হিরোশিমা

হিরোশিমা

হিরোশিমা। নামটার মধ্যেই একটা ভয়ংকর বিস্ফোরণ যেন জমাট বেঁধে আছে। অনেক রক্ত, আগুন, অনেক অশ্রু, আর যন্ত্রণায় মাখামাখি হয়ে আছে একটি নাম। আমি হিরোশিমাতে যাবার জন্য চেষ্টা করেছিলুম, প্রথম যখন জাপান যাই। সম্ভব হয়নি সেবারে। দেখেছিলুম কেবল মন্দির আর বাগান, কেবল প্রাসাদ, নাটক। নো আর কাবুকী। কিন্তু বাইশ বছর বাদে আমিও অন্য মানুষ। আমার এখন হিরোশিমা না দেখে ফেরার ইচ্ছে নেই। কীভাবে ভেঙে যাবার পরেও গড়ে ওঠে মানবসভ্যতা, কীভাবে প্রবাহিত হয় জীবন, কী ভয়ালভাবে সহজ হয়ে আসে ভয়ংকরের স্মৃতি, কীভাবে সহবাস করা যায় বিদ্বেষের ঘৃণার বিষের সঙ্গে, শান্তির জাদুমন্ত্র আর সচ্ছলতার সোনার কঠিন ছোঁওয়া লাগলে, হিরোশিমা আজকে আমাকে এইসব শেখাবে। যুদ্ধের প্রবল পরাজয় যুদ্ধের বিপুল গ্লানি ধুয়ে মুছে ফেলেছে নতুন জাপান। জীবনের সকল নীতির রাজা হচ্ছে অর্থনীতি। জাপানের কোনও অভাব নেই। হিরোশিমা- নাগাসাকিকেও সদম্ভে পুনরুজ্জীবিত করবার মতো শক্তি রাখে সে। মুছে গেছে কিছু নিরীহ মানুষ। কিছু ভালবাসার ইতিহাস। এই নশ্বর উদ্ধত বর্তমানের পটভূমিতে সেই দুঃস্বপ্নের স্মৃতি কে জানে হয়তো একদিন ম্লান হয়ে যাবে। এখন মানুষের হাতে হাজার হাজার হিরোশিমা ধ্বংস করার মতো দিব্য অস্ত্র মজুত আছে। এখন মানুষ আরো হিংস্র, মারণ-উচাটনে আরো পারদর্শী, এখন বিজ্ঞান আরো নীচে নেমেছে। তবুও মানুষের নৈতিকতাকে হঠাৎ যেন থাবড়া মেরে জাগ্রত করে ‘হিরোশিমা’ এই শব্দ। বুকের ভেতরে একটা ঘুমিয়ে থাকা মন উঠে বসে। ভাবতে শুরু করে। অতীত নয়, ভবিষ্যতের ভাবনা। ১৯৪৫-এর আগস্টের ৬ই যা হয়েছিল তার চেয়ে অনেক বৃহত্তর দুঃসময় মানবসভ্যতার অদৃষ্টে আসতেই পারে। তার সব বন্দোবস্ত করে রেখেছি আমরা। পারমাণবিক যুদ্ধ সুদূর কল্পনা নয়। সম্ভাব্য পরিস্থিতি। এই গ্লাসনস্ত বহুকাঙ্ক্ষিত,—জানি না সাধারণ মানুষের প্রার্থনায় ইতিহাসের কালপুরুষ সাড়া দিলেন কিনা পারমাণবিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা বন্ধ না হলে, মানুষের শিল্প সাহিত্য-চর্চা তো অর্থহীন। পদ্মপত্রে জল।

ছাত্র বয়সে ইংলন্ডে C N D ব্যাজ লাগিয়ে বারট্রান্ড রাসেলের নেতৃত্বে অলডারমাসটন মার্চ করেছি, বান্ধবী কুমারী জয়বর্ধনের সঙ্গে। পারমাণবিক যুদ্ধ নিয়ে তখন অনেক বেশি দুর্ভাবিত ছিলেন ছাত্রছাত্রী এবং বুদ্ধিজীবীরা। গর্ভের প্রথম সন্তানটিকে নিয়েও আমি অলডারমাসটনে পুরো একদিন হেঁটেছি। আমি চাইনি আমার সন্তান এমন পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হয় যেখানে পারমাণবিক যুদ্ধের সম্ভাবনা আছে। যেখানে জলে, বাতাসে মিশে থাকবে রেণু রেণু তেজস্ক্রিয় বিষ— শস্যে ঝরতে পারে তেজস্ক্রিয় ছাই—কে জানে ছ’টা করে আঙুল, চারটে চোখ নিয়ে জন্মাবে কিনা আমার শিশু? তার কান থেকে ছত্রাক গজিয়ে উঠবে কিনা? রোজ রাত্রে আমি এসব দুঃস্বপ্ন দেখতুম। কেমব্রিজ শহরে তখন আমি নিউনহ্যাম কলেজের ছাত্রী। গর্ভস্থ শিশুকে নিয়ে আমার দুর্ভাবনার অন্ত ছিল না। কোন বিকৃত পৃথিবীতে ডেকে আনছি আমি আরও একটি মানুষকে? যে পৃথিবীতে হিরোশিমা-নাগাসাকি আছে। হিরোশিমাকে আমার কখনই অতীত বলে মনে হয়নি, মনে হয়েছে ভবিষ্যতের এক ঝলক মাত্ৰ।

হিরোশিমা যখন ঘটেছিল আমি তখন শিশু। কিছুই বুঝিনি। কিন্তু পরে, কৈশোরে একটি ডকুমেন্টারি দেখেছিলাম, হিরোশিমা-নাগাসাকি বিষয়ে। তারপরে, “হিরোশিমা মন আমুর” ছবিতে বেশ কিছু স্টিল ছবি। কৈশোরের ঐ ডকুমেন্টারিটাই আমার মনে আণবিক যুদ্ধের ভয়াবহতার স্পষ্ট ও পরিপূর্ণ ছাপ ফেলে গিয়েছিল। তখন থেকেই আমি নিউক্লিয়ার ডিজ-আরমামেন্টের পক্ষে। পরে ছাত্র বয়সে ইংলণ্ডে গিয়ে C N D-র সংস্পর্শে এলে, সেই জীবনদর্শন আরো জোর পেল।

যখন প্রথমবার জাপানে যাই তখন ভিয়েতনাম যুদ্ধের দশ বছর হয়েছে। প্রচণ্ড অ্যান্টি-ভিয়েতনাম যুদ্ধ প্রতিবাদ গড়ে উঠেছে প্রগতিপন্থী মার্কিনী ছাত্রমহলে। ভিয়েনামে নাপাম বোমা পড়েছে। বোমাতে রাসায়নিক বিষ ব্যবহারের অমানুষিকতার বিরুদ্ধে মার্কিন ছাত্রদেরই একাংশের বিবেক গর্জে উঠেছে। বার্কলে-তে ঘটে গেছে বিখ্যাত ফ্রীস্পীচ ছাত্রবিক্ষোভ। আমিও ভাগ্যচক্রে তখন সেইখানেই ছাত্রী। সেই বিক্ষোভের দলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্তও। কাজেই জাপানে গিয়েও যে হিরোশিমা-নাগাসাকিতে যাওয়া হল না, এতে একটা অভাববোধ নিয়েই দেশে ফিরেছিলাম। অর্মত্য বক্তৃতা দেওয়া নিয়ে অসম্ভব ব্যস্ত ছিলেন—সেবারে তিনি কোথাওই যেতে সময় করতে পারেননি।—আমি একাই আমার জাপানি কলেজবন্ধু কিয়োডো সংবাদসংস্থার চাকুরে যুকিও কুদোর সঙ্গে যে-যে জায়গা দিনে দিনে দেখে আসা যায় শুধু সেইসব দ্রষ্টব্য স্থানেই গেছি। হিরোশিমা, নাগাসাকি তার মধ্যে পড়ে না। এবারে আমি একা।

বক্তৃতার ঝামেলাও নেই। সেসব সেরে এসেছি মার্কিন দেশে, আর মেক্সিকোতে। “ভারত উৎসবে” প্রায় দশ জায়গায় বক্তৃতা আর কবিতাপাঠ করেছি। জাপানে শুধু ছুটি। শুধু বেড়ানো। কপালগুণে জাপানের বর্তমান রাষ্ট্রদূত আর তাঁর স্ত্রী আমার বন্ধু, ফলে আতিথ্যের অসুবিধে নেই বরং এক প্রচণ্ড ভি আই পি ট্রিটমেন্টে লজ্জা পাচ্ছি অনবরত।

খোদ এরোপ্লেন থেকেই আমাকে রিসিভ করে নিয়ে গেলেন তাঁর দূত। আমায় নিয়ে টোকিও আর তার আশপাশে ঘুরে বেড়ানোর ভার নিয়েছিলেন স্বয়ং মাধবন আর গিরিজা নিজেরাই—কবিতাপ্রিয়, সঙ্গীতপ্রিয়, চিত্রপ্রিয়, অত্যন্ত সুকুমার মনের দম্পতি মাধবন এবং গিরিজা। ওঁদের সঙ্গে থাকায় জাপান যেন আরো অর্থপূর্ণ হয়ে উঠেছিল আমার কাছে। আমার জন্য একটি কবি সম্মেলনের পর্যন্ত ব্যবস্থা করেছিলেন তাঁরা। প্রসিদ্ধ দুই জাপানি কবিকে ডেকে এনেছিলেন। অবাক কাণ্ড। ঠিক সেই দুজন কবিই সম্প্রতি “কবিতা এশিয়া”তে জাপানের প্রতিনিধিত্ব করে গেলেন ভারতবর্ষে। গিরিজা অনবদ্য গান করেন, মাধবন কবি। গিরিজার মা অপূর্ব ছবি আঁকেন। জাপানে তাঁর একটি ফুলের ছবির প্রদর্শনী হয়ে গেছে। ওঁদের কথা পরে হবে। সেসব মিষ্টকথা। আগে হিরোশিমা।

হিরোশিমা যেতে হবে ‘কোবে’ থেকে। কোবে-তে আমার বন্ধু গোপাদিরা আছেন। আমি চলে গেলুম সোজা তাঁদের বাড়িতে, তাঁদের মেয়েজামাই রীণা-রতনের কাছে। সেখান থেকে হিরোশিমা ট্রেনে তিন ঘণ্টার পথ। ও নিজে নিজেই চলে যেতে পারবো। সুপার ফাস্ট ট্রেন আছে, জাপানের গর্ব।

অসুবিধে কেবল একটি। জাপানিভাষা আমি জানি না। বাংলাভাষা জাপানিরা জানে না। ইংরিজিও না। ফরাসিও না। এমনকি জগতের শ্রেষ্ঠভাষা হিন্দিও না। পরে আবিষ্কার করেছিলুম টোকিও রেডিওতে তিনজন জাপানি ভদ্রলোক চমৎকার বাংলাদেশী বাংলায় আড্ডা দিতে পারেন। কিন্তু কোবে-তে? কেউ নেই। তাতে কি? সারাটা জীবন প্রতিটি মনুষ্যই তো একা একা ঘুরে বেড়াচ্ছে এক ঝাপসা, আধো-চেনা, বিভাষী পৃথিবীতে। যেখানে কেউ কারুর ভাষা বোঝে না। এই আবছা আলো-আঁধারিতেই তো বড় হয়েছি, পারব না কেন হিরোশিমাতে যেতে? খুব পারব। ইচ্ছে থাকলেই পারা যায়।

পরের দিন ভোরবেলায় একটা ট্রেন, দশটা নাগাদ আর একটা। ভোরেরটা পারব না, দশটারটা ধরতে হবে। রীণা বললে স্টেশনে পৌঁছে, ট্রেনে তুলে দেবে। স্টেশনেও নাকি কেউ ইংরিজি বলে না। পাছে অন্য কোথাও চলে যাই! তার নবনীতাদিকে ততটা নির্ভরযোগ্য মনে হচ্ছে না, নবনীতাদির জগৎপারাবারকে যতটা নির্ভরযোগ্য বলে মনে হয়। বেশ, তোমার যা

খুশি। রীণা যেমন রূপসী, তেমনি কর্মপটিয়সী। আর আমি তো সমর্পণ করেই আছি।

কোবে-তে আগে আসিনি। সব শহরেরই নিজস্ব একটা চরিত্র থাকে, কলকাতা, কাশী, দিল্লি, মাদ্রাজ। তেমনিই কিয়োটো, টোকিও, ওসাকা, নারা—সবাই আলাদা। এবং কোবে-ও। সমুদ্রতীরে বন্দর, গ্যাস রিফাইনারি ভর্তি হলেও তথাচ অত্যন্ত সুদৃশ্য শহর। ভারি সুন্দর পুরোনো অঞ্চল আছে একটি, তারই কাছে আমাদের বাস—অল্প অল্প পাহাড়ী, সুন্দর পুরোনো ধরনের ছোটো ছোটো জাপানি স্টাইলের বাড়ি, নুড়ি পাথরের বাঁধানো সরু অলিগলি, তাতে ফুল ফল সব্জির খোলাবাজার, এখানে-ওখানে লাল টুকটুকে গালার ছাদওলা বুদ্ধমন্দির, সবুজ পার্ক, হঠাৎ ঝরনা, পাহাড়ি রাস্তা। আবার নতুন কোবে-ও আছে। জগতের সকল আধুনিক শহরের মতোই নিশ্চরিত্র। উঁচু বাড়ি, দোকানপাট, রাজপথ। এর মধ্যে দিয়ে গাড়ি এসে গেল ইস্টিশানে।

এমন নিঃশব্দ, নির্জন, পরিচ্ছন্ন ইস্টিশান জীবনে দেখিনি। যেন মোটে ইস্টিশানই নয়, গির্জে টির্জে হবে। প্রার্থনার ঘণ্টা পড়লো বলে।

কেউই বিশেষ ইংরিজি বলে না কোবে-তে। সত্যি, ইস্টিশানে বেশ অসুবিধে হত রীণা সঙ্গে না এলে। কী অবিশ্বাস্য ধরনের পরিচ্ছন্নতা এখানে, কী অপরিসীম নিয়মানুবর্তিতা, এবং রীতিমতো বেদনাদায়ক শান্তি! এই কি শিন-কোবে? না এটাই হিরোশিমা? ইস্টিশান বলতেই আমি বুঝি হাওড়া-শ্যালদার মতন জমজমাট কাণ্ডকারখানা : এখানে থুতু—ওখানে পানের পিক—সেখানে পকেটমার—পানবিডিসিগ্রেট— আমকলা-কমলালেবুর খোসার আছাড়-

পানবিড়িসিগ্রেট—আমকলা-কমলালেবুর মাছের ঝুড়ির আঁশটে গন্ধ—হৈ হৈ ব্যাপার রৈ রৈ কাণ্ড—মারমার—হ্যাটহ্যাট্-গেল গেল-ধর্ ধর্। মাইকে একটানা উচ্চৈঃস্বরে একই সুরে দুর্বোধ্য ঘোষণা, কুলিদের গুঁতোগুঁতি, এই বুঝি ট্রাংক পড়ল মাথায়—ওই বুঝি ট্রলি চলে গেল পায়ের ওপর দিয়ে। কী মশাই? দেখতে পান না? আরে আরে মারবি নাকি? দাঁড়া একটা পুলিশ ডাকি। তা নইলে কিসের ইস্টিশান! এখানে যেন কবরখানার শান্তি। যেন কারুর কোনও তাড়া নেই। যেন কেউ ট্রেন ধরছে না! হাওয়া খেতে এসেছে।

যত দেখছি তত রাগ হয়ে যাচ্ছে ভেতরে ভেতরে। এ-জাতটা বড্ড ভেতরে-একরকম, বাইরে-আরেকরকম। সাধে কি ‘ইনস্ক্ৰটেবল ওরিয়েন্টাল’ দের ইমেজ তৈরি হয়েছে?

জাপানে টেনশান এতই প্রবল যে ইসকুলের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে আত্মহত্যার হার জগতে সবচেয়ে বেশি। অথচ দেখে টের পাবার জো নেই। আচ্ছা মানুষ তো জাপানিরা! যেন যাচ্ছেতাইরকম শান্তিপ্রিয়, এমনি একখানাভাব দিয়ে রাখে সর্বত্র। অথচ যুদ্ধের সময়েই দিব্যি দেখা গেছে জাতটা কেমন জঙ্গী। সামুরাইদের দেশ, আটার অল্! কী রক্তারক্তি কী হিংস্রতা কী নির্দয় হৃদয়হীনতা দেখি জাপানি সিনেমাতে! এখন মৃত্যুর এতরকম সহজ পথ থাকতেও নিজের পেট নিজে চিরে এরা হারাকিরি করে মরে। বড্ড নিঃশব্দ নিষ্ঠুর সূক্ষ্ম ভয়াল বিপরীতমুখী সভ্যতা এদের। এদিকে সুকুমার পুষ্পপ্রীতি, তুলির টান, ওদিকে নিষ্ঠুর ছুরির পোঁচ। এত ভালোমানুষী কি ভাল? জাপানি সৌজন্য, জাপানি ভব্যতার সঙ্গে জাপানি ক্রুরতা হিংস্রতাকে একদম মেলানো যায় না,–এইসব হিংসে-হিংসে মন্দ-কথা ভাবছি, আর বৈঠকখানার মতন ঝাঁ চক্‌চকে মেঝেওলা নির্জন ঝকঝকে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হিরোশিমার ট্রেনের প্রতীক্ষা করছি। প্ল্যাটফর্মে প্রতীক্ষার স্থান, আর ট্রেনলাইনের মধ্যে আবার সতর্কতামূলক রেলিং দেওয়া। তার মধ্যে মধ্যে দরজাও দেওয়া আছে। টিকিট, কোচ নম্বর মিলিয়ে নিয়ে সঠিক দরজার সামনে দাঁড়ালেই ট্রেন এলে ঠিকঠাক কোচে ওঠা যাবে। দৌড়োদৌড়ি খোঁজাখুঁজি লাগে না। সেই দরজাতেই সেই কোচ এসে বশংবদ পালকির মতন দাঁড়াবে। সব নিয়মবাঁধা। অঙ্ককষা। আগের থেকে ছকে ফেলা। এই গুণেই অষ্টাদশ শতকে ওরা পর্তুগীজ দস্যুদের হাত থেকে জাপানকে রক্ষা করতে এবং ওলন্দাজ বণিকদের সঙ্গে বাণিজ্য করতে এক অভিনব উপায় ঠাওরেছিল। যীশুর ছবির ওপর পা-মাড়িয়ে আসতে হত সব শ্বেতাঙ্গদের, বন্দরে ঢোকার সময়ে। পর্তুগীজরা পারত না। ওলন্দাজরা পারত। তারাই বণিক। তাদের ঢুকতে দিত জাপান। মনুষ্যচরিত্র নিয়ে এ কূটবুদ্ধি সহজ মগজের ফসল? জাপানি মগজ সোজা বস্তু নয়। ট্রেন আর প্ল্যাটফর্মের অঙ্ক সে তুলনায় নস্যি। কিন্তু আমার মতো বেনিয়মী মানুষের পক্ষে এত বেশি সুচারু নিয়ম যেন নীতিবিরুদ্ধ ব্যাপারের মতো কষ্টকর। ট্রেনের স্বয়ংক্রিয় দরজার সঙ্গে প্ল্যাটফর্মের ক্ষুদে দরজাগুলো একতারে বাঁধা। ট্রেন এলে, ট্রেনের দরজা খুললে এ দরজাও খুলবে। ইস্টিশানে যে দু’চারজন যাত্রী আছেন, নিঃশব্দে ক্ষুদে দরজার সামনে কিউ দিয়েছেন। কেউ বোধহয় কথাবার্তা বলে না এখানে দরকারে না পড়লে। বাপরে, কি শ্বাসরোধী নিয়মবাগীশ এরা! নিঃশব্দে হুপ্ করে হঠাৎ এসে পড়ল সুশ্ৰী সুপার-সনিক ট্রেন শিন-কান-সেন (নবনীতা সেনের কোনও আত্মীয় নয়)। দোর খুলল। প্ল্যাটফর্মের দোরও খুলল। যাত্রীরা সারিবন্দী ঢুকলেন। আমিও। ভিতরটাও চমৎকার। অথচ আমার তো সবচেয়ে সস্তার টিকিট। শীততাপনিয়ন্ত্রিত তো বটেই, অত্যন্ত আরামপ্রদ সীট, বড় বড় বিরাট জানলা, ঝক্‌ঝকে পরিচ্ছন্ন—কেবল কার্পেটটি নেই; এইটে হল সস্তার লক্ষণ। কোবে ছাড়তেই টানেল। কেবলই টানেল। টানেলের পর টানেল। বসেছি জানলার ধারে। বেশ লাগছে।

মাঝে মাঝে এক ঝিলিক দিনের আলোতে মাখামাখি সবুজ নীল আকাশ পাহাড় খানিক উঁকি দিয়েই লুকিয়ে পড়ছে টানেলের চিরনিশায়। সমানেই লুকোচুরি দিনের সঙ্গে রাতের। দ্যাখ্-না-দ্যাখ্ ‘ভ্যানিশ‍!

এতদিন ছিলুম আলাস্কায়, উত্তর মেরুতে, “মিডনাইট সান’-এর দেশে, এখন এসে পড়েছি ‘রাইজিং সান’-এর রাজ্যে। মাঝখানে পার হয়েছি ইন্টারন্যাশনাল ডেটলাইন। কোবে থেকে হিরোশিমার পথে, দক্ষিণে সবুজ পাহাড়, দূরে বামে নীল সমুদ্র। কাছাকাছি গ্রাম, ক্ষেত, মানুষের বসতি।—”হাই! গোদাইমাস্তা”–বিনয়ে বিগলিত, শরমে লাঞ্ছিত মৃদুভাষী, মৃদুহাসি, তরুণ টি. সি. এসে আগেই ধন্য হয়ে টিকিট দেখতে চাইছেন, যেন বিশেষ একটা অপরাধ করে ফেলছেন এমনভাবে জনে জনে মার্জনাভিক্ষার-ভঙ্গিতে? হায়রে টি. সি.। যাও আমাদের দেশে গিয়ে শিখে এসো কী করে টিকিট চাইতে হয়। তবে হ্যাঁ, টিকিট কেবল থাকলেই সেভাবে চাওয়া যায়। টিকিট যাদের নেই, তাদের বেলা অন্য সুরে। নইলে আবার পৈতৃক প্রাণটাই চলে যাবে। ট্রেনে সুবেশিনী মেয়েরা ফিরি করে বেড়াচ্ছেন জলখাবার, হাতে বেতের সাজি ঝুলিয়ে। সাজিতে থরে থরে সুদৃশ্য টিফিন বাক্সে সাজানো, তাতে আছে হয় মাছ ভাত সমেত জাপানি লাঞ্চ, নইলে “সাংউইচি”, অথবা টাটকা ফল। সুর করে মৃদু হেঁকে বিক্রি করছেন এসব খাদ্যবস্তু তাঁরা। আরো নানা জাপানি খাদ্যদ্রব্য বিক্রি হচ্ছে ফিরিওলা মারফত। আমার সঙ্গে একটা চীজ স্যান্ডউইচ্, দুটো ‘স্প্রাইটের’ (লিমকা জাতীয়) টিন আছে। গোপাদির দেওয়া।

জানলার বাইরে এখন আরেকটু বেশিক্ষণ মাঠঘাট বাড়িঘর দেখা যাচ্ছে। আর কী যে সুন্দর সুন্দর সব বাড়ি এদিকে! কবেকার তৈরি জানি না তবে একসঙ্গে এত মনোলোভা ছাদের সারি বাপু আমি আগে কোথাও দেখিনি। সবই চক্‌চকে ঝক্‌ঝকে সেরামিকসের টালি। রোদ-পিছলে পড়া নীল, সবুজ হলুদ, লাল, গ্রে, মেরুন, বাদামী, টাকোয়াজ। এমনকি রুপোলি রঙেরও সেরামিক্‌সের ছাদ রয়েছে। এইসব রূপকথার ছাদের তলায় কেমনতর সে ঘরদুয়ার? কেমন সব দরজা-জানলা? হাতে তৈরি কাগজের দেওয়াল কি? মাদুর বোনা মেঝে কি? কাগজের লণ্ঠন দোলানো বাতি দুলছে ড্রাগনের ছবি অঙ্গে নিয়ে? রেশমী কিমোনো-পরা, খোঁপায় কাঠের চিরুনি-গোঁজা গোলাপী মেয়েরা হাঁটু মুড়ে বসে চা-পান-উৎসব-করেন কি এইসব ছাদের নিচে? যেন রঙচঙে কাচের বাসন—কী ঝক্‌ঝকে, আর কতরকম রঙ! কোবে-তেও আছে কয়েকটি এই ধরনের ছাদ, রীণা-রতনদের বাড়ি থেকে দেখা যায়। ওদের বাড়ি থেকে সারাটা শহর দৃশ্যমান বন্দরের, সমুদ্রের, জাহাজের, লাইট হাউসের অসামান্য ছবি ফোটে ওদের প্রত্যেকটি ঘরের জানালায়। দিনে এরকম, রাতে আরেকরকম। কোনও একদিন মধ্যযুগীয় দুর্গশহর হিরোশিমাতেও নিশ্চয় ছিল এইরকমের সুদৃশ্য ছাদওলা, কাঠের কাজকরা কাগজের দেয়ালওলা, সুকুমার শিল্পিত ঘরবাড়ি, তাতে শান্ত মানুষের সংসার। সেই হিরোশিমা আমি দেখবো না, আমি দেখবো আরেকটি শহর। পুনর্জন্ম হয়েছে যার। হিরোশিমাতে যাব বলেই কোবে-তে এসেছি।

রুপোলি সেরামিকসের ছাদ বেয়ে রোদ যেন একথালা গলানো রূপোর মতো ছলকে পড়ছে—কাচের টালিগুলোতে রোদ ঠিক যেন মাছের আঁশে রোদ্দুর, –বাড়িগুলো সত্যি সত্যি অবাস্তব দেখাচ্ছে। কেবল ওই চারিদিকে উঁচু উঁচু বিজলীর স্তম্ভের আর বিদ্যুৎ তারের জালিকাজের জন্যেই যা বিশ্বাসযোগ্য, নইলে হিরোশিমার পথে ওই গাঢ় সবুজ পাহাড়ের কোলে ওইসব বর্ণাঢ্য ঘরবাড়ি—নাঃ। জাপান, সত্যি। সেলাম!

এই অঞ্চলটাতে ক্ষেতখামার অনেক দেখছি। ধানক্ষেতে চাষীরা কাজ করছে, কে জানে এখন ওদের চাষের ঠিক কোন্ কাজের সময়। জল-কাদার মধ্যে একটা দু’চাকার গাড়ি মেসিনে চালিয়ে বেড়াচ্ছে। লন-মোওয়ার টাইপের দেখতে। তার পিছনে কী এক যন্তর বাঁধা। লাঙ্গল কিনা এত দূর থেকে বোঝা যাচ্ছে না। চাষীদের মাথায় বেতের টোকা দেখে বেশ আনন্দ হল। বেশির ভাগ ক্ষেতেই জল। যেসব ক্ষেত শুকনো, তাতে লাইন টেনে শিরেলি তৈরি করে ফেলা হয়েছে। দেখে মনে হয়, জল দেওয়া, বা শুকনো রাখা, দুটো চাষীর হাতে। পাশাপাশি দু’টো ক্ষেত দু’রকম কি না। আমার শ্বশুরমশাই থাকলে ব্যাপারটা ঠিকঠাক বুঝতেন, ধানই তাঁর শেষ বয়েসের প্রেম হয়ে উঠেছিল। মানুষের মুখে অন্ন যোগাতে পারার চেয়ে বড় পুণ্য তিনি আর ভাবতে পারতেন না। হিরোশিমার আশেপাশেও নিশ্চয়ই এখন আবারও ধান হচ্ছে। মানুষের স্মৃতি বড় স্বল্পজীবী।

এবার একটা কুশ্রী কুচ্ছিৎ শহর এসে পড়ল। হিমেজি ইস্টিশান এসেছে। এই লাইনটা ওকায়ামাহাকাটার লাইন, টোকিওকিয়োটোর বিপরীতমুখী। এই শিন-কান-সেন-টি শুনেছি তিন ঘণ্টা নেবে। বেলা দশটা সতেরোতে বেরিয়েছি। সকালের ট্রেনটি দু’ঘণ্টায় যায়, কিন্তু সাতটা পঞ্চান্নতে ইস্টিশানে পৌঁছনো যেত না, রীণার বাচ্চা মেয়েটির কাজকর্ম আছে। ওদের বাড়ি থেকে ইস্টিশান বেশ দূর। এই শিন-কান-সেন ট্রেনের দ্রুততা নিয়ে জাপান খুবই গর্বিত। কিন্তু ভিতরে বসে কিছু তফাতও টের পাওয়া যায় না।

হিরোশিমা দেখার পরে মিয়াজিমা দ্বীপে যেতে বলেছেন ওঁরা। যদি ভোরে যেতুম সেটা সম্ভব হত। কিন্তু এত বেলাতে পৌঁছে হয়তো আর ওটা পারা যাবে না। জাহাজ-টাহাজের বাঁধা সময় আছে তো! মিয়াজিমা দ্বীপটি সুন্দর, একটি বৌদ্ধ মন্দিরও আছে। হিরোশিমার শেষ ফেরত-ট্রেন অবিশ্যি ২১-২৪ অর্থাৎ প্রায় সাড়ে ন’টা রাত্তিরে। কিন্তু এসে পৌঁছতে ঢের রাত হয়ে যাবে। হয়তো রীণাদের অসুবিধে হবে তখন আমাকে নিতে স্টেশানে আসতে। এ যাত্রা মিয়াজিমা দ্বীপ বোধহয় হল না। অবশ্য হিরেশিমাই পৌঁছইনি তো এখনও, পরের কথা আগে ভেবে কী লাভ? কে জানে হিরোশিমাতে কতক্ষণ লাগে? জানলার বাইরে তখন আবার ভেসে এসেছে সুশ্রী জাপানি সচ্ছল মফস্বল এলাকা, সাবার্বিয়া। একগুচ্ছ রঙচঙে জাপানি কটেজ, সেই সুদৃশ্য সেরামিক্ টালির ছাদ, সেই স্বপ্নমদির অদেখা গৃহকোণ। দোতলার বেশি উঁচু নয় তার কোনওটাই, ছোটই হোক, বা বড়ই। অথচ টোকিও, কিয়োটো, ওসাকা, কোবে— কেমন করে এমন শ্রীহীন, অভ্রংলেহী দানবিক প্রাসাদে ভরিয়ে দিল জাপান? যে-দেশে এত ভূমিকম্প হয় সেই দেশের উপযোগী বাসাবাড়িই তো বানিয়েছিলেন পূর্বপুরুষেরা। কাঠ, কাগজ, মাদুর, টালি দিয়ে একতলা প্রাসাদ হত সব। এখন পশ্চিমী কেতায় পুরো জাপানই ধোপদুরস্ত। কি বাড়ি-ঘরে, কি পোশাক পরিচ্ছদে, কি কুখাদ্যে, কি বিজ্ঞাপনে। টোকিওতে “হ্যামবার্গার-হটডগ” “ফাস্টফুড কাউন্টার” ইত্যাদি দোকান দেখেছি। মার্কিনী অ্যাটমবম পড়েছিল মাত্র দু’টি শহরেই, কিন্তু তার সংস্কৃতির বিষম বোমা? জাপানময় ছড়িয়ে পড়েছে তার তেজস্ক্রিয় বিষ। মার্কিনীদের নিজেদের কড়িতেই তাদের হারিয়ে দিতে গিয়েই বুঝি জাপান এখন প্রায় পুরোপুরি মার্কিনী। কিছু কিছু গর্ত থেকে গেছে পুরনো জাপানি রুচিপ্রকৃতির।

হঠাৎই মন্দির। “ছবির মতো” এই কথাটি বহু ব্যবহৃত। কিন্তু জাপানে সবই যে সত্যিই ‘ছবির মতো’, অন্যভাবে বলা শক্ত। রেলগাড়ি থেকে দেখা গেল একটি উদ্যান—তার মাঝখানে এক বৌদ্ধ মন্দির। পুরনো, কারুকার্য করা কাঠের তৈরি মন্দির। এখান থেকে মনে হল জনশূন্য। সেটা বোধহয় ঠিক নয়, বাগানটি সুসজ্জিত। জানি না দিনের এই বিশেষ সময়টাই দায়ী কি না, তবে প্রায় সব স্টেশনই এখন জনশূন্য। সকালে প্রবল ভিড় হয় কর্মস্থানে যাবার জন্য—আবার বিকেলে গৃহমুখী জনতার ভিড়। এই সময়টা ফাঁকা থাকে মনে হয়। আবার একটা জনহীন ইস্টিশান এল। গেলও। তবে আমাদের কানে এ-জায়গাটার নামটি বেশ মজার, “এইওই” (aioi) নামের গ্রাম।

রেল ভ্রমণ জাপানে দ্রুত হলেও ব্যয়সাধ্য। বাস অনেক সস্তা এই যে ‘নন রিজার্ভড ক্লাস’ এটাই এ দেশের তৃতীয় শ্রেণী। প্রথম শ্রেণীর নাম অভিজাত ‘গ্রীন কার’, দ্বিতীয় শ্রেণীতে থাকে ‘সংরক্ষিত’ আসন, আর নেহাত এই অসংরক্ষিত আসন হচ্ছে আপামর জনসাধারণের জন্য। আমাদের দেশের প্রথম শ্রেণীর চেয়ে তৃতীয় শ্রেণীর এ কামরা অনেক বেশি আরামপ্রদ, অনেক বেশি পরিচ্ছন্ন। রাজকীয় গদি, মেঝে, জানলা। জাপানি ট্যুরিস্ট বাসেও ঘুরেছি, অত্যন্ত আরামদায়ক ব্যবস্থা সেখানেও। তবে যদি ‘সানরাইজ ট্যুর’ কিংবা ‘গ্রেলাইন ট্যুর’ নিতুম, তাতে বেয়াল্লিশ হাজার ইয়েন খরচ হত। তার বদলে গাইড সঙ্গে থাকতো। আর এতে রিটার্ন ভাড়া ষোলো হাজার ইয়েন। আমার পক্ষে চয়েস নেই। বিনা গাইডে, নিজে নিজেই যা পারি দেখে আসি। চোখ আছে, মন আছে আর আছে ইতিহাস। কোনওরকমে একবার স্টেশন থেকে শান্তি উদ্যানে পৌঁছে গেলেই হল। ট্যাক্সি ভাড়া অত্যন্ত বেশি শুনেছি, বাসে যাওয়ার চেষ্টা করতে হবে। ‘পীস পার্ক’ বললে বুঝবে সবাই। এই ট্রেন সর্বত্র থামছে। প্যাসেঞ্জার গাড়ির মতো। লোকজন যা ওঠে-নামে, দুটি একটি। শুনেছি এটা ফাঁকা-টাইম। কী সুন্দর একটা নদী পার হচ্ছি—রীতিমতো চওড়া, কিন্তু বেশ অগভীর, চড়া-পড়া নদী। চেহারাটা দেশের নদীগুলির গ্রীষ্মকালের মতন দেখতে, কিন্তু খুব সুন্দর, পাথর ছড়ানো। ঘাস নেই। বালি।

ওকায়ামা স্টেশানে এলুম ১১-২০তে। এটি প্রকাণ্ড শহর। প্রচুর যাত্রীর ওঠা-নামা এখানে। জংশন স্টেশান মনে হচ্ছে। ঠেলাগাড়িতে ফেরিওয়ালারা খাদ্য পানীয় দুধ সবই আনছে। যাত্রীরা অনেকেই নিজস্ব প্লাস্টিকের থলি খুলে কাগজের লাঞ্চবক্স বের করে দারুণ সুদৃশ্য জাপানি লাঞ্চ খাচ্ছেন। চপস্টিক দিয়ে। দেখতে দারুণ, খেতে কেমন কে জানে! পাশের ভদ্রলোককে বহুবার জিজ্ঞেস করে করে বিফল হয়ে অনেক চেষ্টার পরে একটি কাগজে “HIROSHIMA 😕 – PM?” লিখে তাঁকে হাতে ধরিয়ে দিই। তিনি খুব সহাস্যবদনে এবার “HIROSHIMA : 12-27” লিখে দিলেন। এবং অনেকবার বসে-বসেই নত হয়ে ‘বাও’ করলেন। জাপানিরা একদম ইংরিজি না বুঝেও এত ‘মার্কিনি’ কেমন করে হয়ে গেল? দিব্যি দু’ফালি সংস্কৃতি এদের—ভেতরে জাপানি, বাইরে মার্কিনি। বাইশ বছর আগেও এসেছিলুম জাপানে। তখন জাপান অনেক বেশি জাপানি ছিল। এর মধ্যে জাপান একেবারে বদলে গিয়েছে। হঠাৎ একটি টেপ-করা ইংরাজি ঘোষণা হল, ‘সেক্‌সি-হাস্কি’ স্ত্রী কণ্ঠে খোদ মার্কিনি উচ্চারণে, যে এই ট্রেনের একটি কামরাতে যাত্রীদের সুবিধের জন্য টেলিফোন সার্ভিস রয়েছে। এই ঘোষণা এই কামরাতে একমাত্র আমারই জন্য মনে করে অত্যন্ত উৎফুল্ল হই। যদিও এই সার্ভিসের সদ্ব্যবহার করার প্রয়োজন আপাতত ঈশ্বরের ইচ্ছেয় আমার নেই। রেস্তও সম্ভবত না। খরচ কত জানতে ইচ্ছে, কিন্তু তাঁর ইংরিজি টু জাপানি ভাষান্তরণের পরিশ্রম কে পোহাবে! টেড্ মেসেজের কণ্ঠস্বর তো প্রশ্নের উত্তর দেয় না। থাক। অত কৌতূহলে কাজ নেই।

ঐ যে, ‘ওচা’ বিক্রি হচ্ছে। অর্থাৎ চা। কী আশ্চর্য! এতক্ষণ আশায় আশায় ছিলুম কখন চা আসবে। আগের বারে বাইশ বছর আগে স্টেশনে স্টেশনে চা খেয়েছি, জাপানি বুনোগন্ধওলা সবুজ চা, কিন্তু চমৎকার সেরামিক্সের কারুকার্যকরা পালিশ-করা চীনেমাটির কেটলি। তাতে বেতের সঙ্গে তার মেশানো হাতল, কেটলির মাথায় ছোট্ট ঐ ম্যাচিং চীনেমাটির বাটি বসান; সেটাই কাপ। খেয়ে ওয়েস্টবাস্কেটে ফেলে দিতে হত। আমি মায়ার চোটে প্রাণে ধরে ফেলতে পারিনি। দুটো কেটলি দেশে নিয়ে গিয়েছিলুম। সেদিন পর্যন্ত একটা ছিল আমাদের বাড়িতে। আমার মেয়েরা খেলতে নিতো, ছোট্ট কেটলি, ছোট্ট বাটি, কত সুন্দর। আমাদের মাটির ভাঁড়ের মতোই ‘ডিসপোজেবল’ ছিল সেই টি-পট-কাপ। সেই বস্তুটি এখন জাপানে উধাও। জানি না, নিশ্চয় এখনও গ্রামেগঞ্জে কোথাও না কোথাও আছে। অন্তত যাদুঘরে। কিন্তু এই ট্রেনলাইনে অন্তত নেই। প্লাস্টিকের প্যাকেটের মধ্যে ‘ওচা’ বিক্রি হচ্ছে। চা কখনও ঐভাবে বিক্রি হয়? না খেতে ইচ্ছে করে? দূর!

সেই সুশ্রী টি-পট-কাপ থেকে ঢেলে ঢেলে চা খেতে কত ভাল লাগত। তার শ্রী আলাদা। স্বাদ আলাদা। জাতই আলাদা সে-সংস্কৃতির।

এই প্লাস্টিক সংস্কৃতি জাপানের সর্বনাশ করছে। ওই টি-পট-কাপ পরে আমি টোকিওতে বাসনের দোকানে দেখেছি। প্রচুর দাম। বাইশ বছর আগে যা ছিল বিনিপয়সায়, বিলিয়ে দেবার।

সেবারে এত ইংরিজি ঘোষণার ছড়াছড়ি দেখিনি এবারে যেমন। এয়ারপোর্ট লিমুজিনে, প্রত্যেকটি হোটেলে আসার আগে টেপ্‌ দারুণ মার্কিনিতে মদির স্ত্রী-কণ্ঠে ঘোষণা করে “নামবার আগে খুব সাবধানে দেখে নেবেন, কিছু জরুরি জিনিসপত্তর ফেলে রেখে যাচ্ছেন না তো?” সে না হয় বুঝি বিদেশীদের জন্যে। কিন্তু জাপানে যে দৃশ্যত সাধারণ জাপানি মানুষের মধ্যে ইংরিজি শিক্ষা—বলা-কওয়া—বেড়েছে, তা মোটেই মনে হচ্ছে না। অথচ ‘পাবলিক’ ঘোষণায় ইংরিজি প্রচুর। ভ্রমণ বিলাসীদের কারণে।

শিনকুরাশিকি আসছে। এখানে প্রচুর নার্সারি, অনেক, অনেক গ্রীনহাউস, সারি সারি। কাচ? নাকি প্লাস্টিকের ছাদ ওগুলো? ঢাকা-দেওয়া পানের বরজের মতো মাচায় তোলা লতাগাছের ক্ষেত। পাহাড়ী শহর। কে জানে এসব জাপানি আঙুর ক্ষেত কি না? জাপানি সুরা ‘সাকে’ তো ধেনো!

আরেকটা বড় ইস্টিশন গেল। ফুকুয়ামা। এতক্ষণে সাইন এসেছে হিরোশিমা-হাকাটা অর্থাৎ ঠিক দিকেই যাচ্ছি। এখানে পাশের যাত্রী নেমে গেলেন, এক তরুণ এসে বসলেন। এদের অবশ্য তারুণ্য বার্ধক্য কিছুই বোঝা যায় না আশিতে না পৌঁছোলে। অথবা খুব দরিদ্র না হলে। “খুব দরিদ্র” কি আছে জাপানে? কি জানি তাদের সঙ্গে দেখা হয় না পথেঘাটে। এক ‘ট্র্যাম্প’-দের সঙ্গেই যা দেখা হয় যত্রতত্র। তারা তো ধনী দেশেরই পাতকুড়োনো মানুষ। আমার পাশের জাপানি তরুণটি যে তরুণই, তা বুঝতে পেরেছি কেন না সে একমনে জাপানি কমিকস অধ্যয়ন করে চলেছে। মুখে অবশ্য হাসি নেই। তেরছা নজর দিয়ে অসভ্যের মতো দেখে বুঝলুম, রোমান্স। লাঞ্চ এলো। জাপানি লাঞ্চ এক হাজার ইয়েন। তরুণটি একবাক্স স্যান্ডউইচ (সাংউইচি) নিল দু’শো ইয়েনে। শিন-কোবে ইস্টিশানে ট্রেনের জন্য দাঁড়িয়ে থাকার সময়ে মেসিনে একশো ইয়েন ফেলে একটিন ঠান্ডা কফি কিনেছিলুম। এবার সেটা খেতে শুরু করি। প্রায় দু’ঘণ্টা এই ট্রেনে আছি আর মিনিট দশেকের মধ্যেই এসে যাবে হিরোশিমা। ইতিমধ্যে গোপাদির দেওয়া চীজ স্যান্ডুইচ খেয়ে ফেলেছি। সঙ্গে আছে কেবল একটাই সোডা।

এখানে কি সুন্দর পাহাড়ের গায়ে খাঁজ খাঁজ বারান্দা কেটে ধানক্ষেত করেছে। সঙ্গে ধানগাছ পোঁতা রয়েছে। গোল গোল ‘টেরা’ ধানক্ষেত ভারি সুন্দর। দেখতে দেখতে মনে থাকে না গন্তব্য হিরোশিমা। মনে হয় বুঝি দৃশ্য দেখতে বেরিয়েছি। আবার টানেলের লুকোচুরি খেলা শুরু হয়েছে। ক্ষেতে হাঁটুজলে দাঁড়িয়ে টোকা-মাথায় জাপানি চাষী ধানগাছ পুঁতছে, তা দেখা হল না কিন্তু! ছবিতেই রয়ে গেল।

ট্রেন এ দেশে দু’তিনতলা উঁচু বাঁধের ওপর দিয়ে চলে বলে কেবলই সর্বত্র বাড়ির ছাদ দেখা যায়। ছাদগুলি সবই সত্যি বড় শিল্পসম্মত, সুরুচিপূর্ণ। যেমন, গড়ন, তেমনি রঙ, তেমনি পালিশ। বাড়িগুলিতে প্রায়ই ছোট্ট ছোট্ট কাঠের বারান্দা আছে, উঠোনও আছে, কিন্তু বাগান দেখতে পাচ্ছি না। বাড়িতে বাড়িতে বাগান থাকে না বলেই বোধহয় এদের দেশে এত পাবলিক পার্ক, এত সুন্দর সুন্দর ‘জাপানি বাগিচা’ সাজানো চারিদিকে। জাপানি বাগিচা বেশ কিন্তু মজার জিনিস। ঠিক যেন ইংলিশ ল্যান্ডস্কেপ গার্ডেন আর ফরাসি ফর্মাল গার্ডেনের সংমিশ্রণ। আর তার সঙ্গে কিছুটা পুতুলখেলা। ‘এটাই প্রকৃত জাপানিয়ানা?’ সবটাই বাস্তব নয়। কল্পনা মিলিয়েই এরা বুঝি বাস্তবকে আকৃতি দেয়, বনসাই গাছে, ইকেবানা ফুলে।

দেখতে দেখতে হিরোশিমা। ঠিক কাঁটায় কাঁটায় ১২টা ২৭ বেজেছে। কি অস্বস্তিকর অনুভূতি। এ কি আজব দেশ, এ কি এশিয়া? স্টেশনে নেমে বাস স্ট্যান্ড খুঁজতে থাকি। পীস পার্কে যাবে এমন বাসে উঠতে হবে। কিছুই ঠিক-ঠিকানা পাই না। ওদিকে বেলা বেড়েই যাচ্ছে। শেষকালে ট্যাক্সিতেই উঠে বসি। ফেরার সময় বাস ধরাটা অপেক্ষাকৃত সহজ হবে নিশ্চয়।

দশ মিনিটের মধ্যে ট্যাক্সি একটি অতি আধুনিক শহর ভেদ করে, ‘শান্তিউদ্যানে’র গোল ফোয়ারার সামনে এসে দাঁড়াল। এতক্ষণ যে-সব ঝলমলে ইন্দ্রপুরীর মতো রাস্তাঘাট পার হচ্ছিলুম, সেই সিটিসেন্টার হিরোশিমার ধ্বংসস্তূপ হয়ে গুঁড়িয়ে গিয়েছিল একদিন।

৬ আগস্ট ১৯৪৫। সকাল ৮টা ১৫-তে মানবসভ্যতার ইতিহাস পাল্টে গেল। ২০,০০০ টন টি. এন. টি. নিয়ে হিরোশিমার আকাশে ঝাঁপিয়ে পড়ল ‘লিট্ল বয়’। মাত্র ১২০ ইঞ্চি লম্বা ২৮ ইঞ্চি মোটা, আর ৯০০০ পাউন্ড ওজন। পড়বার ৪৩ সেকেন্ডের মধ্যেই ঘটল অবিশ্বাস্য সেই বিস্ফোরণ–৫,০০,০০০ সেলসিয়াস ডিগ্রিতে তীব্র উত্তাপ ছড়িয়ে, দিগ্বিদিকে প্রলয় তাণ্ডব হেনে, ১৮০ ফুট ব্যাসের এক বিশাল অগ্নিগোলক তৈরি হল আকাশে, প্রচণ্ড একটা শওয়েভ্ মুহূর্তের মধ্যে পরিব্যাপ্ত হয়ে পড়ল শহরময়। তারপরের গল্প আজও চলেছে। যে আণবিক মেঘ সেদিন হিরোশিমার আকাশ ছেয়ে ফেলেছিল, তার মৃত্যুবর্ষণের ক্ষান্তি নেই আজও। জাপানের নানা বিশেষ হাসপাতালে এখনও ছড়িয়ে আছেন আণবিক বোমার তেজস্ক্রিয়তায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ, যাঁদের কেউ কেউ তখনও ছিলেন মাতৃগর্ভে। মানুষের নিষ্ঠুরতার মৃত্যুতিলক অঙ্গে নিয়ে জন্মেছেন তাঁরা—পঙ্গু, অথর্ব, চিরঅক্ষম বিকলাঙ্গ হয়ে। হিরোশিমার শান্তিদীপের নিচে একটি সিন্দুকে মর্ত্যের চিত্রগুপ্তের জাব্দাখাতা রাখা আছে, তাতে রোজই যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন নাম। আণবিক বোমার তেজস্ক্রিয় বেদীতে নতুনতম আহূতি। তেতাল্লিশ বছর ধরে যার জের টেনে চলেছে জাপান। তালিকা অফুরন্ত। অথচ কি আশ্চর্য, ঐশ্বর্যে ভুলিয়ে দেয় সবই। জুড়িয়ে গেছে ক্রোধের আগুন জাপানেও। পায়রাওড়া পীস মেমোরিয়াল পার্কে, নৌকো-দোলা ওটা-নদীর ঢেউ-তে এখন সত্যিই শান্তি। শুধু ৬ আগস্ট থেকে ৩১ ডিসেম্বর ১৯৪৫-এর মধ্যেই আণবিক বোমায় মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ১,৩৯,০০০ জন।

নাঃ, জাপানে হিরোশিমার আগুন আর জ্বলছে না। কী যে ঠিক হল, তখনই বোঝা যায়নি। হিরোশিমা সেন্ট্রাল ব্রডকাস্টিং স্টেশন বলতে শুরু করেছিল, “মিলিটারি কমান্ড ঘোষণা করছে তিনটি বিরাট শত্রুবিমান সাইজোর আকাশে”— ঘোষণা শেষ হয়নি, শত সহস্র বিদ্যুচ্চমকের আলোয়, অযুত বজ্রপাতের আগুনে আর আওয়াজে মনে হল বিশ্বব্রহ্মাণ্ড থেকে বুঝি এই গ্ৰহ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল চিরকালের জন্য। কেউ জানলো না কী যে হল কেবল কিছু জ্যান্ত মানুষ জ্বলে পুড়ে কোথাও কাঠকয়লা হয়ে গেল, কোথাও ছেঁড়া হাত পা মুণ্ড ধড় উড়ে যেতে লাগল আগ্নেয় ঘূর্ণির প্রলয় বাতাসে, কাচের সঙ্গে তামার সঙ্গে মাংসের সঙ্গে চামড়ার সঙ্গে দলা পাকিয়ে একাকার হয়ে যেতে লাগল, নশ্বরতার পিণ্ড—জমে-ওঠা মৃতদেহের চাপে যন্ত্রণায় কুঁকড়ে ছিঁড়ে যেতে লাগল তখনও জীবিত কম্পমান মনুষ্য শরীর। মানুষ কিছু টের পাবার আগেই মুহূর্তের মধ্যে ধ্বংস হয়ে গেল ২৭টা ট্রেন, ২৪টা ট্রাম, ১০টা বাস, ১৮০টা, ট্রাক, আর ৫৬টি গরু-ঘোড়ার গাড়ি। ৩৭ মাইল ধরে ছড়িয়ে পড়েছিল শক-ওয়েভ্, দশ মাইল জুড়ে ছিটকে গিয়েছিল ভাঙা কাচের টুকরো, সর্বত্র জ্বলে উঠেছিল বিধ্বংসী আগুন, পাতালের অগ্নি বুঝি সেদিন উঠে এসেছিল, মর্ত্যেই নরক দেখেছে হিরোশিমার মানুষ।

.

পারমাণবিক বোমার ‘হাইপোসেন্টার’ থেকে পুরো আট মাইল দূরে, এটাজিমা দ্বীপে, কিছু সাবমেরিন ট্রেনিংয়ের ছাত্র ক্লাসের জন্য তখন অপেক্ষা করছিল, যখন হঠাৎ একটা নীল বিদ্যুৎ তাদের চোখ ঝলসে দিল, আলোর ঝলকটার মানে বোঝবার আগেই কান ফাটানো শব্দে তাদের পিলে চমকে গেল। জানালার কাচ ভেঙে ছড়িয়ে পড়ল ঘরে, ছেলেগুলি দ্বিতীয় বোমার অপেক্ষায় মাটিতে শুয়ে পড়ে মৃত্যুর মুহূর্ত গুণতে লাগল। শেষে যখন আর বোমা পড়ল না, তখন তারা ভয়ে ভয়ে বাইরে বেরিয়ে দেখতে পেল, হিরোশিমার আকাশে ছাতার মতো এক বিশাল তেজষ্ক্রিয় মেঘ ভাসছে, তার নিচেই আকাশ ফুঁড়ে উঠেছে বিপুল ধোঁয়ার ঘূর্ণি-স্তম্ভ— ২৯,৭০০ ফুট উঁচু, যেন স্বর্গের সিঁড়ি। চারিদিকেই লক্ লক্ করে জেগে উঠেছে আগুনের প্রগল্ভ জি, দ্রুত সবটা ঢেকে যাচ্ছে আশ্চর্য আবছা একটা কুয়াশায়—এত বড় একটা দুর্ঘটনা ঘটানো যে মানুষের নশ্বর শক্তিতে সম্ভব তা বিশ্বাস হত না, যদি না সেই বিপুল মেঘের ছাতার তলা থেকেই সহসা বেরিয়ে আসতো একটি মার্কিনি বোমারু B-29 বিমান! তার ডানায় শত সূর্যের আলোর ঝলকানি নিয়ে।

এক নিমেষেই মুছে গেল, উপে গেল, ফুরিয়ে গেল হিরোশিমা নামের পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন মিলিটারি শহরটি। যে শহরের ক্যালেন্ডারে বহুদিন হল রবিবার শনিবার মুছে গিয়েছিল। ছুটির দিন বলে কিছু ছিল না। সপ্তাহের সাতটা দিনই কাজের দিন। যেমন চাষীদের দিনপঞ্জী। তেমনিই যুদ্ধকালীন মিলিটারির শাসনে জাপানের রুটিন, জাপান তখন জয়ের নেশায়, যুদ্ধের নেশায় মত্ত।

বারো বছরের চেয়ে বেশি যাদের বয়স, সেই ছাত্রছাত্রীদেরও নিয়োগ করা হয়েছিল যুদ্ধের কাজে। মারা গিয়েছিল তাদের মধ্যে দশ হাজার জাপানি শিশু। শুধু অ্যাটম বোমাতেই ছ’হাজার। তাদের জন্য একটি আলাদা, সুন্দর স্মৃতিস্তম্ভ আছে হিরোশিমার শান্তি-উদ্যানে, আছে একটি স্মৃতিশিলাও। এক নিমেষেই হিরোশিমার ১৮টা হাসপাতাল আর ৩২টি ফার্স্ট এইড সেন্টার ডাক্তার ও নার্স মুহূর্তের মধ্যেই মৃত, অথবা মৃতপ্রায়।

অ্যাটম বোমা পড়বার সময়ে মোটামুটি তিনটি চরম ক্ষতিকর নাশক-শক্তি কাজ করছিল।

এক—(থার্মাল র‍্যাডিয়েশন) উত্তাপের ব্যাপ্তি ও বিচ্ছুরণের প্রকোপ।

দুই—(ব্লাস্ট প্রেসার) বিস্ফোরণের প্রচণ্ড চাপ।

তিন–(র‍্যাডিয়েশন) তেজস্ক্রিয়তার বিষ।

তিনটিরই বিধ্বংসী শক্তি প্রচুর–৩,০০,০০০° সেন্টিগ্রেড উত্তাপ সৃষ্টি হয়েছিল ওই নীল গোলাপশুভ্র স্বর্গীয় আগ্নিগোলকের তৈরি উত্তাপের প্রকোপের থেকে, যে মানুষরা হাইপোসেন্টার থেকে ৩.৫ কি.মি. দূরত্বে ছিলেন তাঁরাও বাদ পড়েননি। তাঁদের সর্বাঙ্গে দগদগে পোড়া ঘা হয়ে গিয়েছিল। এক কি.মি.-র মধ্যে ছিলেন যাঁরা, তাঁদের কাঠের বাড়িঘরদোর একেবারে জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল, এমনকী গ্রানাইট পাথরেও ফাটল ধরে ছিল। হাইপোসেন্টারের ৬০০ মাইলের মধ্যে যেসব বাড়ি ছিল, তাদের ছাদের টালিতে কাচের বুদ্বুদের মতন বুদ্বুদ তৈরি হয়েছিল উত্তাপের চোটে।

ব্লাস্ট প্রেসারের বা বিস্ফোরণের চাপের ফলটা মানুষের শরীরের ওপর হয়েছিল প্রচণ্ড। কিছু মানুষকে তো বেশ কয়েক মিটার দূরে তুলে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল সেই অনৈসর্গিক চাপ, কাপড়-চোপড়, দগ্ধ চামড়া, সবই উপড়ে ছিন্ন করে নিয়েছিল গা থেকে, ঘটিয়েছিল শরীরে আভ্যন্তরীণ রক্তপাত, অস্ত্র যকৃৎকে ছিন্নভিন্ন করেছিল। আভ্যন্তরীণ বিভিন্ন কলকব্জাগুলিকে আক্রমণ করতে, ধ্বংস করতে ছাড়েনি। ভাঙা কাচের টুকরোয় ছেয়ে গিয়েছিল মানুষের শরীরের মাংস। হাইপোসেন্টারের ২.৫ কি.মি.-র মধ্যে তৈরি সমস্ত কাঠের ঘরবাড়ি তো এক মুহূর্তেই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল, আর সেই ভাঙা বাড়ির কড়িবরগা চাপা পড়ে বন্দি অবস্থায় পুড়ে ছাই হয়ে গেল অসংখ্য জীবিত মানুষ। এমনকী কংক্রিটের অট্টালিকাও রেহাই পায়নি, সম্পূর্ণ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল হাইপোসেন্টারের কাছাকাছি যা কিছু ছিল সবই। ছাদ চাপা পড়ে, ভাঙা দরজা জানলা চাপা পড়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল অজস্র মানুষ। ৩.২ কি.মি.

দূরের বাড়িঘরও আস্ত ছিল না আধো-নিশ্চিহ্ন হয়েছিল, দশ মাইল জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল ভাঙা কাচের টুকরো। সাধারণ বোমা পড়ার সঙ্গে আণবিক বোমা বিস্ফোরণের আকাশ পাতাল ফারাক—কেবলমাত্র ব্যাপকতায় নয়, তার সামগ্রিক নাশকতা-শক্তির প্রচণ্ডতা তখনও সম্পূর্ণ কল্পনা করা যায়নি। গামারশ্মি আর নিউট্রন ছড়িয়ে পড়ে বোমা পতনের এক মিনিটের মধ্যেই যে কী ভয়াবহ সর্বনাশ ঘটিয়েছিল তা ভাবলে এখনও অস্থিমর্ম শিউরে ওঠে। হাইপোসেন্টারের এক কি.মি. ব্যাসের মধ্যে কাউকেই বাঁচানো যায়নি তীব্র তেজস্ক্রিয়তা থেকে। এমনকী অনেকদিন পরেও যাঁরা উদ্ধারকর্মের জন্য সেই এলাকাতে গিয়েছিলেন, (অর্থাৎ আণবিক বোমা পড়ার ১০০ ঘণ্টার মধ্যে) গামারশ্মি লেগে তাঁরা ফিরলেন তেজস্ক্রিয়তার শিকার হয়ে। হাইপো সেন্টার থেকে ২.৩ কি.মি. দূরত্ব পর্যন্ত বিছিয়ে পড়েছিল মৃত্যুর বিষ। এবং বিস্ফোরণের পরেও বহুকাল ধরে মাটিতে জড়িয়েছিল অবশিষ্ট তেজস্ক্রিয়তা (রেসিডুয়াল র‍্যাডিয়েশন)। তা ছাড়া বোমার আধঘণ্টা বাদেই ঝরেছিল সেই ভয়াবহ মৃত্যু-ঝরানো কালবর্ষণ, “কৃষ্ণবারি”। তেজস্ক্রিয় মেঘের গুণেই বোধহয় নব্বই মিনিট ধরে হিরোশিমার ওপরে সেই বিষাক্ত কালো রঙের বৃষ্টি ‘ব্ল্যাকরেন’ ঝরেছিল মানুষ, পশুপাখি আর উদ্ভিদজগতের সর্বনাশ ঘটিয়ে, লিউকিমিয়ায় আর ম্যালিগনান্ট টিউমার হয়ে আজও সেই কারণে মৃত্যু ঘটছে সেদিনের সাক্ষী জীবিত জাপানি মানুষের

আজ সেখানে এই শান্তি-উদ্যান। সেদিন সেখানে আগুন ছড়িয়ে পড়ছিল আগুনের মতোই তীব্রবেগে, আতঙ্কে, যন্ত্রণায় বিস্মিত, ভীত, অসহায় সাধারণ মানুষ পাগল হয়ে উঠেছিল, ওরই মধ্যে মিলিটারি হাসপাতাল উদ্ধারকারী দল পাঠাল, কিন্তু পথ কই? হিরোশিমাতে ঢোকার রাস্তা নেই। বাড়ির ধ্বংসস্তূপে আর মৃতদেহে, ভাঙা গাড়িতে, ভাঙা সেতুতে সবদিক বন্ধ। “ওটা”-নদী বেয়ে নৌকো করে শহরে ঢোকার প্রয়াসও ছাড়তে হল, কেননা নদীতীরেই হাইপোসেন্টার, দাউ দাউ নরকের আগুন জ্বলছে সেখানে, নদী ভর্তি সহস্ৰ পলাতক মানুষের ব্যর্থ মৃতদেহ। “ইনডাসট্রিয়াল প্রমোশন হল”-এর থেকে মাত্র সত্তর গজ দূরেই হাইপোসেন্টারটি অবস্থিত। অথচ এই অট্টালিকাটি, তার বিশাল গম্বুজ নিয়ে ভেঙে-চুরে গিয়েও খাড়া রয়েছে, “ওটা” নদীর তীরের সুদৃশ্য বাগিচা অঞ্চলে বিশাল এক স্মারকচিহ্ন হয়ে। এক মহা-মৃত্যুর সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এই একটি মাত্র ভগ্নগৃহ, যা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়নি। এর বিশাল গম্বুজটির কাঠামোর কঙ্কাল এখনও অক্ষত, যদিও তার মাংসমেদ মহাশূন্য দেহকাণ্ডের ফাঁকে ফাঁকে আকাশ বাতাস মেঘরৌদ্রের খেলা। “ইন্ডাসট্রিয়াল প্রোমোশন হল”-এর নতুন নাম “এ-বম্-ডোম”। হিরোশিমাতে আমি আর কোনও ধ্বংসাবশেষ দেখিনি। সবই পুনর্নির্মাণ।

ছেলেবেলার বন্ধু তান-শ্যামলী খাস্তগীরের মুখে গল্প শুনেছিলাম একবার যখন নর্থ আমেরিকাতে সে ও তার বন্ধুরা অ্যান্টি নিউক্লিয়ার ওয়ার ডেমনস্ট্রেশনের জন্য গ্রেপ্তার হয়েছিল, হিরোশিমা দিবসেই তাদের বিচারদিন স্থির হয়েছিল। তাদের প্রতিবাদটা সেবারে ছিল ভ্যাংকুভারের কাছে ট্রাইডেন্ট স্টেশনের বিরুদ্ধে। সমস্ত পৃথিবী জুড়ে তিরিশটি ট্রাইডেন্ট ঘাঁটি তৈরি হওয়ার কথা ছিল। প্রতিটিতে থাকবে এক একটি ট্রাইডেন্ট সাবমেরিন, যাতে ২০৪০টি হিরোশিমা ধ্বংস করবার উপযোগী পারমাণবিক অস্ত্র মজুত থাকবে। হ্যাঁ ঠিকই পড়েছেন। দুই হাজার চল্লিশটি হিরোশিমা পুড়িয়ে দেবার মতো আগুন। আমাদের পৃথিবীময় ছড়িয়ে থাকবার কথা এই মারাত্মক সাবমেরিনের ঘাঁটিগুলির। সমুদ্রের শান্ত গভীর জলের নিচে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকার কথা। এবং যেহেতু এরা পারমাণবিক শক্তি দ্বারা চালিত, এই সাবমেরিনগুলি কেবলমাত্র তাদের অস্তিত্বেই, তাদের নিরীহ ঘোরা-ফেরাতেই বিষজর্জর করে তুলবে সমস্ত মহাসাগরের জল। নিউক্লিয়ার পল্যুশান এড়াতে পারবে না মহাসিন্ধু, পৃথিবীর মাছেদের’ বিকলাঙ্গতা রোধ করা যাবে না। সামুদ্রিক উদ্ভিদ ধ্বংস হবে। শেষপর্যন্ত শ্যামলীরা দশজন ৬ আগস্ট ১৯৭৯-তে, হিরোশিমা দিবসে, আদালতে রীতিমতো শাস্তি পেল। এজলাসে ছিলেন লস অ্যাঞ্জেলেসের এক জাপানি বিচারক —রায় দিতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন জাপানবাসী হিসেবে দ্বিতীয় মহা-যুদ্ধের সকল যন্ত্রণাই তাঁর স্মরণে আছে-শান্তিসেনাদের প্রতি তাই তাঁর দেওয়া শাস্তিটা ছিল ১০০ ঘণ্টা সোশ্যাল ওয়ার্ক করা। সিয়াটলের ফেডারাল কোর্টে এই শাস্তি দেওয়া হয়েছিল, কানাডার ভ্যাংকুভার থেকে ষাট মাইল দূরে ছিল ওই ত্রিশূল-অস্ত্রসম্ভারের ঘাঁটি। ওই বিচারসভায় এমন একজন জাপানি নারী সাক্ষী ছিলেন, যাঁর স্বামী ও কন্যা হিরোশিমা থেকে চলে আসার বহুকাল পরেও সেই অতীত তেজস্ক্রিয়তার ফলস্বরূপ আমেরিকাতে ক্যান্সার রেডিয়েশনে মারা গেছেন। মহিলা তারপর মার্কিন সিভিল রাইট্স মুভমেন্টে শামিল হয়েছেন। বিচারক নিজেও জাপানি-মার্কিনি। তিনি বলেছিলেন, তিনি নিরুপায়, আইন-ভঙ্গকারীকে শাস্তি দিতেই হবে। কিন্তু নীতিগতভাবে এরা অপরাধী নয়। সেইসব গল্প মনে পড়ে যাচ্ছে, এই সেই গল্পের হিরোশিমা। আমাদের সবার অতীত, আর আমাদের সবার ভবিষ্যৎ তার মুঠোর মধ্যে, তার হাতের রেখায়

আজ এই ১৯৮৮-তেও শুনছি আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র পারামাণবিক বোমা তৈরি করতে ব্যস্ত, আমেরিকা তাকে খোলাখুলি নিউক্লিয়ার সাবমেরিন বিক্রি করছে। ফ্রান্স পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটাচ্ছে সমুদ্রে। তারই মধ্যে লৌহযবনিকা ভেঙে গিয়ে গ্লাসনস্ত হচ্ছে। রথের রশি টানছেন রুশ রাষ্ট্রদূত। সেই নিয়ে আমরা আহ্লাদে মাতোয়ারা। আমি আজকাল ঠিক বুঝতেই পারি না পৃথিবীর অগ্রগতির দিক্‌টা কোনমুখো।

সেই ঢাকাই কুট্টিদের গল্প শুনেছিলাম—এক উল্টো গেঞ্জিপরা মানুষকে তারা প্রশ্ন করেছিল “কী মশায়, যাইত্যাসেন, না আইত্যা সেন?” আমারও পৃথিবীকে সেই প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে।

উল্টো করে গেঞ্জী পরে, কোনদিকে চলেছো, পৃথিবী?

হিরোশিমায় যেতে যেতে একবারও মনে হচ্ছে না ভয়ংকর এক অতীতকে দেখতে যাচ্ছি। রক্তের মধ্যে শিরশির করছে ভয়। হিরোশিমা একটি ধ্বংসবীজের নাম। যেন হিরোশিমার সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি, না নিজেদের ভবিষ্যতের সঙ্গে? শিক্ষা নেয়নি পৃথিবী, ভয় পায়নি মানুষ, কমেনি বিজ্ঞানের দম্ভ। বরং বছর দুই আগের লণ্ডনে দেখে এলুম C. N. D শোভাযাত্রার চরিত্র বদল হয়েছে। না, নেতৃত্বে তো নেই-ই বারট্রান্ড রাসেলের মতো কোনো প্রবল ব্যক্তিত্ব—সে-বিষয়ে কিছুই বলছি না। কিন্তু আজকে যাঁরা পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণের পক্ষে পথে নেমেছেন শোভাযাত্রা করে, তাঁরা প্রত্যেকেই মধ্যবয়স্ক, চল্লিশোর্ধ্ব। তাঁরাই কৈশোরে ছিলেন রাসেলের সঙ্গী। নেই ছাত্রছাত্রীরা, নেই নবীন বয়সী দল। তাদের সময় নেই এসব রাজনৈতিক পাগলামির। তারা কেরিয়ার তৈরিতে ব্যস্ত। অথবা ‘পাংক্’ জাতীয় সামাজিক প্রতিবাদের ঢেউয়ে গা ভাসিয়েছে।

পারমাণবিক যুদ্ধের সম্ভাবনার ভয়ে, এই সুন্দর পৃথিবী বিধ্বস্ত হয়ে যাবার ভয়ে যারা ব্যাকুল আজ তারা কেউ তরুণ নয়। জমানা বদল গয়া। তরুণরা কেবল সুন্দর মুহূর্তের ছলনায় ছুটেছে।

আমাদের ছাত্রাবাসে এই শোভাযাত্রীদের গড়পড়তা বয়স ছিল বিশ-বাইশ থেকে পঁচিশ বড়জোর। আজ তাদের মাথায় টাক, মধ্যদেশে মেদ, কপালে বলিরেখা। অবাক হয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলুম যে শোভাযাত্রাগুলি হাইড পার্কে এসে জড়ো হচ্ছে, এই ট্রেড ইউনিয়নগুলি ভিন্ন—সবই বয়স্কদের দল। কোথায় সেই অগ্নিক্ষরা পঞ্চাশ ষাটের তরুণ প্রতিবাদীরা?

যেখানে ভীতি বাড়বার কথা, সেখানেই এসে গেছে নিষ্ক্রিয়তা, অনবধান। একটাই পাগল যেকালে একটি বোতাম টিপে সৃষ্টি স্থিতি ধ্বংস করে দিতে পারে, সেই কালে এ কি ভয়ংকর শান্তি! এ শান্তি যে শ্মশানের!

হিরোশিমা শহর ফিনিক্সের মতো সব ছাই ঝেড়ে ফেলে আবার বেঁচে উঠেছে। ‘বিশাল অট্টালিকা’, ‘প্রাসাদোপম সৌধ—এইসব শব্দ মনে আসতে লাগল হিরোশিমার ডাউন টাউন চৌরঙ্গী এলাকা পার হতে হতে। কত দোকানপাট। কী বাণিজ্য-ব্যস্ত শহর! কে জানে আছে কিনা এখানকার ধূলিকণায় আজও তেজস্ক্রিয়তার বিষ মিশে?

এ যাত্রা আমার নাগাসাকি যাওয়া হবে না। হাতে সময় নেই। টাকা তো নেই-ই। নেহাৎ কোবে-তে রীণা-রতনরা ছিল, তাই হিরোশিমা সম্ভব হল। তবে, নাগাসাকি, হিরোশিমা দু’জায়গাই যেতে হবে এমন বাধ্যবাধকতা আমার বুকের মধ্যে কখনই ছিল না। একটাই যথেষ্ট। একটি অভিজ্ঞতাই যথেষ্ট যন্ত্রণাদায়ক হতে পারে বলে একটা লুকোনো ভয় আছে। কি জানি কি দেখব। আজকে কী দেখব কে জানে? না। হিরোশিমাই যথেষ্ট।

আত্মধিক্কারের পক্ষে, মনুষ্যজন্মকে ধিক্ বলবার পক্ষে একটি নামই যথেষ্ট। একজোড়া চাই না। এই তো পা দিয়েছি আজ সেই মাটিতে। মনুষ্যত্বের মৃত্যুপুরীতে।

স্টেশন থেকে বেরিয়ে দেখি, বেশ বেলা হয়েছে। কোথা থেকে যে “শান্তি-উদ্যানে”র বাস ছাড়বে তা কিছুতেই ঠাহর করতে পারি না। হিরোশিমা শহরের চেহারা দেখে কেউ টের পাবে না ১৯৪৫-এর খবর। দেরি হয়ে যাচ্ছে, সময় হাতে মাত্র ক’ঘণ্টা, ট্যাক্সি নিয়ে, “পীস পার্ক” নামটি বলতেই ছুটল গাড়ি নিশ্চিত গতিতে পনেরো মিনিটের মধ্যেই হিরোশিমা নগরী পার হয়ে শান্তি-উদ্যানে হাজির। বাহারি দোকানপাট, ভিড়ভরা বাজার হাট, অ্যাবসট্রাক্ট ছবির মতো আধুনিক অফিসপাড়া পেরিয়ে যখন ট্যাক্সি ছুটছিল আমি মনে মনে যেন দেখতে পাচ্ছিলুম শূন্যে বিশাল অগ্নিগোলক, কালোধোঁয়ার কুণ্ডলী, হুড়মুড় করে হুমড়ি খেয়ে পড়া ঘরবাড়ি, ছাতার মতো মেঘ। সেই হিরোশিমা আবার উঠে দাঁড়িয়েছে। আবার সে কর্মচঞ্চল বাণিজ্যনগরী? তা বলে ভুলতে পেরেছে কি? ভোলা কি সম্ভব? বাল্যকালে, ১৯৫০-এর জার্মানিতে দেখেছিলুম যুদ্ধে বিধ্বস্ত হামবুর্গ। ভাঙাচোরা মিউনিখ শহরের করুণ চেহারা। তখনও রুগ্‌ণ। কিন্তু দশ-বারো বছর বাদেই আবার সেই সব শহরে গিয়ে, পুরনো ধ্বংসের মূর্তি আর দেখিনি। সত্তরের দশকের পূর্ব বার্লিনে অবশ্য দেখেছি তখনও কিছু কিছু বিপুল প্রাসাদ, প্রাচীন গির্জে, নেহাৎ পোড়োবাড়ি হয়ে আছে। তখনও চলেছে পুনর্গঠনের কাজ পুরোদমে। ওদিকে প্রায় তৈরি হয়ে মাথা ঝাড়া দিয়ে উঠেছে একদা পুড়ে-যাওয়া লিনডেন-বীথিকার কচি কচি গাছের সারি। তৈরি হয়ে চালু হয়ে গেছে পুরনো অপেরা বাড়ি, লাইব্রেরি ভবন ইত্যাদি অনেক বৃহৎ অট্টালিকা। পুরনো ছবি অনুযায়ী সযত্নে তৈরি হচ্ছে আরো বহু। ঠিক আগের মতো করেই গড়বার চেষ্টা হচ্ছে ওই অঞ্চলটুকু। তাই সময় লাগছে।

হিরোশিমা আগের মতো হতে চায় না—হিরোশিমা নবীন পোশাকে সজ্জিতা। পুরনো ধরনের জাপানি ঘরবাড়ি কই চোখে পড়ল না! সবই অত্যাধুনিক মার্কিনি ঢঙের। বহুতল। কাচ কংক্রিট। দমবন্ধ। “পীস মেমোরিয়াল পার্ক”ও কিন্তু “জাপানি বাগান” নয়। আমি জাপানিজ্‌ গারডেন বলতে যা বুঝি, একেবারেই নয় তা “পীস পার্ক”। পরিচ্ছন্ন, অনেকটা জায়গা নিয়ে ছড়ানো পার্ক, তার সামনে একটি মস্ত গোল ফোয়ারা, ফোয়ারার বলয় বলা যায়, অনেকগুলি সারিবন্দী ফোয়ারার তৈরি গোল চক্কর। ফোয়ারাগুলির অনেক কায়দাকানুন জানা আছে। মাঝে মাঝে লাল, বেগুনি, সবুজ আলোর রঙ বদল করে। আশ্চর্য প্রাণবন্ত। যেন জ্যান্ত। অবশ্য মহীশূরের বৃন্দাবন গারডেনসে এই কাণ্ডই ঘটে, সহস্রগুণ বেশি করে। কিন্তু এটা যে হিরোশিমা!

ফোয়ারার পিছনেই জাদুঘর; শুধুমাত্র অ্যাটম বোমার মারণ উচাটনের জাদু দেখানোর জন্যই প্রস্তুত এই বিশেষ যাদুঘরটি। তার ওপাশে আরেকটিও বড় বাড়ি আছে। যাদুঘরে ঢোকার আগে আমি সেইখানেই যাই। যদি কিছু স্ন্যাক্স জোটে, লাঞ্চটাইম তো? যাদুঘরের সামনে শত শত জাপানি শিশুর সারি—তারা সবাই স্কুলের বাসে করে এসেছে জাপানের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে, আমার মতোই, হিরোশিমা পরিদর্শনে। ত্রিশ পঁয়ত্রিশটি স্কুল-বাস পার্কিং লটে—সেই পরিমাণে শিশু। সবাই যে সারিবন্দী তা নয়, যারা যাদুঘরে ঢুকছে কেবল তারাই। যারা বেরিয়েছে, তারা খেলা করছে। সকলের পরনে নিজস্ব ইস্কুলের ইউনিফর্ম, ভারি সুন্দর দেখাচ্ছে বাচ্চাদের। এমনিতে ইউনিফর্ম ব্যাপারটা আমার পছন্দ হয় না, কিন্তু ইস্কুলের বাচ্চাদের বেলায় দেখতে ভাল লাগে। প্রচুর পায়রা পীস পার্কের স্থায়ী বাসিন্দা। তারা বাচ্চাদের দেখে যত খুশি, বাচ্চারাও তেমনিই তাদের গুণমুগ্ধ। বাচ্চারা পায়রাদের খাওয়াচ্ছে, আর পাখিগুলিও কি নির্ভয়ে তাদের কাঁধে হাতে মাথায় বসছে। একটি গোলগাল নধর ছেলেকে তো প্রায় ঢেকেই ফেলেছে একঝাঁক লোভী পায়রা। আমার তো ভয় করতে লাগল। সে কিন্তু হাসিমুখে তখনও খাইয়ে যাচ্ছে, শেষে শিক্ষয়িত্রী এসে তাকে উদ্ধার করলেন। ব্যাপারটা ঠিক হিচককের সেই পাখিদের মতো ছিল না অবশ্য। সবসময়েই একটা হালকা আহ্লাদের আমেজ আছে এই পায়রাদের ওড়া-উড়িতে। আমি কিছুক্ষণ শিশু ও পাখির খেলাধুলো দেখে, বাড়িটার মধ্যে ঢুকে পড়ি। সেখানেও লাইন। স্যুভেনির বিক্রি হচ্ছে, চটি বইপত্তর, হিরোশিমার পোস্টকার্ড ছবি।

এখানে খাদ্য নেই, পানীয় জলের ব্যবস্থা আর বাথরুম আছে। আর আছে বসে বিশ্রামের মতো কিছু জায়গা। অনেকে লাঞ্চ বাক্স খুলে খাচ্ছেন সেখানে বসে। আর আছে হিরোশিমা বিষয়ক চলচ্চিত্রের সময় তালিকা। মোটামুটি এটা একটি ইনফর্মেশন সেন্টার—পীস পার্ক বিষয়ে অনেক খবর দেয় এরা। ইংরেজি বই যে-দুটি সস্তায় পাওয়া গেল, নিলুম। বাব বাঃ! ইয়েনের যা চড়া দর! বিশ্বের সেরা কারেন্সি তখন, সবচেয়ে শক্তিমান ছিল ১৯৮৬-তে, ইয়েন। আমি বিশেষ খরচ করার ক্ষমতা রাখি না। গরিব দেশের থেকে এসেছি—যদিও সঙ্গে কিছু ডলার আছে, তার তো মুরোদ খুব বেশি নয়। ইচ্ছে থাকলেও মোটা সোটা বইপত্রগুলো নেবার উপায় নেই। এখানে জানা গেল দুটি ভিডিও চিত্র দেখানো হয়, ইংরিজি ও জাপানি ছবি। ভিন্ন ঘরে। বিভিন্ন সময়ে শুরু হয়। সম্ভবত টানাই চলে। বেলা একটা থেকে সোয়া দুটো পর্যন্ত হবে পরবর্তী প্রদর্শনী। পৌনে একটায় পীস পার্কে পৌঁছেছি, এখন একটা বাজতে পাঁচ মিনিট—এই অট্টালিকাটির নাম “পীস প্যালেস” শান্তিপ্রাসাদ। আমি একটা থেকে ভিডিও ছবি দেখতে শুরু করলুম। ঘর প্রায় ফাঁকা। ইংরিজি ভি. সি. আর দেখার লোক নেই। জাপানিটিতে বেদম ভিড়। ইস্কুলের বাচ্চারা দেখছে। এ ঘরে শুধু দুজন আছেন শর্টস পরিহিতা মার্কিন দেশীয়া। আমার সীটটা ভাল, পাশে সরে বসতে দিলুম। তাঁরা বেশ রূঢ়ভাবেই প্রত্যাখ্যান করে অন্যত্র উঠে গেলেন। বেশ অবাকই লাগে। সাধারণত এমন আচরণ চোখে পাড়ে না। সে যাক, কী ভয়ংকর পরবর্তী সোয়া ঘণ্টার দৃশ্যাবলী এবং সংবাদ ভাষ্য। ১৯৪৫-এর ৬ আগস্ট সকাল ৮-৪৫ থেকে শুরু করা হয়েছে—কীভাবে মুহূর্তের মধ্যে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল শতসহস্র মানুষের অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ। কীভাবে মানুষের তৈরি বিজ্ঞানের কাছে ঘটে মানুষেরই সৃষ্টি করা নৈতিকতার পরাজয়। কীভাবে যে মানুষ এক একটা শব্দকে নিংড়ে তার অর্থ বের করে নিয়ে ছিবড়ে করে ফেলে দিতে পারে। যেমন মধ্যত্ব শব্দ। তার আর কোনো মানে নেই জীবনে। শুধু অভিধানেই বুঝি তার অস্তিত্ব, এমন ভয় করে আজকাল।

জল খাবার ঘণ্টা পড়েছিল হিরোশিমা গার্লস স্কুলে। বাচ্চারা কলকল করে ছুটে বেরিয়েছিল জলের কলের দিকে। সেখানেই লুটিয়ে পড়ে জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে গেল তারা। ছিটিয়ে রইল রিবন, পেন্সিল, আঙুল, জুতো, টিফিন বাক্স। ধ্বংসস্তূপের তলা থেকে তাদের খুঁজে বেড়াচ্ছেন তাদের অভিভাবকেরা, যেসব মা-বাবা যে সব শিক্ষক-শিক্ষিকা তখনও জীবিত, যদিও তেজস্ক্রিয়তার সুদূরবিহারী মৃত্যুর হাত তাঁদেরও নাগালে পেয়েছে। কিন্তু তাঁরা তা জানেন না।

একটি সেতুর ওপর দুজন মানুষ দাঁড়িয়েছিলেন রেলিঙে ভর দিয়ে। সেই রেলিং আর মানুষ দুটির ছায়ায় ছাপ চিরন্তন হয়ে গেছে সেতুর মেঝেতে, মুছে গেছে শুধু মানুষ দু’জন। রেলিং সমেত। তেমনি একটি অদৃশ্য মানুষের ছায়ামূর্তিটি রয়ে গেছে তার আবাসগৃহের সদর সিঁড়িতে পাথরের ধাপের গায়ে। মানুষটি নেই ৬ আগস্ট সকাল ৯টার পর থেকেই—কিন্তু ছায়া তার অনুগামিনী হয়নি। আজও বসে আছে সিঁড়ির ধাপে, ভবিষ্যতের কাছে মূর্ত অভিযোগ হয়ে। আণবিক বিস্ফোরণে যে এক্সরে আলোর বিচ্ছুরণ হয়েছিল, তারই তেজস্ক্রিয়তায় এই অনৈসর্গিক, অবিশ্বাস্য ঘটনাও ঘটে গেছে। বস্তু নেই, তার ছায়া আছে। সেই নেই-মানুষের ছায়ার ছবি আমি দেশেই বইতে দেখেছিলুম। কিন্তু এখানে স্বচক্ষে দেখার জাত আলাদা। হাসপাতালগুলিতে এই আশির দশকেও মরে বেঁচে আছেন ধ্বংসমুখী, মৃত্যুমুখী, বেশ কিছু তেজস্ক্রিয়তার শিকার—যাঁরা ৬ আগস্ট ১৯৪৫ মাতৃগর্ভে লুকিয়ে থেকেও আণবিক বিষের মৃত্যুবাণ থেকে রেহাই পাননি। কারুর ইন্দ্রিয়গুলি অচল, কারুর মনবুদ্ধি, কারুর হাত পা। কেউ ভুগছেন ক্যান্সারে। কেউ ব্লাড ক্যান্সারে। একচল্লিশ বছর ধরে তাঁরা নিশ্চিত মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করেই বেড়ে উঠেছেন, আজন্ম হাসপাতালের ঘরে। দু’একজন শুশ্রূষাকারিণীকে কিন্তু দেখলুম, তাঁদের মধ্যে দু’একজন ডাক্তারবাবুও আছেন, যাঁরা সেদিন থেকেই আর্তের সেবায় লেগেছেন, কিন্তু (বলতে নেই) এখনও এই বৃদ্ধবয়সে পৌঁছেও তাঁদের আদর্শ উৎসর্গিত জীবনযাপনে বাধা পড়েনি। ঈশ্বরের আশ্চর্য কৃপায় তেজস্ক্রিয়তা নিয়ে এত ঘাঁটাঘাঁটি করেও তাঁরা জীবিত ও সুস্থ আছেন, যদিও প্রত্যেকেরই শেষপর্যন্ত ক্যান্সারে মৃত্যুর আশঙ্কা রয়েছে। পাশাপাশি মানুষের অন্তর্বর্তী শুভ ও অশুভের এমন স্থূল প্রকাশ চট করে চোখে পড়ে না, আক্রমণে ও শুশ্রূষাতে যেমনটি দেখছি।

সোয়া ঘণ্টা পরে যখন অন্ধকার ঘর ছেড়ে করিডরের আলোয় বেরুলুম, তখন মাথার মধ্যে একটা ফাঁকা অনুভূতি। যন্ত্রণা অনুভবের শক্তিও যেন নেই। হঠাৎ সেই দুটি মার্কিনি মহিলা বিনয়ের অবতার হয়ে উদিত হলেন। এবং প্রশ্ন করলেন—আমার কাছে কি অনুগ্রহপূর্বক দান করার মতো অতিরিক্ত কোনো ট্যাম্প্যাক্স আছে? এখানে কোনও ওষুধের দোকান নেই, বা কথা বুঝিয়ে বলার মতো লোকও নেই। আকস্মিক দুর্বিপাকে পড়ে গেছেন তাঁদের মধ্যে একজন বাঁচা গেল। ছিল আমার কাছে তাঁদের সেই প্রার্থিত বস্তুটি। তাঁদের কপাল ভাল, এবং আমারও। সঙ্গে সঙ্গে এমন মহান প্রতিশোধের সুযোগ তো জীবনে চট করে মেলে না!

সত্যি বলতে কি এদের দেখে আমি বেশ আশ্চর্যই হয়েছি। মার্কিনিদের মধ্যে ভারতীয়দের প্রতি এমন রেসিস্ট মনোবৃত্তি আমার আগে চোখে পড়েনি। জানি না এঁরা ‘গভীর দক্ষিণ’ থেকে কিনা—কথা শুনে তো মনে হল না। ‘সাদার্ন ড্রঅল’ সেই দক্ষিণ মার্কিনের বিখ্যাত আলস্য জড়তা (জিবের আড়-না-ভাঙা আর কি) এঁদের রসনায় ছিল না। তা ছাড়া যে মার্কিনি তরুণীরা হিরোশিমা সন্দর্শনে নিজেরা স্বেচ্ছায় এসেছেন, তাঁদের তো প্রায়শ্চিত্তাভিলাষী, মানবিক হবার কথা। নাকি বিপরীত? এঁরা হয়তো দেখতে এসেছেন মার্কিন শক্তিমত্তার প্রমাণাবশিষ্ট? কি জানি! মনুষ্য চরিত্রে এতই বৈচিত্র্য, যে চটপট সরলীকরণে ভুল হবার সম্ভাবনা খুবই বেশি। তবে আমার কাছে হাত পাততে তাঁদের নিশ্চয় লজ্জা করেছিল, এটা ভেবেই বেশ পুলকিত হলুম। (এটাকে মোটেই আমার পক্ষে মহত্ত্বসূচক প্রতিক্রিয়া বলা যায় না!)

ফিল্মগুলি দেখে নিচে নেমে রোদে বাতাসে বেরিয়েই জাপানি শিশুগুলিকে আবার দেখতে পেলুম, দলে দলে ঘুরছে, হাসছে, ছুটছে, খেলছে। পীস প্যালেসের সামনের বাঁধানো খোলা জায়গায়।

অ্যাটম বোমা পড়বার মুহূর্তে সেই একদল স্কুল বালিকার জল খেতে যাবার দৃশ্যটা মনে পড়ল। একজনও বাঁচেনি। তারা তো জানত না। এদেরই বা ভবিষ্যৎ কেমন হবে কে জানে? এই শিশুদের পটভূমি হিসেবে দৃশ্যত এখন যা দেখছি, একদিকে পীস মেমোরিয়াল মিউজিয়াম—দোতলা বাড়ি। অন্যদিকে একটি দীর্ঘ পথ চলে গেছে ‘সেনোটাফ্’-এর দিকে—শহিদ স্মৃতিস্তম্ভ। পারমাণবিক স্মৃতির। তোরণের মতো, তাঁবুর মতো গড়নের “সেনোটাফ্” এই ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে চিরজ্বলন্ত শিখা, শান্তির দীপশিখা; তারও পিছনে এ-বম্-ডোম, অ্যাটম বোমার গম্বুজ। সেই যে একটি আশ্চর্য প্রাসাদ, যা ধ্বংস হতে হতেও হয়নি, আজও রয়ে গিয়েছে তার কাঠামো—’ওটা’ নামের সরু নদীর ওপারে সেই গম্বুজের কাঠামো দেখা যাচ্ছে এখান থেকেই। ঘুরতে ফিরতে একটা ছোট্ট দোকান পেলুম অন্যান্য জিনিসের সঙ্গে কিছু খাদ্যদ্রব্যও সেখানে মেলে। একটা পাতলা কাঠের বাক্সতে জাপানি লাঞ্চ আর একটা সেভেন আপ কেনা গেল। ওখানে বসে খাবার জন্যে কয়েকটি বেঞ্চ পাতা ও শূন্য বাক্স, বোতল ফেলবার জন্যে জঞ্জালের টিনও রাখা আছে। অল্প স্বল্প বৃষ্টি শুরু হল! আলো-আলো রোদ-রোদ আবহাওয়ার মধ্যেই ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। তেজস্ক্রিয় বর্ষণ নয় আশা করি। এখন তো ইংলণ্ডে ‘অ্যাসিড রেন’ হচ্ছে। কালো বৃষ্টি। মরে যাচ্ছে গাছপালা। সে আরেক গল্প।

দোকানের বেঞ্চির মাথায় কি ভাগ্যি শেডও আছে; পুরো ব্যাপারটাই দেশের মফস্বল স্টেশনের প্ল্যাটফর্মের মতো। সেইখানে বসে লাঞ্চ সেরে মিলুম। তিনটের সময়ে জাদুঘর খুলবে। লাঞ্চের সময়ে অন্যান্য অতিথিদের লক্ষ করছিলুম, সবাই অল্পবয়সী, সবাই জাপানি, নিজেদের রক্তাক্ত ইতিহাস যাতে বিস্মৃত না হয়, তারই জন্য আসা তাদের। কিন্তু ভাবটা এই, যেন হিরোশিমা সুদূর অতীত—আর হবে না। কিন্তু ঘটনা তো তা নয়। মানুষ শেখেনি। একটি বেদী রয়েছে সেনোটাফের নিচে। সেখানে মানুষ রেখে যাচ্ছে ফুলের স্তবক। পঁয়তাল্লিশ বছর আগে মৃত মানুষদের স্মরণে পুষ্প অর্ঘ্য। ওখানেই একটি খাতা আছে, যাতে পারমাণবিক বিস্ফোরণঘটিত প্রত্যেকটি মৃত্যুর হিসেব আছে এবং সেই দীর্ঘ তালিকা এখনও অশেষ। এখনও তাতে যোগ হচ্ছে নিত্যনতুন মৃত নাম। তোরণের পিছনেই একটি বাঁধানো মস্ত চৌবাচ্চা, তার ওপরে জ্বলে সেই অনির্বাণ শিখা, যার চারিদিকে পরিখা ঘেরা, তাতে জল। জল, যার নাম জীবন। আর আগুন যার নাম সভ্যতা। পাবক। অথচ বন্ধ হয়নি পারমাণবিক পরীক্ষা, বন্ধ হয়নি বোমা তৈরির প্রতিযোগিতা। বরং বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।

অনেকটা পথ হেঁটে গিয়ে, কয়েক ধাপ সিঁড়ি উঠে, সেনেটাফ্। এই পথ চলাটা বেশ, ঠিক তাজমহলের সামনে যেমন পড়ে আছে সোজা পথটা, এ-ও তেমনি। গোলাপী পাথর বাঁধানো এই পায়রা-বক-বকানো পথের দুপাশে সবুজ ছাঁটা ঘাসের লন। হেঁটে সেনোটাফের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে মনে নানারকমের স্মৃতি, অনুভূতি’ ভাবনাচিন্তা ক্রমাগত ঢেউ খেলে যেতে থাকে। সেনোটাফে পৌঁছনোর জন্য অতিথিকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করে দেয় এই পাথর বাঁধানো পথটি। সেনোটাফের নিচের শূন্যতা দিয়ে দেখা যায় আণবিক বোমার গম্বুজ—রক্ত মাংস নেই, শুধু কঙ্কালটা দাঁড়িয়ে আছে। সব মানুষের চোখে আঙুল দিয়ে মনে করিয়ে দিচ্ছে এক ৬ আগস্টের সকালবেলার দুঃস্বপ্ন। যার পুনরাবৃত্তি আজও সম্ভব যে কোনও দিনে যে কোনও দেশে। পায়ে পায়ে সেনোটাফ্, শহিদবেদী, অনির্বাণ শিখা, সব পেরিয়ে শান্তি উদ্যানের ওপারের অংশে পৌঁছে যাই। ‘ওটা’ নদীর ধারে ক্রন্দসী উইলো তরুর সারি জলের আয়নায় মুখ দেখছে ঝুঁকে পড়ে। ওদিকটায় যেমন ফাঁকা রোদ ঢালা উঠোন, এদিকে তেমনি বাগান, উপবন। ছায়ানিবিড় কুঞ্জ। নদীর ধারে ধারে জোড়া নৌকোর সারি বাঁধা আছে। এইখানেই সেদিন সকালে মৃত মানুষের সারি ভিড় করে পড়েছিল। নদী ভরে গিয়েছিল। নদীর তীরের বেঞ্চিতে ঘন হয়ে বসেছে তরুণ-তরুণী—যেন এখানে কেউ কোনওদিন মৃত্যুশেল হানেনি। সাইকেলে সামনে শিশুকে বসিয়ে পাশ দিয়ে চলে গেলেন জননী। আমি একটি বেঞ্চিতে বসি। উইলো পাতার ছায়ায়। তাকিয়ে দেখতে থাকি নতুন চোখে এই ১৯৮৮ জুনের হিরোশিমা—শান্তি উদ্যান এখন সত্যিই শান্তির ছবি। এক মধ্যবয়স্কা জাপানি মহিলা বেড়াতে বেরিয়েছেন, সঙ্গে শেকল বাঁধা দুটি মার্জার। বিলেতে অবশ্য গলায় বগলস পরানো বেড়াল দেখেছি (দেখা দেখি; নিজের বেড়ালদেরও বগলস পরিয়েছি—বেড়ালদের বগলসের চরিত্রটি কিন্তু কুকুরের চেয়ে আলাদা, সাবধান! যে-কোনও সরু বগলস হলেই হল না! তাতে খানিকটা ইলাস্টিক থাকা চাই। বেড়াল যে গাছে ওঠে, বগলসে ফাঁসি লেগে না যায়! ইলাস্টিক থাকলে, মুক্তির পথ আছে।) চেন বাঁধা ভব্য বেড়ালকে মার্জার না বলে গতি নেই—তাঁরা অত্যন্ত সম্ভ্রান্তভাবে বাগিচায় ঘোরাফেরা করেছেন। এক বালক দুটি কুকুর নিয়ে ছুটোছুটি করে খেলছে, মা ও শাবক একসঙ্গেই শেকল বাঁধা, তিনজনেই খেলায় মত্ত। পাশের বেঞ্চে এক বৃদ্ধ বসে তাদের খেলা দেখছেন, তাঁর সঙ্গেও একটি বেঁটে কুকুর আছে, সেটি কিন্তু এদের সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধে উদ্যমী নয়। আপন মনে মাটি শুঁকে বেড়াচ্ছে। উঠে, হাঁটতে হাঁটতে একটি টিলা দেখতে পাই। অ্যাটম বোমায় মৃত কিছু মানুষের সমাধি সেটি। সামনে স্মৃতিফলক, পাথরের বাতিস্তম্ভ। একটি ছোট দলে ফরাসি বৃদ্ধা মহিলা ভ্রমণকারিণী এসেছেন কয়েকজন—তাঁরা আমাকে বললেন তাঁদের ছবি তুলে দিতে। পরিবর্তে তাঁরা আমার ছবি তুলে দেবেন আমার ক্যামেরায়। বেশ ভাল প্রস্তাব। তখুনি কার্যকরী হল। এখানে বেশ কয়েক দল পশ্চিম জার্মানি, ফরাসি, ইংরেজ এবং দক্ষিণ আফ্রিকান অতিথি দেখলুম। মার্কিনি বলতে কেবল ওই দুটি তরুণী। সবাই উদ্যানে ছড়িয়ে আছে এদিকে সেদিক। আমি উদ্যানের কোণায় আরেকটি অনুসন্ধান অফিসে যাই মিয়াজিমা দ্বীপের সন্ধানে। ‘ওটা’ বিষয়ে যে কটি ইংরিজি কাগজপত্র ছিল, পড়ে শুনে বুঝলুম সেদিনকার পক্ষে বেশি দেরি হয়ে গেছে। মিয়াজিমার ফেরি নিয়ে দ্বীপে ঘুরে এসে ফের শিন-কোবে-তে ফিরে যেতে অনেক রাত হবে। ফলে ‘ওটা’ নদীর সেতু পার হয়ে ওপারে যাই, শান্তি উদ্যান ছাড়িয়ে হিরোশিমা নগরীর অলিগলি দিয়ে হেঁটে আসি একটু। এখানে দোকানপাট দেখে খুব একটা ধনীর পাড়া বলে মনে হচ্ছে না।

ছোট ছোট দোকান, পোশাক আশাকের, খাবারের, ফুলের। জাপানে ফুলের অনেক দাম, কিন্তু ফুলের দোকানও অনেক। শাক-সবজির, ফলের দোকান বরং সস্তা। একটা মস্ত মদের দোকান, তার সঙ্গেই লাগোয়া ভেনডিং মেশিনের দোকানে সফট্ ড্রিংকসও আছে। মেশিনে পয়সা ফেললে বীয়ারের ক্যান, ওয়াইনের বোতল বেরুবে, হুইস্কিরও। আবার নিরিমিষি শীতল পানীয়ও আছে। আমি একটা কোল্ড কফির ক্যান কেনার চেষ্টা করতে গিয়ে দেখি খুচরো নেই। হঠাৎ এক জাপানি মাঝ-বয়সী, মাথায় ক্রিকেটারদের মতো কাপড়ের টুপি, বাকিটা নোংরা মাতাল পথবাসীর রুক্ষ চেহারা, এগিয়ে এসে, পয়সা দিয়ে ওই কোল্ড কফির ক্যানটা বের করে নিলেন। আমার বেশ রাগ হল। মুখ থেকে চড়া মদের গন্ধ বাতাসে ছড়াচ্ছে। ঐ কোল্ড কফিতে ওঁর কী হবে? ভাবতে না ভাবতে দেখি লোকটি দুই হাতে দুই কানটি ধরে প্রবলভাবে বিনত হতে হতে আমাকেই নিবেদন করছেন। কিছুতেই দাম নিলেন না—ভাষার ব্যবধান কাটিয়ে উঠতে দেরি হল না—”প্লেজেন্তো” “প্লেজেন্ডো” বলে ভীষণ মোদো গন্ধ ছড়িয়ে হলদে দাঁত বের করে ‘বাও’ করে শিশুর মতো হাসতে লাগলেন। তারপর আমাকে একটি মিলিটারি স্যালুট করে হাসি মুখে আপন মনে বকতে বকতে চলে গেলেন। দেড় শো ইয়েন মাত্র দাম, কিন্তু ওই কোল্ড কফির টিনটা আমি কলকাতাতে নিয়ে আসতে চেয়েছিলুম। তাই না-খেয়ে ব্যাগেই ভরে ফেলি।

নদীর ওপারেও দুটি শহিদ স্মৃতিস্তম্ভ আছে। একটি সত্যি সত্যিই স্তম্ভ। পাঁচতলা বারান্দাওলা মিনার, অন্যটি একটি মাত্র ছোট কালো লম্বাটে পাথর। একটা সময়ে স্কুল ছাত্রছাত্রীদেরও, যাদের বয়েস বারোর বেশি, জাপান যুদ্ধের কাজে লাগিয়েছিল। তাদের মধ্যে দশ হাজারের মৃত্যু হয়, ছ’হাজার জন মারা যায় শুধু অ্যাটম বোমাতেই। এই স্মৃতিফলক তাদের উদ্দেশে কালো পাথরটিতে জাপানি ভাষাতে সাদা হরফে কিছু লেখা, পাথরটি ঘাসপাতার মধ্যে একা শুয়ে আছে ঠিক কবর ফলকের মতোই। আর স্মৃতি-স্তম্ভটি খাড়া উঠেছে আকাশে। তার নিচের তলায় বহু রঙিন ফিতে বাঁধা। ছাত্রছাত্রীরা বেঁধে গিয়েছে। ফুল দেবার মতোই এটা এখানে প্রচলিত অনুষ্ঠান। ঠিক যেখানে বোমাটি পড়েছিল, সেই কেন্দ্রবিন্দুতে একটি বেদী আছে। তাতে শতসহস্র রঙিন ফিতে উড়ছে ফুলের মতো। তার কিছু কিছুতে ইংরিজিতে ছাপা আছে : “We want peace।” অথবা “Peace for the world।” বাকি ফিতেগুলির গায়ে জাপানি ভাষাতে নিশ্চয় ওই একই শান্তির বাণী ছাপা। ছাত্রছাত্রীর দল বিভিন্ন ইস্কুল থেকে এসে ওইসব রঙচঙে ফিতের গোছা বেঁধে দিয়ে যায় এখানে। তিব্বতে ‘খাদা’ বাঁধার মতো।

‘হাইপো-সেন্টার’-এর চারিপাশে এখন সবুজ বাগান। সেখানে হাঁটছি। হঠাৎ দেখি অদূরেই একটি লতাকুঞ্জ—সিমেন্টের বাঁধানো মাচাতে বাসন্তী ফুলে ভরা একটি রূপসীলতা রাজত্ব বিস্তার করেছে, অপরূপ দৃশ্য, তার নিচের স্বপ্নিল অংশটিতে একটি বেঞ্চি পাতা। সেই বেঞ্চি কি শূন্য? না, মোটেই না। মাসটা জুন, সময় বসন্ত। সেখানে চিৎপাত হয়ে ঘুমিয়ে আছেন একজন মানুষ। পাশে ছেঁড়া কাপড়ের পুঁটলি, মাটিতে ছেঁড়া জুতোজোড়া খুলে রেখেছেন একটি পা বেঞ্চির পিঠের ওপর তুলে দিয়েছেন। স্বর্গসুখ আর কাকে বলে। ধনী জাপানে এই পথবাসী গৃহহারা দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ভয়াবহ রকমের বেশি। সর্বত্র চোখে পড়ে। টোকিওতে তো সবচেয়ে বেশি। যেখানে যাই, দেখি পার্কে পার্কে বেঞ্চি দখল করে এরা ঘুমন্ত। বেঞ্চির নিচে বা মাথার কাছে প্লাস্টিকের থলিতে কিংবা ব্রাউন পেপারের ঠোঙায়, বা নাইলনের কিটব্যাগে তাদের সারা জীবনের সম্পত্তি অবহেলায় ফেলে রাখা। কেউ যে কিছু চুরি করে না জাপানে। সবারই সব কিছু আছে। নতুন মডেলের টি ভি কিনলে পুরনো মডেলেরটা আস্তাকুঁড়ে ফেলে দিয়ে আসে। জায়গা নেই ঘরে কারুরই—একটিও অতিরিক্ত জিনিস রাখা অসম্ভব। অভাব কেবল এই একটাই—জায়গার। তবে এই পথবাসী মানুষদের নাকি কিছুতেই গৃহবাসী করা যায় না। ইংলন্ডেও এরা প্রচণ্ড সামাজিক সমস্যা, এই বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের কোনও ‘হোমেই পুরে রাখা সরকারের অসাধ্য। চলচ্ছক্তিরহিত না হওয়া পর্যন্ত, এঁরা পথে পালিয়ে আসেন। পয়সা হাতে পেলেই বীয়ার খেয়ে ফেলেন। চার দেওয়ালের বাঁধন এরা মানতে পারেন না। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরেই এদের সংখ্যা ভয়াবহ রকম বৃদ্ধি পেয়েছে ব্রিটেনে। জাপানেও তাই। নিউ ইয়র্কের কৃষ্ণকায়দের মধ্যে এই ব্যাপারটি লক্ষ্য করেছি, এই ব্রাউন পেপার ব্যাগে যথাসর্বস্ব নিয়ে, পার্কে শুয়ে থাকা। যান্ত্রিক সভ্যতাপুষ্ট আধুনিক দেশের দুর্লক্ষণ এই ট্র্যাম্প–যারা ঝড়তি, যারা ঝড়তি পড়তি, যারা পেরে ওঠেনি—যারা স্বনিৰ্বাসিত। চ্যাপলিনের কল্যাণে তার সঙ্গে আমাদের পরিচয় আছে। এরা অবশ্য একটু আলাদা। ঘর দিলেও সে ঘরে এরা থাকতে পারে না। পালিয়ে যায়। দুটি সুপুষ্ট পায়রা গম্ভীর হয়ে বসে আছে ঘুমন্ত ট্র্যাম্পটির মাথার কাছে। ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমীর মতো। পাহারা দিচ্ছে বুঝি কোনো ছদ্মবেশী রাজপুত্তুরকে। রাজপুত্তুরের মুখের কাছে একটি মাছি উড়ছে। ঠোঁট দুটি অল্প ফাঁক হয়ে আছে। আমার ভয় করতে লাগলো মাছিটা যদি ওর মুখের মধ্যে ঢুকে পড়ে? তবু কাছে গিয়ে জাগিয়ে দেবার সাহস হল না। মনে হল নিশ্চয় এমন পরিস্থিতি ওর রোজই ঘটছে। এই আধুনিক হিরোশিমাতে, কুসুমিত বাসন্তী লতাকুঞ্জে ঘুমন্ত মাতালটি যেন একটি বিমূর্ত প্রতীকের মতো ছাপ ফেলে দিল আমার মনে।

আবার ফিরে গেলুম সেই বুককাপানো কেন্দ্রবিন্দুতে, শিশুদের দেওয়া কাগজের মালা উড়ছে, রঙিন কাপড়ের পতাকা, পোস্টার, বহুবর্ণময় জীবনের স্পষ্ট উচ্চারণ—We do not need another nuclear war : ‘ওটা’ নদীতে সবুজ ছায়ায় জোড়ায় জোড়ায় বাঁধা নৌকো মৃদু বাদাসের দোলায় দুলছে। হঠাৎ দেখি সেই বাচ্চা জাপানি ছেলের সঙ্গে এক চেনে বাঁধা যে কুকুর-মা আর তার ছানাটি ছিল, সেই শাবকটি একা একা খেলছে। মা কোথায় গেল? এদের দুটিকে দেখে আমার খুব ভাল লাগছিল। এরা বোধহয় আদি জাপানি নেড়ী, দৃশ্যত একেবারেই বঙ্গীয় পথবাসী সারমেয় কুলের স্বজাতি। হঠাৎ মা-জননী হাজির ছিন্ন শিকলি গলায় নিয়ে

তারপর মহোল্লাসে মায়ে-পোয়ে মারামারি হুড়যুদ্ধ খেলা শুরু হল। পিছু পিছু তাদের নাদুসনুদুস বালক প্রভুটিও এসে পড়ল দেখে আমি নিশ্চিন্ত হয়ে রওনা দিলুম। আচ্ছা, এরা কি মাঝে মাঝে ভুলে যায় এটাই হিরোশিমা? নিশ্চয়ই যায়, নইলে স্নান করে, ভাত খায়, আপিস যায় কেমন করে?

ক্রমে মিয়াজিমা দ্বীপে যাবার ইচ্ছেটাই চলে গেছে। প্রথমে তো ঐ সোয়াঘন্টার ভিডিও, তারপর পুরো দেড় ঘণ্টা হেঁটেছি কেবল হিরোশিমার এই পীস মেমোরিয়াল মিউজিয়ামের ভেতরে। একদঙ্গল জাপানি স্কুল ছাত্রছাত্রীর সঙ্গে।

জাদুঘরটি অত্যন্ত গোছানো, তবে ইংরিজি ধারাভাষ্যটি (একটি টেপ প্লেয়ার ভাড়া নিয়েছি, কানে কানে জ্ঞান দেবে বলে) বিশেষ সুবিধের নয়। ছবির গায়ে যা লেখা, প্রায় তাই-ই। তবে নির্দেশ দেয়, এবার এদিকে যাও, এবার ওদিকে তাকাও। জাদুঘরটি সাজানো এমনভাবে, যে কিছুই জানে না সেও সর্বজ্ঞ হয়ে বেরুবে হিরোশিমা বিষয়ে। প্রথমেই আণবিক বোমা পড়ার আগেকার সাধারণ পটভূমি, তারপর বোমার উত্তাপের বিচ্ছুরণঘটিত ক্ষতির উদাহরণ, তৃতীয় ভাগে বিস্ফোরণের চাপে যা ঘটেছে সেইসব ক্ষতির চেহারা, চতুর্থ অংশে তেজস্ক্রিয়তার ফলাফল, পঞ্চমভাগে অগ্নিকাণ্ডের ধ্বংসস্তূপের নমুনা, ছ’নম্বর অংশে উদ্ধারকার্যের বর্ণনা, সপ্তম ভাগে যা কিছু উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে সেইসব, আট নম্বরে বোমার যাঁরা সাক্ষী হয়ে বেঁচে ছিলেন তাঁদের কণ্ঠস্বর ধরা আছে, তারপরে নাগাসাকি থেকে আনা কিছু পারমাণবিক ধ্বংসের নমুনা।

ওই জাদুঘরে তেজস্ক্রিয় অগ্ন্যুদ্গারের ভয়ংকর জাদুর খেল প্রত্যক্ষ করবার পরে আর কোনও বিমল প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, কোনও মন্দিরের সুকুমার আর্কিটেকচার চেখে দেখবার মতো মনের বল আমার অন্তত নেই।

ওই জাদুঘরে কী নেই? বেঁকে যাওয়া লোহার সিঁড়ি, তালগোল পাকানো কাচ-ধাতু-কাঠ- অস্থির পিণ্ড, খুলে-আসা, খসে-পড়া মানুষের মাথার চুল, বোমায় ফাঁপা হয়ে যাওয়া ভিতরে-নেই-বাইরে আছে, এমন মহীরুহের কাণ্ড, সেই নেই-মানুষের ছায়া-এঁটে থাকা সিঁড়ির ধাপটি, সেই হারিয়ে যাওয়া মানুষের ছায়া-ধরা সেতুর মেঝেটির মস্ত ছবি, আছে প্রচুর ছবি, প্রচুর বিকৃত আণবিক ধ্বংসাবশিষ্ট, মৃত্যুর চিহ্নে, ক্ষয়ের চিহ্নে ধ্বংসের সংকেতে উপচে পড়ছে এই যাদুঘর। বোমার খোলাটার নকলও আছে, আছে নকল মানুষের দল কাঠের শোকেসের পিছনে। জ্বলন্ত মৃত্যুর গ্রাস থেকে যারা জীবনের আশ্রয়ের দিকে পালিয়ে আসার চেষ্টা করেছিল দলে দলে। গলে-যাওয়া মাংস, খসে-পড়া চামড়া, জ্বলে-যাওয়া চুল, প্ৰাণহীন বিবর্ণ মুখচ্ছবি—সেই ভয়াবহ দৃশ্য দেখলে আত্মার মধ্যে একটা বিশেষ পরিবর্তন না ঘটেই পারে না। আজকের গোলাপী-গাল নধর জাপানি বাচ্চারা দল বেঁধে কাচের গায়ে নাক ঠেকিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে সেই দৃশ্য প্রত্যক্ষ করছে। ভবিষ্যতের এই অতীতকে চেয়ে দেখার দৃশ্যটাই যেন আরেকটা ত্রিমাত্রিক ছবি। আমি একটি ছবি তুললুম এই দেখার। এই জাদুঘরে ছবি তোলা বারণ ছিল না। আণবিক সর্বনাশের প্রমাণ সংবলিত প্রায় ৬০০টি দ্রব্য এখানে প্রদর্শিত। চারিদিকের অ্যাটম বোমার ভয়াল পরিণতির নানা প্রমাণ। কিন্তু হিরোশিমা শহরে ধ্বংসাবশেষ বলতে ওই একটিই বাড়ি—এ-বম্ব-গম্বুজ। নতুবা হিরোশিমা শহরে এখন অন্যান্য শহরের মতোই নানান সৌন্দর্যপূর্ণ দ্রষ্টব্য-স্থল আছে। আছে সুগঠিত সিটি সেন্টার। অন্তত আধডজন প্রথম শ্রেণীর হোটেল। প্রসিদ্ধ হিরোশিমা দুর্গ বোমাতে সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যাবার পর ১৯৫৮-তে যেটি পুনর্গঠিত হয়েছে। আছে নবীন ‘শুক্কাই-এন’ উদ্যান, চীনের হ্যাংচাও-এর প্রসিদ্ধ উদ্যানটির নকলে তৈরি। আছে ‘সায়েন্স অ্যান্ড কালচারাল মিউজিয়ম’ জাপানের আধুনিকতম প্ল্যানেটেরিয়ামটি যেখানে। প্রসিদ্ধ পশ্চিমী শিল্পীদের ছবি নিয়ে রয়েছে ‘হিরোশিমা মিউজিয়ম অব আর্ট’। আছেন দেগা, মোনে, রেনোয়ার, পিকাসো। ‘ওটা’ নদীর তীরে আশ্চর্যভাবে আণবিক বিস্ফোরণের হাত থেকে রক্ষা পেয়ে আজও অক্ষত রয়েছে চতুর্দশ শতকের এক বৌদ্ধমন্দির, ফুদোইন মদ্রি, হিজিয়ামা পার্ক আছে, হিজিয়ামা পাহাড়ের গায়ে (হিরোশিমা যে পাহাড়ের কোলে) সেখানে তেজস্ক্রিয়তার ফলাফল নিয়ে গবেষণা হচ্ছে, ল্যাবরেটরি এবং রীডিং রুম রয়েছে। চিড়িয়াখানা, বটানিক্যাল গার্ডেন, যা যা থাকার কথা একটি পরিপূর্ণ শহরের, তা সবই আছে আজ হিরোশিমাতে। ১৫৮৯-তে পত্তন হয়েছিল হিরোশিমার। ‘ওটা’ নদীর তীরে, সামন্তরাজ টেরুমেটো মোড়ি একটি দুর্গ বানিয়ে তার নাম রাখলেন হিরোশিমা। নদী-তীরে বলেই হোক বা অন্য যে কোনও কারণে, হিরোশিমা ক্রমে ক্রমে শক্তিমান দুর্গনগরী হয়ে উঠল। উত্তরোত্তর উন্নতি হয়ে চলেছিল হিরোশিমার ৬ আগস্ট ১৯৪৫ এর সকাল পর্যন্ত। তারপর মুহূর্তেই জ্বলেপুড়ে ছাই হয়ে গেল চারশো বছরের ইতিহাস। আজ জাপানের অসামান্য মনোবলের উজ্জ্বলতম প্রমাণ হয়ে আবার মাথা চাড়া দিয়েছে হিরোশিমা। ১০,৩০,০০০ জনসংখ্যায়, অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক সংস্থায় আর অজস্র বেড়ানোর জায়গাতে জাপানের অনেক শহরকেই টেক্কা দিতে পারে সে এখন। এবারে স্টেশনে ফেরার সময়। বাসে ফিরতে চাই। অথবা ট্রামে। কিন্তু ধরবো কেমন করে? কোন্ বাস? কেউই যে ইংরিজি বলে না। অবশেষে এক নিরীহ সাইকেল আরোহীকে ধরলুম। ট্রাফিক লাইটে, খপ করে। দেখা গেল তিনি ভাঙা ভাঙা ইংরিজি জানেন, মানুষটিও ভাল। বললেন, এদিকে নয়তো, পীস মেমোরিয়াল পার্কের উল্টোদিকে আছি আমি, এখানে ট্রাম যায় বটে, কিন্তু উনি জানেন না কোন ট্রামটি স্টেশনে যায়। অতএব উনি এলেন সাইকেল ঠেলতে ঠেলতে উদ্যান পার হয়ে সামনের দিকে, পীস মেমোরিয়াল মিউজিয়ামের কাছে, সেই গোল ফোয়ারার সামনে, অনেক মানুষজন অফিস ফেরত কিউ দিয়ে আছেন সেখানে। ইনি তাঁদের জাপানিতে বুঝিয়ে দিলেন আমি স্টেশনে যাবো। এক মধ্যবয়সিনী এগিয়ে এসে আমার হাতটি ধরলেন। ইংরিজি জানেন না। আমিও তাঁর হাতে আত্মসমর্পণ করলুম। এবার সাইকেলে চড়ে আমার বন্ধুটি হাত নেড়ে বিদায় নিলেন। যাবার আগে আমার নবলব্ধ সঙ্গিনীকে কী যে নির্দেশ দিলেন, কে জানে। সহচরীটি আমাকে সঙ্গে নিয়ে বাসে চড়লেন। সঙ্গে নিয়ে নামলেন। সঙ্গে করে স্টেশনে নিয়ে গিয়ে আমাকে কোবের ট্রেনের নির্দিষ্ট প্ল্যাটফর্মে পৌঁছে দিলেন। যদিও ভাষাহারা নিঃশব্দ কর্মী, ঘড়িতে দেখিয়ে দিলেন সাতটা কুড়িতে ট্রেন। উষ্ণ করমর্দনের সঙ্গে অনেকখানি নীরব হাসি উপহার দিয়ে তিনি বিদায় নিলেন। হিরোশিমার আকাশে, দুপাশে অভ্রংলেহী অট্টালিকার ফাঁকে একটুকরো ছায়ামূর্তি হিয়াজিমা পাহাড়। তার গায়ে তখন শেষ, সূর্যের শান্ত গোলাপী আলো হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছে। ঠিক যেমন দাঁড়াতো সে ১৫৮৯-তে, যেমন দাঁড়িয়েছিল ১৯৪৫-এর ৫ আগস্ট সন্ধ্যাতেও। যেমন আবার দাঁড়াবে ৬ আগস্ট ১৯৮৮ তে, নাগাসাকি থেকে সুনীল দত্তের পদযাত্রা যখন পৌঁছবে হিরোশিমার শান্তি উদ্যানে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *