বনু কাইনুকার মূল ঘটনা ছিল এই যে, জনৈক আরব মহিলা কিছু পণ্যদ্রব্য নিয়ে বনু কাইনুকা গোত্রের বাজারে বিক্রি করে। সেখানে সে এক স্বর্ণকারের দোকানের কাছে বসে। দোকানের লোকেরা মহিলার মুখ খুলতে বলে। কিন্তু মহিলা তা করতে অস্বীকার করে। অতঃপর স্বর্ণকার এই মহিলার পরিধানের কাপড়ের একটা কোণা ধরে তার পিঠের সাথে বেঁধে দেয়। মহিলা এটা টের পায়নি। ফলে সে উঠে দাঁড়ালে অমনি উলঙ্গ হয়ে যায়। বাজারের লোকেরা তা দেখে হো হো করে হেসে ওঠে। মহিলা সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে ওঠে। জনৈক মুসলমান স্বর্ণকারের ওপর আক্রমণ চালিয়ে তাকে হত্যা করে ফেলে। স্বর্ণকার ছিল ইহুদী। তাই ইহুদীরাও সংঘবদ্ধ হযে ঐ মুসলমানকে হত্যা করে। তখন নিহত মুসলমানের পরিবার-পরিজন মুসলমানদের কাছে ফরিয়াদ জানায় তারা ক্রুদ্ধ হয়ে আক্রমণ চালালে বনু কাইনুকার সাথে মুসলমানদের যুদ্ধ বেঁধে যায়।
মদীনার ইহুদীদের মধ্যে বনু কাইনুকাই সর্বপ্রথম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাদের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তি ভঙ্গ করে। ফলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে অবরোধ করে অনুকূল শর্তে আত্মসমর্পণে বাধ্য করেন। এভাবে আল্লাহর সাহায্যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে নতজানু করলে, আবদুল্লাহ ইবনে উবাই ইবসে সুলুল তাঁর কাছে এসে বললো, “হে মুহাম্মাদ, আমার মিত্রদের প্রতি সহৃদয় আচরণ করুন।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার এ কথায় কোন উত্তর দিলেন না। সে আবার বললো, “হে মুহাম্মাদ, আমার মিত্রদের সাথে সদয় আচরণ করুণ।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুখ ফিরিয়ে নিলেন। এবার সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বর্মের পকেটে হাত ঢুকিয়ে দিলে তিনি বললেন, “আমাকে ছাড়।” এই সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এত ক্রুদ্ধ হন যে, তাঁর মুখম-ল রক্তিম হয়ে যায়। অতঃপর তিনি তাকে বললেন, “আরে। আমাকে ছাড় তো।” সে বললো, “না, আমার মিত্রদের সাথে সদয় আচরণের নিশ্চয়তা আগে দিন, তারপর ছাড়বো। বিশ্বাস করুন, চারশো নাঙ্গামাথা যোদ্ধা এবং তিনশো বর্মধারী যোদ্ধা আমাকে সারা দুনিয়ার মানুষ থেকে নিরাপদ করে দিয়েছে। আর আপনি কিনা একদিনেই তাদেরকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চাচ্ছেন। আমি তাদের ছাড়া এক মুহূর্তও নিরাপদ নই”। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “আচ্ছা, বেশ। ওদেরকে তোমার মর্জির ওপর ছেড়ে দিলাম।”
এরপর উবাদা ইবনে ছামিত (রা) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে হাজির হলেন। বনু কাইনুকার সাথে তাঁরও মৈত্রী সম্পর্ক ছিল। কিন্তু তাঁর কোন পরোয়া না করে তিনি তাদেরকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইচ্ছার ওপর ছেড়ে দিলেন এবং তাদের সাথে তার কৃত চুক্তির দায়দায়িত্ব থেকে তিনি আল্লাহ ও রাসূলের সামনে নিজেকে মুক্ত বলে ঘোষণা করলেন।তিনি বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমার মিত্র ও বন্ধু শুধুমাত্র আল্লাহ, রসূল ও মু’মিনগণ। এসব কাফিরের মৈত্রী থেকে আমি সম্পূর্ণ মুক্ত।”
উবাদা ইবনে ছামিত ও আবদুল্লাহ ইবনে উবাই সম্পর্কেই সূরা মায়িদার নিম্নলিখিত আয়াতগুলো নাযিল হয়,
“হে মুমিনগণ, তোমরা ইহুদী ও খৃস্টানদের কখনো বন্ধু ও মিত্র হিসেবে গ্রহণ করো না। ওরা পরস্পরের মিত্র। তোমাদের মধ্য হতো যে ব্যক্তি তাদেরকে মিত্র হিসেবে গ্রহণ করবে সে তাদেরই দলভুক্ত গণ্য হবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ যালিমদেরকে সুপথ দেখান না। যাদের অন্তরে ব্যাধি রয়েছে তাদেরকে তুমি দেখতে পাবে ইহুদী ও খৃস্টানদের ব্যাপার নিয়ে ছুটোছুটি করে আর বলে: আমাদের আশংকা হয়, আমাদের ওপর বিপদ-মুসিবত এসে পড়ে কিনা। আল্লাহ তো বিজয় দিতে পারেন কিংবা নিজের পক্ষ থেকে অন্য কোন ঘটনা ঘটিয়ে দিতে পারেন। তখন তারা মনের ভেতরে লুকানো ব্যাপার নিয়ে অনুতপ্ত হবে। মুমিনরা বলেঃ এই নাকি কসম খেয়ে লম্বা লম্বা বুলি আওড়ানো সেই লোকদের অবস্থা যারা বলে যে, তারা তোমাদের সাথেই রয়েছে। তাদের সমস্থ নেক আমল বরবাদ হয়ে গেছে। ফলে তারা সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েছে। হে মু’মিনগণ, তোমাদের মধ্য হতে যদি কেউ তার দীন ত্যাগ করে, তাহলে সেদিন বেশী দূরে নয় যখন আল্লাহ এমন একটি দলের আবির্ভাব ঘটাবেন, যাদেরকে আল্লাহ ভালোবাসেন এবং যারা আল্লাহকে ভালোবাসে, যারা মু’মিনদের প্রতি বিনয়ী এবং কাফিরদের প্রতি কঠোর, যারা আল্লাহর পথে জিহাদ করবে এবং কারো নিন্দা বা তিরস্কারের পরোয়া করবো না। এরূপ দৃঢ় হতে পারাটা আল্লাহ অনুগ্রহ বিশেষ। যাকে তিনি দিতে চান, এ অনুগ্রহ দিয়ে থাকেন। বস্তুত: আল্লাহর সর্বত্র অনুগ্রহ বিশেষ। যাকে তিনি দিতে চান, এ অনুগ্রহ দিয়ে থাকেন। বস্তুত: আল্লাহর সর্বত্র বিরাজিত সর্বজ্ঞ। তোমাদের বন্ধু ও মিত্র তো একমাত্র আল্লাহ, তাঁর রাসূল এবং সেই সব মু’মিন যারা নামাযী, যাকাত দাতা ও আল্লাহর অনুগত। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও মু’মিনদের মিত্র হিসেবে গ্রহণ করবে সে আল্লাহর দলভুক্ত হবে এবং তার জেনে রাখা উচিত যে, আল্লাহর দলই চূড়ান্ত বিজয় লাভ করে থাকে।”