ময়ানুভূতি মুছে গেল, আমার ভয় পরিচয়ে রূপ নিল। তারপর আমি জ্ঞানের ব্যাপারে, সমস্যার ব্যাপারে তাঁর কাছে অভিযোগ তুললাম ।
‘নিজেকে জাগিয়ে তোল, আমাকে বললেন তিনি, ‘তোমার সমস্যা মিটে যাবে।’[৩৭]

সজাগ বা আলোকপ্রাপ্ত হওয়ার প্রক্রিয়া পয়গম্বরত্ব লাভের কষ্টকর প্রবল অনুপ্রেরণা হতে একেবারেই আলাদা। এর সঙ্গে বুদ্ধের শান্ত আলোকনের বরং অনেক বেশি মিল ছিল: অতিন্দ্রীয়বাদ ঈশ্বরের ধর্মে অপেক্ষাকৃত শান্ত আধ্যাত্মিকতার সূচনা করছিল। বাহ্যিক কোনও সত্তার সঙ্গে সংঘাতের বদলে স্বয়ং অতিন্দ্রীয়বাদীর অন্তর হতে আলোকপ্রাপ্তি ঘটবে। এখানে সত্য অবহিত করার কোনও ব্যাপার ছিল না। তার বদলে মানবীয় কল্পনার অনুশীলন মানুষকে আলাম আল-মিথাল-খাঁটি প্রতিরূপের জগতের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে ঈশ্বরে প্রত্যাবর্তনে সক্ষম করে তুলবে।

সুহরাওয়ার্দি ইরানের প্রাচীন স্বর্গীয় আদি আদর্শ জগতের বিশ্বাসে ফিরে গিয়েছেন, যেখানে গেতিক (জাগতিক, বস্তুগত পৃথিবী)-এর প্রত্যেক ব্যক্তি ও বস্তুর আবার মেনকে (স্বর্গীয় রাজ্য) অবিকল মূর্তি রয়েছে। অতিন্দ্রীয়বাদ ঈশ্বর-ধর্মসমূহ কর্তৃক পবিত্যক্ত প্রাচীন মিথলজিকে পুনরুজ্জীবিত করে তুলেছিল। সুহরাওয়ার্দি প্রকল্পে আলাম আল-মিথাল-এ পরিণত মেনক এখন আমাদের জগৎ ও ঈশ্বরেব মাঝে অবস্থিত মধ্যবর্তী এক জগৎ। যুক্তি বা ইন্দ্রিয় বোধ দিয়ে একে বোঝা যাবে না। সৃজনশীল কল্পনার গুণই আমাদেরকে গুপ্ত আদর্শজগৎ আবিষ্কারে সক্ষম করে তুলেছে, ঠিক কোরানের প্রতীকী ব্যাখ্যা যেভাবে এর প্রকৃত আধ্যাত্মিক অর্থ প্রকাশ করেছে। আলাম আল-মিথাল ইসলামের আধ্যাত্মিক ইতিহাস সম্পর্কে ইসমায়েলিদের ধারণা কিংবা ইবন সিনার দেবদূতবিদ্যার কাছকাছি, আগের অধ্যায়ে আমরা এনিয়ে আলোচনা করেছিঃ যা জাগতিক ঘটনাবলীর প্রকৃত অর্থ বহন করে । ইসলামের পরবর্তীকালে অতিন্দ্রীয়বাদীদের জন্যে তাদের অভিজ্ঞতা ও দিব্যদর্শনের ব্যাখ্যা দেওয়ার ক্ষেত্রে এটা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। সুহরাওয়ার্দি এমন সব দিব্যদর্শন নিয়ে পৰীক্ষা করছিলেন যা অসংখ্য এবং বিভিন্ন সংস্কৃতির শামান, অতিন্দ্রীয়বাদী বা দরবেশ যেই প্রত্যক্ষ করে থাকুক না কেন বিস্ময়করভাবে একরকম। সাম্প্রতিককালে এ বিষয়টিকে ঘিরে বেশ উৎসাহ সৃষ্টি হয়েছে। জাং-এর সম্মিলিত চেতনাহীনতার ধারণাটি মানুষের এই সাধারণ কল্পনা নির্ভর অভিজ্ঞতাকে যাচাই করার সবচেয়ে বিজ্ঞান ভিত্তিক প্রয়াস। রোমানীয়-আমেরিকান ধর্মীয় দার্শনিক মির্চা এলিয়াদের মতো অন্য পণ্ডিতগণ দেখানোর প্রয়াস পেয়েছেন কীভাবে প্রাচ্যীয় কবিদের মহাকাব্য এবং বিশেষ ধরণের কিছু রূপকথা ভাববাদী অভিযাত্রা ও অতিন্দ্রীয়বাদী যাত্রা হতে নেওয়া হয়েছে।[৩৮]

সুহরাওয়ার্দি জোর দিয়ে বলেছেন যে, অতিন্দ্রীয়বাদীদের দিব্যদর্শন ও ঐশীগ্রন্থের প্রতীকসমূহ-যেমন, স্বর্গ, নরক ও শেষ বিচার-আমাদের এই পৃথিবীর অভিজ্ঞতার মতোই বাস্তব, তবে একই রকম নয়। এগুলো প্রথাগতভাবে প্রমাণ করা যাবে না, কিন্তু কল্পনার ক্ষমতা দিয়ে বোঝা যাবে, দিব্যদ্রষ্টাকে যা জাগতিক ঘটনাবলীর আধ্যাত্মিক মাত্রা দেখায় সক্ষম করে তোলে। যাদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ নেই তারা এই অভিজ্ঞতা বোধ করতে পারে না, ঠিক যেমন প্রয়োজনীয় নৈতিক ও মানসিক অনুশীলনে অভ্যস্ত হওয়ার পরেই কেবল বৌদ্ধদের আলোকন লাভ সম্ভব। আমাদের সকল চিন্তা, ধ্যান ধারণা, আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন ও দর্শন আলম-আল মিথালের বাস্তবতার অনুরূপ । উদাহরণস্বরূপ, পয়গম্বর মুহাম্মদ (স) রাত্রি দর্শনের সময় এই মধ্যবর্তী জগৎ সম্পর্কে সজাগ হয়ে উঠেছিলেন, যা তাকে ঐশী জগতের দোরগোড়ায় নিয়ে গেছে। সুহরাওয়ার্দি হয়তো এও দাবি করতেন যে, ইহুদিদের থ্রোন মিস্টিকদের দিব্যদর্শনও তাদের মনোসংযোগের আত্মিক অনুশীলনের সময় আলম-আল মিথালে প্রবেশ করতে শেখার পরেই ঘটেছিল। সুতরাং ফায়লাসুফরা যেমন ভেবেছিল, ঈশ্বরের পথ কেবল যুক্তির মাঝেই নিহিত ছিল না, বরং সৃজনশীল কল্পনার মাধ্যমে অতিন্দ্রীয়বাদীর জগৎও সেই পথ বটে।

আজকের দিনে নেতৃস্থানীয় কোনও ধর্মতাত্ত্বিক যদি বলেন যে, গভীর অর্থে ঈশ্বর কল্পনারই সৃষ্টি, তাহলে পশ্চিমের বহু লোকই শঙ্কিত হয়ে পড়বে। কিন্তু এটা স্পষ্ট হওয়া উচিত যে, কল্পনা হচ্ছে প্রধান ধর্মীয় গুণ। জা-পল সাত্র একে ‘যা নেই তা চিন্তা করার ক্ষমতা আখ্যায়িত করেছেন। মানুষই একমাত্র প্রাণী যে অনুপস্থিত কোনও কিছু বা এই মুহূর্তে যার অস্তিত্ব নেই অথচ সম্ভব হতে পারে এমন কিছু কল্পনা করার ক্ষমতা রাখে। এভাবে শিল্পকলা ও ধর্মের মতো বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রেও আমাদের প্রধান প্রধান সাফল্যের পেছনে আমাদের কল্পনাশক্তি কারণ হিসাবে কাজ করেছে। ঈশ্বরের ধারণা, একে যেভাবেই সংজ্ঞায়িত করা হোক, সম্ভবত অনুপস্থিত সত্তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ, যার সহজাত সমস্যাদি সত্ত্বেও হাজার হাজার বছর ধরে নারী ও পুরুষকে অনুপ্রাণিত করে চলেছে। অনুভূতি ও যুক্তি-নির্ভর প্রমাণের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে অবস্থানকারী ঈশ্বরকে বোঝার একমাত্র উপায়। হচ্ছে প্রতীক। একে ব্যাখ্যা করা কল্পনাপ্রবণ মনের প্রধান কাজ। সুহরাওয়ার্দি মানব জীবনে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তারকারী প্রতীকসমূহের কল্পনা নির্ভর ব্যাখ্যা দেওয়ার প্রয়াস পেয়েছিলেন, যদিও সেগুলো যে বাস্তবতার কথা বলে সেগুলো ধরা-ছোঁয়ার বাইরে রয়ে যায়। প্রতীককে আমাদের অনুভূতি দিয়ে বোধগম্য বা মন দিয়ে ধারণযোগ্য এমন এক বস্তু বা ধারণা হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা যায় যার মাঝে ঐ বস্তুটির চেয়ে অতিরিক্ত কিছু আমরা প্রত্যক্ষ করি। কেবল যুক্তি আমাদেরকে কোনও বিশেষ পার্থিব বস্তুতে বিশ্বজনীন বা বিশেষভাবে চিরন্তনকে অনুধাবনে সক্ষম করে তুলতে পারবে না। এটা সৃজনশীল কল্পনার কাজ যাতে শিল্পীদের মতো অতিন্দ্রীয়বাদীরা তাদের অন্তদৃষ্টি স্থাপন করে। শিল্পকর্মের মতো সবচেয়ে কার্যকর ধর্মীয় প্রতীকসমূহ বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞান ও মানুষের অবস্থা উপলব্ধি দিয়ে অনুপ্রাণিত হয়ে থাকে । অসাধারণরকম চমৎকার আরবী ভাষায় রচনাকারী সুহরাওয়ার্দি যুগপৎ একজন অতি দক্ষ মেটাফিজিশিয়ান ও অতিন্দ্রীয়বাদী ও সৃজনশীল শিল্পী ছিলেন। দৃশ্যতঃ সম্পর্কহীন বিষয়াদিকে মিলিয়ে-অতিন্দ্রীয়বাদের সঙ্গে বিজ্ঞান, একেশ্বরবাদী ধর্মের সঙ্গে পৌত্তলিক দর্শন-তিনি মুসলিমদের নিজস্ব প্রতীক সৃষ্টিতে এবং জীবনের নতুন অর্থ ও তাৎপর্য খুঁজে পেতে সাহায্য করতে পেরেছিলেন।

সুহরাওয়ার্দির চেয়ে আরও বেশি প্রভাবশালী ছিলেন মুঈদ আদ-দীন ইবন। আরাবী (১১৬৫-১২৪০), যার জীবনকে আমরা সম্ভবত প্রাচ্য ও প্রতিচ্যের ভিন্ন। পথে যাত্রার প্রতীক হিসাবে দেখতে পারি। তাঁর পিতা ছিলেন ইবন রুশদের বন্ধু। একবার দুজনের সাক্ষাৎকালে তরুণের ধর্মানুরাগ দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন রুশদ। অবশ্য এক কঠিন অসুখের সময় ইবন আল-আরাবী সুফীবাদের দীক্ষা নেন ও ত্রিশ বছর বয়সে মধ্যপ্রাচ্যের উদ্দেশে ইউরোপ ত্যাগ করেছিলেন। তিনি হজব্রত পালন করে কাবাহয় প্রার্থনা ও ধ্যানে দুটি বছর পার করে দেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ইউফ্রেতিসের তীরে মালাতিয়ায় থিতু হন। প্রায়শঃ শেখ আল আকবাহ-মহা গুরু’-নামে আখ্যায়িত আল-আরাবী ঈশ্বর সম্পর্কে মুসলিমদের ধারণাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছেন। কিন্তু তার চিন্তাধারা পাশ্চাত্যকে প্রভাবিত করেনি। ইবন রুশদের সঙ্গে সঙ্গে মুসলিম দর্শন শেষ হয়ে গেছে বলে ধারণা ছিল। পাশ্চাত্যের ক্রিশ্চান জগৎ ইবন রুশদের অ্যারিস্টটলিয় ঈশ্বরকে কাছে টেনে নেবে এবং অন্যদিকে ইসলামি রাজ্যের অধিকাংশই অতি সাপ্রতিকাল পর্যন্ত অতিন্দ্রীয়বাদীদের ঈশ্বরের পক্ষে মত দিয়ে এসেছে।

১২০১ সালে কাবাহ্ গৃহ প্রদক্ষিণের সময় ইবন আল-আরাবী এক দিব্যদর্শন লাভ করেন যা তাঁর জীবনে সুদূরপ্রসারী ও গভীর প্রভাব রেখে গিয়েছে: স্বর্গীয় আভায় পরিবেষ্টিত নিযাম নামের এক কিশোরীকে দেখতে পান তিনি এবং উপলব্ধি করেন যে, মেয়েটি স্বর্গীয় প্রজ্ঞা সোফিয়ার অবতার। এই এপিফ্যানি তাঁকে উপলব্ধি করতে শেখায় যে, কেবল দর্শনের যৌক্তিক আলোচনায় নির্ভর করে থাকলে আমাদের পক্ষে ঈশ্বরকে ভালোবাসা সম্ভব হবে না। ফালসাফাহ আল্লাহর চরম অবোধ্যতার ওপর জোর দিয়েছে ও আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছে যে, কোনও কিছুর পক্ষেই তাঁর সমরূপ হওয়া সম্ভব নয়। এমন দূরবর্তী এক সত্তাকে কী করে ভালোবাসতে পারি আমরা? কিন্তু তারপরেও তাঁর সৃষ্ট প্রাণীতে দেখা ঈশ্বরকে আমরা ভালোবাসতে পারি: ‘যদি সৌন্দর্যের জন্যে তুমি কোনও সত্তাকে ভালোবাস, তাহলে সেটা ঈশ্বরকেই ভালোবাসা, কেননা তিনিই ‘সুন্দরতম সত্তা,-ফুতুহাত আল-মাক্কিয়াহ্-এ ব্যাখ্যা করেছেন তিনি। এভাবে সবদিক থেকেই একমাত্র ঈশ্বরই ভালোবাসার লক্ষ্য। শাহাদাহ আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, আল্লাহ ছাড়া আর কোনও প্রভু বা কোনও পরম সত্তা নেই। পরিণামে তাঁকে বাদ দিয়ে কোনও সৌন্দর্যও নেই। স্বয়ং ঈশ্বরকে আমরা দেখতে পাই না, কিন্তু নিয়ামের মতো বেছে নেওয়া সৃষ্ট প্রাণীতে নিজেকে যেভাবে তিনি প্রকাশ করেন সেটা দেখতে পাই, আমাদের হৃদয়ে যা ভালোবাসা সৃষ্টি করে। প্রকৃতপক্ষেই নিযামের মতো একটি মেয়েকে প্রকৃত অবয়বে দেখার জন্যে অতিন্দ্রীয়বাদীদের নিজস্ব এপিফ্যানি সৃষ্টি করার দায়িত্ব রয়েছে। ভালোবাসা আবশ্যিকভাবে অনুপস্থিত কোনও কিছুর জন্য আকাঙ্ক্ষা, এ কারণেই মানুষের ভালোবাসার অনেকাংশই হতাশাব্যাঞ্জক হয়ে থাকে। নিযাম ‘আমার অনুসন্ধান ও আমার আশার বস্তু সবচেয়ে সাধ্বি কুমারীতে পরিণত হয়েছিল। প্রেমের কবিতার সংকলন দ্য দিওয়ান-এর ভূমিকার তিনি যা ব্যাখ্যা করেছেন:

বর্তমান গ্রন্থের জন্য রচিত আমার পঙক্তিসমূহে মুহূর্তের জন্যও আমি স্বর্গীয় অনুপ্রেরণা, আধ্যাত্মিক আবির্ভাব, দেবদূতদের বুদ্ধিমত্তার জগতের সঙ্গে আমাদের জগতের যোগাযোগের আকাঙ্ক্ষা হতে বিরত থাকিনি। এখানে প্রতাঁকের ভিত্তিতে আমার স্বভাবজাত চিন্তা করেছি, কারণ বাস্তব জীবনের বিষয়াদির চেয়ে অদৃশ্য জগতের বস্তুসমূহই আমাকে বেশি টানে; কারণ এই কিশোরীটি ঠিক জানে আমি কিসের কথা বোঝাচ্ছি।

সৃজনশীল কল্পনা নিযামকে ঈশ্বরের অবতারে পরিণত করেছিল।

মোটামুটি আশি বছর পর তরুণ দান্তে আলিগিরি ফ্রান্সে বিয়েত্রিস পাতিনারিকে দেখার পর একই রকম অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন। মেয়েটিকে দেখামাত্রই আত্মার প্রবল কম্পন অনুভব করেন তিনি এবং যেন তার চিৎকার শুনতে পান: আমার চেয়ে শক্তিশালী এক দেবতাকে দেখ যে আমাকে জয় করতে আসছে। সেই মুহূর্ত হতে দান্তে বিয়েত্রিসের জন্যে তাঁর ভালোবাসায় নিয়ন্ত্রিত হতে থাকেন, যা আমার কল্পনার দেওয়া ক্ষমতার সুবাদে প্রবল হয়ে উঠেছিল। দান্তের বেলায় বিয়েত্রিস স্বর্গীয় ভালোবাসার প্রতিরূপ রয়ে গিয়েছিলেন এবং দ্য ডিভাইন কমেডিতে তিনি দেখিয়েছেন কীভাবে নরক ও স্বর্গের ভেতর দিয়ে কাল্পনিক যাত্রার পর এটা তাকে ঈশ্বরের দর্শন করিয়ে দিয়েছিল। দান্তের কবিতার পেছনে মুহাম্মদের (স) স্বর্গারোহণের মুসলিম বিবরণের অনুপ্রেরণা ছিল; নিঃসন্দেহে সৃজনশীল কল্পনার ক্ষেত্রে তার দৃষ্টিভঙ্গি ইবন আল-আরাবীর মতো। অ্যারিস্টটল যেমন বলেছিলেন, ইমাজিনেতিভা স্রেফ জাগতিক বিশ্ব থেকে নেওয়া ইমেজের সংমিশ্রণ নয়, বলে যুক্তি দেখিয়েছেন দান্তে, বরং এটা ঈশ্বর হতে আগত অনুপ্রেরণারই অংশ:

ও ফ্যান্টাসি (ইমাজিনেতিভা), দ্যাট রীভ’স্ট আস অফট অ্যাওয়ে
সো ফ্রেম আওয়ারসেলভস্ দ্যাট উই রিমেইন ডিস্ট্রট,
ডেফ দো আ থাউজ্যান্ড ট্রামপেটস রাউন্ড আস ব্রে.
হোয়াট মুভস দী হোয়েন দ্য সেনসেস শোউ দী নট?
লাইট মুভস দী, ফর্মড ইন হেভন, বাই উইল মেবী
অভ হিম হু সেন্ডস ইট ডাউন, অর এলস সেলফ-রট।

গোটা কবিতায় দান্তে ইন্দ্রিয়গত ও দৃশ্যমান ইমেজোরি ক্রমশঃ একীভূত করেছেন। নরকের বিস্তারিত বাস্তব বিবরণ পারগোটরি পাহাড়ে আবেগগত আরোহণের কষ্টকর পর্বের পর পার্থিব স্বর্গে পৌঁছার পথ খুলে দেয় যেখানে বিয়েত্রিস তাঁকে শারীরিকভাবে শেষ হওয়া সত্তা হিসেবে দেখার জন্যে ভর্ৎসনা করে: বরং তাকে প্রতীক বা অবতার হিসাবে দেখা উচিত ছিল তার, যা তাঁকে জগৎ থেকে ঈশ্বরের দিকে চালিত করেছে। স্বর্গের বাস্তব বর্ণনা নেই বললেই চলে; এমনকি আশীর্বাদপ্রাপ্ত আত্মাসমূহও দূরবর্তী-আমাদের মনে করিয়ে দেয় কোনও মানুষই তার আকাক্ষার পরম বস্তুতে পরিণত হতে পারে না। সবশেষে, শীতল বুদ্ধিবৃত্তি ইমেজারি সকল কল্পনার অতীত ঈশ্বরের চরম দুয়েতা প্রকাশ করে। দান্তের বিরুদ্ধে প্যারাদিসো-তে ঈশ্বরের ঠাণ্ডা প্রতিকৃতি অংকনের অভিযোগ উঠেছে, কিন্তু বিমূর্ত দিকটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, শেষ পর্যন্ত তাঁর সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না।

ইবন আল-আরাবীও বিশ্বাস করতেন যে, কল্পনা ঈশ্বর প্রদত্ত ক্ষমতা। কোনও অতিন্দ্রীয়বাদী নিজস্ব এপিফ্যানি সৃষ্টি করার সময় আসলে সে আদি আদর্শ জগতে আরও নিখুঁতভাবে অবস্থানকারী একটা সত্তাকে পুণর্জন্ম দেয়। আমরা অন্য মানুষের মাঝে ঐশী সত্তাকে দেখার সময় আসলে প্রকৃত সত্তাকে উন্মোচন করার কল্পনা নির্ভর প্রয়াসে লিপ্ত হই: ‘ঈশ্বর আবরণের মতো প্রাণীসমূহকে সৃষ্টি করেছেন, ব্যাখ্যা দিয়েছেন তিনি, যে ওগুলোকে সেভাবে চেনে সে আবার তার দিকে ধাবিত হয় আর সে ওগুলোকে বাস্তব হিসাবে ধরে নেয় সে তার সত্তা থেকে বঞ্চিত হয়। এভাবে-সুফীবাদের পথ হিসাবে বিবেচিত-যা মানুষের ওপর নিবেদিত সম্পূর্ণ ব্যক্তিরূপী আধ্যাত্মিকতা হিসাবে সূচিত হয়েছিল সেটাই ইবন আল-আরাবীকে ঈশ্বরের ব্যক্তির অতীত ধারণার দিকে নিয়ে গিয়েছিল। নারীর প্রতিকৃতি তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ রয়ে গিয়েছিল । তিনি বিশ্বাস করতেন যে, নারীই স্বর্গীয় প্রজ্ঞা সোফিয়ার সবচেয়ে কার্যকর অবতার, কারণ তারা পুরুষদের মনে এমন এক ভালোবাসার অনুপ্রেরণা যোগায় যা শেষ পর্যন্ত তাদেরকে ঈশ্বরের দিকে চালিত করে। অনস্বীকার্য যে এটা একেবারে পুরুষবাদী দৃষ্টিভঙ্গি, কিন্তু ঈশ্বরের ধর্মে একটা নারী-মাত্রা আনার প্রয়াসও ছিল এটা, যে ঈশ্বরকে প্রায়শঃই পরিপূর্ণভাবে পুরুষ হিসেবে ধরে নেওয়া হয়।

ইবন আল-আরাবী বিশ্বাস করতেন না যে তার জানা ঈশ্বরের বস্তুগত অস্তিত্ব আছে। যদিও দক্ষ মেটাফিজিশিয়ান ছিলেন, কিন্তু ঈশ্বরের অস্তিত্ব যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করা যায় বলে বিশ্বাস করেননি। নিজেকে খিজর-এর শিষ্য দাবি করতেন তিনি, এ নামটি কোরানে বাহ্যিক আইন পৌঁছে দেওয়া মোজেসের আধ্যাত্মিক গুরু হিসেবে আবির্ভূত এক রহস্যময় চরিত্রকে দেওয়া হয়েছে, ঈশ্বর খিজরকে তাঁর সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞান দিয়েছিলেন, সে জন্যে মোজেস তাঁর কাছে নির্দেশনা প্রার্থনা করছেন, কিন্তু খিজর তাঁকে বলেছেন যে, তাঁর পক্ষে এটা সহ্য করা সম্ভব হবে না, কারণ এটা তাঁর নিজস্ব ধর্মীয় অভিজ্ঞতার বাইরে অবস্থান করছে। যে ধর্মীয় তথ্যের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা আমাদের নেই সেটা বোঝার চেষ্টা করে কোনও লাভ নেই। খিজর নামটি ‘সবুজ জন’ বোঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে, যেন তার জ্ঞানের চিরনতুন ও চিরন্তনভাবে নবায়নযোগ্যতার ইঙ্গিতবহ। এমনকি মোজেসের মতো বড় মাপের একজন পয়গম্বরও যে ধর্মের কিছু কিছু নিগূঢ় বিষয়াদি উপলব্ধি করতে পারবেন তা নয়, কারণ কোরানে প্রকৃতই খিজরের কৌশলের সঙ্গে মানিয়ে উঠতে পারছেন না বলে আবিষ্কার করেছেন তিনি। এই অদ্ভুত পর্বটি যেন বোঝাতে চায়, ধর্মের বাহ্যিক সৌন্দর্য বা বিষয়াদি যে সবসময়ই এর আধ্যাত্মিক বা অতিন্দ্রীয় উপাদানের সঙ্গে মিলে যাবে এমন নয়। উলেমাদের মতো মানুষেরা হয়তো ইবন আল-আরাবীর মতো সুফীর ইসলামকে নাও বুঝতে পারেন। মুসলিম ঐতিহ্য খিজরকে অতিন্দ্রীয় সত্য-সন্ধানীদের গুরুতে পরিণত করেছে, যা উৎপত্তিগতভাবেই আক্ষরিক, বাহ্যিক রূপের চেয়ে একেবারে আলাদা ও উন্নত। ঈশ্বর সম্পর্কে আর দশ জন সাধারণ মানুষের যেমন ধারণা তিনি আপন অনুসারীদের ঈশ্বর সম্পর্কে সে রকম ধারণা গড়ে তোলায় উৎসাহিত করেননি, বরং এমন এক ঈশ্বরের কথা বুঝিয়েছেন যিনি গভীরভাবে আধ্যাত্মিক ।

ইসমায়েলিদের কাছেও খিজর গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন । ইবন আল-আরাবী সুফী হলেও তাঁর শিক্ষা ইসমায়েলিদের মতবাদের অনেক ঘনিষ্ঠ ছিল শেষ পর্যন্ত যা তাদের ধর্মতত্ত্বে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। অতিন্দ্রীয়বাদী ধর্ম যে গোষ্ঠীগত বিভেদের ঊর্ধ্বে উঠতে পারে, এটা তার আরেকটা উদাহরণ । ইসমায়েলিদের মতো ইবন আল-আরাবী দার্শনিকদের ঈশ্বরের আপাথিয়ার ঘোরতর বিপরীত ঈশ্বরের করুণরসের ওপর জোর দিয়েছেন। অতিন্দ্রীয়বাদীদের ঈশ্বর তাঁর সৃষ্ট জীবকূলের মাধ্যমে পরিচিত হবার আকাঙ্ক্ষা করেন। ইসমায়েলিরা বিশ্বাস করত যে, বিশেষ্য পদ ইলাহ-প্রভু-এসেছে আরবী WLH মূল হতে: বিষণ্ণ হওয়া, দুঃখ করা। পবিত্র হাদিসে ঈশ্বরকে দিয়ে বলানো হয়েছে: ‘আমি গুপ্তধন ছিলাম এবং আত্মপ্রকাশের আকাঙ্ক্ষা করেছি। তারপর প্রাণীকূল সৃষ্টি করেছি ওদের মাধ্যমে পরিচিত হব বলে। ঈশ্বরের বিষণ্ণতার যৌক্তিক কোনও প্রমাণ নেই; আমরা কেবল আমাদের গভীরতম প্রত্যাশা পূরণের জন্যে একটা কিছুর প্রতি প্রত্যাশা ও জীবনের যন্ত্রণার ও করুণ দিক ব্যাখ্যা করার ইচ্ছার মাঝে তা বুঝতে পারি। আমাদের যেহেতু ঈশ্বরের প্রতিরূপে সৃষ্টি করা হয়েছে, আমরা নিশ্চয়ই সর্বোত্তম আদর্শ ঈশ্বরকেই প্রতিবিম্বিত করি। সুতরাং ঈশ্বর’ বলে যে সত্তাকে পাওয়ার জন্যে আমরা আকাক্ষা করি সে আকাঙ্ক্ষা ঈশ্বরের বিষণ্ণতারই প্রতিনিধিত্ব করে। ইবন আল-আরাবী একক ঈশ্বর আকাঙ্ক্ষায় দীর্ঘশ্বাস ফেলছেন বলে কল্পনা করছেন, কিন্তু এই দীর্ঘশ্বাস (নাফাস রাহমানি) আত্ম-করুণার বিচলিত প্রকাশ নয়। এর একটা সক্রিয়, সৃজনশীল শক্তি ছিল যা আমাদের গোটা মহাবিশ্বকে অস্তিত্ব দিয়েছে, এর ফলে মানুষও এসেছে, যারা পরিণত হয়েছে লোগোইতে, যে ভাষায় ঈশ্বর নিজের প্রকাশ করেন। এইভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, প্রতিটি মানুষই লুকায়িত ঈশ্বরের অনন্য এপিফ্যানি, এক বিশেষ ও পুনরাবৃত্তির অতীত উপায়ে তাঁকে প্রকাশ করছে ।

এইসব স্বর্গীয় লোগোই-এর প্রতিটি ঈশ্বর স্বয়ং নিজেকে যে নামে সম্বোধন করেন সেই নাম, এভাবে নিজেকে নিজের প্রতি এপিফ্যানিতে সামগ্রিকভাবে উপস্থিত করেন তিনি। স্বর্গীয় সত্তা যেহেতু প্রকাশের অতীত, সেহেতু একটি মাত্র মানবীয় প্রকাশ ভঙ্গি দিয়ে তাকে তুলে ধরা যাবে না। এখানে আরও বলা হচ্ছে যে, ঈশ্বর আমাদের প্রত্যেকের মাঝে যা প্রকাশ করেছেন তা অনন্য, আরও অসংখ্য নারী ও পুরুষের জ্ঞান ঈশ্বরের চেয়ে ভিন্ন যারা তার লোগোই-ও বটে। আমরা কেবল আমাদের নিজস্ব ঈশ্বরকেই চিনতে পাবি, কেননা তাকে বস্তুনিষ্ঠভাবে অনুভব করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়, অন্যকারও মতো করেও তাঁকে জানা অসম্ভব। ইবন আল-আরাবী যেমন বলেছেন: “প্রত্যেক সত্তার তার বিশেষ প্রভুই ঈশ্বর হিসাবে আছেন; গোটা ঈশ্বরকে লাভ তার পক্ষে সম্ভব নয়।’ তিনি হাদিসের উদ্ধৃতি দিতে পছন্দ করতেন: “ঈশ্বরের আশীর্বাদে ধ্যান করো, কিন্তু তাঁর মূল সত্তাকে নিয়ে নয়।”৭ ঈশ্বরের সমগ্র সত্তা জ্ঞানের অতীত, আমাদের অবশ্যই আপন সত্তা উচ্চারিত বিশেষ শব্দের দিকে দিকে মনোযোগ দিতে হবে। ইবন আল-আরবী ঈশ্বরকে তার অগম্যতার ওপর জোর দেওয়ার জন্যে আল-আমা অর্থাৎ ‘মেঘ’ বা ‘অন্ধত্ব’ ডাকতেও ভালোবাসতেন কিন্তু এসব মানব লোগোই গোপন ঈশ্বরকে তার নিজের সামনেও তুলে ধরে। এটা একটা দ্বিমুখী প্রক্রিয়া: ঈশ্বর জ্ঞাত হওয়ার উদ্দেশ্যে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন এবং যাদের মাঝে তিনি নিজেকে প্রকাশ করেন তাদের মাধ্যমেই নিঃসঙ্গতা হতে মুক্তি পান। অজ্ঞাত ঈশ্বরের দুঃখ প্রত্যেক মানুষের মাঝে প্রকাশিত ঈশ্বর দিয়ে প্রশমিত হয়, যারা তাঁকে নিজের কাছে তুলে ধরে; আবার এটাও সত্যি যে প্রকাশিত ঈশ্বর প্রত্যেক ব্যক্তির মাঝে অবস্থান করার সময় আমাদের নিজস্ব আকাক্ষা জাগিয়ে তোলা এক ঐশী স্মৃতি তাড়নায় আবার মুল উৎসে ফিরে যেতে চান।

এভাবে ঈশ্বর ও মানুষ স্বর্গীয় জীবনের দুটো বৈশিষ্ট্য যা গোটা বিশ্বজগৎ বা সৃষ্টিকে সজীব করেছে। এই দর্শনটি জেসাসের দেহে ঈশ্বরের অবতারের উপলব্ধির চেয়ে খুব ভিন্ন ছিল না, কিন্তু ইবন আল-আরাবী এটা মেনে নিতে পারেননি যে, একজন মাত্র ব্যক্তি, তা তিনি যত পবিত্রই হোন না কেন, ঈশ্বরের অসীম সত্তাকে প্রকাশ করতে পারেন। তার বদলে তিনি প্রত্যেক মানুষকে একেকটি অনন্য স্বর্গীয় অবতার বলে বিশ্বাস করেছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি ‘পূর্ণাঙ্গ মানুষের’ (ইনসান ই-কামিল) একটা প্রতীক সৃষ্টি করেছেন যিনি কিনা সমসাময়িকদের উপকারের জন্যে প্রতি প্রজন্মের প্রকাশিত ঈশ্বরকে ধারণ করেন; যদিও অবশ্যই তিনি ঈশ্বরের সমগ্র সত্তা বা তার ব্যাপক সত্তাকে ধারণ করেন না। পয়গম্বর মুহাম্মদ (স) ছিলেন তাঁর সময়ের পূর্ণাঙ্গ মানুষ, কার্যকর ঐশী প্রতীকও ছিলেন তিনি।

এই অন্তর্মুখী কল্পনা নির্ভর অতিন্দ্রীয়বাদ সত্তার গভীরে অস্তিত্বের ভিত্তির অনুসন্ধান ছিল। এটা অতিন্দ্রীয়বাদীকে ধর্মে গোঁড়া রূপের কিছু নিশ্চয়তা হতে বঞ্চিত করেছে। যেহেতু প্রত্যেক নারী ও পুরুষের ঈশ্বর সংক্রান্ত অনন্য অভিজ্ঞতা রয়েছে, সেক্ষেত্রে বলা চলে যে কোনও একটি ধর্ম সমগ্র স্বর্গীয় রহস্যকে তুলে ধরতে পারবে না। সবার মেনে নেওয়ার মতো ঈশ্বর সম্পর্কে বস্তুনিষ্ঠ কোনও সত্যি নেই, যেহেতু এই ঈশ্বর ব্যক্তিত্বের বৈশিষ্ট্যাবলী অতিক্রম করে যান এবং তার আচরণ বা ঝোঁক সম্পর্কে পূর্বানুমান অসম্ভব। সুতরাং, অন্যের ধর্মের বিপরীতে কারও নিজ ধর্ম নিয়ে অহংকার প্রকাশ নিঃসন্দেহে অগ্রহণযোগ্য, কারণ কোনও বিশেষ একটি ধর্ম ঈশ্বরের সমগ্র সত্যকে ধারণ করে না। ইবন আল-আরাবী অন্য ধর্মের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব গড়ে তুলেছিলেন যা কোরানেও দেখা যায়, এবং একে সহনশীলতার নতুন পর্যায়ে নিয়ে গেছেন:

আমার মন সকল রূপ ধারণেই সক্ষম ।
ভিক্ষুর জন্যে মঠ, মূর্তির জন্যে মন্দির,
হরিণের জন্যে চারণভূমি, বিশ্বাসীর কাবাহ্
তোরাহর ফলক, কোরান।
আমার ধর্ম ভালোবাসা: আমি যেদিকেই ফিরি
তাঁর উট, তবু এমাত্র সত্য ধর্মটি আমার।

ঈশ্বরে বিশ্বাসী সিনাগগ, মন্দির, গির্জা ও মসজিদে সমান স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে, কেননা সবগুলোই ঈশ্বরের একটা বৈধ উপলব্ধি দিয়ে থাকে। ইবন আল আরাবী প্রায়শঃ ‘বিশ্বাসের সৃষ্টি ঈশ্বর’ (খালক আল-হাক্ক ফি’ল-ইতিকাদ) বাক্যটি ব্যবহার করতেন। একটি বিশেষ ধর্মের নারী-পুরুষ কর্তৃক সৃষ্ট অবতারকে স্বয়ং ঈশ্বরের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলা অসমীচিন হতে পারে, এতে কেবল অসহিষ্ণুতা আর ধর্মান্ধতা জন্ম নেবে। এই ধরনের বহুঈশ্বরবাদীতার বদলে ইবন আল-আরাবী এই পরামর্শ দিয়েছেন:

কোনও নির্দিষ্ট ধর্ম বিশ্বাসের (Creed) সঙ্গে নিজেকে এমনভাবে সংযুক্ত করো না যাতে অন্যগুলোকে তুমি অবিশ্বাস কর; সেক্ষেত্রে অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হবে, আসল সত্য উপলব্ধি করতেও ব্যর্থ হবে। সর্বত্র বিরাজমান, সর্বশক্তিমান ঈশ্বর কোনও একটি ধর্মে সীমাবদ্ধ নন, কারণ তিনি বলেছেন, ‘তুমি যেদিকেই তাকাবে, সেখানে আল্লাহ মুখায়ব।’ (কোরান ২: ১০৯)। সবাই যার যার বিশ্বাসের স্তুতি গায়; তার ঈশ্বর তার নিজস্ব সৃষ্টি, প্রশংসা করতে গিয়ে সে আত্মপ্রশংসা করে। পরিণতিতে অন্যদের বিশ্বাসকে দোষারোপ করে, ন্যায় আচরণ করলে এমনটি সে করতে পারত না, কিন্তু তাঁর অপছন্দের মূলে রয়েছে অজ্ঞতা।৫০

আমাদের প্রত্যেকের মাঝে প্রকাশিত ও নিরেট অস্তিত্ব দেওয়া ব্যক্তিগত নাম ছাড়া আমরা আর কোনও ঈশ্বরকে দেখতে পাই নাঃ অনিবার্যভাবে আমাদের ব্যক্তিগত প্রভু সম্পর্কে উপলব্ধি আমরা যে ধর্মে জন্মগ্রহণ করেছি সেই ধর্মের ধর্মীয় ঐতিহ্য দিয়েই রঞ্জিত। কিন্তু অতিন্দ্রীয়বাদী (আরিফ) জানে যে, আমাদের এই ‘ঈশ্বর একজন ‘দেবদূত বা স্বর্গীয় কোনও বিশেষ প্রতীক মাত্র, যাকে কোনওভাবেই স্বয়ং অদৃশ্য সত্তার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা চলবে না। পরিণামে সে একই ধর্মকে বৈধ থিওফ্যানি হিসাবে দেখে। অধিকতর গোঁড়া ধর্মসমূহের ঈশ্বর যেখানে মানুষকে বিবদমান শিবিরে বিভক্ত করেন, অতিন্দ্রীয়বাদীদের ঈশ্বর সেখানে এক ঐক্যবদ্ধকারী শক্তি।

একথা সত্যি যে, সংখ্যাগরিষ্ঠ বিপুল সংখ্যক মুসলিমের জন্যে আল আরাবীর শিক্ষা বড্ড বেশি দুর্বোধ্য ছিল, তবু তা বহু সাধারণ মানুষের মাঝে ছড়িয়ে পড়েছিল। দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ শতাব্দীতে সুফীবাদ আর সংখ্যালঘু আন্দোলনে সীমিত থাকেনি। মুসলিম সাম্রাজ্যের বহু স্থানেই তা প্রভাবশালী ইসলামি ধারায় পরিণত হয়েছিল। এই সময়ের বিভিন্ন সুফী পদ্ধতি বা ত্বরিকা প্রতিষ্ঠিত হয় যাদের প্রত্যেকটির অতিন্দ্রীয়বাদী বিশ্বাস সম্পর্কে নিজস্ব ব্যাখ্যা ছিল। সুফী শেখগণের সাধারণ মানুষের ওপর ব্যাপক প্রভাব ছিল এবং প্রায়শঃই শিয়াহ্ ইমামদের মতোই সম্মান লাভ করতেন তাঁরা। রাজনৈতিক সংঘাতের কাল ছিল এটা: বাগদাদের খেলাফতের ক্ষয় চলছিল এবং মঙ্গোল দস্যুরা একের পর এক মুসলিম নগরীতে ধ্বংসলীলা চালিয়ে যাচ্ছিল। সাধারণ মানুষ ফায়সুফদের দূরবর্তী ঈশ্বর ও উলেমাদের আইননিষ্ঠ ঈশ্বরের চেয়ে অধিকতর নিকটবর্তী ও সহানুভূতিশীল এক ঈশ্বরের কামনা করছিল। সুফীদের পরম আবেশ সৃষ্টির জন্যে জিকির অনুশীলন মন্ত্রের মতো স্বর্গীয় নাম উচ্চারণ, ত্বরিকার সীমা অতিক্রম করে ছড়িয়ে পড়েছিল। শ্বাস-প্রশ্বাস ও আসন গ্রহণের নির্দেশিত বিশেষ ভঙ্গির মনোসংযোগের সুফী অনুশীলন মানুষকে নিজের মাঝেই এক দুৰ্জ্জেয় সত্তার বোধ জাগাতে সাহায্য করেছিল। সবারই অতিন্দ্রীয় অভিজ্ঞতার সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছার ক্ষমতা ছিল না, কিন্তু এইসব আধ্যাত্মিক অনুশীলন মানুষকে ঈশ্বর সম্পর্কে সাধারণ ও মানবীয় ধারণা ত্যাগ করে নিজের মাঝে তার উপস্থিতি অনুভবে সাহায্য করেছে। কোনও কোনও পদ্ধতি মনোসংযোগ গভীর করার উদ্দেশ্যে সঙ্গীত ও নাচের ব্যবহার করত। তাদের। পিগণ সাধারণ মানুষের চোখে নায়ক হয়ে উঠেছিলেন।

সুফীদের বিভিন্ন ধরনের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ছিল মাওলাবিওয়াহ, পশ্চিমে যাদের সদস্যরা ‘ঘূর্ণায়মান দরবেশ’ হিসাবে পরিচিত। এদের বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ নাচ মনোসংযোগের এক ধরনের কৌশল বা পদ্ধতি ছিল। ক্রমাগত ঘুরতে ঘুরতে নাচের মাঝে মিশে যাওয়ার সময় সুফী অনুভব করে, সত্তার সব সীমানা মুছে যাচ্ছে, যা তাকে ফানার বিলীন হবার আগাম স্বাদ পিত। এ পদ্ধতির প্রতিষ্ঠাতা জালাল আদ-দীন রুমি (১২০৭-৭৩) শিষ্যদের কাছে মাওলানা বা আমাদের গুরু নামে পরিচিত ছিলেন। মধ্য এশিয়ার খুরাশানে জন্মগ্রহণ করেন তিনি, কিন্তু অগ্রসরমান মঙ্গোল বাহিনী পৌঁছার আগেই আধুনিক তুরস্কের কনিয়ায় পালিয়ে যান। তাঁর অতিন্দ্রীয়বাদকে এই তাণ্ডবলীলার প্রতি মুসলিমদের সাড়া হিসাবে দেখা যেতে পারে যার পরিণতিতে বহু মুসলিম আল্লাহয় বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছিল। রুমির ধারণার সঙ্গে তাঁর সমসাময়িক ইবন আল-আরাবীর চিন্তাধারার মিল আছে, কিন্তু তাঁর কাব্য সুফী বাইবেল বলে পরিচিত মাসনবীর জনপ্রিয়তা ঢের বেশি এবং সুফী নয় এমন। সাধারণ মানুষের কাছেও অতিন্দ্রীয়বাদীদের ঈশ্বরকে পৌঁছে দিতে সাহায্য করেছে। ১২৪৪ সালে ভ্রাম্যমাণ দরবেশ শামস আদ-দিনের প্রভাব বলয়ে আসেন রুমি, তিনি তাঁকে তাঁর প্রজন্মের পূর্ণাঙ্গ পুরুষ হিসেবে দেখেছেন। প্রকৃতপক্ষেই শামস আদ-দিন নিজেকে পয়গম্বরের পুনরাবির্ভাব বলে বিশ্বাস করতেন এবং তাঁকে মুহাম্মদ’ সম্বোধন করার প্রতি জোর দিতেন। সন্দেহজনক খ্যাতি ছিল তার। জানা যায় নিজেকে নিয়ম-কানুনের মতো তুচ্ছ বিষয়ের উর্ধ্বে ভেবে শরীয়াহ্ বা ইসলামের সর্বোচ্চ আইন পালন করতেন না। রুমির অনুসারীরা তাদের গুরুর স্পষ্ট মোহাচ্ছন্নতায় বোধগম্য কারণেই উদ্বিগ্ন ছিল। এক দাঙ্গায় শামস নিহত হলে সান্ত্বনার অতীত হয়ে পড়ে অতিন্দ্রীয়বাদী সঙ্গীত আর নাচে আরও বেশি সময় অতিবাহিত করতে থাকেন রুমি। প্রবল শোককে কাল্পনিকভাবে ঈশ্বরের জন্যে ভালোবাসার প্রতাঁকে রূপান্তরিত করতে পেরেছিলেন তিনি-মানুষের প্রতি ঈশ্বরের আকাঙ্ক্ষা ও আল্লাহর জন্যে মানুষের কামনা । জেনে হোক বা না জেনে, প্রত্যেকেই অনুপস্থিত ঈশ্বরের সন্ধান করছে, আবছাভাবে সচেতন যে অস্তিত্বের উৎস থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে সে।

নলখাগড়ার কথা শোন, কীভাবে গল্প বলছে সে, বিচ্ছিন্নতার অনুযোগ করছে। খড়ের ক্ষেত থেকে তুলে আনার পর থেকেই আমার বিলাপে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠেছে নারী-পুরুষ। বিচ্ছিন্নতায় ছিন্ন হয়ে যাওয়া এক সুহৃদ চাই আমি, যাতে আমি এমন একজনের কাছে প্রেম-ইচ্ছার শক্তি তুলে ধরতে পারি: আপন উৎস হতে বিচ্ছিন্ন প্রত্যেকে যখন সে সঙ্গে ছিল সেই সময়ে ফিরে যেতে চায়।

পূর্ণাঙ্গ পুরুষ অধিকতর সাধারণ মরণশীলকে ঈশ্বর সন্ধানে অনুপ্রাণিত করে বলে বিশ্বাস করা হয়েছে: রুমির মাঝে মসনাবীর কাজের দরজা খুলে দিয়েছিলেন শামস আদ-দিন, যা এই বিচ্ছেদের বেদনাকেই তুলে ধরেছে।

অন্যান্য সুফীর মতো রুমিও বিশ্বজগতকে ঈশ্বরের অযুত নামের একটা থিওফ্যানি হিসাবে দেখেছেন। এসব নামের কোনও কোনওটি ঈশ্বরের ক্রোধ বা নিষ্ঠুরতা প্রকাশ করে, অন্যদিকে বাকিগুলো স্বর্গীয় প্রকৃতির সহজাত কল্পনার গুণ প্রকাশ করে। অতিন্দ্রীয়বাদী সকল বস্তুতে ঈশ্বরের সহমর্মিতা, প্রেম ও সৌন্দর্য চিহ্নিত করার বিরামহীন সংগ্রাম (জিহাদে) নিয়োজিত; যাতে অন্য সবকিছু ঝরে পড়ে। মাসনাবী মানব জীবনে দুজ্ঞেয় মাত্রা আবিষ্কার ও চেহারা ভেদ করে নিজের মাঝে গুপ্ত সত্তাকে দেখার চ্যালেঞ্জ করেছে। অহমবোধ আমাদের সকল বস্তুর অন্তস্থ রহস্য সম্পর্কে অন্ধ করে রাখে, কিন্তু একবার যদি আমরা তা অতিক্রম করে যেতে পারি তখন আর বিচ্ছিন্ন আলাদা সত্তা থাকবে না, বরং সকল অস্তিত্বের ভিত্তি’র সঙ্গে এক হয়ে যাবে । আবার, রুমি জোর দিয়ে বলেছেন, ঈশ্বর কেবল অন্তরের অনুভূতি হাত পারেন । ঈশ্বর সম্পর্কে অন্যদের ধারণা বা বিশ্বাসকে অবশ্যই সম্মান জানানো উচিত বোঝাতে মোজেস ও রাখাল বালকের মজার এক কাহিনী শুনিয়েছেন তিনি। মোজেস একদিন শুনতে পেলেন রাখাল ঈশ্বরের সঙ্গে পরিচিত ঢঙে কথা বলছে: ঈশ্বরকে সাহায্য করতে চায় সে, তিনি সেখানেই থাকুন না কেন-তাঁর পোশাক ধোয়া, উকুন বাছা, শোয়ার সময় হাত পায়ে চুমু দেওয়া। তোমাকে স্মরণ করে আমি কেবল বলতে পারি, প্রার্থনা শেষ হলো, আইইইই ও আহহহহহহহ।’ শঙ্কিত বোধ করলেন মোজেস। রাখাল কার সঙ্গে কথা বলছে। বলে ভেবেছে? স্বর্গ ও পৃথিবীর স্রষ্টা? শুনে তো মনে হচ্ছে চাচার সঙ্গে আলাপ করছে! রাখাল বালক অনুশোচনা করে হতাশ মনে মরু প্রান্তরের দিকে এগিয়ে গেল, কিন্তু মোজেসকে ভৎর্সনা করলেন ঈশ্বর । তিনি অর্থডক্স বাক্যাবলী শুনতে চাননি, প্রবল ভালোবাসা ও নম্রতা চেয়েছেন । ঈশ্বর সম্পর্কে কথা বলার সঠিক কোনও পথ নেই:

তোমার কাছে যা ভুল মনে হচ্ছে ওর জন্যে তা ঠিক,
একজনের জন্যে যা বিষ, আরেকজনের কাছে তা মধু।
পবিত্রতা ও অপবিত্রতা, উপাসনায় শৈথিল্য ও পরিশ্রম
আমার কাছে এসবের কোনও অর্থ নেই।
আমি এসব কিছু হতে আলাদা।
উপাসনার উপায়সমূহকে একটি অপরটির চেয়ে উন্নত বা
নিম্নমানের হিসাবে দেখা যাবে না।

হিন্দুরা হিন্দুদের মতো করে।
ভারতের দ্রাবিড় মুসলিমরা তাদের মতো।
এসবই প্রশংসা, এসবই ঠিক।

উপাসনার কায়দায় আমি মহিমান্বিত হই না।
মহিমান্বিত হয় উপাসকরা! আমি কোনও কথা শুনি না ।
যা তারা বলে । আমি তার অভ্যন্তরে দেখি।
এই উন্মুক্ত-ভাঙা তাই আসল সত্তা,
ভাষা নয়! অলঙ্কারময় ভাষা ভুলে যাও।
আমি চাই দাহ, দাহ।
আপন দাহর বন্ধু হয়ে যাও। তোমার চিন্তা
আর অভিব্যক্তির রূপকে পুড়িয়ে দাও![৫২]

রাখালের কথার মতোই ঈশ্বর সম্পর্কে যে কোনও রক্তব্যই অবাস্তব, কিন্তু একজন বিশ্বাসী যখন পর্দা ভেদ করে বস্তুসমূহের প্রকৃত রূপ দেখতে পাবে তখন সে বুঝবে এটা মানুষের সকল ধারণাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে।

ইতিমধ্যে ট্রাজিডি ইউরোপের ইহুদিদেরও ঈশ্বর সম্পর্কে নতুন ধারণা গঠনে সাহায্য করেছিল। পশ্চিমের ক্রুসেডিং-অ্যান্টি সেমিটিজম ইহুদি জনগোষ্ঠীর জীবন ধারণকে অতীষ্ঠ করে তুলেছিল; অনেকেই থ্রোন মিস্টিকদের অনুভূত দূরবর্তী উপাস্যের চেয়ে নিকটবর্তী ব্যক্তিক ঈশ্বরের আকাক্ষা করছিল। নবম শতাব্দীতে কালোনিমোস পরিবার দক্ষিণ ইতালি থেকে জার্মানিতে পাড়ি জমানোর সময় সঙ্গে করে কিছু অতিন্দ্রীয়বাদী সাহিত্য নিয়ে যায়। কিন্তু দ্বাদশ শতাব্দী নাগাদ নির্যাতন-নিপীড়ন আশকেনায়ি ধর্মানুরাগে এক নতুন নৈরাজ্যবাদ যোগ করে। কালোনিমাস পরিবারের তিনজন সদস্যের রচনায় তা প্রকাশ পেয়েছে। স্যামুয়েল দ্য এল্ডার, যিনি ১১৫০-এর দিকে সেফার হা-ইরাহ শীর্ষক ক্ষুদে নিবন্ধ রচান করেছেন: র‍্যাবাই জুদাহ দ্য প্রিস্ট সেফার হাসিদিম (দ্য বুক অভ দ্য প্রিস্টস্) এবং তাঁর কাজিন র‍্যাবাই এলিয়েদার বেন জুদাহ অভ ওঅর্মস (মৃ: ১২৩০), যিনি বেশ কিছু প্রবন্ধ ও অতিন্দ্রীয়বাদী টেক্সট সম্পাদনা করেছেন। এঁরা দার্শনিক নিয়মনিষ্ঠ চিন্তাবিদ ছিলেন না, তাঁদের রচনাবলী দেখায় যে, তারা বিভিন্ন উৎস হতে ধারণা গ্রহণ করেছেন যেগুলো অসামঞ্জস্যপূর্ণ ঠেকতে পারে । তারা নিরস ফায়লাসুফ সা’দিয়া ইবন জোসেফের রচনায় দারুণ প্রভাবিত হয়েছিলেন, যাঁর গ্রন্থাবলী হিব্রুতে অনূদিত হয়েছিল, ও ফ্রান্সিস অভ আসিসির মতো ক্রিশ্চান অতিন্দ্রীয়বাদীদের রচনা দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। বিভিন্ন সূত্রের এই বিচিত্র মিশেল হতে তারা এমন এক আধ্যাত্মিকতা সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিলেন যা সপ্তদশ শতাব্দী পর্যন্ত ফ্রান্স ও জার্মানির ইহুদিদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ রয়ে গিয়েছে।

স্মরণযোগ্য, র‍্যাবাইগণ ঈশ্বরের সৃষ্টি আনন্দকে অস্বীকার করা পাপ হবে বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু জার্মান পিয়েটিস্টরা এমন এক ত্যাগের শিক্ষা প্রচার করলেন যা ক্রিশ্চান সংযমবাদের অনুরূপ। একজন ইহুদি আনন্দ থেকে মুখ ফিরিয়ে পশু-পাখি পোেষা, বাচ্চাদের সাথে খেলে সময় কাটানো বাদ দিলেই কেবল পরকালে শেকিনাহর দেখা পাবে। ইহুদিদের উচিত ভর্ৎসনার অপমানে নির্লিপ্ত থেকে ঈশ্বরের আপাথিয়া গড়ে তোলা। তবে ঈশ্বরকে বন্ধুর মতো সম্বোধন করা যেতে পারে। এলিয়েযারের মতো কোনও থ্রোন-সিস্টিক ঈশ্বরকে ‘তুমি’ সম্মোধন করার কথা স্বপ্নের ভাবতে পারেনি। এই পরিচয় রূপ শাস্ত্রে অনুপ্রবেশ করেছে ও এমন এক ঈশ্বরকে তুলে ধরেছে যিনি আবার সর্বত্র বিরাজমান; খুব নিবিড়ভাবে উপস্থিত দুয়ে:

সবকিছুই তোমার মাঝে আর সবকিছুর মাঝে তুমি; তুমি সবকিছু জুড়ে থাক আর ঘিরে থাক; যখন সবকিছু সৃষ্টি হলো, সবকিছুতে তুমি ছিলে, সবকিছু সৃষ্টির আগে তুমিই ছিলে সব ।[৫৩]

এই সর্বব্যাপীতোকে তারা বিশেষ রূপ দিয়েছিলেন এভাবে যে, কারও পক্ষেই স্বয়ং ঈশ্বরের নিকটবর্তী হওয়া সম্ভব নয়; তবে তিনি তাঁর প্রতাপের (কাতোদ) বা ‘শেকিনাহ নামের মহাব্যাপ্তিতে’ নিজেকে যতটা প্রকাশ করেন কেবল তারই নৈকট্য লাভ করা যায়। পিয়েটিস্টরা আপাত অসামঞ্জস্যতায় উদগ্রীব ছিল না । তারা ধর্মতাত্ত্বিক সৌন্দর্যের বদলে বরং ব্যবহারিক বিষয়ের দিকে বেশি জোর দিয়েছে, সতীর্থ ইহুদিদের মনোসংযোগের পদ্ধতি (কাওয়ানাহ) ও অঙ্গভঙ্গির শিক্ষা দান করেছে যা ঈশ্বরের উপস্থিতি সম্পর্কে তাদের অনুভূতিকে জোরাল করে তুলবে। নীরবতার আবশ্যকতা ছিল; একজন পিয়েটিস্টকে শক্ত করে চোখ বন্ধ রাখতে হবে, বিচ্যুতি এড়াতে প্রার্থনার চাদরে মাথা ঢাকতে হবে, পেট ভেতরে টেনে নিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে রাখতে হবে। তারা ড্রয়িং আউট প্রেয়ার’-এর বিশেষ কায়দা আবিষ্কার করেছিল যাতে এই বোধ উৎসাহিত হতে দেখা গেছে। শাস্ত্রের বাক্যাবলীর মামুলি পুনরাবৃত্তির বদলে পিয়েটিস্টকে প্রত্যেক শব্দের অক্ষরগুলো গুনতে হবে, ওগুলোর সংখ্যাতাত্ত্বিক মূল্য হিসাব করে ভাষার আক্ষরিক অর্থের ঊর্ধ্বে আরোহণ করতে হবে। তাকে অবশ্যই এক উন্নত সত্তার অনুভূতি জোরাল করতে ওপরের দিকে মনোযোগ দিতে হবে।

ইসলামি সাম্রাজ্যের যেসব স্থানে অ্যান্টি-সেমিটিক নির্যাতনের অস্তিত্ব ছিল না সেসব জায়গায় ইহুদিদের অবস্থা তুলনামূলকভাবে অনেক ভালো ছিল। তাদের এই আশকেনাযিয় ধর্মানুরাগের প্রয়োজন ছিল না। অবশ্য মুসলিমদের অগ্রগতির প্রতি সাড়া হিসাবে এক নতুন ধরনের ইহুদিবাদ গড়ে তুলছিল তারা। ইহুদি ফায়সুফরা যেমন বাইবেলের ঈশ্বরকে দর্শনের ভিত্তিতে ব্যাখ্যা করার প্রয়াস পেয়েছিল, ঠিক তেমনি অন্য ইহুদিরাও তাদের ঈশ্বরকে অতিন্দ্রীয় প্রতীকী ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেছে। গোড়াতে এই অতিন্দ্রীয়বাদীরা একেবারে সংখ্যালঘু একটা গোষ্ঠী ছিল। এদের অনুশীলন ছিল নিগূঢ় অনুশীলন, তাত্ত্বিক গুরুর কাছ থেকে দীক্ষা নিতে হতো: একে তারা বলত কাব্বালাহ বা উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত ঐতিহ্য। অবশ্য শেষ পর্যন্ত কাব্বালাহর ঈশ্বর সিংহভাগ মানুষকে আগ্রহী করে তুলবে ও ঈশ্বর সম্পর্কে ইহুদিদের দৃষ্টিভঙ্গিকে এমনভাবে ধারণ করবে যা দার্শনিকদের ঈশ্বরের পক্ষে কখনও সম্ভব হয়নি। দর্শন ঈশ্বরকে দূরবর্তী বিমূর্ত অস্তিত্বে পর্যবসিত করার হুমকি সৃষ্টি করেছিল, কিন্তু অতিন্দ্রীয়বাদের ঈশ্বর যুক্তির গভীরে অবস্থিত আতঙ্ক ও উদ্বেগকে স্বপর্শ করতে সক্ষম ছিলেন। থ্রোন মিস্টিকরা যেখানে বাহ্যিকভাবে ঈশ্বরের ‘প্রতাপ লক্ষ করেই সম্ভষ্ট ছিল, কাব্বালিস্টরা সেখানে ঈশ্বরের অন্তস্থ জীবন ও মানুষের চৈতন্যকে ভেদ করার প্রয়াস পেয়েছে। ঈশ্বরের রূপ নিয়ে যুক্তির ভিত্তিতে অগ্রসর হওয়া ও জগতের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের সমস্যাদি নিয়ে মাথা ঘামানোর বদলে কাব্বালিস্টরা কল্পনার আশ্রয় নিয়েছিল।

সুফীদের মতো কাব্বালিস্টরাও ঈশ্বরের মূল সত্তা এবং প্রত্যাদেশ ও সৃষ্টিতে আমরা যে ঈশ্বরের দেখা পাই এ দুয়ের মাঝে নস্টিক ও নিওপ্লেটোনিক পার্থক্যের ব্যবহার করেছে। স্বয়ং ঈশ্বর অত্যাবশ্যকীয়ভাবে জ্ঞানের অতীত, দুর্বোধ্য ও নৈর্ব্যক্তিক। গুপ্ত ঈশ্বরকে তারা এন সফ অভিহিত করত (আক্ষরিক অর্থে ‘অন্ত হীন’)। এন সফ সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি নাঃ এমনকি বাইবেল বা তালমুদে তাঁর নামোচ্চারিত হয়নি। ত্রয়োদশ শতাব্দীর অজ্ঞাতনামা এক লেখক লিখেছেন, এন সফ মানুষের কাছে প্রকাশিত হওয়ার মতো বিষয়ে পরিণত হতে অপারগ।৫* YHWH’র বিপরীতে এন সফের দালিলিক কোনও নাম ছিল না; তিনি কোনও ব্যক্তি নন। প্রকৃতপক্ষে গডহেডকে বোঝাতে ‘এটা বলাই অধিকতর সঠিক। এটা বাইবেল ও তালমুদের প্রবলভাবে ব্যক্তিক ঈশ্বরের ধারণা হতে মারাত্মক বিচ্যুতি। কাব্বালিস্টরা নির্দিষ্ট ধর্ম বিরোধিতার দিকে না গিয়ে এন সক ও YHWH’-র মধ্যে সম্পর্ক ব্যাখ্যা করার জন্যে ধর্মীয় চৈতন্যের এক নতুন জগতে পদচারণার জন্যে নিজস্ব মিথলজির জন্ম দিয়েছে; যেখানে বলা হচ্ছে, এরা দুটো আলাদা সত্তা। কাব্বালিস্টরা ঐশীগ্রন্থ পাঠের এক প্রতীকী পদ্ধতির আবিষ্কার করে। সুফীদের মতো তারা এমন একটা প্রক্রিয়ার কথা কল্পনা করেছে যার মাধ্যমে গুপ্ত ঈশ্বর মানুষের সামনে হাজির হন। এন সফ দশটি ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য বা সেফিরদ অর্থাৎ সংখ্যায় ইহুদি অতিন্দ্রীয়বাদীদের সামনে নিজেকে প্রকাশ করেন, এই সংখ্যাগুলো জ্ঞানের অতীত গডহেডের অজ্ঞাত গভীরতা থেকে উৎসারিত স্বর্গীয় সত্তার অংশ। প্রতিটি সেফিরাহ এন সফের প্রকাশের এক একটি স্তরের প্রতিনিধিত্ব করে; এর নিজস্ব প্রতীকী নাম আছে, কিন্তু এইসব স্বর্গীয় বলয়ের প্রতিটিই একেকটি বিশেষ শিরোনামের অধীনে ঈশ্বরের রহস্যের সম্পূর্ণটুকুই ধারণ করে। কাব্বালিস্টিক ব্যাখ্যায় বাইবেলের প্রতিটি শব্দ দশটি সেফিরদের কোনও একটিকে নির্দেশ করে: প্রতিটি পঙক্তি এমন এক ঘটনা বা বিষয়ের বর্ণনা করে যার অনুরূপ স্বয়ং ঈশ্বরের অন্তর্গত জীবনে অস্তিত্বমান ছিল।

ইবন আল-আরাবী ঈশ্বরের সহমর্মিতার নিদর্শন দেখেছিলেন, যা তাঁকে মানবজাতির সামনে প্রকাশ করেছে, বিশ্বজগতকে সৃজনকারী বাণী হিসাবে। মোটামুটি ঠিক একইভাবে সেফিরদ ঈশ্বর স্বয়ং নিজেকে যে নামসমূহ দিয়েছেন আর যা দিয়ে বিশ্ব সৃষ্টি করেছেন এ দুটোই। এই দশটি নাম এক হয়ে তাঁর একটি মহানাম সৃষ্টি করেছে, যা মানুষ জানে না। এগুলো এন সফের নিঃসঙ্গ অগম্য অবস্থান থেকে পার্থিব জগতে অবতরণ করার পর্যায়গুলোর প্রতিনিধিত্ব করে। এগুলো সাধারণত এভাবে তালিকাভুক্ত করা হয়:

১. কেদার ইলিয়ন: ‘সর্বোত্তম মুকুট ২. হোখমাহ: ‘প্রজ্ঞা’ ৩. বিনাহ: বুদ্ধিমত্তা ৪. হেসেদ: ‘প্রেম’ বা ‘করুণা’। ৫. দিন: ক্ষমতা’ (সাধারণভাবে কঠিন বিচারে প্রকাশ পায়)। ৬. রাখামিম: সহমর্মিতা, অনেক সময় তিফারেদ’: ‘সৌন্দর্য বলা হয়। ৭. নেতসাখ: দীর্ঘস্থায়ী ৮. হদ: আভিজাত্য ৯. ইয়েসদ: ‘ভিত্তি’ ১০. মালকুদ: ‘রাজ্য’; ‘শেকিনাহ’ও বলা হয় ।

অনেক সময় উপর হতে নিচের দিকে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত গাছের মতো করেও সেফিরদকে উপস্থাপন করা হয়, এর শেকড় এন সফের দুর্বোধ্য গভীরতায় প্রোথিত (চিত্র দেখুন এবং এর সর্বোচ্চ বিন্দু শেকিনাহয়, জগতে। এই কাঠামোগত ইমেজ কাব্বালিস্টিক প্রতাঁকের ঐক্য প্রকাশ করে। এন এফ হচ্ছেন গাছের শাখাপ্রশাখা দিয়ে প্রবাহিত হয়ে তাদের জীবন দানকারী প্রাণরস যা এক রহস্যময় জটিল সত্তায় একীভূত করে দেয়। যদিও এন এফ ও তার নামের জগতের ভেতর পার্থক্য রয়েছে, কিন্তু উভয়ই কয়লা আর আগুনের মতো এক। সেফিরদ এন সফের দুর্ভেদ্য অস্পষ্টতায় বিরাজমান অন্ধকারকে প্রকাশকারী আলোর জগতকে তুলে ধরে। আমাদের ধারণাসমূহ যে পুরোপুরি ‘ঈশ্বর’কে প্রকাশ করতে পারে না সেটা দেখানোরই আরেকটি উপায় এটা ।

অবশ্য সেফিরদের জগৎ গডহেড ও পৃথিবীর মাঝখানে মহাশূন্যের বিকল্প কোনও বাস্তবতা নয়। এগুলো স্বর্গ ও পৃথিবীর মধ্যবর্তী কোনও মইয়ের ধারা নয়, বরং আমাদের অনুভূতি দিয়ে উপলব্ধি করা পৃথিবীর ভিত্তি।

The Tree of the Sefiroth

ঈশ্বর যেহেতু সর্বেসর্বা, সেফির অস্তিত্বময় এমন সমস্ত কিছুতেই উপস্থিত এবং সক্রিয়। এগুলো মানুষের চেতনার পর্যায়গুলোও বোঝায় যার মাধ্যমে অতিন্দ্রীয়বাদীরা আপন মনে অবতরণ করে ঈশ্বরের দিকে আরোহণ করে থাকে। আবার ঈশ্বর ও মানুষকে অবিচ্ছেদ্য হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে। কোনও কোনও কাব্বালিস্ট সেফিরদ’কে ঈশ্বর পরিকল্পিত আদি মানুষের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ হিসাবেও দেখেছে। মানুষকে ঈশ্বরের প্রতিরূপে সৃষ্টি করা হয়েছে বলে বাইবেল একথাই বোঝাতে চেয়েছিল: পার্থিব বাস্তবতা স্বর্গীয় জগতের আদি আদর্শ বাস্তবতার অনুরূপ । গাছ বা মানুষের মতো ঈশ্বরের ইমেজসমূহ এমন এক সত্তার কল্পনা যা যৌক্তিক সূত্রবদ্ধকরণ অস্বীকার করে। কাব্বালিস্টরা ফালসাফাহর প্রতি বৈরীভাবাপন্ন ছিল না-তাদের অনেকেই সাদিয়া, গাওন এবং মায়মোনিদসের মতো ব্যক্তিদের শ্রদ্ধা করত-কিন্তু ঈশ্বরের রহস্য উদ্বাটনের ক্ষেত্রে মেটাফিজিক্সের চেয়ে প্রতীকীবাদ ও মিথলজিই অধিকতর সন্তোষজনক হিসাবে আবিষ্কার করেছিল তারা।

কাব্বালিস্টিক সাহিত্যের সবচেয়ে প্রভাবশালী রচনা ছিল দ্য যোহার: সম্ভবত ১২৭৫-এ স্পেনের অতিন্দ্রীয়বাদী মোজেস অভ লিয়নের রচনা। তরুণ বয়সে মায়মোনিদসের রচনা পাঠ করলেও আস্তে আস্তে কাব্বালাহর নিগূঢ় তত্ত্ব। অতিন্দ্রীয়বাদে আকৃষ্ট হয়ে উঠেন তিনি। দ্য যোহার অনেকটা অতিন্দ্রীয়বাদী উপন্যাসের মতো, যেখানে তৃতীয় শতাব্দীর তালমুদ বিশেষজ্ঞ সিমিয়ন বেন। ইয়োহাই পুত্র এলিয়েযারকে নিয়ে প্যালেস্তাইনের আশপাশে ঘুরে ঘুরে অনুসারীদের সঙ্গে ঈশ্বর, প্রকৃতি ও মানব জীবন প্রসঙ্গে আলোচনা করার কথা বর্ণনা করা হয়েছে। এখানে স্পষ্ট কোনও কাঠামো বা ধারণা কিংবা অনুমানের ধারাবাহিক কোনও বিকাশ নেই। এমন কোনও পদ্ধতি দ্য যোহারের চেতনার সঙ্গে বেমানান হতো, তাঁর ঈশ্বর চিন্তার যেকোনও বিন্যস্ত পদ্ধতি প্রতিহত করে থাকেন। ইবন আল-আরাবীর মতো মোজেস অভ লিয়ন বিশ্বাস করতেন, ঈশ্বর প্রত্যেক অতিন্দ্রীয়বাদীকে অনন্য ও ব্যক্তিগত দর্শন দিয়ে থাকেন, সুতরাং তোরাকে ব্যাখ্যা করার উপায়ের কোনও সীমা পরিসীমা নেই: কাব্বালিস্ট যখন অগ্রসর হয়, পরতের পর পরত তাৎপর্য উন্মোচিত হয়ে পড়ে। দ্য যোহার দশটি সেফিরদের রহস্যময় উৎসারণকে এমন এক প্রক্রিয়া হিসাবে দেখিয়েছে যার মাধ্যমে নৈর্ব্যত্তিক এন এফ একজন ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছেন। সর্বোচ্চ তিনটি সেফিরদে-কেদার, হোখমাহ এবং বিনাহযখন, যেমন মনে করা হয়, এন সফ কেবল নিজেকে প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তখন ঐশীসত্তাকে ‘তিনি’ বলা হয়। তিনি যখন মধ্যবর্তী সেফিরদ হেসেদ, দিন, তিফারেদ, নেতসাখ, হোদ, ইয়েসদ-হয়ে অবতরণ করেন, তখন তিনি পরিণত হন, ‘তুমি’তে। সবশেষে ঈশ্বর যখন ‘শেকিনাহ’য়, এই পৃথিবীতে উপস্থিত হন, তিনি নিজেকে বলেন ‘আমি’। এই পর্যায়ে, যেমন মনে করা হয়, ঈশ্বর একজন ব্যক্তিতে পরিণত হন, তার আত্মপ্রকাশ সম্পূর্ণ হয়। মানুষ তখন তার অতিন্দ্রীয়বাদী যাত্রা শুরু করতে পারে। অতিন্দ্রীয়বাদী আপন গভীরতম সত্তার উপলব্ধি অর্জন করার পর নিজের মাঝে ঈশ্বরের উপস্থিতি সম্পর্কে আরও সজাগ হয়ে ওঠে এবং ব্যক্তিত্ব ও অহমের সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে অধিকতর নৈর্ব্যত্তিক বলয়ে আরোহণ করতে পারে। এটা আমাদের সত্তার কল্পনাতীত উৎস ও অসৃষ্ট বাস্তবতার গুপ্ত জগতে প্রত্যাবর্তন। এই অতিন্দ্রয়ীবাদী দৃষ্টিকোণে, আমাদের অনুভূতি প্রকাশক জগৎ ঐশীসত্তার শেষ এবং বহিস্থঃ খোলস মাত্র।

সুফীবাদের মতো কাব্ব্যলাহ সৃষ্টির মতবাদে মহাবিশ্বের বস্তুগত উৎপত্তি নিয়ে মাথা ঘামায় না। দ্য যোহার জেনেসিসের বিবরণকে এন সফের অন্তস্থ সংকটের প্রতীকী ভাষ্য হিসাবে দেখে, যার ফলে গডহেড তার অতলান্ত অন্তর্মুখীনতা থেকে বেরিয়ে এসে নিজেকে প্রকাশ করেছেন। দ্য যোহার যেমন বলেছে:

আদিতে রাজার ইচ্ছা যখন কার্যকর হতে শুরু করল, স্বর্গীয় প্রভায় চিহ্ন খোদাই করলেন তিনি। এন সফের গভীরতম অন্তর হতে এক গাঢ় শিখা জ্বলে উঠল, স্বর্গীয় প্রভার বলয়ে আটকা পড়া নিরাকার হতে জমে ওঠা কুয়াশার মতো, শাদাও নয়, কালোও, লাল নয়, সবুজও নয়, কোনও রঙেরই নয় ।[৫৫]

জেনেসিসে ঈশ্বরের প্রথম সৃজনশীল বাণীটি ছিল: ‘লেট দেয়ার বি লাইট! দ্য যোহার প্রদত্ত জেনেসিসের বিবরণের (হিব্রু ভাষায় বলা হয় রেরেশিত), সুচনার ‘আদিতে’ শব্দের পরে), এই ‘গাঢ় শিখা হলো প্রথম সেফিরাহ: কেদার এলিয়ন, ঈশ্বরের সর্বোত্তম মুকুট। এর কোনও রঙ বা আকার নেই: অন্য কাব্বালিস্টরা একে কিছু না (আইন) বলতে পছন্দ করে। মানুষের উপলব্ধিতে আসতে পারে ঐশীরূপের এমন সর্বোচ্চ ধরণকে শূন্যতার সঙ্গে মেলানো হয়েছে, কারণ এর সঙ্গে অস্তিত্ব আছে এমন কোনও কিছুর কোনও তুলনা হয়। না। সুতরাং বাকি সব সেফিরদ শূন্যতার গর্ত থেকে আবির্ভূত হয়েছে। এটা শূন্য হতে সৃষ্টির প্রথাগত মতবাদের একটি অতিন্দ্রীয়বাদী ব্যাখ্যা। গডহেডের আত্মপ্রকাশের প্রক্রিয়া আলোর বিস্তারের সঙ্গে অব্যাহত থাকে, যা অধিকতর ব্যাপক বলয়ে ছড়িয়ে পড়ে। দ্য যোহার বলছে:

কিন্তু এই শিখাঁটি আকৃতি আর বিস্তৃতি নিতে শুরু করলে উজ্জ্বল বর্ণের সৃষ্টি করে। কারণ একেবারে অন্তস্থ কেন্দ্রে এক গহ্বর জেগে ওঠে যেখান থেকে নিচের যা কিছু এন সফের রহস্যময় গোপনীয়তায় লুকায়িত সমস্ত কিছুর ওপর অগ্নি ঝরায় । গহ্বর ভেঙে যায়, কিন্তু এর চারপাশের চিরন্তন প্রভাকে পুরোপুরিভাবে ভেদ করে না। ভাঙনের প্রভাবে আসার আগে পর্যন্ত পুরোপুরি শনাক্তযোগ্য থাকে এটা, একটা গোপন স্বর্গীয় বিন্দু আবির্ভূত হয়। এই বিন্দুর অতীত কোনও কিছু জানা বা বোঝা নাও যেতে পারে এবং একে বলে বেরেশিত, সুচনা; সৃষ্টির প্রথম বাণী ।[৫৬]

এই ‘বিন্দু’টি হচ্ছে দ্বিতীয় সেফিরাহ হোখমাহ (প্রজ্ঞা), যা সকল সৃষ্ট বস্তুর আদর্শ আকার ধারণ করে। বিন্দুটি এক রাজপ্রাসাদ বা দালানে পরিণত হয়, যা তৃতীয় সেফিরাহ অর্থাৎ বিনাহয় রূপান্তরিত হয়। এই তিন সর্বোচ্চ সেফিরদ মানুষের উপলব্ধির সীমানা প্রকাশ করে। কাব্বালিস্টরা বলে যে, ঈশ্বর বিনাহর মহান ‘কে?’ (Mi) রূপে অবস্থান করেন, যা প্রত্যেক জিজ্ঞাসার শুরুতে থাকে। কিন্তু জবাব পাওয়া সম্ভব নয়। যদিও এন সফ ক্রমশঃ নিজেকে মানবীয় সীমাবদ্ধতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিচ্ছেন, কিন্তু আমাদের জানার কোনও উপায় নেই তিনি কে? আমরা যতই ওপরে উঠি, ততই অন্ধকার আর রহস্যে আবৃত্ত রয়ে যান।

পরবর্তী সাতটি সেফিরদ জেনেসিসের সৃষ্টির সাত দিনের অনুরূপ বলে বর্ণিত। বাইবেলিয় আমলে YHWH শেষ পর্যন্ত কানানের প্রাচীন দেবী এবং তাদের ইরোটিক কাল্টসমূহের বিপক্ষে বিজয়ী হয়েছিলেন। কিন্তু কাব্বালিস্টরা ঈশ্বরের রহস্য প্রকাশের কঠোর প্রয়াস পাওয়ার সময় খানিকটা ভিন্ন রূপে হলেও প্রাচীন মিথলজিগুলো আবার নিজস্ব জায়গা করে নেয়। দ্য যোহার বিনাহুকে ‘ঐশী মাতা হিসাবে বর্ণনা করেছে, যার গর্ভ গাঢ় শিখা ছেদ করে নিম্নস্থ সাতটি সেফিরদকে জন্ম দেওয়ার জন্যে। আবার নবম সেফিরাহ ইয়েসদ এক ধরনের ধর্মীয় লিঙ্গের কল্পনা অনুপ্রাণিত করে: একে একটা সুড়ঙ বা পথ হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে যার ভেতর দিয়ে অতিন্দ্রীয় প্রসবের মতো স্বর্গীয় প্রাণ মহাবিশ্বে বর্ষিত হয়। তবে দশ সেফিরাহ শেকিনাহতেই সৃষ্টির যৌন প্রতীক ও থিওগোনি স্পষ্টতরভাবে উপস্থিত। তালমুদে শেকিনাহ নিরপেক্ষ চরিত্র: এর কোনও লিঙ্গ বা যৌনতা ছিল না। কিন্তু কাব্বালায় শেকিনাহ্ ঈশ্বরের নারীরূপে পরিণত হয়েছে। প্রাথমিক যুগের অন্যতম কাব্বালিস্ট টেক্সট বাহির-এ (ca. ১২০০) শেকিনাহূকে নাস্টিক চরিত্র প্লেরোমা হতে পতিত বর্তমানে ঘুরে বেড়ানো জগতের মাধ্যমে গডহেড হতে বিচ্যুত স্বর্গীয় উৎসারণের শেষটি অর্থাৎ সোফিয়ার সঙ্গে মেলানো হয়েছে। দ্য যোহার ‘শেকিনাহর এই নির্বাসন’কে জেনেসিসে বর্ণিত আদমের পতনের সঙ্গে যুক্ত করেছে। এটা বলছে যে, আদমকে ‘জীবন বৃক্ষে’র ‘মধ্য সেফিয়দ ও ‘জ্ঞানবৃক্ষের’ শেকিনাহকে দেখানো হয়েছিল। সাতটি সেফিরদকে একসঙ্গে উপাসনা করার বদলে তিনি কেবল শেকিনাহকে উপাসনার জন্যে বেছে নিয়ে জীবনকে জ্ঞান হতে বিচ্ছিন্ন করেছেন এবং সেফিরদের ঐক্য নষ্ট করেছেন। স্বর্গীয় উৎস হতে বিচ্ছিন্ন স্বর্গীয় জ্ঞান আর বাধাহীনভাবে পৃথিবীতে প্রবাহিত হতে পারেনি। কিন্তু তোরাহ্ অনুসরণের মাধ্যমে ইসরায়েলের জনগোষ্ঠী শেকিনাহ্র নির্বাসনের অবসান ঘটিয়ে ফের গডহেডের জগতের সঙ্গে মিলিত হতে পারে। এখানে বিস্ময়ের কিছু নেই যে, বহু গোঁড়া তালমুদ অনুসারী এ ধারণাকে ঘৃণাৰ্য মনে করেছে, কিন্তু শেকিনাহর নির্বাসন, যা কিনা ঐশীজগৎ হতে দূরে ঘুরে বেড়ানো দেবীদের কিংবদন্তীর প্রতিধ্বনি, কাব্বালাহর অত্যন্ত জনপ্রিয় উপাদানে পরিণত হয়েছিল। নারী শেকিনাহ্ প্রবলভাবে পুরুষবাচক অর্থের দিকে ঝুঁকে থাকা ঈশ্বরের ধারণায় কিছুটা যৌন-ভারসাম্য এনেছিল: এটা একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় প্রয়োজনও মিটিয়েছে।

স্বর্গীয় নির্বাসনের ধারণা মানুষের বহু উদ্বেগের কারণ বিচ্ছেদের অনুভূতিকেও প্রকাশ করেছে। দ্য যোহার অব্যাহতভাবে অশুভকে এমন কিছু হিসাবে সংজ্ঞায়িত করেছে যা বিচ্ছিন্ন হয়েছে বা যা এমন এক সম্পর্ক স্থাপন করেছে যার সঙ্গে এটা খাপ খায় না। নৈতিকতাবাদী একেশ্বরবাদের অন্যতম সমস্যা হলো এটা অশুভকে পৃথক করে দেয়। আমরা যেহেতু আমাদের ঈশ্বরের মাঝে অশুভের অবস্থানের ধারণা গ্রহণ করতে পারি না, সেহেতু আমাদের নিজেদের মাঝেও একে সহ্য করতে না পারার এক ধরনের বিপদ আছে। তখন এটাকে দূরে ঠেলে দিয়ে দানবীয় ও অমানবিক করে ফেলা হতে পারে । পশ্চিমের ক্রিশ্চান জগতে ভীতিকর শয়তানের ইমেজ এমনি এক বিকৃত অভিক্ষেপ। দ্য যোহার পঞ্চম সেফিরাহ ‘দিন’ বা ‘কঠিন বিচারে স্বয়ং ঈশ্বরের মাঝে অশুভের মুল আবিষ্কার করেছে। দিনকে ঈশ্বরের বাম হাত হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে, হেসেদ (করুণা) তার ডান হাত দিন যতক্ষণ স্বর্গীয় করুণার সঙ্গে তাল মিলিয়ে কার্যকর থাকে ততক্ষণ এটা ইতিবাচক ও উপকারী। কিন্তু অন্যান্য সেফিরদ থেকে বিচ্ছিন্ন ও আলাদা হয়ে গেলে অশুভও ধ্বংসাত্মক হয়ে ওঠে। কিন্তু এই বিচ্ছিন্নতার সৃষ্টি কীভাবে হয় দ্য যোহার সেটা আমাদের বলে না। পরবর্তী অধ্যায়ে আমরা দেখব, পরবর্তী সময়ের কাব্বালিস্টরা অশুভের সমস্যা নিয়ে চিন্তা ভাবনা করে দেখেছে যে, ‘অশুভ’ হচ্ছে ঈশ্বরের আত্মপ্রকাশের একেবারে গোড়ার দিকে কোনও ধরনের আদিম ‘দুর্ঘটনার ফল। আক্ষরিক অর্থে ব্যাখ্যা করতে গেলে কাব্বালাই তেমন কোনও অর্থ প্রকাশ করে না, কিন্তু এর মিথলজি মনস্তাত্ত্বিকভাবে সন্তোষজনক প্রতীয়মান হয়েছে। পঞ্চদশ শতাব্দীতে স্প্যানিশ ইহুদি সম্প্রদায়কে যখন দুর্যোগ-দুর্দশায় গ্রাস করে তখন কাব্বালিস্ট ঈশ্বরই তাদের দুর্ভোগের একটা তাৎপর্য খুঁজে পেতে সাহায্য করেছেন।

আমরা স্প্যানিশ অতিন্দ্রীয়বাদী আব্রাহাম আবুলাফিয়ার (১২৪০-১২৯১ এর পর) রচনাবলীতে কাব্বালাহর মনস্তাত্ত্বিক তীক্ষ্ণতার পরিচয় পাই । মোটামুটি দ্য যোহারের সমসাময়িককালেই তার অধিকাংশ রচনা প্রকাশ পেলেও আবুলাফিয়া স্বয়ং ঈশ্বরের রূপ বা প্রকৃতির পরিবর্তে বরং ঈশ্বরের বোধ অর্জনের ব্যবহারিক কৌশল আবিষ্কারের দিকে মনোযোগ দিয়েছিলেন। এসব পদ্ধতির সঙ্গে বর্তমানকালের সাইকোঅ্যানালিস্টদের ব্যবহৃত আলোকনের জন্যে সেকুলার অনুসন্ধান পদ্ধতির মিল রয়েছে। সুফীরা যেমন মুহাম্মদের (স) মতো ঈশ্বরের অনুভূতি লাভ করতে চেয়েছে, তেমনি আবুলাফিয়া পয়গম্বরসুলভ অনুপ্রেরণা লাভের উপায় বের করার দাবি করেছেন। শ্বাস প্রশ্বাস, মন্ত্রোচ্চারণ ও চৈতন্যের বিকল্প একটা অবস্থা অর্জনের লক্ষ্যে বিশেষ ভঙ্গি প্রয়োগের মাধ্যমে যোগের ইহুদি ধরণ আবিষ্কার করেছিলেন তিনি। আবুলাফিয়া ব্যতিক্রমী কাব্বালিস্ট ছিলেন। তিনি ছিলেন উচ্চ শিক্ষিত । তোরাহ, তালমুদ ও ফালসাফাহ পাঠের পর একত্রিশ বছর বয়সে এক অদম্য ধর্মীয় অভিজ্ঞতার ফলে অতিন্দ্রীয়বাদে দীক্ষিত হয়েছিলেন। নিজেকে কেবল ইহুদি নয় বরং ক্রিশ্চানদেরও মেসায়াহ বলে বিশ্বাস করতেন তিনি। সে হিসাবে গোটা স্পেন এমনকি নিকট প্রাচ্য পর্যন্ত সফর করে অনুসারী সংগ্রহ করেছেন। ১২৮০ সালে ইহুদি দূত হিসাবে পোপের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। যদিও আবুলাফিয়া খৃস্টধর্মের সমালোচনার বেলায় যারপরনাই উচ্চকণ্ঠ ছিলেন, তা সত্ত্বেও কাব্বালিস্টিক ঈশ্বর ও ট্রিনিটির ধর্মতত্ত্বের মিল উপলব্ধি করেছিলেন। সর্বোচ্চ তিনটি সেফিরদ ঈশ্বরের বুদ্ধিমত্তা ও প্রজ্ঞার স্মারক লোগোস ও আত্মার যা অগম্য আলোয় হারিয়ে যাওয়া কিছু না বা পিতা হতে অগ্রসর হয়েছে। আবুলাফিয়া স্বয়ং ট্রিনিটির কায়দায় ঈশ্বর সম্পর্কে আলোচনা পছন্দ করতেন।

এই ঈশ্বরকে পাওয়ার জন্যে আবুলাফিয়া ‘আত্মাকে উনুক্তি করতে একে বেঁধে রাখা গিঁটগুলো খোলার প্রয়োজনের শিক্ষা দিয়েছিলেন। গিঁট খোলার কথা তিব্বতিয় বুদ্ধ মতবাদেও দেখা যায়। বিশ্বব্যাপী অতিন্দ্রীয়বাদীদের মৌলিক মিলের আরেকটা ইঙ্গিত এটা। বর্ণিত প্রক্রিয়াকে রোগির মানসিক গঠনকে ব্যাহতকারী জটিলতাসমূহ উন্মুক্ত করার সাইকোঅ্যানালিটিক প্রয়াসের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। কাব্বালিস্ট হিসাবে আবুলাফিয়া সমগ্র সৃষ্টিকে সচলকারী স্বর্গীয় শক্তির ব্যাপারে অধিকতর আগ্রহী ছিলেন আত্মা যা ধারণ করতে পারে না। আমরা যতক্ষণ ইন্দ্রিয় ধারণার ভিত্তিতে সৃষ্ট মতামত দিয়ে আমাদের মনকে আচ্ছন্ন করে রাখব ততক্ষণ জীবনের দুর্জেয় উপাদান আলাদা করা দুরূহ। আবুলাফিয়া অনুসারীদের যোগানুশীলনের মাধ্যমে এক নতুন জগৎ আবিষ্কারের জন্যে স্বাভাবিক চেতনার উর্ধ্বে যাবার শিক্ষা দিয়েছেন। তাঁর পদ্ধতিসমূহের অন্যতম ছিল হোখমাহ হা- সেরুফ যা ঈশ্বরের নামের ধ্যানের রূপ নিয়েছিল। একজন কাব্বালিস্টকে অধিকতর বিমূর্ত এক ধারণায় মনোসংযোগের লক্ষ্যে নিরেট বিষয়বস্তু হতে মনকে সরিয়ে আনতে ঈশ্বরের নামগুলোকে বিভিন্নভাবে সাজানোর প্রয়োজন হতো। এই অনুশীলনের প্রভাব-বহিরাগত কারও চোখে খুবই নৈরাজ্যজনক মনে হতে পারে-অসাধারণ ছিল বলেই ধারণা হয়। আবুলাফিয়া স্বয়ং একে সঙ্গীতের মূছনা শোনার অনুভূতির সঙ্গে তুলনা করেছেন, বর্ণমালার অক্ষরগুলো স্কেলের বিভিন্ন সুরের স্থান অধিকার করে নিচ্ছে। বিভিন্ন ধারণাকে একীভূত করার একটি প্রক্রিয়াও সৃষ্টি করেছিলেন তিনি যার নাম দিয়েছেন দিল্লাগ (লাফানো) এবং কেফিতসাহ (স্কিপিং), যা স্পষ্টই আধুনিক ফ্রী অ্যাসোসিয়েশনের অ্যানালিটিক্যাল অনুশীলনের অনুরূপ। আবার, এটাও বিস্ময়কর ফল বহন করত বলে কথিত আছে । আবুলাফিয়া যেমন ব্যাখ্যা করেছেন, এতে গোপন মনস্তাত্ত্বিক প্রক্রিয়া আলোর দিকে আসে ও কাব্বালিস্টকে স্বাভাবিক বলয়সমূহের কারাগার হতে মুক্ত করে ‘স্বর্গীয় বলয়ের সীমানায় নিয়ে যায়।৫৭ এইভাবে আত্মার ‘বন্ধনসমূহ’ মুক্ত হয়ে শিক্ষাব্রতী মানসিক শক্তির উৎস আবিষ্কার করে যা তার মনকে আলোকিত করে হৃদয়ের বেদনা দূর করে।

সাইকোঅ্যানালিটিক রোগির যেমন তার থেরাপিস্টের নির্দেশনার প্রয়োজন হয়, অনেকটা ঠিক সে রকম, আবুলাফিয়া জোর দিয়ে বলেছেন, মনের গভীরে অতিন্দ্রীয় যাত্রা কেবল কোনও কাব্বালাহ্ গুরুর তত্ত্বাবধানেই শুরু করা যাবে। বিপদ সম্পর্কে পুরোপুরি সজাগ ছিলেন তিনি, কারণ তরুণ বয়সে তিনি স্বয়ং এক ভয়ঙ্কর ধর্মীয় অভিজ্ঞতার শিকার হয়েছিলেন যা তাকে প্রায় হতাশায় ডুবিয়ে দিয়েছিল। আজকের দিনে রোগিরা প্রায়শঃই তার শক্তি বা স্বাস্থ্যকে যথাযথ করার লক্ষ্যে অ্যানালিস্টের ব্যক্তিত্বকে আস্তস্থ করে নেয়। একইভাবে আবুলাফিয়া লিখেছেন যে, কাব্বালিস্ট প্রায়ই তার আধ্যাত্মিক গুরুর সত্তাকে ‘দেখবে’ বা তার কথা শুনবে, যিনি তার ভেতর থেকে পরিচালকে’ পরিণত হয়েছেন, যিনি তার সঙ্গে বদ্ধ দরজা খোলেন। শক্তির এক নতুন স্রোত ও এক অদম্য অভ্যন্তরীণ পরিবর্তন টের পাবে সে যা ঐশী উৎস হতে আগত বলে মনে হবে। আবুলাফিয়ার একজন অনুসারী পরমানন্দের অবস্থার ভিন্ন রকম ব্যাখ্যা দিয়েছেন: অতিন্দ্রীয়বাদী, বলেছেন তিনি, নিজের মেসায়াহয় পরিণত হয়। পরম মোহাবিষ্ট আনন্দের অবস্থায় আপন মুক্ত ও আলোকপ্রাপ্ত সত্তার দর্শনের মুখোমুখি হয় সে:

স্মরণ রাখবে, পয়গম্বরের জন্যে পয়গম্বরত্বের সম্পূর্ণ চেতনা হচ্ছে সহসা সে আপন সত্তাকে নিজের সামনে দাঁড়ানো অবস্থায় দেখতে পায় এবং আপন সত্তা বিস্মৃত হয়; সেখান হতে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নেয়…এবং এই গুপ্ত বিষয় সম্পর্কে আমাদের শিক্ষকগণ তালমুদে বলেছেন: ‘পয়গম্বরদের শক্তি অসাধারণ, “তার” আকারের তুলনা করে যিনি এর আকার দিয়েছেন।’ (অর্থাৎ, যিনি মানুষকে ঈশ্বরের সঙ্গে তুলনা করেন।]

ইহুদি অতিন্দ্রীয়বাদীরা সবসময় ঈশ্বরের সঙ্গে বিলীন হওয়ার দাবি তুলতে অনীহ ছিল। আবুলাফিয়া ও তাঁর অনুসারীরা শুধু বলতেন যে, একজন আধ্যাত্মিক গুরুর সঙ্গে একীভূত হওয়ার অভিজ্ঞতা বা ব্যক্তিগত মুক্তি অর্জন লাভ করে কাব্বালিস্ট পরোক্ষভাবে ঈশ্বরের স্পর্শ লাভ করত। মধ্যযুগীয় অতিন্দ্রীয়বাদের সঙ্গে আধুনিক সাইকোথেরাপির অবশ্যই সুস্পষ্ট পার্থক্য আছে, কিন্তু দুটো শাস্ত্রই আরোগ্য ও ব্যক্তিগত সংহতি অর্জনের একই ধরনের কৌশল আবিষ্কার করেছে।

পশ্চিমের ক্রিশ্চানরা অতিন্দ্রীয়বাদী ঐতিহ্য গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ধীরগতি ছিল। বাইন্তানিয় ও ইসলামি সাম্রাজ্যর একেশ্বরবাদীদের পেছনে পড়ে গিয়েছিল তারা এবং সম্ভবত এই অভিনব পরিবর্তনের জন্যে তৈরি ছিল না। অবশ্য, চতুর্দশ শতাব্দীতে বিশেষ করে উত্তর ইউরোপে অতিন্দ্রীয়বাদী ধর্মের বৈচিত্র্যপূর্ণ বিস্ফোরণ দেখা দিয়েছিল। বিশেষত জার্মানিতে অতিন্দ্রীয়বাদীদের এক ঝাঁক জন্ম দিয়েছিল যেন: মেইস্তার একহাত (১২৬০-১৩২৭), জোহানেস তাওলার (১৩০০-৬১), গারদ দ্য গ্রেট (১২৫৬-১৩০২) ও হেনরি সুসসা (ca. ১২৯৬-১৩০৬)। পশ্চিমের এই পরিবর্তনে ইংল্যান্ডও তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রাখে এবং এমন কয়েকজন অতিন্দ্রীয়বাদীর জন্ম দেয় যারা নিজ দেশের পাশাপাশি গোটা মহাদেশেও অত্যন্ত দ্রুত অনুসারী লাভ করেছিলেন: হ্যামপোলো রিচার্ড রোলে (১২৯০-১৩৪৯), দ্য ক্লাউড অভ আনোউইং-এর অজ্ঞাত লেখক, ওয়াল্টার হিল্টন (মৃত্যু, ১৩৪৬) ও নরউইচের ডেম জুলিয়ান (ca. ১৩৪২-১৪১৬। এই অতিন্দ্রীয়বাদীদের কেউ কেউ অন্যদের চেয়ে বেশ অগ্রসর ছিলেন। উদাহরণ স্বরূপ, রিচার্ড রোলে যেন অদ্ভুত শিহরণের ফাঁদে আটকা পড়ে গিয়েছিলেন; আধ্যাত্মিকতাকে এক ধরনের অহমবোধে বৈশিষ্টায়িত করা হয়েছে। কিন্তু সবার সেরা যারা ছিলেন তাঁরা নিজেদের জন্যে ইতিমধ্যে গ্রিক, সুফী ও কাব্বালিস্টদের অর্জিত দর্শনসমূহের অনেকগুলোই ফের আবিষ্কার করেছিলেন।

উদাহরণস্বরূপ, মেইস্তার একহাত যদিও তাওলার ও সুসসার ওপর প্রভাব ফেলেছেন, কিন্তু তিনি স্বয়ং ডেনিস দ্য আরোপ্যাগাইত ও মায়মোনিদসের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। অসাধারণ বুদ্ধিমত্তার অধিকারী দোমিনিকান ফ্রায়ার ছিলেন তিনি। প্যারিস বিশ্বাবিদ্যালয়ে অ্যারিস্টটলিয় দর্শনের ওপর লেকচার দিতেন। অবশ্য ১৩২৫ সালে অতিন্দ্রীয় শিক্ষার কারণে তাঁর সঙ্গে আর্চ বিশপ অভ কোলনের বিরোধ সৃষ্টি হয়; বিশপ তাঁর বিরুদ্ধে ধর্মদ্রোহের অভিযোগ আনেন: তার বিরুদ্ধে স্বয়ং ঈশ্বর আত্মায় জন্ম নিয়েছেন ও বিশ্ব সংসারের অনন্ততার প্রচার করে ঈশ্বরের মহানুভবতা অস্বীকার করার অভিযোগ ওঠে। কিন্তু তারপরেও একহার্তের তীব্র সমালোচকদের কেউ কেউ তাকে অর্থডক্স বলে বিশ্বাস করতেন: ভুল হয়েছে তার কিছু কিছু মন্তব্যকে প্রতাঁকের বদলে আক্ষরিকভাবে ব্যাখ্যা করায়, যেটা প্রত্যাশিত ছিল না। একহাত কবি ছিলেন, প্যারাডক্স ও উপমা দারুণ উপভোগ করতেন। যদিও তিনি বিশ্বাস করতেন যে ঈশ্বরের বিশ্বাস করাটা যৌক্তিক, কিন্তু কেবল যুক্তি দিয়ে ঐশী প্রকৃতি সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান পাওয়া সম্ভব বলে মানতেন নাঃ ‘কোনও বোধগম্য জিনিসের প্রমাণ অনুভূতি বা বুদ্ধিতে মেলে, যুক্তি দেখিয়েছেন তিনি, কিন্তু ঈশ্বরের জ্ঞানের বেলায় ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অনুভূতির অবকাশ নেই, কারণ যেহেতু তিনি নিরাকার, তেমনি বুদ্ধি দিয়েও বোঝা সম্ভব নয়, যেহেতু আমাদের পরিচিত কোনও রূপ তিনি ধারণ করেন না।৫৯ ঈশ্বর আর সব জিনিসের মতো নন যে তাঁর অস্তিত্ব চিন্তার স্বাভাবিক বিষয়বস্তুর মতো প্রমাণ করা যাবে।

ঈশ্বর, ঘোষণা দিয়েছেন একহার্ত, কিছু না। তার মানে এই নয় যে, তিনি এক বিভ্রম, বরং ঈশ্বর আমাদের জ্ঞাত অস্তিত্বের চেয়ে সমৃদ্ধ, পূর্ণাঙ্গ অস্তিত্বের অধিকারী। ঈশ্বরকে তিনি অন্ধকার’ও বলেছেন, আলোর অনুপস্থিতি বোঝাতে নয়, বরং উজ্জ্বলতর কোনও কিছুর অস্তিত্বের ইঙ্গিত দেওয়ার জন্যে। একহার্ত নেতিবাচক ভাষায় সবচেয়ে চমৎকারভাবে বর্ণনাযোগ্য, যেমন, মরুভূমি,’ ‘বিরান অঞ্চল, ‘অন্ধকার’ ও ‘কিছু না ‘গডহেড’র সঙ্গে পিতা, পুত্র ও আত্মা হিসাবে আমাদের পরিচিত ঈশ্বরের পার্থক্যও করেছেন। পাশ্চাত্যবাসী হিসাবে একহার্ত মানব মনে ট্রিনিটির মিল সম্পর্কিত অগাস্তিনের মত ব্যবহার করতে পছন্দ করেছেন; তিনি বুঝিয়েছিলেন যে, যদিও ট্রিনিটির মতবাদ যুক্তির সাহায্যে জানা সম্ভব নয়, কেবল বুদ্ধিমত্তাই ঈশ্বরকে তিনটি সত্তায় ধারণ করতে পারে: অতিন্দ্রীয়বাদী ঈশ্বরের সঙ্গে একীভূত হয়ে গেলে সে তাঁকে একজন হিসাবে দেখে। গ্রিকরা হয়তো বা এমন ধারণা মেনে নিত না, কিন্তু ট্রিনিটি যে অত্যবশ্যকীয়ভাবে অতিন্দ্রীয়বাদী ধারণা, এ ব্যাপারে একহাত ওদের সঙ্গে হয়তো বা একমত হতেন। তিনি মেরি তাঁর গর্ভে ক্রাইস্টকে ধারণ করার বদলে পিতা আত্মায় পুত্রকে জন্ম দিয়েছেন আলোচনা পছন্দ করতেন। রুমীও অতিন্দ্রীয়বাদীর হৃদয়ে আত্মার জন্ম লাভের প্রতীক হিসাবে পয়গম্বর জেসাসের ‘ভার্জিন বার্থ দেখেছিলেন। এটা, একহাত জোর দিয়ে বলেছেন, ঈশ্বরের সঙ্গে আত্মার সহযোগিতার এক রূপক প্রকাশ।

কেবল অতিন্দ্রীয়বাদী অভিজ্ঞতা দিয়েই ঈশ্বরকে জানা সম্ভব। মায়মোনিস যেমন পরামর্শ দিয়েছেন: নেতিবাচক পরিভাষায়ই তার সম্পর্কে কথা বলা শ্রেয়। প্রকৃতপক্ষেই আমাদের হাস্যকর পূর্ব ধারণা ও মানবরূপ ইমেজারি হতে মুক্ত হয়ে ঈশ্বর সম্পর্কিত ধারণা পরিশুদ্ধ করে নিতে হবে । এমনকি খোদ ‘ঈশ্বর’ শব্দটির ব্যবহারও এড়িয়ে যাওয়া উচিত। একথাই বোঝাতে চেয়েছিলেন একহার্ত যখন তিনি বলেছেন: মানুষের সর্বশেষ ও সর্বোচ্চ বিচ্ছেদ হচ্ছে যখন সে ঈশ্বরের স্বার্থে ঈশ্বর হতে বিদায় নেয়।৬২ এটা এক যন্ত্রণাময় প্রক্রিয়া। ঈশ্বর যেহেতু কিছু না, আমাদেরও তার সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্যে কিছু না’ হবার প্রস্তুতি নিতে হবে। সুফীদের বর্ণিত ‘ফানা’র মতো মোটামুটি একই রকম এক প্রক্রিয়ায় একহার্ত ‘বিচ্ছেদ বা বলা যায় বিচ্ছিন্নতা (Abgeschiedenheit)-এর কথা বলেছেন। মুসলিমরা যেভাবে স্বয়ং ঈশ্বর ছাড়া আর কারও উপাসনা করাকে বহুঈশ্বরবাদ (শিরক) বিবেচনা করে তেমনি একহার্ত শিক্ষা দিয়েছিলেন যে অতিন্দ্রীয়বাদী অবশ্যই ঈশ্বর সম্পর্কে কোনও সীমাবদ্ধ ধারণার নিগড়ে বাঁধা পড়তে পারবে না। একমাত্র এভাবেই সে ঈশ্বরের সঙ্গে একতা লাভ করতে পারবে, যার ফলে ‘ঈশ্বরের অস্তিত্ব আমার অস্তিত্বে এবং ঈশ্বরের সত্তা (ইস্তিগকেইত) আমার সত্তা হবে। ঈশ্বর যেহেতু সত্তার ভিত্তি, সুতরাং মহাশূন্যে তাঁকে খোঁজার কোনও দরকার নেই, প্রয়োজন নেই আমাদের পরিচিত জগতের ঊর্ধ্বে কোথাও আরোহণের কথা ভাবা ।

‘আমিই সত্য বলে উলেমাদের বিরাগভাজন হয়েছিলেন আল-হাল্লাজ এবং একহার্তের অতিন্দ্রীয়বাদী মতবাদ জার্মানির বিশপদের হতচকিত করে দিয়েছিল: একজন সামান্য নারী বা পুরুষের ঈশ্বরে বিলীন হয়ে যাওয়ার কথা বলে কী বোঝানো হয়েছে? চতুর্দশ শতাব্দীতে গ্রিক ধর্মতাত্ত্বিকগণ এ প্রশ্নে তীব্র বিতর্কে লিপ্ত হয়েছিলেন। ঈশ্বর যেহেতু অত্যাবশ্যকভাবে অগম্য তাহলে কীভাবে তিনি মানবজাতির সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন? ঈশ্বরের সত্তা এবং তার কর্মকাণ্ড’ বা ‘শক্তিসমূহে’র সত্যিই কোনও পার্থক্য থাকলে, ফাদারগণ যেমন শিক্ষা দিয়েছেন, নির্ঘাৎ একজন ক্রিশ্চান প্রার্থনায় যে ঈশ্বরের মুখোমুখি হয় তার সঙ্গে স্বয়ং ঈশ্বরের তুলনা করা ব্লাসফেমাস হবে? আর্চ বিশপ অভ সালোনিকি গ্রেগরি পালামাস শিক্ষা দিয়েছেন যে, স্ববিরোধী মনে হলেও কোনও ক্রিশ্চানই স্বয়ং ঈশ্বরের প্রত্যক্ষ জ্ঞান অর্জন করতে পারে। সত্য যে, ঈশ্বরের ‘সত্তা’ সবসময় আমাদের নাগালের বাইরে, কিন্তু তাঁর ‘শক্তিসমূহ ঈশ্বর হতে আলাদা নয় এবং একে তুচ্ছ স্বর্গীয় প্রভাব বিবেচনা করা যাবে না। কোনও ইহুদি অতিন্দ্রীয়বাদী হয়তো একমত হতো: ঈশ্বর এন এফ সবসময়ই দুর্ভেদ্য অন্ধকারে বিরাজ করবেন, কিন্তু তাঁর সেফিরদ (যার সঙ্গে গ্রিক ‘শক্তিসমূহে’র মিল আছে) সমূহ স্বর্গীয়, একেবারে গডগেডের অন্তর হতে চিরন্তনভাবে প্রবাহিত হচ্ছে। কখনও কখনও নারী-পুরুষ এসব শক্তি’ সরাসরি বা প্রত্যক্ষভাবে দর্শন বা অনুভব করতে পারে, বাইবেল যখন বলে যে, ঈশ্বরের ‘প্রতাপ’ অবির্ভূত হয়েছিল। কেউ কখনও ঈশ্বরের সত্তা দেখেনি। কিন্তু তার মানে এই ছিল না যে, স্বয়ং ঈশ্বরের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা লাভ করা অসম্ভব। এই মনোভাব স্ববিরোধী হলেও পালামাসকে তা মোটেও হতাশ করতে পারেনি । গ্রিকরা বহু আগেই একমত হয়েছিল যে, ঈশ্বর সম্পর্কিত যেকোনও বক্তব্য স্ববিরোধী হতে বাধ্য। একমাত্র এভাবেই মানুষ তাঁর সম্পর্কে রহস্য ও অনিবৰ্চনীয় বোধ বজায় রাখতে পারবে। পালামাস বিষয়টি এভাবে উপস্থাপন করেছেন:

আমরা স্বর্গীয় প্রকৃতিতে অংশ গ্রহণ করি আবার একই সময়ে এটা সম্পূর্ণ অগম্য রয়ে যায়। আমাদেরকে যুগপৎ দুটোই স্বীকার করে নিতে হয় আর সঠিক মতবাদের এক বৈশিষ্ট্য হিসাবে এর প্রতীক রক্ষা করতে হয় ।

পালামাসের মতবাদে নতুন কিছু ছিল নাঃ একাদশ শতাব্দীতে নিউ থিয়োলজিয়ান সিমিয়ন এর রূপরেখা দিয়েছিলেন। কিন্তু বারলাম দ্য কালোব্রিয়ান পালামাসকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। বারলাম ইতালিতে পড়াশোনা করেছেন এবং তোমাস আকুইনাসের যুক্তিবাদী অ্যারিস্টটলবাদে গভীরভাবে প্রভাবিত ছিলেন। পালামাসের বিরুদ্ধে ঈশ্বরকে দুটো আলাদা অংশে ভাগ করার অভিযোগ তুলে ঈশ্বরের ‘সত্তা’ ও তার শক্তিসমূহে’র বিবেচিত প্রচলিত গ্রিক পার্থক্যের বিরোধিতা করেছেন। বারলাম ঈশ্বরের একটা সংজ্ঞার প্রস্তাব রাখেন যা প্রাচীন গ্রিক যুক্তিবাদীদের সংজ্ঞার পুনরাবৃত্তি ও ঈশ্বরের পরম সারল্যের ওপর জোর দেয়। অ্যারিস্টটলের মতো গ্রিক দার্শনিকরা, বারলাম দাবি করেছেন, ঈশ্বর কর্তৃক বিশেষভাবে আলোকপ্রাপ্ত হয়েছিলেন, শিক্ষা দিয়েছেন যে ঈশ্বর পৃথিবী হতে বহু দূরের ও জ্ঞানের অতীত। সুতরাং নারী ও পুরুষের পক্ষে ঈশ্বরকে ‘দেখা অসম্ভব: মানুষ পরোক্ষভাবে ঐশীগ্রন্থ বা সৃষ্টির বিস্ময়ে তার প্রভাব অনুভব করতে পারে । ১৩৪১ সালে অর্থডক্স চার্চের এক কাউন্সিল বারলামের নিন্দা জানায়, কিন্তু আকুইনাস প্রভাবিত অন্য সাধুরা তাকে সমর্থন জানান। মূলত এটা অতিন্দ্রীয়বাদী ও দার্শনিকদের ঈশ্বরের এক বিরোধে পরিণত হয়েছিল। বারলাম ও তার সমর্থকবৃন্দ গ্রেগরি আকিনদিনোস (যিনি Summa Theologiae-এর গ্রিক ভাষ্য থেকে উদ্ধৃতি দিতে পছন্দ করতেন), নিসেফোরাস গ্রেগোরাস ও দ্য তোমিস্ত প্রকরস সিনেস নীরবতা, স্ববিরোধিতা ও রহস্যের ওপর গুরুত্ব আরোপকারী বাইন্তানিয় অ্যাপোফ্যাটিক ধর্মতত্ত্ব হতে সরে এসেছিলেন। এঁরা পশ্চিম ইউরোপের অধিকতর ইতিবাচক ধর্মতত্ত্ব পছন্দ করতেন যা ঈশ্বরকে কিছু না’র বদলে ‘সত্তা’ হিসাবে সংজ্ঞায়িত করেছে। ডেনিস, সিমিয়ন ও পালামাসের রহস্যময় উপাস্যের বিপরীতে তাঁরা এমন একজন ঈশ্বরকে অধিষ্ঠিত করেন যার সম্পর্কে বক্তব্য রাখা যেত। গ্রিকরা পাশ্চাত্য চিন্তাধারার এই প্রবণতাকে বরাবর বিরূপ দৃষ্টিতে দেখেছে। যুক্তিভিত্তিক লাতিন ধারণার এই অনুপ্রবেশের মুখে পালামাস প্রাচ্যের অর্থডক্সি ধর্মতত্ত্ব পুনরুজ্জীবিত করেন। মানবীয় ভাষায় প্রকাশযোগ্য কোনও ধারণায় ঈশ্বরকে অবনমিত করা যাবে না । ঈশ্বর যে জ্ঞানাতীত, এ ব্যাপারে বারলামের সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন তিনি, কিন্তু তারপরেও জোর দিয়ে বলেছেন নারী ও পুরুষ তার অভিজ্ঞতা লাভ করেছে। তাবর পর্বতে জেসাসের মানব দেহকে রূপান্তরিতকারী আলো ঈশ্বরের সত্তা ছিল না, কোনও মানুষ যা প্রত্যক্ষ করেনি, কিন্তু কোনও রহস্যময় উপায়ে স্বয়ং ঈশ্বরই ছিলেন। গ্রিক ধর্মতত্ত্ব অনুযায়ী অর্থডক্স মতকে স্থাপনকারী শাস্ত্র দাবি করে যে তাবরে: ‘আমরা পিতাকে আলো হিসাবে এবং আত্মাকে আলো হিসাবে দেখেছি।’ এটা ছিল ‘আমরা যা ছিলাম এবং আমরা যা হব’ তার প্রকাশ; যখন, ক্রাইস্টের মতো দেবত্ব লাভ করব।৬৬ আবার, এই জীবনে ঈশ্বরের ধ্যান করে যা দেখি সেটা ঈশ্বরের বিকল্প নয় বরং কোনওভাবে স্বয়ং ঈশ্বর। এটা অবশ্যই স্ববিরোধী, কিন্তু ক্রিশ্চান ঈশ্বর তো প্যারাডক্স ছিলেন: প্রতীক ও নীরবতা কেবল আমরা যাঁকে ‘ঈশ্বর’ বলি তাঁর রহস্যের ক্ষেত্রে একমাত্র সঠিক ভঙ্গি-দার্শনিক কোনও অহমিকা নয়–যা অসুবিধাসমূহ দূর করার প্রয়াস পায়।

বারলাম ঈশ্বরের ধারণাকে বড় বেশি সামঞ্জস্যপূর্ণ করার প্রয়াস পেয়েছিলেন: তাঁর মতে হয় ঈশ্বরকে তাঁর সত্তার সঙ্গে একীভূত করতে হবে নয়তো যাবে না। তিনি ঈশ্বরকে তার সত্তায় সীমাবদ্ধ করতে চেষ্টা করেছিলেন এবং একথা বলতে চেয়েছেন যে নিজ শক্তি’র বাইরে তাঁর পক্ষে উপস্থিত থাকা সম্ভব নয়। কিন্তু ঈশ্বর সম্পর্কে এমন চিন্তা করার মানে তাকে অন্য কোনও ঘটনার মতো দেখা, যা কী সম্ভব আর সম্ভব নয় তার সম্পূর্ণ মানবীয় ধারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত। পালামাস জোর দিয়ে বলেছেন যে, ঈশ্বরের দর্শন একটা দ্বিপাক্ষিক পরমানন্দ: নারী ও পুরুষ নিজেদের অতিক্রম করে যায় কিন্তু ঈশ্বরও আপন সৃষ্টির কাছে নিজেকে প্রকাশ করার জন্যে নিজের উর্ধ্বে গিয়ে এক পরমানন্দ লাভ করেন: ঈশ্বরও আপন সত্তা হতে বেরিয়ে আসেন এবং সদয় অবতরণের মাধ্যমে আমাদের হৃদয়ের সঙ্গে একীভূত হন।৬৭ চতুর্দশ শতাব্দীর গ্রিক যুক্তিবাদীদের বিরুদ্ধে অর্থডক্স খৃস্টধর্মের আদর্শ হিসাবে রয়ে যাওয়া পালামাসের ধর্মতত্ত্বের বিজয় সকল একেশ্বরবাদী ধর্মের অতিন্দ্রীবাদের বৃহত্তর বিজয়ের প্রতিনিধিত্ব করে। একাদশ শতাব্দী থেকেই মুসলিম দার্শনিকগণ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন যে যুক্তি-যা ওষুধ বা বিজ্ঞানের গবেষণার ক্ষেত্রে অপরিহার্য-ঈশ্বরের গবেষণায় একেবারেই অপর্যাপ্ত। কেবল যুক্তির ওপর নির্ভর করার মানে দাঁড়াবে কাঁটা চামচ দিয়ে স্যুপ খাওয়ার মতো।

ইসলামি সাম্রাজ্যের বেশির ভাগ স্থানে সূফীদের ঈশ্বর দার্শনিকদের ঈশ্বরের ঊর্ধ্বে স্থান করে নিয়েছিলেন। পরবর্তী অধ্যায়ে আমরা দেখব, ষোড়শ শতাব্দীতে কাব্বালিস্টদের ঈশ্বর ইহুদি আধ্যাত্মিকতায় প্রাধ্যন্য বিস্তার করেন। অতিন্দ্রীয়বাদ অধিকতর বুদ্ধিবৃত্তিক বা যৌক্তিক ধরনের ধর্মের চেয়ে গভীরভাবে মানুষের মনে অনুপ্রবেশ করতে সক্ষম হয়েছিল । অতিন্দ্রীয়রাদের ঈশ্বর অধিকতর আদিম আশা, আশঙ্কা ও উৎকণ্ঠার সমাধানে সক্ষম, যেখানে দার্শনিকদের ঈশ্বর অক্ষম। চতুর্দশ শতাব্দী নাগাদ পাশ্চাত্য নিজস্ব অতিন্দ্রীয়বাদী ধর্মের সূচনা ঘটায় যার শুরু ছিল অত্যন্ত প্রতিশ্রুতিশীল । কিন্তু পশ্চিমের অতিন্দ্রীয়বাদ কখনওই অপরাপর ধর্মের মতো ব্যাপক বিস্তৃতি লাভ করতে পারেনি। ইংল্যান্ড, জার্মানি ও লোল্যান্ডসে বিশেষ ধরনের অতিন্দ্রীয়বাদীদের জন্ম ঘটলেও ষোড়শ শতাব্দীতে প্রটেস্ট্যান্ট সংস্কারকগণ একে বাইবেল বিরোধী আধ্যাত্মিকতা হিসাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। রোমান ক্যাথলিক চার্চে সেইন্ট তেরেসা অভ আভিলার মতো নেতৃস্থানীয় অতিন্দ্রীয়বাদীগণ প্রায়শঃ কাউন্টার-রিফরমেশনের ইনকুইজিশনের হুমকির সম্মুখীন হয়েছেন। সংস্কারের পরিণতিতে ইউরোপ আরও যৌক্তিক দৃষ্টিকোণ থেকে ঈশ্বরকে বিবেচনা করতে শুরু করেছিল ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *