৬. দার্শনিকদের ঈশ্বর
নবম শতকে আরবরা গ্রিক বিজ্ঞান ও দর্শনের সংস্পর্শে আসে এবং এর ফলস্বরূপ এক সাংস্কৃতিক জাগরণের সৃষ্টি হয় যাকে ইউরোপিয় ভাষায় রেনেসা ও আলোকনের মিলন হিসাবে দেখা যেতে পারে। অনুবাদকের একটা দল, যাদের অধিকাংশই ছিল নেস্টোরিয়ান ক্রিশ্চান, আরবী ভাষায় গ্রিক টেক্সট সুপ্রাপ্য করে তোলে, চমৎকার ছিল তাদের অনুবাদ। আরব মুসলিমরা এবার অ্যাস্ট্রনমি, আলকেমি, চিকিৎসা বিজ্ঞান ও গণিতশাস্ত্র নিয়ে গবেষণায় মনোযোগি হওয়ায় এমন সাফল্য অর্জন করে যে নবম ও দশম শতকে আব্বাসীয় সাম্রাজ্যে এত বেশি সংখ্যক বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার অর্জিত হয় যা অতীতের কোনও সময় ঘটেনি। ফালাসাফাহ্ নামের এক আদর্শের প্রতি নিবেদিত এক নতুন ধরনের মুসলিমদের আবির্ভাব ঘটে। সাধারণত একে ‘দর্শন হিসাবে অনুবাদ করা হয়ে থাকে, কিন্তু এর আরও ব্যাপক ও ঋদ্ধ অর্থ রয়েছে: অষ্টাদশ শতাব্দীর ফরাসি ফিলোসফেসদের মতো ফায়লাসুফগণ মহাবিশ্বকে নিয়ন্ত্রণকারী আইন অনুযায়ী যৌক্তিকভাবে জীবনধারণ করতে চেয়েছে। প্রথম দিকে তারা প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের ওপর জোর দিলেও পরে অনিবার্যভাবে গ্রিক মেটাফিজিক্সের শরণাপন্ন হয় ও এর নীতিমালাকে ইসলামে প্রয়োগে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে ওঠে। তাদের বিশ্বাস ছিল যে গ্রিক দার্শনিকদের ঈশ্বর ও আল্লাহ্ একই। গ্রিক ক্রিশ্চানরাও হেলেনিজমের সঙ্গে নৈকট্য বোধ করেছিল, কিন্তু গ্রিকদের ঈশ্বরকে বাইবেলের অধিকতর স্ববিরোধী ঈশ্বর দিয়ে বদলানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল: ফলে, আমরা দেখব, শেষ পর্যন্ত ঈশ্বরের পর্যালোচনায় যুক্তি তর্কের খুব একটা স্থান নেই বিশ্বাস করে তারা তাদের নিজস্ব দার্শনিক ঐতিহ্যে বিশ্বাস থেকে থেকে পিছু হাটে গিয়েছিল। অবশ্য ফায়ালাসুফরা বিপরীত উপসংহারের পৌঁছেছিল। তাদের বিশ্বাস ছিল, যুক্তিবাদ ধর্মের সবচেয়ে অগ্রসর রূপের প্রতিনিধিত্ব করে-তারা ঐশীগ্রন্থের প্রকাশিত ঈশ্বরের চেয়ে উচ্চতর ঈশ্বর ধারণার বিকাশ ঘটিয়েছিল ।
বর্তমান সময়ে আমরা সাধারণভাবে বিজ্ঞান ও দর্শনকে ধর্মের প্রতিপক্ষ হিসাবে দেখে থাকি, কিন্তু ফায়সুফরা সাধারণভাবেই ধার্মিক মানুষ ছিল, নিজেদের পয়গম্বরের অনুগত সন্তান মনে করত তারা। সৎ মুসলিম হিসাবে রাজনৈতিকভাবে তারা সজাগ ছিল, রাজ দরবারের বিলাসিতার বিরোধিতা করত ও যুক্তির নির্দেশ অনুযায়ী আপন সমাজকে সংস্কার করতে চেয়েছে। তাদের উদ্যোগ গুরুত্বপূর্ণ ছিল: তাদের বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক গবেষণা গ্রিক চিন্তাধারায় প্রভাবিত ছিল বলে তাদের বিশ্বাস ও অধিকতর যুক্তিবাদী, বস্তুবাদী, বস্তুনিষ্ঠ দৃষ্টিভঙ্গির ভেতর একটা সংযোগ আবিষ্কার করার প্রয়োজন ছিল। ঈশ্বরকে পুরোপুরি পৃথক বুদ্ধিবৃত্তিক শ্রেণীতে অবনমন ও ধর্ম বিশ্বাসকে মানুষের অপরাপর বিষয়াদি হতে আলাদা করে দেখা সম্পূর্ণ অস্বাস্থ্যকর ব্যাপার। ধর্মকে নিশ্চিহ্ন করার কোনও উদ্দেশ্য ছিল না ফায়সুফদের বরং তারা তাদের চোখে আদিম ও সংকীর্ণ উপাদানসমূহ হতে পরিশুদ্ধতা আনতে চেয়েছিল। ঈশ্বরের অস্তিত্বের ব্যাপারে তাদের কোনও সংশয় ছিল না-প্রকৃতপক্ষে, ঈশ্বরের অস্তিত্বকে স্ব-প্রকাশিত মনে করত তারা কিন্তু আল্লাহ তাদের যুক্তিবাদী আদর্শের সঙ্গে মাননসই দেখাতে যুক্তি দিয়ে প্রমাণের গুরুত্ব অনুভব করেছিল।
অবশ্য সমস্যা ছিল। আমরা দেখেছি, গ্রিক দার্শনিকদের ঈশ্বর প্রত্যাদেশের ঈশ্বরের চেয়ে একেবারে ভিন্ন ছিলেন: অ্যারিস্টটল বা প্রাটিনাসের পরম উপাস্য কালহীন এবং নিরাসক্ত, যিনি জাগতিক বিষয়ের দিকে লক্ষ করেননি, ইতিহাসে নিজেকে প্রকাশ করেননি, বিশ্বজগতের সৃষ্টি করেননি এবং সময়ের শেষে বিচার করবেন না। প্রকৃতপক্ষে একেশ্বরবাদী ধর্মবিশ্বাসের এক প্রধান থিওফ্যানি ইতিহাসকে দর্শনের তুলনায় নিম্নস্তরের বলে অ্যারিস্টটল নাকচ করে দিয়েছিলেন। কেননা বিশ্বজগৎ অনন্তকাল ধরে ঈশ্বরের নিকট হতে উৎসারিত হচ্ছে; এর কোনও সূচনা, মধ্যস্থল বা শেষ নেই। ফায়সুফরা ইতিহাসের মায়ার ঊর্ধ্বে যেতে চেয়েছে, তারা এর বাইরে পরিবর্তনহীন আদর্শ স্বর্গীয় জগতের পরিচয় জানতে চেয়েছিল। যুক্তির প্রতি জোর দেওয়া সত্ত্বেও ফালসাফাহ্র এক নিজস্ব বিশ্বাসের তাগিদ ছিল। বিশ্বজগতে যেখানে উদ্দেশ্যপূর্ণ শৃঙ্খলার চেয়ে বিশৃঙ্খলা আর যন্ত্রণাই বেশি উপস্থিত মনে হয়, যেখানে প্রকৃতই যুক্তির নীতিমালা কার্যকর ভাববার জন্যে সাহসের প্রয়োজন ছিল। চারপাশের সার্বক্ষণিক ধ্বংসাত্মক ও তালগোল পাকানো ঘটনাপ্রবাহের মাঝে তাদেরও এক পরম অর্থবোধকতার অনুভূতি গড়ে তুলতে হয়েছিল। ফালসাফাহয় একধরনের আভিজাত্য, বস্তুনিষ্ঠতার সন্ধান ও কালহীন দৃষ্টিভঙ্গি (Vision) ছিল। এক বিশ্বজনীন ধর্ম চেয়েছিল তারা, যা ঈশ্বরের কোনও বিশেষ প্রকাশ দিয়ে সীমাবদ্ধ নয় কিংবা নির্দিষ্ট স্থান বা কালে প্রোথিত নয়; তাদের বিশ্বাস ছিল যুগ যুগ ধরে সকল সাংস্কৃতির শ্রেষ্ঠ ও উন্নত মানের ব্যক্তিদের হাতে উন্নত হয়ে ওঠা আরও অগ্রসর ভাষায় কোরানের প্রত্যাদেশ অনুবাদ করাই তাদের দায়িত্ব। ঈশ্বরকে রহস্য হিসাবে না দেখে ফায়সুফরা বিশ্বাস করত যে তিনিই স্বয়ং যুক্তি।
বর্তমানে এরকম যৌক্তিক বিশ্বজগতের ধারণায় বিশ্বাস আমাদের চোখে অপরিপক্ক ঠেকে, কারণ আমাদের নিজস্ব বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারগুলো বহু। আগেই ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কে অ্যারিস্টটলের প্রমাণের অসারতা প্রকাশ করে দিয়েছে। নবম ও দশম শতাব্দীর কোনও ব্যক্তির কাছে এই দৃষ্টিভঙ্গি অসম্ভব ছিল, তবে ফালসাফাহর অভিজ্ঞতা আমাদের চলমান ধর্মীয় বিপত্তির সঙ্গে প্রাসঙ্গিক। আব্বাসীয় আমলে সংঘটিত বৈজ্ঞানিক বিপ্লবে অংশগ্রহণকারীদের নতুন তথ্য সংগ্রহের চেয়েও অধিক কিছু করার প্রয়োজন হয়েছিল। আমাদের বর্তমান কালের মতো বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার এক নতুন ভিন্ন মানসিকতার বিকাশের দাবি করেছে, যা ফায়লাসুফদের বিশ্ব সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে দেয়। বিজ্ঞান প্রত্যেক ঘটনা বা বিষয়ের পেছনে যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা রয়েছে বলে বিশ্বাস দাবি করে। এর ওপর এখানে এক ধরনের সাহস ও কল্পনাশক্তিরও প্রয়োজন, যেগুলো ধর্মীয় সৃজনশীলতার চেয়ে খুব বেশি ভিন্ন নয়। পয়গম্বর বা অতিন্দ্রীয়বাদীদের মতো বিজ্ঞানীরাও নিজেদের অজ্ঞাত বাস্তবতার অন্ধকার এবং অনিশ্চিত বলয়ের মোকাবিলায় ঠেলে দেন। এতে করে অনিবার্যভাবে ফায়সুফদের ঈশ্বর সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গি প্রভাবিত হয়েছিল এবং তারা সমসাময়িকদের বিশ্বাস পরিবর্তন, এমনকি ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছে। একইভাবে আমাদের বর্তমান যুগের বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি বা দর্শন বহু লোকের ক্ষেত্রেই ধ্রুপদী ঈশ্বরবাদে বিশ্বাস অসম্ভব করে তুলেছে। পুরোনো ধর্মতত্ত্ব আঁকড়ে থাকাটা কেবল সাহসেরই ব্যর্থতা নয় বরং এতে সংহতিও বিনষ্ট হতে পারে। ফায়সালুফরা ইসলামি ধর্মবিশ্বাসের মূলধারার সঙ্গে তাঁদের নতুন দর্শনের সমন্বয়ের মাধ্যমে গ্রিক অনুপ্রাণিত বৈপ্লবিক ঈশ্বর ধারণার অবতারণা করেছে। কিন্তু তারপরেও তাদের যৌক্তিক উপাস্যের শেষ পরিণতি ধর্মীয় সত্যের ব্যাপারে আমাদের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানায়।
ফায়সুফরা অতীতের যে কোনও একেশ্বরবাদীদের তুলনায় আরও গভীরভাবে গ্রিক দর্শন ও ধর্মের সমন্বয়ের প্রয়াস পেয়েছিল। মুতাযিলি এবং আশারিবাদীরা উভয়ই প্রত্যাদেশ ও স্বাভাবিক যুক্তির মাঝে একটা সেতুবন্ধ গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু তাদের বেলায় প্রত্যাদেশের ঈশ্বরের অবস্থান ছিল সবার আগে। ইতিহাসকে থিওফ্যানি হিসাবে দেখার প্রচলিত একেশ্বরবাদী দৃষ্টিভঙ্গির ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল ‘কালাম’; তাদের দাবি ছিল: নিরেট ও বিশেষ কিছু ঘটনাবলীর গুরুত্ব অপরিসীম, কারণ এগুলোই আমাদের সীমিত নিশ্চয়তার যোগান দেয়। প্রকৃতপক্ষে, আশারিরা সাধারণ নিয়ম ও চিরকালীন নীতিমালার অস্তিত্বে সন্দিহান ছিল। যদিও এই। অ্যাটমিজমের ধর্মীয় ও কল্পণাপ্রবণতার মূল্য ছিল, কিন্তু তা বৈজ্ঞানিক চেতনার বিরোধী ছিল বলে ফায়লাসুফদের সন্তুষ্ট করতে পারেনি। তাদের ফালসাফাহ নিরেট ও বিশেষ ধরনের ইতিহাসকে বাদ দিয়ে আশারিদের প্রত্যাখ্যাত সাধারণ নিয়মের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়েছে। যৌক্তিক বিতর্কের মাধ্যমে তাদের ঈশ্বরকে আবিষ্কার করতে হবে, কোনও নির্ধারিত সময়ের বিভিন্ন পর্যায়ে বিশেষ কোনও নারী ও পুরুষের কাছে নির্দিষ্ট প্রত্যাদেশের মাধ্যমে নয়। এই বাস্তব সরল সত্যের অনুসন্ধান তাদের বৈজ্ঞানিক গবেষণার বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয় ও চরম সত্তাকে অনুভব করার পথ নির্দিষ্ট করে দেয়, ঈশ্বর সবার ক্ষেত্রে একই রকম নন, অনিবার্য সাংস্কৃতিক বর্ণ থাক বা না থাক, মৌলিক ধর্মীয় প্রশ্নের সন্তোষজনক সমাধান দিতে পারবেন নাঃ ‘জীবনের আসল বা শেষ অর্থ কী? গবেষণাগারে বিশ্বজনীন প্রয়োগ আছে এমন কিছুর বৈজ্ঞানিক সমাধান খোঁজার পাশাপাশি বিশ্বাসীরা ক্রমবর্ধমান হারে কেবল মুসলিমদের অধিকারভুক্ত কোনও ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতে পারে না। কিন্তু তারপরেও কোরানের গবেষণা হতে দেখা যায় যে স্বয়ং মুহাম্মদের (স) এক বিশ্বজনীন দর্শন ছিল, তিনি জোর দিয়ে বলেছেন: সত্য পথে পরিচালিত সকল ধর্মই ঈশ্বর হতে আগত। ফায়লাসুফরা কোরানকে বিসর্জন দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি। বরং দুটোর মাঝে সম্পর্ক দেখাতে চেয়েছে: উভয়ই ব্যক্তি বিশেষের প্রয়োজন অনুযায়ী ঈশ্বরের কাছে পৌঁছার বৈধ পথ । বিজ্ঞান ও প্রত্যাদেশ, যুক্তিবাদ ও বিশ্বাসের মাঝে মৌলিক কোনও পার্থক্য দেখেনি তারা, বরং প্রফেটিক ফিলসফি নামে আখ্যায়িত প্রসঙ্গের অবতারণা করেছে। ইতিহাসের সূচনালগ্ন হতে ঈশ্বরের একই সত্তাকে সংজ্ঞায়িত করার প্রয়াসে নিয়োজিত বিভিন্ন ঐতিহাসিক ধর্মের মূলে অবস্থানরত প্রকৃত সত্য উদঘাটন করতে চেয়েছিল তারা।
গ্রিক বিজ্ঞান এবং মেটাফিজিক্সের সংস্পর্শে আসার সুবাদে ফালসাফাহ অনুপ্রাণিত হয়ে উঠলেও তা হেলেনিজমের ওপর প্রবলভাবে নির্ভরশীল ছিল না। গ্রিকরা তাদের মধ্যপ্রাচ্যীয় উপনিবেশগুলোয় একটা বিশেষ মানসম্পন্ন শিক্ষাক্রম অনুসরণ করতে চাইত, যাতে হেলেনিস্টিক দর্শনে আলাদা জোর দেওয়া হলেও আশা করা হতো যে, প্রত্যেক ছাত্র এক বিশেষ অনুক্রমে একগুচ্ছ নির্দিষ্ট বিষয় পাঠ করবে। ফলে এক ধরনের সমতা ও সামঞ্জস্য সৃষ্টি হয়েছিল। ফায়লাসুফরা অবশ্য এই পাঠ্যক্রম অনুসরণ করেনি, বরং যখন যেভাবে পেয়েছে বিষয়বস্তু পড়ে নিয়েছে। এর ফলে অনিবার্যভাবে এক নতুন দৃষ্টিকোণের দুয়ার খুলে গেছে। নিজস্ব ইসলামি ও আরবীয় দর্শনের পাশাপাশি পার্সিয়া, ভারতীয় ও নসটিক প্রভাবেও তাদের চিন্তা-চেতনা আলোড়িত হয়েছে।
এভাবে কোরানে যৌক্তিক পদ্ধতি প্রয়োগকারী প্রথম মুসলিম ইয়াকুব ইবন ইসহাক আল-কিন্দি (মৃত্যু. ৭০) ঘনিষ্ঠভাবে মুতাযিলিদের কাছাকাছি ছিলেন; বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে অ্যারিস্টটলের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন তিনি। বসরায় শিক্ষাগ্রহণ করলেও বাগদাদের স্থায়ী হয়েছিলেন তিনি। এখানে খলিফা আল-মামুনের পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছেন। গণিত, বিজ্ঞান ও দর্শনে তার অবদান ও প্রভাব অপরিসীম। কিন্তু তার মূল আগ্রহ ছিল ধর্ম। মুতাযিলি পটভূমির কারণে দর্শনকে তিনি প্রত্যাদেশের অনুগামী ছাড়া ভিন্ন কিছু ভাবতে পারেননিঃ পয়গম্বরদের অনুপ্রাণিত জ্ঞান সবসময়ই দার্শনিকদের তুচ্ছ মানবীয় দর্শনকে অতিক্রম করে গেছে। পরবর্তীকালে অধিকাংশ ফয়ালাসুফ এই দৃষ্টিভঙ্গি সমর্থন করবে না। আল-কিন্দি অবশ্য অন্যান্য ধর্মীয় বিশ্বাসের সত্য আবিষ্কারেও উদগ্রীব ছিলেন। সত্য একটাই, শত শত বছর ধরে এটা যেমন সাংস্কৃতিক বা ভাষাগত আচরণই গ্রহণ করে থাকুক না কেন, দর্শনিকের দায়িত্ব হচ্ছে একে খুঁজে বের করা।
সত্য স্বীকার করে নেওয়ার এবং তা যে কোনও উৎস হতেই আসুক, হোক কেন অতীত প্রজন্মের এবং বিদেশী জাতির, গ্রহণ করতে আমাদের লজ্জিত হওয়া উচিত নয় । যিনি সত্যের সন্ধানে নিয়োজিত তার জন্যে সত্যের চেয়ে অধিক মূল্যবান অন্য কিছু নেই; সত্য কখনও তাকে ছোট বা অসম্মান করে না, বরং যিনি এর দিকে হাত বাড়ান, সত্য তাঁকে মহিমান্বিত ও সম্মানিত করে।
এখানে আল-কিন্দি কোরানের অনুসারী। কিন্তু নিজেকে পয়গম্বরদের মাঝে সীমাবদ্ধ না রেখে গ্রিক দার্শনিকদেরও শরণাপন্ন হয়েছিলেন বলে আরও অগ্রসর হয়েছেন তিনি। একজন প্রধান চালক (Prime Mover)-এর অস্তিত্ব প্রসঙ্গে অ্যারিস্টটলের যুক্তি ব্যবহার করেছেন তিনি, যুক্তি দেখিয়েছেন যে, যৌক্তিক বিশ্বে সবকিছুর পেছনেই কারণ রয়েছে। সুতরাং পুরো প্রক্রিয়া শুরু করার জন্যে একজন অটল চালক নিশ্চয়ই থাকবেন। এই প্রথম নীতিই (First Principle)-ই অপরিবর্তনীয়, নিখুঁত ও অবিনশ্বর সত্তা স্বয়ং। কিন্তু এই উপসংহারে পৌঁছার পর আল-কিন্দি কোরানের শূন্য হতে সৃষ্টির মতবাদ অনুসরণ করে অ্যারিস্টটলকে ছেড়ে গেছেন। একে শূন্য হতে (ex nihilo) কোনও কিছু করা হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা যেতে পারে। এটাই, যুক্তি দেন আল-কিন্দি, ঈশ্বরের বিশেষ অধিকার। তিনিই একমাত্র সত্তা যার পক্ষে এভাবে কাজ করা সম্ভব এবং তিনিই আমাদের চারপাশের জগতে আমরা যেসব কর্মকাণ্ড লক্ষ করি তার প্রকৃত কারণ।
ফালসাফাহ্র আগমন ছিল শূন্য হতে সৃষ্টির মতবাদ প্রত্যাখ্যানের জন্যে; সুতরাং আল-কিন্দিকে প্রকৃত ফায়সুফ হিসাবে বর্ণনা করা যায় না। কিন্তু তিনি ছিলেন পদ্ধতিগত মেটাফিজিক্সের সঙ্গে ধর্মীয় সত্যের সমন্বয়ের ক্ষেত্রে ইসলামি প্রয়াসের অগ্রপুরষ। তাঁর উত্তরসুরিগণ ছিলেন আরও উগ্র। এভাবে আবু বকর মুহাম্মদ ইবন যাকারিয়া আর-রাযি (মৃত্যু. ৯৩০) যাকে মুসলিম ইতিহাসের মহা ননকনফরমিস্ট হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়, অ্যারিস্টটলের মেটাফিজিক্স নাকচ করে নসটিকদের মতো সৃষ্টিকে স্রষ্টার কর্মকাণ্ড হিসাবে দেখেছেন: সম্পূর্ণ আধ্যাত্মিক ঈশ্বরের হতে বস্তু উৎসারিত হতে পারে না। তিনি প্রাইম মুভার সম্পর্কিত অ্যারিস্টটলিয় সমাধানও প্রত্যাখ্যান করেন, প্রত্যাদেশ ও পয়গম্বরত্বের কোরানিক মতবাদসমূহও প্রত্যাখ্যান করেছেন। কেবল যুক্তি ও দর্শনই আমাদের রক্ষা করতে পারে। সুতরাং আর-রাযি প্রকৃত পক্ষে একেশ্বরবাদী ছিলেন নাঃ সম্ভবত তিনিই প্রথম মুক্ত চিন্তাবিদ যিনি ঈশ্বরের ধারণাকে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে বেমামান জানতে পেরেছিলেন। দক্ষ চিকিৎসক এবং দয়ালু ও দানশীল মানুষ ছিলেন তিনি, ইরানে নিজ এলাকা রাঈতে হাসপাতাল প্রধান হিসাবে বহু বছর কাজ করেছেন। অধিকাংশ ফায়সালুফই তাদের যুক্তিবাদকে এতটা চরম পর্যায়ে নিয়ে যায়নি। সাধারণ মুসলিম বিশ্বাসীদের সঙ্গে বিতর্কে তিনি যুক্তি দেখিয়েছেন যে, প্রকৃত ফায়সুফ প্রতিষ্ঠিত কোনও ধর্মের ওপর নির্ভর করতে পারে না, তার নিজেকেই চিন্তা করে সমাধান করতে হয়, কেননা একমাত্র যুক্তিই আমাদের সত্যের কাছাকাছি নিয়ে যেতে পারে। প্রকাশিত মতবাদসমূহের ওপর নির্ভরতা অর্থহীন, কারণ বিভিন্ন ধর্ম একমত হতে পারে না। কোনটা সঠিক, কে বলতে পারবে? কিন্তু তার প্রতিপক্ষ-কে ভ্রান্তিমূলকভাবে আর-রাযি বলেই ডাকা হয়-এক গুরুত্বপূর্ণ যুক্তি উত্থাপন করেছিলেন। সাধারণ মানুষের কী হবে? জানতে চান তিনি। তাদের বেশিরভাগ দার্শনিক চিন্তাভাবনায় অক্ষম, তবে কি তাদের আশা নেই, ভুল আর বিভ্রান্তিতেই রয়ে যাবে তারা? ইসলামে ফালসাফাহর সংখ্যালঘু গোত্র রয়ে যাবার অন্যতম কারণ এর আভিজাত্যবাদ। এ মতবাদ নির্দিষ্ট বুদ্ধিমত্তার অধিকারীদের ভেতরই আবেদন জাগাতে পেরেছিল এবং তা মুসলিম সমাজের বৈশিষ্ট্য পরিণত হতে শুরু করা সাম্যবাদের চেতনা বিরুদ্ধে ছিল।
তুরস্কের ফায়সুফ আবু-নসর আল-ফারাবি (মৃত্যু. ৯৮০) দার্শনিক যুক্তিবাদে অক্ষম অশিক্ষিত জনগণের সমস্যা নিয়ে কাজ করেছেন। তাঁকে প্রকৃত ফালসাফাহ্র প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে দেখা যেতে পারে। তিনি এই মুসলিম আদর্শের আকর্ষণীয় বিশ্বজনীনতা তুলে ধরেছিলেন। আল-ফারাবিকে আমরা রেনেস পুরুষ বলতে পারি; কেবল চিকিৎসক নন, সঙ্গীত শিল্পী ও অতিন্দ্রীয়বাদীও ছিলেন তিনি। তার অপিনিয়নস অভ দ্য ইনহ্যাবিট্যান্টস অভ আ ভারচুয়াস সিটিতে মুসলিম আধ্যাত্মিকতার কেন্দ্রীয় সামাজিক ও রাজনৈতিক উদ্বেগের বিষয়াদিও তুলে ধরেছিলেন তিনি। রিপাবলিক-এ প্লেটো যুক্তি দেখিয়েছিলেন যে, সাধারণ মানুষের ওপর প্রয়োগের যোগ্যতা রাখেন এমন একজন দার্শনিকের যৌক্তিক নীতিমালার অধীনে কোনও সৎসমাজ পরিচালিত হতে হবে। আল-ফারাবি মত প্রকাশ করেছেন, প্লেটো যেমন ব্যক্তির কথা কল্পনা করেছিলেন মুহাম্মদ (স) ঠিক তেমন একজন শাসক ছিলেন। তিনি মানুষের বোধগম্য এক কল্পনানির্ভর (Imaginitive) রূপের ধরণে কালোতীর্ণ সত্য প্রকাশ করেছেন, সুতরাং প্লেটোর আদর্শ সমাজ গঠনের জন্যে ইসলামই উপযুক্ত। সম্ভবত ইসলামের শিয়াহ্ ধরণ এই প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্যে সবচেয়ে উপযুক্ত ছিল, কারণ এর প্রাজ্ঞ ইমামের কাল্ট। সক্রিয় সুফী হলেও আল-ফারাবি প্রত্যাদেশকে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হিসাবে দেখেছেন। প্রচলিত প্রত্যাদেশের মতবাদ যেমন বোঝায়, মানুষের উদ্বেগ উৎকণ্ঠা হতে সুদূরবর্তী গ্রিক দার্শনিকদের ঈশ্বর মানুষের সঙ্গে কথা বলা ও জাগতিক বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারেন না। অবশ্য, তার মানে এই ছিল না যে আল-ফারাবির মূল ভাবনা হতে ঈশ্বর দূরবর্তী ছিলেন। তাঁর দর্শনের কেন্দ্রে ছিল ঈশ্বরের অবস্থান, ঈশ্বর সম্পর্কিত আলোচনা দিয়েই তাঁর রচনা মূর্ত হয়েছে। অবশ্য এই ঈশ্বর অ্যারিস্টটল ও পুটিনাসের ঈশ্বর: সকল সত্তার শুরু তিনি। ডেনিস দ্য আরোপাগাইতের অতিন্দ্রীয় দর্শনের উপর নির্ভর করে বেড়ে ওঠা কোনও গ্রিক ক্রিশ্চান ঈশ্বরকে কেবল ভিন্ন এক সত্তা হিসাবে তুলে ধরে এমন তত্ত্বের বিরোধিতা করেছেন। কিন্তু আল-ফারাবি অ্যারিস্টটলের কাছাকাছি রয়ে গেছেন। ঈশ্বর ‘সহসা সৃষ্টির সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে বিশ্বাস করতেন না তিনি। সেক্ষেত্রে অনন্ত ও অটল ঈশ্বরের অশোভন পরিবর্তনের প্রয়োজন হয়ে পড়ত।
গ্রিকদের মতো আল-ফারাবি দ্য ওয়ান হতে দশটি পর্যায়ক্রমিক উৎসারণ বা বুদ্ধিমত্তায়’ সত্তার ধারা অগ্রসর হতে দেখেছেন, যার প্রতিটি টলেমিয় বলয় সমূহের একেকটি অংশ সৃষ্টি করেছে: বাইরের আকাশসমূহ, স্থির তারকামণ্ডলীর বলয়; শনি, বৃহস্পতি, মঙ্গল, সূর্য, শুক্র, বুধ ও চাঁদের বলয়। আমরা একবার আমাদের পার্থিব জগতে প্রবেশ করলে জড় পদার্থ হতে শুরু হয়ে গাছ-পালা ও জীবজন্তুর মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়ে মানুষে শেষ হওয়া বিপরীত দিক হতে বিকশিত সত্তার একটা ধারাক্রম (Hierarchy) সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠি; যার আত্মা ও বুদ্ধিমত্তা স্বর্গীয় কারণের (Reason) অংশ, কিন্তু যার দেহ আসে মাটি হতে। প্লেটো এবং প্লাটিনাস বর্ণিত পরিশুদ্ধির প্রক্রিয়ায় মানুষ তার পার্থিব বাধা ছিন্ন করে স্বাভাবিক গন্তব্য ঈশ্বরের কাছে ফিরে যেতে পারে।
সত্তা সম্পর্কে কোরানের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে পার্থক্য ছিল, কিন্তু আল-ফারাবি দর্শনকে সত্য উপলব্ধি করার শ্রেয়তর উপায় হিসাবে দেখেছেন; মানুষের কাছে আবেদন সৃষ্টি করার জন্যে পয়গম্বরগণ যা কাব্যিক এবং রূপকার্থে প্রকাশ করেছিলেন। ফালসাফাহ সবার উপযোগি ছিল না। দশম শতাব্দীর মাঝামাঝি এক ধরনের নিগূঢ় উপাদান ইসলামে প্রবেশ করতে শুরু করেছিল। ফালসাফাহ্ ছিল এ ধরনের একটি নিগূঢ় অনুশীলন। সুফীবাদ ও শিয়াবাদও পবিত্র আইন ও কোরানকে কাঠোরভাবে অনুসরণকারী উলেমাদের চেয়ে ভিন্নভাবে ইসলামকে ব্যাখ্যা করেছে। আবার, সাধারণ মানুষকে বাদ দেওয়ার উদ্দেশ্যে কিন্তু তারা নিজস্ব মতবাদের গোপনীয়তা বজায় রাখেনি, বরং ফায়লাসুফ, সুফী এবং শিয়াদের সবাই বুঝতে পেরেছিল যে, ইসলাম সম্পর্কিত তাদের অধিকতর দুঃসাহসী ও উদ্ভাবনী ভাষ্য নিয়ে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হতে পারত। ফালসাফাহর মতবাদ, সুফীবাদ কিংবা শিয়াদের ইমামতত্ত্বের আক্ষরিক বা সরলীকৃত ব্যাখ্যা সত্য আবিষ্কারের প্রতীকী, যৌক্তিক কিংবা কল্পনানির্ভর পদ্ধতি বোঝার যোগ্যতা বা প্রশিক্ষণহীন ব্যক্তিকে ধাঁধায় ফেলে দিতে পারে। এই গোপন দলগুলোর মন-প্রাণের বিশেষ অনুশীলনের মাধ্যমে শিক্ষাব্রতাঁকে যত্নের সঙ্গে এসব জটিল ধারণা গ্রহণ করার উপযোগি করে ভোলা হতো। আমরা দেখেছি, ডগমা ও কেরিগমার পার্থক্যকরণে গ্রিক ক্রিশ্চানরা একই রকম ধারণা গড়ে তুলেছিল। পশ্চিমে গুপ্ত বা নিগূঢ় ঐতিহ্য গড়ে ওঠেনি, সবার বোধগম্য বলে বিবেচিত ধর্মের কেরিগম্যাটিক ব্যাখ্যাই অনুসৃত হয়েছে।’ তথাকথিত ভিন্ন মতাবলম্বীদের আত্মগোপনে যেতে না দিয়ে পশ্চিমের ক্রিশ্চানরা স্রেফ তাদের ওপর নিপীড়ন চালিয়েছে আর নন-করফরমিস্টদের নিশ্চিহ্ন করার প্রয়াস পেয়েছে। ইসলামি রাজ্যে নিগূঢ় চিন্তাবিদগণ সাধারণত নিজেদের বিছানাতেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন।
আল-ফারাবির উৎসারণ-মতবাদ ফায়লাসুফদের কাছে সাধারণভাবে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে। আমরা দেখব, অতিন্দ্রীয়বাদীগণও শূন্য হতে সৃষ্টির মতবাদের তুলনায় উৎসারণের ধারণাকে বেশি সহানুভূতিশীল বলে আবিষ্কার করেছে। দর্শন ও যুক্তিকে ধর্মের প্রতিপক্ষ বিবেচনা করার বদলে মুসলিম সুফী ও ইহুদি কাব্বালিস্টরা প্রায়শঃই ফায়সুফদের দর্শনকে তাদের অধিকতর কল্পনা নির্ভর ধর্মের প্রতি অনুপ্রেরণার উৎস হিসাবে দেখেছে। শিয়া মতবাদে এ বিষয়টি বিশেষভাবে স্পষ্ট। ইসলামে তারা সংখ্যালঘু রয়ে গেলেও দশম শতাব্দী শিয়াহ শতাব্দী হিসাবে পরিচিত, কেননা গোটা সাম্রাজ্যের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ও নেতৃস্থানীয় রাজনৈতিক পদসমূহে শিয়ারা নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিল। এইসব শিয়াহ্ উদ্যোগের সফলতা ছিল বাগদাদের সুন্নী খেলাফতের বিপরীতে ৯০৯ সালে তিউনিসে শিয়াহ খেলাফতের প্রতিষ্ঠা। এটা ছিল ফাতিমিয় বা সেভেনারস’ নামে পরিচিত ইসমায়েলি সম্প্রদায়ের অর্জন, এরা বার জন ইমামের কর্তৃত মেনে নেওয়া অধিক সংখ্যাক টুয়েলভার’ শিয়াদের চেয়ে আলাদা। ৭৬৫ সালে সাধুপ্রতীম ষষ্ঠ ইমাম জাফর ইবন সাদিকের মৃত্যুর পর ইসমায়েলিরা টুয়েলভারদের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করে। জাফর তাঁর উত্তরাধিকারী হিসাবে ছেলে ইসমাইলকে মনোনীত করেছিলেন, কিন্তু ইসমাইলের অকাল মৃত্যু ঘটলে টুয়েলভাররা তাঁর ভাই মুসার নেতৃত্ব মেনে নেয়। কিন্তু ইসমায়েলিরা ইসমাইলের অনুগত রয়ে যায় এবং বিশ্বাস করে যে নেতৃত্বের ধারা শেষ হয়ে গেছে। তাদের উত্তর আফ্রিকার খেলাফত প্রবল ক্ষমতাধর হয়ে ওঠে: ৯৭৩ সালে আধুনিক কায়রোর অবস্থান আল কাহিরাহয় রাজধানী স্থানান্তর করে এখানে তারা বিখ্যাত আল-আযহার মসজিদ নির্মাণ করে।
তবে ইমামদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন স্রেফ রাজনৈতিক উদ্দীপনা ছিল না। আমরা যেমন দেখেছি, শিয়ারা বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল যে রহস্যময় কোনও উপায়ে ইমামগণ পৃথিবীতে ঈশ্বরের সত্তা ধারণ করেন। কোরানের প্রতীকী পাঠের ওপর নির্ভরশীল নিজস্ব নিগূঢ় ধার্মিকতা গড়ে তুলেছিল তারা। মনে করা হয়েছে যে, মুহাম্মদ (স) তার চাচাত ভাই ও জামাতা আলি ইবন আবি তালিবকে গুপ্তজ্ঞান দিয়েছিলেন এবং এই ইলম তার সরাসরি বংশধর মনোনীত ইমামদের মাধ্যমে প্রবাহিত হয়ে এসেছে। প্রত্যেক ইমাম ‘মুহাম্মদের আলো’র ধারক (আল-নূর আল-মুহাম্মদ-পয়গম্বরসূচক চেতনা-যা মুহাম্মদকে (স) নিখুঁতভাবে ঈশ্বরে আত্মসমর্পনে সক্ষম করে তুলেছিল। পয়গম্বর বা ইমামদের কেউই স্বর্গীয় ছিলেন না, কিন্তু তাঁরা এমনভাবে খোদমুখী ছিলেন যে বলা যায়, ঈশ্বর তাদের মাঝে সাধারণ মরণশীলদের মাঝে যেভাবে অবস্থান করেন তারা চেয়ে আরও পরিপূর্ণভাবে অবস্থান করেছেন। নেস্টরিয়ানরা জেসাস সম্পর্কে একই রকম ধারণা পোষণ করত। নেস্টরিয়ানদের মতো শিয়ারাও তাদের ইমামদের আলোকিত স্বর্গীয় জ্ঞানে পরিপূর্ণ ঈশ্বরের মন্দির’ বা ‘কোষাগার’ হিসাবে দেখেছে। এই ইলম কেবল গোপন তথ্য নয় বরং পরিবর্তন ও অন্তর শুদ্ধকরণের উপায় । দা’ঈর (আধ্যাত্মিক পথ প্রদর্শক) পথ নির্দেশ অনুসরণ করে অনুসারী স্বপ্নের মতো স্পষ্ট দিব্যদর্শনে শৈথিল্য ও অনুভূতিহীন অবস্থা হতে বেরিয়ে আসবে। এটা তাকে এমনভাবে বদলে দিত যে, কোরানের নিগূঢ় ব্যাখ্যা বোঝার ক্ষমতা অর্জন করত সে। দশম শতাব্দীর ইসমায়েলি দার্শনিক নাসিরি আল-খুসর এর এই কবিতায় আমরা দেখতে পাই সচেতন হয়ে ওঠার ক্রিয়াই মূল অভিজ্ঞতা-এই কবিতায় তিনি তার জীবনকে বদলে দেওয়া ইমাম দর্শনের বর্ণনা দিছেন:
অগ্নিকুণ্ড থেকে প্রবাহিত কোনও সাগরের কথা কী শুনেছ তুমি?
কোনও শেয়ালকে কী দেখেছ সিংহে পরিণত হতে?
একটা নুড়ি পাথরকে রত্নে পরিণত করতে পারে সূর্য, এমনকি প্রকৃতির
হাত যাকে বদলাতে পারে না ।
আমিই সেই মূল্যবান রত্ন, আমার সূর্য তিনি, যাঁর রশ্মিতে এই নিকষ
অন্ধকার জগৎ আলোয় পরিপূর্ণ।
ভক্তির কারণে এই কবিতায় আমি তার ইমামের নাম উচ্চারণ করতে
পারছি না, কিন্তু কেবল এটুকু বলতে পারি, প্লেটো স্বয়ং তার দাসে
পরিণত হতেন। তিনিই গুরু, আত্মার পরিত্রাতা, ঈশ্বরের আশীর্বাদপুষ্ট,
প্রজ্ঞার প্রতিমূর্তি, জ্ঞান ও সত্যের ধারা।
হে জ্ঞানের প্রতিভু, গুণের রূপ,
প্রজ্ঞার আত্ম, মানুষের অভীষ্ট,
হে গর্বের গর্ব, তোমার সামনে দাঁড়িয়েছিলাম আমি, মলিন
ও জীর্ণ পশমের পোশাক পরে,
এবং চুম্বন দিয়েছি তোমার হাতে যেন বা তা
পয়গম্বরের মাজার বা কাবাহর কৃষ্ণ পাথর।
গ্রিক অর্থডক্স ক্রিশ্চানদের কাছে তাবর পর্বতের ক্রাইস্ট যেমন মানুষের ঐশীরূপের প্রতিনিধিত্ব করেছেন, বুদ্ধ যেমন গোটা মানবজাতির পক্ষে ধারণ যোগ্য আলোক ধারণ করেছিলেন, ঠিক সেভাবে ঈশ্বরের পূর্ণ গ্রহণযোগ্যতার মধ্য দিয়ে ইমামদের মানবীয় প্রকৃতি বা রূপ বদলে গেছে।
ফায়লাসুফরা ধর্মের বাহ্যিক ও যৌক্তিক উপাদানসমূহের দিকে অতিমাত্রায় মনোযোগী হয়ে উঠে এর আধ্যাত্মিক সত্যকে উপেক্ষা করছিল বলে শঙ্কিত বোধ করেছে শিয়ারা। যেমন মুক্ত চিন্তাবিদ আর-রাযির বিরোধিতা করেছে তারা। কিন্তু নিজস্ব দর্শন ও বিজ্ঞান গড়ে তুলেছিল তারা, কিন্তু সেগুলো শেষ কথা ছিল না বরং কোরানের অন্তর্নিহিত অর্থ (বাতিন) উপলব্ধিতে সক্ষম করে তোলার আধ্যাত্মিক অনুশীলন হিসাবে বিবেচিত ছিল। বিজ্ঞান ও গণিতের বিমূর্ত বিষয়াদি দিয়ে ধ্যান ইন্দ্রিয়জ কল্পনা হতে তাদের পরিশুদ্ধ করেছিল ও দৈনন্দিন জীবনের সচেতনতা থেকে, সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্তি দিয়েছিল। আমরা যেভাবে বাহ্যিক সত্যের সঠিক ও আক্ষরিক উপলব্ধি অর্জনের লক্ষ্যে বিজ্ঞানকে ব্যবহার করি তা না করে ইসমায়েলিরা তাদের কল্পনাশক্তিকে বাড়ানোর প্রয়াস পেয়েছে। তারা প্রাচীন ইরানের সরোস্ট্রিয়ান মিথের শরণাপন্ন হয়ে সেগুলোকে কিছু নিও-প্লেটোনিক ধারণার সঙ্গে মিলিয়ে মুক্তি লাভের ইতিহাসের এক নতুন ধারণা গড়ে তুলেছিল। এখানে স্মরণ করে যেতে পারে যে, অধিকাংশ প্রথাগত সমাজে মানুষ বিশ্বাস করত এই মতের পৃথিবীতে সংঘটিত ঘটনাবলী স্বর্গীয় বলয়ের ঘটনাপ্রবাহের পুনরাবৃত্তি: প্লেটোর আকৃতি বা চিরন্তন আদর্শ জগতের মতবাদে দার্শনিক পরিভাষায় এই চিরকালীন বিশ্বাসই প্রকাশ করেছে। উদাহরণ স্বরূপ, প্রাক-ইসলামি ইরানে বাস্তবতা দ্বৈত চরিত্রের অধিকারী ছিল: এভাবে দৃশ্যমান (গেতিক) আকাশের পাশাপাশি এক স্বর্গীয় (মেনক) আকাশের অস্তিত্ব ছিল যা সাধারণ বোধশক্তি দিয়ে দেখা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। আরও বিমূর্ত ও আধ্যাত্মিক সত্তা বা বাস্তবতার ক্ষেত্রে একথা আরও সত্যি: এখানে গেতিকে আমাদের প্রত্যেক প্রার্থনা বা সকাজের, আবার স্বর্গীয় বলয়ে অনুরূপ সৃষ্টি হয় এবং একে সত্য রূপ ও চিরন্তন তাৎপর্য দান করে।
এইসব স্বর্গীয় আদি রূপ বা আদর্শ আমাদের কল্পনার ঘটনাবলী ও আকার যেমন প্রায়ই আমাদের পার্থিব অস্তিত্বের চেয়ে আরও বেশি বাস্তব এবং তাৎপর্যপূর্ণ ঠেকে ঠিক সেভাবে অনুভূত হতো। বিপরীতে হতাশাব্যাঞ্জক বহু ঘটনাবলী থাকা সত্ত্বেও একে আমাদের জীবন ও আমাদের অনুভবের পৃথিবীর যে একটা অর্থ ও গুরুত্ব আছে সেই বিশ্বাস প্রকাশের প্রয়াস হিসাবে দেখা যেতে পারে। দশম শতাব্দীতে ইসমায়েলিরা এই মিথলজি পুনরুজ্জীবিত করে, ইসলামে দীক্ষা নেওয়ার সময় পার্সিয় মুসলিমরা যা ত্যাগ করেছিল, কিন্তু যা তাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ রয়ে গিয়েছিল। একে তারা কল্পনাপ্রসূতভাবে উৎসারণের প্লেটোনিক মতবাদের সঙ্গে সংশ্লেষ করে। আল ফারাবি ঈশ্বর ও বস্তুজগতের মাঝে দশটি উৎসারণ কল্পনা করেছিলেন যা টলেমিয় বলয়সমূহের তত্ত্বাবধান করে। শিয়ারা এবার পয়গম্বর ও ইমামদের এই স্বর্গীয় প্রকল্পের ‘আত্মা’য় পরিবর্তন করল। প্রথম স্বর্গের সর্বোচ্চ ‘পয়গম্বরত্বে’র বলয়ে ছিলেন মুহাম্মদ (স); দ্বিতীয় স্বর্গে ছিলেন আলি পরবর্তী বলয়গুলোর প্রত্যেকটায় ক্রমানুসারে প্রভুত্ব করেছেন সাত জন ইমাম। এতে করে শেষে, বস্তজগতের নিকটতম বলয়ে ছিলেন মুহাম্মদের (স) মেয়ে, আলির স্ত্রী ফাতিমাহ-যার সুবাদে এই পবিত্র ধারা সম্ভব হয়েছে। সুতরাং তিনি ইসলামের জননী ও স্বর্গীয় প্রজ্ঞা সোফিয়ার সমপর্যায়ের। দেবরূপ ইমামদের এই কল্পনা শিয়াহু ইতিহাসের ইসমায়েলি ব্যাখ্যার প্রতিনিধিত্ব করে। এটা কেবল বাহ্যিক জাগতিক ঘটনাবলীর পর্যায়ক্রম ছিল না-যার অনেকগুলোই করুণ। এইসব বর্ণাঢ্য মানুষদের জীবন আদর্শ জগতের (মেনোক) ঘটনা প্রবাহের অনুরূপ।
একে অলীক ধারণা বলে চট করে উপহাস করা উচিৎ হবে না। আমাদের। বর্তমান পশ্চিমে আমরা বস্তুগত সঠিকতকতার দিকে মনোযোগের জন্যে গর্ব বোধ করি, কিন্তু ধর্মের ‘গুপ্ত (বাতিন) মাত্রার অনুসন্ধানকারী ইসমায়েলি বাতিনিরা এক সম্পূর্ণ ভিন্ন লক্ষ্যে নিয়োজিত ছিল। কবি বা শিল্পীদের মতো প্রতীকী পদ্ধতি ব্যবহার করেছে তারা, যার সঙ্গে যুক্তির মিল ছিল সামান্যই, তবে তারা মনে করত এতেই যৌক্তিক ধারণায় প্রকাশিত বা। অনুভবে উপলব্ধ বাস্তবতার চেয়ে আরও গভীর বাস্তবতা প্রকাশ পায়। সে অনুযায়ী কোরান পাঠের একটা পদ্ধতি গড়ে তুলেছিল তারা, যাকে তারা বলত তাওয়িল-আক্ষরিক অর্থে, ‘পেছনে নিয়ে যাওয়া’ (Carrying back)। এভাবে আদি মূল কোরানের কাছে ফিরে যেতে পারবে বলে ভেবেছিল তারা, যা মুহাম্মদ (স) গেতিকে আবৃত্তি করার সময়ই মেননকে উচ্চারিত হয়েছিল। ইরানি শিয়াহ্বাদের ইতিহাসবিদ প্রয়াত হেনরি করবিন তাওয়িলের অনুশীলনের সঙ্গে সঙ্গীতের ছন্দের তুলনা করেছেন। ইসমায়েলি যেন এক ধরনের শব্দ শুনতে পেত-কোরানের কোনও পঙক্তি বা কোনও হাদিস-একই সময়ে বিভিন্ন মাত্রায়; আরবী শব্দের মতোই এর স্বর্গীয় প্রতিপক্ষের উচ্চারণ শোনার জন্যে নিজেকে গড়ে তোলার প্রয়াস পেয়েছে সে। এই প্রয়াস তার জটিল কোলাহলময় মনকে স্থির করে তুলত ও প্রতিটি শব্দকে ঘিরে থাকা নৈঃশব্দ্যের প্রতি সচেতন করে তুলত, ঠিক কোনও একজন হিন্দু যেমন পবিত্র উচ্চারণ ওঁম কে ঘিরে থাকা অনন্ত নীরবতায় কান পেতে থাকে। নৈঃশব্দ্যে কান পেতে থাকার সময় ঈশ্বর সম্পর্কে আমাদের বক্তব্য ও ধারণার সঙ্গে পূর্ণ সত্তার মধ্যকার পার্থক্য সম্পর্কে সজাগ হয়ে ওঠে। এক নেতৃস্থানীয় ইসমায়েলি চিন্তাবিদ আবু ইয়াকুব আল-সিজিস্তানি (মৃত্যু, ৯৭১) ব্যাখ্যা করেছেন, এই অনুশীলন ঈশ্বরকে যেভাবে উপলব্ধি করা প্রয়োজন সেভাবে উপলব্ধি করতে মুসলিমদের সাহায্য করে। মুসলিমরা প্রায়শঃই ঈশ্বর সম্পর্কে কথা বলার সময় মানবীয় পরিভাষা ব্যবহার করে তাকে অতিমানব ধরনের কিছু বানায়, অন্যদিকে অন্যরা সকল ধর্মীয় অর্থ বাদ দিয়ে ঈশ্বরকে কেবল ধারণার পর্যায়ে নামিয়ে আনে। এর বদলে আল সিজিস্তানি দ্বিগুণ নেতির ব্যবহারের পক্ষে মত দিয়েছেন। আমাদের উচিত নেতিবাচক অর্থে ঈশ্বর সম্পর্কে কথা শুরু করা; যেমন: তিনি ‘সত্তা’ না বলে ‘সত্তা নন’, ‘প্রাজ্ঞ’ না বলে অজ্ঞ নন,’ বলা যেতে পারে, ইত্যাদি। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই এই প্রাণহীন ও বিমূর্ত নেতিকে আবার বাতিল করতে হবে আমাদের। আমরা যেভাবে শব্দগুলো ব্যবহার করি সেভাবে বলতে হবে ঈশ্বর ‘অজ্ঞ না। নন’ বা তিনি কিছু-না নন।’ মানবীয় কথা বলার ঢঙের সঙ্গে তিনি মেলেন । এই ভাষাগত অনুশীলনের চর্চার মাধ্যমে একজন বাতিনি ঈশ্বরের রহস্য বোঝানোর প্রয়াস পাওয়ার সময় ভাষার সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে সজাগ হয়ে উঠবে।
পরবর্তী কালের ইসমায়েলি চিন্তাবিদ হামিদ আল-দিন কিরমানি (মৃত্যু, ১০২১) তাঁর রাহাফ আল-আকল (বাম ফর ইন্টেলেক্ট)-এ এই অনুশীলন বা চর্চার অপরিসীম শান্তি ও সন্তোষ লাভের কথা বর্ণনা করেছেন। এটা বিরস, বুদ্ধির অনুশীলন বা পণ্ডিতি কোনও চাল ছিল না, বরং এখানে ইসমায়েলির জীবনের তুচ্ছাতিতুচ্ছ বিষয় এক ধরনের তাৎপর্যের অনুভূতি নিয়ে যোগ হয়েছে। ইসমায়েলি লেখকগণ বার বার বাতিনকে আলোকপ্রাপ্তি বা পরিবর্তনের প্রেক্ষিতে প্রকাশ করেছেন। ঈশ্বর সম্পর্কে তথ্য প্রদান তাওয়িলের কাজ ছিল না বরং যুক্তির চেয়ে গভীর কোনও স্তরে বিস্ময়ের অনুভূতি গড়ে তোলা এর কাজ যা বাতিনিকে আলোকিত করে তুলবে। এটা পালায়নবাদী কোনও বিষয়ও ছিল না। ইসমায়েলিরা ছিল রাজনৈতিক কর্মী। প্রকৃতপক্ষেই ষষ্ঠ ইমাম জাফর ইবন সাদিক বিশ্বাসকে কর্ম হিসাবে সংজ্ঞায়িত করেছিলেন। পয়গম্বর ও ইমামদের মতো বিশ্বাসীকে জাগতিক জীবনেই ঈশ্বরের দর্শনকে কার্যকর করে তুলতে হবে।
শিয়াহ শতাব্দীতে বসরায় গড়ে ওঠা এক গুপ্ত গোষ্ঠী ইকওয়ান আল-সাফা বা ব্রেদরেন অভ পিউরিটি-ও এইসব আদর্শ গ্রহণ করেছিল । ব্রেদরেনরা সম্ভবত ইসমায়েলিদের দলছুট অংশ ছিল। ইসমায়েলিদের মতো এরাও নিজেদের বিজ্ঞান, বিশেষ করে গণিত ও জ্যোতির্বিদ্যার পাশাপাশি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত করেছিল। ইসমায়েলিদের মতোই ব্রেদরেনরাও বাতিন বা জীবনের গূঢ় অর্থের সন্ধান করেছিল। এদের এপিসলস্ (রাসায়েল) দার্শনিক বিজ্ঞানের বিশ্বকোষে পরিণত হয়েছিল। সুদূর স্পেন পর্যন্ত এর প্রচণ্ড জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে পড়েছিল। ব্রেদরেনরা আবার বিজ্ঞান ও অতিন্দ্রীয়বাদের মিশ্রণ ঘটিয়েছিল। গণিতকে দর্শন ও মনস্তত্বের পূর্বশর্ত হিসাবে দেখা হয়েছে। বিভিন্ন সংখ্যা আত্মার সহজাত বিভিন্ন অবস্থা প্রকাশ করে; এগুলো ছিল মনোসংযোগের একটা পদ্ধতি যা শিক্ষাব্রতাঁকে মনের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে সজাগ হয়ে উঠতে সফল করে তুলত। সেইন্ট অগাস্তিন যেমন আত্মজ্ঞানকে ঈশ্বরের জ্ঞানের জন্যে অপরিহার্য হিসাবে দেখেছিলেন, ঠিক তেমনি নিজ সম্পর্কে এক গভীর উপলব্ধিও ইসলামি অতিন্দ্রীয়বাদের মূল বিষয়ে পরিণত হয়। সুন্নী অতিন্দ্রীয়বাদী অর্থাৎ সুফী, যাদের সঙ্গে ইসমায়েলিরা যথেষ্ট নৈকট্য বোধ করত, তাদের একটা নীতিবাক্য ছিল: “যে নিজেকে চিনতে পেরেছে সে তার প্রভুকে চিনতে পেরেছে। ব্রেদরেনদের ‘ফার্স্ট এপিল’-এ একথা উদ্ধৃত হয়েছে। আত্মার সংখ্যা নিয়ে ধ্যান করার সময় মনের গভীরে মানব সত্তার মূল আদি ওয়ানে ফিরে যেত তারা। ব্রেদরেনরা ফায়লাসুফদেরও বেশ কাছাকাছি ছিল। মুসলিম যুক্তিবাদীদের মতো তারাও সত্যের অখণ্ড রূপের উপর জোর দিয়েছে, সর্বত্রই যার অনুসন্ধান করতে হবে। একজন সত্যানুসন্ধানী অবশ্যই ‘বিজ্ঞান ত্যাগ করবে না, কোনও পুস্তককে নিন্দা করবে না, নির্দিষ্ট কোনও বিশ্বাসও আঁকড়ে থাকবে না। ঈশ্বর সম্পর্কে এক নিওপ্লেটোনিক ধারণা গড়ে তুলেছিল তারা, যাকে তারা প্রটিনাসের অনিবার্চনীয়। দুর্বোধ্য ‘দ্য ওয়ানের মতোই দেখেছে। ফায়লাসুফদের মতো তারা প্রচলিত কোরানিক মতবাদের ‘শূন্য হতে সৃষ্টি’র বদলে উৎসারণের প্লেটোনিক মতবাদেরই অনুসারি ছিল: জগৎ স্বর্গীয় কারণ’কে প্রকাশ করে আর মানুষ ঐশী জগতে অংশ নিতে পারে, আপন যৌক্তিক ক্ষমতাকে পরিশোধন করে ‘দ্য ওয়ানের কাছে ফিরে যেতে পারে ।
পশ্চিমে আভিসেনা নামে পরিচিত আবু আলি ইবন সিনা (৯৮০-১০৩৭) এর রচনাবলীতে ফালসাফাহ্ এর সর্বোচ্চ বিন্দুতে পৌঁছেছিল। সেন্ট্রাল এশিয়ার বুখারার কাছে এক শিয়াহ কর্মকর্তার পরিবারে জন্ম গ্রহণকারী ইবন সিনা তার বাবার কাছে আগত ইসমায়েলিদের যুক্তি-তর্ক দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। এক বিস্ময়বালকে পরিণত হন তিনিঃ ষোল বছর বয়সে বিশিষ্ট চিকিৎসকদের পরামর্শক এবং আঠার বছর বয়সে গণিত, যুক্তিবিদ্যা ও পদার্থ বিজ্ঞানে বিশেষ দক্ষতা অর্জন করেন। অবশ্য অ্যারিস্টটল তাঁর কাছে কঠিন ঠেকেছে, কিন্তু আল-ফারাবির ইনটেনশনস অভ অ্যারিস্টটল’স মেটাফিজিক্স পাঠ করার পর আলোর দেখা পান। ভ্রাম্যমাণ চিকিৎসক হিসাবে কাজ করছেন তিনি, গোটা ইসলামি সাম্রাজ্যে ঘুরে বেড়িয়েছেন পৃষ্ঠপোষকদের খেয়ালের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন। এক পর্যায়ে বর্তমান ইরান ও দক্ষিণ ইরাক অঞ্চলের শাসক শিয়াহু বায়িদ বংশের উজিরের দায়িত্ব পান তিনি। মেধাবী এবং প্রাজ্ঞ বুদ্ধিজীবী ইবন সিনা তথাকথিত পণ্ডিত ছিলেন না। তিনি ইন্দ্রিয়পরায়ণও ছিলেন এবং বলা হয়ে থাকে যে সুরা ও যৌনতার প্রতি মাত্রাতিরিক্ত আসক্তির কারণে মাত্র আটান্ন বছর বয়সে অকাল মৃত্যু বরণ করেছিলেন।
ইবন সিনা বুঝতে পেরেছিলেন, ইসলামি সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরে পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে ফালসাফাহর অভিযোজনের প্রয়োজন রয়েছে। আব্বাসীয় খেলাফতের তখন পতনোন্মুখ অবস্থা। রিপাবলিকে প্লেটোর বর্ণিত আদর্শ দার্শনিক সমাজ গঠনের জন্যে খেলাফতভিত্তিক রাষ্ট্রকে আর উপযোগি ভাবা যাচ্ছিল না। স্বাভাবতই ইবন সিনা শিয়াহ্ আধ্যাত্মিক ও রাজনৈতিক আশাআকাক্ষার প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন, তবে ফালসাফাহ্র নিও প্লেটোনিজমের প্রতি বেশি আকর্ষণ ছিল তার। তিনি অতীতের ফায়লাসুফদের চেয়ে বেশি সাফল্যের সঙ্গে এর ইসলামিকরণে সফল হয়েছিলেন। তাঁর বিশ্বাস ছিল বাস্তবতার পূর্ণাঙ্গ চিত্র ফুটিয়ে তোলার ফালসাফাহ্র দাবি প্রমাণ করতে হলে একে অবশ্যই সাধারণ মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাসের অধিকতর অর্থ প্রকাশ করতে হবে, যা-যেভাবেই ব্যাখ্যা করা হোক না কেন-রাজনৈতিক, সামাজিক ও ব্যক্তিজীবনের এক প্রধান সত্য। ধর্মকে ফালসাফাহর নিম্নস্তরের ভাষ্য হিসাবে না দেখে ইবন সিনা মনে করেছেন মুহাম্মদের (স) মতো পয়গম্বর যেকোনও দার্শনিকের চেয়ে শ্রেয়তর, কারণ তিনি মানবীয় কারণের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন না, বরং সরাসরি ও সহজাতভাবে ঈশ্বরের জ্ঞান লাভ করেছেন। এটা সুফীদের বর্ণিত অতিন্দ্রীয়বাদী অভিজ্ঞতা ও স্বয়ং প্রটিনাস উল্লিখিত প্রজ্ঞার সর্বোচ্চ রূপের অনুরূপ। অবশ্য এর মানে এই ছিল না যে, বুদ্ধি দিয়ে ঈশ্বরের কিছুই বোঝা যাবে না। অ্যারিস্টটলের প্রমাণের ওপর ভিত্তি করে ইবন সিনা ঈশ্বরের অস্তিত্বের এক যৌক্তিক প্রতিপাদ্য বের করেছিলেন যা ইহুদিবাদ ও ইসলামের মধ্যযুগের শেষদিকের দার্শনিকদের আদর্শে পরিণত হয়েছিল। ফায়লাসুফ বা ইবন সিনার মাঝে ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়ে বিন্দুমাত্র সংশয় ছিল না। তারা কখনও সাহায্যবিহীন মানবীয় যুক্তি দিয়ে পরম সত্তার অস্তিত্বের জ্ঞান লাভের সম্ভাব্যতায় সন্দেহ প্রকাশ করেননি। যুক্তি মানুষের মহোত্তম কাজ: এটা স্বর্গীয় কারণের অংশী এবং ধর্মীয় অনুসন্ধিৎসুতার ক্ষেত্রে স্পষ্টতই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে এর। এভাবে যাদের ঈশ্বরকে জানার বুদ্ধিবৃত্তিক যোগ্যতা বা ক্ষমতা আছে ইবন সিনা তাদের জন্যে একে ধর্মীয় দায়িত্ব হিসাবে দেখেছেন, কারণ যুক্তি ঈশ্বরের ধারণাকে পরিশুদ্ধ করতে পারে এবং তাঁকে কুসংস্কার ও মানব রূপ হতে মুক্ত করতে পারে। ইবন সিনা ও তাঁর উত্তসূরিরা যারা ঈশ্বরের অস্তিত্ব দেখানোর যৌক্তিক প্রতিপাদ্যের দিকে মনোযোগ দিয়েছিলেন, তারা কিন্তু আমাদের মতো করে নাস্তিকদের বিরুদ্ধে যুক্তি উত্তাপন করেননি। ঈশ্বরের প্রকৃতি সম্পর্কে যতটা সম্ভব জানার জন্যে যুক্তির প্রয়োগ ঘটাতে চেয়েছেন তাঁরা।
আমাদের মনের কাজের ধারা বিবেচনার মাধ্যমে ইবন সিনার ‘প্রমাণের শুরু। আমরা জগতের দিকেই চোখ ফেরাই, বিভিন্ন অসংখ্য উপাদানের সমন্বয়ে গঠিত যৌক্তিক জিনিস বা সত্তা দেখতে পাই। যেমন কোনও গাছ বাকল, কাঠ, মজ্জা, শাখা-প্রশাখা আর পাতার সমন্বয়। কোনও কিছু বোঝার চেষ্টা করার সময় আমরা একে ‘বিশ্লেষণ করি, একে ভাগ করতে করতে এমন পর্যায়ে পৌঁছাই যার পর আর ভাগ করা যায় না। সাধারণ উপাদানসমূহ আমাদের কাছে মুখ্য ঠেকে এবং এদের সমন্বয়ে গঠিত যৌগিক বস্তুকে মনে হয় গৌণ। সুতরাং যেসব জিনিস আর ছোট করা যায় না, সেগুলোর ক্ষেত্রে আমরা অবিরাম সারল্যকে খুঁজে বেড়াচ্ছি। ফালসাফাহর একটা নীতি ছিল, বাস্তবতা যৌক্তিকভাবে সামজ্ঞস্যপূর্ণ সমগ্রের সৃষ্টি করে; এর মানে সারল্যের জন্যে আমাদের অন্তহীন সন্ধান এক ব্যাপক মাত্রায় বস্তুসমূহে প্রতিফলিত হতে হবে। সকল প্লেটোনিস্টের মতো ইবন সিনাও মনে করেছেন আমাদের চারপাশে দেখা জটিলতা (multiplicity) নিশ্চয়ই কোনও আদি এককের ওপর নির্ভরশীল। আমাদের মন যেহেতু যৌগিক বস্তুকে গৌণ এবং সৃষ্ট বলে দেখে, এই প্রবণতা নিশ্চয়ই বাইরের কোনও এক সরল ও উচ্চতর সত্তা দিয়ে সৃষ্টি হয়েছে। জটিল বস্তু অনিশ্চিত, নির্ভরশীল এবং নির্ভরশীল বস্তুসমূহ যে বস্তুর ওপর তারা নির্ভরশীল সেগুলোর চেয়ে নিম্নস্তরের, ঠিক যেমন সন্তান-সন্ততিরা মর্যাদার দিক থেকে জন্মদাতা পিতার নিম্নপর্যায়ের। এমন কিছু যা স্বয়ং সরল তাকেই দার্শনিকগণ প্রয়োজনীয় সত্তা’ বলেন, অর্থাৎ এটা অস্তিত্বের জন্যে কারও ওপর নির্ভরশীল থাকবে না। তেমন কোনও সত্তা কী আছেন? ইবন সিনার মতো ফায়লাসুফ নিশ্চিতভাবে ধরে নিয়েছিলেন যে সৃষ্টিজগৎ যৌক্তিক, এবং এই যৌক্তিক বিশ্বের একজন অকারণ সত্তা থাকতে বাধ্য, অস্তিত্বের ধারাক্রমের সর্বোচ্চ বিন্দুতে একজন অটল চালক (আন-মুভড মুভার)। নিশ্চয়ই কারণ এবং ফলাফলের কোনও ধারা কিছু দিয়ে শুরু হয়েছিল। এমন একজন পরম সত্তার অনুপস্থিতির মানে হবে আমাদের মন সামগ্রিকভাবে বাস্তবতার প্রতি সজানুভূতিশীল নয়। সুতরাং, সেটাই আবার বোঝাবে যে এই মহাবিশ্ব সামঞ্জস্যপূর্ণ ও যৌক্তিক নয়। যে পরিপূর্ণ সরল সত্তার ওপর জটিল অনিশ্চিত বাস্তবতা সামগ্রিকভাবে নির্ভরশীল ধর্মগুলো তাকেই ‘ঈশ্বর’ বলে আখ্যায়িত করেছে। যেহেতু এটা সকল বস্তুর চেয়ে শ্রেষ্ঠ, সেহেতু একেবারে নিখুঁত এবং শ্রদ্ধা ও উপাসনার যোগ্য। কিন্তু এর অস্তিত্ব যেহেতু অন্য যেকোনও কিছুর চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন, তাই সত্তার ধারায় এটা স্রেফ আরেকটা বস্তুমাত্র নয় ।
ঈশ্বর স্বয়ং যে সরল, দার্শনিক ও কোরান এ বিষয়ে একমত: তিনি একক। সুতরাং এরপরই কথা আসে যে তাঁকে বিভিন্ন অংশ বা গুণাবলীতে ভাগ করা বা বিশ্লেষণ সম্ভব নয়। যেহেতু এই সত্তাটি চূড়ান্তরূপে সরল, সেহেতু এর কোনও কারণ নেই, গুণাবলী নেই, কোনও সময়গত মাত্রা নেই এবং তার সম্পর্কে বলার মতো কিছুই আমাদের নেই। ঈশ্বর বাস্তব চিন্তাভাবনার বিষয়বস্তু হতে পারেন না, কারণ আমাদের মস্তিষ্ক অন্য সবকিছু যেভাবে বিবেচনা করে। তাকে সেভাবে বিবেচনা করতে পারবে না। ঈশ্বর যেহেতু আবিশ্যিকভাবে। অদ্বিতীয়, সেহেতু স্বাভাবিক অনিশ্চিত অর্থে বিরাজিত কোনও কিছুর সঙ্গেই তার তুলনা করা যাবে না। এই অবস্থায় আমরা যখন ঈশ্বর সম্পর্কে কথা বলি তখন আলোচনাযোগ্য সবকিছু থেকে তাকে আলাদা রাখার জন্যে আমাদের উচিত নেতিবাচক শব্দ ব্যবহার করা। কিন্তু ঈশ্বর যেহেতু সকল বস্তুর উৎস, আমরা তাঁর সম্পর্কে নির্দিষ্ট কিছু বিষয় স্বীকার করে নিতে পারি । আমরা যেহেতু জানি যে শুভের অস্তিত্ব আছে, সুতরাং ঈশ্বর নিশ্চয়ই অত্যাবশ্যক বা ‘প্রয়োজনীয়’ শুভ (Goodness); যেহেতু আমরা জানি যে প্রাণ, ক্ষমতা ও জ্ঞানের অস্তিত্ব আছে, ঈশ্বর নিশ্চয় অত্যাবশ্যক ও সম্পূর্ণ অর্থে জীবন্ত, ক্ষমতাবান ও বুদ্ধিমান। অ্যারিস্টটল শিক্ষা দিয়েছিলেন যে, ঈশ্বর যেহেতু নিখুঁত বা খাঁটি কারণ-যুগপত যুক্তি প্রয়োগের ভঙ্গি এবং চিন্তার লক্ষ্য এবং বিষয়-কেবল নিজেকে নিয়েই ভাবতে পারেন তিনি; নিম্ন পর্যায়ের অনিশ্চিত বাস্তবতার প্রতি ভ্রূক্ষেপ করেন না। এটা সর্ব বিষয়ে জ্ঞানী এবং সৃষ্ট জগতে উপস্থিত ও সক্রিয় বলে কথিত প্রত্যাদেশের ঈশ্বরের প্রতিকৃতির সঙ্গে মেলে না। ইবন সিনা একটা আপোসের প্রয়াস পেয়েছিলেন: ঈশ্বর এতই সুমহান যে তার পক্ষে মানুষের মতো তুচ্ছ বিশেষ কোনও সত্তার জ্ঞানে ও তাদের কাজে অবতরণ করা সম্ভব নয়। অ্যারিস্টটল যেমন বলেছিলেন, এমন কিছু বিষয় আছে যেগুলো দেখার চেয়ে না দেখা ভালো। ঈশ্বর ভূমি ও পৃথিবীর তুচ্ছ স্বল্পস্থায়ী জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে নিজেকে নোংরা করতে পারেন না। কিন্তু আত্ম-জ্ঞানের চিরন্তন প্রক্রিয়ায় তিনি তাঁর নিকট হতে উৎসারিত সব কিছু এবং তিনি যাদের অস্তিত্ব দিয়েছেন সেসব বুঝতে পারেন। তিনি জানেন যে তিনিই অনিশ্চিত প্রাণীর কারণ। তাঁর চিন্তা এতই নিখুঁত যে চিন্তা ও তাকে বাস্তবে রূপদান একই সঙ্গে সংঘটিত হয়ে থাকে। সুতরাং, নিজেকে নিয়ে তাঁর চিরন্তন ভাবনা ফায়লাসুফদের বর্ণিত উৎসারণের প্রক্রিয়ার সূচনা করে। কিন্তু ঈশ্বর কেবল সাধারণভাবে বিশ্বজনীন অর্থে আমাদের এবং এই জগতকে জানেন, তিনি ব্যক্তি বিশেষকে নিয়ে ভাবেন না।
তবু ইবন সিনা ঈশ্বরের রূপের এই বিমূর্ত উপস্থাপনে সন্তুষ্ট হতে পারেননিঃ একে তিনি বিশ্বাসীদের অর্থাৎ সুফী ও বাতিনিদের ধর্মীয় মনস্তত্ত্বে ধর্মীয় অভিজ্ঞতার সঙ্গে সংযুক্ত করতে চেয়েছিলেন। ধর্মীয় মনস্তত্ত্বে উৎসাহী ইবন সিনা পয়গম্বরত্বের অভিজ্ঞতা ব্যাখ্যা করার উদ্দেশ্যে উৎসারণের প্রটিনিয় প্রকল্পের ব্যবহার করেছিলেন। ইবন সিনা অনুমান করেছেন, দ্য ওয়ান’ হতে সত্তার অবতরণের দশটি পর্যায়ের প্রত্যেকটায় আত্মা বা দেবদূতসহ দশটি খাঁটি বুদ্ধিমত্তা টলেমিয় বলয়সমূহকে সক্রিয় করে তুলেছিল যা মানুষ এবং ঈশ্বরের মাঝে বাতিনিদের কাল্পনিক আদি আদর্শ জগতের অনুরূপ এক মধ্যবর্তী জগৎ সৃষ্টি করেছে। এইসব বুদ্ধিমত্তার কল্পনা শক্তিও রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, এগুলো কল্পনার খাঁটি পর্যায় এবং কল্পনার মধ্যবর্তী এই জগতের মধ্য দিয়ে এলোমেলো কারণ দিয়ে নয়-নারী-পুরুষ ঈশ্বর সম্পর্কে পরিপূর্ণ উপলব্ধিতে পৌঁছতে পারে। বুদ্ধিমত্তার শেষ বলয়টি হচ্ছে আমাদের বলয়-দশম-ব্রিাইল নামে পরিচিত প্রত্যাদেশের পবিত্র আত্মা আলো ও জ্ঞানের উৎস। মানুষের আত্মা পৃথিবীর সঙ্গে সম্পর্কিত ব্যবহারিক বুদ্ধিমত্তা ও চিন্তাশীল বুদ্ধিমতায় তৈরি এবং জিব্রাইলের সঙ্গে অন্তরঙ্গ হয়ে মিশতে পারে। সুতরাং পয়গম্বরদের পক্ষে ঈশ্বর সম্পর্কে সহজাত ও কল্পনা-নির্ভর জ্ঞান অর্জন সম্ভব, ব্যবহারিক এবং এলোমেলো যুক্তির উর্ধ্বে যে বুদ্ধিমত্তা, তার অর্জিত জ্ঞানের সমপর্যায়ের হবে এই জ্ঞান। সুফীদের অভিজ্ঞতা আমাদের দেখিয়েছে যে, মানুষের পক্ষে যুক্তি বিচার প্রয়োগ না করে দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকে সঠিক ঈশ্বরের দর্শন লাভ সম্ভব। সিলোজিসম প্রয়োগের বদলে তারা সিম্বলিজম এবং ইমেজারির কল্পনা নির্ভর উপাদান ব্যবহার করেছে। পয়গম্বর মুহাম্মদ (স) এই স্বর্গীয় জগতের সঙ্গে পরিপূর্ণভাবে একীভূত হয়েছিলেন। পরবর্তী অধ্যায়ে আমরা যেমন দেখব, দিব্যদর্শন ও প্রত্যাদেশের এই মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দার্শনিকভাবে : ঝোঁক বিশিষ্ট সুফীদের নিজস্ব ধর্মীয় বোধ আলোচনায় সক্ষম করে তুলবে।
প্রকৃতপক্ষে, জীবনের শেষ পর্যায়ে ইবন সিনা স্বয়ং যেন অতিন্দ্রীয়বাদীতে পরিণত হয়েছিলেন। তিনি তাঁর কিতাব আল-আশেরাত (দ্য বুক অভ অ্যাডমোনিশন্স) শীর্ষক নিবন্ধে ঈশ্বরের ক্ষেত্রে যৌক্তিক পদ্ধতির ব্যবহারের স্পষ্ট বিরোধী হয়ে উঠছিলেন, একে হতাশাব্যাঞ্জক মনে হয়েছিল তাঁর। তিনি, যাকে বলে, প্রাচ্য দর্শন’ আল-হিকমত আল-মাশারিক্কিয়ার দিকে ঝুঁকছিলেন। ভৌগোলিক পুবদিকের কথা বোঝায়নি এটা, আলোর উৎসের কথা বুঝিয়েছে। একটি নিগূঢ় নিবন্ধ রচনার ইচ্ছা পোষণ করেছিলেন তিনি, আলোকন (ইশরাক), যেখানে যুক্তিতর্কের ওপর নির্ভরশীল অনুশীলনের একটি পদ্ধতি গড়ে তুলবেন বলে ভেবেছিলেন। আমরা জানি না শেষ পর্যন্ত নিবন্ধটি লিখতে পেরেছিলেন কিনাঃ যদি লিখে থাকেন, তাহলে নষ্ট হয়ে গেছে। কিন্তু পরবর্তী অধ্যায়ে যেমন দেখব, মহান ইরানি দার্শনিক ইয়াহিয়া সুহরাওয়ার্দি ইশরাকি মতবাদ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যেখানে ইবন সিনা পরিকল্পিত দর্শন ও আধ্যাত্মিকতার সংশ্লেষ ঘটেছিল।
কালাম ও ফালসাফাহর অনুশীলন ইসলামি সাম্রাজ্যের ইহুদিদের মাঝে একই রকম বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলনের অনুপ্রেরণা জাগিয়েছিল। প্রথমবারের মতো তারা ইহুদিবাদে মেটাফিজিকাল অনুমান নির্ভর উপাদান যোগ করে আরবী ভাষায় নিজস্ব দর্শন রচনা শুরু করেছিল। মুসলিম ফায়লাসুফদের বিপরীতে ইহুদি দার্শনিকরা দর্শন বিজ্ঞানের সামগ্রিক বিষয় নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে শুধু ধর্মীয় বিষয়াদিতে মনোযোগ দিয়েছিল। ইসলামের ভাষাতেই ইসলামের চ্যালেঞ্জের জবাব দিতে হবে ভেবে বাইবেলের ব্যক্তিক ঈশ্বরকে ফায়লাসুফদের ঈশ্বরের সমান করা প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। মুসলিমদের মতো তাঁরা ঐশীগ্রন্থ ও তালমুদে ঈশ্বরের মানবীয় রূপ দেখে উদ্বিগ্ন ছিল; নিজেদের জিজ্ঞেসা করেছে, এই ঈশ্বর কীভাবে দার্শনিকদের ঈশ্বর হতে পারেন । স্বভাবতই ভিন্ন সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিল তারা, তারা মুসলিম চিন্তাবিদদের ওপর গভীরভাবে নির্ভরশীল ছিল। এভাবে ইহুদিবাদে প্রথম দার্শনিক ব্যাখ্যা প্রদানের দায়িত্ব গ্রহণকারী সাদিয়া ইবন জোসেফ (৮৮২-৯২) একজন তালমুদিস্ট ও মুতাযিলিও ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, নিজস্ব শক্তি বলে যুক্তি ঈশ্বর-জ্ঞান অর্জন করতে পারে। ফায়লাসুফের মতো ঈশ্বর সম্পর্কে যৌক্তিক ধারণা অর্জনকে মিতভাহ, অর্থাৎ ধর্মীয় দায়িত্ব হিসাবে দেখেছেন তিনি। কিন্তু আবার মুসলিম যুক্তিবাদীদের মতো ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়ে তার মনে এতটুকু সংশয় ছিল না। সাদিয়ার কাছে স্রষ্টা ঈশ্বরের অস্তিত্ব এত নিশ্চিত মনে হয়েছিল যে, তার বুক অভ বিলিফস অ্যান্ড অপিনিয়নস গ্রন্থে বিশ্বাস নয় বরং ধর্মীয় সন্দেহের সম্ভাবনাই প্রমাণের প্রয়োজন বোধ করেছিলেন তিনি।
সাদিয়া যুক্তি দেখিয়েছেন যে, কোনও ইহুদির প্রত্যাদেশের সত্যকে মেনে নেওয়ার বেলায় যুক্তির ওপর চাপ দেওয়ার প্রয়োজন নেই। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, ঈশ্বর পুরোপুরিভাবে মানবীয় যুক্তিতে সুগম্য। শূন্য হতে সৃষ্টির ধারণা যে দর্শনিক সমস্যায় পূর্ণ ও যৌক্তিকভাবে ব্যাখ্যা করা অসম্ভব এ কথা মেনে নিয়েছিলেন সাদিয়া, কারণ ফায়লাসুফদের ঈশ্বর আকস্মিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও পরিবর্তন সুচিত করতে সমর্থ নন। কী করে আধ্যাত্মিক একজন ঈশ্বর বস্তুগত একটা জগতের উৎস হতে পারেন? এখানেই আমরা যুক্তির শেষ সীমায় পৌঁছে যাই এবং মেনে নিতে হয় যে, প্লেটোনিস্টদের বিশ্বাস অনুযায়ী বস্তু চিরন্তন নয়, বরং সময়ের বিস্তারে এর একটা সূচনা ছিল। একমাত্র এটিই ঐশীগ্রন্থ ও সাধারণ বুদ্ধির সঙ্গে সামজ্ঞস্যপূর্ণ সম্ভাব্য ব্যাখ্যা। একবার এ ব্যাখ্যা মেনে নিলে ঈশ্বর সম্পর্কে অন্যান্য তথ্য বের করতে পারি আমরা। সৃষ্ট জগৎ বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে পরিকল্পিত; এর প্রাণ এবং শক্তি আছে: সুতরাং এর স্রষ্টা ঈশ্বরের অবশ্যই প্রজ্ঞা, প্রাণ ও ক্ষমতা থাকতে বাধ্য। এইসব গুণাবলী ক্রিশ্চানদের ট্রিনিটি মতবাদে প্রকাশিত পৃথক hypostases নয়, বরং ঈশ্বরের বৈশিষ্ট্যমাত্র। আমাদের মানবীয় ভাষা ঈশ্বরের পরিচয়কে পর্যাপ্তভাবে প্রকাশ করতে পারে না বলে আমরা এভাবে তাঁকে বিশ্লেষণ করতে বাধ্য হই ও তাঁর চরম সারল্যকে যেন নষ্ট করি। আমরা ঈশ্বর সম্পর্কে যথাসম্ভব নিখুঁত হতে চাইলে কেবল সঠিকভাবে এটুকুই বলতে পারি যে, তিনি আছেন। সাদিয়া অবশ্য ঈশ্বরের সব ইতিবাচক বর্ণনাই নিষিদ্ধ করেননি, দার্শনিকদের দূরবর্তী নৈর্ব্যক্তিক ঈশ্বরকে বাইবেলের ব্যক্তিক মানবীয় ঈশ্বরের উর্ধ্বেও স্থান দেননি। উদাহরণ স্বরূপ, তিনি জগতে আমাদের প্রত্যক্ষ করা দুঃখকষ্টের ব্যাখ্যা দেওয়ার প্রয়াস পাওয়ার সময় তালমুদ ও প্রজ্ঞা রচয়িতাদের শরণ নিয়েছেন, বলেছেন দুঃখ-কষ্ট পাপের শাস্তি, আমাদের বিনয়ী করে তোলার জন্যে আমাদের তা শুদ্ধ ও নিয়মনিষ্ঠ করে তোলে। প্রকৃত ফায়লাসুফ এব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট হবে না, কারণ এখানে ঈশ্বরকে বড় বেশি মানবীয় রূপ দেওয়া হয়েছে ও তার ওপর পরিকল্পনা ও ইচ্ছার মতো গুণ আরোপ করা হয়েছে। কিন্তু সাদিয়া ঐশীগ্রন্থের প্রকাশিত ঈশ্বরকে ফালসাফাহর ঈশ্বরের চেয়ে নিম্নস্তরের হিসেবে দেখেননি। পয়গম্বরগণ যে কোনও দার্শনিকের চেয়ে শ্রেয়তর ছিলেন। শেষ বিচারে যুক্তি কেবল বাইবেলের শিক্ষাকেই পদ্ধতিগতভাবে তুলে ধরার প্রয়াস পেতে পারে।
অন্য ইহুদিরা আরও অগ্রসর হয়েছিল। নিওপ্লেটোনিস্ট সলোমন ইবন গাবিরোল (১০২২-১০৭০) তার ফাউন্টেন অভ লাইফ-এ শূন্য হতে সৃষ্টির মতবাদ মেনে নিতে পারেননি, তিনি ঈশ্বরকে কিছু মাত্রায় স্বতঃস্ফুর্ততা ও স্বাধীন ইচ্ছার প্রদান করার জন্যে উৎসারণ তত্ত্বকে অভিযোজনের প্রয়াস পেয়েছেন। গাবিরোল দাবি করেন, ঈশ্বর উৎসারণ প্রক্রিয়া শুরু করার ইচ্ছা বা আকাঙ্ক্ষা করছেন এবং এভাবে প্রক্রিয়াটিকে কম-যান্ত্রিক করার প্রয়াস পেয়েছেন; ঈশ্বরকে তিনি একই গতিবিদ্যার অধীন না করে অস্তিত্বের নিয়ম নীতির নিয়ন্তা হিসাবে দেখাতে চেয়েছেন। কিন্তু বস্তু কীভাবে ঈশ্বর হতে আসতে পারে গাবিরোল সে ব্যাখ্যা দিতে পারেননি। অন্যরা আরও কম উদ্ভাবনী শক্তির অধিকারী ছিল। বাহিয়া ইবন পাকুদাহ্ (মৃত্যু, ১০৮০) গোড়া প্লেটোনিস্ট ছিলেন না, তবে যখনই সুবিধাজনক মনে করেছেন কালামের কৌশলের আশ্রয় নিয়েছেন। এভাবে সাদিয়ার মতো তিনিও যুক্তি দিয়েছিলেন যে, একটি নির্দিষ্ট মুহূর্তে ঈশ্বর বিশ্ব সৃষ্টি করেছেন। জগৎ অবশ্যই দুর্ঘটনাবশতঃ অস্তিত্ব লাভ করেনিঃ সেটা হবে কাগজের ওপর কালি ছড়িয়ে একটা চমৎকার অনুচ্ছেদ লেখা হয়ে গেছে কল্পনা করার মতোই হাস্যকর। ধারণা। বিশ্বের নিয়ম-শৃঙ্খলা ও উদ্দেশ্যপূর্ণতা বোঝায় যে ঐশীগ্রন্থের ভাষ্য মোতাবেক নিশ্চয়ই একজন স্রষ্টা আছেন । এই চরম আদর্শিক মতবাদের অবতারণা করে বাহিয়া কালাম ছেড়ে ফালসাফাহয় সরে গেছেন; তিনি ইবন সিনার প্রমাণ দেখিয়ে বলেছেন, এক প্রয়োজনীয় সরল সত্তার অস্তিত্ব থাকতে বাধ্য।
বাহিয়া বিশ্বাস করতেন যে, কেবল পয়গম্বর ও দার্শনিকরাই সঠিকভাবে ঈশ্বরের উপসানা করেছেন। পয়গম্বরের ঈশ্বর সম্পর্কে সরাসরি ও সহজাত জ্ঞান ছিল, দার্শনিকের থাকে তাঁর সম্পর্কে যৌক্তিক জ্ঞান। বাকি সবাই কেবল তার এক অভিক্ষেপ, নিজের কল্পনায় সৃষ্ট ঈশ্বরের উপাসনা করছে। এরা অন্ধের মতো, অন্য মানুষ দ্বারা পরিচালিত, যদি না তারা নিজেরাই ঈশ্বরের অস্তিত্ব ও একত্ব প্রমাণ করার প্রয়াস না পায়। যে কোনও ফায়লাসুফের মতোই অভিজাত ছিলেন বাহিয়া, আবার তার প্রবল সুফী প্রবণতাও ছিল: যুক্তি আমাদের ঈশ্বরের অস্তিত্ব জানাতে পারে, কিন্তু তাঁর সম্পর্কে আর কিছু বলতে পারে না। শিরোনামে যেমন বোঝা যায়, বাহিয়ার নিবন্ধ ডিউটিজ অভ দ্য হার্ট ঈশ্বরের প্রতি সঠিক মনোভাব গড়ে তুলতে আমাদের সাহায্য করার জন্যে যুক্তি ব্যবহার করেছে। নিওপ্লেটোনিজমের সঙ্গে তাঁর ইহুদিবাদের কোথাও সংঘাত বাধলে তিনি স্রেফ বাদ দিয়ে গেছেন। ঈশ্বর সম্পর্কে তাঁর ধর্মীয় বোধ যেকোনও যৌক্তিক পদ্ধতিকে এড়িয়ে গেছে।
কিন্তু যুক্তি যদি ঈশ্বর সম্পর্কে আমাদের কিছুই বলতে না পারে, তাহলে ধর্মতত্ত্বীয় বিষয়ে যৌক্তিক আলোচনার যথার্থতা কী? এ প্রশ্নটি মুসলিম চিন্তাবিদ আবু হামিদ আল-গাযযালি (১০৫৮-১১১১) কে তাড়িত করেছে। ধর্মীয় দর্শনের ইতিহাসে গাযযালি এক গুরুত্বপূর্ণ প্রবাদ পুরুষ। তাঁর জন্ম খোরাশানে। বিশিষ্ট আশারিয় ধর্মতাত্ত্বিক জুয়াঈনির অধীনে কালাম শিক্ষা করেছিলেন তিনি, এত গভীর ছিল তাঁর জ্ঞান যে মাত্র তেত্রিশ বছর বয়সে বাগদাদের মর্যাদাসম্পন্ন নিযামিয়াহ মসজিদের পরিচালক নিযুক্ত হয়েছিলেন। তাঁর দায়িত্ব ছিল ইসমায়েলিদের শিয়াহ্ চ্যালেঞ্জের বিরুদ্ধে সুন্নী মতাদর্শের পক্ষাবলম্বন করা। আল-গাযযালির অবশ্য এক ধরনের অস্থির মানসিকতা ছিল যার কারণে সত্যের সঙ্গে প্রবল সংগ্রাম করতে হয়েছে তাকে এবং সমস্যা নিয়ে চিন্তা করতে গিয়ে মৃতপ্রায় হয়ে গেছেন, সহজ প্রচলিত অর্ধে সন্তুষ্ট হতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন তিনি। আমাদের তিনি যেমন বলছেন,
প্রতিটি অন্ধকার কোণে উঁকি দিয়েছি আমি, প্রত্যেক সমস্যার ওপর আক্রমণ চালিয়েছি, ঝাঁপ দিয়েছি প্রতিটি গহ্বরে। আমি সকল গোত্রের বিশ্বাস পরখ করেছি, প্রতিটি গোষ্ঠীর গূঢ় মতবাদ উন্মোচিত করার প্রয়াস পেয়েছি। এসবই করেছি যাতে সত্য ও মিথ্যা, সঠিক ধর্ম ও বিদ্রোহী মূলক আবিষ্কারের পার্থক্য বুঝতে পারি।
সাদিয়ার মতো দার্শনিকের অনুভূত সন্দেহাতীত নিশ্চয়তার অনুসন্ধানে ছিলেন তিনি, কিন্তু ক্রমবর্ধমান হারে মোহমুক্ত হয়ে পড়েছিলেন। কঠোর গবেষণা সত্ত্বেও পরম নিশ্চয়তা তাকে এড়িয়ে গেছে। তাঁর সমসমায়িকরা বিভিন্নভাবে যার যার ব্যক্তিগত প্রয়োজন ও মেজাজ অনুযায়ী ঈশ্বরের সন্ধান করেছেন কালামে, ইমামের সাহায্যে, ফালসাফাহ্ আর সুফী অতিন্দ্রীয়রাদে। আল গাযযালি যেন এগুলোর প্রতিটি অনুশীলন গবেষণা করেছেন ‘আসলে এগুলো কী সেটা বোঝার প্রয়াসে। তাঁর গবেষণাভুক্ত ইসলামের চারটি প্রধান ভাষ্যের অনুসারীরা সম্পূর্ণ দৃঢ় প্রত্যয় দাবি করলেও আল-গাযযালির জিজ্ঞাসা ছিল, এই দাবি বস্তুনিষ্ঠাভাবে যাচাই করা যাবে কীভাবে?
যেকোনও আধুনিক সংশয়বাদীর মতোই আল-গাযযালি সজাগ ছিলেন যে নিশ্চয়তা একটি মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা যা বস্তুনিষ্ঠভাবে সত্য নাও হতে পারে। ফায়সুফরা বলেছে, তারা যৌক্তিক তর্কবিতর্কের মাধ্যমে বিশেষ জ্ঞান অর্জন করেছে, অতিন্দ্রীয়বাদীরা জোর দিয়ে বলেছে, সুফী চর্চার মাধ্যমে তারা এটা লাভ করেছে, ইসমায়েলিরা ভেবেছে এটা কেবল ইমামের শিক্ষার মাধ্যমেই পাওয়া সম্ভব। কিন্তু যে সত্তাকে আমরা ‘ঈশ্বর’ ডাকি, তাঁকে অভিজ্ঞতা দিয়ে পরখ করা যায় না, সুতরাং আমরা কীভাবে নিশ্চিত হব যে আমাদের বিশ্বাসসমূহ নিছক বিভ্রান্তি নয়? অধিকতর প্রথাগত প্রমাণাদি আল-গাযযালির কঠোর মানদণ্ডকে সন্তুষ্ট করতে ব্যর্থ হয়েছে। কালামের ধর্মতত্ত্ববিদরা ঐশীগ্রন্থে পাওয়া প্রস্তাবনা নিয়ে অগ্রসর হয়েছিলেন, কিন্তু এসবকে যুক্তিসঙ্গতভাবে যাচাই করা হয়নি। ইসমায়েলিরা একজন গোপন ও অগম্য ইমামের শিক্ষার ওপর নির্ভর করেছে, কিন্তু ইমাম যে ঐশ্বরিক অনুপ্রেরণাপ্রাপ্ত কী করে সেটা নিশ্চিত হব আমরা, আমরা তাঁর সন্ধান না পেলে এই অনুপ্রেরণার যুক্তি কী? ফালসাফাহ বিশেষভাবে অসন্তে ষিজনক ছিল। আল-গাযযালি তাঁর যুক্তির এক উল্লেখযোগ্য অংশ আল ফারাবি ও ইবন সিনার বিরুদ্ধে প্রয়োগ করেছেন। তাদের নিজস্ব বিশ্বাসে অভিজ্ঞ কারও পক্ষেই তাঁদের যুক্তি খণ্ডণ করা সম্ভব বিশ্বাস করে আল গাযযালি তিন বছর পুরোপুরি আত্মস্থ না করা পর্যন্ত ফালসাফাহ অধ্যায়ন করেছেন। তাঁর নিবন্ধ দ্য ইনকোহেরেন্স অভ দ্য ফিলোসফারস-এ তিনি যুক্তি তুলে ধরেছেন যে, ফায়লাসুফরা প্রশ্নটিকে খুঁচিয়েছে। ফালসাফাহ্ জাগতিক দর্শনযোগ্য ঘটনাবলী যেমন চিকিৎসা বিজ্ঞান, জ্যোতির্বিদ্যা বা গণিতশাস্ত্রে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখলে তা দারুণ উপকারে আসবে বটে কিন্তু এ থেকে ঈশ্বর সম্পর্কে কিছুই জানা যাবে না। উৎসারণের মতবাদ ঠিক না ভুল সেটা কেউ প্রমাণ করবে কীভাবে? ফায়লাসুফরা কীভাবে স্থির করল যে, ঈশ্বর কেবল সাধারণ বিশ্বজনীন বিষয়ে ওয়াকিবহাল, ব্যক্তি বিশেষ সম্পর্কে নন? তারা এটা প্রমাণ করতে পারবে? ঈশ্বর অতিমহান বলে তুচ্ছ বাস্তবতা সম্পর্কে অজ্ঞ হবেন, তাদের এই যুক্তি ঠিক নয়: অজ্ঞতা আবার কবে থেকে মহত্ত্বের মাপকাঠি হল? এসব প্রস্তাবনা যথার্থভাবে যাচাই করার জো নেই, সুতরাং ফায়লাসুফরা মানুষের সাধ্যের অতীত ও অনুভূতি দিয়ে যাচাই অযোগ্য জ্ঞান আহরণের প্রয়াস পেয়ে অযুক্তি ও অদার্শনিক সুলভ আচরণ করেছে।
কিন্তু সত্যের প্রকৃত অনুসন্ধানীকে কী অবস্থায় ফেলেছিল তা? ঈশ্বরে গভীর অটুট বিশ্বাস কী অসম্ভব? সত্যানুসন্ধানের চাপ আল-গাযযালির উপর এমন হতাশার সৃষ্টি করেছিল যে সাময়িক বৈকল্য ঘটেছিল তাঁর। হতাশার বিপর্যয়কর অনুভূতির চাপে নাওয়া-খাওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, দিশাহারা বোধ করেছেন তিনি। অবশেষে ১০৯৪ সালে আবিষ্কার করেছেন যে, তিনি কথা বলতে বা লেকচার দিতে পারছেন না:
ঈশ্বর আমার জিভ সংকুচিত করে দিলেন, আমি আর নির্দেশনা দিতে পারছিলাম না। তাই একটা নির্দিষ্ট দিনে শিক্ষা দান করার জন্য নিজের ওপর জোর খাটালাম যাতে আমার অসংখ্য ছাত্র উপকৃত হতে পারে, কিন্তু আমার জিভ একটা শব্দও উচ্চারণ করতে পারেনি।
বিষণ্ণতার শিকারে পরিণত হলেন তিনি। চিকিৎসকরা সত্যি সত্যি তাঁর মনের গভীরে এক গভীর বিরোধ শনাক্ত করলেন, তাঁকে বললেন সুপ্ত উদ্বেগ হতে মুক্তি না পাওয়া পর্যন্ত তার সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা নেই। বিশ্বাস ফিরে পেতে ব্যর্থ হলে নরক বাসের শাস্তির আশঙ্কায় আল-গাযযালি সম্মানজনক শিক্ষকতার পদ ছেড়ে সুফীদের সঙ্গে যোগ দিতে চলে যান।
এখানেই যা খুঁজছিলেন পেয়ে গেলেন তিনি। যুক্তি বিসর্জন না দিয়ে সুফীবাদের চরম রূপকে বরাবরই আবিশ্বাস করেছেন তিনি-গাযযালি আবিষ্কার করলেন, অতিন্দ্রীয় অনুশীলন এক ধরনের সরাসরি কিন্তু সহজাত বোধ সৃষ্টি করে যাকে ‘ঈশ্বর বলা যেতে পারে। বৃটিশ পণ্ডিত জন বাউকার দেখিয়েছেন, অস্তিত্বের আরবী শব্দ উজুদ এসেছে মুল ওয়াজাদা হতে: ‘সে পেয়েছে। সুতরাং, আক্ষরিক অর্থে উজুদ-এর মানে যা পাওয়া সম্ভব’: এটা গ্রিক মেটাফিজিক্যাল পরিভাষার চেয়ে অনেক সংহত ও মুসলিমদের আরও বেশি অবকাশ দেয়। যখন কোনও আরবীভাষী দার্শনিক ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রমাণ দেওয়ার প্রয়াস পান তখন আরও বহু জিনিসের মাঝে ঈশ্বরকে আরেকটা বস্তু হিসাবে তুলে ধরার প্রয়োজন হয় না। তাকে পাওয়া সম্ভব প্রমাণ করতে পারলেই হয়। ঈশ্বরের উজুদের চুড়ান্ত প্রমাণ পাওয়া যাবে-বা যাবে না-মৃত্যুর পরে বিশ্বাসী যখন ঐশী সত্ত্বার মুখোমুখি হবে তখন, কিন্তু পয়গম্বর ও অতিন্দ্রীয়বাদীদের মতো লোক যারা ইহজীবনেই এই অভিজ্ঞতা অর্জনের দাবি করেছেন তাদের সেই দাবি অত্যন্ত সাবধানতার সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। সুফীরা অবশ্যই ঈশ্বরের উজুদের অভিজ্ঞতা লাভের দাবি করেছে: ওয়াজদ শব্দটি ঈশ্বর সম্পর্কে তাদের ভাববাদী উপলব্ধির প্রকাশের প্রায়োগিক শব্দ বা ঈশ্বর যে বাস্তব, কষ্ট-কল্পনা নয় তার পরিপূর্ণ নিশ্চয়তা-ইয়াকিন–দান করেছে। স্বীকার্য, তাদের দাবিতে এইসব সংবাদ ভুল বোঝা হয়ে থাকতে পারে, কিন্তু সুফীদের সংসর্গে দশ বছর কাটানোর পর আল-গাযযালি আবিষ্কার করেন, মানবীয়। বুদ্ধিমত্তা ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্রক্রিয়ার অতীতে অবস্থানকারী কোনও সত্তাকে যাচাই করার একমাত্র উপায়ই হচ্ছে ধর্মীয় অভিজ্ঞতা। ঈশ্বর সম্পর্কে সুফীদের জ্ঞান যৌক্তিক বা মেটাফিজিক্যাল জ্ঞান নয়, বরং অতীতের পয়গম্বরদের সহজাত অভিজ্ঞতার অনেক কাছাকাছিঃ এভাবে সুফীরা ইসলামের মূল বোধের পুনরুজ্জীবনের মাধ্যমে নিজেরাই এর অত্যাবশ্যক সত্যের সন্ধান পেয়েছিল।
সুতরাং, আল-গাযযালি এমন এক অতিন্দ্রীয়বাদী বিশ্বাসের জন্ম দিয়েছিলেন যা রাষ্ট্রযন্ত্রের কাছে গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হয়েছে; পরবর্তী অধ্যায়ে আমরা দেখব রাষ্ট্রযন্ত্র সাধারণভাবে ইসলামে অতিন্দ্রীয়বাদীদের তীর্যক দৃষ্টিতে দেখেছে। ইবন সিনার মতো আল-গাযযালিও ইন্দ্রীয়গ্রাহ্য জাগতিক জীবনের অতীত এক আদি আদর্শ জগতে বিশ্বাসের শরণাপন্ন হয়েছিলেন। দৃশ্যমান জগৎ (আলম-আল শাহাদাহ) হচ্ছে তাঁর ভাষায় প্লেটোনিক বুদ্ধিমত্তার জগৎ আলম-আল মালাকুত এর নিম্নস্তরের অনুকৃতি, যেকোনও ফায়লাসুফই যেমন মেনে নেয়। কোরান ও ইহুদি-ক্রিশ্চানদের বাইবেল এই আধ্যাত্মিক জগতের কথাই বলেছে। মানুষ বাস্তবতার উভয় জগতেই অবস্থান করে: সে ইহজগতের পাশাপাশি আত্মার জগতেও বাস করে, কারণ ঈশ্বর ঐশী রূপ মানুষের মাঝে প্রোথিত করে দিয়েছিলেন। আল-গাযযালি তার অতিন্দ্রীয়বাদ বিষয়ক নিবন্ধ মিশকাত আল-আনওয়ার-এ সুরা নূরের ব্যাখ্যা করেছেন আগের অধ্যায়ে যেটা উদ্ধৃত করেছি। এইসব পঙক্তিতে উল্লিখিত আলো বা জ্যোতি ঈশ্বর ও অন্যান্য আনোদানকারী বস্তু: প্রদীপ, নক্ষত্রমালা, দুটোর কথাই বলে। আমাদের যুক্তিও আলো দানকারী। এটা কেবল আমাদের অন্যান্য বস্তুকে চিনতেই সক্ষম করে তোলে না, বরং ঈশ্বরের মতো স্থান ও কাল অতিক্রম করে যেতে পারে। সুতরাং এটা আধ্যাত্মিক জগতের একই বাস্তবতার অংশ। কিন্তু যুক্তি দিয়ে স্পষ্ট করার জন্যে কেবল আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক, বিশ্লেষণী ক্ষমতার দিকে ইঙ্গিত করেননি তিনি, আল-গাযযালি পাঠকদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, তার ব্যাখ্যাকে আক্ষরিক অর্থে বোঝা যাবে নাঃ আমরা এসব বিষয় কেবল অলঙ্কারপূর্ণ ভাষায় আলোচনা করতে পারি যা সৃজনশীল কল্পনার এখতিয়ার।
অবশ্য কারও কারও এমন ক্ষমতা থাকে যা যুক্তির চেয়ে উচ্চতর । আল গাযযালি যাকে বলেছেন ‘পয়গম্বরসুলভ চেতনা। যাদের এই গুণের অভাব রয়েছে তারা কেবল অভিজ্ঞতা অর্জন করেনি বলেই এর অস্তিত্ব অস্বীকার করা উচিত হবে না। এটা সূর-কালা কারও সঙ্গীতকে বিভ্রান্তি দাবি করার মতোই অবাস্তব ব্যাপার হবে-সঙ্গীত উপভোগ করতে পারছে না বলেই সে এমন কথা বলছে। আমরা আমাদের যুক্তি প্রয়োেগ ও কল্পনাশক্তি দিয়ে ঈশ্বর সম্পর্কে কিছুটা জানতে পারি, কিন্তু পয়গম্বর বা অতিন্দ্রীয়বাদী, যাদের ঈশ্বরকে ধারণ করার বিশেষ ক্ষমতা আছে কেবল তাদের পক্ষেই সর্বোচ্চ ধরনের জ্ঞান লাভ সম্ভব। কথাটা উচ্চমার্গীয় শোনাচ্ছে, কিন্তু অন্যান্য ধর্ম বা প্রথার অতিন্দ্রীয়বাদীরা দাবি করেছে যে জেন বা বৌদ্ধদের ধ্যানের মতো অনুশীলনে প্রয়োজনীয় সহজাত গ্রহণ ক্ষমতা বিশেষ গুণ, যা কাব্য রচনার বিশেষ যোগ্যতার সঙ্গে তুলনীয়। সবার এই অতিন্দ্রীয় প্রতিভা থাকে না। এই অতিন্দ্রীয় জ্ঞানকে আল-গাযযালি ঈশ্বর একাই অস্তিত্বমান বা তার সত্তা থাকার চেতনাবোধ হিসাবে বর্ণনা করেছেন। এর পরিণাম আত্মবোধ তিরোহিত হয়ে ঈশ্বরের বিলীন হয়ে যাওয়া । অতিন্দ্রীয়বাদীরা রূপক বিশ্বের ঊর্ধ্বে উঠতে সক্ষম, অপেক্ষাকৃত স্বল্পগুণ সম্পন্ন মরণশীলদের সন্তুষ্ট করতে হয় একে; তারা
বিশ্বে ঈশ্বর ছাড়া যে আর কোনও সত্তা নেই সেটা দেখতে সক্ষম হন, এবং দেখেন একমাত্র তার মুখাবয়ব ছাড়া (কোরান ২৮: ৮৮) অন্য। সবকিছু আবার ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে…প্রকৃতপক্ষে তিনি ছাড়া আর সবকিছুই খাঁটি সত্তাবিহীন এবং [প্লেটোনিক প্রকল্পের প্রথম বুদ্ধিমত্তা হতে প্রাপ্ত সত্তার দিক হতে বিবেচনা করলে স্রষ্টার (Maker) মুখবয়বের প্রেক্ষিতে ছাড়া এর কোনও সত্তা নেই; সুতরাং একমাত্র যে জিনিসটি সত্য তা হচ্ছে ঈশ্বরের মুখাবয়ব।
বাহ্যিক বস্তুগত সত্তার পরিবর্তে কেবল যুক্তি দিয়ে অস্তিত্ব প্রমাণযোগ্য ঈশ্বর। হচ্ছেন সর্বব্যাপী বাস্তবতা এবং চূড়ান্ত অস্তিত্ব যাঁকে এর ওপর নির্ভরশীল ও অস্তিত্ব গ্রহণকারী অন্যান্য বস্তুকে আমরা যেভাবে দেখি বা অনুভব করি সেভাবে অনুভব করা যাবে নাঃ দেখার এক বিশেষ ভঙ্গি গড়ে তুলতে হবে আমাদের।
শেষে আবার বাগদাদে শিক্ষকতার কাজে যোগ দিয়েছিলেন আল গাযযালি, কিন্তু এই বিশ্বাস কখনও হারাননি যে যুক্তি-প্রমাণ দিয়ে কখনওই ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রকাশ করা সম্ভব নয়। আল-গাযযালি তাঁর আত্মজৈবনিক প্রবন্ধ আল-মুনাদি মিন আল-দালাল (দ্য ডেলিভারেন্স ফ্রম এরার)-এ যুক্তি দেখিয়েছেন যে, বিশ্বাস হারানোর বিপদোন্মুখ কাউকে রক্ষা করার উপযোগী কিছু ফালসাফাহ্ বা কালামে নেই। স্বয়ং তিনি সংশয়বাদের (সাফসাফা) কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিলেন, যখন উপলব্ধি করেছেন সন্দেহাতীতভাবে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করা একেবারেই অসম্ভব। যে সত্তাকে আমরা ঈশ্বর বলে ডাকি তাঁর অবস্থান বোধশক্তি ও যৌক্তিক চিন্তার বাইরে, সুতরাং বিজ্ঞান বা মেটাফিজিক্স-এর পক্ষে আল্লাহর উজুদ প্রমাণ বা নাকচ কোনওটাই সম্ভব নয়। যাদের বিশেষ অতিন্দ্রীয়বাদী বা পয়গম্বরসুলভ গুণ নেই তাদের জন্যে আল-গাযযালি দৈনন্দিন জীবনের খুঁটিনাটি বিষয়ে ঈশ্বরের সত্তা সম্পর্কে সচেতনাবোধ গড়ে তুলতে মুসলিমদের সক্ষম করে তুলতে এক অনুশীলনের উদ্ভব ঘটিয়েছিলেন। ইসলামে এক অমোচনীয় প্রভাব রেখে গেছেন তিনি। মুসলিমরা আর কখনওই ঈশ্বরকে অন্য কোনও সত্তার মতো মনে করতে যাবে, যার অস্তিত্ব বৈজ্ঞানিক বা দার্শনিকভাবে তুলে ধরা সম্ভব হতে পারে। এর পর থেকে মুসলিম দর্শন আধ্যাত্মিকতার এবং ঈশ্বরের অতিন্দ্রীয় আলোচনার অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হবে।
ইহুদিবাদেও প্রভাব রেখে গিয়েছিলেন তিনি। স্প্যানিশ দার্শনিক জোসেফ ইবন সাদিক (মৃত্যু, ১১৪৩) ঈশ্বরের অস্তিত্ব বিষয়ক ইবন সিনার প্রমাণ ব্যবহার করেছেন, কিন্তু সতর্কতার সঙ্গে এ বিষয়টি তুলে ধরেছেন যে, ঈশ্বর স্রেফ আর একটা সত্তা নন-আমাদের স্বাভাবিক বোধ-বুদ্ধির জগতে ‘বিরাজিত’ এক বস্তু নন। আমরা ঈশ্বরকে বোঝার দাবি করলে তার মানে দাঁড়াবে তাঁকে সীমিত ও অপূর্ণ বোঝানো। ঈশ্বর সম্পর্কে সবচেয়ে সঠিক যে বিবৃতি আমরা দিতে পারি সেটা হচ্ছে তিনি উপলব্ধির অতীত, আমাদের সাধারণ বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষমতার সম্পূর্ণ বাইরে। আমরা জগতে ঈশ্বরের ক্রিয়াকর্ম সম্পর্কে ইতিবাচক অর্থে কথা বলতে পারি, কিন্তু ঈশ্বরের সত্তা আল-ধাত সম্পর্কে নয়, যা সবসময় আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরেই রয়ে যাবে। টলেমিয় চিকিত্সক জুদাহ হালেভি (১০৮৫-১১৪১) আল-গাযযালিকে গভীরভাবে অনুসরণ করেছেন। যৌক্তিকভাবে ঈশ্বরকে প্রমাণ করা যাবে না; তার মানে এই নয় যে, ঈশ্বরে বিশ্বাস স্থাপন অযৌক্তিক, আসল কথা তার অস্তিত্বের যৌক্তিক উপস্থাপনের ধর্মীয় কোনও মূল্য নেই। এ থেকে অতি সামান্যই জানতে পারব আমরা: এমন একজন দূরবর্তী ও নৈর্ব্যক্তিক ঈশ্বর কীভাবে এমন অসম্পূর্ণ বস্তুজগৎ সৃষ্টি করতে পারেন বা এই পৃথিবীর সঙ্গে তাঁর অর্থবোধক কোনও সম্পর্ক আছে কিনা সেটা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করার কোনও উপায় নেই। দার্শনিকরা যখন যুক্তি প্রয়োগ করে মহাবিশ্বকে পরিচালনাকরী ঐশী বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে একীভূত হবার দাবি করেছেন তখন তারা আসলে নিজেদেরই বিভ্রান্ত করেছেন। একমাত্র পয়গম্বরদেরই ঈশ্বর সম্পর্কে সরাসরি জ্ঞান বা ধারণা ছিল, যাদের সঙ্গে ফালসাফাহর কোনওই সম্পর্ক ছিল না।
আল-গাযযালির মতো দর্শন বুঝতে পারেননি হালেভি, কিন্তু স্বীকার করে নিয়েছিলেন যে, ধর্মীয় অভিজ্ঞতার মাধ্যমে অর্জিত ঈশ্বর সম্পর্কিত জ্ঞানই নির্ভরযোগ্য। আল-গাযযালির মতো তিনিও এক বিশেষ ধরনের ধর্মীয় জ্ঞানের দাবি করেছিলেন, কিন্তু তাকে কেবল ইহুদির অধিকারভুক্ত দাবি করেছেন । তবে প্রাকৃতিক আইনের মাধ্যমে গোয়িমরা ঈশ্বর জ্ঞানের নিকটবর্তী হতে পারে বলে তিনি একে নমনীয় করার চেষ্টা চালিয়েছেন; কিন্তু তাঁর বিখ্যাত দার্শনিক রচনার দ্য কুরি-র উদ্দেশ্য ছিল বিভিন্ন জাতির মাঝে ইসরায়েলের অনন্যতা প্রতিষ্ঠা করা। তালমুদের র্যাবাইদের মতো হালেভি বিশ্বাস করতেন মিতভোত-এর সযত্ন অনুসরণের মাধ্যমে যেকোনও ইহুদির পক্ষেই পয়গম্বরসুলভ চেতনা অর্জন সম্ভব। যে ঈশ্বরের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ ঘটবে তিনি বৈজ্ঞানিকভাবে অস্তিত্ব উপস্থাপনযোগ্য কোনও বস্তুগত বিষয় নন, বরং আবশ্যিকভাবে এক মানসিক অভিজ্ঞতা। তাঁকে এমনকি ইহুদির স্বাভাবিক সত্তার বর্ধিতরূপ হিসাবেও দেখা যেতে পারে:
যেমন বলা হয়েছে, স্বর্গীয় সত্য সেই ব্যক্তির জন্যে অপেক্ষা করে যাদের সংস্পর্শে তা আসে এবং যার সঙ্গে নিজেকে সে সংযুক্ত করে, যেন সে ঐ ব্যক্তির ঈশ্বরে পরিণত হতে পারে, পয়গম্বর ও সাধুদের বেলায় যেমনটা ঘটেছে এটা ঠিক আত্মার মতো ণে প্রবেশ করার অপেক্ষায় থাকে, যতক্ষণ না শেষোক্তটির প্রাণশক্তি সত্তার এই উচ্চতর রূপকে গ্রহণ করার যোগ্য হয়ে ওঠার জন্যে পর্যাপ্তভাবে পরিপূর্ণ হয়। এটা ঠিক অপেক্ষমান প্রকৃতির মতো, যা এমন এক তাপমাত্রা ও জলবায়ুর অপেক্ষায় থাকে। যাতে সে মাটির ওপর প্রয়াস চালিয়ে গাছপালার জন্ম দিতে পারে।
সুতরাং ঈশ্বর অজ্ঞাত, অনুপ্রবেশকারী কোনও সত্তা নন, আর ইহুদিও ঐশীজগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন স্বাধীন কোনও সত্তা নয়। ঈশ্বরকে আবারও মানবতার পূর্ণতা, পুরুষ বা নারীর সম্ভাবনার পরিপূরণ হিসাবে দেখা যেতে পারে; এছাড়াও, তার অভিজ্ঞতার ‘ঈশ্বর একান্তই তার নিজস্ব; এ ধারণাটি পরবর্তী অধ্যায়ে আমরা আরও বিশদভাবে পরীক্ষা করব। হালেভি স্বয়ং ঈশ্বরের সত্তা ও ইহুদিরা যে ঈশ্বরকে অনুভব করতে সক্ষম তার মাঝে পার্থক্য করার ব্যাপারে সতর্ক ছিলেন। পয়গম্বর ও সাধুগণ যখন ‘ঈশ্বর’ কে প্রত্যক্ষ করার দাবি করেছেন, তখন তিনি স্বয়ং যেমন ঠিক সেভাবে তাঁকে জানতে পারেননি তারা, কেবল তাঁর ঐশী ক্রিয়াকর্মের মাধ্যমেই তাঁকে চিনেছেন যাকে অনেকটা দুৰ্জেয় অগম্য সত্তার আলোকচ্ছটা বলা যেতে পারে।
আল-গাযযালির যুক্তির ভারে ফালসাফাহ অবশ্য পুরোপুরি বিলীন হয়ে যায়নি। কর্দোবার বিশিষ্ট মুসলিম দার্শনিক আবার এর পুনরুজ্জীবনের প্রয়াস পেয়েছিলেন। তিনি যুক্তি দেখিয়েছেন যে, এটা ছিল ধর্মের সর্বোচ্চ রূপ। ইউরোপে আভেরস নামে পরিচিত আবু আল-ওয়ালিদ ইবন আহমাদ ইবন রূশদ (১১২৬-১১৯৮) পশ্চিমে ইহুদি ও ক্রিশ্চান উভয় সম্প্রদায়ের কাছেই বিশেষজ্ঞে পরিণত হয়েছিলেন। ত্রায়োদশ শতাব্দীতে তাঁর রচনাবলী হিব্রু ও লাতিন ভাষায় অনূদিত হয় এবং অ্যারিস্টটলের ওপর তার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ মায়মোনিদস, আকুইনাস ও আলবার্ট দ্য গ্রেটের মতো ধর্মতাত্ত্বিকদের ওপর গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীতে আর্নেস্ট রেনান। মুক্তচিন্তাবিদ এবং অন্ধ বিশ্বাসের বিরুদ্ধে যুক্তিবাদের প্রতীক হিসাবে তাঁর ভূয়সী প্রশংসা করেন। ইসলামি জগতে অবশ্য আবু রূশদ অপেক্ষাকৃত প্রাতিক চরিত্র ছিলেন। তার জীবদ্দশায় ও মরণোত্তর প্রভাবের প্রেক্ষিতে আমরা ঈশ্বরের ধারণার ক্ষেত্রে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের বিভক্তি দেখতে পাই। ফালাসাফাহ্র বিরুদ্ধে আল-গাযযালির নিন্দা ও নিগূঢ় বিষয়ের প্রকাশ্য আলোচনার জোরাল বিরোধিতা করেছেন আবু রুশদ। পূর্বসুরি আল-ফারাবি ও ইবন সিনার বিপরীতে তিনি ছিলেন একজন কাজী, শরীয়াহ আইনের জুরিস্ট আর দার্শনিকও। উলেমারা আগাগোড়া ফালসাফাহ্ ও তাদের ভিন্নতর ঈশ্বরের ব্যাপারে সন্দিহান ছিলেন, কিন্তু ইবন রূশদ অধিকতর প্রথাগত ইসলামী ধর্মানুরাগের সঙ্গে অ্যারিস্টটলকে মেলাতে সক্ষম হন। তিনি ভেবেছিলেন, ধর্ম ও যুক্তিবাদের ভেতর কোনও বিরোধ নেই । দুটো ভিন্নভাবে একই সত্য প্রকাশ করে; একই ঈশ্বরের দিকে দৃষ্টি ফেরায়। সবাই অবশ্য দার্শনিক চিন্তার ক্ষমতা রাখে না, সুতরাং ফালসাফাহ ছিল কেবল বুদ্ধি বা মেধার দিক দিয়ে উচ্চতরদের জন্যে। এটা সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করবে, তাতে ভুলের শিকার হয়ে পরজীবনে উদ্ধার প্রাপ্তি অনিশ্চিত হয়ে উঠতে পারে। এখানেই এসব নিগূঢ় বিশ্বাসের গুরুত্ব যা এগুলোকে বিপজ্জনক মতবাদ গ্রহণে অক্ষমের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। এটা ছিল সুফীবাদ ও ইসমায়েলিদের বাতিনি গবেষণার মতোই। অযোগ্য কেউ এসব মানসিক অনুশীলনের প্রয়াস পেলে সে মারাত্মকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে মনোবৈকল্যের শিকার হতে পারে। কালামও একই রকম বিপজ্জনক ছিল। এটা প্রকৃত ফালসাফাহ্ না হওয়ায় মানুষকে এমন ভ্রান্ত ধারণা দিয়েছে যে, তারা বুঝি যৌক্তিক আলোচনায় নিয়োজিত, যদিও প্রকৃতপক্ষে তা ছিল না। পরিণতিতে এটা কেবল অর্থহীন তাত্ত্বিক বিরোধের জন্ম দিয়েছে, যা অশিক্ষিত মানুষের বিশ্বাসকে টলিয়ে দিয়ে তাদের উদ্বেগেই নিক্ষেপ করতে পারে।
ইবন রূশদ বিশ্বাস করতেন, বিশেষ কিছু সত্যকে মেনে নেওয়া নিষ্কৃতি লাভের জন্যে আবশ্যক-ইসলামি বিশ্বের এক চমৎকার ধারণা। ফায়সাসুফরা মতবাদের ক্ষেত্রে প্রধান কর্তৃত্বের অধিকারী: কেবল তারাই ছিল ঐশীগ্রন্থ ব্যাখ্যায় সক্ষম ও এবং কোরানে বর্ণিত গভীর রোধসম্পন্ন ব্যক্তি। বাকি সবার উচিত হবে কোরানকে প্রাপ্ত রূপে গ্রহণ করা এবং আক্ষরিক অর্থে পাঠ করা। কিন্তু ফায়লাসুফরা প্রতীকী ব্যাখ্যার প্রয়াস পেতে পারে। কিন্তু এমনকি ফায়সুফদেরও অবশ্য পালনীয় বিশ্বাস (Creed) মানতে হবে, ইবন রূশদ যার তালিকা দিয়েছেন এভাবে:
১. বিশ্বজগতের স্রষ্টা ও প্রতিপালক হিসাবে ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস ।
২. ঈশ্বরের একত্ব।
৩. সমগ্র কোরানে ঈশ্বরকে প্রদত্ত জ্ঞান, ক্ষমতা, ইচ্ছা, জ্ঞান, দেখা এবং বলার। যেসব গুনের কথা উল্লেখ আছে।
৪. ঈশ্বরের অনন্যতা এবং তুলনাহীনতায় বিশ্বাস, কোরান ৪২: ৯-এ স্পষ্ট উল্লেখ আছে: “তার মতো আর কিছুই নেই।
৫. ঈশ্বরই কর্তৃক বিশ্ব জগৎ সৃষ্টি।
৬. পয়গম্বরত্বের বৈধতা।
৭. ঈশ্বরের ন্যায় বিচার ।
৮. শেষ বিচারের দিনে পুনরুত্থান।[১৮]
কোরান যেহেতু এ বিষয়ে একেবারেই দ্ব্যর্থহীন, সুতরাং ঈশ্বর সম্পর্কিত ধারণাগুলো অক্ষরে অক্ষরে মেনে নিতে হবে। উদাহরণ স্বরূপ, ফালসাফাহ্ সব সময় বিশ্ব সৃষ্টির বিশ্বাস মেনে নেয়নি, সুতরাং এটা পরিষ্কার নয় যে কোরানের এ ধরনের মতবাদ কীভাবে বোঝা যেতে পারে। যদিও কোরান দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলছে যে, ঈশ্বর বিশ্বজগৎ সৃষ্টি করেছেন, কিন্তু তিনি কীভাবে তা করেছেন বা বিশেষ কোন মুহূর্তে বিশ্বজগৎ সৃষ্টি করা হয়েছে কিনা তা বলছে না। এতে করে ফায়লাসুফদের পক্ষে যুক্তিবাদীদের বিশ্বাস গ্রহণের অবকাশ সৃষ্টি হয়। আবার, কোরান বলছে যে, ঈশ্বরের জ্ঞানের মতো গুণাবলী রয়েছে, কিন্তু আমরা এর অর্থ সঠিকভাবে জানি না, কারণ জ্ঞান সম্পর্কিত আমাদের ধারণা অতি-অবশ্য মানবীয় এবং অপূর্ণ। সুতরাং কোরান যখন বলে যে আমরা যা জানি তার সবই জানেন ঈশ্বর, তখন আবশ্যিকভাবে তা দার্শনিকদের বিরোধিতা করে না।
ইসলামি বিশ্বে অতিন্দ্রীয়বাদের গুরুত্ব এত বেশি ছিল যে ইবন রূশদের সম্পূর্ণ যৌক্তিক ধর্মতত্ত্বের ওপর প্রতিষ্ঠিত ঈশ্বর সম্পর্কিত ধারণা খুব একটা প্রভাব ফেলতে পারেনি। ইসলামে ইবন রূশদ সম্মানিত হলেও গৌণ ব্যক্তিত্ব। ছিলেন, কিন্তু পাশ্চাত্যে যারপরনাই গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে পরিণত হয়েছিলেন তিনি, যে জগৎ তারই মাধ্যমে অ্যারিস্টটলকে আবিষ্কার করে এবং ঈশ্বর সম্পর্ক অধিকতর যৌক্তিক ধারণা গড়ে তোলে। অধিকাংশ পাশ্চাত্য পণ্ডিতদের ইসলামি সংস্কৃতি সম্পর্কে খুব সামান্যই ধারণা ছিল। তাঁরা ইবন রূশদ পরবর্তী সময়ের দার্শনিক অগ্রগতি সম্পর্কে অজ্ঞই ছিলেন; এ কারণেই প্রায়শঃ মনে করা হয় যে, ইবন রূশদের বিদায়ের সঙ্গে সঙ্গেই ইসলামি দর্শনেরও পরিসমাপ্তি ঘটেছে। প্রকৃতপক্ষে ইবন রূশদের জীবৎকালেই দুজন বিশিষ্ট ইসলামি দার্শনিক ইরাক ও ইরানে তাদের সৃষ্টিকর্মে নিয়োজিত ছিলেন যারা ইসলামি বিশ্বে ব্যাপক প্রভাব সৃষ্টি করবেন। ইয়াহিয়া সুহরাওয়ার্দি এবং মুঈদ আদ-দিন ইবন আল-আরাবী দুজনই ইবন রূশদের বদলে ইবন সিনার পথ অনুসরণ করেন এবং দর্শনকে অতিন্দ্রীয় আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে একীভূত করার প্রয়াস পান। পরবর্তী অধ্যায়ে আমরা তাদের অবদান পর্যালোচনা করব।
ইবন রূশদ-এর মহান অনুসারী ইহুদি সম্প্রদায়ের মহান তালমুদ বিশেষজ্ঞ ও দার্শনিক র্যাবাই মোজেস ইবন মায়মন (১১৩৫-১২০৪}–সাধারণভাবে ইনি মায়মমানিস নামে পরিচিত। ইবন রূশদের মতো মায়মমানিদসও মুসলিম স্পেনের রাজধানী কর্দোবার নাগরিক ছিলেন। এখানে ঈশ্বরের গভীর অনুভূতি লাভের জন্যে এক ধরনের দর্শনের প্রয়োজন বলে ক্রমবর্ধমান ঐকমত্য গড়ে উঠেছিল। কিন্তু আলমোরাভিয় ধর্মান্ধ বারবার গোষ্ঠী ইহুদিদের ওপর তীব্র নির্যাতন চালানোর সময় তিনি স্পেন থেকে পালাতে বাধ্য হন। মধ্যযুগীয় ধর্মান্ধতার সঙ্গে দুঃখজনক বিরোধ বা সংঘর্ষ মায়মোনিদসকে পুরোপুরি ইসলামের প্রতি বৈরী করে তোলেনি। অভিভাবকদের সঙ্গে মিশরে স্থায়ী হন তিনি, সেখানে তিনি সরকারী উচ্চ পদমর্যাদার আসনে আসীন হয়েছেন, এমনকি সুলতানের চিকিৎসকের দায়িত্বও পালন করেছেন। এখানে বিখ্যাত নিবন্ধ দ্য গাইড ফর দ্য পারপ্লেক্সড রচনা করেন তিনি, যেখানে তিনি যুক্তি দেখিয়েছেন যে ইহুদি ধর্মবিশ্বাস কোনও খেয়ালিপূর্ণ মতাবাদের মিশেল নয়, বরং সুনির্দিষ্ট যৌক্তিক নীতিমালার ওপর প্রতিষ্ঠিত। ইবন রূশদের মতো মায়মমানিদসের বিশ্বাস ছিল, ফালসাফাহ্ ধর্মীয় জ্ঞানের সবচেয়ে অগ্রসর রূপ ও ঈশ্বরকে লাভ করার রাজকীয় পথ, যা অবশ্যই সাধারণের জন্যে উন্মুক্ত করে দেওয়া ঠিক হবে না, বরং দার্শনিক অভিজাত শ্রেণীর জন্যে তুলে রাখতে হবে। অবশ্য ইবন রূশদের বিপরীতে তিনি বিশ্বাস করতেন যে, সাধারণ মানুষকেও প্রতীকী উপায়ে ঐশীগ্রন্থ ব্যাখ্যা করার শিক্ষা দেওয়া যতে পারে, যাতে তাঁরা ঈশ্বরকে মানবীয় রূপে কল্পনা করে না বসে। নিস্তার লাভের জন্য নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ে বিশ্বাস স্থাপনের প্রয়োজনীয়তায়ও বিশ্বাস ছিল তাঁর। তেরটি ধারার এক
ক্রীড প্রকাশ করেছিলেন তিনি যা আশ্চর্যজনকভাবে ইবন রূশদের সমরূপ:
১. ঈশ্বরের অস্তিত্ব। ২. ঈশ্বরের একত্ব। ৩. ঈশ্বরের নিরাকারত্ব। ৪. ঈশ্বরের অনন্ততা। ৫. প্রতিমা উপাসনায় নিষেধাজ্ঞা। ৬. পয়গম্বরত্বের বৈধতায় বিশ্বাস । ৭. মোজেস ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ পয়গম্বর। ৮. সত্যের ঐশী উৎস। ৯. তোরাহর চিরন্তন বৈধতা । ১০. ঈশ্বর মানুষের সব কাজের খবর রাখেন। ১১. তিনি সেগুলোর সঠিক বিচার করেন। ১২. তিনি একজন মেসায়াহ্ প্রেরণ করবেন । ১৩. মৃতের পুনরুত্থান।
ইহুদিবাদে এটা ছিল নতুন সংযোজন; কখনওই তা পুরোপুরিভাবে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠেনি। ইসলামের মতো অর্থডক্সির ধারণা (অর্থপ্র্যাক্সির বিপরীতে) ইহুদি ধর্মীয় অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রে ছিল অচেনা । ইবন রূশদ ও মায়মোনিদসের ক্রীড বোঝায় যে, ধর্ম উপলব্ধি করার যৌক্তিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি ডগম্যাটিজম এবং বিশ্বাস’-এর সঙ্গে ‘সঠিক আস্থা’-কে গুলিয়ে ফেলার প্রবণতার জন্ম দেয় ।
কিন্তু তারপরেও মায়মোনিদস ঈশ্বর যে অত্যাবশ্যকীয়ভাবে উপলব্ধির অতীত ও মানবীয় যুক্তির অগম্য, একথা সযত্নে ধারণ করে গেছেন। অ্যারিস্টটল ও ইবন সিনার যুক্তির সাহায্য নিয়ে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করেছেন, তিনি, কিন্তু জোর দিয়ে বলেছেন, ঈশ্বর তার পরম সারল্যের কারণে অনিবৰ্চনীয় ও বর্ণনার অতীত রয়ে যান। স্বয়ং পয়গম্বরগণ রূপকের ব্যবহার করেছেন এবং আমাদের শিক্ষা দিয়েছেন যে, কেবল প্রতীক নির্ভর, পরোক্ষ ভাষাতেই ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কে সবচেয়ে অর্থপূর্ণ বা বিশদ আলোচনা করা যেতে পারে। আমরা জানি যে, ঈশ্বরকে অস্তিত্বমান কোনও বস্তুর সঙ্গে তুলনা করা যায় না। সুতরাং আমরা যখন তাকে বর্ণনা করার প্রয়াস পাই তখন নেতিবাচক পরিভাষা ব্যবহার করাই শ্রেয়। তিনি আছেন না বলে আমাদের উচিত তার অন-অস্তিত্ব অস্বীকার করা, ইত্যাদি। ইসমায়েলিদের মতো নেতিবাচক ভাষার ব্যবহার একটা অনুশীলন যা ঈশ্বরের দুজেঁয়তা সম্পর্কে আমাদের উপলব্ধি বাড়িয়ে দেবে, আমাদের স্মরণ করিয়ে দেবে যে আমরা সামান্য মানুষ তাকে যতটা বুঝতে পারি তিনি তার চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা। আমরা এমনকি ঈশ্বরকে ‘ভালো’ও বলতে পারি না, কারণ ‘ভালোত্ব’ দিয়ে আমরা যা বোঝাতে পারি তিনি তাঁর চেয়ে উন্নত। এভাবে আমরা আমাদের ঘাটতিসমূহ হতে ঈশ্বরকে বাদ দিতে পারি, আমাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা তার ওপর স্থাপন হতে নিজেদের বিরত রাখতে পারি। সেটা আমাদের নিজস্ব ভাবমূর্তি ও অনুরূপ ঈশ্বর গড়ে তুলবে। আমরা অবশ্য ঈশ্বর সম্পর্কে কিছু ইতিবাচক ধারণা গড়ে তোলার জন্যে VIA NAGATIVA ব্যবহার করতে পারি। এভাবে আমরা যখন বলব যে ঈশ্বর ‘অক্ষম-নন’ (তিনি শক্তিমান না বলে), তখন যৌক্তিকভাবেই বোঝা যাবে ঈশ্বর অবশ্যই কোনও কাজে সক্ষম। যেহেতু ঈশ্বর ‘অসম্পূর্ণ নন,’ সুতরাং তার কর্মধারা নিখুঁত হতে বাধ্য। আমরা যখন বলি যে, ঈশ্বর ‘অজ্ঞ নন’ (তিনি প্রাজ্ঞ বোঝাতে), তখন ধরে নিতে পারব যে, তিনি পরিপূর্ণভাবে প্রাজ্ঞ ও সম্পূর্ণ জ্ঞাত। এসব সিদ্ধান্ত কেবল ঈশ্বরের কর্ম সম্পর্কেই গ্রহণ করা যাবে, আমাদের বুদ্ধির অতীত সত্তা সম্পর্কে নয় ।
বাইবেলের ঈশ্বর ও দার্শনিকদের ঈশ্বরের মাঝে পছন্দের প্রশ্নে মাইমোনিদস বরাবর প্রথমটিকে বেছে নিয়েছেন। যদিও শূন্য হতে সৃষ্টির তত্ত্ব দার্শনিকভাবে অর্থডক্স নয় এবং মায়মোনিদস প্রচলিত বাইবেলিয় মতবাদই আঁকড়ে থেকেছেন এবং উৎসারণের দার্শনিক ধারণা বাদ দিয়েছেন। তাঁর যুক্তি ছিল, শূন্য হতে সৃষ্টি কিংবা উৎসারণের মতবাদের কোনওটিই কেবল যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করা যাবে না। আবার, পয়গম্বরত্বকে তিনি দর্শনের ওপরে স্থান দিয়েছেন। পয়গম্বর ও দার্শনিকগণ একই ঈশ্বরের কথা বলেছেন, কিন্তু পয়গম্বর অবশ্যই বুদ্ধিমত্তা ও কল্পনাশক্তির দিক থেকে উন্নত ছিলেন। ঈশ্বর সম্পর্কে খেয়ালি যুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে অর্জিত জ্ঞানের চেয়ে উচ্চতর সরাসরি ও সহজাত জ্ঞান ছিল তার। মায়মমানিদস স্বয়ং যেন এক ধরনের অতিন্দ্রীয়বাদী ছিলেন। এ ধরনের সহজাত ঈশ্বরবোধের সঙ্গে গা-কাঁপানো উত্তেজনার কথা বলেছেন তিনি, এক ধরনের আবেগ যা কল্পনাশক্তির পরিপূর্ণতা লাভের পরিণতি।২০ যুক্তিবাদের ওপর গুরুত্ব দান সত্ত্বেও মায়মমানিদস বিশ্বাস করতেন, কেবল বুদ্ধি দিয়ে অর্জিত ঈশ্বরজ্ঞানের চেয়ে কল্পনার মাধ্যমে প্রাপ্ত ঈশ্বরের জ্ঞান শ্রেষ্ঠ।
দক্ষিণ ফ্রান্স ও স্পেনের ইহুদিদের মাঝে তাঁর ধারণাসমূহ ছড়িয়ে পড়েছিল যার ফলে চতুর্দশ শতাব্দীর সূচনা নাগাদ এ অঞ্চলে ইহুদিদের মাঝে দার্শনিক আলোকনের মতো সাড়া পড়ে যায়। এইসব ইহুদি ফায়লাসুফদের কেউ কেউ মায়মমানিদসের চেয়েও বেশি যুক্তিবাদী ছিল । এভাবে দক্ষিণ ফ্রান্সের বাগনলসবাসী লেভাই বেন গারশম (১২৮৮-১৩৪৪) ঈশ্বরের জাগতিক বিষয়ের জ্ঞান থাকার কথা অস্বীকার গেছেন। তাঁর ঈশ্বর ছিলেন দার্শনিকদের ঈশ্বর, বাইবেলের ঈশ্বর নন। অনিবার্যভাবে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছিল। আমরা যেমন দেখব, কোনও কোনও ইহুদি অতিন্দ্রীয়বাদের দিকে ঝুঁকে পড়ে কাব্বালাহ নামে এক নিগুঢ় অনুশীলন সূচিত করেছিল । অন্যরা বিপদের সময় সমবেদনা মেলে না দেখে ফায়লাসুফদের দূরবর্তী ঈশ্বরের দর্শন হতে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। ত্রয়োদশ ও চতুদর্শ শতাব্দীতে পুনর্দখলের খৃস্টিয় যুদ্ধগুলোর ফলে স্পেনে ইসলামের সীমান্ত সংকুচিত হতে শুরু করে এবং পশ্চিম-ইউরোপের অ্যান্টি-সেমিটিজম পেনিনসুলায় নিয়ে আসে। শেষ পর্যন্ত এর ফলে স্প্যানিশ ইহুদি সম্প্রদায়ের বিনাশ ঘটে ও ষোড়শ শতাব্দীতে ইহুদিরা ফালাসাফাহ্ ছেড়ে বৈজ্ঞানিক যুক্তির বদলে মিথলজি অনুপ্রাণিত ঈশ্বর সম্পর্কিত সম্পূর্ণ নতুন এক ধারণা গড়ে তোলে।
পশ্চিমের খৃস্ট-সাম্রাজ্যের ক্রুসেডিয় ধর্ম একে অন্যান্য একেশ্বরবাদী ধর্ম হতে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল। ১০৯৬-৯৯ সময়কালে সংঘটিত প্রথম ক্রুসেড ছিল নতুন পশ্চিমের প্রথম সম্মিলিত প্রয়াস, ইউরোপের অন্ধকার যুগ হিসাবে পরিচিত বর্বরতার দীর্ঘ পর্যায় থেকে বেরিয়ে আসার ইঙ্গিত ছিল এটা। উত্তর ইউরোপের ক্রিশ্চান জাতিগুলোর সমর্থনপুষ্ট নয়া রোম আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ফিরে আসার জন্যে লড়ছিল। কিন্তু অ্যাংলো স্যাক্সন ও ফ্রাঙ্কদের খৃস্ট ধর্ম ছিল অবিকশিত। আগ্রাসী ও যোদ্ধা জাতি ছিল বলে আগ্রাসী ধর্মের আকাক্ষা করেছিল তারা। একাদশ শতাব্দীতে অ্যাবি অভ কুনির বেনেডিক্টাইন মঙ্করা ও এর অধীনস্ত প্রতিষ্ঠানগুলো সামরিক চেতনা গির্জায় সীমিত রাখার এবং তীর্থযাত্রার মতো ভক্তিমূলক অনুশীলনের মাধ্যমে তাদের প্রকৃত ক্রিশ্চান মূল্যবোধের শিক্ষা দেওয়ার প্রয়াস পেয়েছিল। প্রথম ক্রুসেডার বাহিনী তাদের নিকট-প্রাচ্য অভিযানকে পবিত্র ভূমিতে তীর্থযাত্রা হিসাবেই দেখেছিল, কিন্তু তখনও তাদের ঈশ্বর ও ধর্ম বিষয়ে ধারণা ছিল খুবই আদিম পর্যায়ের। সেইন্ট জর্জ, সেইন্ট মারকারি ও সেইন্ট দেমিত্রিয়াসের মতো সৈনিক-সাধুরা তাদের ধর্মাচরণে ঈশ্বরের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন; বাস্তব ক্ষেত্রে পৌত্তলিক দেবতাদের সঙ্গে খুব একটা পার্থক্য ছিল না তাদের। জেসাসকে মানবরূপী লোগোসের চেয়ে বরং ক্রুসেডারদের সামন্ত প্রভু হিসাবেই দেখা হয়েছে: পৈত্রিক সম্পত্তি-পবিত্র ভূমি-শয়তানের কবল হতে উদ্ধার করার জন্যে নাইটদের তলব করেছেন তিনি। অভিযান শুরু করার পর ক্রুসেডারদের কেউ কেউ রাইন উপত্যকাবাসী ইহুদিদের নির্বিচারে হত্যা করে জেসাসের মৃত্যুর বদলা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। ক্রুসেডের আহ্বান জানানোর সময় পোপ দ্বিতীয় আরবানের মূল পরিকল্পনায় এ বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত থাকলেও ৩,০০০ মাইল পাড়ি দিয়ে মুসলিমদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে যাওয়ার ব্যাপারটা অনেক ইহুদির কাছেই বিসদৃশ ঠেকেছে, বিশেষ করে মুসলিমদের সম্পর্কে বলতে গেলে কিছুই জানা ছিল না তাদের; সেখানে যে জাতির লোকেরা কিংবা ওরা যেমন ভেবেছিল-ক্রাইস্টকে হত্যা করেছে তারা যেখানে বাড়ির কাছেই আছে। জেরুজালেমমুখী দীর্ঘ কষ্টকর যাত্রায় ক্রুসেডাররা যখন একবার অল্পের জন্যে একেবারে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিল, নিজেদের অলৌকিক উদ্ধার প্রাপ্তিকে তারা ঈশ্বরের মনোনীত জাতির প্রতি ঈশ্বর প্রদত্ত বিশেষ নিরাপত্তার ফল ধরে নিয়েছিল। প্রাচীন কালের ইসরায়েলিদের যেভাবে পবিত্র ভূমিতে নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি, ঠিক সেভাবে ওদেরও সেখানে নিয়ে যাচ্ছে। বাস্তব ক্ষেত্রে, তাদের ঈশ্বর কিন্তু তখনও বাইবেলের প্রথম দিকের পুস্তকে বর্ণিত আদিম গোত্রীয় উপাস্যই ছিলেন। শেষ পর্যন্ত ১৯৯৯ সালের গ্রীষ্মে জেরুজালেম অধিকার করার পর ওর জোশুয়ার উন্মাদনা নিয়ে নগরীর ইহুদি ও মুসলিম বাসিন্দাদের ওপর হামলে পড়ে এবং এমন নিষ্ঠুর নৃশংসতার সঙ্গে হত্যালীলা চালায় যা দেখে এমনকি তাদের সমসাময়িকেরাও স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল ।
এরপর থেকে ইউরোপিয় ক্রিশ্চানরা ইহুদি ও মুসলিমদের ঈশ্বরের প্রতিপক্ষ ধরে নেয়: বাইয়ান্তিয়ামের গ্রিক অর্থডক্স ক্রিশ্চানদের বিরুদ্ধেও দীর্ঘদিন গভীর বৈরী মনোভাব পোষণ করেছিল তারা; যারা ওদের বর্বর আর তুচ্ছ মনে করেছিল। ব্যাপারটা আগাগোড়া এরকম ছিল না। নবম শতাব্দীতে পশ্চিমের অধিকতর শিক্ষিত ক্রিশ্চানরা গ্রিক ধর্মতত্ত্বে অনুপ্রাণিত হয়ে উঠেছিল । এভাবে কেলটিক দার্শনিক দানস্ স্কতাস এরিজেনা (৮১০-৮৭৭) পশ্চিম ফ্রাংকদের রাজা চার্লস দ্য বোল্ডের দরবারে কাজ করার জন্যে স্বদেশ আয়ারল্যান্ড ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন, পশ্চিমের ক্রিশ্চানদের জন্যে লাতিন ভাষায় গ্রিক ফাদারস অভ দ্য চার্চের বিশেষ করে ডেনিস দ্য আরোপাগাইতের রচনাবলীসহ বহু রচনা অনুবাদ করেছিলেন। এরিজেনা আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করতেন যে, বিশ্বাস ও যুক্তি পরস্পর বিরোধী নয় । ইহুদি ও মুসলিম ফায়লাসুফদের মতো দর্শনকে তিনি ঈশ্বর লাভের রাজকীয় পথ হিসাবে দেখেছেন। যারা ক্রিস্টান ধর্মের যৌক্তিক ব্যাখ্যা দাবি করেছে, তাদের শুরু ছিলেন অ্যারিস্টটল ও প্লেটো। ঐশীগ্রন্থ ও ফাদারদের রচনাবলী যৌক্তিক অনুসন্ধানের অনুশীলনের মাধ্যমে আলোকিত করে তোলা যেতে পারে, কিন্তু তার মানে আক্ষরিক ব্যাখ্যা ছিল নাঃ ঐশীগ্রন্থের কিছু কিছু অনুচ্ছেদ প্রতীকী উপায়ে ব্যাখ্যা করতেই হবে, কারণ, এরিজেনা তাঁর এক্সপোজিশন অভ ডেনিস’স সেলেস্টিয়াল হায়ারারকি-তে ব্যাখ্যা করেছেন, ধর্মতত্ত্ব এক ধরনের কবিতা।[২২]
ঈশ্বর সংক্রান্ত আলোচনায় এরিজেনা ডেনিসের দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি ব্যবহার করেছেন, কেবল প্যারাডক্সের মাধ্যমেই ঈশ্বরকে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে, যা আমাদের মানবীয় উপলব্ধির সীমাবদ্ধতার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। ঈশ্বর সম্পর্কে ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয় মনোভাবই বৈধ। ঈশ্বর উপলব্ধির অতীত: এমনকি দেবদূতরাও তার আবশ্যকীয় প্রকৃতি জানে না বা বোঝে নাঃ কিন্তু ‘ঈশ্বর প্রাজ্ঞ,’ ধরনের ইতিবাচক মন্তব্য গ্রহণযোগ্য, কারণ আমরা শব্দটি ঈশ্বরের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করার সময় আমাদের জানা থাকে যে এর প্রচলিত অর্থে ব্যবহার করেছি। একটা নেতিবাচক মন্তব্য, যেমন ঈশ্বর প্রাজ্ঞ নন,’ করে আমরা এ বিষয়টি নিজেদের স্মরণ করিয়ে দিই। এই বৈপরীত্য ঈশ্বর আলোচনায় আমাদের ডেনিসের তৃতীয় পথের দিকে ঠেলে দেয়, আমরা উপসংহারে পৌঁছাই: ঈশ্বর প্রাজ্ঞেয় চেয়ে বেশি কিছু! একেই গ্রিকরা বলেছে অ্যাপোফ্যাটিক মন্তব্য, কারণ ‘প্রাজ্ঞের চেয়ে বেশি কিছু দিয়ে কী বোঝায় আমরা বুঝি না। এটা কেবল কথার খেলা নয়, বরং এক ধরনের অনুশীলন যা পরস্পর বিরোধী দুটো বিবৃতিকে পাশাপাশি স্থাপন করে আমাদের ঈশ্বর শব্দের উপস্থাপিত রহস্য অনুভব করার উপযোগি করে তোলে, কেননা তুচ্ছ মানবীয় বোধ দিয়ে একে কখনও সীমাবদ্ধ করা যাবে না ।
এরেজিনা এ পদ্ধতিটি ঈশ্বর আছেন’ বিবৃতির ক্ষেত্রে ব্যবহার করে স্বভাবতই সিদ্ধান্তে (Synthesis) পৌঁছেছেন: “ঈশ্বর অস্তিত্বের চেয়েও বেশি কিছু।’ ডেনিস যেমন উল্লেখ করেছেন, ঈশ্বর তাঁর সৃষ্ট বস্তুর মতো বিরাজ করেন না ও সেসবের পাশাপাশি অবস্থিত স্রেফ আরেকটা বস্তুও নন। এটা আবার দুর্বোধ্য বক্তব্য, কারণ, এরেজিনা মন্তব্য করছেন ‘সত্তার’র চেয়ে বেশি কিছুটা কী এখানে সেটা প্রকাশ পায় না; কারণ এখানে বলা হচ্ছে, ঈশ্বর আর সব বস্তুর মতো নন, বরং বস্তুসমূহের চেয়ে বেশি কিছু, কিন্তু এই ‘কিছুটা কী, এখানে তার কোনও সংজ্ঞা নেই।২৩ প্রকৃতপক্ষে ঈশ্বর কিছু না। এরিজেনা জানতেন কথাটা হতবুদ্ধিকর, তাই পাঠকদের আতঙ্কিত না হতে বলেছেন। ঈশ্বর কোনও বস্তু নন বোঝানোই ছিল তাঁর পদ্ধতির উদ্দেশ্য, আমরা যেভাবে বুঝি তিনি সেভাবে কোনও ‘সত্তা’ ধারণ করেন না। ঈশ্বর তিনি, যিনি সত্তার অতিরিক্ত’ (aliquo modo superesse)। তাঁর অস্তিত্বের ধরণ আমাদের অস্তিত্বের ধরণের চেয়ে আলাদা, যেমন আমাদের ধরণ পশুদের চেয়ে ভিন্ন আর পশুর ধরণ পাথরের চেয়ে আলাদা। কিন্তু ঈশ্বর কিছু না, হলে তিনি আবার ‘সবকিছুও। কারণ এই ‘অতি-অস্তিত্ব বোঝায় যে কেবল ঈশ্বরেরই প্রকৃত সত্তা আছে; তিনি এর সমস্ত কিছুর মূল সত্তা। সুতরাং, তাঁর সৃষ্ট প্রত্যেকটি প্রাণীই এক একটি থিওফ্যানি, ঈশ্বরের অস্তিত্বের নিদর্শন। এরিজেনার কেলটিক ধর্মানুরাগ-সেইন্ট প্যাট্রিকের বিখ্যাত প্রার্থনায় অঙ্গীভূত: ‘ঈশ্বর যেন আমার মস্তিষ্ক ও উপলব্ধিতে থাকেন’-তাকে ঈশ্বরের সর্বব্যাপীতার ওপর জোর দেওয়ার দিকে নিয়ে গেছে। নিওপ্লেটোনিক প্রকল্পে গোটা সৃষ্টির ধারক মানুষ। হচ্ছে এইসব থিওফ্যানির সবচেয়ে পূর্ণাঙ্গ নমুনা, এবং সেইন্ট অগাস্তিনের মতো এরিজেনাও শিক্ষা দিয়েছেন, কিছুটা অস্বচ্ছভাবে হলেও আমরা নিজেদের মাঝেই ট্রিনিটি আবিষ্কার করতে পারি।
এরিজেনার বৈপরীত্যমূলক ধর্মতত্ত্বে ঈশ্বর একাধারে সবকিছু এবং কিছু না; দুটো সংজ্ঞা পস্পরকে ভারসাম্য দেয় ও আমাদের ঈশ্বর’ শব্দটি প্রতীকায়িত করতে পারে এমন রহস্য বোঝাতে এক সৃজনশীল চাপ সৃষ্টি করে। এভাবে জনৈক ছাত্র যখন জানতে চেয়েছিল যে ঈশ্বরকে ‘কিছু না’ ডাকেন বলে ড্যানিস কী বুঝিয়েছেন, এরিজেনা জবাব দিয়েছিলেন যে, ঐশীসত্তা উপলব্ধির অতীত, কারণ এটা অতি আবশ্যক’-অর্থাৎ স্বয়ং ভাললাত্বের চেয়েও বেশি-এবং ‘অতিপ্রাকৃত।
সুতরাং যখন এটা নিজেকে নিয়ে ধ্যানে নিমগ্ন হয় (এটা] নেই, ছিল না, থাকবেও না, কারণ একে অস্তিত্বমান কোনও জিনিস ধরে নেওয়া যাবে না, কারণ এটা সবকিছুকে ছাড়িয়ে যায়; কিন্তু যখন নির্দিষ্ট অনিবার্চনীয়ভাবে কোনও বস্তুতে অবতীর্ণ হয়, তখন মানসচক্ষে ধরা পড়ে, কেবল এটাই সকল বস্তুতে দেখা যায় এবং এটা থাকে, ছিল ও থাকবে।[২৫]
সুতরাং আমরা যখন ঐশীসত্তাকেই বিবেচনা করি, একে অযৌক্তিকভাবে “কিছু “ বলা হয় না, কিন্তু যখন এই ঐশী শূন্যতা কিছু না হতে কিছুতে অগ্রসর হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, এর অনুপ্রাণিত প্রত্যেকটা জিনিসকে ‘থিওফ্যানি, অর্থাৎ স্বর্গীয় আবির্ভাব বলা যেতে পারে।২৬ ঈশ্বর স্বয়ং যেমন আমরা যেভাবে তাঁকে দেখতে পাব না, কেননা এই ঈশ্বর কার্যত অস্তিত্বহীন। আমরা কেবল সেই ঈশ্বরকে দেখি যিনি সৃষ্ট জগতকে সঞ্চালন করেন এবং ফুল, পাখি, গাছ-পালা ও অন্যান্য মানবরূপে নিজেকে প্রকাশ করে থাকেন। এই দৃষ্টিভঙ্গির সমস্যা আছে। অশুভ সম্পর্কে কী বলা যাবে? হিন্দুরা যেমন বলে থাকে, এটাও কি জগতে ঈশ্বরেরই ভিন্ন প্রকাশ? এরিজেনা যথেষ্ট বিশদভাবে অশুভের সমস্যা নিয়ে আলোচনার প্রয়াস পাননি, তবে পরবর্তীকালে ইহুদি কাব্বালিস্টরা ঈশ্বরের মাঝেই অশুভকে আবিষ্কার করার প্রয়াস পাবে: তারা ঈশ্বরের কিছু না হতে কিছু হবার প্রক্রিয়া বর্ণনা করার জন্যে এমন এক ধর্মতত্ত্বের অবতারণা করেছিল যা লক্ষণীয়ভাবে এরিজেনার বর্ণনার অনুরূপ, যদিও কাব্বালিস্টদের কেউ তাঁর রচনা পাঠ করেছিল-এমন সম্ভাবনা ক্ষীণ।
এরিজেনা দেখিয়েছেন, গ্রিকদের কাছ থেকে লাতিনদের শেখার অনেক কিছু ছিল, কিন্তু ১০৫৪ সালে এক বিরোধের ফলে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের চার্চের সম্পর্কচ্যুতি ঘটে, যা পরে স্থায়ী রূপ নেয়-যদিও তখন এমন উদ্দেশ্য ছিল না কারওই । বিরোধের একটা রাজনৈতিক দিক ছিল, যা আমি আলোচনা করব না, তবে ট্রিনিটি সক্রান্ত বিরোধও এর মুলে ক্রিয়াশীল ছিল। ৭৯৬ সালে দক্ষিণ ফ্রান্সের ফ্রেইসে পাশ্চাত্য বিশপদের এক সিনদ অনুষ্ঠিত হয়; এ সম্মেলনে নাইসিন ক্রিডে নতুন একটি ধারা যোগ করা হয়েছিল। এ ধারায় বলা হয়, পবিত্র আত্মা কেবল পিতা নয়, পুত্র (filioque) হতেও অগ্রসর হয়েছিলেন। লাতিন বিশপদের কেউ কেউ আরিয়ান দৃষ্টিভঙ্গির অনুসারী হওয়ায় পিতা ও পুত্রকে সমমর্যাদা দেওয়ার ব্যাপারে উদগ্রীব ছিলেন। তাঁরা ভেবেছিলেন আত্মা পিতা ও পুত্র উভয়ের নিকট হতে আবির্ভূত হয়ে থাকলে তাদের সমমর্যাদা নিশ্চিত হবে। অচিরেই পশ্চিমের সম্রাটে পরিণত হতে চলা শার্লামেইন ধর্মতত্ত্বীয় বিষয়াদি খুব একটা না বুঝলেও এই নতুন ধারা অনুমোদন করেন। গ্রিকরা অবশ্য এর নিন্দা জানিয়েছিল। কিন্তু তারপরেও লাতিনরা অনড় থাকে ও তাদের নিজস্ব ফাদাররা এই শিক্ষাই দিয়েছেন বলে দাবি করে। এভাবে সেইন্ট অগাস্তিন পবিত্র আত্মাকে ট্রিনিটির মূল শর্ত হিসাবে দেখেছেন, তবে তাঁকে পিতা ও পুত্রের মাঝে ভালোবাসা হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন। সুতরাং এটা বলা যায়, আত্মা উভয়ের কাছ থেকেই এসেছে। নতুন ধারাটি তিনটি ব্যক্তিত্বের অত্যাবশ্যক অখণ্ডতার উপর জোর দিয়েছে।
কিন্তু গ্রিকরা বরাবর অগাস্তিনের ত্রিত্ববাদী ধর্মতত্ত্বকে অবিশ্বাস করে আসছিল, কারণ এটা বড় বেশি মানবরূপী। পাশ্চাত্যে যেখানে ঈশ্বরের একত্বের ধারণা দিয়ে শুরু করে পরে সেই একত্বের সঙ্গে তিনটি ব্যক্তিত্ব বিবেচনা করে করেছিল, গ্রিকরা সেখানে সবসময় তিন hypostases দিয়ে শুরু করার পর ঈশ্বরের একত্বের ঘোষণা দিয়ে বলেছে, তার সত্তা আমাদের নাগালের বাইরে। লাতিনরা ট্রিনিটিকে বড় বেশি বোধগম্য করে ফেলেছে বলে ভেবেছিল তারা আর এও সন্দেহ করেছিল যে এইসব ত্রিত্ববাদী ধ্যান-ধারণাকে পর্যাপ্ত দক্ষতার সঙ্গে প্রকাশ করার যোগ্যতা লাতিন ভাষার নেই। গ্রিকরা যুক্তি দেখিয়েছে, Filioque ধারা ঈশ্বরের অত্যাবশ্যক দুর্বোধ্যতার দিকে নজর না দিয়ে তিন ব্যক্তির ওপর বেশি জোর দিয়েছে। নতুন সংযোজন ট্রিনিটিকে বড় বেশি যৌক্তিক রূপ দিয়ে ফেলেছে। ঈশ্বরকে এটা তিন বৈশিষ্ট্য বিশিষ্ট বা অবস্থানের একটি সত্তায় পরিণত করেছে। প্রকৃতপক্ষে লাতিন ধারণায় ধর্মবিরোধী কিছু ছিল না, যদিও তা গ্রিকদের অ্যাপোফ্যাটিক আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে খাপ খায়নি। শান্তি স্থাপনের ইচ্ছা থাকলে এই বিরোধের অবসান ঘটানো যেতো, কিন্তু বিশেষ করে ১২০৪ সালে চতুর্থ ক্রুসেডাররা বাইন্তাইন রাজধানী কন্সতান্তিনোপলের অবসান ঘটিয়ে গ্রিক সাম্রাজ্যকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করলে ক্রুসেডসমূহের সময় প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মাঝে উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়। Filioque ভাঙন আসলে গ্রিক ও লাতিনদের ঈশ্বর সম্পর্কে সম্পূর্ণ আলাদা ধারণা গড়ে তোলার ব্যাপারটি উন্মোচিত করেছিল । ট্রিনিটি যেভাবে গ্রিকদের কাছে আধ্যাত্মিকতার মৌল বিষয়ে রয়ে গিয়েছিল, পশ্চিমের ক্রিশ্চানদের কাছে তা কখনওই ছিল না। গ্রিকরা মনে করেছিল, এভাবে ঈশ্বরের একত্বের ওপর জোর দিতে গিয়ে পশ্চিমারা স্বয়ং ঈশ্বরকে এমন এক ‘তুচ্ছ সত্তার সঙ্গে মিলিয়ে ফেলেছে যা দার্শনিকদের ঈশ্বরের মতো সংজ্ঞায়িত ও আলোচনার বিষয় হতে পারে।২৭ পরবর্তী অধ্যায়গুলোয় আমরা দেখব, পাশ্চাত্যের ক্রিশ্চানরা ট্রিনিটি মতবাদ নিয়ে বরাবর অস্বস্তি বোধ করেছে। অষ্টাদশ শতাব্দীর আলোকনের সময় অনেকেই এ মতবাদ সম্পূর্ণ ত্যাগ করবে। কার্যতঃ বহু পাশ্চাত্য ক্রিশ্চান মোটেই ত্রিত্ববাদী নয়। তারা বলে থাকে একজন ঈশ্বরের মাঝে তিন ব্যক্তির মতবাদ বোধের অতীত, এটা বোঝেনি যে, গ্রিকদের কাছে এটাই ছিল মোদ্দা কথা।
বিরোধের পর গ্রিক ও লাতিনরা ভিন্ন পথে যাত্রা শুরু করে । গ্রিক অর্থডস্কিতে ঈশ্বর সম্পর্কিত গবেষণা থিওলোজিয়া ঠিক এরকমই রয়ে যায়। ট্রিনিটি ও অবতারবাদের অত্যাবশ্যকীয় অতিন্দ্রীয় মতবাদের মাঝে ঈশ্বর সম্পর্কিত সকল ভাবনা সীমিত হয়ে পড়ে। তারা ‘থিওলজি অভ গ্রেস’ বা থিওলজি অভ দ্য ফ্যামিলি’র পরস্পর বিরোধী ধারণা আবিষ্কার করে: আসলে। তারা গৌণ বিষয়ে তাত্ত্বিক আলোচনায় ও সংজ্ঞায়িতকরণে খুব একটা আগ্রহী ছিল না। পশ্চিম অবশ্য এই সমস্ত প্রশ্ন বোঝার জন্যে ক্রমশঃ উৎসাহী হয়ে উঠেছিল; সবার জন্যে প্রযোজ্য একটা সঠিত সত্য খুঁজে বের করার প্রয়াস পাচ্ছিল। যেমন, সংস্কার খৃস্টিয় জগতকে আরও বিবদমান শিবিরে বিভক্ত করে দিয়েছিল, কারণ ক্যাথলিক ও প্রটেস্ট্যান্টরা কীভাবে নিষ্কৃতি সম্ভব হয়েছিল এবং ইউক্যারিস্ট আসলে কী ছিল এ বিষয়ে একমত হতে পারেনি। পাশ্চাত্য ক্রিশ্চনরা বারবার এসব প্রশ্নে মতামত দেবার জন্যে চ্যালেঞ্জ করলেও গ্রিকরা এগিয়ে আসেনি আর জবাব দিলেও তাদের উত্তর জোড়াতালি দেওয়া। মনে হয়েছে। আবশ্যিকভাবে যুক্তি এবং ধারণার অতীত একজন ঈশ্বর সম্পর্কে আলোচনার উপায় হিসাবে জুৎসই নয় বোঝার পর যুক্তিবাদের ব্যাপারে বিতৃষ্ণ হয়ে উঠেছিল তারা। সেকুলার গবেষণায় মেটাফিজিক্স গ্রহণযোগ্য ছিল, কিন্তু এটা ধর্মবিশ্বাসকে বিপদাপন্ন করতে পারে বলে ক্রমবর্ধমান হারে ধারণা করেছিল গ্রিকরা। এটা বাকসর্বস্ব মনের ব্যস্ত অংশের কাছে আবেদন সৃষ্টি করে, অথচ থিওরিয়া কোনও বুদ্ধিবৃত্তিক মতামত নয়, বরং ঈশ্বর সকাশে এক নীরব অনুশীলন, যাকে কেবল ধর্মীয় ও অতিন্দ্রীয় অনুভূতি দিয়েই জানা যেতে পারে। ১০৮২ সালে দর্শনের মাত্রাতিরিক্ত প্রয়োগ ও সৃষ্টির নিওপ্লেটোনিক ধারণা প্রকাশের অপরাধে দার্শনিক ও মানবতাবদী জন ইতালোসকে ধর্মদ্রোহী হিসাবে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয় । দর্শন হতে এই স্বতঃপ্রণোদিত। প্রত্যাহারের ঘটনাটা ঘটেছিল বাগদাদে আল-গাযযালির অসুস্থ হয়ে কালাম ছেড়ে সুফী হবার অল্প কিছুদিন আগে।
সুতরাং, এটা নিয়তির পরিহাস ও দুঃখজনক যে পশ্চিমের ক্রিশ্চানরা এমন একটা সময় ফালসাফাহর দিকে অগ্রসর হতে শুরু করেছিল যখন গ্রিক ও মুসলিমরা এর ওপর আস্থা হারাচ্ছিল। অন্ধকার যুগে লাতিন ভাষায় প্লেটো ও অ্যারিস্টটলের রচনাবলী সুলভ ছিল না, সুতরাং অনিবার্যভাবে পশ্চিম পেছনে। পড়ে গিয়েছিল। দর্শনের আবিষ্কার ছিল অনুপ্রেরণাদায়ী উত্তেজনাকর । একাদশ শতাব্দীর ধর্মতাত্মিক অ্যানসেল্ম অভ ক্যান্টারবারি, আতারবাদ সম্পর্কে যার দৃষ্টিভঙ্গি আমরা চতুর্থ অধ্যায়ে আলোচনা করেছি, যেন মনে করতেন যে কোনও কিচুই প্রমাণ করা সম্ভব । তার ঈশ্বর কিছু না হলেও সকল সত্তার সর্বোত্তম ছিলেন। এমনকি আবিশ্বাসীও এক সর্বোচ্চ সত্তার ধারণা গঠন করতে পারে, যা একক প্রকৃতি, সকল বস্তুর চেয়ে উত্তম, অনন্ত স্বর্গবাসে নিজেই সম্পূর্ণ। কিন্তু তিনি এও জোর দিয়ে বলেছেন যে, একমাত্র বিশ্বাস দিয়েই ঈশ্বরকে জানা যেতে পার। যেমন মনে হয় আসলে এটা তেমন স্ববিরোধী কথা নয়। অ্যানসেল্ম তাঁর বিখ্যাত প্রার্থনায় ইসায়াহ্র যদি বিশ্বাস না থাকে, তাহলে বুঝবে না’ এ কথাগুলোর প্রতিধ্বনি করেছেন :
আমি আমার হৃদয়ের বিশ্বাস ও ভালোবাসায় তোমার সত্যের খানিকটা পরিচয় উপলব্ধি করতে চাইছি। কারণ বিশ্বাস করার জন্যে বুঝতে চাই না আমি, বরং আমার বিশ্বাস আছে বোঝার (Credo ut intellegant)। কারণ আমি এও বিশ্বাস করি। আমার বিশ্বাস না থাকলে বুঝব না।[২৯]
প্রায়শঃ উচ্চারিত credo ut intellegan বুদ্ধিবৃত্তি বিসর্জন নয়। ভবিষ্যতে কোনও এক সময় অর্থ বোঝা যাবে, এ আশায় অন্ধের মতো বিশ্বাসকে আঁকড়ে ধরার দাবি করেননি আনসেল্ম । প্রকৃতপক্ষে তার ঘোষণা এভাবে অনূদিত হওয়া উচিত: হয়তো বুঝতে পারব ভেবে আমি অঙ্গীকারবদ্ধ হচ্ছি। এই পর্যায়ে credo শব্দটির তখনও বর্তমানের ‘বিশ্বাস’ (belief) শব্দটির বুদ্ধিবৃত্তিক ঝোঁক ছিল না, তবে এক ধরনের আস্থা ও আনুগত্যের মনোভাব প্রকাশ করত। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, পাশ্চাত্য যুক্তিবাদের প্রাথমিক জোয়ারের সময়ও ঈশ্বরের ধর্মীয় অনুভূতিই মুখ্য রয়ে গিয়েছিল।
তা সত্ত্বেও, মুসলিম ও ইহুদি ফায়লাসুফদের মতো আনসেল্ম বিশ্বাস করতেন ঈশ্বরের অস্তিত্ব যৌক্তিকভাবে প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে; তিনি নিজস্ব প্রমাণও হাজির করেছিলেন যাকে সাধারণত ‘অন্টোলজিক্যাল’ যুক্তি বলা হয়। আনসেল্ম ঈশ্বরকে সংজ্ঞায়িত করেছিলেন এভাবে, এমন কিছু যার চেয়ে মহান fang asal sa stal (aliquid quo nihil maius cogitari possit)। এখানে ঈশ্বরকে চিন্তার বিষয়বস্তু হিসাবে দেখার অবকাশ থাকায় এটাই বোঝায় যে, মানুষের মনের পক্ষে তাকে ধারণ ও অনুধাবন সম্ভব! আনসেল্ম যুক্তি দেখিয়েছেন, এই ‘এমন কিছুর অস্তিত্ব থাকতে বাধ্য। যেহেতু অস্তিত্ব অস্তিত্বহীনতার চেয়ে অনেক বেশি নিখুঁত বা সম্পূর্ণ, সেহেতু আমাদের কল্পনার সম্পূর্ণ সত্তার অস্তিত্ব থাকতেই হবে নইলে তা অসম্পূর্ণ হয়ে যাবে । আনসেক্সের প্রমাণ প্লেটোনিক ধ্যান-ধারণার অনুসারীদের মাঝে অসাধারণ এবং কার্যকর, যেখানে চিরকালীন আদি আদর্শের দিকে অঙুলি নির্দেশ করাই ধারণার উদ্দেশ্য বলে বিশ্বাস করা হতো। এর পক্ষে আজকের সংশয়বাদীকে সন্তুষ্ট করার সম্ভাবনা নেই বলা যায়। ব্রিটিশ ধর্মতত্ত্ববিদ জন ম্যাককারি যেমন বলেছেন, আপনার কাছে ১০০ ডলার আছে ভাবতে পারেন, কিন্তু দুঃখজনক হলো তাতে টাকাটা বাস্তবে আপনার পকেটে আসবে না।
সুতরাং আনলোসের ঈশ্বর ছিলেন ‘সত্তা, ডেনিস ও এরিজেনা বর্ণিত ‘কিছু না’ নন। অতীতের যে কোনও ফায়লাসুফের তুলানায় আনসেল্ম অনেক বেশি ইতিবাচক ভাষায় ঈশ্বর সংক্রান্ত আলোচনায় আগ্রহী ছিলেন। তিনি Via Negativa অনুশীলনের প্রস্তাব করেননি, বরং সম্ভবত স্বাভাবিক যুক্তি দিয়েই ঈশ্বর সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণা লাভ করা সম্ভব বলে ভেবেছিলেন । পশ্চিমের ধর্মতত্ত্বের ঠিক এ জিনিসটাই গ্রিকদের সবসময় দ্বিধায় ফেলে দিয়েছে। আপন সন্তষ্টি মোতাবেক ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করার পর আনল্মেস অবতারবাদ ও ট্রিনিটির মতবাদসমূহ প্রমাণে মনোযোগি হন। গ্রিকরা সবসময় যেগুলোকে জোর দিয়ে যুক্তি ও ধারণাগুলোর অতীত দাবি করেছে। হোয়াই গড বিকেম ম্যান শীর্ষক নিবন্ধে, চতুর্থ অধ্যায়ে আমরা যার আলোচনা করেছি, তিনি প্রত্যাদেশের চেয়ে যুক্তি ও যৌক্তিক চিন্তার ওপর বেশি নির্ভর করেছেন–আমরা দেখেছি, তার দেওয়া বাইবেল ও ফাদারদের উদ্ধৃতিগুলোকে যুক্তির ধারার প্রেক্ষিতে পুরো প্রাসঙ্গিক মনে হয়, যা ঈশ্বরে মানবীয় অনুপ্রেরণা যোগ করেছে। যৌক্তিক ভিত্তিতে ঈশ্বরের রহস্য ব্যাখ্যার প্রয়াস একা আনসেল্মই নেননি। তাঁর সমসাময়িক প্যারিসের ক্যারিশম্যাটিক দার্শনিক পিটার আবেলার্দ (১০৭৯-১১৪৭) ট্রিনিটির একটি ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছিলেন যেখানে তিন ব্যক্তির পার্থক্য সৃষ্টি করে স্বর্গীয় একত্বের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। প্রায়শ্চিত্তের রহস্যেরও একটা বিশেষ এবং আবেগময় যুক্তি দাঁড় করিয়েছিলেন তিনি আমাদের মাঝে সমবেদনা জাগিয়ে তোলার জন্যে ক্রাইস্ট ক্রুশবিদ্ধ হয়েছে; এভাবেই তিনি পরিণত হয়েছেন ত্রাণকর্তায়।
আবেলার্দ অবশ্য প্রধানত দার্শনিক ছিলেন। তাঁর ধর্মতত্ত্ব মোটামুটিভাবে গতানুগতিক। দ্বাদশ শতাব্দীতে ইউরোপের বুদ্ধিবৃত্তিক পুনর্জাগরণের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছিলেন তিনি, প্রচুর অনুসারী পেয়েছিলেন। এতে করে বারগান্ডির ক্যারিশমাটি অ্যাবট বার্নার্ড সিস্টেরসিয়ান অ্যাবি অভ ক্লেয়ারভার সঙ্গে তার বিরোধ সৃষ্টি হয়। তিনি তখন ইউরোপের সবচেয়ে শক্তিশালী ব্যক্তি হিসাবে কথিত ছিলেন। পোপ দ্বিতীয় ইউজিন এবং ফ্রান্সের রাজা সপ্তম লুইস দুজনই ছিলেন বার্নার্ডের পকেটে; তার অসাধারণ বাগ্মীতা ইউরোপে সন্ত বিপ্লবের সূচনা করেছিল: অগুনতি ক্রিশ্চান যুবা সিস্টারসিয়ান মতবাদে দীক্ষা নিতে ঘরবাড়ি ছেড়ে তাঁর দলে যোগ দিয়েছে। সিস্টারসিয়ান মতবাদ পুরোনো বেনেডিক্টাইন ধর্মীয় জীবন আচারের ক্লনিয়াক ধরনের সংস্কার চেয়েছিলেন। ১৯৪৬ সালে বার্নার্ড দ্বিতীয় ক্রুসেডের প্রচারণা শুরু করলে ফ্রান্স ও জার্মানীর জনগণ-এর আগে পর্যন্ত যারা অভিযান সম্পর্কে কিছুটা বৈরিভাবাপন্ন ছিল-বলতে গেলে প্রবল উৎসাহে তাঁকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলার যোগাড় করেছিল, এমন বিপুল সংখ্যায় সেনা দলে যোগ দিতে ভিড় করেছিল যে শেষ পর্যন্ত বার্নার্ড আন্তসন্তুষ্টির সঙ্গে পোপকে চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন, গোটা দেশ জনশূন্য বলে মনে হচ্ছে। বুদ্ধিমান ছিলেন বার্নার্ড, বলা যায় পশ্চিম ইউরোপের বাহ্যিক ধর্মপরায়ণতাকে এক নতুন অভ্যন্তরীণ মাত্রা দান করেছিলেন তিনি। সিস্টেরসিয়ান ধর্মানুরাগ হলি গ্রেইলের কিংবদন্তীকে প্রভাবিত করেছিল বলে মনে হয়-এখানে এক কাল্পনিক শহরে যাত্রার বিবরণ রয়েছে যা এই পৃথিবীর কোনও স্থান নয় বরং ঈশ্বরের দর্শনকেই তুলে ধরে। বার্নার্ড অবশ্য আন্তরিকভাবে আবেলার্দের মতো পণ্ডিতদের বুদ্ধিমত্তাকে অবিশ্বাস করতেন; তিনি তাঁর মুখ বন্ধ করার শপথ নিয়েছিলেন। আবেলার্দের বিরুদ্ধে, মানবীয় যুক্তি দিয়ে ঈশ্বরকে উপলব্ধি করা যাবে বলে তিনি ক্রিস্টান ধর্ম বিশ্বাসের মূল্যকে শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার প্রয়াস পাওয়ার অভিযোগ তুলেছিলেন তিনি। সেইন্ট পলের চ্যারিটির হাইমের উল্লেখ করে বার্নার্ড দাবি করেছেন যে, দার্শনিকের ক্রিশ্চান ভালোবাসার ঘাটতি রয়েছে: ‘কোনও কিছুকেই তার হেয়ালি মনে হয় না, আর্শীর মতো কিছুই না, বরং সবকিছু সামনাসামনি প্রত্যক্ষ করেন। সুতরাং ভালোবাসা ও যুক্তিচর্চা পরস্পর বেমানান। ১১৪১ সালে বার্নার্ড কাউন্সিল অভ সেন্স-এর সামনে হাজির হওয়ার জন্যে আবেলাকে তলব করেন। কাউন্সিলের সবাই বার্নার্ডের সমর্থক ছিলেন । এদের কেউ কেউ আবেলার্দের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে বাইরে অবস্থান করেছেন। কাজটা খুব কঠিন হয়নি, কারণ ততদিনে আবেলার্দের সম্ভবত পারকিনসনস ডিসিজ দেখা দিয়েছিল। বার্নার্ড তাঁকে এমন জোরাল ভাষায় আক্রমণ করেছিলেন যে স্রেফ ভেঙে পড়ে পরের বছরই মারা যান তিনি ।
এক প্রতীকী মূহুর্ত ছিল এটা, যা মন এবং হৃদয়ের ‘বিচ্ছেদ’ সূচিত করেছিল। অগাস্তিনের ত্রিত্ববাদে মন ও হৃদয় ছিল অবিচ্ছেদ্য। ইবন সিনা ও আল গাযযালির মতো মুসলিম ফায়লাসুফগণ হয়তো মনে করেছিলেন যে কেবল বুদ্ধি দিয়ে ঈশ্বরকে পাওয়া যাবে না, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁরা দুজনই। এমন এক দর্শনের প্রতিষ্ঠার কথা ভেবেছেন যা ভালোবাসার আদর্শ ও অতিন্দ্রীয়বাদের অনুশীলনের মিশেল। আমরা দেখব, দ্বাদশ ও এয়োদশ শতাব্দীতে ইসলামি বিশ্বের প্রধান চিন্তাবিদগণ মন ও হৃদয়কে সমন্বিত করার প্রয়াস পেয়েছেন এবং দর্শনকে সুফীদের প্রচারিত ভালোবাসা ও কল্পনার আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত হিসাবে দেখেছেন। অবশ্য বার্নার্ডকে যেন বুদ্ধিমত্তার প্রতি ভীত মনে হয়েছে; তিনি একে মনের অধিকতর আবেগময় অনুভূতিপ্রবণ এলাকা হতে আলাদা রাখতে চেয়েছেন। বিপজ্জনক ছিল ব্যাপারটা: এতে আবেগ অনুভূতির সঙ্গে অস্বাস্থ্যকর বিচ্ছেদ জন্ম নিতে পারে যা যুক্তিবাদের মতোই বিরস একটা ব্যাপার । বার্নার্ড প্রচারিত ক্রুসেড ছিল একটা বিপর্যয়। এর আংশিক কারণ এটা এমন এক আদর্শের উপর নির্ভরশীল ছিল যা কিনা সাধারণ বুদ্ধির সঙ্গে বেমানান এবং এখানে ক্রিশ্চানদের সহমর্মিতার নীতি মারাত্মকভাবে লঙ্ঘিত হয়েছে। এভাবে, আবেলাদের প্রতি বার্নার্ডের আচরণে দৃষ্টিগ্রাহ্যভাবে মায়ামমতার ঘাটতি ছিল । ক্রিশ্চানদের প্রতি পাপীদের হত্যা করার মাধ্যমে খৃস্টের প্রতি ভালোবাসা দেখানোর আহ্বান জানিয়েছেন তিনি, তাদের পবিত্র ভূমি হতে উচ্ছেদ করতে বলেছেন। বার্নার্ড ঠিক করেছিলেন, ঈশ্বরের রহস্য ব্যাখ্যায় উদ্যোগি কোনও যুক্তিবাদ ভয়ংকর, এতে ধর্মের আতঙ্ক ও বিস্ময়ের বোধ হালকা হওয়ার ঝুঁকি ছিল; কিন্তু সমালোচকের দৃষ্টিতে কুসংস্কার যাচাই করার ক্ষেত্রে লাগামহীন বিষয়ানুগতার ব্যর্থতা ধর্মকে অতি নীচে নামিয়ে ফেলতে পারে। আসলে যা প্রয়োজন ছিল, তা হচ্ছে সজাগ ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিষয়মুখীতা, ভালোবাসার আবেগময়তা নয়; যা বুদ্ধিকে প্রবলভাবে দমিত করে ও সমবেদনাকে পরিত্যাগ করে, যার কিনা ঈশ্বরের ধর্মের প্রধান বৈশিষ্ট্য হওয়ার কথা।
পশ্চিমের খৃস্টবাদে খুব কম ব্যক্তিই তোমাস আকুইনাসের (১২২৫ ৭৪) মতো এত দীর্ঘস্থায়ী অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি সেইন্ট অগাস্তিনের মতবাদের সঙ্গে পশ্চিমে সম্প্রতি আগত গ্রিক দর্শনের সংশ্লেষ ঘটানোর প্রয়াস পেয়েছিলেন। দ্বাদশ শতাব্দীতে ইউরোপিয় পণ্ডিতগণ স্পেনে ভিড় জমিয়েছিলেন, এখানে মুসলিম পণ্ডিতদের সংস্পর্শে আসেন। তাঁরা। মুসলিম ও ইহুদি বুদ্ধিজীবীদের সহায়তায় এই মেধা-সম্পদকে পশ্চিমে পরিচিত করে তোলার উদ্দেশ্যে এক ব্যাপক অনুবাদ প্রকল্পে হাত দেন তারা। প্লেটো, অ্যারিস্টটল এবং প্রাচীন বিশ্বের অন্যান্য দার্শনিকদের আরবী ভাষায় প্রাপ্য অনুবাদ এবার লাতিনে অনূদিত হয়ে প্রথমবারের মতো উত্তর ইউরোপের জনগণের নাগালের মধ্যে চলে আসে। অনুবাদকগণ ইবন রূশদ ও সাম্প্রতিক মুসলিম পণ্ডিতদের রচনাবলীসহ অপরাপর আরব বিজ্ঞানী ও চিকিৎসকদের আবিষ্কার তাঁদের প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। একই সময়ে কিছু ইউরোপিয় ক্রিশ্চান নিকট প্রাচ্যে যখন ইসলামকে ধ্বংস করার জন্যে উঠে পড়ে লেগেছিল, তখন স্পেনের মুসলিমরা পশ্চিমকে আপন সভ্যতা গড়ে তুলতে সাহায্য করছিল। তোমাস আকুইনাসের সাম্মা থিওলজিয়া ছিল নতুন দর্শনকে পশ্চিমের ক্রিস্টান ধর্মের সঙ্গে সমন্বিত করার প্রয়াস। আকুইনাস বিশেষভাবে ইবন রূশদের অ্যারিস্টটলের প্রয়োগে অভিভূত হয়েছিলেন। তথাপি আনসেন্স ও আবেলার্দের বিপরীতে তিনি ট্রিনিটি রহস্যগুলো যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করা সম্ভব বলে বিশ্বাস করেননি। তিনি সযত্নে ঈশ্বরের অনির্বচনীয়তা ও তার সম্পর্কিত মানবীয় মতবাদসমূহের মাঝে পার্থক্য টেনেছেন। ঈশ্বরের প্রকৃত রূপ যে মানব মনের অগম্য, ডেনিসের এ ধারণার সঙ্গে তিনি একমত প্রকাশ করেছেন: ‘সুতরাং শেষ পর্যন্ত ঈশ্বর সম্পর্কে মানুষ যা জানে সেটা হলো সে তাঁকে চেনে না এটা জানা, কেননা সে জানে ঈশ্বর আমরা তাঁর সম্পর্কে যতটা বুঝতে পারি তাকে ছাপিয়ে যান।৩৫ একটা গল্প প্রচলিত আছে যে, সাম্মার শেষ বাক্যের তিনি শ্রুতিলেখার সময় আকুইনাস বিষণ্ণতার সঙ্গে হাতের ওপর মাথা এলিয়ে দিয়েছিলেন। শ্রুতিলেখক যখন ব্যাপার কী জানতে চাইল, তিনি জবাব দিয়েছিলেন, তিনি যা কিছু দেখেছেন তার তুলনায় শ্রুতিলেখকের লিখিত অংশটি খড়কুটো মাত্র।
নতুন দর্শনের প্রেক্ষাপটে নিজের ধর্মীয় অনুভূতিকে স্থাপন করার আকুইনাসের প্রয়াস অন্যান্য বাস্তবতার সঙ্গে ধর্মবিশ্বাসকে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্যে প্রয়োজন ছিল, একে নিজস্ব বলয়ে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় পর্যবসিত করা নয়। বুদ্ধিবৃত্তির অতিপ্রয়োগ ধর্মবিশ্বাসের পক্ষে ক্ষতিকর, কিন্তু ঈশ্বরকে যদি আমাদের নিজস্ব অহমবোধের ইচ্ছা পূরণের প্রকাশ হতে না হয়, তাহলে ধর্মীয় অনুভূতিকে অবশ্যই এর বিষয়বস্তুর সঠিক মূল্য নির্ধারণ দ্বারা অনুপ্রাণিত হতে হবে। আকুইনাস মোজেসকে দেওয়া স্বয়ং ঈশ্বরের সংজ্ঞার শরণাপন্ন হয়ে ঈশ্বরকে সংজ্ঞায়িত করেছেন: ‘আমি যা আমি তাই। অ্যারিস্টটল বলেছিলেন ঈশ্বর প্রয়োজনীয় সত্তা’; আকুইনাস যথারীতি দার্শনিকদের ঈশ্বরের সঙ্গে বাইবেলের ঈশ্বরকে তিনি যিনি আছেন বলে সম্পর্কিত করেছিলেন। তিনি অবশ্য এটা পরিষ্কার করে দিয়েছিলেন যে, ঈশ্বর আমাদের মতো স্রেফ আরেকটি সত্তা নন। স্বয়ং সত্তা হিসাবে ঈশ্বরের সংজ্ঞা যথাযথ, কারণ এটা (সত্তার) কোনও নিশেষ ধরণকে তুলে ধরে না, বরং স্বয়ং সত্তাকেই বোঝায় (esse seipsum)।[৩৬] পরবর্তীকালে পশ্চিমে গড়ে ওঠা ঈশ্বরের যুক্তিভিত্তিক ধারণার জন্যে আকুইনাসকে দোষারোপ করা ঠিক হবে না।
অবশ্য দুর্ভাগ্যজনকভাবে আকুইনাস সাধারণ দর্শন হতে ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রমাণ দিয়ে আলোচনা শুরু করার মাধ্যমে ঈশ্বরকে অন্যান্য দার্শনিক ধ্যান ধারণা বা প্রাকৃতিক ঘটনাবলীর মতো আলোচনা করা যেতে পারে বলে ধারণা দিয়েছেন। এটা বোঝায় যে অন্যান্য জাগতিক বাস্তবতার মতো করেই আমরা ঈশ্বরকে চিনতে পারি। আকুইনাস ঈশ্বরের অস্তিত্বের পাঁচটি প্রমাণ’ লিপিবদ্ধ করেছেন, যেগুলো পরে ক্যাথলিক বিশ্বে দারুণ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে ও প্রটেস্ট্যান্টরাও এর প্রয়োগ করবে:
১. প্রাইম মুভারের সপক্ষে অ্যারিস্টটলের যুক্তি। ২. একই ধরনের আরেকটা প্রমাণ,’ যেখানে বলা হয়েছে সীমাহীন কারণ থাকতে পারে না! একটা সুচনা থাকতে বাধ্য। ৩. ইবন সিনার প্রস্তাবিত অনিশ্চয়তার যুক্তি যেখানে একটা প্রয়োজনীয় সত্তা’র অস্তিত্ব দাবি করা হয়েছে। ৪. অ্যারিস্টটলের ফিলোসফি হতে যুক্তি, যেখানে বলা হয়েছে এই বিশ্বের ক্রমোন্নত ধারা এক সর্বোত্তম সম্পূর্ণতা বোঝায়। ৫. পরিকল্পনা হতে নেওয়া যুক্তি, যেখানে বলা হয়েছে মহাবিশ্বে আমাদের প্রত্যক্ষ করা নিয়ম আকস্মিক ঘটনাচক্রের ফল হতে পারে না।
আজকের দিনে এসব প্রমাণ ধোপে টেকে না। এমনকি ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও এগুলো সন্দেহজনক, যেহেতু পরিকল্পনায় যুক্তির ব্যতিক্রম বাদে প্রত্যেকটা প্রমাণই পরোক্ষে বোঝায় যে ঈশ্বর’ স্রেফ আর-একটি-সত্তা, অস্তিত্বের ধারায় আরও একটি সংযোগ। তিনি সর্বোচ্চ সত্তা’, ‘প্রয়োজনীয়। সত্তা, ‘সবচেয়ে নিখুঁত সত্তা। এখন এটা ঠিক ‘আদি কারণ’ বা ‘প্রয়োজনীয় সত্তা’র মতো পরিভাষাগুলো বোঝায় যে, ঈশ্বর আমাদের চেনা-জানা সত্তাসমূহের মতো হতে পারেন না, বরং তাদের অস্তিত্বের ভিত্তি বা শর্ত। নিঃসন্দেহে এটাই আকুইনাসের উদ্দেশ্য ছিল। তা সত্ত্বেও সাম্মা’র পাঠকগণ সবসময় এই গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য টানেননি এবং ঈশ্বর প্রসঙ্গে এমনভাবে আলোচনা করেছেন যেন তিনি সকল সত্তার সর্বোত্তম’। এটা হাস্যকর এবং মহাসত্তাকে আমাদের প্রতিমূর্তিতে নির্মিত মূর্তিতে পরিণত করতে পারে, সহজেই রূপান্তরিত করতে পারে স্বর্গীয় মহা অহমে। এটা বলা হয়তো ভুল হবে না যে পশ্চিমে অনেকেই ঈশ্বরকে এভাবে একটি ‘সত্তা’ হিসাবে দেখে ।
ইউরোপে নতুন অ্যারিস্টটলবাদের সঙ্গে ঈশ্বরকে সম্পর্কিত করার প্রয়াস গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ফায়লাসুফরাও ঈশ্বরের ধারণাকে সমায়ানুগ রাখার ব্যাপারে উদগ্রীব ছিল যাতে তা অপ্রয়োজনীয় বিষয়ে পরিণত হতে না পারে। প্রত্যেক প্রজন্মে নতুন করে ঈশ্বরের ধারণা ও বোধ গড়ে তুলতে হয়। অবশ্য অধিকাংশ মুসলিমই-বলা যেতে পারে-পায়ের সাহায্যে ভোট দিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে ঈশ্বর পর্যালোচনায় অ্যারিস্টটলের দেওয়ার মতো কিছু ছিল না, যদিও প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের মতো অন্যান্য বলয়ে তাঁর ব্যাপক উপযোগিতা ছিল। আমরা দেখেছি, ঈশ্বরের স্বরূপ সম্পর্কিত অ্যারিস্টটলের আলোচনাকে তাঁর রচনাবলীর সম্পাদকবৃন্দ neta ta physica ( After the Physics’) আখ্যা দিয়েছিলেন: তাঁর ঈশ্বর ছিলেন স্রেফ ভৌত বাস্তবতার ধারাবাহিকতা মাত্র, একেবারে ভিন্ন মাত্রার কোনও সত্তা নন। সুতরাং মুসলিম বিশ্বের ভবিষ্যতের অধিকাংশ ঈশ্বর সংক্রান্ত আলোচনার ক্ষেত্রে দর্শনের সঙ্গে অতিন্দ্রীয়বাদের মিশেল ঘটানো হয়েছে। আমরা যে সত্তাকে ঈশ্বর বলি কেবল যুক্তি দিয়ে তার ধর্মীয় উপলব্ধিতে পৌঁছানো সম্ভব নয়, কিন্তু ধর্মীয় অনুভূতিকে যদি এলোমেলো, অসংযত-বা এমনকি বিপজ্জনক-আবেগে পরিণত না হতে হয়, সমালোচনাসুলভ বুদ্ধিমত্তা এবং দর্শনের চর্চা দ্বারা অনুপ্রাণিত হতে হয়।
আকুইনাসের ফরাসি সমসাময়িক বোনাভেঞ্চার (১২১৭-৭৪)-এরও মোটামুটি একই রকম দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। তিনিও উভয় ক্ষেত্রের উন্নতির সুবিধার লক্ষ্যে দর্শনকে ধর্মীয় অভিজ্ঞতার সঙ্গে মেশানোর প্রয়াস পেয়েছিলেন। দ্য থ্রিফোল্ড ওয়ে-তে তিনি অগাস্তিনের অনুসরণে সৃষ্টির সর্বত্র ‘ট্রিনিটি’ প্রত্যক্ষ করেছেন ও তাঁর ‘দ্য জার্নি অভ দ্য মাইন্ড টু গড-এর সূচনা-বিন্দু হিসাবে এই প্রাকৃতিক ত্রিত্ববাদকে গ্রহণ করেছেন। তিনি প্রকৃতই বিশ্বাস করতেন যে, কেবল প্রাকৃতিক যুক্তি দিয়েই ট্রিনিটি প্রমাণ করা সম্ভব, কিন্তু ঈশ্বরের ধারণার ক্ষেত্রে আধ্যাত্মিক অনুভূতির গুরুত্বকে অত্যাবশ্যকীয় উপাদান হিসাবে জোর দিয়ে যুক্তিভিত্তিক অন্ধত্বের বিপদ এড়িয়ে গেছেন। তিনি ক্রিশ্চানের জীবনের আদর্শ হিসাবে তাঁর মতবাদের প্রতিষ্ঠাতা ফ্রান্সিস অভ অসিসিকে বেছে নিয়েছেন। তার জীবনের ঘটনাবলীর পর্যালোচনা করার মাধ্যমে তার মতো একজন ধর্মবিদ চার্চের মতবাদসমূহের প্রমাণ খুঁজে পেতে পারেন। তুসানের কবি দান্তে আলিগেরি (১২৬৫-১৩২২) দেখেছিলেন যে কোনও একজন সতীর্থ মানব সন্তান দান্তের ক্ষেত্রে ফ্লোরেন্স বিয়েত্রিস পোতিনারি ঈশ্বরের এপিফ্যানি হতে পারে। ঈশ্বর সম্পর্কে এই ব্যক্তিরূপ মনোভাব সেইন্ট অগাস্তিনকে মনে করিয়ে দেয়।
ফ্রান্সিসকে এপিফ্যানি হিসাবে উপস্থাপনের আলোচনায় বোনাভেঞ্চার ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রমাণ দিতে গিয়ে আনসেন্সের তাত্ত্বিক প্রমাণ ব্যবহার করেছেন। তিনি যুক্তি দেখিয়েছেন, ফ্রান্সিস জীবনে এমন সাফল্য অর্জন করেছেন যাকে মানবীয়র চেয়ে বেশি কিছু মনে হয়, সুতরাং এই মতে বসবাস করেও আমাদের পক্ষে যার চেয়ে শ্রেয়তর আর কিছু কল্পনা করা যায় না তাই “শ্রেষ্ঠ হচ্ছে সেটা দেখা ও বোঝা। আমরা যে শ্রেষ্ঠ’-এর মতো একটা ধারণা করতে পারি সেটাই প্রমাণ করে, এটা অবশ্যই ঈশ্বরে সর্বোত্তম পরিপূর্ণতায় অস্তি তৃমান। প্লেটো ও অগাস্তিনের পরামর্শ মতো নিজেদের মাঝে প্রবেশ করলে আমরা আমাদের নিজস্ব অন্তর্জগতে’৩৮ ঈশ্বরের প্রতিবিম্ব দেখতে পাব। এই অন্তক্ষেপ আবশ্যক। চার্চের শাস্ত্রাচারে অংশ নেওয়া অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু একজন ক্রিশ্চানকে আগে নিজের সত্তার গভীরে ডুব দিতে হবে, সেখানে সে বুদ্ধিমত্তার ঊর্ধ্বে এক পরমান্দের দেখা পাবে ও আমাদের সীমিত মানবীয় ধারণার অতীত ঈশ্বরের দর্শন পাবে।
বোনাভেঞ্চার ও আকুইনাস উভয়ই ধর্মীয় অনুভূতিকে মুখ্য হিসাবে দেখেছেন। তারা ফালসাফাহর ঐতিহ্যে আস্থাশীল ছিলেন, কেননা ইহুদিধর্ম . এবং ইসলাম, এ দুই ধর্মেই দার্শনিককে প্রায়শঃই অতিন্দ্রীয়বাদী হাত দেখা গেছে, যারা ধর্মতত্ত্বীয় বিষয়ে বুদ্ধিমত্তার সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে প্রবলভাবে সচেতন ছিলেন। বৈজ্ঞানিক গবেষণার সঙ্গে নিজেদের ধর্মীয় বিশ্বাস খাপ খাওয়াতে তারা ঈশ্বরের অস্তিত্বের যৌক্তিক প্রমাণ খাড়া করেছেন, অন্যান্য সাধারণ অভিজ্ঞতার সঙ্গেও একে যুক্ত করতে চেয়েছেন। ব্যক্তিগতভাবে ঈশ্বরের অস্তিত্বের ব্যাপারে তারা সন্দিহান ছিলেন না। অনেকেই তাদের সাফল্যের সীমাবদ্ধতার বিষয়ে যথাযথভাবে সজাগও ছিলেন। অবিশ্বাসীদের বোঝনোর উদ্দেশ্যে এসব প্রমাণ খাড়া করা হয়নি, কেননা তখনও আমাদের আধুনিক অর্থে নাস্তিকের অস্তিত্ব ছিল না। সুতরাং এই প্রাকৃতিক ধর্মতত্ত্ব ধর্মীয় অনুভূতির পূর্বশর্ত ছিল না, বরং ছিল সহগামী: ফায়লাসুফরা এটা মনে করত যে অতিন্দ্রীয় অভিজ্ঞতা অর্জনের আগে আপনাকে যৌক্তিকভাবে ঈশ্বরের অস্তিত্বের ব্যাপারে নিশ্চিত হতে হবে, বরং ব্যাপারটা একেবারে উল্টো। ইহুদি, মুসলিম ও গ্রিক অর্থডক্স জগতে দার্শনিকদের ঈশ্বরকে খুব দ্রুত অতিন্দ্রীয়বাদীদের ঈশ্বর অতিক্রম করে যাচ্ছিলেন।