০৭. দশাশ্বমেধ ঘাট

দুটো বাজে। আকাশে মেঘ। দশাশ্বমেধ ঘাটে এখন লোক নেই বললেই চলে। আমরা তিনজন জলের ধারে বসে আছি ঘাটের সিঁড়ির উপর। মগনলালের ঘরে বিভীষিকাময় ঘটনাটার পর প্রায় এক ঘণ্টা কেটে গেছে। মগনলালের লোকই লালমোহনবাবুর জ্ঞান ফিরিয়ে এনেছিল চোখে মুখে জলের ঝাপটা দিয়ে। তারপর মগনলাল নিজে দুধের সঙ্গে ব্র্যান্ডি মিশিয়ে খাইয়ে লালমোহনবাবুকে চাঙ্গা করে বলেছিল, ‘আঙ্কল, ইউ আর এ ব্রেভ ম্যান।’ তারপর থেকে লালমোহনবাবু কথাটথা আর বিশেষ বলছেন না, কেবল ফেলুদাকে একবার জিজ্ঞেস করেছেন তার মাথার চুল সব পেকে গিয়েছে কি না। তাতে আমরা দুজনেই তাকে আশ্বাস দিয়েছি যে নতুন করে একটি চুলও পাকেনি।

মগনলালের হাবভাবে স্পষ্টই বোঝা গিয়েছিল যে ফেলুদা তদন্ত চালাতে গেলেই সে খতম হয়ে যাবে—হয় ছুরিতে, না হয় গুলিতে। অবিশ্যি শেষ পর্যন্ত ফেলুদা একটা কনসেশন আদায় করে নিয়েছে; সে আরও একটিবার ঘোষালবাড়িতে যাবে, কারণ হঠাৎ ডুব মেরে গেলে সেটা তার সম্মানের পক্ষে অত্যন্ত হানিকর হবে। যাওয়ার ব্যাপারে দেরি করে লাভ নেই, কাজেই সেটা আজই বিকেলে সেরে ফেলতে হবে। মগনলাল আমাদের বিদায় দেবার আগে স্পষ্ট কথায় শাসিয়ে দিয়েছে—‘আপনি জেনে রাখবেন মিস্টার মিত্তির যে, আপনি বাড়াবাড়ি যা করবেন তা অ্যাট ইওর ওন রিসক। আর আপনার উপর নজর রাখার বেওস্থা আমার আছে সেটাও আপনি জানবেন।’

এটা বলতে খারাপ লাগছে যে এখন পর্যন্ত মগনলালই ফেলুদার উপর টেক্কা মেরে আছে। এটা আমি জানি যে যতই ডাকসাইটে প্রতিদ্বন্দ্বী হোক না কেন, শেষ পর্যন্ত প্রতিবারই ফেলুদার জয় হয়েছে। কিন্তু এটাও ঠিক যে মগনলাল মেঘরাজের মতো সাংঘাতিক প্রতিদ্বন্দ্বীর সামনে এর আগে ফেলুদাকে কখনও পড়তে হয়নি।

বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে গঙ্গার দিকে চেয়ে থেকে ফেলুদা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘গণেশটা ঘোষালবাড়িতে রয়ে গেছে রে—তাতে কোনও সন্দেহ নেই। নইলে লোকটা আমাকে তদন্ত বন্ধ করার জন্য এতগুলো টাকা অফার করে না। কিন্তু কথা হচ্ছে—সেটা কোথায়? সেটা কেন এখনও পর্যন্ত মগনলালের নাগালের বাইরে? কখন কীভাবে সেটা সে হাত করার কথা ভাবছে? আর সব শেষে আরও দুটো প্রশ্ন—কে সেটা সিন্দুক থেকে সরাল, এবং ও বাড়ির কার সঙ্গে মগনলালের যোগসাজশ রয়েছে?’

ফেলুদা পকেট থেকে তার খাতাটা বার করে মিনিট পাঁচেক উলটে-পালটে দেখল। বুঝতে পারছি ইতিমধ্যে সেটাতে বেশ কিছু নতুন জিনিস লেখা হয়েছে, কিন্তু সেটা যে কী তা এখনও জানি না। লালমোহনবাবুকে লক্ষ করছি মাঝে মাঝে শিউরে উঠছেন, আর নিজের শরীরের এখানে ওখানে হাত বুলিয়ে দেখছেন। তিনি যে অক্ষত আছেন সেটা বোধহয় এখনও ওঁর বিশ্বাস হচ্ছে না।

আমরা যখন ঘাট থেকে উঠলাম তখনও আকাশ ছাই রঙের মেঘের টুকরোতে ছেয়ে আছে। আকাশটা দেখতে গিয়েই লাল-সাদা পেটকাটি ঘুড়িটার দিকে চোখ গেল। ফেলুদাও দেখেছে, কারণ ওর সিঁড়ি-ওঠা থেমে গেল।

ঘুড়িটা উড়ছে যে বাড়িটার মাথার উপর সেটা আমাদের চেনা বাড়ি। এটা সেই লালবাড়ি—যার ছাতে শয়তান সিংকে ক্যাপ্টেন স্পার্কের কাছে আত্মসমর্পণ করতে হয়েছিল। বাড়ির ছাতে কে? শয়তান সিং না? হ্যাঁ—কোনও সন্দেহ নেই। এ হল রুকুর বন্ধু সূরয। সে এক দৃষ্টিতে আকাশের ঘুড়িটার দিকে চেয়ে রয়েছে।

এবার ঘুড়িটা গোঁৎ খেয়ে সুতোর টানে নীচের দিকে নেমে এল। সূরযের ডান হাতটা একটা ঝটকা দিয়ে উপর দিকে উঠল। তার ফলে একটা ঢিল শূন্যে উঠে ঘুড়িটার পিছন দিকে চলে গেল।

এবার বুঝলাম ঢিলটা একটা সুতার সঙ্গে বাঁধা, আর সুতোটা ধরা সূরযের হাতে।

সেই সুতো ধরে সূরয টান দিচ্ছে, আর তার ফলে বন্দি ঘুড়িটা তার হাতে চলে আসছে।

গোধুলিয়ার মোড়ে একটা দোকানে বসে চা খেয়ে আমরা যখন শংকরী নিবাসে পৌঁছলাম তখন প্রায় চারটে বাজে। ত্রিলোচন পাণ্ডে সেলাম ঠুকে ফটক খুলে দিল। আমরা গাড়িবারান্দায় পৌঁছানোর আগেই সকালেরই মতো বিকাশবাবু বাইরে বেরিয়ে এসে আমাদের অভ্যর্থনা করলেন।

‘কী খবর? এনি প্রোগ্রেস?’

‘উঁহু’ ফেলুদা বলল। ‘শহর দেখে বেড়ালাম সারা দিন।’

‘ওঁরা তো সব বেরিয়েছেন।’

উমানাথবাবুর গাড়িটা দেখছিলাম না। তা ছাড়া বাড়িটা দেখেও কেমন জানি খালি খালি মনে হচ্ছিল।

‘কোথায় গেছেন?’ ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।

‘সারনাথ। আজও কিছু আত্মীয়স্বজন এসেছেন বাইরে থেকে। দুপুরে খাওয়া-দাওয়া সেরে দুটো গাড়ি বোঝাই করে বেরিয়েছেন সব, ফিরতে সন্ধে হবে।’

‘রুকুও গেছে?’

‘না। রুকুর সারনাথ দেখা হয়ে গেছে। ও গেছে টারজান দেখতে ওর এক মামার সঙ্গে।’

আসবার সময় রাস্তার দেওয়ালে বিজ্ঞাপন দেখেছি বটে। সেই আদ্যিকালের ছবি—আমার জন্মের আগে, ফেলুদার জন্মের আগে, এমন কী লালমোহনবাবুর জন্মের আগে—টারজন দি এপ ম্যান।

‘আমার ঘরে এসে বসবেন একটু?’ বিকাশবাবু প্রশ্ন করলেন।

ফেলুদা বলল, ‘আগে একবার ছাতে যাব—যদি সম্ভব হয়।’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ—আপনার জন্য এ বাড়ির সব দরজা খোলা।’

সামনের দরজা দিয়ে ঢুকেই চণ্ডীপাঠের আওয়াজ পেলাম। সেটা পুজোমণ্ডপ থেকে আসছে জানি, কিন্তু এত জোরে আওয়াজ তো কাল পাইনি। ডান দিকে চাইতেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে গেল। সিঁড়ির পিছনের দরজাটা আজ খোলা, আর সেটা দিয়ে দিব্যি পুজোর জায়গাটা দেখা যাচ্ছে। আমরা চারজনেই দরজাটার দিকে এগিয়ে গেলাম। দূর থেকেই দেখা যাচ্ছে শশীবাবু এক মনে তুলি চালিয়ে যাচ্ছেন।

‘কালই তো শশীবাবুর কাজ শেষ’, বলল ফেলুদা।

‘হ্যাঁ’ বললেন বিকাশবাবু, ‘ভদ্রলোকের জ্বর এখনও সম্পূর্ণ সারেনি, তাও একনাগাড়ে তুলি চালিয়ে যাচ্ছেন।’

ছাত দেখা মানে যে আসলে রুকুর ঘর দেখা সেটা আগেই আন্দাজ করেছিলাম। সেদিন সকালে এ ঘরে রোদ ছিল না, আজ পশ্চিমের জানালা দিয়ে ঝলমলে রোদ এসে চারিদিকের ছড়ানো জিনিসের উপর পড়েছে।

আমি ভেবেছিলাম আজ যখন রুকু নেই তখন ফেলুদা হয়তো তন্ন তন্ন করে অনুসন্ধান চালাবে, কিন্তু তার পরেই মনে হল মগনলালের হুমকির কথা। বেশিক্ষণ শংকরী নিবাসে থাকাটাই ফেলুদার পক্ষে বিপজ্জনক। তা ছাড়া বেশি অনুসন্ধানের দরকার হল না, কারণ ফেলুদা যেটা খুঁজছিল সেটা ঘরে ঢুকেই পেয়ে গেল।

আজই বিকেলে সূরযের ফাঁসে বন্দি হতে দেখেছি এই লাল-সাদা পেটকাটিটাকে। মেঝের উপর লাটাই-চাপা অবস্থায় পড়ে আছে ঘুড়িটা; সেটার উপর যে উৎপাত হয়েছে সেটা দেখলেই বোঝা যায়; কাল আর এ ঘুড়ি আকাশে উড়বে না।

ফেলুদা লাটাইটা তুলতেই একটা জিনিস চোখে পড়ল।

ঘুড়ির সাদা অংশটাতে নীল পেনসিল দিয়ে হিন্দি অক্ষরে কী যেন লেখা রয়েছে। দুটো জায়গায় আলাদা করে লেখা।

কাছ থেকে পড়ে বুঝতে পারলাম ভাষাটা বাংলা। বোধহয় সূরয বাংলা পড়তে পারে না বলেই রুকুকে এটা করতে হয়েছে।

একটা লেখা হল এই—

‘আমি বন্দি। সব ঠিক আছে হা হা। আবার বিকেলে। ইতি ক্যাপ্টেন স্পার্ক।’

অন্যটা হল—

‘টারজন দেখতে যাচ্ছি। আবার কাল সকালে। ইতি ক্যাপ্টেন স্পার্ক।’

‘বাপ্‌রে বাপ!’ বলে উঠলেন লালমোহনবাবু। ‘কোন জগতে বাস করে মশাই এ ছেলে?’

ফেলুদা ঘুড়িটাকে আবার ঠিক যেইভাবে ছিল সেইভাবে রেখে বলল, ‘রহস্য রোমাঞ্চ সিরিজের জগৎ। শিশুমনের উপর আপনাদের বইয়ের কী প্রভাব তার স্পষ্ট নিদর্শন এটা।’

আমরা রুকুর ঘর থেকে নীচে ফিরে এলাম। বিকাশবাবু চায়ের কথা আগেই বলে দিয়েছিলেন, তার ঘরে গিয়ে বসতেই ভরদ্বাজ ট্রে নিয়ে ঢুকল।

ঘরটা বেশ বড়। একদিকে খাট, অন্যদিকে একটা কাজের টেবিলের সামনে একটা চেয়ার। এ ছাড়াও বসবার জন্য একটা সোফা রয়েছে। ফেলুদা টেবিলের সামনের চেয়ারটায় বসল, আমরা দুজন সোফাতে, আর বিকাশবাবু খাটে। পাশের বৈঠকখানার ঘড়িতে মোলায়েম সুরে ঢং ঢং করে চারটে বাজল; শুনলেই বোঝা যায় জাত ঘড়ি।

‘মিস্টার ঘোষালের কেমিক্যালের ব্যবসা কীরকম চলে?’ ফেলুদা প্রশ্ন করল।

‘ভালই তো।’ বিকাশবাবু যদি প্রশ্নটা শুনে অবাক হয়ে থাকেন তো সেটা তার কথায় কিছু বোঝা গেল না—‘অবিশ্যি মাঝে-মধ্যে যে স্ট্রাইক ইত্যাদি হয় না তা নয়। তা সে কোন ব্যবসায় হয় না বলুন!’

‘হুঁ’…

ফেলুদা হঠাৎ হাতের কাপটা রেখে উঠে পড়ে বলল, ‘একবার বৈঠকখানাটা দেখতে পারি?’

‘নিশ্চয়ই।’

আমরা চারজনই চা খাওয়া বন্ধ রেখে বৈঠকখানায় গিয়ে হাজির হলাম। বিকাশবাবুর ঘর থেকে বৈঠকখানায় যাবার কোনও দরজা নেই; যেতে হলে আগে একটা বারান্দা পড়ে।

‘সেদিন মগনলাল আর উমানাথবাবু কোথায় বসেছিলেন সেটা জানতে পারি?’

বিকাশবাবু দুটো মুখোমুখি সোফা দেখিয়ে দিলেন।

‘ওদিকে কি ঘর? না আরেকটা বারান্দা?’

আমরা যে বারান্দা দিয়ে ঢুকলাম সেটা পুব দিকে; ফেলুদা দক্ষিণ দিকের দুটো পর্দা দেওয়া দরজার দিকে দেখিয়ে প্রশ্নটা করল।

‘ওদিকে দুটো দরজার পিছনে দুটো ঘর। একটা বড় কর্তার আপিস ঘর ছিল; অন্যটায় মক্কেলরা অপেক্ষা করত!’

আমরা দুটো ঘরের ভিতরেই ঢুকে মিনিটখানেক করে থেকে আবার বিকাশবাবুর ঘরে ফিরে এলাম। এবার ফেলুদা জিজ্ঞেস করল, ‘গণেশটা কি কলকাতায় থাকত, না এখানে?’

‘এখানে’, বিকাশবাবু বললেন, ‘ওটা যাওয়াতে মিস্টার ঘোষালের যত না কষ্ট হয়েছে, তার চেয়ে ঢের বেশি কষ্ট হয়েছে ওঁর বাবার। ওঁর মন ভাল করার জন্যই মিস্টার ঘোষাল এতটা ইয়ে হয়ে পড়েছেন।’

ফেলুদা ইতিমধ্যে বিকাশবাবুর টেবিলের উপর থেকে ট্রানজিস্টারটা হাতে তুলে নিয়েছে। মাঝারি সাইজের মার্ফি রেডিয়ো, চামড়ার খোলস দিয়ে ঢাকা। ফেলুদা নবটা ধরে ঘোরাতে সুইচের কোনও আওয়াজ হল না। তারপর সেটা উলটো দিকে ঘোরাতে খট্‌ করে একটা শব্দ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ফেলুদার ভুরু কুঁচকে গেল।

‘একী, আপনার রেডিয়ো তো খোলা ছিল।’

‘তাই—তাই বুঝি?’

বিকাশবাবুর চেহারাটা যে ঠিক কী রকম হল সেটা আমার পক্ষে লিখে বোঝানো ভীষণ শক্ত। শুধু এটা পরিষ্কার মনে আছে যে বিকাশবাবু খাটের ডাণ্ডাটায় হেলান দিতে যাচ্ছিলেন, ঠিক সেই সময় সুইচের আওয়াজটা হওয়া মাত্র পিঠ সোজা হয়ে গিয়ে হেলান দেওয়া বন্ধ হয়ে গেল।

এদিকে ফেলুদা রেডিয়োর পিছনে ব্যাটারির খোপের দরজাটা খুলে ফেলেছে। আড়চোখে দেখলাম বিকাশবাবু একটা ঢোক গিললেন। তিনটে ব্যাটারি রেডিয়োটার ভিতর থেকে বেরিয়ে এল।

‘আপনার ব্যাটারি তো লিক করেছে’, ফেলুদা বলল, ‘বেশ কিছুদিন হল এর আয়ু ফুরিয়েছে বলে মনে হচ্ছে।’

বিকাশবাবু চুপ।

‘রেডিয়ো আপনি শোনেন নিশ্চয়ই, কিন্তু গত বেশ কদিন আর শোনা হয়নি। কেন বলুন তো?’

কোনও উত্তর নেই।

‘আপনি যদি কিছু না বলেন, তা হলে আমাকেই বলতে দিন।’ ফেলুদার গলায় আমার খুব চেনা একটা ধারালো সুর শুনতে পাচ্ছি। —‘সেদিন মগনলালের কথা শোনার লোভ আপনি সামলাতে পারেননি, তাই না? রেডিয়ো কমিয়ে দিয়ে আপনি নিঃশব্দে চলে গিয়েছিলেন ওই দক্ষিণের বারান্দায়। দরজার পাশে আড়ালে দাঁড়িয়ে আপনি বৈঠকখানায় কথাবার্তা শুনেছিলেন। আপনি জানতেন মগনলাল মিস্টার ঘোষালকে শাসিয়ে গেছেন। আপনি জানতেন মগনলাল মিস্টার ঘোষালকে ত্রিশ হাজার টাকা অফার করেছেন গণেশটার জন্য। তাই নয় কি?’

বিকাশবাবুর মাথা হেঁট হয়ে গেছে। সেই অবস্থাতেই তিনি মাথা নেড়ে ‘হ্যাঁ’ বললেন।

‘এবার আরেকটা প্রশ্নের ঠিক-ঠিক জবাব দিন তো’—ফেলুদা ব্যাটারিগুলো টেবিলের নীচে ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটে ফেলে দিয়ে উঠে দাঁড়াল। ‘যেদিন অম্বিকাবাবুর ঘরের সিন্দুক থেকে গণেশ চুরি যায়—অর্থাৎ পনেরোই অক্টোবর—সেদিন আপনি সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা থেকে সাড়ে আটটা পর্যন্ত কী করছিলেন? আপনি রেডিয়ো শোনেননি, কারণ রেডিয়ো তার পাঁচ দিন আগেই—’

‘বলছি, বলছি—আমাকে বলতে দিন!’—বিকাশবাবু যেন মরিয়া হয়ে বলে উঠলেন। ফেলুদা কথা বন্ধ করে বিকাশবাবুর দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে রইল। বিকাশবাবু দম নিয়ে যেন বেশ কষ্টে তাঁর কথাগুলো বলতে শুরু করলেন—

‘সেদিন মগনলালের হুমকি শোনার পর থেকেই আমার মনে ভীষণ একটা উৎকণ্ঠার ভাব ছিল। রোজই মনে হচ্ছিল একবার সিন্দুক খুলে দেখি গণেশটা আছে কি না। কিন্তু সে সুযোগ প্রথম এল যেদিন মিস্টার ঘোষাল মছলিবাবাকে দেখতে গেলেন। উনি যাবার দশ মিনিটের মধ্যেই আমি অম্বিকাবাবুর ঘরে যাই। দেরাজ থেকে চাবি বার করি, করে সিন্দুক খুলি।’

‘তারপর?’

ফেলুদাকে প্রশ্নটা করতেই হল, কারণ বিকাশবাবুর কথা থেমে গিয়েছিল।

‘সিন্দুক খুলে কী দেখলেন আপনি?’ ফেলুদা আবার প্রশ্ন করল।

বিকাশবাবু ফ্যাকাশে মুখ করে ফেলুদার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘দেখলাম—গণেশ নেই।’

‘গণেশ নেই?’ অবিশ্বাসে ফেলুদার ভুরু ভীষণভাবে কুঁচকে গেছে।

বিকাশবাবু বললেন, ‘আমি জানি আপনি আমার কথা বিশ্বাস করবেন না কিন্তু আমি শপথ করে বলছি যে সেদিন আমি সিন্দুক খোলার আগেই গণেশ চুরি হয়ে গিয়েছিল। আমি যে কেন এ কথাটা এতদিন আপনাকে বলিনি সেটার কারণ আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন মিস্টার মিত্তির। সত্যি বলতে কী, আমি যে কী অদ্ভুত মানসিক অবস্থার মধ্যে রয়েছি সেটা আপনাকে বলে বোঝাতে পারব না।’

ফেলুদা আবার চায়ের কাপটা তুলে নিয়েছে।

‘ও সিন্দুকটা কি এমনিতে প্রায়ই খোলা হয়?’ ফেলুদা প্রশ্ন করল।

‘একেবারেই হয় না। আমি যতদূর জানি, এবার উমানাথবাবু আসার পরের দিনই একবার খোলা হয়েছিল—কিছু পুরনো দলিল নিয়ে বাপ আর ছেলের মধ্যে আলোচনা ছিল। এ ছাড়া খুব সম্ভবত আর একদিনও খোলা হয়নি।’

ফেলুদা চুপ করে বসে আছে। বিকাশবাবুর অবস্থা খুবই শোচনীয় বলে মনে হচ্ছে। প্রায় দু মিনিট এইভাবে থাকার পর ভদ্রলোক আর না পেরে বললেন, ‘আপনি কি আমার কথা বিশ্বাস করলেন না মিস্টার মিত্তির?’

ফেলুদার গলার স্বর এবার রীতিমতো রুক্ষ।

‘আই অ্যাম সরি মিস্টার সিংহ—কিন্তু যারা প্রথমবারেই সত্যি কথাটা বলেন না, তাঁদের উপর থেকে সন্দেহটা সহজে মুছে ফেলা যায় না।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *