2 of 3

০৯৫. বীরে মাউনার ঘটনা (৪র্থ হিজরী)

শাওয়াল মাসের অবশিষ্ট অংশ, যিলকাদ, যিলহাজ্জ ও মুহাররাম মাস রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় অবস্থান করলেন। এই বছরের হজ্জ মুশরিকরা বর্জন করেছিল। সফর মাসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বীরে মাউনার অভিযাত্রীদের পাঠিয়েছিলেন। এ ঘটনা ঘটে উহুদ যুদ্ধের মাত্র চার মাস পর।

ঘটনার পটভূমি হলো, ‘মুলায়িবুল আসিন্নাহ’ (বর্শা খেলায় পারদর্শী) নামে খ্যাত আবু বারা আমের ইবনে মালিক ইবনে জা’ফর রাসূলুল্লাহর সাথে দেখা করতে মদীনায় আসে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার সামনে ইসলাম পেশ করেন এবং তাকে ইসলাম গ্রহণের দাওয়াত দেন। সে ইসলাম গ্রহণও করলো না, ইসলামের বিরুদ্ধেও কিছু বললো না। সে বললো, “হে মুহাম্মাদ, আপনি যদি কিছুসংখ্যক সাহাবীকে নাজদবাসীর কাছে পাঠিয়ে দেন এবং তারা তাদেরকে আপনার দ্বীনের প্রতি দাওয়াত দেন, আমার মনে হয়, তাহলে তারা আপনার দ্বীন গ্রহণ করনে।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “নাজদবাসী তাদের ক্ষতি করতে পারে বলে আমার আশংকা হয়।” আবু বারা বললেন, “আমি তদের নিরাপত্তার জিম্মাদার। আপনি তাদেরকে পাঠিয়ে দিন। তারা জনগণকে আপনার দ্বীনের দিতে দাওয়াত দিক।”

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলমানদের মধ্য থেকে বাছা বাছা চল্লিশজন সুযোগ্য সাহাবীকে বনু সায়েদা গোত্রের বিশিষ্ট সাহাবী মুনযির ইবনে আমরের নেতৃত্বে পাঠিয়ে দিলেন। মুনযির ‘মুয়ান্নিক লিয়ামুত’ [তাঁকে এ উপাধিদানের কারণ হলো, তিনি শাহাদাত লাভের জন্য দ্রুতগতিতে ধাবমান হন।] (দ্রুত মৃত্যুকে আলিঙ্গনকারী) নামে অভিহিত হতেন। তাঁর সুযোগ্য সঙ্গী ছিলেন বিশিষ্ট সাহাবী হারেস ইবনে ছিম্মা, হারাম ইবনে মিলহান, উরওয়া ইবনে আসমা, নাফে ইবনে বুদাইল ইবনে ওয়ারকা ও আবু বাক্র সিদ্দীকের (রা) মুক্ত গোলাম আমের ইবনে ফুহাইরা। তাঁরা রওয়ানা দিয়ে বীরে মাউনাতে গিয়ে অবস্থান করলেন। এই জলাশয়টি বনু আমেরের আবাসভূমি ও বনু সুলাইমের প্রস্তরময় এলাকার মাঝখানে অবস্থিত। উভয় এলাকাই জলাশয়টির নিকটবর্তী হলেও বনু সুলাইমের এলাকা ছিল অধিকতর নিকটবর্তী।

ইসলামের কট্রর দুশমন আমের ইবনে তুফাইলের নিকট রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চিঠি নিয়ে গেলেন হারাম ইবনে মিলহান (রা)। তিনি যখন তার কাছে উপস্থিত হলেন, তখন সে চিঠির দিকে ভ্রুক্ষেপমাত্র না করে হারাম ইবনে মিরহানকে হত্যা করলো। তারপর বাদবাকী সাহাবীদেরকেও খতম করার জন্য সে বনু আমেরের সাহায্য চাইলো। কিন্তু বনু আমের তার অনুরোধ এই বলে প্রত্যাখ্যান করলো যে, “ আমরা বনু বারার প্রতিশ্রƒতি ভঙ্গ করতে চাই না। আবু বারা তাদের নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসেছে।” আমের অগত্যা সুলাইমের কয়েকটি উপগোত্রের সাহায্য চাইল। তারা সঙ্গে সঙ্গে সম্মত হলো এবং তাদেরকে চারদিক থেকে ঘেরাও করে ফেললো। সাহাবাগণ তাদেরকে দেখে তরবারী হাতে নিলেন এবং লড়াই করতে করতে শহীদ হলেন। শুধু কা’ব ইবনে যায়িদ রক্ষা পেলেন। কাফিররা তাঁকে মৃত মনে করে ফেলে রেখে যায়। অথচ তিনি বেঁচে ছিলেন। অনেক রক্তপাতের দরুণ দুর্বল হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও নিহতদের স্তূপের মধ্য থেকে প্রাণ নিয়ে কোন রকমে পালিয়ে যান এবং পরে খন্দকের যুদ্ধে শাহাদাত বরণ করেন।

আক্রান্ত হবার সময় দু’জন সাহাবী আমর ইবনে উমাইয়া দামরী ও জনৈক আনসারী [মুনযির বিন মুহাম্মাদ বিন উকবা। ] সাহাবী কোন কারণে দল থেকে কিছুদূরে অবস্থান করছিলেন। তাঁরা তাঁদের সঙ্গীদের বিপদের কথা জানতেন না। কিন্তু তাঁদের মাথার ওপর কতকগুলো পাখী উড়তে দেখে তাঁদের মনে সন্দেহ জাগে। তাঁরা ভাবলেন, পাখীগুলোর ওড়ার পেছনে নিশ্চয়ই কোন রহস্য আছে। তাঁরা তাঁদের অবস্থা দেখবার জন্য এগিয়ে গেলেন। দেখলেন সবাই রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। আর তাঁদের ওপর আক্রমণকারী দলকেও উপস্থিত দেখলেন। আনসারী আমর ইবন উমাইয়াকে বললেন, “এখন আমাদের কি করা উচিত বলে মনে করেন?” তিনি বললেন, “আমার ইচ্ছা, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে গিয়ে দেখা করি এবং সমস্ত ব্যাপার তাঁকে জানাই।” আনসারী বললেন, “যে রণক্ষেত্রে মুনযির ইবনে আমর শহীদ হয়েছেন সেখান থেকে প্রাণ নিয়ে আমি পালাতে চাই না। আমি নিজে কখনো লোকমুখে হত্যাকা-ের খবর শোনার অপেক্ষায় বসে থাকতাম না।” অতঃপর তিনি লড়াই করে শহীদ হলেন।

আমর ইবনে উমাইয়াকে কাফিররা আটক ও বন্দী করলো। তিনি মুদার গোত্রের লোক একথা শুনে আমের ইবনে তুফাইল তাঁর কপালের চুল কেটে নিল এবং তাঁর মায়ের একটা দাস মুক্ত করার মানত ছিল মনে করে তাঁকে সেই বাবদে মুক্তি দিল। এরপর আমর ইবনে উমাইয়া মদীনার উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। মদীনার অনতিদূরে অবস্থিত কারকারাতে পৌঁছলো বনু আমেরের দুই ব্যক্তি এসে তাঁর সাথে একই ছায়ায় বিশ্রাম নিতে লাগলো। বনু আমেরের সাথে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একটা নিরাপত্তা ও আনাক্রমণ চুক্তি যে ছিল, সেকথা আমর জানতেন না। তিনি তাদেরকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলেন যে, তারা বনু আমের গোত্রের লোক। তিনি একটু অপেক্ষা করলেন। যেই তারা তন্দ্রাচ্ছন্ন হলো অমনি উভয়ের ওপর হামলা চালিয়ে হত্যা করলেন। তাঁর ধারণা ছিল, বনু আমের রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীদের হত্যাকা- চালিয়েছে এবং সে কারণে বনু আমের থেকে প্রতিশোধ নেয়া উচিত।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিকট উপনীত হয়ে আমর ইবনে উমাইয়া সমস্ত ঘটনা জানালেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “তুমি যে দু’জনকে হত্যা করেছো, তাদের জন্য আমাকে রক্তপণ (দিয়াত) দিতে হবে।” অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “এ ঘটনা আবু বারাই ঘটালো। আমি এটা অপছন্দ করেছিলাম এবং শংকিত ছিলাম।” আবু বারা ঘটনা জানতে পেরে খুবই দুঃখিত হলেন। আমের ইবনে তুফাইল তার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করিয়ে দেয়ার এবং তার নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেয়ার কারণে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীদের ওপর বিপদ নেমে আসায় আবু বারা ক্ষোভ প্রকাশ করে। নিতদের মধ্যে আমের ইবনে ফুহাইরাও ছিলেন। হিশাম ইবনে উরওয়াহ তাঁর পিতা থেকে বর্ণনা করেছেন যে, আমের ইবনে তুফাইল বলতো, “ঐ দলের ভেতরে একটি লোক ছিল যাকে হত্যা অব্যবহিত পর তাঁকে আকাশ ও পৃথিবীর মাঝখানে দেখলাম। অবশেষে দেখলাম সে যেন আকাশে উঠে উধাও হয়ে গেছে। কে সেই, লোকটি?” লোকেরা বললো, “সে আমের ইবনে ফুহাইরা।”

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *