এখানে এসে অবধি বেশির ভাগ সময়টা ঘরে বসে বাঙালিদের সঙ্গে কথা বলে মাঝে ভুলে যেতে হচ্ছিল যে আমরা কাশীতে এসেছি। এখন সাইকেল রিকশা, টাঙ্গা আর লোকের ভিড় বাঁচিয়ে মদনপুরা রোড দিয়ে হোটেলের দিকে হাঁটতে হাঁটতে আবার কাশীর মেজাজটা ফিরে পেলাম। বড় রাস্তার গোলমাল এড়িয়ে হোটেলে যাবার শর্টকাটের গলিটাতে ঢুকলাম আমরা তিনজনে। লালমোহনবাবু একটা ছাগলের বাচ্চার পিঠে ছাতা দিয়ে একটা ছোট খোঁচা মেরে বললেন, ‘আমার একটা ব্যাপার কী জানেন ফেলুবাবু—কলকাতা ছেড়ে বাইরে কোথাও গেলেই সেই জায়গার মেজাজটা আমাকে কেমন যেন পেয়ে বসে। সেবার রাজস্থান গিয়ে খালি খালি নিজেকে রাজপুত বলে মনে হচ্ছিল। অন্যমনস্ক হয়ে মাথায় হাত দিয়ে পাগড়ির বদলে টাক ফিল করে রীতিমতো চমকে চমকে উঠছিলুম।’
‘এখানে এসে কি জটার অভাব ফিল করে চমকে চমকে উঠছেন?’
‘তা ঘাটে গিয়ে যে একটু বৈরাগী-বৈরাগী ভাব হয়নি তা বলতে পারি না। আবার এই সব অলিগলিতে ঢুকলে মনে হয় কোমরে একটা ছোরা থাকলে হাতলটাতে মাঝে মাঝে বেশ হাত বোলানো যেত।’
আমি কিন্তু কালকের সেই লোকটাকে আবার দেখেছি। আমি জানি শংকরী নিবাস থেকে বেরোবার কিছু পরেই সে আমাদের পিছু নিয়েছে। কিন্তু কালকে ফেলুদার তাচ্ছিল্য ভাবের পর আজ আর কিছু বলতে পারছি না। সকালবেলা গলিতে বিস্তর লোক—কেউ স্নান করে ফিরছে, কেউ বাজার থেকে ফিরছে, কিছু বুড়ো দাওয়ায় বসে আড্ডা মারছে, এখানে ওখানে বাচ্চার দল হইহল্লা করছে—তারই মধ্যে পিছন ফিরলে চাপা পায়জামার উপর গাঢ় বেগনি চাদর মুড়ি দেওয়া লোকটাকে দেখতে পাচ্ছি আমাদের বিশ-ত্রিশ হাত পিছনে সমানে আমাদের ফলো করে চলেছে।
লালমোহনবাবু বললেন, ‘আপনার এই গণেশের মামলাটি বিলক্ষণ ডিফিকাল্ট বলে মনে হচ্ছে মশাই।’
ফেলুদা বলল, ‘কোনও মামলা একটা বিশেষ অবস্থায় পৌঁছানোর আগে সেটা সহজ কি কঠিন তা বোঝা সম্ভব নয়। আপনার কি ধারণা সেই স্টেজ পৌঁছে গেছে?’
‘যায়নি বুঝি?’
‘একেবারেই না।’
‘কিন্তু যিনি আসল ভিলেন, তাঁর পক্ষে তো ও জিনিস চুরি করার কোনও স্কোপই ছিল না।’
‘কাকে ভিলেন ভাবছেন আপনি?’
‘কেন, ওই যে মেঘরাম না মেঘলাল না কী নাম বললে। যাকে দেখলুম মছলিবাবার ওখানে।’
‘আপনার কি ধারণা মেঘরাজ গণেশ চুরি করার জন্য নিজেই পাঁচিল টপকে ঘোষাল বাড়িতে ঢুকবেন?’
‘এজেন্ট লাগাবে বলছেন?’
‘সেটাই স্বাভাবিক নয় কি? আর তা ছাড়া সে শাসিয়ে গেছে বলে যে সে-ই চুরি করেছে এমন তো নাও হতে পারে।’
লালমোহনবাবু একটুক্ষণ চুপ মেরে হঠাৎ যেন শিউরে উঠে বললেন, ‘ওরকম কাঁধ দেখিনি মশাই। না জানি সামনের দিক থেকে কী রকম দেখতে। ওর মাথায় এক জোড়া শিং লাগিয়ে বিশ্বনাথের গলিতে ছেড়ে দিলে নিঘ্ঘাৎ ঢুঁ মারবে।’
ক্যালকাটা লজে ঢুকে সামনেই আপিসঘর। ম্যানেজারের চেয়ার ছাড়া আরও তিনটে চেয়ার আর একটা বেঞ্চি আছে। সেগুলোতে দু-তিনজন করে নিরঞ্জনবাবুর আলাপী লোক প্রায় সব সময়ই বসে আড্ডা মারে। আজ ঢুকে দেখলাম নিরঞ্জনবাবুর উলটো দিকে একজন প্যান্ট-শার্ট পরা বেশ জোয়ান লোক বসে চা খাচ্ছেন, আর হাত নেড়ে নিরঞ্জনবাবুকে কী যেন বোঝাচ্ছেন। আমাদের ঢুকতে দেখেই ম্যানেজারমশাই পানমুখে একগাল হেসে বললেন, ‘এই তো—ইনি আপনার জন্য প্রায় কুড়ি মিনিট বসে। আলাপ করিয়ে দিই—সাব-ইনস্পেক্টর তেওয়ারি—আর ইনি—’
নিরঞ্জনবাবু পর পর আমাদের তিনজনের নাম বলে বললেন, ‘ভয় নেই—হিন্দি বলতে হবে না—ইনি দিব্যি বাংলা বলেন।’
তেওয়ারি ফেলুদার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে আছেন। চোখের কোণে হাসি এই এল বলে, আর ফেলুদার চোখে ভ্রূকুটি, সেটাও মনে হচ্ছে একটা হাসির অপেক্ষায় রয়েছে।
‘সে কী মশাই’—ফেলুদার ভ্রূকুটি হাওয়া—‘আপনি এলাহাবাদে ছিলেন না?’
দারোগাসাহেব ঝকঝকে দাঁত বার করে হেসে ফেলুদার হাত ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বললেন, ‘আমি শিওর ছিলাম না আপনি চিনবেন কি না।’
‘চেনা মুশকিল। গোঁফটা যা ছিল তার চার ভাগের এক ভাগ হয়ে গেছে। রোগাও হয়েছেন বেশ খানিকটা।’
ভদ্রলোক ফেলুদার সমান লম্বা আর গড়নেও ফেলুদারই মতো ছিমছাম। বছর দু-এক আগে এলাহাবাদে ফেলুদার একটা কেস পড়েছিল। পুলিশ প্যাঁচে পড়ে গিয়েছিল, কিন্তু ফেলুদা দু দিনের মধ্যে সমস্যার সমাধান করে দিয়ে চার দিনের ভিতর কলকাতায় ফিরে এসেছিল। বুঝলাম সেইবারই তেওয়ারির সঙ্গে আলাপ হয়।
‘আমি মিস্টার ঘোষালের কাছে গিয়েছিলাম কাল রাত্রে আপনি চলে আসার পর। তখনই শুনলাম আপনি এসেছেন আর ক্যালকাটা লজে আছেন।’
নিরঞ্জনবাবু চায়ের অর্ডার দিয়েছেন, আমরা তিনজনে বসলাম। ফেলুদা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বলল, ‘যাক!—মিস্টার ঘোষাল পুলিশের কথা বলাতে আমার একটু দুশ্চিন্তা যাচ্ছিল; এখন আপনাকে দেখে অনেকটা হালকা লাগছে। আপনার সঙ্গে ক্ল্যাশ হবে না। আর মনে হয় দুটো মাথা এক করলে বোধ হয় কাজের সুবিধেই হবে। বেশ গোলমেলে ব্যাপার—তাই না মশাই?’
তেওয়ারি একটা শুকনো হাসি হেসে বললেন, ‘ইন ফ্যাক্ট ইট ইজ সো গোলমেলে যে আমি তো আপনাকে এলাম বারণ করতে।’
‘কেন বলুন তো?’
‘মগনলাল যে বেপারে আছে, সে বেপারে এই হচ্ছে আমার অ্যাডভাইস। আপনি দু দিন গেলেন মিস্টার ঘোষালের বাড়ি, তার জন্য আমার খুব ভাওনা হচ্ছে। আপনাকে খুব সাওধান থাকতে হবে। ওর স্পাই আর ভাড়াটে গুণ্ডা সারা বেনারস শহরে ছড়িয়ে আছে।’
হরকিষণ চা নিয়ে এল। ফেলুদা চিন্তিতভাবে একটা কাপ তুলে নিয়ে বলল, ‘কিন্তু মগনলাল যে এ ব্যাপারে সত্যিই জড়িত সে সম্বন্ধে আপনি এত নিশ্চিত হচ্ছেন কী করে?’
মিস্টার তেওয়ারি ভুরুটা কুঁচকে বাঁ হাতের আঙুলগুলো দিয়ে টেবিলের উপর কয়েকটা টোকা মেরে বললেন, ‘আমরা যে লাইনে ইনভেসটিগেশন করছি, তাতে মগনলালকে একেবারে বাদ দেওয়া যায় না। ওর মতো কানিং লোক আর নেই।’
‘আপনারা কোন লাইনে তদন্ত চালাচ্ছেন সেটা…’
‘বলছি আপনাকে। আপনার কাছে আমি কিছুই লুকাব না। ঘোষালবাড়ির সবাইয়ের সঙ্গে আপনার আলাপ হয়েছে কি?’
‘চাকর-বাকর বাদে আর মোটামুটি সকলের সঙ্গেই হয়েছে।’
‘শশীবাবুকে দেখেছেন তো?’
‘হ্যাঁ, দেখেছি বই কী। আজই সকালে তার সঙ্গে কথা হয়েছে।’
‘ওর ছেলেটিকে দেখেছেন নিশ্চয়ই।’
‘হ্যাঁ—সেও তো কাজ করছিল।’
‘কিন্তু শশীবাবুর আরেকটি ছেলে আছে সেটা জানেন?’
এ খবরটা অবিশ্যি আমরা কেউই জানতাম না।
‘এ ছেলেটির নাম নিতাই। ভেরি ব্যাড টাইপ। আঠারো বছর বয়েস, আর এ বয়সে যত খারাপ দোষ থাকতে পারে, সবই আছে। আমরা এখনও কোনও প্রমাণ পাইনি, কিন্তু ধরুন, যদি সে মগনলালের খপ্পরে পড়ে থাকে—’
ফেলুদা হাত তুলে বলল, ‘বুঝেছি। মগনলাল নিতাইকে হাত করবে, নিতাই হয় তার বাপকে না হয় দাদাকে হুমকি দিয়ে তাদের সিন্দুক খুলিয়ে গণেশ চুরি করাবে।’
‘এগজ্যাক্টলি’, বললেন মিস্টার তেওয়ারি। ‘নিতাইয়ের ব্যাপারটা জানার পর থেকেই মনে হচ্ছে একটা রাস্তা পাওয়া গেছে। আমার অ্যাডভাইস আপনি এখন চুপচাপ থাকুন। দসেরা টাইমে বেনারসে অনেক কিছু দেখবার আছে—সেই সব দেখুন, কিন্তু ঘোষালবাড়িতে বেশি যাতায়াত করবেন না।’
ফেলুদা অল্প হেসে চায়ে চুমুক দিয়ে একেবারে অন্য প্রসঙ্গে চলে গেল।
‘আপনারা মছলিবাবা সম্বন্ধে কোনও তদন্ত করার প্রয়োজন বোধ করছেন না?’
তেওয়ারি হাতের কাপটা টেবিলের উপর রেখে একটা প্রাণখোলা হাসি হেসে বলল, ‘আপনাদের এর ভিতরেই মছলিবাবা দর্শন হয়ে গেছে? কী মনে হল?’
‘তদন্তের কথা যখন তুললাম, তখন খুব যে একটা ভক্তি জাগেনি মনে সেটা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন।’
‘সে তো আপনার কথা হল, কিন্তু আপনি তার ভক্তদের দেখেছেন? আপনি ইনভেস্টিগেশনের কথা বলছেন—খোলাখুলি ভাবে কিছু করতে গেলে ভক্তরা আমাদের আস্ত রাখবে?’
কথাটা বলে মিস্টার তেওয়ারি আড়চোখে নিরঞ্জনবাবুর দিকে চাইতে ভদ্রলোক হাত তুলে বলে উঠলেন, ‘আমার দিকে কী দেখছেন মশাই! আমাদের ভক্তি মানে কী? ভক্তিটক্তি কিচ্ছু না—মছলিবাবা হলেন আমাদের ছকে ফেলা একঘেয়ে জীবনে সামান্য একটু ব্যতিক্রমের ছিটেফোঁটা—ব্যস।’
ফেলুদা বলল, ‘একটা জিনিস আপনি করতে পারেন মিস্টার তেওয়ারি—হরিদ্বার আর এলাহাবাদে খবর নিয়ে দেখতে পারেন সেখানে গত মাসখানেকের মধ্যে মছলিবাবা নামে কোনও সিদ্ধপুরুষের আবির্ভাব ঘটেছিল কি না।’
‘ভেরি গুড। এটা করতে কোনও অসুবিধা নেই। আমি দু দিনের মধ্যে আপনাকে ইনফরমেশন এনে দেব।’
দারোগাসাহেব ঘড়ি দেখে উঠে পড়লেন। দরজার মুখে ভদ্রলোক ফেলুদার পিঠ চাপড়ে বললেন, ‘একদিন চৌকে আমাদের থানায় আসুন না। কী রকম কাজ হচ্ছে দেখে যান। আর—’ তেওয়ারি গম্ভীর—‘আমি আপনাকে সিরিয়াসলি বলছি—আপনি যত ইচ্ছে হলিডে করুন, কিন্তু এ বেপারে জড়াবেন না।’
দুপুরের ডাল ভাত কপির তরকারি মাছের ঝোল আর দইয়ের সঙ্গে জিলিপি খেয়ে আমরা হোটেল থেকে বেরিয়ে পান কিনলাম। লালমোহনবাবুকে এমনিতে কখনও পান খেতে দেখিনি; এখানে দেখলাম সাত রকম মশলা দেওয়া রুপোর তবক দিয়ে মোড়া একটা প্রকাণ্ড পান চার আঙুল দিয়ে ঠেলে মুখের ভিতর পুরে দিব্যি চিবোতে লাগলেন। আমরা কোনও বিশেষ জায়গায় যাব বলে বেরিয়েছি কি না জানি না, কারণ ফেলুদা কিচ্ছু বলেনি। লালমোহনবাবু একবার আমার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বললেন, ‘তোমার দাদা বোধ হয় সেই হালুইকরের দোকানে গিয়ে রাবড়ি খাবেন।’ আমার ধারণা কিন্তু অন্য রকম—যদিও সেটা আমি মুখে প্রকাশ করলাম না। ফেলুদাকে অনুসরণ করে আমরা হোটেলের উলটো দিকে একটা গলিতে ঢুকে এগিয়ে চললাম।
একটু এগিয়ে বুঝতে পারলাম এদিকটায় বাঙালির নামগন্ধ নেই। লালমোহনবাবু চাদরটিকে ভাল করে জড়িয়ে নিয়ে বললেন, ‘আপনি চোখ, কান আর নাকের কথা বললেন, কিন্তু টেমপারেচারের কথা তো বললেন না। এদিকটায় বেশ শীত শীত লাগছে মশাই।’
দু দিকে তিন তলা চার তলা বাড়ি উঠে গেছে, আর তার মধ্যে দিয়ে এঁকেবেঁকে চলেছে গলি। সূর্যের আলো প্রায় পৌঁছায় না বললেই চলে। ফেলুদা বলল, বেনারসের গলির বেশির ভাগ বাড়িই নাকি দেড়শো থেকে দুশো বছরের পুরনো। রাস্তার দু দিকের দেওয়ালে যেখানে সেখানে ছবি আঁকা—হাতি, ঘাড়ো, বাঘ, টিয়া, ঘোড়সওয়ার। কারা কখন এঁকেছে জানি না, কিন্তু দেখতে বেশ লাগে। মাঝে মাঝে এক-একটা হাতে-লেখা হিন্দি বিজ্ঞাপন—তার মধ্যে ‘নওজোয়ান বিড়ি’ সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে।
এতক্ষণ চারিদিকে বেশ চুপচাপ ছিল—এবার ক্রমে ক্রমে কানে নানারকম নতুন শব্দ আসতে আরম্ভ করল। তার মধ্যে সব ছাপিয়ে উঠছে ঘণ্টার শব্দ। ঘণ্টার ফাঁকগুলো ভরিয়ে রেখেছে যে শব্দটা তাকেই বলা হয় কোলাহল। ফেলুদা বলে এই কোলাহল জিনিসটা খুব মজার। হাজার লোক এক জায়গায় রয়েছে, সবাই নিজেদের মধ্যে সাধারণভাবে কথাবার্তা বলছে, কেউ গলা তুলছে না, অথচ সব মিলিয়ে যে শব্দটা হচ্ছে তাতে কান ফেটে যাবার জোগাড়।
এরই মধ্যে বেশ কয়েকটা ষাঁড় আমাদের সামনে পড়েছে, আর প্রতিবারই লালমোহনবাবু বলে উঠেছেন, ‘ওই দেখুন, মেঘরাম!’ শেষটায় ফেলুদা বলতে বাধ্য হল যে তার ধারণা মেঘরাজের চেয়ে ষাঁড় জিনিসটা অনেক বেশি নিরীহ এবং নিরাপদ। —‘আমি মশাই একজন ডাকসাইটে প্রতিদ্বন্দ্বী কল্পনা করে মনে উৎসাহ আনার চেষ্টা করছি, আর আপনি বার বার ষাঁড়ের সঙ্গে তুলনা করে তাকে খাটো করছেন!’
চোখ, কান আর নাককে একসঙ্গে আক্রমণ করতে বিশ্বনাথের গলির মতো আর কিছু আছে কি না জানি না। এখানে এসে আর নিজের ইচ্ছেমতো হাঁটা যায় না; ভিড় যে দিকে নিয়ে যায় সেই দিকে যেতে হয়। আমরাও এগিয়ে চললাম ভিড়ের সঙ্গে। ‘দর্শন হবে বাবু?’ ‘বাবু বিশ্বনাথ দর্শন হবে?’ পাণ্ডারা চারিদিক থেকে ছেঁকে ধরেছে। ফেলুদা নির্বিকার। আমরা তিনজনেই তাদের কথায় কান না দিয়ে যদ্দূর পারি ধাক্কা বাঁচিয়ে পকেট বাঁচিয়ে রাস্তার পিছল জায়গাগুলো বাঁচিয়ে এগিয়ে চললাম। লালমোহনবাবুর মনে যতই ভক্তিভাব জাগুক না কেন, ওঁর চোখ কিন্তু চলে গেছে মন্দিরের সোনায় মাড়ো চুড়োর দিকে। একবার ফেলুদাকে কী যেন প্রশ্নও করলেন চুড়োর দিকে আঙুল দেখিয়ে। গোলমালে কী বললেন শুনতে পেলাম না, তবে ‘ক্যারেট’ কথাটা কানে এল। চুড়োর দিকে চাইতে গিয়েই চোখে পড়ল আকাশে দশ-বারোটা চিল চক্কর দিচ্ছে, আর তারই এক পাশে একটা লাল-সাদা পেটকাটি ঘুড়ি গোঁৎ খেয়ে মন্দিরের পিছনে অদৃশ্য হয়ে গেল।
ফেলুদাও ঘুড়িটাকে দেখেছে।
আমরা দুজন ফেলুদারই পিছন পিছন আরও খানিকটা এগিয়ে গেলাম—যদি আবার ঘুড়িটাকে দেখা যায়। হ্যাঁ—ওই তো আবার দেখা যাচ্ছে—লাল-সাদা পেটকাটি। ওই তো উপর দিকে উঠল, আর ওই তো আবার গোঁৎ খেয়ে নীচের দিকে নেমে একটা চারতলা বাড়ির পিছনে অদৃশ্য হয়ে গেল।
‘মোস্ট ইন্টারেস্টিং…’
চাপা গলায় বললেও, ফেলুদার ঠিক পাশেই থাকায় ওর কথাটা আমি শুনতে পেলাম।
লালমোহনবাবু বললেন, ‘শুধু ইন্টারেস্টিং কেন বলছেন মশাই—আমার কাছে তো ডিস্টার্বিং বলেও মনে হচ্ছে। মানে, ঘুড়িটার কথা বলছি না। চারদিকে এত দাড়ি আর জটার মধ্যে মেঘরামের কত স্পাই ঘোরাফেরা করছে ভাবতে পারেন? একটি লোক তো আপনার দিক থেকে চোখ ফেরাচ্ছে না। আমি আড়চোখে ওয়াচ করে যাচ্ছি প্রায় তিন মিনিট ধরে।’
ফেলুদা আকাশের দিক থেকে চোখ না নামিয়েই বলল, ‘গোঁফ-দাড়ি-জটা-যষ্টি-কমণ্ডুল, আর গায়ে টাটকা নতুন-কেনা হিন্দি নামাবলী তো?’
‘ফুল মার্কস’, বললেন জটায়ু।
আমরা আবার এগিয়ে গেলাম। সামনেই একটা ষাঁড়ের পিছনে একটা সিঁদুর আর জবাফুলে বোঝাই দোকানের পাশে লোকটা দাঁড়িয়ে আছে। ফেলুদা তার সামনে এসে বেশ জোর গলায় বলল, ‘জয় বাবা বিশ্বনাথ!’ আমার হাসি পেলেও একদম চেপে গেলাম।
বিশ্বনাথ থেকে আমরা সোজা চলে গেলাম জ্ঞানবাপী। এখানেই অওরঙ্গজেবের মসজিদ, আর এখানেই সেই প্রকাণ্ড খোলা চাতাল। চাতালটায় এসে আবার আকাশের দিকে চাইতে আর ঘুড়িটা দেখতে পেলাম না।
উত্তর দিকে যেখানে চাতালটা শেষ হয়েছে সেখান দিয়ে একটা সিঁড়ি নেমে গেছে রাস্তায়—কারণ চাতালটা রাস্তার চেয়ে প্রায় আট-দশ হাত উঁচুতে। ফেলুদা কী মতলবে বেরিয়েছে সেটা নিয়ে আমার মনে যে সন্দেহটা ছিল, এখন দেখলাম লালমোহনবাবুও সেই একই সন্দেহ করছেন।
‘আপনি কি মশাই মেঘরামের বাড়ি যাবার তাল করছেন নাকি?’
ফেলুদা বলল, ‘আমার আরাধ্য দেবতা আর কে আছে বলুন। ক্রাইম না থাকলে তো ফেলু মিত্তিরের রোজগার বন্ধ হয়ে যাবে, সুতরাং এখানকার সবচেয়ে বড় ক্রিমিন্যালের মন্দিরটা একবার দেখে যাব না?’
দিনের বেলা চারদিকে শরৎকালের ঝলমলে রোদ আর লোকের ভিড় বলে হয়তো ফেলুদার কথায় অতটা শিউরে উঠলাম না; তবে ওই এক কথায় বুকের ঘড়িটায় দম দেওয়া হয়ে গেছে, আর ধুকপুক শুরু হয়ে গেছে।
এখানে গোলমাল কম, তাই লালমোহনবাবু পরের প্রশ্নটা গলা নামিয়ে করতে পারলেন।
‘আপনার অস্ত্রটি সঙ্গে নিয়েছেন তো?’
‘কোন অস্ত্রটার কথা বলছেন? রিভলভার নিইনি। বাকি তিনটে সব সময় সঙ্গেই থাকে।’
লালমোহনবাবু জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ফেলুদার দিকে চাইতে গিয়ে একটা হোঁচট খেয়ে কোনওমতে সামলে নিয়ে আর কিছু বললেন না। ভদ্রলোকের বোঝা উচিত ছিল যে ফেলুদার তিনটে স্বাভাবিক অস্ত্র হল ওর মস্তিষ্ক, স্নায়ু আর মাংসপেশী। এর মধ্যে প্রথমটা অবিশ্যি আসল।
সিঁড়ি দিয়ে রাস্তায় নেমে সামনেই একটা দরজির দোকান। দোকানের সামনেই বসে একটা লোক পায়ে করে সেলাইয়ের কল চালাচ্ছে। ফেলুদা তাকে জিজ্ঞেস করতেই লোকটা মগনলাল মেঘরাজের বাড়ি বাতলে দিল। রাস্তাটা ধরে পুব দিকে কিছুদূর গেলেই বাঁয়ে একটা মহাবীরের মন্দির পড়বে, তার দুটো বাড়ি পরেই মগনলালের বাড়ি। চেনা সহজ, কারণ সামনের দরজার দু দিকে দুটো সশস্ত্র প্রহরীর ছবি আঁকা রয়েছে।
‘ছবি ছাড়া এমনি প্রহরী নেই!’ ফেলুদা প্রশ্ন করল।
‘হাঁ—তাও আছে।’
সোজা রাস্তা, এ-গলি ও-গলি ঘোরার বালাই নেই, তাই মগনলালের বাড়ি পেতে কোনওই অসুবিধা হল না। এখানটায় সত্যি করেই বিশ্বনাথের ঘণ্টার শব্দ ছাড়া আর কোনও শব্দই পৌঁছায় না। আর দুপুরবেলা বলেই বোধ হয় গলিটা এত নিস্তব্ধ। ষাঁড় তো নেই-ই, এমন কী ছাগল কুকুর বেড়াল কিচ্ছু নেই।
মগনলালের বাড়ির দরজার দু দিকে তলোয়ার উঁচোনো প্রহরীর ছবি আছে ঠিকই, কিন্তু জ্যান্ত প্রহরী কাউকে দেখা গেল না। অথচ দরজার পাল্লা দুটোই হাঁ করে খোলা। ব্যাপারটা কী? লোকগুলো খেতে গেল নাকি? ফেলুদা নাক টেনে বলল, ‘খৈনি ঝাড়া হয়েছে মিনিটখানেক আগেই।’ তারপর এদিক ওদিক দেখে বলল, ‘আসুন। কেউ চ্যালেঞ্জ করলে বলব নতুন এসেছি, মানমন্দির ভেবে ঢুকেছি।’
ফেলুদাকে সামনে রেখে ঢুকে পড়লাম দরজা দিয়ে।
সর্বনাশ—এ কি মগনলালের বাড়ি, না গোয়ালঘর? অন্ধকার, স্যাঁতসেঁতে উঠোনে তিনটে জলজ্যান্ত গোরু দাঁড়িয়ে নির্বিকারে জাবর কাটছে, আমাদের দিকে ফিরে দেখবারও কোনও আগ্রহ নেই তাদের। গোরুগুলো যে রাত্রেও এখানেই থাকে তার চিহ্নও চারিদিকে ছড়িয়ে আছে।
ফেলুদা ফিসফিস করে বলল, ‘এ ব্যাপারটা এখানে খুব কমন। এই সব গলির বাড়িতে এক উঠোন ছাড়া আর খোলা জায়গা বলে কিচ্ছু নেই। অথচ দুধ ঘি না হলে এদের চলে না।’
আমাদের ডাইনে বাঁয়ে উঁচু বারান্দা দু দিকেই দুটো দরজায় গিয়ে শেষ হয়েছে, দুটোর পিছনেই ঘুরঘুট্টি অন্ধকার। আন্দাজে মনে হয় ওই অন্ধকারেই দোতলায় যাবার সিঁড়ি। বাড়িটা যে চারতলা সেটা বাইরে থাকতেই দেখেছি। উপর দিকে চাইলে লোহার গরাদের মধ্যে দিয়ে খোলা আকাশ দেখা যায়। গরাদের দরকার হয় বাঁদরের উৎপাত থেকে রেহাই পাবার জন্য।
এর পরে কী করা উচিত ভেবে পাচ্ছি না, এমন সময় ডান দিকের বারান্দায় চোখ গেল।
একটা লোক নিঃশব্দে দরজা দিয়ে বেরিয়ে এসে বাইরে দাঁড়িয়ে আমাদের দিকে দেখছে। মাঝবয়সী মাঝারি হাইটের লোক, গায়ে সবুজের উপর সাদা বুটি-দেওয়া কুর্তা, মাথায় কাজ-করা সাদা কাপড়ের টুপি। এক জোড়া পুরু গোঁফ ঠোঁটের দুপাশ দিয়ে নেমে গালপাট্টা হতে হতে হয়নি।
লোকটা মুখ খুলল। গলার স্বর শুনলে মনে হয় অনেক দিনের পুরনো ক্ষয়ে যাওয়া গ্রামোফোন রেকর্ড থেকে কথা বেরোচ্ছে। ফেলুদার দিকে তাকিয়ে লোকটা যে কথাটা বলল সেটা হচ্ছে এই—
‘শেঠজী আপসে মিলনা চাহতে হেঁ।’
‘কৌন শেঠজী?’ জিজ্ঞেস করল ফেলুদা।
‘শেঠ মগনলালজী।’
‘চলিয়ে’, বলে ফেলুদা লোকটার দিকে পা বাড়াল।