2 of 3

০৫৮. আবু তালিব ও খাদীজার ইন্তিকাল

অতঃপর একই বছর আবু তালিব ও খাদীজা (রা) ইনতিকাল করেন। এতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর একের পর এক বিপদ-মুসিবত আসতে থাকে। খাদীজা (রা) ছিলেন তাঁর এক পরম সত্যনিষ্ঠ উপদেষ্টা। তিনি নিজের যাবতীয় দুঃখ কষ্টের কথা তাঁর কাছে বলতেন। আর চাচা আবু তালিব ছিলেন তাঁর সহায় ও ঢালস্বরূপ। তিনি কুরাইশদের অত্যাচার প্রতিরোধ করতেন এবং তাঁকে সর্বাত্মক সহায়তা দিতেন। মদিনায় হিজরাতের তিন বছর পূর্বে খাদীজা ও আবু তালিবের মৃত্যু ঘটে।

আবু তালিব মারা যাওয়ার পর কুরাইশরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর এমন নির্যাতন শুরু করলো, আবু তালিবের জীবদ্দশায় যা তারা করার সাহস করেনি। এমনকি একদিন কুরাইশদের একজন অত্যন্ত নীচাশয় অর্বাচীন তার চলার পথে গতিরোধ করে তাঁর মাথায় ধুলো নিক্ষেপ করলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ধুলো নিয়ে বাড়ী গেলেন। এ অবস্থা দেখে তাঁর এক মেয়ে ছুটে এসে কাঁদতে কাঁদতে তাঁর মাথার ধুলো মুছে পরিষ্কার করে দিল। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বলছিলেন, “মা, কাঁদিস না! তোর আব্বাকে আল্লাহ রক্ষা করবেন।” এ পর্যায়ে তিনি বললেন, “আবু তালিব মারা যাওয়ার আগে কুরাইশরা আমার সাথে কোন রকম খারাপ আচরণ করতে পারেনি।”

আবু তালিব রোগাক্রান্ত হলে রোগের চরম পর্যায়ে কুরাইশরা একদিন এই বলে সলাপরামর্শ করলো যে, তার রোগ মারাত্মক অবস্থায় উপনীত, হামযা ও উমার ইসলাম গ্রহণ করেছে, কুরাইশদের সকল গোত্রে ইসলাম ছড়িয়ে পড়েছে, এমতবস্তায় আবু তালিবের কাছে আমাদের যাওয়া উচিত। তাঁর কাছে গিয়ে তাঁর মধ্যস্থতায় মুহাম্মাদের সাথে আমাদের একটা চুক্তি করা উচিত। নতুবা তাঁর দলবল আমাদের ধনসম্পদ পর্যন্ত কেড়ে নিতে পারে। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস বলেছেন, “উতবা ও শাইবা ইবনে রাবীয়া, আবু জাহল, উমাইয়া ইবনে খালাফ, আবু সুফিয়ান ইবনে হারব প্রমুখ বড় বড় কুরাইশ নেতা আবু তালিবের কাছে গিয়ে হাজির হলো। তারা তাঁকে বললো, “হে আবু তালিব, আপনি আমাদের কাছে কতখানি শ্রদ্ধার পাত্র তা আপনার অজানা নয় আজ আপনি মারাত্মক রোগে আক্রান্ত। আপনার জীবন নিয়ে আমরা শংকিত। আপনার ভাতিজার সাথে আমাদের সম্পর্কের ধরনও আপনার জানা। কাজেই তাকে ডাকুন, মৃত্যুর আগে তার সাথে আমাদের একটা আপোষরফা করে দিয়ে যান। তার সম্পর্কে আমাদের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি নিন এবং আমাদের সম্পর্কে তার কাছ থেকেও প্রতিশ্রুতি আদায় করে দিন, যাতে আমরা তার ওপর কোন বাড়াবাড়ি না করি এবং সে ও আমাদের ওপর কোন বাড়াবাড়ি না করে। আমরাও তার ও তার ধর্মের ওপর হস্তক্ষেপ না করে আর সেও আমাদের ওপর কোন বাড়াবাড়ি না করে। আমরাও তার ও তার ধর্মের ওপর হস্তক্ষেপ না করি আর সেও আমাদের ও আমাদের ধর্মের ব্যাপারে কোন প্রকার হস্তক্ষেপ না করে।”

আবু তালিব রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ডেকে পাঠালেন। তিনি এসে তাঁকে বললেন, “ভাতিজা, এরা তোমার সম্প্রদায়ের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি। তারা এসেছে তোমার নিকট থেকে একটা কথা নিতে এবং তার বিনিময়ে তোমাকে একটা প্রতিশ্রুতি দিতে। ” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “হ্যাঁ, তোমরা আমার নিকট থেকে একটা মাত্র কথা গ্রহণ করে তাহলে সহগ্র আরবের মালিক হয়ে যাবে এবং অনারব লোকেরা সবাই তোমাদের বশ্যতা স্বীকার করবে। ” আবু জাহল বললো, “বেশ! তা হলে একটা কেন, দশটা কথা গ্রহণ করতেও রাজী আছি।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “তোমরা ঘোষণা কর যে, আল্লাহ ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই এবং অন্য যে সব দেব-দেবীর পূজা করো তা আর করবে না।” এ কথা শুনে তারা সবাই হাততালি দিল। অতঃপর বললো, “আচ্ছা মুহাম্মাদ, তুমি কি চাও যে, আমরা অন্য সব দেব-দেবীর বদলে শুধুমাত্র একজনের পূজা করি? এটা তোমার একটা আজগুবি কথা।” এরপর তারা পরস্পর বলাবলি করতে লাগলো, “দেখ, এই লোকটির কাছে তোমার যা প্রত্যাশা করছো তা সে কখনো দেবে না। অতএব তোমরা চলে যাও। তার ও তোমাদের ব্যাপারে আল্লাহর ফায়সালা না আসা পর্যন্ত বাপদাদার ধর্ম পালন করতে থাক।”

সবাই সেখান থেকে চলে গেলে আবু তালিব রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললেন, “ভাতিজা,আমার মনে হয, তুমি তাদেরকে অন্যায় কিছু অনুরোধ করনি।”

আবু তালিবের মুখে এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মনে তাঁর ইসলাম গ্রহণ সম্পর্কে আশার সঞ্চার হলো। তাই তিনি আবু তালিবকে এই বলে পীড়াপীড়ি করতে থাকলেন, “চাচা, আপনি একবার বলুন। তাহলে কিয়ামতের দিন আপনার জন্য সুপারিশ করা আমার জন্য বৈধ হয়ে যাবে।”

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এরূপ আগ্রহী হতে দেখে আবু তালিব বললেন, “ভাতিজা, আমার মুত্যুর পরে তোমার ও তোমার ভাই বোনদের অপমানিত হতে হবে এবং কুরাইশরা ভাববে যে আমি শুধু মৃত্যুর ভয়ে ঈমান এনেছি। এই আশংকা যদি না থাকতো তা হলে আমি কালেমা পড়তাম ও ঈমান আনতাম। আমি শুধু তোমাকে খুশী করার জন্যই এ কথা বলছি।”

এরপর আবু তালিবের অন্তিম মুহূর্ত ঘনিয়ে এলে আব্বাস দেখলেন, আবু তালিব ঠোঁট নাড়ছেন। তিনি তাঁর মুখের দিকে কান এগিয়ে দিলেন। তারপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললেন, “ভাতিজা তুমি যে কালেমা পড়তে বলেছো, আমার ভাই তা পড়েছে।” রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, “আমি শুনতে পাইনি।”

আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) বলেন, কুরাইশদের যে লোকজন আবু তালিবের কাছে এসেছিল তাদের সম্পর্কে আল্লাহ তা’য়ালা এই আয়াত নাযিল করেছেনঃ

[আরবী *************]

“সা-দ। উপদেশ পরিপূর্ণ কুরআনের শপথ। অবিশ্বাসীরাই বরং অহংকার ও হঠকারিতায় লিপ্ত। তাদের পূর্বে আমি কত জাতিকেই না ধ্বংস করে দিয়েছি। তখন তারা আর্তনাদ করে উঠেছে। কিন্তু তখন আর রক্ষা পাওয়ার অবকাশ ছিল না। এই লোকেরা তাদের মধ্যে থেকেই একজন সতর্ককারী আবির্ভূত হওয়ায় বিষ্মিত হয়েছে আর অবিশ্বাসীরা বলতে লাগলো, ‘এই ব্যক্তি তো যাদুকর, মিথ্যাবাদী। সে কি সমস্ত খোদার স্থানে একজন মাত্র খোদাকে বসিয়েদিল! এটা নিতান্তই অদ্ভুত ব্যাপার!’ তাদের নোতারা এই বলতে বলতে চলে গেল, ‘চল, নিজেদের দেব-দেবীর প্রতি অবিচল থাকো। এটা অর্থাৎ যে কথা বলা হচ্ছে তা অবশ্যই উদ্দেশ্যমূলক। এ রকম কথা তো আমরা সাম্প্রতিক কালের কোন ধর্মের নিকট থেকেই শুনতে পাইনি। নিশ্চয়ই এটা মনগড়া কথা ছাড়া আর কিছুই নয়।” (সূরা সা-দ)

‘সাম্প্রতিক কালের ধর্ম’ অর্থ খৃস্টধর্ম- যার অনুসারীরা বলতো যে, আল্লাহ তিনজনের তৃতীয়জন। অতঃপর আবু তালিব মারা গেলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *