০৬. জয় ধাবা বিশ্বনাথ

‘জয় বাবা বিশ্বনাথ!’

লালমোহনবাবুর মুখের দিকে চাইতে ভরসা পাচ্ছিলাম না, তবে ওর গলার আওয়াজেই ওর মনের ভাবটা বেশ বুঝতে পারলাম।

‘আপনার এত ভরসা বিশ্বনাথের উপর?’

ফেলুদা এখনও কী করে হালকাভাবে কথা বলছে জানি না।

‘জয় বাবা ফেলুনাথ!’

‘দ্যাটস বেটার।’

এত উঁচু উঁচু পাথরের ধাপওয়ালা এত অন্ধকার সিঁড়ি এর আগে কখনও দেখিনি। যে লোকটা ডাকতে এসেছিল তার হাতে আলোটালো কিছু নেই। লালমোহনবাবুকে বার দু-এক ‘ব্ল্যাক হোল’ কথাটা বলতে শুনলাম। ছেচল্লিশ ধাপ সিঁড়ি উঠে তিনতলায় পৌঁছলাম আমরা। লোকটা এবার সামনের একটা দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকে গেল। আমরাও ঢুকলাম তার পিছন পিছন।

একটা ঘর, তারপর একটা সরু প্যাসেজ, আর তারপর আরেকটা ঘর পেরিয়ে একটা অন্ধকার বারান্দা দিয়ে বেশ খানিকদূর গিয়ে একটা নিচু দরজা পড়ল। লোকটা এক পাশে সরে দাঁড়িয়ে আমাদের দিকে ফিরে ডান হাত বাড়িয়ে দরজার ভিতর যাবার জন্য ইশারা করল। কথা না বললেও লোকটার মুখ থেকে বিড়ির কড়া গন্ধ পাচ্ছিলাম।

যে ঘরটায় ঢুকলাম সেটা যে কত বড় সেটা তক্ষুনি বোঝা গেল না, কারণ প্রথমে ঢুকে কয়েকটা রঙিন কাচ ছাড়া আর কিছুই দেখা গেল না। বুঝলাম কাচগুলো জানালায় লাগানো বলে তাতে বাইরের আলো পড়েছে।

‘নোমোস্কার মিস্টার মিটার।’

খসখসে সগম্ভীর দানাদার গলাটা আমাদের সামনে থেকেই এসেছে। এবারে চোখ অন্ধকারে সয়ে এসেছে। একটা সাদা গদি দেখতে পাচ্ছি—আমাদের সামনে কিছুটা দূরে মেঝেতে বিছানো রয়েছে। তার উপরে চারটে সাদা তাকিয়া। একটায় ভর দিয়ে আড় হয়ে বসে আছে একটা লোক, যার শুধু পিছন দিকটা আমরা সেদিন দেখেছি মছলিবাবার ভক্তদের মধ্যে।

একটা খুট শব্দের সঙ্গে সিলিং-এ একটা বাতি জ্বলে উঠল। পিতলের বলের গায়ে ফুটো ফুটো জাফ্রির কাজ—সেটা হল বাতিটার শেড। ঘরের চারদিক এখন বুটিদার আলোর নকশায় ভরে গেছে।

এখন সব কিছু দেখতে পাচ্ছি। মগনলাল মেঘরাজের ভুরুর নীচে গর্তে বসা চোখ, তার নীচে ছোট্ট থ্যাবড়া নাক, আর তার নীচে এক জোড়া ঠোঁট, যার উপরেরটা পাতলা আর নীচেরটা পরু। ঠোঁটের নীচে থুতনিটা সোজা নেমে এসেছে একেবারে আদ্দির পাঞ্জাবির গলা অবধি। পাঞ্জাবির বোতামগুলো হিরের হলে আশ্চর্য হব না। এ ছাড়া ঝলমলে পাথর আছে দশটা আঙুলের আটটা আংটিতে, যেগুলো এখন নমস্কারের ভঙ্গিতে এক জায়গায় জড়ো হয়ে আছে।

‘বোসুন আপনারা। দাঁড়িয়ে কেনো?’

দিব্যি বাংলা।

‘চাই তো গদিতে বসুন। আর নয়তো চেয়ার আছে। যাতে ইচ্ছা বসুন।’

চেয়ারগুলো নিচু। পরে ফেলুদা বলেছিল ওগুলো নাকি গুজরাটের। আমরা গদিতে না বসে চেয়ারেই বসলাম—ফেলুদা একটাতে আর আমি আর লালমোহনবাবু আরেকটাতে।

মগনলাল সেইভাবেই কাত হয়ে থেকে বললেন, ‘আপনার সঙ্গে আলাপ করার ইচ্ছা ছিল, ভাবছিলাম আপনাকে ইনভাইট করে নিয়ে আসব। ভগওয়ানের কৃপায় আপনি নিজেই এসে গেলেন।’ তারপর একটু হেসে বললেন, ‘আপনি আমাকে চিনেন না, কিন্তু হামি আপনাকে চিনি।’

‘আপনার নামও আমি শুনেছি’, ফেলুদা পালটা ভদ্রতা করে বলল।

‘নাম বলছেন কেন, বদনাম বলুন। সত্যি কথা বলুন!’

মগনলাল কথাটা বলে হো হো করে হেসে উঠলেন, আর তার ফলে তাঁর পানখাওয়া দাঁতগুলোতে আলো পড়ে চকচক করে উঠল। ফেলুদা চুপ করে রইল। মগনলালের মাথাটা আমার দিকে ঘুরে গেল।

‘ইনি আপনার ব্রাদার?’

‘কাজিন।’

‘আর ইনি? আঙ্কল?’

মগনলালের চোখে হাসি, চোখ ঘুরে গেছে জটায়ুর দিকে।

‘ইনি আমার বন্ধু। লালমোহন গাঙ্গুলী।’

‘ভেরি গুড! লালমোহন, মোহনলাল, মগনলাল—সব লাল, লালে লাল—এঁ? কী বলেন?’

লালমোহনবাবু কিছুক্ষণ থেকে হাঁটু নাচিয়ে ‘আমি একটুও নাভার্স হইনি’, ভাব দেখানোর চেষ্টা করছিলেন, এবার মগনলালের কথাটা শুনেই হাঁটু দুটো খট খট শব্দ করে পরস্পরের সঙ্গে লাগিয়ে নাচানো বন্ধ হয়ে গেল।

এবার মগনলালের বাঁ হাতটা একটা থাপ্পড়ের ভঙ্গিতে তাকিয়ার পিছনে নামাতেই ঠং করে একটা কলিং বেল বেজে উঠে লালমোহনবাবুকে বিষম খাইয়ে দিল।

‘গলা সুখিয়ে গেলো?’ বললেন মগনলাল।

বাঁ দিকে তাকিয়ে দেখি যে লোকটা আমাদের উপরে নিয়ে এসেছিল সে আবার দরজার মুখে এসে দাঁড়িয়েছে।

‘সরবৎ লাও’, হুকুম করলেন মগনলাল।

এখন ঘরের সব জিনিসই স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। মগনলালের পিছনের দেওয়ালে দেবদেবীর ছবির গ্যালারি। ডান দিকে দেওয়ালের সামনে দুটো স্টিলের আলমারি। গদির উপরে কিছু খাতাপত্র, একটা বোধ হয় ক্যাশবাক্স, একটা লাল রঙের টেলিফোন, একটা হিন্দি খবরের কাগজ। এ ছাড়া তাকিয়ার ঠিক পাশেই রয়েছে একটা রুপোর পানের ডিবে আর একটা রুপোর পিকদান।

‘ওয়েল মিস্টার মিত্তির’—মগনলালের স্থির দৃষ্টিতে আর হাসির নামগন্ধ নেই—‘আপনি বনারস হলিডের জন্যে এসেছেন?’

‘সেটাই মূল উদ্দেশ্য ছিল।’

ফেলুদা সটান মগনলালের চোখের দিকে চেয়ে কথা বলছে।

‘তা হলে—আপনি—টাইম—ওয়েস্ট—করছেন—কেন?’

প্রত্যেকটা কথা ফাঁক ফাঁক আর স্পষ্ট করে বলা।

‘সারনাথ দেখেছেন? রামনগর দেখেছেন? দুর্গাবাড়ি, মানমন্দির, হিন্দু ইউনিভার্সিটি, বেণীমাধোব ধ্বজা—এ-সব কিছুই দেখলেন না, আজ বিশ্বনাথজীর দরওয়াজার সামনে গেলেন, কিন্তু ভিতরে ঢুকলেন না, কচৌরি গলিতে মিঠাই খেলেন না…ঘোষালবাড়িতে কী কাম আপনার? আমার বজরা আছে আপনি জানেন? চৈতি ঘাটসে অসসি ঘাট টিরিপ দিয়ে দেবো আপনাকে, আপনি চলে আসুন। গঙ্গার হাওয়া খেয়ে আপনার মনমেজাজ খুশ হয়ে যাবে।’

‘আপনি ভুলে যাচ্ছেন’—ফেলুদার গলা এখনও স্থির, যাকে বলে নিষ্কম্প—‘যে আমি একজন পেশাদারি গোয়েন্দা। মিস্টার ঘোষাল আমাকে একটা কাজের ভার দিয়েছেন। সে কাজটা শেষ না করে ফুর্তি করার কোনও প্রশ্ন আসে না।’

‘কতো আপনার ফি?’

ফেলুদা প্রশ্নটা শুনে কয়েক সেকেন্ড চুপ করে রইল। তারপর বলল, ‘দ্যাট ডিপেন্ডস—’

‘এই নিন।’

তাজ্জব, দম-বন্ধ-করা ব্যাপার। মগনলাল ক্যাশবাক্স খুলে তার থেকে একতাড়া একশো টাকার নোট বার করে ফেলুদার দিকে এগিয়ে দিয়েছে।

ফেলুদার চোয়াল শক্ত হয়ে গেল।

‘বিনা পরিশ্রমে আমি পারিশ্রমিক নিই না মিস্টার মেঘরাজ।’

‘বাহরে বাঃ!’—মগনলালের পান-খাওয়া দাঁত আবার বেরিয়ে গেছে—‘আপনি পরিশ্রম করে কী করবেন? যেখানে চোরিই হল না, সেখানে আপনি চোর পাকড়াবেন কী করে মিস্টার মিত্তির?’

‘চুরি হল না মানে?’—এবারে ফেলুদাও অবাক—‘কোথায় গেল সে জিনিস?’

‘সে জিনিস তো উমানাথ আমার কাছে বিক্রি করে দিয়েছে। তিস হাজার ক্যাশ দিয়ে আমি সে জিনিস কিনে নিয়েছি।’

‘কী বলছেন আপনি উলটো-পালটা?’

ফেলুদার বেপরোয়া কথায় আমার হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে গেল। সিলিং-এর বাতিটা থেকে একটা আলোর নকশা লালমোহনবাবুর নাক আর ঠোঁটের উপর পড়েছে। বেশ বুঝলাম ওঁর ঠোঁট শুকিয়ে ফ্যাকাশে হয়ে গেছে।

মগনলাল ওর শেষ কথাটা বলে হেসে উঠেছিল, ফেলুদা কথাটা বলতেই মনে হল একটা হাসির রেকর্ডের উপর থেকে কে যেন সাউন্ড-বক্সটা হঠাৎ তুলে নিল। মগনলালের মুখ এখন কালবৈশাখীর মেঘের মতো কালো, আর চোখ দুটো যেন কোটর থেকে বেরিয়ে এসে বুলেটের মতো ফেলুদাকে বিঁধতে চাইছে।

‘উলটো-পালটা কে বলে জানেন? উলটো-পালটা বলে উলটো-পালটা আদমি। মগনলাল বলে না। উমানাথের বেপার কী জানেন আপনি? তার বেওসার বিষয় কিছু জানেন? উমানাথের দেনা কত জানেন? উমা নিজে আমাকে ডেকে পাঠাল জানেন? উমা নিজে সিন্দুক থেকে গণপতি চোরি করেছে জানেন? আপনি চোর কী ধরবেন মিস্টার মিত্তির—চোর তো আপনার মক্কেল নিজে!’

ফেলুদা গম্ভীর গলায় বলল, ‘আপনি কী বলতে চাচ্ছেন সেটা পরিষ্কার হচ্ছে না মগনলালজী। নিজের জিনিস চুরি করবার দরকারটা কোথায়? সোজা সিন্দুক থেকে বার করে আপনার হাতে তুলে দিয়ে টাকাটা নিয়ে নিলেই তো হত।’

‘কার সিন্দুক? সিন্দুক তো ওর বাবার।’

‘কিন্তু গণেশটা তো—’

‘গণেশ কার? ঘোষাল ফ্যামিলির। ফ্যামিলি তিন জায়গায় ভাগ হয়ে গেছে। বড় ছেলে বিলাইতে ডাকটর—ছোট ছেলে উমানাথ কলকাতায় কেমিক্যালস—আর বাবা বেনারসের উকিল—এখুন প্র্যাক্টিস ছেড়ে দিয়েছেন। গণপতি ছিল অল অ্যালং বাবার কাছে। গণপতির ইনফ্লুয়েন্স দেখবেন তো ওনাকে দেখুন। কতো টাকা কামায়েছেন দেখুন, মেজাজ দেখুন, আরাম দেখুন। তার সিন্দুক থেকে গণেশ বার করে উমানাথ আমাকে বিক্রি করল—সে কথা সে বাপকে জানাবে কী করে? তার সাহস কোথায়?’

ফেলুদা ভাবছে। সে কি মগনলালের কথা বিশ্বাস করছে?

‘সিন্দুক থেকে কবে গণেশ নিলেন উমানাথবাবু?’

মগনলাল তাকিয়াটা আরও বুকের কাছে টেনে নিল।

‘শুনুন—অক্টোবর দশ তারিখ আমাকে ডেকে পাঠাল উমা। সেদিন কথা হল। আমি এগ্রি করলাম। আমার লাক ভি কুছু খারাপ যাচ্ছে—আপনি হয়তো জানেন। লেকিন আমার টাকার অভাব এখুনো হয়নি। আর উ গ্রিন ডায়মন্ডকে কত দাম জানেন? উমা জানে না। আমি যা পে করলাম তার চেয়ে অনেক বেশি। এনিওয়ে—দশ অক্টোবর কথা হল। উমা বলল আমাকে দো-তিন দিন টাইম দাও। আমি বললাম নাও। ফিফটিনথ অক্টোবর ইভনিং উমা আবার ফোন করল। বলল গণেশ আমার হাথে এসে গেছে। আমি বললাম তুমি চলে এসো মছলিবাবা দর্শন করতে। উমা এসে গেল। আমি এসে গেলাম। আমার হাথে ব্যাগ, উর পাকিটে ব্যাগ। উর ব্যাগে গণপতি, আমার ব্যাগে তিন-সও হান্ড্রেড রুপি নোটস। দর্শন ভি হল, ব্যাগ বদল ভি হল। ব্যস, খতম।’

মগনলাল যদি সত্যি কথা বলে থাকে, তা হলে বলতে হবে উমানাথবাবু আমাদের সাংঘাতিক ভাঁওতা দিয়েছেন আর নিজের মান বাঁচানোর জন্য একটা চুরির গল্প খাড়া করে ফেলুদাকে তদন্ত চালাতে বলেছেন। অবশ্যি সেই সঙ্গে পুলিশকেও ভাঁওতা দিয়েছেন। পুরো ব্যাপারটাই ফেলুদার পক্ষে পণ্ডশ্রম হবে, আর পকেটে পয়সাও আসবে না। কিন্তু মগনলালই বা ফেলুদার প্রতি এত সদয় হবে কেন?

আমি প্রায় চমকে উঠলাম যখন ফেলুদা ঠিক এই প্রশ্নটাই মগনলালকে করে বসল। মগনলাল তার চোখ দুটোকে আরও ছোট করে একটু সোজা হয়ে বসে বলল, ‘কারণ আমি জানি আপনি বুদ্ধিমান লোক। অর্ডিনারি বুদ্ধি না, একস্ট্রা-অর্ডিনারি বুদ্ধি। আপনি আরও কিছুদিন তদন্ত করলে যদি আসল বেপারটা বুঝে ফেলেন, তখন উমারও মুশকিল, আমারও মুশকিল। আমাদের এই লেনদেনের বেপারটা তো ঠিক সিধা-সাফা নয়—সে তো আপনি বুঝেন মিস্টার মিত্তির!’

ফেলুদা চুপ করে আছে। তিন গেলাস সবুজ রঙের সরবত এসেছে—আমাদের সামনে টেবিলের উপর রাখা। ফেলুদা একটা গেলাস হাতে তুলে নিয়ে বলল, ‘গণেশটা তা হলে আপনার কাছেই আছে। সেটা একবার দেখা যায় কি? যেটার সঙ্গে এত রকম ইতিহাস জড়িত, সেটা একবার দেখতে ইচ্ছা হওয়াটা স্বাভাবিক এটা আপনি নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন।’

মগনলাল মাথা নেড়ে বললেন, ‘ভেরি সরি মিস্টার মিত্তির, আপনি তো জানেন আমার এ বাড়িতে একবার রেড হয়ে গেছে। ও জিনিস কী করে আমি এখানে রাখি বলুন। ওটা আমাকে একটা সেফ জায়গায় পাঠিয়ে দিতে হয়েছে।’

ফেলুদার পরের কথাতে ওর বেপরোয়া ভাবটা আমার কাছে আবার নতুন করে ফুটে বেরোল।

‘তা পাঠিয়েছেন বেশ করেছেন, কিন্তু আপনি সত্যি বলছেন কি না জানার জন্যও তো আমাকে অনুসন্ধান চালিয়ে যেতে হবে মগনলালজী!—তাতে যদি আপনার কথা সত্যি বলে প্রমাণিত হয় তা হলে তো কথাই নেই, কিন্তু ধরুন যদি তা না হয়?’

মগনলালের তলার ঠোঁটটা বিশ্রীভাবে নীচের দিকে ঝুলে পড়ল, আর তার ভুরুজোড়া আরও নেমে এসে চোখ দুটোকে অন্ধকারে ঠেলে দিল।

‘আপনি আমার কথা বিসোয়াস করছেন না?’

লালমোহনবাবু সরবতের গেলাসটা তুলেই আবার ঠক করে নামিয়ে রাখলেন। ফেলুদার হাতের গেলাস আস্তে আস্তে ঠোঁটের কাছে চলে গেল। সরবতে একটা চুমুক দিয়ে একদৃষ্টে মগনলালের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আপনি নিজেই বললেন আপনাকে আমি চিনি না। কী করে আশা করেন প্রথম আলাপেই আমি আপনার সব কথা বিশ্বাস করব? আপনি নিজেই কি সব সময় নতুন লোকের কথা বিশ্বাস করেন—বিশেষ করে যখন সে লোক দিনকে রাত করে দেয়?’

মগনলাল সেইভাবেই চেয়ে আছে ফেলুদার দিকে। একটা ঘড়ির টিক্ টিক্‌ শব্দ শুনতে পাচ্ছি, যদিও সেটা কোথায় আছে তা জানি না।

এবার মগনলালের ডান হাতটা আবার ফেলুদার দিকে এগিয়ে এল—তাতে এখনও সেই নোটের তাড়া।

‘তিন হাজার আছে এখানে মিস্টার মিত্তির। আপনি নিন এ টাকা। নিয়ে আপনি বিশ্রাম করুন, স্ফূর্তি করুন আপনার কাজিন আর আঙ্কলকে নিয়ে।’

‘না মগনলালজী, ওভাবে আমি টাকা নিই না।’

‘আপনি কাজ চালিয়ে যাবেন?’

‘যেতেই হবে।’

‘ভেরি গুড।’

কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গে মগনলালের হাত আবার কলিং বেলের উপর আছড়ে পড়ল। সেই লোকটা আবার দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। মগনলাল লোকটার দিকে না তাকিয়ে বলল, ‘অর্জুনকো বোলাও—আউর তেরা নম্বর বকস লাও—আউর তক্তা।’

লোকটা চলে গেল। কী যে আনতে গেল তা ভগবান জানে।

মগনলাল এবার হাসি হাসি মুখ করে লালমোহনবাবুর দিকে চাইলেন। লালমোহনবাবুর ডান হাত এখনও সরবতের গেলাসটাকে ধরে আছে, যদিও সে গেলাস টেবিল থেকে এক ইঞ্চিও ওঠেনি।

‘কেয়া মোহনভোগবাবু, আমার সরবত পসিন্দ হল না?’

‘না না—বৎসর—ইয়ে, সরবত—মানে…’ আরও বললে আরও কথার গণ্ডগোল হয়ে যাবে মনে করেই বোধহয় লালমোহনবাবু গেলাসটা তুলে ঢক ঢক করে দু ঢোক সরবত খেয়ে ফেললেন।

‘আপনি ঘাবড়াবেন না মোহনবাবু—উ সরবতে বিষ নেই।’

‘না না—’

‘বিষ আমি খারাপ জিনিস বলে মনে করি।’

‘নিশ্চয়ই—বিষ ইজ’—আরেক ঢোক সরবত—‘ভেরি ব্যাড।’

‘তার চেয়ে অন্য জিনিসে কাম দেয় বেশি।’

‘অন্য জিনিস?’

‘কী জিনিস সেটা এবার আপনাকে দেখাব।’

‘খ্যাখ্‌!’

‘কী হল মোহনভোগবাবু?’

‘বিষ—মানে বিষম লাগল।’

বাইরে পায়ের শব্দ।

একটা অদ্ভুত প্রাণী এসে ঘরে ঢুকল। সেটা মানুষ তো বটেই, কিন্তু এরকম মানুষ আমি কখনও দেখিনি। হাইটে পাঁচ ফুটের বেশি না, রোগা লিকলিকে শরীরের মাথা থেকে পা পর্যন্ত শিরা-উপশিরায় গিজগিজ করছে, মাথার চুলে কদম ছাঁট, কান দুটো খাড়া হয়ে বেরিয়ে আছে, চোখ দুটো দেখলে মনে হয় নেপালি, কিন্তু নাকটা খাঁড়ার মতো উঁচু আর ছুঁচোলো। আরও একটা লক্ষ করার বিষয় এই যে, লোকটার সারা গায়ে একটাও লোম নেই। হাত পা আর বুকের অনেকখানি এমনিতেই দেখা যাচ্ছে, কারণ লোকটা পরেছে একটা শতচ্ছিন্ন হাতকাটা গেঞ্জি আর একটা বেগুনি রঙের ময়লা হাফ প্যান্ট।

লোকটা ঘরে ঢুকেই মগনলালের দিকে ফিরে একটা স্যালুট করল। তারপর হাতটা পাশে নামিয়ে কোমরটাকে একটু ভাঁজ করে সামনের দিকে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে রইল।

এবার ঘরে আরেকটা জিনিস ঢুকল। এটাই বোধহয় তেরো নম্বর বাক্স। দুটো লোক বাক্সটা বয়ে এনে গদির সামনে মেঝেতে রাখল। রাখার সময় একটা ঝনাৎ শব্দে বুঝলাম ভিতরে লোহা বা পিতলের জিনিসপত্র আছে।

আরও দুটো লোক এবার একটা বেশ বড় কাঠের তক্তা নিয়ে এসে আমাদের পিছনের দরজাটা বন্ধ করে তার গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড় করিয়ে দিল। এতক্ষণে মগনলাল আবার মুখ খুললেন।

‘নাইফ-থ্রোইং জানেন কী জিনিস মিস্টার মিত্তির? সার্কাসে দেখেছেন কখনও?’

‘দেখেছি।’

সার্কাস আমি দেখেছি, কিন্তু নাইফ-থ্রোইং দেখিনি। ও-ই একবার বলেছিল ব্যাপারটা কীরকম হয়। একজন লোককে একটা খাড়া করা তক্তার সামনে দাঁড় করিয়ে দূর থেকে আরেকটা লোক তার দিকে একটার পর একটা ছোরা এমনভাবে মারতে থাকে যে, সেগুলো লোকটার গায়ে না লেগে তাকে ইঞ্চিখানেক বাঁচিয়ে তক্তার উপর গিয়ে বিঁধতে থাকে। সে নাকি এমন সাংঘাতিক খেলা যে দেখে লোম খাড়া হয়ে যায়। সেই খেলাই আজ দেখাবে নাকি এই অর্জুন?

তেরো নম্বর বাক্স খোলা হয়েছে। ঘরে আরও দুটো বাতি জ্বলে উঠল। বাক্সে বোঝাই করা কেবল ছোরা আর ছোরা। সেগুলো সবকটা ঠিক একরকম দেখতে—সব কটার হাতির দাঁতের হাতল, সব কটায় ঠিক একরকম নকশা করা।

‘হরবনসপুরের রাজার প্রাইভেট সার্কাস ছিল, সেই সার্কাসেই অর্জুন নাইফ থ্রোইং-এর খেল দেখাত। এখুন ও হামার প্রাইভেট সার্কাসে খেল দেখায়—হেঃ হেঃ হেঃ হেঃ…’

বাক্স থেকে গুনে গুনে বারোটা ছোরা বার করে আমাদের সামনেই একটা শ্বেতপাথরের টেবিলের উপর সাজিয়ে রাখা হয়েছে একটা খোলা জাপানি হাতপাখার মতো করে।

‘আসুন আঙ্কল।’

আঙ্কল কথাটা শুনে লালমোহনবাবু তিনটে জিনিস একসঙ্গে করে ফেললেন—হাতের ঝটকায় গেলাসের অর্ধেক সরবত মাটিতে ফেললেন, পেটে ঘুঁষি খাবার মতো করে সোজা থেকে সামনের দিকে ঝুঁকে গেলেন, আর ‘অ্যাঁ’ বলতে গিয়ে ‘গ্যা’ বলে ফেললেন। পরে জিজ্ঞেস করাতে বলেছিলেন উনি নাকি ‘অ্যাঁ’ আর ‘গেলুম’ একসঙ্গে বলতে গিয়ে গ্যাঁ বলেছিলেন।

এবার ফেলুদার ইস্পাত-কঠিন গলার স্বর শোনা গেল।

‘ওকে ডাকছেন কেন?’

মগনলালের হাসির চোটে তার কনুই আরও ইঞ্চি তিনেক কিয়ার ভিতর ঢুকে গেল।

মগনলালের হাসির চোটে তার কনুই আরও ইঞ্চি তিনেক কিয়ার ভিতর ঢুকে গেল।

‘ওকে ডাকব না তো কি আপনাকে ডাকব মিস্টার মিত্তির? আপনি তক্তার সামনে দাঁড়ালে খেল দেখবেন কী করে?…আপনি এ ব্যাপারে কিছু বলবেন না মিস্টার মিত্তির। আমার কথা বিসোয়াস না করে আপনি আমাকে অনেক অপমান করলেন। আপনি জানবেন যে চাকু ছাড়াও অন্য হাতিয়ার আছে আমার কাছে। ওই ঘুলঘুলির দিকে দেখুন—দো ঘুলঘুলি, দো পিস্তল আপনার দিকে পয়েন্ট করা আছে। আপনি ঝামেলা না করেন তো আপনার কোনও ক্ষতি হবে না। আপনার বন্ধুর ভি কোনও ক্ষতি হবে না। অর্জুনের জবাব নেই, আপনি দেখে নেবেন।’

ঘুলঘুলির দিকে চাইবার সাহস আমার নেই। লালমোহনবাবুর দিকেও চাইতে ইচ্ছা করছিল না, কিন্তু চাপা মিহি গলায় ওর একটা কথা শুনে না চেয়ে পারলাম না। ভদ্রলোক হাতল ধরে চেয়ার ছেড়ে উঠতে উঠতে কথাটা বলছেন, তার ফাঁকে ফাঁকে ওঁর হাঁটুতে হাঁটু লেগে খটখট শব্দ হচ্ছে।

‘বেঁচে থাকলে…পপ্‌-প্লটের আর…চি-হি-হিন্তা নেই।’

দুজন লোক এসে লালমোহনবাবুকে দু দিক থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে তক্তাটার সামনে দাঁড় করিয়ে দিল। লালমোহনবাবু চোখ বুজলেন।

তারপর আমার পিছন দিকে যে জিনিসটা ঘটল সেটা আর আমি দেখতে পারিনি। ফেলুদা নিশ্চয়ই দেখেছিল, কারণ না দেখলে নিশ্চয়ই ঘুলঘুলি থেকে পিস্তলের গুলি এসে ওর বুকে বিঁধত। আমার শব্দ শুনেই রক্ত বরফ হয়ে গিয়েছিল। আমার চোখ ছিল সামনের টেবিলের দিকে। তার উপর থেকে একটা একটা করে ছুরি তুলে নিচ্ছে অর্জুনের হাত, আর তার পরেই সে ছুরি ঘ্যাঁচাং শব্দ করে তক্তার কাঠ ভেদ করে ঢুকছে।

ক্রমে শেষ ছুরিটা তোলা হয়ে গিয়ে টেবিল খালি হয়ে গেল, আর ঘ্যাঁচাং শব্দ, আর অর্জুনের ফোঁস ফোঁস করে দম ফেলার শব্দ, আর মগনলালের ঘন ঘন ‘বহুৎ আচ্ছা’ থেমে গিয়ে রইল শুধু অদৃশ্য ঘড়ির টিক টিক আর বিশ্বনাথের ঘণ্টার ঢং ঢং শব্দ। আর তার পরে হল এক তাজ্জব কাণ্ড।

লালমোহনবাবু দরজার দিক থেকে ফিরে এসে অর্জুনের হ্যান্ড শেক করে ‘থ্যাঙ্ক ইউ স্যার’ বলেই অজ্ঞান হয়ে হুমড়ি খেয়ে মগনলালের গদির উপর পড়ে সেটার অনেকখানি জায়গা ঘামে ভিজিয়ে চপচপে করে দিলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *