ক্যালকাটা লজের ঠাকুর ফাউল কারিটা দিব্যি রেঁধেছিল। এ ছাড়া রুই মাছের কালিয়া ছিল, রান্নাও ভাল হয়েছিল, কিন্তু লালমোহনবাবু খেলেন না। বললেন, ‘মছলিবাবাকে দেখার পর থেকে আর মাছ খেতে মন চায় না মশাই।’
‘কেন?’ ফেলুদা বলল, ‘খেলেই মনে হবে বাবাকে চিবিয়ে খাচ্ছেন? আপনার কি ধারণা বাবা নিজে মাছ খান না?’
‘খান বুঝি?’
‘শুনলেন তো বাবা জলেই থাকেন বেশির ভাগ সময়। জলে মাছ ছাড়া আর খাবার কী আছে বলুন। মাছেরাও যে মাছ খায় সেটা জানেন?’
লালমোহনবাবু চুপ মেরে গেলেন। আমার বিশ্বাস কাল থেকে উনি আবার মাছ খাবেন।
সারাদিনের নানারকম ঘটনার পর রাত্রে একটা লম্বা ঘুম দেব ভেবেছিলাম, কিন্তু খানিকটা ব্যাঘাত করলেন রুম-মেট জীবনবাবু। জীবনবাবু মোটা, জীবনবাবু বেঁটে, জীবনবাবুর চাপ দাড়ি, আর জীবনবাবু বালিশে মাথা রাখার দশ মিনিটের মধ্যে নাক ডাকতে শুরু করেন। ভদ্রলোক একটা ডাক্তারি কোম্পানির রিপ্রেজেনটেটিভ, দুদিন হল এসেছেন, কালই সকালে চলে যাবেন। ফেলুদার সঙ্গে পরিচয় হবার এক মিনিটের মধ্যে ব্যাগ খুলে কোম্পানির নাম খোদাই করা একটা ডট পেন ফেলুদাকে দিয়ে দিলেন—যদিও সেটা ওকে অদ্বিতীয় গোয়েন্দা বলে চিনতে পারার দরুন কিনা বোঝা গেল না।
পরদিন সকালে সাড়ে সাতটার মধ্যে আমরা তিনজন চানটান করে চা ডিম রুটি খেয়ে রেডি। বেরোবার মুখে নিরঞ্জনবাবুর সঙ্গে দেখা হল। ফেলুদা দুটো আজেবাজে কথার পর জিজ্ঞেস করল, ‘মগনলাল মেঘরাজের বাড়িটা কোথায় জানেন?’
‘মেঘরাজ? যদ্দূর জানি ওর দুটো বাড়ি আছে শহরে, দুটোই একেবারে হার্ট অফ কাশীতে। একটা বোধহয় জ্ঞানবাপীর উত্তর দিকের গলিটায়। আপনি ওখানে কাউকে জিজ্ঞেস করলেই দেখিয়ে দেবে। পরম ধার্মিক তো, তাই একেবারে খোদ বিশ্বনাথের ঘণ্টা শুনতে শুনতে টাকার হিসেব করে!’
নিরঞ্জনবাবুর কাছ থেকে আরেকটা খবর পেলাম। মছলিবাবা নাকি আর ছদিন আছেন শহরে। কথাটা শুনে ফেলুদা শুধু ওর একপেশে হাসিটা হাসল, মুখে কিছু বলল না।
ঘড়ি ধরে আটটার সময় আমরা শংকরী নিবাসের গেটের সামনে গিয়ে হাজির হলাম। ত্রিলোচনের চেহারাটা রাত্রে ভাল করে দেখিনি, আজ দিনের আলোতে গালপাট্টার বহর দেখে বেশ হক্চকিয়ে গেলাম। বয়স সত্তর-টত্তর হবে নিশ্চয়ই, তবে এখনও মেরুদণ্ড একদম সোজা। আমাদের দেখেই হাসির সঙ্গে একটা স্মার্ট স্যালুট ঠুকে গেটটা খুলে দিল।
গাড়িবারান্দার দিকে কিছুদূর এগিয়ে যেতেই বিকাশবাবু বেরিয়ে এলেন।
‘জানালা দিয়ে দেখলাম আপনাদের ঢুকতে।’ ভদ্রলোক বোধহয় সবেমাত্র দাড়ি কামিয়েছেন; বাঁ দিকের জুলপির নীচে এখনও সাবান লেগে রয়েছে। ‘ভেতরে যাবেন? কর্তামশাই কিন্তু রেডি। আপনি ওঁর সঙ্গেই আগে কথা বলবেন তো?’
ফেলুদা বলল, ‘তার আগে আপনার কাছ থেকে কিছু তথ্য জেনে নোট করে নিতে চাই।’
‘বেশ তো, বলুন না কী জানতে চান।’
বিকাশবাবুর কাছ থেকে কতকগুলো তারিখ নোট করে নিয়ে খাতায় যা দাঁড়াল তা এই—
১। মগনলাল উমানাথবাবুর সঙ্গে দেখা করতে আসেন ১০ই অক্টোবর।
২। উমানাথবাবু তাঁর স্ত্রী ও ছেলেকে নিয়ে মছলিবাবা দর্শনে যান ১৫ই অক্টোবর সন্ধে সাড়ে সাতটায়। বাড়ি ফেরেন সাড়ে আটটার কিছু পরে। এই সময়ের মধ্যেই গণেশ চুরি যায়।
৩। ১৫ই অক্টোবর সাড়ে সাতটা থেকে সাড়ে আটটার মধ্যে শংকরীনিবাসে ছিল—উমানাথবাবুর বাবা অম্বিকা ঘোষাল, বিকাশ সিংহ, অম্বিকাবাবুর বেয়ারা বৈকুণ্ঠ, চাকর ভরদ্বাজ, ঝি সৌদামিনী, ঠাকুর নিত্যানন্দ, মালী লক্ষ্মণ, তার বউ আর তাদের একটি সাত বছরের ছেলে, দারোয়ান ত্রিলোচন, প্রতিমার কারিগর শশী পাল ও তার ছেলে কানাই, আর প্রতিমার কাজে জোগান দেবার একজন লোক, নাম নিবারণ। ওই এক ঘণ্টার মধ্যে বাইরে থেকে কেউ না এসে থাকলে বুঝতে হবে এদেরই মধ্যে কেউ না কেউ অম্বিকাবাবুর ঘরে ঢুকে তার টেবিলের দেরাজ থেকে চাবি নিয়ে সিন্দুক খুলে গণেশ বার করে নিয়েছিল।
খাতায় নোট করা শেষ হলে ফেলুদা বিকাশবাবুর দিকে ফিরে বলল, ‘কিছু মনে করবেন না—এ ব্যাপারে তো কাউকে বাদ দেওয়া চলে না, কাজেই আপনাকেও—’
ফেলুদার কথা শেষ হবার আগেই বিকাশবাবু হেসে বললেন, ‘বুঝেছি; এ ব্যাপারটা পুলিশের সঙ্গে এক দফা হয়ে গেছে। আমি সেদিন ওই এক ঘণ্টা সময়টা কী করছিলাম সেটা জানতে চাইছেন তো?’
‘হ্যাঁ—তবে তার আগে একটা প্রশ্ন আছে।’
‘বলুন। —কিন্তু এখানে কেন, আমার ঘরে চলুন।’
বাড়ির সামনের দরজা দিয়ে ঢুকে ডানদিকে দোতলায় যাবার সিঁড়ি, আর বাঁদিকে বিকাশবাবুর ঘর। বাকি কথা ঘরে বসেই হল।
ফেলুদা বলল, ‘আপনি গণেশের কথাটা জানতেন নিশ্চয়ই।’
‘অনেকদিন থেকেই জানি।’
‘মগনলাল যেদিন উমানাথবাবুর সঙ্গে দেখা করতে আসেন সেদিন আপনি বাড়িতে ছিলেন?’
‘হ্যাঁ। আমিই মগনলালকে রিসিভ করে বৈঠকখানায় বসাই। তারপর ভরদ্বাজকে দিয়ে দোতলায় মিস্টার ঘোষালের কাছে খবর পাঠাই।’
‘তারপর?’
‘তারপর আমি নিজের ঘরে চলে আসি।’
‘দুজনের মধ্যে যে কথাকাটাকাটি হয়েছিল সেটা আপনি জানতেন?’
‘না। আমার ঘর থেকে বৈঠকখানার কথাবার্তা কিছু শোনা যায় না। তা ছাড়া আমার ঘরে তখন রেডিয়ো চলছিল।’
‘যেদিন গণেশটা চুরি গেল, সেদিনও কি আপনি আপনার ঘরেই ছিলেন?’
‘বেশির ভাগ সময়। মিস্টার ঘোষালরা যখন বাইরে যান তখন আমি ওঁদের গেট পর্যন্ত পৌঁছে দিই। ওখান থেকে যাই পুজোমণ্ডপে। শশীবাবুর কাজ দেখতে বেশ লাগে। সেদিন ভদ্রলোককে দেখে অসুস্থ মনে হল। জিজ্ঞেস করাতে বললেন শরীরটা ম্যাজম্যাজ করছে। আমি ঘরে এসে ওষুধ নিয়ে ওকে দিয়ে আসি।’
‘হোমিওপ্যাথিক কি? আপনার শেল্ফে দুটো হোমিওপ্যাথির বই দেখছি।’
‘হ্যাঁ, হোমিওপ্যাথিক।’
‘কী ওষুধ জানতে পারি?’
‘পালসেটিলা থার্টি।’
‘ওষুধ দিয়ে ঘরে ফিরে আসেন?’
‘হ্যাঁ।’
‘কী করছিলেন ঘরে?’
‘লখ্নৌ রেডিয়ো থেকে আখতারি বাঈয়ের রেকর্ড দিচ্ছিল—তাই শুনছিলাম।’
‘কতক্ষণ রেডিয়ো শোনেন?’
‘ওটা চালানোই ছিল। আমি ম্যাগাজিন পড়ছিলাম। ইলাস্ট্রেটেড উইকলি।’
‘তারপর মিস্টার ঘোষাল ফেরা না পর্যন্ত আর বাইরে বেরোন নি?’
‘না। বেঙ্গলি ক্লাব কাবুলিওয়ালা থিয়েটার করছে; ওদের তরফ থেকে দুজনের আসার কথা ছিল মিস্টার ঘোষালের সঙ্গে দেখা করার জন্য—বোধহয় প্রধান অতিথি হওয়ার জন্য অনুরোধ করতে। ওদের আসার অপেক্ষায় বসে ছিলাম।’
‘ওরা এসেছিলেন?’
‘অনেক পরে। নটার পরে।’
ফেলুদা দরজা দিয়ে দোতলায় যাবার সিঁড়িটার দিকে দেখিয়ে বললেন, ‘আপনি যেখানে বসেছিলেন সেখান থেকে ওই সিঁড়িটা দেখা যাচ্ছিল কি?’
‘হ্যাঁ।’
‘ওটা দিয়ে কাউকে উঠতে বা নামতে দেখেছিলেন বলে মনে পড়ে?’
‘না। তবে ওটা ছাড়াও আরেকটা সিঁড়ি আছে। পিছন দিকে। জমাদারের সিঁড়ি। সেটা দিয়ে কেউ উঠে থাকলে আমার জানার কথা নয়।’
বিকাশবাবুর সঙ্গে কথা শেষ করে আমরা ভদ্রলোককে সঙ্গে নিয়ে দোতলায় অম্বিকাবাবুর ঘরে গেলাম।
জানালার ধারে একটা পুরনো আরাম কেদারায় বসে বৃদ্ধ ভদ্রলোক নিবিষ্ট মনে স্টেট্সম্যান পড়ছেন। পায়ের আওয়াজ পেয়ে কাগজটা সরিয়ে ঘাড় ফিরিয়ে সোনার চশমার উপর দিয়ে ভ্রূকুটি করে আমাদের দিকে দেখলেন। ভদ্রলোকের মাথার মাঝখানে টাক, কানের দুপাশে ধপধপে সাদা চুল, দাড়ি গোঁফ কামানো, দু চোখের উপর কাঁচাপাকা মেশানো ঘন ভুরু।
বিকাশবাবু আমাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন।
অম্বিকাবাবু মুখ খুলতেই বুঝলাম যে ওঁর দুপাটি দাঁতই ফল্স। কথা বলার সময় কিট্ কিট্ করে আওয়াজ হয়, মনে হয় এই বুঝি দাঁত খুলে পড়ল। প্রথমে সোজা লালমোহনবাবুর দিকে চেয়ে বললেন, ‘আপনারাও পুলিশ নাকি?’ লালমোহনবাবু ভড়কে গিয়ে ঢোক গিলে বললেন, ‘আমি? না না—আমি কিছুই না।’
‘কিছুই না? এ আবার কীরকম বিনয় হল?’
‘না। ইনিই, মানে, গো-গো—’
বিকাশবাবু এগিয়ে এসে ব্যাপারটা পরিষ্কার করে দিলেন।
‘ইনি প্রদোষ মিত্র। গোয়েন্দা হিসেবে খুব নাম-ডাক। পুলিশ তো কিছুই করতে পারল না, তাই মিস্টার ঘোষাল বলছিলেন…’
অম্বিকাবাবু এবার সোজা ফেলুদার দিকে চাইলেন।
‘উমা কী বলেছে? বলেছে গণেশ গেছে বলে ঘোষাল বংশ ধ্বংস হয়ে যাবে। নন্সেন্স। তার বয়স কত। চল্লিশ পেরোয়নি। আমার তিয়াত্তর। ঘোষাল বংশের ইতিহাস সে আমার চেয়ে বেশি জানে? উমা ব্যবসায়ে উন্নতি করেছে সে কি গণেশের দৌলতে? নিজের বুদ্ধিশুদ্ধি না থাকলে গণেশ কী করবে? আর তার যে বুদ্ধি সে কি গণেশ দিয়েছে? সে বুদ্ধি সে পেয়েছে তার বংশের রক্তের জোরে। নাইনটিন টোয়েন্টিফোরে কেমব্রিজে ম্যাথাম্যাটিকস্-এ ট্রাইপস করতে যাচ্ছিল অম্বিকা ঘোষাল—যাকে দেখছ তোমাদের সামনে। যাবার সাতদিন আগে পিঠে কারবাঙ্কল হয়ে যায় যায় অবস্থা। বাঁচিয়ে দিল না হয় গণেশ, কিন্তু বিলেত যাওয়া যে পণ্ড হয়ে গেল চিরকালের জন্যে, তার জন্য কে দায়ী?…উমানাথের ব্যবসা বুদ্ধি আছে ঠিকই, তবে ওর জন্মানো উচিত ছিল একশো বছর আগে। এখন তো শুনছি নাকি কোন এক বাবাজীর কাছে দীক্ষা নেবার মতলব করছে।’
‘তার মানে আপনার গণেশটা যাওয়াতে কোনও আপসোস নেই?’
অম্বিকাবাবু চশমা খুলে তার ঘোলাটে চোখ দুটো ফেলুদার মুখের উপর ফোকাস করলেন।
‘গণেশের গলায় একটা হিরে বসানো ছিল সেটার কথা উমানাথ বলেছে?’
‘তা বলেছেন।’
‘কী হিরে তার নাম বলেছে?’
‘না, সেটা বলেননি।’
‘ওই তো। জানে না তাই বলেনি। বনস্পতি হিরের নাম শুনেছ?’
‘সবুজ রঙের কি?’
ফেলুদার এই এককথায় অম্বিকাবাবু নরম হয়ে গেলেন। দৃষ্টিটা নামিয়ে নিয়ে বললেন, ‘অ, তুমি এ বিষয়ে কিছু জানটান দেখছি। অত্যন্ত রেয়ার হিরে। আমার আপসোস হয়েছে কেন জান? শুধু দামি জিনিস বলে নয়; দামি তো বটেই; ওটার জন্য কত ট্যাক্স দিতে হচ্ছিল শুনলে তোমার মাথা ঘুরে যাবে। আসল কথা হচ্ছে—ইট ওয়জ ও ওয়র্ক অফ আর্ট। এসব লাক্টাক আমি বিশ্বাস করি না।’
‘ওই টেবিলের দেরাজেই কি চাবিটা ছিল?’ ফেলুদা প্রশ্ন করল। অম্বিকাবাবুর আরাম কেদারা থেকে তিন-চার হাত দূরেই দুটো জানালার মাঝখানে টেবিলটা। এটা ঘরের দক্ষিণ দিক। সিন্দুকটা রয়েছে উত্তর-পশ্চিম কোণে। দুটোর মাঝখানে একটা প্রকাণ্ড আদ্যিকালের খাট, তার উপর একটা ছ ইঞ্চি পুরু তোশকের উপর শীতলপাটি পাতা। অম্বিকাবাবু ফেলুদার প্রশ্নের কোনও জবাব না দিয়ে উলটে আরেকটা প্রশ্ন করে বসলেন।
‘আমি সন্ধেবেলা নেশা করি সেটা উমা বলেছে?’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’
ফেলুদা এত নরমভাবে কারুর সঙ্গে কোনওদিন কথা বলেনি। অম্বিকাবাবু বললেন, ‘গণেশ নাকি চাইলে সিদ্ধি দেন; আমি খাই আফিং। সন্ধের পর আমার বিশেষ হুঁশ থাকে না। কাজেই সাতটা থেকে আটটার মধ্যে আমার ঘরে কেউ এসেছিল কি না সে কথা আমাকে জিজ্ঞেস করে ফল হবে না।’
‘আপনার চেয়ার এখন যে ভাবে রাখা রয়েছে, সন্ধেবেলাও কি সেইভাবেই থাকে?’
‘না। সকালে কাগজ পড়ি, তাই জানালা থাকে আমার পিছনে। সন্ধেয় আকাশ দেখি, তাই জানলা থাকে সামনে।’
‘তা হলে টেবিলের দিকে পিঠ করা থাকে। তার মানে ওদিকের দরজা দিয়ে কেউ এলে দেখতেই পাবেন না।’
‘না।’
ফেলুদা এবার টেবিলটার দিকে এগিয়ে গিয়ে খুব সাবধানে টান দিয়ে দেরাজটা খুলল। কোনও শব্দ হল না। বন্ধ করার বেলাতেও তাই।
এবার ও সিন্দুকটার দিকে এগিয়ে গেল। চৌকির উপরে রাখা পেল্লায় সিন্দুকটা প্রায় আমার বুক অবধি পৌঁছে গেছে।
‘পুলিশ নিশ্চয়ই এটার ভিতর ভাল করে খুঁজে দেখেছে?’
বিকাশবাবু বললেন, ‘তা তো খুঁজেইছে, আঙুলের ছাপের ব্যাপারেও পরীক্ষা করে দেখেছে, কিছুই পায়নি।’
অম্বিকাবাবুর ঘরের দরজা দিয়ে বেরোলে ডাইনে পড়ে নীচে যাবার সিঁড়ি, আর বাঁয়ে একটা ছোট্ট ঘর। ঘরটা দিয়ে ডান দিকে বেরিয়ে একটা চওড়া শ্বেত পাথরে বাঁধানো বারান্দা। এটা বাড়ির দক্ষিণ দিক। পুব দিকে বাগানের নিম আর তেঁতুল গাছের মাঝখানের ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে দূরে গঙ্গার জল সকালের রোদে চিক্চিক্ করছে। আমাদের সামনে আর ডাইনে বেনারস শহর ছড়িয়ে আছে। আমি মন্দিরের চুড়ো গুনছি, ফেলুদা বিকাশবাবুকে একটা সিগারেট দিয়ে নিজে একটা মুখে পুরেছে, এমন সময় ফুরফুরে হাওয়ার সঙ্গে উপর দিক থেকে কী যেন একটা জিনিস পাক খেতে খেতে নেমে এসে লালমোহনবাবুর পাঞ্জাবির উপর পড়ল। লালমোহনবাবু সেটা খপ্ করে ধরে হাতের মুঠো খুলতেই দেখা গেল সেটা আর কিছুই না—একটা চুইং গামের র্যাপার।
‘রুক্মিণীকুমার ছাতে আছেন বলে মনে হচ্ছে?’ ফেলুদা বলল।
‘আর কোথায় থাকবে বলুন,’ বিকাশবাবু হেসে বললেন, ‘তার তো এখন বন্দি অবস্থা। আর তা ছাড়া ছাতে তার একটি নিজস্ব ঘর আছে।’
‘সেটা একবার দেখা যায়?’
‘নিশ্চয়ই। সেই সঙ্গে চলুন পিছনের সিঁড়িটাও দেখিয়ে দিই।’
একরকম লোহার সিঁড়ি হয় যেগুলো বাড়ির বাইরের দেয়াল বেয়ে পাক খেয়ে উপরে উঠে যায়। এটা দেখলাম সেরকম সিঁড়ি নয়। এটা ইঁটের তৈরি, আর বাড়ির ভিতরেই। তবে এটাও পাকানো সিঁড়ি। ওঠবার সময় ঠিক মনে হয় কোনও মিনার বা মনুমেন্টে উঠছি।
সিঁড়ি দিয়ে উঠে সামনেই ছাতের ঘর, আর বাঁ দিকে ছাতে যাবার দরজা। ঘরের ভিতরে মেঝেতে উবু হয়ে বসে আছে রুকু। একটা লাল-সাদা পেটকাটি ঘুড়ি মাটিতে ফেলে হাঁটুর চাপে সেটাকে ধরে রেখে তাতে সুতো পরাচ্ছে। আমাদের আসতে দেখেই কাজটা বন্ধ করে সোজা হয়ে বসল। আমরা চারজনে ছোট্ট ঘরটাতে ঢুকলাম।
বোঝাই যায় এটা রুকুর খেলার ঘর—যদিও রুকুর জিনিস ছাড়াও আরও অনেক কিছু কোণঠাসা করে রাখা রয়েছে—দুটো পুরনো মরচে ধরা ট্রাঙ্ক, একটা প্যাকিং কেস, একটা ছেঁড়া মাদুর, তিনটে হারিকেন লণ্ঠন, একটা কাত করা ঢাকাই জালা, আর কোণে ডাঁই করা পুরনো খবরের কাগজ আর মাসিক পত্রিকা।
‘তুমি গোয়েন্দা?’
ফেলুদার দিকে সটান একদৃষ্টে তাকিয়ে প্রশ্ন করল রুকু। আজ দেখছি ফরসা রংটা রোদে পুড়ে যেন একটু তামাটে লাগছে। তার মুখে যে চুইং গাম রয়েছে সেটা তার চোয়াল নাড়া দেখেই বোঝা যাচ্ছে। ফেলুদা হেসে বলল, ‘খবরটা ক্যাপ্টেন স্পার্ক কী করে পেলেন সেটা জানতে পারি!’
‘আমার অ্যাসিসট্যান্ট বলেছে’, গম্ভীর ভাবে জানাল রুকু। সে আবার ঘুড়ির দিকে মন দিয়েছে।
‘কে তোমার অ্যাসিসট্যান্ট?’ ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।
‘স্পার্কের অ্যাসিসট্যান্ট খুদে র্যাক্সিট সিটা জান না? তুমি কীরকম গোয়েন্দা!’
লালমোহনবাবু ছোট্ট একটা কাশি দিয়ে তাঁর দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললেন, ‘খুদিরাম রক্ষিত। সাড়ে চার ফুট হাইট। স্পার্কের ডান হাত।’
ফেলুদা ব্যাপারটা বুঝে নিয়ে বলল, ‘কোথায় আছে তোমার অ্যাসিসট্যান্ট?’
উত্তরটা এল বিকাশবাবুর কাছ থেকে। ভদ্রলোক একটা অপ্রস্তুত হাসি হেসে বললেন, ‘ও ভূমিকাটা এখন আমাকেই পালন করতে হচ্ছে।’
‘তোমার রিভলভার আছে?’ হঠাৎ প্রশ্ন করল রুকু।
‘আছে,’ বলল ফেলুদা।
‘কী রিভলভার?’
‘কোল্ট।’
‘আর হারপুন?’
‘উঁহু। হারপুন নেই।’
‘তুমি জলের তলায় শিকার করো না?’
‘এখন পর্যন্ত প্রয়োজন হয়নি।’
‘তোমার ছোরা আছে?’
‘ছোরাও নেই। এমনকী এরকম ছোরাও নেই।’
রুকুর মাথার উপরেই দেয়ালে পেরেক থেকে একটা খেলার ছোরা ঝুলছে। এটাই কাল ওর কোমরে বাঁধা দেখেছিলাম।
‘ওই ছোরা আমি শয়তান সিং-এর পেটে ঢুকিয়ে ওর নাড়িভুঁড়ি বার করে দেব।’
‘সে তো বুঝলাম,’ ফেলুদা রুকুর পাশে মেঝেতে বসে পড়ে বলল, ‘কিন্তু তোমাদের বাড়ির সিন্দুক থেকে যে একজন শয়তান সিং একটা সোনার গণেশ চুরি করে নিয়ে গেল তার কী হবে?’
‘শয়তান সিং এ বাড়িতে ঢুকতেই পারবে না।’
‘ক্যাপ্টেন স্পার্ক সেদিন মছলিবাবাকে দেখতে না গেলে এ ব্যাপারটা হত না—তাই না?’
‘মছলিবাবার গায়ের রংটা কঙ্গোর গঙ্গোরিলার মতো কালো।’
‘সাবাস!’ বলে উঠল লালমোহনবাবু, ‘তুমি গোরিলার গোগ্রাস পড়েছ রুকুবাবু?’
গঙ্গোরিলা যে লালমোহনবাবুরই লেখা গোরিলার গোগ্রাস-এর নব্বই ফুট লম্বা অতিকায় রাক্ষুসে গোরিলার নাম সেটা আমি জানতাম। গল্পের আইডিয়াটা কিং কং থেকে নেওয়া, সেটা লালমোহনবাবু নিজেও স্বীকার করেন। জটায়ুর বর্ণনায় গোরিলার গায়ের রং ছিল কষ্টিপাথরে আলকাতরা মাখালে যেরকম হয় সেইরকম। লালমোহনবাবু ‘ও বইটা আসলে আম—’বলেই ফেলুদার কাছ থেকে একটা কড়া ইশারা পেয়ে থেমে গেলেন।
রুকু বলল, ‘গণেশ তো একজন রাজার কাছে আছে। শয়তান সিং পাবেই না। কেউ পাবে না। ডাকু গণ্ডারিয়াও পাবে না।’
‘আবার অক্রুর নন্দী!’ —দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন জটায়ু।
বিকাশবাবু হেসে বললেন, ‘ওর কথার সঙ্গে তাল রেখে চলতে হলে আগে রহস্য রোমাঞ্চ সিরিজ গুলে খেতে হবে।’
ফেলুদা এখনও মাটিতে বসে আড়চোখে রুকুর দিকে চেয়ে আছে, তার ভাব দেখে মনে হয় যেন সে রুকুর আজগুবি কথাগুলোর ভিতর থেকে আসল মানুষটাকে খুঁজে বার করার চেষ্টা করছে। রুকু তার কথার মধ্যেই দিব্যি ঘুড়িতে সুতো লাগিয়ে চলেছে। এবার ফেলুদা প্রশ্ন করল, ‘কোথাকার রাজার কথা বলছ তুমি রুকু?’
উত্তর এল—‘আফ্রিকা।’
ঘোষালবাড়ি থেকে চলে আসার আগে আমরা আরেকজন লোকের সঙ্গে কথা বলেছিলাম। তিনি হলেন শশিভূষণ পাল। শশীবাবু নারকোলের মালায় হল্দে রং নিয়ে নিজের তৈরি তুলি দিয়ে কার্তিক ঠাকুরের গালে লাগাচ্ছিলেন। ভদ্রলোকের বয়স ষাট পঁয়ষট্টি হবে নিশ্চয়ই, রোগা প্যাকাটি চেহারা, চোখে পুরু কাচের চশমা। ফেলুদা জিজ্ঞেস করাতে বললেন উনি নাকি ষোলো বছর বয়স থেকে এই কাজ করছেন। ওঁর আদি বাড়ি ছিল কৃষ্ণনগর, ঠাকুরদাদা অধর পাল নাকি প্রথম কাশীতে এসে বসবাস আরম্ভ করেন সিপাহি বিদ্রোহের দু বছর পরে। শশীবাবু থাকেন গণেশ মহল্লায়। সেখানে নাকি ওঁরা ছাড়াও আরও কয়েকঘর কুমোর থাকে। ফেলুদা বলল, ‘আপনার জ্বর হয়েছিল শুনলাম : এখন ভাল আছেন?’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ। সিংহি মশাইয়ের ওষুধে খুব উপকার হয়েছিল।’
শশীবাবু কথা বলছেন, কিন্তু কাজ বন্ধ করছেন না।
‘আপনার কাজ শেষ হচ্ছে কবে?’ ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।
‘আজ্ঞে পরশুই তো ষষ্ঠী। কাল রাত্তিরের ভেতরই হয়ে যাবে। বয়স হয়ে গেল তো, তাই কাজটা একটু ধরে করতে হয়।’
‘তাও আপনার তুলির টানে এখনও দিব্যি জোর আছে।’
‘আজ্ঞে এ কথা আপনি বলছেন, আর, আরবছর এই দুগ্গাঠাকুর দেখেই ওই একই কথা বলেছিলেন কলকাতার আর্ট ইস্কুলের একজন শিক্ষক। এ জিনিসের কদর আর কে করে বলুন। সবাই ঠাকুরই দেখে, হাতের কাজটা আর কজন দেখে।’
‘বিকাশবাবু যেদিন আপনাকে ওষুধ দেন, সেদিনই সন্ধ্যায় বাড়ির দোতলার সিন্দুক থেকে একটা জিনিস চুরি যায়। এ খবর আপনি জানেন?’
শশীবাবুর হাতের তুলিটা যেন একমুহূর্তের জন্য কেঁপে গেল। গলার সুরটাও যেন একটু কাঁপা। বললেন—
‘আজ পঞ্চাশ বছর হল প্রতি বছর এসে এই একই কাজ করে যাচ্ছি এই ঘোষালবাড়িতে, আর আমায় কিনা এসে পুলিশে জেরা করল! হাতে তুলি নিলে আমার আর কোনও হুঁশ থাকে না, জানেন, নাওয়া খাওয়া ভুলে যাই। আপনি জিজ্ঞেস করুন সিংহি মশাইকে, উনি তো মাঝে মাঝে এসে দাঁড়িয়ে দেখেন। আপনি খোকাকে জিজ্ঞেস করুন। সেও তো এসে চুপটি করে দাঁড়িয়ে দেখে আমার কাজ। কই বলুন তো তাঁরা—আমি ঠাকুরের সামনে ছেড়ে একটা মিনিটের জন্যে কোথাও যাই কি না।’
শশীবাবুর সঙ্গে আরেকটি বছর কুড়ির ছেলে কাজ করছে। জানলাম ইনিই হলেন শশীবাবুর ছেলে কানাই। কানাইকে তার বাপের একটা ইয়াং সংস্করণ বলা চলে। কাজ দেখলে মনে হয় সে বংশের ধারা বজায় রাখতে পারবে। কানাই নাকি গণেশ চুরির দিন সাতটার পরে ঠাকুরের সামনে ছেড়ে কোথাও যায়নি।
বিকাশবাবু আমাদের সঙ্গে গেট অবধি এলেন। ফেলুদা বলল, ‘আপনাদের বাড়িতে এখন অনেক লোক তাই আর উমানাথবাবুকে বিরক্ত করলাম না। আপনি শুধু বলে দেবেন যে আমি হয়তো মাঝে মাঝে এসে একটু ঘুরে টুরে দেখতে পারি, প্রয়োজন হলে একে-ওকে দু একটা প্রশ্ন করতে পারি।’
বিকাশবাবু বললেন, ‘মিস্টার ঘোষাল যখন আপনার উপর ব্যাপারটা ছেড়ে দিয়েছেন তখন তো আপনার সে অধিকার আছেই।’
বেরোবার মুখে একটা শব্দ পেয়ে ফেলুদার সঙ্গে সঙ্গে আমার চোখটাও বাড়ির ছাতের দিকে চলে গেল।
রুকু তার লাল-সাদা পেটকাটিটা সবে মাত্র উড়িয়েছে। সুতোর টানে ঘুড়িটাই হাওয়া কেটে ফরফর শব্দ করছে। রুকুকে এখান থেকে দেখতে পাবার কোনও সম্ভাবনা নেই, তবে তার লাটাই সমেত হাত দুটো মাঝে মাঝে ছাতের পাঁচিলের উপর দিয়ে উঁকি মারছে।
‘ছেলেটিকে খুব একা বলে মনে হয়,’ ফেলুদা ঘুড়িটার দিকে চোখ রেখে বলল। ‘সত্যিই কি তাই?’
বিকাশবাবু বললেন, ‘রুকু উমানাথবাবুর একমাত্র ছেলে। এখানে তো তবু একটি বন্ধু হয়েছে। আপনি তো দেখেছেন সূরযকে। কলকাতায় ওর সমবয়সী বন্ধু একটিও নেই।’