অতঃপর আল্লাহর ইচ্ছায় তিনি শুক্রবার কুবা ত্যাগ করেন। বনু সালেম ইবনে আওফের বস্তিতে গিয়ে তিনি জুমার নামায পড়েন। বাতনুল ওয়াদীর মসজিদে তিনি জুমার নামায আদায় করেন। বাতনুল ওয়াদীর আর এক নাম ওয়াদীয়ে রানুনা। এখানেই তিনি মদীনায় প্রথম জুমার নামায আদায় করলেন।
ইতবান ইবনে মালিক ও আব্বাস ইবনে উবাদা ইবনে নাদলা সহ বনু সালেম ইবনে আওফের একদল লোক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এসে বললো, “হে আল্লাহর রাসূল, আমাদের যা কিছু জনবল, সহায় সম্বল ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা আছে, তাতে খুশী হয়ে আমাদের এখানেই আপনি স্থায়ীভাবে বসবাস করুন।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের উষ্ট্রীকে দেখিয়ে বললেন, “একে তোমরা পথ ছেড়ে দাও। আল্লাহর তরফ থেকে এটির ওপর নির্দেশ রয়েছে আমাকে যথাস্থানে নিয়ে যাওয়ার।” সবাই তাই করলো। উষ্ট্রী নিজের ইচ্ছামত চলতে লাগলো। বনু বায়াদা গোত্রের বস্তির নিকট যখন হাজির হলো, তখন যিয়াদ ইবনে লাবীদ ও ফারওয়া ইবনে আমরের নেতৃত্বে বনু বায়াদা গোত্রের একদল লোক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট হাজির হয়ে বললো, “হে আল্লাহর রাসূল, আমাদের এখানে আসুন, আমাদের যে জনবল, সহায় সম্বল ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা আছে তাঁর মধ্যে এসে বসবাস করুন।” তিনি বললেন, “এই উষ্ট্রীকে তার ইচ্ছামত যেতে দাও। কেননা ওকে যথাস্থানে আমাকে পৌঁছে দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ” উষ্ট্রীটি চলতে লাগলো। বনু সায়েদার বস্তিতে পৌঁছলে সা’দ ইবনে উবাদা ও মুনযির ইবনে আমরের নেতৃত্বে বনু সায়েদার একদল লোক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পথ আগলে দাঁড়ালো। তারাও বনু বায়াদা ও বনু সালেমের মত একই অনুরোধের পুনরাবৃত্তি করলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বনু বায়াদা ও বনু সালেমকে যে কথা বলেছিলেন বনু সায়েদাকেও তাই বললেন। উষ্ট্রী অগ্রসর হতে লাগলো। যখন সেটি খাযরাজ গোত্রের বনু হারেস পরিবারের বাড়ীর পাশ দিয়ে চলতে লাগলো, তখন সা’দ ইবনে রাবী, খবেজা ইবনে যায়িদ ও আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা বনু হারেস পরিবারের আরো কিছু লোককে সাথে নিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পথ আগলে দাঁড়ালো। তারা তাদের পরিবারে অবস্থান করা ও তাদের জনবল, সহায় সম্বল ও নিরাপত্তা ব্যবস্থায় ওপর আস্থা রাখার আমন্ত্রণ জানালো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “তোমরা উষ্ট্রীকে যেতে দাও। কেননা এটি আমাকে উপযুক্ত স্থানে নিয়ে যাওয়ার জন্য আদিষ্ট।” সকলে পথ ছেড়ে দিলো এবং উষ্ট্রীটা সামনের দিকে এগিয়ে চললো। চলতে চলতে উষ্ট্রী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মামাদের পরিবার বনী আদী ইবনে নাজ্জারের বাড়ী অতিক্রম করলো। তখন বনী আদী ইবনে নাজ্জারের কতিপয় লোককে সাথে নিয়ে সালীত ইবনে কায়েস ও আবু সালীত উসাইরা ইবনে আবি খাবিজা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে এসে দাঁড়ালো। তারা বললো, “ইয়া রাসূলুল্লাহ, আপনারা আমাদের কাছে আসুন এবং আমাদের যা কিছু জনবল, সহায় সম্বল ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা আছে, তার ওপর আস্থা রাখুন।” তিনি বললেন, “উষ্ট্রীকে তার খেয়াল খুশীমত যেতে দাও। কারণ ওকে উপযুক্ত স্থানে আমাকে পৌঁছিয়ে দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।” এখানে উল্লেখ থাকে যে, বনী আদী ইবনে নাজ্জারেরই মেয়ে ছিলেন আবদুল মুত্তালিবের মা সালামা বিনতে আমর।
বনু মালিক ইবনে নাজ্জারের বাসস্থানের কাছে এসে উষ্ট্রী হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো। সে যেখানে বসলো সেখানেই পরবর্তীকালে সমজিদে নববীর প্রবেশদ্বার তৈরী হয়। তৎকালে ঐ জায়গাটা ছিলো বনু নাজ্জারের দুটো ইয়াতীম শিশুর খেজুর শুকাবার জায়গা। শিশু দুটো হলো আমরের ছেলে সাহল ও সুহাইল। তাদের লালন পালন করতো মায়য ইবনে আকরা। উষ্ট্রী হাঁটু গেড়ে বসলেও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার পিঠ থেকে নামলেন না। স্থির হয়ে বসে রইলেন। কিছুক্ষন পর উষ্ট্রীটি সামান্য কিছুদূর এগিয়ে গেলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখনও তার লাগাম শক্ত করে ধরে রাখলেন। অতঃপর উষ্ট্রী পিছনের দিকে ফিরে তাকালো এবং পুনরায় তাঁর প্রথম বিরতি স্থানে ফিরে এলা। সেখানে এসে হাঁটু গেড়ে বসলো। এবারে সে নড়াচড়া ও শব্দ করলো। তার বুক ও গলার নিম্নাংশ মাটিতে ঠেকিয়ে দিলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উষ্ট্রীর পিঠ থেকে নামলেন। আবু আইয়ুব খালিদ ইবনে যায়িদ তাঁর আসবাবপত্র নামিয়ে নিলো এবং নিজের ঘরে নিয়ে রাখলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু আইয়ুবের মেহমান হলেন। তাকে জিজ্ঞেস করলেন, “খেজুর শুকাবার জায়গাটা কার?” মায়ায ইবনে আকরা বললো, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, ওটা আমরের ছেলে সাহল ও সুহাইলের। ওরা আমার পালিত ইয়াতীম। আমি তাদেরকে সম্মত করিয়ে নেবো। আপনি এখানে মসজিদ তৈরী করুন। ” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঐ স্থানে মসজিদ নির্মাণে আদিষ্ট হলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর মসজিদ ও ঘরবাড়ী তৈরী হওয়া পর্যন্ত আবু আইয়ুবের বাড়ী অবস্থান করলেন। এই মসজিদ নির্মাণের কাজে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেই যোগদান করেন, যাতে মুসলমানরাও অংশগ্রহণ করার প্রেরণা পায়। ফলে মুহাজির ও আনসারগণ সকলেই ঐ কাজে পূর্ণ আগ্রহের সাথে অংশ নেন। এ সম্পর্কে জনৈক মুসলমান স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করেন,
“আমরা যদি বসে থাকি আর নবী কাজ করেন, তা হবে আমাদের চরম ভ্রষ্টতার পরিচায়ক। ” মসজিদ নির্মানের সময় মাঝে মাঝেই মুসলমানরা উদ্দীপনার সাথে কবিতা বলতেন। যেমন: “আখিরাতের জীবন ছাড়া আর কোন জীবনের গুরুত্ব নেই। হে আল্লাহ, আপনি আনসার ও মুহাজিরদের ওপর রহমত বর্ষণ করুন। ” আর তাদের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলতেন,“আখিরাতের জীবন ছাড়া আর কোন জীবনের গুরুত্ব নেই। হে আল্লাহ, আপনি আনসার ও মুহাজিরদের ওপর রহমত বর্ষণ করুন।”
মসজিদ ও থাকার ঘর নির্মিত হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু আইয়ুবের বাড়ী থেকে নিজের ঘরে গিয়ে বাস করতে লাগলেন।
আবু আইয়ুব বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন আমার বাড়ীতে মেহমান হলেন, তখন তিনি নিচের তলায় থাকতে লাগলেন আর আমি ও আমার স্ত্রী উপরে। আমি বললাম, “হে আল্লাহর রাসূল, আমি উপরের তলায় থাকি আর আপনি নীচের তলায় থাকেন তা আমার কাছে নিতান্ত অপছন্দনীয় ও গর্হিত কাজ। অতএব আপনি ওপরে থাকুন। আর আমরা নেমে এসে নীচে থাকি।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জবাব দিলেন, “আমাদের নীচে থাকাটা আমাদের জন্য এবং যারা আমাদের সাথে দেখা সাক্ষাত করতে আসে তাদের জন্য অধিকতর সুবিদাজনক।”
এ জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নীচের তলায় এবং আমরা ওপরের তলায় বাস করতে লাগলাম। একবার আমাদের একটা পানি ভর্তি কলসী ভেঙ্গে গেলো। আমাদের একটি মাত্র কম্বল ছিলো আর কোন লেপ বা শীতবস্ত্র ছিলোনা। অগত্যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের গায়ে তা থেকে পানি পড়বে এবং তাতে তিনি কষ্ট পাবেন এই আশংকায় আমি ও আমার স্ত্রী ঐ কম্বলটা দিয়েই পানি মুছে ফেললাম।
আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রাতের জন্য খাবার তৈরী করে পাঠাতাম। তিনি ঐ খাবারের উদ্বৃত্তটুকু ফেরত পাঠালে আমি ও আমর স্ত্রী বরকতের আশায় তাঁর হাত লাগানো জায়গা থেকেই খেয়ে নিতাম। একদিন রাত্রে এইভাবে তাঁর জন্য খাবার পাঠালাম। সেই খাবারে আমরা কিছু পিঁয়াজ বা রসুনও দিলাম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা ফেরত পাঠালেন। আমরা ঐ খাবারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাত স্পর্শ করার কোন চিহ্ন দেখতে পেলাম না। ফলে আমি ঘাবড়ে গিয়ে তাঁর কাছে গেলাম। বললাম, “হে আল্লাহর রাসূল, আপনার জন্য আমার বাপ-মা কুরবান হোক। আপনি খাবার ফেরত পাঠালেন অথচ তাতে আপনার হাতের স্পর্শের কোন চিহ্নই দেখলাম না। আপনি যখনই খাবার ফেরত দিতেন, আমি ও আমার স্ত্রী বরকত লাভের জন্য সেই খাবার আপনার হাত লাগানোর জায়গা থেকে খেতাম।”
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “আমি খাবারের মধ্যে অমুক গাছের গন্ধ পেয়েছি। যেহেতু আমাকে অনেকের মুখের কাছে মুখ নিয়ে আলাপ করতে হয়, তাই আমি খাইনি। অবশ্য তোমরা ওটা খেতে পার।” এরপর আমরা ঐ খাবার খেয়ে নিলাম। অতঃপর আর কখনো আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্য পিঁয়াজ বা রসুন পাঠাইনি ইবনে ইসহাক বলেন এরপর মুহাজিররা হিজরাত করে একের পর এক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট চলে আসতে লাগলেন। একমাত্র যারা বন্দী ছিলেন অথবা কঠোর নির্যাতনে ইসলাম ত্যাগে বাধ্য হয়েছিলেন, তাঁরাই মক্কায় থেকে গেলেন। মুষ্টিমেয় কয়েকটি পরিবার ছাড়া আর সব কয়টি পরিবারেরই অবস্থা এরূপ ছিলো যে, তারা তাদের পরিবারের সব লোক এবং ধন সম্পদ মদীনায় নিয়ে আসতে পারেনি। যে কয়টি পরিবার তাদের সকল সদস্যসহ হিজরাত করতে সক্ষম হয়েছিলো তারা হলো,বনু জুমাহ গোত্রের বনু মাযউন পরিবার, বনু উমাইয়ার মিত্র বনু জাহাশ ইবনে রিয়াব এবং বনু সা’দ ইবনে লাইসের বনু বুকাইর পরিবার যারা বনু কা’বের মিত্র ছিলো। হিজরাতের পর এদের ঘরবাড়ী একেবারেই জনশূন্য ও অর্গলবদ্ধ ছিল।