2 of 3

০৫৭. মিরাজের ঘটনা

ইবনে ইসহাক বলেন, আমি বিশ্বস্ত সূত্রে জানতে পেরেছি যে, আবু সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেছেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুখ থেকে শুনেছি, তিনি বলেছেন, “বাইতুল মাকদাসের অনুষ্ঠানাবলী সমাপ্ত হলে আমার সামনে ঊর্ধাকাশে আরোহণের সিঁড়ি হাজির করা হলো। এমন সুন্দর কোন জিনিস আমি আর কখনো দেখিনি। মৃত্যুর সময় হলে মানুষ এই সিঁড়িই দেখতে পায় এবং এর দিকে চোখ মেলে তাকিয়ে থাকে। আমার সঙ্গী (জিবরাইল) আমাকে ঐ সিঁড়িতে আরোহণ করালেন এবং আমাকে সাথে নিয়ে আকাশের একটি দরজায় গিয়ে থামলেন। এ দরজাকে ‘বাবুল হাফাযাহ’ বা রক্ষকদের দরজা বলা হয়। এখানে ইসমাঈল নামক একজন ফিরিশতা কর্তব্যরত রয়েছেন। তাঁর অধীনে রয়েছে বার হাজার ফেরেশতা এবং এইসব ফেরেশতার প্রত্যেকের অধীনেও আবার বার হাজার করে ফেরেশতা রয়েছে।” এই হাদীস বর্ণনা করার সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরাআনের এই আয়াতটি তিলাওয়াত করেন,

[আরবী *************]

“তোমার প্রভুর সৈন্য সামন্তের সংখ্যা তিনি ছাড়া আর কেউ জানে না।” (সূরা আলা মুদ্দাস্সির)

“অতঃপর যখন আমাকে নিয়ে তিনি ভেতরে প্রবেশ করলেন তখন ঐ ফেরেশতা জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে জিবরীল, ইনি কে?’ তিনি বললেন, ‘ইনি মুহাম্মাদ।’ ফেরেশতা আবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘ইনি কি নবী?’ জিবরীল বললেন, ‘হ্যাঁ।’ অতঃপর তিনি আমার কল্যাণ কামনা করে দোয়া করলেন।”

প্রথম আকাশে প্রবেশের পর আমি দেখতে পেলাম এক ব্যক্তি বসে আছেন। তাঁর কাছে সকল মৃত মানুষের আত্মা হাজির হচ্ছে। কোন কোনটা হাজির হলে তিনি খুব খুশী হচ্ছেন এবং প্রশংসা করে বলছেন, ‘এটি একটি পবিত্র আত্মা যা একটি পবিত্র দেহ থেকে নির্গত হয়েছে।’ আবার কোন কোনটা হাজির হলে তিনি চেহারায় বিরক্তি প্রকাশ করে বলছেন, ‘আহ! এটি একটি অপবিত্র আত্মা যা একটি পাপপংকিল দেহ থেকে নির্গত হয়েছে।’ আমি জিবরাইলকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘হে জিবরাইল, ইনি কে?’ জিবরাইল বললেন, ইনি আপনার পিতা আদম (আ)। তাঁর কাছে তাঁর সন্তানদের আত্মা হাজির করা হয়। কোন মুমিনের আত্মা দেখলে তিনি আনন্দিত হয়ে বলেন, ‘এটি একটি পবিত্র আত্মা যা একটি পবিত্র দেহ থেকে বেরিয়েছে।’ ্আর কোনা কাফিরের আত্মা দেখলে তিনি আর্তনাদ করে ওঠেন, তাকে অপছন্দ করেন এবং তার প্রতি বিরক্ত হয়ে বলেন, ‘এটি একটি পাপাত্মা যা কোন পাপিষ্ঠ দেহ থেকে নির্গত হয়েছে।’

অতঃপর কতগুলো লোক দেখলাম। তাদের ঠোঁট উটের মত এবং তাদের হাতের মুঠোয় দগদগে জ্বলন্ত ছোট ছোট পাথর টুকরো রয়েছে। সেগুলো তারা মুখে পুরছে। আর পরক্ষণেই তা মলদ্বার দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘হে জিবরীল, এরা কারা?’ তিনি বললেন, ‘এরা ইয়াতীমের সম্পদ আত্মসাতকারী।’

এরপর আরো কিছু সংখ্যক লোক দেখলাম। তাদের পেটের মত বীভৎস আকৃতির পেট আর কখনো দেখিনি। দেখলাম, ফেরাউনের সহযোগীদের যে পথ গিয়ে দোযখে নেয়া হচ্ছে, সেই পথের ওপর তারা [৩৪.ফিরাউনের সহযোগীদের জাহান্নামের কঠিনতম শাস্তি ভোগ করতে হবে বলে কুরআনে উল্লেখ রয়েছে।] অবস্থান করছে। তারা পিপাসা-কাতর উটের মত ছটফট করছে। আর ফিরাউনের দোযখগামী অনুসারীরা তাদেরকে পায়ের তলায় পিষ্ট করে যাচ্ছে তথাপি সেখান থেকে একটু সরে বসবার ক্ষমতাও তাদের নেই। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘হে জিবরীল, এরা কারা?’ তিনি বললেন, ‘এরা সুদখোর।’

অতঃপর আরো একদল লোক দেখলাম। তাদের সামনে উৎকৃষ্টমানের পুষ্ট গোশত রয়েছে। আর তার পাশেই রয়েছে উৎকট দুর্গন্ধ যুক্ত খারাপ গোশত। অথচ তারা ভালো গোশত বাদ দিয়ে খারাপ গোশত খাচ্ছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘হে জিবরীল, এরা কারা?’ তিনি বললেন, ‘এরা সেই সব লোক যারা বৈধ স্ত্রী থাকতে নিষিদ্ধ স্ত্রী লোকের কাছো যায়।’

অতঃপর কিছু সংখ্যক নারীকে দেখলাম তাদের স্তনে রশি বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম ‘হে জিবরীল এরা কারা?’ তিনি বললেন, ‘এরা সেই সব নারী যারা ব্যভিচারের মাধ্যমে অন্যের ঔরসজাত সন্তান স্বামীর সন্তানদের অন্তর্ভুক্ত করে দেয়।’

এরপর তিনি দ্বিতীয় আকাশে আরোহণ করালেন। সেখানে দুই খালাতো ভাই ঈসা (আ) ও ইয়াহইয়া ইবনে যাকারীয়ার (আ) সাক্ষাত পেলাম।

অতঃপর জিবরীল (আ) আমাকে তৃতীয় আকাশে আরোহণ করালেন। সেখানে এক ব্যক্তিকে দেখলাম। তাঁর চোহারা পূর্নিমার চাঁদের মত উজ্জ্বল। আমি বললাম, ‘হে জিবরীল, ‘ইনি কে?’ তিনি বললেন, ‘ইনি ইয়াকুবের (আ) পুত্র ইউসুফ (আ)।’

অতঃপর চতুর্থ আকাশে আরোহণ করে সেখানে আর এক ব্যক্তিকে দেখলাম। জিবরাইল জানালেন ইনি ইদ্রিস (আ)। অতঃপর পঞ্চম আকাশে আরোহণ করলাম। সেখানে দেখলাম, সাদা চুল ও দীর্ঘ শ্মশ্রুধারী এক বৃদ্ধ। অত সুন্দর বৃদ্ধলোক, আমি আর কখনো দেখিনি। জিজ্ঞেস করলাম, ‘হে জিবরীল, ইনি কে?’ তিনি বললেন, ‘তিনি স্বজাতির কাছে প্রিয় হারুন ইবনে ইমরান (আ)’! অতঃপর ষষ্ঠ আকাশে পৌঁছলাম। সেখানে দেখলাম বাদামী রংয়ের লম্বা নাক বিশিষ্ট এক দীর্ঘায়ী পুরুষ, যেন শানুয়া গোত্রের লোক। আমি বললাম জিবরাইল ইনি কে?’ জিবরাইল বললেন, ‘তিনি আপনার ভাই মূসা ইবনে ইমরান (আ)।’

অতঃপর আমাকে সপ্তম আকাশে আরোহণ করালেন। সেখানে দেখলাম, বাইতুল মামুরের দরজার কাছে একটি চেয়ারে এক বৃদ্ধ বসে আছেন। তোমাদের সঙ্গী (অর্থাৎ মুহাম্মাদ (সা) স্বয়ং তাঁর সাথে সবচেয়ে বেশী সাদৃশ্যপূর্ণ। বাইতুল মামুরে প্রতিদিন সত্তর হাজার ফিরিশতা প্রবেশ করে এবং তারা আর ফিরে আসে না। এভাবে কিয়ামত পর্যন্ত চলতে থাকবে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ইনি কে?” তিনি বললেন, ‘তিনি আপনার পিতা ইবরাহীম (আ)।’

অতপর তিনি আমাকে নিয়ে জান্নাতে প্রবেশ করলেন। সেখানে ঈষৎ কালো ঠোঁট বিশিষ্ট একটি পরমা সুন্দরী যুবতীকে দেখলাম। তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি কার জন্য?’ সে বললো, ‘যায়িদ ইবনে হারেসার জন্য।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যায়িদ ইবনে হারেসাকে এই সুসংবাদটি জানিয়ে দিয়েছেন।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “এরপর আমি ফিরে এলাম। আসার পথে মূসা ইবনে ইমরানের (আ) সাথে দেখা হলো। বস্তুত: তিনি তোমাদের একজন উত্তম বন্ধু। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার ওপর কয় ওয়াক্ত নামায ফরয করা হয়েছে?” আমি বললাম, ‘প্রতিদিন পঞ্চাশ ওয়াক্ত।’ মুসা বললেন, ‘দেখ, নামায বড় কঠিন কাজ। তোমার উম্মাত খুবই দুর্বল। তুমি আল্লাহর কাছে ফিরে যাও এবং তোমার উম্মাতের জন্য দায়িত্ব আরো হালকা করে দিতে বল।’ আমি আল্লাহর কাছে ফিরে গেলাম এবং আমার ও আমার উম্মাতের দায়িত্ব হালকা করে দিতে অনুরোধ করলাম আল্লাহ দশ ওয়াক্ত নামায কমিয়ে দিলেন।অতঃপর ফিরে আসলাম। মূসার সাথে আবার দেখা হলো। তিনি আবার আগের মত বললেন। আমি আবার গিয়ে আল্লাহকে নামায কমিয়ে দেয়ার আবেদন জানালাম। আল্লাহ আরে দশ ওয়াক্ত নামায কমিয়ে দিলেন। এভাবে তিনি ক্রমাগত আমাকে পরামর্শ দিতে লাগলেন।

যখনই তাঁর কাছে ফিরে যাই, তিনি বলেন, ‘যাও, আরো কমিয়ে দিতে বলো। এভাবে কমাতে কমাতে দিনে পাঁচ ওয়াক্ত নামায বাকি রইল। এবারও মূসার (আ) কাছে ফিরে এলে তিনি আরো কমিয়ে আনার পরামর্শ দিলেন। আমি বললাম, ‘বহুবার আল্লাহর কাছে ফিরে গিয়েছি এবং কমিয়ে দিতে বলেছি। আমি লজ্জাবোধ করছি। তাই আর ফিরে যেতে পারবো না।’

অতএব যে ব্যক্তি এই পাঁচ ওয়াক্ত নামায ঈমান ও সতর্কতার সাথে পড়বে, সে পঞ্চাশ ওয়াক্ত ফরয নামাযের সওয়াব পাবে।”

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *