আয়ার্ল্যান্ডের চিঠি

আয়ার্ল্যান্ডের চিঠি

প্রিয় সুনীল,

আপাতত একটার পর একটা অবিশ্বাস্য কাহিনি তোমায় বলতে বসেছি। প্রথমত কেউই বিশ্বাস করবে না যে নেহাৎ অন্যমনস্ক ভাবে আমি ঠিক “ব্লুস্‌ ডে”-তেই, এবং জয়েসের শতবর্ষ উৎসবের প্রধান দিনটিতেই ডাবলিনে এসে উপস্থিত হয়েছি অপূর্ব অপরিকল্পিত উপায়ে। একেই কাজ হল বিশ্বসাহিত্যের মাস্টারি, তায় নিজেও একটু আধটু লিখি, ১৬ই জুনের মাহাত্ম্য মনেই ছিল না বললে লোকে শুনবে কেন। সত্যি সত্যি গাড়িতে চলতে চলতে রেডিওতে অ্যাক্সিডেন্টালিই শুনে ফেললুম ৩১ ঘণ্টা একটানা ইউলিসিস পাঠের অংশ! দ্বিতীয় কথা, কেউ কি বিশ্বাস করবে, যদি বলি, যে এক্ষুনি হোর্হে লুইস বোরহেসকে জিনিভার গাড়িতে তুলে দিয়ে এসে এন্টনি বার্জেসের সঙ্গে বসে কফি খাচ্ছিলুম, এমন সময়ে সেখানে এসে আড্ডায় যোগ দিলেন শ্রীযুক্ত চিনুয়া আচিবি? তুমি ভাবছো, উঃ! হ’ল কি মেয়েটার? বিলেতে কি কেউ যায় না? কী গুল্! কী গুল্! কোথায় আর্জেন্টিনার বৃদ্ধ কবি বোরহেস, আর কোথায় মোনাকোতে স্বনির্বাসিত ইংরেজ ঔপন্যাসিক বার্জেস, আর কোথায় নাইজিরিয়ার রাগী লেখক আচিবি। তাঁদের খেয়ে দেয়ে কাজ নেই, প্রত্যেকে এই কলকাতার হেলেনটির মনোরঞ্জন করবার জন্যে যার যার দেশ ছেড়ে প্লেনের টিকিট কিনে মরতে-পড়তে ছুটে চলে এসেছেন, —কোথায়? না ডাবলিনে! হায় রে! নবনীতার গল্প যে ঘনাদার দ্বিগুণ হচ্ছে! হাসির গল্প লেখার এ কী ভয়াবহ পরিণতি? কৌতুকের ফাঁদে পড়ে কি সব কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে?— উঁহু সুনীল ভুল করলে। মোটেই ইয়ার্কি করছি না। যথার্থ সত্যকথা বলতে পারি!—এক্কেবারে গড়গড় করে এমন সব সত্য কথা বলব, যে শুনলেই মনে হবে গুল্ দিচ্ছি। সুনীল, ওরফে হোরেশিও, স্বর্গে মর্তে আরো ঢের বস্তু ঘটে বটেক যাহা তোমার…ইত্যাদি। যেমন…. “ইউলিসিস” বইয়ের গোড়ায়, সমুদ্র-তীরের সেই টাওয়ার, বাক্ মুলিগ…. যেখানে দাড়ি কামাচ্ছিল, সেই মারটেল্লো টাওয়ারে গিয়ে (না, ‘দাড়ি কামিয়ে এলাম’ বলছিনা!) জয়েসের গাদা-গাদা ম্যানুস্ক্রিপ্ট, তাঁর বাঁকাচোরা গীটারটি, জয়েসের ঠাকুর্মার তৈরি ওয়েস্ট কোট, টাই, ছড়ি এইসব দেখে এলুম। আর দেখলুম মাতিসের ইলাসট্রেট করা (পেন্সিলস্কেচ) ইউলিসিস এক খণ্ড (১৯৩৫)। স্যান্ডিকোভে সেই টাওয়ারটার নামই হয়ে গেছে এখন জয়েস টাওয়ার! একদিন তো আমি সারাদিন ধরেই কেবল লিওপোল্ড ব্লুম যেখানে যেখানে গিয়েছিল সেইখানে সেইখানে ঘুরে বেড়ালুম। ডিউকস্ট্রীটের সেই যে ডেভি বার্নসের পার্, সেটা সেখানেই এখনো আছে। গিয়ে বসলুম। এবারে ব্লুমের মতন এখানে রেড ওয়াইন আর চীজ খেতে হবে। হঠাৎ দেখি, আরে! ঠিক তার উল্টোদিকেই রয়েছে বেইলি’র পার্! চীজ ওয়াইনটা খতম হলেই একবার সেখানেও যেতে হবে বৈকি। ব্লুম যেহেতু গিয়েছিল। সেইখানেই গিয়ে দেখি রাখা আছে সত্যি সত্যি সাত নম্বর একট্স্ স্ট্রীট বাড়ির গোল খিলেনসুদ্ধু কাঠের দরজাখানা। ঠিকানার ফলক দরজার ধারের দেয়ালগিরি বাতিটি সমেত খুলে এনে সাজিয়ে রেখেছে এরা। পুরোনো বাড়িটা মিউনিসিপ্যালিটি ভেঙে গিয়েছে বলে, দোরটা এরা রক্ষে করেছে।—আহা, আমাদের দেশের কোনও মদের দোকান এমন কথা কল্পনাও করবে? উপন্যাসের নায়কের বাড়ির ঠিকানাটি সংরক্ষণ করার কথা ভাববে? লিওপোল্ড ব্লুম লেখকের কল্পনাই তো, হাজার হোক। ‘বেইলি’ পাবটি বেশ বড়সড়, এর আবহাওয়াটা ভারি সুন্দর, সত্যি। ভেতরের সিলিং থেকে চারখানা কাঠের পাখনাওলা বিরাট ঝুলন্ত দুটো পাখা ঘুরছে। ভেতরে চারিদিকে কত লতাপাতা, গাছগাছালির টব, দেয়ালে দেয়ালে নানারকম বাণী লেখা আছে—চমৎকার অক্ষরে, আর ভেতরে বেশির ভাগই অল্প-বয়সীর ভিড়। বেশ লাগল। যেন এক্ষুনি আধা-ক্লান্ত লিওপোলড ব্লুম পাশের টেবিলে এসে বসবেন মনে হচ্ছিল। শুধু কি তাই? সেই যে-হোটেলে ইউলিসিসের বিখ্যাত “সাইরেন” পরিচ্ছেদ, সেখানেও বেড়াতে, গিয়েছিলুম তো। সেই অরমণ্ড হোটেলে। গেলুম, কিন্তু বড়ই ভগ্নদশা, ঢুকতে ইচ্ছে হল না। ডক্ অঞ্চলের হোটেল। ব্লুস্‌-ডে’র দিনে কিন্তু দারুণ ব্যবসা করছে ওরা, প্রায় নিখরচায়—দু’পৈনি করেই বিয়ার বিলি করছে? এক্কেবারে লিওপোল্ড ব্লুমেরই সময়কার বাজারে দরে। আবার উনিশ শতকের পোশাক পরিয়ে দুটি মেয়েকে সাজিয়ে গুজিয়েও রেখেছিল, ইউলিসিসে বর্ণিত মিস কেনেডি আর মিস্ দ্যুস্—সেই বারমেড দুটির ভূমিকায়। যারা ব্লুমের সঙ্গে ফ্লার্ট করত। আমি অবশ্য সেইদিনের উন্মত্ত ভীড়ের (জয়েসের ভক্তের চেয়ে সস্তায় গিনেস বিয়ারের ভক্তই ছিল বেশি সংখ্যায়) ভেতরে যাইনি। শুনেছি শ’পাঁচেক খদ্দের এসেছিল।

“ফর্টি ফুট” বলে ইউলিসিসে যে স্নানের জায়গাটির উল্লেখ আছে না, সমুদ্রতীরে, “জেন্টলমেন বেদিং” বলে লেখা?—সেখানেও গেলুম। এখনও তাই লেখা। চমৎকার জায়গা। সমুদ্রটি কী আশ্চর্য দেখায় সেখান থেকে! দূরে হোওএর লাইটহাউসে আলো দেখা যাচ্ছে। আকাশে তখন সন্ধে, কত মাছধরার নৌকো ফিরছে। অনেকগুলো ছোটবড় আলোকস্তম্ভ আছে এই অঞ্চলের সমুদ্রে। ইউলিসিসে উল্লিখিত জায়গাগুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে বেড়ানোর খেলায় আমার সঙ্গী ছিল আমার নাতি বাবলুর দুই ছেলে, মুক্ আর পক্। ফাঁকতালে তাদের অনেক জ্ঞানসঞ্চয় হয়েছে। একুশ নম্বর ওয়েস্ট ল্যান্ড রো-তে ঠিক কোনখানে অস্কার ওয়াইলডের বাড়ি ছিল, আর হ্যারিংটন স্ট্রিটের কাছে সাউথ সার্কুলার রোডে কোথায় বার্নার্ড শ’ জন্মেছিলেন, এবং কিলানী হিসের কোনখানে তিনি থাকতেন, কবি টমাস মোর যে ১২ নম্বর অনজিয়ার স্ট্রিট-এ থাকতেন সেই বাড়িতে এখন সেলুন হয়েছে, সাউথ ডাবলিনে রাথফার্ণহামের নিউ টাউন ভিলেজে, ঠিক কোন্ বাড়িটিতে জন মিলিংটন সিঙ্ জন্মেছেন, আর একচল্লিশ নম্বর ব্রাইটন স্কোয়্যার-এর নীল দরজাওলা বাড়িটাই যে জয়েসের জন্মস্থান, আর ‘জর্জ ভিল্‌’ নামে স্যান্ডি মাউন্ট্ অ্যাভিনিউয়ের ঐ বাড়িটাতেই যে ইয়েটস-এর জন্ম, ওয়ারবার্গাস চার্চের সাত নম্বর হোয়ীজ কোর্টে জন্মেছিলেন মহামতি জনাথন সুইফট্, এ-সমস্তই তারা এখন হাড়ে হাড়ে জেনে গেছে। বাবার দিদিমার পাল্লায় পড়ে যারপরনাই ক্ষুধা-তৃষ্ণা-জল-কাদা সহ্য করে এসব তীর্থস্থানে তাদের হাজিরা দেওয়া হয়ে গেছে। আয়ারল্যান্ডেই যদিও তাদের জন্ম-কর্ম, কিন্তু এতকাল এসব কিছুই দেখেনি, শোনেনি, বা ভাবেনি। তাদের বন্ধুরা বা মাস্টার-রা কেউই এসব নিয়ে মাথা ঘামায় না। এগুলো দেখানোর জন্যে কলকাতা থেকে তাদের পিতৃদেবের পূজনীয় দিদিমার ডাবলিনে ধেয়ে আসার দরকার ছিল। বাবার দিদিমা? তিনি কে? আবার কে?—আমি! এটাও বিশ্বাস করছ না তো, যে কলেজপড়ুয়া ছেলের প্রৌঢ় বাবাটির আমি খাঁটি দিদিমা হই? বয়েসে অবশ্য নাতিই কিছুটা বড়, কিন্তু নিখাদ সত্যি সম্পর্ক। ওদের বাপের সাক্ষাৎ দিদিমা হই! বড় পরিবারের এই সুবিধা। জ্যাঠতুত দাদার বড় নাতি যে! গ্রাফটন স্ট্রিট দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ওদের বললুম, “দেখে রাখো, এখানে নোরা বারনালের সঙ্গে জেম্‌স্‌ জয়েসের দেখা হয়েছিল। কী, শুনে গায়ে কাঁটা দিচ্ছে না?” ওরা বলল, “না! নোরা কে?”—”আরে, জয়েসের বউ। তাঁর জীবনভোর প্রেমিকা, মলি ব্লুমের মডেল।” নাতির ছেলেরা দু’জনেই বৈজ্ঞানিক হবার সাধনায় ব্যস্ত, কিন্তু আমার পাল্লায় পড়ে ডাবলিনের একটা লিটারারি ট্যুরিস্ট গাইড করবার যোগ্যতা অর্জন করে ফেলেছে। আমি ওদের সঙ্গে ফিনিক্স পার্ক, লিফি নদী এমনকী গ্লাসনেভিন কবরখানায় পর্যন্ত ধেয়ে গিয়েছিলুম। লিওপোল্ড ব্লুম যেন গতঃ সঃ পন্থাঃ—এই আইনানুযায়ী। গ্লাসনেভিন সিমেট্রিতে গিয়ে দেখি, তার পাশেই বিখ্যাত একজনের জন্মস্থান। কার বলো তো? অ্যাডিসন সাহেবের। “অ্যাডিসন লজ” বলে তাঁর জন্মবাড়িটিও রয়েছে; এখন অবশ্য ট্যাভার্ন ও কাফে হয়ে গেছে। চমৎকার বাড়ি ন্যাশনাল মনুমেন্ট। এরা রাখার জিনিস রাখতে জানে সাজিয়ে গুছিয়ে। তাই থাকেও। এবার কবিদের জন্মস্থানই কি কম দেখলুম? কত বিখ্যাত লেখকই যে জন্মেছেন এই ছোট ডাবলিন শহরে! কেবল জন্মস্থানই তো নয়, হয়তো কোনও বাড়িতে ইয়েট্স্ দু’ বছর ছিলেন, বা সিঙ্ কয়েকদিন মাত্র বাস করেছেন, ব্যস্! অমনি সেই বাড়ির গায়ে একটা স্মারক-প্ল্যাকার্ড মারা হবে, এখানে অমুক মহোদয় অত সাল থেকে অত সাল পর্যন্ত বাস করে গেছেন। সরকারি পয়সায় বাড়ি সারানো হবে। আর আমরা? বিদ্যাসাগর বাদুড়বাগানে যে বাড়িতে থাকতেন তা ভেঙে যাচ্ছে, বঙ্কিমচন্দ্রের বসত্ বাড়ি তো ভেঙে পড়েইছে, রামমোহন তো আরও দূরস্থান, বিবেকানন্দের বাড়িও ভেঙে যাচ্ছে, মাইকেল মধুসূদন কোন্ কোন্ বাড়িতে সপরিবারে থাকতেন কেন জানো? হয়তো রাধারমণ মিত্তির আর রাধাপ্রসাদ গুপ্ত জানেন, আমাদের জানায় ওই উত্তরপাড়া লাইব্রেরি, আর স্পেনসার্স হোটেলটুকুই যা ভরসা।—আমরা আমাদের প্রিয়জনদের নিয়ে ফাঁকা গর্বই করি, তাঁদের জীবন্ত স্মৃতিকে যত্ন করতে জানিনা। নিমতলায় রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিসৌধ কি ঐ রকম হবার কথা? ওতে মন ভরে? বা শরৎচন্দ্রের? মানিক বাঁড়ুজ্যে কোথায় থাকতেন? বিভূতিভূষণের বাড়িও বারাকপুরে ভেঙে পড়ছে নাকি শুনতে পাই। কেউ কি দেখতে যাই তারাশংকর বনফুল বুদ্ধদেব বসুর বাড়ি?

সাহিত্যপিপাসু দর্শনার্থীদের ঘোরার সুবিধের জন্য এরাও অবশ্য কোনও ব্যবস্থা রাখেনি, যত বাস-ভ্রমণ, সবই নিসর্গ, আর প্রাসাদ বিষয়ক। ‘লিটারারি ট্যুর অব ডাবলিন,’ জাতীয় কিছু নেই। আমি নিজেই নানান সোর্স থেকে খুঁজে খুঁজে লেখকদের ঠিকানা বের করলুম। তবে, হ্যাঁ। ‘ফেমাস পিপল ফাইল’ বলে একটা ফাইল আছে ডাবলিন-এর ট্যুরিস্ট ব্যুরোতে। সেটা বসে ঘাঁটা ঘাঁটি করতেই অনেকগুলো ঠিকানা বেরুল। কলকাতা শহরে এরকম কোনও ফাইলই নেই। অন্তত আছে বলে তো জানি না। কেউ যদি দেখতে চায়, দেখবার সুযোগও পাবে না।

সুইফটের জন্মস্থান এবং কর্মস্থানই শুধু নয়, তাঁর এবং তাঁর প্রেমিকা স্টেলার গোরস্থানও দেখলুম। ওই যেখানে তিনি ডিন ছিলেন, সেই সেন্ট প্যাট্রিক্স ক্যাথিড্রালেই। মূল হলঘরের মার্বেল মেঝেয় একসঙ্গে দুজনের কবরফলক। খুব রোম্যান্টিক। স্টেলাকে লেখা চিঠিগুলোর মতন।

সবচেয়ে রোম্যান্টিক, সবচেয়ে মর্মস্পর্শী কবরফলকটা অবশ্য ইয়েটসের। হ্যাঁ, ইয়েটসের জন্মস্থানই শুধু নয়, কবরটাও তো দেখে এলুম—সেই স্লাইগোতে গিয়ে। কোথায় রে-ডাবলিন, দক্ষিণপূর্ব সমুদ্রতীরে, আর কোথায় স্লাইগো, কনেমারা, একেবারে উত্তর-পশ্চিম সৈকতে। হ্যাঁ, সেখানেও ঘুরে এলুম তো, পুরো ইয়েট্স কান্ট্রি ঘুরিয়ে দেখিয়ে দেখিয়ে এনেছে যে আমার নাতি। এক বিপুল অরণ্যের মধ্যে, এক বিশাল স্থির হ্রদের ধার দিয়ে যেতে যেতে একটা ভাঙা কেল্লার পাশে এসে নাতি বললে—”নামো। এইখানে এই ম্যাপটা দ্যাখো।” ম্যাপে দেখি তীর চিহ্ন দেওয়া একটা দ্বীপ। বলো তো?”দ্য লেক আইল অফ ইনিশফ্রী!” এই লেকই তবে লখ্ গিল হ্রদ? কে ভেবেছিল কোনওদিন সত্যি সত্যি চর্মচক্ষে দেখতে পাব লখ্‌ গিল, আইল অফ ইনিশফ্রী? ছোট, সবুজ গাছপালায় ঘেরা দ্বীপ। দেখলুম সেই ন্যাড়ামাথা বেন বুলবেন শৈলমালা—আর গ্লেনকার প্রপাত, আর দেখলুম বেন বুলবেনের সাক্ষাৎ ছায়ায়, ড্রামক্লিফ গ্রামে, ছোট একটা চার্চ অফ আয়ারল্যান্ডের গির্জের আঙিনায়, ছাইরং-চুনাপাথরের একটি নিরাভরণ কবর। তাতে পড়ে আছে কিছু শুকনো বিবর্ণ ঘাসফুলের গুচ্ছ। ঠিক অবিকল যেমন তাজা, টাটকা পাঁচমিশেলি ঘাসফুলের গুচ্ছ ছিল আমার হাতে, ইয়েসের জন্য, ডেইজী- ড্যানডিলায়ন-বাটারকাপ-ভায়োলেট-ব্লুবেল মেশানো। পথের ধারের ঘাসবন থেকে নিজে তোলা যত বুনো ফুল। কবরটিতে কেবল কিছু নুড়ি ছড়ানো। কোনও অলংকরণ নেই। এমনকী ঘাসও নেই। মাথার কাছে লাইমস্টোনেরই ছাইরঙা ফলক। তাতে লেখা W. B. Yeats আর নিজেরই লেখা এপিটাফের সর্বশেষ তিনটি লাইন-

Cast a cold eye
on life, on death,
Horseman, pass by

অবাক হয়ে ভাবলুম মধুসূদন ঠিক এর উল্টো লিখেছিলেন—”দাঁড়াও পথিকবর।” ইয়েসের মৃত্যু আয়ারল্যান্ডে হয়নি। অনেকদিন পরে তাঁর শবদেহ তাঁর প্রিয় ড্রামক্লিফে এনে তাঁরই পরিকল্পিত কবরে স্থাপিত করা হয়েছে। ওঁর শিল্পীভাই জ্যাক ইয়েট্সও পাশের কবরেই সমাধিস্থ। তিনি এ অঞ্চলের প্রচুর ছবি এঁকে গেছেন। বাবলু, আমার নাতি, তো ছুটিই নিয়ে বসল সারা ইয়েট্স্ কান্ট্রি আমাকে ঘুরিয়ে দেখাবার জন্যে। রসকম্-এর অ্যাবে দেখেছি, ড্রামহেয়ার, ড্রামক্লিফ্, বেন বুলবেনপাহাড়, গ্লেনকার ঝর্ণা, আর রসেস্ পয়েন্ট-এর রাস্তা দিয়ে ঘুরেছি, লখ্ গিল হ্রদের কূলেকূলে কত ভাঙা কেল্লা দেখেছি, দেখেছি লেক আইল অব ইনিশফ্রী—ভাবো একবার? কী কাণ্ড।

সেখানে যাবার পথে দেখেছি কী? গোল্ডস্মিথ কান্ট্রি। অলিভার গোল্ডস্মিথ্ এই আয়ারল্যান্ডেরই ছেলে। পলাস শহরে লংফোর্ড কাউন্টিতে তাঁর জন্ম। ডাবলিন ট্রিনিটি কলেজের সামনে একদিকে গোল্ডস্মিথ, অন্য দিকে বার্ক-এর মূর্তি আছে দেখেছি। ট্রিনিটি কলেজের সামনে কী সুন্দর ওই সেন্ট ভেন্স গ্রিন—স্ট্রিভেন হিয়েরো যাকে বলে “মাই গ্রিন, ১৬ই সেখানে জয়েসের মূর্তি উন্মোচন করা হল।

শেষ খবর এবার শোনো বলি, হোর্হে লুইস বোর্হেসের সঙ্গে, এন্টনি বার্জেসের সঙ্গে, আর চিনুয়া আচিবির সঙ্গে সত্যি সত্যিই আমার বেশ ভাব হয়ে গেছে। প্রত্যেকের কাছে লম্বা লম্বা ইন্টারভিউ নিয়েছি। আমার মতন তাঁরাও এখন ডাবলিনে, এবং সবাই এই শেলবোর্ন হোটেলে। আরও কত কবি এসেছেন, জার্মানির এসেন্-বারগার, ইতালির মন্তালবান, স্পেনের ভালভের্দে, ইংলন্ডের উইলিয়াম এম্পসন। সবাই জয়েস-শতবর্ষ উৎসবে আমন্ত্রিত। আর অনিমন্ত্রিত আমিও হঠাৎ এসে জুটে গেছি। সালমান রাদির আসার কথা ছিল, আসেননি। মাঝখান থেকে আমারই হল লাভ। এসেছিলুম অক্সফোর্ডে বক্তৃতা দিতে—ভাবলুম এখন তো ছুটি, কয়েকদিন ডাবলিনে বেড়িয়ে আসা যাক। ঘটে গেল মহৎ যোগাযোগ! এবার আর গল্পগুলো নিশ্চয়ই অবিশ্বাস করছ না? কী? একটু একটু গাজ্বালা? এরপরে আলাদা করে লিখব শতবর্ষে জেম্‌স্‌ জয়েসের জন্মদিনটি কী ভাবে কাটাল ডাবলিনের মানুষ। বোরহেস, বারজেস (দুটো নামই কিন্তু এক—উৎপত্তি একই শব্দ থেকে), আর আচিবি—তিনজনের ইন্টারভিউও আলাদা করে লিখে পাঠাচ্ছি—তখন আর বিশ্বাস না করেই উপায় থাকবে না তোমাদের।

—কী? হিংসে হচ্ছে তো? অন্তত, একটু একটু? তা তো হবেই। এতেও যদি হিংসে না হয়, তবে আমরা লেখকই নই! স্বভাবমোহিত, স্বভাব-প্রেমিক, আর স্বভাব-ঈর্ষক, এই তিন রিপুতে পীড়িত না হলে ভাল লেখক হওয়াই যায় না! স্বাতী, পুলু সমেত ভালবাসা নিও।

ইতি।—নবনীতা
২০ জুন, ১৯৮২, ডাবলিন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *