বনু নাযীরের ঘটনার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পুরো রবিউল আউয়াল মাস ও জমাদিউল আউয়ালের একটা অংশ মদীনায় কাটালেন। এরপর নাজদে বনু মাহারিব গাতফানের উপগোত্র বনু সা’লাবার বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করলেন।মদীনার শাসনভার অর্পণ করে গেলেন আবু যার গিফারীর ওপর। নাজদে গাতফান গোত্রের আবাসভূমি এলাকা নাখাল পৌঁছে তিনি শিবির স্থাপন করলেন। এটাই যাতুর রিকা [৬৬. রিকা অর্থ টুকরো কাপড় যা তালি দেয়ার কাজে ব্যবহৃত হয়। এই নামকরণের কারণ হলো এই অভিযানে তালি দেয়া পতাকা ব্যবহৃত হয়েছিলো। কেউ কেউ বলেন, ভূমি অত্যন্ত প্রস্তরময় হওয়ায় সৈন্যগণ পায়ে কাপড়ের টুকরো বেঁধে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন বলে এই নাম হয়েছে। আবার কেউ কেউ বলেন, যাতুর রিকা একটি গাছের নাম বা ঘটনাস্থল ছিল।] অভিযান। এখানে তিনি গাতফান গোত্রের এক বিরাট সমাবেশের সম্মুখীন হলেন। উভয় পক্ষ পরস্পরের কাছাকাছি হলো। কিন্তু যুদ্ধ হলো না। তা সত্ত্বেও উভয় পক্ষ পরস্পর সম্পর্কে ভীত সন্ত্রস্ত্র থাকে। ফলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীদের নিয়ে প্রস্থান করেন।
জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা) বলেন: আমি একটা দুর্বল উটে আরোহণ করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে নাখল থেকে রওনা হই। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন সদলবলে যাত্রা করলেন তখন অন্যান্য সহযাত্রী দ্রুত এগিয়ে যেতে লাগলো। আর আমি পেছনে পড়তে লাগলাম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার কাছে এসে জিজ্ঞোসা করলেন, “হে জাবির, তোমার অবস্থা কি?” আমি বললাম, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমার পেছনে ফেলেছে।” তিনি বললেন, “উটটি থামাও।” আমি উটটিকে থামালাম, রাসূলুল্লাহও তাঁর উট থামালেন। এবার তিনি বললেন, “তোমার হাতের এই লাঠিটা আমাকে দাও অথাবা কোন একটা গাছ থেকে ডাল কেটে আমাকে লাঠি বানিয়ে দাও।” আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে লাঠি দিলাম। তিনি ঐ লাঠি দিয়ে আমার উটকে বেশ কয়েকবার গুতা দিলেন। তারপর আমাকে বললেন, “আরোহণ কর।” আমি আরোহণ করলাম। তখন আমার উটটি এত দ্রুতো চলতে লাগলো যে, রাসূলুল্লাহর উটকেও পেছনে ফেলে যেতে লাগলো।
কথা প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বললেন, “জাবির, তোমার উটটি কি আমার কাছে বিক্রি করবে?” আমি বললাম, “হে আল্লাহর রাসূল, ওটা আপনাকে বিনামূল্যেই দেব।” তিনি বললেন, “না বিক্রি কর।” আমি বললাম, “কত দাম দেবেন?” তিনি বললেন, “এক দিরহাম।” আমি বললাম, “তাহলে ্আমার লোকসান হবে।” তিনি বললেন, “তা হরে দুই দিরহাম দেব?” আমি বললাম, ‘না।’ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ক্রমাগত দাম বাড়াতে বাড়াতে এক উকিয়া (এক আউন্স) পর্যন্ত বললেন। তখন আমি বললা, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, আপান এই দামে খুশী তো?” তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ’ আমি বললাম, “তাহলে আপনাকে ওটা দিলাম।” তিনি বললেন, “আমি নিলাম।” অতঃপর বললেন, “জাবির, তুমি বিয়ে করেছো?” আমি বললাম, ‘হ্যাঁ।’ তিনি বললেন, “কুমারীকে না বিবাহিতাকে?” আমি বললাম, “বিবাহিতাকে।” তিনি বললেন, “একটা তরুণী বিয়ে কর না কেন? সে তোমার সাথে কৌতুক করতো। আর তুমিও তার সাথে কৌতুক করতে পারতে?” আমি বললাম, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমার পিতা তাঁর সাতটি কন্যা রেখে উহুদ যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। এই জন্য আমি একজন বয়স্কা মহিলা বিয়ে করেছি, যে ওদের তত্ত্বাবধান ও লালন পালন করতে পারে।” তিনি বললেন, “আল্লাহর ইচ্ছায় তুমি ঠিকই করেছো।” অতঃপর বললেন, “আমরা যদি সিরার পৌঁছে যাই তাহলে একটি উট জবাই করতে বলবো এবং তা জবাই করা হবে। অতঃপর তোমার স্ত্রীর মেহমানদারীতে একদিন সেখানে কাটাবো। তাকে ইসলামের কথা শোনাবো এবং সে আমাদেরকে বালিশ বিছানা দিয়ে যত্ন আদর করবে।” ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমাদের তো বালিশ নেই।” তিনি বললেন, “বালিশ অবশ্যই মিলবে। তুমি সেখানে পৌঁছার পর বুদ্ধিমত্তার সাথে কাজ করবে।”
অতঃপর সিরারে [সিরার মদীনা থেকে তিন মাইল দূরে একটি জায়গা।] পৌঁছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উট জবাই করতে বললেন। সঙ্গে সঙ্গে তা জবাই করা হলো। আমরা ঐ উটের গোশত খেয়ে একদিন অতিবাহিত করলাম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সন্ধ্যা বেলা বাড়ীতে প্রবেশ করলেন। সেইসাথে আমরাও প্রবেশ করলাম। স্ত্রীকে সব ঘটনা এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে যা যা বলেছেন তা জানালাম। স্ত্রী তা শুনে বললো, “আমার সিদ্ধান্ত শুনে নাও, আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সব কথা শুনবো ও মানবো।”
সকাল বেলা আমি উটের মাথা ধরে টেনে নিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে গেলাম এবং তাঁর থাকার ঘরের দরজার সামনে বেঁধে রাখলাম। অতঃপর আমি মসজিদে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পাশে গিয়ে বসলাম। মসজিদ থেকে বেরিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উটটি দেখে বললেন, “এটা কি?” উপস্থিত জনতা বললো, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, এই উট জাবির নিয়ে এসেছে।” তিনি বললেন, “জাবির কোথায়?” সবাই আমাকে ডেকে তাঁর নিকট হাজির করলো। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ভাহিজা, এ উট তুমি নিয়ে যাও। এটা তোমার উট।” অতঃপর বিলালকে ডেকে বললেন, “জাবিরকে নিয়ে যাও এবং এই উটের মূল্য বাবদ এক উকিয়া দাও।” আমি বিলালের সাথে গেলাম। আমাকে তিনি এক উকিয়ার কিছু বেশী দিলেন। আল্লাহর কসম, উটটি এভাবে বরাবরই আমার সমৃদ্ধি সাধন করে আসছিল এবং আমার বাড়ীতে তার গুরুত্ব ও মর্যাদা স্বীকার করা হতো। নাজদের প্রস্তরপূর্ণ রণাঙ্গন থেকে বাড়ীতে তার গুরুত্ব ও মর্যাদা স্বীকার করা হতো। নাজদের প্রস্তরপূর্ণ রণাঙ্গন থেকে ফিরবার পথে তার সাথে যে ঘটনা ঘটে, এটা সেই মর্যাদারই সর্বশেষ প্রতিফলন।
জাবির (রা) আরো বলেন, যাতুর রিকা অভিাযান শেষে নাখল থেকে আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে রওনা হলাম। এই সময় একজন মুসলমান জনৈক মুশরিকের স্ত্রীর সাথে দুর্ব্যবহার করে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সদলবলে রণাঙ্গন থেকে প্রস্থান করলেন। তার স্বামী বাড়ীতে ফিরলো, ইতিপূর্বে সে অনুপস্থিত ছিলো। সে যখন তার স্ত্রীর প্রতি দুর্ব্যবহারের খবর শুনলো তখন কসম খেয়ে প্রতিজ্ঞা করলো যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সহচরদের একজনকে অন্ততঃ হত্যা না করে সে ক্ষান্ত হবে না। সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লারেম পদচিহ্ন অনুসরন করে চলতে লাগলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক জায়গায় পৌঁছে যাত্রাবিরতি করলেন। অতঃপর বললেন, “আজ সারারাত জেগে কে আমাদের পাহারা দিতে প্রস্তুত আছে?” একজন মুহাজির ও একজন আনসারী রাজী হলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে পাহাড়ের গুহার মুখে পাহারায় নিয়োগ কররেন। সাহাবীদ্বয় নিজেদের মধ্যে আপোষে রাতটি এভাবে ভাগ করে নিলেন যে, রাতের প্রথম ভাগ পাহারা দেবেন আনসারী এবং শেষের ভাগ মুহাজির। সেই অনুসারে মুহাজির প্রথম রাত ঘুমালেন আর আনসারী দাঁড়িয়ে নামায পড়া শুরু করলেন।
মুশরিক ঘাতক গভীর রাতে সোখানে এসে উপনীত হলো। নামায আদায়রত আনসারীকে দেখে সে বুঝতে পারলো যে, তিনি মুসলমানদের পাহারাদার। তৎক্ষনাৎ সে তাঁকে লক্ষ্য করে তীর নিক্ষেপ করে তাঁর দেহ ভেদ করলো। অতঃপর সে ঐ তীর দেহ থেকে টেনে বের করে নিজের কাছে রেখে দিল। তা সত্ত্বেও তিনি অবিচলিত রইলেন এবং নামায অব্যহত রাখলেন। এরপর সে আরো একটা তীর নিক্ষেপ করলো এবং সেটিও তাঁর দেহ ভেদ করলো। অতঃপর ঘাতক তাও দেহ থেকে টেনে বের করলো এবং নিজের কাছে রেখে দিল। তা সত্ত্বেও তিনি নামাযে অবিচল রইলেন। অতঃপর সে তৃতীয় তীর নিক্ষেপ করলো। এই তীরও ওই সাহাবীর দেহ ভেদ করলো। ঘাতক তা টেনে বের করে নিজের কাছে রেখে দিল। এবার তিনি রুকু ও সিজদা করে নামায শেষ করলেন এবং তাঁর সঙ্গীকে জাগালেন। তাঁকে বললেন, “উঠে বস। ঘাতক আমাকে জখম করে অচল করে ফেলেছে।” সঙ্গে সঙ্গে মুহাজির লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। ঘাতক উভয়কে দেখে বুঝলো যে, তাঁরা তার উপস্থিতি টের পেয়ে সাবধান হয়ে গেছে। তাই সে পালিয়ে গেল।
মুহাজির সাহাবী আনসারীর রক্তাক্ত দেহ দেখে বরলেন, “সুবাহানাল্লাহ! আপনি আমাকে প্রথম তীরের আঘাতেই জাগালেন না কেন?” আনসারী সাহাবী বললেন, “আমি নামাযে একটি সূরা পড়ছিলাম। সূরাটি শেষ না কের নামায ভঙ্গ করতে ইচ্ছা হচ্ছিলো না। কিন্তু শত্রু অব্যাহতভাবে তীর নিক্ষেপ করতো থাকায় আমি রুকু সিজদা করে আপনাকে ডাকলাম। আল্লাহর কসম, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে যে দায়িত্ব দিয়েছিলাম, সেই দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হবো এই আশংকা যদি না থাকতো তাহলে আমি খুন না হওয়া পর্যন্ত নামায় ভঙ্গ করতাম না।”
ইবনে ইসহাক বলেন, রাসূলুল্লাহ যাতুর রিকা অভিযান শেষে মদীনায় প্রত্যাবর্তন করেন এবং রজবের শেষ পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করেন।